3 of 3

‘রামকৃষ্ণ মেল’

‘রামকৃষ্ণ মেল’

জানুয়ারি মাস। কলকাতায় তখন খুব শীত পড়ত। তখন মানে ১৮৬৮ সাল। কথায় আছে আধা মাঘে কম্বল কাঁধে। তা মাঘ মাসের সাত-আট তারিখ। শীত যাই যাই করলেও বেশ কামড় আছে। পশ্চিমে প্রবাহিনী গঙ্গা। উত্তুরে বাতাসে প্রথম সকালে বেশ একটা হিম হিম ভাব। মোলাস্কিনের চাদরটি গায়ে দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতে হাসি হাসি মুখে পায়চারি করছেন। মুখ দেখলে মনে হয় সদাসর্বদা আনন্দময় কোন দৃশ্য যেন দেখছেন। মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কোন বার্তা ভেসে আসছে। সবে কামারপুকুর থেকে ফিরেছেন। দুরূহ সব সাধনা সমাপ্ত। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে জ্যোতির্ময় এক দিব্যপুরুষ ফুরফুরে আনন্দে গাছের আড়ালে ফুলের সমারোহে বিচরণ করছেন। একাকী এক সিংহ।

ফুরফুরে রোদ। বসন্ত যে এসে গেছে। উতলা কোকিল তারস্বরে ডাকছে। শীতে গঙ্গার জল কাঁচের মতো স্বচ্ছ। মাঝি যখন দাঁড় ফেলে দাঁড় তুলছে তখন মনে হচ্ছে তরল কাঁচের আলোড়ন। গাছে গাছে কচি পাতার উদ্ভেদ। সিম সবুজ, হরিৎ সবুজ। পঞ্চবটীর বট, অশ্বত্থ যেন কাঁচা সবুজে স্নান করে উঠেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ মাঝে মাঝেই অস্ফুটে বলছেন, কি আনন্দ! কি আনন্দ! কখনো গুণগুণ করে গাইছেন—”মা যার আনন্দময়ী সে কি নিরানন্দে থাকে!”

কলকে গাছ হলদে ফুলে ছেয়ে গেছে। ঠাকুর একটি ফুল হাতে নিয়ে দেখছেন আর ভাবছেন, সারদা কলকে ফুল বড় ভালবাসে! এমন সময় মথুরবাবু এলেন। ফিটন থেকে নেমেই, ‘বাবা কোথায়,’ ‘বাবা কোথায়’ বলতে বলতে সোজা পঞ্চবটীতে। জানতেন, এইসময় এইখানেই থাকবেন তিনি। প্রকৃতি যে তাঁর সঙ্গে কথা বলে। পাখির ভাষা তিনি বোঝেন। বাতাস তাঁর কানে কানে কথা কয়। পাশের বারুদ কোম্পানি যখন এই পঞ্চবটী অধিকার করতে চেয়েছিল, বাবা জগদম্বাকে বলেছিলেন, মা, আমার পঞ্চবটী চলে গেলে কোথায় সাধন করব? মথুরবাবু মামলা জুড়লেন, মাইকেল মধুসূদন ডাটকে ব্যারিস্টার দিলেন। মামলা জিতলেন মথুরমোহন।

মথুরবাবু এখনো শাল ছাড়েননি। দামী কাজ করা শাল। এর জোড়াটি বাবাকে দিয়েছিলেন। প্রথমে সাগ্রহে বালকের আনন্দে গায়ে দিলেন। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। পরমুহূর্তেই উন্মাদ। মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে ঠাসছেন আর বলছেন : “দূর শালার শাল!” মথুরবাবু তাড়াতাড়ি উদ্ধার করলেন, করো কি, করো কি! পাঁচ হাজার টাকা দাম!

মথুরবাবুর পরিধানে ফরাসডাঙ্গার মিহি ধুতি। বাহান্ন ইঞ্চি বহর। সামনে লোটাচ্ছে কোঁচা। বার্নিস করা কালো ঝকঝকে জুতো। সাজতে ভালবাসেন। রজোগুণী মানুষ। বিশাল ব্যক্তিত্ব। কেউ মুখ তুলে কথা বলতে সাহস পায় না; কিন্তু বাবার কাছে কেঁচো।

ঠাকুর একটু আগে মৃদু মৃদু হাততালি দিচ্ছিলেন। তালির শব্দে দেহবৃক্ষের পাপ-পাখি উড়ে যায়। তালি থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, কি ব্যাপার! এত সকালে তুমি?

ঐ যে জগদম্বা বললে, তুমি এক্ষুণি গিয়ে বাবাকে ধর।

তোমরা তো ধরেই আছ, নতুন করে আর কি ধরবে!

আমাদের সঙ্গে তোমাকেও যেতে হবে।

যাচ্ছ কোথায়?

কাশীতে, বাবা বিশ্বনাথের কাছে।

বাবার কাছে! রানী এই পর্যন্ত এসে মায়ের কাছে নোঙর ফেলেছিল, আমরা সেই নোঙর তুলব?

তখন রেল ছিল না, এখন লাইন পেতেছে। আমরা রেলে যাব।

তা চল। তাড়াতাড়ি চল।

ঠাকুরের চোখে ঘোর নামছে। মথুর বুঝতে পারছেন, বাবা এখনি এই মুহূর্তে কাশী চলে যাবেন। বিষয়ের কথায় টেনে ধরে রাখতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি বললেন, ব্যবস্থাটা কিরকম করেছি শোন। রেল কোম্পানির কাছ থেকে চারখানা বগি একেবারে রিজার্ভ করে নিয়েছি আমাদের জন্য।

ঠাকুর বললেন, চল, চল, বেদিতে বসে শুনি। তারপর মথুরের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন, তুমি কি বসতে পারবে! তোমার যা সাজপোশাক!

মথুর বললেন, তুমি যেখানে স্বর্গ সেখানে। তোমার স্পর্শে ধুলোও সোনা হয়ে যায়।

দুজনে বেশ আয়েস করে বেদিতে বসলেন গঙ্গার দিকে মুখ করে। শ্রীরামকৃষ্ণের বাঁ পাটি ঝুলছে। ভাঁজ করা ডান পা বেদিতে। ডান হাতটি পড়ে আছে হাঁটুর ওপর। মথুরের দিকে তাকিয়ে আছেন গভীর আগ্রহে।

মথুরবাবু বলছেন, দ্বিতীয় শ্রেণীর একটা বগি, তৃতীয় শ্রেণীর তিনটে। চারটে কোচ থাকবে একেবারে শেষের দিকে। যে স্টেশানে বলব, সেইখানেই কেটে রেখে দেবে। আমরা ঘুরব ফিরব। বললেই আবার জুড়ে দেবে ইঞ্জিনের সঙ্গে।

এরকম করলে কেন?

বাবা, বেরচ্ছি যখন, তখন কি আমরা শুধু কাশীতেই যাব! আমরা বৈদ্যনাথধামে যাব। একবার প্রয়াগে যাব।

ঠাকুর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, পইরাগ! পইরাগে যাবে?

আরো যাব, আরো দূরে। বৃন্দাবন।

ঠাকুরের চোখে ভাবাশ্রু। ধরা গলায় বললেন, যেখানে আজো বাজায় বাঁশি শ্যামসুন্দর। সেই গিরিগোবর্ধন! তাহলে সব গোছগাছ করে ফেলি। আমার গামছা, গাড়ু, বটুয়া।

মথুর বললেন, তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। সব করবে তোমার জগদম্বা।

তাহলে আমরা রেলে চাপছি কবে?

‘রামকৃষ্ণ মেল’

সাতাশে জানুয়ারি। আর ঠিক সাতদিন পরে।

তাহলে মাকে একবার বলে আসি! কি বল?

অবশ্যই। মায়ের অনুমতি ছাড়া তুমি কবে কি করেছ বল। মা অনুমতি দেবেন। আমার সঙ্গে যাচ্ছ যে। কি মজা হবে! জানালার ধারে আমার পাশটিতে বসে থাকবে। রেল ছুটবে হুহু করে। ঝিঝিক্ শব্দ। মাঝে মাঝে ভোঁ। জঙ্গল, পাহাড়, নদী। তারপর তোমার সবচেয়ে প্রিয় নদী হর হর গঙ্গা!

মাঝে মাঝে একটু একটু খাওয়া।

মথুরবাবু হাসছেন।

ঠাকুর বলছেন, হ্যাঁ গো, রেলে চাপলেই দেখবে, কেবল মনে হবে, এটা খাই, ওটা খাই।

মথুরবাবু কুঠিবাড়ির দিকে যেতে যেতে বললেন, বাবা! ঋতুপরিবর্তন হচ্ছে। সাবধান! শরীরটা ঠিক রেখো। আর মাত্র সাতদিন। যাচ্ছি শেষ শীতে, ফিরব সেই গ্রীষ্মে। অনেক দিন।

।। দুই।।

রাতের বেলা ঠাকুর হৃদয়কে বলছেন, শোন, প্রশ্ন করেছিলুম মাকে, মা তীর্থে কেন যাব?

ঠাকুর মশারির ভিতর, হৃদয় মশারির বাইরে। লণ্ঠনের মৃদু আলোয় দেয়ালে বড় বড় ছায়া। বাইরে রাতের অন্ধকারে বাতাসের পায়চারি। শীত চলে যাওয়ার মুখে মশার উপদ্রব বাড়ে। ধুনোর ধোঁয়ায় একটু কমেছিল, এখন কোণে কোণে কীর্তন। হৃদয় চড়-চাপড় মারছিলেন। শব্দ থামিয়ে, সংযত হয়ে বললেন, মা কি বললেন?

মা বললেন, যেখানে অনেক লোক অনেকদিন ধরে ঈশ্বরদর্শন করবে বলে তপজপ, ধ্যানধারণা, প্রার্থনা, উপাসনা করেচে সেখানে তাঁর প্রকাশ নিশ্চয় আছে জানবি। তাদের ভক্তিতে সেখানে ঈশ্বরীয় ভাবের একটা জমাট বেঁধে গেছে। তাই সেখানে সহজেই উদ্দীপন হয়, তাঁর দর্শন হয়। যুগযুগ ধরে কত সাধু-ভক্ত-সিদ্ধ পুরুষেরা এইসব স্থানে ঈশ্বরকে দেখবে বলে এসেচে, অন্য সব বাসনা-কামনা ছেড়ে তাঁকে প্রাণ ঢেলে ডেকেচে, সেজন্যে ঈশ্বর সব জায়গায় সমানভাবে থাকলেও এইসব জায়গায় তাঁর বিশেষ প্রকাশ। যেমন মাটি খুঁড়লে সব জায়গাতেই জল পাওয়া যায়, কিন্তু যেখানে পাতকো, ডোবা, পুকুর বা হ্রদ আছে সেখানে জলের জন্যে আর খুঁড়তে হয় না, যখনই ইচ্ছা জল পাওয়া যায়, তেমনি।

হৃদয় নিজের মশারি গুঁজতে গুঁজতে বললেন, কদিন একটু সাবধানে থাকার চেষ্টা করো, মাঝরাতে এমন হুটহাট করে মায়ের খোঁজে পঞ্চবটীতে চলে যেও না। শীত শেষ হতে চলেছে, এখন তেনারা সব ঘুম ভেঙে শিকারের সন্ধানে বেরবেন।

কাদের কথা বলছিস?

সাপ।

সাপ আমার কি করবে! ঐ জঙ্গলে সবাই আমার বন্ধু।

বুঝবে, যেদিন ন্যাজে পা পড়বে! বন্ধুর শত্রু হতে এক মিনিটও সময় লাগবে না।

হৃদয় চাদরমুড়ি দিয়ে বেশ গুছিয়ে শুয়ে পড়লেন। আলো নেভানো ঘরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। গোটাকতক আগুনের ফুলকি ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুটো এসে পড়ল শ্রীরামকৃষ্ণের মশারির চালে। শীতল অগ্নি। এ-আগুনে আগুন লাগে না। ঠাকুর জোনাকি ভালবাসেন। যেন আত্মার উড়ন্ত স্ফুলিঙ্গ! বিছানায় বসে বসে অবাক হয়ে দেখছেন। মহামায়ার মায়ার খেলা—সুন্দরে কুৎসিতে, বিশালে, ক্ষুদ্রে জগত্‍টাকে কেমন সাজিয়েছেন!

অস্ফুটে কয়েকবার বললেন, কাশী, কাশী। কানের কাছে ঝঙ্কৃত হলো শঙ্কর-স্তোত্র-

“মনোনিবৃত্তিঃ পরমোপশান্তিঃ সা তীৰ্থবৰ্য্যা মণিকর্ণিকা চ।
জ্ঞানপ্রবাহা বিমলাদিগঙ্গা, সা কাশিকাহং নিজবোধরূপা।।”

-–শোন শোন, এখানে এলে মানুষের চিত্তে বিষয়বাসনা থাকে না। পরমা শান্তি পেতে চাও? চলে এস এইখানে। তীর্থশ্রেষ্ঠ মণিকর্ণিকা এইখানে। জ্ঞানের প্রবাহস্বরূপ বিমল আদিগঙ্গা এইখানেই প্রবাহিত। আমি স্বয়ং সেই বোধরূপিণী কাশীস্বরূপ।

চারপাশ থেকে জোনাকির চমকিত আলো ঠাকুরের ভাবময় মুখের ওপর এসে পড়েছে। ঠাকুর বসে আছেন। কথা কইছেন শঙ্করাচার্যের সঙ্গে। “ঠিকই তো! বোধরূপিণী কাশীস্বরূপ।”

“কাশ্যাহ হি কাশতে কাশী কাশী সর্বপ্রকাশিকা।
কা কাশী বিদিতা যেন তেন প্ৰাপ্তা হি কাশিকা।।”

—জ্ঞানের দ্বারাই কাশী প্রকাশিত হয়, আর জ্ঞানরূপিণী কাশী সকলকে প্রকাশিত করে। জ্ঞানকাশীকে জানলে তবেই কাশীলাভ হয়। রানীর তো তাই হলো মথুর! মা দেখিয়ে দিলেন, এই দক্ষিণেশ্বরে আমার প্রকাশ, এইখানেই আছে তোমার কাশী। মথুরকে শোনাতে হবে, শোন মথুর, শঙ্কর কি বলছেন—

“কাশীক্ষেত্রং শরীরং ত্রিভুবনজননী ব্যাপিনী জ্ঞানগঙ্গা,
ভক্তিঃ শ্রদ্ধা গয়েয়ং নিজগুরুচরণধ্যানযোগঃ প্রয়াগঃ।
বিশ্বেশোহদুয়ং তুরীয়ঃ সকলজনমনঃ সাক্ষীভূতঃ অন্তরাত্মা,
দেহে সর্বং মদীয়ে যদি বসতি পুনস্তীর্থমন্যৎ কিমস্তি।।”

—মানুষের দেহই কাশীক্ষেত্র, জ্ঞানই ত্রিভুবনজননী ও সর্বব্যাপিনী গঙ্গাস্বরূপা, ভক্তি আর শ্রদ্ধাই হলো গয়া, নিজের গুরুর চরণধ্যানই প্রয়াগ আর সকল মানুষের মনঃসাক্ষীভূত তুরীয় ব্রহ্মই বিশ্বেশ্বর। আমার দেহেই তো সব রয়েছে। তাহলে!

হঠাৎ গান এসে গেল—

“গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশীকাঞ্চী কেবা চায়
কালী কালী কালী বলে অজপা যদি ফুরায়!”

হৃদয় বিছানায় উঠে বসে বললেন, তোমার নাহয় ঘুম নেই, আমাদের তো একটু ঘুমোতে দেবে! সারাটা দিন খেটে খেটে মরি। হৃদয়ের কথা কানেই গেল না।

।। তিন।।

মথুরবাবু স্টেশনে এলেন। সে এক মহা মিছিল। শ-দেড়েক মানুষ। মালপত্তর, হই-হট্টগোল। এস্টেটের কর্মচারীদের অতি তৎপরতা। আসা- শেঁটো। ভাঁজ করা রুপোর ছাতা। সুবেশধারী আত্মীয়স্বজন, মথুরবাবুর গুরুপুত্ররা। ঝকঝকে ট্রেন। লোহার ইঞ্জিন সর্বাঙ্গ দিয়ে বাষ্প ছাড়ছে। গনগনে আগুনে কয়লা ঠেলছে খালাসি। উর্দিপরা অ্যাংলো ড্রাইভার লালমুখে বাইরে তাকিয়ে। রাজকীয় এই সমারোহ দেখছেন। বারে বারে তাঁর চোখ চলে যাচ্ছে একটি মানুষের পানে। তিনি যেন হাঁসের মধ্যে রাজহাঁস।

মথুরবাবু তাঁর বাবাকে আগলে রেখেছেন একেবারে পাশটিতে দক্ষিণেশ্বরের মা কালীকে যেন নিয়ে চলেছেন, কাশীর বিশ্বনাথের কাছে। রামকৃষ্ণই তো তাঁর কালী। এ-দর্শন তো তাঁর হয়েছে। সে কৃপা তো বাবা তাঁকে করেছেন। ঠাকুর তাঁর ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণের প্রশস্ত বারান্দায় গোঁভরে পায়চারি করছেন আর মথুরবাবু তাঁর কুঠিবাড়ির একটি ঘরে বসে ঠাকুরকে লক্ষ্য করছেন। হঠাৎ এ কী দর্শন! এ তো শ্রীরামকৃষ্ণ নয়! চোখ রগড়ালেন। না, কোন ভুল নেই! সেই একই দর্শন! অভিভূত, আত্মহারা মথুরমোহন সম্পূর্ণ বিস্মৃত যে, তিনি জানবাজারের জমিদার, রানী রাসমণির জামাতা। ছুটে গিয়ে পড়লেন বাবার পায়ে। শ্রীরামকৃষ্ণের সম্বিৎ ফিরে এল, পদপ্রান্তে এ কে! সেজবাবু! ঠাকুর বলছেন, একি, একি! তুমি একি করছ মথুর? তুমি বাবু, রানীর জামাই, তোমায় এমন করতে দেখলে লোকে কি বলবে! স্থির হও, ওঠ। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে মথুরমোহন বললেন, বাবা, তুমি বেড়াচ্চ আর আমি দেখছি, যখন এদিকে এগিয়ে আসছ, তুমি নও, আমার ঐ মন্দিরের মা! যেই পিছন ফিরে ওদিকে যাচ্ছ, সাক্ষাৎ মহাদেব। তুমিই শিব, তুমিই কালী!

বিশ্বনাথকে নিয়ে বিশ্বনাথ দর্শনে চলেছেন মথুরমোহন। গার্ডসায়েব পতাকা নেড়ে, হুইসিল বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিলেন। ঠাকুর বসেছেন জানালার ধারটিতে। একপাশে হৃদয়। বিপরীত দিকে মথুরমোহন। কলকাতা ক্রমশই পেছচ্ছে। নতুন গ্রাম, জনপদ, বনানী সব ঘুরপাক খেতে খেতে ছিটকে চলে যাচ্ছে পেছন দিকে। মনে মনে ভাবছেন ঠাকুর, বিশ্বনাথের দিকে যত এগচ্ছি বর্তমান জগৎ ততই কেমন পেছনে সরে সরে যাচ্ছে। এ-জগৎ না পালালে ও- জগৎ কাছে আসবে কি করে! এদিক যাবে তবে তো ওদিক আসবে! সূর্য গেলে আসবে চাঁদ। সূর্য এলে চাঁদ পালাবে।

ঠাকুরকে সাবধান করছেন মথুরমোহন, বাবা! মিটিমিটি চাও, চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়লে কষ্ট হবে। তুমি বরং আমার জায়গাটায় এস। আমি ঐ দিকটায় যাই!

ঠাকুর স্নেহমাখানো গলায় বললেন, না গো সেজবাবু। তোমার চোখে পড়া মানেই আমার চোখে পড়া! এতকাল চোখে কালী পড়েছে, এবার নাহ কয়লাই পড়ুক।

ঠাকুর আনন্দে গান ধরলেন—

“ভাব কি ভেবে পরাণ গেল।
যাঁর নামে হরে কাল, পদে মহাকাল,
তাঁর কেন কালরূপ হলো।
কালরূপ অনেক আছে, এ-বড় আশ্চর্য কালো।
যারে হৃদিমাঝে রাখলে পরে হৃদ পদ্ম করে আলো।।”

রেলের ছুটন্ত চাকার দুরন্ত শব্দ, বাতাসের ফনফন, ঠাকুরের গান। কামরার বিশিষ্ট যাত্রীরা অভিভূত। হ্যাঁ, একেই বলে তীর্থযাত্রা। যার মনে যতটুকু বিষয় লেগেছিল সব ঝরে ঝরে পড়ে যেতে লাগল।

ট্রেন যশিডিতে এল। স্টেশনের কাছের পাহাড়টি দেখে ঠাকুরের কী আনন্দ। সমতলের মানুষ পাহাড় দর্শনে উদ্দীপন। মথুরমোহন দলবল নিয়ে নামলেন। পূর্বের ব্যবস্থা মতো সার সার টাঙা লেগে গেল। কঙ্কালসার ঘোড়া। ঠাকুর রহস্য করে বললেন, ও মথুর! এখানেও যে বেণী শা!

বরানগরে বেণী শা-র আস্তাবল থেকে ঠাকুরের জন্যে ঘোড়ারগাড়ি ভাড়া করার ব্যবস্থা মথুরবাবু চালু করেছিলেন। যখন খুশি ঠাকুর কলকাতার ভক্তদের বাড়ি যাবেন। সেখানেও এই একই ঘোড়া। জরাজীর্ণ।

মথুরবাবু বললেন, বাবা, ভয় নেই। ঘোড়া যখন, অভ্যাসই দৌড়বে। এখানে একটাই ভয়, মাঝে মাঝে চাকা খুলে যায়।

ঠাকুর মহা উৎসাহে বললেন, সে ওখানেও খোলে গো!

তাহলে বলতে হয় গাড়ি যখন, চাকা তো খুলবেই।

সার সার টাঙা বৈদ্যনাথধামের দিকে ছুটল। পথের মোরামে লোহার চাকার মচমচ শব্দ। যে গাড়িতে সস্ত্রীক মথুরবাবু সেই গাড়িতেই ঠাকুর। মথুরবাবু বাবাকে কাছছাড়া করবেন না। এই অলৌকিক বালকটি কখন কি করে বসেন তার ঠিক নেই। জড়িয়ে ধরে আছেন। টাঙায় টাঙায় গতির প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এদের এই স্বভাব। মথুরবাবুর টাঙার চালকের মহা উৎসাহ। খোদ মালিক তার সওয়ারি। তাকে তো সবার আগে যেতে হবেই।

মথুরবাবু যত বারণ করেন, ঠাকুর ততই উৎসাহ দেন, “চালাও, চালাও।” এইসব অঞ্চলে বাঙালিবাবুরা শীতে বায়ুপরিবর্তনে আসেন। সুন্দর সুন্দর বাগানবাড়ি। গোলাপ বাগিচা। গোলাপের জন্য বিখ্যাত এই সাঁওতাল পরগণা। ঠাকুর উৎফুল্ল হয়ে বললেন, তোমরা আমাকে কত আনন্দই দিচ্ছ মথুর।

মথুর বললেন, আমরা দিচ্ছি, না তুমি আমাদের আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছ!

মথুরবাবুর সব ব্যবস্থাই সুন্দর। বিশাল বাড়িটি মুহূর্তে শত মানুষে জমজমাট। ঠাকুরের জন্যে নির্দিষ্ট হয়েছে নির্জন, নিরিবিলি একটি কোণের ঘর। জানালায় দাঁড়ালেই বৈদ্যনাথজীর মন্দিরের চূড়াটি চোখে পড়ে। হৃদয় বলছেন, তুমি এত অস্থির হয়েছ কেন? উঠছ, বসছ, ছুটে ছুটে জানালার কাছে। …

ঠাকুর বললেন, সেজবাবুকে বল না, মন্দিরে গিয়ে শৃঙ্গার আরতি দেখে আসি।

সে হবেখন। এখন একটু বিশ্রাম কর।

শ্রম হলো কই যে বিশ্ৰাম!

বলতে বলতেই মথুরমোহন এলেন, কি হলো, ছটফট! ফরসিতে সবে দু- টান দিয়েছি, মনে হলো হৃদয়ে হৃদয় লাফাচ্ছে। তখনই বুঝলুম, বাবা চঞ্চল। চল মন্দিরে। বাবাকে হাজিরা দিয়ে আসি।

প্যাড়া-গলিতে প্রবেশমাত্রই ঠাকুরের ভাবান্তর। মন্দিরের দশাসই এক সেবক, হাতে তাঁর বিশাল এক পেতলের সাজি, ঝড়ের বেগে গলিতে গলিতে ছুটছেন, শিবকণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়ছেন, ‘ভোলে ব্যোম।’ যে যা পারছেন তুলে দিচ্ছেন তাঁর সাজিতে ঝটাপট। মন্দিরে বাদ্যবাজনা শুরু হয়ে গেছে। ঠাকুরের সহাস্যমুখ অন্তরঙ্গ জ্যোতিতে উদ্ভাসিত। মনে মনে বলছেন, বাবা, তোমার কীর্তি তো জানা আছে। এত সাজগোজ, এত খাতির, এরপরেই তো শ্মশানশয্যা! ছাইভস্ম মড়ার মাথা! আমার মা-টি না থাকলে, বাবা, তোমার কি হতো! যখন খুব বাড়াবাড়ি করে ফেল, তখন মা বাধ্য হয়ে তোমাকে পায়ে চেপে রাখেন। আমরা সেই দৃশ্য দেখে ফেলি বলে, মা লজ্জায় জিভ কাটেন। সে আর কি হবে বল, একমাত্র আমার মা-ই জানেন তোমার শাসন! তোমার অনুশাসনে যত জীব, আর আমার মায়ের শাসনে সাক্ষাৎ শিব!

ঠাকুর খিলখিল করে হাসছেন। সে হাসি যুক্ত হলো আরতির ডমরু, ঘণ্টার ঐক্যবাদ্যে। কর্পূরের অগ্নিশিখা মন্দির কন্দরে নৃত্যের তালে তালে নাচছে। অজস্র ঘৃতপ্রদীপের শিখায় উদ্ভাসিত অলৌকিক পরিবেশ। ধীরে ধীরে ঠাকুর সমাধিতে প্রবেশ করলেন। মন্দিরের দুয়ার এবার বন্ধ হবে। সবাই দেখছেন, জ্যোতির্ময় এক দিব্যপুরুষ রাজকীয় এক মানুষের কাঁধে ভর রেখে মাতালের মতো টলতে টলতে বেরিয়ে আসছেন। কেউ বলছে, বহুত পিয়া। এক বিশালকার সন্ন্যাসী পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললেন, পিলে, পিলে, হরি-নামকা পেয়ালা।

শ্রীরামকৃষ্ণ বালগোপালের মতো হাসতে হাসতে আবদারের গলায় বললেন, ও সেজবাবু! আমি একটা প্যাড়া খাব।

ঠাকুরের যখন এই ভাবটি হয়, বালক ভাব, মথুরমোহনের তখন আনন্দের সীমা, পরিসীমা থাকে না। তখন তিনি অবতারের পিতা, যেন বসুদেব! এমন আবদারে প্যাড়া কেন, রাজত্বও দিয়ে দেওয়া যায়। মথুরমোহন প্যাড়ার দোকানে গেলেন।

পরের দিন সকালে যেমন হয় তেমনই হলো। বিদায়ী শীতের ভব্যসূর্য, নরম তাপে নেমে এল কাঁকুরে, কিঞ্চিৎ রুক্ষ প্রকৃতিতে। গোলাপে সেজেছে উদ্যান, গাঁদার ঢল নেমেছে। শ্বেত টগর। বাগানবিলাসে লালে লাল। ঠাকুর হাততালি দিয়ে হরিনাম করছেন। হৃদয় হিসেব করছেন, এ-যাত্রায় মথুরমোহনের কত খরচ হতে পারে। ঠাকুর মাঝে মাঝে আক্ষেপ করেন—এত করেও বিষয় তোকে ছাড়ছে না রে হৃদয়!

মথুরবাবু বললেন, চল বাবা, গ্রামে ঘুরে আসি।

দেহাতি গ্রামের করুণ অবস্থা দেখে ঠাকুর একটি গাছতলায় বসে পড়লেন। হতদরিদ্র মানুষ সব। হাড়ের খাঁচা। মাথাগুলো সব তালের আঁটির মতো। চুলে কতকাল তেল পড়েনি। পরনে ট্যানা। পেটগুলো সব পিঠের সঙ্গে ঠেকে গেছে। প্রতিটি পাঁজর গুনে নেওয়া যায়। চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। ঠাকুরের চোখে জল আসছে। ইশারায় কাছে ডাকলেন মথুরমোহনকে। ভাল করে কথা বলতে পারছেন না—মথুর এসব কি! এ কী দীনহীন অবস্থা!

বাবার এই কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মথুর পরিচিত। এ এক অন্য কণ্ঠস্বর, অন্য রামকৃষ্ণ, অন্য ব্যক্তিত্ব, যাঁর সামনে জাঁদরেল জমিদার মথুরমোহনও থতমত খেয়ে যান। এ-তাঁর ইষ্টের কণ্ঠস্বর। মথুরমোহন আমতা আমতা করে বললেন, বাবা, এরা যে খুব গরিব!

রামকৃষ্ণ উঠে পড়েছেন। বসে থাকতে পারলেন না। প্রশ্ন করলেন, কেন গরিব?

মথুরমোহন জবাব খুঁজে পেলেন না। কেন কিছু মানুষ গরিব, কিছু মানুষ বিপুল ধনী, তিনি কি করে বলবেন! অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন ঠাকুরের সামনে।

রামকৃষ্ণ মথুরমোহনের হাত দুটি ধরলেন। তাঁর চোখে জল। বললেন, তুমি তো মা-র দেওয়ান মথুর! তুমি পার না, এদের একমাথা করে তেল, আর একখানা করে কাপড় দিতে, আর পেট ভরে একদিন খাইয়ে দিতে!

মথুরমোহনের হাত দুটো শক্ত করে ধরে আছেন রামকৃষ্ণ। মথুরমোহনের ওপর স্থির দৃষ্টি। তিনি কদাচিৎ পুরোপুরি চোখ খোলেন। এখন খুলেছেন। মথুর বিস্মিত। যেন জল টলটলে অতল দুটি হ্রদ দেখছেন। এত প্রেম! এত করুণা! তবু মথুরমোহন একটু পিছপাও হলেন। বললেন, বাবা, তীর্থে অনেক খরচ হবে, তাছাড়া এত লোক, এদের খাওয়াতে-দাওয়াতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। টাকার অনটন হয়ে যেতে পারে, বাবা।

রামকৃষ্ণ এক ঝটকায় মথুরমোহনের হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটে চলে গেলেন সেই লোকগুলির দঙ্গলে। তাদের মাঝে থেবড়ে বসে উগ্রকণ্ঠে বললেন, দূর শালা, তোর কাশী আমি যাব না। আমি এদের কাছেই থাকব; এদের কেউ নেই, এদের ছেড়ে যাব না। তোমার দলবল নিয়ে তুমি চলে যাও মথুরমোহন। এই আমার কাশী।

ঐ যে শঙ্করাচার্য লিখেছেন—

“পাপরাশিসমাক্রান্তা যে দারিদ্র্যপরাজিতাঃ।
যেষাং ক্বাপি গতির্নাস্তি তেষাং বারাণসী গতিঃ।।”

—রাশি রাশি পাতকে আক্রান্ত, দারিদ্র্য কর্তৃক পরাভূত, কোথাও যাদের গতি নেই, বারাণসী তাদের গতি। তা মাঠের মাঝে তারাই তো বসে আছে যাদের গতি বারাণসী। তুমি যাও মথুর তোমার বারাণসীতে, আমার বারাণসী আমি পেয়ে গেছি! এরাই আমার সচল বিশ্বনাথ!

মথুরবাবু হাত ধরে ঠাকুরকে তুললেন। বললেন, ওঠ। সব ব্যবস্থা করছি। তোমার আদেশ মায়ের আদেশ। তুমিই মায়ের বিশ্বেশ্বর, তুমিই আমার বীরেশ্বর, তুমিই আমার বিবেকের কণ্ঠস্বর। এইবার মথুরবাবুর চোখে জল। বঙ্গের পণ্ডিতমণ্ডলী শাস্ত্র-প্রমাণে সাধে কি এঁকে অবতার বলেছেন! প্রেমাবতার!

মথুরবাবুর নায়েব ছুটলেন কেনাকাটায়। এল মাথায় মাখার নারকেল তেল, গাঁট গাঁট কাপড়, চাল, ডাল, তরি-তরকারি। পরের পরের দিন সে এক মহা সমারোহ! সবাই জেনেছেন, দরিদ্র, জীব; ঠাকুর দেখছেন, জীবন্ত শিব। সকলের মাথায় তেল পড়েছে। রোদে পোড়া মুখ চকচক করছে। সকলের পরনে নতুন বস্ত্র। কোরা কাপড়ের গন্ধ। পাতে পাতে গরম খিচুড়ি ধোঁয়া ছাড়ছে। হাতা হাতা তরকারি। লাড্ডুর পাহাড় একপাশে অপেক্ষা করছে, একটু পরেই পাতে পড়বে। গাছের ছায়ায় মাঠভর্তি লোক। মাথা হেঁট করে সুপ-সাপ খেয়ে চলেছে। কতদিন পরে তাদের এই পেটপুরে সুখাদ্য ভোজন! রামকৃষ্ণ হাত দুটি জোড় করে তাদের মাঝে মহানন্দে ঘুরছেন। অশ্রুসজল চোখ। মাঝে মাঝে করতালি দিয়ে বলছেন, খাও, খাও, বাবারা খাও, খুব খাও, খুব খাও। যারা আহারে বসেছে, যারা বসার অপেক্ষায়, তারা মনে মনে বলছে, তু কে বট! তুই কে? ভগবান!

অদূরে মথুরমোহন নিজে তদারকি করছেন। কর্মচারীদের আদেশ করছেন—যে যত খেতে পারে দিয়ে যাও। ফুরিয়ে গেলে আবার চাপাও। আমি মায়ের দেওয়ান। আমার দক্ষিণেশ্বরের বাবা বিশ্বনাথ, ঐ দেখ পাতে পাতে লাড্ডু পরিবেশন করছেন। এই অজানা প্রান্তরে আজ জীব আর শিব একসঙ্গে হাসছেন।

“যা দেবী সর্বভূতেষু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।”

চাপাও হাঁড়ি, আমার বাবা আজ শতমুখে আহার করছেন। লাগে টাকা দেবে মথুরমোহন।

সূর্য নামল পশ্চিমে। দূর আকাশে ত্রিকূটের ছবি আরো গাঢ় হলো। আকাশের রঙ হয়ে এল ধূসর নীল। গ্রামের মানুষ পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে গেল গ্রামে। কেউই জবাব পায়নি তাদের প্রশ্নের—তু কে বট! এক বালক বলেছিল, ভগবান বটে! হতে পারে! গল্পে আছে, জীবের দুঃখে বৈকুণ্ঠের ভগবান মানুষের ভগবান হয়ে নেমে আসেন।

সাইডিং থেকে লাইনে এল চারখানা কোচ, জুড়ে গেছে ইঞ্জিন। গার্ডসায়েব বাজাও বাঁশি, নাড়াও পতাকা। ঐ দেখ, যায় চলে ‘রামকৃষ্ণ মেল’ ইতিহাসের লাইন ধরে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *