৩
ঈদের দিন রফিকদের বাড়িতে আমার প্রত্যেক বছর নেমন্তন্ন থাকে। ঈদের নেমন্তন্নের বৈশিষ্ট্য হলো, এর জন্য কার্ড ছাপানো হয় না, বাড়িতে এসে মুখে নেমন্তন্নও করে যায় না। নিজে থেকেই ঈদ মুবারক জানাতে যেতে হয়। হিন্দুদের বিজয়া দশমীর মতন।
রফিক আমার ইস্কুলের বন্ধু। পাছে আমি ঈদের দিনটা ভুলে যাই, তাই রফিক আগের দিন টেলিফোন করে মনে করিয়ে দেয়, কাল আসছিস তো?
হিন্দুরা অনেকেই মুসলমানদের পরবের দিনগুলো ঠিক খেয়াল করে না। ক্যালেণ্ডারে বা খবরের কাগজে হিন্দুদের পুজো–পার্বণের দিনগুলিই প্রাধান্য পায় এদেশে। আমার অবশ্য ভুলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। রফিকদের বাড়ির খাওয়া–দাওয়া একেবারে বিশ্ববিখ্যাত বলা যায়। ওরকম বিরিয়ানি আমি আর কোথাও খাইনি। অত বড় বড় মাংসের খণ্ড আর অত খাঁটি ঘি যে ওরা কোথায় পায় কে জানে? আর বিরিয়ানির সঙ্গে ওরা টক টক ঝাল ঝাল একটা পানীয় দেয়। যার নাম বুরহানি, সেটা একেবারে অপূর্ব! সেটাই তো আমি দশ বারো গেলাশ মেরে দিই!
রফিকরা বেশ ধনী, রীতিমতন খানদান আছে। এক সময়ে ওদের মুর্শিদাবাদে জমিদারি ছিল, এখনও জমিজমা কম নয়। তা ছাড়া উত্তরবঙ্গে ওদের ছিল দু’খানা চা–বাগান। কলকাতায় পার্ক সার্কাস, বেকবাগান অঞ্চলে খান চারেক বাড়ি। রফিকের মা ঊনপঞ্চাশটি কুকুর পোষেন। সেই কুকুরের জন্যই মাসিক খরচ পাঁচ হাজার টাকা। টাকার অঙ্কটা আমি আন্দাজে বললুম, এর অনেক বেশিও হতে পারে।
রফিককে আমি ঈর্ষা করি।
আমার গায়ের রং ঠিক ছাতার মতন নয়, তার চেয়ে একটু পরিষ্কার, চেহারাটা লম্বা ধ্যাড়েঙ্গা। রফিক গৌর বর্ণ, অ্যাথলীটদের মতন স্বাস্থ্য। সে জন্য নয়।
রফিকদের বাড়িতে তিনখানা গাড়ি আর টাকাকড়ির অভাববোধ কাকে বলে তা ওরা জানে না। আর আমরা খুব গরিব না হলেও টানাটানির সংসার, মাসের শেষে কাটা পোনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বড় জোর কুচো চিংড়ি বা পমফ্রেট, তেলাপিয়া। সে জন্যও নয়।
রফিক ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, আমি ঠিক ফেল–করা না হলেও গড়িয়ে গড়িয়ে পাশ
করার দলে। সে জন্যও নয়।
আমি রফিককে ঈর্ষা করি, তার কারণ রফিকের ইচ্ছে এবং অনিচ্ছের প্রবল মূল্য আছে।
উদাহরণ দিচ্ছি!
রফিক কোনোদিন ভোর পাঁচটায় ওঠে, কোনোদিন বেলা এগারোটায়। এক একদিন রফিক সারাদিন বাড়ি থেকে বেরোয় না, আবার কখনো কখনো রফিক আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে লাগাতার আড্ডা মারে।
রফিক এমনিতে খুব পড়ুয়া ছেলে। বই সম্পর্কে বাছ–বিচার নেই। উইপোকার মতন যে কোনো বই পেলেই এফোঁড়–ওফোঁড় করে দেয়। এত বই পাওয়া যাবে কোথায়? রফিক আর আমি দু’জনেই ন্যাশনাল লাইব্রেরির মেম্বার, কিন্তু রফিক একবার ওর ন্যাশনাল লাইব্রেরির দু’খানা বই হারিয়ে ফেলল। তারপর আর অনেকদিন যায় না, কিন্তু সেজন্য আফশোষ করে। আমি ওকে অনেকবার বলেছি, চল আমার সঙ্গে, ওখানকার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে আমার চেনা আছে, একটা কিছু সহজ ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রফিকের তো বইয়ের দাম দিতে আপত্তি নেই, কিন্তু কারুর সামনে দাঁড়িয়ে যে বই হারানোর কথা বলতে হবে, ওটাতেই ওর লজ্জা।
একদিন রফিক আমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করল। সনির্বন্ধ অনুরোধ। আমি যেন রফিকের বাড়িতে সকাল দশটার সময় যাই। তারপর ওদের গাড়িতে যাওয়া যাবে ন্যাশনাল লাইব্রেরি। আমি যথারীতি দশটার সময় গিয়ে শুনি রফিক তখনও ঘুমোচ্ছে। সারা কলকাতা তখন ব্যতিব্যস্ত, ট্রামে–বাসে বাদুড় ঝোলা ভিড়। জীবনের নানা ক্ষেত্রে সবাই যখন জীবিকার সন্ধানে আধ–উন্মত্ত, তখন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে আছে রফিক।
উঠল পৌনে এগারোটার সময়। মুখ চোখ না ধুয়েই বসবার ঘরে এসে আমাকে বলল, নীলু তুই এসে গেছিস? ফাইন! একটু বোস, আমরা একসঙ্গে নাস্তা খাব। আজ আর ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাওয়া হবে না।
–কেন যাবি না কেন?
–ইচ্ছা করছে না!
এই যে রফিক বলল, ইচ্ছা করছে না, এটাই ফাইনাল। কোনো মতেই আর ওর মত বদল করা যাবে না। রফিকের দ্বিধাহীন পরিচ্ছন্ন মুখ, পরিপূর্ণ চোখের দৃষ্টি। ওর ইচ্ছা করছে না, এটাই এখন সবচেয়ে বড় যুক্তি।
আবার এই রফিকই রাত বারোটায় আমার বাড়িতে এসে বলে, নালু চটপট তৈরি হয়ে নে। আমরা জামসেদপুরে যাচ্ছি।
আমাকে অবাক হবারও সুযোগ দেয় না। আমার হ্যাঁ কিংবা না শোনার আগেই ও বলে, কোনো অসুবিধা তো নেই। গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, ভোরের মধ্যেই পৌঁছে যাব। দেখিস, ছ’টার আগেই—।
যেন জামসেদপুরে পৌঁছতে সাতটা বেজে গেলেই আমার আপত্তি, ছ’টার মধ্যে পৌঁছলে তো কোনো কথাই নেই।
–কেন, জামসেদপুরে যাবে কেন?
—ইচ্ছা করছে।
—হঠাৎ এ রকম ইচ্ছে হলো কেন?
–কাল দশটায় ওখানে ওয়েস্ট ইণ্ডিজের সঙ্গে খেলা আছে। দেখে আসি চল।
—আর পাঁচদিন বাদেই তো ওয়েস্ট ইণ্ডিজ কলকাতায় টেস্ট খেলবে। জামসেদপুরে যাবার দরকার কী?
—খুব ইচ্ছা করছে!
সেই পরিচ্ছন্ন মুখ, পরিপূর্ণ চোখের দৃষ্টি। ইচ্ছা করছে যখন তখন যেতে তো হবেই।
শুধু যাওয়া–আসার ব্যাপারেই নয়, রফিকের আড্ডা, তাশ খেলা, বই পড়া, বন্ধুত্ব সব বিষয়েই ওর ইচ্ছা–অনিচ্ছার স্পষ্ট ভাগ করা আছে।
অথচ আমি কত ইচ্ছে বিসর্জন দিয়েছি ভাগীরথীর জলে। কত অনিচ্ছের দায়িত্বের বোঝা পিঠে নিয়ে ঘুরেছি।
কলেজ জীবনের শেষ দিকে রফিক আর আমি একই মেয়ের প্রেমে পড়ি। তাই নিয়ে আমাদের দু’জনের সম্পর্কে খানিকটা চিড় ধরেছিল, তা মাত্র কিছু দিনের জন্য। তারপর আমরা উদারতার খেলা খেলতে শুরু করি। রফিক যেন চরম আত্মত্যাগ করে মেয়েটিকে আমার হাতেই তুলে দিতে চেয়ে নিজে একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগল। আমিই বা কম উদার হবো কেন? আমি রফিককে বলেছিলুম, রিঙ্কি তোকেই বেশি পছন্দ করে, আমি আমের আঁটি হয়ে মাঝখানে থাকতে চাই না। রফিক এ কথার প্রতিবাদ করল। আমি আরো জোরে প্রতিবাদ জানালুম।
এর ফলে হলো কী, আমরা দু’জনেই রিঙ্কির থেকে দূরে সরে গিয়ে পরস্পরের কাছাকাছি চলে এলুম আবার। এখন রিস্কি আমাদের দু’জনের কারুর সঙ্গে কথা বলে না। আমি আর রফিক আমাদের সেই সাময়িক দুর্বলতা নিয়ে হাসাহাসি করি প্রায়ই
রফিকদের পরিবারে বাল্যবিবাহের চল আছে। এ বাড়ির পুরুষদের কুড়ি একুশ বছরে বিয়ে হয়ে যায়। ওদের যৌথ সংসার, রফিকের অনেক খুড়তুতো– জ্যাঠতুতো ভাই থাকলেও রফিক তার পিতার একমাত্র পুরুষ–সন্তান। সেইজন্যই রফিকের বিয়ের জন্য অনেক দিন থেকেই চাপ দেওয়া হচ্ছে। রফিকের আম্মা অতি শান্ত প্রকৃতির মহিলা। তিনি তাঁর পোষ্য কুকুরদের নিয়েই সারাদিনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দেন। রফিকের আব্বা অতি জাঁদরেল। এ বাড়িতে তাঁর দোর্দণ্ড প্রতাপ। তিনি রফিকের শাদির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু রফিকের এক উত্তর, ইচ্ছা করছে না! ব্যাস, এর ওপর আর কথা নেই। সাতাশ বছর বয়েস, এ পর্যন্ত রফিক তার অনিচ্ছা বজায় রেখেছে।
রফিকের মন দুর্বল করার জন্য ওর আম্মা প্রায়ই দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের সুন্দরী মেয়েদের নেমন্তন্ন করেন এবাড়িতে। ঈদের দিনেও তাদের দেখা যায়। ঈদের দিনে এ বাড়িতে আসার জন্য সেটাও আমার একটা অতিরিক্ত আকর্ষণ। কিংবা খাদ্যটা গৌণ। এটাই প্রধান।
বনেদি বাড়ির প্রথা অনুযায়ী বাইরের লোকদের পক্ষে ওবাড়ির মহিলাদের সঙ্গে সহজে মেলামেশার সুযোগ নেই। কিন্তু পর্দা প্রথাও চালু নেই। আমরা রফিকের বন্ধুরা এসে বসি তেতলায় রফিকের নিজস্ব ঘরে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে কোনো কোনো যুবতীকে দেখতে পাই। এক একজনকে দেখলে যেন গলার কাছে দম বন্ধ হয়ে আসে। এই সব সাঙ্ঘাতিক সুন্দরীরা বছরের অন্য সময় কোথায় থাকে? আর কোনো সময়ে তো দেখতে পাই না। এই সব সুন্দরীদের দেখেও রফিকের মতিভ্রম হয় না?
গতবছর এই দিনে আমি রফিকের ফুফার মেয়ে সম্পর্কে একটু বেশি উৎসাহ প্রকাশ করে ফেলেছিলুম। মেয়েটির নাম সেলিনা, ডাকনাম রোমি। ঐ নামেই ওকে অনেকে ডাকছিল। ওর বয়েস তেইশ চব্বিশের বেশি নয়।, বেশ লম্বা, শরীরের গড়নটি ছবি–ছবি মতন। এ বাড়িতে অনেক মহিলারই দুধে–আলতা রং। সেই তুলনায় রোমির রং একটু চাপা। সবাই রোমিকে সুন্দরী বলবে, কিন্তু ওর চোখ দুটির যেন তুলনাই হয় না। এত বড় বড় চোখের পল্লব যে কোনো মেয়ের হয় তা আমি না দেখলে বিশ্বাস করতুম না। ওর চোখের পল্লব যেন কোনো ফুলের সূক্ষ্ম পাপড়ি। অবশ্য কালো রঙের ফুল আমি কখনো দেখিনি।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আমি রোমির মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলুম। সাদা সিল্কের শাড়ি পরা। শরীরে কোনো অলঙ্কার ছিল কি না লক্ষ করিনি। রোমি অকারণ লজ্জাবতী লতা নয়, আমাকে দেখেই সে শরীর কুঁকড়ে মুখ ফিরিয়ে নিল না। স্পষ্ট ভাবে চেয়ে রইল। সে দৃষ্টিতে কি খানিকটা কৌতুক চাঞ্চল্য ছিল!
কয়েক মুহূর্ত মাত্র, আমিও থমকে দাঁড়াইনি, রোমিও গতিবেগ সংযত করেনি, সে নেমে গেল, আমি উঠে এলুম। বুকটা একবার কেঁপে উঠেছিল ঠিকই।
ওপরে এসে আমি রফিককে জিজ্ঞেস করেছিলুম, রোমি কি বাঙালি? কলকাতায় থাকে? ওকে দেখলে মনে হয় হিমালয়ের কাছাকাছি কোথাও থাকে।
রফিক হেসে উঠে বলেছিল, তুই কি রোমির প্রেমে পড়ে গেছিস নাকি? তা হলে বেশ মজা হবে!
মজা? এই প্রসঙ্গে কি মজা কথাটা খাটে? রফিকের এই হাল্কামি আমার পছন্দ হয়নি।
রফিক বলেছিল, কেন বলছি জানিস? রোমি একটু পাগলাটে ধরনের মেয়ে, ঝুঁকি নিতে খুব ভালোবাসে। বছর চারেক আগে, খুব বুড়ো আর মোটামুটিভাবে গরিব এক সেতারের ওস্তাদজীকে ও বিয়ে করার জন্যে ক্ষেপে উঠেছিল। তারপর আর একবার ট্রেনে বম্বে যাবার সময় রোমি টপ করে নেমে পড়েছিল জলগাও স্টেশনে। রাত তখন তিনটে। পরের স্টেশনে গিয়ে রোমির খোঁজ পড়ল, তারপর সে কি কাণ্ড! হা–হা–হা–হা! খুব মজা হয়েছিল!
আমি এক দৃষ্টে চেয়েছিলাম রফিকের দিকে। আরো কিছু শুনতে চাইছিলাম।
—তুই যদি ওকে প্রেম নিবেদন করিস—আমি বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি, প্রথমে চিঠি লিখবি, তারপর দেখা করবি—তুই তো একটা লক্ষ্মীছাড়া বাউণ্ডুলে, তোকে রোমির পছন্দ হয়ে যাবে, টপ করে বিয়ে করে ফেলবি, তারপর দু’জনেই দারুণ বিপদে পড়ে নাস্তানাবুদ হবি, বেশ মজা হবে! হা–হা–হা!
মেজাজ ভালো থাকলে রফিক দম ফাটিয়ে হাসতে পারে যখন–তখন। ওর হাসির ধাক্কায় মনে হয় যেন দরজা–জানলা কাঁপে।
সিঁড়িতে এক রমণীর সঙ্গে একবারমাত্র দেখা হবার পরেই তার সঙ্গে প্রেম, বিয়ের প্রস্তাব, বিয়ে, তারপর দাম্পত্য জীবনের ব্যাপারস্যাপার…এতখানি ভেবে ফেলার মতন পরিকল্পনাবাজ আমি নই।
পাহাড়ের কোলের কাছে মারুমাঢ় নামে এক অপরূপ ডাক–বাংলোয় গিয়েছিলুম। তখন বিকেল প্রায় শেষ, আলো নরম হয়ে এসেছিল, চতুর্দিকে জঙ্গল, সেটিকে প্রায় ঋষিহীন তপোবন বলা যায়, দুটি হরিণ উঁকি দিয়ে আমাদের দেখে আবার উধাও হয়ে গেল। যাদের সঙ্গে গিয়েছিলুম, তাঁদের হাতে একটুও সময় ছিল না। সেই বাংলোতে আসা হয়েছিল শুধু একজনের জরুরি বাথরুম ব্যবহারের জন্য। এমন একটা চমৎকার বাংলো শুধু ঐটুকু সময়ে কি উপভোগ করা যায়?
জিপ গাড়িতে ওঠার পর আমি আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে সেই বাংলোটির দিকে মনে মনে বলছিলুম, আবার আসতে হবে, আবার দেখা হবে।
রোমি সম্পর্কেও তাই। ওকে শুধু আমি আর একবার দেখতে চেয়েছিলুম। সৌন্দর্যতৃষ্ণা, আর কিছু নয়।
রফিক বলেছিল, তুই আনোয়ারুল চৌধুরীকে চিনিস? আমার এক দুলাভাইয়ের ছোট ভাই। ডাক্তার, তুই দেখেছিস, এ বাড়িতে একসময় প্রায়ই আসত, একটা চোখ একটু ট্যারা মতন।
আমার মনে পড়ল, আমি ডাক্তার আনোয়ারুল চৌধুরীকে দেখেছি। একটু আলাপও হয়েছিল।
—উনি কাকে বিয়ে করেছেন জানিস? কলেজে আমাদের হিস্ট্রি পড়াতেন মনোমোহন চক্রবর্তী? তাঁর মেয়েকে। প্রেমের ব্যাপার। মনোমোহন চক্রবর্তী গোঁড়া বামুন, এ বিয়ে অ্যাকসেপ্ট করেননি। মেয়ে–জামাইকে বাড়িতে ঢুকতে দেন না। ওদিকে আনোয়ারুল সাহেবের বাবাও প্রায় এক মোল্লা, তিনিও চটে লাল। ভেবেছিলেন ছেলে ডাক্তার, বেশ ভালো পাত্র, একটা বেশ পয়সাওয়ালা বাড়ির মেয়েকে বউ করে আনবেন। সেটা ফস্কে গেল। গরিব মাস্টারের মেয়ে, তাও আবার হিন্দু। ব্যস, সে বাড়িতেও ঢোকা বন্ধু। ওরা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল টালিগঞ্জে। যেই জানাজানি হয়ে গেল যে মুসলমানের ছেলে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে এনেছে, অমনি বাড়িওয়ালা নোটিশ দিল। এখন আর কোথাও বাড়ি পায় না। খুব গণ্ডগোলে পড়েছে, দারুণ মজা চলছে। হা–হা–হা!
রফিকের মজা–বোধটা সত্যিই অত্যদ্ভুত!
গত বছর সেই রোমিকে দেখার পর মাসখানেক বাদে রফিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কী রে, তোকে যে সেলিনার ঠিকানা দিয়েছিলুম, তুই চিঠি লিখেছিস? দেখা করেছিলি?
আমি মাথা নেড়েছিলুম দু’দিকে।
–কেন রে, আনোয়ারুল সাহেবের কেসটা শুনে তুই ঘাবড়ে গেলি নাকি?
—যার সঙ্গে আলাপ হয়নি, তাকে চিঠি লেখা যায়? ওদের বাড়িতেই বা হুট করে যাব কী করে?
–তোকে চেনে! আমি তোর কথা রোমিকে বলেছি।
— অ্যাঁ? কী বলেছিস?
–রোমিকে বলেছি যে তোর একটি নীরব প্রেমিক আছে, দূর থেকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তোর ঘরের জানলা খুললে হয়তো দেখতে পাবি ল্যাম্পপোস্টে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বলতে বলতে রফিক অট্টহাসি হেসে উঠেছিল। আমি মনে মনে বলেছিলুম, ঠিক আছে, তোমারও পাওনা রইল। আমারও সুযোগ আসবে।
তারপর আমি রোমিকে মুছে ফেললুম মন থেকে।
এ বছরেও একটি আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। রফিকের বাড়িতে এসে ওর জ্যাঠতুতো দাদা জাভেদের সঙ্গে দেখা হলো একতলায়। আরো লোকজন রয়েছে অনেক। কিন্তু রফিক সেখানে নেই। সাধারণত অতিথিদের স্বাগত সম্ভাষণ জানাবার জন্য রফিক নিচেই থাকে।
জাভেদ আমাকে বলল, তিনতলায় চলে যাও। রফিক ঘরেই আছে। এখনো নিচে নামেনি।
আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, আড়াইতলায় কাছাকাছি আসতেই ওপর থেকে নেমে এলো একজন। সাদা সিল্কের শাড়ি পরা, এক দীর্ঘদীপিতা। রোমি! গত বছর ঠিক এই একই সময়ে, খুব সম্ভবত আড়াইতলায় ঠিক এই সিঁড়িটাতে দাঁড়িয়েই আমি রোমিকে দেখেছিলাম। সেদিনও এই রকম সাদা সিল্কের শাড়ি পরে ছিল। আমার মুখের দিকে কৌতুক–চঞ্চল চোখে তাকাল। যেন টাইম মেশিনে আমরা দু’জনেই এক বছর পেছিয়ে গেছি।
এবার বোধহয় দু’একটা মুহূর্ত বেশি থেমে রইলাম। এবারে লক্ষ করলুম ওর গলায় একটা সবুজ পাথরের মালা, মাথার চুল খোলা। রোমি চোখ সরালো না, আমি লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে উঠে এলুম ওপরে।
বুক ঢিপঢিপ করছে, গত বছরের চেয়েও জোরে ঢিপ ঢিপ করছে। তাতেই বুঝতে পারলুম, যা দেখলুম, তা সন্ধেবেলার স্বপ্ন নয়।
রফিকের ঘরে এসে দেখি জানলার দিকে মুখ করে সে একটা গদি–মোড়া, হাতলওয়ালা পুরোনো আমলের চেয়ারে বসে আছে। পরনে সোনালি কাজ করা একটা মেরুন রঙের কুর্তা আর পাজামা। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।
এই রকম পোশাকে রফিককে খুব সুন্দর মানায়। কিন্তু সে যখন মুখ ফেরাল তখন তা বিমর্ষ মনে হলো। এই উৎসবের দিনে সে এ রকম একা বসে আছে?
–ঈদ মুবারক, রফিক!
ও খুব আস্তে বলল, মুবারক। তারপর মুখটা আবার ফিরিয়ে নিল জানলার দিকে।
–কী রে, আর কেউ আসেনি?
–না।
–তুই ঘরে একা একা বসে আছিস? নিচে যাসনি?
–না।
–কেন।
— ইচ্ছা করছে না!
আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওর বইয়ের আলমারির কাছে দাঁড়ালুম।
রফিকের ঘরটা বিচিত্রভাবে সাজানো। পুরোনো আমলের বাড়ি, বেশ বড় ঘর। চারখানা জানলা। একদিকের দেয়ালে রয়েছে একটি চিতাবাঘের মুণ্ডু ট্যাক্সিডার্মি করা। ওদের জলপাইগুড়ির চা বাগানে ওদেরই বংশের কেউ বাঘটি মেরেছিলেন। খুব বেশি দিন আগে নয়।
রফিক নিজে বন্দুক–পিস্তল ছোঁয় না। আসলে ওকে মানাতো একটা সাদা ঘোড়ার পিঠে, কোমরে তলোয়ার, দিগ্বিজয়ীর ভূমিকায়। ওর মেজাজ–মর্জিই অন্তত তিনটে শতাব্দী আগেকার কোনো সম্রাটপুত্রের মতন।
অন্য দিকের দেয়ালে একটি বিশাল ছবি। মদিগ্লিয়ানির আঁকা এক শায়িতা সুন্দরীর প্রিন্ট।
এ ছাড়া এলোমেলো ভাবে ছড়ানো অজস্র বই। রফিক এক সঙ্গে তিন চারখানা বই পড়তে শুরু করে। সেগুলো সব ওল্টানো থাকে এদিক ওদিক। সেই সব বইতে কেউ হাত দিলে রফিক চটে যায়। কিন্তু ওর ঘরের অন্য বই, যা ওর পড়া হয়ে গেছে, সেগুলো চাইলে ও অনায়াসে দিয়ে দেবে, কোনোদিন ফেরৎ চাইবে না।
রফিক এখন গম্ভীর, ওর সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই, শুধু হ্যাঁ, না উত্তর দেবে। অন্য বন্ধুরা কেউ আসেনি কেন এখনো? আমি তো সকাল থেকেই ছটফট করছিলুম। রোমিকে দেখার সুপ্ত বাসনাই কি আমাকে এত তাড়াতাড়ি টেনে এনেছে? মন অনেক কিছু চায়, যা মনই জানে না।
হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে রফিক বলল, নীলু, আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তুই আমাকে একটা ফ্ল্যাট খুঁজে দিতে পারবি?
আমি ওর দিকে চুপ করে চেয়ে রইলুম। ও আরো কিছু বলুক। একটা চমকপ্রদ খবর শোনালেই যে আমাকে উত্তেজিত হয়ে উঠতে হবে, তার কোনো মানে নেই।
–তোর তো অনেক চেনা, দ্যাখ না খোঁজ করে, দু’কামরার একটা ছোট ফ্ল্যাট হলেই চলবে, মোটামুটি ভালো পাড়ায়, যোধপুর পার্ক বা সল্ট লেক হলেই ভালো—দেখবি একটু?
–না।
–তুই আমার জন্য ফ্ল্যাট খুঁজবি না? কেন?
–আমি কোথায় ফ্ল্যাট খুঁজব? বাড়ি পাওয়া এখন খুবই শক্ত শুনেছি…তারপর আমি যদিও বা কষ্ট করে কোনো ফ্ল্যাট খুঁজে বার করি, তারপর তুই বলবি, নাঃ যাব না, ইচ্ছা করছে না!
যেন আমার জন্যই রফিক কষ্ট করে একটুখানি হাসল। তারপর বলল, না রে, এবাড়িতে আমি আর থাকব না ঠিক করেছি। ফ্ল্যাট না পেলে হোটেলে চলে যাব!
—ঈদের দিনে এসব কী কথাবার্তা—কার সঙ্গে ঝগড়া হলো!
–তুই বুঝতে পারবি না, নীলু, তোর তো অন্যরকম জীবন! আমাদের এই এত বড় বাড়ি, এতরকমের লোক, যারই আমার থেকে একটু বয়েস বেশি, সে–ই আমার ওপর একটা মতামত চাপিয়ে দিতে চায়! আমাদের দেশে এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার, বয়েস বেশি হলেই যেন দাদাগিরি ফলাবার অটোমেটিক অধিকার এসে যায়! তোর তো ওপরে দাদা–টাদা কেউ নেই!
–তোরও তো আপন বড় ভাই কেউ নেই!
—তাতেও কোনো সুবিধে নেই। মাসি–পিসি, কাকা–টাকারাও দাদাগিরি ফলাতে আসে। অধিকারটা লিগ্যাল নয়, মরাল। কিন্তু আমার জীবনটা হচ্ছে আমারই জীবন। আমি কেন অন্যের কথা অনুযায়ী চলব?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, ভাই রফিক, আমাকে তো বাধ্য হয়েই অন্য অনেকের মতামত মেনে নিতে হয় অনেক সময়। এমনকি আমাদের বাড়িওয়ালা পর্যন্ত ধমক দিয়ে বলে, রাত এগারোটার মধ্যে না ফিরলে সদর দরজায় তালা পড়ে যাবে। কিন্তু তোর কথা আলাদা। তোর ওপর আবার কে মতামত চাপিয়ে দেবার সাহস পাবে? বিয়ের জন্য বাড়িতে আবার খুব পেড়াপেড়ি করছে বুঝি?
–আরে আজ আমার বড় ভাই ঠারেঠোরে শাসিয়ে গেল যে আমি যদি শিগগির বিয়ে না করি তাহলে আমি নানীর সম্পত্তির ভাগ পাব না। ওদের ভয়, আমি ফট্ করে একটা হিন্দু মেয়েকে না বিয়ে করে ফেলি!
–সেরকম কোনো মেয়ের সঙ্গে তোর ভাব হয়েছে নাকি?
—আমার এক এক সময় ইচ্ছে করে কি জানিস? একটা ইহুদী মেয়েকে বিয়ে করে এনে এদের সব্বাইয়ের একেবারে পিলে চমকে দিই। হিন্দু মেয়ে যদি বা সহ্য করতে পারে, ইহুদী মেয়ে দেখলে সবাই তিড়িং তিড়িং করে লাফাবে!
– ওরে বাবা, তোর যখন ইচ্ছে হয়েছে, তা হলে তো তুই সত্যি ইহুদী মেয়েই বিয়ে করে ফেলতে পারিস! অবশ্য, কলকাতায় বসে সে–রকম ইহুদী মেয়ে টপ্ করে পাওয়া যাবে না!
—আমাকে বিষয়–সম্পত্তির ভয় দেখাচ্ছে! যেন আমি পরোয়া করি!
–এই একটা ব্যাপারে, রফিক, তোর চেয়ে আমি অনেক বেশি ভাগ্যবান। সর্বহারার কোনো কিছুই হারাবার ভয় থাকে না। আমার চোদ্দ পুরুষের যাবতীয় বিষয় সবই শূন্য আকাশের সম্পত্তি। সুতরাং তা থেকে আমাকে কেউ বঞ্চিতও করতে পারবে না।
– আই ডোন্ট এনভি ইউ, নীলু! বাপ–মায়ের কিছু টাকা পয়সা থাকা ভালো, তাতে অনেক সুবিধে হয়। চাকরি–বাকরির মতন বাজে ব্যাপার কোনোদিন আমার দ্বারা সম্ভব হতো না। টাকার চিন্তা করাটা অনর্থক সময় নষ্ট। এখন থেকে আমি সত্যিই কিছু কাজ করতে চাই। নিজের কাজ
–কী কাজ?
— আমি লিখব। সেই জন্যই আমার আলাদা একটা ফ্ল্যাট দরকার। যেখানে আমায় কেউ ডিসটার্ব করবে না। তোর মতন ঘনিষ্ঠ দু’–একজন বন্ধু ছাড়া আর কেউ সেই ঠিকানাই জানবে না।
আমি জোরে হেসে উঠলুম। তাতে ঠিক ব্যঙ্গের সুর ছিল না, খানিকটা প্রশ্রয়ই ছিল, তবু রফিক চটে গেল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুই হাসছিস? তোর ধারণা, আমি চেষ্টা করলেও কিছু লিখতে পারব না?
–সে জন্য হাসিনি রে! রফিক, তোর ফরাসি দেশে জন্মানো উচিত ছিল। সেখানে শুনেছি লেখকরা কোনো নির্জন জায়গায় চলে যায়, তাদের ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় পাহাড় কিংবা সমুদ্র, সেখানে তারা সারাদিনে একপাতা বা আধপাতা লেখে, একখানা বই শেষ করতে লাগে দু’ তিন বছর। আমাদের দেশে উঠতি লেখকদের পেটের ধান্দায় ঘুরতে হয়, কেরানিগিরি বা মাস্টারি বা খবরের কাগজের অফিসে খুচরো কোনো চাকরি জুটিয়ে নেয়, সারাদিন সেই খাটুনি। বাড়িতেও নিজস্ব কোনো ঘর নেই; কাচ্চাবাচ্চাদের চ্যাঁচামেচি, সন্ধের পর লোডশেডিং। সকালে বাজারে যেতে হয়, রেশনের দোকানে লাইন দিতে হয়, তারই মধ্যে টুকটাক লেখা চলে। এইভাবেই তো বাংলা গল্প–কবিতা লেখা চলছে।
–কেন, রবিঠাকুর শিলাইদহে গিয়ে বোটে করে ঘুরতে ঘুরতে লেখেননি!
—তুই রবীন্দ্রনাথের যুগে ফিরে যেতে চাস?
—শোন, যদি কারুকে আদর্শ করতে হয়, তাহলে সবচেয়ে যিনি বড় তাঁকেই আদর্শ করব।
—চমৎকার কথা। আমরা তাহলে দ্বিতীয় একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য প্রতীক্ষায় থাকব।
—ঠাট্টা করছিস তো, দেখিস।
–মোটেই না।
– আমি সেরকম কিছু লিখতে পারব কি না জানি না। কিন্তু চেষ্টা একবার করবই যথাসাধ্য। এ বাড়ি ছেড়ে যখন চলে যাব ঠিক করেছি।
আমি চুপ করে গেলুম। সত্যিই তো, রফিকের সঙ্গে তর্ক করার তো কোনো মানেই হয় না। রফিকের যখন ইচ্ছে হয়েছে, তখন কেউ আর ওকে ফেরাতে পারবে না।
বংশানুক্রমিক বাড়ি ছেড়ে স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া যে কী রকম অভিজ্ঞতা, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। রফিক একেবারে কষ্ট সহ্য করতে পারে না, ও কি থাকতে পারবে একা একা? হয়তো এটা ওর দু’দিনের খেয়াল।
রফিক বলল, আমি তোর সাহায্য চাই, নীলু। তুই তো সারা কলকাতা টো টো করে ঘুরে বেড়াস। তুই দ্যাখ না, যদি একটা ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিতে পারিস আমার জন্য?
— আমি যদি ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিই তাহলে তোর বাড়ির লোকেরা ভাববেন, আমিই তোকে বাড়ি ছাড়ার কু–পরামর্শ দিয়েছি!
—ধ্যাৎ! আমার বাড়ির লোক কী ভাবল না ভাবল তাতে তোর কী আসে যায়? শোন, তুই যদি আমার জন্য ভালো একটা জায়গা ঠিক করে দিতে পারিস তাহলে আমি তোকে পুরস্কার দেব!
—এক মোহর বকশিশ?
—তার চেয়ে অনেক বেশি। আমি রোমিকে আসতে বলব আমার ফ্ল্যাটে, যেখানে তোর সঙ্গে ওর দেখা হবে!
সবাই বলে আমি সহজে লজ্জা পাই না। কিন্তু রফিকের মুখে এই কথাটা শোনা মাত্র আমার কান গরম হয়ে উঠল। রোমির সঙ্গে আমি এ পর্যন্ত একটাও কথা বলি নি। আমাকে সে চেনেই না। তার মতন অসাধারণ একজন রূপসী আমার মতন একজন ফেকলুকে পাত্তাই বা দেবে কেন?
শুধু লজ্জা নয়, রোমির নাম শুনে আমার গলার কাছে একটা ব্যথা–ব্যথারও ভাব হলো।
রফিক জিজ্ঞেস করল, তোর সঙ্গে রোমির দেখা হয়েছে আজ?
আমি দু’দিকে মাথা নাড়লুম। সত্যি কথা বলতে পারলুম না।
–তুই যদি একটু আগে আসতিস, তা হলেই দেখা হয়ে যেত। রোমি তো আমার এখানেই ছিল। রোমিরও বেশ প্রবলেম চলছে। ডাকব ওকে?
আমি প্রবলভাবে বললুম, না, না, না, ডাকতে হবে না।
রফিক তা গ্রাহ্য করল না। দরজার কাছে গিয়ে হাঁক দিল, কাদের! কাদের!
কাদের নামে একটি ফুটফুটে কিশোর রফিকের ফাইফরমাস খাটে। সে বারান্দা দিয়ে ছুটে আসতেই রফিক বলল, তুই সেলিনা আপাকে চিনিস তো?
কাদের অনেকখানি ঘাড় নেড়ে বলল, জী!
—তাকে ডেকে নিয়ে আয়। আমার নাম করে বলবি এক্ষুনি আসতে। আমার খুবই অস্বস্তি লাগছে। রফিকদের বাড়িতে বাইরের লোকদের সঙ্গে মেয়েদের আলাপ করিয়ে দেবার রীতি নেই আমি জানি। এ বাড়িতে আমি অনেক দিন যাওয়া–আসা করছি। রফিকের আম্মা আমাকে চেনেন। কিন্তু ওর এক ভাবীকে আমি সিঁড়িতে ওটা–নামার পথে অনেকবার দেখেছি। কিন্তু কোনোদিন একটাও কথা হয় নি।
দরজার পাশে আমি দাঁড়িয়ে দেখলুম, সিঁড়ির নিচে অনেক লোকজন। ভালো রান্নার মনমাতানো গন্ধ ভেসে আসছে। বাচ্চারা হৈ–হল্লা করছে একতলায়।
হঠাৎ আমার সেই ডিমওয়ালী বুড়ির কথা মনে পড়ল। তার মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পেলুম। রোজার উপোস করে তার শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আজ তার বাড়িতেও নিশ্চয়ই ঈদের উৎসব। গরিবের বাড়িতে এসব দিনে কেমন উৎসব হয় কে জানে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো চম্পক, কায়সুল আর বরুণ। চম্পক চেঁচিয়ে বলল, কি রে, নীলু, তুই আগেই চলে এসেছিস।? আমাদের ডেকে আনার কথা ছিল না? আমার মনটা দমে গেল। বন্ধুদের দেখলে আমি সব সময়েই খুশি হই, কিন্তু সেলিনা যেন এখন না আসে।
ঠাঠা পোড়া রোদ্দুরের মধ্যে যদি গিয়ে উপস্থিত হই, চৌকিদারটি গোমড়ামুখো, সামনের বাগানে তিনজন লোক বসে ট্রানজিস্টারে বিকট গান শুনছে, এমন অবস্থায় মারুমাঢ় বাংলো কী আমার ভালো লাগবে আগের মতন? সুন্দরেরও একটা বিশেষ সময় আছে।
এরপর আধঘণ্টা আড্ডা চলল তুমুল। রোমি এলো না। কাদের এসে খবর দিয়ে গেল সেলিনা আপা খেতে বসেছেন। আমি তাতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললুম। তারপর এক সময়ে আমরাও খেতে গেলুম নিচে! রোমিকে দেখা গেল না কোথাও। সেটাই তো স্বাভাবিক।
এত ভালো ভালো খাবার, তবু আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলুম। কে কী বলছে তাও শুনতে পাচ্ছি না। নরম আলোয় পাহাড়ের উপকণ্ঠে ছবির মতন একটা বাংলো, জঙ্গল থেকে তিনটে চিত্রল হরিণ চলে এসেছে, বাগানে দাঁড়িয়ে আছে রোমি, শাদা সিল্কের শাড়ি পরা, আর কেউ নেই সেখানে। হরিণের অবাক চোখ দিয়ে আমি রোমিকে দেখছি—
রফিক আমার পিঠে চাপড় মেরে বলল, কী রে, নীলু, শুধু শুধু হাড্ডি চিবাচ্ছিস কেন? আর একটু মাংস নে।
বরুণ বলল, নীলু, তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমি এই শনিবার পাটনা যাচ্ছি, হোটেলে তো ডাব্ল রুম থাকবেই, তুই যাবি আমার সঙ্গে!
চম্পক বলল, উঁহু, নীলু যেতে পারবে না, ওকে আমি আগেই বুক করেছি। ও আমার সঙ্গে হলদিয়া যাবে।
কায়সুল বলল, নীলুটা বেশ আছে। আল্লার ষাঁড়। কেউ বাইরে যাবার একটা তাল তুললেই হলো। ও অমনি রাজি!
আমি কোনো কথা বললুম না।
রফিক ডেকে পাঠিয়েছিল, তবু রোমি আসেনি। রফিকের সঙ্গে আমিও আছি জেনেই ইচ্ছে করে আসেনি? কিংবা আরো তিনজন বন্ধু এসে গেছে বলেই!
রফিক বলেছিল, রোমিরও একটা সমস্যা চলছে। কী সেই সমস্যা? একটা অসমাপ্ত কাহিনী জানার কৌতূহল আমার মনের মধ্যে ছটফট করতে থাকে।