ভালোবাসা নাও, হারিয়ে যেও না – ৫

রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম
জানিলাম
এ জগৎ স্বপ্ন নয়…

রবীন্দ্রনাথ রূপনারায়ণের কূলে জেগে উঠেছিলেন আর আমি রূপনারায়ণের তীরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম এবং একটি বিচিত্র স্বপ্ন দেখলুম।

দেউলটিতে তপনদের বাড়িতে গিয়ে পড়ে গেলুম মহা ফাঁপরে। বাড়ি ভর্তি অনেক লোক এবং সকলেরই প্রায় ফুড পয়জনিং হয়েছে। আজকাল যার নাম আন্ত্রিক রোগ। দু’দিন আগে তপনের দাদার ছেলের মুখে ভাত উপলক্ষে বিরাট ভোজ ছিল। সেদিন কোলাঘাটে প্রচুর ইলিশ উঠেছিল, তাই খেয়েই নাকি এই বিপত্তি। ইলিশের মতন চমৎকার মাছের নামে এই বদনাম, অকৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কী!

যাক, তপনের দাদার ছেলের কিছু হয়নি।

তপন বিছানায় শুয়ে চিঁ চিঁ করছে। ওদের বাড়ির তিনজনকে পাঠানো হয়েছে হেল্থ সেন্টারে, তপন নিজে কাল পর্যন্ত সুস্থ ছিল, আজ সে–ও পড়েছে।

সত্যি কথা বলছি, ও বাড়িতে পা দিয়েই স্বার্থপরের মতন ঠিক করে ফেললুম, এখানে আমি জলগ্রহণ করছি না। কোনো একটা অছিলায় অবিলম্বেই সরে পড়তে হবে। আমি তো তপনের চিকিৎসার কোনো সাহায্য করতে পারব না। তপনদের বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার, অনেক লোকজন। তাছাড়া গ্রামেও ওদের বহু আত্মীয়–স্বজন, সুতরাং দেখাশুনো করবার লোকের অভাব হবে না।

তপন কিন্তু ঠিক ধরে ফেলেছে যে আমি ওদের বাড়িতে থাকবার উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলুম। কলকাতার মানুষ এত দূরে কোনো গ্রামে বন্ধুর সঙ্গে ক্ষণেক দেখা করার জন্য আসে না। তাছাড়া তপন আমার স্বভাব জানে।

তপন বলল, তুই আমার পিসিমার বাড়িতে থাকবি, আমি বলে দিচ্ছি, ও বাড়িতে কারুর অসুখ করে নি!

কিন্তু সেটা একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। ওর পিসিমার বাড়িতে কারুকে চিনি না শুনি না…সুতরাং গল্প বানাতে আরম্ভ করলুম। দীঘা থেকে ফিরছিলুম, ব্রীজের ওপাশে বাস খারাপ হয়ে গেছে, সরকারি বাস, টিকিটের দাম ফেরৎ দেবে না, আমার কাছে পয়সা নেই, আজ কলকাতায় ফিরতেই হবে, কাল আমার চাকরির একটা ইন্টারভিউ, তপনের কাছে এসেছিলুম দশটা টাকা নেবার জন্য, অবশ্য ওর এই অবস্থা দেখে…।

তপন ওর বালিশের তলার মানি ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে দিল। অত টাকা আমি কিছুতেই নেব না, তপন দেবেই দেবে। অসুস্থ মানুষের সঙ্গে বেশিক্ষণ তর্ক করা যায় না।

বাজারে আমার গুডউইল আছে। বন্ধুবান্ধবরা আমাকে উদার ভাবে টাকা ধার দিতে দ্বিধা করে না। যারা ধার নিয়ে অমুক তারিখে ফেরৎ দেব বলে কথার খেলাপ করে তাদের ওপর লোকে রেগে যায়। আমি কক্ষনো কথা দিই না। বন্ধুরা এইসব টাকা আমাকে দান হিসেবেই দেয় বোধহয়, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করে না।

তপনও বলল, আমি সামনের সপ্তাহে কলকাতা যাচ্ছি, যদি সেরে উঠি ধর আগামী বেস্পতিবার, সেদিন দুপুরে তোদের বাড়িতে যাব।

আমি বললুম, তুই নিশ্চয়ই সেরে উঠবি। মাকে বলব, তোর জন্য থানকুনি পাতা দিয়ে সিঙ্গি মাছের ঝোল রান্না করে রাখতে।

তপনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। মনটা বেশ অস্থির হয়ে আছে, কিছুতেই কলকাতায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। কোথায় যাই?

বাতাসে বেশ একটা মনখারাপ ঘ্রাণ। আকাশ মেঘলা। একটা দোয়েল কোন্ গাছে বসে ডাকছে, দেখতে পাচ্ছি না।

গ্রামের রাস্তা দিয়ে অচেনা কেউ হাঁটলে অনেকেই ফিরে ফিরে তাকায়। এদিকে আজকাল সাইকেল রিক্সা চলে। একজন রিক্সাওয়ালা আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন? পানিত্রাস?

নামটা শুনে মনে পড়ল। হ্যাঁ, কাছেই তো শরৎচন্দ্রের বাড়ি। গেলে হয়। শরৎচন্দ্রের বাড়িটা আমার বেশ পছন্দ। বিশেষত দোতলার বারান্দাটা। শরৎচন্দ্র বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বাড়িতেই রাতটা কাটিয়ে যাবার আবদার ধরতুম।

ছুটির দিনে এখানে অনেকে আসে। আজ বাইরের কেউ নেই। বাড়ির পেছন দিকে একটা ধানের গোলা, সেখানে কিছু লোক জটলা করছে। আমি ওপরে উঠে গেলুম, কেউ আপত্তি করল না।

আফিং খেয়ে মৌতাত করার জন্য শরৎচন্দ্র এখানে ইজি চেয়ারে বসে থাকতেন। সম্পাদকরা লেখা চাইতে আসত এতদূর ধেয়ে। জলধর সেন, উপেন গাঙ্গুলী। তোষামুদেরা এসে বলত, আপনি রবি ঠাকুরের চেয়েও কত বড় লেখক। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর নেতৃত্বে কল্লোলের ছোকরা লেখকদের দলবলও এসেছিল একদিন। তাদের মধ্যে কে যেন ক্যামেরা এনেছে, শরৎচন্দ্রের ছবি তুলতে চায়, কল্লোলে ছাপবে। শরৎচন্দ্র আপত্তি করে বললেন, আহা–হা এই খোলটার ছবি তুলে কী হবে! একটু পরেই ভেতরে গিয়ে মুখে স্নো–পমেটম মেখে কাঁধে একটা মুগার চাদর ঝুলিয়ে এলেন! …সে ঘটনাটা কি এখানেই ঘটেছিল, না বাজে শিবপুরে?

সেই ফাঁকা বারান্দায়, কাঠের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমি শরৎচন্দ্রের সঙ্গে সংলাপ শুরু করলুম।

—এবারে পুজো সংখ্যায় ক’টা উপন্যাস লিখছেন?

—ক’টা? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? আমি আজকালকার এইসব লেখকদের মতন ঝুড়ি বরাদ্দে উপন্যাস লিখি? না না না, লেখাটেখার কথা আমাকে বলো না। আজকাল আমার লিখতে একেবারেই ইচ্ছে করে না!

—তবু?

—অ্যাঁ? তুমি কিছু খেয়েছ তো? মুখ শুকিয়ে গেছে দেখছি। দুধ–মুড়ি আর কলা খাবে! আমার খেতের ধানে মুড়ি হয়েছে, বেশ মুচমুচে। দুধও আমার বাড়ির গোরুর। এ গোরু আমি ভাগলপুর থেকে আনিয়েছি। কলাও আমার বাগানের। নিজে হাতে কলাগাছ পুঁতেছিলুম। অতি খাসা এক কাঁদি মর্তমান কলা ফলেছে। খেয়ে দ্যাখো।

–আহা, আজকালকার বেচারা লেখকরা! তাদের কারুরই বাড়িতে গোরু নেই, টাটকা দুধ কাকে বলে জানে না। নিজস্ব ধান জমি আর কলাগাছ…হায় রে! –দ্যাখো বাপু, আমিও অনেকদিন না খেয়ে–দেয়ে কাটিয়েছি। বার্মায় এক সময় এত ধার হয়ে গেসলো…

—তা তো জানিই। আপনি কত কষ্ট করেছেন। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আপনি ভগবান মানতেন?

—আমার লেখা পড়ো নি? কী মনে হয়?

—আপনার সব বই–ই স্কুল–বয়েসে পড়েছি, এখন ভালো মনে নেই। আপনার লেখা পড়লে বোঝা যায় না আপনি নিজে নাস্তিক কি না!

–শোনো, আমি নিজে কী বিশ্বাস করতুম না করতুম সেটা আলাদা কথা। কিন্তু এদেশে কোনো লেখক যদি নিজেকে নাস্তিক বলে প্রচার করে, তবে সে পাঠকদের কাছে কল্কে পাবে না। বঙ্কিমবাবুর ব্যাপারটাই দ্যাখো না, আগে শুধু রোমান্স লিখছিলেন, নিছক গল্পখোর পাঠকরা মুগ্ধ হয়েছিল, তার বেশি কিছু না। তারপর আনন্দমঠে যেই দুর্গা প্রতিমার একখানা বেশ রমরমা গোছের বর্ণনা দিলেন অমনি সবাই কেঁদে ভাসাল। ঠিক কিনা!

—কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো ঠাকুর দেবতার বর্ণনা দেননি কোথাও? বরং রাজর্ষিতে কালীপুজোর নিন্দেই করেছেন প্রকারান্তরে।

—উনি যে কথায় কথায় পরম ব্রহ্মকে নিয়ে আসতেন! উপনিষদ আর বৈষ্ণব সহজিয়াতত্ত্বকে হুইস্কি আর সোডার মতন মিলিয়ে দিতেন বেশ মাপে মাপে।

–আপনি রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করেন না, তাই না? উনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, আপনার ধারণা আপনারও নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত ছিল…

– আরে রামো রামো, এসব কী কথা? ছি ছি ছি ছি! উনি আমাদের সকলের নমস্য। বাপু হে, জানো তো, গঙ্গায়ই ঢেউ হয়। ঢেউয়ে কখনো গঙ্গা হয় না। আমরা হলাম গিয়ে ঢেউ। উনি গঙ্গা।

—এই কথাটা তো ছাপার জন্য আপনি আগেও অনেকবার বলেছেন।

—আমার কী পাওয়া উচিত ছিল না?

—কী?

—ঐ নোবেল প্রাইজ? মন্টু আমায় বলেছিল…যারা পায়, তারা কি সবাই আমার থেকে বড়?

—মোটেই না। কত সাহেব রাম–শ্যাম–যদু–মধু পায়! আপনার নিশ্চয়ই পাওয়া উচিত ছিল, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে থাকতেই। তাহলে বেশ মজা হতো!

—মজা?

– মাপ করবেন, আমার এক বন্ধু, রফিক, প্রায়ই এই রকম ক্ষেত্রে মজা কথাটা ব্যবহার করে। তাই আমার মুখে এসে গেল। সত্যি, আপনি নোবেল প্রাইজ পেলে আমরা খুব খুশি হতুম। একটা কথা জিজ্ঞেস করব? যদি অনুমতি দেন।

—নির্ভয়ে বলো!

—এই উনিশ শো চুরাশি সালে আপনি যদি একটা উপন্যাস লিখতেন, তা হলে কোন্ বিষয় নিয়ে লিখতেন!

—লিখছি তো! ওদের কি এড়ানো যায়? শারদীয় সংখ্যায় খান দুই তো লিখতেই হবে। অমুক আর অমুক কাগজ থেকে তমুক আর তমুক ঘন ঘন আসছে। ট্রেনে আসে না, নিজেদের গাড়িতে আসে। ওদের ভালো করে খাইয়ে দাইয়ে বলি, বাপু হে, এবার আমার লেখার হাত থেকে নিষ্কৃতি দাও। তা কি শোনে! অমুক কাগজের তমুক তো বললে, আজ অন্তত দুটো স্লিপ না দিলে উঠবই না!

—কী নিয়ে লিখছেন?

– আন্দাজ করো তো।

—আপনি এত বড় লেখক। আপনার মনের কথা কি আমি বুঝতে পারি? যদি একটু আভাস দেন–

–শোনো, বুঝিয়ে বলি! এখন, এই বর্তমান সময়ে…

দোতলার বারান্দায় কখন যে ধুতি আর ফতুয়া পরা একটি লোক উঠে এসেছে টেরও পাই নি। চটি ফটফটিয়ে লোকটি আমার কাছে এসে বার্লি–খাওয়া মুখ করে জিজ্ঞেস করল, আপনি?

অর্থাৎ আমি যদি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা এস.পি হই, তা হলে লোকটি আভূমি ঝুঁকে পড়ে নমস্কার জানাবে। আর আমি যদি নীললোহিত নামে এলেবেলে কেউ হই তাহলে লোকটি বলবে, আপনার এখানে কী চাই?

আমি প্রথমে মনে মনে বললুম, বোচন্দর, আমি শরৎচন্দ্রের সঙ্গে সিরিয়াস আলোচনা করছিলুম, তুমি সেটা নষ্ট করে দিলে? তোমায় আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তুমি কোনোদিন বই পড়ে আনন্দ পাবে না!

তারপর প্রকাশ্যে বিনীতভাবে বললুম, আমি এমনিই এদিকে বেড়াতে এসেছি। লোকটির মাথাটি ডিমের আকৃতির, চকচকে টাক। সেই টাকে হাত বুলোতে বুলোতে গম্ভীরভাবে বলল, কিন্তু আমরা যে দুপুরে বন্ধ রাখি?

আমি নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করলুম, কী বন্ধ রাখেন?

—এই বাড়ির দরজা!

–আর রাত্তিরে কী করেন

—অ্যাঁ? কী বলছেন!

–বলছি যে রাত্তিরে কি এ বাড়িতে কেউ থাকে?

—থাকে। ওপরে থাকে না।

—আমি থাকব!

–থাকব বললেই কি আর থাকা যায়। হে হে হে।

—কিন্তু আমায় থাকতে হবে। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে আমার কয়েকটা জরুরি কথা আছে!

–অ্যাঁ?

—রাত্তিরবেলা আমি এখানে থাকব, শরৎচন্দ্রের সঙ্গে আমার জরুরি কথাবার্তা আছে। উনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন!

ভদ্রলোক এবারে বারান্দা দিয়ে মুখ ঝুঁকিয়ে বললেন, ওরে হরু, একবার ওপরে আয় তো বাবা!

আমি এবারে দম ফাটিয়ে হা হা করে হেসে উঠলুম।

তারপর লোকটির কাছে গিয়ে কাঁধ চাপড়ে বললুম, আপনি ভাবছেন বুঝি আমি পাগল! হাওড়ার ডি.এম পি চৌধুরীর নাম শুনেছেন তো? আমি তাঁর শালা।

এমনভাবে কথাটা বললুম, যেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের শালা হলে তার যত খুশি পাগলামি করার অধিকার আছে।

লোকটির বিস্মিত মুখের সামনে ম্যাজিকের ভঙ্গিতে হাত তুলে আবার বললুম, ডি.এম সাহেব এদিকে ইন্‌সপেকশানে এসেছেন, নাউপালা ডাকবাংলোতে উঠেছেন। আমার বাংলোটা ভালো লাগল না। তলায় অফিস, অনেক লোকজন…।

ভদ্রলোক এবারে বললেন, ডি.এম সাহেব এদিকে এসেছেন! ওনার সঙ্গে…উনি বলেছিলেন…আমরা দেখা করতে…

আমি লোকটির দিকে এবারে বুদ্ধের ভঙ্গিতে অভয় মুদ্রা দেখালুম। তারপর বললুম, ডি.এম সাহেব আজ সন্ধেবেলা কিংবা কাল সকালে এখানে আসবেন আমি ওঁকে বলে এসেছি, আমি ডাকবাংলোতে থাকব না, এখানেই থাকব। রাত্তিরে একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন তো!

—নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই!

— গরমকাল, বিছানা–পত্তরের তো তেমন দরকার নেই, এই বারান্দাতেই শুয়ে থাকতে পারব।

—বিছানারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে স্যার!

এইরকম খেলা অনেকক্ষণ চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ধরা পড়ার ভয় কিছু নেই। দৈবাৎ যদি ডি.এম সাহেব এখানে এসে পড়েন হঠাৎ এবং আমাকে চিনতে না পারেন, তাহলে তাঁকে বললেই হবে, ইয়োর অনার, কিংবা স্যার, আপনি আমার বোনকে যে বিয়ে করেননি তার কারণ আমার বিবাহযোগ্যা ভগ্নী নেই, কিন্তু একদিন আপনি আমায় মধুর সম্বোধন করেছিলেন, হয়তো আপনার মনে নেই…

লোকটি বলল, আপনার জন্য একটা চেয়ার বার করে দেব স্যার?

আমি বললুম, এখন দরকার নেই। আমি একটু ওপারে কোলাঘাট যাচ্ছি, দেখি যদি ভালো ইলিশ–টিলিশ পাওয়া যায়। রাত্তিরে রান্নার ব্যবস্থা করতে হতে পারে—

–সেসব হয়ে যাবে স্যার।

সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর একটি সাইকেল রিক্সা পাওয়া গেল। ডি.এম– এর শালার হেঁটে যাওয়া উচিত নয়। অবশ্য বম্বে রোডে পড়েই রিক্সা ছেড়ে দিলুম। রিক্সা চেপে নদী পার হবো, আমি এতটা গাধা নই।

শরৎচন্দ্রের আমলে এই ব্রীজ ছিল না। আমরা ছেলেবেলাতেও তো শুনেছি, রূপনারায়ণ নদী খেয়াতে পার হতে হতো। ব্রীজগুলো খুবই প্রয়োজনীয়, তবু খেয়ার জন্য মন কেমন করতে লাগল।

এবারে বর্ষায় নদীর স্বাস্থ্য অতি চমৎকার

ওদিকে রেল ব্রীজের পাশে নাউপালা ডাকবাংলোটি দেখা যায়। হয়তো সেখানে সত্যিই আজ ডি.এম সাহেব এসেছেন। কোনো একটা ব্যাপার বানাবার পর সেটা আস্তে আস্তে আমার কাছে বাস্তব হয়ে ওঠে।

ব্রীজের মাঝখানে একটি বাচ্চা ছেলে একদৃষ্টে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। খুব বাচ্চা নয়, এগারো বারো বছর বয়স, কালো হাফ প্যান্ট আর সাদা কলার দেওয়া গেঞ্জি পরা। একা ঐ ছেলেটি কোথা থেকে এলো? ও কি ঘরছাড়া পলাতক? মগ্ন চোখ।

আমি ছেলেটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম।

ছেলেটির ঠোঁট নড়ছে, কী যেন বলছে ও। ঐটুকু ছেলে কথা বলছে নদীর সঙ্গে? এ রকম দৃশ্য আমি আগে কখনো দেখিনি।

ছেলেটিকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেলুম। রফিকের কথাটা মনে পড়ল, বয়েসে বড় হলেই দাদাগিরি ফলানো যায় না। ও আপন মনে রয়েছে, কেন আমি ওকে ডিসটার্ব করব?

আমার উপস্থিতির উত্তাপ বোধহয় ওর পছন্দ হলো না। একটু বাদে ছেলেটি রেলিং–এর ওপর হাত বুলোতে বুলোতে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। একবারও ভ্রূক্ষেপ করল না আমার দিকে।

তারপর সে ব্রীজের অন্য পারের রেলিং ধরে দাঁড়াল।

ঐ ছেলেটিকে ঘিরে রয়েছে এক মধুর একাকিত্ব। হয়তো ও এই গ্রহের কেউ নয়। যে গ্রহে কোনো নদী নেই ও সেখান থেকে বেড়াতে এসেছে।

ব্রীজটা পার হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার বেশ খিদে পেয়ে গেল। বেলাও যথেষ্ট হয়েছে। এখানে একটি উত্তম মাছ–ভাতের হোটেল আছে, আগে অনেকবার খেয়েছি। ইলিশের ডিম ভাজা পাওয়া যায়।

বেশ অনেকক্ষণ ধরে তারিয়ে তারিয়ে খেলুম। ভাত, ডাল, আলু ভাজা, মাছের ডিম ভাজা, শর্ষে–ইলিশ, আমড়ার টক। লেবু, কাঁচালঙ্কা। তারপর দই। রীতিমতন ভোজ। নিজের ওপর পরম একটা মায়া বোধ করছিলুম, যেন আগামী কাল আবার খেতে পাব কি–না ঠিক নেই, আজ আত্মার সাধ মিটিয়ে নেওয়া যাক।

হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে দেখলুম, আকাশ মেঘ–মেদুর। নরম ছায়ায় মানুষের মুখ বদলে গেছে।

কিছু না ভেবেই আমি কাঠ গুদামের পাশ দিয়ে চলে এলুম নদীর ধারে।

নদীর বুকে দূরে দূরে কয়েকটা মাছ ধরার নৌকো। বাতাস বইছে ফিনফিনে। নদীর ধারে কিছু ডাবের খোলা পড়ে আছে, তা ছাড়া জায়গাটা বেশ পরিষ্কার। বালির চেহারা দেখলে মনে হয় জোয়ারের সময় এই জায়গাটা ছাপিয়ে যায়।

সেই বালির ওপরে আসন পিঁড়ি হয়ে বসলুম। ব্রীজটা এখান থেকে পুরোটা দেখা যায়। সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ল, ওর ঠোঁট নড়ছিল। ও কি নদীর ভাষা জানে?

জলের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ জুড়িয়ে যায়। অন্তরীক্ষে যেন একটা বাঁশি বাজছে। এখন আর কিছুই মনে পড়ে না। সুন্দর এই পৃথিবী। দুর্লভ এই মানবজন্ম।

গতকাল রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি, আজ দুপুরের খাওয়াটাও হয়েছে জব্বর। একটু পরেই আমার চোখ টেনে এলো। আকাশে মেঘ বেশ ঘোরালো হয়ে এসেছে, একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। নামুক, তখন দেখা যাবে।

আমি বালির ওপর গা এলিয়ে দিলুম। চোখ বোজার পর দেখতে পেলুম বিচিত্র সব রং। মানুষ দু’চোখে কখনো দু’রকম জিনিস দেখে না। অথচ এখন যেন আমি দুটো রামধনু দেখতে পাচ্ছি। তারপর রামধনু মিলিয়ে গিয়ে জঙ্গল হলো। নিলয়দার সঙ্গে আমি জিপে করে পালাচ্ছি…অনেকদিন দেখা হয়নি নিলয়দাদের সঙ্গে…রফিক নতুন ফ্ল্যাট পেয়েছে, পার্ক স্ট্রিটে একুশতলায়, জানলা খুললেই গঙ্গা দেখা যায়, মাঝখানে রোমি দাঁড়িয়ে, দুপাশে আমি আর রফিক, আমি বললুম কলকাতার গঙ্গা আর দেখবার মতন নেই, বর্ষাকালে রূপনারায়ণ এত সুন্দর… রোমি বলল, রূপনারায়ণ নদী কোথায়? আমি কখনো দেখিনি, আমায় নিয়ে যাবেন?

….ইলিশ মাছের ডিম ভাজা…ঐ ব্রীজের ওপর একা বালকটির মতন আমার বয়েস, দিদিমা ঘরের মধ্যে আমায় ডেকে নিয়ে বলছেন, এই ডিম ভাজা খেয়ে নে তো নীলু! রাবণের গুষ্ঠি…কারুর ভাগে এক দানাও পড়বে না। খা, তুই ভালো করে খা…। দিদিমা শুয়ে আছেন, তাঁর বিছানা ঘিরে অনেক মানুষ, ঘনিয়ে এসেছে শেষ নিশ্বাস, তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, নীলু, নীলু কোথায়? …দিদিমার মুখটা মিলিয়ে গেল…সেই ডিমওয়ালী বুড়ি, কোমরে হাত দিয়ে বলল, শরীরটা ভালো নেই, রোজার মাস…বাবা, তুমি একদিন আমাদের বাড়িতে আসবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *