3 of 3

খানদানী চাষা

খানদানী চাষা

ঈশ্বর স্বয়ং আনন্দস্বরূপ। তারার চুমকি বসানো রাতের আকাশে তাঁর হাসি। চাঁদভাঙা নদীর স্রোতে তাঁর হাসি। প্রভাত সূর্যের গাছের পাতায় পাতায় তাঁর ঝিলমিল হাসি। তাঁর বিশ্বরচনার সর্বত্র তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন সুন্দরতম করে। মানুষেও তাঁর সেই প্রকাশ। এখন মানুষ যদি নিজেকে নষ্ট করে তাহলে তো কিছু করার নেই।

আনন্দের উপাসনা না করে কেন দুঃখের উপাসনা! মুক্তির আরাধনা না করে কেন বন্ধন, আরো বন্ধনের অভিপ্রায়! ঠাকুর শ্যামপুকুর বাটীতে। দুরারোগ্য ব্যাধির সবে সূত্রপাত, কিন্তু আনন্দে আছেন। সকলকে আনন্দে ভরপুর করে রেখেছেন।—সংসার কেমন জানিস! এই বাউলের দল। এল, একখানে জড়ো হলো। গাইলে, নাচলে, হাসলে, তারপর হাট ভেঙে দিয়ে চলে গেল। পড়ে রইল শূন্য মাঠ, উনুনের ছাই, ভাঙা হাঁড়ি, কলসি। আবার একদল আসবে কোনদিন। তাহলে আনন্দস্বরূপ শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দী মন্ত্র কি? রোগ জানুক আর দেহ জানুক, মন তুমি আনন্দে থাক।

ডাক্তার সরকার এসেছেন। ঠাকুর অল্প অল্প কাশছেন। গলায় ব্যথা, ঢোক গিলতে অসুবিধা। শ্রীশ্রীমা কখনো গলা ভাত, কখনো সুজির পায়েস খাওয়াবার চেষ্টা করছেন। ডাক্তার জিজ্ঞেস করছেন : “আবার কাশি হয়েছে?” তারপর সহাস্যে বলছেন : “তা কাশীতে যাওয়া তো ভাল!”

অন্য ভক্তরাও হাসছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ হাসতে হাসতে বলছেন : “তাতে তো মুক্তি গো! আমি মুক্তি চাই না, ভক্তি চাই।”

আমি ভক্ত হওয়ার জন্য বাঁচতে চাই, বারে বারে আসতে চাই। তোমাকে সাজাব ফুলসাজে, অভ্র-চন্দনে। তোমাকে নিবেদন করব, তোমাকে গান শোনাব, তোমার জন্য কাঁদব। তোমা থেকে আমি বিচ্ছিন্ন—বেদনার এই হাহাকারেই আমার আনন্দ। আগে এই জ্ঞান পাকা করব যে, তুমি আছ। তারপর নিজের কাঁচা ‘আমি’টাকে পাকা করব। তারপর তুমি—’তুমি’, আমি— তোমার ‘ভক্ত আমি’। ভক্তির আমি-কে সাবধানে লালন করাটাই সাধনা। জ্ঞানবিচারে কাজ নেই।

“যতনে হৃদয়ে রেখ, আদরিণী শ্যামা মাকে;
(মন) তুই দেখ আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দ্যাখে।
কামাদিরে দিয়ে ফাঁকি, আয় মন বিরলে দেখি,
রসনারে সঙ্গে রাখি, সে যেন ‘মা’ বলে ডাকে।।”

জ্ঞানবিচার চাই না। দক্ষিণেশ্বরে সাধক-জীবনের প্রথমদিকে রাতের অন্ধকারে রামকৃষ্ণ কেঁদে কেঁদে বেড়িয়েছেন আর বলেছেন, মা, আমার জ্ঞানবিচার ধ্বংস করে দাও। আমি ভক্ত আর ভগবানকে নিয়ে থাকতে চাই!

“(আমায়) দে মা পাগল করে (ব্রহ্মময়ী)
(আর) কাজ নাই মা জ্ঞানবিচারে।”

ভগবানের আর সব আছে। ষড়ৈশ্বর্যশালী। কিন্তু তাঁর একটি জিনিস নেই, সেটি হলো ভক্তি। ভক্তি জীবের সম্পদ। তুমি ত্রিভুবনেশ্বর, কিন্তু “আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হতো যে মিছে?” তোমার বিরহে কে কাঁদবে? কে নিশিভোর প্রদীপ জ্বেলে বসে থাকবে দুয়ারে? কোথায় পাবে তুমি মাতা যশোদাকে? ঘরসংসার ফেলে বাঁশি শুনে গোপীরাই আসবে ছুটে আর কেউ নয়। তোমার বিরহে নদের নিমাই ছাড়া কে ঝাঁপ দেবে নীল সফেন সাগরে? ভক্ত আছে বলেই না তুমি মন্দিরে ভগবান!

ভাবস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ ডাক্তার সরকারকে বলছেন : “মহীন্দ্রবাবু, কি টাকা টাকা করছ!… মান, মান করছ! ওসব এখন ছেড়ে দিয়ে, একচিত্ত হয়ে ঈশ্বরেতে মন দাও।—ঐ আনন্দ ভোগ কর।”

ভক্ত হব বললেই তো আর হওয়া যায় না। সহজ, অথচ বড় কঠিন পথ। পুজো করা, কি অসংখ্য জপ করা যায়। কিন্তু চোখে জল আসে কই! তাঁর নাম করামাত্রেই নয়ন ঝরে—এমন অবস্থা হয় কই! বঙ্কিমচন্দ্র জিজ্ঞেস করছেন :

“মহাশয়, ভক্তি কেমন করে হয়?”

ঠাকুর বলছেন : “ব্যাকুলতা। ছেলে যেমন মার জন্য। মাকে দেখতে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে কাঁদে, সেইরকম ব্যাকুল হয়ে ঈশ্বরের জন্য কাঁদলে ঈশ্বরকে পর্যন্ত লাভ করা যায়।”

এইবার আমাদের প্রশ্ন হলো—”ব্যাকুলতা আসবে কি করে?”

নিজের ব্যাকুলতা সম্পর্কে ঠাকুর বলছেন : “যখন দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরবাড়িতে সন্ধ্যারতির কাঁসর-ঘণ্টা বেজে উঠত তখন আমি গঙ্গার ধারে গিয়ে মাকে কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে বলতুম, ‘মা, দিন তো গেল, কৈ এখনো তোমার দেখা পেলুম না।’”

এমন ব্যাকুলতা আসবে কি আমাদের! আমাদের ধারাটা হলো—হলো হলো, না হলো না হলো, দিন গেল তো কি হলো! এইবার খেয়েদেয়ে পাখা চালিয়ে ভোঁস ভোঁস। সকাল হলেই নিত্যদিনের পৃথিবী ক্যাক করে ধরবে!

কিন্তু ভুলেও যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণকে ছুঁয়েছেন তাঁদের ঘুম গেছে। রামকৃষ্ণ রয়্যাল বেঙ্গল। আবার তাঁরই উপমা–বিড়াল দুভাবে ধরে। তার ইঁদুর ধরাটা একরকমের ধরা। আবার নিজের বাচ্চাকে যখন ঘাড়ে ধরেছে, সে-ধরাটা আরেক রকম। বাচ্চাটি ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ স্থানে। যেখানে হুলোর আক্রমণ নেই।

বাঘরূপী শ্রীরামকৃষ্ণ টানতে টানতে নিয়ে যাবেন স্থির সরোবরের কিনারায় নিজেকে দেখ। জলদর্পণে স্ববিম্ব। স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, অর্থ, প্রতিপত্তি ইত্যাদি অস্থায়ী বাষ্প আমি মুছে দিই। এইবার দেখ তোমার মুখ। নিজের মুখচ্ছবি দেখে সন্তুষ্ট হতে পারছ?

না ঠাকুর।

কি কি সংশোধনের দরকার?

হাসি নেই।

কেন নেই?

বেঁচে থাকার আতঙ্কে।

আতঙ্ক কেন? চার্বাক-দর্শন অনুসরণ করলে ক্ষতি কি? “যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।”

ঐ দর্পণের পাশে যে আপনি এসে দাঁড়িয়েছেন! রামকৃষ্ণানুভূতিতে সংসার তলিয়ে যেতে চায়।

তার মানে আমি বটের আঠা! বটপাতার আঠার মতো জড়িয়ে ধরেছি!

হয়তো তাই। কেবলি মনে হয়—হচ্ছে না, হলো না। স্বরূপ ভুলে ঘুরছি কেন? আনন্দময়ীর পুত্র আমি, সদানন্দের বদলে সদানিরানন্দ। কুকুরের লেজে কে একটা সংসারের টিন বেঁধে দিয়েছে, যত দৌড়াই তত ঠ্যাংঠ্যাং শব্দ, যত ঠ্যাংঠ্যাং শব্দ তত দৌড়। মানুষের ভিতরে একটা সদসৎ প্রশ্ন থাকে, প্রশ্নকারী থাকে, যার নাম বিবেক। আমার বিবেকের নাম—শ্রীরামকৃষ্ণ।

তাহলে বলি শোন —”খানদানী চাষা হও। যারা খানদানী চাষা তারা বার বৎসর অনাবৃষ্টি হলেও চাষ দিতে ছাড়ে না; আর যারা ঠিক চাষা নয়, চাষের কাজে বড় লাভ শুনে কারবার করতে আসে, তারাই এক বৎসর বৃষ্টি না হলেই চাষ ছেড়ে দিয়ে পালায়; তেমনি যারা ঠিক ঠিক ভক্ত ও বিশ্বাসী, তারা সমস্ত জীবন তাঁর দর্শন না পেলেও তাঁর নাম-গুণকীর্তন করতে ছাড়ে না।”

আমাকে বিশ্বাস কর, রোজ চোখ বুজে এই দেহটাকে একবার দেখ।

“হরিসে লাগি রহরে ভাই,
(তেরা) বনত বনত বনি যাই
(তেরা) বিগড়ী বাত বনি যাই।।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *