বাংলা প্রবন্ধ
Essays in English
পরিশিষ্ট

রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রলিপি’

রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রলিপি’

এই বইখানি নানা দিক দিয়া একক, এবং বৈশিষ্ট্যময়। ইহাতে শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথের অঙ্কিত আঠোরোখানি চিত্রের প্রতিলিপি আছে (এগুলির মধ্যে দশখানি বহুবর্ণময়), এবং চিত্রের ভাব ও উদ্দেশ্য লইয়া কবিবরের রচিত আঠারোটি ক্ষুদ্র বাঙ্গালা কবিতা এবং কবিতাগুলির ইংরেজি ভাবানুবাদ কবির স্বাক্ষরিত হস্তলিপির প্রতিলিপিতে প্রদত্ত হইয়াছে। এতদ্ভিন্ন কবির রচিত একটি ইংরেজি ভূমিকা ও শিল্পাধিষ্ঠাত্রী ‘চিত্রলেখা ত্রয়ী’-র উদ্দেশ্যে রচিত আর একটি বাঙ্গালা কবিতা ও তাহার ইংরেজী অনুবাদও আছে।

এই বইয়ের সহজলভ্য আকারে কবির চিত্র বিষয়ক কৃতির কতকগুলি নিদর্শন মিলিবে। রবীন্দ্রনাথ সর্ববাদিসম্মতিক্রমে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে অন্যতম। সংগীত বিষয়ে তাঁহার কৃতিত্ব কাহারও কাহারও পক্ষে—বিশেষতঃ যাঁহারা ভারতের প্রাচীন সংগীতের ব্যবসায়ী বা অনুরাগী তাঁহাদের কাহারও কাহারও পক্ষে—অনুমোদনীয় বলিয়া মনে না হইলেও, আধুনিক বাঙ্গালায় ও ভারতবর্ষে তিনি যে সংগীতকে তাহার একটি অভিনব এবং বহুজনের মতো যুগোপযোগী রূপ দিয়াছেন, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। নাট্যেও—নাটক রচনায়, অভিনয়ে এবং প্রয়োগে—তাঁহার প্রতিভা আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। কলা বা সুকুমার শিল্প—ইংরেজিতে যাহাকে Art বা Fine Art বলে—তাহার চারিটি মুখ্য অঙ্গ : কাব্য, সংগীত, নাট্য এবং রূপ-শিল্প। রূপ-শিল্পের প্রকাশ হইয়া থাকে নেত্র-গ্রাহ্য রেখায়, বর্ণে এবং বস্তুর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও ঘনত্বের সমাবেশের মধ্যে; বাস্তুগঠন, ভাস্কর্য ও চিত্র উহার প্রকাশের তিন প্রধান উপায়। নাট্য—অভিনয় নৃত্য ইত্যাদিকে একাধারে চলমান চিত্র বা ভাস্কর্য এবং সংগীতের সংযোগ বলা যাইতে পারে। এই চারি প্রকার কলার মধ্যে আপেক্ষিক স্থান কোনটির সর্বোচ্চে, তাহা নির্ণয় করা দুষ্কর। তবে রূপকর্ম, নাট্য, কাব্য এবং সংগীত, এই তিনটির মধ্যে, সংগীত-ই দ্যোতনা-শক্তিতে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী—বিশেষতঃ যন্ত্র-সংগীত, কারণ ইহা ভাষার অতীত, বাক্যের অতীত, এবং নেত্র-গ্রাহ্য রূপের অতীত। কিন্তু কাব্য, নাট্য ও রূপকর্ম বহুল পরিমাণে সীমাবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের মত অনুভূতিশীল কবি এবং নিষ্ঠাবান গুণীর কাব্য, নাট্য এবং সংগীত, তিনটিই সার্থকভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। তাঁহার অনুভবী প্রতিভা, রূপ-শিল্পের প্রতিও যে আকৃষ্ট হইবে, ইহা স্বাভাবিক। শিল্পকলার তিনি একজন শ্রেষ্ঠ সমঝদার; অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল প্রমুখ শিল্পীদের লোকোত্তর প্রতিভার একজন দরদী পরিপোষক তিনি, এবং বিদেশী শিল্পের মহত্ত্বও তিনি উপলব্ধি করেন। বহু বৎসর পূর্বে অসলো নগরে নরওয়ের বিখ্যাত ভাস্কর গুস্তাভ ভিগেলাণ্ড-এর বিরাট ভাস্কর্য বিষয়ক কৃতিত্ব দর্শন করিয়া তিনি বিশেষভাবে তাহার সৌন্দর্য্য ও শক্তি দ্বারা অভিভূত হইয়াছিলেন; সেই দর্শনের অনুধ্যানের আনন্দে যাহাতে অন্তত একটি দিনের জন্য কোনও বাধা না পড়ে, সেইজন্য তিনি সারাদিন ধরিয়া অন্তরঙ্গ বন্ধু ছাড়া জনসাধারণের মধ্যে দেখা দেন নাই, একথা নরওয়ের একটি বন্ধু আমায় বলিয়াছিলেন।

কলানুরাগী বিদগ্ধজন রূপ-শিল্পকে উপেক্ষা করিতে পারেন না। কলা বা সংগীতে কৃতিত্ব কিন্তু বিশেষ শিক্ষাসাপেক্ষ, শিক্ষা দ্বারা এবিষয়ে মানসিক প্রবণতাকে পুষ্ট এবং প্রকাশক্ষম করিয়া তুলিতে হয়। রবীন্দ্রনাথের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভা, শিক্ষা ও সাহচর্যের ফলে সংগীতে সহজেই আত্মপ্রকাশ করিতে সমর্থ হইয়াছিল। রূপ-শিল্পে তাঁহার যে প্রকাশ কয়েক বৎসর হইল দেখা দিয়াছে, তাহার মধ্যে রূপকর্মের অনুধ্যান আছে, সাহচর্য্য আছে, রূপকর্মের সহিত ‘সাহিত্য’ আছে; কিন্তু রীতিমত পরিপাটী বা নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষা বা সাধনার সহায়তা রবীন্দ্রনাথের শিল্পময় প্রকাশের মধ্যে ঘটে নাই। রবীন্দ্রনাথের শিল্প চেষ্টার পক্ষে ইহাই সর্বপ্রধান লক্ষণীয় যে, ইহা স্বতঃ-উৎসারিত, সাবলীল,—এবং ইহার মধ্যে অপরিহার্য্যতা গুণ বিদ্যমান। কবির বিভিন্ন প্রকারের অনুভূতির প্রকাশ যেমন আপনা হইতেই তাঁহার গানে, কাব্যে, নাটকে, কথায় হইয়া থাকে,—গোপন বার্তা যেমন তাঁহাকে প্রকট করিয়া দিতেই হইবে, তেমনি একটা অবশ্যম্ভাবিতার সহিত তাঁহার অনুভূতির প্রকাশ নূতনভাবে রূপরেখায় ও বর্ণে আমাদের চোখের সামনে প্রকটিত হইয়াছে। ইহার মধ্যে অবশ্য শিক্ষার বা শিক্ষানবিশীর অভাব আছে—তাহা শিল্প-শিক্ষককে, এবং যিনি শিল্পের প্রাণ অপেক্ষা তাহার আকারকেই বড়ো বলিয়া মনে করেন তাঁহাকে, খুশি করিবে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই শিল্প চেষ্টাকে শ্রীযুক্ত আনন্দ কুমারস্বামীর মতো শিল্পরসিক childlike, not childish—অর্থাৎ শিশুচেষ্টিতের মতো সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত অতএব সুন্দর, বয়োবৃদ্ধ কতৃক শিশুর অসুন্দর অনুকরণ নহে, বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁহার রূপ-শিল্পের এই অবশ্যম্ভাবিতা সম্বন্ধে ইঙ্গিত করিয়াছেন। তাঁহার তুলিকার লিখনে যে ভাষাহীন গীতি বা উক্তি রচিত হইয়াছে, সাধারণ চিত্রের ভাষার ব্যাকরণ দিয়া তাহা যাচাই করিতে গেলে চলিবে না। কথা হইতেছে, এগুলির দ্বারা অনুভবশীল ব্যক্তির চিত্তে কোনও ভাব-পরম্পরা উদিত হয় কি না। হয়তো রচনাকালে যে ভাবের ভাবুক হইয়া কবি তুলিকার চালনা করিয়াছেন দ্রষ্টার মনে এই প্রকার চিত্রের দর্শনে ঠিক সেই ভাবটি জাগিবে না; কিন্তু তাহাতে আসিয়া যায় না—কারণ তথ্যের বাহিরেকার সমস্ত ব্যাপারেই আমাদের মন-গড়া ভাবই আমাদের পক্ষে কার্যকর হইয়া থাকে।

কবির আঁকা সব ছবিগুলিই যে শ্রেষ্ঠ বা সুন্দর তাহা কেহ বলিবে না। ছবিগুলির মধ্যে সেগুলির উদ্ভবের ইতিহাস নিবদ্ধ রহিয়াছে। কেমন করিয়া বাঙ্গালায় ও ইংরেজিতে লেখা গান কবিতা বা গদ্যরচনার মধ্যে লিখনকালে কোনো অংশ কাটাকুটি করিয়া বাদ দিবার আবশ্যকতা হওয়ায়, কবির অলস লেখনীর মুখে এই সমস্ত কাটাকুটির রেখা নানা প্রকারের নকশার এবং কিম্ভূতকিমাকার জীবের রূপ গ্রহণ করিত। নিজ কল্পনার বলগাকে শ্লথ করিয়া দেওয়ার ফলে, এইভাবে কবির কলমের অব্যাহত গতির ফলে তাঁহার চিত্র-প্রতিভা নিজেকে দেখা দিতে আরম্ভ করে। কালো কালির লেখায় ক্রমে লাল কালির মিলন হইল, তাহার পর বিভিন্ন রঙ্গের কালি আসিল, প্রথমটায় কলমের দ্বারায় ও পরে তুলির সাহায্যে তাঁহার চিত্র রচনার ক্রমবিকাশ চলিল।

কবির হাতে এইভাবে নানা ঢঙ্গের রঙ্গীন ও একরঙ্গা বহু চিত্র রচিত হইয়াছে। কতকগুলি নিছক কল্পনাপ্রসূত—নকশা, অথবা আদিম যুগের বিরাটকায় অদ্ভুত অদ্ভুত অধুনালুপ্ত জন্তুর অনুকরণে অঙ্কিত পশুপক্ষীর মূর্তি। বিভিন্ন রঙ্গের সমাবেশে রচিত প্রাকৃতিক দৃশ্য, ফুল-পাতা এবং অনেকটা স্বাভাবিকভাবে আঁকা নর-নারীর চিত্রও তাঁহার হাতে দেখা দিয়াছে। এগুলির মধ্যে অনেকগুলিতে একটা রোমান্টিক আবহাওয়া বিশেষ স্পষ্ট।

শিল্পের দিক হইতে এই ছবিগুলির সার্থকতা অথবা, এগুলির নিরর্থকতা বিচার করিবার যোগ্যতা আমার নাই। তবে আমি এইটুকু বলিতে পারি, কবির আঁকা অনেকগুলি ছবিই আমার কাছে উপভোগ্য। রঙ্গের সমাবেশের দরুন, অনেকগুলির মূল্য আমার কাছে শব্দহীন গানের সুরের গুঞ্জনের মতো মনে হয়। আমার কাছে কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে, কবির হাতে আঁকা কতকগুলি মুখ। আমার মনে হয় এইখানে কবি মুখের আকার ও ভঙ্গীর দ্বারা অদ্ভুতভাবে ছবিতে মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। এখানে তাঁহার কৃতিত্ব একেবারেই শিশু-চেষ্টিতের মতো নহে, এখানে যেন অকস্মাৎ প্রৌঢ় শিল্পের, ওস্তাদ শিল্পীর হাতের ঝংকার দেখা দিয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ চিত্রলিপি-র ২, ১১, ১৫ সংখ্যক চিত্রের উল্লেখ করা যাইতে পারে। কবির চিত্রের প্রদর্শনীতে এরূপ মুখের ছবি আরও অনেক দেখিয়াছি। কবির অসীমের আহ্বান তাঁহার কবিতা গান ও সুরে আমাদের শুনাইয়া দিয়াছেন, তেমনি মানব-চরিত্রের মধ্যে সীমার পরিচয়ও আমাদের দিয়াছেন; এই মুখচিত্রগুলি নূতনভাবে, এবং নিরতিশয় শক্তি সহানুভূতি ও সার্থকতার সঙ্গে মানব-চরিত্রের সম্বন্ধে কবির সুগভীর আত্মীয়তাবোধের এবং ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের প্রমাণ দিতেছে। এই প্রকার মুখের ছবিগুলির জন্যই আমি রবীন্দ্রনাথকে উচ্চকোটির রূপ-শিল্পীর আসন দিতে ইতস্তত করিব না। হয় চিত্রগুলি, রেখা ও রঙ্গের jeu d’esprit বা প্রতিভার লীলা কিন্তু এগুলি যথার্থ creative art—প্রতিভার সার্থক শিল্প-রচনা।

রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেক ছবিটির আশয় অবলম্বন করিয়া, কতকটা ব্যাখ্যাত্মকভাবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাঙলা কবিতা ও সেগুলির ইংরেজি ভাবানুবাদ দিয়াছেন। সবসময়ে সেগুলি যে দ্রষ্টা এবং পাঠকের মনোভাবেরও প্রকাশক হইবে, তাহা মনে হয় না। কিন্তু তাহাতে ছবি ও কবিতা, উভয়ের মূল্য কমে না। একাধারে কবি ও চিত্রকার জগতে তাদৃশ সুলভ নহে। শিল্পরসিক ব্যক্তি এই বই হইতে কবির প্রতিভার একটা নূতন দিক দেখিয়া প্রীত ও বিস্মিত হইবেন।

প্রবাসী, পৌষ ১৩৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *