ভারতদূত রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ছিল নানামুখী, তাঁহার প্রতিভা ও কর্ম উভয়ই নানা ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। ভাবপ্রবণতা ও জ্ঞাননিষ্ঠা, জাতীয়তা ও বিশ্বমানবিকতা, শান্তি ও সংগ্রাম প্রভৃতি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী ধর্ম ও কর্ম তাঁহার চিত্তে ও চরিত্রে অপূর্ব সামঞ্জস্য লাভ করিয়াছিল। সুদক্ষ মণিকারের হাতেকাটা ভাস্বর হীরকখন্ডের ন্যায় তাঁহার ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য দেখা দিয়াছিল নানা ভূমিতে, যে দিক হইতেই ইচ্ছা দেখা যাউক না কেন ইহার দীপ্তি ও বর্ণবৈচিত্র্য দর্শককে মুগ্ধ করিবে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঔপন্যাসিক, তিনি ছিলেন নাট্যকার এবং নাট্যকলার প্রযোজক; তিনি সংগীত ও সুরের শিল্পী ছিলেন, কলাবিৎ এবং কৃতকর্মা রূপকারও ছিলেন; আধ্যাত্মিক অনুভূতির আভাস তাঁহার কাব্যরচনায় সুপরিস্ফুট, এবং সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব জীবনে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাশীল কর্মপ্রচেষ্টা, সামাজিক ও মানসিক জগতে সুধার ও সংস্কার তিনি দেখাইয়া গিয়াছেন। রসানুভূতিময় অন্তর্দৃষ্টি এবং বৈজ্ঞানিক অবলোকন ও বিচারশক্তি, এই উভয়ের এরূপ অদ্ভুত সমাবেশ মানব-সংস্কৃতির ইতিহাসে নিতান্ত বিরল; এই দিক দিয়া দেখিলে চিন্তানেতা ও সত্যদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে প্লাতোন, আরিস্তোতল, পতঞ্জলি, লেওনার্দো দা-ভিঞ্চি ও গ্যোতে প্রমুখ মহামানবদের সঙ্গে সমশ্রেণির বলিতে হয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের রচনাবলীকে পৃথিবীর দশ-বারোটি প্রধান বা শ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ বা গ্রন্থাবলী অথবা মহাকবি-বিশেষের রচনাবলীর মধ্যে অন্যতম বলিতে হয়। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের, সাহিত্যিক ও অন্য নানাবিধ প্রকাশের গভীর ও ব্যাপক আলোচনা বহু রসজ্ঞ এবং দর্শনশীল সমালোচক বহুদিন ধরিয়া করিবেন; রবীন্দ্রনাথ নিজ কৃতিস্বরূপ একটি বিরাট সাহিত্য-রত্নভান্ডার চিরন্তনকালের জন্য আমাদের দিয়া গিয়াছেন, এবং সেই সাহিত্য ও তাঁহার জীবনের বিচিত্র কার্যাবলীকে অবলম্বন করিয়া ক্রম-প্রবর্ধমান ‘রবীন্দ্রসাহিত্য’, বাঙ্গালা ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় ইতিমধ্যে যাহার পত্তন আরম্ভ হইয়া গিয়াছে, তাহা গঠিত হইতে থাকিবে।
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত মহত্ত্ব তাঁহার জাতিকে ধন্য করিয়াছে। তাঁহার সম্বন্ধে সত্যই বলা যায়—‘কুলং পবিত্রং জননী চ কৃতার্থা’। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব-গৌরবে তাঁহার মাতৃভূমি ভারতবর্ষে বিশ্বমানব-সভায় কী পরিমাণে উন্নীত ও গৌরবান্বিত হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। যাঁহারা ভারতের বাহিরে বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে একটু অভিজ্ঞতা অর্জন করিবার সুযোগ পাইয়াছেন তাঁহারাই জানেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়িয়া ভারতের সংস্কৃতির প্রতি এবং সঙ্গে সঙ্গে ভারতবাসীর প্রতি পৃথিবীর নানা দেশের লোকেদের মনে কতটা গভীর শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতি জাগিয়াছে। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ছিল আমাদের সমগ্র ভারতবর্ষের পক্ষে এক অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদের সম্বন্ধে বহু বিদেশী সহৃদয় ব্যক্তি সচেতন ছিলেন—আমাদের সকলে হয়তো ইহার মূল্য ততটা বুঝি না বা বুঝিতাম না। আমেরিকার একজন বিখ্যাত লেখক উইল ড্যুরাণ্ট রবীন্দ্রনাথকে স্বরচিত একখানি বই একবার পাঠাইয়া দেন, সেই বইয়ের ভিতরে তিনি স্বহস্তে রবীন্দ্রনাথের নামে সমর্পণ লিখিয়া দেন—‘You are the reason why India should be free,’ অর্থাৎ ‘তুমি যে আছ, ইহাই ভারতের পক্ষে স্বাধীন হইবার জন্য প্রধান কারণ বা দাবী।’ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মালয়-উপদ্বীপ, যবদ্বীপ, বলিদ্বীপ ও শ্যামদেশ ভ্রমণ করিয়া আসিবার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার ঘটিয়াছিল। সেই সময়ে বলিদ্বীপের প্রধান ডচ রাজপুরুষ শ্রীযুক্ত কারন আমায় বলিয়াছিলেন:০
আপনারা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আছেন; দেখিবেন, উহার স্বাস্থ্যের কোনো হানি যেন না হয়; আপনাদের দায়িত্ব বিশেষ গুরুভার, কারণ রবীন্দ্রনাথ কেবল আপনাদের দেশের নহে, উনি সমগ্র মানবজাতির।’
আমার একজন মহারাষ্ট্রীয় বন্ধু ফ্রান্সে অবস্থান-কালে আমায় বলিয়াছিলেন:
He has been the greatest ambassador any country could have—he has been the greatest ambassador of India whose services have rendered her high and great among nations.
অর্থাৎ,
‘রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড়ো রাজদূত পৃথিবীর কোনো দেশের ভাগ্যে ঘটে না; ভারতবর্ষের পক্ষে এঁর চেয়ে রাজদূত আর কখনো হয় নি, এঁর উপস্থিতিতে আর কার্য্যে বিশ্বের তাবৎ জাতির মধ্যে ভারতের স্থান উঁচুতে উঠেছে আর মহৎ হয়েছে।’
এই কথাটি অতি খাঁটি কথা। ইংল্যাণ্ড বা আমেরিকার শক্তি আর ঐশ্বর্যের কারণেই ইংরেজ বা মার্কিন জাতির লোক যেখানে বিশ্ব-জনসভায় খাতির পায়, সেখানে বিজিত, পরাধীন, নিজ বাসভূমেও পরবাসী ভারতবাসী সম্মানের আসন পাইয়াছে,—ইহা বহুবার দেখা গিয়াছে; সম্মান পাইয়াছে জনসাধারণের নিকটে—রাজনৈতিক দরবারে হয়তো ভারতের স্থান নাই, কিন্তু ভারতবাসী পাইয়াছে জনগণের হৃদয় হইতে স্বতঃ-উৎসারিত প্রীতি ও সম্মাননা। কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁহার কাব্য, উপন্যাস এবং জ্ঞান ও চিন্তাগর্ভ প্রবন্ধের মধ্য দিয়া, তাঁহার গীতিকবিতায় এবং নাটকের মানবিকতা ও তাঁহার আনুষঙ্গিক রহস্যবোধের অপূর্ব সৌন্দর্যের মধ্য দিয়া, ইউরোপ, এশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া-ওশেনিয়া এই পাঁচটি মহাদেশের বিভিন্ন জাতির মানবের মনের মধ্যে নিজের আসন করিয়া লইয়াছেন; ভারতের সনাতন আকাঙ্ক্ষা তাঁহার লেখায় মূর্তি পাইয়াছে এবং তাহার মধ্যে বিশ্বমানবও তাঁহার নিজের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষাকে দেখিতে পাইয়াছে। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রতি, তাঁহার ভারতীয় সাধনার আদর্শের প্রতি, তাঁহার জাতির প্রতি, নানা দেশের মানুষের এতখানি দরদ।
আমি নিজের জীবনে বিদেশ-ভ্রমণকালে ছোটো-বড়ো নানা অভিজ্ঞতা হইতে এই প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করিয়াছি—রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার সমজাতিত্ব আছে বলিয়া, রবীন্দ্রনাথের দেশেরই মানুষ আমি, সেইজন্য আমার কদর কতটা বাড়িয়া গিয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এই শ্রদ্ধার ভাব জগতে বাড়িতেছে বই কমিতেছে না। ১৯২২ সালে ছাত্রাবস্থায় যেমনটি দেখিয়াছিলাম, ১৯৩৮ সালেও সেই ভাবই দেখিয়াছি, এখনও সব দেশে লোকে তাঁহার বই পড়িয়া আনন্দ লাভ করিয়া থাকে, আধ্যাত্মিক ও মানসিক আনন্দ, শক্তি ও শান্তি পায়; তিনি কেবল হুজুগের বা ফ্যাশনের ঢেউয়ের মাথায় দুই দিনের বা দুই বছরের জন্য ইউরোপ-আমেরিকা-চীন-জাপানের চিত্ত জয় করিয়া পরে চিরবিদায় লন নাই; এখন তাঁহাকে লোকে মনের নিভৃত কোণে শ্রদ্ধার সিংহাসনে বসাইয়া রাখিয়াছে; তাঁহাকে না পাইয়া, ব্যক্তিগতভাবে তাঁহার সান্নিধ্যে আসিতে না পারিয়া, তাঁহার দেশবাসীকে পাইয়া তাঁহার প্রতি সেই শ্রদ্ধা নিবেদন যেন ঐ নগণ্য দেশবাসীর মারফতই করিতে চাহিতেছে। আমি ১৯২২ সালের একটি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার কথা বলিব; তাহা হইতে বুঝা যাইবে, আমাদের ভারতের সম্মানবর্ধনকারী কত বড়ো রাজদূত হইয়া রবীন্দ্রনাথ দেশ হইতে দেশান্তরে ভ্রমণ করিয়া গিয়াছেন, দেশ হইতে দেশান্তরে তাঁহার বাণী পাঠাইয়াছেন।
১৯২২ সালে মে-জুন-জুলাই মাসে আমি ইটালি ও গ্রীসদেশে ভ্রমণ করি। জুলাই মাসে আমি ইটালির ভেনিস নগরে গ্রীক কনসাল বা রাষ্ট্র-প্রতিনিধির দপ্তরে গিয়া গ্রীসদেশে অবতরণের ও গ্রীস-ভ্রমণের অনুমতির জন্য উপস্থিত হইব স্থির করি। ইংরেজ সরকারের তরফ হইতে যে পাসপোর্ট অর্থাৎ রাষ্ট্র-পরিচয়পত্র আমার ছিল, তাহাতে প্রথমতঃ লণ্ডনের ব্রিটিশ পররাষ্ট্র বিভাগের নির্দেশ ও ছাপ করাইয়া লই যে, আমায় গ্রীস দেশে ভ্রমণ করিতে দিতে ব্রিটিশ সরকারের আপত্তি নাই। সেই নির্দেশ দেখাইয়া তবে যে দেশে যাইতেছি সেই দেশের অনুমতি লইতে হইবে। গ্রীক কনসালের আপিসে গিয়া যথানির্দিষ্ট শুল্ক বা মাশুল দিয়া, আমার পাসপোর্টে ছাপ লইতে হইবে যে আমি অবাধে গ্রীস দেশে ভ্রমণ করিতে পারি; অন্যথায় সে-দেশে আমাকে নামিতেই দিবে না। ভেনিস শহরে গ্রীক কনসালের আপিস খুঁজিয়া বাহির করিলাম। একটি পুরাতন ইটালীয় বাড়িতে দোতলায় দুই-তিনটি ঘর লইয়া আপিস। গ্রীষ্মকাল, ইটালির সূর্য যেন আমাদের দেশের মতনই প্রখর। তখন বেলা প্রায় বারোটা বাজে। এখন ফ্রান্স ইটালি প্রভৃতি বহু ইউরোপীয় দেশে এইরূপ নিয়ম আছে যে, আপিস-আদালত-ইস্কুল-কলেজ প্রভৃতি সকালে নয়টা হইতে বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে, তাহার পরে বারোটায় সব বন্ধ হইয়া যায়, আবার খোলে সেই দুইটায় বা তিনটায়, তার পরে পাঁচটা বা ছয়টা পর্য্যন্ত খোলা থাকে। মাঝে এই বন্ধের দুই-তিন ঘণ্টা সকলে মাধ্যাহ্নিক ভোজন ও বিশ্রামে অতিবাহিত করে। গ্রীক কনসালের আপিস তখন বন্ধ হইবার সময়; জানালাগুলি বন্ধ হইতেছে। তখনই আমার কাজটুকু সারিয়া না গেলে সেই রৌদ্রে আমাকে আবার দুই বা আড়াই ঘণ্টা পরে ফিরিয়া আসিতে হয়। কপাল ঠুকিয়া দোতলায় উঠিয়া আপিস-ঘরের রুদ্ধ দ্বারের বাহিরের ঘণ্টার দড়ি ধরিয়া টান দিলাম। ভিতরে ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল, অত্যন্ত অপ্রসন্ন মুখে একজন ইটালীয় চাকর বাহিরে আসিয়া বলিল, ‘দেখিতেছেন না, বারোটা বাজে, আপিস এখন বন্ধ হইতেছে, সেই বিকালে আসিবেন।’ আমি তখন দোর্দন্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ জাতির নাম লইলাম—বলিলাম, ‘কনসালকে বলো গিয়ে, আমার ইংরেজ সরকারের পাসপোর্ট আছে’। অর্থাৎ ইংরেজ জাতির সম্মাননা গ্রীসকে করিতে হইবে। কনসালের চাকর ফিরিয়া গেল, একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘আমাদের কনসাল ইংরেজি বলতে পারেন না’। আমি নাছোড়বান্দা, বলিলাম, ‘Parla francese? parla alemana? পার্লা ফ্রাঞ্চেস? পার্লা আলেমানা? তিনি ফরাসী বলেন? জরমান বলেন?’ সভ্য ভাষা, আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি, ফরাসী, জরমান—এই তিনটার একটাও তো জানা উচিত। ভৃত্য এবার গিয়া কনসালকে বলিল। ফিরিয়া আসিয়া আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া কনসাল সাহেবের সামনে হাজির করিল। তখন দেখি ঘরের জানালা বন্ধ, ঘর অন্ধকার, কনসালও মধ্যাহ্নভোজনের জন্য ছড়ি টুপি লইয়া বাহিরে যাইবার জন্য প্রস্তুত; কিন্তু কী করেন, ইংরেজ সরকারের দোহাই পাওয়ায় অগত্যা কোনো ইংরেজপুঙ্গবের খেদমতের জন্য হাজির রহিয়াছেন নিতান্ত অখুশী মনে। কিন্তু আমাকে দেখিয়াই ফরাসীতে বলিলেন, ‘ah, mais vous n’etes pas anglais ! আ, মে ভু নেৎ পাষাঁগলে! আঃ, কই, আপনি তো ইংরেজ নন!’ উত্তরে বলিলাম, ‘না, আমি ভারতীয়’। শুনিয়াই ভদ্রলোক উচ্ছ্বসিতভাবে বলিলেন, ‘ভারতীয়! বসুন মশায়, বসুন! আমি রাবীন্দ্রানাত তাগোরের বই পড়েছি!’ আমি ভারতীয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশের লোক, এই পরিচয় যেন যথেষ্ট; আমাকে ভদ্রলোক অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে গ্রহণ করিলেন। ফরাসীতে তাঁহার সঙ্গে আলাপ হইল; দেখিলাম, তিনি আমাদের সংস্কৃত ‘রামাইয়ানা’ আর ‘মাখাবারাতা’-র-ও খবর রাখেন, তাঁহার দেশের একজন বড়ো কবি আধুনিক গ্রীক ভাষায় ‘নালাস’ আর ‘দামাইয়ান্দী’-র কাহিনী মূল সংস্কৃত হইতে অনুবাদ করিয়াছেন সে-কথা বলিলেন;—আর রবীন্দ্রনাথের লেখার সম্বন্ধে তাঁহার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। তাঁহাদের শ্রেষ্ঠ কবি একজন ইংরেজি থেকে গ্রীকে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি, গার্ডনার, আর সাধনা-র অনুবাদ করিয়াছেন। ভদ্রলোক তখনই আমার পাসপোর্ট-এ ছাপ দিয়া দিলেন, আইন-মোতাবেক যথাকর্তব্য তখনই চুকাইয়া দিলেন; উপরন্তু গ্রীসের রাজধানী আথেন্সে দুই একটি শস্তা অথচ ভদ্র হোটেলের ঠিকানা দিলেন, গ্রীসে ভ্রমণ সম্বন্ধে নানা উপদেশ দিলেন, আর নানা বিষয়ে খানিক আলাপ করিলেন। প্রায় ৪০ মিনিট এইভাবে সদালাপ ও শিষ্টাচার করিলেন—রবীন্দ্রনাথের দেশের লোক পাইয়াছেন বলিয়া। এই ঘটনা হইতে বুঝিতে পারা গেল, রবীন্দ্রনাথের মতো দেশগৌরব ভারত-সন্তানের কল্যাণে ভারতবর্ষের জনসাধারণ কতটা মর্যাদার এবং হৃদ্যতার অধিকারী হইতে পারে।
এরূপ দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি দেওয়া যায়। যাঁহারাই ইদানীং বিদেশ ভ্রমণ করিয়াছেন ও করিতেছেন, তাঁহারা সকলেই এই প্রকারের অভিজ্ঞতার কথা বলিতে পারেন। ‘বাকপতি’ রবীন্দ্রনাথ, ‘কবিগুরু’, ‘কবি-সম্রাট’, ‘কবি-সার্বভৌম’ রবীন্দ্রনাথ, ‘সমগ্র এশিয়া-খন্ডের Poet Laureate বা ‘রাজকবি’ রবীন্দ্রনাথ, ‘ভারত-ভাস্কর’ রবীন্দ্রনাথ, ‘দেশনেতা’ বা ‘রাষ্ট্রনেতা’ রবীন্দ্রনাথ, ‘বিশ্বমানবিকতার অগ্রদূত’ রবীন্দ্রনাথ, ‘জন-গণ-মন-অধিনায়ক’ রবীন্দ্রনাথ, ‘কর্মী’ রবীন্দ্রনাথ, ‘শিক্ষাব্রতী’ রবীন্দ্রনাথ, ‘সংগীত-নায়ক’ রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের বহুবিধ পরিচয় আছে; এগুলির কৃতিত্ব তাঁহার দেশ, সমাজ ও যুগকে উজ্জ্বল করিয়াছে; এগুলির মধ্যে ‘ভারত-রাজদূত’ রবীন্দ্রনাথের অবদান ও কৃতিত্ব কিছু কম নহে। রবীন্দ্রনাথ তাঁহার রচনার মধ্যে, তাঁহার কাব্য, গান, গানের সুর, চিত্র, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধাদির মধ্যে, তাঁহার বিশ্বভারতী শ্রীনিকেতনের মধ্যে চিরজীবী হইয়া থাকিবেন; কিন্তু জীবৎকালে তাঁহার সাহিত্যিক কৃতিত্বের পার্শ্বে তাঁহার জীবন্ত ব্যক্তিত্ব ভারতকে ও ভারতবাসীকে যেভাবে বাহিরের জগতের গৌরব ও মর্য্যাদা দিয়া গিয়াছে, ভারত ও ভারতবাসী তাঁহার তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে তাহা হইতে অনেকটা বঞ্চিত হইতে চলিল। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকে আমাদের লাভ-লোকসান-খতানো পাটোয়ারী বুদ্ধি অনুসারে আমরা যেন না দেখি; কিন্তু রবীন্দ্রের অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গৌরবও যে কতটা ম্লান হইল, তাহা মনে করিয়া, এই গুরুতর দুর্ভাগ্যের গুরুত্ব সমগ্র ভারতীয় জাতির দিক হইতে কতকটা যেন আমরা উপলব্ধি করিতে পারি।
ভারতবর্ষ, আশ্বিন, ১৩৪৮