রবীন্দ্রনাথের দেশমর্যাদাবোধ
রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এই বিষয়টি শোনা। এতে তাঁর দেশাত্মবোধ আর আত্ম-মর্যাদাজ্ঞানের একটু পরিচয় পাওয়া যাবে।
রবীন্দ্রনাথ শেষবার যখন আমেরিকায় (অর্থাৎ আমেরিকার সংযুক্ত-রাষ্ট্রে) যান, তখন তিনি সোজা কানাডা হয়ে গিয়েছিলেন। কানাডা থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি সোজা ভারতবর্ষ থেকে কানাডায় যান, তারপরে কিছুদিন কানাডায় ঘুরে সংযুক্ত-রাষ্ট্রের পশ্চিম খন্ডে, দুটি দেশের সীমান্ত পার হয়ে, তাঁর ট্রেন কানাডা থেকে সংযুক্ত-রাষ্ট্রের একটি ছোটো সীমান্ত নগরে এসে পৌঁছোল। এক দেশ থেকে আর এক দেশে ট্রেনে করে যাত্রীরা আসছে; যথারীতি পাসপোর্ট দেখার, আর বেআইনিভাবে জিনিসপত্র এক রাষ্ট্র থেকে আর এক রাষ্ট্রে যাত্রীরা কেউ নিয়ে যাচ্ছে কিনা তার পরীক্ষা করার পালা এল। এই ব্যাপারটা বরাবরই বিরক্তিকর। আবার যে দেশে প্রবেশ করা যাচ্ছে, সেই দেশের রাজকর্মচারীরা ইচ্ছে করলে এটাকে আরও বিরক্তিকর এমনকী কষ্টদায়ক করে তুলতে পারে। মালপত্র পরীক্ষার অজুহাতে, গাড়ি থেকে বাক্স-সুটকেস-ব্যাগ প্রভৃতি কুলি দিয়ে আর কুলি না পাওয়া গেলে নিজেদের ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে গিয়ে স্টেশনের মধ্যে একটা ঘরে জমা করায়, আর তারপরে সেখানে সব খুলে ঘাঁটাঘাটি করে অস্থির করে তোলে। যে জাতের লোকেদের উপরে রাগ, সে জাতের যাত্রী পেলে এই যন্ত্রণাটুকু এরা একটু বেশি করে দিয়ে থাকে। এখন, আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলে ‘হিন্দু’ অর্থাৎ ভারতীয়দের ওপরে স্থানীয় লোকেরা একটা বিজাতীয় ক্রোধ আর ঘৃণার ভাব পোষণ করে, কারণ ও অঞ্চলে বহু শিখ গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করে, আর চাষবাস করে শাকসবজি বিক্রির ব্যবসাটা, কাঠ চেরার কাজ প্রভৃতি কতকগুলি ব্যবসা আর কাজ প্রায় একচেটে করে নেয়। এইজন্য স্থানীয় শ্বেতকায় আমেরিকানরা আর অন্য নবাগত শ্বেতকায় উপনিবেশিকেরা ভারতবাসী শিখ বা ‘হিন্দু’-দের প্রতি ঈর্ষ্যান্বিত হয়ে তাদের তাড়াতে চায়, নানারকম দুর্ব্যবহার করে তাদের অতিষ্ঠ করে তুলতে আরম্ভ করে, আর শেষে আইন করে তাদের দেশছাড়া হতে বাধ্য করে। যখন রবীন্দ্রনাথের পাসপোর্ট দেখে তাঁকে ‘হিন্দু’ অর্থাৎ ভারতবাসী বলে জানতে পারে, তখন তাঁর মালপত্র সব নামিয়ে আনবার কথা পাসপোর্ট পরীক্ষক বললে, ওঁর প্রতি কোনোরকম ভদ্রতার ব্যবহার করলে না। কিন্তু তার উপরিওয়ালা একজন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ এই নামটা শুনে একটু ভদ্রতা-জ্ঞানের পরিচয় দিলে,—অত বড়ো বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তির প্রতি সাধারণ যাত্রীদের, বিশেষ করে সাধারণ ভারতীয় যাত্রীদের মতন ব্যবহার করাটা ঠিক হবে না, এ জ্ঞানটুকু তার ঘটে এল। সে তখন এসে বললে—‘দেখুন, যদিও আমরা ‘হিন্দু’ যাত্রীদের একটু কড়া নজরে দেখে থাকি, আপনার বেলায় কিন্তু আমরা তা করবো না। আপনি ‘হিন্দু’ হলেও একজন নামী লোক, তাই এই বিষয়ে খাতিরটুকু আমরা আপনার সম্বন্ধে করছি—আপনার মালপত্র নামাতে হবে না।’ এই কথা শুনে রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ক্রোধে আর ক্ষোভে যেন জ্বলে ওঠে। তিনি তাদের বললেন:
না না, আমি নিজের ব্যক্তিগত পরিচয়ে তোমাদের কাছ থেকে কোনো বিশেষ খাতির বা ভদ্রতা চাই না; তোমরা আমার দেশবাসী জনসাধারণের সঙ্গে যে ব্যবহার করে থাকো, ঠিক সেই ব্যবহারই আমার সঙ্গেও করো—তোমাদের বিশেষ অনুগ্রহের প্রার্থী আমি নই।
তাঁর এই কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে এরা চলে গেল, আর তাঁর কামরার দিকে এল না।
এই ব্যাপারে আমেরিকার সংযুক্ত-রাষ্ট্রে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। তারপর তিনি পশ্চিম আমেরিকার কালিফরনিয়ার কোন একটা শহরে এলেন, বোধহয় সানফ্রান্সিস্কোতে, কিংবা লস-আঞ্জেলিস-এ। সেখানে তিনি আমেরিকার বহু প্রতিষ্ঠান থেকে নিমন্ত্রণ পেলেন, তাদের মধ্যে গিয়ে তিনি বক্তৃতা দেবেন। তিনি প্রথমটায় স্থির করেছিলেন যে, এইসব নিমন্ত্রণের কতকগুলি অন্ততঃ গ্রহণ করবেন। এইভাবে তিনি আমেরিকার সংযুক্ত-রাষ্ট্রে আর একবার ঘুরে যাবেন। তাঁর কার্যক্রম তদনুসারে তৈরি হবার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে স্থানীয় শিখ আর ভারতবাসীরা এল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তারা তাঁকে জানালে—কীভাবে তারা ছোটোখাটো জমি নিয়ে ঘরবাড়ি থেকে শাকসবজির চাষ করে আর অন্য ব্যবসায় করে চালাচ্ছিল, কিন্তু কেমন করে শ্বেতকায় লোকেরা তাদের উপর চড়াও হয়, তাদের ব্যবসায় নষ্ট করে সব অধিকার কেড়ে নেয়, নানারকম আইন করে; তার ফলে অনেকে বেশ সংগতিসম্পন্ন অবস্থা থেকে একেবারে পথের ভিখিরি হয়ে পড়ে। তাদের আর উপায় নেই;—অনেকদিন ধরে অনেক পরিশ্রম করে যা তারা গড়ে তুলেছিল, তা নতুন এক আইন, যার দ্বারা এশিয়ার লোকদের ওদের জমির মালিক হয়ে চাষবাস করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, সেই আইন করে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এসব শুনে অত্যন্ত মর্মাহত হন, আর এই অবিচার অত্যাচারের জন্য খুব ক্রোধও হয় তাঁর মনে। যারা তাঁর দেশবাসীর প্রতি এরূপ নিষ্ঠুর অপমান অত্যাচার করে, তাদের দেশে আর থাকতে তাঁর মন বসে না। হলিউড থেকে তাঁর খাস নিমন্ত্রণ এসেছিল, কতকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও এসেছিল। সব নিমন্ত্রণ আর সমস্ত প্রোগ্রাম নাকচ করে দিয়ে তিনি দেশে ফিরে যেতে চাইলেন। যে কয়দিন না থাকলে নয় সে কয়দিন মাত্র তিনি রইলেন এবং যাতে তাঁর সাথীরা তাঁর এই সংকল্প অনুসারে সব ব্যবস্থা করে উঠতে না পারেন, সেজন্য তিনি নিজে জাপানী জাহাজ কোম্পানির আপিসে গিয়ে প্রথম যে জাহাজ আমেরিকা থেকে জাপানে যাবে তাতে করে দেশের দিকে যাত্রার জন্য সেই জাহাজটির টিকিট করে এলেন।
এই ঘটনা দুটিতে তাঁর স্বদেশের জনগণের প্রতি দরদ কতখানি ছিল, কতটা তিনি স্বদেশের মর্যাদার কথা ভাবতেন, তার একটু দিগদর্শন পাওয়া যাবে।
পূর্ণিমা, শারদীয় সংকলন, ১৩৫৩ এবং পরে কালি ও কলম,
১৩৭৮ আশ্বিন সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত