মহাকাল – ১৪

চৌদ্দ 

মহেন্দ্রের বাড়ীটা ওদের মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। পরের দিনই ওরা জিনিসপত্র নিয়ে এসে উপস্থিত হল। 

আসা পর্যন্ত মহেন্দ্ৰ পেনিলোপীর কাজ করবার শক্তি এবং নিপুণতা দেখতে লাগলো। 

বসন্ত বসে বসে সিগার খায়। ঘরের কাজ তার এলাকায় পড়ে না। ঘোরে পেনিলোপী। এই ক’দিনেই ও মোটা-মুটি কলকাতার রাস্তা চিনে ফেলেছে। দেখতে দেখতে নিয়ে এল কতকগুলো আসবাবপত্র। এলো গ্যাস স্টোভ, কার্পেট, রান্নার এবং খাবার বাসনপত্র, কতকগুলো ফুলগাছ সমেত টব, টুকিটাকি আরও অনেক কিছু। মহেন্দ্রের ভূতুড়ে বাড়ী দেখতে দেখতে নন্দন-কাননে পরিণত হল। 

মহেন্দ্র বুঝলে এরা মানুষের মতো বাস করতে জানে। 

দু’খানি তো ঘর। তার একখানি হল শোবার। আর একখানি পর্দা দিয়ে দু’ভাগ করে একটি বসবার এবং একটি লেখবার ঘর হল। সামান্য কয়েকটি আসবাবপত্র, ক’খানি মাত্র ছবি, তাই দিয়েই ঘর সাজালে এমন চমৎকার করে যে, তার রুচির পরিচয় পেয়ে মহেন্দ্ৰ মুগ্ধ হল। 

মহেন্দ্র ধরে বসলো, তার দোতলাটিকেও অমনি চমৎকার করে সাজিয়ে দিতে হবে। 

তাতে পেনিলোপীর বিরক্তি নেই। 

মহেন্দ্র বললে, বাড়ীটা কেনা হয়ে যাক। তারপর সমস্ত বাড়ীটার মনের মত করে সংস্কার করতে হবে। সে কাজের ভারও পেনিলোপীকেই নিতে হবে। 

বললে, জানো পেনিলোপী, আমাদের বাস করার পদ্ধতি আর তোমাদের বাস করার পদ্ধতি এক নয়। 

—না হওয়াই স্বাভাবিক। 

—সাদাসিধে জীবনযাত্রা এবং উঁচু চিন্তাধারা, এইটেই আমাদের আদর্শ।

—সে তোমাদের দেখলেই বোঝা যায়। 

—কিন্তু যুগ বদলে গেছে। আজ তার কিছু পরিবর্তন করা দরকার। 

—কর। কে বাধা দিচ্ছে? 

—আমাদের আলস্য এবং স্বভাবসিদ্ধ ঔদাসিন্য। উঁচু চিন্তাধারা আমরা ছেড়ে দেবার চেষ্টায় আছি। কিন্তু সাদাসিধে জীবনযাত্রার আকর্ষণ কিছুতেই ছাড়তে পারছি না। এঁদো স্যাঁৎসেতে ঘর, ছেঁড়া মাদুর আর মলিন বালিশ,- সাধারণ ভারতবাসীর বাস করার আদর্শ এর উপরে উঠলো না। 

—এর সবটাই আলস্য এবং ঔদাসিন্যের জন্যে নয় নিশ্চয়ই। দারিদ্র্যের কথাটাও বলো। 

—তাও বাদ দোব না। কিন্তু মানুষ যদি পণ করে, এমন একটি ঘর তার চাই, সমস্ত দিনের কাজকর্মের পরে যেখানে এসে বসলেই দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে, তাহলে সে তা পেতে পারে না, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না। আমার কথাই ধর। ভগবানের ইচ্ছায় অর্থের আমার বিশেষ অভাব নেই, তবু কি অবস্থায় ছিলাম, সে তো নিজের চোখেই দেখেছ। 

পেনিলোপী সে কথার উত্তর দিলে না। 

পালটা প্রশ্ন করলে, এ তো ভারতবর্ষের অন্ধকার দিকটার ছবি মহিন, আলোর দিকের কথাও কিছু বলো। 

—আলোর দিক? সেও এক হৈ হৈ ব্যাপার। অনাবশ্যক প্রাচুর্যের আর এক অস্বস্তিকর অধ্যায়। যত নেবে তার দ্বিগুণ ছড়াবে, যত ছড়াবে তার দ্বিগুণ হাঁকডাক ছাড়বে। ঐশ্বর্যের সে এক কুরুচিকর সমারোহ! আশা-সোটা, কাড়ানাকাড়া, কত কি! 

—এই কি ভারতবর্ষের সবটা ছবি? 

—না। ভালো দিকও যথেষ্ট আছে, নইলে এ জাতটা কবে মরে যেত, এতদিন বাঁচতো না। 

—সেটা তো বললে না। 

—না। এই দেশের বধূ হয়ে তুমি এসেছ। সেটা তোমাকে নিজেই খুঁজে নিতে হবে।

দুই হাতের মুঠো শক্ত করে পেনিলোপী বললে, তুমি দেখে নিও, সে আমি খুঁজে নোবই। 

—তাই নিও। কিন্তু তোমার বাংলা শেখার কাজ আরম্ভ করবে কবে থেকে?

-–আমি তো বলি আজ সন্ধ্যা থেকেই আরম্ভ হোক। 

মহেন্দ্র খুশি হয়ে বললে, বেশ। আরম্ভ যা করতে হবে, তা আজ থেকে আরম্ভ করাই ভালো। আমি বিকেলে তোমার বই কিনে নিয়ে আসব। এখন উঠি। 

.

একটা ভাষা যার জানা আছে, আর একটা ভাষা কাজ চলাগোছের শিখতে যে তার বিলম্ব হয় না, পেনিলোপী তা প্রমাণ করে দিলে। যে যে দেশেই থাকনা কেন, এই সুবৃহৎ মানবসমাজের চিন্তাধারা ও প্রকাশভঙ্গির মধ্যে একটা মূলগত গভীর ঐক্য আছে। পেনিলোপী অল্পায়াসেই প্রয়োজনীয় বাংলা শব্দ এবং ক্রিয়াগুলি দ্রুত শিখে ফেলতে লাগলো। 

বাংলা ভাষা বোঝবার কিছু শক্তি যখন ওর হয়েছে তখন ওরা তিনজনে একদিন বাংলা সিনেমা দেখতে গেল। 

ছবিটা বিলিতি ছবির তুলনায় একেবারেই খেলো এবং চতুর্থ শ্রেণীর। পেনিলোপীর ভালো লাগবার কথা নয়, এবং লাগেও নি। কিন্তু একটা জিনিস ও অন্তর ভরে নিয়ে এল। সে হচ্ছে এদেশের মেয়ের কোমলতা এবং সলজ্জ প্রেমনিবেদন। ওর বিদেশী চোখে এ জিনিসটা এত মিষ্টি লাগলো যে, বাড়ী পৌঁছুবার পর পর্যন্তও ভুলে-যাওয়া গানের রেশের মতো ওর সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে বাজতে লাগলো। 

রাত্রে নানা অবান্তর গল্পের মধ্যেও মহেন্দ্রকে হঠাৎ এক সময় জিজ্ঞাসা করলে, তুমি কখনও প্রেমে পড়েছ মহিন? 

মহেন্দ্র নিরীহভাবে উত্তর দিলে, কখনও কখনও পড়েছি বইকি। 

পেনিলোপী এতই অন্যমনস্ক ছিল যে, ব্যঙ্গের সুরটা ঠিক ধরতে পারলে না। সরলভাবে জিজ্ঞাসা করলে সে তোমাকে ভালবাসতো? 

—কখনও কখনও বাসতো বইকি। 

বসন্ত একটু সোডা আর হুইস্কি নিয়ে এল। বললে, কি? প্রেমের গল্প? চমৎকার! হুইস্কি আর সোডার সঙ্গে এই শীতের সন্ধ্যায় চমৎকার জমবে। 

সবাইকে যে গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে দিলে। 

পেনিলোপী বললে, এখন তার সঙ্গে দেখা হয়? 

তেমনি নিরীহভাবে মহেন্দ্র উত্তর দিলে, হয়। স্বপ্নে। 

গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে পেনিলোপী বললে, স্বপ্নে? জাগরণে না?

নিজের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে মহেন্দ্ৰ বললে, না। সে অবস্থা এখনও আসেনি। 

—তার মানে? 

—শুনেছি, উন্মাদ না হলে সে অবস্থা আসে না। 

এতক্ষণে পেনিলোপী বুঝতে পারলে। বললে, ঠাট্টা করছ? 

বসন্ত ওকে বুঝিয়ে দিলে, আমাদের সমাজে প্রেমে পড়ার সুযোগ কদাচিৎ ঘটে। আগে তো ছেলেমেয়ের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হত। এখন বড় বয়সে বিয়ে হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতেও প্রেমে পড়ার অনেক বাধা। 

পেনিলোপী জানতে চাইলে, কি রকম? 

বসন্ত বললে, প্রেমের চরম উদ্দেশ্য যদি বিয়ে করা হয়, তাহলে ঝঞ্ঝাট অনেক। আমাদের বিবাহ হয়, গাঁই-গোত্র, ঠিকুজি-কোষ্ঠি মিলিয়ে। কিন্তু ঠিকুজি মিলিয়ে তো আর সত্যি প্রেম করা যায় না। 

হতাশভাবে পেনিলোপী বললে, তাহলে? 

মহেন্দ্র বললে, তাহলেও আমাদের বিয়ে হয়। ঠিকুজি-কোষ্ঠি মিলিয়ে অভিভাবকেরা একটি সুলক্ষণা কন্যা দেখে আসেন। নির্দিষ্ট দিনে ছেলে অভিভাবক এবং বন্ধুবান্ধব পরিবৃত হয়ে সেই কন্যাকে বিবাহ করে আনে। 

শুনতে শুনতে পেনিলোপী খুব কৌতুক বোধ করছিল। জিজ্ঞাসা করলে, অথচ সেই মেয়েটিকে ছেলেটি চিনতোও না? 

মহেন্দ্র উত্তর দিলে, হয়তো কখনও দেখেওনি, তার গ্রামের নাম পর্যন্ত শোনেনি।

—তাতে কোনো পক্ষেরই কোনো অসুবিধা হয় না? 

মহেন্দ্ৰ বললে, সে-সম্বন্ধে আমাদের কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই। তবে যতদূর দেখেছি, অসুবিধা হয় বলে বোধ হয় না। বরং অপরিচয়ের অস্পষ্টতার জন্যে রোমান্সের রহস্য ঘনিয়ে আসে। 

স্তম্ভিতভাবে পেনিলোপী বললে, আশ্চর্য! জীবন কাটে কি রকম করে? 

—সব দেশেরই আর পাঁচজনের মতো করে, অর্থাৎ ভাব করে, ঝগড়া করে এবং আবার ভাব করে। জানো পেনিলোপী, আমাদের সমাজে ডাইভোর্স নেই, বিধবার দ্বিতীয়বার বিবাহও হয় না। 

শুনে পেনিলোপীর চোখ কপালে উঠলো। 

গলাটা একটু ভিজিয়ে নিয়ে ঈষৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, কিন্তু এ কি ভালো? তুমিই বলো বসন্ত। 

—জানি না।—বসন্ত বললে, তবে আমার মনে হয়, আমাদের এই সুপ্রাচীন দেশে এ বিষয়ে নানা রকম পরীক্ষাই হয়েছে নিশ্চয়, এবং অনেক দেখে শেষে এই ব্যবস্থাই পাকা হয়েছে। কিন্তু এও নিশ্চয় যে, যুগের প্রয়োজনে যদি কোনোদিন দেখা যায়, এ ব্যবস্থা উপযোগী নয়, তাহলে এ ব্যবস্থা ভেঙে যেতেও বিলম্ব হবে না। 

পেনিলোপী খুশি হল না। মহেন্দ্রের দিকে চেয়ে বললে, তোমারও কি এই মত? 

—না। 

—কেন নয়? এর বিরুদ্ধে কী তোমার যুক্তি?

—বসন্ত প্রশ্ন করলে। 

মহেন্দ্রের মস্তিষ্কে হুইস্কির ক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গেছে। 

বললে, কোনো ধর্মশাস্ত্রের অথবা ন্যায়শাস্ত্রের যুক্তি নয়, এ আমার হৃদয়ের যুক্তি। আমার স্বভাব পরিহাস- প্রবণ। হাসি দিয়ে আমি হৃদয়ের ক্ষত ঢেকে থাকি। তোমরা শোনো আমার কথা। 

শীতের রাত্রি। নিস্তব্ধ নিঃঝুম। 

ঘরের আলোয় বাইরে চাঁদ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। পিছনের কি একটা বড় গাছের ডাল নেমে এসেছে এদের জানালার কাছ বরাবর। হাওয়ায় দুলছে সেই ডালের পাতাগুলি, ছায়ামূর্তির ইসারার মতো। বস্তির ওপাশের বাড়ীটার জরাজীর্ণ দেওয়ালে কোনো একটা বাড়ীর তীব্র আলো এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে, কত যেন রাত। গায়ত্রীর গল্প বড় নয়, নিতান্তই ছোট। অবরুদ্ধ কণ্ঠে সেটুকু শেষ করতে মহেন্দ্রের দশ মিনিটের বেশি লাগলো না। 

গল্প যখন শেষ হল, কারও মুখ থেকে একটি কথাও বেরুল না। সবাই স্তব্ধভাবে বসে রইল। 

অনেকক্ষণ। 

জানালার বাইরে শুকনো গাছের পাতা মুড়মুড় করে মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছিল।

অনেকক্ষণ পরে পেনিলোপী মৃদুকণ্ঠে বললে, গায়ত্রীকে দেখতে বড় ইচ্ছা করছে।

কেউ তার কোনো উত্তর দিলে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *