3 of 3

মা জানেন

মা জানেন

জীবনে কি করলে? কি পেলে? সফল মানুষ কাদের বলে জান? ইউরোপ, আমেরিকা। পদমর্যাদা। ‘সেমিনার’। ফাটাফাটি নাম। খেতাবের পর খেতাব। হৈহৈ, রৈরৈ। তুমি কি করলে?

ঠাকুর! ওরা যে এইসব বলছে ঠাকুর!

আমার কাছে পালিয়ে এস। তোমার ভিতরে বুকের কাছটিতে আমাদের দুজনকে বসিয়ে রাখ। যেন কোন ফাঁকফোকর না থাকে। তোমাদের মা বলেছেন না—’আমি আর তোমাদের ঠাকুর অভেদ?’ যে যা বলছে বলুক। দেখে যাও, আর শুনে যাও। “শুনিস নে তুই ভবের কথা/সে যে বন্ধ্যার প্রসব- ব্যথা।” তুমি চল—এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও। আমরা তোমার সঙ্গে আছি।

ঠাকুর! ওদের একটু বিজ্ঞানের কথা দিয়ে গর্ব হরণ করব! ঐ উন্নাসিক, সবজান্তাদের। পৃথিবীর জায়গিরদার!

পারবে?

আপনিও শুনুন না। পৃথিবীর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী—আমেরিকান—মানুষের কত দাম খতিয়ে বের করেছেন। মানবদেহের মূল্য মাত্র দশ ডলার! ভারতীয় মুদ্রায় শ-পাঁচেক টাকার বেশি নয়।

কি হিসেবে?

একটা মানুষের দেহ কি কি উপাদানে তৈরি! আমাদের দেহের বেশির ভাগটাই হলো জল। পৃথিবীতে জলের কোন দাম নেই। দ্বিতীয় উপাদান কার্বন কার্বন আর কয়লা মোটামুটি একই বস্তু। কয়লার দাম খুব বেশি নয়। মণখানেক কয়লার দাম বড় জোর পঞ্চাশ টাকা। এইবার হাড়ের কাঠামোটা! হাড় হলো চক বা খড়ি। তারই বা কত দাম? এরপর আছে নাইট্রোজেন—শরীরের প্রোটিন বস্তুতে। নাইট্রোজেনও সস্তা, এমন কিছু দামী বস্তু নয়। এরপর খানিকটা লোহা চাই রক্তের জন্য। গোটাকতক মরচে ধরা পেরেক হলেই হবে। অতএব বৎস! কিসের তোমার এত হম্বিতম্বি! তোমাকে ‘মানুষ’ না বলে যদি ‘মাল’ বলি, সেই মালের দাম চারশ কি পাঁচশ! বড় কোম্পানির এক জোড়া জুতোর দাম তোমার চেয়ে বেশি। কেমন হলো?

বেশ হলো। এইবার উদ্ধার কর। এদিকের হিসেব হলো, এইবার ওদিকের। হ্যাঁ, ওদিকের। একজন বিজ্ঞানীকে এইসব উপাদান দিলে তিনি কি মানুষ তৈরি করতে পারবেন? যাঁরা রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি করেন, তাঁদের কাছে গিয়ে বলা হলো, মানুষ তৈরির উপাদান দিন। অণুর আকারে। জল, কার্বন, নাইট্রোজেন, আয়রন আর ক্যালসিয়াম। কত দাম পড়বে? দশ মিলিয়ন ডলার। সে কি? মানুষের ছাইয়ের দাম পাঁচশ টাকা, আর সেই উপাদান পৃথিবীর দোকানে কিনতে গেলে পাঁচ কোটি টাকা!

যাক, মানুষের দেহ-গৌরব অনেকটাই বাড়ল!

আরো বাড়বে। এইবার একটা কাঁচের জারে পরিমাণ-মতো ঐ উপাদানগুলি ঢালা হলো। এইবার যন্ত্রের সাহায্যে আচ্ছা করে মেশানো হলো। এইবার অপেক্ষা। দিন যায়, মাস যায়। বছর ঘুরে ঘুরে আসে, কৈ জার থেকে একটা মানুষ তো বেরিয়ে আসে না! কোনদিনই আসবে না।

অনন্ত, অনন্ত, অনন্ত সমুদ্রের তটভাগ যেন এই ছোট্ট পৃথিবী।

“The surface of the earth is the share of the Cosmic Ocean. ‘ আজ আমরা আমাদের সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তা এইখান থেকেই জেনেছি। হেঁটে হেঁটে ঐ সীমাহীন সমুদ্রের কিনারা পেরিয়ে সাহস করে যতটুকু গেছি, তাতে আমাদের পায়ের গোড়ালিটুকু ভিজেছে মাত্র। ঐ অনন্তের বড় মায়া। অবিরত তার আহ্বান—’আয়, আয়, চলে আয়। দেখবি আয়, কোথা থেকে গেছিস কোথায়? তুই কোন্ কাননের ফুল!” “The ocean calls. Some part of our being knows this is from where we came. We long to return.“ “মন চলো নিজ নিকেতনে।”

মহাবিশ্বে, মহাকাশে “We float like a mote of dust in the morning sky.” ভোরের আকাশে তুচ্ছ এক ধূলিকণা আমাদের এই রঙদার পৃথিবী। আমাদের যত কলরব, যত হুঙ্কার, জ্ঞানেরই বড়াই, অহঙ্কার—সব তুচ্ছ। অনন্ত এর কোন খবরই রাখে না। আমাদের পৃথিবীর মাপ, সময়, ঘড়ি সেখানে অচল। একমাত্র মাপ ‘আলোকবর্ষ’। আলোর গতি সেকেণ্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসতে আলোর সময় লাগে আট মিনিট। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব আট আলোক মিনিট। এইবার এই আলো এক বছরে যতদূর যেতে পারে, সেইটাই আমাদের মাপক। আলোকবর্ষ—ছয় ট্রিলিয়ান মাইল। এই হলো অনন্তকে মাপার বিজ্ঞানীদের ফিতে।

“(ও) তুই যেদিক যাবি দেখতে পারি জলে জলাকার/(ও তার) নাহি অন্ত দিগদিগন্ত অপার পাথার।” তাহলে! “We are like butterflies who flutter for a day and think it is forever.” হায় প্রজাপতি! তোমার একটা দিনকেই চিরদিন ভাবলে! গতকাল, সে কতকাল? আগামীকাল, সেই বা কত কাল! সাত কোটি বছর পার হয়ে গেছে।

প্রাচীন, প্রাচীন, কত প্রাচীন!

মাথা ঘুরে যায়! ‘কোথা হতে আসি! কোথা ভেসে যাই?’ পনের থেকে কুড়ি বিলিয়ন বছর। বিলিয়নের আভিধানিক বাঙলা হলো—মহাপদ্ম গণিতে ১,০০০,০০০,০০০,০০০। আপনি ঠাকুর কী অসাধারণ একটি সত্য বললেন, যা বিজ্ঞানীর বিজ্ঞান—ঐ ১-কে সরিয়ে নাও, সব শূন্য।

সেই ‘এক’-এর সন্ধান! “নাহি সূর্য, নাহি জ্যোতিঃ।” কেউ নেই, কিছু নেই। নিস্তরঙ্গ সমাধি। ঘোষ, বোস, মিত্তির, টম, ডিক, হ্যারি, কেঁচো, ব্যাঙ, বনমানুষ, হাতি, ছুঁচো, পণ্ডিত, মূর্খ, তোলাবাজ, মামলাবাজ—কেউ নেই, কিছু নেই। আছেন শুধু absolute — স্বয়মাত্মা। আছেন সেই এক। এক না থাকলে দুই আসে কোথা থেকে! আবার দুই আছে বলেই না এককে নিয়ে টানাটানি! প্ৰথম আদি।

নেই, নেই হঠাৎ আছে, আছে। এই যে ক্ষণ—একটি চমক, একটি ঝলক, একটি বিস্ফোরণ, একটি শব্দ—অ উ ম—ওম্। বিজ্ঞানীরা বললেন : Α remarkable explosive event called the ‘Big Bang’.” “প্ৰথম আদি তব শক্তি।” বিশাল, বিশাল, বিপুল এক অগ্নিগোলক।

সর্বকালের মানবগোষ্ঠীর ভাবুক অংশ নিজেদের মতো করে ভেবেছে—বিশ্ব এল কোথা থেকে? নরওয়ের রূপকথার একটি সঙ্কলনের নাম-’Younger Edda’। প্রাচীন একটি গ্রন্থ প্রায় নয়শ বছর আগে ১২২০ সাল নাগাদ সঙ্কলিত। তৎকালীন আইসল্যান্ডের এক মহৎ ব্যক্তি স্মরি স্টারলেসন কর্তৃক সঙ্কলিত। ‘এডডা’ বলছেন—শুরুতে কিছুই ছিল না। পৃথিবী নেই, মাথার ওপর স্বর্গও নেই। বিশাল এক শূন্যতা। কোথাও ঘাস নেই। উত্তরে হিমাঞ্চল, তার নাম ‘নিলহেইম’, আর দক্ষিণে অগ্নির অঞ্চল, তার নাম ‘মাসপেলহেইম’। দক্ষিণের অগ্নিবলয়ের উত্তাপে উত্তরের হিমমণ্ডলের বরফের কিছুটা গলে জল তৈরি হলো। সেই জলবিন্দুতে জন্মাল এক দৈত্য, তার নাম ‘ওয়াইমের’। এই দৈত্য কি খেয়ে বাঁচবে? তাহলে একটা গরুও ছিল, তার নাম ‘আউধুমলা’। এখন সেই গরু কি খাবে? তাহলে কিছু লবণও ছিল। সৃষ্টিতত্ত্বের এই সরল গতি

ষোড়শ আর সপ্তদশ শতকে এল আধুনিক বিজ্ঞান। পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান। ১৯৫০ সাল অবধি বিজ্ঞানীরা ভাবতেন বিশ্ব নিয়ে; সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা খুব সম্মানজনক নয়। হাতে কোন তথ্য নেই, পরীক্ষা করে দেখার মতো উপাদান নেই, যন্ত্র নেই। এই এক দশকে বিজ্ঞানে হঠাৎ এসে গেল বিপ্লব। এখন মহাকাশ-গবেষণা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হে আকাশ, খোল তব স্তব্ধ নীল যবনিকা। মানুষের সামর্থ্যে যতদূর যাওয়া যায় ততদূর গিয়ে দেখা যাচ্ছে—গভীর ঘন অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে মহামায়ীর টায়রা থেকে খসে পড়া শত শত উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। কোনটা অতি উজ্জ্বল শুভ্র আলোকসম্পন্ন তরুণ নক্ষত্র, কোনটা নীল, কোনটা প্রবীণ লাল—জ্বলতে জ্বলতে আলো দিতে দিতে যার দিন শেষ হতে চলেছে। ছুটে আসছে অপ্সরার মতো ঝিলমিল আলোর রোশনি তুলে কোন অ-ঘন তারকা। একে অপরের গা ঘষে চলে যাচ্ছে, যাওয়ার সময় নিজেদের পারস্পরিক আকর্ষণ-ক্ষমতায় নিজেদের শরীর থেকে আকাশের আঙিনায় ছড়িয়ে দিচ্ছে ছিন্ন টুকরো অংশ। সেই অংশ ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে মহাবিশ্বের সেই মহাফেজখানায়, যেখানে জমা হয় যত ধূমকেতুর মশলা। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে হঠাৎ চমকে উঠতে হয়—এ কে? এই তামসী বস্তুপিণ্ড! আকাশ জুড়ে পড়ে আছে বিধাতার মৃত্যুলিপির মতো। বিজ্ঞানী বলবেন—ভয়ঙ্কর এক মৃত নক্ষত্র, ‘ব্ল্যাকহোল’, ঘনীভূত মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে গিলে ফেলতে পারে কোটি বিশ্ব। এক-একটি ‘মৃত্যুরূপা কালী’। যার বলয়ে সময় ঘুরছে বিপরীত সঙ্কেতে। যদি কোন মানব নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন না করে এর কিনারায় বার সাতেক প্রদক্ষিণ করে সময়ের পৃথিবীতে ফিরে আসে, সে দেখবে পাহাড়ি উপত্যকায় মোজেস বসে আছেন। যে-সভ্যতা ভূপৃষ্ঠ থেকে মুছে গেছে, সেই সভ্যতায় হাজির হবে। ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানে গোলাপের গন্ধ নেবে। শুনতে পাবে নিরোর বেহালাবাদন।

মায়া সভ্যতার মায়ানদের ধর্মগ্রন্থের নাম ‘পোপোল ভু’। সেখানে আছে কে ঐ আদিমানব, যাদুকর মরণ-হাসি হাসছ! তুমি মহানিশার গুণিন, অমাবস্যা। বাতাসে তোমার পোশাক তোমার জটাজাল উৎক্ষিপ্ত! তুমি মারণ, উচাটনের দূত। পৃথিবীটাকে ভরে ফেললে! তোমাদেরই নাম হলো ‘মানুষ’। স্ৰষ্টা তোমাদের দিলেন বুদ্ধি আর চাতুর্য। এই জগতের যাবতীয় রহস্য তোমরা একদিন জেনে যাবে। তাই তো হলো। তাকানো মাত্রই বুঝে গেলে—ঐ তো স্বর্গের বলয়, এই তো আমাদের বর্তুলাকার পৃথিবী। স্রষ্টা সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হলেন—’এরা যে সব জেনে যাচ্ছে, এদের নিয়ে আমি এখন কি করি! তবে তাই হোক, অহঙ্কার খর্ব করে দিই। শোন মনুষ্যকুল! তোমাদের ইন্দ্রিয় যতটুকু জানবে ততটুকুই জানবে। চোখ যতদূর যায় ততদূরই তোমাদের সীমা। নিকট নিয়ে থাক, পৃথিবীর মুখমায়ার সামান্যতম দর্শনে মোহিত হও। তোমরা মানুষ আমার সৃষ্টি। তোমরা ভগবান হবে? এ কেমন স্পর্ধা!

এই পর্যন্ত এসে রবীন্দ্রনাথে যেতে ইচ্ছে করছে! এমনটি কে আবার লিখবেন কোন কালে?—

“জগতেরে জড়াইয়া শত পাকে যামিনী-নাগিনী
আকাশ পাতাল জুড়ি ছিল পড়ে নিদ্রায় মগনা,
আপনার হিম দেহে আপনি বিলীনা একাকিনী।
মিটিমিটি তারকায় জ্বলে তার অন্ধকার ফণা।
উষা আসি মন্ত্র পড়ি বাজাইল ললিতরাগিণী।
রাঙা আঁখি পাকালিয়া সাপিনী উঠিল তাই জাগি—
একে একে খুলে পাক, আঁকি বাঁকি কোথা যায় ভাগি!
পশ্চিমসাগরতলে আছে বুঝি বিরাট গহ্বর,
সেথায় ঘুমাবে বলে ডুবিতেছে বাসুকিভগিনী
মাথায় বহিয়া তার শত লক্ষ রতনের কণা।
শিয়রেতে সারাদিন জেগে রবে বিপুল সাগর।
নিভৃতে স্তিমিতদীপে চুপি চুপি কহিয়া কাহিনী
মিলি কত নাগবালা স্বপ্নমালা করিবে রচনা।”

ঠাকুর!

বল!

এইবার আপনি বলুন ঠাকুর।

শোন তবে তন্ত্রের কথা। আঁধারে ধ্যান, এইটি তন্ত্রের মতো। তখন সূর্যের আলো কোথায়? তন্ত্রসাধনের সময় আমি ব্রহ্মযোনি দর্শন করেছি। প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড প্রসব করছে দেখলাম। ব্রহ্মাণ্ডান্তর্গত পৃথক পৃথক ধ্বনি একত্রীভূত হয়ে এক বিরাট প্রণবধ্বনি প্রতি মুহূর্তে জগতের সর্বত্র স্বত উদিত হচ্ছে। কুলাগারে আমার দেবীদর্শন হয়েছে। স্ত্রীযোনির মধ্যে আমি শ্রীশ্রীজগদম্বাকে সাক্ষাৎ অধিষ্ঠিতা দেখেছি। আদ্যাশক্তি লীলাময়ী, সৃষ্টি-স্থিতি- প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম ‘কালী’। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী! একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয়—সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না—এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ‘ব্রহ্ম’ বলে কই। যখন তিনি এইসব কাজ করেন তখন তাঁকে ‘কালী’ বলি, ‘শক্তি’ বলি। তিনি একরূপে নিত্য, একরূপে লীলা। বেদান্তে কি আছে? ব্ৰহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।

ঠাকুর! ব্রহ্ম হলো অনন্ত। অবশ্যই সত্য। আর এই অনন্তের সীমাহীন সীমায় পৃথিবী আছে কি নেই! মহাকাশের একপাশে ছায়াপথের ধারে এইটুকু একটা বিন্দু। সে থাকাও যা, না থাকাও তা!

শোন, শোন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেখানে আছে থাক। আমার কথা শোন, ‘আমি’টা তো আছে! সেইটাই যে বাপু বিশ্বদর্পণ! ‘ভক্তের আমি” আর “ভগবানের লীলা’। ‘আমি’ যখন তিনি পুঁছে ফেলবেন, তখন যা আছে তাই আছে।

ঐ যে ‘জ্ঞানসঙ্কলিনী তন্ত্র’ বলছেন :

“অব্যক্তাচ্চ ভবেৎ সৃষ্টিরব্যক্তাচ্চ বিলীয়তে।
অব্যক্তং ব্রহ্মণো জ্ঞানং সৃষ্টিঃ সংহারবর্জিতম্।।”

অব্যক্ত মহাব্যোম থেকে ব্যক্ত বিশ্বের আবির্ভাব। আবার অব্যক্তেই লয়। “ওঠে ভাসে ডুবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর।”

বিশ্বের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ‘আমি’র আবির্ভাবের কথাটি স্মরণে রাখতে হবে। প্রকাশ। ‘যতক্ষণ আমি’ রেখে দিয়েছেন, ততক্ষণ সবই নিতে হবে। কলাগাছের খোল ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে মাজ পাওয়া যায়। কিন্তু খোল থাকলেই মাজ আছে, মাজ থাকলেই খোল আছে। খোলেরই মাজ, মাজেরই খোল। নিত্য বললেই লীলা আছে বোঝায়। লীলা বললেই নিত্য আছে বোঝায়। তিনি জীবজগৎ হয়েছেন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন তাঁকে ‘ব্ৰহ্ম’ বলি। যখন সৃষ্টি করছেন, পালন করছেন, সংহার করছেন—তখন তাঁকে ‘শক্তি’ বলি। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। ভক্তেরা–বিজ্ঞানীরা—নিরাকার-সাকার দুই-ই লয়—অরূপ-রূপ দুই-ই গ্রহণ করে।

যতক্ষণ মনের দ্বারা বিচার, ততক্ষণ নিত্যতে পৌঁছানো যায় না। মনের দ্বারা বিচার করতে গেলেই জগৎকে ছাড়বার জো নেই; রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ—ইন্দ্রিয়ের এইসকল বিষয়কে ছাড়বার জো নাই। দেখ না, একটা জিনিস দেখতেই কতগুলো দরকার—চক্ষু দরকার, আলো দরকার, আবার মনের দরকার। এই তিনটির মধ্যে একটি বাদ দিলে তার দর্শন হয় না।

তাহলে কি জানব? কতটা জানব? কারণ, “Nature does not reveal her mysteries once and for all (Seneca).” বিশ্বচরাচর অবিরত প্রসারিত হচ্ছে। Expanding Universe. এতকাল আমরা আকর্ষণের কথা শুনেছি, এইবার বিকর্ষণের পালা। Gravity আর anti-gravity। আইনস্টাইন এই anti-gravity-র ধারণা এনেছিলেন। কেমন করে কোয়ান্টাম তত্ত্ব আর এতকালের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বকে একত্র করে ‘ইউনিফায়েড ফিল্ড থিয়োরি’তে আসা যায়! ‘অ্যান্টিগ্র্যাভিটি’কে তিনি করতে চেয়েছিলেন ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’। প্রমাণাভাবে এই তত্ত্ব নিয়ে তিনি আর অগ্রসর হননি। সম্প্রতি মানবের উন্নত প্রযুক্তি আইনস্টাইনের সেই তত্ত্বের সত্যতার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে—”A kind of anti- gravity that repels objects from each other.” হাবল টেলিস্কোপের এ এক যুগান্তকারী দর্শন। Dark energy অর্থাৎ negative gravity-তে বিশ্ব আচ্ছন্ন।

অনেক ছুটলে, এইবার তোমাদের মায়ের কাছে গিয়ে শুনে নাও। তোমাদের মা কি বলছেন—”মায়ার রাজ্যে সর্বজ্ঞ হওয়া একমাত্র ঈশ্বরেই সম্ভবে। চিত্রকর যেমন তুলি দিয়ে চোখটি, মুখটি, নাকটি—এমনি একটু একটু করে পুতুলটি তয়ের করে, ভগবান কি অমনি একটি একটি করে সৃষ্টি করেছেন? না, তাঁর একটা শক্তি আছে। তাঁর ‘হাঁ’তে জগতের সব হচ্ছে, ‘না’তে লোপ পাচ্ছে। যা হয়েছে সব এককালে হয়েছে। একটি একটি করে হয়নি।”

একটি প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে। বিশিষ্ট কেউ শঙ্খধ্বনিতে পর্দাটি সরাবেন। ভিতরে উজ্জ্বল আলো। কত বিচিত্র সব বস্তু থরে থরে প্রদর্শিত। উন্মোচন। কে এই উন্মোচক! বোধ, আর বুদ্ধিযুক্ত মন। আমি দেখছি, আমি বুঝছি, তাই সব আছে। নয় তো নেই। “It remains ever illumined by its own radiance.’ (Rig Veda)। একটি ‘তাও’ কবিতায় ইতি হোক এই আলোচনার—

“Clay is moulded into vessels,
And because of the space where nothing exists
We are able to use them as vessels,
Doors and windows are cut in the walls of a house
And because they are empty spaces
We are able to use them.
Therefore on the one hand we have
The benefit of existence
And on the other we make use of non-existence.”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *