মহাকাল – ১০

দশ 

ব্যাঙ্কের উদ্বোধন-উৎসব শেষ হয়ে গেল। এত বড় সমারোহ এদিকে কখনও হয়নি। দশখানা গ্রামের লোক উৎসব দেখতে এসেছিল। ব্যাঙ্কের বাড়ী এবং তার সামনের ময়দান এমন করে সাজানো হয়েছিল যে, পাড়াগাঁয়ের লোকে হাঁ করে চেয়ে দেখেছে, এবং শহরের লোকদেরও বলতে হয়েছে, চমৎকার! সভা শেষ হয়ে গেলে ময়দানে সামিয়ানা টাঙিয়ে রাত্রি দশটা পর্যন্ত গান-বাজনার আয়োজন হয়েছিল। এটা মহেন্দ্রর সখ। তাদের চারিপাশের কয়েকখানি গ্রামে অনেক ভালো ভালো গাইয়ে আছেন যাঁরা বাইরের সমাদর বড় একটা পাননি, অথচ সমাদৃত গাইয়ের চেয়ে কোন অংশে ন্যূন নন। জজ সাহেব গানের সমজদার শুনেই এই ব্যবস্থা সে করেছিল। এদের গান শুনে জজ সাহেব পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন। 

সব চেয়ে খুশি হয়েছিল নরেন নিজে। এখানকার ম্যাজিস্ট্রেট ছোকরা সাহেব। এঁর ভাই মহেন্দ্রর সহকর্মী ডাক্তার ছিল। এল-আলামিনের শিবিরের শত্রুপক্ষের গোলায় সে মারা যায়। ওঁদের দুই ভায়ের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। দুজনে অল্প ছোট-বড় ছিল। মহেন্দ্রকে ভায়ের সহকর্মী জেনে ম্যাজিস্ট্রেট যেন ছাড়তে চাইছিলেন না। সভার ভিতরে এবং সভার বাইরে যতক্ষণ তিনি ছিলেন ততক্ষণ মহেন্দ্রর একখানি হাত তাঁর হাতের মধ্যে ছিল। ভায়ের সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে গিয়ে ভদ্রলোকের চোখ বারবার ছলছল করে উঠছিল। অনেক কথাই তাঁর জানবার ছিল। মহেন্দ্র যথাসম্ভব সে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেয়। 

বিদায়কালে স্টেশনে সকলের সঙ্গে করমর্দনের পর ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্রকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরেন। 

বলেন, মেজর মুখার্জি, তুমি আমার ভাই। মনে থাকবে সে কথা? একদিন আসবে আমার বাংলোয়? তোমার তো গাড়ী আছে। আসবে একদিন? 

সন্তপ্ত ভ্রাতৃহৃদয়ের বেদনা মহেন্দ্রকে স্পর্শ করেছিল। গাঢ়কণ্ঠে সে বলেছিল, যাব, নিশ্চয় যাব। 

—কথা দিচ্ছ? 

—কথা দিচ্ছি। 

গ্রামের লোক বুঝলে, এবং যারা না বুঝতে চাইলে তাদের নরেন ধমকে বুঝিয়ে দিলে, মহেন্দ্র লোকটা কি দরের। 

রামলোচনের দিকে চেয়ে বললে, ভায়াকে নিয়ে বিপদ কম হবে না রামলোচনদা। সাহেবের তো যে রকম গদগদভাব ও তো নিত্যি আসবে। সঙ্গে সঙ্গে মেমসাহেবও না আসতে আরম্ভ করে। তাহলেই ফতুর! হাঃ হাঃ হাঃ! 

এ তো গেল নরেনের মুখের কথা। এর পরে আর পাঁচ জনের মুখে মুখে যখন কথাটা ছড়িয়ে পড়লো, তখন আর ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা তাঁর মেমসাহেব নন, সপরিবার স্বয়ং লাটসাহেবের অভ্যর্থনার জন্যে গ্রামবাসী প্রস্তুত হয়ে রইলো। 

এর একটা ফল সদ্য সদ্য পাওয়া গেল। 

পাশের গ্রামের জমিদার হরসুন্দর বাবুর সঙ্গে শ্রীপুরের মুখুজ্যেদের চর নিয়ে একটা দাঙ্গা আসন্ন। দাঙ্গায় খুন-জখম যা হবার তা তো হবেই, অধিকন্তু একটা বড় মামলায় উভয় পক্ষকেই কম হয়রানি ভোগ করতে হবে না। 

ব্যাঙ্কের উদ্বোধন শেষ হবার সপ্তাহখানেকের মধ্যে হরসুন্দরবাবুর পক্ষ থেকে একজন বিশ্বস্ত লোক এসে জানালে, চর নিয়ে নরেনবাবুর সঙ্গে মামলা করবার ইচ্ছা হরসুন্দরবাবুর মোটেই নেই। 

নরেন ভালোমানুষের মতো বললে, এ তো খুব সুখের কথা। কিন্তু সেদিনও ইচ্ছা ছিল, এখন নেই কেন? 

লোকটি হেসে বললে, বুঝতেই তো পারছেন, জজ ম্যাজিস্ট্রেট থেকে লাটসাহেব পর্যন্ত সকলের সঙ্গে এখন আপনাদের যেরকম দহরম-মহরম, তাতে আপনাদের সঙ্গে ফৌজদারী করায় সুবিধা হবে না। ফৌজদারী না করলে ও মামলায় আর আছে কি? বাবু তো সব নিজের চোখেই দেখে গেছেন। 

—আজ্ঞে হাঁ। সেদিন তিনি দয়া করে পায়ের ধুলো দিয়েছিলেন। আদর-সম্মান কিছুই করতে পারিনি। 

—বলেন কি, আপনাদের দুই ভায়ের সৌজন্যে তিনি বড় আপ্যায়িত হয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা, আগামী রাসের সময় আপনাদের দুই ভায়ের পায়ের ধুলো তাঁর গৃহে পড়ে। অবশ্য নিজেই তিনি আসবেন নিমন্ত্রণ করতে। 

—বিলক্ষণ! নিশ্চয়ই যাব। 

লোকটি ওঠবার সময় জিজ্ঞাসা করলে, মহেন্দ্রবাবু কি আছেন! বাবু তাঁকেও নমস্কার জানিয়েছেন। 

—সাহেব বোধ হয় বেরিয়েছেন।

—নরেন বললে, ওরা তো বসে থাকতে পারে না। তিনি ফিরলে আমি আপনার কথা জানাবো। হরসুন্দরবাবুকেও আমাদের নমস্কার জানাবেন। একদিন দেখা হলে খুবই খুশি হব। 

লোকটি চলে যাবার পর নরেন মনে মনে হিসাব করে দেখলে ব্যাঙ্কের উদ্বোধনে যে টাকাটা তার খরচ হয়েছে, এক চর থেকেই তার দ্বিগুণ উশুল হয়ে যাবে এতে আর ভুল নেই। সে অত্যন্ত খুশি হল। এবং স্থির করলে, দু’তিন দিনের মধ্যে মহেন্দ্রকে ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোয় পাঠাতেই হবে। এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। 

.

এ তো গেল নরেনের কথা। আর মহেন্দ্রের? 

কাজ ফুরিয়ে যাওয়ায় সে একেবারে বেকার। আবার সেই বই পড়া আর বাগানে বেড়ানো। কিন্তু তাও ভালো লাগে না। তার কব্জাগুলোর জোড় যেন খুলে গেছে। বেশিক্ষণ ধরে কিছুই সে করতে পারে না। কোনো কাজেই মন বসে না। 

দেশে প্র্যাকটিসে বসবার সম্ভাবনা একেবারেই বিলুপ্ত। নরেনকে সেকথা বলবারই উপায় নেই। শোনামাত্র সে উত্তেজিত হয়ে উঠছে। 

—তুমি কী বলছ মহিন! ম্যাজিস্ট্রেট যার হাত চেপে ধরে ছাড়ে না, সে যাবে যত ছোটলোকদের চিকিৎসা করতে? কেন? কি দুঃখে বলো। কলকাতা গিয়ে চিকিৎসা ব্যবসা করতে চাও করগে। না চাও, চুপ করে বসে থাকো। কিছুই করতে হবে না তোমাকে। তুমি বসে থাকলেও আমাদের টাকা আসবে। কি করে, সে আর জিজ্ঞাসা কোরো না। মহেন্দ্র সেকথা জিজ্ঞাসা করলে না। বুঝলে, এখানে প্র্যাকটিস করার কোনোই সম্ভাবনা নেই। নরেনের উদগ্র আভিজাত্যবোধ এবং বিষয়বুদ্ধি তাকে তা করতে দেবে না। 

তাহলে এখন কি করবে সে? কলকাতায় ফিরে যেতে কি জানি কেন তার ইচ্ছাই করছে না। 

কাল বিকেলে একবার বেরিয়েছিল নদীর ধারে। করবী গাছের ঝাড়টি দেখে এল। কত ফুল তাতে ফুটেছে। মহেন্দ্রের বুকের ভিতরটা কেমন হু হু করে উঠলো। সে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না। চলে এল। 

গায়ত্রী কেমন আছে কে জানে। অনেকদিন ওদিকে যায়নি সে। যাবার কোনো উপলক্ষ্যও ঘটেনি সম্প্রতি। আশা করছে খুব সম্ভবত ভালোই আছে। 

এমনি এলোমেলো হাজারও চিন্তা। 

নরেন এসেছিল আজ দুপুর বেলায়। বারে বারে জেদ করে গেছে দু’একদিনের মধ্যেই একবার সদরে যেতে। অত করে সাহেব বলে গেলেন, না যাওয়াটা ভালো দেখায় না। বিশেষ, ওঁরা জেলার কর্তা। ওঁদের সঙ্গে সৌহার্দ্য রাখার প্রয়োজনও যথেষ্ট। 

সেকথাও সে ভাবছে। 

নিছক অলসভাবে দিন কাটানোর চেয়ে গাড়ীখানা নিয়ে একবার ঘুরে এলে মন্দ হয় না। সকালে যাবে, বিকেলে ফিরবে। সঙ্গে যদি বৌদি যান, তাহলে আরও আনন্দ হয়। কিন্তু বৌদি ইংরাজি জানেন না। সুতরাং ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ী তাঁকে নিয়ে যাবার অসুবিধা অনেক। আর নরেন যা নিষ্ঠাবান হিন্দু, ঘরের বৌকে সেখানে যেতে দেবে, এ ভরসা নেই। 

তবু মহেন্দ্ৰ উঠলো। বৌদির সঙ্গেই দেখা করবার জন্যে। কিন্তু দোতলার বারান্দায় উঠেই সে থমকে দাঁড়ালো। 

গায়ত্রী মধ্যেখানে বলে সুর করে রামায়ণ পড়ছে। তাকে ঘিরে বসে শুনছে মা আর বৌদি। জন্মদুঃখিনী জানকীর দুঃখে দু’জনেরই গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

ওর পায়ের শব্দে মুখ তুলেই গায়ত্রী পড়া বন্ধ করে বইখানা একপাশে ঠেলে রাখলে। 

মা বললেন, মহিন! কি খবর? 

—খবর না থাকলে কি তোমাদের বাড়ি আসতে নেই? 

মা হেসে বললেন, তাই কি আমি বলেছি? শোনো কথা পাগল ছেলের! এমন সময় তো বড় একটা আসিস না। তাই জিগ্যেস করলাম। 

—বেশ করলে। কেঁদে তো বান এনেছ। ব্যাপারটা কি? সীতার বনবাস? আমি একটু শুনে কাঁদতে পাব না? 

সুবর্ণ ঝঙ্কার দিয়ে বললে, না। নাস্তিকদের আমরা রামায়ণ শোনাই না, কাঁদতেও দিই না। তার চেয়ে তুমি বরং ওই কোণে একটা মোড়া টেনে বসে বাইবেল পড়, আর যত খুশি হাস। 

বিরাজমোহিনী বললেন, আহা, তা শোনা না গায়ত্রী। বেশ পড়িস তুই। শুনতে চাচ্ছে ছেলেটা, একটু পড়না। 

সুবর্ণ বললে, বুঝতে পারছেন না মা, ঠাকুরপো ঠাট্টা করছে? 

—না, না। ঠাট্টা করবে কেন? ঠাকুর দেবতার বই, এ কি ঠাট্টা করবার জিনিস! তুই পড়। 

গায়ত্রী সাড়া দিলে না, পড়বারও লক্ষণ দেখালে না। যেমন নিঃশব্দে বসে ছিল, তেমনি বসে রইলো। 

মহেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, থাকগে মা। রামায়ণ শোনবার মতো সৌভাগ্য করে তো আসিনি, তুমি আর কি করবে? তার চেয়ে বৌদি, যেজন্যে এসেছি সেইটেই বলি। 

সুবর্ণ বললে, হ্যাঁ, বাজে কথা ছেড়ে দিয়ে সেইটে বল। 

মহেন্দ্ৰ বললে, সেটা আর কিছুই নয়, তোমার হাতের চিঁড়েভাজা খাওয়ার জন্যে বিকেলে মনটা ভয়ানক ব্যাকুল হয়ে উঠলো। ভাবলাম, তোমার কাছে গিয়ে পড়লে, এর একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হতে পারবে। 

—নিশ্চয়ই পারবে। কিন্তু সাহেব মানুষের মন হঠাৎ চিঁড়েভাজার জন্যে লোলুপ হয়ে উঠলো কেন? 

—সে আমিও বলতে পারব না বৌদি। ধরে নাও সংসারে অকারণে যেমন আরও পাঁচটা দুর্ঘটনা ঘটে, এও হয়তো তেমনি ক’রেই ঘটেছে। 

সুবর্ণ হাসতে হাসতে উঠে গেল। 

গায়ত্রীর দিকে চেয়ে মহেন্দ্র বললে, তুমি এখন কেমন আছ? 

—ভালোই। 

বিরাজমোহিনী বললেন, তুই তো ওকে মরা বাঁচিয়েছিস বাবা। ওর মা সেদিন এসে তোর কী যশই গাইলে, আর কী আশীর্বাদই না করলে! 

মহেন্দ্র হেসে বললে, রোগীর মায়েরা আছে বলেই এখনও ডাক্তারের ভাগ্যে ওইটুকু জোটে মা। নইলে তাও জুটতো কি না সন্দেহ। 

গায়ত্রী ফিস ফিস করে বিরাজমোহিনীকে বললে, আমি আজকে উঠি জ্যাঠাইমা। আর একদিন আসব। 

বলে কোনো দিকে না চেয়েই গায়ত্রী নিঃশব্দে ধীরে ধীরে নেমে গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *