3 of 3

শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ

শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ

‘সেনয়োরুভয়োমধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত।” (গীতা, ১।২১) ধুলো উড়িয়ে, ঘড়ঘড় শব্দে, জোড়া জোড়া অশ্বের মুখর ক্ষুরধ্বনিতে বিপুল রথ ছুটে চলল। শীর্ষে উড্ডীন পতাকা রথের গতিতে টান টান। গগনে দীপ্ত সূর্য। বিশাল রুক্ষ প্রান্তর। তরুহীন, ছায়াহীন। কোথাও ধরিত্রীর সামান্যতম কোমলতা নেই। সর্বত্র ধুলোর উৎক্ষেপ। ঘর্মাক্ত অশ্বের অস্থির ছোটাছুটি। রথের পর রথ। অশ্ব, গজ, পদাতিক সেনাবাহিনী। অস্ত্রের ঝনৎকার। রোদের আলোয় ধারাল লোহার ঝলসানি। মাথার ওপর তামাটে আকাশের বিস্তার। ঘোর শঙ্খনিনাদ। অঙ্গদ, কুণ্ডল, উষ্ণীষশোভিত সারথি দৃঢ় মুষ্টিতে অশ্বের বল্গা ধারণ করে আছেন। শ্যামাঙ্গ, অতি সুন্দর মুখমণ্ডল, উন্নত নাসা, রক্তিম ওষ্ঠদ্বয়, আয়ত দুটি চোখ প্রেমে ভরা। মুখভাবে দৃঢ়তা, সঙ্কল্প, জ্ঞান, বৈরাগ্য, দিব্যশোভা, সর্বোপরি প্রচ্ছন্ন অদৃষ্ট নির্ভরতা। ঐশ্বরিক নিস্পৃহতা। সুঠাম সারথি রথ চালনা করছেন, পাশেই ধনুর্বাণধারী বীর যোদ্ধা সুদর্শন এক রাজপুত্র। ‘ডাস্ট অ্যান্ড ডিন অফ দ্য ব্যাটল’।

মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে উপনিষদের প্রবেশ। “ভক্তিরথে চড়ি, লয়ে জ্ঞান তূণ,/রসনা ধনুকে দিয়ে প্রেম গুণ।” কালের প্রান্তরে জীব এসেছে কালীর শাসনে। নিষ্ক্রিয় মহাকালের জমিদারি। “জীব সাজ সমরে, রণবেশে কাল প্রবেশে তোর ঘরে।” এই রণে জয়লাভ করতে হলে কি করতে হবে? যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে হবে? কোথায় পালাবে? সর্বত্রই যুদ্ধ। রণভূমিতেই আমাদের জন্ম। সবাই ক্ষত্রিয়। যুদ্ধ নয়, ধর্মযুদ্ধই আমাদের ধর্ম। অন্যের ভূমি অধিকার নয়, নিজের ভূমি রক্ষা করা। সেই ভূমির উপাদান? ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। আবার এই অবস্থানের মালিক ভগবান। সেই ভূমির পরিমাণ? আমার এই দেহ। যুদ্ধজয়ের শ্রেষ্ঠ বিধান—”আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।/ বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।।” (কঠ উপনিষদ্, ১াতা৩) শাক্তসঙ্গীতে এই একই যুক্তি। “আরোহণ করি পুণ্য মহারথে, ভজন পূজন দুটো অশ্ব জুড়ি তাতে,/দিয়ে জ্ঞান-ধনুকে টান, ভক্তি-ব্রহ্মবাণ বসে আছি ধরে।”

পরিপূর্ণ জীবনকে জানতে হলে মৃত্যুকে জানতে হবে। এই গ্রহের যাবতীয় প্রাণী মৃত্যুর মধ্যেই লালিত হচ্ছে খাদিত হবে বলে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের এই খেলাটি শেখাতে এসেছিলেন। প্রেম, রণ, মৃত্যু! প্রেমে বাঁচ, পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ কর, জ্ঞানীর মতো মরে যাও। মানবের চিরকালের বিভিন্ন রকমের বাঁচাটা অনুধাবন কর। পাপী মরবে, পুণ্যবানও মরবে। সাধু মরবে, শয়তান মরবে। কারণ, সেইটাই পরিণতি। সেই কারণেই এখানকার সর্বকালের সব সমাবেশই হলো ‘সমবেতা যুযুৎসবঃ’। আর প্রশ্ন একটাই—’কিমকুর্বত’? কিম্‌ অকুর্বত? কি করল সবাই! এল আর গেল। এ-প্রশ্ন ধৃতরাষ্ট্রের মতো ‘ফসিল’দের! যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে যাঁরা বসে আছেন–হয় তাত্ত্বিক হয়ে, নাহয় উপদেষ্টা হয়ে অথবা অতি সুচতুর ‘প্যারাসাইট’-এর মতো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখস্খলিত শ্রেষ্ঠ উপদেশ যুদ্ধক্ষেত্রেই কথিত উদাহরণ সহযোগে—অর্জুন, তোমার প্রথম লড়াই তোমারই ক্লীবতা আর কাপুরুষতার বিরুদ্ধে। এর বিরুদ্ধে তোমাকে লড়তে হবে জ্ঞান দিয়ে। জ্ঞানধনুকে দাও টান। আবার শুধু জ্ঞানী হলে হবে না। প্রজ্ঞা চাই। প্রাজ্ঞের মতো কথা তুমি অবশ্যই বলছ, কিন্তু তোমার আচরণ অজ্ঞের মতো। মন মুখ এক কর। ইন্দ্রিয়যুক্ত জ্ঞান দিয়ে পথের নির্দেশ খুঁজো না। ইন্দ্রিয়রা অন্ধ। কুজা তোমাকে কু বোঝাবে। শুদ্ধজ্ঞানের আশ্রয় নাও। জেনে রাখ, অবিনাশী আত্মা অর্থাৎ ব্রহ্মে এই জগৎকাণ্ড বুদবুদের মতো ফুটছে, ফাটছে। “অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ম্।” (গীতা, ২।২০) – এই অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বাঁধ।

ছেড়ে দিই; শ্রীকৃষ্ণ ভগবান, এই সিদ্ধান্তটি আপাতত তোলা থাক। তা নাহলে বংশীধারী, ত্রিভঙ্গঠাম, গোপিকাবিলাসী শ্রীকৃষ্ণ একটি প্রণাম ছাড়া কিছু পাবেন না। শ্রীকৃষ্ণ একজন পরিপূর্ণ মানুষ, ‘পারফেক্ট ম্যান’। কারাগার একটি ‘সিম্বল’। সব মানুষই কারাগারে জন্মায়। পরিবার, পরিবেশ, জাতি, বর্ণ, নিয়ম, শাসন, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম—এই কারাগারের এক-একটি লোহার দণ্ড। শৃঙ্খল। এই কারাগারেই জন্ম, বিবাহ, সংসার, শেষ। এই কারাগার ভেঙে বেরতে হবে। জীবনের স্বাদ নিতে হবে। বৃন্দাবনের রাখাল, মথুরার রাজা যদুবংশ ধ্বংস করে, ব্যাধের শরে নিজেকে ফুরিয়ে দিয়ে অনন্তের পথিক অনন্তে ফিরে যাবেন। এ কেমন! প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠলেন, ফুঁ হয়ে নিবিয়ে দিলেন। কাল শেষ। বিশাল বিস্তৃত জীবনলীলার অবসান। কনফুসিয়াস যে-কথাটি মানতেন, সেটি হলো – “A perfect man is God.“

পুরাণের সমস্ত অলৌকিকত্বকে সরিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীকৃষ্ণকে যেভাবে ধরেছিলেন, সে যেন ভগবানের হাতে ভগবান! পোশাক ভিন্ন, কালান্তরের ব্যবধান, বর্তমানের দর্পণে প্রতিচ্ছায়া দর্শন। ভগবান এইভাবেই ভগবানকে বোঝাতে আসেন। একটি উপমা–ময়দার লেচি কাটা। বেলা হবে, লুচি হবে। পাতে পাতে পড়বে। সেই লেচিগুলোকে এক হাতে এনে একসঙ্গে করে দিলেই ময়দার তাল।

শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনে শ্রীকৃষ্ণ অনবদ্য। শ্রীকৃষ্ণকে বিভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা যায়। জ্ঞানের দৃষ্টিতে, ভক্তির দৃষ্টিতে, প্রেমের দৃষ্টিতে, কর্মের দৃষ্টিতে, রাজনীতির দৃষ্টিতে, কূটনীতির দৃষ্টিতে ইত্যাদি। দেখা যাবে, সবেতেই তিনি আছেন, সবই তাঁতে আছে। কারণ, ঠাকুরের সেই বেলের উপমা–”তাঁকে যারা পেয়েছে, তারা জানে যে তিনিই সব হয়েছেন। তখন বোধ হয়—ঈশ্বর-মায়া-জীব-জগৎ। জীবজগৎসুদ্ধ তিনি। যদি একটা বেলের খোলা, শাঁস, বিচি আলাদা করা যায়, আরেকজন বলে—বেলটা কত ওজন ছিল দেখ তো, তুমি কি খোলা বিচি ফেলে শাঁসটা কেবল ওজন করবে? না, ওজন করতে হলে খোলা বিচি সমস্ত ধরতে হবে। ধরলে তবে বলতে পারবে, বেলটা এত ওজন ছিল। খোলাটা যেন জগৎ, জীবগুলি যেন বিচি। বিচারের সময় জীব আর জগৎকে অনাত্মা বলেছিলে, অবস্তু বলেছিলে। বিচার করবার সময় শাঁসকেই সার, খোলা আর বিচিকে অসার বলেই বোধ হয়। বিচার হয়ে গেলে সমস্ত জড়িয়ে এক বলে বোধ হয়। আর বোধ হয়, যে-সত্তাতে শাঁস সেই সত্তা দিয়েই বেলের খোলা আর বিচি হয়েছে। বেল বুঝতে গেলে সব বুঝিয়ে যাবে।”

শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যাখ্যা আর বর্ণনায় শ্রীকৃষ্ণ যেন দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীতলে বিরাজিত। শ্রীকৃষ্ণ বসে আছেন। নতজানু অর্জুন সখার স্তব করছেন, তুমি পূর্ণব্রহ্ম। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, আমি পূর্ণব্রহ্ম কিনা দেখবে এস। এই বলে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি কি দেখছ? অর্জুন বললে, আমি এক বৃহৎ গাছ দেখছি, তাতে থোলো থোলো কালো জামের মতো ফল ফলে রয়েছে। কৃষ্ণ বললেন, আরো কাছে এসে দেখ দেখি ও থোলো থোলো ফল নয়—থোলো থোলো কৃষ্ণ অসংখ্য ফলে রয়েছে—আমার মতো। অর্থাৎ সেই পূর্ণব্রহ্মরূপ বৃক্ষ থেকে অসংখ্য অবতার হচ্ছে যাচ্ছে।

ঠাকুর বলছেন : “কবীর দাসের নিরাকারের ওপর খুব ঝোঁক ছিল। কৃষ্ণের কথায় কবীর দাস বলত, ওঁকে কি ভজব? গোপীরা হাততালি দিত আর উনি বানর-নাচ নাচতেন।” বলছেন : “আমি সাকারবাদীর কাছে সাকার, আবার নিরাকারবাদীর কাছে নিরাকার।“

মাস্টারমশাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন : “যাঁর কথা হচ্ছে তিনিও যেমন অনন্ত, আপনিও তেমনি অনন্ত! আপনার অন্ত পাওয়া যায় না।”

তোতাপুরীও বুঝতে পারেননি শ্রীরামকৃষ্ণকে। বলেছিলেন : “আরে, কেঁও রোটি ঠোকতে হো?” ঠাকুর বিশুদ্ধ বাঙলায় হাসতে হাসতে বলেছিলেন : “দূর শালা! আমি ঈশ্বরের নাম করচি।”

শ্রীকৃষ্ণ অসীম আর সসীমের মধ্যে বাচ খেলান। এটি ঠাকুরের কথা। তিনি ব্রহ্ম। তিনি অনন্ত। অর্জুনকে দেখিয়েছিলেন তাঁর সেই রূপ। অর্জুন প্রার্থনা করেছিলেন, আপনার প্রেম, বৃন্দাবনলীলা, আপনার গোষ্ঠলীলা, রাসলীলা— এসবই তো সসীমে মধুর বিচরণ। হে পুরুষোত্তম! আপনার জ্ঞান, ঐশ্বর্য, শক্তি, বল, বীর্য ও তেজঃসমন্বিত ঈশ্বরীয় বিশ্বরূপ দেখার ইচ্ছা হচ্ছে।

ঝলসে উঠল সেই রূপ। সে কেমন? “দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুখিতা।/যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ।।” (ঐ, ১১।১২)—যদি আকাশে সহস্র সূর্যের প্রভা যুগপৎ সমুদিত হয়, তাহলে সেই দীপ্তি বিশ্বরূপের প্রভার কিঞ্চিৎ তুল্য হতে পারে।

সেকালে শ্রীকৃষ্ণ একালের আণবিক বিস্ফোরণ। পরীক্ষামূলক আণবিক বিস্ফোরণের রাতে লস এলামোস প্রোজেক্টের ডিরেক্টর বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার গীতার এই শ্লোকটিই বিস্ময়ে আবৃত্তি করেছিলেন। বোমাটি ফাটানো হয়েছিল জোরনাদা দেল মুয়েরতোতে। যার অর্থ-মৃত্যু উপত্যকা। দশ মাইল দূরে একটি পোস্ট আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ওপেনহাইমার। আরো অনেক সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ঐভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে। ওদিকে আকাশ যেন গলে গলে পড়ছে। কানে আসছে দর্শক বিজ্ঞানীদের বিস্ময়ের উক্তি—”Good God, the long haired boys have lost control.” ওপেনহাইমার বললেন গীতার ঐ শ্লোক-

“If the radiance of a thousand Suns
Were to burst into the sky
That would be like
The splendour of the mighty one.”

বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার—ছাত্র ও সহকর্মীদের প্রিয় ‘ওপি’–কন্ট্রোল টাওয়ারে একটি লোহার পোস্ট আঁকড়ে ধরে কম্পন ও ঝটিকা সামলাতে সামলাতে দেখছেন রথারূঢ় শ্রীকৃষ্ণকে। অর্জুনকে বলছেন : “কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো লোকান্ সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্তঃ।” (ঐ, ১১।৩২)

“I am become Death, the shatterer of worlds.”

ভগবান কী ভয়ঙ্কর! ভগবান—অর্থাৎ, অসীম, অনন্ত। Construction, destruction, creation, annihilation মুহূর্তের খেলা। ঠাকুরের সেই গল্প— দুম্ করে শব্দ হলো। কি হলো প্রভু? রাবণ জন্মাল। আবার দুম্। আবার কি হলো প্রভু? রাবণ বধ হলো। চোখের পলক। যা উঠছে—কোল থেকে উঠছে। যা পড়ছে—কোলেই পড়ছে। সবই শ্রীকৃষ্ণরূপী অনন্তের মুখগহ্বরে। “তেজোভিরাপূর্য জগৎ সমগ্রং। /ভাসস্তবোগ্রাঃ প্রতপন্তি বিষ্ণো।।” (ঐ, ১১।৩০) আমি ভয়ের ভয়, আমি মৃত্যুর মৃত্যু। আমি প্রাণের প্রাণ। “পিতাহহমস্য জগতো মাতা ধাতা পিতামহঃ।/বেদ্যং পবিত্রমোঙ্কার ঋক্ সাম যজুরেব চ।।” (ঐ, ৯।১৭)–ভক্ত জানেন, তুমি মাতা, তুমি পিতা, তুমিই সখা। ভক্ত আমাকে জানে। “ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ।/ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্।।” (ঐ, ১৮।৫৫)

কুরুক্ষেত্রে এ কেমন যুদ্ধ, ভগবান? যাদের মারবার মেরে রেখেছেন! রথ, রথী, অশ্বই শুধু নিয়ন্ত্রণে নেই, পরিস্থিতি, পরিণতি নামক অশ্বযুগল তাঁর লাগামে ধরা। একালের ভাষায়—এ যেন ‘Action replay’। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের দৃষ্টি উলটে দিলেন। জীব, তুমি সামনেটাই দেখ, কারণ তোমার দেখার যন্ত্র ঐরকমই। তোমাকে আমি পিছন দেখার মনশ্চক্ষু দান করি। যার নাম ‘দিব্যদৃষ্টি’। ‘হেমিস্ফেরিক্যাল আই’। উপনিষদের চোখ। চতুর্দিকে ব্ৰহ্ম। সৃষ্টি, স্থিতি, লয়—ত্রয়ী। ‘তজ্জলানিতি’। “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম।/তজ্জলানিতি শান্ত উপাসীত।” (ছান্দোগ্য উপনিষদ্, ৩।১৪।১) জগৎ ব্রহ্মময়। ব্রহ্মতে জাত, জীবিত, লীন। ‘তজ্জলানিতি’। কুরুক্ষেত্র নয়, আমাদের জীবন—’Action replay’। সব ঠিক করা আছে। কে করেছে? কর্ম আর কর্মফল। প্রারব্ধ, সংস্কার। এই কর্ম ও কর্মফল সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অতুলনীয়। যিনি কর্মে অকর্ম ও অকর্মে কর্ম দর্শন করেন তিনিই জ্ঞানী, যোগযুক্ত ও সর্বকর্মের কর্তা। কর্ম আর অকর্মের এইটিই বোদ্ধব্য রহস্য। এই জ্ঞানে মুক্তিলাভ। শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করছেন, মৃগতৃষ্ণায় জলের ন্যায় ও শুক্তিকায় রজতের ন্যায় নিষ্ক্রিয় আত্মাতে কর্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্ব দর্শন ভ্রান্ত জীবের স্বভাব। নৌকারূঢ় ব্যক্তি নৌকা চলিতে থাকিলে তটস্থ গতিহীন বৃক্ষসমূহে প্রতিকূল গতি এবং দূরবর্তী গতিশীল বস্তুকে গতিহীন দেখেন। এইরূপ বিপরীত দর্শন মায়িক সংসারের ধর্ম। ‘রিলেটিভ’। আপেক্ষিক। ইন্দ্রিয়কে ছাঁটতে হবে। আকাঙ্ক্ষাশূন্য কর্ম। মনকে সেই অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে-যে-অবস্থায় মন সদাতৃপ্ত ও নিরবলম্বন। শ্রীরামকৃষ্ণ এটিকে আরো সহজ করে দিলেন—বাঁদরছানা আর বেড়ালছানা। সমর্পণের দুটি ধরন। বাঁদরছানা মায়ের পেট জাপটে ধরে থাকে। নিজে ধরে। ছেড়ে গেলে পড়ে যাবে। মায়ের কিছু করার থাকবে না। ঠাকুর বলছেন, এটি জ্ঞানমার্গ। শাস্ত্র দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, বিচার দিয়ে ধরব। বিশ্বাসে আনব, তারপর ‘মা’ বলে ঝাঁপাব। অহং দিয়ে, ক্ষুদ্র আমি দিয়ে বৃহৎ ‘আমি’কে বুঝব। ঠাকুর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন—বোধহয় সম্ভব নয়। নৌকারূঢ় ব্যক্তি, তার জ্ঞান তো relative—আপেক্ষিক। Absolute-কে জানতে হলে, পেতে হলে ভক্তি দিয়ে অহংকে নস্যাৎ করতে হবে। বেড়ালছানার মতো মিউমিউ। মা যেখানে যেভাবে রাখবেন। সদাতৃপ্ত। আমার কোন ক্ষোভ নেই মা! যা করবে। যেভাবে রাখবে। অনন্তে ভেসে চলেছি একখণ্ড মেঘের মতো জল ঝরাতে ঝরাতে। জীবনের যাবতীয় কর্মসমূহ একসময় নিঃশেষ। “ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিব্রহ্মান্নৌ ব্ৰহ্মণা হুতম্।/ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকৰ্মসমাধিনা।” (গীতা, ৪।২৪)

বিশাল, বিচিত্র জীবনলীলা তাঁর। জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি—তিনটি শেখাতে এসেছিলেন। বিশাল ভারত—শ্রীকৃষ্ণক্ষেত্র। তিনি যেন অপেক্ষা করেছিলেন, কবে আসবেন আরেকজন, সময়ের কোন্ পাদে শ্রীরামকৃষ্ণ। যিনি জ্ঞান দিয়ে ব্রহ্ম বুঝবেন, শুধু বোঝা নয়—উপলব্ধিরও ঊর্ধ্বে আস্বাদন। সেতু রচনা। ভক্তি দিয়ে লীলা বুঝবেন। বলবেন, ব্রহ্ম আর মায়া এক। ওদিক থেকে এদিক দেখা, এদিক থেকে ওদিক দেখা। বলবেন, ব্রহ্মও সত্য, মায়াও সত্য। তবে ব্রহ্মের মায়া, মায়ার ব্রহ্ম নয়।

ঐ যে শ্রীকৃষ্ণের রথে আরোহী মায়া। বহু শ্বেতাশ্বযুক্ত এক মহারথ। অহো, সে কী দৃশ্য! অসংখ্য শঙ্খ, ভেরী, ঢাক, মৃদঙ্গ ও রণশিঙ্গা বেজে উঠল। ভয়াবহ রণবাদ্য। রথারোহী দিব্যদর্শন দুই পুরুষ। শ্রীকৃষ্ণের ছবিটি কেমন! ঘাড়টি পিছন দিকে হেলিয়ে দুই ঠোঠের কাছে ধরেছেন তাঁরই দ্বারা নিহত জলদৈত্য পঞ্চজনের অস্থিতে নির্মিত পাঞ্চজন্য শঙ্খ। বিশাল সৈন্য সমাবেশ, ‘মহতীং চমূম্‌’

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধর্ম ও সাধনার কত ধারা খুলে দিয়ে গেছেন! ভারত কৃষ্ণময়। জ্ঞানী ধরবেন ব্রহ্মের পথ। তান্ত্রিক নেবেন তন্ত্রের পথ। রাধাযন্ত্রে তন্ত্রসাধন করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : “গোপীরা কাত্যায়নীপূজা করেছিলেন। সকলেই সেই মহামায়া আদ্যাশক্তির অধীনে। অবতার আদি পর্যন্ত মায়া আশ্রয় করে তবে লীলা করেন। তাই তাঁরা আদ্যাশক্তির পূজা করেন।”

এই লীলা। দর্শন জ্ঞানমার্গ ছেড়ে ভক্তিমার্গে প্রবেশ করলে খুলে যায় লীলাক্ষেত্র। অনন্ত অনন্তে থাক। মহাকাল কুম্ভকে থাক। টুকরো কালে, টুকরো জীবনে ভক্তি আস্বাদনের মতো কী আছে! ভগবানের ষড়ৈশ্বর্যে একটি অভাব— ভক্তি নেই। ভক্তির মালিক ভক্ত জীব। ঠাকুর সেইটিই আমাদের ধরাতে এসেছিলেন। বলছেন : “যে অকিঞ্চন, যে দীন—তার ভক্তি ঈশ্বরের প্রিয় জিনিস। খোলমাখানো জাব যেমন গরুর প্রিয়! দুর্যোধন অত টাকা, অত ঐশ্বর্য দেখাতে লাগল, কিন্তু তার বাটীতে ঠাকুর গেলেন না। তিনি বিদুরের বাটী গেলেন। তিনি ভক্তবৎসল, বৎসের পাছে যেমন গাভী ধায়, সেইরূপ তিনি ভক্তের পাছে পাছে যান।”

জ্ঞান, সে এক পথ বটে; কিন্তু ভক্তি, অনুরাগ—তাতে কোন চকমকি নেই। ঠাকুর বলছেন : “অব্যভিচারিণী ভক্তি, যার অপর নাম নিষ্ঠা ভক্তি। যেমন একডেলে গাছ, সোজা উঠেছে। ব্যভিচারিণী ভক্তি যেমন পাঁচডেলে গাছ। গোপীদের এমন নিষ্ঠা যে, বৃন্দাবনের মোহনচূড়া, পীতধরা পরা রাখালকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু ভালবাসবে না। মথুরায় যখন রাজবেশ, পাগড়ি-মাথায় কৃষ্ণকে দর্শন করলে, তখন তারা ঘোমটা দিলে। আর বললে, ইনি আবার কে? এঁর সঙ্গে আলাপ করে আমরা কি দ্বিচারিণী হব?”

শ্রীকৃষ্ণ যোদ্ধা, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ‘ডিপ্লোম্যাট’, স্বয়ং ভগবান। ভগবান মানুষের রূপ ধারণ করেন, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে মাটির পৃথিবীতে এলেন কংসের কারাগারে। কারাগার মানবদেহ। ইন্দ্রিয়ের শাসনে মানুষের ভগবান পিষ্ট। মুক্তির পথ? শ্রীকৃষ্ণ। ভক্ত হও। তখন আমি তোমার সামনে নয়—পিছনে, পিছনে যাব। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, সেটি শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে জেনে নিই—”বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে তাঁকে দর্শন হয় না। শ্রীমতী যখন বললেন, আমি কৃষ্ণময় দেখছি, সখীরা বললে, কৈ, আমরা তো তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না! তুমি কি প্রলাপ বকচ? শ্রীমতী বললেন, সখি! অনুরাগ-অঞ্জন চক্ষে মাখ দেখতে পাবে।’

জ্ঞান সহায়ে শ্রীকৃষ্ণকে অনেকেই বোঝার ও বোঝাবার প্রয়াস পেয়েছেন। সে ভাল, তবে শ্রীকৃষ্ণকে হৃদয়ে ধারণ করতে হলে শ্রীরামকৃষ্ণের হাত ধরতে হবে। সে-ভিন্ন উপায় নেই। সুরেন্দ্রের বাড়িতে মহেন্দ্র গোস্বামী বলছেন (তিনি সিমুলিয়ায় থাকতেন। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে কয়েক মাস ছিলেন। যদুলাল মল্লিকের বাগানবাড়িতে মাসাবধিকাল ধরে ভাগবত-উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন।) : “আমি কয়েক মাস প্রায় সর্বদা এঁর কাছে থাকতাম। এমন মহৎ লোক আমি কখনো দেখি নাই। এঁর ভাবসকল সাধারণ ভাব নয়।”

ঠাকুর বলছেন : “এ কী, এসব তোমার কী কথা! আমি হীনের হীন, দীনের দীন; আমি তাঁর দাসানুদাস। কৃষ্ণই মহান। যিনি অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, তিনিই শ্রীকৃষ্ণ। দূর থেকে দেখলে সমুদ্র নীলবর্ণ দেখায়, কাছে যাও কোন রঙ নাই যিনি সগুণ, তিনিই নির্গুণ; যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা। শ্রীকৃষ্ণ ত্রিভঙ্গ কেন? রাধার প্রেমে। যিনিই ব্রহ্ম তিনিই কালী, আদ্যাশক্তি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। যিনি কৃষ্ণ তিনিই কালী। মূল এক—তাঁর সমস্ত খেলা লীলা। শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ, শ্রীমতী তাঁর শক্তি—আদ্যাশক্তি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যুগলমূর্তির মানে কি? পুরুষ আর প্রকৃতি অভেদ। তাঁদের ভেদ নাই। পুরুষ প্রকৃতি না হলে থাকতে পারে না; প্রকৃতিও পুরুষ না হলে থাকতে পারে না। একটি বললেই আরেকটি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে। যেমন অগ্নি আর দাহিকাশক্তি। দাহিকাশক্তি ছাড়া অগ্নিকে ভাবা যায় না। আর অগ্নি ছাড়া দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। তাই যুগলমূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টি শ্রীমতীর দিকে ও শ্রীমতীর দৃষ্টি কৃষ্ণের দিকে। শ্রীমতী গৌরবর্ণ বিদ্যুতের মতো; তাই কৃষ্ণ পীতাম্বর পরেছেন। শ্রীকৃষ্ণের বর্ণ নীল মেঘের মতো; তাই শ্রীমতী নীলাম্বর পরেছেন। আর শ্রীমতী নীলকান্ত মণি দিয়ে অঙ্গ সাজিয়েছেন। শ্রীমতীর পায়ে নুপূর, তাই শ্রীকৃষ্ণ নুপূর পরেছেন; অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের অন্তরে-বাহিরে মিল।”

মথুরমোহন ঠাকুরকে মথুরায় এনেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ধ্রুবঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবে বিভোর। দিন অবসান প্রায়। অতীত আর বর্তমানের সময়চিহ্ন ঘুচে গেছে। ঠাকুর স্পষ্ট দেখছেন, যমুনা দুভাগ হয়ে গেছে। সেই রাত ফিরে এসেছে। মেঘ এসেছে, বিদ্যুতের ঝিলিক। এলোমেলো বাতাস। ও কে যায়! ঐ তো বসুদেব! যমুনা পার হচ্ছেন, কোলে তাঁর কৃষ্ণ! বৃন্দাবন। বৃন্দাবনবাসী অবাক-এ কী অলৌকিক দৃশ্য! গিরি গোবর্ধনের শীর্ষে অঙ্গাবরণহীন দিব্যপুরুষটি কে? শ্রীকৃষ্ণ কি ফিরে এলেন? দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *