রবীন্দ্রনাথ ও বাঙলাভাষা
১৯১৩ সালে কলকাতায় এম এ পাস করি। বিষয় ছিল ইংরিজি। এম এ পরীক্ষার জন্য ইংরিজি পড়ার যে ব্যবস্থা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, তাতে বিষয়টি দুটি পৃথক ভাগে ভাগ করা হয়েছে—এক, শুদ্ধ আধুনিক ইংরিজি সাহিত্য, আর দুই, প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইংরিজি সাহিত্য আর ইংরিজি ভাষাতত্ত্ব। কলেজে পড়তে পড়তে সাহিত্যের চাইতে ভাষাতত্ত্বের প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করি। একটু গুন্ডাপ্রকৃতির ছিলুম—ব্যায়াম করা, দৌড়ধাব, ধাক্কাধুক্কি, এইসবে প্রবৃত্তি ছিল। আমাদের সঙ্গে কতকগুলি সহপাঠী ছিলেন, তাঁরা অতি মোলায়েম প্রকৃতির, বসে বসে কবিতা লিখতেন আর কবিতা পড়তেন, আর তাঁদের কারও কারও চালচলনে কথাবার্তার ধরনে যেন একটি অত্যন্ত সুকুমার ভাব তাঁরা প্রকট করতেন। এটা আমার ভালো লাগত না—যখন এইসব সহপাঠী চোখে একটু উদভ্রান্ত কবি-কবি দৃষ্টি নিয়ে ঘাড় কাত করে ইংরিজি আর বাঙলা নানারকম সাহিত্যিক বুকনি প্রয়োগ করতে করতে, Shelley, Epipsychidion আর The Ideal আর ‘মানসী মূর্তি’ আর ‘ভাবের সংঘাত’ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন, সেসব বুঝতুম না—তাঁদের আমি ঠাট্টা করে বলতুম, ‘তোমাদের শেলির দল আমাকে গথিক ভাষার ব্যাকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ যাই হোক, নিছক সাহিত্যের চেয়ে, জটিল আধুনিক সাহিত্যের চেয়ে সহজবোধ্য প্রাচীন সাহিত্য আর ভাষাতত্ত্বের কচ্চায়ন এই দুটির দিকেই একটু ঝোঁক আসে, এবং কখন অজ্ঞাতসারে ভাষার আলোচনাতেই একটা রস পেতে থাকি। সেইজন্যে ইংরিজিতে এম এ পড়বার কালে আমি প্রাচীন আর মধ্যযুগের ইংরিজি সাহিত্য আর ইংরিজি ভাষার নাড়ীনক্ষত্রের কথা খুব আগ্রহ করে স্বীকার করে নিই। দু-বচ্ছর এম এ পড়বার সময়ে, ইংরিজি ভাষাতত্ত্বের খুঁটিনাটি আমাকে ভালো করেই আয়ত্ত করতে হয়। এবং সেই সময়ে একটি জিনিস দেখে মনে আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে—ইউরোপের লোকেরা নিজেদের ভাষা, যেমন ইংরিজি, জার্মান, ফরাসি, কী নিষ্ঠার সঙ্গে কেমন গভীরভাবে আলোচনা করেছে আর তার নষ্টকোষ্ঠী কত কষ্ট করে বার করেছে, তাদের মধ্যে যা-কিছু অজানা ছিল তার সব-ই তারা যেন প্রকাশ করে দিতে পেরেছে। আমার মনে এই দেখে একটা হিংসের ভাবও জাগত, আর একটা প্রবল ইচ্ছাও হত, এইভাবে আমার মাতৃভাষার ইতিহাসের উদ্ধার হয় না! আমাদের ভাষার প্রকৃতি আর বিকৃতি, আর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার গতিশীল ধারার ইতিহাস আমরা তো কিছুই জানি না! মনে একটা উৎকট আগ্রহ হত, আমরা আমাদের ভাষার নানা ব্যাসকূটের সমাধান করতে কবে পারবো! তখন থেকেই মনে এই ইচ্ছা যেন পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছিল, ইংরিজিতে এম এ পরীক্ষায় পাস করেই মাতৃভাষা বাঙলার ভিতরকার কথা খুঁজে বার করতে হবে।
ভারতবর্ষে এখন থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে পাণিনির উদ্ভব হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষার নিজস্ব রূপ যেটি আছে, সেটির অভূতপূর্ব বিশ্লেষণ পাণিনি করে দিয়ে গিয়েছেন। সংস্কৃত ভাষায় এই নিয়ম কাজ করছে, ভাষার ধ্বনি আর প্রত্যয়গুলির প্রয়োগ এইভাবে হচ্ছে, এইসব নিয়ম সর্বত্রই কার্যকরী, আবার এই নিয়মগুলির প্রতিষেধও আছে, আবার এইসব নিয়মের বিরোধী অনেক বৈশিষ্ট্যও আছে—সংস্কৃত ভাষায় যা আছে, তার একখানি সর্বগ্রাহী নিখুঁত বর্ণনা পাণিনি ব্যাকরণে পাই। কিন্তু সংস্কৃত ভাষার গঠনে এমন অনেক জিনিস আছে, যা কোনো নিয়ম মানে না, আমাদের প্রাচীন বৈয়াকরণেরা তার উল্লেখ করলেও তার কারণ নির্দেশ করেননি। ‘এইরকমটি হয়, এইরকম আদেশ আছে’—এই বলেই তাঁরা ক্ষান্ত হয়েছেন। কিন্তু আধুনিক ভাষাতত্ত্ব বা বাকতত্ত্ব বিদ্যার যে নবীন বিচার আর প্রয়োগ গত দেড়শো বছরের মধ্যে গড়ে উঠেছে, তার এক নূতন দৃষ্টিভঙ্গী ক্রমে নির্ধারিত হয়েছে। আধুনিক বাকতত্ত্বের বিচারের সাহায্যে, সংস্কৃত ব্যাকরণ বা অন্য ভাষার ব্যাকরণের তথাকথিত নিয়ম-বহির্ভূত নানা ব্যাপারের একটা কারণ নির্দেশও সম্ভবপর হয়েছে। এইভাবে প্রাচীন বৈয়াকরণের বস্তুনিষ্ঠ পরিপূর্ণ আলোচনা একদিকে, আর একদিকে আধুনিক তুলনাত্মক বাকতত্ত্বের সাহায্যে আভ্যন্তর কারণ নির্দেশ, তাতে অনিয়মেরও নিয়ম পাওয়া যায়, এই দুইয়ের সঙ্গেই একটু পরিচিত হবার সুযোগ আমার এই ছাত্রাবস্থায় হয়েছিল। এম এ পাস করবার পর এল ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’। সৌভাগ্যবশতঃ ভালো কাজও পেয়ে গেলুম—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পাঠভবনের ইংরিজি বিভাগে প্রাচীন ইংরিজি সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্ব পড়ানো হল আমার ব্যবসায়। পড়াতে গেলেই লোকে শিখতে আরম্ভ করে, আমারও তাই হল। ইংরিজির সঙ্গে সঙ্গে নিবিষ্টচিত্তে পড়তে লাগলুম অন্যান্য ভাষা। ক্রমে ভারতের আধুনিক ভাষা আর অন্যান্য ভাষা, তা ছাড়া সংস্কৃত আর প্রাকৃতের ভাষাতত্ত্ব, আর ভারতের অনার্যভাষা প্রভৃতির মোহে পড়ে গেলুম।
এই কাজে নেমেই প্রথমেই জানবার আগ্রহ হল—আমাদের দেশের পূর্বাচার্যেরা ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে কী কাজ করেছেন। সংস্কৃত ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে পাণিনি ও তাঁর পূর্বগামী ও অনুগামীরা যা করেছেন তা তো আছেই। তা ছাড়া আধুনিক তুলনাত্মক গবেষণাও আমাদের সামনে আছে। কিন্তু আধুনিক ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে, যেটি আমার প্রধান উপজীব্য করে নিতে চাই সে-বিষয়ে কী কাজ হয়েছে? পুরোনো বাঙলা ব্যাকরণ খুঁজতে লাগলুম। হ্যালহেডের বাঙলা ব্যাকরণ, যেটি ১৭৭৮ সালে ছাপা, মানোএল দা-আসসুম্পসাওঁ-এর পর্তুগীজ ভাষায় লেখা বাঙলা ব্যাকরণ ১৭৪৩ সালে লিসবনে ছাপা, রামমোহনের ব্যাকরণ ১৮৩৩ সালে ছাপা, কেরী সাহেবের বই, শ্যামাচরণ সরকারের লেখা বিরাট বাঙলা ব্যাকরণ, চিন্তামণি গাঙ্গুলী আর পরে নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ এঁদের লেখা বাঙলা ব্যাকরণ—এসব দেখলুম। কিন্তু মনে হল রামমোহন আর নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ ছাড়া আর কেউ বাঙলা ভাষার ভিতরকার প্রকৃতি ধরতে পারেন নি, বা সেদিকে নজর দেননি।
এমন সময় পেয়ে গেলুম রবীন্দ্রনাথের বাঙলা-ভাষাতত্ত্ব-বিষয়ক প্রবন্ধের সংগ্রহ শব্দতত্ত্ব। এগুলির মধ্যে একটি জিনিস দেখে মনে মনে কবির সমীক্ষাশক্তির শত-সহস্র সাধুবাদ দিতে লাগলুম। এমন করে তাঁর পূর্বে বাঙলা ভাষার বৈশিষ্ট্য আর কারও তো চোখে পড়েনি! আর বৈশিষ্ট্যগুলি শুধু যে ধরেছেন তা নয়, বৈশিষ্ট্যগুলি কেমনভাবে কাজ করছে সে-বিষয়ে যেন তাঁর একটা দিব্য দৃষ্টি এসে গিয়েছে। ইউরোপের যেসব ভাষাতত্ত্বের পন্ডিত, সাধারণ ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের অনুসৃত পদ্ধতি তো আমার জন্যে তৈরিই ছিল। তা ছাড়া, সহজ মোটা কথা যা আমরা সকলেই জানি, তার ভিতরে কী সূক্ষ্ম ধ্বনি বিষয়ক বা ভাব বিষয়ক রীতি কাজ করছে সেটা আমাদের কাছে এ পর্যন্ত অজ্ঞাত থাকছিল, তার কতকগুলি বিষয়ে ইঙ্গিত রবীন্দ্রনাথেই পাওয়া গেল। এইজন্যেই আমার মনে হল যে, বাঙলা ভাষাতত্ত্বের বা বাঙলাভাষার ইতিহাসের আলোচকদের মধ্যে একজন পাইওনিয়র বা অগ্রণী পথিকৃৎ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বারো বৎসরের পরিশ্রমের পরে যখন আমার বড়ো বই Origin and Development of the Bengali Language কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃপায় প্রকাশিত হল, তার ভূমিকায় এই কথা লিখেছিলুম :
The first Bengali with a scientific insight to attack the problems of the language was the poet Rabindranath Tagore, and it is flattering for the votaries of Philology to find in one who is the greatest writer in the language, and a great poet and seer for all time, a keen philologist as well, distinguished alike by an assiduous enquiry into the facts of the language and by a scholarly appreciation of the methods and findings of the modern Western philologist. The work of Rabindranath is in the shape of a few essays (now collected in one volume) on Bengali phonetics, Bengali onomatopoetics, and on the Bengali noun, and on other topics, the earliest of which appeared in the early nineties, and some fresh papers appeared only several years ago. The papers may be said to have shown to the Bengali enquiring into the problems of his language the proper lines of approaching them.
যাঁরা কেবল ব্যাকরণ নিয়ে চর্চা করেন, অনেক সময় তাঁরা ‘সাহিত্য’ বোঝেন না। ‘সাহিত্য’ শব্দের ব্যাখ্যা কেউ কেউ করেছেন—‘যা কেবল ব্যাকরণের সহিত পড়া যায়’। নিছক ব্যাকরণকারকে সংস্কৃতে ‘শাব্দিক’ বলা হয়—শব্দ আর শব্দের বাহ্যরূপ নিয়েই যাঁদের কারবার। ‘শাব্দিক’ আর ‘রসিক’ এ দুজনের মধ্যে চিরন্তন বিবাদ। খ্রিস্টীয় ১৬৫০ সালের দিকে তামিল দেশের পন্ডিত নীলকন্ঠ দীক্ষিত তাঁর শিবলীলার্ণব নামে সংস্কৃত কাব্যের প্রথম সর্গে শাব্দিক আর তার্কিকদের বেশ একহাত নিয়েছেন। তাঁর সংস্কৃত শ্লোকগুলি বেশ উপভোগ্য। একটি শ্লোকে তিনি বলছেন—
স্তোতুং প্রবৃত্তা শ্রুতির ঈশ্বরং হিন
শাব্দিকং প্রাহ,ন তার্কিকং বা।
ব্রুতে তু তাবৎ কবিরিত্যভীক্ষ্ণং,
কাষ্ঠা পরা সা কবিতা ততো নঃ।।
শ্রুতি অর্থাৎ বেদ ঈশ্বরের স্তব করতে প্রবৃত্ত হয়ে তাঁকে কখনো শাব্দিকও বলে নি, তার্কিকও বলে নি, সর্বদা তাঁকে ‘কবি’ বলেই বর্ণনা করেছে। এইজন্য আমাদের পক্ষে কবিতাই হচ্ছে পরাকাষ্ঠা।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক অদ্ভুত সমন্বয় দেখতে পাই—তিনি শাব্দিকও বটেন, কবিও বটেন। শব্দ আর অর্থ, উচ্চারিত ধ্বনি আর তার ভিতরের ব্যঞ্জনা, এই দুইয়ের সম্বন্ধেই কবির মনে স্পর্শকাতরতা ছিল। ভাষার নাড়ীনক্ষত্র সম্বন্ধে তাঁর মনে জিজ্ঞাসা ছিল, কিন্তু সে-নাড়ীনক্ষত্রের জ্ঞানটাই চরম বস্তু নয়, সে-কথাটা তিনি তাঁর সৃজনী প্রতিভার দ্বারা দেখিয়ে গিয়েছেন। প্রাচীন ভারতের কবি আর সমালোচক রাজশেখর, যিনি খ্রিস্টীয় নবম শতকের লোক ছিলেন, তাঁর কাব্য মীমাংসা-য় বলে গিয়েছেন, সাহিত্য-রচয়িতার প্রতিভা দুই প্রকারের,—এক, ‘কারয়িত্রী’—যা সাহিত্য সৃষ্টি করে; আর দুই, ‘ভাবয়িত্রী’—যা বিচার করে, সমালোচনা করে, উপভোগ করে। এই উভয়বিধ প্রতিভাই যে রবীন্দ্রনাথের ছিল, তা বলা বাহুল্য। তা ছাড়া, শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণিয়ার যোগ্য বৈজ্ঞানিক মনোভাবও তাঁর ছিল। যাঁরা কেবল ব্যাকরণের ছোবড়া নিয়েই কারবার করেন, তাঁরা ব্যাকরণের খুঁটিনাটি আর প্রয়োগের আইনকানুন নিয়েই মাতামাতি করেন, লেখকদের ধমকও দেন। আমাদের দেশে বহুকাল ধরে এই ধারণা চলে আসছিল যে, বাঙলা ভাষা আর বাঙলা ব্যাকরণের নিকষ হচ্ছে সংস্কৃত ভাষা আর সংস্কৃত ব্যাকরণ। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক দুজন বিশিষ্ট পন্ডিত বাঙলা দেশে দেখা দিয়েছিলেন, যাঁরা বাঙলা ভাষার বিশিষ্ট প্রকৃতি ধরবার চেষ্টা করেছিলেন আর জোর গলায় বলেছিলেন যে, সংস্কৃতের সব নিয়ম বাঙলায় চলবে না, বাঙলার নিজস্ব স্বরূপটিকে ধরে দিতে হবে, যেটি বাঙলাকে চিরকাল ধরে সংস্কৃতের সঙ্গে এক দড়িতে বেঁধে রাখবে না। এই দুজন মনীষী হচ্ছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) আর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯)। রবীন্দ্রনাথ ঠিক এঁদের পথেরই পথিক ছিলেন, আর মনে হয় এঁদের চেয়ে আগেই এদিকে তাঁর দৃষ্টি পড়েছিল। ভাষাতাত্ত্বিক, শাব্দিক বা ব্যাকরণিয়া ঢঙের বিচার বা মন্তব্য আর নিষ্কর্ষ বা সমাধান তাঁর প্রথমদিকের কতকগুলি বাঙলা প্রবন্ধে পাওয়া যায়। এই প্রবন্ধগুলির পত্তন হয় ১৮৮৫ সালে। আর এই প্রবন্ধমালার শেষ প্রবন্ধ বার হয় ১৯৩৮ সালে, যখন বাঙলা ভাষা সম্বন্ধে দ্বিতীয় গ্রন্থ বাঙলাভাষা-পরিচয় নামে সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয়। ১৮৮৫ সাল থেকে কয়েক বছর ধরে মাঝে মাঝে প্রবন্ধে বাঙলা ভাষায় কয়েকটি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন। সেই প্রবন্ধগুলির অধিকাংশ পরে শব্দতত্ত্ব নামে বার হয় ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে। এর পরেও কতকগুলি প্রবন্ধ প্রবাসী ও অন্যত্র বেরোতে থাকে, আর তা ছাড়া বাঙলা ছন্দের উপর তিনি কতকগুলি প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় বার করেন। রবীন্দ্রনাথের অন্য সব রচনার তুলনায় এই প্রবন্ধগুলি সাকুল্যে খুব একটা বড়ো ব্যাপার নয়। কিন্তু সেগুলির মধ্যে বাঙলা ভাষার প্রকৃতি, আর বাঙলা ভাষার রীতি আর পদ্ধতি, আর উচ্চারণগত নাম আর ক্রিয়ার রূপগত, আর শব্দগত বৈশিষ্ট্য তিনি আবিষ্কার করেন আর ধরে দিয়ে যান। তাঁর আগে এগুলিকে এভাবে কেউ লক্ষ্য করেন নি। শব্দতত্ত্ব-তে সংকলিত প্রবন্ধগুলিকে বাঙলা ভাষাতত্ত্ব আলোচনায় এক হিসাবে প্রথম বৈজ্ঞানিক রচনা বলা যায়। এই প্রবন্ধগুলির মধ্যে যেকোনো ভাষার চারটি মুখ্য বিভাগের সবগুলির সম্বন্ধেই কিছু-না-কিছু নূতন কথা আছে। এই চারটি বিভাগ হল—(১) উচ্চারণ-বানান-ছন্দ—ধ্বনিতত্ত্ব; (২) সুপ-তিঙ-কৃৎ-তদ্ধিত—রূপতত্ত্ব আর শব্দসাধন; (৩) বাক্যে শব্দের স্থান বা ক্রম—বাক্যরীতি; আর এ ছাড়া আছে (৪) শব্দের ইতিহাস আর শব্দের অর্থ নিয়ে বিচার। বাঙলা উচ্চারণ বিষয়ক প্রবন্ধে আলোচনা আছে, কলকাতার চলতি বাঙলা -টা-টো-টে নিয়ে—যেমন সাধুভাষায় -টা প্রত্যয়ের চলিত-ভাষায় তিনটি রূপ—সাধুভাষায় ‘একটা, দুইটা, তিনটা’, কিন্তু চলিতভাষায় ‘একটা, দুটো, তিনটে’; বাঙলার কতকগুলি স্বরধ্বনির উচ্চারণ, আর তা ছাড়া বাঙলা আর আধুনিক ভারতীয় ভাষার ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রকৃতি নিয়ে বিচার,—এগুলি একেবারে নূতন ঢঙের আলোচনা। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মহাশয় বাঙলা ধ্বন্যাত্মক শব্দের আলোচনাকে সম্পূর্ণ করেন ১৩১৪ সালে সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা-য় প্রকাশিত ‘ধ্বনিবিচার’ নামে এক উপাদেয় বহু তথ্য ও বিচারপূর্ণ প্রবন্ধে। ‘বাঙলা শব্দদ্বৈত’, ‘বাঙলা কৃৎ ও তদ্ধিত’, ‘সম্বন্ধে-কার’ আর ‘বাঙলা বহুবচন’—এই কয়টি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বাঙলা রূপতত্ত্ব আর শব্দসাধনের ঐতিহাসিক আলোচনা করবার চেষ্টা করেন। ‘ভাষার ইঙ্গিত’ প্রবন্ধে আবার বাঙলা ভাষার শব্দের দ্যোতনা নিয়ে তিনি কতকগুলি মূল্যবান কথা বলেছেন।
রবীন্দ্রনাথ উত্তরকালে ১৯৩৮ সালে রচিত আর প্রকাশিত তাঁর বাঙলাভাষা-পরিচয় বইয়ে বাঙলা ভাষার প্রকৃতি আর রীতি সম্বন্ধে আরও কতকগুলি ভাববার কথা বলে গিয়েছেন। এই বইয়ে তিনি প্রথমেই ভূমিকাতে তাঁর ভাষাতত্ত্ব আলোচনার প্রেরণা সম্বন্ধে আমাদের ব’লছেন যে, ‘মানুষের মনোভাব ভাষাজগতের যে অদ্ভুত রহস্য আমার মনকে বিস্ময়ে অভিভূত করে, তারি ব্যাখ্যা করে এই বইটি আরম্ভ করেছি।’ দেখা যাচ্ছে, এইখানে রবীন্দ্রনাথের মনে আছে—ভাষা সম্বন্ধে রহস্যবোধ, আর সঙ্গে সঙ্গে ভাষার ব্যাখ্যার চেষ্টা। এই দুটি জিনিস মিলে, একদিকে তাঁর রস-রচনা আর অন্যদিকে তাঁর ভাষাঘটিত রচনা, এই দুই-ই আমাদের মনে একটা কৌতূহল আর তার সঙ্গে সঙ্গে আত্মতৃপ্তি এনে দেয়। সত্যকার যিনি জ্ঞানী, তাঁর মনের মধ্যে একটা বিনয়বোধ থাকে। রবীন্দ্রনাথ বাঙলা ভাষার বিরাট ইতিহাস লিখতে বসেন নি, যদি বসতেন তাহলে হয়তো সে-ইতিহাস বিজ্ঞানসমৃদ্ধ হত, আর মুষ্টিমেয় ভাষাবিজ্ঞানী তাঁদের সংকীর্ণ গোষ্ঠীতে বসে তা নিয়ে কচ্চায়ন করে আনন্দ পেতেন; কিন্তু বিশ্বমানব রবীন্দ্রনাথের রসসৃষ্টি থেকে তাহলে হয়তো বঞ্চিত হত। সেটা মানুষের পক্ষে এক পরম দুর্ভাগ্য হত। কিন্তু বিজ্ঞান-সমৃদ্ধ ইতিহাস না লিখলেও তিনি প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক অনুপ্রেরণা যুগিয়ে গিয়েছেন এই প্রবন্ধগুলিতে। রবীন্দ্রনাথ যেন তাঁর নিজের সম্বন্ধে আক্ষেপ করেই বলেছেন, তিনি ভাষা-সম্পর্কে ‘ভূগোল-বিজ্ঞানী’ নন, যেহেতু তিনি ভাষাবিজ্ঞানীর মতো এ বিষয়ে তলিয়ে অনুশীলন করেন নি। তিনি নিজের সম্বন্ধে বলছেন, ‘আমি যেন পায়ে-চলা পথের ভ্রমণকারী। …বিজ্ঞানের রাজ্যে স্থায়ী বাসিন্দাদের মতো সঞ্চয় জমা হয়নি ভান্ডারে, রাস্তায় বাউলদের মতো খুশি হয়ে ফিরেছি, খবরের ঝুলিটাতে দিন-ভিক্ষে যা জুটেছে তার সঙ্গে দিয়েছি আমার খুশির ভাষা মিলিয়ে। …জ্ঞানের দেশে ভ্রমণের শখ ছিল বলেই বেঁচে গেছি, বিশেষ সাধনা না থাকলেও।’ এই যে ‘জ্ঞানের দেশে ভ্রমণের শখ’, এটা তাঁর মনে ছিল—সেইটেই মস্ত কথা, এবং সে-শখটা তিনি অনেকের মনে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। কাজেই, একদিকে ভাষার বাহ্যরূপ আর তার ইতিহাস, আর অন্যদিকে ভাষার আভ্যন্তর রূপ আর তার রসপরিপূর্ণ প্রয়োগ, এই দুইয়েরই অপূর্ব সমাবেশ দেখে রবীন্দ্রনাথকে এককথায় ‘বাকপতি’ বলতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আর প্রবন্ধে নিহিত তাঁর কারয়িত্রী ভাবয়িত্রী প্রতিভার অনেক কিছু কথা চিরকালের জন্য স্থায়ী হয়ে রইল। কিন্তু দৈনন্দিন আলাপে তাঁর যে পরিহাসোজ্জ্বল নানা মন্তব্য আমরা শুনতে পেতুম, তা থেকে ভাষা আর ভাষাতত্ত্ব বাদ পড়ে নি, সেগুলির তো সংগ্রহ হল না। মনে হয়, যদি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পাশে যেমন ‘শ্রী-ম’ বসে থেকে নি:শব্দে তাঁর বচনামৃত লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন, গান্ধীজির নানা উপদেশ যেমন দিনের পর দিন সংগৃহীত হয়ে গিয়েছে—সেই রকমটা যদি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও হত, আমরা তাহলে তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্বের একটা কত বড়ো দিক পেতে পারতুম! Rabindranath the Conversationalist ‘সদালাপী’ রবীন্দ্রনাথকে চিরতরে তাহলে ধরে রাখা যেত। তাঁর ভাষা আর ভাবকে একাধারে, দ্রাবিড়-দেশে প্রচলিত একটি সংস্কৃত সমস্তপদ দিয়ে বলা যায়, ‘সুগুণ-বিলাস’। নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মধ্যে মধ্যে বাঙলা ভাষার অনেক সমস্যা এবং অপূর্ণতা নিয়েও তাঁর স্বভাব-রসিক মন্তব্যের সঙ্গে, নিজের মত তিনি প্রকট করে গিয়েছেন। আজকাল হচ্ছে সাম্যের যুগ। ইংরিজি আর ফরাসি ভাষায় এক you আর vous, মধ্যমপুরুষে সকলের সম্বন্ধেই প্রযুক্ত হয়, যদিও সেকেলে মতে অত্যন্ত শ্রদ্ধা জানাবার জন্য ঈশ্বরের প্রতি thou শব্দের প্রয়োগ ইংরিজিতে পাওয়া যায়, এবং ফরাসিতে যেখানে তুই-তোকারির সম্বন্ধ সেখানে tu, toi রূপের প্রয়োগ হয়। কিন্তু you আর vous-এর একচ্ছত্র সাম্রাজ্য। অতি সম্মানিত ব্যক্তি সম্বন্ধেও you, অতি দীন দরিদ্রের সম্বন্ধেও you। বাঙলা ‘তুই তুমি আপনি’—এ নিয়ে মাঝে মাঝে বিপদ হয়। ‘তুমি’ বলবো কি ‘আপনি’ বলবো এটা যখন ঠিক করতে না পারি, তখন আমরা কর্মবাচ্য বা ভাববাচ্যের আশ্রয় নি—‘তুমি কোথায় থাকো’ আর ‘আপনি কোথায় থাকেন’—এই দুইয়ের টানাটানির মধ্যে পড়লে বলি, ‘কোথায় থাকা হয়’, ‘কী করা হয়’। বাঙলায় যদি ইংরিজি ও ফরাসির মতন মধ্যমপুরুষের জন্য একটা সর্বনামই চলে, সেটা কোনটা হওয়া উচিত? অনেক তর্কের পর ঠিক হল, ‘আপনি’-টাই গ্রহণযোগ্য, ‘তুমি’ নয়, ‘তুই’ তো নয়ই। যদিও ঘরের লোকেদের জন্য ‘তুমি’-টা ‘তুই’-টাও চলতে পারে। ইংরিজিতে Mrs. আর Miss এ দুইয়ের পার্থক্য বাঙলায় মেয়েদের সম্বন্ধে কী করে জানানো যায়? Miss অর্থে তো ‘কুমারী’ চলছে, আর Mrs. অর্থে ‘শ্রীমতী’ চলতে পারে। হিন্দী মারাঠী গুজরাটীতে ‘সৌভাগ্যবতী’ চলে, ‘সৌভাগ্যবতী’ কি বাঙলায় আমদানি করা যায়? কোনো মহিলাকে উদ্দেশ করে বলতে গেলে, ‘মিস অমুক, মিসেস অমুক’-এর জায়গায় কী বলবো? ইংরিজিতে সম্মান দেখিয়ে Madam চলে। রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের মত চাইলেন। ম্যাডামের জায়গায় ‘ভদ্রে’ বলবো? কেউ বললেন, ‘মা লক্ষ্মী’ কথাটি আবার জীইয়ে তুললে চলে না? রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ভদ্রারা এ বিষয়ে কী বলেন? ইংরিজিতে এক-অক্ষর ধাতু ask, পুরোনো বাঙলায় ‘পুছ’, হিন্দীতে ‘পুছ’, সংস্কৃত ‘পৃচ্ছ’ বা ‘প্রচ্ছ’ থেকে এসেছে। কিন্তু বাঙলায় বলি ‘জিজ্ঞাসা করা’, আর তার নানা বিকার ‘জিজ্ঞেস করা’, ‘জিগেস করা’, ‘জিগানো’, ইত্যাদি। তিনি বললেন, ‘পুছ’ বোধহয় আবার ফিরে আসতে চাইবে না—কিন্তু ‘শুধানো’ এখনও বোধহয় চলে, আর ‘শুধানো’-কে এখনও ফিরিয়ে আনা চলে। ‘শুধানো’ শব্দটি অনেকেরই মনে লাগে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় পরে প্রবাসী-তে ‘শুধানো’ ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন। এখন দেখা যাচ্ছে, দুই-একজন নামকরা আধুনিক সাহিত্যিক, যেমন শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ বিশী, ‘শুধানো’ প্রয়োগ করছেন। বাঙলায় ‘মুখ’ বললে ইংরিজি face আর mouth দুই-ই বুঝি। ‘মুখ’-এর বিশুদ্ধ (বা তদ্ভব) বাঙলা রূপ ‘মু’, ‘মুহ’ অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে; mouth-এর জন্য ‘মুখবিবর’—এ দাঁতভাঙা শব্দ লোকে নেবে না। আমি বললুম, বীরভূমে ‘বেঁত’ বা ‘ব্যাঁত’ প্রচলিত আছে, শব্দটা এসেছে ‘ব্যত্তি’ থেকে, প্রাকৃতে ‘বত্ত’, তা থেকে পুরোনো বাঙলায় ‘বাঁত’, সিন্ধী ভাষায় এ শব্দ পাওয়া যায়, ‘বাত্তু’। এইরকম অনেক শব্দ আমাদের লোপ পেয়েছে। এরকম স্থানে কী করা যায়? তাঁর দৈনন্দিন আলাপের মাঝে এইরকম অনেক সমস্যার আলোচনা হত, অনেক সমস্যার সমাধানও তিনি দিতেন সুন্দরভাবে। বাঙলা পরিভাষা-শব্দ সম্বন্ধেও তিনি চিন্তা করেছেন, এবং কতকগুলি শব্দের সুন্দর পরিভাষা তিনি তৈরি করে দিয়েছেন, যেমন, compulsory আর optional—এদের বাঙলা তিনি করেছেন ‘আবশ্যিক’ আর ‘ঐচ্ছিক’। সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা-য় এইরকম তাঁর প্রস্তাবিত অনেক পরিভাষা-শব্দ বেরিয়েছিল। একবার বিশ্বভারতীয় নিয়মাবলী তৈরির সময়ে প্রশ্ন উঠল—advisory council of senior members-এর জন্য কী বাঙলা বা সংস্কৃত পরিভাষা করা যায়? রবীন্দ্রনাথ একটু ভেবে বললেন, যদি বলি ‘সুমন্ত্রসভা’, তাহলে কেমন হয়? আমরা তো আনন্দে প্রায় আত্মহারা হলুম। কী সুন্দর শব্দটি তিনি আমাদের বললেন! আর এর পিছনে আছে রামায়ণের বয়োবৃদ্ধ মন্ত্রী সুমন্ত্রের অতন্দ্র সেবা আর সৎ-পরামর্শের কথা! এইভাবে রবীন্দ্রনাথের দৈনন্দিন আলাপ-আলোচনার মধ্যেও তাঁর ‘বাকপতি’-রূপের অনেক বিকাশ আমরা লক্ষ করেছি—তার সামান্যই স্থায়ীভাবে ধরে রাখা হয়েছে।
কিন্তু যা তিনি দিয়ে গিয়েছেন তাতেই আমরা ধন্য। তাঁর জন্মের এই শতবার্ষিকী উদযাপনের সময় বিনম্র কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তিনি যে আমাদের মধ্যে আবিভূর্ত হয়েছিলেন, সেই মহাগৌরবের অধিকারী হতে পেরেছি বলে ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করি।
শ্রীপুলিনবিহারী সেন-সম্পাদিত, রবীন্দ্রায়ণ প্রথম খন্ডে মুদ্রিত