নিয়তি ও প্রতিকারের চেষ্টা
‘সত্যক্রিয়া’ একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার উদ্দেশ্য হল আরোপিত অপরাধের প্রতিকার। এ হল নিয়তির কাছে তির্যক আবেদন, যে-নিয়তি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। মিথ্যা অপবাদ দিলে অভিযুক্ত মানুষ অনেক সময়ে প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলির কাছে তার নির্দোষিতা প্রতিপন্ন করার জন্যে আবেদন জানায়। ‘সত্যক্রিয়ার নানা প্রকারভেদ এবং শপথের অনুষ্ঠান (আছে)। (এর) পুরো তত্ত্বটিই সভ্যতার আধুনিকতম স্তরেও নির্ভর করে শর্তাধীন অভিশাপকে তত্ত্বের ওপরে, প্রায়ই শর্তাধীন আত্মাপরাধ ঘোষণায়। এই যে শপথ, এর দ্বারা মানুষ যা বলছে তা মিথ্যা হলে নিজের ওপরে কোনও অশুভকে সে আহ্বান করে। প্রতীকী জাদুক্রিয়ার যত উপাদান তা সবই টেনে আনা হয় এই (সত্যক্রিয়ার) বহুবিধ তত্ত্বের উদাহরণে।… শপথের মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে মিথ্যাভাষণের শাস্তি। প্রাচীন রাষ্ট্রগুলিতে সব আইনের সঙ্গে জোড়া থাকত উন্মার্গগামীর উদ্দেশ্যে একটি অভিশাপ।… ধীরে ধীরে আইন সেই অভিশাপের ভূমিকা অধিগ্রহণ করে কতকটা যেন ক্ষতিপূরণের ভঙ্গিতে।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন অ্যান্ড এথিক্স ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭৩-৭৪) ভারতবর্ষে এই সত্যক্রিয়ার প্রথম দেখা পাই ঋগ্বেদ-এ (৭:১০৪:১৫) যেখানে এক ব্যক্তি বলছে, সে যদি সত্যিই রাক্ষস হয়ে থাকে, তবে যেন সেই দিনই তার মৃত্যু হয়; স্পষ্টতই তার শত্রু তার বিরুদ্ধে রাক্ষসত্বের অভিযোগ এনেছিল। এখন জীবনমৃত্যর আধিকারিক সেই অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলি যেগুলিকে সে তার নির্দোষিতা প্রমাণ করবার জন্যে আহ্বান করছে। অর্থাৎ সে যে যথার্থই মানুষ, রাক্ষস নয় এ কথা প্রতিপন্ন করার জন্যে এবং সে যদি যথার্থই রাক্ষস হয়ে থাকে, যেমন প্রতিপক্ষ বলছে, তা হলে যেন তার অবিলম্বে মৃত্যু হয়। কেমন করে সে আশা করে যে এমনটাই ঘটবে? বিশ্ববিধানের অন্তর্গত কোনও কোনও যথার্থ সুবিচারের ওপরে তার একটি একান্ত বিশ্বাস আছে— এমন এক নিয়তির ওপরে, যার বিধানে এক ধরনের নৈতিক সমস্যা আছে। তাই এই সত্যক্রিয়া।
সিন্ধুসভ্যতার কালে রাজারা কী ভাবে তাদের রাজত্ব চালাতেন তা জানবার কোনও উপায়ই নেই, সে যুগের আইনের কোনও নথিপত্রও আমাদের কাছে পৌঁছয়নি। অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়নি, তাই মনে হয়, পুরোহিত ধর্মীয় অনুজ্ঞা দিয়েই প্রজাদের রাজার বশীভূত রাখত। ধর্মের সঙ্গে বহুলাংশে জাদুবিদ্যারও প্রয়োগ ছিল বলে মনে হয়। যাযাবর গোষ্ঠীবদ্ধ আর্যরাও সম্ভবত একান্ত ভাবেই গোষ্ঠীপতির অধীনে ছিল এবং বিরোধ বা সংঘর্ষে দলপতির বিচারই ছিল শেষ কথা। লিখিত দলিল না থাকায় ঋগ্বেদ-এ উল্লিখিত ‘সভা’ আহ্বান করা হত এবং সমাজ-প্রবীণেরা কোনও বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিগুলি আলোচনা করে একটা রায় দিতেন যা বাদী-প্রতিবাদী উভয়কেই মেনে নিতে হত। এটা লক্ষণীয় যে, গোষ্ঠী ভেঙে যাওয়ার একটা ফল হল একটা সাধারণ আইনের উদ্ভব, যার প্রথম প্রতিলিপি পাই কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-তে; সম্ভবত এর সূচনা মৌর্য সাম্রাজ্যের আগেই। রোমেও যেমন এখানেও তেমন, আইনের চোখে সমাজের সব মানুষ সমান ছিল না; রোমের ‘নাগরিক’ যে বিশেষ সুবিধা ভোগ করত তার থেকে ক্রীতদাস, বিদেশি ও অপরাধী বঞ্চিত ছিল। তা হলে এ-নীতিতে একটা সাম্যবোধ ছিল, বিশেষত অপরাধ ও দণ্ডের অনুপাতে, যদিও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির জন্যে বিভিন্ন আইন প্রযুক্ত হত। কিন্তু প্রত্যেক শ্রেণির মধ্যে আইনের একট সমদৃষ্টি ছিল। ভারতবর্ষে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র জাতিভেদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে; কিন্তু এর মধ্যে বর্ণানুক্রমে হলেও অপরাধ ও দণ্ডের মধ্যে একটা স্পষ্ট অনুপাত আছে। এ সমস্ত ভূমিকার উদ্দেশ্য হল এমন একটা যুগকে কল্পনা করা যখন গোষ্ঠী ভেঙে গেছে, কিন্তু যথার্থ দণ্ডনীতি বা আইনের কোনও নির্ভরযোগ্য ও সর্বজনসম্মত শাস্ত্র গড়ে ওঠেনি। বৈদিক ‘সভা’র জায়গায় যে সামাজিক বিধায়করা ছিলেন তাঁরাই বিচারক, ‘জুরি’ও ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা পালন করতেন। সত্যকার নথিবদ্ধ আইন না থাকায় একটা জায়গা ছিল যেখানে সংশয়কে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন ছিল, যেখানে নিরপরাধিতা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হতে পারত না এবং অবৈধ দণ্ডদানকে সার্থক ভাবে আটকানো যেত না। এই আইনের ফাঁকের যুগে, যুগের ক্রান্তিকালে চালু ছিল সত্যক্রিয়া। পরবর্তী নীতিশাস্ত্রকাররাও সত্যক্রিয়াকে মেনে নিয়েছিলেন বৈধ বিচারেরই অন্যতম একটি প্রক্রিয়া হিসেবে। এটি ছিল চার রকমের— অগ্নি, জল, বিষ ও তুলাদণ্ড। যত নিষ্ঠুরই হোক এ প্রক্রিয়ার প্রত্যয়গত ভিত্তি ছিল সেই অদৃশ্য শক্তিগুলি যা মানুষের ভাগ্য নিরূপণ করে। নিয়তি কখনও নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাস্তির কষ্ট পেতে দেবে না; অতিলৌকিক ভাবে দেবতারা বা প্রাকৃতিক শক্তিগুলি অন্যায় ভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তির সপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। কাজেই সত্যক্রিয়া পশ্চাতেও নিয়তিতে বিশ্বাস ছিল।
অর্থশাস্ত্র-র যে পাঠ পাই তা সম্ভবত গুপ্তযুগের প্রথম পর্যায়ের রচনা; কিন্তু তারা বহু পূর্বে নীহারিকার মতো অস্পষ্ট হলেও একটা বিচার ও দণ্ডবিধির প্রচলন নিশ্চয়ই ছিল, সম্ভবত ষোড়শ মহাজনপদের কালেই এর উদ্ভব। কিন্তু রাজারা তখন মামলা নিষ্পত্তি করতেন রাজ্যের অলিখিত নীতির ঐতিহ্য অনুসারে, পুরোহিত, মন্ত্রী ও ন্যায়াধীশের সাহায্যে। কৌটিল্যের আগে আর্যাবর্তে প্রচলিত কোনও সাধারণ নীতিগ্রস্থ ছিল না। কৌটিল্যের পূর্বে, সমকালে এবং পরেও অগ্নি, জল, বিষ ও তুলার দ্বারাও বিচার হত; আগুনে নিরপরাধ পুড়বে না, জলে ডুববে না, বিষে মরবে না ও তুলায় লঘুভার প্রমাণিত হবে না। এই ধরনের আরও দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত বহু প্রক্রিয়া ছিল যেগুলিকে নীতিগ্রন্থ পরে স্থান দেয়— যেমন সত্যক্রিয়া। সীতার অগ্নিপরীক্ষা যাকে বলা হয়, তা আসলে অগ্নির দ্বারা সীতার নিরপরাধিত্ব প্রমাণ করা। রাম তাঁর সতীত্বে সন্দেহ করেন জানতে পেরে সীতা মৃত্যুবরণের ইচ্ছায় জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করতে চেয়ে লক্ষ্মণকে চিতা প্রস্তুত করতে বলেন। ঘটনাচক্রে তাঁর চিতারোহণটা পরিণত হল সত্যক্রিয়ায়, যখন অগ্নি স্বয়ং এবং দেবতারা তাঁর সতীত্ব সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিলেন। নারীর সতীত্ব ও পুরুষের নিরপরাধিত্বের প্রমাণ মাঝে মাঝে মহাকাব্যে পুরাণে এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্বিংশ শতকে ডাইনি ও অসতী বলে অভিযুক্ত এক নারীকে নদীর স্রোতে ডুবে গিয়ে ওই রকম জল পরীক্ষা দিতে হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায়— এ দুটি অভিযোগে সারা পৃথিবীতে কত কোটি নারীকে যে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এবং এখনও হয়, তার আর ইয়ত্তা নেই। শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতকে (১৭১০-১৭৫০) রাজা হাম্মুরাব্বি পৃথিবীতে প্রথমবার একটি নীতি বা আইন প্রণয়ন করেন। ওই সত্যক্রিয়াটির উদ্ভব ইয়োরোপীয় সংস্কৃতিতে, সরাসরি বিভিন্ন জার্মান গোষ্ঠীর রীতির খ্রিস্টীয় বা রোমান আইনে রূপান্তর ঘটে, কারণ এটিকে তত দিনে ‘দিব্য’ সুবিচারের অঙ্গ বলে গ্রহণ করা হয়েছে।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ১১শ খণ্ড ‘অর্ডীল) ভাবটা এই ছিল যে, দিব্য বিচারালয়ে যখন আপিল করা হত তখন তাঁরা মিথ্যা বিচার করতে পারতেন না, করলে তাঁদের সুবিচারের সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তাই ‘সত্যক্রিয়া’ ন্যায়বিচারের শক্তিগুলিকে অতিলৌকিক উপায়ে আবেদনকারীর কাছে সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করত। এ হল ভাগ্যের দরবারে ধরনা দেওয়ার অন্য এক পদ্ধতি, যাতে নিয়তি সরব হয়, মিথ্যা অভিযোগ ও দুর্বিচার প্রতিহত হয়। নিয়তির বিচারকে নিজের অনুকুলে আনবার জন্য মানুষ যা যা করত, তার মধ্যে একটি হল প্রায়শ্চিত্ত। পাপের দণ্ড তো হবেই; হয় নিয়তির রায় দণ্ড নিরূপণ করবে অথবা করবেন মহাবিশ্বের অধিষ্ঠাতা— তাঁকে ঈশ্বর, দেবতা, বিধাতা, ধর্ম যে নামই দেওয়া হোক না কেন। ঋগ্বেদে মহাবিশ্বের অন্তরালে ক্রিয়াশীল নীতিকে ‘ঋত’ বলা হত, এই নীতিই মানুষকে তার পাপের, ভুলের বা অপরাধের জন্য দণ্ড দেয়। ঋতই আহ্বান করে আত্মপক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা। যেহেতু পাপ অনিবার্য ভাবে দণ্ডিত হবেই, তাই মানুষ হয় পূর্বাহ্নেই প্রায়শ্চিত্ত করে, নয়তো পাপাচরণের পরে করে। প্রায় সব প্রাচীন সভ্যতাতেই পাপ বা অপরাধ সম্বন্ধে একটা বোধ ছিল আর ছিল পাপকে দণ্ড দিতে উদ্যত অতিলৌকিক কোনো শক্তি সম্বন্ধে সচেতনতা। প্রায়শ্চিত্ত বা পাপমোচন হল দৈবদণ্ডের আশঙ্কায় মানুষী ক্রিয়া।
‘বিশ্বাস ছিল যে, মানুষের কর্ম তিন ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। প্রথমত, পূর্ব-পাপের জন্য অনুশোচনার দ্বারা, অর্থাৎ সৎ জীবনযাপনের অভ্যাসের দ্বারা (সৎকর্ম পাপের বা অসৎকর্মের শক্তিক্ষয় করে)। দ্বিতীয়ত, কোনও ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, কোনও সাধু বা সাধ্বী যখন মন্ত্র উচ্চারণ করেন ও তার জন্যে ধর্মানুষ্ঠান করেন, তখন সেই সাহায্য— তার নিজের সৎকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে— তার মন্দ ক্রিয়াকে বিনাশ করে বা (পুণ্যে) উন্নীত করে। তৃতীয়ত, যদি কোনও আত্মীয় বা পুণ্যাত্মা ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পরে কোনও বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণ করে তা হলে এই সব সৎকর্ম আপন পুণ্যে মৃতের সঞ্চিত অপকর্মের লাঘব ঘটায়।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ৮ম খণ্ড, পৃ. ২৬৭) কাজেই প্রায়শ্চিত্ত পরার্থেও হতে পারে, অন্তত কোনও কোনও ধর্মে, কিন্তু ভারতবর্ষে এ হল ব্যক্তির নিজস্ব পূর্ব-পাপক্ষালন করার জন্যে তার নিজেরই চেষ্টা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা আগাম চেষ্টাও হতে পারে অর্থাৎ কিছু কিছু প্রায়শ্চিত্ত কর্মের ফল সুদূরাপ্রসারী হয়। তবু মুনিঋষির মন্ত্রোচ্চারণ ব্যক্তির পুণ্যে কিছু পুণ্য যোগ করে।
‘…কিছু কিছু (কর্ম, প্রতীকী) শাস্ত্রে বিষয়টা সম্বন্ধে ঔৎসুক্য জাগায়, যথাযথ অনুষ্ঠানটি প্রতিক্রিয়ার দ্বারা ভগবানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা থেকে সরে আসে প্রত্যক্ষ ভক্তি ও বিশ্বাসে, কিংবা দায়িত্বপূর্ণ নৈতিক ক্রিয়ার প্রকাশে। সে সব ক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্তের প্রক্রিয়াটি পাপের সঙ্গে সমানুপাতিক— পাপ যদি ‘হৃদয়ের’ হয় এবং ভক্তিবিশ্বাসের সম্পর্ককে ক্ষুণ্ণ করে, তা হলে মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুশোচনা করে এবং ছোটখাট নতুন ভাবের সূচনার দ্বারা ক্ষতিপূরণ করতে চায়। পাপটি যদি হয় দায়িত্ববোধহীনতার কিংবা অনৈতিক আচরণের, তখন মানুষ অনুতাপের যোগ্য ক্রিয়াকলাপ এবং পরিবর্তিত জীবনধারা দিয়ে কৃতকর্মের ক্ষতিপূরণ করতে প্রয়াসী হয়।’ (স্মিথ, আডেয়ার লাইব্রেরি বুলেটিন, ৩০শ খণ্ড, ১৯৬৬, পৃ. ২৭) প্রয়শ্চিত্ত কিছু কিছু মৌলিক প্রশ্ন তোলে: পাপ কার বিরুদ্ধে? ভগবানের? মানুষের? কোনও বিশ্বজনীন নৈতিক বিধানের? প্রায়শ্চিত্ত কী ভাবে পাপী ও পাপকে প্রভাবিত করে? তা কি পাপকে মুছে দেয় অথবা পাপের বল এবং/বা শাস্তিকে নষ্ট করে? যে মানুষের বিরুদ্ধে পাপটি, তার ওপর? পাপ ও প্রায়শ্চিত্ত কী ভাবে ভগবান বা ঋতকে বা বিশ্বজনীন নীতিকে প্রভাবিত করে?
ভিন্ন ভিন্ন ধর্মশাস্ত্রকাররা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ও সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সবচেয়ে সহজ ও সরলরৈখিক উত্তর আসে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলি থেকে। মানুষ ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই পাপ করে তাঁর নিয়ম লঙ্ঘন করে এবং তিনি নির্দেশ দিয়েছেন আবেগজাত অনুশোচনা ও নৈতিক/স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রায়শ্চিত্তবিধানের। পাপী এ সব শর্ত পূরণ করলে পাপের বোধ ও ফল থেকে মুক্ত হয়। ঋগ্বেদ-এ দণ্ডদাতা দেবতা বরুণও দণ্ড ভোগ করবার পর পাপীকে আর পাপী মনে করেন না; বৈদিক সাহিত্য অপ্রতিকার্য মহাপাতকের কথা জানে না। বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম পাপের গুরুত্ব অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেয়, কিন্তু সম্ভবত সেখানেই ব্যাপারটা নিষ্পত্তি হয়। যদিও কিছু বৌদ্ধ কাহিনিতে পৃথিবী ফাঁক হয়ে পাপীকে গ্রাস করে, অবীচি নরকে নিয়ে যায়, এবং যদি সে অপ্রতিকার্য পাপ করে থাকে তো সেই নরকেই চিরকাল বাস করে।
মনে হয়, নীতিশাস্ত্র অর্থাৎ আইনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নীতিলঙ্ঘন, অকরণীয়করণ ও করণীয়ের অকরণ, প্রতিকার ও দণ্ডনীতি এ সব জনমানসে ক্রমে ক্রমে দৃঢ়মূল হয়ে উঠল, নীতিগ্রন্থে যদিও প্রায়শ্চিত্তের অর্থ পাপের বা অপরাধের মোচন বোঝাতে পারে, (তা শুধু) এমন প্রসঙ্গে, যেখানে কোনও নির্ব্যক্তিক ধর্ম প্রধান্য পেয়েছে… প্রায়শ্চিত্তের অর্থ হল ভক্ত ও ভগবানের পাপজনিত ব্যবধান বা দূরত্ব ঘোচানো, যা (কেবল) ব্যক্তিগত ভগবানের দ্বারা শাসিত জগতে (দণ্ড) অন্যথাকরণের জন্যে, বা শুধুই নিরাকরণের জন্যে করা হয়।’ (স্মিথ, ওই পৃ. ২৪) ভগবানের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোর এই অনুষ্ঠানটির একটি গম্ভীর মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য আছে, এটা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে হতে পারে, আবার অন্য ভাবেও হতে পারে। যেমন মেক্সিকোবাসীরা যদি পাপ করে… এবং প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় তা হলে টলাকোল্টকটল দেবীর পুরোহিতের কাছে গিয়ে পাপ স্বীকার করে; পুরোহিত স্বীকারোক্তি শোনবার পরে কোনও কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশ দেন। তারা বিশ্বাস করত যে, এই কৃচ্ছ্রসাধনের পরে শুধু যে পাপ থেকে মুক্তি হল তা-ই নয়, কিন্তু পাপের জন্যে শাস্ত্রনির্ধারিত যে শাস্তি তার থেকেও সে অব্যাহতি পেল।’ (হেস্টিংস ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন অ্যান্ড এথিক্স, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৬১৪) এই মানবিক প্রক্রিয়াটির সঙ্গে ক্যাথলিক ধর্মের পাপক্ষালন পদ্ধতির মিল আছে এবং হয়তো বা ক্যাথলিক প্রভাবেই এটি প্রবর্তিত হয়। কিন্তু অধিকাংশ প্রাচীন ধর্মে, অথবা যে সব অর্বাচীন ধর্ম প্রাচীন ধর্মের স্পষ্ট অবশেষ চিহ্ন বহন করে সেগুলিতেও, প্রায়শ্চিত্তের একটি অনুষ্ঠান থাকে। বাস্তবে একটি ধর্মানুষ্ঠান করার মধ্যে কিছু আয়াস, অসুবিধা, খরচ, কখনও কখনও কোনও রকম আত্মত্যাগ বা কৃচ্ছ্রসাধন, কখনও-বা নিজের দেহে আনুষ্ঠানিক কশাঘাত— এ সবের দ্বারা মনের মধ্যে একটি বোধ জন্মায় যে, পাপের ‘মূল্য’ দেওয়া হল এবং পাপী মনে মনে একান্ত ভাবে এক ধরনের জমাখরচ মেলানোর স্বস্তি কামনা করে। এ ধরনের প্রায়শ্চিত্ত যেন আগে থেকে নৈতিক ঋণ শোধ করে দিয়ে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত শাস্তি গ্রহণের দ্বারা ক্রুদ্ধ নিয়তির শাস্তিদানে উদ্যত হাত বেঁধে দেয়।
‘প্রায়শ্চিত্তের অঙ্গক্রিয়া হল: পাপস্বীকার, কৃত পাপের জন্যে ও তার দ্বারা যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্যে অনুশোচনা, প্রাণায়াম ও প্রায়শ্চিত্তমূলক কৃচ্ছ্রসাধন, ছোটখাট অগ্নি-যাগ, মন্ত্রোচ্চারণ, দানধ্যান, উপাস এবং তীর্থযাত্রা সম্পাদন।’ (স্মিথ, পৃ. ৩০) এই তালিকা প্রায় সমস্ত রকম প্রায়শ্চিত্তই লিপিবদ্ধ করেছে। পরবর্তী কালের এবং/বা একেশ্বরবাদী ধর্মগুলিতে অনুষ্ঠানগুলি বর্জিত হয়েছে, প্রায়শ্চিত্ত ক্রমেই অন্তঃশুদ্ধি, অনুতাপ, পাপস্বীকার এবং নতুন ভাবে জীবন শুরু করার সংকল্পে পরিণত হয়েছে।
জৈনধর্মে পাপস্বীকার আবশ্যিক কিন্তু স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট নয়, বরং সেটি প্রায়শ্চিত্তের প্রথম পর্ব মাত্র। ‘পাপের ফল শাস্তি এবং পাপ হল… সত্যের পথ ছেড়ে অন্য কিছু; তাই তাকে বলা হয় ‘মায়া’; ‘মাঈ (হল) যে নিজে অপরাধী হয়েছে।’ পাপস্বীকার ও পাপীর দণ্ডগ্রহণের মাঝে যা থাকে সে সম্বন্ধে ছটি নীতির মধ্যে প্রথম দুটি বলে অপরাধী নিজেকে ও তার গুরুকে ভর্ৎসনা করে, তার পরের দুটি (অর্থাৎ) আভ্যন্তরীণ অন্যায় থেকে, অপরাধ থেকে শুচি হওয়ার জন্য প্রক্রিয়াটি বলে: সংশোধনের অভিপ্রায়…. প্রায়শ্চিত্ত প্রায়ই আভ্যন্তরীণ কৃচ্ছ্রসাধনের (অর্থাৎ) ‘বিবেগ’-এর সমানুপাতিক হয়, আমোদপ্রমোদ বর্জন এবং ‘বিউসগ্গ’ অর্থাৎ হাত দুটি ঝুলিয়ে নিষ্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা (একটি নির্দিষ্ট কালের জন্যে)… ‘তব’ হল খাদ্যের পরিমাণ হ্রাস করা বা পূর্ণ বর্জন অথবা পরিবর্তন করা।’ (শূ ব্রিং, ১৯৬২, পৃ. ২৭৭, ২৮০-২৮২)
জৈনধর্ম এক দিকে পাপকে অন্তরস্থ করেছে, যা আত্মার পবিত্র দীপ্তিকে আবৃত করে এমন অশুচি সংসর্গের মতো; অন্য দিকে দেহভোগ্য শাস্তির দ্বারা দণ্ডকে ইন্দ্রিয়-অনুভাব করে তুলেছে, যে দণ্ড অন্য কেউ বা মানুষ নিজেই নিজেকে দেয় যার ফলে পাপের কৃষ্ণ আলেপটিকে বস্তুগত ভাবে মুছে ফেলা যায়। তথাপি এ ধর্ম বিশ্বাস করে যে, অপরিশোধিত অর্থাৎ প্রায়শ্চিত্তরহিত পাপ থেকে নিম্নস্তরে পুনর্জন্ম হয়। অতএব যদিও একটি বিকল্প আছে পাপের জন্যে প্রায়শ্চিত্ত, তথাপি এ জন্মে কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত না হওয়া অথবা ন্যূনতায় বা নিজের অগোচরে আরও পাপ করার অথবা পূর্বজন্মকৃত পাপের বোঝা পরজন্মেও সঞ্চারিত হয়। পাপ ও দণ্ডের কোনও আনুপাতিক তালিকা না থাকায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের মতো জৈন ধর্ম ও গৌণ ভাবে নিয়তিকে স্বীকার করে অদৃশ্য অপ্রাপ্যদর্শন কর্ম ও কর্মফল হিসেবে।
পাপ যখন বহিঃস্থ এবং ধর্মবেত্তারা মন্দ আত্মার ‘ভর’ দেখতে পান, তখন সেটা নিয়তির এক বিশেষ ধরনের ক্রিয়া এবং তার একটি অদ্ভুত প্রতিকারের বিধান দেওয়া হয়েছে, ঝাড়ফুঁক। এটি সারা পৃথিবীতে মূলত একই, যদিও আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খগুলি পৃথক। শামান-জাদুকরী ধরনের উৎপত্তি থেকে উদ্ভুত বলে প্রতিবিধানটিও শামান জাদু’র অনুরূপ। ‘সমাজের কোনও ব্যক্তিকে যখন মন্দ আত্মা ‘ভর’ করে তখন সেটি একটি বহিঃস্থ মন্দ, যা পুরো গোষ্ঠীকে সন্ত্রস্ত করছে একটি ব্যক্তিকে ‘ভর’ করার দ্বারা। তখন ওঝা শামান, জাদুকর বা ডাইনিকে ডাকা হয় এবং সে এসে ঝাড়ফুঁক করে। মন্দ আত্মা যে অশুভের প্রতীক, তা অপসারিত হয় না; সেটি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সমাজের উন্নততর মূল্যবোধের অধীন হয়’। (অ্যালহ্বোরসন হিস্ট্রি অব রিলিজ্যন, ১ম খণ্ড ৪র্থ সংখ্যা ১৯৭৬, পৃ. ৩৫৫)
পাপ সম্বন্ধে যে মৌলিক প্রশ্নগুলি উঠেছিল তার কিছু কিছু উত্তর বোধহয় এ আলোচনায় পাওয়া গেছে। পাপ কার বিরুদ্ধে এ প্রশ্নের সমাধানে শাস্ত্র দুটো দিকই খোলা রেখেছে— পাপ মুখ্যত দেবতা ও দিব্য শক্তি ও দিব্য নীতির বিরদ্ধে, কিন্তু এর আর একটা দিক মানবমুখী; দেবতার প্রতিনিধি, পিতামাতা, গুরু, আচার্য, গুরুপত্নী, রাজা, পদস্থ ব্যক্তি এবং মুখ্যত ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধেই পাপ। অবশ্য দিব্য নীতির আরও একটা দিকে আছে: দুঃখী অসহায় ও দরিদ্র, এদের দুঃখমোচনে বিমুখ হওয়াও পাপ। তাই অন্যকে ভাগ না দিয়ে ভোগ করা অপরাধ বলেই গণ্য। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল: প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে পাপী ও পাপকে প্রভাবিত করে। পাপের অনিবার্য ফল যে দুঃখভোগ, এ জন্মে বা পরজন্মে, প্রায়শ্চিত্ত তাকে বিনষ্ট করে। পাপীকে মানসিক শান্তি ও স্থৈর্য ফিরিয়ে দেয় প্রায়শ্চিত্ত। মানুষ তো জানে যে পাপের অর্থই দুঃখভোগ এবং এই জানাটায় তার অস্বস্তি ও অশান্তি জন্মায়। প্রায়শ্চিত্তে এই অস্বস্তি নষ্ট হয়ে মানসিক ভারসাম্য ফিরে আসে। অলক্ষ্যে নিয়তিও অপরাধীর প্রতিকূলতা করা থেকে নিরস্ত হয়। যে মানুষের বিরুদ্ধে পাপ, তার ওপরে প্রায়শ্চিত্তের কী প্রভাব? সে মানুষ যদি অবহিত থাকে যে তার বিরুদ্ধে কেউ অন্যায় করেছে তা হলে তার মনে ক্রোধ ও প্রতিহিংসার উদ্রেক হয়, কিন্তু অপরাধী প্রায়শ্চিত্ত করলে সে আর অপরাধীর অনিষ্ট চিন্তা করে না, ফলে পরোক্ষে নিয়তিও আর প্রতিশোধের চিন্তা করে না। প্রায়শ্চিত্ত বিশ্বজনীন নীতি বা ‘ঋত’ কে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে না, ‘ঋত’ বা নীতি নির্ব্যক্তিক; কিন্তু ‘ঋত’ বা নীতির বিরুদ্ধে পাপ করা মানেই নিয়তিকে তার দণ্ডদানে প্ররোচিত করা, প্রায়শ্চিত্তে নিয়তি প্রশমিত হয় এবং অপরাধী প্রাপ্য দণ্ড থেকে ছাড়া পায়।
সাধারণ মানুষ মনে করে যে পাপের একটা হিসেবনিকেশ চলে মানুষের অগোচর কোনও জগতে; সেখানে পূর্বজন্মে বা এ জন্মে কৃত পাপ-পুণ্য অনুসারে মানুষের ভাগ্য নিরূপিত হয় এবং সেখানে মানুষের সরাসরি কোনও কিছু পরিবর্তন করবার ক্ষমতা সেখানে নেই। প্রায়শ্চিত্ত সেই অলক্ষ্যলোকে একটি শক্তি হিসাবে উপস্থিত হয়ে পাপীর অ-দৃষ্ট ভাগ্যলিপিতে তার খরচের হিসেব মুছে দিতে পারে; এই ভাবে হয়তো নিয়তিকে প্রভাবিত করতে পারে প্রায়শ্চিত্ত। যদিও এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। তেমনই হয়তো তা পারে নানা অগ্রিম পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান; সেগুলির বিবরণ এর পরেই আলোচিত হচ্ছে।
ভারতবর্ষে ওঝা ঝাড়ফুঁক করবার সময়ে সরষের দানা বা অন্য কিছু ঘৃণিত পদার্থ-সহযোগে নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানটি সমাধা করে। ‘প্রেতবিষ্ট’ ব্যক্তিকে ঝাঁটা দিয়ে মারা, নানা গালিগালাজ করে, তার পর ‘রোগী’ যখন ক্লান্তি ও কষ্টে অভিভূত হয়ে প্রেতের হয়ে বলে যে সে (প্রেত) এ বার বিদায় নেবে, তখন জাদুকর তাকে চলে যেতে হুকুম করে এবং কখনও কখনও কোথায় যাবে তাও বলে দেয়। এ ছাড়া বিশেষ বিশেষ ঋতু ও লগ্নের ঝাড়ফুঁক আছে, যা ওঝা পুরো গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পন্ন করে; বিশেষ বিপদ ও সংকট যখন গোষ্ঠী জীবনকে ত্রস্ত করে তোলে তখন গোষ্ঠীজাদুকরের শরণাগত হয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্পাদন করে। এ সবেরই নেপথ্যে নিয়তি সক্রিয় থাকে এবং জাদুকর বা ওঝা তারই প্রতিভু-রূপে সে পূর্বনির্ধারিত শাস্ত্রনির্দিষ্ট প্রণালীতে অনুষ্ঠান করে। এতে দুস্তরের অতিপ্রাকৃতের মধ্যে একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে গোষ্ঠী বা ব্যক্তি অদৃশ্য নিয়তির প্রতিকূল শক্তির আকস্মিক রুষ্ট প্রকাশ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। এটা ঘটলে প্রকৃতি ও অতিপ্রাকৃতের মধ্যে ভারসাম্য আবার ফিরে আসে এবং পরবর্তী সংকট দেখা দেওয়ার আগে পর্যন্ত গোষ্ঠীর জীবনধারা গতিতে চলে।
মহাকাব্য ও পুরাণে ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীগত প্রায়শ্চিত্তের বহু উপাখ্যান আছে। কিন্তু প্রায়শ্চিত্তের সূচনা বৈদিক যুগে; তখন যজ্ঞ অনুষ্ঠানে কোনও ত্রুটি ঘটলে তার জন্যে শাস্ত্রনির্দিষ্ট প্রতিবিধানের প্রক্রিয়া অনুষ্ঠান করতে হত। অথর্ববেদীয় পুরোহিত ‘ব্রহ্মা’র কাজই ছিল আনুষ্ঠানিক ত্রুটি ধরে দেওয়া এবং তার জন্যে প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেওয়া। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে এমন বহু প্রায়শ্চিত্তের কথা আছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যক-এ ‘সুপর্ণ’ অধ্যায়ে বহু মন্ত্র আছে যা উচ্চারণ করলে আকস্মিক মৃত্যুর সম্ভাবনা অন্তর্হিত হয়। (১০:৪৮-৫০) মহাভারত-এ পাপের তালিকার সঙ্গেই প্রায়শ্চিত্তেরও তালিকা আছে। এগুলির সংখ্যা বেড়েই চলেছিল, কারণ এক দিকে ভগবান বা ঐশী শক্তির বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে এতে তার মানসিক শান্তি আসে, অন্য দিকে এ সব অনুষ্ঠান বেড়ে উঠলে পুরোহিতদের আয়ও বাড়ে। এদের লোভও ক্রমশই বাড়ছিল।
মৎস্যপুরাণ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে কিছু অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেয়। (২২৭-২৩৭ অধ্যায়) ব্রহ্মা যখন শিবকে প্রায়শ্চিত্তের উপায় সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, শিব তখন একটিই প্রতিবিধানের কথা বলেন: বিষ্ণুর শরণাপন্ন হওয়া। (বামন পু. ৭৬:৯-১০) কূর্মপুরাণ-এরও বৃহৎ একটি অংশে করণ ও অকরণগত পাপের ও সেগুলির প্রায়শ্চিত্তের তালিকা। (৩০-৩৩ অধ্যায়) একটি অদ্ভুত শ্লোক বলে, ‘যে ব্যক্তি ঐতিহ্যগত আচরণবিধি থেকে স্খলিত হয় বেদ, হরিভক্তি, মহেশ্বরভক্তি কিছুই তাকে শুচি করতে পারে না।’ (বৃহন্নারদীয় পু. ৪:২৫) ওই গ্রন্থের ২৮ অধ্যায়ে অবশ্য ঠিক ওই সব প্রক্রিয়াগত ত্রুটির একটি সুদীর্ঘ প্রায়শ্চিত্ত তালিকা আছে।
এ সব প্রায়শ্চিত্ত-মন্ত্রের ধ্রুবপদ হল: ‘যে ব্যক্তি তীর্থস্থানের নদীতে (হ্রদে বা পুকুরে স্নান করে দান করেছে, দেবতাদের স্তব করেছে, স্তোত্রগান করেছে, ব্রত পালন করে দেবপূজা করেছে, রাজসেবা করেছে, (নারী হলে) স্বামীসেবা করেছে, বিশেষত ব্রাহ্মণের পরিচর্যা করেছে, সে তৎক্ষণাৎ সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।’ অগ্নিপুরাণ-এ অনেকগুলি অধ্যায়ের বিষয়বস্তুই হল মৃত্যুজনিত বা শবদেহ স্পর্শজনিত অশৌচ। (তুলনীয় অবেস্তা-য় মৃতদেহের সংস্পর্শে এসে ‘নাসসৌ’ এর ভাগী হওয়া, এ সংস্পর্শ সরাসরিও হতে পারে; গৌণ ভাবেও হতে পারে) এ ধরনের অশুচিতার মধ্যে পড়ে রক্তক্ষরণ, ঋতুস্রাব, পঞ্চমহাপাতকের সংস্পর্শ এবং এরই সঙ্গে বিধান আছে এগুলির প্রায়শ্চিত্তের। (১৫৭-৫৮, ১৬৯, ১৭২, ১৭৩-৭৪ অধ্যায়) দেবীভাগবতপুরাণ বলে, ‘যদি কেউ জন্মাষ্টমীর দিনে উপবাস করে সে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল পায়, কোনও ব্রত পালন বা রাত্রিজাগরণ ছাড়াই। এতে শৈশবে কৃত পাপের ও সাতটি জন্মে, কৈশোরে, যৌবনে ও বার্ধক্যে কৃত সর্বপাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়।’ (কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৮:৭৪,৭৫) ‘যদি কেউ ভক্তিভরে ব্রাহ্মণকে প্রণাম করে, সে সর্বতীর্থে স্নানের পুণ্য অর্জন করে ও সর্বপাপমুক্ত হয়।’ অথচ বারেবারে নানা গ্রন্থে বলা হয়েছে পঞ্চমহাপাতকের কোনও প্রায়শ্চিত্ত নেই। (ওই ৯৩ অধ্যায়) ‘সর্বপ্রকার যজ্ঞ সম্পাদন করে এবং উপনয়নদীক্ষায় মানুষ যে-পুণ্য অর্জন করে, সেই সবই লাভ করা যায় গাভীকে খাদ্য দান করে’ (ওই ১২৯ অধ্যায়)।
সন্ন্যাসীর প্রায়শ্চিত্তের বিশেষ প্রক্রিয়া একটি অধ্যায় বলা আছে। (লিঙ্গ পুরাণ ৯০ অধ্যায়) অর্বাচীন দেবীভগবতপুরাণ-এ হঠাৎ গায়ত্রীমন্ত্র উচ্চারণের সমর্থন করা হয়েছে, ‘যেহেতু বেদে বিষ্ণু বা শিব উপাসনার বা উপনয়নের বিধান নেই, সে জন্যেই সব বেদেই গায়ত্রী উপাসনার বিশেষ বিধান দেওয়া হয়েছে যা ছাড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ভ্রষ্ট হয়।’ (১২:৮৮,৮৯) পদ্মপুরাণ-এ পুরো একটি অধ্যায়ে পাপ অনুসারে যথাযথ প্রায়শ্চিত্তের বিবরণ আছে। (৪৬ অধ্যায়) গরুড়পুরাণ-এর উত্তরার্ধে একটি শ্লোক আছে, বহু দুষ্প্ৰতিকাৰ্য পাপ করেও লোকে ভূমি ও পশুচর্ম দান করে মুক্তি পায়।’ (৪০:৬) পূর্বার্ধে একটি পুরো অধ্যায় নানা পাপের প্রায়শ্চিত্তের কথা বলা আছে (৫২) এবং সে সব পাপের প্রায়শ্চিত্তেরও বিধান দেওয়া আছে : গুরুপত্নীগমনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত, ব্রহ্মহত্যার প্রায়শ্চিত্ত অর্থাৎ চার-পাঁচবার চান্দ্রায়ণব্রত (পালন করার নির্দেশ)।’ (৫৬:১১) লক্ষণীয় যে, পাপের গুরত্ব একই রকম থাকা সত্ত্বেও প্রায়শ্চিত্ত ক্রমশ লঘু হয়ে আসছে। চান্দ্রায়ণ ব্রতে কৃষ্ণপক্ষে প্রত্যহ একটি করে অন্নগ্রাস কমিয়ে অমাবস্যায় উপবাস ও শুক্লপক্ষে প্রত্যহ একগ্রাস বাড়িয়ে পূর্ণিমায় পনেরো গ্রাস অন্নগ্রহণের বিধান। গুরুপত্নীগমন ও ব্রাহ্মণহত্যা— যা অপ্রতিকার্য পঞ্চমহাপাতকের অন্তর্গত; –এ সব পক্ষে এই প্রায়শ্চিত্ত নেহাৎই লঘু। অন্য একটি শ্লোক বলে, ‘যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণকে ভোজন করায় তার সর্বপাপ বিনষ্ট হয়।’ (ওই ৫৬:১৫) পদ্মপুরাণ-এর দুটি শ্লোকে বলে, ‘ব্রহ্মঘ্ন, কৃতঘ্ন, মদ্যপ কৃচ্ছ্রসাধন, চান্দ্রায়ণ, দান ও বিধিমতে ব্রতপালনের দ্বারা যথাবিধি প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে; তাতে তাদের সব পাপ নিশ্চিহ্ন হয়ে নষ্ট হয়।’ (পাতালখণ্ড ১৯:৩১, ৩২) অপ্রতিকার্য পাপ ও তার জন্যে নামমাত্র লঘুদণ্ডের বিধান হঠাৎ যেমন পরস্পরবিরোধী, অতএব অবাস্তব মনে হয়। কিন্তু হয়তো প্রায়শ্চিত্তের দুটি নির্দেশে এর কিছু ব্যাখ্যা মেলে: দান ও ব্রতপালন। উভয়ক্ষেত্রেই দানসামগ্রী ও ব্রতপালনের দক্ষিণার প্রাপক হল ব্রাহ্মণ পুরোহিত। কাজেই নিয়তিবাদ ও প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রকাররা যাকে পূর্ব প্রায়শ্চিত্তের অযোগ্য, ঘৃণ্য পাপ বলে অভিহিত করেছিল তার প্রায়শ্চিত্ত ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রাপ্তিযোগের মধ্যে দিয়ে বেশ সুলভে সাধিত হল। এর মধ্যে খুব সূক্ষ্ম ভাবে ব্রাহ্মণের সামাজিক অবস্থানটি কিন্তু নেমে গেল, কারণ এ তালিকার শীর্ষে আছে ব্রহ্মঘ্ন এবং সুরাপান ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল বলেই সেটি এখানে স্থান পেয়েছে। কাজেই পূর্বে শাস্ত্র যাকে অপ্রতিকার্য পাপ বলেছে, পরবর্তী শাস্ত্রকাররা সে সম্বন্ধে অনেক সহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। এ ছিল সে যুগের প্রধান একটি লক্ষণ। পরে দেখব যে, সমাজের কিছু কিছু পরিবর্তনই পাপীদের সম্বন্ধে এই সহিষ্ণুতার মূলে।
নৈতিক ও ধর্মীয় জমাখরচের খাতায় পাপ পড়ে খরচের দিকে। পুণ্য জমার দিকে। পুণ্য নানা ভাবে অর্জন করা যায়, খরচ করা যায়, সঞ্চয় করা যায়, ব্যবহার করা যায়, ধার নেওয়া যায়, ধার দেওয়া বা নষ্ট করে ফেলা যায়। এ হল আধ্যাত্মিক সম্পদ এবং ধর্মশাস্ত্রকাররা সাংসারিক সম্পত্তির মতোই এর বিষয়ে চিন্তা করেছেন। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নগদ টাকাপয়সা ও মুদ্রার প্রচলন ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লাভ করল; আধ্যাত্মিক জগতে পুণ্যও ক্রমে ক্রমে এই মুদ্রাগত ধনের ভূমিকায় দেখা দিল। ব্রতপালন, যজ্ঞসম্পাদন, পূজা, দান, পতিসেবা, প্রভুসেবা, রাজপরিচর্যা ও ব্রাহ্মণের পরিচর্যা, সাধুসেবা, তীর্থভ্রমণ ও তীর্থে স্নান, ধ্যান, উপবাস এবং আত্মনিগ্রহের অন্য প্রক্রিয়া, পূর্বপুরুষের ও পিতামাতার শ্রাদ্ধ, দেবদ্বিজে ভক্তি এ সবের দ্বারাই পুণ্য অর্জন ও সঞ্চয় করা যায়। পুণ্য দিয়ে নিয়তির বিরূপ সিদ্ধান্তকে নাকচ করা বা ঠেকানো যায়।
অন্যান্য কোনও প্রাচীন সভ্যতাতেই যেখানে মরণোত্তর সত্তার কোনও সুস্পষ্ট বোধ ছিল না সেখানে এই ধরনের পুণ্যবোধ বা পুণ্যকে অর্থের মতো করে দেখার রীতি ছিল না। হিব্রু শেওল— পৃথিবীর অবতলে একটি নিঃশব্দ বিস্মৃত ধাম, এর সঙ্গেই ব্যাবিলনীয় নরকের যোগ ছিল। উভয়ক্ষেত্রেই বাইবেল-এর নতুন বিধানের সমকালীন ‘কুমরান’ সম্প্রদায়ের পরিমাপযোগ্য পুণ্যের ধারণা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
ইহুদীদের পুরোহিত সম্প্রদায় রাব্বি (বা রাবাই) দের পুণ্য সম্বন্ধে ধারণা যদিও (খ্রিস্টীয়) প্রথম চারটি শতকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে স্পষ্ট উচ্চারিত হয়েছে, তবু তা এমন দুটি মুখ্য তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত যার মূল অতীতে বহু সুদূরে প্রোথিত: (১) পুরাতন নিয়মে মোশীর সঙ্গে নিষ্পন্ন ঈশ্বরীয় চুক্তিগুলি মেনে চলা (অর্থাৎ তোরাহ’র প্রতি আনুগত্য) যা আশীর্বাদ ও সুখ বহন করে আনে, এবং (২) এই শর্তের দায়িত্ব ও সুবিধা সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক দুঃখ ও মূলত শাস্তিরূপে যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সংক্রমিত হয়, নঞর্থক ভাষায় বললে, অবাধ্যতার ফল শাস্তি—।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন ‘মেরিটস পৃ. ৩৮১) মেসোপটেমিয়ায় মরাণোত্তর অবস্থা সম্বন্ধে অত্যন্ত আদিম কিছু ধারণা প্রচলিত ছিল, তবু পুণ্য সম্বন্ধে কোনও তত্ত্বের সৃষ্টি হয়নি। ইহুদিদের একটি ধারণা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, এ বোধের পশ্চাতে সক্রিয় ছিল অন্য এক ব্যাপার: সমাজে উদ্বৃত্ত সম্পত্তির উদ্ভব হওয়ার পরে মানুষ যখন ব্যক্তি হিসেবে ধন উপার্জন, সঞ্চয় এবং বংশানুক্রমে সে-ধন হস্তান্তরণের ব্যবস্থা করতে পারল, তখন পুণ্য অর্জন, সঞ্চয় ব্যয় এবং উত্তরাধিকার রূপে রেখে যাওয়ার ধারণাটিও দেখা দিল। পাপকে খণ্ডন করে পুণ্য এবং ব্যক্তির স্বতন্ত্র প্রয়াসে তা অর্জন ও সঞ্চয় করা যায়, দুর্দিনের জন্যে যেমন ধন রাখা যায়, অকস্মাৎ পদস্খলনের সময়ে ব্যবহারের জন্যে তেমনই পুণ্যও সঞ্চয় করে রাখা যায়।
তীর্থভ্রমণ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পুণ্যকর্ম— শাস্ত্র একে উচ্চস্থান দিয়ে প্রকাশ্যে বিশেষ ঘোষণা করেছে। উত্তরপশ্চিম ভারতবর্ষ থেকে আর্যরা যখন ক্রমেই দক্ষিণপূর্বে এগোচ্ছিল তখন মুনিঋষিরা প্রকৃতিকে সৌন্দর্যমুক্ত, মনোরম স্থানগুলি, সমুদ্র বা নদী-তটে, হ্রদের বা প্রস্রবনের কাছে কিংবা পর্বতের শীর্ষে ও সানুদেশে— প্রথম পর্বে লোকালয় থেকে দূরবর্তী স্থানে কিন্তু পরে তীর্থভ্রমণ জনপ্রিয় হলে গঞ্জে, হাটে, বাণিজ্য কেন্দ্রেও তীর্থস্থান নির্দিষ্ট করে। ফলে এ সব জায়গায় মানুষ তো সামাজিক ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে আসতই, নিসর্গসুন্দর স্থান দেখে স্নান, পূজা, দানদক্ষিণা দিয়ে পুণ্য সংগ্রহের সুবিধাও পেল। অতএব, ব্যবসাবাণিজ্যে এবং ভক্তি অর্থে এ সব তীর্থস্থান ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। কিছু তীর্থ আছে দুর্গম অঞ্চলে, যেগুলি পুণ্যকামীকে কৃচ্ছ্রসাধনের সুযোগ দেয়। যারা কষ্ট সহ্য করে যায়, তারা নিরালা প্রাকৃতিক শোভায় আকৃষ্ট হয়, কেউ বা তীর্থে বেসাতির আকর্ষণে থেকে যায়। যাই হোক না কেন, শাস্ত্রগুলি— পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র— ধীরে ধীরে নানা উপাখ্যানে একটি মাহাত্ম্যসাহিত্য সৃষ্টি করে তীর্থগুলিকে মহিমান্বিত করে তুলতে লাগল। সারা ভারতবর্ষে লক্ষ লক্ষ ছোট বড় তীর্থ আছে যেগুলিতে সারা বছর ধরে পুণ্যার্থীর কমবেশি ভিড় হয়; এরা নানা সম্প্রদায় ও উপাসনাপদ্ধতির প্রতিনিধি। অধিকাংশকেই টেনে আনে পুণ্যসঞ্চয়ের লোভ।
‘তীর্থ শব্দের দ্বারা নানা বিচিত্র ব্যাপার বোঝায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিকট বা দূর অঞ্চলের মন্দির বা পুণ্যভূমি দর্শন করাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়… যে ধরনের ক্ষেত্র দর্শন করা হয় সে অনুসারেও তীর্থকে পৃথক করা যায়।’ (উইলসন ১৯৮৩, পৃ. ১২-১৩) এই মন্দিরগুলি নানা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং কাঠ, পাথর বা ইঁট দিয়ে গড়া ছোট দেউল থেকে বহুতল বিস্তৃত সৌধও হতে পারে। সঙ্গে থাকে স্নানের সুবিধা এবং তৎসংশ্লিষ্ট ছোটখাট ঘর কিংবা গ্রামে হয়তো কোনও বড় গাছের নিচে বিশ্রাম বা আশ্রয়স্থল। প্রায় সব প্রধান ও কিছু অপ্রধান ধর্মসংস্থাতেই এ ধরনের ছোটখাট দেউল থাকে। প্রায় প্রত্যেকটিরই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনা-সমন্বিত কাহিনি, যার দ্বারা ধর্মস্থানটির মহিমা বৃদ্ধি পায়। ব্রাহ্মণ্য মন্দিরগুলির ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রায় সব কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে। কিছু বা জনমানসে সঞ্চরমান ধর্মকথার অন্তর্ভুক্ত গাথা, গান, বীরগাথা এবং অধিষ্ঠাতা দেবতাদের লোকসাহিত্যে প্রকাশের কাহিনিরূপে বিধৃত আছে। অতিকথার সৃষ্টিতে সব তীর্থস্থানই পৃথিবীর ‘নাভিমূল’ রূপে পরিকল্পিত, এগুলি পৃথিবীর কেন্দ্র, অতএব পৃথিবীর অবতলের ও অন্যান্য দেবশক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, যে শক্তিগুলি বিশ্বজাগতিক বলেই তারা পৃথিবী ও মনুষ্যজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। দীর্ঘকালব্যাপী লোকমানসের অতলে বিচরণশীল এই সব বিশ্বাসই কোনও স্থানকে পুণ্যভূমি বা তীর্থে পরিণত করে, পারিপার্শ্বের অঞ্চলগুলি থেকে একটি স্থলকে স্বতন্ত্র করে, কারণ সেখানে থাকে অতিলৌকিক পবিত্রতা, এ শক্তি তীর্থযাত্রীকে আশীর্বাদ করার ক্ষমতা রাখে, যাতে তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় এবং সে পুণ্যসঞ্চয় করে।
অধিকাংশ তীর্থক্ষেত্র সম্বন্ধেই মানুষ বিশ্বাস করে যে, বিশেষ বিশেষ দিনে, তিথিতে, লগ্নে, ঋতুতে তার পবিত্র শক্তি তীক্ষ্ণতর হয়। অনুষ্ঠানের নির্দেশ অনুসারে, বিশেষ তিথিতে, সূর্য-চন্দ্র-গ্রহণকালে অধিক পুণ্যের সঞ্চার হয়। (মৎস্য পু. ৬৬ অধ্যায়) ‘যে ব্যক্তি কার্তিক মাসে তুলসীপাতা দেয় (দেবস্থানে) সে সহস্র গাভীদানের পুণ্য লাভ করে।’ (বৃহন্নারদীয় পু. আদ্যখণ্ড ৮:২৩) ‘যে পরিস্কৃত উন্নত ভূমিতে তুলসীপাতা স্থাপন করে সে অনন্ত স্বর্গ লাভ করে’। (ঐ ৮:৫৩) তীর্থস্থান সারা ভারতবর্ষে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আছে। মহাভারত-এ তীর্থস্থানের বহু তালিকা আছে এবং এমন বেশ কিছু পুরো অধ্যায় আছে যাতে তীর্থগুলির নাম, আপেক্ষিক পবিত্রতা এবং দর্শনে পুণ্যের মাত্রা বর্ণিত হয়েছে। (৩:৮০:২৯-৮১; ৯৬; ১১৪-১৭৮; ৩:৮২; ৮৩:১-১০১; ৮৫:৪০২৩; ৮৬ থেকে ৮৮ তিনটি পুরো অধ্যায় এবং পুরো ৯৩ অধ্যায়) মহাভারত-এর পরবর্তী সংযোজন হরিবংশ-তেও তীর্থক্ষেত্রের নানা পরিচয় আছে; নদী, পর্বত এবং পবিত্র কুঞ্জও। প্রখ্যাত পর্যটক কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম ওই গ্রন্থে অনেক তীর্থের বর্ণনা করেন। (বিষ্ণুপর্ব ১০৯:২২-৪২)
তীর্থক্ষেত্রের সঙ্গে পাপমোচনের অচ্ছেদ্য যোগ। বিশেষ বিশেষ তীর্থের বিশেষ ধরনের পাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার খ্যাতি। কিন্তু কিছু তীর্থ আছে যেখানে সর্ব পাপ ক্ষয় হয়, যেমন গঙ্গা, বারাণসী, প্রয়াগ, গয়া, ইত্যাদি। এ সব তীর্থে অধিক পরিমাণে পুণ্য অর্জন করা যায়। অর্থাৎ পুণ্যক্ষেত্রগুলির মহিমাও আপেক্ষিক। মানুষ অন্যত্র পাপ করলেও গঙ্গা তার সব পাপ হরণ করে। কিন্তু গঙ্গার তটে বা সান্নিধ্যে পাপ করলে তা তৎক্ষণাৎ দশ লক্ষগুণ বেড়ে যায়। (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. ব্রহ্মখণ্ড ১০:৮৩) ভারতবর্ষে যে পাপ করেছে সে যদি সরস্বতী নদীতে তীর্থস্থান করে, তৎক্ষণাৎ তার সর্ব পাপ মোচিত হয় ও সে বিষ্ণুলোকে নিরন্তর বাস করে। (ব্রহ্মবৈ পু. প্রকৃতি খণ্ড ৬:৪) সব ক’টি পুরাণেই গঙ্গার বিশেষ মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে। (অগ্নি পু. ১১০ অধ্যায়, বৃহন্নারদীয় আদ্য অধ্যায় ৫, মধ্য অধ্যায়, ২৫, দেবীভাগবত ৯:১২:৩৭ ইত্যাদি) গঙ্গা, বারাণসী ও প্রয়াগের বিশেষ পবিত্রতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হল অন্য একটি পবিত্র নদী, যমুনা, যার সঙ্গে গঙ্গার সঙ্গমস্থলেই প্রয়াগতীর্থ; বহু প্রাচীনকাল থেকেই এটি একটি পুণ্যক্ষেত্র বলে গণিত। কোটি কোটি বৎসরে কৃত পাপ এমনকী ব্রহ্মহত্যার পাপও গঙ্গাস্নানে বিলুপ্ত হয়। (দেবীভাগবত পু. ৯:১২:৩৭) প্রায় সব পুরাণেরই বারাণসী একটি মহতী পুণ্যভূমি (পদ্ম পু. সৃষ্টি খণ্ড ১৯ অধ্যায়, মৎস্য ১৭৯-১৮৪ অধ্যায়, কূর্ম ৩০ অধ্যায়, নারদ ১১২ অধ্যায় ইত্যাদি) যে সকাল-সন্ধ্যা গঙ্গাতটে ঝাঁট দেয় সে বহু কোটি জন্মের পাপ থেকে মুক্ত হয়। (বৃহন্নারদীয় ২৮:১০) প্রয়াগও বহু প্রাচীন কাল থেকে একটি তীর্থক্ষেত্র। (পদ্ম স্বৰ্গখণ্ড ২১-২৩ অধ্যায় কূর্ম ৩৫-৩৭ মৎস্য ১০২-১১১) যমুনা ও তার তটভূমি প্রাচীন কাল থেকেই পবিত্র ক্ষেত্র, প্রধানত কৃষ্ণের লীলাভূমি বলে। (ব্রহ্মাণ্ড ৬:৩১, কূর্ম ৩৮ অধ্যায়, পদ্ম স্বৰ্গখণ্ড ১৭, ১৮৩ অধ্যায়, ব্রহ্মবৈবর্ত ব্রখণ্ড ১১:২৫, বৃহন্নারদীয় মধ্য ২৮ অধ্যায়) যে কুরুক্ষেত্রকে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধক্ষেত্র বলে মনে করা হয় সেটিও একটি পুণ্যভূমি, সম্ভবত এর ‘ঐতিহাসিক’ গভীর অনুষঙ্গের জন্যেই, এটিও একটি প্রধান তীর্থক্ষেত্র। কুরুক্ষেত্রে স্নান করলে মানুষের সর্বপাপ মোচন হয়। (বামন পু. ৪১:২১; পদ্ম স্বর্গখণ্ড ১৩ অধ্যায়) কাবেরী, নর্মদা, সরস্বতী, রেবা নদীকেও পুরাণে তীর্থ বলে উল্লেখ করেছে। (পদ্ম স্বর্গ ৬, ৮-১০ অধ্যায়; মৎসয ১৮৫-১৯৩ অধ্যায়; অগ্নি ১১৩ অধ্যায়) গয়ার পবিত্রতার সঙ্গে প্রধান যোগ শ্রাদ্ধ-তর্পণের, কাজেই তীর্থ হিসাবে এটি একেবারে প্রথম শ্রেণির। (অগ্নি ১১৪-১৬ অধ্যায়) এ সব ছাড়াও নানা ছোটখাট তীর্থস্থান প্রায় সব পুরাণেই ভারতবর্ষের ইতস্তত ছড়ানো আছে। (ব্রহ্ম ২:১৫, ১৬-৩২ অধ্যায়, মৎস্য ১১৫ অধ্যায়, বামন ২:৩৬-৪২; ৩৬, ৩৭, ৪২ অধ্যায়, ব্রহ্ম ১:১৭:১-৮৬; ৪০-৪৬ অধ্যায় দ্বিতীয় ভাগ ১৫-৩২ অধ্যায়।
সমুদ্র, নদী, হ্রদ, পুষ্করিণী, প্রস্রবণ ইত্যাদির সান্নিধ্য ছাড়াও শিবলিঙ্গ যেখানে যেখানে প্রতিষ্ঠিত, সেগুলিকেও এক বিশেষ ভাবে পুণ্যস্থান মনে করা হয়। বামন পুরাণে এর পবিত্রতা ব্যাখ্যা করে, এই তীর্থের পুণ্য বিবৃত করা হয়েছে; শিবলিঙ্গ দেখলেই অগ্নিহোত্র যাগ করার পুণ্য লাভ করা যায়। (৪৬:৩৩ )
গত দু শতাব্দী আগেও তীর্থযাত্রা শ্রমসাপেক্ষ, ব্যয়সাধ্য ও বিপৎসংকুল ছিল। কাজেই আপ্রাণ আগ্রহ সত্ত্বেও রোগী, বৃদ্ধ, নারী, শিশু ও দরিদ্রের পক্ষে পুণ্যের এ দ্বারটি রুদ্ধ ছিল। অতএব বিকল্পের উদ্ভাবনা আবশ্যিক হয়ে উঠল; যে ব্যক্তি স্নানান্তে প্রতিদিন প্রাতঃকালে ব্রাহ্মণকে ভক্তিভরে প্রণাম করে, তার সর্বতীর্থে স্নান ও সর্ব যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা হয়ে গিয়েছে। (ব্রহ্মবৈবর্ত, ব্রহ্মখণ্ড ১১:২৫) এক জায়গায় কৃষ্ণ বলেন, ‘যেখানে আমার ভক্তরা পরস্পরের পাদপ্রক্ষালন করে, সে স্থানটি এমন এক তীর্থে পরিণত হয় যা নারীহত্যা, গাভীহত্যা, ব্রহ্মহত্যা, কৃতঘ্নতা ও গুরুতন্ত্রগমনের পাপ নাশ করে। এরা এই জন্মেই মোক্ষ লাভ করে।’ (দেবীভাগবত ৯:৫:২৬, ২৭) কাজেই তীর্থে না গিয়েও তীর্থ করার পুণ্য পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম উদ্ধৃতিটিতে ব্রাহ্মণ দেবতার ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হয়ে পাপ মোচনের অধিকার লাভ করছেন এবং দ্বিতীয়টিতে কৃষ্ণভক্তি মহাপাতক মোচন করে।
বহু তীর্থস্থানের পবিত্রতা এবং গরিমা আসে তৎসংলগ্ন পৌরাণিক উপাখ্যান থেকে। তবুও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না তীর্থই কাহিনিগুলি সৃষ্টি করে, না কাহিনি তীর্থস্থানটিকে। অতিকথার চরিত্রগুলি যে সব স্থানে জীবনধারণ করে বিশেষ বিশেষ কীর্তি রেখে যান সেগুলি তীর্থে পরিণত হয়। প্রত্যেক তীর্থেরই সংশ্লিষ্ট পৌরাণিক কাহিনির প্রয়োজন এবং প্রধান তীর্থগুলির সঙ্গে বহু বিভিন্ন উপাখ্যান সংযুক্ত হয়ে সেগুলির বহুমুখী গরিমা বৃদ্ধি করে। তীর্থভ্রমণ কেন? যে কারণে মানুষ দান করে, দেবতার অর্চনা করে, ব্রতপালন করে, প্রায়শ্চিত্ত ও তর্পণ করে সেই কারণেই তীর্থভ্রমণ। এতে পাপ ক্ষয় করে পুণ্য অর্জন করা যায়। গ্রিক প্রতিহিংসার দেবী এরিনিয়েসদের মতো পূর্বপাপ মানুষকে নিয়ত তাড়া করে ফেরে; প্রত্যেকটি পাপভার তাদের যেন আপল্লোর বেদীর কাছে নিয়ে আসে ক্ষমা এবং শান্তি পাওয়ার জন্যে। তীর্থ হল পাপস্বীকার ও প্রায়শ্চিত্তের স্থান, এখানে পাপভারে ক্লিষ্ট চিত্ত স্বস্তি পায়, নৈতিক শুচির বোধ ও প্রশান্ত ভবিষ্যতের আশ্বাস ফিরে পায়। তীর্থের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা প্ৰকাশ্য নিমিত্তমাত্র; যথাবিহিত ভাবে অনুষ্ঠিত ও সমাপিত তীর্থক্রিয়াই নৈতিক শোধন সাধন করে— সুদীর্ঘ, কষ্টকর পথপরিক্রমা, স্নান, প্রদক্ষিণ, পূজা, তৰ্পণ-প্রায়শ্চিত্ত, দানদক্ষিণাতে এ অনুষ্ঠান পরিপূর্ণ হয়। তীর্থ তাই একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা এক দিকে পাপমোচন করে ও অন্য দিকে পুণ্য অর্জন করে। নৈতিক জমাখরচের হিসেব মিলে যায়, জমার অঙ্ক বাড়ে। বস্তুত, নিয়তির গতিভঙ্গকারী সব প্রক্রিয়ারই উদ্দেশ্য নিয়তির গতিকে স্থগিত করা। তীর্থও এই কাজই জটিল অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সমাধা করে।
তীর্থক্ষেত্রগুলিকে একটি দিব্য মহিমা ঘিরে থাকে; ভূগোলে এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। ইতিহাসে কুরুক্ষেত্র ছাড়া (কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধ যদি সত্যিই ঐতিহাসিক হয়ে থাকে; যা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে) অন্য তীর্থগুলির যে মহিমা তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। তীর্থের মহিমার ব্যাখ্যা দিয়েছে পুরাণের উপাখ্যানগুলি, কিন্তু এগুলি তীর্থস্থান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের সমর্থক রচনাও হতে পারে। বর্তমানে যেমন, তেমনই অতীতেও কোনও ব্যক্তি যদি ভাবে, অনুভব করে বা ‘স্বপ্ন দেখে’ যে একটি স্থান পবিত্র বা অতিলৌকিকমহিমাযুক্ত, তা হলে সহজেই আশপাশের লোকেরা তা মেনে নেয় এবং ক্রমে ক্রমে স্থানটি তীর্থের মহিমা পায়। এই পুণ্য বা মহিমায় কী হয়? প্রায় সব তীর্থস্থান সম্বন্ধেই শাস্ত্র বলে যে, ‘বহু জন্মের পাপ নষ্ট হয়’– এ কথা পুরাণগুলিতে অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে। অর্থাৎ তীর্থ যেন স্বস্থানে থেকে নিয়তিরই কর্মচারী হয়ে কাজ করে। শুচিমনে তীর্থভ্রমণ, ভক্তি ভরে সেখানে নানা শাস্ত্রবিহিত অনুষ্ঠান, স্নান, পূজা, শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে দানদক্ষিণা— এর দ্বারাই পাপকারী পাপ থেকে মুক্ত হয়; এবং পাপের শাস্তি হয়, তার পাপের প্রকৃতি, গুরুত্ব, পাপাচরণের কালের ব্যাপ্তি অনুসারে, যত জন্ম ব্যাপ্ত করে পাপ করা হয়েছে তার হিসেব ধরে। সাধারণ ভাবে দীর্ঘ নরকবাস, ঘৃণ্য বা নিম্নবর্গের জীবনে জন্ম, প্রেত বা ইতর জীব হিসেবে দীর্ঘকাল যাবৎ অবস্থান— পাপীর এই সবই প্রাপ্য হয়। কিন্তু শাস্ত্রে যখন বলে যে, তীর্থ করলে হিসেবের খাতা পরিষ্কার হয়ে যায়, তখন বোঝা যায় যে, তীর্থ নিয়তির এক অত্যন্ত রহস্যময় ও শক্তিশালী পরিচারক। সে যেন দয়াময় বিশ্বনিয়ন্তার বা ক্ষমাশীল ত্রাতার করুণার প্রতীক। ভারতবর্ষে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত— উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে— যে অগণ্য তীর্থগুলি আছে তাতেই প্রমাণ হয় পুরাণের অংশগুলি কোথায় কোথায় রচনা হয়েছিল। পুরাণকাররা তাঁদের অঞ্চলের অধিবাসীদের সুবিধের জন্যে তীর্থের স্থানগুলি নিরূপণ করতেন, যেন সেই যানবাহনের অসুবিধের দিনে মানুষকে খুব দূরের পথ পাড়ি দিয়ে তীর্থে না আসতে হয়।
ক্যাথলিক সমাজে পুরোহিতের কাছে পাপস্বীকার ও ক্ষমাপ্রাপ্তিতে যে ভাবে মানসিক ভার লাঘব হয়, তা মানুষের পরম কাম্য একটি প্রাপ্তি। তীর্থে যে পুণ্য হয় তা এর চেয়ে অনেকগুণ বেশি। কারণ, প্রথম ভারতবর্ষের মানুষ জন্মান্তরে বিশ্বাস করে, কাজেই পূর্ব-পূর্ব জন্মে কত অসংখ্য পাপ যে তার জমে আছে তা জানবার কোনও উপায়ই তার নেই; সে আতঙ্ক একটা প্রকাণ্ড মানসিক বোঝা। দ্বিতীয়ত, তীর্থ যে পাপমুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয় তা বিগত ও আগামী বহু জন্মের পাপক্ষয়ই শুধু নয়, বিগত পূর্বপুরুষ ও অনাগত উত্তর পুরুষের কোটি কোটি জন্মের সমস্ত পাপমোচনের আশ্বাস দেয়। এতে যে মানসিক প্রশান্তি, স্থৈর্য, বিশদতা ও লঘুভার-বোধ আসে তার কোনও তুলনা নেই। তার জানা, অজানা সমস্ত পাপের বোঝা এক লহমায় মিলিয়ে যায়, যে সব পাপের উপর এমনিতে তার কোনও নিয়ন্ত্রণই ছিল না। শুধু তাই নয়, এই বিশেষ ধরনের লঘুভার বোধ বিবেককে প্রণোদিত করে শুচি জীবনযাপন করতে এবং আরও সাহস ও ভরসা দিয়ে জীবনের সম্মুখীন হতে, তাকে আশ্বস্ত করে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। এ কথা তাদের পক্ষে সত্য, যারা তীর্থ এবং তীর্থ মাহাত্ম্য বিশ্বাস করতে পারে; তারাই এই পাপমোচন ও নৈতিক দায়মুক্ততার বোধ লাভ করে।
তীর্থযাত্রীর একটি আবশ্যিক ও গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হল, ব্রাহ্মণকে দান করা। এটি না হলে তীর্থযাত্রা অসম্পূর্ণ ও নিষ্ফল থেকে যায়, পাপক্ষয়ের সম্ভাবনা থাকে না। ব্রাহ্মণকে জীবিকার উপায় করে দেওয়া খুবই পুণ্যকর। এই গ্রহীতা ব্রাহ্মণ যদি আধ্যাত্মিক শক্তিযুক্ত হয় তবে দানের ফল অক্ষয় হয়। সদাচারী বিবাহিত ব্রাহ্মণ যদি বেদজ্ঞ ও শাস্ত্রজ্ঞ হন এবং তেমন ব্রাহ্মণকে কেউ যদি জীবিকার স্থায়ী উপায় করে দেন তা হলে সেই দাতার কী লাভ হয়? ‘সে পিতা ও মাতার পক্ষ থেকে দু’ কোটি বংশধর নিয়ে নিষ্পাপ অবস্থায় বিষ্ণুলোকে বাস করে।’ (বৃহন্নারদীয়, উত্তর ১৩:২৭-২৯) দুশো বারো শ্লোকের একটি পুরো অধ্যায় দানের পুণ্য কীর্তনের। যে লোক মন্দির ঝাঁট দেয় (শ্রমদান) সে তত সহস্র কল্প বিষ্ণুলোকে বাস করে যতগুলি ধূলিকণা সে ঝাঁট দিয়েছে। (ওই ১৩:১৩৭-৭৯) কল্প মানে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের সমাহার। খাদ্যদানের চেয়ে বড় দান তিন ভুবনে নেই। (বৃহদ্ধর্ম উত্তর ১৫:২৬) ব্রাহ্মণকে যে কোনও দিন দান করলেই পুণ্য হয়, কিন্তু পূর্ণিমা অমাবস্যায় করলে শতগুণ হয়। (বৃহন্নারদীয়, প্রকৃতি ৯:১৩, ২৯ শ্লোক পর্যন্ত পুরো অধ্যায়টির বক্তব্যই দানের পুর) দানকে আবশ্যিক, অপরিহার্য করে তোলা হয়েছে নানা শাস্ত্রবাক্য দিয়ে— যেমন, ‘কোনও শুভ অনুষ্ঠানের পরে অনুষ্ঠাতা যদি জ্ঞানের অভাবে বা অসাবধানতাবশে ব্রাহ্মণকে দান না দেয়, তা হলে এক ‘মুহূর্ত’ পরে তার পাপ দ্বিগুণ হয়, ছ’গুণ হয় এক রাত্রি পরে, ত্রিরাত্রি পরে দশগুণ, সপ্তাহান্তে বিশগুণ, মাসান্তে শতগুণ ও বৎসরান্তে ত্রিকোটিগুণ হয়।’ (ব্রহ্মবৈবর্ত প্রকৃতি, ৪২:৫৪-৫৮) ব্রাহ্মণকে দানের ওপরই নির্ভর করবে ‘দাতা’ বহু সন্তান লাভ করবে না নির্বংশ হবে, ধনী না দরিদ্র, রূপবান না কুৎসিত হবে, তার সন্তান দীর্ঘজীবী হবে, না মৃত জন্মাবে, গুণবাণ হবে, না অঙ্গহীন হবে। (ঐ ৪৩:২৯-৩২) এই অংশ ব্রাহ্মণকে দান করার কথাই বারে বারে আছে; দান না করার দোষ বাড়তে বাড়তে নরকে মূত্রহ্রদে সহস্র বৎসর বাস করার কথাও আছে। (ঐ কৃষ্ণজন্ম, ৮৭:৭২-৭৪)
ক্রমে ক্রমে দানের সামগ্রীগুলি বিশ্লেষিত হতে লাগল। খাদ্য থেকে আরম্ভ করে, (তেলের জন্যে) তিন গাভী, সহস্র বলদ, তিলপর্বত, লক্ষ্মী প্রতিমা, একটি কুমারী ও একটি গাভী (যজ্ঞের ঘিয়ের জন্যে); যে দাতার অদেয় কিছু থাকে না তার ‘কল্পপাদপ’ সংজ্ঞা হয়। (লিঙ্গ পুরাণ উত্তরভাগ, ৩০-৪০ অধ্যায়) ‘ব্রাহ্মণরা লোকপালদের প্রতিভু, তাই তাদের যথোপযুক্ত দান দিতে হবে। ভূমি, গাভী, সুবর্ণ, খাদ্য এবং কুমারীমূর্তি; অধিকাংশ দানের তালিকাতেই তিল ও ঘিয়ের উল্লেখ আছে। মহাভারত-এ দানসামগ্রীর তালিকায় প্রতি বস্তু দানের সঙ্গে অনুরূপ পুণ্যের উল্লেখ আছে।’ (১৩:৬৫:২৪:৬৩, ৬৬; পরজন্মে লভ্য পুণ্যফলের কথা আছে ৩:১৮৪:৮-১১; ১৩:৬৭:১৫-৩৩; ভূমিদান ইত্যাদির পুণ্যফল ১৩:৬৮:৪-২১, গাভী, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত বস্তু দানের ফল আছে ১৩:৭০:২৭–৩৫; ৪৫–৫৫; ছাতা ও জুতো দানের ফল আছে ১৩:৯৭ পুরো অধ্যায়টি জুড়ে।) দান ব্যক্তিকেও দেওয়া যায়, কোনও গোষ্ঠীকেও দেওয়া যায়। যেমন ইষ্টাপূর্তের মধ্যে পড়ে পুষ্করিণী খনন, উদ্যান নির্মাণ, কূপখনন— এ সবের দ্বারা বহু লোক উপকৃত হয় এবং এ সবের দাতা অনুষ্ঠাতার পুণ্য বহুগুণ হয়। সেই ধরনের পুণ্যই হয় বৃক্ষরোপণে ও কাননরচনায়। (মৎস্য ৫৮-৫৯ অধ্যায়) কিন্তু ব্রাহ্মণকে দেয় সাধারণ দান হল: গুড়ে নির্মিত গাভী, তণ্ডুলপর্বত, লবণশৈল, সুবর্ণাচল, তিলপর্বত, কার্পাস, ঘি, রত্ন, রৌপ্য, শর্করা, গাভী, চিত্রমৃগচর্ম। এই সব দানের ফর্দ বাড়তেই থাকে যতক্ষণ না আমরা ষোড়শ মহাদানের কথা শুনি, তেমনই ‘হিরণ্যগর্ভ’ নামে মহাদান, ‘ব্রহ্মাণ্ড’ মহাদান, ‘কল্পতরুদান’, ‘কল্পধেনু’, ‘রথ-অশ্ব’ দান, সুবর্ণহস্তী, পাঁচটি লাঙল, রত্ননির্মিত গাভী, ইত্যাদি ইত্যাদি। (মৎস্য ৮১-৯১ অধ্যায়, ২০৪, ২০৫, ২৭৩-২৮৮ অধ্যায়; কূর্ম ২৬ অধ্যায়, অগ্নি ২০৬-২১৩ অধ্যায়) দান সম্বন্ধে অংশগুলির শেষে প্রায়ই একটি মাহাত্ম্য অংশ দেখা যায়, সেখানে দানকে শ্রেষ্ঠ পুণ্যকর্ম বলা হয়েছে এবং দাতাকে উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে।
এ সব থেকে পরিষ্কার হয় যে, ব্রাহ্মণকে দান করলে অতিলৌকিক শক্তিগুলি প্রীত হন এবং দাতা সম্বন্ধে তাদের প্রতিকূল সিদ্ধান্তগুলি প্রত্যাহার করে নেন। অতএব নিয়তির অশুভ সিদ্ধান্ত প্রতিহত করার পক্ষে ব্রাহ্মণকে দান করা একটি প্রকৃষ্ট উপায়। শাস্ত্ৰ অবশ্য ‘দ্বিজাতি’কে দান করার কথাই বলে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ; সমাজে ধীরে ধীরে যে সব পরিবর্তন আসে তাতে পৌরাণিক যুগে দ্বিজাতির অর্থ ক্রমে শুধু ব্রাহ্মণেই পর্যবসিত হয়েছিল। যদিও কোনও কোনও পুরাণ বলে দানপ্রতিগ্রাহী ব্রাহ্মণকে শাস্ত্রজ্ঞ হতে হবে, আদর্শচরিত্র হতে হবে, কিন্তু পরবর্তী কালের শাস্ত্রগুলিতে এ সব গুণের দাবি প্রত্যাহত হয়ে গেল; তখন ব্রাহ্মণ হলেই প্রতিগ্রাহী হতে পারবে— জাত্যা ব্রাহ্মণঃ হলেই হল। অতএব দানের প্রতিগ্রহীতার গুণের বা বিদ্যার বা চরিত্র-উৎকর্ষের ওপর আর দাতার পুণ্য নির্ভর করছে না। শাস্ত্র পরম উদার ভাবে দাতাকে সর্বপাপ থেকে মুক্ত করে, শুধু তাকে নয় তার পূর্বপুরুষ ও উত্তর পুরুষের বহু প্রজন্ম ধরেই এই পাপমুক্তির আশ্বাস দেয়। নিয়তি যেন দানের হিসাব রাখে এবং দাতার নৈতিক দায়মুক্ত করে তাকে যান্ত্রিক ভাবে পুণ্য দায় করে।
বৌদ্ধ গ্রন্থে বহুজনীন কল্যাণের জন্য দানে যে কাহিনি পাই— দুর্ভিক্ষের সময়ে অনাথপিণ্ডদের সহস্র ক্ষুধিতকে আহার দান বা বিত্তবতী গণিকা অম্বাপালীর অর্হৎদের জন্যে ভূমি ও উদ্যানদান— এর দ্বারা এরা বহু পুণ্যের অধিকারী হন, আধ্যাত্মিক কল্যাণের ভাগী হন ও নির্বাণের কাছাকাছি আসেন। কিন্তু ব্রাহ্মণশাস্ত্রে দানের ফল স্বর্গে সুখভোগ, ধনী উচ্চবংশে জন্ম এবং পূর্ব ও পরজন্মের বহু পুরুষের সঙ্গে বহু পাপ থেকে মুক্তি। পাপমুক্তির একটা অস্পষ্ট নৈতিক দিক আছে, কিন্তু শুধু দানের দ্বারা পাপমুক্তি হলে এক দিকে নৈতিকতা যেমন অতি সুলভ হয়ে যায়, অন্য দিকে ধনীদেরই এ পুণ্যলাভে অধিকার থাকে। এ কথা বলা হয়নি যে, গৃহনির্মাণ, পুষ্করিণী, উদ্যান নির্মাণে অধিক পুণ্য, কারণ বহু সংখ্যক ব্যক্তি এর ফল ভোগ করে এবং এ দানগুলি দীর্ঘস্থায়ী, বহু প্রজন্মের প্রয়োজন মেটায়, যা একক ব্রাহ্মণকে দত্ত দানের চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এবং সে ব্রাহ্মণটি দুশ্চরিত্র ও অশিক্ষিত হলেও কিছু এসে যায় না, কারণ যার যোগ্যতা নির্ণীত হচ্ছে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ বংশে তার জন্মের দ্বারা। বারবার ব্রাহ্মণদের দানের ব্যাপারে গ্রহীতা ব্রাহ্মণদের শিক্ষাগত, চরিত্রগত যোগ্যতাকে উপেক্ষা করার দ্বারা একটি ব্যাপার স্পষ্ট হচ্ছে তা হল জাতি হিসাবে ব্রাহ্মণের ক্রমাগত অবক্ষয়। পরবর্তী পুরাণগুলি বলে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মই একটি পুণ্যকীর্তি। এর থেকে সূচিত হয় যে, গুণে বিদ্যায় চরিত্রে ব্রাহ্মণের কোনও দাবি আর গোষ্ঠীগত ভাবে অবশিষ্ট নেই; তার একমাত্র পরিচয় ব্রাহ্মণবংশে জন্ম। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণবংশে জন্মেছে যে সে বিদ্যাগুণ-চরিত্রবর্জিত হলেও তাকে দান করার দ্বারা দাতারও যেন নৈতিক অবক্ষয় ঘটে।
শাস্ত্র যখন নিয়তির নির্দেশকে এমন যান্ত্রিক ভাবে নির্ধারণ করার সমর্থন জোগায় তখন বোঝা যায় পুরো সমাজেরই নৈতিক মান নেমে গেছে এবং পরিহাসের মতো শোনালেও, নিয়তি সম্বন্ধে সম্ভ্রমও যেন এক অর্থে কমে গেছে— এমনটা বোঝা যায়। এখন মানুষ অপ্রায়শ্চিত্তাহ মহাপাতক সহজেই মোচন করতে পারে, এমন পাতক যা সে বা তার পূর্বপুরুষ করেছে ও উত্তরপুরুষ অতীত ও অনাগত কালে করবে। এতাবৎকালে যে নিয়তি প্রবল প্রতাপান্বিত ছিল তার বিধান যদি শুধু ব্রাহ্মণনামধারীকে দান করেই খণ্ডন করা যায়, তা হলে সমাজের নৈতিক কাঠামোটা হাস্যকর ভাবে নড়বড়ে এবং খেলো হয়ে যায়।
ব্রত দেখা দেয় দানের কিছু পরে, দানের সূচনা বৈদিক পর্বে; ব্রত পরবর্তী কালের উদ্ভাবন। দুটিরই নিশ্চয়ই প্রাচীন কাল থেকেই যুগপৎ চর্চা ছিল। সহজ ভাষায় বললে— ব্রত হল দৈনন্দিন বা শৌখিন ব্যবহার্য কিছু বস্তু বা খাদ্য থেকে কিছুকাল নিজেকে বঞ্চিত রাখার মানসিক সংকল্প, যার পরিবর্তে সে ব্যক্তি কোনও কামনা পূরণের আশা করে। ব্রতে এই ভাবে স্বেচ্ছাবঞ্চিত থাকার সর্বদাই একটা সময়সীমা থাকে। সে সময় শেষ হলে ব্রতকারী বা ব্রতকারিণী আত্মীয়বন্ধুর সঙ্গে মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্রতের ‘পারন’ করে পুরোহিতের সাহায্যে এবং পুরোহিতকে যথাসাধ্য দক্ষিণা দেয়, শাস্ত্র নির্দিষ্ট বস্তু দান করে। এই ভাবে ব্রত উদযাপন করে মানুষ নিয়তির কোনও সিদ্ধান্তকে নিজের অনুকূলে আনতে বা প্রতিহত করতে চেষ্টা করে।
আধ্যাত্মিক ভাবে ‘ব্রতের পূর্বগামী ছিল ‘সত্যক্রিয়া’। সমাজের কোনও মানুষকে অপর কেউ কোনও অপরাধ সম্বন্ধে সন্দেহ করলে সন্দিগ্ধ ব্যক্তি একটি সত্যক্রিয়া করে সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি ইত্যাদি দেবতাদের আহ্বান করে— যেন তাঁরা তার নিষ্পাপতা সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেন। প্রাচীন শাস্ত্রে ওই প্রাকৃতিক বা অতিপ্রাকৃত দেবতারা আবির্ভূত হয়ে সন্দিহান জনতার সামনে সন্দিগ্ধ ব্যক্তির শুচিতা জ্ঞাপন ও প্রতিপাদন করেন, তার নিষ্পাপতা তখন সমাজে গ্রাহ্য হয়। অশ্বত্থামা উত্তরার গর্ভে অভিমন্যুর পুত্রের ভ্রুণটিকে হত্যা করার পরে কৃষ্ণ এসে সত্যক্রিয়ার দ্বারা তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন, এর দ্বারা পাণ্ডুর বংশ পরম্পরা অব্যাহত থাকে। (মহাভারত ১৪:৬৮:২০-২৪) এ যেন শপথের সমগোত্র। ‘যে সমাজে জনসাধারণের শক্তির প্রতিষ্ঠা দুর্বল এবং আইন অতি প্রাথমিক অবস্থায় আছে (সেখানে) শর্ত বা সন্ধিকে দৃঢ় করার বিষয়ে শপথের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে, সেখানে অতিপ্রাকৃত সমর্থন দিয়ে শপথকে সত্য বলে প্রমাণ করা হয়।’ (উইলসনস ১৯৮৩, পৃ. ৩৬) সীতা যখন প্রচণ্ড বেদনা ও অপমানে নিজের শুচিতা সম্বন্ধে দেবতাদের সাক্ষী মেনে চিতাপ্রবেশ করেন তখন ব্যাপারটি পরিণত হয় একটি সত্যক্রিয়ায় এবং তখন দেবতারা তাঁর শুচিতা-প্রতিপাদন করেন। প্রায় এই ধরনেরই একটি সত্যক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় যখন ‘মার’ এর বারংবার প্রলোভনে, শক্তি ও আধিপত্যের লোভ দেখানোতে বিরক্ত হয়ে বুদ্ধ ভূমিস্পর্শ করে শপথ করেন যে, পৃথিবীর আধিপত্য যথার্থই তাঁর; পৃথিবী তাঁর এ শপথের মর্যাদা রাখে; কেঁপে ওঠে, ভূমিকম্প হয়।
বৌদ্ধ সাহিত্যে সত্যক্রিয়ার বেশ কয়েকটি নিদর্শন আছে। ‘পোলজনক’কে মুক্ত করে একটি সত্যক্রিয়া (৫৩৯ নং মহাজনক), আর একটি মৃত বালক ‘সাম’র রক্ষাদেবী বহুশোদরি একটি সত্যক্রিয়া করে তাকে পুনরুজ্জীবিত করে। (৫৪০ নং, সাম) তৃতীয় একটি কাহিনিতে চন্দকে যখন যজ্ঞভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এবং খণ্ড যখন তার মাথাটা কেটে ফেলতে যাচ্ছে তখন চন্দ্র’র স্ত্রী একটি সত্যক্রিয়া করাতে তার স্বামীর প্রাণ বাঁচে। (৫৪২ নং খণ্ডহাল) এই সত্যক্রিয়াগুলিতে শুধু যে অন্যায় অপবাদের নিরাকরণ হয় তা নয়, যে সত্যক্রিয়া করে তার হয়ে প্রকৃতি যেন সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে দুটি কাহিনিতে মৃত সঞ্জীবিত হয়। অর্থাৎ এটা জীবন মৃত্যু, নিয়তির রাজ্য এবং এই সব কাহিনিতে স্পষ্টই প্রতীত হয় যে, কোনও পুরুষ বা নারীর নির্মল বিবেক নিয়তির ওপরে চাপ সৃষ্টি করে, তাদের অনুকূলে ঘটনা ঘটাতে বাধ্য করে। রামায়ণের সমকালীন এই কাহিনিগুলিতে অতিলৌকিক সাক্ষ্যে ব্যক্তিরা অপবাদমুক্ত হয়। এ হল শপথের আদিম পর্যায়, বেদেও এর নিদর্শন পাওয়া যায়।
‘ব্রত হল সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে একটি প্রতিজ্ঞা, যেন তাঁরা বিশেষ কোনও কাজ করেন… (এর ভাষা) উপহারবিনিময় থেকে ধার করা ভাষার সংকেত, সমকক্ষদের মধ্যে আদানপ্রদানের, পারস্পরিকতার অথবা অসমকক্ষদের মধ্যে ঋণের সম্পর্ক, অথবা এ দুইয়ের অন্তর্বর্তী নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষকতার সম্পর্ক… এ সব ধর্মনিরপেক্ষ বন্ধনের এবং যে-সব কাঠামোতে এগুলি সংবৃত, তার দিব্যতা প্রতিষ্ঠা হল। একেবারে অসমীচীন ব্যাপারে দিব্যতার আক্রমণ বা অনুপ্রবেশ ঘটল।’ (উইলসন, ১৯৮৩, পৃ. ১৬) ভারতীয় পটভূমিকায় সাধুসন্ন্যাসীরা পুরোহিতের ভূমিকা নিয়েছে, এরা ভগবানকে মিনতিতে অনুকূল করে ভক্তের কামনা পূরণ করিয়ে দেয়।
পারিভাষিক অর্থে শপথ আসলে ‘ব্রত’ এবং ‘ব্রত’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল জীবনধারণে প্রয়োজনীয় খাদ্য। বস্তুত, অধিকাংশ ব্রতেই কিছুকাল উপবাসের নির্দেশ থাকে এবং খাদ্যের প্রকৃতি, পরিমাণ নিয়ন্ত্রণও একটি আবশ্যিক অঙ্গ, যার দ্বারা পুরোহিত এবং তার মাধ্যমে দেবতা তুষ্ট হন। ব্রতের ক্ষেত্রে দুটি চন্দ্র পক্ষের বিশেষ তাৎপর্য আছে এবং এ তিথিগুলির স্বতন্ত্র নামও আছে। যেমন প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া বাদেও জয়ন্তাষ্টমী, অখণ্ড দ্বাদশী, ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট তিথিও আছে। (অগ্নি ১৭৫-১৯৪ অধ্যায়) এ ছাড়াও ব্রত সম্বন্ধেই পৃথক একটি উপদেশ আছে। (১৭৫ অধ্যায়) শিবরাত্রি (১৯৩ অধ্যায়), ঋতুব্রত (১৯৮ অধ্যায়), ইত্যাদিও আছে। আরও বিশেষ উপলক্ষ যেমন অগস্ত্যপূজা (২০৬ অধ্যায়), ভীষ্মপঞ্চমী (২০৫ অধ্যায়), পূর্ণিমা (২০৭)। কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিণীর নামে এক ব্ৰত আছে। (কল্কি ৩:১৭ পুরো অধ্যায়টি) সপ্তাহের দিনগুলির জন্যে বিশেষ বিশেষ ব্রত আছে। ঋতুগুলির জন্যে, দীপ-দানের উপলক্ষে (অগ্নি ১৯৫, ১৯৭, ১৯৯ অধ্যায়) বামণ পুরাণে ‘অশূন্যশয়ন’ ব্ৰত আছে। (১৬ অধ্যায়) বৃহন্নারদীয় পুরাণে প্রায় ছ’টি পুরো অধ্যায় জুড়ে ব্রতের কথা আছে। (১৬-২১) জ্যোতিষ্কমণ্ডলী যখন থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে তখন থেকে তাদের নামেও ব্রত প্রবর্তিত হচ্ছে। একটি ব্রতের নামই ‘নক্ষত্রপুরুষ’। (মৎস্য ৫৪ অধ্যায়); সূর্যেরও একাধিক ব্ৰত আছে, (৫৫ অধ্যায়) চন্দ্রের এবং তার প্রিয়পত্নী রোহিণীর নামেও ব্রত আছে। (৫৭) ‘সৌভাগ্যশয়ন’ একটি ব্রতের নাম। (৬০) এমন ব্রতও আছে যাতে ত্রিভুবনের অধিপতি হওয়ার প্রক্রিয়া বলা আছে (৬১); আর একটি ব্রতে সাধ্বী নারীর আচরণ কী করে পাওয়া যায় তাও বলা আছে। (৬৯) তার পর আছে তিথি বিশেষের নামের সঙ্গে যুক্ত ব্রতের কথা শুক্লতৃতীয়া, বিশোকসপ্তমী, ফলসপ্তমী, শর্করাসপ্তমী, কমলসপ্তমী, মন্দারসপ্তমী, ইত্যাদি; এই বিষয়টি নিয়ে বহু পুরাণে আলোচনা আছে। শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের একাদশী পালনের রীতি নিয়ে সুদীর্ঘ নির্দেশ দেওয়া আছে যাতে এর মাহাত্ম্য সম্পূর্ণ অনুভূত হয়। (পদ্ম সৃষ্টি ২২-২৬ অধ্যায়, ২৯)
কিছু কিছু ব্রতের ভিত্তি অতিকথায়: সত্যবানের জীবনের ওপরে যমের দাবি সাবিত্রী নাকচ করে দিতে পেরেছিলেন, অতএব সাবিত্রী ব্রত প্রবর্তিত হল। (ব্রহ্মবৈবর্ত, প্রকৃতি ২৩:১৪-২৯) মহাপাপিষ্ঠের সমস্ত পাপ ধ্বংস হয়ে যায় নবরাত্র ব্রতে। (দেবীভাগবত ৩:২৭:২৯) বিশেষ বিশেষ দেবতার উদ্দেশ্যে বিশেষ বিশেষ ব্রত আছে, যেমন শিবের উদ্দেশ্যে পাশুপত ব্রত। (লিঙ্গ ৮১-৮৬ অধ্যায়) এখানে শিবের বিভিন্ন প্রকাশ ও ভূমিকা বিবৃত করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্রত পুরাণগুলির অংশ বিশেষে আলোচিত হয়েছে। (লক্ষণীয় পদ্ম ৮০-৮১ অধ্যায়; বৃহন্নারদীয় ১৯-২১; মৎস্য ৫৫-১০০; অগ্নি ১৭৬-২০৭, ইত্যাদি।)
ব্রতের দুটি দিক বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। প্রথমটি আগেই বলা হয়েছে; ব্রাহ্মণ্যধর্মে ব্রত দেখা দিয়েছে বিলম্বে এবং খুব দ্রুত এটি বহুগণিত হয়ে যায়; অতএব অর্বাচীন পুরাণগুলিতে ব্রত বেশি নামে এবং সংখ্যায় দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্রতগুলি অধিকাংশই নারীর জগতে প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্মের প্রথম পর্যায়ে নারী ছিল অবহেলিত। উপনয়নে তার অধিকার ছিল না, (কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতেও সে বঞ্চিত ছিল); যজ্ঞে সে অনধিকারিণী ছিল, মন্ত্রপাঠ করা তার পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল, শুধু নীরবে স্বামীর পাশে বসে থাকারই অধিকার ছিল তার, সে হয়তো যজ্ঞকালে যৎসামান্য কায়িক পরিশ্রমের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারত। পুরাণের যুগে পূজার পুরোহিতও ছিল পুরুষ, পুরোহিত উপস্থিত না থাকলে কোনও ব্রাহ্মণ পুরুষ কাজ চালিয়ে দিতে পারত, কিন্তু নারী কদাপি নয়। কাজেই পুণ্য অর্জনের অন্য সব পথ যেহেতু তার সামনে রুদ্ধ ছিল তাই নারী ব্রত পালনে একনিষ্ঠ হয়ে উঠল। স্বামী বা অন্য পুরুষ আত্মীয়দের সঙ্গে গিয়ে সে তীর্থ দর্শন করতে পারত, কিন্তু (নিম্নবর্গের ক্ষেত্রে এবং উচ্চবর্গে যৎসামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) নিজস্ব অর্জন বা সঞ্চয় না থাকায় দানদক্ষিণাতেও তার অধিকার ছিল না, কাজেই পুণ্য অর্জনের এ পথটিও তার পক্ষে প্রায় রুদ্ধই ছিল। কিন্তু তার জীবনে আত্মীয় প্রিয়জনদের ঘিরে বিশিষ্ট কিছু কিছু উদ্বেগ আশঙ্কা তো ছিল— বৈধব্যের আশঙ্কা, সপত্নী সম্ভাবনার উদ্বেগ, সন্তান শোকের ভয়, দারিদ্র্যের আতঙ্ক, স্বামী ও সন্তানদের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা, কোনও গ্রহ নক্ষত্রের বা দেবতার রোষের সম্ভাবনা। তার এই সব ভয়-আতঙ্ক-উদ্বেগ দূর করবার জন্যে পুরোহিতরা ব্রতের পর ব্রত উদ্ভাবন করে চলেছিলেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা দেখলেন বধূ এ সব ব্রত পালন করলে আখেরে তাঁদেরই লাভ, কারণ বিবাহিত নারীর পক্ষে পিতৃকূলের জন্যে বা নিজের মঙ্গলের জন্যে কোনও ব্রতের নির্দেশ নেই; কুমারী জীবনে তার যা ব্রত তা-ও ভাল স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি পাওয়ার আশায় করা। কাজেই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বধূর ব্রত পালনে বাধা দিতেন না; বরং, অনুমোদনই করতেন, প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্যও করতেন যাতে সে পুণ্য কর্মে ব্যাপৃত থাকে। তারও কোনও অপরাধ বোধ থাকত না, কারণ ব্রতান্তে ব্রাহ্মণভোজন করিয়ে ব্রাহ্মণকে দানদক্ষিণা দেওয়াকে সব শাস্ত্রই চিরদিন সমর্থন করেছে। তা ছাড়া ব্রতের দ্বারা সে তো স্বামী, সন্তান ও শ্বশুরবাড়িরই মঙ্গলবিধান করেছে, নিয়তিকে তাদের প্রতি অনুকূল করার সাধনাই তো তার ব্রত। ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক দিকে সে অনাদৃত ছিল, তার ব্যক্তিসত্তার কোনও স্বীকৃতিই সেখানে ছিল না। এই অবহেলিত মানুষটি তার ব্যক্তিসত্তা খুঁজে পেল ব্রতানুষ্ঠানে, আরও পেল এই আশ্বাস যে, তার ব্রতপালনের দ্বারা তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়কূলের সঙ্গে তারও জীবন শান্ত স্রোতে বাইবে। ঋতু, তিথি, নক্ষত্র, বার ধরে ব্রত পালন করে, উপবাস ও কৃচ্ছ্রসাধন করে, নানা ভাবে আত্মত্যাগ করে সে প্রতিকূল দৈবকে অনুকূল করতে পারবে- এই ছিল তার আশ্বাস। খুব কম ব্রতই নারীটির নিজের স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য, পরমায়ু বা সুখের জন্যে উদ্দিষ্ট, গৌণ ভাবে এগুলি কখনও কখনও লক্ষিত ছিল কোনও কোনও ব্রতে, যেমন— বৈধব্য-নিবারণ, সপত্নী-নিবারণ, সন্তানলাভ ইত্যাদি। (বৈধব্য নিবারণের ব্রতেরও মুখ্য ফলভোগী সে নয়, তার স্বামীই) কিন্তু সে হয়তো তার সত্তাকে শ্বশুরবাড়ির সত্তার মধ্যে এমন নিঃশেষে বিলীন করে দিতে পেরেছিল যে, সে মনে করত ব্রতগুলি হয়তো মুখ্যত তারই স্বার্থে সে পালন করছে।
বৈদিক ধর্মে ব্রত সম্পূর্ণত উপস্থিত ছিল না (যদি না দীক্ষার পূর্বে আচরণীয় কিছু কিছু কৃচ্ছ্রসাধনকে ধরি, যা নিতান্ত স্বল্পকালের জন্যে আচরণীয় ছিল)। হঠাৎ একটা সময়ে ব্রত দেখা দিল এবং অচিরেই পল্লবিত হয়ে উঠল, এর থেকে মনে হয় প্রাগার্যদের মধ্যে হয়তো ধর্মাচরণের অঙ্গ হিসাবে ব্রত ছিল। আর্য প্রাগার্য সংমিশ্রণের পরে অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও অন্যান্য প্রাগার্য গোষ্ঠীর ধর্মাচরণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মে অনুপ্রবেশ করবার ফলেই গুপ্তযুগে এর উদ্ভব ও প্রাধান্য দেখা দিল, তীর্থ, মানত, পূজা— এ সবের সঙ্গে ব্রতও ক্রমে বিস্তার লাভ করল।
বহু প্রাচীন কাল থেকেই পুণ্য অর্জনের একটি স্বীকৃত পন্থা হল ধ্যান। সম্ভবত প্রাগার্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মাচরণের একটি উপায় হিসেবে এটি প্রচলিত ছিল। প্রাগার্য-আর্য সংমিশ্রণের প্রথম পর্বে এই ব্যাপারটা আর্যদের কাছে বিদ্রুপের বস্তু ছিল— ‘মুনি’ ‘যতি’ এদের আর্যরা তাচ্ছিল্যমিশ্রিত বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দেখত। ইন্দ্ৰ যতিদের সালাবৃকদের কাছে ছেড়ে দিয়েছিলেন।’ কিন্তু ধীরে ধীরে সংমিশ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ধ্যান বা তপস্যাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখতে পেরেছিলেন। উপনিষদের যুগে ‘ব্রহ্মা’ বা ‘পুরুষ’ নিজেই ধ্যান করছেন এবং তপস্যার দ্বারা সৃষ্টি করছেন, কাজেই ততদিনে তপস্যা আর অবজ্ঞেয় নয়। সামাজিক মানুষের চোখে তপস্বী অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী, অতএব শ্রদ্ধার পাত্র। ধ্যান বা তপস্যা হল কোনও একটি বস্তু, ব্যক্তি বা বোধের ওপরে চিত্ত স্থির করে কিছুকাল একাগ্র ভাবে তারই চিন্তা করা। এর প্রাক্শর্ত আত্মত্যাগ, চিত্তনিয়ন্ত্রণ ও কৃচ্ছ্রসাধন, সারা পৃথিবীতেই চিরকাল এটি তপস্যার অঙ্গ। এই ত্যাগ বা কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারা দেবতা মানুষের কাছে ঋণী বোধ করেন এবং নিজেকে তার দাবি ও কামনা পূরণ করতে বাধ্য মনে করেন। ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে কৃচ্ছ্রসাধনের স্বতন্ত্র একটি মূল্য স্বীকার করা হয়। ধ্যান মানুষকে আধ্যাত্মিক ভাবে উন্নততর লোকে নিয়ে যায় এবং ধ্যানীকে অধিকতর শুচিতা ও মহিমায় মণ্ডিত করে। বারেবারেই শাস্ত্র বলে, মানুষের তপস্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনে ইন্দ্র বিচলিত হন এবং প্রায়ই তপোভঙ্গ করবার জন্যে একটি অপ্সরাকে পাঠিয়ে দেন যাতে ধ্যানীর ধ্যান দেবতাদের তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে বাধ্য না করে। কারণ, পূরণ করলে দেবতাদের কিছু মুশকিল হতে পারে। শুধু মানুষই নয় দানব, রাক্ষস, অসুররাও অবিশ্বাস্য দীর্ঘকাল ধরে তপস্যা করেছে এমন বহু নজির শাস্ত্রে আছে এবং দেবতারা প্রতারণা করে তাদের তপস্যা থেকে নিবৃত্ত না করলে তারা কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়েওছেন। শাস্ত্রে দেবতারা তাঁদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে মাঝে মাঝে নিরবলম্ব ধ্যান করে থাকেন। (প্রশ্ন জাগে, দেবতাদের কোন ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা ছিল যা দূর করতে তাঁদের এমন ধ্যান করতে হত?) প্রায়ই দেবতাদের নিষ্কাম তপস্যা তাঁদের সৃষ্টিকর্মের পূর্বশর্ত। কিন্তু তপস্যা ও সৃষ্টিকর্মের সম্পর্ক ঠিক কী, তা স্পষ্ট নয়। উপনিষদের কাল থেকে তপস্যাকে একটি উচ্চ আধ্যাত্মিক মার্গে স্থাপন করা হয়েছে যেখােেন মানুষ বা দেবতা নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তার ওপরে শর্ত আরোপ করতে পারে, এমন পথে নিয়তির গতি বাঁকিয়ে দিতে পারে যা নিয়তির অভিপ্রেত ছিল না কিন্তু তপস্বী যা চেয়েছিল।
তপস্যা শব্দটি নিষ্পন্ন হচ্ছে, তপস শব্দ থেকে, যার মূলে ‘তপ’ ধাতু, অর্থাৎ যাতে মানুষ তপ্ত হয়। তপের দুটি অর্থ, একটি উত্তাপ, অন্যটি মানসিক যন্ত্রণা। এই দ্বিতীয় অর্থটিই এখানে প্রযোজ্য। যারা তপস্যা করে তারা উদ্দিষ্ট বস্তু লাভ করার জন্য কিছুকাল মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করেন। বহির্বিশ্ব থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রত্যাহরণ করে অন্তর্লোকে কোনও কিছুর ওপরে চিত্তকে সংহত ভাবে স্থাপন করাই তপস্যা। এর সঙ্গে আছে শারীরিক কিছু কৃচ্ছ্রসাধন যেমন অনাহার, অনিদ্রা, ইত্যাদি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই তপস্যা নিয়তিকে জয় করবার একটি উপায় এবং এর উদ্দেশ্য ব্যক্তিজীবনে নীরবে কিছু মূল্য দিয়ে নিয়তিকে ঋণী করে বাধ্য করা এবং উদ্দিষ্ট বস্তু লাভ করা। তাপ থেকেই বস্তু জগৎ সৃষ্টি হয়, তখনকার পদার্থবিদ্যা তা-ই বলত; উপনিষদেও ব্রহ্মা তপস্যার দ্বারা সৃষ্টি করেন, তা বিশ্ব সৃষ্টিই হোক, অথবা কাব্য সৃষ্টিই হোক, মূল শক্তিটি অর্জন করা হত তপস্যার দ্বারা। তাপের মূল্য স্রষ্টার পদবিতে আরোহণ করত, এবং তপস্বী সৃষ্টির উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে নিয়তিকে বাধ্য করত।
মহাবাক্য দুটিতে তপস্যা অতিপ্রাকৃতের অভিমুখে বহুধাবিসর্পিত একটি মাৰ্গ। যে আসন্ন বিপৎপাতের সম্মুখে সে তপস্যা করতে শুরু করে যাতে অভিশাপ, ব্যাধি, মৃত্যু ও দুর্ভাগ্য এড়াতে পারে; সে ক্ষেত্রে সমাধানের ও বিপদ এড়ানোর জন্যে তপস্যাই বিহিত। দিতির পুত্রকে ইন্দ্র বধ করলে দিতি তপস্যায় বসলেন। তাঁর স্বামী মারিচ তাঁকে ইন্দ্রের হত্যাকারী পুত্র লাভের বর দিলেন। (রামায়ণ ১:৪৬:১-৫) এটা অবশ্য ইন্দ্রের ছলনায় ব্যাহত হল। (১:৪৭:১-৮) যখন বিশ্বামিত্রের ক্ষাত্রশক্তি অক্ষম প্রতিপন্ন হল তখন তিনি তপস্যার জোরে ব্রাহ্মণ্যত্ব লাভ করলেন। (১:৪৭:৬৩) বিশ্বামিত্র অপ্সরা মেনকাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। যখন পদস্খলনের জন্যে অনুশোচনা হল তখন ব্রহ্মা তাঁকে তপস্যা করার নির্দেশ দিলেন, যাতে তাঁর প্রায়শ্চিত্ত হয়। ঊর্ধবাহু হয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বায়ুভুক অবস্থায় তিনি দশ হাজার বৎসর প্রায়শ্চিত্তের জন্যে তপস্যা করলেন এবং বহু কষ্ট সহ্য করলেন। (১:৬৩:২৩-২৫) বিশ্বামিত্র স্বভাবকোপন ঋষি, ক্রোধের মুখে অপ্সরা রম্ভাকে শাপ দিলেন এবং রিপুদমন না করতে পারার গ্লানিতে— এবং সেই শক্তি অর্জন করার জন্যে— দীর্ঘ কষ্টকর তপস্যা করেন ও ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। (১:৬৫:২০) রামায়ণের শুরুতেই দেখি রচয়িতা বাল্মিকী ওই মহা-তাৎপর্যপূর্ণ মহাকাব্য রচনার জন্যে পূর্বাহ্নে তপস্যায় নিমগ্ন। তপস্যায় তাঁর আধ্যাত্ম শক্তির বিকাশ হয়, সৃষ্টিশক্তি জাগ্রত হয় এবং দেবতার আশীর্বাদ নিয়ে ওই মহাকাব্য সমাধান করেন। উচ্চাশী রাক্ষসরাজ রাবণ বহু সহস্র বৎসর তপস্যা করে, ব্রহ্মার কাছে প্রায় সর্বজীবের দ্বারা অবধ্যতার বর পান। কিন্তু নিশ্চয়ই কোথাও ত্রুটি থেকে গিয়েছিল, তাই বরদানের তালিকায় মানুষ বাদ পড়েছিল বলে অবশেষে মর্ত্য মানুষের হাতেই শেষ পর্যন্ত তাকে নিহত হতে হল, একটি মর্ত্য নারীকে কামনা করার অপরাধে। রাবণের এ তপস্যা ছিল আত্মম্ভরিতাপ্রসূত, কিন্তু এমন বহু ক্ষেত্রে প্রার্থীর উদ্দেশ্য অসাধু থাকলে দেবতারা শুধুমাত্র তপস্যাতেই প্রীত হয়ে বর দেন; এ ভাবে তপস্যার দ্বারা নিয়তির গতি প্রতিহত হয় এবং সর্বক্ষেত্রে নৈতিকতার মর্যাদাও রক্ষিত হয় না।
মহাভারত-এও আমরা বহু তপস্যার কথা পাই, একটি ছোট অংশে তপস্যা ও তার ফল সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। (১৩:১০৬:৩) তপস্যার অঙ্গাঙ্গী ধর্মকৃত্য হল উপবাস। অনেক কৃচ্ছ্রসাধন, যা তপস্যার সঙ্গেই আচরিত হয় তার থেকেও পুণ্য অর্জন করা যায়, সে কথাও আলোচিত হয়েছে। (১৩:১১০:৫-১৩৭) বৌদ্ধ মহাবগ্গ, ললিতবিস্তর ও মহাবস্তুতে আমরা বুদ্ধের নিজের তপস্যার স্তর সম্বন্ধে অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাই। এ তপস্যার উদ্দেশ্য ছিল জীবনে মৌলিক সমস্যার সমাধান, জন্মান্তর, কর্ম, বাসনা এবং তার নিরোধের দ্বারা পুনর্জন্মর সূত্রটিকে ছিন্ন করার চেষ্টা। জাতক এবং অন্যান্য বৌদ্ধ গ্রন্থে পাই বহু মানুষের তপস্যার কথা। তপস্যার এমনই ক্ষমতা যে, বৌদ্ধসাহিত্যে যখনই কেউ কঠোর তপস্যায় নিরত হয় তখনই স্বর্গে ইন্দ্রের সিংহাসন তপ্ত হয়ে ওঠে, তিনি সন্ধান করতে শুরু করেন কেন এমন হল, কখনও-বা মর্তে অবতরণ করে তপস্বীর সম্মুখীন হয়ে বর দিয়ে তাকে তুষ্ট করেন। মহাকাব্য দুটিতে দেবতারা নানা ভাবে তপস্যারত ব্যক্তিকে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করেন যেন ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব নিরাপদ থাকে। ত্রিশঙ্কু তপস্যার বলে সশরীরে স্বর্গে যাচ্ছিল, কিন্তু মধ্যপথে বুঝতে পারল যে তার সঞ্চিত পুণ্যে কুলোবে না, ফলে সে অন্তরীক্ষে ঝুলে রইল, পরে দেবতারা ঠেলে তাকে মর্তে পাঠিয়ে দেন। (ভাগবত পু. ৯:৭) মহাভারতে বেশ কিছু মুনির তপস্যার কথা পড়ি যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে কঠোর তপস্যা করতেন ও ফাঁকে ফাঁকে দম্ভ প্রকাশ করতেন, সামান্য অপরাধে যাকে তাকে অভিশাপ দিতেন। চ্যবন ঋষি দীর্ঘকাল সম্পূর্ণ স্থির থেকে এমন তপস্যা করেছিলেন যে, তাঁর দেহ ঘিরে বল্মীক স্তুপ গড়ে ওঠে। কিন্তু একটি বালিকার চাপল্যে ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি বহু লোককে অসুস্থতার অভিশাপ দেন এবং ততক্ষণ প্রসন্ন হন না, যতক্ষণ না বালিকাটির পিতা মুনিকে কন্যাটি সম্প্রদান করেন। স্পষ্টতই ওই দীর্ঘ তপস্যায় চ্যবন ঋষি কাম ক্রোধ কিছুই জয় করতে পারেননি। (মহাভারত ৩:১২২)
অতএব কিছু দীর্ঘকালব্যাপী কঠোর তপস্যাও আধ্যাত্মিক ভাবে সম্পূর্ণ নিষ্ফল থেকে যায়। তাই এ সব ক্ষেত্রে যে পুণ্য তপস্বী অর্জন করে থাকে তা নিয়তি গ্রাস করে, তপস্যার ফল তপস্বী কিছুই পায় না। যযাতির কাছে প্রার্থী হয়ে এল ব্রাহ্মণ ছাত্র গালব, তার গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। সে সময় যযাতিরও রাজকোষ শূন্য, তাই রাজকন্যা তরুণী সুন্দরী মাধবীকে গালবের কাছে দিলেন যেন সে পরপর তিনটি রাজার কাছে এক বছরের জন্যে রাজকন্যাকে ভাড়া দেয়। বৎসরান্তে মাধবী রাজাকে পুত্রসন্তান উপহার দিলে রাজা গালবকে অর্থ দেবেন। এই ভাবে তিন বছরে তিন রাজার কাছে পাওয়া অর্থ দিয়ে গালব গুরুদক্ষিণা দিলেন, মাধবী তপস্যা করতে চলে গেলেন। কিছুকাল পরে যযাতি সশরীরে স্বর্গে যেতে গিয়ে দেখলেন তাঁর সঞ্চিত পুণ্য যথেষ্ট নয়, তখন কন্যা মাধবীর কাছ থেকে প্রয়োজন মতো পুণ্য সংগ্রহ করে স্বর্গে গেলেন। যযাতি যে কন্যাকে সর্বতো ভাবে অপমান ও শোষণ করেছিলেন, তার শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিয়ে তিনি স্বর্গে গেলেন। (মহাভারত ৫:১১৮-২২) এটি অবশ্য নারীর তপস্যার একটি ব্যতিক্রমী নিদর্শন, কারণ সমাজে নারীর তপস্যা করার অধিকার ছিল না। বিবাহিতা নারীকে তপস্যা করতে হলে স্বামীর অনুমতি নিতে হত। বোধহয় মাধবী কুমারী ছিলেন বলেই স্বেচ্ছায় তপস্যা করতে পেরেছিলেন। অবশ্য পরবর্তী পুরাণগুলিতে নারীর এমনকী দেবীদেরও, তপস্যা করবার বহু নিদর্শন আছে; দেবীভাগবত, বৃহন্নারদীয় ও ব্রহ্মবৈবর্ত-তে দেবীরা মাঝে মাঝেই কোনও ইষ্টসিদ্ধির জন্যে (এমনকী ফর্সা হওয়ার জন্যেও)। কিংবা কোনও বিষয়ে রুষ্ট হয়ে প্রতিশোধ বা প্রতিবিধানের জন্যে তপস্যা করেন। কখনও কখনও স্বামী বা সপত্নীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যও তপস্যা করা হয়।
হরিবংশ-তে অসুর বজ্রনাভ কঠোর তপস্যা করে; ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে বর দিয়ে তাকে অজেয় করে দেন। বজ্রপুরে রাজধানী স্থাপন করে সে রাজত্ব করে। (১৪:৩০) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এ তপস্যা সম্বন্ধে একটি তত্ত্ব আছে: ‘সাধু প্রকৃতির কোনও ব্যক্তি কোনও পুণ্যভূমিতে দীর্ঘকাল যাবৎ তপস্যা করলে দেবতারা তার তপস্যার মূল্য দেন, এ কথা অবিসাংবাদিত সত্য।’ (২:৯১:৭)
তপস্যা, দেখা যাচ্ছে, নানা ধরনের হয়, নানা উদ্দেশ্যে:
(১) পাপের জন্যে অনুতাপ থেকে উদ্রিক্ত হয়ে প্রয়শ্চিত্ত সাধন করতে;
(২) ঐহিক কোনও ইষ্টসিদ্ধির জন্যে, যেমন উত্তম স্বামী বা স্ত্রী লাভ কিংবা বীরপুত্র লাভ, বিজয়লাভ, ইত্যাদি;
(৩) তাৎক্ষণিক কোনও সামান্য কারণে, যেমন গৌরবর্ণ লাভ বা স্বামী অথবা সপত্নীকে শিক্ষা দেওয়া;
(৪) পুণ্য সঞ্চয়ের জন্যে;
(৫) সৃষ্টিমূলক ক্রিয়ার জন্যে, যেমন মহাভারতে ব্রহ্মার নির্দেশে পৃথিবী সৃষ্টির জন্যে শিবের দীর্ঘকালব্যাপী তপস্যা, স্বয়ং ব্রহ্মার তপস্যার সৃষ্টির জন্যে যা উপনিষদে বর্ণিত; বা মহাকাব্য রামায়ণ রচনার প্রাক্কালে রচয়িতা বাল্মীকির তপস্যা।
এর প্রত্যেকটিই নিয়তিকে খণ্ডন করার প্রয়াস; এমনকী মহাকাব্য রচনাও, যা মর্ত্য মানুষের অসাধ্য বলে মনে করা হত, তা সিদ্ধ করার জন্যে তপস্যাও প্রকারন্তরে নিয়তির গতিরোধ করে। কিন্তু তপস্যায় যে পুণ্য অর্জিত হয় তা শাস্ত্রে সম্পত্তি বলে বিবেচিত হয়েছিল: তা ভোগ করা যায়, তপস্বীর অভিপ্রেত সুখভোগের দ্বারা, তা দান করা যায়, ধার দেওয়া যায়, ধ্বংস বা ক্ষয় হয়ে যায় বিরুদ্ধ ক্রিয়া বা চিত্তবৃত্তির— যেমন কাম বা ক্রোধ দ্বারা।
শাস্ত্রে তপস্যাকে অর্থের মতো দেখা হয়েছে, যেন টাকার নোট যা প্রয়োজনে ভাঙানো যায়, দীর্ঘকাল কোনও নিরাপদ স্থানে রক্ষা করা যায়, অর্থের মতো এটিকে দানও করা যায়। অর্থের মতোই এটি একটি শক্তি এবং এ শক্তিকে নিয়তির সঙ্গে দরাদরিতে আধ্যাত্মিক শক্তিরূপে ব্যবহার করা যায়।
নিয়তি যখন এ জন্মে বা পরবর্তী কোনও জন্মে শাস্তিবিধান করে তখন একটি মাত্র আবেগ তাকে প্রতিহত করতে পারে; ইষ্টদেবতার প্রতি ভক্তি। শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত, সৌর ও গাণপত্য এই পাঁচটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম তিনটিই মুখ্য, এগুলির ভক্তসংখ্যা বেশি। এই সব সাম্প্রদায়িক দেবতাদের আরাধনার দ্বারাও নিয়তির বিধান নাকচ করা যায়। আরাধ্য দেবতার প্রতি অনুগত হলে, ভক্ত তার ভক্তির দ্বারা ইষ্টসাধন করতে পারে বা ভাব ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে দেবতা তার ইষ্টসাধন করেন, যদিও তত্ত্বগত ভাবে ভক্তি ইষ্টসিদ্ধির হেতু ভাগবতপুরাণ, যা ভক্তিমার্গের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, সেখানে কৃষ্ণ বলেন, চণ্ডালও যদি আমার প্রতি ভক্তিমান হয় তা হলে তার সে ভক্তিই পুনর্জন্মের অবসান ঘটাবে; (১১:১৪,২১) অর্থাৎ তার ভক্তিই তাকে পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি দেবে— যা মনুষ্যজন্মের শ্রেষ্ঠ কাম্য, মোক্ষ, তার অধিকারী হবে সে ভক্তির দ্বারা। এই বাক্যটির শব্দবিন্যাস লক্ষণীয়, মোক্ষ কৃষ্ণ দিচ্ছেন না। দিচ্ছে তার ভক্তি। এ ভক্তি তা হলে বিশিষ্ট একটি শক্তি, নিয়তির সঙ্গে যা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।
ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, ‘তাঁর (কৃষ্ণের) প্রতি একান্ত ভক্তিমান হয়ে সর্বতো ভােেব আত্মনিবেদন করলে তাঁর কৃপায় অর্জুন পরম শান্তি এবং সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক লোকে আরোহণ করতে পারবেন।’ (১৮:৬২) কৃষ্ণ একটি স্পষ্ট দ্বিধাহীন আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁর ভক্তকে ‘সব ধর্ম পরিত্যাগ করে একা আমাকেই আশ্রয় কর, আমি তোমাকে সর্ব পাপ থেকে মুক্ত করব; শোক কোরো না।’ মনে পড়ে, বাইবেল-এ যিশুখ্রিস্টও বলেন, ‘আমিই পথ, সত্য ও জীবন, আমাকে বাদ দিয়ে কেউ পিতা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারে না। (যোহন ১৪:৬)
ভক্তি কী? অর্বাচীন গ্রন্থ হরিভক্তিবিলাস এর সংজ্ঞানিরূপণ করেছে ভগবানের সপক্ষে থাকবার সংকল্প, সকল প্রকার হিংসা ত্যাগ, ‘আমি (ভক্তি) রক্ষা করব’ এই বিশ্বাস, ভগবানকে রক্ষক বলে গ্রহণ করা, নিজেকে তাঁর কাজে সমর্পণ করা— এই ছ’টিই হল ভগবানে শরণাগতির লক্ষণ।’ (১১:৪১৭) এর সারসংক্ষেপ হল, ‘ভগবানের প্রতি একান্ত আত্মসমৰ্পণ।’ ভক্তি কর্মের বিকল্প; ‘চান্দ্রায়ণ’ ব্রত পালনে যে পুণ্য তা-ই পাওয়া যায় বেদীতে আরূঢ় কৃষ্ণকে দেখে। (ব্রহ্ম পুরাণ ৩২:৭২) পুরো অধ্যায় জুড়ে ওই জাতীয় বিস্তর সমীকরণ আছে যার মূল কথা হল যজ্ঞের মূল্য হ্রাস করে ভক্তিকে গৌরবান্বিত করা
ভক্তির বহিঃপ্রকাশ কী? ‘গুরু যদি প্রসন্ন হন তো হরি স্বয়ং তুষ্ট হন, আর যে ব্যক্তি ইষ্টদেবতাতে নিমগ্ন হয়, সে নৃত্য করে, দাম্ভিকের মতো চিৎকার করে, হাসে, ঘুরে বেড়ায়, আত্মসচেতনতা সম্পূর্ণ হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়, দূরত্বের সকল বোধ হারিয়ে ফেলে।’ (কল্কিপুরাণ ৩:১১:৩৪, ৪২) ওইখানেই পড়ি: ‘ভক্তি হল অনন্ত প্রকৃতি যা ব্রহ্মসম্পদকে প্রকাশ করে; শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা, বেদের ও অন্য শাস্ত্রের সারাংশ (ভক্তি)।’ (ঐ ৪৪ শ্লোক) ‘যে যোগী ভগবানে নিবেদিতচিত্ত, যে তাঁর নামের স্তব করতে করতে দেহত্যাগ করে, কর্ম ও বাসনা থেকে সে মুক্ত হয়।’ (ভাগবত পু. ১:৯:২৩ )
ভক্তির উদ্ভব হয় কী ভাবে? অধিকাংশ শাস্ত্র বলে, এ হল অহেতুক, সিদ্ধির চেয়ে এর মূল্য অধিক। (ঐ ৩:২৫:৩৩) অন্য এক জায়গায় পড়ি, ভগবানে ভক্তি জন্মায় সৌভাগ্য থেকে। (দেবীভাগবত পু. ৭:৩১:৩) জনমেজয়কে ব্যাস বলছেন, ‘দেবীর প্রতি এই যে তোমার অকৃত্রিম ভক্তি, এ তোমার সৌভাগ্য। চণ্ডালও যদি বিষ্ণুসেবা করে, লক্ষ লক্ষ পূর্বপুরুষ ও উত্তমপুরুষকে সে উদ্ধার করে।’ (৯:২৪) মনে রাখতে হয়, দেবতার সন্নিধানে আসবার পথরূপে ভক্তি যখন প্রাধান্য পেয়েছে তখনও কিন্তু কর্ম ও জ্ঞানমার্গ সমাজে ভগবৎসান্নিধ্যে আসবার স্বীকৃত পথ, যদিও কতকাংশে ভক্তি এ দুটির বিরোধী। কাজেই যারা ভক্তিমার্গকে অস্বীকার করত বা তাকে নিরুদ্ধ করতে প্রয়াসী ছিল এমন লোকও সমাজে ছিল। তাদের কারও কাছে ভক্তিমার্গ হিসাবে যথেষ্ট পর্যাপ্ত নয়। আবার অন্যদের কাছে ধর্মাচরণ ভক্তির দ্বারা সুলভ ও সহজ হয়ে যাচ্ছিল। এরা কর্ম ও জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তিমার্গের তুলনা করে ভক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাইত। বৃহন্নারদীয়পুরাণ-এ পড়ি, ‘যে কর্ম ত্যাগ করে ভক্তিকে আশ্রয় করে বিষ্ণু তার ওপরে তুষ্ট হন না, কারণ বিষ্ণু যথাবিহিত অনুষ্ঠানে পূজাও চান। কাজেই ভক্তের হরিভক্তি তার বর্ণাশ্রম ধর্মবিহিত ধর্মাচরণের বিরুদ্ধে হওয়া উচিত নয়।’ (১৫:৮,১০) অন্য দিকে ভক্তিই একমাত্র পথ এই বোধে সর্ব কর্ম ত্যাগ করার বিকল্প বলে স্বীকার করেছে মার্কণ্ডেয়পুরাণ : ‘যারা ললাটে বিষ্ণুভক্তের চিহ্ন ভস্মত্রিপুণ্ড্রক ধারণ করে তারাই শ্রেষ্ঠ বিষ্ণুভক্ত।’ (১:৫:৬৮) অথবা, ‘যারা কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষের একাদশী ব্রত পালন করে তারাই শ্রেষ্ঠ ভাগবত।’ (১:৫:৭৪) কিংবা ‘গঙ্গার নামেই ইহলোকের সর্বদুঃখ দূর হয়।’ (১:৬:২৬)
ভক্তিবাদ সারা ভারতবর্ষে দুশো বছর প্লাবনের মতো বয়ে গিয়েছিল, ‘নায়ানার’ (বা নায়নমার, শিবভক্ত) আর ‘আলওয়ার’ (বিষ্ণুভক্ত)রা দক্ষিণ ভারতে শৈব এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায় এবং উত্তর ভারতের শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়রা প্রায় সকলেই জ্ঞান ও কর্মের চেয়ে ভক্তিকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন এবং ভক্তিকে জ্ঞান ও কর্মের বিকল্প মনে করতেন। এক অর্থে ওই মনোভাব ভক্তিকেই সুলভ ও লঘু করে তুলল; ভক্তি মানে নামজপ, গঙ্গায় ডুব দিয়ে ওঠা, ললাটে তিলক ধারণ করা, প্রাত্যহিক ভক্তিস্তোত্রপাঠ ও গান, এ সবই দীর্ঘ, শ্রমসাধ্য উপাসনা ও কঠোর জ্ঞানচর্চার বিকল্প হয়ে উঠল। যেন নিয়তির সঙ্গে আপোষ করে শাস্ত্রগুলি তপস্যা ও ধ্যানকে অলৌকিক ক্ষমতায় মণ্ডিত করে বর্ণনা করল, কারণ ব্রত দান, ও তীর্থের তুলনায় তপস্যা উচ্চতর মার্গের আধ্যাত্মিকতা; এর যেন নিজস্ব একটি জ্যোতির্বলয় আছে এবং দেবতা ও অতিলৌকিকের সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে। কাজেই যে সব শক্তি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে তার সঙ্গেও যোগ আছে। সমস্ত শাস্ত্রেই তপস্যার এই মাহাত্ম্য বিশেষ ভাবে বর্ণিত হয়েছে। যারা তপস্যা করে তারা তৎক্ষণাৎ ইহলোক ত্যাগ করে, সম্ভবত, এই কারণে যে, স্রষ্টা সৃষ্টিকর্মের পূর্বে তপস্যা করেছিলেন; অন্য দেবতারাও তপস্যার দ্বারা ইষ্ট লাভ করেছিলেন। ক্ষত্রিয় বিশ্বামিত্র তপস্যা করে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছিলেন, ঋষিরা তপস্যা করে দেবতাদের সান্নিধ্য লাভ করেন। দেবতারা ব্রহ্মের উপরে চিত্ত স্থির করে তপস্যা করেন কোনও কিছু প্রাপ্তির আশায় নয়, কেবলমাত্র মহাবিশ্বের কেন্দ্রগত শক্তিপুঞ্জের সাযুজ্য লাভ করবার জন্যে। যে ধ্যান বা তপস্যা করে সে রূপকের মাধ্যমে দেবতাদের স্বারূপ্য লাভ করে এবং নিয়তি অবশ্যই নমনীয় হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করবে।
তপস্যা যেন বিশ্বজাগতিক মহাশক্তির সঙ্গে সাযুজ্যের পথ করে দেয়, তেমনই জ্ঞানমার্গ কর্মমার্গের দুটি প্রকল্প: তপস্যা ও ভক্তি। ভক্তিমার্গের আবার দুটি দিক, মুখ্য ও গৌণ্য। মুখ্য ভক্তিমার্গের কেন্দ্রে ইষ্টদেবতা, যাঁর কাছে ভক্ত একাগ্র ভাবে আত্মনিবেদন করেন। এই আত্মনিবেদনই তাকে প্রেরণা দেয় পূজা, ধ্যান, নামজপ ইত্যাদিতে। গৌণ ভাবে এই ভক্তিই মানুষকে ব্রত, তীর্থ, মানত করতে প্রবৃত্তি দেয়। কাজেই আচারনিষ্ঠ ক্রিয়া ও মানসভক্তি (ধ্যান, জপ, তপস্যা) দুইয়ের উদ্ভব ভক্তি থেকে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় চতুর্থ শতক থেকে এগুলি সমাজে স্পষ্ট ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং এখনও প্রায় অব্যাহত ভাবেই আছে। দেবশক্তির সমীপবর্তী হওয়ার জন্যে অন্য পন্থাও আছে, যার একটি অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণ হল নিয়তি; জাদু ও তুকতাক এমনই আরও দুটি পন্থা। অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলির মধ্যে জাদু ও বশীকরণও পড়ে। জাদুর সঙ্গে মন্দশক্তির যোগ এবং একটি ব্যক্তির মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়, যে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবে। একে যে নিযুক্ত করে তার ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের স্পষ্ট কোনও দায় থাকেই। তার হয়ে যে জাদুকর অনুষ্ঠানটি করে, তার মাধ্যমে ওই নিয়োগকারী অতিপ্রাকৃতের সান্নিধ্যে আসে। জাদুবিদ্যা, ঝাড়ফুঁক ও ডাকিনীবিদ্যার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। জাদুকর ও ডাকিনী পৃথিবীর অবতলের শক্তিগুলির কাছে সরাসরি পৌঁছতে পারে অথবা ভূতপ্রেতদের হুকুম করতে পারে যারা অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী বলে জাদুকরের নির্দেশে মানুষের ক্ষতি করতে পারে। পুরাকাল থেকে লোকের বিশ্বাস, পৃথিবীর অবতলে নিহিত শক্তিগুলি ঊর্ধলোক বা অন্তরীক্ষের শক্তি থেকে পৃথক এবং এই নিম্নস্থ শক্তি মানুষের ক্ষতিসাধনে সমর্থ।
‘ডাকিনীবিদ্যার উদ্ভব মূলত মানুষের সেই সব ধারণা থেকে যা কিছু কিছু কষ্টের জন্যে দায়ী এবং সাধারণত মন্দ বলে পরিচিত একটি অতিলৌকিক শক্তি। মানুষ একে কতকটা ইচ্ছানুসারে ব্যবহার করতে পারে, অথবা এতে যে কোনও ব্যক্তির সাহচর্য পায়।’ (কার্লটন, ১৯৭২ দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ১০০) জাদুকর, ডাকিনী, শামান, ভবিষ্যদ্বক্তা, মন্ত্রবিৎ, ওঝা ও অলৌকিক ক্রিয়াকুশল— এরা সকলে মিলে একটি ব্যাপক গোষ্ঠী নির্মাণ করেছে যার মধ্যে ক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিস্তর স্তরভেদ আছে। মোটের ওপরে ওঝা ও যারা ঝাড়ফুঁক করে তারা ভবিষ্যদ্বক্তার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে; তেমনই শামান, জাদুকর এবং অলৌকিক ক্রিয়াকুশলী রয়েছে পুরোহিতের বিপরীত মেরুতে; শুধুমাত্র জাদুবিৎ উভয়ত্রই থাকতে পারে। ভারতবর্ষে কখনওই এমন সময় ছিল না যখন ব্যক্তিগত শত্রু, ব্যাধি ও অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্যে প্রার্থনা করা হয়নি…. (পূর্বে) এমন ব্যাধি ছিল যেগুলিকে মানুষের কাছে জাদুকর, প্রেতাত্মা বা দেবতা কিংবা পিশাচরা প্রেরণ করতেন।’ (রোঢ়, ১৯৪৬, পৃ. ৭৮)
অথর্ব বেদের বিষয় এবং কিছু কিছু বিশিষ্ট লক্ষণ মনে পড়ে। যেখানে এমন বহু সূক্ত আছে যার একমাত্র উদ্দেশ্য নিজের শত্রুর বা নারীর সপত্নীর ক্ষতি করা। পীড়াকে দেখা হত পিশাচপ্রেরিত রূপে, এবং ঠিক যেমন কিছু সূক্ত রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হত, তেমনই অন্য আরও কিছু আছে যা শামান, জাদুকর, ডাকিনী, ওঝা বা মন্ত্রবিদের প্রয়োগের জন্যে। এরা পাতাল থেকে কোনও কোনও আত্মাকে আহ্বান করে এবং তাদের বিশেষ বিশেষ কার্য সমাধার জন্যে আদেশ দেয়। জ্বর, কৃমি, শোথ, যক্ষ্মা, তক্ম (ম্যালেরিয়া), হারিদ্র, রক্তস্রাব, কেশপতন ও গর্ভপাতের জন্যে পাতাল থেকে রহস্যময় ভাষায় বিশিষ্ট নামের আত্মাদের আহ্বান করে নির্দিষ্ট কাজের অর্থাৎ আরোগ্যের ভার দেওয়া হয়। এর ইতিহাস বহু প্রাচীন। শামান অতিপ্রাকৃতকে জাদু অনুষ্ঠানের কাজে, ‘সেটাকে বা সেই ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ রূপী শক্তিটিকে মন্ত্রের দ্বারা, অনুষ্ঠানের দ্বারা বা বিশিষ্ট মহিমার সাহায্যে লভ্য করে তোলে। সরলই হোক বা জটিলই হোক, মানুষের ধর্মবুদ্ধি সরাসরি দিব্য প্রকাশকে প্রাথমিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক এবং ধর্মতত্ত্বকে গৌণ জ্ঞান করে। শামানের প্রাথমিক লক্ষ্য দর্শন, দিব্য ‘ভরে’র বা দিব্য উন্মাদনার প্রতি। শামান দিব্য শক্তির দ্বারা অধিকৃত; সে আদিম যুগ থেকে রোগ নিরাময়ের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করে থাকে।’ (প্রেসলার, ১৯৭৬, পৃ. ৮৭) প্রাচীন রাশিয়া, চিন বা মেক্সিকোতে শামানের কৃত্য অনেক সময়ে সূক্ষ্ম ভাবে পৃথক করা হয়েছে, মধ্যযুগের ইউরোপের বা ভারতবর্ষের জাদুকর, ডাকিনী বা ভবিষ্যদ্বকআর কৃত্য থাকে। এখানে বিভিন্ন কর্মকারের কৃত্য অনেক স্পষ্ট ভাবে নির্দিষ্ট করা ছিল এবং প্রায়ই তাদের ওপর দেবতাদের ‘ভর’ও হত না, কারণ তাদের আজ্ঞাবহ দাসদের তারা পাতাল থেকে ডেকে পাঠিয়ে কাজ করে নিত— সে সব কাজ হল প্রতিপক্ষবিনাশ (শত্রু, প্রতিযোগী বা সপত্নী) কিংবা তাদের শারীরিক ক্ষতিসাধন করা কিংবা বিশেষ বিশেষ রোগে আক্রান্ত কিংবা যে বিশেষ আত্মার প্রভাবে ব্যাধি— তা তাড়িয়ে রোগ সারানো অথবা গর্ভস্থ ভ্রূণের খাদক রাক্ষসীদের আত্মাদের প্রতিহত করে ভ্রূণটিকে রক্ষা করা। এ সব আত্মা পাতালে ও অন্তরীক্ষে বিচরণ করে থাকে। প্রতিরোধী পক্ষের দৃষ্টিতে এই জাদু ‘কৃষ্ণ’, যে প্রয়োগ করে তার দৃষ্টিতে কিন্তু এটি ‘শুভ্র’ই। কিন্তু যদি উপায়ের কথা চিন্তা করি— একটি মন্দ আত্মাকে তাড়াবার চেষ্টাই ‘কৃষ্ণ’ কৃত্যা। কিন্তু দু-দিক থেকেই জাদুকরের প্রয়াস হল নিয়তিকে প্রতিহত করা। শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী, সপত্নী, ব্যাধি, বন্ধ্যাত্ব, গর্ভপাত সম্ভাবনা— এ সবই কিছু কিছু মানুষের নিয়তিনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা। জাদুকরের কাজ এগুলিকে রোধ করা বা প্রতিকার করা। আরব মতে অবশ্য জাদুকররা নিয়তি থেকে রক্ষা করতে পারে না।’ (রিংগার্ন, ১৯৫৫, পৃ. ৫১) আরব ধর্মতত্ত্ব নিয়তিকে স্বীকার করতে পারে না, কিন্তু সে দেশের প্রাচীন সাহিত্যে এবং অন্যত্রও বিরুদ্ধ দৈবের আক্রমণ ঠেকাবার জন্যেই জাদুর আশ্রয় নেওয়া হত।
বৌদ্ধসাহিত্যে জাদুকর ও ডাকিনীরা বেশ স্পষ্ট ভাবে প্রত্যক্ষ। ‘মহাবগ্নে’ বুদ্ধ তাঁর অলৌকিক শক্তি প্রদর্শনের জন্যে নানা অলৌকিক কর্ম করেন (১:১৫-২১); একটি সুদীর্ঘ বিবরণ আছে যেখানে, তাঁর সম্বন্ধে সন্দিহান লোকদের বিশ্বাস উৎপাদন করবার জন্য এবং তাঁর সমকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিরুদ্ধ মতবাদ খণ্ডন করে তাঁর মতের অবিসাংবাদিত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করবার জন্য বুদ্ধ একের পর এক অলৌকিক কর্ম সাধন করেন।
মহাবগ্গে আমরা শুনি একটি জাদু রাসায়নিক পদার্থের কথা, যার প্রয়োগে মানুষকে স্ববশে আনা যায়। সেখানে আছে, ‘সে জাদুবিদ্যার দ্বারা আচ্ছন্নবুদ্ধি হয়েছিল, ডাকিনীবিদ্যার প্রয়োগের ফলে কষ্ট পাচ্ছিল।’ (ওই ৬:১৪) বুদ্ধ অলৌকিক শক্তির দ্বারা রোগ সারান, এমন কথাও আছে (ওই ৬:২৩:৭) এবং একটি শূন্য শস্যাভাণ্ডারকে শুধুমাত্র ইচ্ছা প্রয়োগের দ্বারা শস্যপূর্ণ করেছিলেন, (ওই ৬:৩৪:১)। পালি জাতক থেকে কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। ‘বেদবভ’ নামে একটি মন্ত্রের কথা শুনি যা হাতে নিয়ে বিশেষ বিশেষ গ্রহনক্ষত্রের সমাবেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলে আকাশ থেকে সোনা, রূপো, মুক্তো, পলা, বৈদুর্য, চুনি ও হীরে ঝরে পড়ত। (জাতক সংখ্যা ৪৮, ‘বেদবভ’) এ মন্ত্র এক দরিদ্রকে দেওয়া হয় তাকে ধনবান করার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ তার নিয়তি নির্দিষ্ট দারিদ্র ঘোচাবার জন্য। আর একটি কাহিনিতে বুদ্ধের প্রতিপক্ষ তাঁর সম্বন্ধে প্রতিস্পর্ধা দেখালে তিনি তক্ষশিলায় গিয়ে এক রাত্রে বেদ ও হস্তিবিদ্যা শিখে ফিরে আপন অধীত বিদ্যা প্ৰদৰ্শন করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করেন। (১৬৩ সংখ্যক, সুসীম) এক ধনীর পুত্র হয়ে জন্মে বুদ্ধ তক্ষশিলায় গিয়ে বিদ্যাশিক্ষা করেন; সেখানে তাঁর পাঠ্যতালিকায় জাদুবিদ্যাও ছিল। (১৮৫ সংখ্যক, অনভিরতি) আবার শুনি, এক বন্য বরাহ জাদু-মণি কুড়িয়ে পায়। (১৮৬ সংখ্যক); দধিবাহনকে রাজা ধৰ্ম্মধ্বজের সামনে অসাধ্য কিছু করণীয় স্থাপন করতে পারবে এ কথা বলা হলে, পরে তিনি জাদুবলে তা স্থাপন করেন। (২২০ সংখ্যক, ধৰ্ম্মধ্বজ)। এতে গ্রিক পুরাণের হেরাক্লেসের কাহিনির কিছু সাদৃশ্য আছে। একটি ঘোড়ার জন্য বুদ্ধ অনেক অলৌকিক কর্ম করেন। (২৫৪ কুণ্ডককুচ্ছিসিন্ধব) রাজা মান্ধাতাও নাকি তার অতিপ্রাকৃত শক্তি প্রকাশ করেছিলেন। (২৫৮ মান্ধাতা) বারাণসীরাজকে তার মন্ত্রীরা প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাদের ওপরে প্রভুত্ব বিস্তার করবার জন্যে অতিশয় গর্হিত ও নিষ্ঠুর জাদুপ্রক্রিয়ায় প্ররোচনা দেন। (৩৫৩ ধোনশাখ) উদয় তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন, তিনি যোগবলে ভূমি থেকে উত্থিত হয়ে শূন্যে বসে থাকতে পারতেন। (৪২১, গঙ্গামাল) এটা যোগের একটা সিদ্ধি বা বিভূতি, যাকে যোগসূত্রে (৩য় অধ্যায়) খুব বেশি মর্যাদা দেওয়া হয় না। বুদ্ধ ও কোনও কোনও বোধিসত্ত্ব অনেকবার ওই সিদ্ধি প্রকাশ করেছেন। কয়েকজন বণিকের জাহাজ এক মন্দ আত্মা ডুবিয়ে দিতে উধ্যত হলে একটি পুণ্য আত্মা নাবিকদের সতর্ক করে দেন; নাবিকরা তাঁর কথা শুনে আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার পান। (৪৬৬, সমুদ্দবণিজ্জ) অন্যান্য জাদুকাহিনির সঙ্গে এগুলির প্রভেদ হল মানুষ-জাদুকরের অনুপস্থিতি; এ কাহিনিগুলিতে শুভ ও অশুভ শক্তি সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রবৃত্ত। এমনই একটি অলৌকিক ঘটনা আছে; এক কিন্নরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীর বিলাপ শুনে দুঃখিত হয়ে ইন্দ্র এসে কিন্নরকে উজ্জীবিত করেন। (৪৮৫, চন্দ্রকিন্নরক) এখানেও নিয়তির বিধান প্রতিহত হল এক দেবতার সহৃদয় হস্তক্ষেপে, কোনও মানুষ জাদুকর নেই।
এক বটবৃক্ষের অধিষ্ঠাতা দেবতার আরাধনা করে এক বন্ধ্যা নারী সাতটি সন্তান লাভ করে। (৫০৯, হখিপাল) বৃক্ষলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বহু আদিম অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস এখানে রূপায়িত; ওই উদ্ভিদজগতের অতিলৌকিক শক্তি মানুষের মধ্যস্থতা ছাড়াই কার্যকরী হয়। বারাণসীরাজের প্রথম দুই পুত্রকে এক পিশাচ খেয়ে ফেলে; তৃতীয় পুত্র (বুদ্ধ)-কে লোহার খাঁচায় রাখা হয়, ক্রমে ক্রমে পিশাচটির মৃত্যু হয় ও বুদ্ধ বেঁচে যান। (৫১০, আয়োঘর) বহু উপাখ্যানে প্রেতাত্মা বিশেষ ভাবে উপস্থিত। একটি ঈর্ষাপরায়ণ নিঃসন্তান মহিষী রাক্ষসী হয়ে যায় এবং সপত্নীর সন্তানদের জন্মমাত্রই খেয়ে ফেলে। তৃতীয়টিকে খেতে উদ্যত হতেই শিশুটি ভুল করে তাকে মা ভেবে স্তন্যপানে প্রবৃত্ত হয়। এতে সপত্নীটির চিত্ত করুণার্দ্র হয় ও সে শিশুটিকে জননীর মতো পালন করে। সে পুত্রকে একটি জাদুমন্ত্র দেয় যার বলে সে ইচ্ছে করলে অদৃশ্য হতে পারত। (৫১৩, জয়ন্দিস)
এখানেও ভাল ও মন্দের মধ্যে একটি প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু কাহিনির শুরুতেই নিয়তির একটা খামখেয়ালি আচরণ আছে, শিশুটির ভ্রম, রাক্ষসীকে মা বলে ভাবা, তাতেই তার আপাত-অনিবার্য মৃত্যু স্থগিত হয়। সে পরে রাক্ষস হয়ে যায় এবং যখন রাজা জয়দ্দিসকে খেতে যায় তখন রাজা বলেন একটা ঋণ শোধ করেই চলে আসবেন; আসেনও, এবং এই সত্যরক্ষায় রাসক্ষটি এত অভিভূত হয় যে তার চরিত্র পরিবর্তিত হয়। ভালমন্দের শেষ দ্বন্দ্বে ভাল’র জয় হয় কারণ রাজপুত্রের রাক্ষস হওয়ার কথা ছিল না, সে যখন রাজার সত্যনিষ্ঠা এবং আত্মত্যাগ দেখল তখন তার চিত্তে পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ তাকে রাক্ষসে পরিণত হতে দিয়ে নিয়তি যে ভুল করেছিল তারই প্রতিবিধান ঘটল। মানুষ জাদুকরের অভাব এখানে রাক্ষস-রাক্ষসী দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। আর একটি জাতকে এক ব্যক্তির রক্ষাদূত তার প্রাণ বাঁচিয়ে দেয়। (৫৪০, সাম) একটি অদ্ভুত কাহিনিতে বুদ্ধ ঋষিরূপ পরিগ্রহ করেন, সক্ক, কয়েকজন দেবতা, পিশাচ ও কিছু মন্দ আত্মাও ঋষিরূপ গ্রহণ করেন। (৫৪৪, মহানারদকসসপ
এই রূপপরিবর্তন নেহাৎই জাদুবিদ্যার প্রকাশ, এখানে জাদুকরের কোনও ভূমিকাই নেই। মহোষধের অন্য এক ধরনের অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, যার বলে তিনি রাতারাতি গাছপালার বৃদ্ধি ঘটাতে পারতেন, রাজাকে তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে বিজ্ঞব্যক্তিদের জাদুবিদ্যা শেখা উচিত।’ (৫৪৬ মহাউন্মগ্গ) অতএব জাদুবিদ্যা অন্যান্য শিক্ষণীয় বিদ্যার তালিকায় স্থান পেয়েছিল। এ-দিক থেকে দেখলে মানুষ-জাদুকরের ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়, কারণ জাদুবিদ্যা পাঠ্যতলিকার অন্তর্গত ছিল এবং প্রকাশ্যে প্রয়োগ করা যেত। রাজপুত্র বেসসন্তরের হাতিটির সাহায্যে বৃষ্টিপাত ঘটানো যেত, কারণ হাতিটি ছিল সুলক্ষণযুক্ত। (৫৪৭, বেসসন্তর) এখানে হাতিটিকে অলৌকিক শক্তি আরোপ করা হয়েছে। জাদুশক্তির কথা বৌদ্ধ সাহিত্যে প্রচুর এবং অনেক ক্ষেত্রেই জাদুকরের কাজই করে রাক্ষস, পিশাচ ও মন্দ বা পুণ্য আত্মা, কাজেই মানুষ জাদুকর স্বভাবতই সেখানে স্বরূপে অনুপস্থিত।
বাইবেল-এর একটি জাদুক্রিয়ার কথাও প্রাসঙ্গিক। রাজা দানিয়েল এন-ডর এর ডাইনির কাছে গেলে সে স্যামুয়েলের আত্মাকে জাদুবলে এনে উপস্থিত করে; স্যামুয়েল দানিয়েলের ভবিষ্যৎ বলে দেন। (১ স্যামুয়েল ২৮:৮-২৫) শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ নাটকেও তিনটি ডাইনিকে এই ভূমিকায় দেখানো হয়েছে। বহু পরবর্তী কালে ফ্লরেন্টাইন কোডেক্স-এ দেখি ‘জাদুকর বিজ্ঞ ব্যক্তি, পরামর্শদাতা, বিশ্বাসযোগ্য, গাম্ভীর্যপূর্ণ, ভক্তিভাজন, সম্ভ্রম-উদ্রেককারী, অনিন্দিত, তাঁকে অমান্য করা যায় না… তিনি নারীদের বশ করেন… উদ্ভ্রান্ত করেন… প্রলুব্ধ করেন, তাদের অধিকৃত বা বশুবৃত হতে দেন। তিনি মানুষকে প্রতারণা করেন, বিভ্রান্ত করেন।’ (১০ খণ্ড, ৯) স্পষ্টতই এখানে জাদুকরের চরিত্র ও ভূমিকার মধ্যে একটা বিরোধ আছে। এটি অন্তর্হিত হয়, যদি আমরা স্মরণে রাখি যে, জাদুকরের, (১) দিব্যশক্তির সঙ্গে সরাসরি যোগ ছিল, এবং (২) তাঁর কর্মকাণ্ড বৃহৎ গোষ্ঠীজীবনের মঙ্গলের জন্যে, যা অদীক্ষিত সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হবে না, বরং কখনও কখনও মন্দ বলেই প্রতীত হবে; যদিও অন্তিম বিচারে তা সমাজের মঙ্গলই করে।
অথর্ব বেদের কাল থেকেই বহু প্রকারের জাদুবিদ্যার কথা পড়ি: মারণ, স্তম্ভন, উচাটন, বশীকরণ এবং শান্তি। প্রথম চারটি বিদ্বেষ-প্রসূত এবং কতকটা ডাকিনীবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত। জাদুকর বা ডাকিনী মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে যা ব্যবহার করে তা হল কবচ-তাবিজ, ধাতুপত্র, লেখ, প্রতীক, অঙ্কন, চিত্রণ, মূর্তি, ভাস্কর্য, যন্ত্রপাতি, ভেষজ, কুশপুত্তলিকা, স্বর্ণকরণ ও জ্যোতিষ। বৃক্ষ ও জাদুক্রিয়ায় জাদুকরের উপকরণ ও প্রক্রিয়ার অনেকটাই প্রতীকী অনুকরণ; লভ্য ফলের পূর্বাভাসসূচক। জাদুক্রিয়ায় প্রযুক্ত চিত্র, প্রতীক, কুশপুত্তলিকা হল মূল শত্রু— যার উদ্দেশ্যে জাদুক্রিয়া— তারই প্রতিরূপ। অন্তর্নিহিত বিশ্বাসটি হল কতক দূর পর্যন্ত অভীষ্ট ফলটির অনুকরণের দ্বারা প্রকৃতি বা নিয়তির বিধান এড়াবার চেষ্টা, যাতে, যার হিতসাধনের জন্যে জাদুক্রিয়া, নিয়তির অবধারিত বিরুদ্ধ গতিকে বাঁকিয়ে তারই অনুকূলে আনতে পারে জাদুকর।
সমস্ত অতিকথাতেই অতিপ্রাকৃত পশুপাখির কথা শোনা যায়:
বশিষ্ঠ-র কামধেনু ইচ্ছাপূরণ করত (রামায়ণ ১:৫২:৭০, ১১৭), যেমন করত স্বর্গের কল্পদ্রুম। অন্য অতিপ্রাকৃত বস্তুর মধ্যে পুষ্পক রথ, দিগগজ, পক্ষিরাজ ঘোড়া, ইত্যাদি আছে। রাম-লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্র দিব্য অস্ত্র ও ক্ষুধাতৃষ্ণা-নিবারক ‘বলা’ ও ‘অতিবলা’ বিদ্যা দান করেছিলেন (১:২৭:৪-২০; ১:২২) শরভঙ্গ ঋষি অগ্নিপ্রবেশ করে দেহত্যাগ করে স্বর্গে যান। (২:৫:৩৯-৪২) রাম পাদস্পর্শে অহল্যাকে সঞ্জীবিত করেন; (১:৪৯:১৯) রাক্ষসদের নানা প্রকারের অস্ত্রশস্ত্র তিনি শুধুমাত্র ধনুর্বানের দ্বারাই প্রতিহত করেন। (৩:২০:১৭) মারীচ স্বর্ণমৃগের রূপ ধারণ করে। (৩:৪২-৪৩) ব্রাহ্মণের হাতে মৃত্যু হলে কবন্ধ স্বর্গে যায়। (৩:৬৯,৭০) শরবী দেহত্যাগ করে দিব্যরূপে স্বর্গে যান। (৩:৭৪) হনুমান লাফ দিয়ে সমুদ্র পার হন, সিংহিকা ও সুরসা রাক্ষসীকে বধ করেন। (৬:১৯:২) রাবণ জাদুবিদ্যার দ্বারা রামের ছিন্নমুণ্ড সীতাকে দেখান। (৬:৩০) রামলক্ষ্মণ নাগপাশে রুদ্ধ হলে গরুড় এসে তাঁদের মুক্ত করেন। (৬:৫০:৩৬-৪৮) চূড়ান্ত জয়ের জন্যে অগস্ত্য রামকে ‘আদিত্যহৃদয়’ মন্ত্র শেখান। (৬:১০৫)
এ সব ছাড়াও রামায়ণে বিস্তর জাদুমন্ত্রের স্বতন্ত্র অলৌকিক ঘটনার বিবরণ আছে। এগুলি বস্তুত লোককথার উপাদান, বিস্মরকর অতিলৌকিকের ব্যবহার। মহাভারত-এর কলেবর রামায়ণ-এর চতুর্গুণ, ফলে অতিলৌকিক ঘটনার সংখ্যাও বেশি।
ঋষি মঙ্কণক এমনই তপস্যা করেন যে, তাঁর দেহ থেকে শাকরস নির্গত হচ্ছিল; শিব তাঁর সে গর্ব চূর্ণ করেন নিজের দেহ থেকে ভস্ম নির্গত হচ্ছে দেখিয়ে। (মহাভারত ৩:৮১:৯৭-১০৭) অগস্ত্য সমুদ্র শোষণ করেন। (৩:১০১:৭-১০২; ১-২৩) বিন্ধ্যপর্বত শির নত করে অগস্ত্যকে পথ করে দেয়। (ঐ ৩:১১০:১১-১৭) রাজা সোমক পুত্র ‘জন্তু’কে যজ্ঞে হনন করে শতপুত্র লাভ করেন। (৩:১২৭-২৪) কুন্তী সূর্যের পুত্ররূপে কর্ণকে জন্ম দেন। (৫:১৪৪:১-৩) শিখণ্ডি নারী থেকে পুরুষ হন। (৫:১৪৪:১-৩)
আরও অনেক অলৌকিক কাহিনি মহাভারত জুড়ে আছে। এর পরিশিষ্ট হরিবংশ, সেখানেও বেশ কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনার সমাবেশ আছে।
কৃষ্ণ শকটাসুর ও পুতনাকে বধ করেন, যমলার্জুনকে ধ্বংস করেন। (বিষ্ণুপর্ব ৬:১-২১; ২২-৩৯; ৭:১৩-২২) কৃষ্ণের দেহ থেকে নেকড়ে বাঘ নির্গত হয় গাভীদের সন্ত্রস্ত করে। (৯:১-৩৫) কৃষ্ণ কালিয়নাগকে দমন করেন, (১২ অধ্যায়), ধেনুককে বধ করেন বলরাম, (১৩ অধ্যায়) তিনি প্রলম্বাসুরকেও বধ করেন। (১৪ অধ্যায়) ইন্দ্র প্রবল ধারা বর্ষণ করেন, কৃষ্ণ গিরিগোবর্ধনকে বাহুবলে উত্তোলন করেন। (১৭,১৮ অধ্যায়) অরিষ্ট অসুরকে বধ করেন। (২১ অধ্যায়) কৃষ্ণ শিশুকালেরই পুতনা রাক্ষসীর প্রাণনাশ করেন। (২২ অধ্যায়) কেশী অসুর ও মল্লযোদ্ধা চাণুর, মুষ্টিক এবং হাতি কুবলয়াপীড়কে পরাস্ত ও বধ করেন (২৮-২৯ অধ্যায়)।
এই ধরনের অলৌকিক শক্তির প্রকাশ সব ধর্মগ্রন্থেই আছে। বুদ্ধ ও যিশু দু’জনেই জলের ওপর দিয়ে হাঁটেন, যৎসামান্য খাদ্যে বহু লোককে ভোজনে তৃপ্ত করেন। ‘জাদু, ডাকিনীবিদ্যা ও ওঝাদের তুকতাক এ সব ঐতিহ্যবাহিত সংস্কৃতিতে দৃঢ়মূল, এ দিয়ে সংস্কৃতি মহাবিশ্বকে ভাগ করে ও নিয়ন্ত্রণ করে তাদের চারপাশে। এর দ্বারা শুধু যে তারা সংস্কৃতির, চিন্তার ও ভাষার সব অংশের সঙ্গে বিজড়িত হয় তা-ই নয়, কিন্তু যে পৃথিবীতে মানুষ বাস করে তাকে সুসংহত ও সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে প্রভাবিতও করতে পারে।’ (ইন্টারন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব সোস্যাল সায়েন্সেস, ইয়ালমান, ‘ম্যাজিক’ ১৯৬৮, পৃ. ৫২৭)
জাদু ডাকিনীবিদ্যা ও তুকতাক সারা পৃথিবীতেই আছে এবং চিরকালই আছে; প্ৰকৃতি ও নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য এগুলিকে মানুষ বিশেষ ভাবে ব্যবহার করে আসছে। বৈদিক ও বেদোত্তর সাহিত্যে ‘অভিচার’ শব্দটির অর্থ হল কোনও ব্যক্তি শত্রুর ক্ষতি করার জন্য জাদুকর যে জাদুক্রিয়া সম্পাদন করে তা-ই। পরে এর অর্থ সম্প্রসারণের ফলে মন্দ করার এবং মন্দ শক্তি সৃষ্টি করাও ‘অভিচার’ শব্দের অন্তর্গত হয়।
দুর্যোধন যখন দুর্বিপাকে পড়ে পাণ্ডবদের সাহায্যে উদ্ধার পায় ও শোকাকুল চিত্তে প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করার সংকল্প করে, তখন ‘কৃত্যা’ (মন্দ জাদুশক্তি) এসে বলে- দুর্যোধনের শরীরের নিম্নার্ধ অসুররা কৃত্যার দ্বারা নির্মাণ করেছিল। (মহাভারত ৩:২৩৯:২২) রৈভ্য এক কৃত্যার সাহায্যে যবক্রীতকে বধ করে। (ঐ ৩:১২৪:৩৯) বৃষাদর্ভি আসুরিক শক্তির দ্বারা এক যাতুধানীকে সৃষ্টি করে তাকে সপ্তর্ষিকে বধ করতে পাঠায়। (ঐ ১৩:৯৪:৪০)
যখন দেবতারা ও ঋষিরা কোনও অলৌকিক মন্দ শক্তি সৃষ্টি করেন তখন তাঁরা কোনও অন্যায়কে দমন করবার জন্যে বা ন্যায়সংগত প্রতিশোধের জন্যেই তা করেন। অর্থাৎ তাদের এই কাজে বিশ্বসৃষ্টির ভারসাম্য বজায় থাকে, ফলে তাদের ক্ষেত্রে এটি জাদুক্রিয়া বলে অভিহিত হয় না। সেই রকম দেবতারা যখন কোনও অতিলৌকিক ক্রিয়া করেন তখন সন্দিহান ব্যক্তির বিশ্বাস উৎপাদন করবার জন্য বা কোনও ব্যক্তিকে অসাধু পথ অবলম্বন করা থেকে নিবৃত্ত করবার উদ্দেশ্যেই তা করেন; সাধারণ ভাবে তাঁদের দিব্যত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এই ধরনের কাজের মধ্যে।
বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে জাদু ও ‘অলৌকিক ক্রিয়া’’অভিচার’ও ‘কৃত্যা’সম্বন্ধে তিনটি পুরো অধ্যায় আছে; এগুলির দ্বারা নাকি নানা রকম ব্যাধি সৃষ্টি করা যায়। (২৮, ৩১, ৩২ অধ্যায়) এ গ্রন্থে পরবর্তী একটি অধ্যায়ে বুদ্ধকে স্পষ্টতই ‘মহামোহ’ বলা হয়েছে, পরবর্তী বেদান্ত দর্শনে ‘মহামোহই পরম শত্রু। এখানে মহামোহের জন্ম হয়েছে অসুর ষণ্ড এবং মর্কের দেবতা নিধনের অভিপ্রায়ে অনুষ্ঠিত কৃত্যা থেকে। বুদ্ধভক্তদের নিন্দা করা হয়েছে পদে পদে। (৬৬ অধ্যায়) বোঝাই যায়, এই অর্বাচীন পুরাণটিতে এ কাহিনির ভিত্তি হল মহাভারতে কৃত্যাদের দ্বারা দুর্যোধনের অর্ধশরীর নির্মাণের বিবরণ। একাদশ শতকের নাটক প্রবোধচন্দ্রোদয়-তে বিষ্ণুভক্তির উৎকর্ষ প্রকাশের চেষ্টাই মুখ্য উপজীব্য; সেখানেও প্রতিনায়ক হল মহামোহ, অসুরদের জাদুবিদ্যার দ্বারা মন্দ শক্তি বা ব্যক্তির সৃষ্টি, (কখনও বা দেবতারাও অশুভনাশের জন্যে এই ধরনের কাজ করেন)— এটি দেড় হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের অতিকথার একটি স্বীকৃত উপজীব্য। জাদুবিদ্যা বহুল-প্রচলিত একটি অনুষ্ঠান ছিল, অনুষ্ঠাতা (যজমান) তার বিরুদ্ধ নিয়তি বা দৈবের মোড় ঘুরিয়ে তার সম্পর্কে প্রতিকূল ঘটনাবলিকে অনুকূল করে তোলার জন্য জাদুকরের সাহায্যে এর আশ্রয় নিত। যা কিছু তার মঙ্গল বা অভীষ্টের প্রতিবন্ধক, তাকে নিজের সপক্ষে নিয়ে আসবার জন্যে প্রকৃতি বা নিয়তিকে বাধ্য করাই এর উদ্দেশ্য। পোপেল হুহ গ্রন্থে দেবতাদের প্রথম ও দ্বিতীয় সৃষ্টি ব্যর্থ হয়, তখন তাঁরা জাদুকরদের বলেন, ‘তোমরা শস্যকণা দিয়ে দান ফেল।’ (রাশিনোস ও মর্লে সম্পাদিত ১৯৪৭, পৃ. ৮৭) সৃষ্টির এটি একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিবরণ। এতে শুনি দেবতাদের দুটি ব্যর্থ প্রয়াসের কথা: তোমরা দু’বার চেষ্টা করেও সৃষ্টি করতে পারলে না, কাজেই সৃষ্টি দিব্য বা দেবতাদের কৃতি নয়। ওই দেবতারাই তখন জাদুকরদের ডেকে সৃষ্টির ভার দিলেন। তাঁরা শস্যকণা নিয়ে জাদু প্রক্রিয়ার সঙ্গে উচ্চারণ করলেন, ‘নিয়তি, প্রাণী, সৃষ্টি’। প্রথম যা সৃষ্টি করা হল তা হল ‘নিয়তি’, তার পর জীবজগৎ, তার পর সম্ভবত বড় জগৎ। এই জাদুকর কারা? এক বৃদ্ধা ও এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধার কথাই প্রথম এসেছে, তার পর বৃদ্ধ— খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই যুগল; জাদুকর-জাদুকরীর যুগ্ম সত্তা। আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে, পোপেল হুহ এই যুগলকে বিশ্বস্রষ্টার স্থানে দেখেছে। এরা অতিলৌকিক তেজ-সমন্বিত বাক্-এর দ্বারা সৃষ্টি করেছে। এখানে শস্যকণা (জীবের প্রাণধারণের প্রাথমিক উপাদান) ও ব্রহ্ম (অলৌকিক শক্তিযুক্ত বাক্-এর উপনিষদীয় নাম) দুটি মিলে সৃষ্টি করে। পরবর্তী কালের জাদুকরেরা কিছু কিছু বস্তুগত উপকরণ ব্যবহার করে কিন্তু সভ্যতার শক্তিশালী উপাদান হল ওই শব্দব্রহ্ম, যে মন্ত্র বা শব্দ তারা জাদু প্রক্রিয়ায় উচ্চারণ করে। আর একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হল, দেবতারা এই যুগলকে ‘দান’ ফেলতে (লটারির বা পাশা খেলার মতো) বলেন। এই দানই তো দৈব, এবং দৈবই চূড়ান্ত স্রষ্টা, দেবতারা তার কাছে ব্যর্থ, পরাস্ত সৃষ্টি-প্রয়াসী মাত্র, বিশেষত এই জাদুকর যুগলের কাছে এবং তাদের প্রথমতম সৃষ্টি ‘দৈবের কাছে। সব অতিকথা এমন স্পষ্টভাষী নয়। প্রাচীন বীরকাহিনিগুলিতেও দেবতারা কোনও কোনও পক্ষ অবলম্বন করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যার দ্বারা যুদ্ধের পরিণতি নিরূপিত হয়, নায়কের জীবনমৃত্যু নিরূপিত হয় তা হল ‘নিয়তি’ বা ‘দৈব’। এখানে জাদুক্রিয়া একক ভাবেই সৃষ্টিশীল, অনুষ্ঠানটি আদিম, অনুষ্ঠাতারাও আদিম, অর্থাৎ যুগল জাদুকর, যারা অতিকথা ও জাদুপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে শব্দব্রহ্মের দ্বারা সৃষ্টি করে। সৃষ্টির তালিকায় প্রথম নাম নিয়তির, কাজেই পরবর্তী কালের জাদুর প্রয়োগও দৈবের সঙ্গে আত্যন্তিক ভাবে সম্পৃক্ত, যা দিয়ে দৈবকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জাদুকরের জগৎটাই হল দৈব-কেন্দ্রিক, তারই সঙ্গে আছে জীবজগৎ ও জড়জগৎ। এই হল জাদুক্রিয়ার আদিকল্প, পরবর্তী প্রত্যেক জাদু অনুষ্ঠানই ছোট কোনও কিছুর সৃষ্টি বা উদ্ভাবন সম্পর্কিত, অথবা দৈব এবং জীব ও জড় প্রকৃতির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সৃষ্টিশীল শক্তি।
‘আদিম মানব তার অভিলষিত বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েও তার দুর্লভতায় ব্যর্থকাম হয়ে, স্বভাবপ্রণোদিত ভাবে অভীষ্ট ব্যাপারটার অনুকারী প্রক্রিয়ার অনুষ্ঠান করে। তবে এতে তাকে অভিলষিত বস্তুর একটি বিকল্প ব্যবহার করতে হয়। এ অভিজ্ঞতার ফলেই উপমান-সূচক প্রক্রিয়াতে বিশ্বাস জন্মায়, যাকে আমরা জাদু বলি।’ (গাৰ্নে, ১৯৫৪, পৃ. ১৬০) পোপেল হুহ বর্ণিত অনুকারী কল্পে সৃষ্টি যে প্রকৃতপক্ষে একটি পরিচিত প্রক্রিয়াতেই অতিকথার আদিমতম কাল-পর্যায়ে স্থাপন করে— তার ব্যাখ্যা মেলে এখানেই।
নিয়তির সঙ্গে বোঝাপড়া বা আপোষের অন্য প্রণালীগুলির মতোই জাদু বা অলৌকিক ও অন্ধ, অসহায় মানুষের অতিলৌকিক সেই শক্তির উৎসে পৌঁছবার চেষ্টা হিসেবে গণ্য, যাকে সে নিজের স্বার্থের অনুকূলে ঘুরিয়ে আনতে চায়। শামান, ভবিষ্যদ্বক্তা, জাদুকর সম্বন্ধে যতই সম্ভ্রম ও প্রত্যাশাজনিত নম্রতার মনোভাব প্রার্থীর থাকুক না কেন, সমাজ কিন্তু এই জাদুকর ডাকিনীদের সম্বন্ধে এক ধরনের তাচ্ছিল্য পোষণ করে এসেছে; সমাজ মুখ্যত এদের পরিচর্যা কামনা করেনি, এদের ব্যবহার করেছে মাত্র, যদিও এরা সমাজের দৃষ্টিতে অবিমিশ্র মন্দ ব্যক্তিত্ব বলে প্রতিভাত, কারণ এরা সমাজজীবনে মৃত্যু, ব্যাধি ও বিপদ ডেকে আনে। এতেই ব্যাখ্যা মেলে ডাকিনী নির্যাতনের সামাজিক ইতিহাসের, যে নির্যাতন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শেষ হয় মৃত্যুতে। এই মনোভাব ভারতবর্ষে ও অন্যত্র এখনও বিদ্যমান। এই ভিত্তিহীন তাড়না ও নির্যাতন থেকেই এসেছে পাশ্চাত্য জগতে ডাকিনীদের ঝাঁটায় চড়ে উড়ে বেড়ানো ও বিশেষ বিশেষ তিথিতে নৈশ সমাবেশের কল্পকথা। সেই সব ‘ডাকিনী’ নামের নারীরাও নিজেদের এই আখ্যা দিয়েছিলেন, হয়তো স্বেচ্ছাকৃত কলঙ্কচিহ্ন রূপে। এ যেন সমাজের একটা ক্ষতিকর কালিমাপ্রলেপ, যা আসলে তাদের একটা স্বতন্ত্র সত্তার পরিচায়ক মাত্র। তারা নিয়তি ও অতিলৌকিকের সঙ্গে একটা সরাসরি সংলাপের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছে, পুরুষপ্রধান সমাজের মনোভাব ছিল এই যে, এ ধরনের পাতালকেন্দ্রিক সংলাপকে পুরোপুরি মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই ধর্মের সংবিধান। তাতেই সামাজিক স্বাস্থ্য রক্ষা পাবে। এই কারণে পৃথিবীর সবর্ত্রই ডাকিনীর লাঞ্ছনা, তার মন্দকারিতা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বে, এবং অন্য দুই বিশ্বেও গোপন ভাবে, নারীলাঞ্ছনার এই একটি বিশেষ প্ৰকাশ।