বাংলা প্রবন্ধ
Essays in English
পরিশিষ্ট

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বীপময় ভারতে

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বীপময় ভারতে [ ১৯২৭ ]

কবির সঙ্গে আমরা ছিলুম তিনজন। ত্রিপুরার শ্রীধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মা, শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রাক্তন ছাত্র এবং অধুনা বিশ্বভারতী কলাভবনের অধ্যক্ষ; শ্রীসুরেন্দ্রনাথ কর, তখনকার বিশ্বভারতীর কলাভবনের অধ্যাপক; আর আমি। কলকাতা থেকে মঙ্গলবার ১২ জুলাই, ১৯২৭ আমরা যাত্রা করি। আর জাহাজে চাপলুম বৃহস্পতিবার, ১৪ তারিখে। এই মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি—তিনদিন ধরে একটানা রেলযাত্রা করে আর মাদ্রাজে ঘোরাঘুরি করে, জাহাজে যখন চড়লুম তখন শরীর ও মন দুইই অবসন্ন। জাহাজ ছাড়তে সকলেই একটু আরামের নি:শ্বাস ফেললুম—অন্ততঃ চার-পাঁচদিন শুয়ে-বসে হাত-পা ছড়িয়ে যেতে পারা যাবে এই মনে করে।

আমাদের জাহাজটি ছিল ফরাসী কোম্পানীর। নাম আঁবোআজ (Ambois)। ফরাসী কোম্পানীর নাম মেসাঝেরি মারিতীম (Messageries Maritimes)। কোম্পানীর বড়ো কর্তা মসিও কেদিয়ার (M. Caudiere) স্বয়ং এসেছিলেন কলম্বোর হেড অফিস থেকে কবির সংবর্ধনা করতে। তিনি, মাদ্রাজ অফিসের কর্তা মসিও ঝোবার (M. Jobard), আর জাহাজের কঁমাঁদা বা কাপ্তেন নসিও গাব্রিয়ার্গ (M. Gabrillargues) কবির সংবর্ধনা করে জাহাজে স্বাগতঃ করলেন। আমাদের ছিল প্রথম শ্রেণির টিকিট, কিন্তু জাহাজ-কোম্পানী বিশেষ করে প্রথম শ্রেণীর উপর যে ‘কাবীন-দ্য-ল্যুকস’ আছে তাতে কবির থাকবার ব্যবস্থা করেছিল। জাহাজে উঠে, প্রথম শ্রেণীর পাঠাগারে কবি যাতে বসে আলাপ করতে পারেন, তার ব্যবস্থাও করা ছিল।

কবিকে মোটরে করে নিয়ে শ্রীযুক্ত রামস্বামী এলেন জাহাজঘাটায়। মাদ্রাজে এলেই কবি শ্রীযুক্ত রামস্বামীর আতিথ্য স্বীকার করতেন। শ্রীরামস্বামী ছিলেন মাদ্রাজ হাইকোর্টের একজন প্রথিতনামা উকিল। এবারেও আমরা তাঁর মৈলাপুরের বাড়ীতে উঠেছিলুম। ভদ্রলোকের স্বল্প পরিচয় থেকেও বড়ো প্রীত হয়েছিলুম আমরা। অতি মৃদুভাষী লোক, মোটেই নিজেকে কবির সামনে জাহির করতে চান না, অথচ সর্বদাই তাঁর অতিথিদের সেবার জন্য হাজির। কবির সঙ্গে নানান রকমের লোক সদাসর্বদা দেখা করতে আসছে—ইনি বিশেষ সঙ্কুচিত—এদিকে যাতে কবিকে বিরক্ত না করা হয়, আবার ওদিকে দর্শনার্থী লোকেরা যাতে মনে না করে যে কবি তাঁর অতিথি বলে তিনি কবির সঙ্গে একত্র অবস্থিতির সুযোগ পেয়ে তাঁকে একান্ত অধিকার করে আছেন। আমরা ভালো দিনেই শ্রীযুক্ত রামস্বামীর গৃহে অতিথি হয়েছিলুম। তাঁর বাড়ীতে এক বিবাহ উৎসব ছিল, তাঁর এক পিসতুতো ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে। বিয়ে হয়ে গিয়েছে তিনদিন পূর্বে; বৃহস্পতিবার যেদিন সকালে আমরা পৌঁছলুম সেটি ছিল বিবাহ উৎসবের চতুর্থ এবং শেষদিন;—চারদিন ধরে আমোদ-অনুষ্ঠান, কুটুম্বভোজন ইত্যাদি চলে। গৃহস্বামী নিজে নিষ্ঠাবান তামিল ব্রাহ্মণ-ঘরের কর্তা হয়েও আমাদের আহারপর্বের জন্যে দু-তিনটে মাছ-মাংসের ভোজ্যসামগ্রীর ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজে সেগুলি স্পর্শ করেননি। কবির শরীর অসুস্থ ছিল। তিনি খালি একটু দই দিয়ে দুটি ভাত খেলেন।

বিকালে শ্রীরামস্বামীই জাহাজে তুলে দিতে এসেছিলেন। কবির অনুগত ভৃত্য বনমালী কবির সঙ্গে মাদ্রাজ পর্যন্ত এসেছিল। কবির জন্যে নির্দিষ্ট কেবিনে গিয়ে দেখলুম তাঁর বসবার ঘরে একরাশ পদ্মফুল দেওয়া হয়েছে। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের এই সুন্দর উপায়টি দেখে আমরা সকলেই খুবই খুশী হয়েছিলুম।

বেশ মনে আছে, আমাদের জাহাজখানা ছিল বেশ বড়োসড়ো। পনেরো হাজার টনের জাহাজ। এতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণীর সব মিলে প্রায় পাঁচশো যাত্রী যাবার ব্যবস্থা ছিল। এ ছাড়াও খোলা ডেক আছে দুটি। তাতেও যাত্রী ছিল ভরতি। হরেক রকম জাতের হরেক রকম মানুষের সমাবেশ। ফরাসী ত আছেই; তা ছাড়া ভারতবাসী, অনামী, আরব কেউ আলজ্জাইর বা আলজিরিয়ার লোক, জনাকয়েক কাফরী আর দু-পাঁচজন চীনা।

মার্সেয়ি (Marseilles) থেকে জাহাজটা আসছিল, যাবে তোঙকিঙের হাইফঙ বন্দর—মস্ত লম্বা পাড়ি। পথে তার প্রথম থামা সিঙ্গাপুর—সেখানে আমাদের নামিয়ে দেবে। জাহাজে বোধকরি আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল একটি রঙ-ফরসা ফরাসী ফিরিঙ্গি Creole ‘ক্রেওল’ জাতীয় ছেলের সঙ্গে। সত্যি বলতে কি, সেই আমাদের সঙ্গে পরিচয় করলে। আমরা কেবিনে জিনিসপত্র বাক্সটাক্স নাড়ানাড়ি করছি, এমন সময় সেই কেবিনে ঢুকে সেলাম ঠুকে একগাল হেসে স্বাগত করে ফরাসীতে বললে—‘নমস্কার। আপনারা তো তিনজন এই দুই কেবিনে থাকবেন? আমি হচ্ছি আপনাদের কেবিনের চাকর আর খানসামা। যখনি কিছু দরকার হবে, কেবিনঘরের কোণের বিজলী-ঘণ্টার বোতাম টিপবেন, আওয়াজ পেলেই হাজির হবো।’ ছেলেটির নাম মার্সেল (Marcel) বাড়ী মাদাগাস্কারে। ঘণ্টা টিপলেই আসত বলে কবি এর একটি নাম দিয়েছিলেন। তিনি তাকে বলতেন ‘ঘণ্টাকর্ণ’—যে ঘণ্টাকে আকর্ণ করে বা শোনে। মার্সেলের বদলে মাঝে মাঝে একটি আহ্লাদী পুতুলের মতো মুখ আমাদের কাছে দেখা দিত। তার কথা আমার বেশ মনে আছে। তার নাম ছিল লুইজ (Louise)। একটি প্রৌঢ়, খুব মোটাসোটা ঠানদিদি-গোছের স্ত্রীলোক। চোখে উজ্জ্বল স্নেহমাখা দৃষ্টি। খাঁটি ফরাসী মানুষ। কবিকে দেখে তার ভারি ভক্তি হয়েছিল। প্রায়ই বলত—‘কি চমৎকার চেহারা! ঠিক যেন হিব্রু ঋষি মোশেহ! কি মহদভাব-ব্যঞ্জক কপাল, চোখ, মুখ!’

জাহাজ ছেড়ে যাবার আগের দিন দুপুরবেলা খাবার টেবিলে বসেছি। অন্যদিনের মতই হাস্যালাপ করতে করতে মধ্যাহ্নভোজন চলছে। খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্রধান খানসামাটি ফরাসী, রোজ খাবার সময় একবার করে ঘুরে যায়, আর বিশেষ করে বহুবার আমাদের টেবিলে আসে; সে এসে কবিকে সেলাম করে একখানা বেতার টেলিগ্রাম কবির হাতে দিল। কবি খুলে দেখে বললেন যে, সেটি একটি নিমন্ত্রণপত্র। ব্রিটিশ মালয়ের গভর্নর তাঁর বাড়ীতে আতিথ্য স্বীকার করতে অনুরোধ করেছেন।

আগে ঠিক ছিল আমরা সবাই শ্রীযুক্ত মোহম্মদ আলী নামাজীর (Namazi) বাড়ী গিয়ে উঠবো। এখন ঠিক হল, কবি যাবেন লাটের আতিথ্য স্বীকার করতে—আমরা নামাজীর বাড়ীতে গিয়ে উঠবো।

সিঙ্গাপুরে এসে জাহাজ পৌঁছুলো সকাল আটটার দিকে। সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়া হল জাহাজের। বন্ধুবর আরিয়ম এসে জানালেন যে, ব্রিটিশ-মালয়ের গভর্নর স্যর হিউ ক্লিফোর্ড (Sir Hugh Clifford) লাটবাড়ীর গাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছেন কবিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। সেখানে তিনদিন থাকতে হবে। কবি কিন্তু এই সংবাদে খুশী হলেন বলে মনে হয়নি। কবিকে সংবর্ধনা জানাতে জাহাজঘাটায় এসেছিলেন সিঙ্গাপুর মিউনিসিপ্যালিটির সভাপতি, শ্রীযুক্ত ফারার (Mr. Farrar) এবং লাট তরফের শ্রীযুক্ত ক্যামুবেল (Camplell) আন্তর্জাতিক কবিসংবর্ধনামন্ডলীর দ্বারা এখানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ভারতীয় ছিল, চীনা ছিল, ইউরোপীয় ছিল, মালাইও ছিল। নীচে একটা খোলা জায়গায় কবিকে একটি চেয়ারে বসিয়ে একটি তামিল ভদ্রলোক ইংরিজিতে তাঁকে স্বাগত জানালেন। মালা দেওয়া, উপস্থিত ভদ্রলোকদের বটনহোলে ফুল দেওয়া, গোলাপজল ছিটানো, গোলা চন্দন দেওয়া—কিছুই বাদ গেল না। এমনকি জেটীর সেই গোলমালের মধ্যেই এক তামিল ভদ্রমহিলা তাঁর দক্ষিণী বীণায় সুর তুলেছিলেন—বুঝি বা গানও ধরেছিলেন। কিন্তু কিছুই বোধ করি শোনা গেল না। কবি লাটভবনের গাড়ীতে গিয়ে উঠলেন। আমরা চললুম শ্রীযুক্ত নামাজীর বাড়ী।

সিঙ্গাপুর শহর থেকে পূবে আট মাইল গেলে Siglap (সিগল্যাপ) বলে একটা চমৎকার জায়গা আছে। সমুদ্রের ধারে নানা রকম বনের ছায়ায়, সাদা বালির উপর তৈরী কতকগুলি বাগান বাড়ীর সারি। এরই একটি নামাজীর। সেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। নামাজী মহাশয়েরা জাতিতে ইরানী, পারস্যদেশে এঁদের আদি বাড়ী। ঘরে এঁরা ফরাসী বলেন, ধর্মে শিয়া-মুসলমান। বাল্যে নামাজী মহাশয় দেশ ছেড়ে ভারতে আসেন। মাদ্রাজে এঁর কারবার ছিল। সেখান থেকে সিঙ্গাপুরে এসে ব্যবসা ফলাও করে জমিজিরেত, বিষয়সম্পত্তি, রবার এস্টেট করে, স্থায়ী বসবাস করছিলেন।

সিঙ্গাপুরে দ্বিতীয় দিনে বিকেলবেলা সেখানকার চীনা শিক্ষিত লোকেরা আর ধনী ব্যবসায়ীরা, Singapore Garden Club নামে তাঁদের বড়ো সংস্থার তরফ থেকে কবির জন্যে একটি চা-পানের মজলিশ আহ্বান করেন। এই মজলিশে চীনা ছাড়াও বহু বিশিষ্ট ভারতবাসীও নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এই সভায় কবি চীনের সঙ্গে ভারতের যোগ আর বিশ্বভারতীর সম্বন্ধে কিছু বলেন। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস আলোচনায় চীনাভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় আবশ্যকতার কথাও তিনি এই প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। এই সভায় সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত ব্যারিস্টার Song Ong-Siang (সোঙ-ওঙ-সিয়াঙ)-এর সঙ্গে কবির আলাপ হয়। ইনি মালাই দেশের, বিশেষ করে সিঙ্গাপুরের চীনাদের পূর্বকথা নিয়ে আলোচনা পুস্তক One Hundred Years History of the Chinese in Singapore গ্রন্থটির রচয়িতা। কবির পূর্ব-পরিচিত চীনের বিখ্যাত শিক্ষাব্রতী শ্রীযুক্ত Dr. Lim Boon Keng (লিম-বুন-কেঙ)-এর সঙ্গেও এই সভায় কবির সাক্ষাৎ ঘটে। ডাক্তার কেঙ-এর সঙ্গে কবির প্রথম পরিচয় হয় গতবার চীন-ভ্রমণের সময়। এতদিন পর আবার সাক্ষাৎ হওয়ায় উভয়েই বিশেষ আনন্দিত হলেন।

পরের দিন শুক্রবার সিঙ্গাপুর শহরের টাউন হলে, ভিক্টোরিয়া থিয়েটারে, একটি সভায় কবিকে নিয়ে এলেন স্যর হিউ ক্লিফোর্ড সাহেব। সমস্ত সিঙ্গাপুর শহর যেন ভেঙে পড়েছিল কবির বক্তৃতা শোনবার জন্যে। সেদিনের সভায় ইউরোপীয় এসেছিল প্রচুর। ভারতবাসী আর চীনার সংখ্যাও ছিল বহু। ক্লিফোর্ড সাহেবের স্বাগত-ভাষণের উত্তরে কবি বিশ্বভারতীর সহানুভূতিপূর্ণ জ্ঞানের আদর্শ, আর স্বার্থের সংঘাতে ক্লিষ্ট পরস্পরবিরোধী জাতির জীবনে শান্তি আনবার জন্যে সেই আদর্শের উপযোগিতার সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন।

সিঙ্গাপুরের ভারতীয়েরা কবিকে সিগলাপে শ্রীযুক্ত নামাজীর বাড়ীতে সংবর্ধনা জানাতে এলেন তার পরদিন বৈকালে।

পরদিন রবিবার। এদিনে ছিল তিনটি অনুষ্ঠান। বেলা দুটোর সময়ে Palace Gay Theatre-এ চীনা শিক্ষক আর ছাত্রদের কাছে কবির বক্তৃতা। চারটেয় সিঙ্গাপুরের সব জাতের লোক মিলিয়ে যে International Fellowship বা আন্তর্জাতিক সম্মেলন গড়ে তোলা হয়েছিল, তার-ই এক সভায় কবির সংবর্ধনা; আর তৃতীয় হচ্ছে সিঙ্গাপুরে ভারতীয়দের এক সভায় কবির উপস্থিতি।

প্রথমটিকে স্থানীয় শিক্ষিত ভদ্র চীনাদের মেলা বলতেই হয়। কবির সঙ্গে আমাদেরও মঞ্চে বসিয়ে দেওয়া হল। চীনদেশের কনসাল ছিলেন সভাপতি। তিনি চীনাভাষায় কবিকে স্বাগত করলেন। তাঁর খাস-মুনশী তারপরে উঠে তাঁর বক্তৃতা ইংরিজিতে তর্জমা করে দিলেন। কবি তাঁর বক্তৃতায় বললেন যে, মানুষ যে দেশে বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জন্মায় সে তার জন্মসূত্রেই সেই ক্ষেত্রের সমস্ত অতীতের, সমস্ত ইতিহাসের, সহজ অধিকারী হয়ে থাকে। কলকাতার একটি কোণে জন্ম নিয়ে কবি তেমনি ভারতের সমস্ত কৃতিত্বের উত্তরাধিকারী হয়েছেন। তেমনি তাঁর চীনা বন্ধুগণও চীনা সভ্যতার জগতের শ্রেষ্ঠ অধিকার পেয়েছেন। ভারতের এই যে প্রাচীন ইতিহাস আর সংস্কৃতি তার সঙ্গে চীনের বেশ একটু যোগ আছে। কবির ভারতীয় পূর্বজগণ চীনে যে আধ্যাত্মিক অভিযান করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন। এশিয়া-খন্ডের এই দুই বিশাল জাতির মধ্যে যাতে পুনরায় ভাবের আদান-প্রদান আরম্ভ হয়, সে-বিষয়ে আন্তরিক কামনা জানিয়ে কবি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। বিকালে আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র-সংবর্ধনা সমিতির যে সভ্যেরা কবির সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তাঁদের মধ্যে ভারতী, চীনা, ইউরোপীয়, মালাই জাতেরই লোক ছিল। সন্ধ্যায় ভারতীয়দের জনসভায় কবির ভাষণটির হিন্দী অনুবাদ আমাকেই পড়তে হয়েছিল। শ্রীযুক্ত কুপ্পুস্বামী অয়্যর বলে এক তামিল ভদ্রলোক সেটিকে তামিলে অনুবাদ করে শোনান। সেদিনের ভারতীয় জনসভায় যারা ছিল তারা অত্যন্ত সাধারণ লোক—ছোটোখাটো দোকানদার, ব্যবসায়ী, মোটর গাড়ীর শোফার, দরওয়ান প্রভৃতি—শিখ, পাঠান, পাঞ্জাবী, মুসলমান, তামিল হিন্দু কুলি, ভোজপুরে, তেলুগু ইত্যাদি। দেশ ছেড়ে অনেক দূরে স্বদেশের এক মহাপুরুষকে দেখবার, বুঝুক না বুঝুক তাঁর মুখের দুটো কথা শোনবার যে গভীর আগ্রহ ও আকুলতা তাদের চোখে-মুখে সেদিন আমি দেখেছিলুম, সে কথা আজও আমার মনে আছে।

পরদিন অর্থাৎ সোমবার বিকেলে সিঙ্গাপুরে সব জাতের ছাত্র আর শিক্ষকদের কাছে কবির বক্তৃতার কথা ছিল। এর ব্যবস্থা হয়েছিল সেই ভিক্টোরিয়া থিয়েটারে। এই সভায় সভাপতি ছিলেন কলোনিয়েল সেক্রেটারী শ্রীযুক্ত ই-সি-এম উলফ (Wolf)। এই বক্তৃতায়ও খুব ভীড় হয়েছিল। আর কবি বলেছিলেনও ভারি সুন্দর। শান্তিনিকেতনের শিক্ষা আর তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর বক্তব্য-বিষয়। কবির বক্তৃতাটির পুরো রিপোর্ট নেওয়া হয়েছিল এবং মালয়ের কতগুলি পত্রিকাতে বক্তৃতাটি প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানি।

সেদিন ডিনারের নিমন্ত্রণ ছিল শ্রীযুক্ত ক্যাশিন (Cashin) বলে স্থানীয় এক ইউরেশীয় ধনী ব্যক্তির বাড়ীতে। গৃহস্বামিনী খুব সুন্দরী মহিলা, উচ্চশিক্ষিতা, এবং সবচেয়ে বড়ো কথা কবির একজন ভক্ত পাঠিকা। সে-রাত্রির অন্যান্য অভ্যাগতদের মধ্যে ছিলেন ফরাসী ও ইতালীয় কনসাল। ফরাসী কনসালের স্ত্রী রুশজাতীয়া। তিনি রুশ ও ফরাসী তর্জমায় কবির লেখা কিছু কিছু পড়েছেন বললেন। সেদিন মিস্টার ক্যাশিন কবিকে বিশ্বভারতীর জন্যে এক হাজার ডলারের একটি চেক নমস্কারী দিয়েছিলেন।

সিঙ্গাপুর-প্রবাসের শেষদিন মালয়া ট্রিবিউন বলে এক ইংরিজি খবরের কাগজের সম্পাদক শ্রীযুক্ত গ্রানভিল রবার্টস বলে এক ইংরেজ, সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক সম্মিলনীর তরফ থেকে তার বাসায় আমাদের লাঞ্চ অর্থাৎ দুপুরের খাওয়া খাওয়ায়। লাঞ্চে সস্ত্রীক জার্মান কনসাল ও ফরাসী কনসাল এবং দু-একজন ইউরোপীয়, চীনা আর মাদ্রাজী ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। জার্মানী-ভ্রমণের সময়ে কবির সঙ্গে জার্মান কনসাল মহাশয়ের পরিচয় হয়েছিল। এবারে পুনরায় সাক্ষাতে আলাপটা আরও গাঢ় হল। রবার্টস লোকটির সঙ্গে পরিচয় কবির পক্ষে ভালো হয়নি। কেননা কবি সিঙ্গাপুর ত্যাগ করে যাওয়ার পরেই লোকটি কবির বিরুদ্ধে তার কাগজে প্রচন্ড আক্রমণ শুরু করে। পরে অবশ্য কারও সমর্থন না পেয়ে এই আক্রমণ আপনিই থেমে যায়।

বিকেলে আমরা ‘লারুৎ’ (Larut) জাহাজে চেপে চললুম মালাক্কার পথে। এটা প্রায় বারো ঘণ্টার উপর পথ। জাহাজঘাটায় বিদায় দিতে এসেছিলেন শ্রীযুক্ত নামাজী, চীনের কনসাল ও আরও অনেক গণমান্য ব্যক্তিরা। এবার আমাদের নতুন সঙ্গী হলেন শ্রীযুক্ত ফ্যঙ-চ্যঃ-চেন (Feng-Chih-Chen) নামে এক চীনা যুবক। যুবকটি সিঙ্গাপুরে শিক্ষিত চীনামহলে কবির বিষয়ে আর বিশ্বভারতী সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনায় আমাদের দোভাষীর কাজ করেন। আর তা ছাড়া আমাদের পাণ্ডারাও কাজ করেন। ইনি এক চীনা ইস্কুলে ইংরিজির শিক্ষক ছিলেন।

আমাদের জাহাজে, ‘হজ’ সেরে কতকগুলি ভারতীয় মুসলমান যাত্রী ফিরছিলেন। তাঁদেরই একজন আমাকে জিগ্যেস করেছিলেন—‘সাহব, উও জো পীর-সা আদমী হমারে সাথ ইস জহাজ মৌ চঢ়ে হৈ, রাবীন্দ্রনাথ টেগোর ঊ-হী হৈ, ন? বাহ, ক্যা নুরানী শকল (সায়েব, ওই যে ঋষির মতো মানুষটি আমাদের সঙ্গে এই জাহাজে চড়ে যাচ্ছেন, উনিই কী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? তাই না? আহা, কি জ্যোতির্ময় আকৃতি!)’

পরদিন সকালে জাহাজ এসে পৌঁছুলো মালাক্কা শহরের সামনে। নোঙর ফেলে দিল। আমাদের স্বাগত জানাতে এলেন স্থানীয় ম্যাজিষ্ট্রেট—মিস্টার ডডস (Dodds), আর মালাক্কার অধিবাসীদের তরফ থেকে সেখানকার একজন প্রখ্যাত ব্যারিস্টার শ্রীযুক্ত শ্রীশচন্দ্র গুহ। সরকারী লঞ্চ শহরের একটি ঘাটে আমাদের হাজির করলে। সেখানে বহু গণমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। মালাক্কায় আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল তাঞ্জঙ-ক্লিঙ-এ (Tanjong Kling) অবস্থিত শ্রীযুক্ত চান-কাঙ-সুই-এর (Chan-Kang-Swee) একটি মনোরম সুন্দর বাঙলা বাড়ীতে। শ্রীশবাবু কলকাতার কম্বুলেটোলার বিখ্যাত গুহ পরিবারের বংশধর। আরও যে কয়েকজন সদালাপী বাঙালির সঙ্গে আমাদের সেখানে পরিচয় হয়েছিল তাঁরা হচ্ছেন—শ্রীযুক্ত বরেন্দ্র বসু শ্রীযুক্ত শচীন্দ্রনাথ দত্ত আর শ্রীযুক্ত সুধীর দাস।

এখানে প্রথম দিন দুপুরে মালাক্কা বিভাগের কমিশনার শ্রীযুক্ত ক্রাইটন (Crighton) সাহেবের সঙ্গে লাঞ্চ ছিল। এই আহারের আমন্ত্রণে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সঙ্গে মালয়ের একজন রাজাও ছিলেন। বিকালে গভর্নমেন্ট হাউসের বাগানে সান্ধ্য চা-পান সভায় শহরের বিস্তর প্রধান ব্যক্তি এসেছিলেন। রাত্রে ডিনারের আয়োজন হয়েছিল রবীন্দ্র-সংবর্ধনা সভার তরফ থেকে। ডিনারে সভাপতি ছিলেন মালাক্কার ম্যাজিষ্ট্রেট মিস্টার ডডস। ভোজনের পর বক্তৃতার পালা। কবির ‘স্বাস্থ্যপান’ করতে উঠে ডডস সাহেব বললেন যে, মালাক্কাতে বিশ্ববিখ্যাত অনেকগুলি নামী ব্যক্তির পদার্পণ ঘটেছে। কিন্তু বিশ্বমৈত্রীয় বার্তাবাহী এমন কোনো ভাবুক, কবি আর শিল্পী এদেশে কখনও আসেনি। বিশেষ করে মালাক্কার মতন দেশে যে বহু জাত মিলে একটা নতুন রাজ্য গড়ে তুলেছে সেখানে আন্তর্জাতিক চিন্তার বাণীবাহী ব্যক্তির পদার্পণের বিশেষ সার্থকতা আছে। কবি তাঁর হাস্যরসোজ্জ্বল ভাষণে বলেন যে, শাস্ত্রে বলেছেন যে, ‘ভুক্তা রাজবদাচরেৎ’—কিন্তু সে-অনুশাসন তাঁকে ভঙ্গ করতে হয় কিঞ্চিৎ নাচার হয়েই। তারপর তিনি বিশ্বভারতীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছু বলেন।

কবির আগমনে স্থানীয় তামিল চেট্টিদের মধ্যে খুবই উৎসাহ দেখা গিয়েছিল। দলে দলে এঁরা আসতে লাগলেন কবি সন্দর্শনে। সঙ্গে থালায় আর বারকোষে প্রচুর ফল, মিছরি আর এলাচ প্রভৃতি নিয়ে। মালাক্কা ত্যাগ করে যাবার আগের দিন বিকালে চীনাদের মহলে কবির অতিভাষণ ও সন্ধ্যায় স্থানীয় রোমান ক্যাথলিক ইস্কুল St. Francis Institution গৃহে কবির বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয়। সন্ধ্যার সভায় শ্রীক্রাইটন ছিলেন সভাপতি।

পরের দিন অর্থাৎ ৩০ জুলাই বেলা দেড়টায় মোটরে করে যাত্রা করা গেল তামপিন। সেখান থেকে মেন লাইনে ট্রেন ধরে যাওয়া হল কুআলা-লুম্পুর (Kuala Lumpur)। কুআলা-লুম্পুরের পথে নেগরি-সেম্বিলান রাজ্যের রাজধানী সেরেম্বান পড়ে। এখানে আমাদের নামা হল না। স্টেশনে বিস্তর লোকের সমাগম হয়েছিল। স্থানীয় বাঙালি ব্যারিষ্টার শ্রীযুক্ত এন এস নন্দী মহাশয় আমাদের সঙ্গী হলেন। আবার এখানেই কুআলা-লুম্পুর থেকে সেখানকার লোকেদের প্রতিনিধি হয়ে শ্রীযুক্ত মনোজেন্দ্রনাথ মল্লিক ও একজন সিংহলী ভদ্রলোক শ্রীযুক্ত বি তালালা (B. Tallala) এলেন আমাদের অভ্যর্থনা করতে। কলকাতায় মনোজবাবুর পিতার সঙ্গে কবির বিশেষ পরিচয় ছিল, তিনিও আগে থাকতেই কবির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সিংহলী ভদ্রলোক বৌদ্ধ, কুআলা-লুম্পুরের স্থায়ী বাসিন্দা, ভারতবর্ষ মায় শান্তিনিকেতন ঘুরে এসেছেন।

সন্ধ্যার দিকে কুআলা-লুম্পুর পৌঁছোনো গেল। এখানে স্টেশনে ভীড় খুব বেশি। সেই ভীড় ঠেলে এখানের স্বাগতকারিণী সভার সভারা কবিকে স্বাগত করলে। এক মাদ্রাজী তামিল ভদ্রলোক কবিকে মাল্যদান করতেই বিপুল আরাবে তামিল চেট্টি-মন্দিরের রৌশন-চৌকীর বাদ্য বেজে উঠল—শাঁখ, ঝাঁঝর, ঢোলক, মন্দিরা আর শানাই। ওঃ, সে কি কর্ণপটহ-বিদারণকারী শব্দ!

আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল চব্বিশ নম্বর ওয়েল্ড রোডে চ্যান-চুক-কী-লো (Chun-Chook-Kee-Lo) নামে ক্লাবের। স্থানীয় জন আষ্টেক অতিশয় ধনশালী চীনা বণিক আর বিষয়ী লোকেদের এই ক্লাবের স্থানীয় নাম (Millionaires’ Club) বা ‘দশ-লাখিয়া ক্লাব’। এই ক্লাবের বাড়ীটি তার চীনা চাকর-বাকর সমেত আমাদের জন্যে ছেড়ে দেওয়া হল। রবীন্দ্র-সংবর্ধনায় স্থানীয় চীনারাও যে প্রাণ দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন, এই ব্যাপারটা তার একটা বড় প্রমাণ।

পরদিন সকাল থেকেই কবি-দর্শনার্থীর ভীড়। বিকালে কুআলা-লুম্পুর মিউনিসিপালিটির তরফ থেকে কবির অভিনন্দন, স্থানীয় টাউন হলে হল। লোকসমাগম হয়েছিল খুব। এমনকী স্থানাভাবে অনেককে বিরস মনে ফেরৎ যেতে হয়। চীনা আর তামিল লোকই বেশি। কিছু পাঞ্জাবীও ছিল। সেলাঙর-রাজ্যের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট শ্রীযুক্ত জে লরনী (Lornie) সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সভাপতি, আর স্বাগতকারিণী সভার শ্রীযুক্ত লোক চাউথাই (Mr. Loke Chow-Thye) কবির প্রশস্তি করলেন, কবিকে মাল্যদান করলেন এবং রৌপ্যাধারে রক্ষিত মানপত্র উপহার দিলেন। কবি সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য বললেন।

কয়দিন পরেই স্থানীয় ভারতীয় আর চীনারা মিলে এখানে বিশ্বভারতীর টাকা তোলবার জন্যে একটা বিচিত্রানুষ্ঠান Variety Entertainment-এর ব্যবস্থা করেন। অনুষ্ঠানটি হয় ‘ড্রুরি লেন থিয়েটার’ নামীয় চীনা থিয়েটার হলে। কবি স্বয়ং এতে রাত্রে খাওয়ার পর এসে তাঁর ইংরিজি কবিতা গুটিপাঁচেক পাঠ করে যান।

এই সময়ে এক ঘটনা ঘটে। গ্রানভিল রবার্টস (এর কথা উপরে আগেই বলেছি—সিঙ্গাপুর ত্যাগের দিন এই ভদ্রলোক কবিকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন) সম্পাদিত মালায়া ট্রিবিউন কাগজে দোসরা অগস্ট অর্থাৎ আমরা কুআলা-লুম্পুর পৌঁছোনোর একদিন পরেই এক সম্পাদকীয় বেরোল— ‘Dr. Tagore’s Politics’; তাতে অভিযোগ করা হল যে, রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি শাংহাই টাইমস-এ ইংরেজদের চীনে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোকে আর চীনদেশে ইংরেজ জাতের রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের নিন্দা করে এই হুমকিও নাকি দেখিয়েছেন যে, এশিয়ার লোকেরা ইউরোপের এই জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। এমনি অনেক কথা বলে সম্পাদকীয় স্তম্ভে কৈফিয়ৎ চাওয়া হয় যে, তিনি ব্রিটিশশাসিত মালাই দেশে সমাদর পাচ্ছেন, ইংরেজ রাজকর্মচারীর সহযোগিতা ও সহানুভূতি পাচ্ছেন কী করে? ওই দিনের কাগজে শাংহাই টাইমস-এর কাগজের প্রবন্ধ বলে কবির খানিকটা লেখাও তুলে দেওয়া হয়।

এখন আসল ব্যাপারটা হয়েছিল এই। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন চীনদেশে ভ্রমণ করেন, তখন চীনাদের উপরে ইংরেজ নিয়োজিত ভারতীয় শিখ পাহারাওয়ালার অত্যাচার দেখে তিনি বড়োই ক্ষুব্ধ হন। আর এই ঘটনা নিয়ে তিনি ‘শূদ্রধর্ম’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ১৩৩২ সালের অগ্রহায়ণ মাসের প্রবাসী-তে বার হয়। এই প্রবন্ধটিই আবার ইংরিজিতে অনুবাদ করে ১৯২৭ সালে মার্চ সংখ্যা Modern Review-তে ছাপা হয়। এই ইংরিজি প্রবন্ধটি নানা কাগজে ঘুরে শেষে শাংহাই টাইমস কাগজে প্রকাশিত হয়। মালায়া ট্রিবিউন সাংবাদিক সততা ও ন্যায়বুদ্ধির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে, প্রবন্ধটির বিকৃত অংশবিশেষ নিয়ে, কবির বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে শুরু করে।

মালায়া ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় প্রবন্ধের কথা কবির কানে উঠতে, তিনি সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠাবান সংবাদপত্রে কবির প্রবন্ধের বিকৃত অংশের প্রতিবাদ করে একটি তার পাঠিয়ে দিতে বললেন। মালায়া ট্রিবিউন-কে কোনোরূপ পাত্তাই দেওয়া হল না। মালায়া ট্রিবিউন দিনতিনেক ধরে এই নিয়ে অনেক লেখালেখি করে এক সময়ে থামল। দু-একখানা ইংরেজ কাগজও এই ঘোঁটে যোগ দিয়েছিল। এখন মডার্ণ-রিভিউ-এর প্রবন্ধের কথা আমাদের কারো মনে ছিল না। স্থানীয় এক তামিল কর্মচারী প্রবন্ধটি আমাদের গোচরে আনেন! সেটা পড়ে দেখা গেল যে, ‘that’ কে বদলে ‘and’ করে, একটা সেমিকোলন লাগিয়ে, তারা মডার্ণ-রিভিউ-এর প্রবন্ধের কোনো বাক্যের অর্থ উলটে দিয়েছে। কুআলা-লুম্পুরের ভারতীয়দের সংবাদপত্র মালায়ান ডেলি এক্সপ্রেস তাঁদের ৬ আগস্ট তারিখের সংখ্যায় এই কথা খুলে লিখে দিলে। কিন্তু এদিকে কবিও চীনে ভারতীয়দের সৈন্য পাঠানোর বিরুদ্ধে তাঁর মতামত স্পষ্ট করে কাগজে জানিয়ে দিলেন।

সবচেয়ে লক্ষণীয় যে, এইসব লেখালেখি সত্ত্বেও বেসরকারী ইংরেজ আর সরকারী ইংরেজ কর্মচারী কেউই একটুও বিচলিত হননি। স্থানীয় বিশিষ্ট ইংরেজরা, এই ঘৃণ্য কলমবাজীর সঙ্গে ভদ্র ইংরেজের কোনো যোগ নেই, একথা লিখে কবিকে জানিয়ে দিলেন। কিন্তু দেশে অবশ্য এই ব্যাপারটা এত সহজে মেটেনি। দেশীয় কয়েকটি পান্ডা খবরটি এইরূপভাবে পরিবেশন করলেন যে, রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ লাটের আতিথ্যের লোভে তাঁর স্বাধীন মতামত বিসর্জন দিয়েছেন। ব্যাপারটা নিয়ে বাঙলাদেশের দুই-একজন গেঁয়ো মোড়লও মাতব্বরী করতে ছাড়েননি!

যাই হোক, আটদিনের দিন আমরা কুআলা-লুম্পুর ত্যাগ করলাম। মাঝে রবীন্দ্রনাথ সেরেম্বান দেখে এসেছেন। কাজাঙ বলে কুআলা-লুম্পুরের দক্ষিণে একটি ছোটো শহরে একটি বক্তৃতা সেরে এসেছেন। ক্লাঙ বলে একটি ছোটো শহরও দেখে এসেছেন। কুআলা-লুম্পুর থেকে আমরা Ipoh (ইপো:)-তে পৌঁছোলুম। সেখানে Perak (পেরা:) বা পেরাকের রাজার বাড়ীতে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। রাজার তরফ থেকে তাঁর মন্ত্রী রাজ বন্দহারা স্টেশনে এসে কবিকে স্বাগত করলেন।

এখানে কবি মালাই দেশের শিক্ষক-সম্মেলনে বক্তৃতা করলেন। বিকালে টাউন হলে নগরবাসীরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানালে। চীনা, মালাই—আর তামিল, সিংহলী, সিন্ধী, ভাটিয়া, শিখ, পাঞ্জাবী হিন্দু, এমনকী চার-পাঁচজন বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে এই সুযোগে আলাপ হয়েছিল সেখানে। ইপো:-র টাউন হলে কবির বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়েছিল! পেরাক রাজ্যের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট অনিবার্য কারণে সে-সভায় সভাপতিত্ব করতে পারেননি। সেখানকার প্রধান বিচারপতি সভাপতিত্ব করেন। এখান থেকে কবি তেলো: আনসেন বলে একটি শহরে গেলেন, পেরার ‘রাজা-মুদা’ বা যুবরাজের তরফ থেকে একটি নিমন্ত্রণ রক্ষায়। যেখানে কবিকে যথারীতি অভিনন্দন-গ্রহণ আর বক্তৃতা দান করতে হয়। ইপো: থেকে আরও একটি ছোট্ট শহর Tai-ping ‘তাই-পিঙ’-এ যাওয়া হল। সেখানে একদিন থেকে Penang (পেনাঙ)। সর্বত্রই স্থানীয় ব্যক্তিরা কবির দর্শন-লাভের জন্যে ভীড় করে। সভা-সমিতি পূর্ববৎই চলতে থাকে। তবে পেনাঙ ছেড়ে আসবার আগের দিন স্থানীয় এম্পায়ার থিয়েটার হলে কবির যে বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয়, তার কথা বলতে হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পেনাঙের রেসিডেন্ট কাউন্সিলার অনারেবল মিস্টার আর স্কট (Scott)। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘Nationalism’। এ বিষয়ে কবির যে নিজস্ব স্পষ্ট মত আছে, তা স্বভাবতই সকল জাতির পক্ষে মুখরোচক হয়নি। কিন্তু কবি স্পষ্ট ভাষায় সে মতটুকু পুনরাবৃত্তি করতে মোটেই দ্বিধা করলেন না। প্রসঙ্গতঃ জগতের শান্তির জন্য আন্তর্জাতিক মনোভাবের আবশ্যকতা, আর এই কার্যে বিশ্বভারতীয় সহায়তার কথা উল্লেখ করলেন তিনি।

মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট আমরা সুমাত্রাগামী জাহাজে গিয়ে উঠলুম। Blue Funnel Line (ব্লু-ফনেল-লাইন), ইংরেজ কোম্পানী। তাদের জাহাজের নাম Kuala ‘কুআলা’। সারারাত ধরে পাড়ি দিয়ে জাহাজ পরদিন ভোরে পৌঁছোল সুমাত্রা দ্বীপের বন্দর Belawan (বেলাওয়ান)-এ। ঘণ্টা পনেরো-ষোলোর পথ। এদিকে পেনাঙ, ওদিকে বেলাওয়ান। মাঝখানে সুমিত্রা প্রণালী। জাহাজ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভ্রমণের প্রথম পর্ব শেষ হল। যবদ্বীপের পথে মালাই দেশটা ঘোরা হল।

বেলাওয়ানে আমাদের নূতন সঙ্গী হলেন পুরনো বন্ধু শ্রীযুক্ত আ-আ বাকে (Mr A. A. Bake)। শ্রীযুক্ত বাকে হল্যাণ্ডদেশীয়। হল্যাণ্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেখানে সংস্কৃত শিখতে শুরু করেন। সেখান থেকে সস্ত্রীক আসেন শান্তিনিকেতনে। যবদ্বীপ-যাত্রায় কবির সহযাত্রী হবেন এঁরা, এটাই ঠিক ছিল।

বেলাওয়ান আসলে এ অঞ্চলে সুমাত্রার প্রধান নগর বা সরকারী কেন্দ্র মেদান (Medan) বা মেদান-দেলি (Medan-Deli)-র বন্দরমাত্র। মেদানের Hotel Deboer (হোটেল দেবূর)-এ আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল—যদিও থাকবার সময় ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। হোটেল-দেবূর-এর ব্যবস্থা খুবই উঁচুদরের। বেলাওয়ানে কবিকে স্বাগত জানাতে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন, ডচ ভদ্রলোক ও মহিলা জনকতক ছাড়া, স্থানীয় থিওসফিস্টদের প্রতিনিধি, চেট্টিদের প্রতিনিধি, সিন্ধীদের প্রতিনিধি আর ইপো:র বিখ্যাত টিন-খনির সিংহলী মালিক ডাক্তার (Rogers) রজার্স। এ ছাড়া বহু দর্শনপ্রার্থী আমাদের হোটেলে কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেলেন। বিকেল চারটায় আমরা বাতাভিয়াগামী ডচ জাহাজ প্লানসিউস (Plancius) ধরে যাত্রা করলুম। বিদায় দিতে জাহাজঘাটায় বহু লোক এসেছিলেন। কবি এখানে পুরো একদিনও রইলেন না বলে অনেকেই আক্ষেপ করতে লাগলেন।

জাহাজ সিঙ্গাপুরে একদিন থেমে ছিল। কবি Kelly and Walsh কোম্পানীর দোকানে গিয়ে খানকয়েক বই কিনলেন। আমেরিকান এক্সপ্রেস কোম্পানীর অফিসে দরকার ছিল—সেটুকুও সেরে নিলেন। তারপর শ্রীযুক্ত নামাজীর কন্যার কাছে প্রতিশ্রুত তাঁর নিজের একখানি বই তাঁদের অফিসে পৌঁছে দিয়ে, জাহাজে ফিরে এলেন। নামাজীরা কেউ অফিসে ছিলেন না তখন। এঁরা পরে জাহাজ ছাড়বার আগে এসে কবির সঙ্গে দেখা করে যান।

যবদ্বীপের পথে জাহাজে কবির বিখ্যাত কবিতা ‘শ্রীবিজয়লক্ষ্মী’ লেখা হয়। কবিতাটি ১৩৩৪ সালের কার্তিক মাসের প্রবাসী-তে প্রকাশিত হয়। কবিতাটির কিছুটা তুলে দিচ্ছি—

তোমায় আমায় মিল হয়েছে কোন যুগে এইখানে

ভাষায় ভাষায় গাঁঠ পড়েছে, প্রাণের সঙ্গে প্রাণে।

ডাক পাঠালে আকাশপথে, কোন সে পূবেন বায়ে,

দূর সাগরের উপকূলে, নারিকেলের ছায়ে।

গঙ্গাতীরের মন্দিরেতে সেদিন শঙ্খ বাজে,

তোমার বাণী এপার হতে মিলল তারি মাঝে।

বিষ্ণু আমায় কইলে কানে, বললে দশভুজা,

‘অজানা ঐ সিন্ধুতীরে নেবো আমার পূজা।’

মন্দাকিনীর কলধারা সেদিন ছলো-ছলো

পুব-সাগরে হাত বাড়িয়ে বললে, ‘চলো, চলো’।

রামায়ণের কবি আমায় কইলে আকাশ হতে,

‘আমার বাণী পার করে দাও দূর সাগরের স্রোতে।’

তোমার ডাকে উতল হল বেদব্যাসের ভাষা,

বললে, ‘আমি ঐ পারেতে বাঁধবো নোতুন বাসা।’

আমার দেশের হৃদয় সেদিন কইলে আমার কানে,

‘আমায় বয়ে যাওগো লয়ে সুদূর দেশের পানে।’

এই সুন্দর কবিতাটির ইংরিজি তর্জমা কবি নিজেই করেন। ডচ অনুবাদ করেন শ্রী বাকে। ইংরিজি তর্জমাটি পরে বিশ্বভারতী ত্রৈমাসিকে-এ প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটির যবদ্বীপীয় অনুবাদও হয়েছিল, আর যবদ্বীপের একজন শ্রেষ্ঠ কবি তার উত্তরে নিজের ভাষায় একটি সুন্দর কবিতাও লেখেন।

বাতাবিয়ায় আমরা দু-দিন ছিলাম। বাতাবিয়ার বন্দর তানজোঙ-প্রিয়োক-এ আমাদের জাহাজের সিঁড়ি লাগাতেই, কবিকে স্বাগত করবার জন্যে এলেন ডাক্তার Bosch বস, ইনি ডচ সরকারের নিযুক্ত দ্বীপময় ভারতের প্রত্ন-বিভাগের অধ্যক্ষ, আর ডাক্তার হুসেন জয়দিনিঙরাট, ইনি এক যবদ্বীপীয় বিশিষ্ট বিদ্বান। এঁদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের পর সিন্ধীদের দ্বারা মাল্যদান, ফুলের তোড়া উপহার আর কবির পদধূলি গ্রহণের ধূম পড়ে গেল। চীনাদের সংস্থা ‘চোঙ হোআ ক্কে ক্কান’ (Tjong-Hoa Kwe Kawan) থেকে কবিকে পুষ্পচক্র দেওয়া হয়। স্থানীয় ভারতবাসীদের সাজানো মোটরে না উঠে, সাধারণ একটা গাড়ীতে চড়ে আমরা বন্দর থেকে ভেলটেফ্রেডেন (Weltevreden) অঞ্চলে যে হোটেলে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখান এসে উঠলুম। হোটেলটির নাম Hotel des Indes অর্থ ‘ভারতের হোটেল’। হোটেলটির ফটকের দু-পাশে দ্বারীর মতো দু-টি বিশাল ‘ওয়ারিঙিন’ (Waringin) গাছ ছিল—আমাদের বটগাছের মতন। হোটেলে পৌঁছোবার পরেই বাতাবিয়ার ইংরেজ কনসাল মিস্টার ক্রসবি (Mr. Crossby) কবির সঙ্গে দেখা করে গেলেন। ইনি রবীন্দ্রনাথের পরম অনুরাগী।

বাতাভিয়ায় আমাদের প্রথম সম্মেলনের ব্যবস্থা করলেন ‘কুনস্টক্রিঙ’ (Kunstkring)। এটি বাতাভিয়ার শিক্ষিত ডচেদের একটি সাহিত্য আর কলাচর্চার সমিতি। ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত কতকগুলি যবদ্বীপীয় ভদ্রলোকও এতে যোগ দিয়েছে। যবদ্বীপে আসবার জন্যে রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা যাঁরা আমন্ত্রণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই ‘কুনস্টক্রিঙ’ সমিতিটি প্রধান। এই সমিতির আয়োজিত সান্ধ্য সম্মেলনে ডাক্তার বস আর ডাক্তার জয়দিনিঙরাট ছাড়াও ডাক্তার কাটস (Dr. T. Kats) বলে একজন বড়ো প্রত্নতত্ত্ববিৎ আর শ্রীযুক্ত পি এ জে মুন (Moen) নামে এক পন্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। মিস্টার ক্রসবি কবির সঙ্গে ডচ গভর্নর জেনারেলের দেখা করবার ব্যবস্থা করেন। ভারতীয়দের তরফ থেকে অভিনন্দন জানাবারও ব্যবস্থা করা হয়। যেদিন আমরা বাতাভিয়া ছেড়ে এলুম, তার আগের দিন রাত্রে মিস্টার ক্রসবি আমাদের তাঁর বাড়ীতে ভোজ খাওয়ালেন। ভোজের পর সভায় ক্রসবি সাহেব এক আবেগপূর্ণ বক্তৃতায় কবির রচনা কী গভীর আনন্দ দিয়েছে, তা সশ্রদ্ধ হৃদয়ে উল্লেখ করলেন। কবি এই সভায় তাঁর যবদ্বীপের উপর লেখা কবিতার ইংরিজি অনুবাদ—‘The Indian Pilgrim to Java’ পাঠ করে শোনান। যাবার দিন স্থানীয় ভারতীয় বণিকরা কবির সঙ্গে দেখা করতে আসেন। কবি তাঁদের সঙ্গে বিশ্বভারতী আর বিশ্বভারতীর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের কোন বাণী তিনি প্রচার করতে চান, আর বিদেশে এসে প্রবাসী ভারতীয়দের দায়িত্ব কী—সে-সম্বন্ধে আলোচনা করেন। এঁরা সকলেই বিশ্বভারতীকে সাহায্য করতে স্বীকৃত হন।

আমাদের জাহাজটি ছোটো—K.M.P.-র জাহাজ। পথে সেমারাঙ (Semarang) আর সুরাবায়া (Soerabaja বা Surabaya) হয়ে ২৬ আগস্ট, ১৯২৭ শুক্রবার আমরা বুলেলেঙ (Boeleleng) বন্দরে বলিদ্বীপের মাটিতে অবতরণ করলুম। পথে যবদ্বীপের প্রধানতম ব্যবসায়-কেন্দ্র সুরাবায়ায় আমরা নেমেছিলুম। সেখানে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা আবার জাহাজে এসে উঠেছিলুম। আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্যে বিশেষ করে এক ডচ ভদ্রলোক এসেছিলেন; এঁর নাম সামুএল কোপেয়ারবেয়ার্গ (Koperberg)।

ঠিক ছিল, বুলেলেঙ থেকে মোটরে করে আমরা বাঙলি (Bangli) যাবো। সেখানে স্থানীয় রাজার পিতৃব্যের শ্রাদ্ধবাসরে আমরাও হাজির হবো। সেইমতই আমরা Rani Patima ‘রাণী পাতিমা’-র মোটর ভাড়া করে যাত্রা শুরু করলুম। রাণী পাতিমা বুলেলেঙ শহরের একজন প্রধানও বটেন। তিনি স্বয়ং এসে ইউরোপীয় কায়দায় আমাদের সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর সব ঠিক হলে, গাড়ী ছাড়বার সময় আমাদের বার বার ‘সালামৎ জালান’ (Selamat Djalan) বা শুভযাত্রা জানিয়ে বিদায় নিলেন।

বাঙলিতে যে উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলুম, সেটি হচ্ছে বাঙলির রাজা, যাঁর উপাধি হচ্ছে ‘পুঙ্গব’ (Poenggawa), তাঁর এক পিতৃব্যের আদ্র্যশ্রাদ্ধ। বলিদ্বীপের ভাষায় তাকে বলে ‘মেমুকুর’ (Memukur)। বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন—শ্রীযুক্ত লেওনার্ডস যোহানেস যাকোবস কারোন (Mr. Leonardus Johannes Jacobus Caron)। ইনি বলী আর লম্বক দ্বীপের ডচ রেসিডেন্ট বা শাসনকর্তা। কারেঙ-আসেম নামে এক খন্ডরাজ্যের রাজা; আর এক খন্ডরাজ্য Gianjar (গিয়াঞার)-এর জমীদার; উবুদ-এর ‘পুঙ্গব’ শ্রীযুক্ত গড়ে রাকে চকর্দে সুখবতী—এঁরা সকলে বাঙলির পুঙ্গবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথকে শ্রীযুক্ত কারোন খুবই সম্মানের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বসালেন। বলিদ্বীপের হয়ে তাঁকে তিনি স্বাগত জানালেন। রবীন্দ্রনাথ যে প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি দেখতে এসেছেন, তা শুনে তিনি খুব খুশী হলেন। উপরন্তু, তিনি আশা প্রকাশ করলেন যে, তাঁর আগমনে বলিদ্বীপে মনোহর হিন্দু সংস্কৃতি আরও সুদৃঢ় হবে। প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ বললেন যে, আধুনিক ভারতবর্ষ আর বলিদ্বীপ পরস্পর নিজেদের মঙ্গলের জন্যে পরস্পরকে জানুক—তাঁর আসার মুখ্য উদ্দেশ্য তাই।

এইখানে একটি ছোটো ঘটনা ঘটেছিল, সেটা বলা দরকার। রবীন্দ্রনাথ মোটরে করে যখন বাঙলিতে আসছিলেন, তখন তাঁকে দেখে মোটরচালক পার্শ্ববর্তী কোপেয়ারবেয়ার্গকে জিজ্ঞাসা করলে, ইনি কে? কোপেয়ারবেয়ার্গ মালাইয়ে বললেন—ইনি Voor-India বা Hindoestan থেকে আগত Mahagoeroe মহাগুরু। ‘মহাগুরু’ এই পরিচয়টি কথায় কথায় এসে গেলেও, এই উপযুক্ত শব্দটির দ্বারা কবি বলিদ্বীপে সাধারণত পরিচিত বা অভিহিত হয়েছিলেন। বুলেলেঙ বন্দর থেকে আসবার পথে মোটরচালক, যেখানেই দরকার হয়েছে, ‘ভারতবর্ষ থেকে আগত মহাগুরু’ (Mahogoeroe dari Boratawarsa) নামেই রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিয়েছেন। আর সেই পরিচয়ই—বোধকরি বলিদ্বীপবাসীদের মনে বেশ সার্থক বোধ হওয়ার জন্যে—সাধারণ্যে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ বা অভিধা হয়ে গিয়েছিল।

সেদিনই আমরা বাঙলি থেকে কারেঙ-আসেম (Kareng-Arem) খন্ডরাজ্যে চলে গেলাম। রাজার নাম শ্রীযুক্ত হিডা আনাকে আগুঙ বাগুস জলান্তিক (Mr. Hida Anake Agoeng Bagoes Djelantik)। বনেটে সোনার গরুড়-মূর্তিযুক্ত তাঁর মোটরে করে রাজা কবিকে নিয়ে গেলেন। আমরা গেলুম পরে। কবি আর সুরেনবাবু রইলেন রাজপ্রসাদে। আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হল কারেঙ-আসেমের Pasanggrahan ‘পাসাঙগ্রাহান’ বা ডাক-বাংলোয়। কবি রাজপুরীতে পদার্পণ করতেই, স্থানীয় বলিদ্বীপীয় ব্রাহ্মণ পন্ডিতেরা মিলে সুললিত মন্ত্রাদি পাঠ করে কবিকে স্বাগত জানান। এখন কবি ছিলেন পথভ্রমণে বিশেষ ক্লান্ত। তিনি একটু নির্জন স্থানে একাকী বিশ্রাম করতে চান। কিন্তু তাঁর ভাষা রাজার বোধগম্য করার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। মাঝে মোটরে আসতে আসতে, রাজা সমুদ্র দেখে সমুদ্রের নানা সংস্কৃত প্রতিশব্দ কবিকে শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কথাবার্তা চালানোর কোনো ব্যবস্থা হয়নি। শেষে কে একজন বুদ্ধি করে, বাজারের গুজরাটী কাপড়ওয়ালার দোকানের একজন খোজা বানিয়াকে কথাবার্তা চালাবার জন্যে ধরে নিয়ে এল। তখন তার মারফৎ কবি রাজাকে অনুরোধ করলেন যে অতিথিকে একলা থাকতে দিয়ে রাজা নিজেও যেন বিশ্রাম গ্রহণ করেন। রাজা তখনই সেইমতো ব্যবস্থা করলেন। কবি স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে বাঁচলেন। সেদিন রাত্রে বলিদ্বীপীয় নাচের ব্যবস্থা হল কবির জন্যে রাজপুরীতে। আমরা ডাক-বাংলো থেকে গিয়ে দেখে এলুম। বাঙলিতে যেমন যাত্রা অভিনয় দেখেছিলুম, এটিও অনেকটা তেমনি। আখ্যানটা মহাভারত থেকে নেওয়া।

পরদিন রাজার বৈঠকখানায় কবিকে কতকগুলো প্রাচীন তালপাতার পুঁথি দেখালেন রাজা। রাজা অনুরোধ করলেন, সেই পুঁথির বিষয়বস্তু ‘মহাগুরু’ তাদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিন। রাজার সংস্কৃত উচ্চারণ দুর্বোধ্য। আমি তাঁকে পুঁথিখানি রোমান অক্ষরে লিখে যেতে বললুম। রোমান প্রত্যক্ষরীকরণ থেকে শ্লোকগুলি আমি আমাদের মতন করে পড়ে যেতে লাগলুম, আর কবি সেগুলির ইংরেজি অনুবাদ করে যেতে লাগলেন। আমাদের একজন ডচ বন্ধু ইংরিজি থেকে মালাই-এ তার অনুবাদ করতে লাগলেন। রাজা সেগুলি লিখে নিতে লাগলেন। রাজা বোধকরি একটা সত্য বুঝতে পেরেছিলেন যে, সংস্কৃত না শিখলে নিজেদের ধর্ম আর সংস্কৃতি ভালো করে উপলব্ধি করা যাবে না। বলিদ্বীপে আবার সংস্কৃত চর্চা শুরু করার উপায় সম্বন্ধে তিনি অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করেছিলেন। ভারতবর্ষ থেকে সংস্কৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের বলিদ্বীপে পাঠানোর ব্যাপারটা কবি চেষ্টা করে দেখবেন বললেন। বলিদ্বীপের কয়েকজন ব্রাহ্মণকে ভারতবর্ষ নিয়ে গিয়ে সংস্কৃত পড়ানোর কথাও আলোচনা করা গিয়েছিল। আর একটা জিনিস আমার নজরে পড়েছিল। রাজার বসবার ঘরে তাঁর পারিবারিক ছবির পাশেই কবিরও একটি ছবি টাঙানো ছিল।

এখানে কবির শরীর ভালো যাচ্ছিল না। ঠিক হল কবি মধ্য-বালিতে পাহাড়-অঞ্চলে Tampak Sering (তাম্পাক-সেরিঙ) বলে একটি অতি নির্জন আর ঠান্ডা জায়গায় থাকবেন। কারেঙ-আসেমে তাঁর আরও দুইদিন থাকবার কথা ছিল। কিন্তু শরীরের জন্যে বাধ্য হয়ে যে ভ্রমণসূচী বাতিল করে, কবি তাম্পাক-সেরিঙ চলে গেলেন। সঙ্গে গেলেন সুরেনবাবু আর কোপ্যায়ারবার্গ সাহেব। সেখানে ডাক-বাংলোয় কবি উঠলেন। ডক্টর খোরিস (Dr. Goris) নামে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত এক ডচ যুবকও, পরে কবির সঙ্গে যোগ দেন। তাম্পাক-সেরিঙের পার্বত্য নদীতে স্নানের স্থান বা ঘাট বিখ্যাত। সেখানকার ‘পাসাঙ গ্রাহানের’ সামনে পাহাড়ে নদীর জলধারাকে অবলম্বন করে যে স্নানাগার করা হয়েছে, সেটির নাম Tirta Ampoel ‘তীর্তা বা তীর্থ আম্পুল’। এই স্নানাগার নিয়ে চিত্তাকর্ষক উপকথার প্রচলন আছে। ইতোমধ্যে গিয়াঞারের রাজা এসে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছেন, তাঁর বাড়িতে অন্ততঃ একদিনের জন্যে পদার্পণ করতে। দিন-দুই এখানে বিশ্রাম করে কবিও বেশ খানিকটা সুস্থ। আমরা ঠিক করলুম, তাম্পাক-সেরিঙ থেকে গিয়াঞার, এবং সেখান থেকে একেবারে বাদুঙ (Badoeng) বা দেন-পাসার (Den-Pasar) শহরে যাত্রা করবো।

গিয়াঞারের রাজার পুরো নাম ‘হিডা আনাকে আগুঙ ঙূরা: আগুঙ (Hida Anake Agoeng Ngoeng Agoeng)। রাজা নিজে এসে আমাদের স্বাগত জানালেন। তাঁর প্রাসাদের বহির্বাটীতে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। স্থানীয় ডচ কন্ট্রোলার শ্রীযুক্ত বুর্সমা (Mr. Boersma) কবিকে দেখাবার জন্য গিয়াঞারের রাজবাটীতে সন্ধ্যায় যাত্রার আয়োজন করিয়েছিলেন। মুখস পরে নাটকের অভিনয় হয়েছিল। এই নাচের নাম Topeng ‘তোপেঙ’। নাটক চলতে চলতেই আহারের ডাক এল। আহারের মধ্যে আমাদের তরফ থেকে রাজাকে ধন্যবাদ দিয়ে মালাই ভাষায় একটি বক্তৃতা দেওয়া হল। রাজা তার উত্তরে বললেন যে, বলিদ্বীপীয় আর ভারতের লোকেরা একই বংশের; ভারতের সঙ্গে এই সংযোগ তাঁদের কাছে গৌরবের বস্তু। কবিকে এর উত্তরে কিছু বলতে বলা হলে, তিনি বললেন যে, পিতৃপুরুষদের ঋণ কথঞ্চিৎ পরিশোধের জন্যেই তাঁর দ্বীপময়-ভারত ভ্রমণ; যে প্রাচীন ভারত এই সমস্ত দূর দেশকে একান্ত আপনার করে তুলেছিল, সেই ভারতের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্যে, আর সেই ভারতকে বোঝাবার জন্য—আর সেই সংস্কৃতিকে আবার এদেশে আর ভারতবর্ষে সুদৃঢ় করে তোলবার জন্যেই, তাঁর এদেশে আগমন।

গিয়াঞার থেকে আমরা পরে বাদুঙ-এ চলে এলুম। এখানে ফিদা হোসেন বলে একজন গুজরাটী মুসলমান ব্যবসায়ী আমাদের খুবই সাহায্য করেছিলেন। আমরা বাদুঙ-এর ডাক-বাংলোয় উঠেছিলুম।

বাদুঙ থেকে আমরা Oeboed ‘উবুদ’ গ্রামে স্থানীয় ‘পুঙ্গব’ বা জমিদার, গডে রাকে চকর্দে সুখবতীর (Gade Rake Tjokorde Soekawati) বাড়ীতে গেলুম। এঁর বাড়ীতেও একটি শ্রাদ্ধপর্ব চলছিল। জমিদারটি বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। বেশ যত্নের সঙ্গে আমাদের গ্রহণ করলেন। এঁর সঙ্গে পূর্বেই আমাদের বাঙালির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সাক্ষাৎ হয়েছিল। এখানে বেশ একটা লক্ষণীয় ব্যাপার ঘটেছিল। আমি ব্রাহ্মণ জেনে, এবং ভারতবর্ষ থেকে আগত ‘পদন্ড’ বা ‘দন্ডধারী’ পুরোহিত ভেবে, সুখবতী আমাকে তাঁর আত্মীয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে কিছু বেদ পড়তে অনুরোধ করলেন। কবিকে সে-কথা বলতে, তিনিও আমাকে সানন্দে রাজী হতে বললেন। কবিও একদিন উবুদের শ্রাদ্ধ-সভা ঘুরে গেলেন। সেখানে গৃহস্বামী সুন্দর সুখবতী কবিকে স্বাগত করলেন। এখন নির্ধারিত দিনে আমি কঠোপনিষদের গোটা দুই বল্লী, গীতার দ্বিতীয় আর একাদশ অধ্যায়, আর শেষে ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের ষোড়শ সূক্তের কতকগুলি ঋক পড়লুম। এদের পদন্ডেরা যে উচ্চমঞ্চে বসে পূজা-পাঠ করছিলেন, সেই মঞ্চের উপর ধুতিচাদর পরে বসে আমিও পাঠ করলুম। সুখবতী তো খুব খুশি। আমাকে পুরোহিতের দক্ষিণা হিসাবে ওই দেশীয় প্রথা অনুযায়ী ধোত্র উষ্ণীষ ও উত্তরীয় ও আর কয়েকটা জিনিস উপহার দিলেন। আমি ডান হাতে স্পর্শ করে সেগুলি গ্রহণ করলুম।

বাইরের থেকে আগত ‘ব্রাহ্মণ’ দ্বারা এই বেদপাঠ নিষ্পন্ন হওয়ায়, স্থানীয় ‘পদন্ড’-রা কেউ কেউ ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখেনি। এদের একজন আমায় জিজ্ঞাসা করে বসল, কী কী ‘মুদ্রা’ বা কর-মুদ্রা আমি জানি। এখানকার ব্রাহ্মণেরা দেবার্চনায় হাতের আঙুল দিয়ে নানা প্রকার ‘মুদ্রা’ করে থাকেন। এই বলে সে পদন্ডটি সাধা হাতে নানারকম মুদ্রা দেখাতে লাগল। আমি এই বিষয়ে আমার অজ্ঞতা স্বীকার করলুম। বললুম যে আমি ব্রাহ্মণ মাত্র—পূজা-আচারে দক্ষ পুরোহিত বা ‘পদন্ড’ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ নই। ভদ্রলোক মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করে বললেন, আমাদের ‘মহাগুরু’ নিশ্চয়ই পূজা-অনুষ্ঠানের সব কয়টি মুদ্রাই করতে পারেন—এমনকী বলিদ্বীপে জানা নেই এমন মুদ্রা নিশ্চয়ই শিক্ষাও দিতে পারেন। আমাদের এক বিপদে ফেললেন। পরে কবিকে এই পদন্ডের কথা বলি। ইনি যে কবির কাছে নূতন মুদ্রা শিখতে আসবেন এবং মুদ্রার ব্যাপারে কবির দক্ষতাও যে যাচাই না করে ছাড়বেন না, কবিকে সে-কথাও বলি। কবি হাসতে হাসতে বললেন, ‘এই দেখ, তুমি কোথায় কার সঙ্গে আলাপ করে যত বিভ্রাট ঘটিয়ে’ আসবে—এখন জগতে আমার যেটুকু পসার হয়েছে এই বলিদ্বীপে এসে পদন্ডদের দন্ডাঘাতে সেটুকু বুঝি মাটি হয়ে যায়। কোনোরকমে তাকে ঠেকাও। সে যদি আমার মুদ্রার পরীক্ষা করতে আসে, তাহলে বিশ্বভারতীর জন্যে খালি ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে কিছু মুদ্রার জন্যেই দ্বারে-দ্বারে ঘুরছি, আমার আবার মুদ্রা কোথায়—আমি গরীব বেচারা দাঁড়িয়ে ‘ফেল’ হয়ে মারা যাবো।’

এখানকার ব্রাহ্মণদের সঙ্গে পরে আমার দেখা হয়। অজ্ঞাতকুলশীল বিদেশী, রাজার কাছে দেশমান্য ব্রাহ্মণ পুরোহিতের সম্মান আমি পাই, এতে তাঁদের স্বাভাবিক উষ্মা ছিল। আমি বিনীতভাবে জানালুম, আমরা একই ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অধিকারী, ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের মতন তাঁদের দেশে এসেছি তাঁদের দেখতে, জানতে, শিখতে—তাতে আমরা উভয়ই লাভবান হবো—গর্ব বা মান্যতার বোধ নিয়ে আসিনি। এতে তাঁরা আশ্বস্ত হলেন, মেঘ কেটে গেল। উবুদ থেকে আমরা মুন্ডুকে এলুম। এখানেও পাসাংগ্রাহানে উঠলুম। এখানে এসে আমরা খবর পেলুম যে, মিস মেয়ো-র ‘মাদার ইণ্ডিয়া’ বেরিয়েছে। এবং বিলেতে এই নিয়ে খুব হৈ-চৈ শুরু হয়েছে। নিউ স্টেটসম্যান কাগজে মিস মেয়োকে সমর্থন করে সমালোচনা বেরিয়েছে। আর তাতে বলা হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি শিশুবিবাহের পক্ষপাতী। তাঁর সম্বন্ধে আরও যা সব বলা হয়েছে যেগুলি কোনো সাধারণ উচ্চশিক্ষিত লোকের পক্ষে বলাও লজ্জাকর। কবি অনিচ্ছুক হলেও বলিদ্বীপের মুন্ডুকে বসে এই সমালোচনার উত্তর লিখলেন, ইংল্যাণ্ডের ম্যাঞ্চেস্টার গার্জেন পত্রে প্রকাশের জন্যে তা পাঠানো হল। সেই সমালোচনার উত্তর যথাসময়ে ওই কাগজে আর ওদেশে নানা পত্রে বার হয়েছিল।

৮ সেপ্টেম্বর আমরা মুন্ডুক থেকে বুলেলেঙ-এ ফিরে আসি। বলি-লম্বকের রেসিডেন্ট শ্রীযুক্ত কারোন সাহেব এসে কবিকে জাহাজে তুলে দিয়ে গেলেন। আমরা নৌকায় করে ডাঙ্গা থেকে জাহাজে উঠলুম। ছোট্ট জাহাজ, নাম ‘ফান নেক’ (Van Neck)। জাহাজটি আমাদের বলিদ্বীপ থেকে আবার যবদ্বীপ-সুরাবায়ায় ফেরত নিয়ে চলল।

৯ সেপ্টেম্বর সুরাবায়া বন্দরে আমাদের জাহাজ লাগল। জেটিতে কবিকে স্বাগত করবার জন্যে অনেক ভীড় হয়েছিল। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আগত চিনির ব্যবসায়ী শ্রীযুক্ত মদনলাল ঝাম্ব, শ্রীযুক্ত লোকুমল ও অন্যান্য ভারতীয়েরাও এসেছিলেন। আর এসেছিলেন ষষ্ঠ মঙ্কুনগরোর পুত্র শ্রীযুক্ত আর্য-সুযান (Mr. Raden M Harjo Soejono)—এঁদের বাড়ীতেই কবির থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। এই মঙ্কুনগরোরা (Mangkoenogoro) হচ্ছেন পূর্ব-যবদ্বীপের শূরকর্ত (Soerokarta) নগরের রাজা। এখন রাজা হচ্ছেন সপ্তম মঙ্কুনগরো। ষষ্ঠ মঙ্কুনগরোর সঙ্গে ডচ সরকারের বনিবনা না হওয়ায়, ইনি রাজপদ ত্যাগ করে সুরাবায়াতেই বাস করছিলেন।

ভারতীয়দের তরফ থেকে এক সভায় কবিকে সংবর্ধনা করা হল। সুরাবায়ার রেসিডেন্ট, স্থানীয় ব্রিটিশ ভাইস-কনসাল, চীনের কনসাল সকলেই উপস্থিত ছিলেন। কবিকে অভিনন্দন জানানো হল, শ্রীঝাম্ব অভিনন্দন প্রশস্তি পড়লেন। বিশ্বভারতীর জন্যে হাজার টাকার তোড়া কবিকে দেওয়া হল। লোকুমল কবির পায়ের ধূলো নিয়ে তাঁর দোকানে পায়ের ধূলো দেবার জন্যে কবিকে নিমন্ত্রণ করলেন। এখানে শোনা গেল যে, মিস মেয়োর বই আর নিউ স্টেটসম্যান-এর সমালোচনা হল্যাণ্ড মারফৎ যবদ্বীপেও প্রচারের চেষ্টা হচ্ছে। দু-চারজন ডচ বন্ধু বললেন, ম্যাঞ্চেস্টার গার্জেন-এর জন্যে লেখা চিঠিখানা ইংরেজি আর ডাচ অনুবাদে যবদ্বীপেও সর্বত্র প্রকাশিত হওয়া উচিত। কতকগুলি পত্রিকার সম্পাদক এই চিঠি প্রকাশ করবেন স্থির হল।

শ্রীযুক্ত লোকুমলের দোকানে একদিন যাওয়া হল। কবির আগমনে লোকুমল শেঠ একেবারে কৃতার্থ। তাঁর শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে তিনি সওয়া শ’ গিলডারের একটি থলে আর খানকতক অতি সুন্দর যবদ্বীপের ‘বাতিক’ কাপড় কবির সামনে ধরে দিলেন। আর একজন সিন্ধী ব্যবসায়ী বিশ্বভারতীর জন্যে একান্ন গিলডার, একটি হাতির দাঁতের বাক্স ও কিছু ‘বাতিক’ কাপড় ভেট দিলেন।

শ্রীযুক্ত সুযানের বৈঠকখানায় যবদ্বীপের যুবকদের সমাগমে কবি কিছু বলেন। শ্রীযুক্ত বাকে দোভাষীর কাজ করলেন। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মধ্যে মিলন সম্ভব কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে কবি বললেন যে, মানুষের মানসিক আর আধ্যাত্মিক জীবনই যাঁদের কাছে সত্যকার জীবন বলে মনে হয়, তাঁরা যদি এই intellectual আর spiritual দিক নিয়ে মিল করবার চেষ্টা করেন, তবেই এই মিল সম্ভব হবে, সার্থক হবে; আর এই মিলের আধারের উপরেই পরে আর সব বিষয়ের সমাধান হতে পারবে।

ডচ ডাক্তার ক্লাফরভাইডন (Dr. Klaverweiden)-এর সঙ্গে কবির একদিন সাক্ষাৎ হয়েছিল। ইনি বিশ্বভারতী কলাভবনের জন্যে একটি মূল্যবান উপহার দিলেন—সেকেলে কাঠের সিন্দুকে করে অনেকগুলি ‘ওয়াইয়াঙ’ (wajang) বা ছায়া-নাট্যে ব্যবহৃত চামড়ায় কাটা আর খুব রঙচঙে আর সোনালী কাজ করা বা পট ছবি। সুরাবায়া ত্যাগের আগের দিন রাত্রে স্থানীয় Kunstkring বা ডচদের সাহিত্য-সংগীত-কলা সভায় কবির বক্তৃতা ছিল। ডচ সমাজের প্রায় সব বড়ো বড়ো লোকই এসেছিলেন। ‘What is Art’ সম্বন্ধে কবি এই উপলক্ষ্যে বক্তৃতা দেন।

গুবেঙ স্টেশনে আমরা শূরকর্তের ট্রেনে চড়লাম। শ্রীযুক্ত সুযানও আমাদের সঙ্গে চললেন। বিকেলের দিকে আমরা শূরকর্তে পৌঁছোলুম। শহরটির নাম সংস্কৃতে হচ্ছে ‘শূরকৃত’ অর্থাৎ শূরের বা বীরের কৃত নগরী। এই পোষাকি নামটির একটি ছোট্ট সংক্ষিপ্ত রূপ আছে—সেটি হচ্ছে Solo সোলো। ষ্টেশনে আমাদের নিতে এসেছিলেন ডাক্তার রাজিমান (Radjiman) বলে এক যবদ্বীপীয় ভদ্রলোক, আর সোলোতে যাঁর বাড়ীতে আমরা থাকবো সেই সপ্তম মঙ্কুনগরোর দুজন প্রতিনিধি। মঙ্কুনগরোর প্রাসাদে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পরেই, স্বয়ং মঙ্কুনগরো কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। কবিকে সঙ্গে নিয়ে আমরাও স্থানীয় ডচ সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করে এলুম। রাত্রে যবদ্বীপীয় গামেলান বাজনার সঙ্গে ‘গোলক’ (Golak) নাচ দেখলুম। যবদ্বীপের সংগীত আর বাদ্য নিয়ে কবি, মঙ্কুনগরো, ডাক্তার রাজিমান, কোপ্যারব্যার্গ আর বাকে আলোচনা করতে লাগলেন। মাঝে আহারের জন্যে কিছুক্ষণ নাচ বন্ধ রইল। আহারাদির পরে আবার নাচ শুরু হল। এই দ্বিতীয় পর্বের নাচের নাম ‘কাম্বিওঙ’ (Kambiong)—এই নাচ খুব ভালো হয়েছিল। কবি খুব মোহিত হয়েছিলেন। যতদূর স্মরণ হচ্ছে, কবি যেন বলেছিলেন—যবদ্বীপের মেয়েরা যেভাবে নাচলে, স্বর্গের অপ্সরাদের নাচ তার চেয়ে কত ভালো হত, তা তাঁর কল্পনার অতীত। যবদ্বীপকে উদ্দেশ্য করে কবি যে বাঙলা কবিতাটি লিখেছিলেন, তার ইংরিজি অনুবাদ কবি নিজেই করেছিলেন। ইংরিজি থেকে ডচ অনুবাদ করেন শ্রীযুক্ত বাকে। ডচ থেকে যবদ্বীপীয় ভাষায় অনুবাদ করান মঙ্কুনগরো। এই অনুবাদটি মঙ্কুনগরোর মেয়েরা গান গেয়ে কবিকে শোনালে।

এখানে আসার একদিন পরেই মঙ্কুনগরো কবির সম্মাননার জন্যে একটি বড়ো ভোজ দিলেন। এই উপলক্ষ্যে যবদ্বীপীয় নৃত্যের বিশেষরূপে আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁর প্রাসাদের বিরাট বড়ো মন্ডপটিতে এই নাচের আর ভোজনের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। খাওয়ার ভোজ্যতালিকা ইংরিজিতে ছাপান হয়েছিল—তার উপরে লেখা—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবর্ধনার জন্যে মঙ্কুনগরোর গৃহে নৈশ-আহারের পদ-তালিকা। কবির যবদ্বীপের প্রতি কবিতাটির ইংরেজি আর ডচ অনুবাদ বেশ চমৎকারভাবে পুস্তকাকারে ছাপানো হয়েছিল, সেই বই সমাগত অতিথিদের মধ্যে বিতরিত হল—কবির আর মঙ্কুনগরোর হস্তাক্ষরসমেত।

শূরকর্ততে দুজন রাজা আছেন। একজন মঙ্কুনগরো—এর কথা এতক্ষণ বললুম। অন্যজনের উপাধি হচ্ছে সুসুহুনান (Soesoehoenan)। পদমর্যাদায় সুসুহুনান যবদ্বীপের তাবৎ দেশীয় রাজাদের মধ্যে প্রধান। সেই রাজা, দশম পাকু-ভুবন (Pakoeboewono X) রবীন্দ্রনাথকে একদিন তাঁর Kraton অর্থাৎ রাজপ্রাসাদ-এ নাচ দেখবার জন্যে আমন্ত্রণ জানান। রাজাবরোধের নয়জন কন্যার এই নাচ খুবই চিত্তাকর্ষক হয়েছিল। এই নাচের নাম ‘বেডোয়া’ (Bedojo)।

মাঝে একদিন স্থানীয় Kunstkring-এ এক সভায় কবি বক্তৃতা দিলেন। বাকে ডচ ভাষায় তর্জমা করলেন।

কয়েকদিন পরে স্থানীয় Contact Club-এর হলে যবদ্বীপীয়রা একটি কবি সংবর্ধনার ব্যবস্থা করলেন। এখানকার যবদ্বীপীয় সমাজের তাবৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, ডচ ভদ্রলোকও ছিলেন অনেকগুলি। রাজকুমার কুসুমায়ুধ (Koesoemjoedo) (সুসুহুনানের দুই ছেলের একজন) ইংরিজিতে কবিকে স্বাগত করে ছোটো একটি বক্তৃতা দিলেন। ডাক্তার রাজিমানও বক্তৃতা দিলেন। কথা ও কাহিনী-র চারটি কবিতা—‘অভিসার, মূল্যপ্রাপ্তি, স্পর্শমণি, বিচার’—যার বাঙলা থেকে আমি ইংরিজি করে দিই, আর বাকে করেন ডচ ভাষায় তার যবদ্বীপীয় অনুবাদ। ডাক্তার রাজিমান পাঠ করে শোনালেন। অনেকেই বক্তৃতা দিলেন। কবিকেও কিছু বলতে হল।

শূরকর্তয় একটি নতুন রাস্তা কবি সাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করলেন। রাস্তার নামকরণ হল কবির নামে—Tagorestraat। এই উদ্বোধন-কার্য শেষ করে কবি এলেন প্রাম্বানানে। এখানে বিরাট প্রাচীন খন্ডগৃহ—‘খঁড়হর’ অর্থাৎ বিধ্বস্ত প্রাচীন মন্দিরাদির সমাবেশ কবি দেখলেন। রবীন্দ্রনাথকে প্রাম্বানান ভালো করে দেখাবার জন্যে ডচ সরকার সেরা বন্দোবস্ত করেছিলেন। দ্বীপময় ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্তা Dr. F. D. K. Bosch (বস) স্বয়ং সেখানে হাজির ছিলেন। এখানে শিব, বিষ্ণু আর ব্রহ্মার তিনটি বড়ো বড়ো মন্দির আছে। ছোটো শিবমন্দিরও অনেকগুলি।

প্রাম্বানান থেকে আমরা যোগ্যকর্তয় (Jogiakarta) পৌঁছলুম। এই শহরটির প্রাচীন শুদ্ধ সংস্কৃত নাম হচ্ছে ‘অযোধ্যাকৃত’। এখানকার এক রাজা, ‘পাকু-আলম’ (Pokoe Alam) যাঁর উপাধি, তাঁর বাড়ী অতিথি হওয়া গেল। যোগ্যকর্তয় অন্যতম রাজা (মান্যে ইনি পাকু-আলমের চেয়ে উঁচু) সুলতানের সেদিন ছিল জন্মদিন। তাঁর রাজবাড়ী ‘ক্রাতন’-এ, ডচ রেসিডেন্ট ও পাকু-আলম সমভিব্যাহারে ‘সেরিম্পি’ (Serimpi) নাচ দেখতে গেলুম। কবির সঙ্গে সুলতানের পরিচয় হল। ‘সেরিম্পি নাচ’, ‘বেডোয়ো’ নাচের চেয়ে অনেক আভিজাত্যপূর্ণ বলে মনে হল। পাকু-আলমের মন্ত্রী বা ‘পতি’-র বাড়ী একদিন রাত্রে রামায়ণ অভিনয় দেখে আসা গেল। রাজবাড়ীর ছেলেরা মিলে এই অভিনয় করেছিল। স্থানীয় Kunstkring বা ডচদের বিদগ্ধ সভায় কবি তাঁর ইংরিজি আর বাঙলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। কবির সঙ্গে একদিন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত ‘তামান শিশ্ব’ (Taman Siswo) বিদ্যালয় দেখতে যাওয়া গেল। এখান থেকেই আমরা বরবুদুর (Boroboedoer) স্তূপ দেখতে গেলাম। বরবুদুর আর তার কাছাকাছি আর দুটি ছোটো মন্দির—‘চন্দী সেন্দুৎ’ আর ‘চন্দী পাওন’—এই তিনটি নিয়ে একটি মন্দিরচক্র। সেখানে ডাক্তার বস আর ডাক্তার কালেনফেলস (Callenfels) কবির জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।

বরবুদুরের পাশেই ডচ সরকার একটি ‘পাসাঙ গ্রাহান’ বা ডাক-বাঙলা করে দিয়েছেন। আমরা এখানে উঠলুম। কবিকে নিয়ে আমরা দলবদ্ধ হয়ে চৈত্যের উপরে উঠলুম। কবি তিনটি ভূমির উপরে উঠতে উঠতে শ্রান্তি অনুভব করলেন, আমরা তাঁকে আর না উঠতে অনুরোধ করলুম। দ্বিতীয় ভূমির কতকগুলি চিত্র তিনি দেখলেন। পরদিন ‘পাসাঙ গ্রাহানে’ বসে বসে কবি দূর থেকে বরবুদুরের শোভা দেখতে লাগলেন, আর এই সময়েই তাঁর বিখ্যাত ‘বর-বুদুর’ কবিতাটি লিখে ফেললেন।

পরদিন দুপুরে আমরা যোগ্যকর্তয় ফিরলুম। রাত্রে পাকু-আলম কবির সম্মাননার জন্যে একটি বড়ো ডিনার পার্টি দিলেন। যোগ্যকর্ত-র ডচ আর যবদ্বীপীয় সকল গণমান্য ব্যক্তিই আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ২৪ সেপ্টেম্বর আমরা ট্রেনে বাতাভিয়ার পথে যাত্রা করলুম। পথে বান্দুঙ শহরে নামলুম। বান্দুঙে আমরা দুদিন ছিলুম। উঠলুম শ্রীযুক্ত ও শ্রীমতী দেমন্ট (Demont) নামে এক ডচ দম্পতির অতিথিরূপে তাঁদের বাড়ীতে। সেখানে কবি স্থানীয় কনকর্ডিয়া (Concordia) সভার সুন্দর হল-ঘরে Kunstkring-এর আমন্ত্রণে একটি বক্তৃতা দেন। বিষয় ছিল—What is Art. এখানে সকালে ও দুপুরে প্রচুর সিন্ধীদের আগমন ঘটতে লাগল। একদিন ভারতীয়দের এক সভায় কবিকে মানপত্র দেওয়া হল।

একদিন তিনজন যবদ্বীপীয় যুবক কবির সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এরা যবদ্বীপের স্বরাজকামী দলের নেতা। একজনের নাম সুকর্ণ (Soekarno), ইনি হল্যাণ্ড-ফেরৎ ইঞ্জিনীয়ার। বেশ ইংরিজি জানেন। বুদ্ধিমান, প্রিয়দর্শন। কবির আর আমাদের এঁদের বেশ ভালো লাগল।

ইনিই পরে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নেতা হন, আর ১৯৪৫ সালে এঁর সহকর্মীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এখন ইনিই হচ্ছেন স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি ডাক্তার আহমদ সুকর্ণ (Dr. Ahmad Sukarno)।

২৭ সেপ্টেম্বর আমরা বান্দুঙ ছাড়লুম। সেদিনই পৌঁছলুম বাতাভিয়ায়।

বাতাবিয়ায় আমরা প্রথমবারে যেখানে উঠেছিলুম, কবি, সুরেনবাবু আর বাকে সেই Hotel des Indes-এ উঠলেন। আমরা উঠলুম সিন্ধী বণিক বাসিয়ামল্ল আসোমল্ল-এর (Wassiamall Assomall) ম্যানেজার শ্রীযুক্ত রূপচাঁদ নবলবায়ের বাড়ীতে, তাঁর অতিথি হয়ে। এখানে আমরা প্রায় তিনদিন ছিলুম। কবি একদিন স্থানীয় মিউজিয়ম দেখে এলেন। একদিন কবিকে ও আমাদের স্থানীয় এক সিন্ধী বণিক শ্রীযুক্ত মেথারাম নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন। একদিন বাতাভিয়ায় Kunstkring-এ কবি তাঁর ইংরিজি ও বাঙলা কবিতা পাঠ করে শোনালেন। বাঙলা ভাষার ঝঙ্কার কবির মুখে শুনে এরা সবাই খুশী হয়েছিল।

এখানকার ডচদের স্থাপিত শিল্প ও বিজ্ঞানসভায় (আমাদের ‘এশিয়াটিক সোসাইটির’-র মতন) আমি একটি বড়ো বক্তৃতা পাঠ করলুম—বিষয় ছিল, ভারতের সভ্যতার পত্তন ও তাহাতে অনার্য উপাদান। এটি পরে এই সভার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

৩০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার কবি বিপুল জনসমাগমের মধ্যে যবদ্বীপ থেকে বিদায় নিলেন। আমাদের ফিরতি জাহাজের নাম ‘মাইয়ার’ (Mijer)। আমি একদিনের জন্যে রয়ে গেলুম। কবির সঙ্গে সিঙ্গাপুরে গিয়ে মিলিত হবো। সেখান থেকে আবার নতুন করে ভ্রমণ শুরু হবে। আপাততঃ দ্বীপময় ভারত ভ্রমণ শেষ হল। এবারের ভ্রমণপর্ব শ্যামে। সেখান থেকেও কবির নিমন্ত্রণ এসেছে।

Life Time, Rabindra Centenary Issue, 1961 Eastern Railway

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *