মহাকাল – ২৩

তেইশ 

চৈত্রমাসের শেষের দিকে পেনিলোপীর পত্রে সুবর্ণ জানতে পারলে, মহেন্দ্র কলকাতায় নেই। মাস দুয়েক হল সে বেড়াতে বেরিয়েছে। বলে গেছে কাশী, এলাহাবাদ, দিল্লী, লাহোর এবং সেখান থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত যাবে। ফিরতে আষাঢ়ের শেষ। 

পেনিলোপী আরও জানিয়েছে, কাশী পৌঁছে যে একখানা চিঠি সে দিয়েছিল, তার পরে তার আর কোনো খবরই পাওয়া যায় নি। সুবর্ণ যদি কোনো চিঠি পেয়ে থাকে, যেন জানায়। ওরা সবাই মহেন্দ্রের জন্যে খুব ভাবছে। 

চিঠি পাওয়া দূরে থাক, মহেন্দ্ৰ যে কলকাতায় নেই, পেনিলোপী না জানালে এ খবরটাও তারা জানতে পারত না। মহেন্দ্র তাদের কোনো চিঠিই দেয়নি। কাশী থেকেও না, দিল্লী-লাহোর কোথাও থেকেই না। সে যে কলকাতার বাইরে যাচ্ছে এ খবরটাও সে জানায় নি। 

সুবর্ণ মহা মুশকিলে পড়লো।

তখন বিকেলবেলা। নরেন বাইরে অফিসের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তখনই সুবর্ণ তাকে ডাকতে পাঠালো। 

ডাকাডাকির রোগ সুবর্ণর নেই। সুতরাং নরেন খুব চিন্তিতভাবে তখনই চলে এল।

—কি ব্যাপার? 

—ঠাকুরপোর কোনো খবর পেয়েছ? 

নরেনের মাথাটা যেন ঘুরে গেল। বললে, না। কোনো খবর আছে নাকি? 

স্বামীর অবস্থা দেখে সুবর্ণ তাড়াতাড়ি বললে, না। খারাপ কিছু নয়। কোনো খবর পেয়েছ কিনা জানতে চাইলাম, তা এমন করলে! তুমি যেন মেয়েমানুষেরও অধম। যেন মহিনের বিধবা দিদি! 

সুবর্ণর হাসি দেখে নরেনও আশ্বস্ত ভাবে হাসলে। 

বললে, বিধবা দিদিতেই কি কেবল ভালোবাসতে জানে বড় বৌ, দাদাতে জানে না?

—কিন্তু কোন পুরুষ-মানুষে এমন স্ত্রীলোকের মতো ব্যস্ত হয়? 

একথার আর নরেন জবাব দিলে না। 

বললে, তার একখানা চিঠি পেয়েছি। আগ্রা থেকে লিখেছে। কিছুদিন আগ্রায় থেকে লাহোর যাবে। সেখান থেকে পেশোয়ার। ভায়া এবার লম্বা ট্যুরে বেরিয়েছেন। 

নরেন হাসলে। 

বললে, শ পাঁচেক টাকা পাঠাতে লিখেছিল। কিন্তু সেই সময়টা লাটের ঝামেলা। একশো টাকার বেশি তখন পাঠাতে পারি নি। দু’তিন দিন হোল বাকি চারশো পাঠিয়েছি। 

সুবর্ণ পেনিলোপীর চিঠির বৃত্তান্ত জানালে। 

বললে, চিঠি না পেয়ে ওরা ভয়ানক ভাবছে। কিন্তু হঠাৎ বাবুর বেড়াবার সখ হোল কেন, এই গরমে? 

—কি করে বলব বল। 

—লেখেনি কিছু? 

—না। তবে ও তো চিরকালই খেয়ালী। এমনি খেয়ালেই একদিন যুদ্ধে চলে গিয়েছিল, এমনি খেয়ালেই আজ সফরে বেরিয়েছে। 

—কবে ফিরবে, কিছু লিখেছে? 

—না। আমিও জানতে চাইনি। কি দরকার বল? আমার অনুমতি নিয়ে তো বেরোয়নি। 

সুবর্ণ বললে, তুমি টাকা পাঠালে কেন? না পাঠালে হয় তো তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হোত। 

নরেন হাসলে। বললে, তুমি তাহলে তাকে কিছুই চেনো বড় বৌ। তাকে কোনো কাজ করতে বাধ্য করাতে পারে এমন শক্তি পৃথিবীতে কারও আছে বলে আমি জানি না। 

ব্যঙ্গভরে সুবর্ণ বললে, তোমারও না? তুমি তো বল তোমাকে সে খুব ভক্তি করে।

—সেটাও মিথ্যে নয়। তুমি বিধবা দিদি বলে যে ঠাট্টা করলে, সেও সত্যি। ওর ছেলেবেলায় মা বারো মাস ভুগতেন। ওকে কখনও দেখাশুনো করতে পারেন নি আমাদের দিদি ছিল না, বোন ছিল না। আমিই ওকে দিদির মতো করে মানুষ করেছি। বাবা ওকে দেখতে পারতেন না। মহিনও কখনও বাবার কাছে যেত না। ওর যত কিছু আবদার, যত কিছু বায়না আমারই কাছে করে এসেছে। 

—তার প্রতিফল ভালোই পাচ্ছ! 

—তা পাচ্ছি। সেই জন্যেই তো নিজের ছেলেগুলোকে দেখি না। ওরাও তো ঐ রকমই হবে। 

বলে নরেন আর সেখানে দাঁড়ালো না। সোজা তেতলায় মায়ের ঘরে চলে গেল। উপরের ঘরে বিরাজমোহিনী একখানি কম্বলের উপর বসে মালা জপ করছিলেন। হাতে কাজ না থাকলে এইটেই তাঁর কাজ। 

ঘরে আর কাকেও না দেখে নরেন ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে মায়ের কাছে এসে বসলো। 

বিরাজমোহিনী জিজ্ঞাসা করলেন, দরজা বন্ধ করে দিলি যে! আমাকে গোপনে কিছু বলবি! 

—তোমার নামে যে মহালটা কেনা হয়েছে, সেইটের কথা বলতে এসেছিলাম মা।

-–কেন, সেটার কী হয়েছে? 

—হয়নি কিছুই। বলছিলাম, বাবা তো ছোঁড়াকে কিছুই দিয়ে যান নি। বাবার সর্ত ও ভেঙেছে। সেই সর্তের অমর্যাদা আমি কিছুতেই করতে পারব না। তাতে বাবা স্বর্গে বসেও ক্ষুণ্ন হবেন। সে আমি পারব না। কিন্তু যে রকম দেখছি, ও কিছুই করবে না, করতে পারবেও না। শুধু উড়ে-উড়ে বেড়াবে। এ অবস্থায় কী করা যায় ওর জন্যে? 

—কি করতে চাও তুমি? 

—আমি বলি কি, তোমার নামের এই মহালটা ওকেই উইল করে দাও। আর সে বিষয়ে দেরী করা ঠিক হবে না। জীবন-মৃত্যুর কথা তো কেউ বলতে পারে না! 

বিরাজমোহিনী হেসে বললেন, ওরে বিধবার পরমায়ু হাজার বছর। সেজন্যে ভাবিস নি। কিন্তু আমার কাছে লুকোনো তো মিথ্যে নরেন, যেন মহিনও একেবারে ফাঁকি না পড়ে সেই জন্যেই তো ও মহাল তুই আমার নামেই নীলেমে কিনেছিলি। এখন যদি ওকেই ওটা দিতে চাস, আমি বাধা দোব কেন? 

খুশি হয়ে নরেন বললে, বাধা যে তুমি দেবে না, সে আমি জানি মা। সেজন্যে আমার কোনো দুশ্চিন্তাও নেই। কিন্তু আজকে বিশেষ করে সেই কথাটা তুলতে এসেছি অন্য কারণে। 

—কি কারণে? 

—মহিনের মতিগতি আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এখান থেকে যাবার সময় বলে গেল, কলকাতায় গিয়ে ডাক্তারী করবে। তার বন্দোবস্ত করেছে, সে খবরও পেলাম এর মধ্যে হঠাৎ এমন কি ঘটলো যে, সে পালিয়ে গেল? 

—কোথায় পালিয়ে গেল? 

—গিয়েছিল কাশী, সেখান থেকে দিল্লী, এখন রয়েছে আগ্রায়, সেখান থেকে যাবে লাহোর, তারপর পেশোয়ার পর্যন্ত। এরকম করার তো মানে খুঁজে পাচ্ছি না। 

—ও তো নরেন, চিরকালই অমনি। চিরদিনই জ্বালিয়েছে, এখনও জ্বালাচ্ছে, যতদিন বাঁচবে ততদিন জ্বালাবেও। তার জন্যে তোর তৈরী থাকাই ভালো। 

নরেন চিন্তিত ভাবে বললে, এ তো ঠিক তা নয় মা। আমার সন্দেহ হয়, বাবা যে ওকে ত্যজ্যপুত্র করে গেছেন, এখবরটা এখন ও কোনো রকমে জেনেছে। হিতৈষীর তো অভাব নেই! অবশ্য সঠিক খবর গ্রামের লোক কেউ জানে না। শুধু একটা গুজব রটেছে। 

বিরাজমোহিনী বললেন, কিন্তু যে খবরটা দু’দিন পরে ও জানতে পারবেই, তাই নিয়ে এত ঢাকাঢাকি যে তুই কেন করিস, আমি তো বুঝি না। 

নরেন শিউরে উঠে বললে, খবরটা ও শুনবে, মুখ ওর ফ্যাকাশে হয়ে যাবে, তাই আমি দেখব, এ তুমি ভাবতে পারো মা? ওকে হারানোর চেয়ে বড় সর্বনাশ আমার আর আছে? যাই হোক, তোমার উইলটা আমি তাহলে উকিলকে তৈরি করতে বলি। সাক্ষী থাকব আমি নিজে আর বাইরের ক’জন বন্ধু। কি বল? 

বিরাজমোহিনী বললেন, এ বিষয়ে আমার মতামত আর কি বাবা, তুমি যা ভালো বুঝবে করবে। 

বলে বিরাজমোহিনী হাসলেন। নরেনও খুশি হয়ে নিচে নেমে গেল। 

.

তার পরের দিন সন্ধ্যা বেলায়। 

সূর্য ডোববার আগেই ভাঁড়ার বের করে দিয়ে সুবর্ণ উপরে ওঠে। কচি-কাচা নিয়ে আর নামতে পারে না। গায়ত্রী একাই রান্না করে। 

সেদিনও তাই করছিল। আর ফ্যালার মা বাইরে বসে যত রাজ্যের গল্প করছিল। গল্পের ভাণ্ডার ফ্যালার মায়ের অফুরন্ত। বয়স হয়েছে ষাট বছর। এই ষাট বছরের যত পুরাতন কথা তার মনে পড়ে যায়, তা শোনবার ধৈর্য গায়ত্রী ছাড়া এ বাড়ীতে আর কারও নেই। 

গায়ত্রীও কতক শোনে, কতক শোনে না। কিন্তু তালে তালে হুঁ-টা ঠিক দিয়ে যায়। ফ্যালার মায়ের তাতেই কাজ চলে যায়। বুড়ো বয়সে বকুনীটা স্বভাবতই বাড়ে। তারও বেড়েছে। এমন অবস্থায় একটা ঘুমন্ত লোকের কাছে বকতেও তার আপত্তি নেই। 

ন’বছরে তার বিয়ে হয়েছিল। স্বামী যে কি, তাই তখন সে জানতো না। সেই বয়সে ননদ আর শাশুড়ীতে মিলে কী অত্যাচারটা তার উপর করতো, চৈত্রের সন্ধ্যায় তাই সেদিন তার মনে পড়ে গেল। এবং গায়ত্রীর কাছে রান্নাঘরের বারান্দায় সেই বিবরণ খুলে বসলো। 

করুণ কাহিনী সন্দেহ নেই। ফ্যালার মা যত বলে, তার দ্বিগুণ কাঁদে। হঠাৎ একসময় তার গল্পের সুর গেল কেটে। 

চীৎকার করে উঠলো : 

—কী হোলো গো! এ আবার কী হোলো গো! ওগো, কে কোথায় আছে গো! গায়ত্ৰী, ও গায়ত্রী! 

ফ্যালার মায়ের কণ্ঠস্বরের খ্যাতি আছে বরাবরই। সুতরাং বাড়ীর ভিতরে ঝি-চাকর যারা ছিল তারা তো বটেই, বাইরে থেকে আমলা-কর্মচারী এবং উপর থেকে সুবর্ণ পর্যন্ত ছুটে নেমে এল। 

—কি হয়েছে! কি হয়েছে! 

ফ্যালার মা চ্যাঁচাতে লাগলো : 

—ওগো, গায়ত্রীর কী হয়েছে দেখ গো! এই তো দিব্যি রাঁধছিল, গল্প করছিল, হঠাৎ অমন করছে কেন গো! 

সিঁড়িতে সুবর্ণকে দেখেই আমলারা বারান্দা থেকে নেমে পথ ছেড়ে দিলে। আড়- ঘোমটা টেনে সুবর্ণ রান্নাঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লো। গায়ত্রীর মাথাটা কোলে নিয়ে মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বললে, তুই শীগগির একটা পাখা নিয়ে আয় ফ্যালার মা। আর ওঁদের সরে যেতে বল। এমন কিছুই হয়নি। 

আমলারা চলে গেল। 

সুবর্ণ ওর চোখে-মুখে জল দেয়, আর বাতাস করে। 

একটু পরেই গায়ত্রী চোখ মেলে চাইলে, কিন্তু তখনই ক্লান্তভাবে আবার চোখ বন্ধ করলে। 

—একটু জল খাবি গায়ত্রী? 

গায়ত্রী ঘাড় নেড়ে জানালে, খাবে। 

জলটুকু খেয়ে সে উঠে বসলো। লোক-সমাগম দেখে কিছুক্ষণ বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো। তারপর ফ্যালার মায়ের অস্ফুট গুঞ্জনে ব্যাপারটা খানিকটা আন্দাজ করলে, এবং তাড়াতাড়ি হাতাটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। 

বাধা দিয়ে সুবর্ণ বললে, তুই শুগে যা গায়ত্রী। আমিই রাঁধছি। 

লজ্জিত ব্যস্ততায় গায়ত্রী বললে, না, না, বৌদি। আমি বেশ রাঁধতে পারব। তুমি যাও।

সুবর্ণ নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর রান্না করা দেখতে লাগলো। জিজ্ঞাসা করলে, আর কখনও তোর ফিট হয়েছে? 

—না। 

—এই প্রথম? 

—হুঁ। হঠাৎ কি রকম মাথাটা ঘুরে গেল। তারপর কি হোল আর মনে পড়ে না। 

—কেন এমন হোল? 

—তা জানি না। 

সবাই চলে গিয়েছিল, কেবল ফ্যালার মা দাঁড়িয়ে ছিল। খনখন করে বললে, তুমি জানবে কি গো। তাহলে শোন বলি বৌমা, 

সুবর্ণ এক ধমক দিলে : 

—তুই থাম তো ফ্যালার মা। আমি বুঝতে পারছি কি করে কি হোল, তোর গল্প শুনতে শুনতেই ওর ফিট হয়েছিল। 

গালে হাত দিয়ে ফ্যালার মা চেঁচিয়ে উঠল : হেই মা! আমার গল্প শুনতে…

—আবার চেঁচাচ্ছিস! আমি জানি না? তোর গল্প শুনতে শুনতে আমারই কতদিন ফিটের মতো হয়েছে! গল্প কিছুদিন তুই বন্ধ রাখ্ ফ্যালার মা। 

বলে হাসতে হাসতে উপরে চলে গেল। 

কাঁদ কাঁদ হয়ে ফ্যালার মা বললে, দেখো দেখি বাছা! বৌমা আমার নামে কি অপবাদ দিলেন! 

গায়ত্রী হেসে বললে, তুমি বোঝ না কেন ফ্যালার মা, বৌদি ঠাট্টা করে বলে গেলেন। 

ফ্যালার মা কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হোল না। গজগজ করে বলতে লাগলো : আমার গল্প তো কেউ শোনে না। তুমিই শুধু ভালোবাসতে, তাই আসতাম। তা আর না হয় আসব না, আর না হয় আসব না। 

বলে মাদুরটা গুটিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। যাবার সময় বার বার করে বলে গেল : বাবুর খাওয়া হয়ে গেলে যেন আমাকে ডেকো। নইলে রাত্রিতে আর খাওয়াই জুটবে না। গল্প করতে আসি কি সাধে? বসে থাকলেই ঘুমিয়ে যাই, আর ঘুমুলেই মড়া। ডেকো যেন মা, বেশ? জানো তো, ক্ষিদে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। 

গায়ত্রী হেসে বললে, ডাকব। 

আশ্বস্ত হয়ে ফ্যালার মা শুতে গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *