উনিশ
রাত্রে নরেন সুবর্ণকে জিজ্ঞাসা করলে, মেমসাহেব দেখলে?
ডিবে থেকে একটি পান নরেনকে দিয়ে সুবর্ণ আর একটি নিজে নিলে। হেসে বললে, দেখলাম। আজ বিকেলে এসেছিলেন যে!
—তার পরে?
—মেমসায়েবকে শাড়ী পরলে কি সুন্দর লাগে দেখেছ? যেন সরস্বতী ঠাকরুন, না?
—অনেকটা। তারপরে?
—চমৎকার বাংলা বলে। একেবারে বাঙালীই হয়ে গেছে। কি আশ্চর্য দেখ! ভাষা এক নয়, দেশ এক নয়, ধর্ম এক নয়, রংও এক নয়,–সেই স্বামীর ঘর করতে কত দূর থেকে এসেছে। বেশ লাগলো মেয়েটিকে। তবে বয়স হয়েছে বাপু। ঠাকুরপোদেরই বয়িসী, বড় হবে তো ছোট হবে না।
—তা হবে না? ওদের তো তোমাদের মতো বারো-চোদ্দ বছরে বিয়ে হয় না। কিন্তু একটা বিষয় আমার ভারি বিশ্রী লাগে।
—কি?
—কোথায় রইলো স্বামী, মেয়েটা একটা পরপুরুষের সঙ্গে নির্জন একটা বাড়ীতে দিন-রাত্রি কাটাচ্ছে। দেখতে ভালো লাগে না।
একটা পরিহাসের লোভ সুবর্ণ সামলাতে পারলে না।
বললে, সবাই তো তোমাদের মতো নয়। কেউ কেউ স্ত্রীকে বিশ্বাস করতেও জানে।
কথাটার মধ্যে খোঁচা ছিল। কিন্তু তা গায়ে না মেখেই নরেন বললে, বিশ্বাস- অবিশ্বাসের কথা নয় বড় বৌ। কিন্তু পাঁচজনের চোখে দেখতে খারাপ লাগে। তাছাড়া ভয় যে নেই তাতো নয়।
সুবর্ণ বললে, ভয় যদি কারো থাকেই তাহলে যে পুরুষের দুর্মতি হবে তারই, ওর নয়। দেখেছ হাতের কব্জি, পায়ের গোছ?
নরেন হেসে ফেললে। বললে, তা বটে।
সুবর্ণ বললে, বাঙালী মেয়ে ওর মতো চললে-ফিরলে বেহায়া মনে হয়। কিন্তু ওকে তা মনে হয় না। ছেলেবেলা থেকে অমনিভাবেই ওরা মানুষ। দেখলেই মনে হয়, ওই ব্যবহারটাই ওদের স্বাভাবিক। ও যদি একগলা ঘোমটা দিয়ে এ বাড়ী ঢুকতো তাহলেই বেমানান লাগতো, হাসি আসতো।
—যা বলেছ!
—বাচাল তো নয়। মুখে একটা গাম্ভীর্য আছে। আর কথাগুলো কি মিষ্টি! কাল এখানে খাবে। নিজেই যেচে নিমন্ত্রণ নিলে। না বলতে পারলাম না।
নরেন চমকে উঠলো। বললে, সর্বনাশ! জাতজন্ম আর রাখবে না দেখছি। কাজটা ভালো হয় নি। ওরা সব মাংস-টাংসই খায় বেশী। সে সব ও বাড়ীতে-
বাধা দিয়ে সুবর্ণ বললে, সেসব এ বাড়ীতে হবে কেন? তা খেতে চায়ও না ও। আমরা যা খাই, তাই খেতে চায়।
—ও বাড়ী থেকে আবার টেবিল-চেয়ার আনতে হবে তো?
—না, না। আমাদের সঙ্গে মেঝেয় বসেই খাবে। জ্ঞান কিন্তু টনটনে আছে, জানলে? বললে এক সঙ্গে বসে তো খাবে না দিদি, আমি বরং দূরে বসেই খাব।
সুবর্ণ হাসলে।
কিন্তু এ সব ব্যাপারে নরেনের একটা ভয় আছে। বললে, রাগ-টাগ করেনি তো? একে অতিথি, তায় মেম সায়েব। ওদের রাগকে বড় ভয় করি।
—না, না। বললাম না, ভারি ঠাণ্ডা মেয়ে। কিন্তু একটা আমার মনে খুব সন্দেহ হয়।
—কি সন্দেহ?
—ঠাকুরপোর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে তো বোঝাই যায়। নইলে তার সঙ্গে একা এতদূর কখনই আসতো না। আমার বেশ সন্দেহ হচ্ছে এ বাড়ী এসে পর্যন্ত ওর লক্ষ্যই ছিল গায়ত্রীর উপর। তাকে কাছে টেনে বসানো, তার সঙ্গে গল্প করা—
—তাতে কি হয়েছে?
—সুবর্ণ হেসে বললে, তুমি কিছুই বোঝ না কেন?
—বোঝবার কিছুই পাচ্ছি না যে!
সুবর্ণ বললে, তোমাকে বললাম ওদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দাও। হলই বা বিধবা! বিধবা বিয়ে তো চলছে আজকাল।
বাধা দিয়ে নরেন বললে, সে আমি পারব না বাপু। প্রাণ থাকতে নয়। ওর ইচ্ছে থাকে, কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে করুক। আমি বাধাও দোব না, ওর মধ্যেও থাকবো না।
—মেয়েটার কষ্ট তো আর দেখা যায় না।
—সে তো ও ইচ্ছা করেই করছে বড় বৌ। আমরা কি করব বলো? ওর সম্পত্তি আছে, বিক্রি করে দিব্যি পায়ের উপর পা দিয়ে বসে খেতে পারে। তা না করতে চায়, শ্বশুরবাড়ীতে গিয়েও থাকতে পারে। তাই তো সবাই করে।
বিরক্ত হয়ে সুবর্ণ বললে, তা বটে! মেয়েটার সবই বে-আকার!
একটু পরে নরেন বললে, নতুন পুকুরে মাছ ধরাতে হবে কাল। গলদা চিংড়ি অন্যবার এ সময়ে কত! এবারে ডাকই শোনা যায় না। খয়রা মাছ ভেজো। কিছু মৌরলা মাছ। কই মাছের একপিঠ ঝাল, একপিঠ টক কোরো। মাছের রান্নাই বেশি কোরো। মেমসায়েবকে কতকগুলো শাক-পাতা খাইও না যেন, তাহলে অবেলায় ইব্রাহিমের আবার খাটুনি বাড়বে।
সুবর্ণ হেসে বললে, সে যা হয় হবে। তোমাকে আর রাত জেগে রান্নার ফর্দ করতে হবে না, ঘুমোও।
ধমক খেয়ে নরেন পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
.
মহেন্দ্র কিন্তু বেঁকে দাঁড়ালো।
সকালে উঠেই পেনিলোপীকে জানিয়ে দিলে, ও-বাড়ীতে নিমন্ত্রণে সে যাচ্ছে না। সে এখানেই খাবে।
পেনিলোপী বললে, হতেই পারে না। কত ভাগ্যের নিমন্ত্রণ, এমন করে হাতছাড়া করা যেতেই পারে না।
—তুমি যাও না। তোমাকে তো আটকাচ্ছি না।
—তুমিই বা যাবে না কেন? তোমারই বা আপত্তি কিসের?
—আছে। সে তুমি বুঝবে না।
পেনিলোপী হেসে বললে, আমি বুঝব না? সেদিনের ছেলে তুমি, হাঁ করলে পেটের ভেতর দেখতে পাই।
—তাহলে আর কেন? আমি হাঁ করি, তুমি চুপি চুপি পেটের ভেতর দেখে নাও। মুখে কিছু জিগ্যেস কোরো না।
—মেয়েটি হয়তো ছেঁড়া কাপড়ে পরিবেশন করবে, সে তুমি দেখতে পারবে না। এই তো? কী পাগল ছেলে তুমি মহিন!
মহেন্দ্র হেসে বললে, মেয়েরা অল্প বয়সেই ভেঁপো হয়!
পেনিলোপী তাকে একটা ঠেলা দিয়ে বললে, বাজে কথা ছেড়ে দাও। তুমি যাবে কি না বলো।
—না।
এমন সময় গোলক এসে ওদের কলহে বাধা দিলে। মেমসাহেবকে দেখে বাইরে থেকেই অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে গোলক ডাকলে, ছোটবাবু!
—ভিতরে এস গোলক দাদা।
গোলক তথাপি উসখুস করে, ভিতরে আসে না।
মহেন্দ্ৰ হেসে বললে, মেম সায়েব কিছু বলবেন না গোলক দাদা, তুমি নির্ভয়ে এস।
তখন গোলক ভিতরে এল। গায়ে তার একটা চেক-কাটা সুতী আলোয়ান, তার সহস্র জায়গায় ছিদ্র, তার ফাঁক দিয়ে তার রুক্ষ-কর্কশ চামড়া এবং হাড়-পাঁজরা দেখা যাচ্ছে।
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, মেম সায়েবকে তোমার এত ভয় কেন গোলক দাদা?
মহেন্দ্রের কাছে বসে গোলকের ভয় খানিকটা কেটে গিয়েছিল। আড়-চোখে পেনিলোপীর সুন্দর স্মিত মুখের দিকে চেয়ে বাকিটুকুও কেটে গেল।
সে উত্তর দিলে, আর একদিন বলব ছোটবাবু।
পেনিলোপী হেসে বললে, এখন বলতেই বা দোষ কি গোলক? তুমি এখনই বলো।
ঘটনাটা এমন কিছু নয়। বহুকাল পূর্বে গোলক একবার সদরে গিয়েছিল। শহর দেখা সেই তার প্রথম এবং শেষ। বাজারে সে ঘুরছিল, এমন সময় একটা জমকালো ফিটন গাড়ী এসে দাঁড়ালো। যাবার রাস্তা নেই। একখানা মহিষের গাড়ী আড়াআড়ি রাস্তাটা আটক করে আছে। ফিটনের কোচোয়ান যতই ঘণ্টা বাজায়, মোষের গাড়ী নড়েও না, চড়েও না। ভিতরে যে মেমসাহেব বসে আছে, মোষের গাড়ীর গাড়োয়ান তা বোধ হয় দেখতে পায় নি। হঠাৎ লালমুখ করে ফিটন থেকে লাফিয়ে নেমে এল মেমসাহেব, এবং কোচোয়ানের হাত থেকে চাবুকটা টেনে নিয়ে গাড়োয়ানকে কী মার যে মারলে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। মনে করলে এখনও গোলকের বুকের ভিতরটা টিপ ঢিপ করে ওঠে। মেয়েমানুষের হাতে মার খাওয়ার চেয়ে বেটাছেলের লজ্জার আর কী আছে!
সেই থেকে গোলকের মেমসাহেবকে বড় ভয়।
গল্পটা শুনে মহেন্দ্র আর পেনিলোপী হেসে আকুল।
পেনিলোপী হেসে বললে, তোমার ভয় নেই গোলক। আমি শাড়ী পরা মেমসায়েব। কাউকে মারি না। শুধু বেশি দুষ্টুমি করলে মাঝে মাঝে তোমার এই ছোটবাবুর কান মলে দিই।
কথাটা সত্য কিংবা পরিহাস ঠিক বুঝতে না পেরে গোলকও বোকার মতো হাসতে লাগলো।
মহেন্দ্র বললে, তারপরে, গোলকদাদা, তোমার দরকারটা তো বললে না।
গোলক একটু দ্বিধা করলে। একবার পেনিলোপীর, একবার মহেন্দ্রের দিকে চেয়ে খানিকটা সাহস পেয়ে আলোয়ানের ভিতর থেকে একখানা থান ধুতি সন্তর্পণে বার করে বললে, বাগদীতে বামুনের মেয়েকে একখানা শাড়ি কিনে দিলে তাতে দোষ কি?
মহেন্দ্র জবাব দেবার আগেই পেনিলোপী বলে, কিছু দোষ হয় না গোলক। তুমি স্বচ্ছন্দে দিয়ে এস না।
–নিলো না। গোলকের গলা কান্নায় বন্ধ হয়ে এল। বললে, —বাইরের লোক দু’জন খাবে। তোমাকে নিতে হবে না দিদিমণি, শুধু আজকের দিনটি এইখানি পরে ওদের পাতে ভাত দিও। তারপরে ইচ্ছে হয় ছেড়ে দিও, আমি মাথায় করে নিয়ে গিয়ে ডাঁপে তুলে রেখে দোব। শুধু এই একটি দিনের জন্যে দিদিমণি।
কান্নায় গোলকের কঙ্কালসার প্রকাণ্ড দেহটা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কোনোরকমে বললে, তা কিছুতেই নিলে না।
মহেন্দ্ৰ অনেকদিন থেকেই প্রাণপণে নিজেকে সম্বরণ করে আসছিল আর পারলে না! একেবারে স্ত্রীলোকের মতো কেঁদে উঠলো।
চীৎকার করে বললে, কেন দিতে গিয়েছিলে গোলকদাদা। তুমি কি জানো না, ও কত নিষ্ঠুর। ওর দয়া মায়া কিছু নেই।
গোলক বললে, সত্যি ছোটবাবু। দয়ামায়া কিছুই নেই। নইলে বাঁড়য্যে মশায়ের দেহ রাখার পর থেকে আমি কাঙালের মতো যা করে ওর পিছু পিছু ঘুরেছি, তাতে পাথরের দেবতারও মন গলতো, কিন্তু ওর মন গলেনি।
গোলক আর থাকতে পারলে না। কাপড়খানি বগলে দেবে পাগলের মতো টলতে- টলতে বেরিয়ে গেল। মহেন্দ্র রুমালে চোখ ঢেকে পাশের ঘরে চলে গেল কান্না চাপতে! পেনিলোপী অভিভূতের মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে আপন মনেই বললে, অদ্ভুত।
.
পেনিলোপী একাই গেল নিমন্ত্রণে।
সুবর্ণ এগিয়ে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে দোতলার বারান্দায় বসালো। জিজ্ঞাসা করলে, ঠাকুরপো কই?
—তোমার ঠাকুরপো?- পেনিলোপী হাসতে হাসতে বললে, সে আসবে এই গাছ- গাছড়া খেতে? সে এতক্ষণ ইব্রাহিমের হাতে ফাউল কাটলেট খাচ্ছে।
সুবর্ণ কিন্তু এই রসিকতায় ঠিক যোগ দিতে পারলে না। তার মুখখানা অন্ধকার হয়ে গেল।
বললে, এমন তো হবার কথা নয়! আমার হাতে খেতে সে যে ভয়ানক ভালোবাসে।
পেনিলোপী তেমনি হাসতে হাসতে বললে, তার প্রমাণ তো পাচ্ছি না।
সুবর্ণ বলতে লাগলো : গেলবারে যখন এসেছিল কত রাগারাগি। শেষে তার দুপুরের খাবার এইখান থেকেই যেত। তুমি তাকে বলেছিলে তো ভাই?
পেনিলোপী বললে, কী আশ্চর্য। পয়সা খরচ নয়, কিছু নয়, মুখের বলা। এই সামান্য বিষয়েও কি আমার উপর তুমি ভরসা করতে পারো না দিদিভাই?
সুবর্ণ আর কিছু বললে না। মুখখানা ভার করে দাঁড়িয়ে রইলো। পাশেই নির্বিকার দাঁড়িয়ে গায়ত্রী। পেনিলোপী চেয়ে দেখলে, তার মুখে দুঃখ-হর্ষ, আনন্দ-উদ্বেগ, কিছুরই চিহ্ন নেই। যেন কিছুই হয় নি এমনি নির্লিপ্ত ভাব!
পেনিলোপী মনে মনে বললে, তুমি পাথরের দেবতাই বটে। মনে তোমার ঢেউ খেলেই না। তুমি জমাট-বাঁধা নদী।
গায়ত্রী জিজ্ঞাসা করলে, তাহলে জায়গা করে দিই বৌদি?
অন্যমনস্কভাবে সুবর্ণ বললে, দাও।
—এই দোতলার বারান্দাতেই করে দোব কি?
এবারে সুবর্ণ রেগে গেল।
বললে, এখানে হবে না তো কি উঠোনে জায়গা করা হবে? তুই দিন দিন বোকা হচ্ছিস কেন গায়ত্রী?
গায়ত্রী রাগ করলে না। ব্যস্তভাবে জায়গা করতে গেল।
পেনিলোপী তার হাতের আসনগুলো কেড়ে নিয়ে বললে, কেমন করে জায়গা করতে হবে দেখিয়ে দিই।
বলে ওদিকে পাশাপাশি একটুখানি ছাড়াছাড়ি করে দুখানা আসন পাতলে। তার থেকে অনেক দূরে, তারই সামনা-সামনি আর একখানা আসন পাতলে।
বললে, ওই দুটো তোমাদের জায়গা, এইটে আমার। কেমন করে যে তোমরা খাও, কিছুই জানি না। এইখান থেকে দেখে শিখব আর খাব কেমন?
পেনিলোপী হাসলে, গায়ত্রীও।
পেনিলোপী হেসে জিজ্ঞাসা করলে, এত দূরে বসলেও কি তোমাদের জাত যাবে ভাই?
গায়ত্রী হেসে বললে, না।
তারপর সুবর্ণর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, আমার এখন বসা কি ঠিক হবে বৌদি?
—না, তুমি রাত্রি বারোটার পরে বসবে। বেলার দিকে চেয়ে দেখেছ?
গায়ত্রী একটা ঢোক গিলে বললে, তা নয়, বলছিলাম, পরিবেশন করবে কে?
–পরিবেশনের কি আছে? থালা সাজিয়ে নিয়ে আসব। তারপর হাত ধুয়ে একসঙ্গে বসে পড়ব। এর মধ্যে ভাববার কি আছে? নিচে চল।
সুবর্ণ আর গায়ত্রীতে মিলে থালা সাজিয়ে নিয়ে এল। ঝি জলের গ্লাস দিয়ে গেল। একটু পরে হাত ধুয়ে এসে পেনিলোপীকে ওরা ডাকলে, এস ভাই।
পেনিলোপী খেতে বসবে কি, আয়োজন দেখেই চক্ষুস্থির! প্রকাণ্ড বড় থালার মধ্যেখানে ফুলের মতো একমুঠো ভাত। চারদিকে সাজানো বিবিধ ব্যঞ্জন। তার চারদিকে আবার সারে সারে ছোট-বড়-মাঝারি নানা রকমের বাটি। দই। মিষ্টিই আছে পাঁচ-ছয় রকমের।
বললে, করেছ কি দিদি! এত খাবে কে?
—দেখনা কে খায়! বোসো তো।
—না, না। এ যে অনেক! নষ্ট হবে।
তার জন্যে চিন্তা করো না। অনেক নষ্ট না হলে আমাদের দেশে খাওয়ানোই হয় না।
—তাই না কি? এ ভারি অন্যায়।
এদেশের বড় লোকদের খাওয়া এবং খাওয়ানো সম্বন্ধে মহেন্দ্রের সেই উক্তিটা পেনিলোপীর মনে পড়লো। বুঝলো এমনিই এখানে হয়। আর কথা না বাড়িয়ে সে ওদের দেখে-দেখে খেতে আরম্ভ করলে। হাতে করে এর আগে সে কখনও খায়নি। খেয়ে দেখলে, বেশ আরাম তো! কাঁটা-চামচের চেয়ে ভালো। বসন্ত মাঝে মাঝে বলে হাতে না খেলে পেট ভরে না। মিথ্যে বলে না!
সুবর্ণ বললে, ঠাকুরপোকে বোলো, সে যে এলো না, এর শাস্তি তোলা রইলো।
—বলব।
—বোলো তারই জন্যে এই শীতে ভোরবেলায় স্নান করে আমি রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম। আর সে এলো না!
—স্নান না করে কি তোমরা রাঁধ না দিদি?
—তাই রাঁধে? লোকে খাবে, পবিত্র হয়ে না রাঁধলে তৃপ্তি হবে কেন?
গায়ত্রী বললে, খাবার পরিচ্ছন্ন হলেই তোমাদের কাজ মিটে যায়। আমাদের কিন্তু তাতেই চলে না। রান্না পবিত্র হওয়া চাই। ভগবানকে নিবেদন করে খাই কিনা।
ব্যাপারটা পেনিলোপী বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলো।
জিজ্ঞাসা করলে, ভগবান কি খেতে পারেন যে, তাঁকে খাবার নিবেদন কর? গায়ত্রী বললে, কি জানি তিনি কি পারেন আর কি পারেন না। আমরা যা কিছু পাই তাঁরই দয়ায় পাই। তাই তাঁকে উৎসর্গ না করে কিছু ব্যবহার করি না। নতুন কাপড় পরবার আগে, একগাছি সূতো তাঁকে দিয়ে তবে কাপড়খানি পরি। এই সূতোর টুকরোখানি না পেলে কি তিনি উলঙ্গ হয়ে থাকেন? তা নয়। তবু এই উপলক্ষে তাঁকে একবার স্মরণ করাও তো হয়।
পেনিলোপী খুশি হল। বললে, বেশ ভালো ব্যবস্থা তো।
এতক্ষণ পেনিলোপী খেয়াল করেনি। এখন দেখলে গায়ত্রী আর সুবর্ণও ঠিক পাশাপাশি বসে নেই। দুজনের আহার্যও ঠিক এক বস্তু নয়। সুবর্ণর থালা ঠিক পেনিলোপীর মতোই সাজানো। কিন্তু গায়ত্রীর পাতে কেবলমাত্র দু’তিনটা তরকারী এবং এক বাটি দুধ। তাছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
দেখে পেনিলোপীর ভারি বিশ্রী লাগলো। সুবর্ণ আর গায়ত্রীর আহার্যের এই তারতম্য দেখে তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। জিজ্ঞাসা না করে পারলে না, আমি না হয় খ্রীস্টানের মেয়ে দিদি, আমার সঙ্গে যেন খেলে না। কিন্তু গায়ত্রীর সঙ্গেও কি তুমি খাও না?
সুবর্ণর মুখে একটা কোমল বিষণ্ণ ছায়া নেমে এল। বললে, ও যে বিধবা ভাই, মাছ-মাংস তো খায় না। সেই জন্যেই দূরে বসেছে।
পেনিলোপীর মুখটা প্রসন্ন হল। গায়ত্রীর পাতের দিকে চেয়ে মনে এমনও সন্দেহ হয়েছিল, বেতনভুক পাচিকা বলেই বুঝি তাকে দূরে সরানো হয়েছে এবং আহার্যের ব্যবস্থাও পৃথক করা হয়েছে।
সুবর্ণ জিজ্ঞাসা করলে, আমাদের রান্না কেমন লাগছে?
সত্য কথা বলতে গেলে, এ রান্নায় এখনও তার জিহ্বা অভ্যস্ত হয়নি। তবু মন্দ লাগছিল না। কিন্তু বলবার সময় ভদ্রতা রক্ষা করে উচ্ছ্বাসভরে বললে, চমৎকার তোমাদের রান্নার পদ্ধতি! খাসা খেতে হয়েছে। আমাকে দু’একটা রান্না শিখিয়ে দিও তো। বিশেষত গলদা চিংড়ির এইটে। ভারি সুন্দর হয়েছে।
খাওয়া-দাওয়ার শেষে বিদায় নেবার সময় পেনিলোপী সুবর্ণকে জিজ্ঞাসা করলে, মহিনের উপর আর কিছু আদেশ আছে তোমার? থাকলে বল, তাকে গিয়ে বলব।
সুবর্ণ বললে, আর যা আছে তা দেখা হলে তাকেই বলব। তাকে একবার পাঠিয়ে দিও বরং।
—আচ্ছা।
বলে পেনিলোপী চলে গেল। যাবার সময় গায়ত্রীকে একটা সম্বোধনও করলে না।
.
বাগান বাড়ীতে ফিরে গিয়ে পেনিলোপী দেখে একখানা ইজি-চেয়ারে চিৎ হয়ে পড়ে মহেন্দ্র খবরের কাগজ পড়ছে।
পেনিলোপীর পায়ের শব্দে মাথা তুলে মহেন্দ্র বললে, Good afternoon, Mrs. Lahiri.
—Very good afternoon!
—খেলে কি রকম?
—প্রচণ্ড! উঃ কি আয়োজনই না করেছিল! এত বড় একটা থালার তিন দিক তো ভর্তি, তার উপর সারি সারি বাটি! সে, কত!
ইজি-চেয়ারের উপর ধড়মড় করে উঠে বসে মহেন্দ্র বলে উঠলো : থাম, থাম! কী বললে? থালা? বাটি?
—থালাই তো বলে তাকে? বেল মেটালের?
—হ্যাঁ, থালাই বলে। তাইতে খেতে দিয়েছিল তোমাকে? নরেন মুখুজ্যের গেল এক প্রস্থ বাসন!
—কেন?
—ও থালা-বাসন আর ঘরে ঢুকবে না। ফেলে দেওয়া হবে। তথাপি তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী পেনিলোপী। তোমাকে আমার হিংসে হচ্ছে।
—কেন?
—আমি চীনে-মাটির বাসন ছাড়া আর কিছু পাইনি। তোমার ভাগ্যে জুটেছে কাঁসার থালা।
পেনিলোপী বললে, আজ তুমি গেলে তোমার ভাগ্যেও জুটতো।
—না, জুটতো না। কোনোদিন জোটে নি, আজও তার ব্যতিক্রম হত না। তারপর আর কি খবর বল।
—খবরের মধ্যে তোমার বৌদি তোমার উপর চটেছেন।
—কেন?
—নেমন্তন্ন রক্ষা করনি বলে।
—কিন্তু নেমন্তন্ন তো আমি গ্রহণ করিনি।
—তুমি করনি, কিন্তু তোমার হয়ে আমি করেছিলাম। তাঁর হাতের রান্না খেতে ভালোবাস বলে এই শীতের ভোরে উঠে তিনি স্নান করে রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন। আর কত রান্না রেঁধেছিলেন। কিন্তু তুমিই গেলে না!
—আমার ভাগ্য পেনিলোপী!
—তোমাদের দোতলার বারান্দায় একসঙ্গে সব খেতে বসেছিলাম, তোমার বৌদি, গায়ত্রী, আমি। তুমি থাকলে তুমিও বসতে।
—না। কারণ আমাদের পরিবারে স্ত্রী-পুরুষে একসঙ্গে খাওয়ার রেওয়াজ নেই। তারপরে আর কি কথা হল?
—কথা? কথা বিশেষ কিছু নয়। এই সব রান্না-খাওয়ার গল্প।
—মাত্র?
—মাত্র।
মহেন্দ্ৰ অন্য কথা শুনতে চায়। পেনিলোপী তা বোঝে। কিন্তু তার বলবার কথা কিছু নেই। খাওয়ার পরে গায়ত্রীকে একলা পাবার জন্যে পেনিলোপী অনেকবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার মনোগত অভিপ্রায় বুঝতে পেরেই হোক, অথবা না বুঝতে পারার জন্যই হোক, গায়ত্রী কেবলই তাকে এড়িয়ে গেছে। সুতরাং মহেন্দ্রকে তার বলবারও কিছু ছিল না। মহেন্দ্ৰ বোধ করি তার মনের কথা অনুমান করলে। এবং এ নিয়ে আর জেদ করলে না।
বললে, চল। মোটরটা নিয়ে একটু ঘুরে আসা যাক।
—সেই ভালো।—পেনিলোপী বললে, ওটা আমার খেয়ালই হয়নি। চল, চারিদিকটা একবার দেখাও হবে।
মোটরটা বের করে পেনিলোপী নিজেই ড্রাইভ করতে লাগলো। মহেন্দ্র বসলো তার পাশের আসনে। মেয়ে মানুষ মোটর চালায়, এই দৃশ্য দেখবার জন্যে রাস্তার দু’ধারে কাতার দিয়ে লোকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলো।