ভালোবাসা নাও, হারিয়ে যেও না – ৭

একদিন একজন আমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছিল।

বাবার গুণেন কাকা, আমরাও তাঁকে কাকা বলতুম। তিনি দাদু ডাকটা পছন্দ করতেন না। তখন তাঁর অনেক বয়স, এককালে জেল–টেল খেটেছিলেন, তারপর বনগাঁ–র দিকে কোন্ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাঝে মাঝে আসতেন কলকাতায়।

আমি তখন সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছি। গুণেনকাকা বেশ রসিক ছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বল্ দেখি বাবা, কোন লোকের সঙ্গে প্রত্যেকদিন সকালে আমাদের দেখা হয়, অথচ আমরা তার নাম জানি না?

আমি একটু ভেবে বলেছিলুম, খবরের কাগজের হকার।

গুণেনকাকা হেসে বলেছিলেন, তুই খুব ভোরে উঠিস বুঝি? খবরের কাগজের হকারের সঙ্গে প্রত্যেকদিন দেখা হয়?

বুঝলুম ভুল বলেছি। খবরের কাগজের হকার অত্যন্ত দুর্লভ প্রাণী। মাসের মধ্যে একদিনও তাকে ধরা অতি কঠিন কাজ। তাছাড়া আমাদের দোতলায় সে কাগজ দিয়ে যায় রাস্তা থেকে ছুঁড়ে, তার মুখ আমি কোনোদিন দেখেছি কিনা মনে পড়ে না। নাম জানার তো প্রশ্নই ওঠে না।

গুণেনকাকার ধাঁধার উত্তরটি হচ্ছে ধাঙড়। সে প্রত্যেকদিন বাড়ির মধ্যে আসে বাথরুম পরিষ্কার করে, তার মুখ চিনি, কিন্তু তার নাম জানি না।

গুণেনকাকা বলেছিলেন, সপ্তাহে একদিন যে ধোপা আসে বাড়িতে, ক’জন তার নাম জানে? যে মুচি নিয়মিত জুতো সারায়, যে মাছওয়ালার কাছ থেকে নিয়মিত মাছ কিনি, আমরা তার নাম জানার কোনো আগ্রহই বোধ করি না। এই জন্যই মানুষে মানুষে যোগাযোগ আজকাল এত কমে গেছে। আগেকার দিনে লোকে যে গয়লা দুধ দিত তারও বাড়ির খবর, কটি ছেলেমেয়ে, তার বিবাহিতা মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সুখে আছে কিনা সে খবরও রাখত। নতুন কেউ ভিক্ষে চাইতে এলেও জিজ্ঞেস করা হতো, বাপের নাম কী, বাড়ি কোথায় ছিল? তার ফলে মানুষে মানুষে সুখ–দুঃখের অংশিদার হতো। ইংরেজদের প্রভাবে আমরা সেসব ভুলে গেছি। সহসা কেউ কারুর নাম–ধাম জানতে চাই না।

গুণেনকাকা আমাকে কিছু শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন, তখন সে শিক্ষা আমি গ্রহণ করিনি। জীবনের অনেক ক্ষেত্রে নানান মানুষের সঙ্গে নিয়মিত দেখা হয়, তাদের নাম–ধাম কিছুই জানি না।

পরদিন বাজারে গিয়ে সেই কথাই মনে পড়ল। ডিমওয়ালি বুড়ির নাম কী? কোথায় তার বাড়ি? সে একদিন তার বাড়িতে যেতে আমায় অনুরোধ করেছিল, আমি ওটা কথার কথা ভেবে তার বাড়ির কথা জানতেও চাইনি।

হিলহিলে চেহারার কিশোরীটি আজ ঝিঙে নিয়ে বসেছে। ওর কাছ থেকে এক কিলো ঝিঙে কিনলুম। এক টাকা বারো আনা দাম, দু’টাকার নোটের চার আনা সে ফেরৎ দিতে পারছে না বলে আমি বললুম, থাক না, পরের দিন এসে নিয়ে নেব।

তারপর জিজ্ঞেস করলুম, তোমার পাশে যে বুড়ি বসত, কী হলো তার? সে আর আসে না!

কিশোরীটি ঠোঁট উল্টে বলল, কী জানি!

–বাঃ, তোমার পাশে রোজ বসত, এখন আর আসে না, তার কোনো খবর নাওনি? সে কোথায় থাকে জানো?

কিশোরীটি উত্তর না দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের বোধহয় নিয়মকানুন আলাদা। যাকে বলে ‘জীবন সংগ্রাম’। তাই নিয়ে প্রত্যেকদিন যারা ব্যস্ত, তারা হয়তো কে এলো কে গেল তা নিয়ে মাথা ঘামায় না।

অন্য পাশের প্রৌঢ়টি বলল, ও বুড়ি থাকে সোনারপুরে। অসুখ–বিসুখ করেছে বোধ করি।

কিশোরী মেয়েটি তাকে ধমক দিয়ে বলল, তুমি ছাই জানো। বুড়ি থাকে কাদাগোলায়, আমাদের পাশের গাঁ। সোনারপুর থেকে আরো দুই কোরোস।

আমি কিশোরীটিকে জিজ্ঞেস করলুম, তোমার নাম কী?

সে লজ্জায় এদিক ওদিক মাথা দোলাতে লাগল। এটা আমিও লক্ষ করেছি যে গ্রামের ছেলেমেয়েরা নাম জিজ্ঞেস করলে খুব লজ্জা পায়।

একটু বাদে সে বলল, ময়না। একটা ভালো নাম আছে, নাজমা।

পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করলুম, তোমার নাম কী?

সে বলল, তার নাম খগো।

নাম দুটো মনে রাখতে হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ। আজ মাছওয়ালা, আলুওয়ালা, নারকোলওয়ালী সবার নাম জেনে নেব।

এরপর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলুম, ঐ যে বুড়ি ডিম বিক্রি করত, ওর নাম কী?

দেখা গেল ইংরেজি সভ্যতার প্রভাব এই সবজি–বিক্রেতাদের ওপরেও পড়েছে। কিশোরী মেয়েটি বা প্রৌঢ়টি কেউ–ই ঐ ডিমওয়ালি বুড়ির নাম জানে না। অথচ কতদিন সে ওদের মাঝখানে বসেছে। দু’জনেই তাকে ডাকত দিদিমা বলে।

কিশোরীটির কাছে আমি জানতে চাইলুম, কাদাগোলা কীভাবে যেতে হয়?

সে তার টলটলে চোখ দুটি আমার দিকে বেশ কয়েক মুহূর্ত তুলে রাখল। তারপর বলল, আপনি কাদাগোলায় যাবেন? হি হি হি।

–কেন, যেতে পারি না? হাসছ কেন?

—হেঁটে যেতে হয় গো বাবু।

–তোমার কি ধারণা আমি হাঁটতে পারি না? গাঁয়ের মানুষই শুধু হাঁটতে পারে? চার মাইল আর এমনকি রাস্তা।

—গাঁয়ের নাম যে কাদাগোলা। এঁটেল মাটি, হি হি হি। এই বর্ষার সময় একেবারে থকথকে দই। হি হি হি। দেখুন গে, দিদিমা বোধহয় ঐ রাস্তার জন্যই আসতে পারছে না।

প্রৌঢ় দোকানীটি পোড়খাওয়া সংসারী মানুষ। সে বলল, বাবুর কিছু টাকা পাওনা আছে, লয়? একদিন একটা বিশ টাকার লোট দিয়ে ভাংতি ল্যাননি।

একথা ঠিক নয়, বুড়ির কাছে আমার এক পয়সা পাওনা নেই। বরং সে একদিন আমায় বিনা পয়সায় একটা ডিম দিয়েছিল। আমি যে বুড়ির কাছে কেন যেতে চাইছি তা এই লোকটিকে বোঝানো যাবে না, অন্তত আমার ভাষায়।

খগো আবার বলল, বুইঝলেন বাবু, ও বুড়ি প্রায়ই ওর এক লাতির কথা বলত। খুব পেয়ারের লাতি। সে ছোঁড়া সোনারপুর এস্টেশানে পান–বিড়ি ফিরি করে।

এটা একটা দরকারি সংবাদ। সোনারপুর স্টেশনে যে পান–বিড়ি বিক্রি করে তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ।

ময়না বলল, সে লোকটা তো একবার জেল খেটেছিল, ও দিদিমার আপন নাতি নয় গো! পাড়াতুতো।

খগো বলল, তা হতি পারে। যা শুনিছি তাই বলিছি। বাবু জানতে চাইলেন।

ময়নার কাছে অন্য খদ্দের এসে গেছে, তাই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওর ঝিঙেগুলো বেশ টাটকা, উড়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না।

সেই খদ্দেরটি চলে যেতে আমি ময়নাকে জিজ্ঞেস করলুম, এই ঝিঙে তোমাদের নিজেদের খেতের বুঝি?

ময়না ফিক করে হেসে খগোর দিকে ফিরে বলল, পোড়া কপাল। বাবুটা কিচ্ছু বোঝে না। আমাদের আবার খেতি জমি আছে নাকি। একখানা মাত্তর ঘর সম্বল।

খগো মাথা নাড়ল। সে বাবুশ্রেণীর অজ্ঞতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সেও হাসে।

আমি তবু জিজ্ঞেস করলুম, তা হলে এ ঝিঙে কোথা থেকে আনলে?

—হাট ঠেঙে। কাল বিকেলে হাট ছিল না?

—হাট থেকে তুমি নিজেই জিনিস কেনো?

–তবে আবার কে কিনবে? হি–হি–হি।

-বাড়িতে তোমার কে কে আছে?

–কেউ নেই, যাও, তোমার তো কেনা হয়ে গ্যাচে, এখন দোকানের সামনে থেকে সরে ডাড়াও তো।

গুণেনকাকা যাই বলুন, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ এখন আর তেমন সহজ নয়। এ মেয়েটি আমার বেশি প্রশ্ন পছন্দ করছে না।

ময়না সবেমাত্র উদ্ভিন্নযৌবনা। কেউ আবার অন্যরকম সন্দেহও করতে পারে। খগো সেইরকম চোখেই চাইছে আমার দিকে। ডিমওয়ালি দিদিমার সঙ্গে আমার কীরকম ভাব ছিল তা এরা জানে, তবু তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া এরা এত অস্বাভাবিক মনে করছে কেন?

অলস পায়ে আমি এগিয়ে গেলুম মূল বাজারের দিকে।

ঘণ্টাখানেক বাদে বাজারের থলি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসে আমি বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে ট্রেন ধরলুম সোনারপুরের।

.

সোনারপুরের নামটা বড় বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়? কে এই নাম রেখেছিল? কী আছে সোনারপুরে? কোনোদিন তো সোনারপুরের বিশেষ কোনো গৌরবের কথা শুনিনি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটা জংশন স্টেশন। বারুইপুর বা ক্যানিং যাবার পথে কয়েকবার এই স্টেশনটা দেখেছি, কোনোদিন ওখানে নামা হয়নি।

পৌঁছতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালুম।

নিজেকে বেশ একটা শখের গোয়েন্দার মতন লাগছে। এক বুড়ির সন্ধানে এসেছি, যার আমি নাম জানি না। বুড়ির এক নাতি পান–বিড়ি ফেরি করে এখানে, তারও নাম জানি না, চেহারা জানি না। সে নাকি একবার জেল খেটেছে। যদি বা সেই নাতিকে খুঁজে পাই, তারপর সেই নাতি যদি উল্টে আমায় জিজ্ঞেস করে, আমার দিদিমাকে আপনি কেন খুঁজছেন, তাহলে তারও কোনো বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দিতে পারব না আমি।

একটা ক্যামেরা আনলে মন্দ হতো না। তাহলে বলা যেত ঠিক ঐরকম একটা বুড়ির মুখ আমাদের দরকার। সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির জন্য দ্বিতীয় এক ইন্দির ঠাকরুন খুঁজছেন। সত্যজিৎ রায়ের নাম হয়তো এখানে অনেকেই শোনেনি, তবু যদি বলা যায় যে সিনেমার জন্য একজন বেশ ভালো মতন বুড়ি চাই, তাহলে এখানকার লোক নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করার জন্য চাঙ্গা হয়ে উঠত।

ট্রেনটা ছেড়ে যাবার পর আস্তে আস্তে প্ল্যাটফর্মের ভিড় পাতলা হলো। গোটা তিনেক চা–ওয়ালাকে দেখতে পাচ্ছি, একজনও পান–বিড়িওয়ালা চোখে পড়ল না। প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে একটা পাকা মনোহারী দোকান আছে, সেখানে পান– সিগারেট পাওয়া যায়। এই দোকানদারই কি বুড়ির নাতি?

কিন্তু এত বড় দোকানের যে মালিক, তার দিদিমা কেন বাজারে ক’টা ডিম বিক্রি করতে যাবে রোজ? অবশ্য বলা যায় না, অনেক ছেলে আজকাল নিজের বুড়ো বাপ–মাকেই দেখে না, ঠাকুমা–দিদিমা তো কোন্ ছার।

খগো বলেছিল, সেই পান–বিড়িওয়ালা ঐ বুড়ির খুব পেয়ারের নাতি। তাতেও কিছু প্রমাণ হয় না। কুপুত্রকেও মা ভালোবাসে, কুনাতিকেও ঠাকুমা–দিদিমারা অগাধ প্রশ্রয় দেয়।

দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। পকেটে সিগারেট আছে, এই দোকানে আমার কেনার মতন আর কিছু নেই।

এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে।

যতদূর সম্ভব দেরি করে তারিয়ে তারিয়ে চা–টা খেতে লাগলুম। নানান লোকজন আসছে, তাদের কথাবার্তা শুনছি। কেউ কাদাগোলা গ্রামের নাম করছে কিনা সেই সম্পর্কেই আমার বেশি কৌতূহল।

একজন লোক দোকানদারকে ডেকে বলল, অ বিষ্টুদা শোনো। কালকের ব্যাপারটার কিছু ফয়সলা হলো? আমি কিন্তু ছাড়ব না বলে দিচ্ছি।

দোকানদার যেহেতু উঁচু জায়গায় বসে আছে তাই তার কণ্ঠস্বরে বেশ গাম্ভীর্য। লোকটির বয়স বছর পঁয়তিরিশের হবে, মুখে তিন–চারদিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

সে বলল, আমি কী জানি, তোর যা ইচ্ছে করগে যা।

–তুমি মাথা গলালে, নইলে কালই আমি ওকে ছাড়তুম না।

— আমি কী মাথা গলিয়েছি, অ্যা। ওসব ছেঁড়া ঝামেলায় আমার কি দরকার?

—তুমি শালাকে প্রোটেকশান দিলে, আর এখন বলছ… কথা থামিয়ে লোকটি আমার দিকে আড় চোখে তাকাল। ওরা কোনো গূঢ় বিষয়ে আলোচনা করছে, যা বাইরের লোকের শোনবার কথা নয়। অনেক রেল স্টেশনেই এমন অনেক কাণ্ড হয় যার সঙ্গে ট্রেন চলাচলের কোনো সম্পর্কই নেই।

চায়ের কাপটি নামিয়ে আমি আস্তে আস্তে সরে পড়লুম।

দোকানদারের নাম বিষ্ট, অর্থাৎ বিষ্ণু। কোনো মুসলমানের এরকম নাম হতেই পারে না। ডাকনামও না। এ কী করে বুড়ির নাতি হবে?

অবশ্য ময়না বলেছিল সোনারপুরের লোকটি বুড়ির পালিত নাতি। বুড়ি তো একটি হিন্দুর ছেলেকেও নাতি হিসেবে পালন করতে পারে। বুড়ি তো আমাকেও নাতির মতনই ভালোবেসেছিল।

এই সূত্রে আর একটা কথাও মনে পড়ল। বাজারে এত লোক আসে, তার মধ্যে বেছে বেছে শুধু আমার ওপরেই বুড়ির এত স্নেহ ছিল কেন? তার একটা কারণ এই হতে পারে যে বুড়ির নিজের নাতির সঙ্গে আমার চেহারার মিল আছে। আমাকে দেখে তার কথা মনে পড়ে যেত।

হ্যাঁ, এটাই অনেকটা যুক্তিসঙ্গত। সোনারপুর স্টেশনে ঠিক আমার মতন চেহারার একটি ছেলেকে খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু আমার নিজের চেহারাটা কী রকম তা কি আমি সঠিক জানি? আয়নায় যাকে দেখি সে কি হুবহু আমার নিজের ছবি, নাকি তার মধ্যেও খানিকটা ইচ্ছাপূরণ থাকে।

সে যাই হোক, ঐ দোকানদারটিকে অনায়াসেই খারিজ করে দেওয়া যায়। এরকম চৌকো চোয়াল আমাদের চোদ্দ পুরুষের কারুর নয়।

ঝমঝম করে এসে পড়ল আর একটা ট্রেন। অমনি জায়গাটা মাছের গন্ধে ভরে গেল। ট্রেনটা ক্যানিং থেকে আসছে। এই স্টেশনে বেশ অনেক লোক ওঠে নামে।

একটা বেঞ্চ দেখে আমি বসলুম। পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করতে হবে। আশা করে এসেছিলুম, সোনারপুরে একটি মাত্র পান–বিড়িওয়ালার দেখা পাওয়া যাবে, তার সঙ্গে কায়দা করে কথা বলে অনেক খবর বার করে নেব। এমনকি তাকে কী কী প্রশ্ন করব তাও ঠিক করা ছিল।

আরও একটা ট্রেন এলো, গেল। কিন্তু আমি স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে পারছি না। প্রায় এক ঘণ্টা সময় পার হয়ে গেছে। এক একবার মনে হচ্ছে বুড়ির সন্ধান আজকের মতন ছেড়ে ক্যানিং বেড়াতে চলে গেলে কেমন হয়? সেখান থেকে লঞ্চে চেপে সুন্দরবন।

ময়লা পাজামা আর পাঞ্জাবি পরা রোগা মতন একটি ছোকরা এসে বসল আমার পাশে। পকেট থেকে একটি চ্যাপ্‌টা হয়ে যাওয়া সিগারেট বার করে সে জিজ্ঞেস করল, দাদা দেশলাই আছে?

আমার কাছে আছে রফিকের দেওয়া একটি লাইটার। সেটা আমি হাতছাড়া করতে চাই না বলে ঝুঁকে পড়ে ছোকরাটির সিগারেট ধরিয়ে দিলুম।

গাঁজায় দম দেওয়ার মতন জোরে একটান মেরে আরাম করে ধোঁয়া ছাড়ার পর সে বলল, জমি দেখতে এসেছেন?

—কী?

—এদিকে জমি দেখতে এসেছেন? আমার হাতে ভালো ভালো জমি আছে, এস্টেশান থেকে সাত মিনিট, পাকা রাস্তা। দরও সস্তা পড়বে।

প্রস্তাবটি শুনে আমার খুশি হবারই কথা। আমাকেও কেউ জমি কেনার যোগ্য লোক মনে করে।

আমার গোঁফ নেই, তাই ডানদিকের জুলপিটা ধরে পাক দিতে দিতে বললুম, হ্যাঁ, জমি কেনার কথা ভেবেছি বটে দু’একবার। আপনি জমি দেখাতে পারবেন?

লোকটি কাছে সরে এসে বলল, কেন পারব না, কীরকম জমি চান বলুন? দু কাঠা, তিন কাঠার প্লট? পুকুর–বাড়ি সমেত বড় জমিও আছে। সরকারদের একটা বাড়ি, দোতলা, সঙ্গে বাগান, সেটা বিক্‌কিরি আছে।

–কত দূরে?

—সাইকেল রিক্সায় গেলে ঠিক আপনার লাগবে আট মিনিট।

—এত কাছে আমার পছন্দ নয়। শহরের মধ্যে আমি জমি চাই না। কলকাতা শহরে তো বাড়ি আছেই। এদিকে বেশ একটা গ্রাম মতন জায়গা চাই, গাছপালা থাকবে।

–বাগানবাড়ি চাইছেন?

–না, চাইছি গ্রামের মধ্যে খানিকটা জায়গা। এদিকে কাদাগোলা নামে একটা গ্রাম আছে না?

লোকটা বেশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে চেয়ে রইল আমার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, কাদাগোলা?

আমি বললুম, ঐ নামে গ্রাম নেই কাছাকাছি?

—হ্যাঁ আছে, সে তো বেশ দূর।

–কত দূর? আমি তো শুনেছি মাইল পাঁচেক হবে।

—না–না, কী বলছেন, আট ন’ মাইল তো হবেই। ওখানে গিয়ে কী করবেন দাদা? রাস্তাঘাট ভালো নেই, বাস চলে না।

—সাইকেল রিক্সা?

–এই বর্ষাকালে তাও যাবে না।

—তাহলে আর কী হবে। ঐ গ্রামটাই আমার পছন্দ।

—গ্রামের মধ্যে বাড়ি করতে চান তো? চলুন না, ভালো গ্রামে নিয়ে যাচ্ছি। আমবাগান পাবেন, কাছেই বাস রাস্তা, সাইকেল রিক্সা পাবেন রাত এগারোটা পর্যন্ত।

—যে গ্রামে বাস রাস্তা নেই, সেই রকম গ্রামই আমার চাই। সেখানে জমির দাম সস্তা।

—চলুন ঐ কাদাগোলাতেই নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে।

–এখন?

—হ্যাঁ, জমি দেখে বায়না করে আসবেন।

– আপনাকে কত দিতে হবে?

—যা খুশি হয় দেবেন। পথ খরচা হিসেবে বিশ পঁচিশ।

–পথ খরচা মানে? গাড়ি ভাড়া করতে হবে নাকি?

–না, আপনাকে আমি সর্টকাটে নিয়ে যাব। বলছি আমার ডেইলি একটা খরচা আছে তো।

আমার মনের মধ্যে একটা অ্যালার্ম আছে। কোনো কোনো লোক দেখলে সেটা বেজে ওঠে। এখন আমি সেই ট–র–র–ং শব্দটা শুনতে পাচ্ছি।

এই লোকটির চোখের মণি বেড়ালের মতন। দৃষ্টি চঞ্চল। ঘন ঘন হাঁটু দোলাচ্ছে। এই লোককে বিশ্বাস করা যায় না।

জমি দেখাবার নাম করে নিরালায় নিয়ে গিয়ে এ আমার মাথায় ডাণ্ডা মারতে পারে।

আমার হাত ঘড়ি, আংটি কিছু নেই। পকেটে মাত্র পঞ্চান্ন টাকা। কিন্তু প্যান্ট, শার্ট, জুতো কোনোটাই ছেঁড়া নয়। শুধু পরিষ্কার জামাকাপড়ই খুনেদের আকৃষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট।

আমি লোকটির চোখে স্থির দৃষ্টি রেখে জিজ্ঞেস করলুম, আপনার নাম কী ভাই?

– আমার নাম? ইয়ে আমার নাম এককড়ি। এককড়ি সাপুই।

—বাড়ি কোথায়?

—বাড়ি এই সোনারপুরেই।

–কে কে আছে বাড়িতে?

– আছে মা, বাবা, দুটো ছোট ভাই। কই যাবেন তো উঠুন। বেলাবেলি ঘুরে আসা যাবে।

লোকটি নিজের নাম সত্যি বলেনি। আমার এত সব প্রশ্নও পছন্দ করছে না। আমাকে ও শহুরে বোকা বলে ধরে নিয়েছে।

-থাক, আজ আর যাব না।

–কেন, চলুন আজ দু’তিনটে জমি দেখাই। একবার দেখলেই তো পাকা হয় না।

—এদিকে জমি কেনার ইচ্ছে আমার আছে। তবে আমার মামা বারণ করছেন। আমার মামা বারাসত থানার ও সি। পঞ্চানন ঘোষাল, নাম শুনেছেন? মামা শিগগিরই সোনারপুর থানায় বদলি হয়ে আসছেন। মামা তাই বলছেন, আমি আগে যাই, তারপর ওদিকে তোর জন্য ভালো জমি দেখে দেব। এখন সোনারপুর থানার যিনি ও সি, তাঁর সঙ্গেও আমার চেনা আছে। আমার মামার ওখানে তো কতবার নেমন্তন্ন খেতে গেছেন।

লোকটি শুকনো গলায় বলল, ও!

– মামা আসার পরই জমি দেখা ঠিক হবে না?

—তা তো বটেই!

–ঠিক আছে, তখন আপনার খোঁজ করব, আপনিও সঙ্গে যাবেন। পুলিশের লোক হলেই যে গ্রামের সব খবর জানবে, তার তো কোনো মানে নেই। সে খবর আপনারাই ভালো জানবেন।

লোকটি দূরে কাকে যেন ‘এই গুপী’ বলে ডেকে সট করে উঠে চলে গেল।

এর কাছ থেকে এইটুকুই তথ্য পেলুম যে কাদাগোলা গ্রামটি মাত্র চার–পাঁচ মাইল নয়, তার চেয়েও বেশি দূর। গ্রামের লোকের মাইলের হিসেবের ঠিক থাকে না।

আজ আকাশে মেঘ নেই, স্বচ্ছ দিন। এখানকার লোকজনদের কাছে খোঁজ নিয়ে আমি নিজেই কাদাগোলার দিকে রওনা দিতে পারি। কিন্তু তাতে খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছি না। গ্রামে গিয়ে সেই ডিম–বেচা বুড়ির খোঁজ করব কী করে? ঐ বয়েসের বুড়ি গ্রামে অনেক থাকে। প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঁকি মারব? আজকাল গ্রামের লোক বাইরের মানুষ দেখলেই সন্দেহ করে।

রেল স্টেশনে বা বাস ডিপোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়ার অভ্যেস আমার আছে। আমার ভালো লাগে, নিজেকে বেশ একা পাওয়া যায়। অনেক কথাবার্তা হয়।

– আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, নীললোহিত, ঐ বুড়ির সঙ্গে দেখা করার এত গরজ কেন তোমার?

–রোজার মাসে বুড়ির শরীর খারাপ হয়েছিল, তারপর আর আসছে না। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, বুড়ি হয়তো অসুস্থ, আর কোনোদিনই আসতে পারবে না। ও অনুরোধ করেছিল একবার ওর বাড়িতে যেতে।

—শুধু সেই জন্য?

–তাছাড়া, ঐ যে স্বপ্ন দেখলুম, সেইজন্য মনটা একটু খচ্‌খচ্ করছে।

—মনে আছে দণ্ডকারণ্যের কথা?

–হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন?

–সেখানেও একজন বুড়ির সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল—কী যেন জায়গাটার নাম?

—জগদলপুর?

—উহুঃ!

—হ্যাঁ–হ্যাঁ, মনে পড়েছে, কোণ্ডাগাঁও!

–সেখানে একটা বড় বাস স্টেশন, তুমি রাত্তিরে একটা হোটেলের বাইরের খাটিয়ায় বসে রুটি–মাংস খাচ্ছিলে…একজন বুড়ি তোমার কাছে ভিক্ষে চাইতে এলো, তুমি ধমক দিয়ে বললে, দেখতা নেহি, হাত ঝুটা হ্যায়? কেইসে দেগা! বুড়ি বলল, একটু তাহলে ঘুরে আসি বাবা? তুমি তার মুখে বাংলা কথা শুনে খুব চমকে উঠলে।

–না, খুব চমকাই নি। আগেও মধ্যপ্রদেশের সেই দুর্গম অঞ্চলে বেশ কয়েকজনের মুখে বাংলা কথা শুনেছি। দণ্ডকারণ্যের রিফিউজি ক্যাম্প থেকে অনেক বাঙালি ছিটকে বাইরে চলে এসেছে।

—তুমি বুড়িটাকে জিজ্ঞেস করলে, আগে কোথায় বাড়ি ছিল? সে বললে, ফরিদপুর। তারপর তুমি জিজ্ঞেস করলে, কোন্ গ্রাম? সে বললে–

–জানি, জানি, কেন নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছ? সে আমার মামার বাড়ির গ্রামের এক নমঃশূদ্র। মামার বাড়িতেই সে কাজ করত।

—শুধু তাই নয়। যখন সে বলল, তাকে বোঁচার মা নামেই সবাই চিনত, তখন তা শুনে তুমি বিচলিত হওনি? তোমার রোমাঞ্চ হয়নি সারা গায়ে?

—হ্যাঁ, তা হয়েছিল। আমার মা–মাসির কাছে ঐ বোঁচার মায়ের অনেক গল্প শুনেছি। উনি ধাইয়ের কাজ করতেন। আমার জন্মের সময়ও উনি ধাই ছিলেন। ওর হাতেই আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছি।

—তুমি তোমার মামাবাড়ির নাম করতেই বুড়ি একেবারে হেসে–কেঁদে অস্থির। তুমি তোমার পরিচয় দাওনি। শুধু গ্রামটা চেনো শুনেই বুড়ির সে কি উত্তেজনা। তোমার গায়ে–মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। তখন তোমার কী মনে হয়েছিল?

—মনে হয়েছিল যে অনেককাল পরে জন্মভূমির স্পর্শ পেলাম। আমি আবেগ– প্রবণ, একটুতেই কাতর হয়ে পড়ি, আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।

–তারপর?

—বেশিক্ষণ কথা বলা যায় নি। আমার বাস হর্ন দিয়েছিল।

–বুড়ি তোমার কাছ থেকে কিছুতেই আর ভিক্ষে নেয় নি। সে তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তার বাড়িতে। তার নাতি–নাতনিদের দেখাবে একজন গ্রামের মানুষ।

—যাওয়ার উপায় ছিল না, একটু পরেই বাস ছেড়ে দিল।

—তুমি বুড়িকে কী কথা দিয়েছিলে?

—বলেছিলুম আবার আসব। শিগগিরই। বলেছিলুম, বোঁচার মা, তোমার কাছ থেকে সব গল্প শুনব। কী করে তুমি ফরিদপুরের সেই গ্রাম থেকে এত দূর দণ্ডকারণ্যে এসে পৌঁছলে।

–তুমি সেই কথা রাখনি।

–ঐ পথ দিয়ে যে আর ফেরা হয়নি!

—পরে তো আবার যেতে পারতে!

–দ্যাখো, মধ্যপ্রদেশ কত দূর, বার বার কি আর যাওয়া যায়? জগদলপুরের এস. পি বলেছিল আবার আমাদের নেমন্তন্ন করবে…সে আর চিঠিপত্র কিছু লিখল না।

—সেই জন্যই তুমি ঐ বুড়ির কাছে কথা রাখলে না। সে, প্রত্যেকটি বাস এসে থেমেছে, আর তোমাকে দেখবে বলে ছুটে গেছে। সেই বুড়ি, যার কোলে শুয়ে তুমি জীবনে প্রথম কেঁদেছিলে, তার বাড়িতে তুমি যাওনি, আর এই ডিমওয়ালি বুড়ির জন্য এত টান।

–দ্যাখো, একবার একজনের কাছে কথা রাখতে পারিনি বলেই তো অন্যদের কাছে কথা রাখবার বেশি করে চেষ্টা করতে হয়।

—ডিমওয়ালির কাছে তো তুমি কোনো কথা দাওনি। সে বলেছিল, বাবা, তুমি একদিন আমার বাড়িতে আসবে? তুমি কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু হেসেছিলে। তারপর রূপনারায়ণের পাড়ে শুয়ে নিছক একটা দিবাস্বপ্ন দেখে…

—কারণটা যাই হোক না কেন, পাড়াগাঁর দিকে একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ায় দোষের তো কিছু নেই। কলকাতার এত কাছেই যখন।

–আসল কারণটা তুমি স্বীকার করতে চাইছ না। আসল কারণ হচ্ছে, তুমি রোমির থেকে দূরে সরে থাকতে চাইছ!

– না, না, না, মোটেই তা নয়। আমি রোমির খুব কাছাকাছি যেতেই চাই না। তাজমহল দূর থেকেই ভালো দেখায়।

—দূর থেকে ভালো দেখায় বলেই কেউ দূরে থেমে থাকে না। সবাই তাজমহলের কাছেই যায়। রক্তমাংসের সুন্দরকে মানুষ অতি ঘনিষ্ঠভাবে পেতে চায়।

–না, না, না, তুমি কী বলছ! রোমির জন্য আমি…তা একেবারেই অসম্ভব!

–অসম্ভব হতে পারে, তবু তো ইচ্ছে হয়। রোমির ঠিকানা জানবার পর তোমার দু’একবার ইচ্ছে হয়নি ওর বাড়ির রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটতে?

—মোটেই না!

—নিজের কাছেও নিজেকে লুকোচ্ছ? মানুষের দুটো সত্তা থাকতে পারে। তিনটে কি হয়? ইচ্ছে তোমার হয়েছিল ঠিকই, তবু রোমির সঙ্গে তুমি যোগাযোগ করো নি ভয়ে। তোমার ভয় রফিক তোমাকে কোনো ফাঁদে ফেলতে চাইছে।

–যাঃ, যত সব বাজে কথা। রফিক আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সে আমায় কোনোদিন ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে না।

—ফাঁদে মানে বিপদে ফেলার কথা বলছি না! কিন্তু রফিক যে তোমাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছে তাও তুমি বুঝতে পারনি? রফিক যাকে বলে, মজা?

—কী এক্সপেরিমেন্ট?

—রফিকের অনেক সুন্দরী সুন্দরী কাজিন আছে। তাদের অন্য কারুর সম্পর্কে কোনো কথা তুমি রফিকের মুখে কখনো শুনেছ? রোমি সম্পর্কেই রফিক বেশি উৎসাহী। রোমি প্রায়ই আসে রফিকের সঙ্গে দেখা করতে। ঈদের দিনেও রফিক যখন একা ছিল, তখন রোমি ওর ঘরে ছিল। হয়তো আগ্রহ আর উৎসাহটাই আস্তে আস্তে প্রেমে রূপান্তরিত হয়েছে।

– ও হ্যাঁ, এটা তুমি ঠিক বলেছ। এটা হতে পারে। রোমি সম্পর্কে কথা বলার সময় রফিকের মুখ চোখ বদলে যায়। এটা রিসেন্টলি দেখছি।

—রোমি বিদ্রোহিনী টাইপের। রফিক তো এইসবই পছন্দ করে। রফিক নিজের বাড়িতে একবার শুয়োরের সসেজ খেয়ে কী রকম হুলুস্থলু বাধিয়েছিল মনে নেই?

—তাহলে…তাহলে…একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, রফিক কেন রোমিকে আমার সঙ্গে একা একা ছবির প্রদর্শনীতে পাঠাতে চাইছিল?

—তুমি একটি অতি বোকা, নীলু! একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে। এটাই তো রফিকের মজার খেলা! তুমি যেই রোমিকে দেখে মুগ্ধ হলে, খুব একটা দেবী দেবী ভাব করে রোমিকে পুজো করতে শুরু করে দিলে, তখনই শুরু হয়ে গেল ওর এক্সপেরিমেন্ট। ও দেখতে চায়, তুমি কতটা এগোও। রোমি তোমার দিকে ঝোঁকে কি না। তাহলে ও সরে দাঁড়াবে, সে ব্যাপারে রফিক উদার!

—রফিকটা একটা পাগল!

–যার হাতে প্রচুর সময়, টাকাপয়সার কোনো চিন্তা নেই, তার এরকম পাগলামি বেশ মানিয়ে যায়। আমরা সবাই কিছু কিছু বে–নিয়মের কাজ করতে চাই। কিন্তু পারি না।

—রফিককে তাহলে একটা চিঠি লিখতে হবে। ওকে জানিয়ে দেব যে জীবনে আর কোনোদিন আমি রোমির সঙ্গে দেখা করব না।

–খবরদার ও কাজও করো না। ও রকম লিখলেই রফিক বুঝে নেবে যে রোমি সম্পর্কে তোমার দুর্বলতা একেবারে বদ্ধমূল! রোমির সঙ্গে রফিকের বিয়ে হলে তারপর কি তুমি রফিকের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেবে? রফিক তার বন্ধুদের ভালোবাসে, তোমাকে বেশি ভালোবাসে। রোমি সম্পর্কে তুমি বরং স্বাভাবিক হয়ে যাও। আর পাঁচটা মেয়ের মতো। রফিকের স্ত্রী হিসেবে তার সঙ্গে তোমার প্রায়ই দেখা হবে, তখন তুমি তার সঙ্গে হাসি–ঠাট্টা করবে, যেমন অন্য বন্ধুপত্নীদের সঙ্গে কর।

—ঠিক আছে, সেটাই চেষ্টা করা যাবে তা হলে।

—কী নীললোহিত, কষ্ট হচ্ছে?

—কষ্ট তো হবেই একটু একটু। কোনো একজন বিশেষ রমণীকে একেবারে সাধারণ স্তরে নামিয়ে আনা কি সহজ?

–আস্তে আস্তে সহ্য হয়ে যাবে।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে আর সান্ত্বনা দিতে হবে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *