৯
দিন্দার বাড়ি দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছি। যত দরিদ্র তাকে মনে করেছিলুম, ততটা সে নয় মোটেই। বেশ গোছানো ব্যবস্থা। একটা চৌকো উঠোনের একপাশ জুড়ে তার বসতবাড়ি। মাটির হলেও গোবর দিয়ে নিকোনো দেয়াল, সামনে চওড়া দাওয়া। উঠোনের আর এক পাশে রান্নাঘর, তার উল্টো দিকে একটি গোয়াল ঘর, সেটি যদিও আপাতত শূন্য। উঠোনের আর এক পাশে একটি ডোবা, তার জলের রং কালচে, এক পাড়ের বাঁশঝাড় থেকে পাতা ঝরে ঝরে পড়ে সেই ডোবার মধ্যে। এই রকম জলে কইমাছ, শিঙ্গি–মাগুর ভালো হয়।
দুটি বেশ তেজালো চেহারার হাঁসা–হাঁসীও প্যাক প্যাক করছে উঠোনে। রান্নাঘরের পাশটিতে একটি নধর ছাগল বাঁধা, সে কালো রঙের বোঁদের মতন এক রাশ নাদি ছড়িয়েছে।
রান্নাঘরের উনুনে নতুন চালের ভাত ফুটছে, গন্ধতেই বুঝতে পারা যায়।
হিন্দু–মুসলমান আদিবাসী নির্বিশেষে এদেশের গ্রামের মানুষ অধিকাংশই খুব অতিথিপরায়ণ। ঐ জিনিসটা এখনো লোপ পেয়ে যায়নি। দুমকার কাছে এক প্রৌঢ়া –সাঁওতাল রমণী তার বাড়িতে আমাকে দুপুরে ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য কী ঝুলোঝুলিই করেছিল। অথচ তার বাড়ির চেহারা দেখে মনে হয়েছিল তারা নিজেরাই দু’বেলা খেতে পায় না।
সেই তুলনায় দিন্দা তো বেশ সচ্ছলই বলতে হবে।
দিন্দার নাম দীননাথ পাড়ুই, তার সাতটি ছেলেমেয়ে এবং বউটি দ্বিতীয় পক্ষের। অবশ্য দ্বিতীয় পক্ষের বলতেও অনেকদিনের পুরোনো। তার প্রথমা পত্নীর মৃত্যু হয়েছে সতেরো বছর আগে। এ পক্ষের ছেলেমেয়ের সংখ্যা পাঁচ। তার প্রথম পক্ষের দুটি ছেলেই ক্যানিং–এর দিকে চলে গেছে, সেখানে কাজ–কারবার করে, ভালোই আছে। বাপের সঙ্গে একেবারে সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়নি। পালা–পার্বণে বাড়ি আসে। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে বারুইপুরে, জামাই সাইকেল রিক্সা চালায়। বাকি ছেলেমেয়েরা এখনো যুগ্যি হয়নি।
উঠোনে এসে নিমগাছের ছায়ায় খাটিয়ায় বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই দিন্দা তার পুরো পারিবারিক ইতিহাস আমাকে শুনিয়ে দেয়।
আমি কিন্তু প্রথমে অন্য কথা ভাবছিলুম। বাজারে চালকুমড়ো–বেগুন–বরবটি– টম্যাটো বেচেও কারুর সাতটি ছেলেমেয়ে সমেত সংসার মোটামুটি ভালোভাবে চলে যেতে পারে! কতই বা লাভ হয় ওতে? এর মাঝখানে আবার পাইকার, মহাজন, রেলের টিকিট চেকার ইত্যাদি ডাঙার কুমিরদের উৎপাত আছে!
পরে শুনলুম, কাকাদের সঙ্গে দিন্দার কিছু ভাগচাষের জমিও আছে, সেখান থেকে সম্বৎসরের খোরাকির ধান অনেকটাই এসে যায়। অবশ্য তার কাকারা নাকি তাকে কিছুটা ঠকায়।
ময়না আগেই বিদায় নিয়েছে, নিজের বাড়ির উঠোনে পা দেওয়া মাত্রই দিন্দার অদ্ভুত এক পরিবর্তন আমি লক্ষ করেছিলুম। এখন সে আর একজন সামান্য দোকানদার নয়, সে এখানে হেড অফ দা ফ্যামিলি। সে বাড়ি–জমির মালিক। এসেই সে তার ছেলেমেয়েদের হুকুম করতে লাগল।
আমি যে বাজারে যাই, দিন্দা সে বাজারে বসে না, সে বসে অন্য বাজারে। ময়নার সঙ্গে সে এক ট্রেনে যায়, আসে। আমি তার খদ্দের নই, তবু আমাকে সে যা খাতির করতে লাগল তাতে আমি অপ্রস্তুতের এক শেষ। আমাকে কি সে বাবু সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করছে? কিন্তু আমি তো সেই সমাজের কেউ না! সেই সমাজ তো আমাকে হেলা–তুচ্ছ করে।
একটু পরে বুঝতে পারলুম, ভালোমানুষীতেই তার আনন্দ। এরকম মানুষ আছে, যারা প্রতিদানে কিছুই চায় না, শুধু নিজেদের ভালোত্ব নিয়েই মশগুল হয়ে থাকে।
দিন্দার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি তার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে আগ্রহ বোধ করছিলুম ঠিকই, আবার সেই সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনের একটা অংশ কাদাগোলা গ্রামের সেই বুড়ির কথাই চিন্তা করছিল। সত্তরের বেশ ওপরে বয়েস, দীর্ঘ এক মাস রোজার উপোস, বেশ কিছুদিন বাজারে যেতে পারেনি…তার মৃত্যু কিছুই আশ্চর্যের নয়। এরকম একজনের মৃত্যু নিয়ে পাশের গ্রাম কেন, তার নিজের গ্রামের কেউও বোধহয় মাথা ঘামায়নি। প্রতিবেশীরা কবরে মাটি দিয়েছে। জানাজা হবে কি তার? নাতিটা কোথায় লুকিয়ে আছে…
এরকম একটা অবস্থায় আমি ওখানে গিয়ে হাজির হলে খুবই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তুম।
বুড়ির মৃত্যুর কথা ভেবে যে সেরকম একটা কিছু কষ্ট হচ্ছে তা নয়। আমি যে এতটা উদ্যম নিয়ে এই পর্যন্ত এলুম তবু দেখা হলো না, সেটার জন্যই খারাপ লাগছে। নিজের কাছেও নিজের বাহবা নেবার একটা ব্যাপার থাকে। আবার মনের মধ্যে কেউ এই নিয়ে বিদ্রূপ করতেও ছাড়ে না।
আমাকে বসিয়ে রেখে দিন্দা এক ফাঁকে ডোবাতে স্নান সেরে এলো। তারপর লুঙ্গি পরে, পরিপাটি চুল আঁচড়ে আমার কাছে এসে বলল, বাবু চারডি মুড়ি খাবেন তো। বাতাসা আর কলা আছে। কিন্তু ঘরে তো দুধ নেই। আপনার কষ্ট হবে। আমাদের বাড়িতে ভাত তো খাওয়া চলবে না আপনার––
আমার খুব একটা খিদে পায়নি। তবে নতুন চালের ভাত রাঁধবার গন্ধে মনটা একটু আনচান করে উঠেছিল। ভাত সম্পর্কে একটা জন্মসংস্কার আছে। গরম ভাতের চেয়ে উপাদেয় পৃথিবীতে আর কিছুই লাগে না।
–কেন, ভাত খেতে পারব না কেন? ভাত কম পড়বে?
—আরে, কী যে বলেন, দুটি চাল ফুটিয়ে নিতে আর কতক্ষণ লাগে? তবে সকলে তো আর সব বাড়িতে খায় না। ভোটের সময় বাবুরা আমাদের বাড়ি থেকে রুটি চেয়েছিলেন, তা রুটির তো পাট নেই।
—আমি মুড়ি বা রুটির চেয়ে দু’গাল ভাতই পছন্দ করি।
রান্নাঘরের দাওয়ায় আমার জন্য কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পেতে দেওয়া হলো। পিঁড়ি মাত্র একখানিই আছে। দিন্দা জানাল সেটা তার প্রথম বিয়ের পিঁড়ে।
গরম ভাত, অড়হর ডাল, আর ঝিঙেভাজা। এই ঝিঙেভাজা আমি প্রথম খেলাম, অল্প ব্যসনে ডুবিয়ে বেশ মুচমুচে, যদিও ঝিঙেটা একটু জালি এই যা। এর সঙ্গে খানিকটা পোস্তবাটা। সব মিলিয়ে খুব একটা আহামরি কিছু বলা যায় না, তবে বেশ তৃপ্তি হলো।
আমরা আমিষ–ভুক বলে ভাত কম খাই। গ্রামের লোকেরা মাছ–মাংস কম পায়। তাই বেশি ভাতে সেটা পুষিয়ে নেয়। আমার ভাত নেওয়া দেখে দিন্দা বেশ ব্যথিত সুরে বলতে লাগল, আপনি কিছুই খেলেন না, আপনার রান্না পছন্দ হয়নি। ও ঝেবনের মা, বাবুর জন্য এট্টু বেগুন পোড়া দিলে তো পারতি, ঘরে কি একটাও ডিম ছিল না? হায় আমার পোড়া কপাল
ঝেবনের মায়ের স্বভাবটা বেশ কাঠ কাঠ। শব্দ করে হাঁড়ি নামায়, ঠকাস করে গেলাস রাখে। কে জানে বাড়িতে অতিথি আসায় সে বিরক্ত হয়েছে কি না। দিন্দা নরম প্রকৃতির লোক, দ্বিতীয় পক্ষের বউ তাকে যথেষ্ট শাসনে রাখে বোঝা গেল। সেইজন্যই কি তার মুখে একটা দুঃখী দুঃখী ভাব, নইলে অন্য কোনো অভাব তো তার তেমন একটা নেই।
খাওয়ার পর আবার আমরা উঠোনে খাটিয়ায় এসে বসলুম। দিন্দা এখনো আমাকে ছাড়বে না, সে আমাকে কাদাগোলায় পৌঁছে দেবে বলেছে। আমি তাতে আপত্তি করিনি। কাদাগোলায় শেষ পর্যন্ত একবার যাওয়া দরকার ঠিকই, কিন্তু একা যেতে আমার মন সরছে না।
এবারে আমার সঙ্গে দু’তিনটে কথা বলতে না বলতেই দিন্দা ঘুমে ঢলে পড়ল। এ জন্য তাকে একটুও দোষ দেওয়া যায় না। সেই সাতসকালে ওঠে। সারাদিন কত পরিশ্রম। খাওয়ার পর একটু ঘুম নিশ্চয়ই তার অভ্যেস হয়ে গেছে।
আমি চুপ করে বসে রইলুম। আকাশে এখনো শকুন উড়ছে অনেক। খুব কাছেই কোনো গাছে ঘুঘুর ডাক শুনতে পাচ্ছি। প্রথমবারের ডাকটা শুনে গা ছমছম করে উঠল। ঘুঘু নির্জনতা–প্রিয় পাখি। যে বাড়িতে লোকজন থাকে সে বাড়ির কাছাকাছি নাকি ঘুঘু আসে না। গেরস্থের বাড়িতে ঘুঘুর ডাক অমঙ্গলজনক, সেই জন্যই বলে।
হাঁস দুটো নেমে গেছে ডোবায়। পাঁঠাটা রাগত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। ও কি আমাকে ওর কোনো প্রতিযোগী ভাবছে নাকি?
দিন্দার দ্বিতীয় পক্ষের পাঁচটি সন্তানের মধ্যে জনা দু’এককে এ পর্যন্ত দেখেছি। এখন আর কারুকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িটি বেশ নিস্তব্ধ।
আমার বন্ধুবান্ধব, পরিচিত মানুষরা কেউ জানে না আমি এখন কোথায় বসে আছি। মা–কে বলে এসেছি, দক্ষিণেশ্বরে এক বন্ধুর বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন। ফিরতে রাত হবে। চম্পক যদি বাড়িতে আমার খোঁজ নিতে আসে, তা হলে হকচকিয়ে যাবে একেবারে। আমার মায়ের স্বভাব আমার চেয়ে তো ভালো কেউ জানে না! মা চম্পকের সঙ্গে তর্ক করবে না, পূর্ণ বিবরণ জানতে চাইবে না, কোনো কথাই বলতে চাইবে না চম্পকের সঙ্গে। চম্পক আমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চেয়েছিল, সুতরাং চম্পকের আর স্নেহ পাবার অধিকার নেই। চম্পক যদি এরকম ঠাণ্ডা ব্যবহারের পরেও আমার চাকরির প্রসঙ্গ তুলতে চায়, তা হলে মা বলবে, না, নীলুর হলদিয়ায় যাওয়ায় আমার মত নেই। আমিই ওকে বারণ করে দিয়েছি। ও যদি কলকাতায় কিছু পায় তো ভালোই…পাবে তো নিশ্চয়ই, আজ না হয় কাল…
চকিতে একবার রোমির মুখখানা মনে পড়ল। তারপর যেন জলের ঢেউতে মিলিয়ে যাচ্ছে সেই মুখ, ভেসে ভেসে দূরে সরে যাচ্ছে, শুধু জল আর জল, যেন অন্য কোনো দেশ। সেই দেশে আমার কোনোদিন যাওয়া হবে না।
পান চিবোতে চিবোতে ময়না এসে ঢুকল উঠোনে। সকৌতুকে ভুরু তুলে বলল, ও বাবু, তোমরা এখুনো যাউনি?
ময়নার পিঠের ওপর এক রাশ ভিজে চুল খোলা। একটা বেগুনি ছাপ ছাপ শাড়ি পরে এসেছে। হাতে একটা তালপাতার পাখা, গোল করে পাড় বসানো। তাকেও এখন আর বাজারের সবজিওয়ালি বলে একদম চেনা যায় না। মুখে সামান্যতম হীনমন্যতার ছাপ নেই।
অ বৌদি, তোমাদের পাখা এনিছি, বলে ময়না এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। ঝেবনের মা বেরিয়ে এসে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। দিন্দা জেগে উঠে চোখ রগড়ে বলল, বেলা পড়েনি, চলেন এবার যাই।
ময়না মুখ ঘুরিয়ে বলল, হ্যাঁ খবর পেলুম, কাদাগোলায় পরশুদিনকে এক বুড়ির ইন্তেকাল হয়েছে। আক্কাসের দাদীই হবে!
দিন্দা বলল, চলেন, তবু একবার দেখে আসি, নাকি বলেন? এত দূর এলেন!
উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, হ্যাঁ, আমি একবার যাব তবু।
ময়না বলল, কাদাগোলা থেকে বদরু শেখ তো রোজই এস্টেশনে যায় ডাব বেচতে। আজও ছিল, দ্যাখোনি? তার ঠেঙে পাকা কথা জানা যেত, তখন মনে পড়েনি!
দিন্দা বলল, একবার ঘুরে দেখে এলেই তো হয়। চ ময়না, যাবি নাকি?
আমি বললুম, তোমাদের তো বিকেলে আবার কাজকর্ম থাকে। তোমরা শুধু শুধু যাবে কেন? একটা কোনো বাচ্চা ছেলে দাও না, আমায় পথ দেখিয়ে দেবে?
দিন্দা উদারভাবে বলল, চলেন, কতক্ষণই বা লাগবে। কাজ তো আছে, কাজ তো পালিয়ে যাচ্ছে নে।
এই গ্রাম ছাড়াবার পর মাঝখানে গোটাকয়েক ধান জমি, তার পরেই কাদাগোলা। সেই জোড়া তালগাছের সীমানার পর থেকেই শুরু হলো কাদা।
চটি খুলে প্যান্ট গুটিয়ে নিলুম হাঁটু পর্যন্ত। তবু এ কাদার মধ্যে হাঁটা খুব শক্ত। একেবারে হড়হড়ে, প্রতি পদক্ষেপে পা পিছলে যেতে চায়। দু’তিনবার আমাকে দিন্দার কাঁধ ধরে সামলাতে হলো।
ময়না বলল, এমনিভাবে বুড়ো আঙুল টিপে টিপে হাঁটুন।
দিন্দা বলল, বাবুর জন্য একটা লাঠি নিয়ে এলে হতো রে! বাবুর অভ্যেস নেই। আমাদেরই পা হড়কে যায়। বুঝলেন বাবু, এই কাদাগোলা গাঁয়ের পেছন দিকটায় একটা বেশ বড় ঝিল রয়েছে। বর্ষাকালে সেখানে অনেক শালুক ফোটে। শাপলা তো বিকিরি হয় বাজারে, তাই অনেকে তুলতে যায়।
ময়না বলল, এতটা কাদা ভেঙে যাওয়া…পরতা পোষায় না।
ময়না ঘন ঘন তাকাচ্ছে আমার দিকে। যেন একজন শহুরে বাবু এই কাদার মধ্যে কতখানি দুর্দশায় পড়বে সেটা দেখার জন্যই তার সঙ্গে আসা।
অবিলম্বেই ময়নার প্রত্যাশা পূর্ণ করবার জন্য আমি একটা আছাড় খেলুম।
ভাগ্যিস আছাড় খেয়ে কেউ সামনে পড়ে না, মাধ্যাকর্ষণ সবাইকে পেছনে টানে। সেইজন্যই মুখ–চোখ বেঁচে গেল এবং পশ্চাৎদেশের যে কী অবস্থা হলো তা আমি নিজে দেখতে পেলুম না।
হেসে কুটি–কুটি হয়ে যাওয়া ময়নাকে একটা ধমক লাগাল দিন্দা। তার মুখে একটা কুণ্ঠিত ভাব, যেন রাস্তার এত কাদার জন্য সে–ই দায়ী। আমাকে টেনে তুলতে তুলতে সে বলল, কোমরে চোট লাগিনি তো? দেখুন দিকিনি তো, কী গেরো! কোথাকার এক বুড়ি, কোনো সম্পর্ক নেই যার সঙ্গে…কী জানি কার কোথায় নিয়তি বাঁধা থাকে।
লুঙ্গি পরা, খালি গায়ে তিনজন বলিষ্ঠ চেহারার লোক একটু দূর থেকে আমাদের লক্ষ করছিল। তাদের চোখের চাহনি ঠিক সুবিধের নয়।
ময়না একটা বাঁখারি জুটিয়ে আমার পিঠ থেকে কাদা চেঁছে তুলে দিল। একেবারে আঠার মতন কাদা।
দিন্দা বলল, আর দূর নেই। ঐ লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।
লোক তিনটি একটি শিরীষগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দিকে এগিয়ে আসেনি। আমরা ওদের কাছাকাছি পৌঁছোবার পর ওরা রাস্তার মাঝখানে চলে এলো। আমাদের আর এগোতে দেবে না।
দিন্দা ভালো মানুষের মতন জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ গো, তোমাদের গাঁয়ে এক বুড়ি মারা গ্যাছে দু’দিন আগে?
একজন বলল, গ্যাছে তো কী হয়েছে?
—এই বাবু আক্কাসের দাদীর খোঁজ নিতে এয়েচেন।
–আক্কাস এখেনে থাকে না!
– আক্কাস নয়, আক্কাসের দাদী।
–বলছি তো, আক্কাস এখেনে থাকে না।
– আহা, চটছো কেন? বাবু ভালোমানুষের মতন বুড়ির খোঁজ নিতে এয়েচেন।
একজন অমনি কড়া গলায় বলে উঠল, বলি, তুমি ফোঁপরদালালি করে পুলিশের লোক নিয়ে এ গাঁয়ে এয়োছো কেন?
দিন্দা চোখ বিস্ফারিত করে বলল, পুলিশের লোক? না–না, পুলিশের লোক হবে কেন?
—আলবাৎ পুলিশের লোক! আক্কাস সোনারপুরে কী করেছে না করেছে আমরা জানি না। তা বলে এ গাঁয়ের ওপর হামলা হবে কেন? দু’দিন ধরে এখানে বাইরের লোক ঘোরাঘুরি করছে।
ময়না বলল, এ বাবু পুলিশের লোক নয়। আমার সঙ্গে রোজ বাজারে দেখা হয়।
একজন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, চুপ কর তুই! পুলিশের লোক বুঝি বাজার করে না! তোর অত রস কিসের রে?
সরল বিশ্বাসী দিন্দা নতুন চোখে তাকাল আমার দিকে। পুলিশের লোক ছাড়া এতটা রাস্তা ভেঙে একটা বুড়ির খোঁজে কেউ আসে? আসলে পুলিশ থেকে আক্কাসকে খুঁজছে।…একজন পুলিশের লোককে সে বাড়িতে ডেকে নিয়ে খাইয়েছে…গ্রামের মানুষের কাছে তার মুখ ছোট হয়ে গেল!
আমাকে পুলিশের লোক মনে করায় আমি রীতিমতন অপমানিত বোধ করলুম। এরকম কথা শুনলে পুলিশ বাহিনীরও অপমানিত বোধ করা উচিত। আমার মতন চেহারার লোক কি পুলিশ হিসেবে মানায়?
আক্কাসের মতন একজন খুদে অপরাধীকে ধরবার জন্য, যদি সে অপরাধী হয়, সেটাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তা হলেও তার জন্য এতটা কাদা ভেঙে পুলিশের লোক আসবে, এরকম কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ এখনো আছে এদেশে?
সোনারপুর স্টেশনে বসে আমি এক জমির দালালের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছিলুম দারোগার ভাগ্নে হিসেবে। সেই লোকটির কাছে আমি কাদাগোলা গ্রাম সম্পর্কেও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলুম। সেই কথা কি এর মধ্যে পৌঁছে গেছে এখানে? অসম্ভব কিছু নয়।
আমি বললুম, ভাই রাগারাগি করছেন কেন? আক্কাস কে তা আমি চিনি না। তার খোঁজে আমি আসিওনি। আক্কাসের দিদিমার সঙ্গে আমার একবার দেখা করার দরকার ছিল। তা সে যদি মরে গিয়ে থাকে, তবে তো আর এ–গাঁয়ে ঢোকার কোনো দরকার নেই। চলো দিন্দা, ফিরে যাই।
দিন্দা অস্ফুটভাবে বললেন, বাবু, আপনি পুলিশের লোক?
— পুলিশ হলে কি ভয় খায়? গ্রামের লোকের কথা শুনে ফিরে যায়? আমি তো বলছিই, বুড়ি যখন বেঁচে নেই, তখন এ গ্রামে আর ঢোকার কোনো প্ৰয়োজন নেই আমার।
এবারে কাদাগোলা গ্রামের এক রক্ষক আমার কাছে এসে বলল, আপনি ভয় খাওয়ার কথা বলছেন কেন? আপনাকে কি আমরা সেরকম কিছু বলিছি? আক্কাসের দাদীর সঙ্গে আপনার কী দরকার?
একে আমি কী করে বোঝাব? আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সব তো চুকে বুকেই গেছে।
তবু এদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য কিছু একটা বলা দরকার।
লোকটির চোখে চোখ রেখে বললুম, ঐ বুড়ি গড়িয়াহাট বাজারে ডিম বেচতে যেত তো? আমার সঙ্গে খুব চেনা হয়ে গিয়েছিল। প্রায়ই ধারে ডিম দিত আমায়। দশ–বারো টাকা পাবে বোধহয়। ময়না জানে, ও তো পাশেই বসত। সোনারপুরের দিকে এসেছিলুম, তাই ভাবলুম, বুড়ির টাকাটা শোধ করে দিয়ে যাই। ঠিক কিনা ময়না?
ময়না দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, মিছে কথা। বাবুর এক পয়সা ধার ছিল না। এই বুড়ি বাবুকে নাতি মেনেছিল। তাই বাবুটা শেষ দেখা দেখতে এসেছিল বুড়িকে, তা বুড়ির ভাগ্যে নেই তো কী হবে!
ওদের তিনজনের মধ্যে যার বয়েস একটু বেশি সে বলল, আসেন আমার সাথে।
—কোথায়?
– আক্কাসের দাদী তো মরেনি, মরেছে অন্য একজন। তবে এ বুড়িরও বেশি দিন নেই। আছাড় খেয়ে হাঁটু ভেঙেছে, চলতি ফিরতি পারে না। তার ওপরে ধুম জ্বর।
–সে তাহলে বেঁচে আছে?
—মানুষ চিনতে পারবে কিনা তার ঠিক নেই! আমার হাত ধরেন, কাদা সামলাতি পারবেন না।
আরো কিছু গ্রামের লোক জুটে গেল আমাদের সঙ্গে। সবাই আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। যেন আমি সুন্দরবনের এক আজব জানোয়ার।
আমি এরকমভাবে আসতে চাইনি। কিন্তু একেবার বাইরের মানুষ হয়ে এরকম গ্রামের মধ্যে একা একা আসা বোধহয় সম্ভবও নয়।
যে আমার হাত ধরে আছে সে বলল, বুড়ি ওর নাতির জন্য কেঁদে মরে, কিন্তু আক্কাসটা এমন নিমকহারাম, একবার দেখতে আসে না। একফোঁটা উবগার নেই ওরে দিয়ে, বরং যত ঝামেলা। আপনাকে তখন ও–কথা কেন বলছিলাম জানেন? কালই সোনারপুর এস্টেশনে দুটো বদমাস বলছিল, ওরা এসে গাঁ থেকে আক্কাসকে টেনে বার করবে। ওদের সঙ্গে পুলিশের ষড় আছে তো!
– আক্কাস বাজারে ডিম বেচতে গেলেই পারে?
–ওর তেজ বেশি। সে ওগুলোনের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি করতে চায়। ঐ যে বাড়ি।
এ বাড়িটি গ্রামের এক টেরেয়। সুকুমার রায়ের কবিতায় বুড়ির বাড়ির যে বর্ণনা আছে, তার সঙ্গে খুব একটা অমিল নেই। দেখলেই বোঝা যায়, এ বাড়ির সব কিছুর পতন আসন্ন
একটিই মাত্র ঘর, তার সামনে এক চিলতে উঠোন। সেই উঠোনে একটা মুরগি তুরতুর করে ঘুরছে। এই মুরগিরই প্রথম ডিম বুড়ি আমাকে দিয়েছিল।
ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। একটা মাদুর না কী যেন পাতা, তার ওপরে শুয়ে আছে বুড়ি। দরজার কাছ থেকে উঁকি মেরেই বুকটা ধক করে উঠে। মনে হয়, ওর প্রাণ নেই।
দিন্দা বলল, সবাই মিলে ঘরে ঢুকো নে। এত ভিড় করতে বারণ করো!
ময়না ভেতরে গিয়ে বুড়ির কপালে হাত দিল। ঠোঁট উল্টে বলল, গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে।
তারপর আস্তে আস্তে বুড়িকে ঠেলা দিয়ে বলল, ও দাদীমা, ওঠো! চোখ খোল! দ্যাখো, কে এয়েছে।
বুড়ি বিপন্ন মিনমিনে গলায় বলল, কে রে? ময়না? আর বেটি আমার যাওয়া হয় না, পায়ে চোট লেগেছে।
–দ্যাখো না। আর কে এয়েছে!
–কে রে, কে? আক্কাস? এলি? কই রে?
—আক্কাস নয় গো। তোমার আর এক নাতি। ঐ যে গো বাজারে যার সঙ্গে নাতি পাতিয়েছিলে।
—কে? কার কথা বলছিস?
–বাঃ, মনে নেই, তোমার সঙ্গে কত ভাব, সেই ছোকরা বাবুটা, তুমি যাকে বেছে বেছে সরেস মাল দাও গো।
—মাথার ঠিক ত নাই রে আমার। কার কথা বলছিস?
দিন্দা আমার পিঠে চাপ দিয়ে বলল, যান বাবু, কাছে যান। আপনারে দেখলে চিনবে।
আমার লজ্জা করছিল। তবু আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললুম, কেমন আছ, বুড়ি মা?
আমার গলার স্বর শোনামাত্র চিনল। ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, কে? আমার বাবা এয়েছ? ওরে আমি কী করি! সত্যি সত্যি এয়েছ? অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিনি, ওরে ময়না, জানলাটা খুলে দে না…হা আমার কপাল! আমি ভাবলুম, বাজারে তো আর যেতে পারব না কোনোদিন, আমার বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না, এসো বাবা, একটু কাছে এসো, মুখখানা দেখি
আমি হাঁটু গেড়ে পাশে বসে বললুম, অনেকদিন তোমার খোঁজ করেছি। তোমার কী হয়েছে?
বুড়ি হাত বাড়িয়ে আমার মাথা ছোঁবার চেষ্টা করে বলল, কিছু হয়নি, বাবা, ভালো আছি। পায়ে একটু জোর হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে মনে কত ভেবিছি তোমার কথা, তুমি আমার বাবা, যদি শেষ দেখাটা না হতো—
আমি মনে মনে বললুম, তুমি স্বপ্নে আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলে…। বুড়ি বলল, ও ময়না, একটা কাজ কর না, মা। আমার বাবা এত দূর থেকে এয়েছে, একটা কিছু খেতে দিবি তো!
–না, না, না, বুড়ি মা, আমি একটু আগেই খেয়ে এসেছি।
—তা বললে কী হয়! কীই বা দোব! ও ময়না, ঐ টিনটা দ্যাখ না। ক’টা নারকোল নাড়ু করে রেখেছিলুম আক্কাসের জন্যে, সে ভালোবাসে। তার থেকে দুটো দে আমার বাবাকে।
ময়না কয়েকটা নারকোল নাড়ু এনে দিল আমার হাতে।
বুড়ি বলল, খাও বাবা, খাও, আমার সামনে বসে খাও, আমি একটু চক্ষু ভরে দেখি। ভালো করে এখন দেখতেও পাই না ছাই—
দৃশ্যটা যেন সত্যি নয়, অলৌকিক। লক্ষ্মীপুজোর আগের রাত্রে আমার দিদিমা আমাকে নারকোল নাড়ু এনে দিতেন। অবিকল তাঁকেই দেখতে পাচ্ছি যেন সামনে। ঠিক একই রকম প্রাচীন স্নেহ।
নারকোল নাড়ু মুখে তুলবার আগে মনে মনে বললুম, বুড়িমা, তোমরা হারিয়ে যেও না! আমি আর কী দিতে পারব, অতি সামান্য ভালোবাসা, তাই নাও, হারিয়ে যেও না!
***