3 of 3

“আমি জানি তুমি কে”

“আমি জানি তুমি কে”

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ। মাঝে মাঝে ভক্তদের পরিহাস করে বলছেন, এত মল কোথা থেকে আসে? এ-দেহটা কি মল দিয়েই তৈরি? ঠাকুরের আমাশা হয়েছে। কঠিন আমাশা। হাতের জল যেন শুকোচ্ছে না। শরীর কৃশ হয়ে পড়েছে। দুর্বল। জ্বর। একদিন বিরক্ত হয়ে বলছেন, অবতারই বটে! অবতারের পেটের অসুখ হয়! যেন বলতে চাইছেন—ভগবানের ইনফ্লুয়েঞ্জা! ডাক্তার বলছেন, দেখি, জিভটা দেখান তো! শুইয়ে পেট টিপছেন, আর বারেবারে জিজ্ঞেস করছেন, লাগছে? লাগছে?

দেহধারণ করলেই ‘ট্যাক্স’ দিতে হবে। সেকালের দক্ষিণেশ্বরের জল! ঠাকুর গঙ্গার জল ব্যবহার করতেন। বর্ষার জলে নানা দূষণ, অ্যামিবায়োসিস, জিয়ার্ডিয়াসিস। একালের ওষুধ সেকালে ছিল না।

ঠাকুর অসুস্থ। সেই সংবাদ পেয়ে মা সারদা জয়রামবাটী থেকে দক্ষিণেশ্বরে চলে এসেছেন। ঠাকুরের পরম ভক্ত ধনবান শম্ভুচন্দ্র মল্লিক নহবতের ক্ষুদ্র পরিসরে মায়ের বসবাসের কষ্ট দেখে মন্দিরের কাছেই একটি চালাবাড়ি করে দিয়েছিলেন। আড়াইশ টাকার জমি। নেপালের রাজকর্মচারী কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের দেওয়া শালকাঠ। মা সেই কুটিরে এসে উঠেছেন। ঠাকুর মন্দিরে তাঁর ঘরে, মা তাঁর কুটিরে। হৃদয়রামের স্ত্রীও মায়ের কাছে এসেছেন। মায়ের সঙ্গিনী।

এইসময় এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। কোথা থেকে প্রবীণা এক মহিলা এলেন। তিনি এসেই ঠাকুরের সেবার কাজে নিযুক্ত হলেন। কে মা তুমি? তিনি বললেন, আমি কাশীতে থাকি, কাশী থেকে এসেছি। একদিন রাতে তিনি দৈবনির্দিষ্ট অদ্ভুত একটি কাজ করলেন। এতকাল মা ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে ঠাকুরের কাছে প্রয়োজনে আসতেন। সলজ্জ বধূটির মতো। আর তো বধূটি থাকলে চলবে না। ভবিষ্যৎ যে এগিয়ে আসছে, এইবার যে জগতের মা- হতে হবে। শত সন্তানের জননী সারদা। মন্দির বন্ধ হয়েছে। কর্মচারীরা নিজেদের এলাকায়। রাতের নির্জনতা চারপাশে থমথম করছে। ঠাকুরের ঘরে প্রদীপের আলো। সন্ধ্যায় ধুনো দেওয়া হয়েছিল। কোণে কোণে সেই গন্ধের অবস্থান। ঠাকুর বসে আছেন তাঁর ছোট খাটটিতে। ভাবে বিভোর। পেট পড়ে আছে পেটে। জ্বর আছে জ্বরে। মন অখণ্ডের ঘরে। কানে অখণ্ডের করতালি। খণ্ডকাল লজ্জায় জিভ কেটে মা কালী রূপে দাঁড়িয়ে পড়েছেন অখণ্ডের বুকে। বিভোর ঠাকুর বসে আছেন আলোকমণ্ডল হয়ে। সেই প্রবীণা কাশীবাসিনী রহস্যময়ী লজ্জাপটাবৃতা জননী সারদাকে নিয়ে ঠাকুরের ঘরে প্রবেশ করলেন। মায়ের অবগুণ্ঠন খুলে দিলেন। ঠাকুর মৃদু হেসে বললেন, বস, বস।

ঠাকুর মাকে লজ্জা শেখাতেন। নম্রতা, শালীনতা নারীর অলঙ্কার। নহবত চিক দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। মা শেষ রাতে স্নানাদি সেরে সেই যে চিকের আড়ালে চলে যেতেন, সারাদিনে আর বেরতেন না। মন্দিরের কর্মচারীরা বলতেন, শুনেছি বটে তিনি আছেন। সেই ঠাকুরও কিছু বললেন না। ঠাকুর ভগবৎ কথা শুরু করলেন। বসতে বলেছিলেন, তাঁরা বসেননি। দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছেন। শুনতে শুনতে রাত ভোর। পুব আকাশে লাল সূর্য। কচি রোদ বাইরের দালানে। পঞ্চবটী মুখর পাখির ডাকে।

অবতারের অসুখ হলো ছল। লোকশিক্ষা। রোগ জানুক আর দেহ জানুক। অপূর্ব অভিসার। মা দ্রুত ফিরে গেলেন। এসেছিলেন বধূ সারদা, ফিরে গেলেন মা সারদা। প্রবীণা রহস্যময়ী রমণী যেমন হঠাৎ এসেছিলেন, সেইরকম হঠাৎই চলে গেলেন একদিন। মা প্রথম যেবার কাশী গেলেন ঠাকুরের দেহরক্ষার কয়েকদিন পর, তিনি অনেক অনুসন্ধান করেছিলেন ঐ প্রবীণার। সন্ধান পাননি। কেউ বলতে পারেনি। তাহলে কে এসেছিলেন কাশী থেকে? স্বয়ং অন্নপূর্ণাই কি?

ঠাকুরের সমস্ত সাধন তখন শেষ। ব্রহ্মবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরে তখন তাঁর সহজ বিচরণ। তিনি বলতেন, আমার বিজ্ঞানীর অবস্থা, সহজ অবস্থা। কৃষকের সব ফসল ঘরে উঠে যাওয়ার পর তখন তার যে-অবস্থা। যেদিকে তাকায় সর্বত্র পূর্ণতার ছবি। হৈমন্তী পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকাবার অবসর মেলে। দূর কোন আত্মীয়ের বাড়ি আলের পথ ধরে যাওয়া যায়। দু-চারজনের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প। ময়রার দোকানের সামনে বাঁশের মাচানে বসে দুটো গরম জিলিপি। প্রশ্ন করে জানা গেল, ফসল তুলে নেওয়া মাঠে ঐ যে সামিয়ানা—ওখানে আজ রাতে যাত্রা হবে। পালার নাম ‘হরিশ্চন্দ্র’। তাহলে এই রইল ভাই আমার পোঁটলা- পুঁটলি তোমার কাছে, পালাটা আজ দেখে যাই। ঠাকুরের এইরকমই সহজ অবস্থা, দহনের কাল শেষ এখন দোহনের কাল। এখন তিনি গীতা। এধার ওধার দুধার থেকেই। ওদিক থেকে তাগী, এদিক থেকে গীতা। গীতার স্বরূপ!

“সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ।
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ।।”

সমস্ত উপনিষদ্ গাভীস্বরূপ, গোপালনন্দন দোহনকর্তা, অর্জুন বৎসতুল্য, পণ্ডিতগণ পানকর্তা, গীতার অমৃতস্বরূপ বাণী দুগ্ধসদৃশ। ঠাকুর এখন গীতা। মা-ও কি নন? মায়েরও সহজ অবস্থা। লজ্জা, জড়তা, ভয় কেটে গেছে। ঠাকুর স্ত্রীকে বর্জন করেননি, পূর্ণ মর্যাদায় গ্রহণ করেছিলেন। মায়ের তখন বয়স আঠার। আলাদা ঘর নয়, সমশয্যায় শয়নের অধিকার দিয়েছিলেন।

ঠাকুর একদিন প্রশ্ন করলেন, তুমি কে?

মা বললেন, আমি তোমার সেবা করতে আছি।

ঠাকুর বললেন, কী?

মা এবার দৃঢ়স্বরে বললেন, তোমার সেবা, তোমার সেবা করতে আছি।

ঠাকুরের দ্বিতীয় প্রশ্ন—তুমি আমা বৈ আর কাউকেও জান না?

মা দৃঢ় প্রতিষ্ঠায় বললেন, না।

ঠাকুর তিন সত্য করালেন—আর কাকেও জান না?

না।

আর কাকেও জান না?

না।

বেশ, তাহলে এইবার গভীর রাতের অনন্তে বিচরণকারী তোমার স্বামীকে দেখ। মানুষ, কিন্তু মানুষ নয়। এই এখানে, তো ঐ ওখানে! আঠার বছরের এক নারীর সে কী ভয়ঙ্কর অলৌকিক অভিজ্ঞতা! একাদিক্রমে আট মাস। যত রাত বাড়ছে, ঠাকুর ক্রমশই অন্যরকম হয়ে যাচ্ছেন। সারা ঘরে পায়চারি করছেন। মৃদু মৃদু করতালি। জগদম্বার সঙ্গে কত কথা, আবদার, খিলখিল হাসি। কোমর থেকে কাপড় খুলে পড়ে গেছে। মা অসহায়ের মতো দেখছেন। এই তো একটু আগে সাধারণ একজন মানুষ, সাধারণ সব কথা। পরক্ষণেই এ কী পরিবর্তন! মুহূর্তে সমাধি। কাঠের পুতুল! একদিন সমাধি আর কিছুতেই ভাঙে না। জ্ঞান আর ফেরে না। মা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলেন হৃদয়ের কাছে।

ঠাকুর মাকে বললেন, আমার সব ভার তো তোমাকে দিয়েছি, তুমি অন্যের কাছে ছুটে যাবে কেন! আমার যখনি ঐ অবস্থা হবে, তুমি আমার কানে কানে এই বীজ বলবে, এই নাম। সে তো হলো; কিন্তু মায়ের রাতের ঘুমটি চলে গেল। ঠাকুর বললেন, তোমার শরীর ভেঙে যাবে। রাতে তুমি নহবতে আমার মায়ের কাছে শোবে।

একদিন মাকে বললেন, আমি পুরুষ নই, আমি জগদম্বার দাসী।

মা বললেন, তাহলে এস তোমাকে সাজিয়ে দিই।

শাড়ি পরালেন, অলঙ্কার দিয়ে সাজালেন। ঠাকুর তখন সুন্দরী এক রমণী। পায়ে পায়জোর। সাজাতে সাজাতে মা ভাবছেন, আমিও জগদম্বার দাসী, দাসীভাবে ভাবিত ঠাকুরের সখী। দুই সখীতে পরমানন্দে ঈশ্বরের আলাপন। মায়ের মনে একবার সন্তানের আকাঙ্ক্ষা উঁকি দিয়েছিল। মুখে কিন্তু বলেননি। ঠাকুর কিন্তু ঠিক বুঝেছেন। বললেন, কিগো, মাত্র একটি সন্তান চাইছ! তোমার যে শত শত সন্তান হবে। তাদের ‘মা, মা’ ডাকে তুমি অস্থির হবে। ঐ আসছে তারা।

কলকাতা থেকে ঘাটাল স্টীমার চলাচল শুরু হয়েছে। সস্ত্রীক শ্রীরামকৃষ্ণ দেশে চলেছেন। কর্তাটি সেজে আসনে বসেছেন। পাশে আমাদের মা-জননী। লালপাড় শাড়ি, দিঘল ঘোমটা। কোলের ওপর পুঁটলি। পায়ের কাছে আরেকটি। ঠাকুর তাঁকে শিখিয়েছেন, এমনকালে কি কি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে! ভগবানের পৃথিবীতে চোরের অভাব নেই। ঠাকুর মাকে আগলে রেখেছেন—যেন জলে পড়ে না যান!

যাত্রীরা কেউ জানে না, এই যাত্রী দুজন কে! জানবে অনেক পরে, যখন ঘরে ঘরে ছবি ঝুলবে। একজন যাত্রী হয়তো জিজ্ঞাসা করলেন, কর্তার কোথায় যাওয়া হবে?

স্টীমার বন্দরে ভিড়ল। দুজনে নামলেন। জগদম্বার দুই সখী। বড় মধুর লাগছে। তৃতীয় কারো মানুষী শাসন নেই। স্টীমার থেকে উঠলেন নৌকায়। ঠাকুরের চেয়ে মা অনেক সমর্থ। ঠাকুরকে কষকষে করে ধরে আছেন। বলছেন, টাল সামলে।

নৌকা দ্বারকেশ্বর নদে গিয়ে পড়ল। নৌকা থামল বালি গ্রামে। বালি থেকে কামারপুকুরের দূরত্ব প্রায় চার ক্রোশ। হঠাৎ বৃষ্টি এল মুষলধারে। কাছেই একটি নবনির্মিত গৃহ—এক ভক্ত মোদকের। পল্লীটি গোঁসাইদের। আশপাশে আরো কয়েকটি গোঁসাইবাড়ি। ঠাকুর, মা সেই মোদকের অতিথি হলেন। নিম্নচাপের অকাতর বৃষ্টি। তিন দিনের আগে ঠাকুর সেই আশ্রয় ত্যাগ করতে পারলেন না।

ভগবানের আশ্চর্য লীলা! ভক্ত মোদকের বাসনা ছিল, নবনির্মিত আবাসে প্রবেশের আগে কোন সাধুসজ্জনকে তিনদিন রেখে সেবা করবেন। ঠাকুরের আগমনে যেন উৎসব লেগে গেল। লোকে লোকারণ্য। ঠাকুরের শ্রীমুখ-নিঃসৃত ধর্মকথা, নামসঙ্কীর্তন শোনার জন্য।

মা পরে স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন : “নৌকায় করে বালি হয়ে দেশে যাওয়া—একসঙ্গে খাওয়া, গান গাওয়া, পরস্পর প্রসাদ পাওয়া। বললেন, ‘আমি জানি তুমি কে, কিন্তু এখন বলব না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *