ভালোবাসা নাও, হারিয়ে যেও না – ১

একদিন সকালবেলা বাজার করে ফিরছি, দেখি যে গলির মোড়ের মিষ্টির দোকানের কাছটায় একটি ছেলে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। ছেলেটির বয়েস চোদ্দ–পনেরো হবে, ধ্যারেঙ্গা মতন গড়ন, কালো হাফ–প্যান্ট আর ময়লা গেঞ্জি পরা, খুব সম্ভবত কোনো বাড়ির চাকর। ইদানিং যাদের বলে ‘কাজের লোক’।

কান্নার আওয়াজ নানা রকম হয়। দুঃখ ও বিষাদের যেমন অনেক রকম স্তর আছে। সে যাই হোক, ছেলেটির কান্নার মধ্যে ফুটে উঠছিল গভীর অভিমান।

চোদ্দ–পনেরো বছরের ছেলেরা চেঁচিয়ে কাঁদে না। ঐ বয়েসে আত্মসম্মান বোধ প্রখর হতে শুরু করে, দুঃখ–টুঃখগুলো সব গোপন হয়ে যায়, বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে একটা বেপরোয়া, তেজি ভাব জাগে।

ছেলেটির কণ্ঠস্বর গোল মতন, নিটোল। তার কান্নার আন্তরিকতায় আমার বুকে একটা ধাক্কা লাগে। আমি থমকে দাঁড়ালুম।

ফুটো ঘটি থেকে গড়িয়ে পড়া জলের মতন আজকাল কলকাতার সব বাজারই আশপাশের রাস্তা ও গলিগুলিতে ছড়িয়ে থাকে। আমাদের বাজারের এই পেছনের গলিটায় দু’পাশেও নানা রকম আনাজপত্তরের সওদা নিয়ে ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়িরা বসে। সেই সব দোকানে কেনাকাটি চলছে, লোকজন যাচ্ছে আসছে, কেউ গ্রাহ্যই করছে না ঐ ছেলেটির কান্না। কেউ একটা প্রশ্নও করছে না। শুধু একটি বুড়ি ডিমওয়ালি খানিকটা অসহায় ভাবে বসে আছে।

তা হলে ছেলেটির কান্না কারুকে শোনাবার জন্য নয়। শুধু যদি নিজেরই জন্য হয় তা হলে একটা নিভৃত জায়গা খুঁজে নেয়নি কেন?

আমি বুড়ি ডিমওয়ালিকে জিজ্ঞেস করলুম, কী হয়েছে ওর?

একজন কথা বলার লোক পেয়ে বুড়ি যেন বাঁচল। সে তড়বড় করে বলল, দ্যাখো তো বাবা, আমি কী করব? ও ছেলেটা একটা কুড়ি টাকার নোট আমায় দেখিয়েছিল সে কথা ঠিক। আমি কেন মিছে কথা বলব বলো? তারপর ঐ দোকানদার বলছে সে কথা মানি না। তা এখন আমি কী করি? আমার কথা যদি না শোনে—

ডিমওয়ালি বুড়ির বয়েস অন্তত সত্তর তো হবেই। কথা বলার ধরনটি বেশ মিষ্টি এবং স্পষ্ট। আমি এর কাছ থেকে কোনো দিন ডিম কিনিনি, আগে কখনো দেখেছি কিনা তাও খেয়াল নেই। তার কথা শুনে ঘটনাটা ঠিক বোঝা গেল না।

আমি ছেলেটির দিকে ফিরতেই সে কান্না আদ্ধেকটা থামিয়ে বলল, আমি এখন কী করে বাড়ি যাব? আমাকে মারবে। আমাকে তাড়িয়ে দেবে। আমি কোনো দোষ করিনি—

জিজ্ঞেস করলুম, কী হয়েছে?

ঘটনাটা এই: ছেলেটি কোনো বাড়ির চাকর ঠিকই। সে কুড়ি টাকার একটা নোট নিয়ে বাজার করতে এসেছিল। প্রথমে সে ডিমওয়ালির কাছ থেকে ছ’টা ডিম নেয়। ডিমওয়ালি জানায় যে তার কাছে কুড়ি টাকার ভাঙানি নেই, সকাল থেকে তার বিক্রি হয়েছে মাত্র সাড়ে চার টাকা। তখন ছেলেটি তাকে বলে যে, বাজার করে ফেরার পথে সে দাম দিয়ে যাবে। এর পরে ছেলেটি যায় বাজারের গেটের দোকানে পাশেই এক স্টেশনারি দোকানে। সেখানে সে এক প্যাকেট বিস্কুট কেনে দু’টাকা পঁচাত্তর পয়সা দিয়ে। দোকানটিতে বেশ ভিড় ছিল। সেই দোকানদার অন্যান্য খদ্দেরদের সামলাতে সামলাতে এই ছেলেটিকে ফেরৎ দেয় শুধু দু’টাকা পঁচিশ। ছেলেটি জিজ্ঞেস করে, আর টাকা? দোকানদার বলে, আবার কিসের টাকা? তুই তো পাঁচটাকার নোট দিয়েছিস!

একজন প্রতিষ্ঠিত দোকানদার বনাম একটি চোদ্দ–পনেরো বছরের বাড়ির চাকর। এখানে কার কথা বিশ্বাসযোগ্য? ছেলেটি খানিকটা চ্যাঁচামেচি করেছিল, দোকানদার তাকে ভাগিয়ে দিয়েছে। অন্য খদ্দেররা মাথা ঘামায়নি। ছেলেটির একমাত্র সাক্ষী ঐ বুড়ি ডিমওয়ালি। এসব ক্ষেত্রে কেউ সাক্ষী দিতেও চায় না। কিন্তু ঐ বুড়ি উঠে গিয়ে বলেছিল, দ্যাখো বাবা, আমি অন্য কিছু জানি না। তবে এই ছেলেটা আমায় একটা কুড়ি টাকার নোট দেখিয়েছিল বটে। আমার ডিমেরও দাম বাকি আছে সেই জন্য। দোকানদার এই সাক্ষ্য অগ্রাহ্য করছে।

বাজারের অন্য কেনাকাটি দূরে থাক, ছেলেটি এখন ডিমের দামও শোধ করতে পারবে না। তার মনিব ও মনিবানী ‘আচ্ছা যা হয়েছে তো হয়েছে, ও নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, এই নে আর একটা কুড়ি টাকা’, এমন কথা বলারও মানুষ নয় মনে হচ্ছে!

অধিকাংশ ঘটনাতেই আমার ভূমিকা দর্শকের। আমি কোনো সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারি না। রাস্তায় ঘাটে অনেক ঘটনাই দেখবার আধ ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পরে মনে হয়, ইস, তখন এই কথাটা তো বলা যেত!

আমি পাড়ার মস্তান নই, সমাজসেবক নই, কোনো রাজনৈতিক দলের আঞ্চলিক কমিটির সদস্যও নই। সুতরাং বাজারে একটি দোকানদারের সঙ্গে কোনো বাড়ির চাকরের কী ঝামেলা হয়েছে, সে ব্যাপারে আমার কোনো দায়িত্ব থাকার কথা নয়। মধ্যবিত্তদের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী গা বাঁচিয়ে সরে পড়াই উচিত ছিল। কিন্তু, আমি কোনো বাড়িতে চাকরের কাজ না করলেও আমারও তো একসময়ে পনেরো বছর বয়েস ছিল। ছেলেটিকে দেখে আমার সেই বয়েসের কথা মনে পড়ে। সেই বয়েসে আমিও অনেকবার বঞ্চিত হয়েছি, বিনা দোষে ভর্ৎসনা সহ্য করেছি।

একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি ছেলেটিকে বললুম, চল তো আমার সঙ্গে। দেখি দোকানদারটা কী বলে!

ডিমওয়ালি বুড়িটি বিনা আমন্ত্রণেই আমাদের পিছু নিল।

একটা চোদ্দ–পনেরো বছরের চাকর–চেহারার ছেলে আপন মনে কাঁদলে কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু একজন প্যান্ট–শার্ট পরা, সিগারেট–ফোকা, ভদ্রলোক চেহারার মানুষ তার পক্ষ নিয়ে কথা বললে অনেকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। দোকানটির সামনে কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে বেশ একটি ছোটখাটো ভিড় জমে গেল।

দোকানদারটির চেহারায় বেশ ব্যক্তিত্ব আছে। খাড়া নাক। মাথার চুল তেল– চকচকে। মুখে কোনো রকম অপরাধীর ভাব নেই। স্পষ্ট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বলুন!

আমি চোটপাট না করে নম্র ভাবেই বললুম, দেখুন, এই ছেলেটি বলছে…

–ও কি আপনার বাড়িতে কাজ করে?

–না, তা নয়, ও কাঁদছিল, সেই শুনে আমি….

আমাকে থামিয়ে দিয়ে দোকানদারটি বলল, ও বাজে কথা বলছে। আমার ঠিক মনে আছে ও পাঁচ টাকার নোট দিয়েছিল।

—কিন্তু ও আগে এক জায়গায় কুড়ি টাকার নোট…

—বুড়িটাকে ও কুড়ি টাকার নোট দেখিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু ওর কাছে যে আর একটা পাঁচ টাকার নোট ছিল না তার কোনো প্রমাণ আছে? ওরা এইরকম করে, বুঝলেন? বুড়িটাকেও ডিমের দাম দিত না, অন্য রাস্তা দিয়ে চলে যেত…

দোকানদারটির কথার ওজন আছে, চট করে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভিড়ের মধ্য থেকে দু’একজন আলগা উক্তি করল, আজকাল কারুকেই বিশ্বাস নেই!

ছেলেটি তার প্যান্টের দু’পকেট উল্টে কান্না কান্না অভিমানী গলায় বলল, এই দেখুন, আমার কাছে আর কিছু নেই, একটা শুধু কুড়ি টাকার নোট…

দোকানদারটি বলল, ও আমি বিশ্বাস করি না!

তারপর অন্য খদ্দেরকে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কী দেব?

আমি বললুম, দেখুন, আপনারও তো ভুল হতে পারে। আরও অনেক খদ্দের ছিল…

দোকানদারটি কাউন্টার থেকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, শুনুন ভাই, এইসব দোকানে সব সময় পাঁচরকম লোক আসে, আমাকে লোক চরিয়ে খেতে হয়, নজর রাখতে হয় সব দিকে। আমি জানি কে কী রকম। আপনি যে ঐ ছোঁড়াটার কথা বিশ্বাস করছেন, আপনি কোনো প্রমাণ পেয়েছেন? ও যে ঠকবাজ নয় তা আপনি কী করে বুঝলেন?

সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর দিতে পারলুম না। প্রমাণ? কিছু নেই! ছেলেটির কান্না আমার কাছে খাঁটি মনে হয়েছে, এই যা। কিন্তু যুক্তি–তর্কের মাঝখানে কান্নার প্রমাণ খাটে না। দোকানদারটির ব্যক্তিত্বের কাছে আমি পরাজিত হয়ে গেলুম।

একটা ঘটনার মধ্যে ঢুকে পড়েও এই ভাবে ব্যর্থ হয়ে যাব?

আমার অ্যাপ্রোচটাই ভুল হয়েছে। প্রথমেই এসে দোকানের কাউন্টারে প্রকাণ্ড একটা কিল মেরে আমার বলা উচিত ছিল, শালা, গরিবকে ঠকাচ্ছো? এক্ষুনি যদি ক্যাশ না ছাড়ো তো তোমার দোকান একেবারে চৌপাট করে দেব! এ পাড়ায় ব্যাবসা করছ…।

আমার চেহারা খারাপ নয়। গুণ্ডা হিসেবে অনায়াসেই চালিয়ে দেওয়া যায়। একবার ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে যদি বলা যায়, ডাকব আমার লোকজনদের? তা হলেই ভিড় একদম ভোঁ ভোঁ হয়ে যেত। আজকাল এই ধরনের কথা শুনলে কেউ আর ট্যাঁ ফোঁ করে না। পনেরো টাকা কেন, দোকানদারটি একশো পনেরো টাকা দিয়ে দিতেও রাজি হয়ে যেত!

কিন্তু আমার যে এরকম নাটক করার অভ্যেস নেই। একদিনের চেষ্টাতে পারাও যায় না।

বাজার করে ফেরার সময় পকেটে টাকা থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাকে বাড়ি থেকে দিয়েছে একশো টাকার নোট। বাজার খরচের ওপর দু’টাকা আমার নিজস্ব কমিশন সরিয়ে রেখে বাকি টাকা ফেরৎ দেবার কথা। আজ না দিয়ে কাল দিলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।

একটা কিছু তো করতে হবে। আমি পকেটে হাত দিয়ে বললুম, এই খোকা, আমি তোমাকে পনেরোটা টাকা দিয়ে দিচ্ছি। বাড়িতে গিয়ে দ্যাখো, হয়তো কিছু ভুল হয়েছে।

টাকাটা বার করতে আমার ভীষণ লজ্জা হচ্ছিল। অনেকেই আমাকে দেখছে। আমার কথায় কি একটা গর্বের সুর ফুটে উঠেছে। এরা কি আমাকে মহৎ–টহৎ কিছু ভাবছে? মাত্র তো পনেরোটা টাকা!

দোকানদারটি অন্য খদ্দেরদের সামলাতে সামলাতেও লক্ষ রাখছিল আমাদের দিকে। এবারে সে বলল, না না, ও কি কথা? আপনি টাকা দেবেন কেন? সে কোশ্চেন তো উঠছে না! আমি বলেছি, আমার ভুল হয়নি।

আমি বললুম, ঠিক আছে।

দোকানদারটি বলল, না, ঠিক থাকবে কেন? দশ–পনেরো টাকার কি আমি পরোয়া করি? এই খোকা, ঐ ভদ্রলোকের টাকা ফেরৎ দে! এই নে!

দোকানদার একটি দশ টাকা ও একটি পাঁচ টাকার নোট ছুঁড়ে দিল ছেলেটির গায়ে।

ছেলেটি সেই টাকাই কুড়িয়ে নিল, ফিরিয়ে দিল আমার টাকা। আর কথা না বাড়িয়ে আমি প্রস্থানে উদ্যত হলুম। ডিমওয়ালি বুড়ি এতক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ, এবারে সে সমস্ত মুখ ও চোখ দিয়ে মধুর ভাবে হাসল।

তখন তাকে মনে হলো খুব চেনা চেনা।

সব তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর ঘটনা কিন্তু আমরা একেবারে ভুলে যাই না। কোনো কোনো ঘটনার রেশ থেকে যায় মনের মধ্যে।

সেদিন বাজার থেকে ফেরার পথে আমি বেশ উৎফুল্ল বোধ করেছিলুম। মনে মনে আমি অন্যরকম একটি চিত্রনাট্য তৈরি করে তা নিয়ে সময় কাটিয়েছিলুম অনেকক্ষণ।

ঐ যে চোদ্দ–পনেরো বছরের চাকরটি, তাকে যদি কেউ সাহায্য না করত তা হলে ঘটনা মোড় নিতে পারত কত দিকে। ঐ ছেলেটি বাজার থেকে বাড়ি ফিরলে শুধু এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে, আর চোখে জল। ও যে বাড়িতে কাজ করে, ধরা যাক, সে বাড়িতে দাদাবাবু আর বৌদি দু’জনেই অফিসে কাজ করেন। তাঁদের একটা খোকা বা খুকি স্কুলে যায়। সকালবেলা সবাই খুব ব্যস্ত। উনুনে ভাত চাপানই আছে। ছেলেটা বাজার করে আনলেই কোনো রকমে খানিকটা মাছ– তরকারি রান্না করে, খাওয়া সেরেই কর্তা–গিন্নী দাঁড়াবেন মিনিবাসের লাইনে। এর মধ্যে যদি ছেলেটি খালি হাতে, একটা অদ্ভুত গল্প সঙ্গে নিয়ে ফেরে, তাহলে কার মেজাজ ঠিক থাকে? একে তো ব্যস্ততা, তার ওপরে মাসের চব্বিশ তারিখে পনেরো টাকার মূল্য কম নয়। হয়তো ওঁরা ঐ ছেলেটিকেই চোর বলে সন্দেহ করতেন। রাগারাগি, বকাবকি…তারপর স্বামীটি হঠাৎ ওকে মারতে উঠলে স্ত্রী বাধা দিয়ে বলতেন থাক ওসবের দরকার নেই! তুই বিদেয় হ, তোকে আর আমাদের লাগবে না, তুই এক্ষুনি চলে যা!

বিনা দোষে চুরির অপবাদ নিয়ে চাকরি গেল ছেলেটির। অপমানে, অভিমানে সে ফুঁসতে লাগল। এর পর কি সে আত্মহত্যা করবে? না। মধ্যবিত্ত বাড়ির পনেরো বছরের ছেলে পরীক্ষায় ফেল করলে আত্মহত্যা করেও ফেলতে পারে। কিন্তু ঐ বয়েসের চাকরেরা আত্মহত্যা করে না। তারা অন্য বাড়িতে কাজ খোঁজে। আজকাল চট করে ঐ রকম বয়েসের অচেনা ছেলেদের কেউ কাজ দেয় না। রেফারেন্স লাগে। ছেলেটির চোর অপবাদ ছড়িয়ে গেছে, দু’চারটে বাড়িতে ঘুরেও সে ব্যর্থ হলো। তারপর…কাছেই রেললাইন, বস্তি…সে ভিড়ে গেল সমাজবিরোধীদের দলে। ওয়াগন লুট, ছিনতাই, বোমাবাজি, খুন। একটার পর একটা। ছেলেটার নাম আগে ছিল হাবু, পরে হলো হাবু মাস্তান, দু’তিনটে পাড়া তার নাম শুনলেই কাঁপে, পুলিশ তাকে খাতির করে, নানান পার্টির দাদারা কাজেকর্মে তাকে ডাকে। সেই দোকানদারকে সে আগেই খুন করেছে, তারপর একদিন সে তার প্রাক্তন দাদাবাবুর বুকেও পাইপগান থেকে গুলি চালালো…।

এই সব কিছুই ঘটতে পারত, ঘটল না শুধু আমার মতন একজন লোকের পাঁচ মিনিট সময় খরচের জন্য। ছেলেটি সুস্থভাবে, ঠিকঠাক বাজার করে বাড়ি ফিরেছে। এ জন্য আমার যদি মনে মনে একটু আহ্লাদ হয়, তাতে খুব দোষ দেওয়া যায় না।

আবার এ ঘটনাটা এমনও নয় যা নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের কাছে গল্প করা যায়।

কয়েকদিন পর আমি আবার ঐ গলি দিয়ে বাজার করতে যাচ্ছি, সেই ডিমওয়ালি বুড়ি হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, ও বাবা, শোনো, শোনো!

আমি কাছে যেতেই সে খুব অন্তরঙ্গ সুরে বলল, সেদিনকার সেই ছোঁড়াটা, যাকে তুমি টাকা দিতে চাচ্ছিলে, সে তো আর একদিনও এলো না! তোমার মনে আছে সেদিনকার কথা?

হ্যাঁ, ঘটনাটি আমার পুরোই মনে আছে, ছেলেটির মুখও মনে আছে। কিন্তু ছেলেটি এ পথে আর আসেনি, তাতে কী হয়েছে! এই রাস্তায় দোকানদারের সঙ্গে ঝঞ্ঝাট হয়েছিল, তাই সে হয়তো অন্য রাস্তা দিয়ে বাজারে ঢোকে। দোকানদারটিকে ভয় পাওয়াও তার পক্ষে স্বাভাবিক।

কিন্তু বুড়িটি এর পর যা বলল, তাতে আমি রীতিমতন আঘাত পেলুম। ঠিক অভিযোগের সুরে নয়, খানিকটা যেন নিজের নিয়তিকে দোষ দেবার ‘ মতন গলায় বুড়িটি বলল, ছোঁড়াটা আমার ডিমের দাম দিয়ে গেল না? সেদিন গোলে–গণ্ডগোলে কী হলো, সে ছেলে কোথায় চলে গেল, কিছুই বুঝলুম না।

—অ্যা? তোমার দাম দেয়নি? সে তো সব টাকা ফেরৎ পেয়েছিল!

—না বাবা, আমি ভাবলুম পরে বুঝি এসে দিয়ে যাবে। কিন্তু আর তো আসে নি।

আমার মুখখানা নিশ্চয়ই ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। মানুষ চিনতে আমার ভুল হতে পারে, তা বলে কি আমি কান্নাও চিনি না? ঐ ছেলেটির কান্নাটা নকল ছিল? দোকানদারের কথা ঠিক, ঐ ছেলেটা একটা পেশাদার ঠক?–

নিজের কাছেই নিজে বোকা বনতে কেউ সহজে চায় না। আমি ঐ ছেলেটাকে বেনিফিট অব ডাউট দিতে রাজি হলুম। হয়তো ওর অসুখ–বিসুখ করেছে। কিংবা ওর বাবুরা ওকে আর বাজারে পাঠাচ্ছে না। পরে একদিন এসে নিশ্চয়ই ডিমের দাম দিয়ে যাবে। অতি বড় প্রতারকও এই রকম একজন বুড়ির টাকা মারতে চাইবে না।

বুড়িটির ঝুড়িতে মোট বারো–চোদ্দটি ডিম। এই কটা ডিম বেচে তার ক’পয়সাই বা লাভ হয়? এর মধ্যেও যদি ছ’টা ডিমের দাম বাকি পড়ে তাহলে তো তার ক্যাপিটালেই আরো শর্ট পড়ে যায়। বাহাত্তর বছরের এক বুড়ি তো আর সাধ করে ডিম বিক্রি করতে আসে না! নিশ্চয়ই এই ভাবেই তার সংসার চলে। ক্যাপিটাল বেশি থাকলে সে আরো বেশি ডিম কিনে আনতে পারত। যে মোট বারো চোদ্দটা ডিম বিক্রি করে, সে ছ’টা ডিমের দাম পায়নি…।

এবারেই প্রথমে বুড়িটিকে আমি লক্ষ করলুম। রোগা, শুকনো চেহারা হলেও তার মুখের মধ্যে এমন একটা ভাব আছে, যার জন্য তাকে দেখতে ভালো লাগে। সারল্য আর মমতা মিশে আছে। গলার আওয়াজটি শ্রুতিমধুর। তার পরনের নরুণ পাড় সাদা শাড়িটি খুব ময়লা নয়। এই বুড়িটি রয়েছে দারিদ্র্য–সীমার অনেক নিচে, তবু তার চেহারা ও ব্যবহারের স্নিগ্ধতা দেখে অবাক লাগে।

সেদিন সেই ছেলেটিকে আমি পনেরো টাকা দিতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু আসল ক্ষতি তো হয়েছে এই বুড়িটিরই। ছটা ডিমের দাম সাড়ে চার টাকা, সেটা আমি অনায়াসে দিয়ে দিতে পারি।

কিন্তু এই জায়গায় আমি একটু কার্পণ্য করলুম।

হঠাৎ আমার মনে হলো, এই বুড়িটির ক্ষতিপূরণ একা আমাকেই করতে হবে কেন! বাজারে কি আর লোক নেই? আমিও তো গৌরী সেনের বংশধর নই। আমাকেও দু’টাকা পাঁচটাকার জন্য অনেক সময় অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। সেদিন না হয় ছেলেটির কান্না শুনে ঝোঁকের মাথা …

পকেট থেকে দু’টাকার একটা লাল নোট বার করে এগিয়ে দিয়ে বললুম এই নাও, তুমি এটা রাখো।

বুড়ি অবাক হয়ে বলল, কেন? এটা কিসের?

–এমনিই তুমি নাও না, রাখো।

বুড়ি হঠাৎ আঁচল দিয়ে তার চোখ চাপা দিল। সেইরকম ভাবেই রইল অনেকক্ষণ। আমি অপ্রস্তুত।

বুড়ির এক পাশে বসে আছে একটি কিশোরী, সে বেগুন ও চালকুমড়ো বিক্রি করে। আরেক পাশে এক প্রৌঢ় সবজিওয়ালা। এরা আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। আগের দিনের কথাও বোধহয় এরা জানে।

কিশোরীটি বুড়িকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ও দিদিমা, নাও না, বাবু তোমাকে এমনি দুটো টাকা দিচ্ছেন।

সবজিওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল, ও নেবে না! ও নেবে না!

আমি ততক্ষণে লজ্জা পেয়ে টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছি। ঐ যে কিশোরী মেয়েটি দিদিমা বলে ডাকল, তাতেই আমার মাথায় একটা ঝঙ্কার লেগেছে। আমার নিজের দিদিমাও অনেকটা এরকমই দেখতে ছিলেন। খুব মিল আছে। দিদিমার কথা মনে পড়তেই একটু কষ্ট অনুভব করলুম। শেষ একটা বছর দিদিমার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, তখন আমি ঘুরছিলুম কাঁহা কাঁহা সাহেবী মুল্লুকে।

চোখ থেকে আঁচল নামিয়ে বৃষ্টির পর রোদ্দুরের মতন ঝিকমিকিয়ে হেসে বুড়ি বলল, তুমি দিতে চেয়েছ…সেই যথেষ্ট—বেঁচে থাক বাবা…আমার কোনো রকমে চলে যায়…

এবারে এখান থেকে চলে যাবার জন্য আমি ব্যস্ত হতেই বুড়ি বলল, ডিম নেবে না? তোমার ডিম লাগবে না?

মাছ আর তরিতরকারিই আমি কিনি বাজার থেকে। ডিম একজন লোক বাড়িতে এসে দিয়ে যায় নিয়মিত। বাজার থেকে ডিম নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা আছে, ভেঙেটেঙে যেতে পারে।

তবু বুড়িটির কথা শুনে বললুম, হ্যাঁ–হ্যাঁ নেব। ছ’টা ডিম রেখে দাও, ফেরার সময় নিয়ে যাচ্ছি।

পাশের কিশোরীটি বলল, আমিও এক কিলো বেগুন রেখে দিচ্ছি!

কলকাতার বাজারে দু’রকম দোকানদার আছে। এক যারা উঁচু বেদির ওপরে বসে। এদের ফুলকপি বেশি সাদা, বেগুন বেশি চকচকে, লাউ–কুমড়ো বেশি নধর হয়। সব জিনিসের দামও কিছু বেশি। এরা শীতকালে পটল, শরৎকালে কাঁচা আম পর্যন্ত রাখে। বেদির ওপর যেসব মাছওয়ালা বসে, তারা বিক্রি করে কাটা পোনা, ফ্রাইয়ের ভেটকি, চিতলপেটি, অসময়ের ইলিশ। এরা সব বনেদি দোকানদার।

আর কিছু মাছওয়ালা, তরকারিওয়ালা বসে মাটিতে। এরা বিক্রি করে পার্শে– ট্যাংরা, কুচো চিংড়ি, তেলাপিয়া, গুরজালি ইত্যাদি, আর শাক–সবজী– তরকারিগুলো প্রত্যেকদিন গ্রাম থেকে আনা। অনেক গ্রামের লোকই রোজ এইসব জিনিস বাজারে নিয়ে বসে, ভোরের ট্রেনে এসে দুপুরের ট্রেনে ফিরে যায়।

আমি এই দ্বিতীয় শ্রেণীর দোকান থেকেই প্রায় সব কিছু কিনি। কিছুটা সস্তার জন্য তো বটেই, তাছাড়া টাটকা জিনিসের লোভেও। মাটিতে চট পেতে যে একটি মাত্র লাউ নিয়ে বসে, আমার ভাবতে ভালো লাগে যে সে ঐ লাউটি আজই তার গ্রামের বাড়ির মাচা থেকে ছিঁড়ে এনেছে, একটা এবড়ো–খেবড়ো চেহারার রংচটা বেগুন দেখলে মনে হয়, ওগুলো আজই কোনো আনাড়ি চাষীর খেত থেকে তুলে আনা। এসব কিছুর মধ্যে পেস্টিসাইডের বিষ নেই। মাছের বেলাতেও তাই। বড় বড় বাগদা–গলদা চিংড়ি যতই সুস্বাদু হোক, তার থেকে জল–রঙা, জ্যান্ত, ছটছট করে লাফানো ছোট চিংড়ি আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয়। বিরাট বিরাট মৃত পোনা মাছের কাটা অংশের চেয়ে এখনো কানকো নাড়ছে এমন ছোট কাৎলা আমার পছন্দ।

এই সব ছোট দোকানদাররা অনেকেই আমাকে চেনে। এদের সঙ্গে কথা বলে আমি বেশ একটা আরাম বোধ করি। কলকাতায় বসে এইভাবে গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ হয়। নাগরিক জীবনের নানান প্যাঁচ–পোঁচের মধ্যে দিন কাটাতে হলেও আজও আমরা সারল্যের জন্য কাঙাল। এই সব গ্রামের নারী– পুরুষরা অনেকেই এখনো সত্যিই বেশ সরল। কত সহজ এদের মন জয় করা। আমি কোনো দিন এদের সঙ্গে দরাদরি করি না বলে এরা আমাকে সব কিছু ন্যায্য দামে দেয়। কোনো জিনিসের হঠাৎ দাম বেড়ে গেলে ওরা নিজেরাই আফশোষ করে। আমি একটা গর্ভমোচা কিনতে চাইলে তার গায়ে দুঃখিত হাত বুলিয়ে প্রৌঢ় বিক্রেতাটি বলে, একটু বেশি দাম পড়ে যাচ্ছে বাবু, কী করব, যা দিনকাল!

এরা কেউ জেনেশুনে কক্ষনো আমাকে খারাপ জিনিস দেয় না, তার কারণ একটাই। আমি কোনো দিন এদের জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি, বাছাবাছি করি না। আমি বলি, ওগো, তুমি নিজের হাতে বেছে দাও তো, তুমি দিলে কী আর খারাপ জিনিস দেবে? ঐ যে কিশোরী মেয়েটি আমার জন্য এক কিলো বেগুন রাখবে বলল, ওর কাছেই আমি আগে আর একদিন বেগুন কেনার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম, ও বলেছিল, আজ তুমি অন্য দোকান থেকে নাও, এ বেগুনগুলো তেমন ভালো না, পোকা লেগে গেছে।

এইসব লোকজনদের সঙ্গে টুকিটাকি কথা, গ্রামের এক ঝলক জীবনের স্বাদ, দর ওঠা–নামার দুঃখ–সুখ, এইসব কিছু মিলিয়ে বাজার করাটা আমার কাছে সকালবেলার বেশ একটা আকর্ষণীয় কাজ, মোটেই বিরক্তিকর লাগে না একদিনও।

সেদিন সেই ছেলেটির সমস্যার মধ্যে মাথা গলিয়ে আমি বেশ একটা আত্মপ্রসাদ বোধ করেছিলুম কিন্তু আজ আমি বেশ লজ্জিত ও অপরাধ বোধ নিয়ে ফিরলুম বাড়িতে। বুড়িটিকে আমি দুটো টাকা দিতে গিয়েছিলুম কেন? দান নিতে না চেয়ে গ্রামের গরিব বুড়িটি যে মহত্ত্ব দেখাল সেই তুলনায় পুরো সাড়ে চারটাকা দিতে না চেয়ে আমি কি অনেক ছোট হয়ে যাইনি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *