২
ডিমওয়ালী বুড়িটির ব্যবহার দিন দিন আমার কাছে খুব রহস্যময় হয়ে উঠছে।
তার সঙ্গে যতবার দেখা হচ্ছে ও কথা বলছি, ততবারই আমি তার সঙ্গে আমার মৃত দিদিমার মিল খুঁজে পাচ্ছি বেশি করে। এবং বুড়িটির ব্যবহারও ক্রমশই আমার দিদিমার মতন হয়ে উঠেছে। আমাদের দু’জনের মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে যা ব্যাখ্যা করে বোঝান যাবে না। আমার মৃত দিদিমার আত্মা যেন ওর ওপর ভর করেছে, এই রকমভাবে বলা যেতে পারত, কিন্তু আজকাল কে আর আত্মা–ফাত্মায় বিশ্বাস করে!
বাজারের পেছন দিককার গলিটাতে ঢুকলেই দেখতে পাই সেই বুড়ি দুটি ব্যগ্র চোখ মেলে চেয়ে আছে। আমাকে দেখতে পেলেই হাতছানি দিয়ে ডাকে, তার মুখে ফুটে ওঠে হাসি। কাছে গেলে জিজ্ঞেস করে, ও বাবা, তুমি তিন দিন আসোনি কেন? তোমার জ্বর হয়েছিল নাকি? মুখটা শুকনো শুকনো দেখছি!
আমি লক্ষ করি যে এই বুড়ির কণ্ঠস্বর অবিকল আমার দিদিমার মতন! স্নেহ সব সময় অতিরিক্ত বিপদের আশঙ্কা করে। বাড়ি থেকে বেরুবার সময় মা ছেলেকে বলে, দেখিস যেন গাড়িচাপা পড়িস না। আমার দিদিমা প্রায় সব সময়েই আমার কাল্পনিক শরীর খারাপ নিয়ে চিন্তিত হতেন। যদিও আমার জ্বর–জ্বারি, অসুখ– বিসুখ হতেই চায় না। ক’দিন যে একটানা বিছানায় শুয়ে আরাম করব তার উপায় নেই।
বাবা চাকরি সূত্রে বাইরে থাকতেন, ছেলেবেলাটা আমি দিদিমার কাছেই কাটিয়েছি বেশ কয়েকটা বছর। সেই যে তখন দিদিমা আদর দিয়ে দিয়ে আমার মাথাটি খেয়েছেন, তারপর থেকে আর আমার মাথা ঠিক হলো না।
আমার মামাবাড়ি ভর্তি অনেক লোকজন ছিল। কিন্তু আমার ছিল স্পেশাল খাতির। যেহেতু আমার মা–বাবা দূরে থাকে, তাই অনেকেই আমাকে দুঃখী দুঃখী মনে করত। আসলে মা–বাবার কাছ থেকে দূরে থাকায় আমার বেশ মজা হয়েছিল। পড়াশুনোর কড়াকড়ি নেই, দুপুরবেলার গনগনে রোদে ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়িয়ে চোখ লাল করলেও কেউ বকুনি দেয় না, সবাই বেশি বেশি প্রশ্রয় দেয়, নিয়মিত হাতখরচ পাই, এমন মধুর বাল্যকাল ক’জনের ভাগ্যে ঘটে!
আমাকে আলাদা ভাবে যত্ন করার জন্য দিদিমা লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার দিতেন। দাদু বেঁচে ছিলেন না, কিন্তু মামারা বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবার, সে বাড়িতে খাবারদাবারের কোনো অসুবিধে ছিল না। তবু দিদিমা আমাকে গোপনে গোপনে কিছু খাইয়ে আনন্দ পেতেন। যেমন বাড়িতে একটা বড় ইলিশ মাছ এসেছে। সেই ইলিশ মাছের ডিমটা ভেঙে দিদিমা একটা প্লেটে করে ঘরে নিয়ে আসতেন আমার জন্য। চুপি চুপি ফিসফিস করে বলতেন, খেয়ে নে, চট করে খেয়ে নে!
বাড়ির অন্যান্য সবাইকে বঞ্চিত করে একা আমার ঐ ডিম ভাজা খাওয়া যে অন্যায়, সেটা আমিও বুঝতুম ঐ বয়েসে। কিন্তু আমার ক্ষীণ আপত্তি টিকত না। দিদিমা বলতেন, এই রাবণের গুষ্ঠির সবাইকে ভাগ করে দিলে এইটুকু কারুর মুখেও লাগবে না। তুই খা তো! দিদিমার স্নেহের অত্যাচার আমাকে সহ্য করে নিতেই হতো।
কিংবা, লক্ষ্মীপুজোর জন্য আগের দিন রাত্তিরে নারকোল নাড়ু তৈরি হচ্ছে। সেগুলো প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হবে। রাত্তিরে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিদিমা বলতেন, এই চারটে নাড়ু গরম গরম খেয়ে নে তো! নে নে, হাঁ কর!
পুজোর আগেই সেই নাড়ু খাবার অধিকার একমাত্র আমারই ছিল। সেই দিদিমার মৃত্যুকালে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। তিনি নাকি আমার নাম ধরে ডেকেছিলেন তিনবার।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। এখন বাজারের এই ডিমওয়ালি বুড়ির মধ্যে আমি অবিকল আমার দিদিমাকে প্রত্যক্ষ করি। চেহারা, ব্যবহার, কণ্ঠস্বর সব এক। সেই বুড়ি এমন সুরে আমার সঙ্গে কথা বলে যেন কতকালের আত্মীয়।
তার দুপাশে যে দু’জন বসে, তারাও ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। পাতলা হিলহিলে চেহারার কিশোরী মেয়েটি তার ডাগর ডাগর চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাসে। অন্য পাশের প্রৌঢ়টিও মুচকি হাসে।
কোনোদিন বুড়ি আমাকে আগে লক্ষ্য না করলে কিশোরী মেয়েটি তাকে খোঁচা দিয়ে বলে, অ দিদিমা, ঐ দ্যাখো তোমার নাতি এয়েছে!
বুড়ির মুখ সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমাকে সহাস্য অভিযোগের সুরে বলে, তুমি কাল এলে না, আমি তোমার জন্য বসে রইলুম সেই কতক্ষণ। তোমার অসুখ করেনি তো?
আমি ওর কাছ থেকে চারটে বা দুটো ডিম নিই। বুড়ি দামের হিসেব জানে না। মুখের দিকে চেয়ে থাকে। অন্য খদ্দেররা ডিম কিনলে সে পাশের মেয়েটির কাছ থেকে হিসেব বুঝে নেয়। সে মেয়েটি বেশ তুখোড়। দেড়টাকা জোড়া হলে সাতটা ডিমের দাম বলতে তার এক মুহূর্তও ভাবতে হয় না।
আজকালকার নতুন একটাকা, দু’ টাকার কয়েনের তফাতও অনেক সময় ধরতে পারে না বুড়ি। আমাকে প্রায়ই একটাকার বদলে দু’টাকা ফেরত দেয়।
বুড়ির কাছ থেকে আমি ডিম নিই অন্যান্য বাজার শেষ করে ফেরবার সময়। একদিন দেখি, তার আর সব ডিম বিক্রি হয়ে গেছে, শুধু পাঁচটি ডিম নিয়ে বসে আছে সে আমার জন্য। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই প্রথমে চারটি ডিম তুলে দিল আমার ঝুড়িতে, তারপর বাকি ডিমটি হাতে দিয়ে বলল, একটা আলাদা করে নাও, এটা তুমি খাবে। এটার দাম দিতে হবে না।
আমি বললুম, সেকি! ওটার দাম নেবে না কেন?
বুড়ি বাচ্চা মেয়েদের মতন লজ্জা লজ্জা ভাব করে বলল, ওটা আমার ঘরের মুরগির ডিম গো! এই প্রথম ডিম দিল তো। ওটা আমি তোমার জন্যই মনে করে এনেছি।
হঠাৎ আমার সর্বাঙ্গে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গের অনুভূতি হলো। এ যেন আমার দিদিমার সেই ইলিশ মাছের ডিমভাজা কিংবা লক্ষ্মীপুজোর নারকোল নাড়ু!
অনেক দূরের গ্রাম থেকে মাত্র কয়েক ডজন ডিম বিক্রি করতে আসে অতি সামান্য লাভের জন্য, সে কেন একটা ডিম আমাকে বিনা পয়সায় দেবে? এসব ব্যাপারে যুক্তি খুঁজতে যাওয়া বৃথা।
পাশের মেয়েটিও কথাটা শুনতে পেয়েছে। সে অনেকখানি ভুরু তুলে বলল, ওমা, দিদিমা আমাদের কোনোদিন ডিম খাওয়ায় না। আর নাতিকে খাওয়াচ্ছে?
বুড়ি তাকে তাড়না করে বলল, তুই থাম তো!
স্নেহ নিম্নগামী। বুড়িকে আমি ঐ ডিমের বদলে কী দিতে পারি! কিছুই দেওয়া যায় না। বুড়ির অনুরোধে আমি সেই ডিমটিকে আলাদা ভাবে পকেটে ভরে নিয়ে এলুম। একটা ডিমের সঙ্গে আর একটা ডিমের তফাৎ কী বোঝা সম্ভব? বুড়ি কী করে এই ডিমটিকে আলাদা করে রেখেছিল সারাক্ষণ?
এরকম একটা ডিম কি টপ করে খেয়ে ফেলা যায়? এ তো বাঁধিয়ে রাখার মতন জিনিস। বাড়িতে গিয়েই বা কী করে বলি যে এই ডিমটা আমার জন্য আলাদাভাবে রান্না করে দিতে, যাতে অন্য ডিমের সঙ্গে মিশে না যায়।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চম্পকের সঙ্গে দেখা। যতবার চম্পকের সঙ্গে দেখা হয় ততবারই সে প্রথম বাক্যটি বলে, শোন্ তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে! পৃথিবীতে ওর সব কিছুই জরুরি।
চম্পকের গায়ের রং খুব ফর্সা, সেজন্য ওর বেশ লজ্জা আছে। ফর্সা মুখখানি ঢাকবার জন্য ও একগাদা দাড়ি–গোঁফ রেখেছে। সেইজন্য অনেকে ওকে মিনি কার্ল মার্কস বলে ডাকে।
চম্পকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি আমার পাঞ্জাবির পকেটের ডিমটার কথা ভুলেই গেলুম।
চম্পকের জরুরি বিষয় হচ্ছে, ও একটা চাকরির ইন্টারভিউ পেয়েছে হলদিয়াতে, সেখানে আমি ওর সঙ্গে যেতে রাজি আছি কিনা, আমি এ প্রস্তাবে আপত্তির কিছু দেখলুম না। চম্পক হয়তো চাকরি পাবে না, তাতেও আমার তো ক্ষতি কিছু নেই, আমার বেড়ানো হয়ে যাবে।
বাড়িতে এসে চম্পকের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা চলল ঘণ্টাখানেক। তারপর আমি টের পেলুম আমার পাঞ্জাবির ডান পকেটটা ভিজে ভিজে লাগছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে গিয়ে খাবার টেবিল থেকে এক চিমটি নুন নিয়ে ঢুকে গেলুম বাথরুমে। ভাঙা ডিমটার যতটুকু উদ্ধার করা গেল, তার মধ্যেই নুন ছড়িয়ে সুরুৎ করে দিলুম এক টান।
এ বিষয়ে আমার কোনো গ্লানি হলো না। সব ডিমই এক। একজন ভালোবেসে একটা নিজের বাড়ির মুরগির ডিম দিয়েছে বলে সেটাতেই যে একেবারে অমৃতের স্বাদ পাওয়া যাবে তার কোনো মানে নেই।
এরপর তিন দিন ধরে একটানা বৃষ্টি চলল।
একজন কারুর সঙ্গে খানিকটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক হলেই তার সুখ–দুঃখের ব্যাপারটা টের পাওয়া যায়। অতিবৃষ্টির ফলে মালদা, বাঁকুড়া, বর্ধমানে বন্যার খবর পড়ছি কাগজে। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় জল জমে কী দুর্দশা হচ্ছে তাও অনেকটা জানি। কিন্তু বাজারের পাশের রাস্তায় সামান্য সবজি–তরকারি বা ডিম নিয়ে যারা বসে, তাদের কী অবস্থা হয়, তা আগে কোনোদিন চিন্তা করিনি।
অবিরাম বৃষ্টিঝরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি কোনো প্রিয়ার ছায়া দেখতে পাই না, আমার একটি সত্তর বছরের বুড়ির মুখ মনে পড়ে, সে মুখটি কখনো আমার দিদিমার, কখনো ডিমওয়ালির।
এই বৃষ্টির মধ্যে বাড়িতে রোজই খিচুড়ি আর আলু পেঁয়াজ ভাজা চলছে। বাজারে যাবার দরকার নেই। তবু আমি তৃতীয় দিনে নিজের গরজেই একহাঁটু জল ভেঙে বাজারে গেলুম।
পেছনের সেই গলিটি এখন রীতিমতন খাল। রিক্সাওয়ালাদের কোমর ডুবে যায়। সেখানে আনাজ–তরকারির কোনো দোকান থাকারই প্রশ্ন ওঠে না। বাজারের মধ্যেও তিলার্ধ জায়গা নেই, বাইরের খুচরো বিক্রেতাদের সেখানে ঢোকারও অধিকার নেই বোধহয়। ডিমওয়ালিকে আমি কোথাও দেখতে পেলুম না।
আমার মনটা একটু একটু খারাপ হয়ে গেল। ঐ যারা রাস্তার ধারে সওদা নিয়ে বসে, এই তিন দিন তাদের রোজগার বন্ধ। অনিচ্ছামূলক হরতাল। প্রকৃতি আসলে গরিব মানুষদের ওপর কখনো সদয় হয় না।
আশ্চর্য, মাত্র কিছুদিন আগেও আমি খবরের কাগজের পাঠক হিসেবে ফুটপাথের হকার, জবরদখল দোকান, বাজারের বাইরের রাস্তায় আনাজপত্তরের ব্যাপারীদের সম্পর্কে খুব বিরূপ ধারণা পোষণ করতুম। ভাবতুম, ওরা কলকাতা শহরটাকে আরও কুশ্রী করে তুলছে, রাস্তাঘাটগুলো হয়ে উঠছে হাঁটার অযোগ্য।
আর আজ আমার মনে হচ্ছে, এই তিন দিন রোজগার বন্ধ, ওরা খাবে কী? কয়েকদিন পরে সেই বুড়ির সঙ্গে যখন আমার আবার দেখা হলো, মনে হলো সে যেন আর একটু রোগা হয়ে গেছে। মুখটা শুকনো। কিন্তু ঠোটের হাসিটি আগের মতনই মিষ্টি।
জিজ্ঞেস করলুম, বৃষ্টির মধ্যে এই কটা দিন কী করলে? বেচা–কেনা কিছুই হয়নি তো?
বুড়ি বলল, যা বৃষ্টি বাবা, কী করে আসব! তুমি এয়েছিলে? তোমাদের বাড়িতে জল ঢোকেনি তো? শুনলুম কলকাতার কতক কতক বাড়ি ডুবে গেসলো!
পাশের প্রৌঢ় দোকানদারটি কৌতুক করে বলল, এ বছর আকাশ যেন সর্বক্ষণ নাইছে!
অন্য পাশের হিলহিলে চেহারার কিশোরীটি বলল, আমাদের গাঁয়ে পুকুর থেকে কইমাছ উঠেছিল ড্যাঙায়, আমি একটা ধরিচি।
তিন চার দিন যে ওদের রোজগারপাতি বন্ধ ছিল তা নিয়ে কোনো নালিশ নেই। কোনো তিক্ততা নেই। এদেশে যাদের একবেলা আহার জোটে না, তারাও কখনো কখনো হাসে।
এক সহানুভূতিশীল সাহেবের লেখায় পড়েছি যে দারিদ্র্য, মৃত্যু, অনাহার সম্পর্কে ভারতীয় দর্শন এমন এক জমাট উদাসীনতা সৃষ্টি করে রেখেছে যে সেই আবরণ সরিয়ে ফেলা খুবই শক্ত। নিয়তিবাদ এত প্রবল বলেই কেউ কিছুর প্রতিবাদ করে না। বাইরে থেকে আমদানী করা কোনো পরিবর্তনের আদর্শই এখানে সেইজন্য তেমন কল্কে পায় না।
বুড়ি আমাকে সেদিনের ডিমটার কথা কিছুই জিজ্ঞেস করল না। আমি নিজে থেকেই বললুম, ওগো, তুমি যে আমায় ডিমটা দিয়েছিলে সেটার স্বাদ অপূর্ব। বুড়ি লজ্জা পেয়ে এমনভাবে মাথা দোলাতে লাগলো যেন এ কথা আলোচনার যোগ্যই নয়। তারপর সে বলল, ও বাবা, তুমি একটু সরে দাঁড়াও, ওখানে কাদা রয়েছে, তোমার পেন্টুলে লেগে যাবে।
বুড়ির ঝুড়িতে আজ ন’টি ডিম আছে। গুণে দেখে আমি বললুম, ঐ সবকটাই আমাকে দিয়ে দাও। বাড়িতে আজ বেশি লোক।
বুড়ি দুটি ডিম সরিয়ে রেখে বলল, তুমি সাতটা নাও!
–কেন, ও দুটো দেবে না কেন?
–ও দুটো বড্ড ছোট যে! ওর আমি অন্য খদ্দের পেয়ে যাব!
আমি হেসে ফেলে বললুম, ডিম বড়–ছোট হলে কিছু আসে যায় না। সব ডিমের গুণ সমান
বুড়ি সে কথা বুঝবে না। সে মাথা নাড়তে লাগল। বড় মাছের টুকরো আর ছোট মাছের টুকরোয় যা তফাৎ, বড় ডিম আর ছোট ডিমেও সেই একই তফাৎ, এই তার ধারণা, মনে হলো।
আমি বললুম, অন্য খদ্দেরকে দেবে কেন, আমাকেই দাও না।
বুড়ি বলল, তুমি এই সাতটা নাও, আর বাকি যা লাগে অন্য দোকান থেকে কিনে নাও।
বুড়ি আমাকে নটা ডিম দেবে না, আমি তা নেবই। কিছুক্ষণ এইরকম ঝুলোঝুলির পর বুড়ি হার মানল।
ডিম ক’টি সব আমার থলেতে তুলে দিয়ে বুড়ি উঠে দাঁড়াল। কোমরে হাত দিয়ে একটু বিষণ্ণ গলায় বলল, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বাবা! রোজার মাস, রোজ উপোস করতে হয় তো, আর দুটো দিন বাকি।
আমার আরেকবার চমক লাগল। এই বুড়ি মুসলমান। আমার দিদিমা ছিলেন নিষ্ঠাবতী ব্রাহ্মণী। সকাল–সন্ধে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জপ করতেন। আমার ভালো করে জ্ঞান হবার পর থেকে দিদিমাকে আমি বিধবা অবস্থায় দেখেছি। বরাবর স্বপাক খেতেন। দিদিমার হাতের রান্না নিরামিষ সুক্তোটি অতি উপাদেয় ছিল।
এই বুড়িও নিষ্ঠাবতী। এতখানি বয়েসেও রোজার মাসে সে সারাদিন উপোস পালন করে। সেই অভুক্ত অবস্থায় ডিম বেচতে আসে। ওর বাড়ির পাশে দারিদ্র্য নামের দৈত্যটি একটি করাল খড়্গগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সংসার একটু টালমাটাল হলেই কোপ লাগাবে।
মাথার আঁচল টেনে বুড়ি জিজ্ঞেস করল, বাবা, তুমি আবার কবে আসবে?