3 of 3

“মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”

“মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!”

রাত তিনটে। শেষ রাতের চাঁদের আলোয় চারপাশ ঝকঝক করছে। ময়ূরপঙ্খীর মতো সাদা একখণ্ড মেঘ নিঃসঙ্গ গগনবিহারী। বলা কি যায়, হয়তো তিনিই ফিরছেন দক্ষিণ থেকে উত্তরে তাঁর ভুবনভ্রমণ শেষে! রাত ঠিক তিনটে। চরাচর সুপ্ত। দক্ষিণেশ্বরের নহবতের পশ্চিম ধারের সিঁড়ির শেষ ধাপে এক ধ্যানমগ্না নিশ্চল রমণীমূর্তি। পশ্চিমের চাঁদ ঢেলে দিয়েছে উজাড় উছল জোছনা। বাতাসের দামাল দাপটে গায়ের আঁচল উড়ে গেছে। এলো চুল ঝিরিঝিরি উড়ছে। কোলের ওপর ধ্যানের ভঙ্গিতে হাতদুটি একটির ওপর আরেকটি স্থাপিত। সোনার রুলিতে সূক্ষ্ম আলোর ঝিলিক। গলার হার চিকচিক করছে। নিশ্চল ধ্যানে নারীমূর্তি বাহ্যজ্ঞানহারা। বাতাসের ঘুরপাক। বিদায়ী চাঁদের বিষণ্ণ হাসি। গঙ্গার জলে এপার থেকে ওপার চন্দ্রকিরণের রুপোলি পথরেখা। লালপাড় শাড়ি পরা, সালঙ্কারা এই দেবী কে!

রোজকারমতো শ্রীরামকৃষ্ণ ঝাউতলার দিকে চলে গেলেন। আবার ফিরে এলেন তাঁর ঘরে। ঠাকুরের জুতোর শব্দ টের পেলেন না শ্রীমা সারদাদেবী। এই পবিত্র স্বর্গীয় দৃশ্যে ঠাকুর বড় খুশি হলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সেবক যুবক যোগীনও (পরবর্তী কালে স্বামী যোগানন্দ) সেই দিব্য দৃশ্য দেখলেন। যোগীন অভিভূত। সময় বড়ই চঞ্চল। একটু পরেই চাঁদ নেমে যাবে। সরবে এসে পড়বে দিবসের সূর্যরথ। স্বর্গীয় মুহূর্তটি মুছে যাবে। লজ্জাশীলা মা অদৃশ্য হবেন নহবতের অন্দরে।

ঠাকুর বড় খুশি আজ। ক্রমশই তৈরি হয়ে উঠছেন সহধর্মিণী সারদা। ঠাকুরের আরব্ধ কর্ম মাকেই যে করতে হবে। সঙ্ঘজননী হতে হবে। রামকৃষ্ণ- তরঙ্গে সুদূরপ্রসারী একটা ঢেউ তুলতে হবে। সেই অভিঘাত প্রাচ্য থেকে চলে যাবে পাশ্চাত্যে। তোমার সন্তানদল দিকে দিকে প্রচার করবে ভারতধর্ম। যে- ধর্মের সারকথা—ভক্তি, মুক্তি, শান্তি ও প্রেম। সে-ধর্মের মাথা নেই, আছে আলিঙ্গনের হাত। সে-ধর্মে বিচার-বিতর্ক নেই, আছে বিশ্বাস। সে-ধর্মের শেষ কথা—”যত্র জীব তত্র শিব”। সেই ধর্মের প্রবক্তা সন্ন্যাসীদের তৈরি করবে নরেন্দ্রনাথ। সে নিজের মোক্ষ চাইবে না, সে শুধু কাঁদবে,

ক্ষোভে নয়— বিক্ষোভে। সমস্ত ভণ্ডামি, সঙ্কীর্ণতা, উৎপাত, অত্যাচার, শৃঙ্খল, পরাধীনতা, দারিদ্র্য, অনাহারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে বলবে : “I shall revolutionize the monastic order!”

জোছনা রাত মা খুব ভালবাসতেন। চারপাশ কেমন ছলছল করে! সারা পঞ্চবটীতে আলো-ছায়ার রহস্যময় খেলা। গগনস্পর্শী মন্দিরচূড়া। ধ্যানস্থ ভৈরবমূর্তি। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে গঙ্গার জলে। মা বসে থাকেন, ভাবেন, কথা বলেন চাঁদের সঙ্গে : “তোমার ঐ জোছনার মতো আমার অন্তর নির্মল করে দাও।”

ঠাকুর রাতশেষের ধ্যানজপের ওপর খুব জোর দিতেন। তিনি জানতেন, কিছু না করলে কিছু পাওয়া যায় না। কষ্ট না করলে কেষ্ট কি মেলে! কত কষ্টের সাধনপথ তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে! উথালপাথাল নদীতে মাঝিকে গলদঘর্ম হয়ে দাঁড় বাইতে হয়। তারপর অনুকূল বাতাস পেলে সে পালটি তুলে দিয়ে হালে বসে যায়, একহাতে হুঁকো ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ করে টানে, ফুরফুরে বাতাসে নৌকা ভেসে চলে। সহধর্মিণী সারদাকে সেই পথেই নিয়ে চলেছেন। ভোররাতে তিনটের সময় শৌচে যাওয়ার সময় নহবতের পাশে এসে ঠাকুর ডাকতেন : “ও লক্ষ্মী, ওঠরে ওঠ। তোর খুড়িকে তোল রে। আর কত ঘুমুবি! রাত পোহাতে চলল। গঙ্গাজল মুখে দিয়ে মার নাম কর, ধ্যানজপ আরম্ভ করে দে।” এই ডাকে তাঁদের দুজনের পাতলা ঘুম ভেঙে যেত। ধড়মড় করে উঠে বসতেন। শয্যা বিদায়। ভোর হয়ে আসছে। নতুন দিনের জন্মক্ষণে অনন্তের চিন্তা। জীবন-মৃত্যুর দেবীকে স্মরণ। শীতকালে কখনো কখনো শ্রীমা লক্ষ্মীদেবীকে আরেকটু ঘুমোবার সুযোগ দেওয়ার জন্য, ফিসফিস করে বলতেন : “তুই চুপ কর, ওঁর চোখে ঘুম নেই। এখনো ওঠার সময় হয়নি— কাক-কোকিল ডাকেনি, সাড়া দিসনি।’

আহা! দাম্পত্যজীবনের কী অপূর্ব মধুর চিরন্তনী চিত্র! একজন অবতার, আরেকজন ষোড়শী, সাক্ষাৎ সরস্বতী, নরেন্দ্রনাথের ‘জ্যান্ত দুর্গা’! সে হোক না, সম্পর্কটা যে বড় নিবিড়! স্বামী-স্ত্রী! পরবর্তী কালে নিবেদিতা ও ক্রিস্টিন যখন তাঁকে খ্রীস্টান বিবাহপ্রথা বোঝাবার সময় বিবাহমন্ত্র বলছিলেন : “সুখে-দুঃখে, সৌভাগ্যে-দারিদ্র্যে, রোগে-স্বাস্থ্যে যতদিন না মৃত্যু আমাদিগকে পৃথক করে, ততদিন আমরা অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা থাকব।… শ্রীমা তখন অভিভূত। বললেন : “আবার বল, আবার শুনি তোমাদের মন্ত্র।” নিজের জীবনের মধুর মুহূর্তগুলি অবশ্যই তখন তাঁর মনে পড়ে থাকবে।

ঠাকুর যে সব দেখতে পান, শুনতে পান। দুষ্টুমি তোমার দেখাচ্ছি—সাড়া দিসনি! শুয়ে থাক! ওঁর চোখে ঘুম নেই! তাহলে তোমার চোখেই বা ঘুম থাকবে কেন? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা! ব্রহ্মে লীন ঠাকুরের মুখে বালকের দুষ্টু হাসি। দাঁড়াও, দিই তাহলে দরজার চৌকাঠে গাড়ুর জল ঢেলে!

জল আছড়ে পড়ার শব্দ। মেঝেতে সামান্য বিছানা। জগজ্জননীর ভূমিশয্যার দিকে গড়িয়ে আসছে বিশ্বেশ্বরের গঙ্গা। গেল, গেল, সব ভিজে গেল! ওঠ, ওঠ, লক্ষ্মী, উঠে পড়, উঠে পড়! বাইরে গোলাপী আঁধারে ঠাকুরের নৃত্য—কেমন মজা, কেমন মজা! সেই দক্ষিণেশ্বর, নহবত, গঙ্গা, সিঁড়ির ধাপ, পথ, ঝাউতলার স্থান, বেলতলা, ম্যাগাজিন সবই আছে। শেষরাতের সেই চাঁদ পশ্চিমে ঢলতে ঢলতে আজও জোছনা ছড়ায়। লীলাক্ষেত্র আছে, লীলা নেই। হংস আর হংসী কালের কপাট খুলে মহাকালে অন্তলীন।

শেষরাতের সাধন-অভ্যাসটি সংস্কারে এমনভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুর যে, শ্রীমার সারাজীবনে তা অব্যাহত ছিল। রাত তিনটেয় ঠাকুর-দেবতার নাম করতে করতে তিনি শয্যা ত্যাগ করে প্রথমেই শ্রীশ্রীঠাকুরের চিত্রপট দর্শন করতেন। প্রাতঃকৃত্য সাঙ্গ করে ঠাকুরকে শয়ন থেকে তুলতেন, তখন তিনি মাতা যশোদা :

“উঠ লালজী, ভোর ভয়ো
সুর-নর-মুনি-হিতকারী!”

তখন তুমি আমাকে ওঠাতে, এখন আমি তোমাকে ওঠাই। মুখ ধুইয়ে, চুল আঁচড়ে পরিপাটি করে বসাই। মনে পড়ে কি তোমার, শরীর ভাল করার জন্য কত কায়দায় তোমাকে দুধ খাওয়াতুম! পাঁচসেরকে মেরে একসের। নাও, ওঠ লালজী। আমি জপে বসি। মা পরবর্তী কালে বলতেন : “জীবনটাকে তিনি এমনভাবে গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, রাত তিনটে বাজলেই যেখানেই থাকি, কানের কাছে যেন বাঁশীর ফুঁ শুনতে পেতুম।”

আমরা কেন শুনতে পাই না? ঠাকুর তো পল্লীতে পল্লীতে, দুয়ারে দুয়ারে, রাত শেষে স্নিগ্ধস্বরে ডাক দিয়ে যান। ওঠ, ওঠ, আর কত ঘুমোবে! রাত পোহাতে চলল, গঙ্গাজল মুখে দিয়ে মার নাম কর। শুনতে পাই হয়তো সে- ডাক, কিন্তু বিষয়শয্যা ছাড়ার বাসনা যে নেই! কামনার বালিশে মাথা। “বিষয়ে মেজেছ মাঞ্জা, কর্কশা হয়েছে দড়ি।” ঠাকুরের উপমা অতুলনীয়, অমনটি আর হবে না। আমার মা-ই বা কম যান কিসে! বলছেন : “পড়ে থাক, ধরে থাক।” আরো বলছেন : “শুধু তাঁর কৃপাতে (সব) হয়। তবে ধ্যানজপ করতে হয়। তাতে মনের ময়লা কাটে। পূজা, জপ, ধ্যান—এসব করতে হয়। যেমন ফুল নাড়তে-চাড়তে ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে গন্ধ বের হয়, তেমনি ভগবত্তত্ত্ব আলোচনা করতে করতে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়। নির্বাসনা যদি হতে পার, এক্ষুণি হয়।” আবার বলছেন : “কৃপালাভ ও কৃপাবিষয়ে সচেতনতা কেমন জান? তুমি যদি একটা খাটে ঘুমিয়ে থাক, আর কেউ সেই খাটখানা সমেত তোমাকে অন্যত্র নিয়ে যায় তাহলে তুমি ঘুম ভাঙতেই কি বুঝতে পারবে যে, স্থানান্তর হয়েছে? না, যখন বেশ পরিষ্কারভাবে ঘুমের ঘোর কেটে যাবে তখন দেখবে যে, অন্যত্র এসেছ!”

দক্ষিণেশ্বরে মায়ের আবাসস্থল নহবতটি ছিল গুহার মতো। ঠাকুর রহস্য করে বলতেন : “ওরে রামনেলো! খাঁচায় শুক-সারী আছে; ফলমূল, ছোলাটোলা কিছু দিয়ে আয়।” সকলের সামনে যখন বলতেন, সবাই ভাবতেন, সত্যি পাখি। ঠাকুর জানতেন, ঐ গুহায় আছে রামকৃষ্ণ-অগ্নি, বিশ্বেশ্বরের শক্তি। আধুনিক ‘পোখরান’। তফাত এই, আত্মচৈতন্যের আণবিক বিস্ফোরণের ভবিষ্য-শক্তি সযত্নে লালিত হচ্ছে বিজ্ঞানী রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক প্রযুক্তিতে।

আইরিশদুহিতা ভারতভগিনী নিবেদিতা বাঙলায় বলেছেন : “মাতাদেবী, আপনি হন আমাদিগের কালী!” সাথী ক্রিস্টিনও ঐকথা বললেন। মা হাসতে হাসতে বলছেন : “না বাপু, আমি কালী-টালী হতে পারব না। জিব বার করে থাকতে হবে তাহলে!” নিবেদিতা ও ক্রিস্টিন বললেন : “মাকে অত কষ্ট করতে হবে না, আমরাই তাঁকে জননীরূপে দেখব। শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের শিব।”

ঠাকুর একদিন সমাধিভঙ্গের পর তাঁর দর্শনের কথা মাকে বলেছিলেন : “দেখ গা, আমি একদেশে গেছলুম—সেখানকার লোক সব সাদা সাদা। আহা তাদের কি ভক্তি!”

ঠাকুরের দর্শনই ঐ অপূর্ব ছবি—প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মিলন! বসে আছেন দুজনে মুখোমুখি—জননী সারদা আর ভারতকন্যা নিবেদিতা, মায়ের ‘খুকি!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *