মহাকাল – ১১

এগারো 

পরদিন দুপুরে মহেন্দ্র খাটে শুয়ে ছিল। 

দিবানিদ্রার অভ্যাস তার নেই। তবু বাংলাদেশের তেলে-জলে এই ক’দিনেই দিনে তার একটু তন্দ্রার মতো আসছে। সামান্য একটু তন্দ্রা,—মিনিট পনেরোর জন্যে। 

সেই তন্দ্রাও খুট শব্দে কেটে গেল। 

চোখ মেলে দেখে দ্বারপ্রান্তে ছোট ভাইটির হাত ধরে গায়ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। দেখে তার আর বিস্ময়ের শেষ রইল না। ব্যস্তভাবে উঠে বসে বললে, বোসো, বোসো। বৃহৎ কাষ্ঠে দোষ নেই শুনেছি। তুমি ওই কাঠের চেয়ারটা টেনে বোসো বরং! 

শান্তভাবে একটু হেসে গায়ত্রী ভাইটিকে কোলে নিয়ে সেই রিক্ত মেঝের উপর বসে পড়লো। 

বললে, তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এলাম মহিন দা। অসুখ থেকে উঠে পর্যন্ত কোথাও বেরুইনি। কালই প্রথম তোমাদের বাড়ী বেরিয়েছিলাম। 

ওর শীর্ণ, ক্লান্ত কণ্ঠস্বরে এবং বিশুষ্ক মুখের দিকে চেয়ে শান্তকণ্ঠে মহেন্দ্ৰ বললে, তুমি তো এখনও ঠিক সেরে উঠতে পারোনি গায়ত্রী। 

—না, আমি বেশ সেরে উঠেছি। সংসারের সব কাজই এখন করতে পারি।

মহেন্দ্র বললে, সেটা ভালো নয় গায়ত্রী। আরও কয়েকদিন তোমার বিশ্রাম করা উচিত। নইলে আবার পড়বে। 

গায়ত্রী ফিক করে হেসে বললে, তখন তুমি আছ। দিনরাত্রি আমার শিয়রে বসে তুমি তখন শুশ্রূষা করবে। পাড়ার লোকেরা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে। মন্দ কি? মহেন্দ্ৰ থমকে গেল। তার মুখ রাগে ঘৃণায় কালো হয়ে উঠলো। বললে, তাই করছে নাকি? 

—করবে না? ডাক্তার আসে, রোগী দেখে, ভিজিট নেয়, চলে যায়। রোগীর শিয়রে বসে শুশ্রূষা কে করে? তাদের বলার তো দোষ নেই মহিনদা! 

উত্তেজিতভাবে মহেন্দ্ৰ বললে, দোষ নেই? তাদের ইঙ্গিত যেমন নোংরা, তেমনি মিথ্যে। 

গায়ত্রী মুখ নামিয়ে টিপে টিপে হাসতে লাগলো। একটু কি ভাবলে। তারপর শান্তকণ্ঠে বললে, একেবারেই মিথ্যে? তোমার মনকে জিজ্ঞাসা কর তো। 

মহেন্দ্ৰ চমকে উঠলো। 

তারপর ধীরে ধীরে বললে, একেবারে মিথ্যে হয়তো নয় গায়ত্রী। আমার মন তোমার অগোচর নয়। কিন্তু তোমাকেও বলছি, এর মধ্যে নোংরা কোথাও নেই। 

–সে আমি জানি, নইলে নির্জন দুপুরে একটা ছোট শিশুর হাত ধরে তোমার শোবার ঘরে আসতে পারতাম না। কিন্তু এ তুমি কী করলে মহিনদা! কেন আমাকে বাঁচালে! 

অস্ফুটস্বরে মহেন্দ্র বললে, কি জানি কেন তোমায় বাঁচালাম। 

দুজনে নিঃশব্দে অনেকক্ষণ বসে রইল। 

মহেন্দ্ৰ বললে, তোমার সেই করবীঝাড়টা সেদিন দেখে এসেছি গায়ত্রী। তাতে এখন কত ফুল! 

গায়ত্রী নতমস্তকে বসেছিল। 

তাড়াতাড়ি বললে, তুমি একটি মেমসাহেব বিয়ে করেছ বলে যে শোনা যায়, সেটা কি?

—সেটা মিথ্যা। আমার সম্বন্ধে যে অসংখ্য মিথ্যা গুজব রটেছে ওটাও তারই একটি।

—বিয়ের কথা কি হয়নি? 

—কোনো কালে না। 

—কিন্তু তুমিই তো বৌদিকে ওই রকম একটা কথা লিখেছিলে। 

—না। পোর্টসৈয়দে থাকতে একটি ইংরাজ পরিবারে চমৎকার একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সেই কথাই শুধু বৌদিকে লিখেছিলাম। 

—তারপরে বিয়ে হল না কেন? 

—হবার নয় বলেই হল না। 

—বাধা কি? তুমি তো জাত-ধর্ম মানো না। 

—না। কিন্তু হৃদয় মানি। সেই তরুণীটির সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্কই হয়নি।

গায়ত্রী হেসে বললে, হলেই ভালো হত মহিনদা। আমাদের একটি মেমসাহেব বৌদি হত। 

—তোমাদের অদৃষ্ট!- কৃত্রিম সমবেদনার সঙ্গে মহেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে।

ওর দীর্ঘশ্বাস ফেলবার ভঙ্গিতে গায়ত্রী হেসে ফেললে। বললে, ফুলের কথা কি বলছিলে মহিনদা? একটু তাড়াতাড়ি বল, আমি আর বেশিক্ষণ বসতে পারব না। 

—ফুল? ও, সেই করবী গাছটার কথা। জ্বরের ঘোরে তুমি একদিন একটা কথা বলেছিলে গায়ত্রী : মরা গাছ বাঁচাতেই নেই, তার অভিশাপ লাগে। 

—লাগেই তো। 

—ফুলেভরা করবী গাছটার দিকে চেয়ে সেকথা আমার মনে লাগলো না। তবু বুকটা আমার কি রকম হু হু করে উঠলো। সেখানে আর দাঁড়াতে পারলাম না। পালিয়ে এলাম। 

গায়ত্রীর ছোট ভাইটা চুপি চুপি বললে, এইবার ওঠো দিদি। 

—এই যে উঠি ভাই।—বলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলে, পালিয়ে এলে কেন? 

—আর একটা কথা মনে পড়লো বলে। 

মহেন্দ্ৰ হেসে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইতেই গায়ত্রীর মুখ এক ঝলক রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো। তার বুঝতে বাকি রইল না কি কথা মহেন্দ্রর মনে পড়লো। কিশোরী মেয়ের দুঃসাহস আজও সে নিজেও ভুলতে পারেনি। আজও তার গভীর লজ্জার কারণ হয়ে রয়েছে। 

তখন কতই বা তার বয়স হবে, চৌদ্দর বেশি নয়। মহেন্দ্রকে তখন তার অদেয় কিছুই ছিল না। নিজেকে নিঃশেষেই নিবেদন করেছিল। তার সবটাই ছেলেবয়সের খেয়াল কিন্তু নয়। সেই বয়সেই তার হৃদয়পদ্ম দল মেলেছিল। সেই বয়সেই সহজাত বুদ্ধিবশে তার কি রকম মনে হয়েছিল, দরিদ্র পুরোহিত-কন্যাকে জমিদার চিন্তাহরণবাবু কিছুতেই বধূরূপে গ্রহণ করতে সম্মত হবেন না। তাই মহেন্দ্রকে হারাবার আশঙ্কা তাকে পাগল করে তুলেছিল। 

মহেন্দ্র সেইবার মেডিকাল কলেজের শেষ পরীক্ষা দেবে। কি একটা ছুটিতে দু’এক দিনের জন্যে বাড়ী এসেছিল। 

সেই সময় একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে ওই করবী গাছটারই আড়ালে গায়ত্রী তাকে চুপি-চুপি কলকাতায় নিয়ে পালিয়ে যাবার জন্যে মহেন্দ্রকে পাগলের মতো সেধেছিল। 

ওই করবী গাছটারই আড়ালে! 

গায়ত্রীর লজ্জারক্ত মুখের দিকে চেয়েও মহেন্দ্র নিষ্ঠুরের মতো সেই প্রসঙ্গেরই উল্লেখ করলে। 

উত্তরে স্খলিতকণ্ঠে গায়ত্রী শুধু বললে, তখন তো পারোনি। 

—না, সাহস হয়নি। কিন্তু যখন শুনলাম, তোমার বিবাহ হয়ে গেল তখন আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। ক’দিন ধরে কেবলই কেঁদেছিলাম। সেই দুঃখেই আমি যুদ্ধে চলে যাই গায়ত্রী। 

গায়ত্রীর চোখ হঠাৎ জ্বালা করে উঠলো। 

তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললে, ব্যস। তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কিন্তু আমার কথাটা একবার ভেবেছিলে? 

তার উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে থতমত খেয়ে মহেন্দ্র বললে, তোমার কি কথাটা গায়ত্রী?

—এই বিয়ের কথাটাই। ভগবান অত শীগগির তাঁকে না নিলে আমার কি হত ভেবেছিলে? তাঁকে তো আমি কিছুতেই ঠকাতে পারতাম না। মরণ ছাড়া আর কোনো পথই যে আমার জন্যে খুলে রেখে যাওনি, সে কথা ভেবেছিলে? নিষ্ঠুর! শুধু নিজে পালিয়েই বাঁচার চেষ্টা করেছিলে! আজ মরা বাঁচিয়ে কৃতজ্ঞতা চাইছ বড় গলা করে? লজ্জা করে না? 

গায়ত্রী দুর্বল শরীরে হাঁপাতে লাগলে। 

তার উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে এবং হাঁপানোতে ছোট ছেলেটা ভয় পেয়ে একদৃষ্টে দিদির মুখের দিকে চাইতে লাগলো। এবং আর একবার তাগাদা দিয়ে চুপি চুপি বললে, চলো দিদি। 

সে কথা বোধ হয় ওদের কারও কানেই গেল না। 

লজ্জিত কণ্ঠে মহেন্দ্র বললে, অত কথা অমন করে আমি তখন ভাবিনি গায়ত্রী। আমার অনেক অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু আজ যদি আমি তোমাকে বলি, সেই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করব, চলো আমার সঙ্গে। যাবে? 

—না। 

ছোট ভাইটির হাত ধরে গায়ত্রী উঠে দাঁড়ালো। 

ব্যাকুল কণ্ঠে মহেন্দ্ৰ বললে, কোনোদিন যাবে না? এ অভিমানের কোনোদিন শেষ হবে না? 

শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে গায়ত্রী বললে, তুমি বুঝতে পারবে না মহিনদা। এ অভিমান নয়। তোমার কাছে আজ আমার কোনো প্রত্যাশাই নেই। চল খোকা! 

গায়ত্রী চলে গেল। 

গায়ত্রী চলে যাবার পর মহেন্দ্রের পায়ের তলার পৃথিবী দুলে উঠলো না, আকাশও পীতবর্ণ মনে হল না। সে শুধু নিঃঝুম হয়ে তার বিছানায় তেমনি করে বসে রইলো। 

ইব্রাহিম শোবার ঘরেই ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। 

চা খেয়ে অনেকদিন পরে মহেন্দ্রর কি খেয়াল হল, তার সেই মেজরের পোশাকটা বের করে পরলো। যখন নেমে এল তখন ইব্রাহিম আর রাম সিং দুজনেই সগর্বে সেলাম করলে। দেখা যায় প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কে অর্থনৈতিক দিকটাই সর্বত্র বড় নয় এবং বেতনটাও একমাত্র গর্বের বিষয় নয়। ইংরেজ সওদাগরী আফিসের চল্লিশ টাকা বেতনের কেরাণী দেশী মনোহারী দোকানের ওই বেতনের কেরানীকে সমকক্ষ ভাবে না। 

মহেন্দ্র গ্যারাজ থেকে মোটর গাড়ীখানা বের করলে, এবং সোজা চলতে আরম্ভ করলে। 

প্রচণ্ড বেগে ছোটে গাড়ী। এই তীব্রগতি আজ ওর ভালো লাগে। বন বন করে সমস্ত কিছুকে পিছনে ফেলে-যাওয়া, ছাড়িয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া,—জীবনকালে হৃদয় যা সঞ্চয় করে তা পথের দু’পাশে মুঠো মুঠো করে ছড়িয়ে উড়িয়ে দিয়ে যাওয়া। 

এই গতি, এই যে দুর্বার গতি, এই তো জীবন 

মহাকাল। 

নিশ্চল, নিস্তরঙ্গ মহাকাল। 

তার বুকে ছোঁয়া লাগে গতির। জাগে মহাকাল, জাগে তরঙ্গ, জাগে সৃষ্টির আনন্দ। ঘোরে সূর্য, ঘোরে কোটি কোটি সৌরজগৎ। মহাকালের আঁচল থেকে ঝরে পড়ে পল- অনুপল-বিপলের রেণুকণা। ভোলানাথের শ্মশানে ফলে ভুলের ফসল। মানুষের চলায় আসে ছন্দ,-হারিয়ে যাওয়া ছাড়িয়ে যাওয়ার ছন্দ। আর্য ছাড়িয়ে যায় অনার্যকে শক হুনকে। মোগল ছাড়ালো পাঠানকে, বৃটিশ মোগলকে। রক্তের সমুদ্রে বারে বারে পৃথিবী যায় ভেসে। ক্লান্ত পৃথিবী, তবু তার থামবার উপায় নাই। সমস্ত স্তব্ধতাকে স্তব্ধ করে মহাকালের বিষাণ বাজে। যে থামবে, যে পিছিয়ে পড়বে, দূরের দিকে যে চাইবে না, তারই মৃত্যু হবে। 

মোটর চলেছে অবারিত মাঠের বুকের উপর দিয়ে। 

কালো পিচঢালা রাস্তা ভোজনশ্রান্ত অজগরের মতো নিশ্চল পড়ে ছিল। গতি সংক্রামক। মোটরের গতি তাকে ছুঁয়েছে, ছুঁয়েছে দু’পাশের গাছগুলোকে, দূরের গ্রামগুলোকে, পদতলের প্রান্তরকে, মাথার উপরের মেঘলোককে। 

সব ছুটছে। 

ছুটছে পথ। তীব্রবেগে ছুটছে দু’ধারের গাছগুলো। নিঃশব্দ সঞ্চরণে ঘুরছে মাঠ- ঘাট, ঘুরছে গ্রামরেখা, ঘুরছে মেঘলোক, ঘুরছে দিগ্বলয়। 

ঘুরছে মহেন্দ্র : 

শৈশব থেকে বাল্যে, বাল্য থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে। মায়ের কোল থেকে খেলার মাঠে, খেলার মাঠ থেকে করবীবনে, সেখান থেকে রণক্ষেত্রে। একটিবারের জন্যে একটুখানি সে অন্যমনস্ক হয়েছিল। অমনি বাস চলে গেল, আর ফিরে আসবে না। 

গায়ত্রীর উপর তার রাগ নেই, অভিমানও নেই। 

হিস্টেরিক মেয়ে। একদিন গভীর আবেগে যে-জেদের সঙ্গে তার হাত ধরে সে নিয়ে যাবার জন্যে সেধেছিল; আর একদিন তেমনি আবেগে তেমনি জেদের সঙ্গে তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলে। 

হয়ত সব মেয়েই এমনি। 

হয়তো তার উপায় নেই। তার জীবনের গতি গেছে ফুরিয়ে। যাকগে—

.

মহেন্দ্র যখন ফিরলো তখন রাত্রি ন’টার কম নয়। 

পাড়াগাঁয়ে ন’টা রাত্রি অনেক। অধিকাংশ লোকই এর মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়ে। আগে যখন কেরোসিন পাওয়া যেত, তখন গ্রামের কিছুটা সাড়া পাওয়া যেত। কখনও কখনও স্যাকরার দোকানে হাতুড়ি পেটার শব্দ উঠতো। এখানে ওখানে তাস পাশা-দাবার কোলাহল এবং রামায়ণের মধুর সুর শোনা যেত। চাষীরা অন্ধকার দাওয়ায় বসে চাষ – বাস, সুখ দুঃখের গল্প করতো। 

যুদ্ধ বাধার পর থেকে সে সব বন্ধ। কেরোসিন নেই, মানুষের মনে আনন্দও নিস্তেজ। 

মহেন্দ্রকে অভ্যর্থনা করলে কতকগুলো ঘুমভাঙা কুকুর বিরক্ত চীৎকারে। এ ছাড়া গ্রামে জাগ্রত জীবনের আর কোনো লক্ষণ পাওয়া গেল না। 

গাড়ীটিকে গ্যারাজে পুরে মহেন্দ্র ফিরে এল বাগানবাড়ীতে। রামসিং এবং ইব্রাহিম পাশাপাশি বসে ঝিমুচ্ছিল। মহেন্দ্রর পায়ের শব্দে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো। 

পোশাক ছেড়ে বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে খাবার ঘরে এসে মহেন্দ্র দেখে ট্রেতে কতকগুলো চিঠি সাজানো। গ্রামে আসা পর্যন্ত চিঠি তার বড় একটা আসেনি। 

খেতে খেতেই চিঠিগুলো একে একে খুলে দেখতে লাগলো। কতকগুলো বিলিতি ঔষধের পুস্তিকা। তার কলকাতার ঠিকানা থেকে রিডাইরেক্ট করে পাঠানো। একখানি ডাক্তারী পত্রিকা। আর একখানা খামের চিঠি, লিখছে বসন্ত। 

বসন্তকে সে ভুলেই গিয়েছিল। 

তারই সঙ্গে বসন্তও গিয়েছিল যুদ্ধে এবং তারই মত সেও মেজর হয়ে ফিরেছে। সম্প্রতি একটি গ্রীক তরুণীর পাণিপীড়ণে উদ্যত। 

অন্যগুলো একপাশে ঠেলে রেখে মহেন্দ্র এই চিঠিখানাই মনোযোগের সঙ্গে পড়তে লাগলো। 

দীর্ঘ পত্র। তার অধিকাংশই গ্রীকপত্নীর কথা ও কাহিনীতে পূর্ণ। মেয়েটি নানা বাধাবিঘ্নের ফলে ওদের সঙ্গে আসতে পারেনি। এত দিনে বহু কষ্টে এবং অনেক জায়গা ঘুরে এসে পৌঁছেচে। এবার তাদের বিয়ে হবে। দশ তারিখে দিনস্থির হয়েছে। তার পূর্বে নিশ্চয় যেন মহেন্দ্র আসে—এই অনুরোধ পুনঃপুনঃ জানিয়ে বসন্ত চিঠিখানা শেষ করেছে। 

আশ্চর্য! বসন্তের এখনও মহেন্দ্রকে মনে আছে! 

ওদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল বোধ হয় বেনগাজী থেকে। সেই সময় লম্বা একটা ছুটি নিয়ে মহেন্দ্র ভারতে ফিরে আসে। তার পর তাকে উত্তর আফ্রিকায় না পাঠিয়ে দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ায় পাঠানো হয়। সেইখানেই সে জাপানীদের হাতে ধরা পড়ে এবং শেষে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেয়। 

সে কত দিনের কথা! 

মহেন্দ্রের মন অকস্মাৎ সেই গ্রীক তরুণীকে দেখবার জন্যে অধীর হয়ে উঠলো। যে-মেয়ে একা কত বাধাবিপত্তি ভেদ করে, কত সমুদ্র পেরিয়ে একটা অপরিচিত দেশে, ততোধিক অপরিচিত সমাজের মধ্যে এসে তার প্রিয়তমের সঙ্গে মিলিত হতে পারে, তাকে দেখবার প্রলোভন জয় করা মহেন্দ্রের পক্ষে কঠিন। 

সে-মেয়ে গায়ত্রী নয়। গায়ত্রীর মতো তার ললাট তৃতীয়ার শশিকলার মতো ক্ষীণ নয়, চোখও কৃষ্ণতারা, স্নিগ্ধ এবং আয়ত নয়, চিবুকও হয়তো তেমন সুকুমার নয়। শরতের চাঁদের মত বর্ণও হয়তো নয়। 

সে মেয়ের চোখ কপিশ। জ্যৈষ্ঠ মাসের রোদের মতো ঝকঝকে তার রং। প্রশস্ত ললাটের গঠন সুদৃঢ়। চোয়াল প্রশস্ত। বলিষ্ঠ তার মণিবন্ধ, এবং নাতিস্থূল দীর্ঘ দেহ লবঙ্গলতিকার মতো ললিত নয়। সে আসে সাগর পেরিয়ে প্রিয়ের সঙ্গে মিলতে। 

মেয়েটিকে মহেন্দ্র এরই মধ্যে কল্পনায় দাঁড় করিয়ে ফেললো। তার পাশে গায়ত্রী মলিন হয়ে গেল, সূর্যের পাশে চাঁদ যেমন ম্লান হয়ে যায়। 

খেতে খেতে মহেন্দ্ৰ বললে, কাল আমি কলকাতা যাচ্ছি ইব্রাহিম।—হ্যাঁ সাব। 

—আবার কবে ফিরব তার ঠিক নেই। 

—হ্যাঁ সাব। 

—তোমাদের বকশিস কাল সকালেই দিয়ে দোব। 

—বহুৎ আচ্ছা সাব। 

ইব্রাহিম খুশি হয়ে পূর্বাহ্ণেই একটা সেলাম ঠুকলে। এবং কাঁটা-চামচ প্লেট সরিয়ে নিয়ে গেল। 

মহেন্দ্ৰ বললে, কাল লাঞ্চ খেয়ে যাব, বিকেলের ট্রেনে। আমার জিনিসপত্র সব কিন্তু কাল সকালেই বেঁধেছেদে রাখবে। জিনিসপত্র অবশ্য বেশি নেই। তবু সকালেই ওসব সেরে রাখা ভালো। ক’দিন তোমার খুব খাটুনি গেল ইব্রাহিম। পরশু থেকে আবার কিছুদিন বিশ্রাম পাবে। 

হাসতে হাসতে মহেন্দ্ৰ শুতে চলে গেল। কিন্তু ঘুম আসবে কি না সন্দেহ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *