বারো
বিকেলের ট্রেনে মহেন্দ্র চলে গেল।
বিরাজমোহিনী কাঁদলেন; সুবর্ণ আরও দিন কয়েক থেকে যাবার জন্যে সাধলে; নরেন কিছুই করলে না শুধু জিজ্ঞাসা করলে, তোমার সেই পুরানো বাসাতেই উঠবে তো?
মহেন্দ্র বললে, সেই ঠিকানায় চিঠি দিলেই পাব। তাছাড়া আমি গিয়ে চিঠি দিলেই ঠিকানা জানতে পারবেন।
নরেন জিজ্ঞাসা করলে, কি করবে কিছু ঠিক করলে?
—ঠিক করিনি কিছুই। ওখানে গিয়ে ভেবে দেখব।
—ফিরছ কবে?
সুবর্ণ হেসে বললে, এখন ফিরবে না। বিয়ে-থা দাও তবে ফিরবে। নইলে ফিরতে আমি নিষেধ করে দিয়েছি।
মহেন্দ্র চলে যাবার পর সুবর্ণ জিজ্ঞাসা করলে, হ্যাঁগা, সত্যি, ঠাকুরপোর বিয়ের কথা কিছু ভাবছ?
—কি ভাবব? ওর ওই আচার ব্যবহার, আমাদের সমাজে কে ওকে মেয়ে দেবে বলো? শহরে অবশ্য ও সব চলে।
—তা হলে শহুরে মেয়েই নিয়ে এস।
নরেন চুপ করে রইলো।
সুবর্ণ বললে, আমি একটা কথা বলব?
—বলো।
—বিধবা বিবাহ আজকাল তো চলছে।
—কোথাও চলছে না। শুধু খবরের কাগজেই প্রবন্ধ বার হয়।
—না চললেও ঠাকুরপোর তাতে অসুবিধা হবে না। তুমি তো আমাদের সমাজে কিছুতেই ওকে চলতে দিলে না। ওর আর সধবাই বা কি, আর বিধবাই বা কি! শেষে একটা মেম-টেম বিয়ে করবে, সেইটেই কি ভালো হবে? এ তবু হিন্দুমতেই হোত।
নরেন হেসে বললে, কিন্তু আমাকে তুমি কী করতে বল? সধবাও আমার হাতে নেই, বিধবাও আমার হাতে নেই। থাকলেও, সে বিয়ে হিন্দুমতে হলেও, আমি দাঁড়িয়ে থেকে দিতে পারতাম না।
সুবর্ণ একটু দ্বিধা করে বললে, আমি গায়ত্রীর কথা বলছিলাম। ওদের দু’জনের খুবই ভাব। দেখলে তো কি রকম করে ওকে বাঁচালে। আমার মনে হয়, ওদের দু’জনের মধ্যে বিয়ে হলে—
নরেন ওকে আর কথাটা শেষ করতে দিলে না।
দুই কানে আঙুল দিয়ে বললে, ছিঃ! ছিঃ! ওকথা আর কোন দিন আমাকে শুনিও না বড় বৌ। ও সব কানে শুনলেও পাপ হয়। তা ছাড়া তুমি কি মনে কর, ব্যাপারটা নিতান্তই সহজ? বেণীকাকাই বা রাজি হবেন কেন? অবস্থা যাই হোক, তাঁর ধর্মনিষ্ঠা এবং আত্ম-সম্মান জ্ঞান যে কত বড়, সে তো তুমি ভালো করেই জান।
সুবর্ণ আর কিছু বলতে সাহস করলে না।
কেবল কুণ্ঠিতভাবে বললে, তাহলে আমাদেরই বাড়ীর ছেলে কি শেষে ধর্মত্যাগ করবে?
—ধর্ম তো ও অনেক দিনই ত্যাগ করেছে বড় বৌ, নামটাকে শুধু আঁকড়ে আছে।
–তাও তো আছে। এর পর যদি অন্য জাতেই বিয়ে করে? একবার তো সেই অবস্থাই হয়েছিল।
হাতের তালু উলটে নরেন বললে, করে তো আমরা কি করতে পারি বড় বৌ? সে কি ছোট ছেলে, না আমাদের হাতের মধ্যে রয়েছে? তাছাড়া ও ভাবনা এখন থেকে কেন আরম্ভ করলে বড় বৌ? এই তো সবে ফিরলো। যাকনা আরও কিছুদিন।
এ প্রস্তাব মন্দ নয়।
আর গায়ত্রী?
তার বাইরেটায় পরিবর্তনের চিহ্ন মাত্র দেখা গেল না। তারই বাড়ীর সম্মুখের রাস্তা দিয়ে গেছে মহেন্দ্রের মোটর, হর্ণ বাজাতে বাজাতে। কিন্তু উঠে গিয়ে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াবার কৌতূহল সে দেখালে না। ছোট ছোট ভাইবোনগুলিকে উঠানে গোল করে বসিয়ে সে তখন তাদের ভাত খাওয়াচ্ছিল, আর হুমো পাখীর গল্প করছিল। হুমোপাখীর গল্পের সঙ্গে মোটা মোটা গ্রাসের চেয়ে মিষ্টতর খাদ্য ছেলেদের আর জানা নেই। তার জন্যে তরকারীরও দরকার হয় না।
সেই সময় মোটরের হর্ণ তার কানে গেল।
একজন বললে, ওদের ছোটবাবু ওই যাচ্ছে দিদি।
মা জিজ্ঞাসা করলেন, মহিন বুঝি কলকাতায় গেল?
—জানিনে তো।
—জানিসনে কি! দেখলাম যে মটোরে করে গেল।
—তাহলে তাই গেলেন বোধ হয়।
বিকেলে গায়ত্রী গেল নরেনদের বাড়ী।
ধরা গলায় বিরাজমোহিনী বললেন, আজ মহিন এল গায়ত্রী।
এল মানে গেল। মায়ের প্রাণ, গেল বলতে বাধে।
গায়ত্রী নিস্পৃহভাবে শুধু বললে, তাই বুঝি?
তারপর সুবর্ণর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, আজ রামায়ণ পড়া হবে না বৌদি?
সুবর্ণ উত্তর দেবার আগেই বিরাজমোহিনী বললেন, হবে বই কি? তবে কান্নার জায়গা পড়িস না বাছা, মনটা এমনিতেই ভালো নেই।
দোতলার প্রশস্ত বারান্দায় গোল হয়ে বসে রামায়ণ পড়া চললো। হঠাৎ একসময় পড়া বন্ধ করে গায়ত্রী ব্যস্তভাবে বললে, ওই যাঃ!
সবাই চমকে উঠল :
—কি হল?
—বাইরে বড়ি মেলে দিয়ে এসেছি। মা তো ঘুমুচ্ছে। গরুতে এতক্ষণ বোধ হয় দিলে শেষ করে।
ঢুল একটু-একটু বিরাজমোহিনীরও আসছিল। বড়ির প্রসঙ্গে তা ছুটে গেল।
জিজ্ঞাসা করলেন, বড়ি দিলি বুঝি? কি ডালের?
—কলায়ের আছে, মুসুরিও আছে জ্যাঠাইমা।
বিরাজমোহিনী ঘাড় বেঁকিয়ে বললেন, ছোট-ছোট মুসুরীর ডালের ফুলবড়ির টক মনে হচ্ছে কতদিন যেন খাইনি। হ্যাঁ বৌমা, তুমি না হয় জানো না, কিন্তু বাড়িতে এতগুলো ঝি-চাকরানী, তাদের বললেও তো পারো। ক্ষান্তর মা তো সজ্জাত, সেও তো একদিন স্নান করে মটকার কাপড় পরে দিতে পারে।
গায়ত্রী হাসতে হাসতে বললে, কাউকে দিতে হবে না জ্যাঠাইমা। ডাল আনিয়ে ভিজিয়ে রাখবেন। আমিই এসে দিয়ে যাব।
বলে সে তাড়াতাড়ি চলে গেল।
বাড়ি গিয়ে গায়ত্রী সটান ঘরের মধ্যে একটা মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়লো। বড়ির ব্যাপারটা একেবারেই কল্পনা।
মা সভয়ে বললেন, অমন করে এসে শুলি যে! শরীর ভালো আছে তো?
–শরীর ভালোই আছে মা, কেমন ঘুম পাচ্ছে তাই শুলাম।
—দেখিস বাছা, তুই শুলে যে ভয় করে।
শুয়ে শুয়ে গায়ত্রীর মনে হল, এ ভালো হল যে মহেন্দ্র চলে গেল। এই গ্রামের মধ্যে এত কাছে তার উপস্থিতি সহ্য করার দুঃখ থেকে সে বাঁচলো, সে বাঁচলো।
.
মহিম স্বর্ণকারের দোকানেও একটা সভা বসলো।
জনার্দন গ্রামের যাত্রার দলের পাণ্ডা। উৎসাহী ছোকরা। বললে, যাই বলো ভাই, ছোটবাবু চলে যাওয়ায় গ্রামটা অন্ধকার হয়ে গেছে।
কিনু কয়াল, সেও সামান্য ব্যক্তি নয়। যুদ্ধের বাজারে ধান-চালের কয়ালী করে যা হোক দু’পয়সা করেছে।
বললে, কেন বাপু? সাহেব তো পাইপ মুখে দিয়ে বসে থাকতেন বাগানবাড়ীতে। মাঝে মাঝে হাওয়াগাড়ী করে হাওয়া খেতে বার হতেন। তার জন্যে গ্রামটার কি এমন জৌলুস বাড়তো?
গোবর্ধন পাটের ব্যাপারী। ব্যবসাসূত্রে গঞ্জে ঘোরাঘুরি করে। গম্ভীরভাবে বললে, তাও বাড়ে হে, তাও বাড়ে। এক-একটা রাশভারী লোক থাকে যারা ঘরের ভিতর বসে থাকলেও গ্রাম গমগম করে। আমি পাঁচ জায়গায় ঘোরাঘুরি করি কিনা, জানি।
কিনু বললে, গমগম যদি করে তো বেণী বাঁড়ুয্যের বাড়ী। আমাদের তাতে কি?
বলে একটা অভদ্র ভঙ্গিতে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলো।
গোবর্ধন বললে, না হে। বলে, কানায় কি বুঝবে আলোর মর্ম? তোমার হয়েছে তাই। মর্ম বোঝে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, হাত ধরে যে ছাড়ে না। বোঝে দেশ-বিদেশের লোক। তুমি কয়ালী করে খাও তুমি কি বুঝবে?
কিনু পরিহাসের ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বললে, আমার বুঝেও কাজ নেই দাদা। কয়ালী আমার লক্ষ্মী, আমার শাঁখা-সিঁদুর। তোমাদের পাঁচ জনের আশীর্বাদে ওইটে বজায় থাকলেই বাঁচি। কিন্তু তোমরা তো পাঁচ গাঁয়ে ঘোর গবুদা, বলি ভেতরের খবর কিছু রাখো?
ভিতরের ব্যাপারের নামে আগ্রহে এবং কৌতূহলে সকলেরই মুখ সূচলো হয়ে উঠলো।
সবাই বললে, কি, কি, কি?
কিনু বললে, আলো আলো করছিলে, এইবারে আলোয় ছয়লাপ হবে যে! -কিসে? ছোটবাবুর বিয়ে?
—হ্যাঁ গো। আছ কোথায়?
কিনুর এক বিধবা মাসী বাবুদের বাড়ীর পরিচারিকা। সুতরাং বাবুদের বাড়ীর ভিতরের কথা জানবার তার সুযোগ আছে, তার উপর নির্ভরও করা যায়।
সবাই বললে, কবে? কবে? ঠিকঠাক হয়ে গেছে নাকি?
–বর-কনেতে হয়ে গেছে। এখন বরের দাদার অপিক্ষে।
—সেটা কি রকম হ’ল?
—এ সব সাহেব-সুবোর ব্যাপার রে দাদা! কি রকম করে কি যে হয় তা, আমি কয়ালী করে খাই, কি করে বলব?
জনার্দন গোলমালের মধ্যে থাকে না। বললে, যা হবার তা হোক রে ভাই, আমার যাত্রাদলের একটা জমকালো রাজপোশাক পেলেই হল।
গোবর্ধন বললে, হ্যাঁ। আর ক’দিন পেট পুরে লুচি-মণ্ডা পোলাও কালিয়া খাওয়া।
কিনু দুই বুড়ো আঙুল ওদের নাকের উপর নেড়ে বললে, সে গুড়ে বালি। মুর্গির ঠ্যাং দেবে মুখে ঢুকিয়ে। খাবে?
ওরা দমে গেল।
বললে, কেন? খিস্টানী বিয়ে নাকি?
জনার্দন চীৎকার করে বললে, সে কখনই হতে পারে না। বড় বাবু তা কখনও হতে দেবেন না। ছোটবাবুর যত দোষই থাক, দাদাকে গুরুর মতো ভক্তি করেন।
ওর অজ্ঞতায় মুখ ফিরিয়ে কিনু মুরুব্বির মতো হাসলে।
বললে, ভীমের পার্ট করে করে চ্যাঁচানি তোমার রোগে দাঁড়িয়েছে জনার্দনদা। ভেতরের ব্যাপার কিছু জানো?
ধমক খেয়ে জনার্দন দমে গেল। সবিনয়ে ঘাড় নেড়ে জানালে, কিছু জানে না।
গলা খাটো করে কিনু বললে, বড়বাবুই তো এর গোড়া হে!
—কি রকম?
—ওই যে বেঁটে-খাটো নাদুস-নুদুস মানুষটি, পেটে কি ওর কম বুদ্ধি খেলে ভেবেছ? সবাই নিঃশব্দে উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগলো।
—কত্তা উইল করে গেছেন, ছোট ছেলে যুদ্ধ থেকে ফিরে ইিঁদুর আচার-ব্যাভার যদি না মানে, হিদু মতে যদি না থাকে তো সে তেজ্যপুত্তুর।
তর্জনী উঁচিয়ে কিনু বলতে লাগলো :
—বিষয়-আশয়ের এক কৌড়ি সে পাবে না। ছেলে যুদ্ধ থেকে বেঁচে-বত্তে ফিরলো, বড় ভাই গাঁয়ের ষোলো-আনা লোককে দেখিয়ে দিলে, সে মোছলমানের হাতে খায়, গলার পৈতে ফেলে দিয়েছে, হিঁদুর আচার-ব্যাভার মানে না। এইবারে দেবে একটা বেধবার সঙ্গে বিয়ে। দিয়ে…
—বেধবার সঙ্গে? বল কি হে?
বাধা পেয়ে বিরক্ত ভাবে কিনু বললো, তক্ক কোরো না দাদা, যা বলি শুনে যাও। এ আমার ভেতরের খবর।
বলে চোখ পাকিয়ে বাধাদানকারীর দিকে চাইলে।
লোকটা দমে গিয়ে চুপ করলে।
সবাই কিনুকে তোয়াজ করে বললে, ও চ্যাংড়ার কথা শুনো না কিনু, তুমি বলো তারপরে কি?
গোবর্ধন ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করলে, বেধবাটি কে হে কিনু? আমাদের বেণী বাঁড়ুজ্যের–
তার পিঠে একটা চাপড় মেরে কিনু বললে, জিতা রও দাদা, জিতা রও। ব্যবসা কর পাটের, কিন্তু একেবারে হাঁড়ির খবর রাখ। ঠিক ধরেছ! তবে গেরস্ত ঘরের ব্যাপার, কথাটা এখন পাঁচ কান করা ঠিক হবে না।
জনার্দন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললে, কিন্তু বেণী বাঁড়ুজ্যের-
দাঁত খিঁচিয়ে কিনু বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, বেণী বাঁড়ুয্যেরই। বিশ্বাস হচ্ছে না? বলি সমারোহের চিকিচ্ছের কথাটা জানো, না তাও জানো না? তা সে কথাও ছেড়ে দিলাম! ডাক্তার-বদ্যি রোগের চিকিচ্ছে করে। কিন্তু বেণী বাঁড়ুজ্যের মেয়ে রোজ রাত্রে যে বাগানবাড়ী যেত, সেটা কোন্ চিকিচ্ছের জন্যে দাদা?
—না, না।
—না, না? ডাকো ইব্রাহিমকে, সে তো এই গাঁয়েরই লোক। ডাকো রাম সিংকে। ভজিয়ে দিচ্ছি। আরে বাবা তাদেরই বা ডাকতে হবে কেন? আমি নিজের চোখে দেখেছি যে, ছোট ভায়ের হাত ধরে বিকেল বেলায় ছুঁড়িটা সুড় সুড় করে বেরুচ্ছে।
মাসীকে যদি বা অবিশ্বাস করা যায়, ইব্রাহিম এবং রাম সিংকেও, কিনুর স্বচক্ষে দেখা ঘটনা তো আর অবিশ্বাস করবার নয়।
সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কালে-কালে হোল কী!
মরা করবীর অভিশাপ?
কি জানি কি। হয়তো তাই, নয়তো কলিকালেরই ক্রিয়া। সমস্ত জীবনভোর ওদের দু’জনকে হয়তো এরই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।