3 of 3

ভয়ঙ্কর ঠাকুর

ভয়ঙ্কর ঠাকুর

ঠাকুর, আপনাকে ভীষণ ভয় করে, আপনি ভয়ঙ্কর। কেন শুনবেন? কারণটা আপনার ‘কেদার চাটুজ্যে এপিসোড’। কেদারবাবুর ঘটনা ভবিষ্যকালের সামনে আপনার একটি উত্থিত আঙুল—যে-আঙুলের নাম শ্রীরামকৃষ্ণ-তর্জনিসঙ্কেত। সাবধান, সাবধান, সাবধান!

‘কথামৃত’-এ পাই, কেদার চাটুজ্যের বাড়ি হালিশহরে। সরকারি অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করতেন। অনেকদিন ঢাকায় ছিলেন। সেইসময়ে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তাঁর সঙ্গে সর্বদা শ্রীরামকৃষ্ণের বিষয়ে আলাপ করতেন। ঈশ্বরের কথা শুনলেই তাঁর চোখে জল আসত। তিনি একসময় ব্রাহ্মসমাজভুক্ত ছিলেন। সব ছেড়ে ঠাকুরের শরণাগত হলেন।

শ্রীম লিখছেন—”কেদার আজ (১৩ আগস্ট ১৮৮২) উৎসব করিয়াছেন। সমস্ত দিন আনন্দে অতিবাহিত হইতেছে। রাম একটি ওস্তাদ আনিয়াছিলেন, তিনি গান গাহিয়াছেন। গানের সময় ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়া ঘরের ছোট খাটটিতে বসিয়াছিলেন। মাস্টার ও অন্যান্য ভক্তেরা তাঁহার পাদমূলে বসিয়াছিলেন।”

এই হলো চিত্র। ওস্তাদের গার্নে ঠাকুর প্রসন্ন। তাঁকে বলছেন : “যে-মানুষে একটি বড় গুণ আছে, যেমন সঙ্গীতবিদ্যা, তাতে ঈশ্বরের শক্তি আছে বিশেষরূপে।” ওস্তাদ একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করছেন : “মহাশয়, কি উপায়ে তাঁকে পাওয়া যায়?” ঠাকুর বলছেন : “ভক্তিই সার, ঈশ্বর তো সর্বভূতে আছেন; তবে ভক্ত কাকে বলি? যার মন সর্বদা ঈশ্বরেতে আছে। আর অহঙ্কার, অভিমান থাকলে হয় না। ‘আমি’-রূপ ঢিপিতে ঈশ্বরের কৃপারূপ জল জমে না, গড়িয়ে যায়। আমি যন্ত্র।”

এই কথোপকথন সকলেই শুনছেন। ঠাকুর তাঁদের সকলকেই বলছেন : “সব পথ দিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়। সব ধর্মই সত্য। ছাদে ওঠা নিয়ে বিষয়। তা তুমি পাকা সিঁড়ি দিয়েও উঠতে পার; কাঠের সিঁড়ি দিয়েও উঠতে পার; বাঁশের সিঁড়ি দিয়েও উঠতে পার; আর দড়ি দিয়েও উঠতে পার। আবার একটি আছোলা বাঁশ দিয়েও উঠতে পার।”

ঠাকুর প্রসঙ্গটিকে আরো একটু বিস্তৃত করছেন : “যদি বল, ওদের ধর্মে অনেক ভুল, কুসংস্কার আছে; আমি বলি, তা থাকলেই বা, সকল ধর্মেই ভুল আছে। সব্বাই মনে করে আমার ঘড়িটা ঠিক যাচ্ছে। ব্যাকুলতা থাকলেই হলো;

তাঁর ওপর ভালবাসা, টান থাকলেই হলো। তিনি যে অন্তর্যামী। অন্তরের টান, ব্যাকুলতা দেখতে পান। মনে কর, এক বাপের অনেকগুলি ছেলে, বড় ছেলেরা কেউ বাবা, কেউ পাপা—এইসব স্পষ্ট বলে তাঁকে ডাকে। আবার অতি শিশু ছোট ছেলে হদ্দ ‘বা’ কি ‘পা’–এই বলে ডাকে। যারা ‘বা’ কি ‘পা’ পর্যন্ত বলতে পারে—বাবা কি তাদের ওপর রাগ করবেন? বাবা জানেন যে, ওরা আমাকেই ডাকছে, তবে ভাল উচ্চারণ করতে পারে না। বাপের কাছে সব ছেলেই সমান।”

ঠাকুর নিজের মনেই বসে রইলেন কিছুক্ষণ ভাবস্থ হয়ে। এই কাছে, তো এই দূরে। অনন্ত থেকে আরো কিছু ভাব নিয়ে ফিরে এলেন, ভক্তদের হৃদয়- ঘট ভরে দেবেন। অনতিদূরে শ্রাবণের ভরা গঙ্গা। জলের রঙ সন্ন্যাসীর গেরুয়ার মতো, বৈরাগ্যের স্রোত। ঠাকুর বলছেন : “আবার ভক্তেরা তাঁকেই নানা নামে ডাকছে; এক ব্যক্তিকেই ডাকছে। এক পুকুরের চারটি ঘাট। হিন্দুরা জল খাচ্ছে এক ঘাটে, বলছে ‘জল’; মুসলমানরা আরেক ঘাটে খাচ্ছে, বলছে ‘পানি’; ইংরেজরা আরেক ঘাটে খাচ্ছে, বলছে ‘ওয়াটার’; আবার অন্য লোক এক ঘাটে, বলছে ‘অ্যাকোয়া’। এক ঈশ্বর তাঁর নানা নাম।”

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। দূরের ভক্তরা একে একে চলে গেলেন। কাল সরে গেল অতীতে। ১৮৮২ চলে এল ১৮৮৩-তে। জানুয়ারি মাসের পয়লা। ইংরেজদের নববর্ষ। সকাল সাড়ে নটা। একজন বৈরাগী এসেছেন। গোপীযন্ত্র বাজিয়ে ঠাকুরকে গান শোনাচ্ছেন—

“নিত্যানন্দের জাহাজ এসেছে।
তোরা পারে যাবি তো ধর এসে।।
ছয় মানোয়ারি গোরা, তারা দেয় সদা পারা,
বুক পিঠে তার ঢাল খাঁড়া ঘেরা।
তারা সদর দুয়ার আলগা করে রত্নমাণিক বিলাচ্ছে।”

ঠাকুর গান শুনছেন। তেমন ভাবের গান হলে এখনি নিজেই গান ধরবেন। ঘরে ঢুকছেন কেদার চাটুজ্যে। ফিটফাট সাজগোজ। চাপকান, ঘড়ি, ঘড়ির চেন। ঠাকুরকে প্রণাম করলেন। কেদারবাবু প্রেমিক মানুষ। ভিতরে তাঁর গোপীর ভাব। এতক্ষণ গান শুনে ঠাকুরের যা হয়নি, কেদারবাবুকে দেখে তাই হলো। শ্রীবৃন্দাবনলীলার ভাবোদ্দীপন হলো। দাঁড়িয়ে উঠলেন। প্রেমে মাতোয়ারা। কেদারবাবুকে সম্বোধন করে ঠাকুর গাইছেন—

“সখি সে বন কতদূর।
(যথা আমার শ্যামসুন্দর) (আর চলিতে যে নারি)।”

শ্রীরাধার ভাবে গান গাইতে গাইতে ঠাকুর সমাধিতে চলে গেলেন। যেন একটি ছবি! ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন স্থির। চোখে পলক নেই। দুকোণ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়াচ্ছে, দুগাল বেয়ে। আকাশের মতো পবিত্র, তুষারের মতো স্নিগ্ধ একটি দৃশ্য।

কেদারবাবু আবার ভূমিষ্ঠ। ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করে স্তব করছেন— “হৃদয়কমলমধ্যে নির্বিশেষং নিরীহম্।/হরিহরবিধিবেদ্যং যোগিভিৰ্ধ্যানগম্যম্।।”

একসময় ঠাকুর সমাধি থেকে অবতরণ করলেন। কেদারবাবুর বাড়ি হালিশহরে। তিনি যাবেন কলকাতায়। ঠাকুরকে দর্শন করে যাচ্ছেন। একটু বিশ্রাম করে বিদায় নিলেন।

দেখতে দেখতে দুপ্রহর বেলা হলো। রামলাল থালায় করে মা কালীর প্রসাদ নিয়ে এলেন ঠাকুরের জন্য। ঠাকুর দক্ষিণাস্য হয়ে আসনে বসলেন। তাঁর আহার বালকের আহার। একটু একটু সবই চেখে দেখলেন।

সময়ের পথ ধরে এগোতে এগোতে এসে গেল ১৮৮৩-র ১১ মার্চ। ভক্তরা দক্ষিণেশ্বরে আজ ঠাকুরের জন্মদিন পালন করছেন। বহু ভক্তসমাগম। এঁদের মধ্যে কেদারবাবুও আছেন। কেদারবাবুর বয়স হলো পঞ্চাশ। ঠাকুরের চেয়ে- প্রায় তিন বছরের বড়।

ঠাকুরের শরীর আজ বিশেষ ভাল নেই। গঙ্গাস্নান বন্ধ। কলসিতে করে জল এনে পূর্বদিকের বারান্দায় রাখা হয়েছে। থইথই রোদ। নতুন পাতায় পাতায় বৃক্ষাদি সেজেছে। ঠাকুরের জন্মোৎসব যে আজ। ঠাকুর স্নান করবেন। ঠাকুর বলছেন : “এক ঘটি জল আলাদা করে রেখে দে।” স্নানের ব্যাপারে ঠাকুর আজ খুব সাবধান। শেষে ঐ ঘটির জল মাথায় দিলেন। ঐ এক ঘটি, তার বেশি নয়।

কত কথা, কত গান! ঠাকুর পীতাম্বর পরিধান করে দাঁড়িয়ে আছেন। গলায় দুলছে মালা। উত্তর-পূর্বের বারান্দায় খোল-করতালের মশগুল শব্দ। কোন্নগরের দল কীর্তন করছেন। ঠাকুর ছুটে গেছেন সেখানে। তিনিও সঙ্কীর্তনে মেতেছেন। দুহাত তুলে মহাভাবে নাচছেন। বুকের ওপর দুলছে মালা। যেন . স্বয়ং মহাপ্রভু! রূপসাগরে এ কোন্ অরূপরতন!

ঠাকুর মন্দিরে গিয়েছিলেন। নিজের মতো করে পূজা করেছেন। পঞ্চবটীতে সঙ্কীর্তন হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে অপরাহ্ণ এসে গেছে। প্রায় ছটা বাজল। দিন এইবার রাতের শয়নশয্যা প্রস্তুত করছে। আলো নিভল বলে।

নিজের ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় ঠাকুর বসে আছেন ভক্তসঙ্গে। সেখানে কেদারও আছেন। ঠাকুর বলছেন : “সংসারত্যাগী সাধু—সে তো হরিনাম করবেই। তার তো আর কোন কাজ নাই। সে যদি ঈশ্বরচিন্তা করে তো আশ্চর্যের বিষয় নয়। সে যদি ঈশ্বরচিন্তা না করে, সে যদি হরিনাম না করে তাহলে বরং সকলে নিন্দা করবে।

“সংসারী লোক যদি হরিনাম করে, তাহলে বাহাদুরি আছে। দেখ, জনক রাজা খুব বাহাদুর। সে দুখানি তরবার ঘুরাত। একখানা জ্ঞান ও একখানা কর্ম। এদিকে পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞান, আরেকদিকে সংসারের কর্ম করছে। নষ্ট মেয়ে সংসারের সব কাজ খুঁটিয়ে করে, কিন্তু সর্বদাই উপপতিকে চিন্তা করে।

“সাধুসঙ্গ সর্বদা দরকার, সাধু ঈশ্বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন।” কেদারবাবু ঠাকুরকে সমর্থন করে বললেন : “আজ্ঞে হাঁ! মহাপুরুষ জীবের উদ্ধারের জন্য আসেন। যেমন রেলের ইঞ্জিন, পেছনে কত গাড়ি বাঁধা থাকে, টেনে নিয়ে যায়। অথবা যেমন নদী বা তড়াগ, কত জীবের পিপাসা শান্তি করে।” কেদারবাবু এখানে অবশ্য ঠাকুরের কাছে শোনা কথাটিরই প্রতিধ্বনি করলেন।

আসর শেষ হলো। আলো-অন্ধকারের পথ ধরে একে একে সবাই চলেছেন গেটের দিকে। ঠাকুরের আদেশে রয়ে গেলেন ভবনাথ। ঠাকুর তাঁকে সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখেন।

বর্ষা আসবে আর কয়েকদিন পরেই। মৌসুমী মেঘের বিচ্ছিন্ন টুকরো এসে গেছে আকাশে। কদিন খুব গরম পড়েছে। জুন মাসের আজ ৮ তারিখ, ১৮৮৩ সাল। সন্ধ্যারতি শেষ হয়েছে সবে। ঠাকুর মন্দিরে। দেবীপ্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। চামর নিয়ে মাকে কিছুক্ষণ ব্যজন করলেন।

কলকাতা থেকে ভক্ত এসেছেন কয়েকজন—রামবাবু, কেদারবাবু, তারক। তাঁরা ঠাকুরের জন্য ফুল, মিষ্টান্ন এনেছেন। তাঁরা অপেক্ষা করছেন। ঠাকুর কালীঘর থেকে বেরলেন। চাতালে ভূমিষ্ঠ হয়ে মাকে প্রণাম করলেন। প্রণাম শেষ করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছেন, ভক্তরা সব দাঁড়িয়ে আছেন স্থির হয়ে। ঠাকুর তারকের চিবুক ধরে আদর করছেন। তাঁকে দেখে ঠাকুরের খুব আনন্দ হয়েছে। ঠাকুর সদলে নিজের ঘরে এসে মেঝেতে বসলেন। রামবাবু আর কেদারবাবু যত ফুল আর মালা এনেছিলেন সব দিয়ে ঠাকুরের শ্রীপাদপদ্ম সাজিয়েছেন। ঠাকুর সমাধিস্থ।

কেদারবাবু ঠাকুরের শ্রীচরণের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ধরে আছেন। তাঁর ধারণা, এটি করলে ঠাকুরের শক্তি তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হবে। ঠাকুর একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে নিজের মনেই বলছেন ভাবের কথাঃ “মা, আঙুল ধরে আমার কি করতে পারবে।”

কেদারবাবু আঙুল ছেড়ে দিয়ে বিনীতভাবে হাতজোড় করে আছেন। ঠাকুর ভাবাবেশে এইবার সরাসরি কেদারকে বলছেন : “কামিনী-কাঞ্চনে মন টানে (তোমার)—মুখে বললে কি হবে যে আমার ওতে মন নাই।

“এগিয়ে পড়। চন্দনকাঠের পর আরো আছে-রূপার খনি—সোনার খনি— হীরে-মানিক। একটু উদ্দীপন হয়েছে বলে মনে করো না যে, সব হয়ে গেছে।” সবাই নিস্তব্ধ—বাক্যহারা। ঘরে হঠাৎ যেন বজ্রপাত হলো এইবার। ঠাকুর আবার মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন। বলছেন : “মা, একে সরিয়ে দাও।”

কেদারবাবুর মুখ শুকিয়ে গেছে। তিনি শুষ্ক কণ্ঠে রামচন্দ্র দত্তকে প্রশ্ন করছেন : “ঠাকুর একি বলছেন?”

ঠাকুরের শ্রীমুখ দিয়ে ভাবাবস্থায় যা বেরিয়ে এল, তা হয়তো পরে আর স্মরণে রইল না। কথায় কথায় কেদারের প্রসঙ্গ অবশ্যই করেন। কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমা, ১৬ অক্টোবর ১৮৮৩। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে অনেকে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন—বলরামবাবুর পিতা। পরম বৈষ্ণব। হাতে হরিনামের মালা। সর্বদা জপ করেন। আর আছেন বেণী পাল, মাস্টারমশাই, মণি মল্লিক প্রমুখ।

নানা প্রসঙ্গ হতে হতে ঠাকুর বলছেন : “এই ‘আমি’ জ্ঞানই আবরণ করে রেখেছে। নরেন্দ্র বলেছিল, ‘এ আমি যত যাবে, তাঁর আমি তত আসবে।’ কেদার বলে, কুম্ভের ভিতরের মাটি যতখানি থাকবে, ততখানি এদিকে জল কমবে।’

অমন একটি কথা সেদিন বললেও ঠাকুর কেদারের প্রসঙ্গ করছেন, আবার কেদারও আসছেন—যখনি সময় পাচ্ছেন। ২৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩। কলকাতা থেকে এসেছেন রামবাবু, কেদারবাবু ও অন্যান্য ভক্তরা। শীতকাল, রবিবার। বেলা প্রায় তিনটে। এর আগে ঠাকুর যেদিন রামবাবুর বাগান দেখতে যান, সেদিন পাশের বাগানের গাছতলায় জনৈক সাধুকে একা খাটিয়ায় বসে থাকতে দেখেছিলেন। সেদিন উপযাজক হয়ে অনেক কথা বলেছিলেন সাধুর সঙ্গে। ঠাকুরের আদেশে রামবাবু আজ সেই সাধুটিকে নিয়ে এসেছেন।

ঠাকুর সাধুর সঙ্গে অনেক প্রসঙ্গ করলেন। কেদারবাবুর সঙ্গে কোন কথা হলো না। বছর ঘুরে গেল। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৪। দুর্গাসপ্তমী। ঠাকুর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে এসেছেন। চেয়েছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। শাস্ত্রীমশাই বাড়িতে নেই। ব্রাহ্মভক্তরা ঠাকুরকে সমাজমন্দিরে এনে বসিয়েছেন। কথায় কথায় ঠাকুর বিজয়কৃষ্ণকে বলছেন : “কেন, শিবনাথকে চাই? যে অনেকদিন ঈশ্বরচিন্তা করে, তার ভিতর সার আছে। তার ভিতর ঈশ্বরের শক্তি আছে। আবার যে ভাল গায়, ভাল বাজায়, কোন একটা বিদ্যা খুব ভালরকম জানে, তার ভিতরেও সার আছে। ঈশ্বরের শক্তি আছে। এটি গীতার মত। চণ্ডীতে আছে, যে খুব সুন্দর, তার ভিতরও সার আছে, ঈশ্বরের শক্তি আছে।”

এইবার বিজয়কৃষ্ণকে কেদারবাবুর কথা বলছেন : “আহা! কেদারের কি স্বভাব হয়েছে! এসেই কাঁদে। চোখ-দুটি সর্বদাই যেন ছানাবড়া হয়ে আছে।” বিজয়কৃষ্ণ বলছেন : “সেখানে (ঢাকায়) কেবল আপনার কথা, আর তিনি আপনার কাছে আসবার জন্য ব্যাকুল।“

ব্রাহ্মসমাজ থেকে ঠাকুরের গাড়ি চলল অধরবাবুর বাড়ির দিকে। ঠাকুর প্রতিমা দর্শন করবেন।

অষ্টমীর দিন ঠাকুর রামবাবুর বাড়িতে এসেছেন। সন্ধ্যা হয় হয়। ভক্তরা সব ঘিরে আছেন। কেদারও আছেন। তিনি একান্তে ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করছেন : “মাথাঘোরাটা কিসে সেরে যাবে?”

ঠাকুর সস্নেহে বলছেন : “ও হয়, আমার হয়েছিল। একটু একটু বাদামের তেল দিবেন। শুনেছি দিলে সারে।”

ঠাকুরের আজ বড় প্রেমময় ভাব। ঠাকুর আসার অনেক পরে রামবাবু পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঠাকুর জিজ্ঞেস করছেন : “রাম, তুমি কোথায় ছিলে?”

রামবাবু বললেন : “আজ্ঞে, ওপরে ছিলাম।”

ঠাকুর আর ভক্তদের সেবার জন্য রামবাবু ওপরে আয়োজন করছিলেন। ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন : “ওপরে থাকার চাইতে নিচে থাকা কি ভাল নয়? নিচু জমিতে জল জমে, উঁচু জমি থেকে জল গড়িয়ে চলে আসে।” অধরবাবুর বাড়ি। কেদারবাবু হঠাৎ সিদ্ধান্ত করলেন, তিনি আহারাদি না করেই চলে যাবেন। একটু স্ব-সচেতন। ঠাকুরকে প্রণাম করে বলছেন : “আজ্ঞে! তবে আসি।”

ঠাকুর বলছেন : “তুমি অধরকে না বলে যাবে? অভদ্রতা হয় না?”

ঠাকুরের কী অপূর্ব সামাজিক ভদ্রতাবোধ! ইংরেজরা যাকে বলে ‘এটিকেট’, ‘ম্যানার্স’। কেদারবাবু বলছেন : “তস্মিন্ তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্। আপনি যেকালে রইলেন, সকলেরই থাকা হলো।”

এমন সময় অধরবাবু এসে ভিতরে আসার জন্য আহ্বান জানালেন। তিনি বিজয়কৃষ্ণ ও কেদারবাবুকে সম্বোধন করে বললেন : “এস গো আমার সঙ্গে।”

কেদারবাবু বাধ্য হলেন ভিতরে যেতে। আহারান্তে আবার বৈঠকখানায়। কেদারের ভিতর একটা অস্বস্তি। বুঝতে পেরেছেন, অহঙ্কারের শিকার হয়েছিলেন। ভাবছেন, তিনি কি ঠাকুরের চেয়ে বড়? ঠাকুরকে হাতজোড় করে বিনীতভাবে বলছেন : “মাফ করুন, যা ইতস্তত করেছিলাম!” শ্রীম ‘কথামৃত’-এ লিখছেন, কেদারবাবু মনে মনে ভাবছেন—”ঠাকুর যেখানে আহার করিয়াছেন সেখানে আমি কোন্ ছার!”

কেদারবাবুর কর্মস্থল তখন ঢাকায়। সেখানে অনেক ভক্ত তাঁর কাছে আসে। সন্দেশাদি নানা খাদ্য আনে। কেদারবাবু বিনীতভাবে সেই প্রসঙ্গেই ঠাকুরকে প্রশ্ন করছেন : “লোকে অনেকে খাওয়াতে আসে। কি করব প্রভু, হুকুম করুন।”

ঠাকুর চিরকালের শাশ্বত কথাটি বললেন : “ভক্ত হলে চণ্ডালের অন্ন খাওয়া যায়। সাত বৎসর উন্মাদের পর ওদেশে গেলুম। তখন কি অবস্থাই গেছে! খানকী পর্যন্ত খাইয়ে দিলে! এখন কিন্তু পারি না।”

কেদারবাবু বিদায় নেওয়ার আগে প্রার্থনা করছেন : “প্রভু, আপনি শক্তিসঞ্চার করুন। অনেক লোক আসে। আমি কি জানি!”

২৭ ডিসেম্বর ১৮৮৪, দক্ষিণেশ্বর। কেদারবাবু আবার সেই একই প্রসঙ্গ তুললেন—”তাদের জিনিস কি খাব?”

ঠাকুর বললেন : “যদি ঈশ্বরে ভক্তি করে দেয়, তাহলে দোষ নাই। কামনা করে দিলে সে-জিনিস ভাল নয়।”

কেদারবাবু বললেন : “আমি তাদের বলেছি, আমি নিশ্চিন্ত। আমি বলেছি, যিনি আমায় কৃপা করেছেন, তিনি সব জানেন।”

না, ঠাকুর তাঁকে কৃপা করতে পারেননি। ১৫ জুলাই ১৮৮৫। রথযাত্রার দিন। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বলরাম-মন্দিরে। সমাধির কথা বলছেন : “সমাধি মোটামুটি দুইরকম। জ্ঞানের পথে, বিচার করতে করতে অহংনাশের পর যে- সমাধি, তাকে স্থিতসমাধি বা জড়সমাধি (নির্বিকল্প সমাধি) বলে। ভক্তিপথের সমাধিকে ভাবসমাধি বলে। এতে সম্ভোগের জন্য, আস্বাদনের জন্য রেখার মতো একটু অহং থাকে। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলে এসব ধারণা হয় না।”

এইবার ঠাকুর সেই ভয়ঙ্কর কথাটি বলছেন : “কেদারকে বললুম, কামিনী- কাঞ্চনে মন থাকলে হবে না। ইচ্ছে হলো, একবার তার বুকে হাত বুলিয়ে দিই, কিন্তু পারলাম না। ভিতরে অঙ্কট-বঙ্কট। ঘরে বিষ্ঠার গন্ধ। ঢুকতে পারলাম না। যেমন স্বয়ম্ভূলিঙ্গ কাশী পর্যন্ত জড়। সংসারে আসক্তি, কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলে হবে না।”

ভয়ঙ্কর! ঠাকুর অতি ভয়ঙ্কর! নো কম্প্রোমাইস! বলছেন, ঈশ্বরের কথায় যার চোখে জল আসে, সে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ঈশ্বরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। কেদারবাবুর চোখে জল আসত। হলো না। হলো না। ঠাকুরের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ হলো না। সেখানেও খুঁত। ঈশ্বরের পথের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী কাম-কাঞ্চন। ঠাকুর কোন রফার মধ্যে যেতে চান না। সাবধান! তুমি যদি ঠাকুরকে চাও, সম্পূর্ণ পরিশ্রুত হও। ভোগের সামান্য বিন্দু ত্যাগের জগতে বাধার সিন্ধু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *