মহাকাল – ২১

একুশ 

বাইরে মোটর প্রস্তুত। 

মহেন্দ্র এবং পেনিলোপী মাকে প্রণাম করবার জন্যে উপরে গেল। উভয়েরই চিবুকে হাত দিয়ে বিরাজমোহিনী চুমু খেলেন। বললেন, মহিন আবার যখন আসবে মা, তখন তুমিও যেন এসো। কিন্তু এবারে আর একলা নয়, আমার ছেলেকে সুদ্ধ সঙ্গে এনো। 

মহেন্দ্ৰ হেসে বললে, এ রকম ভার তো কোনো শাশুড়ী বৌমাকে দেয়নি মা। ছেলেই বৌমাকে সঙ্গে আনে, বৌমা নয়। 

সবাই হাসতে লাগলো। 

কিন্তু বিরাজমোহিনী ঠকবার পাত্রী নন। বললেন, আমাদের কালে তাই ছিল বাবা। কিন্তু তোমাদের কালে সবই যে উলটো হয়েছে। এখন বৌমাই ছেলেকে নিয়ে আসে।

খোঁচাটা পেনিলোপী উপভোগ করলে। বুঝলে, মহেন্দ্রের জন্যেই অকারণে এই খোঁচাটা সে খেলে। 

বললে, আসব বই কি মা। সামনের ফাল্গুনে মহিনের বিয়ে দিন। সবাই মিলে আনন্দ করা যাবে ক’দিন। 

মহেন্দ্রের বিবাহের কথায় বিরাজমোহিনীর মুখে একটা বিষণ্ণ ছায়া নামলো। বললেন, তোমরা পাঁচ জন আছ। খুঁজে পেতে ওর একটা কনে দেখে দাও। এ তো তোমাদেরই কাজ। 

পেনিলোপী হেসে বললে, কিন্তু ছেলেতো আপনার ভালো নয়। ওর কনে দেখার ফ্যাসাদ আছে। 

সায় দিয়ে বিরাজমোহিনী বললেন, মিথ্যে বলোনি মা। ফ্যাসাদ সত্যিই আছে। ওকে নিয়ে সারাজীবন আমি জ্বললাম। তবে তোমাদের কথা শুনতেও হয়তো পারে।

পুত্রের সঙ্গে আসন্ন বিচ্ছেদ-বেদনায় মায়ের গলা ভারী হয়ে এলো।

দোতলায় নামতেই দেখা হলো সুবর্ণের সঙ্গে। 

সুবর্ণ ওদের আসা বোধ হয় টের পায়নি। গালে একটি পান দিয়ে নেমে যাচ্ছিল। ওদের দেখে মুখের পানটা তাড়াতাড়ি ফেলে দিয়ে হাসতে হাসতে কাছে এল। পেনিলোপী বুঝতে পারলে না, কেন পান ফেলে দিলে। কিন্তু মহেন্দ্ৰ বুঝলে। 

মহেন্দ্র সুবর্ণের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলে। পেনিলোপী নমস্কার করে ওর হাত দুটি জড়িয়ে ধরলে। 

বললে, অনেক অত্যাচার করে গেলাম দিদি। চলে গেলে যেন গালাগালি দেবেন না।

সুবর্ণ হেসে বললে, গালাগালি দোব না? তাও কি কখনও হয়? তোমার জন্যে যখনই মনটা খারাপ হবে, তখনই গালাগালি দোব। আবার কবে আসছ বলে যাও। 

—আবার আসব শীগগির। তোমাকে মোটর চালানো শেখাব বলেছি। আসতেই হবে।

মহেন্দ্রের দিকে চেয়ে সুবর্ণ বললে, এবারে তুমি আমাকে অনেক রাগিয়েছ ঠাকুরপো। তোমার শাস্তি তোলা রয়েছে। 

হেসে মহেন্দ্র বললে, বেশ খানিকটা উঁচুতে তুলে রেখো বৌদি। কবে আসব ঠিক তো নেই। আসতে দেরি হতে পারে। আর নাও আসতে পারি। বলা তো যায় না। 

সুবর্ণ গম্ভীরভাবে বললে, ও সব বলতে নেই। 

কথাটা সুবর্ণ এমনই গম্ভীরভাবে বললে যে, মহেন্দ্র পরিহাসছলেও আর একটা কথা বলতে পারলে না। 

ওরা চলে আসবে এমন সময় গায়ত্রী ঘর থেকে বাইরে এসে দূরে থেকেই প্রণাম করলে। পেনিলোপী ছুটে গিয়ে হাত চেপে ধরলে : 

—তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে ভাই? কাল বেড়াতে গেলে না। আজও লুকিয়ে ছিলে। কী ব্যাপার তোমার? 

গায়ত্রী হাসলে, কোনো উত্তর দিলে না। 

মহেন্দ্র নির্বিকার দাঁড়িয়েছিল। হাত ঘড়িটা দেখে বললে, আর সময় নেই পেনিলোপী। 

—হ্যাঁ, চল—বলে গায়ত্রীর হাতে একটা চাপ দিয়ে পেনিলোপী মহেন্দ্রর পিছু পিছু নেমে গেল। 

.

সত্যই বেশি সময় আর ছিল না। ওরাও স্টেশনে পৌঁছুলো, ট্রেনও এসে পড়লো। নরেন ওদের সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত এসেছিল। ওদের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে, পেনিলোপীকে আবার আসবার জন্যে বারবার অনুরোধ জানিয়ে ট্রেন ছাড়লে পর বাড়ী ফিরলো। 

পেনিলোপী বসে রইলো জানালায়। দেখতে লাগলো চলন্ত দৃশ্য। মহেন্দ্র একদিকের বেঞ্চে বিছানাটা পেতে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো। 

বললে, আমি ঘুমিয়েও যেতে পারি পেনিলোপী। জংশন এলে আমাকে উঠিয়ে যেন চা দিও। 

পেনিলোপী বললে, জংশন কেন, যেখানে ইচ্ছা সেখানেই চা খেতে পারো।

—জংশনের আগে আর কোথাও চা পাওয়া যায় না। 

—তা জানি মশাই। কিন্তু ওই সবের ভেতর কি আছে জানো? 

বলে মাথার উপরকার বাঙ্কের দিকে পেনিলোপী সহাস্যে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে। 

—কি ওগুলো? 

—খুলে দেখিনি, শুনলাম ফ্লাস্কে চা আছে আর টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার আছে। তোমার দাদার কাণ্ড! আশ্চর্য মানুষ! 

তারপর বললে, তোমাকে দেখে বোঝা যেত তোমাদের অবস্থা ভালোই। কিন্তু তোমরা যে এত বড়লোক, তা জানতাম না। 

মহেন্দ্র সংশোধন করে দিয়ে বললে, তোমরা মানে আমি নই, দাদা।

পেনিলোপী সবিস্ময়ে বললে, তার মানে? 

—মানে বাবা তাঁর সম্পত্তি একা দাদাকেই দিয়ে গেছেন। কিন্তু সে কথা দাদা আমাকে জানতে দিতে চান না। 

—কেন? 

—সম্ভবত স্নেহবশে। পাছে আমি মনে দুঃখ পাই। 

—কেউ কি একথা জানে না? 

—সবাই জানে, কিন্তু দাদার মুখে কেউ কখনও শোনে নি। সুতরাং কেউই এ বিষয়ে ঠিক সুনিশ্চিত নয়। 

—তবে তুমি জানলে কি করে? 

—আমিও নিশ্চয় করে কিছু জানি না। শুনেছি মাত্র। কিন্তু দাদার কাছে যাচাই করার চেষ্টা করিনি। তবে আমার বিশ্বাস কথাটা মিথ্যে নয়। 

—সুবর্ণ জানে না? 

—বোধ হয় না। 

—তুমি বলতে চাও, তোমার দাদা নিজের স্ত্রীর কাছেও এ কথা গোপন করেছেন। 

—দাদা তা পারেন। 

একটু থেমে পেনিলোপী বললে, গুজবও তো হতে পারে। 

—তাও পারে, কিন্তু তা নয়। আমাকে দেখলেই মায়ের মুখ ম্লান হয়ে যায়। সন্দেহ হয়, একমাত্র তিনিই হয়তো ব্যাপারটা জানেন এবং জেনে খুব অশান্তি ভোগ করছেন। 

—কিন্তু তোমার বাবার এরকম করার কোনো কারণ আছে? 

—আছে। এবং অত্যন্ত সঙ্গত কারণই আছে। সত্যি কথা বলতে কি এর জন্যে বাবা, দাদা অথবা অন্য কারও ওপর আমার কোনো রাগ নেই। 

—কি তোমার অপরাধ? 

—অপরাধ অত্যন্ত গুরুতর। আমি ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও আচারভ্রষ্ট। আমি কালাপানি পার হয়েছি, জাত মানি না, উপবীত ত্যাগ করেছি। 

—এ আর আজকাল এমন কী গুরুতর অপরাধ! 

—কিছুই নয়। কিন্তু আমার বাবাকে আমি ভালো করেই জানি। তাঁর কাছে এর চেয়ে গুরুতর অপরাধ আর নেই। এবং সম্পত্তিটা যখন তাঁর, তখন এবিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয় কি? 

মহেন্দ্র হাসতে লাগলো। 

তারপর বললে, উত্তর আফ্রিকা গেলে, কিংবা মুসলমানের হাতে মুর্গির মাংস খেলে জাতিচ্যুত করবে সমাজের এমন আঁটাআঁটি বাংলাদেশে খুব কম জায়গাতেই তুমি পাবে। কিন্তু আমাদের এইদিকটা ব্রাহ্মণপ্রধান। বহু পণ্ডিতের বাস এখানে। তার উপর আমাদের বংশের মতো একটি অত্যন্ত গোঁড়া এবং নিষ্ঠাবান বংশের হাতে জমিদারী থাকায়, এই দিকটা এখনও ঊনবিংশ শতাব্দীর আওতা ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। এত গোঁড়ামি তুমি আর কোথাও পাবে না। 

দুজনেই নিঃশব্দে বসে রইল। 

ট্রেন স্টেশনের পর স্টেশন পার হয়ে যায়। মহেন্দ্র পাশ ফিরে শুয়ে। সম্ভবত ঘুমুচ্ছে। পেনিলোপী জানালার বাইরে চেয়ে পল্লীবাংলাকে দেখছে। তার গরু-চরা মাঠ, পদ্ম-ফোটা পুকুর, পানাবোঝাই খাল। 

হঠাৎ এক সময় ডাক শুনলে, পেনিলোপী! 

চমকে মুখ ফিরিয়ে পেনিলোপী জিজ্ঞাসা করলে, ঘুম ভাঙলো? 

—ঘুমোইনি তো। 

সবিস্ময়ে পেনিলোপী বললে, জেগে জেগেই এতক্ষণ মুখ বুজে পড়ে ছিলে? আশ্চর্য! 

মহেন্দ্র বললে, চিরজীবনই তো তাই রইলাম পেনিলোপী। ওইটুকুই তো আমার অহঙ্কার! 

 —ডাকছিলে কি জন্যে? 

—দেখ তো খাবার-টাবার কি কি আছে? ক্ষিধেও পেয়েছে, বিশেষ একটু চা নইলেই নয়।

টিফিন-ক্যারিয়ার খুলে পেনিলোপী আবাক! লুচি, চপ, কাটলেট, মাছের ফ্রাই, আলুরদম থেকে বড় বড় রসগোল্লা এবং নতুন গুড়ের সন্দেশ পর্যন্ত সবই আছে। আর তা এত বেশি পরিমাণে যে বলবার নয়। 

পেনিলোপী সভয়ে বললে, এ বোধ হয় আমাদের জন্যে নয়। 

—তার মানে? 

ঘাড় নেড়ে পেনিলোপী সজোরে বললে, আমাদের জন্যে কখনই নয়। এতে যা আছে তাতে আমাদের কলকাতার গোটা পাড়ার লোককে খাওয়ানো যায়। 

মহেন্দ্র উঠে বসে বললে, ঠিকই হয়েছে। আমার দাদার ব্যবস্থাই ওই রকম। ও রকম না হলেই সন্দেহের কারণ ঘটতো। আমার কেবল আশঙ্কা হচ্ছে, এই অবেলায় দাদাকে গিয়ে আবার স্নান করতে হবে। অথচ শরীর তাঁর ভালো নয়। 

—স্নান করতে হবে কেন? 

—কারণ ইব্রাহিমের রান্না ঐ অখাদ্যগুলো যে-মোটরে এসেছে, সেই মোটরে তিনি নিজেও এসেছিলেন। 

—এগুলো মোটরে তো আসেনি। ইব্রাহিম হাতে করে নিয়ে এসেছিল। 

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মহেন্দ্র বললে, বাঁচা গেল। এই অবেলায় স্নান করে দাদা যদি বা বাঁচতেন, মোটরখানা বাঁচতো না। 

—মোটরটাকেও স্নান করাতেন না কি? 

—তা ছাড়া উপায় ছিল না। মুর্গির কাটলেট ও-মোটরে এলে ওকে স্নান করতেই হত। তা সে যাক গে, কি আছে ছাই-ভস্ম বের করো। যতদূর পারি ওগুলো খেয়ে নিঃশেষ করে দিই। অবশিষ্ট রেখে দাও, বসন্তকে দেওয়া যাবে। 

—সেই ভালো।—বলে পেনিলোপী দুটো প্লেটে দুজনের খাবার সাজিয়ে ফেললে।

খেতে খেতে মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলে, বসন্তের জন্যে তোমার মন-কেমন করছে না পেনিলোপী? 

—করছে বই কি! যা অগোছালো মানুষ, বাড়ীঘর হয়তো নরককুণ্ড করে রেখেছে! 

মহেন্দ্ৰ যোগ দিলে : হয়তো কোনো দিন খাওয়াই হয়নি, জামা-কাপড় ময়লা, যে মোজাগুলো সেলাই করে দিয়ে এসেছিলে, সেগুলো আবার ছিঁড়েছে, ফুলগাছগুলোয় জল দেওয়া হয়নি, টেবিলে ধুলো জমেছে আধ ইঞ্চি,—বুঝতে পারছি খুব মন-কেমন করছে। আর একটু চা দিতে পার পেনিলোপী? 

পেনিলোপী রেগে বললে, না পারি না। ওই ফ্লাস্কটায় আছে, ইচ্ছে হয় ঢেলে নাও। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *