ভবিষ্যতের পূর্বাভাস
বইথিউস যখন পঞ্চম শতাব্দীতে কারাকক্ষে বসে তাঁর ডি কনসোলাতিওনে ফিলজফিআ রচনা করেন, তখন তাঁর ওপর মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা ঝুলছে। এ গ্রন্থে তিনি দর্শনের দেবী ও নিজের মধ্যে একটি কাল্পনিক সংলাপ লেখেন। দর্শন তাঁকে শিখিয়েছিল যে, ‘মানুষের জীবনের নশ্বর ঘটনাগুলি দিব্যস্বরূপের স্থিরত্ব ও স্থায়ী সরলতা থেকে উত্থিত। সব ঘটনার কেন্দ্ৰেই বিধাতা। কিন্তু পরিবর্তনশীল ঘটনাবলির মধ্যে যখন আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছার সন্ধান করি তখনই আমরা নিয়তির মুখোমুখি হই, কারণ এগুলি নিয়ন্ত্রণ করে নিয়তিই। নিয়তি প্রত্যেক স্বতন্ত্র বস্তুর সম্বন্ধে স্থান ও কাল নির্ধারণ করে দেয়।’(৪:৬:১) যা কিছু মানুষের কর্মস্বাতন্ত্র্য নষ্ট করে তার সম্বন্ধে ঈশ্বরের এক অভ্রান্ত পূর্বজ্ঞান আছে। এই দিব্য পূর্বজ্ঞান অনন্তকালের দ্বারা (ঈশ্বরের) একটি অন্তর্নিহিত গুণ রূপে নিরূপিত হয়।’ (৫:৩:২৬) গ্রন্থকারের দর্শন তাঁকে সান্ত্বনা দেয় যাতে তিনি বিধাতা ও নিয়তির মধ্যে এক সংগতি সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষ দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে এ সংগতি নির্মাণ করতে পারে না। তবু সে ভবিষ্যৎকে জানবার জন্যে উদগ্র ভাবে আকাঙ্ক্ষা করে। লখীন্দরের ওপরে শাপ ছিল বাসররাত্রেই তার মৃত্যু হবে, সর্প দংশনে। বেহুলা, চাঁদ সদাগর, সনকা সকলেই তা পূর্বাহ্নে জানতে পেরেছিল এবং যে কারণে মানুষ ভবিষ্যতের পূর্বাভাস জানার জন্য এত ব্যাকুল, সেই অমঙ্গলের প্রতিকারের চেষ্টাতে মানুষের বোধবুদ্ধির চূড়ান্ত ব্যবহারের দ্বারা সম্পূর্ণ নিশ্ছিদ্র একটি লৌহবাসরকক্ষ নির্মিতও হয়েছিল। কিন্তু নিয়তি তো অপ্রতিরোধ্য, তাই যা ঘটবার ঘটল। ঠিক যেমন সত্যবানের পরমায়ু সম্বন্ধে সাবিত্রী বিয়ের আগেই জানতে পেরেছিল এবং নির্দিষ্ট দিনে যম এসে সত্যবানের প্রাণকে দেহ থেকে নিষ্কর্ষণ করে নিয়ে চলল। অর্থাৎ, নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে।
কিন্তু এ দু’ ক্ষেত্রেই মানুষের চেষ্টা নিয়তিকে প্রতিহত করেছিল; সে আলোচনা যথাস্থানে হবে। এখানে প্রাসঙ্গিক এইটুকুই যে, পূর্বাভাস পেয়ে নিয়তিকে ঠেকানো যায় না; শুধু পূর্ব হতে জানা যায় মাত্র; অন্তত গল্পকাহিনিতে জানা যায়; এবং ঠেকাবার উদ্দেশ্যে এই পূর্বাভাস পাওয়ার জন্যে মানুষের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা চিরদিনই, সর্বত্রই।
মানুষের জীবনে যা ঘটে সে সম্বন্ধে পূর্বজ্ঞানের সম্পূর্ণ অভাব ও সেই অনুপাতে আতঙ্ক থেকেই নিয়তিবাদের উদ্ভব। মানুষের এ জীবনে এবং পরজন্মে যা ঘটবে তা পূর্বাহ্নেই জানবার জন্য মানুষ কী-ই না দিতে পারে। যেহেতু এর কোনও সমাধান নেই, এবং যেহেতু, মানুষের বর্তমান ও অতীতের মধ্যেই শুধু নয়, তার বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে এক দুর্ভেদ্য যবনিকা দুলছে, তাই পৃথিবীর সর্বদেশে সর্বকালে মানুষ এমন কিছু পূর্বাভাসের সন্ধান করে ফিরেছে যা তাকে অবহিত করবে, আগামী ঘটনার জন্যে প্রস্তুত করবে। আগামীকে জানবার জন্যে মানুষ যত উপায় উদ্ভাবন করেছে, তার একটা হল স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা।
ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-তে শঙ্করাচার্য দৈবজ্ঞদের অন্বয়-ব্যতিরেক-কুশল বলেছেন, অর্থাৎ যাঁরা কার্যকারণ সম্বন্ধের অস্তিত্ব বা অভাব বুঝতে পারেন। তাঁরা জানেন, কেমন করে কোনও কোনও বাস্তব ঘটনা স্বপ্নবস্তুর সহচারী বা অনুগামী হয়।’ (হালবফাস, ১৯৯১, ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২:১:১৪’র ওপরে পাদটীকা) কাজেই কিছু লোক ছিল যারা স্বপ্নের ভাষ্য করে উপার্জন করত, এরা সর্বদেশে সর্বকালেই ছিল, আছেও। স্বপ্ন হিসেবে কোনও উল্লেখ সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদে নেই। এর অর্থ এই নয় যে, লোকে দুঃস্বপ্ন দেখে উদ্বিগ্ন হত না; নিঋতির বা যমের পুত্রের নাম দুঃস্বপ্ন। (অথর্ব বেদ ৬:৪৬:১,২; ১৬:৫:১-৩) কাজেই দুঃস্বপ্নের অশুভ অনুষঙ্গ ছিলই; শুধু সে সব স্বপ্নের বা তার অর্থের উল্লেখ নেই। এগুলি দেখা দিল ঠিক জন্মান্তর ও কর্মবাদের উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গেই। নিয়তিবাদেরও সূচনা ঠিক এই সময়ে। অর্থাৎ স্বপ্ন ও তার তাৎপর্যের কথা আমরা প্রথম পাই মহাকাব্যেই। এই স্বপ্নব্যাখ্যা পুরাণ ধর্মশাস্ত্র থেকে আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
মহাকাব্যের প্রথম পর্যায়ের রচনার সমকালীন হল পালি জাতকগুলি। সেখানে দেখি :
বারাণসীর মহিষী খেমা স্বপ্নে একটি সোনার ময়ূর দেখে তাকে রাজধানীতে আনালেন, (ইনি বোধিসত্ত্ব), যাতে তাঁর কাছে ধর্মকথা শুনতে পান। (মহামোর, ৪৯১) এই রানিই আবার স্বপ্ন দেখলেন একটি সোনার রাজহাঁসের এবং জটিল কৌশলে সেটিকে ধরে আনলেন, (ইনিও বোধিসত্ত্ব), ইনি রানির কাছে ধর্মকথা প্রচার করলেন। (মহাহংস, ৫৩৪) ভোররাতে এক রাজা স্বপ্ন দেখলেন (জনপ্রবাদ, ভোরের স্বপ্ন সফল হয়) রক্তবস্ত্র পরিহিত এক কৃষ্ণকায় ব্যক্তি— রক্তপুষ্প দিয়ে যে তার কর্ণকুণ্ডল তৈরি করেছে— এসে গুণরূপ শাখাবিশিষ্ট একটি জ্ঞান বৃক্ষকে একেবারে মূল থেকে কেটে ফেলল। রাজা বুঝলেন তার প্রিয় মন্ত্রী বিধুরপণ্ডিতের মৃত্যু আসন্ন, এবং সত্যিই দুষ্ট লোকের কুচক্রান্তে তাঁর মৃত্যু ঘটল। (বিধুরপণ্ডিত, ৫৪৫) অন্য এক রাজা এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন; ছোট একটি স্ফুলিঙ্গ যেন চারটি জ্বলন্ত স্তম্ভের চেয়ে বেশি দেদীপ্যমান। এক বুদ্ধিমান ব্যাখ্যাতা রাজাকে বললেন, শীঘ্রই রাজা এক তরুণ পণ্ডিতের সন্ধান পাবেন যার কাছে তার চার মন্ত্রী নিষ্প্রভ হয়ে যাবেন। বাস্তবে তা-ই ঘটল। (মহাউস্মগ্গ, ৫৪৬) বিখ্যাত বেসসন্তর জাতকে নির্বাসিত রাজকুমার বেসসন্তর অরণ্যে স্ত্রী মাদ্রী ও পুত্রকন্যা নিয়ে খুব কষ্টে ছিলেন। একরাত্রে মাদ্রী স্বপ্ন দেখলেন যেন তাঁর হাত-পা ও বক্ষোদেশ উৎপাটিত হচ্ছে এবং তার রক্তক্ষরা হৃৎপিণ্ডটি যেন এক কুদর্শন ও কুবেশ ব্যক্তি ধরে মুচড়ে ফেলছে। স্বপ্ন এমন ভাবে ফলল যে, পুত্রকন্যা সহ তিনি এক দুব্রাহ্মণের হাতে ক্রীতদাসীর মতো নিগৃহীত হলেন। পরে মাদ্রীর শ্বশুর স্বপ্নে কিছু ফুল দেখেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারেন তাঁর পৌত্রপৌত্রীকে দেখতে পাবেন। এ স্বপ্ন সেই ভাবেই সফল হল (বেসসন্তর, ৫৪৭)
রামায়ণে রাক্ষসী ত্রিজটার স্বপ্নে রাবণের অমঙ্গল সূচিত হয়। (৫:২৭ পুরো অধ্যায়ে স্বপ্নটির বিশদ বর্ণনা, তাতে আসন্ন বিপদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে) অর্বাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কংসের স্বপ্নের বিবরণে কংসের বিনাশের সূচনা আছে। এটিতে লক্ষ্য করি একটি প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব। রক্তবসনা নারী, রক্তপুষ্পহারে সজ্জিতা, অসি-খঙ্গধারিণী, প্রচণ্ড অট্টহাসি হাসছে। কংস তার বর্ণনা করে:
‘আমার রাজপুরীতে নাচছে, কেশ উন্মুক্ত ও বিস্রস্ত, নাসিকা কর্তিত। আর এক জন কৃষ্ণবর্ণা শূদ্র বিধবা, কৃষ্ণবসনা, রুক্ষকেশা মলিনবসনা— সে এসে (কংসের) কপালে আর বুকে তিলক এঁকে দিল। কালো পাকা তালফল গাছ থেকে মাটিতে পড়ে প্রচণ্ড শব্দ করে এ-দিকে সে-দিকে ছড়িয়ে গেল। এক ম্লেচ্ছ, রুক্ষ এলোমেলো চুল, পরনে কুৎসিত কাপড়, ভোরের দিকে আমাকে ভাঙা মুদ্রা দিচ্ছিল, আর ভরা কলসিগুলো ভাঙছিল। এক দেবী, গলায় টাটকা জবাফুলের মালা, আমার ওপরে খুবই রেগে ছিলেন। বানর, কাক, কুকুর, ভাল্লুক, শুয়োর, গাধারা মিলে বিকট শব্দ করছিল। সকালে দেখা গেল, নখের কুচির একটা স্তুপ, একবোঝা কাঠ, কাজল, কঙ্কাল ও নরমুণ্ডের সামনের অংশটা। হলুদ কাপড় পরা একটি মেয়ে, শ্বেতচন্দনে লিপ্তদেহ, মালতী ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে এল, গায়ে অনেক গহনা, হাতে লীলাপদ্ম, কপালে সিঁদুরের টিপ। আমাকে প্রচণ্ড গালাগাল করে সে রেগে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। দেখলাম ভয়াবহ আকৃতির লোকেরা ফাঁস হাতে নিয়েছে, তাদের খোলা চুল উঠছে। এলোচুলে ছেলেরা ও মেয়েরা বাড়ি বাড়ি নেচে বেড়াচ্ছে। এক খাঁদা স্থূল শূদ্র বিধবা, নগ্ন তার দেহ, এসে ভয়াবহ ভাবে আমার গায়ে তেল মাখিয়ে দিয়ে গেল। খুব ভোরে দেখলাম একটি চিতা, শুনলাম বাড়ি বাড়ি বিয়ের গান আর নাচ। দেখলাম, একজন রক্তকেশ, রক্তবেশ, রক্তবমি করছে। গ্রহণের সময়েও চন্দ্র সূর্য দেখতে পেলাম। ধূমকেতু আর উল্কা খসে পড়ছে, ভূমিকম্প, বিপ্লব, ঝড় ও অন্য অনেক অশুভ ঘটনা ঘটছে, যেমন কাণ্ডসুদ্ধ গাছগুলো ঝড়ে ঘুরছে, পাহাড় ধসে পড়ছে মাটিতে। দেখলাম উলঙ্গ কবন্ধরা বাড়ি বাড়ি নেচে বেড়াচ্ছে। শুনলাম চারিদিকে মানুষ বিলাপ করছে।’ (কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৬৩:৩-৩০)
এ স্বপ্নের বহু উপাদানের সঙ্গে লৌকিক বিশ্বাস ও আচরণ অনুষ্ঠানের যোগ আছে: মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত লোককে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় লাল কাপড় ও জবাফুলের মালা পরানোর রীতি ছিল। শূদ্র, দুর্লক্ষণ, বিধবা হলে দ্বিগুণ অশুভ। যে দিব্য নারী কংসের গৃহ ত্যাগ করে গেলেন, সহজেই বোঝা যায়, তিনি তার রাজ্যলক্ষ্মী ও ভাগ্যলক্ষ্মী; তাঁর প্রস্থান কংসের প্রতাপ ও সমৃদ্ধির আসন্ন বিনাশ সূচিত করে। পুরুষের এবং আরও বেশি করে নারীর মুক্ত ও অবিন্যস্ত কেশ বিশেষ ভাবে অশুভ বলে গণ্য করা হত। ম্লেচ্ছ অস্পৃশ্য, অশুচি, তার উপস্থিতি বিপদের সংকেত দেয়। পাকা তালফল খসে গড়িয়ে পড়া যুদ্ধে সৈন্যদের মাথা খসে পড়ারই রূপক
কংসের বিনাশের সম্বন্ধে আরও একটি স্বপ্নের উল্লেখ পাই। কংস স্বপ্নে দেখে কুকুর, কুমির, শেয়াল, ভষ্মস্তূপ, অস্থিস্তূপ, তালফল, চুল, কাঁচা তুলো, নেবানো মশাল, চিতায় শবদেহ, কুমোরের চাক, ঘানি, বাঁকানো কড়ির মুদ্রা, শ্মশান, নেভা পোড়া কাঠ, শুকনো কাঠ, কুশ ঘাস, চলন্ত প্রেত, কথাবলা নরমুণ্ড, শ্মশানের ছাই, শুকনো পুকুর, পোড়া মাছ, লোহা, আগুনে পোড়া বাগান, ঘা থেকে পুঁজ-পড়া কুষ্ঠী, খোলা চুলে উলঙ্গ শূদ্র, ভীষণ রাগী বামুন গুরুকে শাপ দিচ্ছে, ক্রুদ্ধ ভিখারির শাপ সন্ন্যাসী আর বৈষ্ণবদের। (ব্রহ্মবৈবর্ত কৃষ্ণজন্মখণ্ড, ৭২:৭০-৭৯) এ সব অনুপুঙ্খই অশুভ চিহ্ন, কংসের ধ্বংসের পূর্বাভাস।
সতীর দেহত্যাগের পর ক্রুদ্ধ শিব যখন দক্ষযজ্ঞ বিনাশ করেন তখন দক্ষের স্ত্রী প্রসূতি স্বপ্নে আগামী ঘটনা দেখেন এবং সতীর কাছে বিবৃত করেন। (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. মধ্য ৭:৬-১৫) আগামী দুর্ঘটনার সংকেতবহ বহু স্বপ্নের কথা মহাভারত-এ আছে, সেগুলি সবই ঘোর ও অশুভ। ললিতবিস্তর ও অন্যান্য বৌদ্ধগ্রন্থে মায়াদেবীর দেহে শ্বেতহস্তী প্রবিষ্ট হওয়ার স্বপ্ন বুদ্ধের আগমনবার্তা বহন করে। সুদর্শনের সঙ্গে কাশীরাজকন্যা শশিকলার আগামী মিলনের আশ্বাস রাজকন্যা স্বপ্নেই পান। (দেবীভাগবত পু. ৩:১৭:১৪) অসুররাজ বাণের কন্যা ঊষা কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধকে স্বপ্নে দেখেন, অনিরুদ্ধও ঊষাকে স্বপ্নেই দেখেন এবং দুজনেই স্বপ্নে জানতে পারেন তাঁদের আসন্ন মিলনের কথা। (ঐ ৭২:১১৪) ওখানে একটি পুরো অধ্যায় জুড়ে বিবৃত আছে বহু দুঃস্বপ্নের বিষয় (৮২ অধ্যায়); সেখানে স্বপ্নগুলির ভাবী ফলও বলা আছে— ক্ষতি, ব্যাধি, বিপদ ও মৃত্যু।
স্বপ্নব্যাখ্যার ভূমিকা সারা পৃথিবীতেই বিশেষ কিছু ‘জ্ঞানী’ ব্যক্তির পেশা হয়ে ওঠে। ভূমধ্যসাগরীয় জগৎটা মিশরকেই অতিলৌকিক ক্রিয়াকারী, ধর্মতাত্ত্বিক ও গোপন জ্ঞানের পীঠস্থান বলে জানত। (দেবী) আইসিসের আরাধনায় নিযুক্ত থাকত এক পুরোহিত যার বিশেষ নাম ছিল আরেটালোগোস। (পবিত্র বাণীর উদগাতা) সে ছিল স্বপ্নের ব্যাখ্যাতা, হয়তো ভাবী অতিলৌকিক ঘটনা ঘোষণা করাও তার কাজ ছিল।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন, ৯ম খণ্ড, ‘মাইক্রোনেসিয়ান ধর্মগুলি: অলৌকিক নির্ধারণ’, পৃ. ৫৪৪) ইলিয়াডে আমরা পড়ি ‘জেউসের কাছ থেকেই স্বপ্ন আসে…’ (১:৪৩ থেকে) স্বপ্ন তা হলে ঈশ্বরের প্রেরিত, যে-ঈশ্বর মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা এবং কখনও কখনও তাঁর মর্জি হলে মানুষের ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে তা তাদের জানিয়ে থাকেন।
সিবিলিয়ান বুকস-এ সিবিল (ভাবি-বক্তা)-এর ছন্দোবদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী সংকলিত হয়েছে (তা ‘দাম্ভিক টারকুইন’-এর কাছে বিক্রীত হয়েছিল বলে শোনা যায়)। এতে আছে ‘প্রথমত আত্মা যা দেবতাদের সমগোত্র, তার নিজেরই শক্তি আছে ভবিষ্যৎ দেখার; দ্বিতীয়ত, বাতাস সত্যের চিহ্নধারী অমর আত্মায় পরিপূর্ণ; এবং তৃতীয়ত, মানুষ ঘুমোলে দেবতারা স্বয়ং তাদের সঙ্গে কথা বলেন… মানুষ যখন মৃত্যুর সন্নিকটে আসে তখনই ভবিষ্যতের সম্বন্ধে তার দৃষ্টি স্বচ্ছতম হয়।’ (ঈনীড ১:৩০) এখানে স্বপ্ন সম্বন্ধে মানুষের বিশ্বাসের একটি সূত্র পাওয়া যায়: স্বপ্নে দেবতা মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, কাজেই স্বপ্ন যেন নিয়তি সম্বন্ধে এক দিব্য প্রকাশ, কারণ স্বপ্নে দেবতাদের বাণী পাওয়া যায়। মৃত্যুর কাছাকাছি এসে যে স্বচ্ছ বা অলৌকিক দৃষ্টি পাওয়া যায় তা হল জাগ্রৎ অবস্থায়, দেবতার সঙ্গে সংলাপেরই অন্য একটি রূপ এবং সেহেতু নিয়তি সম্বন্ধে একটি প্রাগ্-বোধ।
‘স্বপ্ন সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া এবং তা ব্যাখ্যা করার বিদ্যা মিশরে ও প্রাচ্যের অন্যত্রও খুব সমাদৃত ছিল। (লক্ষণীয়, বাইবেলে জোসেফ ফারাও’র স্বপ্ন ব্যাখ্যা করছেন, জেনেসিস ৪০:৪১) ১২২ নং প্যাপিরাসে ৬৪ পঙক্তি থেকে ৩৫৯ পঙক্তি পর্যন্ত স্বপ্ন নির্মাণের প্রণালী দেওয়া আছে, ‘দিব্যদর্শন পাওয়া। স্বপ্ন পাওয়ার প্রক্রিয়া…’ (বাজ, ১৯৭২, পৃ. ২১৪, ২১৬)
ফ্রয়েডের স্বপ্ন সম্বন্ধে প্রামাণ্য গ্রন্থটি (দি ইন্টারপ্রেটেশন অব ড্রিমস) প্রকাশের পর প্রায় এক শতাব্দী অতিক্রান্ত; কার্ল ইয়ুঙ ও অন্যান্যদের এ বিষয়ের কাজও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে; তবু এই একবিংশ শতকে এসেও স্বপ্ন সম্বন্ধে মানুষের মনে দৃঢ়প্রোথিত যে সব ধারণা ও সংস্কার হয়েছে তা এতই প্রবল যে এখনও দুঃস্বপ্ন প্রায় সব মানুষকেই বিচলিত করে তোলে, যেন নিয়তি দুঃস্বপ্নের মাধ্যমে ভাবী দুর্ঘটনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। স্বপ্নের সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক গৌণ; মানুষ তার পাপ কর্ম দিয়ে মন্দভাগ্য অর্জন করে এবং এ সংবাদ নানা অতিপ্রাকৃত মধ্যস্থতায় আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়, এগুলিরই একটি হল স্বপ্ন। লক্ষণীয়, সর্বদেশে, সর্বকালে এক শ্রেণির স্বপ্নভাষ্যকার আছে যারা যথাযথ স্বপ্ন ব্যাখ্যা করতে পারে বলে দাবি করে। যখন মায়াদেবী স্বপ্নে শ্বেতহস্তীকে তাঁর কাছে আসতে দেখেন, তখন সে কথা শুনেই শুদ্ধোদন পেশাদার স্বপ্নভাষ্যকারদের ডেকে পাঠান, যারা এসে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে পুরস্কৃত হয়। জীবনে আমরা অধিকাংশ স্বপ্নই ভুলে যাই, তার মধ্যে এমন বহু স্বপ্নই থাকে যা ভাষ্যকারদের মতে তাৎপর্যপূর্ণ ও সফল হত। আমাদের যা মনে পড়ে, অথবা মনে পড়ে বলে অনুমান করি, তা মনে পড়ার কারণ হল কোনও ঘটনা ঘটবার পরে সম্ভাব্য কোনও স্বপ্নকে আমরা তার সঙ্গে মিলিয়ে নিই কল্পনার। বহু সহস্রাব্দের প্রাচীন এই স্বপ্ন সম্পর্কিত বিশ্বাসটি সহজে যাওয়ার নয়। যখন স্বপ্ন ফলে না, তখন সর্বদাই একটি ছিদ্রের সন্ধান পাওয়া যায়, যা দিয়ে তার ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে; কখনও স্বপ্নের দ্রষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ভুল ব্যাখ্যার ইন্ধন জোগানোর জন্যে, কখনও ব্যাখ্যাকারের ওপরে দোষ দেওয়া হয় ভুল ব্যাখ্যার জন্য। আর জেগে ওঠার পর বিলীয়মান দুরাঘ্রাত পুষ্পগন্ধের মতো স্বপ্নের স্মৃতি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। যেহেতু নিয়তি একটি অন্ধকারাবৃত অঞ্চল, তাই ভাবী ঘটনা সম্পর্কে বা সেই অনাগত ভবিষ্যতের ওপরে আলোকপাত করবে এই আশায় যে কোনও অস্পষ্টতম, ভঙ্গুরতম আভাসকেও মানুষ স্বাগত জানায়, কারণ আমাদের ইচ্ছাপূরণের প্রয়োজনে ও আভাসের অধিকাংশকেই আমরা ভেঙেচুরে, বাঁকিয়ে সাজিয়ে ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি। ঠিক এই কারণেই স্বপ্নকে এখনও তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হয়, যদিও স্বপ্ন ও তার ভাষ্যগত ব্যাখ্যার সঙ্গে ঘটনার অসংখ্য গরমিল দেখা গেছে।
এই ধরনের অন্যান্য অতিলৌকিক পূর্বাভাসের মধ্যে আর একটি হল, ভবিষ্যদ্বাণী, দৈববাণী ও সংকেতনির্ণয়। এ সবের মধ্যে দিয়ে যা আভাসিত হয়, তা হল ভাগ্য বা নিয়তি। নিয়তির প্রাকৃশর্ত মানুষের ভাগ্যের এক নিয়ন্তা যিনি ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করেন, মানুষের জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা সংস্থাপন করেন। দৈববাণী সাধারণত মানুষের গোষ্ঠীগত ভাগ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কিন্তু সংকেতনির্ণয় সচরাচর ব্যক্তির ভাগ্যের সঙ্গেই যুক্ত। সংকেত নির্ণয় প্রকৃতপক্ষে দিব্যদৃষ্টির অধিকারের দাবি করে, অর্থাৎ একটি ভূমিকায় দেবতার প্রতীক হওয়া।
‘সংকেত নির্ণয়, যার দ্বারা দৈব অসন্তুষ্টি জানা যেত, তা তিন রকমের ছিল; শাকুনশাস্ত্র, পবিত্র জন্তুর অস্ত্রপরীক্ষা এবং পাশার দান… এই ভাবে এক সুদূরবিস্তৃত নেতি-নেতি প্রক্রিয়ার দ্বারা ক্রমে ক্রমে সেই বিশেষ অপরাধটি ধরা পড়ত, যার জন্য প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন ছিল। সংকেতনির্ণয় বিদ্যাটি হিটাইটরা ব্যাবিলনীয় পণ্ডিতদের কাছ থেকে পায়। মানুষের ভাগ্যের চিহ্ন ঈশ্বর প্রেরণ করেন— অতিলৌকিক ঘটনায় তা প্রকাশ পায়, এই রকম মনে করা হত। জন্তুর অস্ত্রপরীক্ষা জনপ্রিয় দৈবজ্ঞানের প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে প্রধান ছিল।’ (এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ম্যাক্রোপিডিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯১) এই পরীক্ষার দ্বারা অস্ত্রের অবস্থান ও প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে ভাবী ঘটনার আভাস নিরূপণ একটি আপাতবিজ্ঞানের রূপ নিয়েছিল।
‘ধর্মকে সাক্ষী হিসেবে আহ্বান করে আত্মসাধুতার পরীক্ষার জন্য প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণিত যে ‘সত্যক্রিয়া’ তা আদিম সমাজগুলিতে যেখানে আইন বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অবকাশ কম ছিল, (সেখানে) প্রচলিত ছিল। এর দ্বারা সমাজ যাকে কোনও অপরাধের জন্যে অভিযুক্ত করেছে সেই ব্যক্তির পাপ অথবা নিষ্পাপতা প্রতিপাদন করা হত। পশুর অস্ত্রপরীক্ষার উদ্দেশ্য হল, নির্দিষ্ট কোনও অপরাধ জানা, যাতে তার প্রতিকার বা প্রায়শ্চিত্ত করা যায়। অজ্ঞানের এই পরিসরটির জন্যেই বিপদ, দুর্ঘটনা, ব্যাধি এ সব গুলিকে দিব্যবিচার ও দণ্ড মনে করা হত; এতে সন্দেহাকুল মানুষের মনে হঠাৎ একটি অপরাধবোধ সঞ্চারিত হত, এবং এ সব দুর্বিপাকের কারণ জানবার জন্যে সে অস্থির হয়ে পড়ত। তাই ‘বর্তমানের ওপারে যেখানে মানুষের দৃষ্টি যায় না, অন্ত্রপরীক্ষার উদ্দেশ্য হল সেই ওপারে, সাধারণ ভাবে জ্ঞানাতীত তথ্যকে জানবার জন্য একটি বঙ্কিম পন্থায় অতিলৌকিকের কাছে আবেদন করা।’ (প্রেসলার ১৯৭১, পৃ. ৫৯, ৬৬)
সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে দৈববাণীর প্রয়োজন হয় যে তার ভবিষ্যৎ জানতে উৎসুক, যাতে সে আগামী দুর্ঘটনা ঠেকাবার ব্যবস্থা করতে পারে। সে যেহেতু জানে যে, যেখানে তার ভাগ্য অগোচরে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, সেখানে জ্ঞান ও অনুমান পৌঁছয় না, তাই তার উদ্বেগ তাকে কোনও মতে অজ্ঞানের আড়ালটা সরিয়ে ভবিষ্যৎকে জানতে প্রণোদিত করে। ‘দৈববাণী হল মানুষের ব্যক্তিগত ভবিষ্যতের তাৎপর্য, অথবা আরও বেশি করে বর্তমান ও অতীত ঘটনার তাৎপর্য জানার কৌশল ও প্রক্রিয়া। স্বপ্নবিদ্যা (ওনেইরোম্যান্সি) ইচ্ছা ব্যতিরেকেই সংঘটিত শারীরিক ক্রিয়া, দেবতার ‘ভর’, মৃতের সঙ্গে সংলাপ (নেক্রোম্যান্সি), জীবজন্তুর আচরণ লক্ষ করা… ধরে নেওয়া হয়, সব রকম ভর ও দৈববাণীর পেছনেই রয়েছে একটি রহস্যময় অযৌক্তিক জগৎ যার নিয়ন্তা এমন কিছু ব্যক্তিগত শক্তি যাঁরা মানুষের জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যাদের সহজেই আঘাত করা যায়। হয়তো এটা অনিবার্যই যে, সেই সব সভ্যতার সামাজিক কেন্দ্রে দেবতাদের অনির্দেশ্য ইচ্ছা বুঝে ফেলার একটা চেষ্টা চলে… পণ্ডিত পুরোহিতেরা জটিল শাকুনশাস্ত্র অনুষ্ঠান করে দেবতাদের ইচ্ছার ব্যাখ্যা করেন, তেমনই নিম্নবর্গের মধ্যে ‘ভর’; আরও অনেক অহেতুক ও জটিল নিমিত্তশাস্ত্রের দ্বারা ব্যক্তি-ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের আভাস পাওয়া যায়।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন, ১৯৮৭, ‘ডিভিনেশন’ পৃ. ৩৭৫, ৩৭৭, ৩৭৮) প্রাচীন গ্রিসে, সম্ভবত সব প্রাচীন সংস্কৃতিতেই অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় নিয়তিকে জানবার চেষ্টায় মানুষ নানা রকম প্রক্রিয়া অবলম্বন করত। গ্রিসেই সম্ভবত এর সবের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায়। ভবিষ্যদ্বাণী, দৈববাণী, নিমিত্তনিদান, পশুর অস্ত্রনিরীক্ষা, মৃতের সঙ্গে সংলাপ, শাকুনশাস্ত্র, শুভাশুভ চিহ্নবিচার— সব ক’টিরই উদ্দেশ্য ছিল অজ্ঞানের পর্দাটা ছিঁড়ে দেওয়া। ইলিয়াডে অন্ধ ভবিষ্যদ্বক্তা টিরেসিয়াস ছাড়াও অডিসিতে পেট্রোক্লাস-এর প্রেতও ভবিষ্যৎ বলে; ঋষিদের বংশধররা ভবিষ্যদ্বাণী করে। ডোডোনার ওক ও লরেল গাছ থেকেও নাকি দৈববাণী হত।
সিবিলিয়ান বুকস-এর একটি পুরো অধ্যায় (১:৩৮) এর উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যদ্বাণীর যুক্তিগত সমর্থন জোগানো। যে ভবিষ্যদ্বাণী করে, সে দিব্য শক্তির দ্বারাই অনুপ্রাণিত। ইসলামীয় সংস্কৃতিতে একটি প্রচলিত পদ্ধতি ছিল শরনিক্ষেপের দ্বারা ভবিষ্যতের গণনা।
আজীবিকরা ভাগ্য গণনার ও স্বপ্নের অর্থ ও নিমিত্ত ব্যাখ্যার একটি জটিল প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করে। এই ধরনের ভবিষ্যজ্ঞানের ভিত্তি হল, সব কিছুই পূর্বনিরূপিত এবং মানুষের চেষ্টায় কোনও কিছুই পরিবর্তিত হয় না— এমন একটি বিশ্বাস। আজীবিকরাই ছিল পরিপূর্ণ ভাবে নিয়তিবাদী। লোকায়তিক বা চার্বাকপন্থীদের মতো তারাও কার্যকারণবাদকে প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু আজীবিকরা ভাগ্যের কাছে ভবিষ্যদ্বাণীর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছিল, যা তাদের নিয়তিবাদকেই পুষ্ট করেছিল— এটা চার্বাকপন্থীরা করেনি।
দৈববাণীর খবর পাওয় যায় প্রাচীন চিন, মিশর, সুমের, আসিরিয়া, ব্যাবিলোনিয়া, গ্রিস এবং মেক্সিকো থেকেই। ভারতবর্ষেও সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই নিজস্ব পদ্ধতিতে দৈববাণী ও তার ব্যাখ্যা করত, কিন্তু যেহেতু শুধু উচ্চবর্গের মানুষের কথাই শাস্ত্র ও সাহিত্য মারফৎ পাওয়া গেছে, তাই শুধু ‘মুখ্য ঐতিহ্যের কথাই জানা যায়; সাধারণ মানুষের সব বিশ্বাস ও আচরণ নথিভুক্ত হয়নি। উপনিষদে প্রেতাত্মার ‘ভর’ সম্বন্ধে উল্লেখ পাই। (বৃহদারণক উপ ৩:৩:১-২) লাহু্যর পুত্র ভুজ্যু বলে, মদ্রদেশে ঘুরতে ঘুরতে সে কাপ্য পাঞ্চালের বাড়ি যায়। কাপ্যের কন্যাটি গন্ধর্বাধিকৃত। ভুজ্যু সে গন্ধর্বকে প্রশ্ন করে সে কে, উত্তর আসে, ‘আঙ্গিরস গোত্রের সুগম্বা’। এর পর দুজনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ও দার্শনিক কিছু বিষয়ে সংলাপ চলে। এটা ঠিক দৈববাণী নয়, কিন্তু এইটিই তার সবচেয়ে কাছাকাছি, যা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায়। অনুমান করা যায় যে, সংশয়াচ্ছন্ন ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছু লোক অতিলৌকিক উপায়ের দ্বারা ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান জানবার জন্যে উৎসুক বোধ করত। কিন্তু যথার্থ দৈববাণীর নজির যে ভাবে মিশর, মধ্যপ্রাচ্য, গ্রিক ও চিনাদের সাহিত্যে মেলে ঠিক তেমনটি ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায় না। সাধারণ নিচের তলার মানুষ এবং নিশ্চয়ই বেশ কিছু ওপরতলার মানুষও কিছু কিছু দৈব উপায়ে এবং তার ব্যাখ্যার দ্বারা আগামী ঘটনা জানবার চেষ্টা করত। ‘প্রাচীন মিশরে আমরা শুনি দিব্যশক্তিযুক্ত প্রস্তরখণ্ড বা মণি, কবচ, মূর্তি, চিত্র, ছকবাঁধা মন্ত্র, গুপ্ত নাম ও রহস্যময় অনুষ্ঠান যার উদ্দেশ্য শত্রুর ক্ষতিসাধন করা অথবা তাকে হত্যা করে ক্ষমতালাভ করা, যাতে (নিজের) স্বার্থসিদ্ধি হয়। প্রেতাবিষ্ট হওয়া, স্বপ্ন, প্রেতাত্মা, শুভ অশুভ তিথি, কোষ্ঠী ও পূর্বাভাস এ সব খুবই সাধারণ এবং বহুধাব্যাপ্ত বিশ্বাস ছিল।’ (বাজ, ১৯৭২, পৃ. ২০৬-৩৪)
ভবিষ্যদ্বাণী দৈবের এমন একটি প্রকাশ যা সারা পৃথিবীতেই ব্যাপ্ত ছিল। এই ভবিষ্যদ্বক্তা কারা? সাধারণত যখন একটি দেশ, জাতি বা গোষ্ঠী কোনও সংকট বা দুদৈর্বের মধ্যে দিয়ে যেত, তখনই তাদের মধ্যে ভাবি-বক্তা ঋষির আবির্ভাব ঘটত, যিনি নিজেকে দিব্যজ্ঞানের অধিকারী বলে দাবি করতেন, বলতেন উচ্চতর জ্ঞান এবং দিব্যদৃষ্টি থাকার ফলে তিনি রহস্যের জাল ভেদ করে সেই সব ঘটনা দেখতে পান, যা অপরের কাছে অন্ধকারময়। সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের কারণ তিনি বুঝতে পারেন, আগে থেকে তা বলতে পারেন এবং যে ব্যক্তি দুষ্কৃতি, অমঙ্গলের জন্যে দায়ী, তাকে ও তার কুকর্মকে শনাক্ত করতে পারেন। এই ভাবি-বক্তা গোষ্ঠীগত ব্যাধি নিরূপণ করতে পারতেন এবং তা থেকে রক্ষা পাওয়ার পথটিও নির্দেশ করতে পারতেন। তিনি যেন সমগ্র গোষ্ঠীর চিকিৎসকের ভূমিকায় ছিলেন।
‘চিনে আমরা পেয়েছি হাড়ের ও ব্রঞ্জের যজ্ঞীয় পাত্র যাতে ভবিষ্যদ্বাণী খোদিত আছে… আছে দৈববাণী ও যজ্ঞীয় ক্রিয়া অর্থাৎ কচ্ছপের খোলায় ও জন্তুর হাড়ের সংকেত পড়া।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন, পৃ. ২৫৮) অ্যারিস্টটলের মতে (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে) এপিমেডেনস ছিলেন এক জ্ঞানী (সফস), কবি বা দৈবজ্ঞ যাঁর অতিলৌকিক ক্ষমতা ছিল। প্রিস্কিপিউম সাপিয়িনটিয়া-তে জাদুকর-সদৃশ বিদ্বজ্জনের উল্লেখ আছে যাদের মধ্যে রয়েছেন ভুয়োদর্শী পুরোহিত, কবি ও জ্ঞানী দার্শনিক। এরা সবাই মিলে ডেলফির মন্দিরে অ্যাপলোদেবের ভবিষ্যদ্বক্তার ভূমিকাটি পালন করত।
‘….শামান (জাদুকর) ধর্মাচরণকে অতিপ্রাকৃতের সান্নিধ্যে নিয়ে আসতেন, যা তিনি মন্ত্র ও আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি এবং ভগবানের বিশেষ প্রসাদের দ্বারা অর্জন করতেন। সরলই হোক বা জটিল, মানুষের ধর্মবোধকে সরাসরি দৈব প্রকাশকে প্রাথমিক অভিব্যক্তি মনে করা হত; প্রাক্-চেতন বোধ ও ধর্মতত্ত্বকে দ্বিতীয় পর্যায়ের বলে ধরা হত। শামানের যোগ প্রাথমিক প্রকাশের সঙ্গে; ভাবের ঘোর, উন্মাদনা, এ সবের মধ্যে শামানের ওপরে দেবতার ‘ভর’ হত। আদিম ধর্মের কেন্দ্রে ছিল তার মধ্যস্থতা।’ (মেনশিং সম্পাদিত ১৯৭৬, পৃ. ৮৭) ভারতীয় ধর্মে যদিও ওই রকম ‘শামান’ ঠিক ছিল না, তবু পুরোহিত, ভবিষ্যদ্বক্তা ও নানা ধরনের জাদুকর মিলে, চিহ্ননিরূপণ ও ভবিষ্যদ্বাণীর নিরূপিত ভূমিকাটি পালন করত। এরা সবাই দেবতার বিশেষ প্রসাদভাজন ব্যক্তি, যাদের সম্বন্ধে ধারণা ছিল এই যে, তারা পৃথিবীর নিয়ামক শক্তিগুলির সঙ্গে সরাসরি ভাবে যুক্ত থাকত।
চিনে ‘এরাই দেবতার মুখপাত্র ছিল। ইহুদিদের ধারণা, ভবিষ্যদ্বক্তা তার ব্যক্তিসত্তাকে স্তিমিত রেখে ঈশ্বরের বাণী পেতেন; সে রকম কোনও ধারণা চিনাদের ছিল না এবং বিধাতার দেওয়া চিত্তবৃত্তি ব্যবহার করা সম্বন্ধেও তাদের কোনও কুণ্ঠা ছিল না। কিন্তু তারা স্বীকার করত যে, তাদের এই বৃত্তির জন্যে তারা বিশেষ ভাবে প্রস্তুত হয়ে বেড়ে উঠেছেন; যিনি অদৃশ্য এঁরা নিজেদের তাঁরই মুখপাত্র বলতেন।’ (রলে ১৯৫৬, পৃ. ২৬) বারেবারেই রাষ্ট্রশক্তির ধারক বাহকদের হাতে এই সব ভবিষ্যদ্বক্তারা ক্রীড়নকমাত্র হয়ে উঠতেন, অথবা সচেতন ভাবে নিজেরাই রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করতেন। প্রমাণিতই হোক বা অপ্রমাণিতই হোক, জ্ঞানমাত্রই শক্তি। এই দুয়ে জ্ঞানে অধিকার যেন একটি অদৃশ্য ও অতিলৌকিক গরিমায় মণ্ডিত থাকত ও জনমানসে সম্ভ্রমের সঞ্চার করত। স্বয়মারোপিত ভবিষ্যদ্বক্তার ভূমিকার একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠা ছিল এবং প্রায়শই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাও।
চিনের প্রাচীন ঐতিহাসিক ধ্রুপদী সাহিত্য ‘শু চিং’ ‘অবক্ষয়ের যুগে নেতাদের রাজনৈতিক কর্তব্য নির্দেশ করেছে। তখন যথার্থ দেশপ্রেমী ভবিষ্যদ্বক্তা স্থিতাবস্থা রক্ষার কোনও চেষ্টা করবে না, বরং চেষ্টা করবে জনগণের অনুকূলে ইতিহাসকে পরিবর্তিত করতে। ধ্রুপদী সাহিত্যগুলি বারবার বলে, স্বেচ্ছাচারী রাজত্বের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ বিদ্রোহ নয়, ঈশ্বরের ইচ্ছা সিদ্ধ করা… সকলে সে যুগের সমাজের অবক্ষয় এবং যে নগ্ন স্বার্থসর্বস্বতার প্রকাশ ঘটেছিল, তা নিয়ে বিলাপ করেছেন। সকলেই অত্যাচারী ও নীতিবর্জিত রাজত্বের নিন্দা করেছেন এবং সুবিচার ও দয়াপরায়ণতার প্রকাশ দেখতে চেয়েছেন।’ (হসিল, ১৯৩২, পৃ. ৭২) ভবিষ্যদ্বক্তারা নিজেদের বিধাতার মুখপাত্র বলে মনে করতেন এবং তাঁদের বাণীর ভঙ্গি এমন ছিল যেন ঈশ্বর মানুষকে সম্বোধন করে কথা বলছেন। এই ভূমিকায় তাঁরা বিধাতার অভিনয় করতেন ও তাঁরা যা বলতেন তা দিব্যবাণীর গরিমায় মণ্ডিত হত। এদে দৈব বিধান ও নিয়তির ভূমিকা যেন সাধারণ মানুষের আরও একটু কাছে এসে পৌঁছত।
গ্লস্টিসিজম-এ দৈব অনুপ্রেরণার সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণীর সম্পর্ক খুব স্পষ্ট। ‘(মানুষ) জীবটির সম্পর্কে দেবদূতদের একটা ত্রাস স্পর্শ করত, কারণ তার সৃষ্টির পক্ষে যা উপযুক্ত তার চেয়েও বেশি কথা সে বলে, কারণ সেই ‘এক’ অদৃশ্য ভাবে ঊর্ধ থেকে সত্তার বীজ তার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করে রেখেছেন— সেই ‘এক’ যিনি নিজেকে অসংকোচে প্রকাশ করেছেন।’ (গ্রান্ট, ১৯৬১, পৃ. ১৪৩)
ব্যাবিলনে ‘মাদুক’দেব ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতা অর্জন করেছেন এ কথা শুনি। ‘দেবতারা… তাঁকে (মাদুককে) সেই শক্তি দিলেন যাতে তাঁর কথা যথার্থ হয়… কৃতজ্ঞতাস্বরূপে মাদুক মানুষ সৃষ্টি করে দেবতাদের কর্মভার কমিয়ে দিলেন।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ১৯৮১, ‘ব্যাবিলনীয় ধর্ম’, পৃ. ৪৬৩) ‘পুরোহিতের ভূমিকা মাঝেমাঝে ভাগ করে দেওয়া হত; ভবিষ্যদ্বক্তা প্রায়শই দেবতা ও মানুষের মধ্যে সংযোজক ব্যক্তি হতেন।… মানুষের বাসনা ও প্রয়োজন দেবতাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে সাহায্য চাইবার জন্যে, আবেদন পেশ করার জন্যে একটি অনুষ্ঠান ছিল। গুডিয়ার ক্ষেত্রে এটি ছিল তাঁর স্বপ্নে পাওয়া বার্তাগুলিকে যাচাই করে নেওয়ার একটি উপায়।… একটি বৃহৎকলেবর ও বহু অনুপুঙ্খযুক্ত সাহিত্য ছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় ও প্রথম সহস্রাব্দের একটি পাঠ্যগ্রন্থের মতো, এই বিষয়ে এবং আরও অনেক বিষয় ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জ্ঞান পাওয়ার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। আদিতে রাজা ও যুদ্ধনেতাদের নির্দেশ দেওয়ার উদ্দেশ্যে রচিত হলেও ক্রমে এর পরিসর বিস্তৃত হয়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্যকেও এর আওতায় নিয়ে আসা হয়।’ (ঐ, পৃ. ৪৬৫) ভবিষ্যদ্বক্তা এ ভাবে পুরোহিতের ভূমিকাতেই কাজ করত; যে সব সাধারণ মানুষ কিছু আলোকপাতের প্রতীক্ষা করেছে এরা তাকে আশ্বাস, জ্ঞান ও ভবিষ্যতের হদিশ দিত। এ ভাবে ভবিষ্যদ্বক্তা নিয়তি ও ভাগ্যেরই যেন এক অলৌকিক প্রকাশ হয়ে উঠত।
মধ্য আমেরিকায় পোপোল হুহ প্রায়ই জাদুকরের; অলৌকিক ক্ষমতার কথা বলে সে ক্ষমতার সৃষ্টি এবং বিনাশ সাধিত হয়। (ফ্লোরেন্টাইন কোডেক্স ৪র্থ ও ৫ম অধ্যায়; এগুলিতে জাদুকর, নিমিত্ত ও ভবিষ্যদ্বক্তার কথা আছে যাঁরা দেবতা ও মানুষের মধ্যস্থতা করত)
প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে দৈবনির্দেশ ভবিষ্যদ্বাণীর খুব কাছাকাছি ছিল। দৈববাণীকে ‘প্রায়ই মনে করা হত অতিলৌকিকের বাচনিক প্রত্যুত্তর, এর সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণীর প্রভেদ হল প্রথমোক্তটি মানুষের মাধ্যমে আসা অযাচিত বাচনিক প্রকাশ যা সামাজিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে নির্দেশিত।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন, ১১শ খণ্ড, ‘দৈববাণী’ পৃ. ৮১-৮৭) ভবিষ্যদ্বাণী ও দৈববাণীর মধ্যে একটি তত্ত্বগত পার্থক্য হল, ভবিষ্যদ্বক্তা স্বনিযুক্ত ঈশ্বরের দূত, জনগণের স্বার্থে আপৎকালে তাঁদের বাণী শোনা যায়, আর দৈববাণীর ক্ষেত্রে মানুষ এগিয়ে এসে একান্ত তাৎপর্যপূর্ণ রাষ্ট্র-সামাজিক প্রসঙ্গে কোনও ধর্মগুরু বা সাধুর নির্দেশ যাচঞা করে। দৈববাণীর বক্তা সমাজ গোষ্ঠীর একাগ্র প্রার্থনায় সাময়িক ভাবে ঈশ্বরের মুখপাত্র হয়ে যায়। ডেলফির বিখ্যাত দৈববাণীর ক্ষেত্রে দেব ‘গাইয়া’-ই প্রথমে দৈববাণীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরে আপল্লো তাঁকে স্থানচ্যুত করেন। যে ‘পুথন’ নাগকে আপল্লো ধ্বংস করেন, সে আসলে নারীপুরোহিত ‘পুথনেস’ এরই প্রতীক ছিল; ইনি দৈববাণীর ব্যাপারে ‘গাইয়া’র সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ‘গাইয়া’ অর্থাৎ ভূ-দেবীর প্রতীক ছিল ‘পুথন’: পাতালের একটি জীব। ডোডোনার দৈববক্তা নারীটি, (যিনি পরবর্তী কালে ‘পুথনেস’ হয়ে ওঠেন, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে), তাঁর ব্যাখ্যাতারা ছিলেন ‘সেল্লই’। এঁরা অধৌত-চরণে ভূশয্যায় শয়ন করতেন। (দ্রষ্টব্য ঈলিয়াড ১৬:২৩৪) এখনও অসংখ্য গ্রামে যেখানে ‘ভর’ বা দৈববাণী হয়, সেখানে প্রার্থীরা উপবাস করে অনির্দিষ্টকাল ভূমিশয্যায় শয়ন করেন, যত দিন না ‘জীবন্ত ঈশ্বরে’র প্রতিনিধি অর্থাৎ মন্দির-পুরোহিত প্রার্থীদের কাছে দৈববাণী উচ্চারণ করেন। গ্রিসের ডোডোনা বা ডেলফির দৈববাণীতে উপকৃত হত সারা দেশের সমাজ, ওই সব স্থানে কোনও কঠিন সংকটকালে জাতীয় ভাগ্য গণনা হত এবং প্রার্থী সমুদয় দৈববাণীর কামনায় সমবেত হত; ভক্তিভরে অপেক্ষা করত, যতক্ষণ না বাণী এসে পৌঁছয়। প্রায়ই তা আসত দ্ব্যর্থবোধক ভাষায়, তারও আবার ব্যাখ্যা করতেন জ্ঞানী সাধু ব্যক্তিরা। ভারতবর্ষের যে সব মন্দির দৈববাণীর জন্যে প্রসিদ্ধ সেখানে প্রায়ই নারী পুরুষরা সন্তান, সম্পদ, কোনও দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধি থেকে আরোগ্য ও সম্পত্তির মামলায় জয়লাভ, ইত্যাদি কামনা নিয়ে আসে। এক কথায় উপকারটা পায় ব্যক্তিগত প্রার্থী বা দম্পতি বা পরিবার; প্রার্থনার বিষয়টির পরিসর এখানে প্রাচীন গ্রিসের তুলনায় সংকীর্ণতর। প্রাচীন গ্রিসে যদিও আদিতে একটি বিশেষ মাসের সপ্তম দিনেই শুধু দৈববাণী হত (পরে প্রতি মাসে এক দিন করে), তবুও বাজির দান ফেলা হত অন্য দিনেও। এর ঘুঁটিগুলিও ছিল সাদা আর কালো সীমের বিচি। ‘হ্যাঁ ও না’ এর প্রতীক। ‘পুথিয়া’— নারীপুরোহিত এর থেকে একটিকে কুড়িয়ে নিত এবং তাতেই জানা যেত দেবতার সম্মতি বা অসম্মতি।
‘গাইয়া’ ও আপল্লো ছাড়া আথেনাও দৈববাণীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ‘আথেনার বিহঙ্গ সহচর বা অনুষঙ্গও তার আদিম দৈববক্তার ভূমিকা প্রমাণ করে, কারণ তিনটি পাখিকেই (প্যাচা, কাক ও সিন্ধুবিহগ) ভবিষ্যদ্বক্তা পাখি বলে মনে করা হত।’ (‘জেসি, ‘হিস্ট্রি অব রিলিজিয়নস’ ৩য় খণ্ড, ২য় সংখ্যা, পৃ. ১৫৪)
‘চিনে দৈববাণীর পাণ্ডুলিপিগুলিতে… অনিশ্চয়তা, আবেদন, বিভ্রান্তির প্রকাশ… ঝুঁকি, দৈববাণীর মাধ্যমে নিয়তি সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ।’ (রিংগার্ন, ১৯৬৭, পৃ. ১২৭) মেনশিয়াস কিন্তু এ ধরনের প্রক্রিয়ার বিপক্ষে ছিলেন, তিনি বলতেন, ‘মানুষ ব্যাপার ঘটিয়ে তুলতে পারে না, ঘটাবার প্রচেষ্টা স্বর্গের (=দেবতাদের) হাতে।’ দৈববাণীর সাহায্যে ভবিষ্যৎকে জানার প্রচেষ্টা সারা পৃথিবীতেই ব্যাপ্ত; বর্তমানকালেও মানুষ হঠাৎ একটা বইয়ের পৃষ্ঠা খুলে পাঠ করে দেখে, যদি কোনও গোপন খবরের সন্ধান মেলে— এ চেষ্টাও ভবিষ্যতের বন্ধ দুয়ারে কড়ানাড়া-ই। ‘লেপচারের মতে নিয়তি হল বহুসংখ্যক ভাবী ঘটনা, যা দিব্যশক্তিগুলি মানুষের জন্যে সঞ্চয় করে রেখেছে এবং এগুলি নিয়তই দিব্যশক্তিগুলির প্রসন্ন বা অপ্রসন্ন প্রতিক্রিয়ার দ্বারা সৃষ্ট বা পুনঃসৃষ্ট হচ্ছে। অতএব নিজের নিয়তির ওপরে মানুষের একেবারে কোনও প্রভাব নেই, এমন নয়। কারণ নিয়তি দুটি উপাদানের ওপরেনির্ভর করে এবং যদিও মানুষই (এ দুটির মধ্যে) নিকৃষ্টতর, তবু সম্পূর্ণ হতাশাজনক অবস্থায় তাকে ফেলে রাখা হয়নি।’ (রিগার্ন, ১৯৬৭, পৃ. ১৫৭) এখানে স্পষ্টতই দুটি পরস্পর-নিরপেক্ষ ও বিরোধী উপাদানকে সংহতি দেওয়ার চেষ্টা চোখে পড়ে— দৈব ও স্বাধীন ইচ্ছা। পূর্বেই যেমন দেখেছি, যুগ যুগ ধরে এ ব্যাপারটি ধর্মতত্ত্বপ্রবক্তাদের একটি প্রবল শিরঃপীড়া হয়ে রয়েছে।
(দেবী) থেমিসের উদ্দেশ্যে অর্ফিক স্তোত্রে বলে, (তিনি) ‘প্রভু আপল্লোকে দৈববাণীর শিক্ষা দিয়েছিলেন।’ (সংখ্যা ৭৯, পংক্তি ৬) এখানেও দেখি আপল্লো দৈববাণীর অধিকর্তা হওয়ার আগে নিয়তি একটি দেবীর অধিকারে ছিল। ‘হের্মেস’ এর উদ্দেশ্যে স্তোত্রে ‘থ্রিয়াত্র’ (তিন ভাগ্যদেবী) সম্বন্ধে আপল্লো বলেন, ‘তিনটি কুমারী… আমি ছাড়া এরাই নিমিত্ত-শাস্ত্রের শিক্ষয়িত্রী; এ বিদ্যা গোপালক বালক অবস্থাতেই আমি প্রয়োগ করতাম।… এরা যখন হলুদ মধু পান করে অনুপ্রাণিত হন, তখন এঁরা সত্যি কথা বলতে রাজি হন, কিন্তু যদি দেবতাদের মধুময় আহার্য থেকে এঁদের বঞ্চিত করা হয়, তা হলে তাঁরা মিথ্যা কথা বলেন… জেউস গৌরবময় হেমেসকে অনুজ্ঞা দেন যে, তিনি সমস্ত শাকুনশাস্ত্র নির্দিষ্ট বিহঙ্গ কুলের অধিষ্ঠাতা হবেন, আর কঠোরনেত্র সিংহদের, ঝবঝকে দাঁতের ভাল্লুকদের, কুকুরদের এবং যে সব পশুকে এই বিস্তীর্ণ পৃথিবী আহার দেয় তাদের, মেষদেরও; কেবল তিনিই (হেসে) নরকরাজের দূত হবেন; যদিও তিনি কোনও নৈবেদ্য গ্রহণ করেন না তবুও নরকরাজ তাঁকে (হেমেসকে) ভাল পুরস্কারই দেন।’ (হোমেরিক স্তোত্র, সংখ্যা ৪, পঙক্তি ৫৫০-৫৬৫, ৫৬৭ থেকে আধোরেখা সংযোজিত) অতএব আপল্লো এবং তিনটি ভাগ্যদেবী— ক্লোথো, লাখেসিস ও আট্রোপস ছিলেন নিয়তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। যথাযথ পরিচর্যা করলে এঁরা ‘সত্য’ বলেন, কিন্তু ঠিক মতো আহার ও পরিচর্যা না পেলে এঁরা মিথ্যা বলেন। এখানে যে সব দৈববাণী মিলবে না তার জন্যে একটি ফাঁক রাখা হল। যিনি প্রেতাত্মার পথপ্রদর্শক ছিলেন সেই হেমেস দেবতাদের দ্বারা নিযুক্ত নরকের দূত। এর দ্বারা প্রতিভাত হয়: মানুষ ও নিয়তির মধ্যে একটি যোগাযোগের সম্ভাবনা। অন্যান্য ধর্মে এমন একটি বিশ্বাস ছিল যে, দেবতারা মানুষকে তার নিয়তি সম্বন্ধে পুরো অন্ধকারে রাখতে চান না; উপযুক্ত মাধ্যমে তাঁরা নিয়তির পূর্বাভাস জানাতে প্রস্তুত। অন্তত মাঝে মাঝে ও আংশিক ভাবে।
‘জীবিত সাধুসন্তদের ওপরে… বিশেষ ক্ষমতা আরোপ করা হত— রোগ নিরাময়ের দিব্যদৃষ্টির ও আশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা। (এদের) কারও কাছে লোকে বাণী নিতে আসত যেন দৈববাণীর মতো।’ (উইলসন, ১৯৮৩, পৃ. ৯) মানুষকেও পুরোপুরি উন্নীত করা হত দৈববক্তার পদবিতে— যদি তারা দিব্য প্রেরণার অধিকারী ও তাতে বিশ্বাসী থাকত। ইসলাম দৈববক্তারা সবাক বিচারক; উচ্চমানের ছন্দোবদ্ধ গদ্যে তাঁরা বাণী দিতেন; দৈববাণীর ভাষা অবশ্য রহস্যময় (হত); বালুকার ওপরে লেখার দ্বারা দৈববাণীতেও তাঁরা বিশ্বাস করতেন।’ (লো ও ব্ল্যাকার সম্পাদিত, ১৯৮১, সার্জেন্টের প্রবন্ধ পৃ. ৭৪-৭৫) যে সব বিভিন্ন প্রক্রিয়াতে দৈববাণীর পূর্বাভাস পাওয়া যেত ল্যাটিনে সেগুলির ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল: ওসেন্টা (স্পষ্ট করা), পোর্টেন্টা (পূর্বাভাস), মনস্ট্রা (নির্দেশ করা) ও প্রদিজিয়া (ভবিষ্যদ্বাণী বলা)।
জাতককাহিনিগুলিতে এ সবের বহু নমুনা আছে। কয়েকটি উদাহরণ দিই:
একটি বস্ত্রখণ্ড থেকে এক ব্রাহ্মণ দৈব নির্ণয় করে। বুদ্ধ ধিক্কার দিয়ে বলেন, ‘ভাগ্যে বিশ্বাস কারওরই উচিত নয়, যারা ভবিষ্যৎ জানতে চায় তাদের জন্য কারওরই ভবিষ্যদ্বাণী করা উচিত নয়।’ (৮৭ সংখ্যক মঙ্গল জাতক) ধর্মরূপে যখন বুদ্ধ অধর্ম দেবদত্তের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করেছিলেন তখন একটি ভূমিকম্প হয়, তাতে বুদ্ধের উৎকর্ষ প্রমাণিত হয়। (৪৫৭; ধৰ্ম্ম) দৈবজ্ঞদের কথাও শুনি যারা কলিঙ্গের দুই রাজপুত্রের সম্বন্ধে ও একটি নারীর সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করে (৪৭৯, কালিঙ্গ বোধি) ‘স্বাধীন’ জাতকে (৪৯৫ সংখ্যক) দেখি ভাগ্যগণনা একটি স্বতন্ত্র পেশা। মহারক্ষিত দিব্যজ্ঞানের দ্বারা জানতে পারলেন যে, সেই রাত্রেই তাঁর মহিষীর গর্ভে বুদ্ধ আসবেন। (৫০৫, সমনসস)
মহাভারত-এ সঞ্জয় দিব্যদৃষ্টি পেয়ে সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্রের সকল ঘটনা যুগপৎ দেখতে পাচ্ছিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যথাযথ বর্ণনা করতে পারছিলেন। সাবিত্রীর পিতৃবন্ধু ঋষি নারদ দিব্যজ্ঞানের প্রভাবে সত্যবানের যে মাত্র এক বৎসর পরমায়ু অবশিষ্ট আছে তা জানিয়ে দেন। (৩:২৯) অর্জুন যখন আত্মীয়বন্ধুদের যুদ্ধে হত্যা করতে অসম্মত হন এবং কৃষ্ণ কোনও মতেই তাঁর সংশয় দূর করতে পারলেন না, তখন তিনি অর্জুনের সামনে তাঁর বিশ্বরূপ উদঘাটিত করলেন এবং দৈববাণীর ভাষায় কথা বলতে লাগলেন। তখন অর্জুন কৃষ্ণের আদেশ পালন করতে সম্মত হলেন। যুদ্ধের শেষে অনাবশ্যক বিপুল লোকহত্যায় বিক্ষুব্ধ ও অসহিষ্ণু হয়ে গান্ধারী ভবিষ্যদ্বাণী করেন: কী ‘কুৎসিত’ উপায়ে কৃষ্ণের মৃত্যু হবে এবং কী ভাবে যদুবংশের পূর্ণ বিনাশ ঘটবে (১১:২৫:৪০-৪১); সবই ফলেছিল, ঠিক যে ভাবে গান্ধারী বলেছিলেন ঠিক সে ভাবেই। এবং এতে প্রমাণ হল যে বলবার মুহূর্তে তিনি দিব্যজ্ঞানে আবিষ্ট হয়েছিলেন, যেন কাসান্দ্রার মতোই তাঁরও সহসা ভবিষ্যদ্দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। যদুবংশের কয়েকজন যখন খেলাচ্ছলে ঋষিদের প্রতারণা করেছিল তখন সব ছলনা বুঝতে পেরে ক্রুদ্ধ ঋষিরা যে আসন্ন বিনাশের কথা বলেছিলেন তা ফলেছিল; ওই সময়ে সেই ঋষিরা ভবিষ্যদ্বক্তা হয়ে উঠেছিলেন। একটি ক্ষেত্রে দৈববাণী মানুষের পাপের বিচার ও দণ্ডদানের ভূমিকা পালন করেছে।
রামায়ণ-এও দশরথ কৈকেয়ীকে যে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তা ফলে গিয়েছিল (২:১২:২১) তেমনই রাবণের পরাজয় ও মৃত্যু সম্বন্ধে জটায়ু যা বলেছিলেন তাও ফলেছিল। (৩:৫১:২৫) এমন বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় যেখানে সাধু নারী বা পুরুষ দৈব প্রেরণায় সংকটের মুহূর্তে যা উচ্চারণ করেন তা ভবিষ্যদ্বাণীতে পর্যবসিত হয়। দুটি মহাকাব্যেই দেবতাদের চেয়েও অনেক বেশি বার এই ধরনের মানুষের উক্তিই যথার্থ হয়ে ওঠে। ভবিষ্যদ্বাণী, দৈববাণী ও নিমিত্তজ্ঞান সম্বন্ধে অধিকাংশ নিদর্শনই পরবর্তী কালের ভার্গব প্রক্ষেপের অন্তর্গত, এই প্রক্ষেপের রচনাকালে নিয়তিকে আগে থেকে জেনে নেওয়ার নানা প্রক্রিয়ার বিকাশ হয় এবং এগুলি জনপ্রিয় হতে থাকে, ধীরে ধীরে সংগুপ্ত ভাবে জনমানসে প্রসার লাভ করে। কালিদাসের রঘুবংশ-এ (২য় সর্গে) রাজা দিলীপের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠ দিব্যজ্ঞানের প্রভাবে রাজার পুত্রহীনতার কারণ টের পান এবং একটি প্রায়শ্চিত্ত নির্দেশ করেন যেটি কার্যকরী হয় এবং তাতে বশিষ্ঠের দিব্যদৃষ্টি প্রমাণিত হয়।
‘প্রচ্ছন্ন সংকেতের ভাষায় দৈববাণী (অভীষ্টের) সন্ধান দেয়… ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত থেকে এক রকম মুক্তির; দৈববাণী এমন এক বাস্তবের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে যা কালের সীমাবদ্ধ কাঠামোর বাইরে।’ (ডগলাস, ১৯৭৫, পৃ. ১৩০)
ভবিষ্যদ্বাণী, নিমিত্তজ্ঞান ও দৈববাণীর পশ্চাতের প্রেরণা যে সব সময় দিব্য তা নয়। আধ্যাত্মিক জগতে শুভ ও অশুভ ক্ষমতার মধ্যে একটি শক্তিশালী দ্বন্দ্বযুদ্ধ যে লেগেই আছে, সে কথা ভুললে চলবে না। মহাকাব্যের রূপকে এ হল সমুদ্রমন্থন, যেখানে দেবতারা ও অসুররা দুই বিপরীত দিক থেকে টানাটানি করছে এবং সিন্ধু গর্ভ থেকে উঠে আসছে বহু দুর্লভ রত্ন ও বস্তু এবং সঙ্গে সঙ্গে বিষও। ঠিক তেমনই ভবিষ্যদ্বাণী, নির্ণায়ক ও প্রতিবিধায়ক নির্দেশগুলিও কখনও শুভ কখনও বা অশুভ শক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। প্রচণ্ড অপমানে বিক্ষুব্ধ দুর্যোধন যখন প্রায়োপবেশনে মৃত্যুবরণ করবার সংকল্প গ্রহণ করে তখন দেবতারা নয়, অসুরেরা এসে তাকে সান্ত্বনা ও আশ্বাস দেয়; সে আবার যুদ্ধে ফিরে যায়। অতএব এ ধরনের অতিপ্রাকৃত নির্দেশের সঙ্গে অধোলোকেরও একটা স্পষ্ট যোগাযোগ দেখা যায়। ‘মানুষের ইতিহাসের আদি পর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী ও নিমিত্তনিদান সম্পৃক্ত হয় পাতালের শক্তি ও মৃতদের সঙ্গে… পাতালের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণীর গুণের সম্পর্ক হল মানুষ যে সব গুণের সঙ্গে পাতালকে সম্পৃক্ত করে ভাবে, সে-বিষয়ে তর্কের একটি অবকাশ তৈরি করা।… জাদু, নিমিত্তজ্ঞান ও বাস্তব উদ্দেশ্যের সঙ্গে এর বহুতর সংযোগ (ফন্তেনরোজ, ১৯৮০, পৃ. ৫৪৮ ) যারা দৈববাণী কামনা করে তারা যে মাটিতে পড়ে ‘হত্যা’ দেয় ও গায়ে ধুলো মাখে, সেটা কোনও আপতিক ব্যাপার নয়; ভারতবর্ষে এরা সর্বদাই ‘দণ্ডী খাটে’ অর্থাৎ লক্ষ্যস্থলে পৌঁছনো পর্যন্ত সর্বাঙ্গ দিয়ে মাটি ছুঁতে ছুঁতে যায়। পৌঁছে মাটিতে শুয়ে থাকে এবং দৈবনির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভূমিশয্যা ছেড়ে ওঠে না। এই যে মাটির কাছাকাছি থাকা এতে মনে পড়ে গ্রিসের দৈববাণীর প্রথম দেবতা হলেন ‘গাইয়া’ বা ধরিত্রীদেবী। যখন তাঁর জায়গায় আপল্লো এলেন তখনও ভূতলস্থ নাগ ‘পুথন’ ভৈরবী বা নারী পুরোহিতের (পুথনেসের) প্রতীক রইলেন। অতএব একটা প্রচ্ছন্ন বোধ থেকেই গেল যে, অতিলৌকিক জ্ঞান আসে ভূগর্ভের অতল থেকে। ‘গাইয়া’র পরে এ শক্তি আপল্লোর মধ্যে, এ আর পাতালের সঙ্গে সংযুক্ত রইল না, যদিও পুথনেস তখনও ভূগর্ভের স্পষ্ট অনুষঙ্গ বহন করে। কিন্তু আথেনাতে পাতালের অনুষঙ্গ দেখা গেল তাঁর বিহঙ্গগুলিতে— কাক, প্যাঁচা আর সিন্ধুশকুনে; ভবিষ্যদ্বাণী ও নিমিত্তজ্ঞানের সঙ্গে রইল ভূতলের অনুষঙ্গ। ভারতবর্ষেও শাস্ত্রে ততটা না হলেও লোকাচারের মধ্যে ভূগর্ভের অনুষঙ্গযুক্ত শিব ও তাঁর বিভিন্ন প্রকাশের কাছে সাধারণ মানুষ চিত্তের বোঝা নামাতে চায় এবং স্পষ্টতই যা অপ্রাপ্য তা-ই চায়। ধরিত্রীদেবী ও ভূগর্ভস্থ দেবতাদের শক্তিতে যে আদিম বিশ্বাস তাই মানুষকে তাদের সংকটের মুহূর্তে মাটির ওপরে শোওয়ায়, অঙ্গে ধূলির প্রলেপ দেওয়ায়। এটা শুধু যে একান্ত দীনহীনতা প্রকাশ করাত, তা নয়, বরং ধরিত্রীমাতার সঙ্গে সান্নিধ্যের দ্বারা ভূগর্ভের অতলে যে সব শক্তি মানুষের ভাগ্য নিরূপণ করছে, তাদের কাছাকাছি আনতে চায়।
‘আকাশের, মেঘের ও পাখির চিহ্নের দ্বারা ভবিষ্যতের ঘটনা, সূর্যচন্দ্রগ্রহণের সন্ধান দান শুধু পুরোাহিতরা নয়… কিন্তু কিছু কিছু পুরোহিত পরিবারও তাঁদের সহজাত ক্ষমতা হিসেবে ও দিব্যজ্ঞানের দাবি করেন।… রোগের নিরাময়ের জন্যে ওষুধ, ওষধি ও কোনও কোনও গ্রহের ও রাশিচক্রের কোনও চিহ্নের অন্তর্গত এবং মানুষ যে রাশিতে অসুস্থ হয়েছে সেই রাশির অন্তর্ভুত ভেষজই তার সেবন করা উচিত।’ (ড্রাওয়ার, ১৯৬২, পৃ. ৮২-৮৩) ইরাক ও ইরানের মাণ্ডেয়ানদের সম্বন্ধেই গ্রন্থকার এখানে বলেছেন, কিন্তু যা বলছেন তা সমস্ত প্রাচীন সভ্যতা সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। এখানে অজ্ঞতাকে জানতে দৈবজ্ঞদের দু’ ধরনের প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হতে দেখা যায়: জ্যোতির্বিদ্যা ও নিমিত্তদান। এ দুটির মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা একটি স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিজ্ঞানে পরিণত হয়, নিমিত্তদান থেকে যায় সংস্কারের পর্যায়ে।
‘কানানের ‘মারি’ গ্রন্থগুলি দৈববাণী-প্রার্থীদের কথায় ভরা; আপাত ভাবে মনে হয়, সাধারণ লোকের মাধ্যমে দিব্যজ্ঞান বাহিত হত; এই ছিল দৈববাণীর মূল কাঠামোটি। ‘ডোডোনা’র নারীপুরোহিতটি যতই শক্তিশালী হোন না, প্রার্থীদের কাছে সাধারণ মর্ত্য মানবীই ছিলেন— যাঁর মাধ্যমে গাইয়া, আপল্লো ও আথেনে প্রার্থীদের কাছে তাঁদের স্বর পৌঁছে দিতেন। কখনও মনে করা হত এই মহিলাকে ‘ভর’ করেছেন মন্দিরের দেব বা দেবী যাঁর বাণী ইনি মানুষের কাছে এনে দিতেন। শামান-পন্থী এই বিশ্বাস ও প্রক্রিয়া শুধু যে ভারতবর্ষে বহুলপ্রচারিত তা নয়, সারা পৃথিবীতেই সর্বকালে এর চল ছিল। এর দ্বারা মর্ত্য মাধ্যমটিকে প্রয়োজনীয় দিব্যপ্রসাদের অধিকারী বলে মনে করা হত।
লোকে বিশ্বাস করত, দেবতা মানুষের সঙ্গে কথা বলবার জন্যে নিজেই মাধ্যম বেছে নেন। তিনি মানুষকে সতর্ক করে দেওয়া, সাহস ও আশ্বাস দেওয়ার জন্যে কিছু কিছু চিহ্ন ব্যবহার করেন। ধর্মশাস্ত্রগুলিতে এ ধরনের বহু উপাখ্যান আছে। মিশরে, ‘যখনই কোনও ‘শকুন’ বা চিহ্ন দেখা যেত তৎক্ষণাৎ তার ব্যাখ্যা করা হত যে, ফারাওয়ের প্রতি উচ্চভূমির দেবতা’ তাঁর শুভ ইচ্ছার চিহ্ন পাঠিয়েছেন।’ (গ্রান্ট ১৯৫৯, পৃ. ৫৭ )
নক্ষত্র অবলোকন করা থেকে প্রাচীন ব্যাবিলনে, ভারতবর্ষে ও অন্য সভ্যতায় যে বিজ্ঞানটি গড়ে ওঠে, তার শেষ হয় নক্ষত্র ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলের অবস্থান থেকে মানুষের ভাগ্য সম্বন্ধে তথ্যলাভ করায়। কাজেই যা শুদ্ধ বিজ্ঞানের আকারে গড়ে ওঠে, জ্যোতির্বিজ্ঞান, নৌযাত্রা ও নৌবাণিজ্যের পক্ষে অপরিহার্য ছিল বলেই যার বিকাশ ঘটেছিল, তা শেষ পর্যন্ত প্রায়োগিক ‘বিজ্ঞান’ অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রে পরিণত হয়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ভারতবর্ষে প্রথম নগরায়ণে জ্যোতিষচর্চা ঠিক বৈজ্ঞানিক ছিল না, ধর্ম ও কুসংস্কার নির্ভর মিশ্র একটি ব্যাপার ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকেও সেই প্রথম নগরায়ণের সময়ে অধীত ও আলোচিত জ্ঞানই হুবহু গৃহীত হয়; তত দিনে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী স্থান পরিবর্তন করেছে, কাজেই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রথম নগরায়ণের অর্জিত অনেক জ্ঞানই তখনও অনুবৃত্তিরূপে থেকে গেছে তা বোঝা যায়। ভারতবর্ষে জ্যোতিষশাস্ত্র বিশুদ্ধ ‘বিজ্ঞান’ হয়ে ওঠে আরও অনেক পরে।
বলা বাহুল্য, নক্ষত্রগুলি থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছতে অন্যুন সাড়ে তিন বা চার বছর সময় লাগে, ফলে জাতকের ভাগ্যের সঙ্গে জ্যোতিষ্কের অবস্থানের কোনও সত্যকার যোগাযোগ একেবারেই অবাস্তব। তবু পৃথিবীতে প্রায় সব দেশেই মানুষ ভেবেছে জ্যোতির্লোকের অবস্থান দিয়ে জাতকের ভাগ্য নিরূপিত হয়। ‘মহাবিশ্ব-অনুবিশ্ব-সমানুপাত যেন সর্বত্রই মানুষের ধর্মীয় প্রতীকায়নের দ্বারাই ঘটে… প্রথম পুর্ণায়ত জ্যোতিষ দেখা যায় ব্যাবিলনে হেলেনিস্টিক যুগের গ্রিক ভাষায়। এখন সম্ভব হল একজন মানুষের সঙ্গে জ্যোতিষ্কের সম্বন্ধ অনুধাবন করা; তার জন্মকালীন রাশিচক্রের সঙ্গে জ্যোতিষ্কগুলির অবস্থান মিলিয়ে এই সম্বন্ধ স্থাপন। কাজেই তত্ত্বগত ভাবে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করাও সম্ভব হল।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ‘ফেট’, পৃ. ২৯১) যেহেতু কোনও ব্যক্তির জন্মকালে জ্যোতির্মণ্ডলের অবস্থান থেকে তার ভাগ্য গণনা করা ‘সম্ভব’ হল, ব্যাখ্যাতারা জ্যোতিষ্কগুলিকে প্রভাবিত করে অশুভ সম্ভাবনাকে প্রতিহত করবার ভার নিলেন। এই দুটির মধ্য দিয়েই জ্যোতিষীরা নিয়তির অনুচর হিসেবে কাজ করত এবং অংশত, নিয়তির নিয়ন্ত্রণ, গতিপরিবর্তন ও তাকে প্রতিহত করারও কাজ করত।
পরবর্তী যুগে ব্যাবিলনীয় সাহিত্যে জ্যোতিষের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অনেক গ্রন্থ পাওয়া যায়। একটি হল তিথিতত্ত্ব, বিশেষ বিশেষ দেবতার আরাধনায় অনুকূল দিনক্ষণ নিরূপণের বিদ্যা, আর কোনও জ্যোতিষ্কের পূজার উপযুক্ত অনুষ্ঠান, তার সঙ্গে পবিত্র শিলাখণ্ডেরও, যেগুলির সঙ্গে রাশিচক্রের কোনও যোগ আছে— এগুলিতে কিন্তু জাদুবিদ্যা ও রোগ উপশমের উপযুক্ত গুণ আছে। মৌহুর্তক বিদ্যার দ্বারা বিশেষ কোনও কাজে হাত দেওয়ার উপযুক্ত মুহূর্ত নিরূপণ করা যেত।
‘অনাবিষ্কৃত কারণেরই অপর নাম দৈব। তত্ত্বগত ভাবে সব ভবিষ্যৎ ঘটনাই আগে থেকে বলা যায় এবং লোকে কার্যকারণ সূত্রটির প্রামাণ্যতা প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে জ্যোতিষ ও নিমিত্ত বিজ্ঞানের আশ্রয় নিত। সম্ভাবনা ঠিক ততটুকুই আছে যতটা মানুষ ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কে সম্বন্ধে অজ্ঞান।’ (লং ১৯৮৬, পৃ. ১৬৪) অন্য ভাবে বলা যায়, ঈশ্বরের মতো কোনও সর্বজ্ঞ ব্যক্তির কাছে সমস্ত কার্য ও কারণ তৎক্ষণাৎ প্রতিভাত হয়; যেহেতু মানুষ সর্বজ্ঞ নয়, তাই সে তার জীবনের বিশেষ কোনও অন্ধকার অঞ্চলের উপরে আলোকপাত করবার জন্যে জ্যোতিষের দ্বারস্থ হয়; এটা সেই জ্ঞানের জন্য যেটা তখন তার পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয়।
ঈশ্বরের ইচ্ছার বাইরে জ্যোতিষিক পূর্বনির্ধারণকে তিনি (সেন্ট অগাস্টিন) নাস্তিকের চেয়েও খারাপ বলে বর্জন করেন। ঈশ্বরের ইচ্ছার অধীনে সঞ্চরমাণ স্বাধীন জ্যোতিষ্কগুলি থেকে আসা পূর্বনির্ধারণকে তিনি ঐশী শক্তির অসম্মান হয় বলে দোষ দেন।’ (উইলসন, ১৯৮৩, পৃ. ৭৮) সেন্ট অগাস্টিন স্পষ্টই দেখতে পান যে, ঈশ্বরের ইচ্ছা তাঁর সৃষ্টি থেকে সংগ্রহ করা, সেগুলি ঈশ্বরের ইচ্ছার ওপরে নির্ভরশীল হোক অথবা স্বতন্ত্রই হোক— খ্রিস্ট ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে এর কোনও সংগতিই নেই।
আসলে জ্যোতিষ সম্বন্ধে এ ধরনের মনোভাবের সঙ্গে কোনও ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মের সংগতি থাকতে পারে না। কিন্তু শাস্ত্রীয় নির্দেশ কখনওই সাধারণ মানুষকে তাদের যুগযুগান্তের বিশ্বাস থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। যুক্তির দিক থেকে ঈশ্বরে বিশ্বাসের সঙ্গেও তো নিয়তিবাদের কোনও সংগতি থাকতেই পারে না, যেমন পারে না কর্মবাদ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিশ্বাসের সঙ্গেও। ব্যাবিলনের প্রথম রাজবংশের (খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ থেকে পঞ্চদশ শতকের মধ্যে) কালে জ্যোতির্লোকের চিহ্নকে প্রথম ব্যাপক ভাবে নিমিত্ত হিসেবে দেখা হতে লাগল, যদিও চন্দ্ৰগ্ৰহণকে এর পূর্বেও দুর্নিমিত্ত বলে মনে করা হত। এ ধরনের ‘বিচার সংক্রান্ত’ ভবিষ্যৎ নিরূপণ রাজসভা ও রাষ্ট্র সম্বন্ধেই প্রযোজ্য ছিল। গ্রিসে জ্যোতিষ, বিশেষত নক্ষত্রগুলিকে ভাগ্যদেবী হাইমারমেজের যন্ত্র বলে মনে করা হত। নক্ষত্রগুলি চিরস্থায়ী, চির-উজ্জ্বল, মনুষ্যলোকের বহু ঊর্ধে, যেন মানুষের ভাগ্য নিয়ন্তা দেবতাদের কাছাকাছি। ‘কোষ্ঠীঠিকুজির যে-জ্যোতিষ, যেখানে জাতকের জন্মলগ্নে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থানই তার ভাগ্য নিরূপণ করে সে-জ্যোতিষ ব্যাবিলন পারস্য সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হওয়ার আগে গড়ে ওঠেনি।… সবচেয়ে প্রাচীন যে কোষ্ঠীর সন্ধান পাই সেটি ৪১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে… পূর্বের বিচার-সংক্রান্ত জ্যোতিষ এবং পরবর্তী কালের কোষ্ঠীর জ্যোতিষ, দুটিই মূলত দাঁড়িয়ে আছে কাল সম্বন্ধে পূর্বনির্ধারিত নিয়তিনির্ভর এক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে।’(হুইটরো, ১৯৮৮, পৃ. ৩১) ‘যারা বিশ্বাস করে ইতিহাস ও মানুষের ভাগ্য নক্ষত্রগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তারা ইতিহাসের অগ্রগতি মানতে পারে না। বরং তারা কালের চক্রবৎ গতিতে বিশ্বাসী। ব্যাবিলনের পুরোহিত বেরোসসুস (আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বিশ্বাস করতেন যে, মহাবিশ্ব মাঝে মাঝে ধ্বংস হয় এবং পরে আবার সৃষ্ট হয়।’ (ঐ পৃ. ৫৮) গৌণ ভাবে হলেও গ্রন্থকার দেখাচ্ছেন যে, ইতিহাসের অগ্রগতির ধারণা নিয়তিবাদের পরিপন্থী। নিয়তিবাদ কালের চক্রবৎ গতিকে মানে— এ কথা ভারতবর্ষ সম্বন্ধে খুবই সত্যি; মহাকাব্য-পুরাণের যুগ থেকেই এখানে ‘কল্পে’র ধারণা দেখা যায়; এক কল্প হল সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় এবং তার পরে আবার এই ক্রমেরই পুনরাবর্তন। কাল প্রতি সৃষ্টিতে একটি বিন্দু থেকে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে। তত্ত্বগত ভাবে এ মত ইতিহাসের অগ্রগতিকে অস্বীকার করে, কারণ কল্প থেকে কল্পান্তরে যা থেকে যায় তা হল সনাতন বেদ। পরবর্তী সাহিত্যে এ মত বিশেষ ভাবে বিবৃত ও ব্যাখ্যাত হল এবং এ দেশে ঐতিহাসিক সাহিত্যের বিরলতার হয়তো এ-ও একটি আংশিক হেতু, কারণ ইতিহাস অগ্রগতি নির্ভর। সে যাই হোক, কাল সম্বন্ধে এই ধারণা নিয়তিবাদের একান্ত পরিপোষক।
ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন-এ সুনিমিত্ত দুর্নিমিত্ত ও নিমিত্তবিচারের নানা নাম দেখি: গ্রিক ‘মাস্টিক টেখনে’, ‘সেমিওন’, ল্যাটিন ‘ডিহ্বিনাতিও’, ‘সিগনুম’। এগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল শাকুনশাস্ত্র আউগুর, (ল্যাটিন ‘লিব্রি আইগুরালিস’), ‘হারুসপিকি’ (পশুর অস্ত্রপরীক্ষা)। ‘প্রদিজি’ মানে ‘দিব্য শক্তির আকস্মিক বিঘ্ন’, এ ছাড়াও আছে ‘অর্নিথোম্যান্সি’ (পাখি থেকে নিমিত্ত নির্ণয় শাকুনশাস্ত্র), ‘হেপাটোস্কোপি’ (পশুর যকৃৎ থেকে বিচার), ‘ওনেইরোম্যান্সি’ (স্বপ্ন ব্যাখ্যা), ‘সর্টিলেজ’ (জুয়ার মতো দান ফেলে বিচার), ‘ফিজিওগ্রোমি’ (সামুদ্রিক জ্যোতিষ) এবং করকোষ্ঠী বিচার। (ঐ ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৫৪-৫৮)
আক্কাদীয় দেবী ইনান্না মানুষের নিয়তিসমূহ ‘মেস’কে ললাটে রত্নললাটিকার মতো ধারণ করেন। ব্যাবিলনে সুপরিণত ভাগ্যবিচার জাদুর জগতে একটি কেন্দ্রীয় তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। মেসোপটেমিয়ার নিয়তি ছিল ‘আনাস্কে’ অর্থাৎ আবশ্যিক। এটি নিয়তির ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক: মানুষের জীবনে যে সব ঘটনার প্রাথমিক ও সুস্পষ্ট কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক পাওয়া যায় না তা-ই ভাগ্য। এবং এ ভাগ্য আধ্যাত্মিক শক্তিগুলির কাছে আবশ্যিক। ইজরায়েলে অন্যান্য জাদুপ্রক্রিয়ার সঙ্গে ছিল মৃতের সঙ্গে কথোপকথন। দারুণ সংকটের মুহূর্তে রাজা সল এন-ডরের ডাকিনীর কাছে যান, সে মৃত স্যামুয়েলের আত্মাকে আহ্বান করে; সে-আত্মা প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয় সলকে। (স্যামুয়েল ২৮:৮-২৫) (এরই যেন এক প্রতিধ্বনি পাই ম্যাকবেথের চতুর্থ অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে।
ব্যাবিলনের নিমিত্তবিদরা খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে অন্তরীক্ষের নিমিত্তগুলিকে বিষয় অনুসারে ভাগ এবং উপবিভাজন করে এগুলিকে বহুমুখী প্রভাবের ক্ষেত্র অনুযায়ী শিলাখণ্ডে ও নানা অংশে সাজান। জাদুকর রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এ সবে পুঁথির শরণ নিত— অন্তরীক্ষলোকের চিহ্ন থেকে আগামী বিপদের সংকেত সংগ্রহ করাই উদ্দেশ্য। মেসোপটেমিয়াতে দুর্নিমিত্ত সম্বন্ধে সত্তরটি শিলাখণ্ড আছে। এগুলির উৎস জ্যোতিষ্ক, আবহাওয়ার ঘটনা, সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সম্বন্ধে প্রণিধানে লব্ধ ‘নিমিত্ত’। উল্কাপাত ও তাদের গতি থেকেও হ্যাঁ’ বা ‘না’ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। গ্রহনক্ষত্র যে মানুষের জীবনকে ও তার ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করে এ বিশ্বাস ছিল, কাজেই ভবিষ্যৎ সংকট এড়ানোর জন্যে এবং সিদ্ধি ও প্রাচুর্য পাওয়ার জন্যে সেগুলিকে আহ্বান করা হত। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনও বিবরণ ছিল না, কিন্তু গ্রহ নক্ষত্রের সমাবেশ লক্ষ করে এবং কিছু কিছু পার্থিব ঘটনা লক্ষ্য করে মানুষের ভাগ্য সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হত। ভেড়ার অস্ত্র পরীক্ষা করে দৈবজ্ঞ নির্ভরযোগ্য চিহ্নের সন্ধান করত। অন্তরীক্ষলোকের চিহ্ন বিচার করে বোঝা যেত সে পরীক্ষা ফলপ্রসূ হবে কিনা। এটা কখনও সফল হত, কখনও হত না। এ ছাড়াও ছিল তিথিক্ষণের শাস্ত্র, এদের সাহায্যে ঠিক করা হত কোন সময়ে পূজা বা নৈবেদ্য সার্থক হয়, পুণ্যকর্ম ফলপ্রসূ হয় এবং কোন কোন দেবতা ও নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে নিবেদিত অর্ঘ্য সার্থক হয়। এ ছাড়া ধাতু ও রত্ন পরীক্ষাও তেমনিই একটি অপবিজ্ঞান; সামান্য কিছু ভেষজ গুণের সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু থাকলেও তার সম্বন্ধে যা দাবি করা হয় তা সম্পূর্ণ অবাস্তব।
যে মানুষের ওপরে সহজে দেবতার ‘ভর’ হয় তাকে মৃতের আত্মার কাছে থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য জানার জন্যে ব্যবহার করা হয়। জাহাজ বা নৌকা নিয়ে পাড়ি দেওয়ার আগে নাবিকরা নৌ-জ্যোতিষের শরণ নিত। মাঙ্গলিক দ্রব্য-পূর্ণ কবচ ধারণ করার রীতি সর্ব যুগে সারা পৃথিবীতেই ছিল, প্রধানত দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্যে। আকাশের নক্ষত্রকে উদ্দেশ্যে করে ভেষজ দ্রব্য নিচে রেখে দেওয়া হত যাতে নক্ষত্রের মাঙ্গলিক গুণ ভেষজে সঞ্চিত হতে পারে। ব্যাধিকে মনে করা হত নক্ষত্র থেকে বিন্দুবিন্দু ঝড়ে পড়া অথবা ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা বস্তু। (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, পৃ. ২৯১-২৯৮) এ সবের মধ্যে এ কথাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষ তার নিয়তি সম্বন্ধে অগ্রিম জ্ঞান লাভ করবার জন্যে ও অমঙ্গল এড়ানোর জন্যে বহুবিধ উপায় উদ্ভাবন করেছিল। এ সবই নিয়তিবাদের সঙ্গে বিজড়িত। যেহেতু পূর্বজ্ঞানও নিয়তির এবং প্রতিকারও নিয়তি নির্দিষ্ট অশুভের, সে কারণে রিংগার্নের সঙ্গে একমত হওয়া কঠিন, যখন তিনি বলেন, ‘দৈবজ্ঞান লাভের চেষ্টা সব সময়েই নিয়তিবাদের সঙ্গে যুক্ত নয়।’ (১৯৫৫, পৃ. ৫২) সরাসরি না হলেও দৈবজ্ঞানের উদ্দেশ্য নিয়তি সম্বন্ধে পূর্বাহ্নে অবহিত হওয়া। এর পশ্চাতে যে বিশ্বাস সক্রিয়, তা হল মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে ঘটা ক্রিয়াকলাপগুলো জানবার একটা ক্ষমতা দৈবজ্ঞের আছে। যদি মনে করা যায় যে, পাতালের প্রেতপিশাচের সঙ্গে দৈবজ্ঞ একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে ও তাদের কাছ থেকে নিয়তি সম্বন্ধে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারে তা হলে ওই প্রেতপিশাচরাই নিয়তির অনুচর হয়ে যায়।
‘তোরাহ-তে স্থানীয় নিসর্গের আত্মার দ্বারস্থ হওয়া অথবা মৃতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা বিষয়ে নিষেধ রয়েছে। ওই রকম সম্পর্ক স্থাপন করার উপযোগিতা যে কাজে কাজেই অস্বীকার করা হচ্ছে তা নয়, ওই ধরনের ক্রিয়াকলাপের বিশ্বাসগত ভিত্তি হচ্ছে ঈশ্বর সব ঘটনা এবং নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের একমাত্র উৎস নয়। (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, পৃ. ৩৭৯) যদি নিমিত্ত আর স্বপ্ন ব্যাখ্যাকে মানা যায়, তা হলে ঈশ্বর ব্যতিরিক্ত জ্ঞানের উৎসও প্রকারান্তরে মানা হল। এ হল জনসাধারণের মধ্যে বহু যুগ ধরে প্রচলিত বিশ্বাস ও আচরণকে কতকটা প্রশ্রয় দেওয়া। যে সব একেশ্বরবাদী সমাজে নিয়তিবাদ অস্বীকৃত, সে সব সমাজে এ ধরনের আপোষ হয়ে থাকে ও জীবনের দুর্জ্ঞেয়তার ভারে পীড়িত মানুষ তাতে আশ্রয় নেয়।
‘অনাবিষ্কৃত কারণেরই অন্য নাম হল দৈব। তত্ত্বগত ভাবে সব ভাবী ঘটনারই পূর্বনির্দেশ করা সম্ভব; মানুষ জ্যোতিষ ও দৈবজ্ঞানের কাছে আশ্রয় নিল, কার্যকারণ সূত্রের যথার্থতার একটি প্রমাণ হিসেবে।’ (লং ১৯৮৬ (১৯৭৪) পৃ. ১৬৪) মানুষ যার উৎস জানে না অথচ যা ঘটে চলেছে এবং যে অঞ্চলটিতে তার অভিজ্ঞতার কার্যকারণ সম্পর্ক এখনও নির্ণয় করা যাচ্ছে না— সম্ভাবনা বা দৈব তারই সংজ্ঞা নির্ণয় করে। অতএব এ-ও নিয়তিরই অন্য রূপ। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল, মানুষের মনে কার্যকারণ সম্পর্কে অন্তর্নিহিত একটি বোধ, সব ঘটনার যুক্তি সহ একটি ব্যাখ্যা আছে এমন একটি বিশ্বাস। যে অঞ্চলে কার্যকারণ সূত্র দিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা হয়, প্রকৃতি ও মনুষ্যজীবন সম্বন্ধে নিত্য নিত্য আবিষ্কৃত তথ্যের দ্বারা তার পরিসর প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। কাজেই লং এর ভাষায়, ‘কার্যকারণ সূত্র সম্বন্ধে আজকের জ্ঞানাভাব দৈবের ওপরে হেতুত্ব আরোপ করছে, আগামীকালে যে কার্যকারণ সূত্র আবিষ্কৃত হবে, তা আজকের জ্ঞানের চক্রবালের ওপারে।’
প্রাচীন গ্রিসে ‘মর্ত্য মানুষ দৈবের দ্বারা অধিকৃত ছিল। অথচ জেউস যা-ইচ্ছে করতে পারেন… জেউস সব কিছুর ওপরে আসীন ছিলেন; তবু তাঁর সার্বভৌমত্বের সঙ্গেই নিয়তিকেও মেনে নেওয়া হয়েছে। প্রাচীন নর্স অতিকথায় ‘উর্দু’ হলেন দৈবের প্রতিরূপ একটি নারীমূর্তি, বিশ্বমহীরুহের নিচে সমাসীন থেকে যিনি দৈবকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ‘ফেট’, পৃ. ২৯২-৯৩) ‘উর্দু’র সঙ্গে বিশ্বমহীরুহের সম্পর্ক তাঁর ব্যক্তিত্বের পাতালস্থ অনুষঙ্গ বহন করে। মনে পড়ে ডেলফি’র গুহা, যেখানে ভূতলস্থ পুথোন ছিলেন; এ হল অধোলোকের সঙ্গে নিয়তির সংযোগ।
প্রাচীন যুগের শেষাংশে গ্লস্টিকবাদের পরিত্রাণতত্ত্বের সঙ্গে ঈশ্বরের ওপরে দৈবের খুব স্পষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়। এই একটি চূড়ান্ত অবস্থিতি খুব কম অতিকথাতেই দেখা যায়; এখানে দৈব ঈশ্বর থেকে স্বতন্ত্র, এক স্বয়ম্ভর শক্তি, যা নিজেই বিচার করে অংশ নিরূপণ করছে, দৈব বিচার বা দিব্য হস্তক্ষেপের দ্বারা একটুও সংকুচিত না হয়ে। অর্বাচীন জোরাষ্ট্রীয়বাদে যে প্রাচীন তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল সেখানে অনেকে নিয়তিকে কালের সঙ্গে একাত্ম বলে ভেবেছিলেন। একটি যে তত্ত্বগত কাঠামো পূর্ণনিরূপণের দিকে এগোচ্ছিল তার পরিণতি ঘটেছিল। এক অর্বাচীন যুগে একে বলা হত, জুবানবাদ। মানিকীয়বাদ যেমন জোরাষ্ট্রীয়বাদের চিন্তার দ্বারা প্রবল ভাবে প্রভাবিত তেমনই কাল, দৈব, ভাল, মন্দ সম্বন্ধে এর ধারণাও প্রভাবিত। (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন ‘ফেট’ ২৯৬-৯৭) কাল ও নিয়তির একীকরণ খুব লক্ষণীয়। মানুষ যা আবিষ্কার করতে পারে না, অথচ করবার জন্যে আগ্রহে আপ্রাণ চেষ্টা করে তা হল ভবিষ্যতে তার ভাগ্যে কী আছে তা জানা। এবং ভবিষ্যৎ হল কালের সেই রূপ, যা নিয়তির সবচেয়ে কাছাকাছি।
আজটেকদের মধ্যে ‘জাদুবিদ্যা, নিমিত্ত ও শাকুনশাস্ত্র প্রাত্যহিক জীবনকে ব্যাপ্ত করে রাখত। নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশিই অবস্থান করত আজটেক সভ্যতার আশ্চর্য জীবনীশক্তি।’ (এনসাইক্লোপিডিয়া রিটানিকা ম্যাক্রোপিডিয়া ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৫১) এখানে স্পষ্ট একটা ধারণা ছিল যে, নিয়তিই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিমিত্ত, জ্যোতিষ এ সব তারই বহিঃপ্রকাশ। ‘বণিকরা নৌযাত্রার পূর্বে শুভদিন দেখে নৈবেদ্য দিত।’ (ফ্লরেন্টাইন কোডেক্স ১০ খণ্ড, পৃ. ৯)
ভারতবর্ষে পুনর্জন্মবাদ দেখা দেয় সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের কাছাকাছি এবং তার সমকালে বা অল্প পরেই কর্মবাদের অভ্যুত্থান। নিয়তিবাদের পুনরভ্যুত্থান খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতকে, যখন মহাকাব্য দুটির শেষতম প্রক্ষিপ্ত অংশ দুটি গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়। মনে হয় শাস্ত্রে দেখা দেওয়ার অনেক আগে থেকেই গণমানসে নিয়তিবাদ বিদ্যমান ছিল। সম্ভবত প্রথম নগরায়ণের কাল থেকেই নিয়তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৈবজ্ঞান, ভবিষ্যদ্বাণী, নিমিত্তশাস্ত্র, স্বপ্ন, দৈববাণী সবই এই সময়ে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়, যদিও এগুলির সম্যক বিকাশ ঘটে আরও পরে।
জাতকে আমরা এগুলিকে খানিকটা স্পষ্ট ভাবেই প্রত্যক্ষ করি। একটি বিবাহের সম্পর্কে পারিবারিক জ্যোতিষীকে শুভদিন সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হল। সে স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যা বলে। তার সম্মানে লাগে, কারণ নগরবাসীরা গ্রামের বধু চায়। জ্যোতিষীর গণনা সত্ত্বেও বিয়েটা হয়ে যায়। (পাঠটা এখানে— অনথো অখসস, নকখত্তং কিং করিসসতি, অর্থাৎ বিয়েটা খারাপ হলে নক্ষত্র কি করবে?’ ৫৯ সংখ্যক, নকখণ্ড) সত্তপত্ত জাতকে বোধিসত্ত্ব তস্করদলপতি হয়ে জন্মান। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘যদিও বোধিসত্ত্বরা মহাপুরুষই হন, তবু কখনও কখনও তাঁরা মন্দ হয়ে জন্ম নিয়ে পরদ্রব্য অপহরণ করেন; লোকে বলে এটা সম্ভব হয় কোষ্ঠীর ত্রুটিতে।’ (২৭৯ সংখ্যক) বলা বাহুল্য, ব্যাখ্যাটি হাস্যকর, কারণ কোষ্ঠীতে ভাবী ঘটনার গণনা থাকে যা নক্ষত্রসংস্থান বা নিয়তির দ্বারা পূর্বনিরূপিত; বাস্তবজীবন কোষ্ঠীগণনাকে অনুসরণ করে মাত্র। অন্য এক জাতকে বুদ্ধ এক কলিঙ্গরাজার অনুরোধে সক্ককে একটি যুদ্ধের ভাবী ফলাফল সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন; সক্ক অন্তরীক্ষের চিহ্নগুলি যথাযথ পাঠ করে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেন তা ফলে যায়। (৩০১ সংখ্যক, চুল্লকলিঙ্গ) এক নির্বাসিত রাজপুত্রকে জ্যোতিষী বলে যে, তাঁর পিতা, মারা গেছেন। রাজকুমার রাজধানীতে ফিরে রাজা হন। (৩২০ সংখ্যক, সুচ্চজ) এক বার এক শেয়াল রাজার মৃত্যু ও রাজার ধ্বংস সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করে। সে সব ফলে যায়। এর আংশিক কারণ অবশ্য রাজা পরন্তপ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে ও দুর্নিমিত্ত দেখে যুদ্ধ ত্যাগ করেন। (৪১৬ সংখ্যক পরন্তপ) রাজার ক্রিয়ার দ্বারাই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হল কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। একটি অদ্ভুত কাহিনিতে বুদ্ধ নিমিত্ত সম্বন্ধে শিক্ষা দেন, সম্ভবত এ বিদ্যাও যে তাঁর আয়ত্তে, তা-ই প্রমাণ করবার জন্যেই। যদিও এই শিক্ষা তিনি সমাপ্ত করেন এই বলে যে, ‘নিমিত্তে কোনও সত্যই নেই।’ (৪৫৩ সংখ্যা, মহামাতঙ্গ) রাজা শিবির অপরূপ রূপলাবণ্যবতী কন্যা উন্মাদন্তীকে কোনও জ্যোতিষী কামনা করেন এবং কন্যাটির একটি ভাল বিবাহ সম্বন্ধ নাকচ করে দেন। কিন্তু রাজকন্যার বিবাহ হয় সেনাপতির সঙ্গে; অতএব মিথ্যা গণনায় জ্যোতিষীর কোনও লাভই হল না (৫২৭ সংখ্যক, উন্মাদন্তী) মহোষধকে এক পুরোহিত প্রশংসা করেন এই বলে যে, তিনি বুদ্ধিমান সৰ্বনিমিত্তজ্ঞ। (৫৪৬ সংখ্যক, মহাউন্মঙ্গ)
রামায়ণ-এ খর দূষণ ও চোদ্দ হাজার রাক্ষসের উপর রামের জয় সূচনা করে যে-নিমিত্ত, তার একটি তালিকা আছে; এ সবই ফলে যায়।
(৩:২৪) বনে শূন্য কুটীরে যখন রাম লক্ষ্মণ সীতাহরণের পরে ফিরে আসেন, তখন চারিদিকেই দুর্নিমিত্ত দেখা যায়। (৩:৫৭) ত্রিজটা স্বপ্নে সীতার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে শুভচিহ্ন দেখতে পায়। (৫:২৯) রাম সমুদ্র পার হওয়ার আগেই রাবণ ও তার অনুচরেরা দুর্নিমিত্ত দেখে। (৬:১০:১৪-২৭) সমুদ্র পার হওয়ার পরে আসন্ন যুদ্ধে যে বহু প্রাণহানি হবে সে সম্বন্ধে রাম অনেক দুর্নিমিত্ত দেখতে পান। (৫:২৩:৩-১২) রাবণ ও তার রাক্ষস অনুচরেরা যুদ্ধের আরম্ভেই অনেক অপশকুন দেখে। (৬:৩৫:২০-৩৫)
মহাভারতেও বিস্তর অতিলৌকিক চিহ্নের কথা আছে, বিশেষত প্রত্যেক দিনের যুদ্ধের আগে এবং প্রত্যেক মহাবীরের মৃত্যুর পূর্বাহ্নে (৭:১৬৫:১০-১৩), দুর্যোধনের মৃত্যুতে। (৯:৫৭:৪৬-৫৭০) হরিবংশে কৃষ্ণের জন্মের আগে বহু শুভচিহ্ন দৃষ্ট হয়। (বিষ্ণু পর্ব ৪:১৫-২০)
দুটি মহাকাব্য ছাড়াও পুরাণে সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র এবং মানুষের জীবনে এদের প্রভাব সম্বন্ধে বিস্তর উপাখ্যান আছে এবং ওই জ্যোতিষ্কগুলিকে কী ভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হয় তার বিধানও দেওয়া আছে। (বিষ্ণু পু. ১:২ কূর্ম পূর্বভাগ ৪২ অধ্যায়, ভাগবত ৫:২, ইত্যাদি অগ্নি ৫১:১২১, ১২৬, ১৩৬, ১৬৪, ১৯৬; মৎস্য ৫৪-৭০, ১২৫, ১২৬, কূর্ম পূর্বভাগ ৪১ অধ্যায়) নিমিত্ত সম্বন্ধে দীর্ঘায়ত বিবরণ আছে মৎস্য ২২৯-৩৬ অধ্যায়ে এবং প্রয়োজনীয় প্রায়শ্চিত্তের বিধান ২৩৯ অধ্যায়ে, বায়ু, ১৯:১৬, মার্কণ্ডেয় ৩৪ অধ্যায়ে, অগ্নি ২২৯ অধ্যায়ে। গরুড় ২৩০-৩১ অধ্যায়ে শুভ ও অশুভ নিমিত্ত, নরনারীর সামুদ্রিক লক্ষণ সম্বন্ধেও নির্দেশ আছে।
‘যেহেতু জ্যোতিষ অজ্ঞের ললাট-লেখনের একটি অসম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি (এ সম্বন্ধে ) ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি অভ্রান্ত না হওয়াই সম্ভব। কোনও ব্যক্তি তার বোধ ও নিয়ন্ত্রণের বহির্ভূত ভাগ্যের দোহাই দিয়ে আসন্ন সর্বনাশের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে।… যে ব্যক্তির (জীবনে কোনও) দুর্ঘটনা ঘটেছে সে সাধারণ পূর্বনিরূপণের দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন আশ্রয় খোঁজে যা তাকে সান্ত্বনা দেবে, তাকে সে যে অমোঘ দৈবের অসহায় লক্ষ্য তা প্রতিপন্ন হয়। (কে’স অ্যান্ড ড্যানিয়েল, ১৯৮৮, পৃ. ৪৪-৪৫)
মহাভারত, বিশেষ করে এর অর্বাচীন ভার্গব প্রক্ষেপের অংশগুলিতে, নিমিত্ত ও লক্ষণ সম্বন্ধে নানা বিবরণ দেয়। যে গুরুতর সংকট, অর্থাৎ অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনার বিনাশ, ভ্রাতৃহত্যা এবং দু’পক্ষেই নানা অন্যায়ের ফলভোগ (কুরুরাজসভা কৌরবদের হাতে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা এবং জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের জুয়াখেলার লোভ সংবরণ করতে না পারা)— এ সবই সেই আত্মপ্রত্যয়ের ভিৎ ধরে ধরে নাড়া দিয়েছিল যে প্রত্যয় আসে শুধু নির্মল বিবেক থেকেই। এ প্রত্যয়ের অভাবে মানুষ অনায়াসেই নানা কুসংস্কারের কাছে নতিস্বীকার করে। পাপবোধ নৈতিক শক্তিকে ক্ষয় করে। কাজেই তারা প্রতীক্ষা করে সেই ভাগ্যের জন্য যা নিজের গতিতে কাজ করে যাবে; তার উদ্দেশে ও ক্রিয়াকলাপ প্রকাশ পাবে নিমিত্ত ও চিহ্নের মাধ্যমে:
অর্জুনের জন্মকালে অশরীরী বাণী শোনা গিয়েছিল যে, ইন্দ্রের মতো একজন জন্মেছেন। (মহাভারত ৫:৮২:৫-১০) যখন কৃষ্ণ কৌরবদের কাছে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে যান, তখন চারিদিকেই নানা দুর্লক্ষণ দেখা গেল। যুদ্ধের পূর্বেই যে নানা দুর্নিমিত্ত দেখা যাচ্ছিল সে কথা কৃষ্ণও স্বীকার করেন। (ঐ ৫:১৪১:২-৩০) ভীম যখন দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরশুরামকে মেরে ফেলায় প্রায় কৃতকার্য, তখনও দুর্লক্ষণ দেখা গেল। (৫:১৮৩:২১-২৭) যুদ্ধের প্রাক্কালে সকলেই প্রকৃতিতে দুর্নিমিত্ত দেখতে পায়। (৫:২:১৬-৩:৪৩) যে ভীষ্ম যুদ্ধের প্রথম দশ দিন সেনাপতি ছিলেন তাঁর মৃত্যু যখন আসন্ন হল, তখন সারা প্রকৃতি জুড়ে ইতস্তত নানা অশুভচিহ্ন দেখা গেল। (৬:১০৮) দ্বিতীয় সেনাপতি দ্রোণের মৃত্যুর আগেও অশুভ সব লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। (৭:১৫:১১-১৪) মৌষলপর্বে যেখানে একটি অভিশাপ ফলতে চলেছিল, সেখানে দেখি মানুষ, জন্তু সকলেই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। (১৬:৪:৫-৪৬)
এগুলি একেবারেই চূড়ান্ত নির্দেশ নয়, কিন্তু এর থেকে ধারণা পাওয়া যায় তৎকালীন মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের চেহারা কী রকম ছিল। দু’পক্ষই নিয়তিকে উত্তেজিত করেছিল; একটি অস্বাভাবিক বিনাশ সংঘটিত হচ্ছিল, যেখানে লোভ, আত্মপ্রচারের বাসনা, পরশ্রীকাতরতা এবং বিদ্বেষ দু’পক্ষকেই প্রবৃত্ত করেছে এক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে যেখানে বহুসংখ্যক নিরপরাধ এবং শ্রদ্ধেয় প্রবীণ বৃদ্ধ মানুষের মৃত্যু ঘটবে। নিয়তি এই মহতি বিনষ্টির মধ্যে নানা চিহ্ন ও অপশকুনের মাধ্যমে নিজের গতিপ্রকৃতির আভাস দিচ্ছে।
অনেক পরের এক সভ্যতা আজটেকদের বিষয়ে ‘ফ্লরেন্টাইন কোডেক্স’ আমাদের বলে, ‘স্প্যানিশরা ও দেশে আসবার আগে কী সব দুর্নিমিত্ত দেখা গিয়েছিল’ (৯ম খণ্ড) প্রাচীন ইংরেজিতে Wyrd শব্দটির অর্থ ‘কোনো মানুষের জন্যে নিরূপিত ভাগ্য, সৌভাগ্য, নিয়তি ও দুদৈব, যে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে প্রতিশোধ হিসেবে পাঠিয়ে দেয়। মধ্যযুগীয় ইংরেজিতে এর অর্থ ‘পূবনিরূপিত ঘটনাবলি, কিন্তু প্রাচীন ইংরেজি সাহিত্যে এটি মূর্তি পরিগ্রহ করেছিল।’
নিমিত্তনিদান ও জ্যোতিষের চর্চা বুদ্ধ সমর্থন করেননি, কিন্তু জনসমাজে এ সব যথেষ্টই প্রচলিত ছিল। এ ব্যাপার সব ধর্মের বেলাতেই ঘটে, বিশেষত যেগুলি ঈশ্বর বা বিধাতা পরমাত্মাকে স্বীকার করে মানুষের ভাগ্যের চূড়ান্ত নিয়ন্তা হিসাবে এবং সাধারণ মানুষকে নিয়তির আবরণটা ছিন্ন না করতে শিক্ষা দেয়। কিন্তু সাধারণ লোক যারা দুঃখে জর্জরিত, অভাবে পীড়িত, ব্যাধিতে আক্রান্ত, বিপদে সংকটাপন্ন তারা যে নিষ্প্রতিবাদে ভাগ্যকে মেনে নেবে এটা আশা করা যায় না; তারা তো অপেক্ষা করবেই দুর্দিন কেটে গিয়ে সুখের মুখ কবে দেখতে পাবে। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানরাও এর জন্যে অপেক্ষা করে, তারা সর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকে, পাছে তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ বা আসাধু উপায়ে অর্জিত বিপুল সম্পত্তি কেউ ছিনিয়ে নেয়। অন্তরের অন্তরালে তারা জানে যে, ওই ধনে তাদের কোনও ন্যায়সংগত অধিকার নেই, কাজেই সুখসম্ভোগে সর্বদাই মিশে থাকে কেড়ে-নেওয়া ধন-ভোগের গ্লানি; বিশেষত যেখানে চারিদিকে জনসাধারণের নিষ্প্রতিকার যন্ত্রণা। তাই তাদের সর্বদাই হারাই হারাই ভয়। সম্পত্তি চিরকালের জন্য করতলগত বা বংশে বন্দি করবার জন্যে তারা নিয়তিকে নানা ভাবে মিনতি, অনুরোধ, উপরোধ জানায়। এই সৌভাগ্যবান ধনিক শ্রেণিই নিয়তি সম্বন্ধে লোকচেতনায় কুসংস্কারের সৌধনির্মাণের একটি মজবুত ভিত্তি নির্মাণ করে। এরই উপরে নিয়তিবাদ তারা নানা অনুষঙ্গ ও প্রকাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই শ্রেণির উদগ্র লোভ ও সাধারণ মানুষের অপ্রতিকার দুঃখভোগ— এই টানাপোড়েনেই বোনা হয় নিয়তিবাদ।
কোনও গুরুত্ব-বা তাৎপর্যপূর্ণ কাজ শুরু করবার আগে ‘তিথি’ বা পঞ্জিকার শুভ দিন-ক্ষণ নিয়ে খুব মাথা ঘামানো হয়ে থাকে, যেমন বিয়ে কিংবা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে। বৃহন্নারদীয়পুরাণ-এ গোটা একটা অধ্যায় (২৭) জুড়ে তিথিনিরূপণের নানা নির্দেশ। মৎস্যপুরাণ-এ একটি পুরো অধ্যায়ে প্রস্থানের তিথি নিয়ে বিচার (২৩৯), আর একটি অধ্যায়ে গৃহনির্মাণের শুভলগ্ন নির্ণয়। (২৪২) বিভিন্ন ধরনের বর্ষগণনা ও তাদের চরিত্র ও ফল বিভিন্ন ঋতুর, মাসের, গ্রহ-নক্ষত্রের, শুভদিন-ক্ষণের, ‘করণে’র বিবরণ ও সেগুলির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, ‘হোরা’, ‘কুলিক-বেলা’, লগ্ন অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ কাজের পক্ষে অনুকূল প্রহর, গ্রহনক্ষত্রের প্রভাবের স্বরূপ, দেশবিদেশ ও অবস্থা-বিশেষে— এ সবের বিবরণ। বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের ৮২ থেকে ১০৫ অধ্যায়ের অংশে দীর্ঘ বিবরণ পাই, প্রচুর অনুপুঙ্খসহ গ্রহযজ্ঞ অনুষ্ঠান এবং গ্রহ ও নক্ষত্রের বিশেষ বিশেষ সমাবেশের। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ এবং তারই সঙ্গে রাজার জীবনের ওপরে গ্রহনক্ষত্রের প্রভাব বিবৃত হয়েছে আর একটি অংশে। (১৯৯-১৭৪ অধ্যায়)
মিথুইজম-এরও কিছু ধর্মতত্ত্ব বিশ্বাস জ্যোতিষের সঙ্গে সংযুক্ত। মিথ্রবাদীরা বিশ্বাস করতেন, মানুষের জীবনের ওপরে সূর্য, চন্দ্র এবং গ্রহগুলির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আছে; এরা মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। জোরাষ্ট্রীয়ধর্মে কাল বা ‘জুবান অকরন’অন্তরিক্ষের অপরিবর্তনীয় গতিকে নিয়ন্ত্রিত করে। এর থেকে সরাসরি উঠে এল নিয়তিবাদ। মিথ্রবাদের সঙ্গে অন্যান্য নিয়তিবাদী মতের পার্থক্য এইখানে যে এর তত্ত্বগত নিয়তিবাদ মানুষের কর্মপ্রচেষ্টাকে নিরুদ্ধ করেনি। বাস্তবত, মিথুবাদ উদ্যমের অনুকূল একটি মতবাদ। জ্যোতিষে এবং তৎসংশ্লিষ্ট নিয়তিবাদে এর বিশ্বাস এমন কোনও যুক্তিনির্ভর কাঠামো নির্মাণ করেনি, যাতে কর্মোদ্যোগ ব্যাহত হতে পারত। অর্থাৎ এর বিভিন্ন উপাদানগুলি পরস্পর-সাপেক্ষ অথবা পরস্পর-সংশয়ী ছিল না। এ কথা অবশ্য অধিকাংশ ধর্ম সম্বন্ধেই সত্য। ‘জুবান’ বা কাল যেখানে নিয়ামক দেবতা এবং সূর্য চন্দ্র ও গ্রহগণের সম্পর্কে যেখানে বিশেষ সম্ভ্রম, সেখানে শুভ ও অশুভ যে জ্যোতিষ্কদের সমাবেশ ও গতিবিধি থেকে নির্ণীত হবে, তাতে বিষ্ময়ের কিছু নেই। এরা বিশ্বাস করত যে, মনুষ্যজীবনের ওপরে এ সমস্তের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা আছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, সূর্য-চন্দ্র গ্রহগণের উপাসনা পুরাণগুলিতে বিরাট একটি অংশ হয়ে উঠেছে। বামনপুরাণ-এ একটি পুরো অধ্যায় (৮০) রয়েছে এই জ্যোতিস্কগুলি সম্বন্ধে। নারদপুরাণ-এর অংশবিশেষ (২:১৮-২০) এবং অন্যত্রও জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ সম্পর্কে আলোচনা করেছে। একটি বিশেষ ‘বিজ্ঞান’, সামুদ্রিক লক্ষণ [স (=সহ) + মুদ্রা (=শারীরিক অবয়বসংস্থান, শুভ বা অশুভ, এই হল ব্যুৎপত্তি]। এ দিয়ে শরীরের লক্ষণ থেকে জাতকের ভাগ্যভবিষ্যৎ বলে দাবি করে ওই ‘বিজ্ঞানী’রা। (অগ্নি ৩৩:১-৯; পুরুষ সম্বন্ধে ২৪৩ অধ্যায়, নারী সম্বন্ধে ২৪৪ )
কিন্তু যে বিষয়টির সবিস্তারে চর্চা হত তা হল নিমিত্ত বা লক্ষণ; নিমিত্ত মানুষের ভাগ্যে শুভ বা অশুভ আনে এবং মানুষ চিরদিনই, সর্বত্রই জানতে উদগ্রীব যে তার ভাগ্যে কী আছে। এই কারণেই এই অপবিজ্ঞানটি সর্বত্র সমাদৃত। যাত্রাকালে যেগুলি দেখলে যাত্রা শুভ হয়, ইষ্টসিদ্ধি হয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ তার একটি তালিকা দিয়েছে:
পূর্ণ কুম্ভ, ব্রাহ্মণ, গণিকা, শ্বেতধান্য, দর্পণ, দধি, ঘৃত, মুড়ি, পুষ্প, দুর্বা, শ্বেতলাজ (খই), বৃষভ, হস্তি, অশ্ব, জ্বলন্ত অগ্নি, সুবর্ণ, পত্র, পক্ক ফল, সধবা নারী ও জীবিত সন্তানের মাতা, প্রদীপ, মণি, মুক্তা, পুষ্পমালা, সদ্যঃকৃত্ত মাংস, চন্দন কাষ্ঠ, শৃগাল, নকুল, কলস, বামদিকে মৃতদেহ, রাজহংস, পারাবত, শ্বেত চিল, চক্রবাক, শুক, কোকিল, ময়ূর, খঞ্জন, কৃষ্ণমৃগ, গাভী, চমরী গাভী, শ্বেতচমর, সবৎসা গাভী এবং দক্ষিণ দিকে শ্বেতপতাকা। (গণেশখণ্ড ১৬:২৩-২৯)
ওই পুরাণের যাত্রাকালে মাঙ্গলিক বস্তুর অন্য একটি তালিকা আছে:
কৃষ্ণমৃগ, হস্তি, সিংহ, অশ্ব, গণ্ডার, চমরী, রাজহংস, শ্বেত চিল, শুক, কোকিল, ময়ূর, খঞ্জন, চক্রবাক, তিত্তির, পারাবত, সারস, কারও হংস, সদ্যঃকৃত্ত মাংস, জীবন্ত মৎস্য, শঙ্খ, সুবর্ণ, মাণিক্য, রৌপ্য, মুক্তা, হীরক, প্রবাল, দধি, লাজ, শ্বেত-ধান্য, শ্বেত-পুষ্প, অলক্তক, পত্র, পতাকা, ছত্র, দর্পণ, শ্বেতচামর, সবৎসা গাভী, রথারূঢ় রাজা, দুগ্ধ, ঘৃত, পূগ (সুপারি), অমৃত, মধু, পায়স, শালগ্রাম, শিলা, পক্ক ফল, স্বস্তিকাচিহ্ন, শর্করা, বিড়াল, শক্তিমান বৃষভ, মেষ, শিলামুষিক, মেঘাচ্ছন্ন আকাশে উদীয়মান সূর্য, চন্দ্র, মৃগনাভি, ব্যজন, জল, হরিদ্রা, তীর্থমৃত্তিকা, শ্বেতসর্যপ, কৃষ্ণসর্যপ, দূর্বা, ব্রাহ্মণবালক, বালিকা, মৃগ, গণিকা, মধুমক্ষিকা, কর্পূর, পীতবসন, গোমূত্র, গোময়, গোক্ষুরে উত্থিত ধূলি, গো-পদ চিহ্নিত ভূমি, গোশালা, গোচারণ পথ, সুন্দরী নারী, গোষ্ঠ, গাভীর শুভ যাত্রাগতি, অলংকার বিগ্রহ, জ্বলন্ত অগ্নি, মহোৎসব, তাম্র, স্ফটিক, বৈদ্য, সিন্দুর, মাল্য, চন্দন-পঙ্ক, সুরভি, হীরক ও মণি— সবই যাত্রাকামীর দক্ষিণে এবং এরই সঙ্গে চাই সুগন্ধ বায়ুপ্রবাহ। (গণেশখণ্ড ৩৩:১৮-২৯)
ওই গ্রন্থে তৃতীয় একটি তালিকায় দেখি:
বামে শবদেহ, শৃগালী, পূর্ণকুম্ভ, নকুল, ভাসপক্ষী, সালঙ্কারা, জীবৎপুত্রভর্তৃকা নারী, শ্বেতপুষ্প, ধান্য, খঞ্জন, সবৎসা গাভী, শ্বেত অশ্ব, রাজহংস, গণিকা, পুষ্পমাল্য, পতাকা, দধি, পায়স, মাণিক্য, সুবর্ণ, রৌপ্য, মুক্তা, রত্ন, সদ্যঃকৃত্ত মাংস, চন্দনপঙ্ক, সুরা, উত্তম ঘৃত, কৃষ্ণমৃগ, ফল, লাজ, শ্বেতসর্ষপ, দর্পণ, সুসজ্জিত রথ, শ্বেত চিল, চকোর, বিড়াল, পর্বত, মেঘ, ময়ূর, শূক, সারস ও শঙ্খধ্বনি। (কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৭০:২৩-২৯)
এই ভাবেই মানুষের জীবনে দুর্নিমিত্তেরও বিশেষ ভূমিকা আছে। পামর কংস মৃত্যুর পূর্বে একটি স্বপ্ন দেখে: এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। দুর্নিমিত্ত মৃত্যুকেও সূচিত করে:
আসন্ন-মৃত্যু ব্যক্তি দেখে সূর্যমণ্ডল নিষ্প্রভ, বাস্তবেই হোক বা স্বপ্নেই হোক, দেখে রৌপ্যময় মলমূত্র ত্যাগ করছে (এক ব্যক্তি); এই সব দর্শন যার ঘটে সে দশ মাসের মধ্যে মারা যায়। যদি সুবর্ণবৃক্ষ দেখে বা গান্ধর্বনগর, তা হলে ন’ মাসের মধ্যে মারা যায়। হঠাৎ যদি মোটা বা রোগা হয়ে যায় তা হলে আট মাসের মধ্যে মরে; বালিতে বা কাদায় যার পদক্ষেপ হালকা বা ভারি হয়ে যায় সে মরে সাত মাসে; যার মাথায় কাক, পায়রা, গৃধ্র বা মাংসাশী এসে বসে সে মরে ছ’ মাসে। যে কাক পরিবৃত হয়ে ঘোরে কিংবা যার চারিদিকে বালির বর্ষণ হয় কিংবা শুচিস্থানে যে বিকৃতি দেখতে পায়, কিংবা নিজেকে কবন্ধ হিসেবে দেখতে পায় তার মৃত্যু এক মাসের মধ্যেই ঘটে। যে শবের বা বসার (চর্বির) গন্ধ পায়, সে পক্ষকালের মধ্যে মরে। যার স্নানের অব্যবহিত পরেই হৃৎপিণ্ড শুষ্ক বোধ হয়, কিংবা যার মাথা থেকে ধূম উদ্গত হয় তার মৃত্যু হয় দশদিন পরে। জলের সংস্পর্শে যার শরীর অভ্যন্তরে খণ্ডিত বোধ হয় তার মৃত্যু আসন্ন। যে স্বপ্নে ভাল্লুকে বা বানরে টানা রথ দেখে, যে রথে সে নিজে বসে আছে আর তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার মরণক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। (লিঙ্গ পুরাণ, পূর্বভাগ ৯১ অধ্যায়)
তালিকাগুলি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মাঙ্গলিক বস্তুগুলি হয় উর্বরা শক্তির বা প্রাচুর্যের প্রতীক, কিংবা শোভা, শৌর্য বা শুচিতার প্রতীক। এরই উল্টো হল অশুভ শক্তির প্রতীকগুলি যেগুলি দুর্ভাগ্যের সূচনা করে, নিচু সামাজিক অবস্থান বা দুর্দৈবের, অশান্তি ও অন্ধকারের অনুষঙ্গ বহন করে। যে সব চিহ্ন আসন্ন মৃত্যু ঘোষণা করে সে সব বস্তুত চিকিৎসাবিদ্যায় দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধির লক্ষণ অর্থাৎ— চিকিৎসাবিদ্যার তত্ত্ব কিংবা তারই চিহ্নধারী কোনও প্রতীক। এই সব ক্ষেত্রে সিদ্ধি বা ব্যর্থতার কিংবা মৃত্যুর দূত প্রেরিত হয় কোনও অতিপ্রাকৃত জগৎ থেকে এবং এ বাণী আসে রহস্যঘন ভাষায় আসন্ন দুর্দৈবের সংবাদ নিয়ে।
এটি খুবই বিস্ময়ের যে, যদিও এই সব প্রতীকী বাণীর কাঠামোটি বহু পূর্বেই দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতাব্দীতে— মহাকাব্য দুটির পরবর্তী প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিতে অভিপৌরাণিক চরিত্র সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রতীকী চিহ্নের পূর্ণ বিকাশও ঘটেছিল গুপ্ত বা গুপ্তোত্তর যুগে, তখনই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সেই পুনরুভ্যুত্থান ঘটে যার বর্তমান নাম হিন্দু। পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে নৌবাণিজ্য যখন ক্ষীণ হয়ে এল তখন জনসমাজকে একটা আত্মসন্তুষ্টি পেয়ে বসল। স্বয়ম্ভরতা, গ্রহণক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে একটা দ্বৈপায়ন মনোবৃত্তির সৃষ্টি হল; এই আবহাওয়ায় নতুন চিন্তাধারা গ্রহণের আগ্রহ সংকীর্ণ হয়ে গেল। অতএব ভাগ্য সম্বন্ধে এই নিমিত্তবিচার একটি সার্বভৌম ভূমিকা লাভ করল। সংস্কৃত সাহিত্য নিমিত্ত-লক্ষণে পূর্ণ, স্বপ্ন, দৈববাণী এবং নানাবিধ ব্যাখ্যা একটি গোষ্ঠীর পেশা উঠল। এটি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে এল যে, সাহিত্য ও অলংকারশাস্ত্র বলতে লাগল, নারী ও পুরুষের প্রেম শুধু যে কল্পনামধুর তা নয়, এটা সংঘটিত হয় অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার হস্তক্ষেপে; স্বপ্নে এমনকী প্রতিকৃতিতে পরস্পরকে দেখেও প্রেম সঞ্জাত হয়। সমাজের উচ্চমার্গে অবিবাহিত নারীপুরুষের পরস্পরকে দেখার সুযোগ কমে আসছিল, কাজেই প্রেম অদর্শনে, প্রতিবিম্বে বা স্বপ্নেও সাধিত হচ্ছিল। প্রাথমিক যোগাযোগ এই কৃত্রিম উপায়েই হচ্ছিল। সেই ভাবেই ভাল বা মন্দ নারী বা পুরুষের যে সব লক্ষণ দিয়ে তাদের বিচার করা যাবে, ভবিষ্যৎ নিরূপণ করা যাবে, এ সব হয়ে দাঁড়াল অতিপ্রাকৃতির একটি প্রকাশ। ভবিষ্যদ্বাণী সর্বদাই ছিল, কিন্তু গুপ্তোত্তরযুগে তার গুরুত্ব কমে গেল, যদিও পুরো ইতিহাসেই ইতস্তত তাদের দেখা যায়।
কোনও গুরুত্বের কাজে হাত দেওয়ার আগে বিশেষত জন্মমৃত্যুবিবাহের পূর্বক্ষণে যে উদ্বেগ থাকে তাতে মানুষের সাধারণ বোধবুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে যায়, যেমনটি হয় নিরাপত্তার বোধ চলে গেলে; সংশয়ই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। বাণিজ্য, নৌযাত্রা, যুদ্ধযাত্রা, দীর্ঘযাত্রা বা দুরারোগ্য রোগের মুখোমুখি হয়ে মানুষ বিশেষজ্ঞকে ডেকে আনে, সে গণনা করে এবং নির্দেশ দেয়। মৃত্যু সম্বন্ধে বহু ভবিষ্যদ্বাণী সত্যিই আতঙ্কের হয়ে ওঠে, রোগীর বাঁচার ইচ্ছেটাই নষ্ট করে দেয়; বৈদ্যের সারানোর ইচ্ছেকেও আড়ষ্ট করে দেয় এবং অসাড় করে দেয় প্রিয়জনদের। কিন্তু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজে হস্তক্ষেপ করবার পূর্বে মানুষ অপেক্ষা করে তেমন কোনও চিহ্নের, যা নিয়তির আড়ালখানা ভেদ করতে পারে; ফিসফিস করে শোনা কোনও নির্দেশ, কিছু সতর্কবাণী, পূর্ব সাবধানবাণী, আশ্বাস— একজন বিভ্রান্ত মানুষ এই সবই অবলম্বন করে বাঁচে। কাজেই বেঁচে রইল শাকুনশাস্ত্র, দিকে দিকে বিস্তার লাভ করল নিমিত্ত নিদান। সমাজে নিয়তিবাদের মুষ্টি যত দৃঢ় হয় ঠিক সেই অনুপাতেই এগুলিও ব্যাপ্তি পায় ও জনমানসে গভীরতর অবস্থানে চলে যায়। অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃতিতেও যেমন ভাগ্যবাদ কর্মবাদের পরিপন্থী, তেমনই জন্মান্তরবাদেরও। বিধায়ক ঈশ্বরের তত্ত্ব যখন মোক্ষ বা নির্বাণের তত্ত্বের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত, সে সময়ে জ্ঞান অস্থায়ী দুর্গ বা নরকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বিভ্রান্ত সমাজ সেই ‘বিশেষজ্ঞ’কে অবলম্বন করে কোনও সর্বজন-স্বীকৃত বিচারক বা জুরি ছাড়াই, যাঁর রায় ওই স্বর্গনরক-বাসকে আইনসিদ্ধ করে তোলে।
নিয়তিবাদের পূর্বশর্ত হল জ্ঞানাভাব, নিরাপত্তার অভাববোধ, জানবার জন্য দাম দিতে প্রস্তুতি এবং ভাগ্যকে নিজের অনুকূলে প্রসন্ন করে তোলার আকুলতা। স্বপ্নে, ভবিষ্যদ্বাণীতে, দৈববাণীতে, জ্যোতিষে, নিমিত্ত-লক্ষণে, বিহঙ্গলক্ষণশাস্ত্রে, পশুর অস্ত্রপরীক্ষায়, দেবতার ‘ভর’-এ, মৃতের সঙ্গে সংলাপে এবং এই জাতীয় অন্যান্য প্রক্রিয়ায় আপৎসংকুল মানুষ বাইরের দৈবকে নিজের মুঠোয় ধরতে চায় এবং সম্ভব হলে নিজের অনুকূলে ঘুরিয়ে আনতে চায়। এই সব অতিপ্রাকৃত প্রতীকী ভাষাকে ব্যাখ্যা করে সমাজ নিযুক্ত অভিজ্ঞ বা শাস্ত্রজ্ঞ লোকেরা। এদের ব্যাখ্যাটা উদ্বেগ-ব্যাকুল মানুষটিকে যা দেয় তা হল এক ধরনের ‘জ্ঞান’– সমাজে স্বীকৃত জ্ঞানের পরিসরের মধ্যেই। এই জ্ঞান পেয়ে লোকটি সাফল্যের আশ্বাস পেয়ে সেই কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করে, অথবা সে ক্রিয়াকাণ্ড থেকে নিবৃত্ত হয়ে আসন্ন সর্বনাশের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে। ঠিক সহকর্মী নির্বাচন করে, ভুল সহকর্মীকে ত্যাগ করে, দুশ্চিহ্নগ্রস্ত পুত্রকে ত্যাগ করে, সে প্রতিপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয় কিংবা তার কাছে আত্মসমৰ্পণ করে; সে যুদ্ধ অভিযান বা বাণিজ্যযাত্রা করে বা ত্যাগ করে; অনন্যোপায় হয়ে আসন্ন মৃত্যুকে স্বীকার করে। আর যাই করতে বাধ্য হোক, ওই সব বাণী যে অতিপ্রাকৃতের সন্ধান দেয় তার বিরুদ্ধে মানুষকে লড়তে বলে না; কারণ যে শক্তি মানুষের নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করে এ সব সন্ধান আসে সেই শক্তির কাছ থেকে, যে শক্তিকে মানুষ কোনও নির্দেশ দিতে পারে না। সবচেয়ে বেশি যা পারে তা হচ্ছে ওই ক্রুদ্ধ কোনও শক্তিকে তোয়াজ করা, বা কোনও কুপিত শক্তিকে প্রসন্ন করবার চেষ্টা, যাতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো যায়, যদি তা ওই শক্তির দ্বারা প্রকাশিত হয়ে থাকে। এই অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলির কিছু অমোঘ অপরিবর্তনীয়তা আছে। সংসিদ্ধ ঘটনা হিসেবে তাদের প্রকাশ ঘটে, অন্তত ধারণার জগতে, মানুষের ভাগ্যের বিভিন্ন দিকে প্রকাশ রূপে। মানুষ বড়জোর তার ভাগ্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারে, কিন্তু ভাগ্যের গতি প্রতিহত বা ব্যাহত করতে পারে না। এক অর্থে তাই ওই জ্ঞান নৈতিক ভাবে কর্মশক্তিকে যেন অসাড়, পক্ষাঘাত-গ্রস্ত করে রাখে। তাত্ত্বিকরাও এ বিষয়ে অস্পষ্ট ভাবে হলেও অবহিত ছিলেন। জনতার এক অংশও অস্পষ্ট ভাবে হলেও বুঝতে পেরেছিল যে তখনই দুর্বলতা সৃষ্টি হয় যখন শুধু একটি আগামী ঘটনার পূর্বাভাস পাওয়ার জন্যে হাতড়াতে গিয়ে তাদের আশা ও আগ্রহ নিঃসীম অন্ধকারে অবসিত হয়। শেষ অধ্যায়ে আমরা এ আলোচনা করব। এই সব শক্তির প্রকাশ বা পূর্বাভাসের এমন একটা প্রবল প্রভাব জনসাধারণের ওপরে ছিল, যা সর্বব্যাপী এবং অন্তত আপাত ভাবে অনিঃশেষ। এই সব পূর্বাভাস পাওয়ার জন্যে মানুষ সর্বদাই উৎকণ্ঠিত থাকে, সবলে এদের আঁকড়ে থাকে, যদিও ম্যাকেবেথের ডাইনিদের মতো ভবিষ্যদ্বাণী তাদের আরও গভীর জলে নিয়ে গিয়ে ডোবায় যা তাদের কল্পনারও অতীত; এবং শেষ পর্যন্ত আরও বৃহত্তর সর্বনাশের সূচক হয়ে ওঠে। কিন্তু সম্ভাব্যতার নিয়ম অনুসারে এই সব পূর্বাভাসের কিছু অংশ তো মিলতেই পারে এবং এরই সমর্থনে যুগে যুগে ওই আভাসটুকু ছলে বলে জেনে নেওয়ার আকুতি দীর্ঘজীবন পেয়ে যায়।