দৈব ও আত্মশক্তি
পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার মতোই ভারতবর্ষে শ্রমজীবীদের জীবন খুব কঠিন ও তিক্ত ছিল। পশুচারী যাযাবর আর্যরা এল পশুপালন নিয়ে। তারা দুধ ও মাংস পেত পশুপালের কাছ থেকে, জঙ্গল থেকে ফলমূল, আর কিছু খাদ্য সংগ্রহ হত শিকার করে। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর তাদের ওপরে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রথমে ভিন্ন জীবনধারার সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে, পরে ধীরে ধীরে অন্তর্বিবাহ ও জাতিগত সংমিশ্রণে যে মিশ্র জাতির উদ্ভব ঘটে তাতে প্রাগার্য ও আর্য জীবনধারা একটি মিলিত ও সংহত আকার ধারণ করে। এদের জীবনবোধ কি ছিল? প্রাগার্যদের দিক থেকে লিখিত বা আস্য কোনও সাহিত্য পৌঁছয়নি। আমাদের জ্ঞানের মুখ্য আকর হল প্রথমে আস্য পরে লিখিত ঋগ্বেদ-সংহিতা। ক্রমে সমাজে যে পরিবর্তন এসে পৌঁছেছিল তার দলিল আছে যজুর্বেদ-এ, ব্রাহ্মণগুলিতে এবং অথর্ব সংহিতা-য়, সর্বশেষে উপনিষদ ও বৌদ্ধ সাহিত্য ও মহাকাব্য পুরাণগুলিতে। বেদের আভ্যন্তরীণ এই পরিবর্তন কতকাংশে নিশ্চয়ই সংঘটিত হয়েছিল অন্তর্বিবাহ এবং দুটি জনগোষ্ঠী পাশাপাশি বাস করার ফলে অনিবার্য সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে।
অন্য পার্থক্য যাই থাক, এ দুটি গোষ্ঠীর পক্ষে জীবন যে কঠোর সংগ্রামের এবং নানা বিপদসংকুল ছিল— তা উভয়ের পক্ষেই সত্য ছিল। আগন্তুকরা কৃষিকাজ শিখে নেওয়ার পরেও, আগুনে পোড়া ইঁটে পাকা বাড়ি তৈরি করা শেখবার আগে রোদে শুকনো কাঁচা ইঁটে বাড়ি করত। পরেও প্রকৃতির নানা সমস্যার চেহারা ধরে দেখা দিল— বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দুরন্ত ঝড়, হিংস্র শ্বাপদ, মহামারী— মানুষ ও পশুর, ভূমিকম্প, দাবানল, কৌমগত ও গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ, শস্যের কম ফলন, ইত্যাদিতে জীবন নানা ভাবেই বিপর্যস্ত হত। অনাশঙ্কিত যে সমস্ত ঘটনা মানুষের সব হিসেব নিমেষে ধূলিসাৎ করে দিত, সেই সব আকস্মিক সম্ভাবনাকে মানুষ এখন দৈব বলে মনে করতে লাগল। এনসাইক্লোপিডিয়া অব সোস্যাল সায়েন্সেস বলছে, নিষ্প্রতিকার দুর্দশার অবস্থাই নিয়তিবাদের জন্ম নেওয়ার পক্ষে উর্বরা জমি। বহু ক্ষেত্রেই নিয়তিবাদের অসাড়তার সঙ্গে মিশে যায় সামাজিক আচরণের দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত ছক ও বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির স্বার্থ; এগুলির দ্বারা নির্মিত হয় নিষ্প্রতিবাদে মেনে নেওয়ার মনোভাব, যার দ্বারা সামাজিক অন্যায়গুলি সহ্য করে নেওয়া হয়; (গড়ে ওঠে) পরীক্ষামূলক পরিবর্তন আনারও অক্ষমতা।… নিয়তি অন্ধ, সে সান্ত্বনা দেয়। পথ দেখায় না। এই যে নিয়তিবাদ একচ্ছত্র আধিপত্যকে কোনও সুবিধাভোগী জাতিতে বা বর্ণে কায়েম করে রাখে, তা-ই আবার সমর্থন করে সফল বিপ্লবকে… (এটি ততদিন থাকে) যতদিন প্রকৃতিকে বশ করার উপকরণ ও কৃৎকৌশল না থাকে, যতদিন দারিদ্র থেকে উদ্ভুত সামাজিক সমস্যার সমাধান না হয়, নারীপুরুষের বৈষম্য থাকে, উন্মত্ততা, অপরাধ, যুদ্ধ এবং হাল ছেড়ে দেওয়া মনোভাবও থাকে— সে নিয়তি সম্বন্ধে হোক অথবা ঈশ্বরেচ্ছা সম্বন্ধেই হোক।’ (পৃ. ১৪৭, ১৪৮)
এবং, যেখানে একেশ্বরবাদের প্রাধান্য, যেমন সেমিটিক ধর্মগুলিতে, সেখানে তত্ত্বগত ভাবে দৈব ও ভাগ্যের স্থান নেই, কারণ ঈশ্বরই সেখানে চূড়ান্ত বিচারক; তাঁর বিনা অনুমোদনে কিছুই ঘটতে পারে না। যদি নিয়তিবাদের সংজ্ঞা হয় দৈবে মানুষের বিশ্বাস, যে দৈব নিরূপণ করছে কোনও নির্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া, যা একঘেয়ে, স্থির এবং অনিবার্য ভাবে ফিরে চলেছে তার সূচনাবিন্দুতে— তা হলে তা প্রতীকী ভাবে চক্রঘূর্ণনে রূপায়িত হয়।’ (ডিকশনারি অব দ্য হিস্ট্রি অব আইডিয়াস, ১৯৭৩, পৃ. ২২৬) অফিকদের সম্বন্ধে এ উক্তি কিন্তু প্রাচীন ভারতবর্ষ সম্বন্ধেও প্রযোজ্য, যেখানে পুনর্জন্ম মানেই নিরানন্দ, দুঃখময় জীবনে বারংবার ফিরে ফিরে আসা, বিশেষত চিরকালের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুর্দশাপীড়িত জনসাধারণের কাছে, যেখানে সমাজ বর্ণবিভাগ ও শ্রেণিবিভাগের মাধ্যমে, অধিকাংশ মানুষকেই পদদলিত করে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। তাদের পক্ষে জীবন কোনও করুণাময় ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং এক অন্ধ যন্ত্রবৎ নিয়তির দ্বারা পরিচালিত। এবং নিয়তিবাদ পুষ্ট হয়েছিল শ্রেণিগুলির মধ্যে ব্যবধানে এবং সমাজের নিচের তলার দুঃখী মানুষের প্রতি ওপরতলার শাসকশ্রেণির মর্মান্তিক ঔদাসীন্যে
সমাজের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে জীবনের মান স্বভাবতই মর্মান্তিক ভাবে দীন ছিল। (সমাজে কৃষি ও বাণিজ্য) বহির্বাণিজ্য ও অন্তর্বাণিজ্য— সহসা ফুলে ফেঁপে ওঠার ফলে শাসকশ্রেণিটির অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন শ্রেণির বৈষম্যও দৃষ্টিকটু ভাবে প্রকট হয়ে উঠল; ব্রাহ্মণসাহিত্যে এর নিদর্শন রয়েছে। এর ফলে আধ্যাত্মিক জগতে যে বিপুল তোলপাড় শুরু হল তা সহজেই অনুমেয়। বৈদিক সংহিতা যুগেও লোকসংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের জীবনের মান খুব নিচু ছিল; কিন্তু সমাজ তখন গোষ্ঠীবদ্ধ ছিল এবং শ্রেণিবিভাগ ছিল না, ফলে ধনী-দরিদ্রের দৃষ্টিকটু বৈষম্য না থাকায় এক ধরনের সংহতি ছিল। সে সময় ‘জীবনযাত্রা ছিল সম্পূর্ণ বাহুল্যবর্জিত, স্থূল প্রয়োজনে সীমাবদ্ধ এবং (শুধু) তা-ই সম্ভব ছিল ওই অবস্থায়: বেঁচে থাকাই ছিল বহুমূল্য, জীবনে সন্ত্রাস আনত দুর্ভিক্ষ, ব্যাধি, শত্রু, শ্বাপদ। প্রত্যেক বিপদকেই মনে করা হত দেবতা ও মানুষের মধ্যে যোগসূত্রের শক্তিধারায় একটা ছেদ; বৈদিক ভারতীয়রা দেবতাদের যদৃচ্ছাচারী বলে মনে করত না, কিন্তু দ্রব্য-দেব-মন্ত্র-যজমানকে এই শক্তিসূত্রে প্রায় যান্ত্রিক ভাবে সক্রিয় (একটি প্রবহমান ক্রিয়াধারা বলে) মনে করত। যদি শক্তিসঞ্চরণের প্রবাহে কোনও ছেদ দেখা দিত তা হলে সংস্কারের বিন্দুটি হত যজ্ঞের কর্ম।’ (যশ সম্পাদিত, ১৯৮৪, পৃ. ৩৫১)
কৃষির উন্নতি এবং পাশ্চাত্য— মধ্যপ্রাচ্য, গ্রিস, রোম— এর সঙ্গে নৌ-বাণিজ্যের পুনঃ সংযোগের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত উদ্বৃত্ত ধন সঞ্চিত হতে লাগল, যার অধিনিয়ন্তা স্বাভাবিক ভাবেই হল সমাজের ধনী সম্প্রদায়। সমাজের সুবৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের তুলনায় এ শ্রেণি নেহাৎই মুষ্টিমেয়। বৃহৎ জনসাধারণ দারিদ্র্যে পিষ্ট হচ্ছিল; এর স্বাভাবিক ও প্রায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শ্রেণি-বৈষম্য কঠোরতর হতে লাগল এবং এটা বর্ণ-জাতি-নিরপেক্ষ ভাবেই হল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের জৈনগ্রন্থ অঙ্গবিজ্জাতে পড়ি ‘বর্ণ’ মাত্র দুটিই, অজ্জ ও পেসস (আর্য আর প্রেষ্য)। আর্য অর্থাৎ উচ্চ তিন বর্ণের ধনী এবং প্রেষ্য অর্থাৎ শূদ্র পরিচারক। সমাজের এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিরুদ্ধ নিয়তির গতিরোধ বা আনুকূলায়নই ছিল উদ্দিষ্ট লক্ষ্য।
রামায়ণ-এ অন্ত্যেষ্টির বর্ণনা আছে, কিন্তু মহাভারত-এ বিশেষত, এর পরবর্তী কালের ভার্গব প্রক্ষেপে অন্ত্যেষ্টি এবং শ্রাদ্ধের দীর্ঘ বিবরণ ও নির্দেশ আছে। বোঝাই যায়, মরণোত্তর ক্রিয়াকর্ম ক্রমেই প্রাধান্য লাভ করছে। বেদাঙ্গ রচনার কাল থেকে বিশেষত গুপ্ত যুগের শুরু থেকে এবং পরে শ্রাদ্ধ-বিষয়ক গ্রন্থগুলি বিশেষ প্রসার লাভ করে। একটি কারণ আঞ্চলিক পার্থক্য, অন্য কারণটি হল প্রাগার্য ক্রিয়াকল্প ও মরণোত্তর অনুষ্ঠানগুলি ধীরে ধীরে আর্য ক্রিয়াকলাপের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছিল— দুটি লোকগোষ্ঠীর অন্তর্বিবাহের ফলে একটি মিশ্র গোষ্ঠী আর্যাবর্তে গড়ে উঠছিল। মহাভারত-এ বিভিন্ন ধরনের শ্রাদ্ধের কথা এবং প্রয়াত আত্মার ওপরে সেগুলির প্রতিক্রিয়া বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা হয়েছে (ওই ১৩:৯০-৯১ এবং তর্পণ সম্বন্ধে ৯২ অধ্যায়ে)
মৎস্যপুরাণ-এ শ্রাদ্ধের সম্বন্ধে পুরো একটি অধ্যায় (১৩শ) আছে। এর প্রধান উপজীব্য হল পূর্বপুরুষের শ্রাদ্ধ। আর একটি অধ্যায়ে মাঙ্গলিক কর্মের বিবরণ আছে এবং এগুলিতে শ্রাদ্ধক্রিয়া কী ভাবে প্রয়াত আত্মীয় ও জীবিতদের, নিমন্ত্রিতদের এবং শ্রাদ্ধভোজটিকেও প্রভাবিত করে সে কথা বিবৃত আছে। (১৭,১৮ অধ্যায়) স্পষ্টতই এত দীর্ঘ বিবরণের উদ্দেশ্য শুধু পরলোকগতদের মঙ্গল বিধানই নয়, জীবিতদেরও শ্রাদ্ধকর্মে প্রেরণা দেওয়া, যাতে তাদের পরপ্রজন্মের মৃত্যু হলে বংশধরেরা অনুরূপ আড়ম্বরে তাদের পারত্রিক কল্যাণ বিধান করে। হয়তো শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিত হওয়ার উপযুক্ত চরিত্র যেন ব্রাহ্মণরা চর্চা করেন, সে উদ্দেশ্যও গৌণ ভাবে ছিল এতে। এবং শেষত, সমারোহের শ্রাদ্ধভোজ ও প্রভূত দানদক্ষিণার বিবরণও এ ব্যাপারে জীবিত বংশধরদের সামাজিক প্রতিষ্ঠায় প্রলুব্ধ করার একটি উপায় মনে করা হত। এ কথা সত্যি যে, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহের অনুষ্ঠানে পৃথিবীর সর্বত্রই কিছু আতিশয্য থাকে, এবং শ্রাদ্ধ হচ্ছে এই কৃত্যগুলির মধ্যে শেষতম: এর পরে পরলোকগত আত্মার জন্যে আর কিছু করণীয় থাকে না, এবং আত্মার কৃতকর্মের প্রতিবিধানের কোনও উপায় থাকে না এবং তার জন্যে দীর্ঘকাল নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হতে পারে। (গরুড়পুরাণ-এ মৃত্যুর পর থেকে নরকযন্ত্রণা পর্যন্ত সুদীর্ঘ ও সানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া আছে) কাজেই জীবিত আত্মীয় ও উত্তরপুরুষেরা প্রয়াতের আত্মার যন্ত্রণা লাঘব করবার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করা কর্তব্য বলে মনে করে, যাতে তাদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ও ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে দত্ত বহুমূল্য দানে প্রীত ও সদয় হয়ে নিয়তি প্রয়াতের পরলোক-প্রবাসে লঘুদণ্ড বিধান করে।
শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের নানা ক্ষুদ্র অনুপুঙ্খ ও তার থেকে যে পুণ্যসঞ্চয় করা যায় তার সুফল প্রয়াতের ও জীবিতদের জীবনে কী ভাবে ফলে, তাই নিয়ে কুর্মপুরাণ-এ একটি সুদীর্ঘ অংশ আছে। (উত্তরভাগ ২০-২৩ অধ্যায়) মার্কণ্ডেয়পুরাণ-এ বিশেষ করে ঝোঁক দেওয়া হয়েছে নৈমিত্তিক শ্রাদ্ধের ওপরে— পার্বণ-শ্রাদ্ধ, তিথিকল্প এবং কাম্যশ্রাদ্ধ, অর্থাৎ বিশেষ উদ্দেশ্যে তিথি লগ্ন দেখে যে সব শ্রাদ্ধ নিষ্পন্ন করা হয় তারই বিবরণ। মৎস্যপুরাণ-এ একটি পৃথক অধ্যায়ে শ্রাদ্ধে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে দেয় দ্রব্যাদি কী ভাবে দাতার চরিত্র ও মেজাজ অনুসারে শুভ ও অশুভ উপাদানে পরিণত হয় তা বলা আছে। (১৯:৮,৯) বৃহন্নারদীয়পুরাণ নির্দেশ দেয়, শ্রাদ্ধে কোন কোন খাদ্যবস্তু উৎসর্গ করা যায়। (মধ্য, ২৮:১০-১২) পদ্মপুরাণ-এ শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে দুটি পুরো অধ্যায় আছে। (১০,১১) অন্যান্য পুরাণ ও স্মৃতিগ্রন্থেও এ জাতীয় বিস্তর নির্দেশ পাওয়া যায়। শ্রাদ্ধের গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে করণীয় ও বর্জনীয় বস্তু ও অনুষ্ঠানের তালিকা দীর্ঘতর হতে লাগল। রাজা ও জমিদারদের ভোগবিলাস ও প্রজাপীড়নের বৈচিত্র্যের সঙ্গে সমান অনুপাতে স্বর্গ নরকে সুখ ও যন্ত্রণাভোগের তালিকা বাড়তে লাগল।
নরকযন্ত্রণা বর্ণনায় যেটা বাড়তি, সেটা হচ্ছে যেহেতু নরক লোকান্তরে, তাই সেখানে অতিলৌকিক ঘটনা ঘটা সম্ভব। এই বিশ্বাসের সূত্র ধরে যন্ত্রণা দেওয়ার বিভিন্ন প্রণালীর মধ্যে অলৌকিকের আমদানি করা হয়েছে। যেমন, যে নিজের মাংস খুবলে খাচ্ছে, তার সে মাংস তৎক্ষণাৎ গজাচ্ছে; দু’পাশে তরবারি দিয়ে যার দেহে ক্ষত সৃষ্টি করা হচ্ছে, তার সে ক্ষত তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে যাচ্ছে, যাতে তার যন্ত্রণাভোগটা নিরন্ত হয়, যা পৃথিবীতে হতে পারে না। নরকে প্রেতাত্মার যন্ত্রণায় মৃত্যু হয় না, তাই তপ্ততৈলকটাহে সে নিরবধি কাল কষ্টই পেতে থাকে। এই সব বর্বর নৃশংস এবং ক্রূর পরপীড়ক শাস্ত্রকারদের কল্পনায় নরকের যন্ত্রণা বিপুল ভাবে বাড়তে লাগল এবং নরক আতঙ্কজনক ভাবে বিভীষিকাময় হয়ে উঠল। ঋণশোধে অসমর্থ দরিদ্র প্রজার ওপর নির্মম অত্যাচার মানুষের কাছে নরক-যন্ত্রণার আতঙ্ককে খুব বাস্তব রূপে ভয়াবহ করে তুলল, কাজেই মৃত পূর্বপুরুষদের ওই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার বা তাঁদের যন্ত্রণা লাঘব করবার চেষ্টায় শ্রাদ্ধ, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি, বেড়ে চলতে লাগল এবং উত্তরপুরুষও দেখে শিখতে লাগল মৃত গুরুজনদের উদ্দেশ্যে করণীয় অনুষ্ঠানগুলি। শ্রাদ্ধকল্পসংক্রান্ত গ্রন্থগুলি বলে শ্রাদ্ধক্রিয়া কেমন করে পরলোকে আত্মার শাস্তি মকুব করে দেয় অথবা যথেষ্ট কমিয়ে দেয়। এ সব কিছুরই ভিত্তি হল ব্রাহ্মণকে যথেষ্ট পরিমাণ দান এবং শ্রাদ্ধে যথেষ্ট ঘটা করা। যেন সুষ্ঠু ভাবে অনুষ্ঠিত শ্রাদ্ধ নিয়তির সিদ্ধান্তে পরিবর্তন ঘটায়, পরলোকে আত্মার যন্ত্রণা কমায় ও সুখের ব্যবস্থা করে।
শ্রাদ্ধ কাজটা পরস্মৈপদী; কারণ এতে জীবিতের সম্পাদিত অনুষ্ঠানে মৃতের উপকার হয়। কিন্তু পাপ পুণ্য আরও সরাসরি ভাবেও অন্যের ওপরে সংক্রামিত হয়। ‘মানুষ পুণ্য সংক্রমণের দ্বারা একে (কর্মকে) থামাতে চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু সেটি একটি পরবর্তী কালের মহাযান বৌদ্ধ তত্ত্ব, হিন্দু নয়।’ (ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, ৩৮ খণ্ড, ১-৪ সংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৮৮, স্মিথ, পৃ. ১০২) হীনযান থেকে মহাযানে সরে আসবার একটি পথে এই পার্থক্যটি দেখা দেয়; মহাযানে বোধিসত্ত্বরা স্বেচ্ছায় নির্বাণ বিলম্বিত করেন, মানবসমাজের কল্যাণে জন্যে, পাপীদের ধর্মপথে আনবার জন্যে, ধর্মশিক্ষা দেওয়ার জন্যে। এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা-তে কয়েকটি নিদর্শন আছে। ‘পাজ’শিলালিপিতে পড়ি, সমস্ত প্রাণীর সুখ এবং পুণ্যলাভের জন্য ‘পৃষ্ঠপোষক পুণ্য ভাগ করে নিতে সম্মত ছিলেন।’ (২য় খণ্ড, পৃ. ১১৪, জামাল গঢ়ি লিপি) বা ‘সকল প্রাণীর পুণ্যের জন্যে।’ (ঐ, পৃ. ১১৫, কুররম লিপি)
পূর্বেই দেখেছি পুণ্যকে ধনের মতো সঞ্চয় করা যেত, বহু কষ্টে, কৃচ্ছ্রসাধনে অর্জন করা যেত, সাবধানে রক্ষা করতে হত, প্রার্থীকে দান করা যেত, নির্বোধ ভাবে অপব্যয় করা যেত এবং অন্যের সঙ্গে ভাগ করে ভোগ করা যেত। পুণ্য একটি আধ্যাত্মিক সম্পত্তি এবং শাস্ত্রকাররা ঠিক সেই ভাবেই এর সম্বন্ধে উল্লেখ করেন।
দ্বিতীয় নগরায়ণের প্রারম্ভে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের দিকে যখন পূর্বের গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের কাঠামোটা ভেঙে গেল তখন জনসাধারণের মধ্যে ধনবণ্টনের যে খানিকটা সমতা ছিল তা-ও লুপ্ত হয়ে গেল। নিষ্ঠুর দৃষ্টিকটু বৈষম্য দেখা গেল সামাজিক নিরাপত্তা, উৎপন্ন বস্তুর ভোগ এবং প্রাথমিক উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে— এর দ্বারা পূর্বেকার সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিই শুধু নয়— এমনকী ধর্মের সম্বন্ধেও সাধারণ মানুষের একটা অনীহা দেখা গেল, বিশেষত ধর্ম যখন এই বৈষম্যের সমর্থন করছিল। ধর্ম যদি জীবনের মৌলিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শ্রেণিবিশেষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখায়, তা হলে সে ধর্মে যা-ই থাক, কোনও ন্যায়বিচার বা নিরপেক্ষতা নেই। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, বর্ণ, জাতি ও তৎসংক্রান্ত নীতি ও আচরণ মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্তকে যাদের শ্রমে ভোগপণ্য উৎপন্ন হয় সেই নিম্নবর্গীয় অগণ্য সাধারণ মানুষের থেকে পৃথক করে ফেলল, এ দুটি শ্রেণির মধ্যে সংলাপ ও সংযোগ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছিল— কায়িক শ্রমকে হীন ভাবা হল, বুদ্ধিগত শ্রমকে উচ্চতর স্থান দিয়ে একটি মহিমায় মণ্ডিত করা হল। এতে সংখ্যাল্প সুবিধাভোগীর দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ কায়িক শ্রমজীবীকে অবদমন করা হল।
উপনিষদে জ্ঞানকে মোক্ষের পন্থা বলা হলে জ্ঞানজীবী ও শ্রমজীবীর ভেদ আরও প্রকট হয়ে উঠল। শুধু উপনিষদ নয়, তত্ত্বের দিক থেকে বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক সব মত ও তত্ত্বই কায়িক শ্রমজীবীর বোধের বাইরে চলে গেল। উচ্চবর্গের বিশ্বাস, আচরণ সবই সাধারণের অগম্য হয়ে পড়ল। ফলে দু-তিন শতক পরেই নিয়তির কথা স্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হতে শুরু করল। নিশ্চয়ই বেশ কিছুকাল ধরে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব সমাজকে তোলপাড় করছিল এবং এ তোলপাড় তত্ত্বপ্রবক্তা ও শাস্ত্রকারদের মতো সাধারণ মানুষকেও স্পর্শ করেছিল। ‘পরস্পরবিরোধী ধর্মীয় ধারায় বিবর্তন শুধু যে শাসকশ্রেণির মধ্যেকার বিরোধকেই প্রকাশ করেছিল তাই নয়; এর কতকাংশ বিপুল জনসাধারণের মধ্যেও একটা সাড়া জাগাচ্ছিল, এটি বর্ণবৈষম্যের অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি অর্ধচেতন বিদ্রোহ।’ (টোকারে, ১৯৮৯, পৃ. ১৭৩) নিঃসন্দেহে, মহাকাব্যের যুগেই (অথবা তার দু-এক শতক পূর্ব থেকেই অন্তঃসলিল আকারে) বর্ণ ও জাতি সামাজিক উৎপীড়নের অস্ত্রে পরিণত হয়ে গেছে। সাধারণ লোকের অধিকাংশই অব্রাহ্মণ, অতএব বর্ণগত অবস্থানের দিক থেকে এঁরা স্বল্পতর সুবিধাভোগী এই সব দারিদ্রপীড়িত চাষি ও শিল্পশ্রমিকেরা ধনীদের জন্যে ধনীদের অধীনে পরিশ্রম করতেন। অতএব বর্ণবিভেদ ও বিত্তবিভেদ-জনিত অত্যাচারে সৎ, নিরীহ, সাধারণ মানুষেরা মর্মে পীড়িত হতেন। এ জন্মের কোনও কর্মের জন্যে এমন দুঃখভোগ হতে পারে না; শাস্ত্র বলছে, পূর্বজন্মের পাপে তাদের এই দণ্ড। পূর্বজন্মের সবটাই তাদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা ও অন্ধকার, কাজেই এ-ই হল ‘অদৃষ্ট’, একটি পূর্বনিরূপিত বিধান যা অন্ধ ভাবে দণ্ডবিধান করে। মানুষ কি বোঝেনি যে নিয়তির অন্তরালে সক্রিয় শক্তিটি আসলে মর্তে তাদের যে সব শক্তিমান অত্যাচারীরা নিষ্পেষণ করে— তারই নামান্তরমাত্র? এ শক্তি দুর্বল দরিদ্রের জন্যে শুধু অন্যায় ও নিষ্ঠুর ভাগ্যই নিরূপণ করে, যে অসহায় মানুষগুলির প্রতিবাদগুঞ্জনও অশ্রুত, উপেক্ষিত থেকে যায়।
মোজেস ফিনলে গ্রেকো-রোমান সমাজ সম্বন্ধে যা বলেন তা ভারতীয় সমাজ সম্বন্ধে ও সমান ভাবে প্রযোজ্য। উপনিবেশ স্থাপন (সমস্যাটিকে) এড়িয়ে যাওয়া, দরিদ্রদের প্রয়োজনের কোনও সমাধান নয়… দ্বিতীয় শতকের শেষের আগেই বাইরের চাপ আসতে লাগল যা চিরকালের মতো প্রতিহত করা চলল না। সৈন্যদলকে প্রয়োজনের অনুপাতে কমই বাড়ানো গেল, কারণ জমি থেকে শ্রমিক-নির্বাসন জমির (চাষের) পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। জমির অবস্থার অবনতি হয়েছিল খাজনা ও ধর্মক্রিয়ার খরচ বেশি ছিল বলে… একটি দুষ্টচক্র অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। প্রাচীন জগৎটা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সংগঠনের জন্যে; দৃঢ়মূল প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধের কাঠামো এবং সমস্তটার মূলে উৎপাদন শক্তিগুলির সংগঠন ও শোষণ। এইখানে… প্রাচীন জগতের অবসানের ব্যাখ্যা।’ (ফিনলে, ১৯৭৩, পৃ. ১৭২, ১৭৬) ভারতবর্ষেও বৈদিক যজ্ঞের যুগে ধর্মক্রিয়ার দুর্বহ বোঝা এতটা স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু পৌরাণিক ধর্ম উপস্থাপিত করল ব্যক্তিগত ইষ্টদেবতা এবং পারিবারিক দেবতা, (গৃহদেবতা বা কুল-দেবতা যাঁকে বিশেষ বিশেষ তিথিতে প্রসন্ন করতে হত); এরই সঙ্গে দেখা দিল ব্রত, তীর্থ, দান। এ সবই ঐচ্ছিক, কিন্তু যে সমাজের চিত্তাকাশে নিয়তির ঘনঘটা নিত্য বিরাজমান, নিয়তির রোষ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে সে তার শেষ কপর্দক দিয়েও এগুলির মধ্যে যে’কটি পারে অনুষ্ঠান করবে। অজ্ঞাতের সম্বন্ধে সম্ভ্রমমিশ্রিত আতঙ্ক ও ভয়ই তাকে দিয়ে ওই সব অনুষ্ঠান করাবে।
সিন্ধু সভ্যতার কালে ভারতবর্ষে প্রথম নগরায়ণ ঘটে; আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ বা সপ্তদশ শতকের কাছাকাছি এর অবসান হয়। যে সময় থেকে বৈদিক আর্যদের এ দেশে আগমন— খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের কাছাকাছি— এর মধ্যে অন্তত পাঁচ শতাব্দীর ব্যবধান; এই কালপর্যায়ে পূর্বের নাগরিক সভ্যতার অবক্ষয় ঘটে, সেটি তখন শুধু স্মৃতিতেই পর্যবসিত। আর্যরা এ দেশে এসে উত্তরপূর্ব ভারতে একটি নাগরিক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পায়; তারা নিজেরা যাযাবর পশুচারী ছিল কাজেই নগরনির্মাণ তাদের সাধ্য ছিল না। সিন্ধু সভ্যতায় পোড়া-ইঁটের বাড়িঘর ছিল, কিন্তু আর্যরা ইটভাটার কৃৎকৌশল জানত না, তারা শুধু জানত কাঁচা, রোদে-পোড়া ইঁটের বাড়ি তৈরি করতে। সে সব মাটিতে মিশিয়ে গেছে, প্রথম আর্য বসতির কালের কোনও প্রত্নচিহ্ন মেলে না। ক্রমে ক্রমে তারা প্রাগার্যদের কাছ থেকে পাকা বাড়ি তৈরি, কৃষি, ধাতুর কাজ, লিপি ও বিজ্ঞানের কিছু কিছু শিখল এবং খ্রিস্টপূর্ব নবম-অষ্টম শতকের কাছাকাছি মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত যে নৌবাণিজ্য আগে প্রচলিত ছিল, কিন্তু আর্যরা আসবার সঙ্গে সঙ্গে যা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই নৌবাণিজ্য আবার চালু হল। এর দু-তিন শতকের মধ্যে লোহার ফলা-ওয়ালা লাঙল দিয়ে চাষ চালু হল; প্রথমে কৃষিতে ও পরে শিল্পে উদ্বৃত্ত দেখা দিল; নতুন করে নগরের পত্তন হল, যার উল্লেখ পাই ষোড়শ মহাজনপদে। মুষ্টিমেয় বিত্তশালী ব্যক্তি কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যের কর্ণধার হয়ে উদ্বৃত্তভোগী হল। এই বার যাযাবর পর্যায়ের স্বল্প আয়োজনের যজ্ঞের পরিবর্তে দেখা দিল কৃষিজীবী উদ্বৃত্তভোগীর ব্যয়সাধ্য বিচিত্র ও জটিল যজ্ঞ, যার ফলভোগী ওই ধনী সম্প্রদায়; পূর্বের যজমান আর নয় স্বয়ং যজ্ঞকারই পুরোহিত।
প্রথম নগরায়ণের জ্যোতিষ, জ্যামিতি, গ্রহনক্ষত্র সম্বন্ধে জ্ঞান (যা নাবিকের পক্ষে অপরিহার্য ছিল) সেগুলি আবার ফিরে এল, কিন্তু এগুলি এ বার যজ্ঞের অঙ্গ হয়ে দেখা দিল। দ্বিতীয় নগরায়ণ, খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকে যার সূচনা, সেটি ধর্মকেন্দ্রিক অর্থাৎ যজ্ঞকেন্দ্রিক। ধীরে ধীরে বিজ্ঞান যে দেখা দিল তারও মূলে ছিল ধর্ম; ক্রমে অবশ্য এগুলি ধর্মনিরপেক্ষ স্বতন্ত্র বিজ্ঞান রূপে বিবর্তিত হল। প্রথম নগরায়ণের সঙ্গে মৌলিক যে মিলটি ছিল, তা হল ওই উদ্বৃত্তভোগী অবসরভোগী একটি শ্রেণি, যেটি শুধু যে দেশের সম্পদের অধিকারী ছিল তা নয়, দেশের শ্রমজীবীদেরও অধিকর্তা ছিল। প্রত্নখননে ওই যুগে অস্ত্রশস্ত্র প্রায় কিছুই পাওয়া যায়নি; কাজেই সৈন্যবল দিয়ে প্রজা নিয়ন্ত্রণ করা হত না। মুষ্টিমেয় সম্পদভোগী বহুলসংখ্যক সম্পদ-উৎপাদককে বশে রাখত কী উপায়ে? ধর্ম। দ্বিতীয় নগরায়ণের কালে এ ধর্ম যজ্ঞের পরিসর থেকে বেরিয়ে আসছে, জ্ঞানকে প্রাধান্য দিচ্ছে, কায়িক শ্রমকে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে বুদ্ধিচর্চাকেই একমাত্র সম্মানযোগ্য বলে ঘোষণা করছে। কারণ, উৎপাদন কর্ম থেকে সম্পূর্ণ অবসরপ্রাপ্ত উপস্বত্বভোগী ও সুবিধাভোগী মানুষগুলিরই শুধু সময় ছিল কেবলমাত্র বুদ্ধি ও জ্ঞানের চর্চার, যে-জ্ঞান সমাজের দৈনন্দিন প্রয়োজন সাধনের দায়িত্ব থেকে বহু দূরে সরে গেছে। অতএব সমাজে স্পষ্ট দৃশ্যমান শ্রেণিবিভাগ ঘটে গেছে সমাজে, ধনী ও দরিদ্র সমাজের দুটি পৃথক তলের বাসিন্দা এখন।
এই স্বল্প-সংখ্যক বহুবিত্ত মানুষ কোন উপায়ে বহুসংখ্যক স্বল্পবিত্ত মানুষকে নিজেদের বশে রাখবে? এই প্রয়োজনেই নির্মিত হল ধর্মের সেই অচলায়তন, যার ভিত্তিতে আছে বুদ্ধির অগম্য নিয়তিবাদ। যজ্ঞের দেবতারাও এখন গৌণ হয়ে উঠল। নিয়তি আত্মপ্রকাশ করল তার অনির্দেশ্য ভয়াল ও করাল রূপে; দেবতারা বা সাধুসন্ন্যাসীরা সমাজে যে সম্ভ্রম পেতেন নিয়তি তা কোনও দিনই অর্জন করতে পরেনি। মানুষকে নিয়তি আতঙ্কিতই করতে পেরেছে, ভক্তিপ্লুত করতে পারেনি।
প্রাচীন চিনেও ‘সামাজিক পরিবর্তন এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন ও দুঃখভোগ এ যুগের (খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে) কয়েকজনকে দেবতাদের ক্ষমতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করিয়েছে…. সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে বেশ কিছু দেবতা ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাঁদের অসম্মানকারীরা বেশ প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। শিহ চিং-এর (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সাল) কিছু কবিতা দিব্য ন্যায়বিচার সম্বন্ধে প্রশ্ন করছে।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ‘চাইনিজ রিলিজিয়ন’, পৃ. ২৬০ )
ভারতবর্ষেও, চিনের মতো স্পষ্ট ভাবে না হলেও অস্পষ্ট ভাবে অবচেতনে এমনটা অনুভূত হচ্ছিল। যেমন এর পূর্বে উপনিষদের যুগেই উচ্চারিত হয়েছিল যজ্ঞের ব্যর্থতা, তেমনই মীমাংসা-শাস্ত্র স্বীকার করেছে দেবতাদের ব্যর্থতা। ভারতীয় ধর্মচেতনায় নিয়তিবাদ একটি উপাদান হয়ে ওঠার পূর্বে বহু বিচিত্র সমস্যার একটি যুগ ছিল। বিদেশি আক্রমণ থেকে শুরু করে দেশের অর্থনৈতিক জীবন যে সমস্ত কারণে পরিবর্তিত হচ্ছিল তা হল: মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পশ্চিমের সঙ্গে নৌবাণিজ্যের পুনঃসংযোগ, মুদ্রাপ্রবর্তন, লিপি ও পঞ্জিকার ব্যবহার এবং গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ-জীবন ভেঙে যাওয়া। এরই সঙ্গে মুষ্টিমেয়ের হাতে বিত্তসঞ্চয় হওয়াতে তারা নিচের সংখ্যাগুরু উৎপাদক শ্রেণির ওপরে অসঙ্গত পরিমাণে ক্ষমতা প্রয়োগ করত। এ সবের ফলে, নিচের তলার দুর্দশাগ্রস্ত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে জীবন এক বিষম দুঃখের অভিজ্ঞতা বলে প্রতিভাত হল: এ এক অভিশাপ যার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে তারা উৎসুক হয়ে থাকত। যজ্ঞের উপযোগিতায় বিশ্বাস সমূলে টলে গিয়েছিল। (মুণ্ডক উপনিষদ ১:২:৭ বলে যজ্ঞ হল ‘অদৃঢ় নৌকা’) এই অবস্থায় কর্মবাদ তো বিশেষ প্রসার লাভ করবেই; কিন্তু যজ্ঞ যেহেতু আশানুরূপ ফল দিচ্ছিল না তাই মানুষ বাধ্য হয়েই অন্যত্র আশ্রয় সন্ধান করছিল যাতে তার জীবনে যা ঘটছে, তার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা এবং তার অভিজ্ঞতার একটা কার্যকারণগত ভিত্তি পাওয়া যায়। দেবতাদের সম্বন্ধে প্রথম প্রতিপাদ্যই দৃঢ় ভাবে নাকচ করে দেয় অহেতুক নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার, দারিদ্র, ব্যাধি, অকারণ দুঃখভোগ বা সর্বনাশ; কোনও দয়াবান এবং সর্বশক্তিমান দেবতাই মানুষের জীবনে অকারণে এ সব ঘটতে দেবেন না। কর্মবাদে অভিজ্ঞতার যথাযথ ব্যাখ্যা তবেই মিলত, যদি কর্ম ও কর্মফলের মধ্যে অভ্রান্ত কোনও নিয়তি সম্পর্ক থাকত, অথবা সত্যকার কোনও ন্যায়পরায়ণ বিচারক থাকতেন যাঁর বিচার মানুষ ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকার করতে পারত, যিনি কর্ম অনুযায়ী ফল দেবেন, এবং তাঁর ওপরে মানুষ যদি ভরসা রাখতে পারত। এ সবের পরিবর্তে শুধু রইল অজ্ঞাত, অজ্ঞেয় এক যদৃচ্ছাচারী শক্তি যা মানুষের জীবনকে ইচ্ছা মতো নিয়ন্ত্রণ করে। একেই মানুষ নিয়তি ব্যাখ্যা দিল। একেই দৃঢ় ও একান্ত ভাবে ব্যবহার করল শাস্ত্রকার ও পুরোহিত সম্প্রদায়।
বৈদিক ভাষ্যের উত্তরাধিকার এবং তার দর্শনের সিদ্ধান্ত— মীমাংসা— ‘(যার) সঙ্গে সম্পর্ক ধর্মের, মোক্ষের নয়… (এই) মীমাংসা ভারতবর্ষের প্রাক্ কর্মবাদ অতীতের উত্তরাধিকারকে নিয়ে এসেছে এমন এক যুগে যখন কর্ম ও সংসার মৌলিক প্রতিজ্ঞা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ (হালবফাস, ১৯৯১, পৃ. ৩০১) লক্ষ্য করা যায় যে, সংহিতাগুলি যেখানে দীর্ঘ পরমায়ুর জন্যে এক বাক্যে প্রার্থনা করছে, কারণ জীবন ভাল অর্থাৎ আনন্দের ও উপভোগ্য এবং প্রত্যহ উদীয়মান সূর্য দেখতে পাওয়া একটা পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার— সেখানে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য অর্থাৎ উপনিষদগুলি ব্যাখ্যা করছে জন্মান্তরের তত্ত্ব এবং জীবন ব্যাপারটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি অবিমিশ্র দুঃখের অভিজ্ঞতা, যার থেকে বেরিয়ে আসতে পারাই হল লক্ষ্য। যখন মানবাত্মা বিশ্বসংসারের বিরুদ্ধে তীব্র কোনও মনোভাব পোষণ করে না সেই থেকে ধীরে ধীরে দেহবিরোধী অবস্থান এসে পৌঁছালো; অতএব এল দ্বৈতবাদ (দেহ ও আত্মার ভিন্নত্ব প্রতিপাদনে) এবং নৈরাশ্যবাদ, গ্লসিস (জ্ঞানবাদ)-এর সঙ্গে যার অদ্ভুত একটা সংযোগ।’ (বিয়াস্কি, ব্লিকার ও বাওসানি সম্পাদিত, ১৯৭২, পৃ. ১০৭)
অতএব দেখছি, ভারতবর্ষে নিয়তিবাদের বহুবিধ কারণ ছিল। বস্তুগত স্তরে ছিল অস্থিরতা, আক্রমণ, রাজনৈতিক নিরাপত্তার অভাব। তারই থেকে সামাজিক আলোড়ন, নানা ধরনের উদ্ভাবন; ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন, নতুন নতুন অঞ্চলে জ্ঞানচর্চা মানুষকে বাধ্য করল এগুলিকে গ্রহণ করতে। এগুলি ওই পরিমাণে পরিচিত জগতে বিপ্লব আনল। এ সমস্ত এবং উৎপাদনব্যবস্থায় উন্নততর প্রযুক্তি, সিন্ধুপারে মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যজগতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত সম্পদের আবির্ভাব, এটিই ধীরে ধীরে গোষ্ঠীজীবনের ভিত টলিয়ে দিয়ে একান্তবর্তী পরিবার ও ‘কুল’কে সমাজের মৌলিক এককে পরিণত করল। অর্থনীতির স্তরে উদ্বৃত্ত সম্পদ জনসমাজকে তীক্ষ্ণ ভাবে দু’ ভাগে বিভক্ত করল— ধনী ও দরিদ্রে, সম্পদশালী ও অকিঞ্চনে। অর্থাৎ জাতিভেদের অন্যায়ের সঙ্গে সংযুক্ত হল অন্য একটি অন্যায়, শ্রেণিভেদ, এর দ্বারা সমাজের সম্পর্কগুলি জটিলতর হল। বিদেশি আক্রমণে বিধ্বস্ত হল লোকসংখ্যার অনুপাত ও সামাজিক ভারসাম্য, কারণ আগন্তুকদের জাতিগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের প্রশ্ন নতুন সমস্যার চেহারায় দেখা দিল।
ধীরে ধীরে মহাকাব্যোত্তর এক নতুন দেবমণ্ডলী দেখা দিল; এঁরাই ধর্মজগতের নতুন বিধায়ক। যজ্ঞের বদলে এল পূজা এবং এটা একটা মৌলিক পরিবর্তন, যার সমস্ত অনুষঙ্গই নতুন। জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পালটে গেল; এখন জীবনের লক্ষ্য হল জন্মান্তরের সম্ভাবনার অবসান ঘটানো। এবং এ অবসান ঘটাবে যজ্ঞ নয়, জ্ঞানমার্গ। পূর্বে সংহিতা-ব্রাহ্মণ যুগে উপায় ছিল কর্ম অর্থাৎ যজ্ঞ। তার পরে আরণ্যক উপনিষদ যুগে উদ্দেশ্য হল মোক্ষ এবং উপায় হল জ্ঞান। এখন পৌরাণিক পূজার যুগে উপায় হল আনুগত্য ও ভক্তি— আপন ইষ্টদেবতার কাছে আত্মনিবেদন করা যাতে ঐহিক সুখ এবং অন্তিমে মোক্ষ পাওয়া যায়। ধর্ম অনিবার্য ভাবে ফল সৃষ্টি করে এবং বাসনার রেশ রেখে যায়, যে বাসনা থেকে পুনর্জন্ম ঘটে। তাই মোক্ষের জন্য এত আকুতি। কিন্তু কর্ম ও কর্মফলের অনুপাত দৃঢ় বা নিয়মবদ্ধ কিছু নয়। আগুনে আঙুল দিলে পুড়বেই, কিন্তু যখন আগুনে আঙুল দিলে পোড়ে না, তখন? অথবা আগুনে আঙুল না দেওয়া সত্ত্বেও পোড়ে? তখন বাধ্য হয়েই এ সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে কর্ম ও কর্মফলের মধ্যে আরও অনেক ব্যাপার আছে যা সহসা চোখে পড়ে না। কিন্তু এর কোনও পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা ধর্মতত্ত্বে কোথাও নেই; দেবতারাও এর কোনও ব্যাখ্যা দেননি, যদি না ধরে নিই নৈতিক ভাবে তাঁরা যদৃচ্ছ আচরণই করেন।
এ কথা ধরে নিলে ভুল হবে যে, শাস্ত্রকাররা ও সমাজপতিরা সব বিষয়ে একমত ছিলেন। মনে রাখতে হবে, অন্তত চার পাঁচশো বছর ধরে যজ্ঞ ও পূজা পাশাপাশি চলেছিল, এরই মধ্যে বেদ বিরোধী বহু সম্প্রদায়ের উত্থান, বিকাশ ও বিলয় ঘটে। অতএব সাধারণ মানুষ দেখেছে, যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, অপরপক্ষে, সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলি কর্মত্যাগী, সমস্ত বাসনা ত্যাগের পরামর্শ দিচ্ছে বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক ধর্ম ও উপনিষদও। একমাত্র তত্ত্ব কারও কাছে যজ্ঞ, কারও কাছে নির্বাণ, কারও কাছে ব্রহ্ম, কারও কাছে নিয়তি। প্রাচীন বৈদিক ও পরবর্তীকালের পৌরাণিক কোনও দেবতারই নাস্তিক প্রস্থানগুলির কাছে কোনও আত্যন্তিক সত্তা নেই, বেদান্তেও নেই। পদার্থ কেউ বলে সুপ্ত, কেউ বলে এক, কেউ বলে তত্ত্ব চতুর্বিংশতি। কেউ (আজীবিক) বলে পাপ পুণ্য নিরর্থক সংজ্ঞা, চুরাশি লক্ষ জন্মের পরে মোক্ষ আপনিই আসবে। কেউ বলে যজ্ঞ সুখ এবং স্বর্গ, কেউ বলে পূজায় সুখ এবং মোক্ষ, কেউ বলে অন্তিমে কী তা কেউ জানে না। এ সকল বিভিন্ন প্রস্থানের প্রবক্তাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল না। কিন্তু এরা প্রায় সকলেই স্পষ্ট অথবা প্রচ্ছন্ন ভাবে নিয়তিকে স্বীকার করত, শ্রদ্ধা করে নয়, আতঙ্কের সঙ্গে। এবং প্রায় সকলেই নানা উপায়ে নির্দেশ করেছে যাতে নিয়তিকে প্রতিহত করা যায় বা নিজের অনুকূলে আনা যায়।
তত্ত্বগত ভাবে নিয়তি নিরালম্ব, এর প্রতিষ্ঠা তবে কীসের ওপরে? নিয়তির কোনও নির্দিষ্ট চরিত্র, লক্ষ্য, কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা যায় না। কর্মবাদের সঙ্গে— সে যজ্ঞই হোক, পূজাই হোক— তত্ত্বগত ভাবে এর বিরোধ আত্যন্তিক। জন্মান্তরবাদও নিয়তির সমর্থন করে না। করুণাময় ঈশ্বরের সঙ্গেও নিয়তি সহাবস্থান করতে পারে না; ভক্তিবাদে এর সব কিছুই ব্যাহত হয়; আর জ্ঞানবাদের সামনে তো নিয়তিবাদ একটা কুয়াশামাত্র। তবুও এ সবের সঙ্গে নিয়তি আড়াই হাজার (হয়তো বা চার হাজার) বছর ধরে ভারতবর্ষে সহাবস্থান করে এসেছে। অন্যান্য কত প্রস্থান এল গেল, নিয়তি রয়ে গেল অব্যাহত। সম্ভবত, তত্ত্বগত কোনও ভিত্তি না থাকাই এর জোর; কার সঙ্গে বিতর্ক হবে? এর তো কোনও মৌলিক প্রতিপাদ্যই নেই।
এ অবস্থায় মানুষ নিজের নৈতিক জগৎ নিজে সৃষ্টি করল অন্য ভাবে নিয়তিকে উদ্ভাবন করে, যে-নিয়তির ওপরে জীবনের সব দুর্বোধ্য অজ্ঞেয় অভিজ্ঞতা চাপানো যাবে, যা কিছু হিসেবে মেলে না। নিয়তিবাদ এল কর্মবাদ ও জন্মান্তরের পরিপূরক রূপে। এই আড়ালখানা যা কিছু জ্ঞাত, দৃশ্যমান, যুক্তিনিষ্ঠ, প্রত্যাশিত, গাণিতিক ভাবে সিদ্ধ, তার পরিপন্থী সব কিছুকে পৃথক করে; যা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ নয়, শুধু নিয়তিবাদের আশ্রয় নিয়েই যার ব্যাখ্যা মেলে। নিদারুণ নৈতিক সংকটে পড়ে মানুষ যে নিয়তিকে উদ্ভাবন করেছে এটাই তার কৃতিত্ব; তার অন্তরের গভীরতম তাগিদে বস্তুজগৎকে জানবার ও ব্যাখ্যা করবার ঔৎসুক্যে, বোঝবার আত্যন্তিক আগ্রহে সে নিয়তিতে এসে ঠেকেছে। যখন কার্যকারণ ধারা বা যুক্তি ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ হল, তখন অযুক্তিকে, নিয়তিকে ডেকে আনা হল, জ্ঞানের ওই বড় ফারাকটাকে ভরাবার জন্যে। জীবন নিজেই সম্পূর্ণ অর্থহীন, এ কথা মানুষের গ্রহণ করতে বাধছিল। কাজেই সে ভাবতে চাইল যে, এই জানা জগৎটার ওপারে, কর্ম ও কর্মফলের পরপারে, যথাযথ ভাবে আধারিত হলে যে-দেবতারা মানবহিতৈষী হয়ে ওঠেন তাঁদেরও ছাড়িয়ে, অর্থাৎ জীবনে যা কিছু জানা যায় তার সবটুকুকেই অতিক্রম করে রয়েছে নিয়তি। এই সেই সর্বশক্তিমান দৈবের শাসন, যা মানুষের জীবনের অন্ধকার দিকের ওপর রাজত্ব করে— যে অঞ্চলে কোনও এক পূর্বজন্মে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে কৃত কর্ম সঞ্চিত আছে। সেই ছায়াচ্ছন্ন অতিলৌকিক অঞ্চলটি মানুষ কেমন করে বিদীর্ণ করবে? সে কেবল সর্বশক্তিমান ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণই করতে পারে। এটা সে করল, বিস্তৃত নানা জটিল অনুষ্ঠান আবিষ্কার করে এবং ভাগ্যের পূর্বাভাস ও পূর্বজ্ঞান লাভের এবং প্রতিকারের উপায় আবিষ্কার করে, নিজে বা অন্য কাউকে দিয়ে তার অনুষ্ঠান করানোর দ্বারা। কিন্তু কিছুই তাকে স্পষ্ট করে জানাল না কীসে এমন হয়; সবটাই জানা জগতের ওপারে রইল।
মানুষের ইতিহাসের আদিপর্বেই ব্যাবিলনীয়রা মানুষের জীবনে দুঃখ এবং মানুষের ভাগ্যের প্রশ্ন নিয়ে বিচলিত বোধ করত। ‘কেন মানুষ দুঃখ পায় তার কোনও উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। গ্রন্থটিতে (লুডলুলের অহেতুক দুঃখভোগের) শুধু একটা বোধ তুলে ধরা হয়েছে যে দেবতাদেরও চিত্ত পরিবর্তন হতে পারে, তাঁরা করুণাও করতে পারেন। অন্য রচনাটির নাম থিওডিসে (দেবরাজ্য); এটি দুই বন্ধুর মধ্যে সংলাপের আকারে; মন্দলোকের কেন সুখসমৃদ্ধি হয়, ভালরা কেন কষ্টে পড়ে, তা নিয়ে। এখানেও সত্যিকারের কোনও উত্তর নেই, শুধু একটা বিশ্বাস যে, মন্দ লোক তার কার্যের ফল এক দিন পাবেই।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন, ‘ব্যাবিলন’) সদাচরণ ও দুঃখ এবং অসচদাচরণ ও সুখের মধ্যে প্রত্যক্ষ অসঙ্গতি তা-ই মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল দৈব ও পূর্বজন্মের কর্মের ফল, এ জন্মে পাওয়ার বিশ্বাসের দিকে। কর্ম ও কর্মফলের আপেক্ষিক তালিকা কই? পূর্বজন্মের কোন কর্ম কোন ফল উৎপন্ন করবে এ জন্মে তার নির্দেশ কোথায়? কেমনই বা সেই ফল? রাষ্ট্রিক আইন নির্মাণের পূর্বের সমাজে কর্ম ও ফলের এই অনুপাতের কোনও ভিত্তিই মানুষের সামাজিক অধিকারে ছিল না। কিন্তু হামুরাবি ও তাঁর প্রণীত নীতির পরেও, এক অজ্ঞেয় দৈবের ধারণা মানুষের সামাজিক চেতনায় ক্ষোদিত থেকে সক্রিয় ছিল। আংশিক ভাবে এর কারণ আইনের মধ্যেও অনেক ফাঁক ছিল এবং বহু দূরবর্তী কোনও বিচারক ইচ্ছা মতো রায় দিতেন। দ্বিতীয়ত, সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কিছু সুবিধা ছিল, ফলে সাধারণ মানুষ ও উচ্চবিত্ত শক্তিশালী সম্প্রদায়ের সামাজিক অবস্থান এক রকমের ছিল না। এর দ্বারা অন্য ভাবে ন্যায়বিচার বলে গণ্য, সেই দেওয়ানি আইনের মধ্যেও বহু অসঙ্গতি থেকে গিয়েছিল। তৃতীয়ত, কৃষিজীবী সমাজ জানত যে, বীজবপন এবং ফসল তোলার মধ্যে কালগত ব্যবধান থাকেই; এর দ্বারা বিলম্বিত কর্মফলের ধারণা দৃঢ় হল, ফলে লোকে মেনে নিল, যে একজন্মের কর্মের ফল অন্য জন্মে ভোগ করা সম্ভব। অহেতুক দুঃখভোগ, কখনও-বা অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যের উদয়, এ-তো নিশ্চিতই ঘটে থাকে, যা নিশ্চিত নয় তা হল ন্যায়সঙ্গত বিচার। কাজেই নিয়তিতে বিশ্বাসের একটি দৃঢ় জমি তৈরি হল। তবুও শেষ পর্যন্ত একটা ন্যায়বিচার আসবেই, এমন বিশ্বাস সহজে যায় না, এবং এর থেকেই সৃষ্টি হয় ভাবী কালে প্রলয়কালীন পরিত্রাতার সম্বন্ধে অতিকথাগুলি, যিনি এসে সব মন্দের অবসান ঘটাবেন। যিশুখ্রিস্টের দ্বিতীয় আগমন, বা কল্কি অবতার, এড্ডা-র রাগনারোয়েক, আবেস্তা-য় শেষ বিচারের কাহিনি তুলে ধরা হয় মানুষের সামনে, নতুন স্বর্গ ও নতুন পৃথিবীর এক কল্পদৃশ্যরূপে।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের গিলগামেশ মহাকাব্য একটি প্রলয়োত্তর কল্পদৃশ্যের ছবি আঁকে যেখানে জীবনের সব কাম্য বস্তুর সমাবেশ। ‘সেখানে ছিল দেবতাদের কুঞ্জকানন, তার চারদিকেই ছিল গুল্ম যেগুলিতে রত্ন ফলে আছে… কার্নেলিয়ান মণির ফল, তার থেকে দ্রাক্ষালতা ঝুলছে, দেখতে ভারী সুন্দর; নীল পাথরের পাতা থেকে ঝুলছে ফল, দেখতে মধুর। কাঁটার জায়গায় হেমাটাইট ও অন্যান্য দুর্লভ মণি, অ্যাগেট, সমুদ্রের মুক্তা।’(পেঙ্গুইন সংস্করণ, ৪র্থ অধ্যায়) বাইবেল-এর ‘প্রকাশিত বাক্যে’ তুলনীয় একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। ‘আমি এক নতুন স্বর্গ ও এক নতুন পৃথিবী দেখলাম… এবং ঈশ্বর তাদের চোখ থেকে সমস্ত অশ্রু মুছিয়ে দেবেন, মৃত্যু আর থাকবে না, কোনও দুঃখ বা রোদন আর থাকবে না, কোনও যন্ত্রণাও আর থাকবে না, কারণ পূর্ব বিষয়গুলির সব মিলিয়ে গেছে।’ (২১ অধ্যায়, ১,৪) সমস্ত মানুষ কি চিরকালই স্বপ্ন দেখেনি, উৎসুক হয়ে প্রতীক্ষা করেনি যে, ঈশ্বর সব অশ্রু মুছিয়ে দেবেন? সব অন্যায়ের প্রতিকার হবে, আর যন্ত্রণাভোগ, আর্তনাদ ও মৃত্যু থাকবে না? ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে প্রয়োজন ছিল এমন একটি প্রলয়োত্তর আশার মরীচিকা সৃষ্টি করারে, যেখানে জীবনের সব অন্যায়ের, অমঙ্গলের চূড়ান্ত, সম্পূর্ণ ও চিরস্থায়ী ক্ষতিপূরণ ঘটবে।
ভারতবর্ষে আদিমতম চিত্রটি সোমপায়ীদের উন্মাদনার প্রেরণায় নির্মিত একটি স্বপ্নস্বর্গের বর্ণনায়। ঋগ্বেদ-এর সোমমণ্ডলে পড়ি, ‘যেখানে সর্ব কামনার পূর্তি (আছে), খাদ্য ও তৃপ্তি (আছে), সেখানে আমাকে অমর কর। যেখানে সুখ ও আনন্দ আছে, সম্ভোগ ও চূড়ান্ত আমোদ, যেখানে কামনাগুলির নিরন্ত পূর্তি, সেখানে আমাকে অমর কর।’ (তত্র মামৃতং কৃধি’ এইটিই ধ্রুবপদ। ৯:১১৪:১০-১৪) এই স্বপ্ন যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। সাহিত্যে এর প্রথম নিদর্শন উত্তরকুরুর বর্ণনায়। শ্রেণিভেদের উদ্ভবের চিহ্ন মেলে ব্রাহ্মণ-সাহিত্যে। (ঐতরেয় ৮:২৩) তার পরে পাই মহাভারত-এ, যেখানে উত্তরকুরুর বর্ণনা হল ‘যে দেশে কর্ষণ না করেই শস্য পাওয়া যায়, যেখানে প্রত্যেক পত্রপুটে মধু।’ (২:২৮:৭-২০); পুরাণের শেষের দিকের একটি উল্লেখ হল ভাগবত পুরাণে, এখানে উত্তরকুরুর বর্ণনা এ রকম: যেখানে আর্যদের প্রথম বসতি ছিল, ‘সিদ্ধরা এখানে বাস করে, গাছে গাছে ফল ও সুরভি কুসুম, এখানে কল্পতরুটি আছে, সুবর্ণ ও মণিমুক্তা ভূমিতে আকীর্ণ। স্বর্গের মন্দাকিনী এখানে প্রবাহিত এবং চৈত্ররথ কুঞ্জবনটিও এখানে।’ (৫:১৮:৩৪) গুপ্ত যুগের কবি কালিদাসও তাঁর অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকে (৭:১২) দিব্যকল্প ঋষি মারীচের আশ্রম বর্ণনায় এবং তাঁর কাব্য কুমারসম্ভব-এ ওষধিগ্রন্থের বর্ণনায় লেখেন, ‘যেখানে বয়স যৌবনে এসে থেমে যায়, (যেখানে) প্রেমের দেবতা মদন ছাড়া আর কোনও ঘাতক নেই।’ (৬:৪৪); ‘এ এমনই সুখের স্থান যে, এখানকার লোকে স্বর্গসুখকেও বঞ্চনা মনে করে।’ (৬:৪৭) এবং শেষবার মেঘদূত-এর অলকার বর্ণনায়: ‘যেখানে আনন্দশ্রু ছাড়া অন্য কারণে অশ্রুপাত নেই, প্রেমের বেদনা, যা মিলনে প্রশমিত হয় তা ছাড়া আর কোনও বেদনা নেই, প্রেমিক-প্রেমিকার কলহ ছাড়া বিরহ নেই, যক্ষদের (যারা সেখানে থাকে তাদের) যৌবন ছাড়া অন্য বয়স নেই।’ (উত্তরমেঘ ৬৬ নং শ্লোক)
এ সবেরই অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল একটি স্বপ্নকে বাঁচিয়ে ও কল্পনার কাঠামোতে চিরকালের মতো বাঁধিয়ে রাখার জন্যে। মানুষ জীবনে যে সব প্রতিকার পায় না এবং যেগুলির জন্যে সারা জীবন সে উৎসুক আগ্রহে প্রতীক্ষা করে, যেগুলির সম্বন্ধে তাকে বারংবার বলা হয়েছে যে, হয় উত্তরকুরুতে, নয় অলকায়, নয় প্রলয়োত্তর কোনও নতুন সৃষ্টিতে সে সবই পাওয়া যাবে। সেই স্বপ্নটিতে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য সাহিত্য বারে বারেই এই স্বপ্নস্বর্গের আলেখ্য সৃষ্টি করেছে। প্রসঙ্গত, সমস্ত অতিকথাতেই এই অবিমিশ্র ও নিরবচ্ছিন্ন সুখের স্বপ্নস্বর্গটিকে স্থাপন করেছে কালের দুটি চরম প্রান্তে; হয় সৃষ্টির আদিতে (বাইবেল-এ ঈডেন উদ্যানে, আবেস্তা-য় যিমেহ’র স্বর্গে ইত্যাদি), নয় সৃষ্টি কালের অপর প্রান্তে, প্রলয়ের পরপারে: কল্কি এসে এই কলুষিত সৃষ্টিকে ধ্বংস করে নতুন সৃষ্টি করবেন (আবেস্তা-য় শেষ বিচারে, এড্ডা-র রাগনারোয়েক-এ, বাইবেলের অন্তিমবিচারের পর নতুন স্বর্গ ও নতুন পৃথিবী ইত্যাদি)। মানুষের চির-অনুত্তরিত প্রশ্ন, দুঃখ কেন? জীবনে অব্যাহত অবিমিশ্র সুখ থাকবে না কেন, যাতে তার অক্ষয় অধিকার? এই মরীচিকাগুলি মানুষের চিত্তে সাহস সঞ্চার করে, যাতে সে বর্তমানের দুঃখকষ্ট দুঃসহ বলে বোধ না করে, ভবিষ্যতের একটি মৃগতৃষ্ণিকার দিকে তাকিয়ে বর্তমানকে বহন করতে পারে। এখন, যেহেতু এগুলি স্থানে ও কালে দূরে অবস্থিত এবং অন্তিমে সুখের প্রতিশ্রুতি দেয় তাই বর্তমানকে নিয়ে সম্ভাব্য বিদ্রোহ-বাসনা স্তিমিত হয়ে আসে; বর্তমান সামাজিক বৈষম্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের নিপ্পুর শিলালেখে দিলমুনের বর্ণনাও সর্বকামনার সিদ্ধির জগৎ: ‘(যেখানে) দাঁড়কাকের কর্কশধ্বনি শোনা যায় না, মৃত্যুর বিহঙ্গটি মৃত্যুর ধ্বনি উচ্চারণ করে না, নেকড়ে বাঘ মেষশাবককে ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করে না, ঘুঘু শোক করে না, সেখানে কোনও বিধবা ছিল না, কোনও জরা কোনও বিলাপও ছিল না।’
কিন্তু যতক্ষণ ন্যায়সঙ্গত প্রতিকার উপস্থিত না হচ্ছে, এ সব আশা শুধুমাত্র স্বপ্নেই পর্যবসিত থাকছে, কেবলমাত্র পুরোহিত ও কবিরা বারংবার আবৃত্তি করে এ সব জীবিত রেখেছেন, ততক্ষণ মানুষ তো বাস করছে বাস্তবিকপক্ষে এক অন্যায়-অধিষ্ঠিত জগতে। এই অযৌক্তিক ব্যবস্থাকে চূড়ান্ত ভাবে অপ্রতিকার্য বলে মেনে নেওয়া মানুষের পক্ষে স্বতই অসাধ্য। প্রলয়োত্তর কাল উপস্থিত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিয়তিতে বিশ্বাস সমাজের সমস্ত অসঙ্গতির, অব্যবস্থার, অন্যায়ের ও অত্যাচারের একটি আপাত-ব্যাখ্যা দেয়।
ভারতবর্ষে মহাকাব্য দুটির পূর্বে বৌদ্ধসাহিত্যেই নিয়তিতে বিশ্বাসের নিদর্শন পাই, বিশেষত জাতকগুলিতে। একটিতে দেখি পর পর কতকগুলি দৈব ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের গতিপ্রকৃতি নিরূপণ করে। (২-৭ সংখ্যক, গামনিছন্দ) এখানে দৈব প্রধান হয়ে উঠে মনুষ্য জীবনের গতি স্থির করে; এ সব দৈব ঘটনা নিয়তিরই দৈব ভাষ্য। বিপদের সামনে কয়েকটি বালক অবিচলিত ছিল দেখে বুদ্ধ বলেছিলেন, নিয়তি এই বালকগুলির উপরে অত্যন্ত প্রবল ও চরম অত্যাচার করেছে। (৩৬৮ সংখ্যক, তচসার) বুদ্ধ শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতিভূ হয়েও নিয়তির প্রাধান্য স্বীকার করছেন এবং বালকগুলির বিপদের দায়িত্ব নিয়তির ওপরে আরোপ করেছেন। এমনই কতকগুলি দৈবদুর্ঘটনাকে অন্যত্র আনা হয়েছে নিয়তির শক্তি জ্ঞাপন করবার জন্যে। (৪৩২ সংখ্যক, পদকুসল মানব) কোনও এক জন্মে বুদ্ধ একটি সুবর্ণহংস হয়ে জন্মান। ধরা পড়েও পালাননি কারণ ‘যখন জীবন শেষ হয়ে আসছে, মৃত্যুর গ্রহণ সন্নিকট, তুমি তার পিছুপিছু কাছাকাছি এলেও ফাঁদ বা জলে (তাকে) দেখতে পাবে না।’ (৫০২ সংখ্যক, হংস) এক রাজা দীর্ঘকাল দুর্ভাগ্যপীড়িত থাকবার পরে বলেন, ‘আমি জানি, যেখানেই আমি যাই না কেন, নিয়তি বিনিদ্র ভাবে আমার প্রহরী হয়ে থাকে।’ (৫৩৮ সংখ্যক, মুগপক্খ )
রামায়ণ-এ খুব সংক্ষেপে নিয়তির সংজ্ঞানির্ণয় করেছে। ‘বুদ্ধি দিয়ে যার নাগাল পাওয়া যায় না, তা-ই নিয়তি।’(২:২২:২০) এ মহাকাব্যটিতে অচিন্তিতপূর্ব বহুতর ঘটনার সমাবেশ আছে। তা ছাড়াও বীর চরিত্রগুলি বারেবারেই নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করছেন। রাম লক্ষ্মণকে বলছেন, ‘নিয়তির বিরুদ্ধে কে সংগ্রাম করতে পারে?’ (২:২২:২১) আরও বলছেন, ‘আমার এই নির্বাসনে শুধু নিয়তিকেই সক্রিয় দেখতে পাওয়া যায়। নইলে আমাকে দুঃখ দেওয়ার শক্তি কৈকেয়ী কোথায় পাবেন, যদি না নিয়তি তাঁর এই মনোভাব নির্ধারণ করে থাকে?’ (২:২২:১৫,১৬) এ শুধু কৈকেয়ীকে নৈতিক দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে বলা হচ্ছে না, প্রসঙ্গত, গৌণ ভাবে, নিরপরাধ (রামকে) অন্যায় ভাবে দণ্ডিত করার দায়িত্ব থেকে— দশরথকেও মুক্ত করা হচ্ছে; সর্বোপরি এমন একটি দার্শনিক ছক প্রস্তুত করা হচ্ছে যার মধ্য দিয়ে একটি ঘোরতর অন্যায়কে অন্যতর এক শক্তি নিয়তির ওপরে আরোপ করা হচ্ছে। অন্যত্র আমাদের নিয়তি সম্পর্কে উপদেশ দেওয়া হয়েছে ‘সুখ ও দুঃখ, ভয় ও ক্রোধ, লাভ ও ক্ষতি, সত্তা ও অসত্তা, এর কোনওটারই অভিজ্ঞতা যার হয়েছে, (সে-ই জানে) সেটি (হয়েছে) নিয়তির ক্রিয়ার দ্বারা। যে সব সাধু কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের তপস্যা করেছেন, নিয়তি যখন তাঁদের প্রভাবিত করে, তখন তাঁরা সংযম পরিহার করে কাম-ক্রোধের বশীভূত হন। যা অভিপ্রেত ছিল না, যা সহসা ঘটে যায়, কৃত্যকর্মকে বাধা দেয় অন্যবিধ কৃত্যের দ্বারা তা-ই নিয়তির ক্রিয়া।’ (২:২২:২০-২৪) রামের নির্বাসনে কৌশল্যা বিলাপ করছেন, ‘কাল সত্যই দুরতিক্রম্য।’ (২:২৪:৩৩) কিংবা ‘পুত্র, পৃথিবীতে নিয়তির গতি চিন্তাকে বিকল করে দেয়।’ (২:২৪:৩৫) ‘শৌর্য-সুরামত্ত, অপরাধী ও দৈবহতদের ওপরে বিজয়ী, নিয়তি বিচার করেই এ-ই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ এখানে কৌশল্যা নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে নিয়তিতে বিচার আরোপ করেছেন, যদিও এ দুটির পরস্পর বিরুদ্ধ। (৬:৮:৯) ‘বীর, শক্তিমান, সশস্ত্র মানুষও নিয়তির দ্বারা বশীভূত হয়ে বালুকাসেতুর মত যুদ্ধে পতিত হয়।’ (৬:১৭:২৪) রাবণের মৃত্যুতে পুরনারীরা বিলাপ করে, ‘নিয়তির জয় সর্বত্র, যাদের মৃত্যু হয় তারা নিয়তির দ্বারাই নিহত হয়।’ (৬:১১০:২৩)
নিয়তির এই সার্বভৌমত্ব মহাভারত-এও দেখা যায়; রচনার দিক থেকে অনেক পরিণততর, জটিল ও শিল্পোত্তীর্ণ এ মহাকাব্যটি নিয়তিবাদের ব্যাপারটাকে আরও গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। নিয়তি মানুষের জীবনে কী ভাবে কাজ করে? ‘অগ্নিময় অক্ষিগোলকের মতো এসে মানুষের (ওপরে) পড়ে নিয়তি মানুষকে দৃষ্টিবিরহিত করে দেয়।’ (২:৫২:১৮) অগ্নিময় অক্ষি মানুষের চর্মচক্ষুকে যেন দগ্ধ করে দেয় আর তাই মানুষের বিচারবুদ্ধি সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে যায়; অতএব সে নৈতিক ক্ষেত্রে অন্ধের মতো আচরণ করে ফল দুর্নিয়তি তাকে ধাওয়া করে এবং তখন তার দুঃখভোগ যেন আত্ম-দুষ্কৃতিরই পরিণাম হয়ে দেখা দেয়। নিয়তির ক্রিয়া সম্বন্ধে বিখ্যাত সেই উক্তি, ‘নিয়তি যাকে পরাজিত করতে চায় তাকে (প্রথমে) বুদ্ধিভ্রষ্ট করে, তখন সে (সবকিছু) বিপরীত ভাবে দেখতে শুরু করে।’ (২:৭২:৮) ‘মানুষ ভাগ্যে যা পায় তা নিঃসন্দেহেই নিয়তিই।’ (৩:৩৩:১৫) বিপদের কোনও কারণ বা যুক্তি নেই, কোনও সীমা বা সঙ্গতি নেই; ধর্মই পাপ পুণ্যের বিভাগ করে।’ (৩:২৯৫:১) যখন সূর্য কর্ণকে পাণ্ডব পক্ষে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেন এবং কর্ণ সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন, তখন কুন্তী কর্ণকে বলেন, ‘নিয়তি বলবত্তরা।’ কিসের চেয়ে বলবত্তরা? পুরুষকারের চেয়ে, আপাতগ্রাহ্য সুযুক্তির চেয়ে নিজের জীবনের গতি নিয়ন্ত্রণ করার সমস্ত প্রয়াসের চেয়ে। এই ছোট্ট উক্তিটি অনেক কথাই বলে। পূর্বেকার রূপক: নিয়তি দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন, ঘোলাটে করে তোলার পরে কোনও ব্যক্তি তার নিজের অপরাধেই ধ্বংস হয়— এটি থেকে আমাদের সেই ইংরেজি প্রবাদটি মনে পড়ে: ‘দেবতারা যাকে ধ্বংস করতে চান তাকে প্রথমে উন্মাদগ্রস্ত করে তোলেন।’ কাজেই নিয়তি সরাসরি কাজ করে না, সূক্ষ্মতর উপায়ে তার লক্ষ্য ব্যক্তির আধ্যাত্মিক ও নৈতিক অন্ধতা উৎপাদন করে শেষ পর্যন্ত তাকে নিজের দোষেই ধ্বংস হওয়ার পথে এগিয়ে দেয়; ফলে নৈতিক দায়িত্ব আপাত ভাবে তারই থেকে যায়। দুষ্কৃতিই যেন তার দুর্ভাগ্যকে ডেকে এনেছে, এমন মনে হয়। অথচ সবটাই নিয়তির কৌশল।
অম্বাকে যখন তার দুই বোনের সঙ্গে ভীষ্ম হরণ করে আনেন, তখন তাঁকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যেতে হয়েছিল, কারণ তিনি শাল্বকে ভালবাসতেন। কিন্তু অম্বা যখন ভীষ্মকে সে কথা বলে মুক্ত হয়ে শাল্বর সামনে দাঁড়ালেন, ততক্ষণে শাল্বের অহমিকা আহত হয়েছে, তিনি অন্যপূর্বার মতো তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তখন অম্বার মহাসংকট এবং নিরন্ত গভীর মর্মবেদনায় তিনি নিয়তিকে অভিশাপ দিলেন। (৫:১৭২:৬) অম্বার নিজের কথা একটু পর্যালোচনা করে দেখা যাক। নিয়তি যেন গোপন শত্রুর ভূমিকায় থেকে অসন্দিহান নিরপরাধ মানুষের উপরে আপন অস্ত্র মোচন করল। এই সূক্ষ্ম ছলনাময় নিষ্ঠুর আচরণ থেকে নিয়তির যে কল্পমূর্তি নির্মিত হয় তা যেন বুদ্ধিমান ও বিদ্বেষপরায়ণ এক শত্রু— অদৃষ্ট— অতএব তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাও কঠিন। তার গোপন প্রয়াস প্রকাশিত হয় কুঠারাঘাতের পরে, যখন আর করণীয় কিছুই থাকে না। মহাভারত-এর যুদ্ধে সৈনিকদের মনে হল, ‘জয় আসলে অনিশ্চিত, সব পূর্ণগণনাকে ব্যর্থ করে দেয়; একা নিয়তিরই জয়জয়কার।’(৬:৪:৩৫) এতে ক্ষত্রিয় যোদ্ধার প্রতি একটা অন্তর্নিহিত অসম্মান আছে, তার শৌর্য ও যুদ্ধকৌশলের প্রতি এক অমর্যাদা আছে। নিপুণ অস্ত্রশিক্ষা, কৌশলী বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, উৎকৃষ্টতর অস্ত্রশস্ত্র, সংখ্যাগত আধিক্য, আত্মত্যাগ এ সব নিয়ে যে সুশিক্ষিত সৈন্য বীরভাবে একাগ্র হয়ে যুদ্ধ করছে তার যুদ্ধফল যদি নিয়তির ওপরে, এবং শুধুই নিয়তির ওপরেই নির্ভর করে তা হলে শিক্ষা, শৌর্য, সংগ্রাম— এ সবই তো অর্থহীন হয়ে পড়ে। নিয়তিকে গৌরব অর্পণ করবার ফলে পুরুষকারের অবমূল্যায়ন ঘটে এক অপমানজনক পরিস্থিতিতে। মহাকাব্য ও পুরাণে এ জাতীয় কথা অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে।
ঘটনার প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা হল, যেমন পূর্বেও দেখেছি, সব কিছুর চূড়ান্ত দায়িত্ব প্রকৃতির উপরে অর্পণ করা। ‘প্রকৃতি তার অনুচরদের নিয়ে যে সব ক্রিয়া সম্পাদন করে, অহংবোধে মুগ্ধ মানুষ মনে করে, সে-ই বুঝি সে-সবের কর্তা।’ (৬:২৫:২৭) এ প্রকৃতি অজ্ঞেয়, অতএব নিয়তিরই নামান্তরমাত্র। ধৃতরাষ্ট্র যখন স্বকৃত অপরাধের জন্য অনুশোচনায় বিলাপ করছেন, তখনও তিনি নিয়তিকেই দোষ দিচ্ছেন, তাঁকে ওই সব অন্যায় কাজে প্রবৃত্ত করানোর জন্যে, ‘অতীতে কত অন্যায় করেছি, যখন চিত্ত নিয়তির দ্বারা রাহুগ্রস্ত ছিল।’(১১:১:১৪) ‘কালের কোনও শত্রুও নেই, মিত্রও নেই, কাল কখনও উদাসীন নয়, প্রত্যেককে (ইচ্ছেমতো) টেনে নিয়ে যায় কাল।’ (১১:১:১৪) ‘পালা করে সকল জীবকেই নিয়ে যায় কাল।’ (১২:৩৪:৪) ‘কালের পিতামাতা নেই, জেনো কারও প্রতি পক্ষপাত নেই কালের, মানুষের কর্মের সাক্ষী, তার আত্মার আকৃতি হল কর্ম, পাপপুণ্যকর্মের সাক্ষী, সুখ-দুঃখের ফল কাল, (তাকে জেনো) কর্মের ফলদাতা রূপে।’ (১২:৩৪:৫,৭) এমনই শুনি, ক্লীবের মতো আত্মসান্ত্বনা, ‘এটা ঘটা নিয়তি নির্দিষ্ট ছিল, কাজেই এ নিয়ে শোক করা উচিত নয়, বিশেষ বুদ্ধি নিয়েও কে কবে নিয়তিকে প্রতিহত করতে পেরেছে?’ (১:১৯:১:১৮৬) ‘পাণ্ডবরা নিজেদের নিয়তিই সৰ্বদা ভোগ করেছে।’ (২:৪৪:১) ‘আমরা যাকে ভাগ্য বলে জানি, সেই শক্তিকে প্রতিহত করা যায় না। পুরুষকারের দ্বারা নিয়তিকে জয় করা যায় না।’ (১৫:১৩:১,২) ‘লোভী ও মোহান্ধ মানুষকে নিয়তি রক্ষা করে না।’ (১৩:১:৪২ )
এ কথা শুনে সহসা মনে হয় যে, নিয়তির মধ্যে কোনও শুভবুদ্ধি সক্রিয় যা মন্দকে প্রশ্রয় দেয় না, সচাদরণকে পুরস্কৃত করে। কিন্তু নিয়তি সম্বন্ধে ধারণার মূলেই আছে কার্যকারণের মধ্যে ঘোরতর অসামঞ্জস্য। ‘নিয়তি কখনও কোনও অন্যায় রায় দেবে না।’ (২:৪৫:৫৫) এ যেন অর্ফিক স্তোত্রের একটি চরণের প্রতিধ্বনি, ‘ন্যায়সঙ্গত প্রয়োজনই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে।’ (ওই ৩ সংখ্যক ‘রাত্রি’, পঙক্তি ১১) কিন্তু প্রয়োজন যদি ন্যায়সঙ্গত হত এবং কোনও অবিচারকে যদি ঘটতে না দিত, তা হলে মানুষ নিয়তি নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাত না। শাস্ত্র থেকে এর আগে যতগুলি উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তার অধিকাংশই তো নিয়তির বিচারশূন্য, যদৃচ্ছাচার ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে। লোভী ও মোহান্ধকে নিয়তি রক্ষা করে না, শুনলে সহসা মনে হতে পারে, নির্লোভ ও নির্মোহ মানুষকে নিয়তি রক্ষা করে। কিন্তু তা হলে নিয়তি তো ন্যায়বিচারক হয়ে যায়, কিন্তু সর্বত্র সর্বকালের সমস্ত শাস্ত্র জুড়েই এর প্রতিবাদ।
নিয়তিকে যুক্তিহীন, স্বেচ্ছাচারী, সাধুপীড়ক ও দুর্বৃত্তপোষক ভূমিকায় বারবার দেখা গেছে। কাজেই নিয়তির হয়ে এ ওকালতি সর্বাংশে মিথ্যা। নিয়তি বারে বারে অন্যায় রায় দেয় বলেই সে নিয়তি। যা প্রত্যাশিত, যুক্তিসংগত, বিচারসিদ্ধ ও ন্যায়পরায়ণ, তার সঙ্গে নিয়তির কল্পনা তো কোথাও মেলে না। তাই ওই সব উক্তি যেমন দুর্বল, তেমনই নিরর্থক। যেহেতু নিয়তি সজ্জনকে দুর্জনের প্রাপ্য দেয় এবং দুর্জনকে সজ্জনের, সেই কারণেই নিয়তি পরিমাপের অতীত, এত ভয়াবহ এবং ওই জন্যেই নিয়তি সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ সর্বদাই স্বতন্ত্র। ‘কাল’ আখ্যায় যে শক্তি শুধু এই সব অন্যায় শাস্তি ও দণ্ডের সাক্ষী মাত্র সেই নিয়তি তো কালের আড়ালে সমস্ত দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। কালের এই নির্লিপ্তি, এই মারাত্মক ঔদাসীন্যই একে নিন্দা-প্রশংসার অতীত করে তোলে; এবং নিয়তির এই প্রকৃতি সদয়ও নয় দুরভিসন্ধিও নয়। তবু নিয়তি যদি অদৃষ্ট হয়, সর্বশক্তিমান হয়, যদি এর সামনে পুরুষকার নিরর্থক হয়, তা হলে নিয়তিই বলি আর কাল-ই বলি, জীবনের অনার্জিত মূল অন্যায়গুলির দায়িত্ব তারই হয়। অধিকাংশ অতিকথায় নিয়তির এই ঔদাসীন্য এমন ভাবে বর্ণিত যে, নিয়তি মানুষের ব্যাপারে জড়িত নয় বলেই তাকে বেশি গৌরান্বিত রূপে দেখানো হয়েছে।
তবু শাস্ত্র নির্দেশ দেয় নিয়তিকে অনুকূল করার, তাকে উত্যক্ত না করার। শুধু এ থেকেই তো নিয়তির অসদভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিশেষত যখন তাকে উদীপ্ত করা যায়। সেই জন্যেই দুর্ভাগ্যবিরোধক এত নির্দেশ। নিয়তির এই অসম্পৃক্ত ঔদাসীন্য ভারতবর্ষে বস্তুত কর্মবাদের উপরেই প্রতিষ্ঠিত; এ হল কর্মের জন্মান্তরের অপরিশোধিত ঋণের অন্য একটি নাম। কাজেই মানুষকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় শুধু যে সব শাস্তি তার পাওনা বা স্পষ্টতই যা পাপ ও ত্রুটি, তার জন্যে নয়, এমনকী যে সব অপরাধের সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, যে সব পাপ সে পূর্বজন্মে করেছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, তারও জন্য। অতএব এই অত্যন্ত চতুর উপায়ে নিয়তি অথবা কাল এমন একটি অসম্পৃক্ত মধ্যস্থ বা সাক্ষীতে পরিণত হয় যা মানসিক ভাল মন্দ সম্বন্ধে পরম উদাসীন।
পূর্বেই মস্করী গোসাল নিয়তির সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেছিলেন। (দীঘনিকায় ২:২৬; ২:২০-২২, পৃ. ৫৬; উবাসগদসাও ১:৯৭:১১৫, ২:১১১:১৩২ পরিশিষ্ট ২, পৃ. ১৭-২৯, সংযুক্তনিকায় ৩:২১০, অঙ্গুত্তরনিকায় প্রথম খণ্ড পৃ. ২৮৬) এ সব মত পরবর্তী কালের বৌদ্ধগ্রন্থগুলি ধার করেছে, এগুলি এবং উপনিষদের ধারণাগুলি— যাতে অবশ্য নিয়তি উপস্থিত নয়, কিন্তু যা জন্মান্তর ও নিয়তিবাদের জন্যে জমি তৈরি করেছিল— উদ্দিষ্ট স্বার্থসিদ্ধির জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে।
কোনও কোনও চিন্তাপ্রস্থান প্রকৃতির ক্রিয়ার পরিসর বৃদ্ধি করবার প্রয়াসে নিয়তি ও নিয়তির ক্রিয়াকেও এর অন্তর্গত করেছেন, কিন্তু অধিকাংশ প্রস্থানই প্রকৃতি, ঈশ্বর ও দেবগণের থেকে নিয়তিকে পৃথক একটি শক্তি বলে মনে করেন। ‘…কেবল প্রকৃতি ও ঈশ্বরই অভিন্ন নয়, কিন্তু নিয়তিও এ দুটির সঙ্গে অভিন্ন। নিয়তি, সেনেকা বারবার বলেন, স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া কিছুই নয়… বিধাতা হল ঈশ্বরেচ্ছা: যে দিব্য ধারণা বা পরিকল্পনা ঈশ্বরের মনে আছে, যে পরিকল্পনা বিশ্বের স্থায়িত্বের জন্যে, সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের উদ্ঘাটন, তাদের সমষ্টি। নিয়তি হল অপরপক্ষে, প্রাথমিক ভাবে আইনশৃঙ্খলা, যে শৃঙ্খলা কালের সেই পরিকল্পনার উদ্ঘাটন যা পূর্বেই ঈশ্বরের মনে বিধান রূপে বিদ্যমান ছিল। বিধান হল নিয়তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে যা উদ্বৃত্ত থাকে সেইটুকুই, যার জন্যে অন্য ভাবে কাজ করতে হয়: এই উদ্বৃত্তটুকুই স্বাধীন ইচ্ছা ও দৈব। ‘সৌভাগ্য’ হল আমাদের উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়ার মধ্যে গণনার অতীত শুভ ব্যতিক্রম।’ (উইলসন ১৯৮৩, পৃ. ৫২,৫৪) নিয়তি ও বিধান যে একে অপরের বিকল্প তা সত্যি নয়; নিয়তি ভাল মন্দ দুই-ই হতে পারে, কিংবা আরও স্পষ্ট ভাবে বললে, নিয়তি প্রায় দুর্দৈব, কারণ সহসা যে শুভ ঘটনা ঘটে তাকে ‘সৌভাগ্যই’ বলা হয়। সৌভাগ্য আর বিধানও সমার্থক নয়; বিধানের একটি স্বতন্ত্র অনুষঙ্গ আছে, ঈশ্বরেচ্ছার সঙ্গে এর যোগ ঘনিষ্ঠতর, যেখানে সৌভাগ্য হল আকস্মিক।
ইসলামে নিয়তিবাদ সম্বন্ধে রিংগার্ন লিখছেন, ‘…অতিমানবিক স্তরে দ্বন্দ্ববাদ হল দিব্য ও আশুর প্রয়োজনের মধ্যে; মানবিক স্তরে (এ দ্বন্দ্ব হল) দিব্য ও মানবিক দায়িত্ব ও অপরাধের মধ্যে।’ রিংগার্ন, ১৯৬৭, পৃ. ৩১) ঈশ্বরবাদী বিশ্বাসসূত্রগুলি যেহেতু তৃতীয় কোনও শক্তির ক্রিয়ার জন্যে কোনও অবকাশ রাখে না, ঈশ্বর ও শয়তান, অহুর মাজদা ও অংগ্রমৈন্যু, আল্লাহ ও শয়তান, বুদ্ধ ও মার ছাড়া— তাই ধর্মতত্ত্বগত কোনও ফাঁকই থাকে না নিয়তির অনুপ্রবেশের জন্যে। এখানে বিরোধটি অনেক বেশি সরলরৈখিক: শুভ ও অশুভের মধ্যে, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির মধ্যে
আগেই দেখেছি, গ্রিসে নিয়তির বিভিন্ন দিকের প্রতিরূপ হিসেবে একটি বড় দেবমণ্ডলী ছিল। আপুলেইয়ুস তাঁর মেটামরফসিস-এ (দ্য গোল্ডেন অ্যাস, পেঙ্গুইন, ইংরেজি অনুবাদ) লেখেন ‘আইসিস নিয়তিকে জয় করেন, কিন্তু তিনি নিজেই নিয়তির ভূমিকা অধিগ্রহণ করেন…. মিশরেও দেবতারা ও ফারাও দেখা দেন, শুধু যে নিয়তির অধিকর্তা হিসেবে তা-ই নয়, নিজেদের নিয়তির সঙ্গে একাত্ম করেও।’ (পৃ. ৪৭) প্যারিসে একটি মিসরীয় প্যাপিরাস আছে, তার নাম ‘দেবাধিদেব নিয়তি’। সারা পৃথিবীতেই মানুষ দেবতাকে দেখেছে ‘নিয়তি-চক্র’ রূপে, যেটি যদৃচ্ছাক্রমে আবর্তিত হয়, অর্থাৎ এ এমন একটি শক্তি যাকে অন্য কোনও শক্তিই নিয়ন্ত্রণ করতে বা প্রতিহত করতে পারে না। আদিম সুমেরীয়দের প্রসঙ্গে এস এন ক্রামার এই সিদ্ধান্ত উপনীত হন, যে, ‘মানুষের জীবন অনিশ্চয়তাসংকুল এবং নিরাপত্তার অভাবে বিপর্যস্ত, কারণ দুয়ে দেবতারা কোন ভাগ্য নিরূপণ করেছেন তা সে আগে থেকে জানত না।’ (১৯৬৩, পৃ. ১২৩) যেহেতু সুমের পৃথিবীর আদিমতম সভ্যতাগুলির একটি, তাই সেখানে অনির্দেশ্য ও দুষ্প্রতিরোধ্য নিয়তির এই রকম উপস্থিতি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সুমেরের দেবমণ্ডলী বৃহদায়তন এবং প্রায় সকলেই ভাগ্যের প্রতিভু রূপে কাজ করেন। নিয়তি ও দেবতাদের মধ্যে যে দ্বৈততা কিছু অতিকথায় পাওয়া যায় তা এখানে নেই। হোমারের সমকালীন গ্রিক অতিকথায় এবং ভারতবর্ষেও কিছু দেবতা নিয়তির ভূমিকায় সক্রিয় ছিলেন। গ্রিক ও ভারতীয় অতিকথার পার্থক্য হল, গ্রিসে সাধারণ দেবমণ্ডলীর বাইরে নিয়তিবাচক স্বতন্ত্র একাধিক দেবতা ছিল। দুটি অতিকথাতেই দু’শ্রেণির দেবতা, নিয়তি ও অভিজাত দেবমণ্ডলী সহাবস্থান করেন এবং পরস্পরকে প্রভাবিত করেন।
লক্ষণীয় হল, নিয়তি সেই সব ঘটনার আর একটি নাম যেগুলির প্রাকৃতিক বা সাধারণ যুক্তিগত ব্যাখ্যা মেলে না। ‘প্রাচীন ইংরাজী’ কাব্যে wyrd (হ্রিদ) শব্দটি নিয়তিরই প্রতিশব্দ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বেওউলফে এমন বহুতর নিদর্শন পাওয়া যায়, যেখানে হির্দ শব্দটি দিয়ে দুর্ব্যাখ্যা শক্তি ও ক্রিয়াকে অনুবাদ করা হয়েছে সর্বস্বীকৃত ভাবে ‘নিয়তি’ দিয়ে। ‘নিয়তিকে (ত্বির্দ) যে ভাবে যেতে হবে ঠিক সেই ভাবেই নিয়ে যাবে।’ (পঙক্তি ৪৫৫) অর্থাৎ জ্বির্দের গতি গণনার বাইরে, এটি স্বতন্ত্রচারী ও অগম্য। ‘প্রাচীরের ধারে আমাদের দুজনেরই তা-ই হবে যেমন হ্রিদ, বিধাতা সর্বমানবের শাসক চাইবেন।’ (পঙক্তি ২৫:২৬) আবার, ‘…নিয়তি (হূিদ) আমার বীর যোদ্ধা সব আত্মীয়জ্ঞাতিকে মুছে দিয়েছে, যেমন ভাগ্যের নিদর্শন ছিল।’ (পঙক্তি ২৮:২৪) স্পষ্টতই (তির্দ) ভাগ্যের হাত ধরেই কাজ করে অথবা উভয়েই একই শক্তির প্রতীক। শেষ উদ্ধৃতিতে দেখি যোদ্ধাদের বীরত্ব কোনও কাজেই এল না, তারা নিহত হল, কারণ এটাই ভাগ্যের অভিলষিত ছিল, তাই হূিদ তাদের মুছে দিতে পারল। এই তির্দ শব্দটি ম্যাকবেথ-এ ‘হুইয়র্ড’ ভগিনীত্রয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। মধ্যযুগের শেষ প্রান্তে স্থানীয় ডাকিনীবিদ্যা এ বোধটিকে কতকটা রঞ্জিত করেছে, কিন্তু ম্যাকবেথ-এর এই তিন বোন রাজার ভবিষ্যৎ, সেই সঙ্গে— তাঁর উত্তরাধিকারী এবং ভাবী রাজবংশ এবং দেশের ভবিষ্যৎও অভ্রান্ত ভাবে বলে দিচ্ছে। তারা যেমন বলেছিল বা পেয়েছিল সবই ঠিক তেমনই ঘটেছিল। ‘হুইয়র্ড’ শব্দটির পরবর্তী, এবং বর্তমান অর্থ হল ‘অদ্ভুত’, অজ্ঞেয়, অপ্রত্যাশিত; এটি ঐ তির্দ শব্দটিরই ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তনে সজ্ঞাত; ‘প্রাচীন ইংরেজি’র হৄির্দ বিমূর্ত, অজ্ঞাত ও অশুভ অনুষঙ্গ বহন করে।
সব ধর্মেই নিয়তি দুয়ে, যেমন রিংগার্ন বলেন আরব নিয়তিবাদ প্রসঙ্গে। ‘মানুষ নিয়তির গুপ্ত সংবাদ জানতেই পারে না।’ (১৯৫৫, পৃ. ১২৭) ‘মহম্মদ স্বর্গে রক্ষিত কিছু গ্রন্থের সম্বন্ধে বলেন, শেষ বিচারে ব্যবহার করার জন্য মানুষের কর্ম সম্বন্ধে এমন কিছু তত্ত্ব সেখানে লেখা আছে।’ (হেস্টিংস এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিক্স ‘ফেট’) এর সঙ্গে মেলে অর্বাচীন ভারতীয় পুরাণে কল্পিত চিত্রগুপ্তের বর্ণনা, যে মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসেব লিখে রাখে। প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে ও জোরাষ্ট্রীয় ধর্মে, মৃতের আত্মাকে ওজন করে নির্ধারণ করা হয় তার ভবিষ্যৎ কী হবে, তার প্রাপ্য কী। সম্ভবত খ্রিস্টীয় সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের স্মৃতিশক্তি প্রখরতর, বিনা দলিলেই তিনি সৃষ্টির আদিপর্ব থেকে আবহমান কাল মানুষ যা করেছে, তার শেষ বিচার করেন। সেই শেষ বিচার সম্পর্কে সব ধর্মের লোকেরাই একটা আশঙ্কা ও আতঙ্ক নিয়ে বাস করে, পরলোকে তার কী গতি হবে এই ভেবে!
কিন্তু ভারতীয় শাস্ত্র মৃত্যুর পরেও আত্মাকে তার ভবিষ্যৎ গতি সম্বন্ধে অজ্ঞানের অন্ধকারে রাখে; সে শুধু তার আসন্ন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেই জানতে পারে— সুদূর ভবিষ্যতে আত্মা কোন লোকে বাস করবে, কী আকৃতি ও প্রকৃতিতে, এ সবই তার কাছে অজ্ঞাত থাকে। নিয়তি তার কাছে গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন। শুধু যে মৃত্যুর পরের ভবিষ্যৎ তার অজানা, তা-ই নয়, পরবর্তী জন্মগুলি আছে কিনা, থাকলে ক’টি, এবং সেগুলি কী ধরনের হতে চলেছে তা-ও তার অজানা। বায়ু পুরাণে তো স্পষ্টই বলে, ‘(মৃত্যুর পরে কী হয়) তা জানা সম্পূর্ণ অসম্ভব, দার্শনিকরাও তা জানেন না, সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই।’ (৫৫:৬৩) যম বা ধর্মকে সাবিত্রী মৌলিক প্রশ্ন করেন, ‘সেই ধর্মটি কী, তা এমন কেন হয়, তার কারণ কে? আত্মা তার কে, দেহই বা কী? এখানে কর্মের কর্তা কে?’ (দেবীভাগবত পু ৯:২৪:২) যম এ সবের কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। মৌলিক সত্যই যেখানে নেই, সেখানে মানুষের নিয়তি নিয়ে তত্ত্বালোচনা সম্পূর্ণ নিষ্ফল।
যুধিষ্ঠির যখন সর্বনাশা পাশা খেলায় লিপ্ত, তখন বলেন, ‘আমি নিয়তির অধীন’ 1 (মহাভারত ২:৫৩:১৩) কলি নলের শরীরে প্রবেশ করে তাকে নিজের সর্বনাশ করতে বাধ্য করছে। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের পক্ষে সেটুকু আড়ও নেই। স্বয়ং ধর্মপুত্র, সর্বত্র সম্মানিত তাঁর ধর্মাচরণের জন্যে, ধর্মবুদ্ধির জন্যে, তিনি এই মহাপাতকের জন্যে দোষ দিচ্ছেন দৈবকে! তিনি জানতেন যে, তাঁর বিরত হওয়া উচিত ছিল, সম্ভবও ছিল; ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তিনি এটা করতে পারতেন। যে খেলায় তাঁর কোনও দক্ষতা ছিল না তার দ্বারাই তিনি মহাপ্রলয়ের বীজ বপন করলেন; মহাভারতের যুদ্ধের বিপুল লোকক্ষয়। তিনি নিজের সিদ্ধান্তের দায় দৈবের ওপর চাপাচ্ছেন এবং নিজের যথার্থ দায়িত্ব অস্বীকার করছেন, মরিয়া হয়ে আত্মদোষ অস্বীকার করতে চাইছেন। পাঠক শ্রোতা তাঁকে ক্ষমা করে না; এই মহাসর্বনাশের দায় তাঁরই। ‘দেবতারা যাকে ধ্বংস করতে চান, আগে তাকে বুদ্ধিভ্রষ্ট করেন।’ যুধিষ্ঠিরের তাই হল, যদিও পুরোপুরি নয়, কারণ তাঁর ধর্মজ্ঞতা ও বিচারবুদ্ধি দিয়ে তিনি অন্যের চেয়ে তীক্ষ্ণ ভাবেই ভালমন্দ বুঝতে পারতেন।
দৈব যে অ-দৃষ্ট, নিয়তি, পূর্বনিরূপিত, এটা মানলে মানুষ তো সহজেই অস্বীকার করবে যে, বিশ্বসংসারে কোনও অন্তর্নিহিত ন্যায়বিচার আছে। রাবণ যখন সীতাহরণ করে লোকে বলল, ‘ধর্ম (ন্যায়বিচার) নেই, সত্য কোথায়, সদাচরণ বা করুণাই বা কোথায়? রাবণ যদি বৈদেহীকে হরণ করতে পারে তো এ সব কিছুই নেই।’ (রামায়ণ ৩:৫২:৩৯ )
দুর্জ্ঞেয়েতা সম্বন্ধে মহাভারত-এ আরও বেশি উক্তি আছে নিয়তির:
‘জীব অজ্ঞান, তার সুখদুঃখের পরে তার কোনও কর্তৃত্বই নেই; স্বর্গ বা নরক, যেখনেই দেবতা তাকে পাঠান সেইখানেই সে যায়।’ (৩:২:২৭ লোকচলিত সংস্করণ) ‘মানুষের শরীর একটা নিমিত্তমাত্র, ঈশ্বরের সৃষ্টি একটি ক্ষেত্র, যা দিয়ে ঈশ্বর ভাল-মন্দ কাজ করেন।’ (৩:৩১:৩০) ‘স্বয়ম্ভূ পিতামহ দেব ব্রহ্মা জীবকে দিয়েই জীব সংহার করেন, ছলনা করে।’ (৩:৩১:৩৫) এ-মনোভাবে সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ে ঈশ্বরের ওপরে, এ ভাবে মানুষ নিজের নৈতিক নির্বাচনের দায়িত্ব এড়িয়ে যায় এবং যন্ত্রে পরিণত হয়, যে যন্ত্রটি ঈশ্বর তাঁর খুশি মতো চালান। আর এক জায়গায় পড়ি, ‘কর্ম যদি কর্তাকে অনুসরণ করে তবে ঈশ্বর পাপকর্মের দ্বারা দূষিত হন।’ (৩:৩১:৪১) ‘কৃত কর্ম যদি কর্তাকে অনুসরণ না করে তা হলে কারণটি শক্তিশালী; দুর্বল মানুষকে লোকে করুণাই করে।’ (ওই ৪২) ‘পাপ বা পুণ্য কর্মের ফল, উৎস এবং বিলয় এ সবই দেবতাদের গুপ্ত তথ্য। (কিংবা দেবতাদের কাছে গুপ্ত তথ্য)।’ (৩:৩২:৩৩) ‘লোকে বিভ্রান্ত হয় কারণ (নিয়তি) কালরূপে তাদের হৃদয় আচ্ছন্ন করে।’ (৯:৬২:৪৫) নিয়তির অদৃশ্য শক্তি কালরূপে নিজেকে প্রকাশ করে, কারণ বলা হয়, এই শক্তিই অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয়রূপে কর্মের বিপাক ঘটায়। এই ‘কাল’ তাহলে নিয়তি থেকে অভিন্ন। দুর্যোধনের মৃত্যুতে গান্ধারী বলেন, ‘দেখ, কালের গতি ও বিলয়।’ (৯:১৭:১০) কেন তাহলে ঈশ্বর এমন ঘটতে দেন? কেন তিনি পুণ্যবানকে কষ্ট পেতে দেন ও পাপীকে সুখভোগ করতে দেন? মহাকাব্যের উত্তর হল, ‘বালক যেমন খেলনা নিয়ে খেলা করে তেমনই ঈশ্বরও মানুষকে নিয়ে খেলা করেন।’ (ঐ ৩৬) অর্থাৎ ঔদাসীন্য, উপেক্ষা। ‘দুরন্ত বালকের কাছে মাছি যেমন/আমরাও দেবতাদের কাছে তেমনই/তাঁরা ফূর্তির জন্যে আমাদের হত্যা করেন।’ (কিং লিয়ার ৪র্থ অঙ্ক ১ম দৃশ্য পঙক্তি ৩৬-৩৭) এটি নাস্তিক্যবাদী বা একেশ্বরবাদী মতও নয় (যেখানে ঘড়ি থাকা মানে নির্মাতা আছে, অতএব সৃষ্টিই স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ, এমন মত পোষণ করা হয়) কিন্তু এখানে ঈশ্বর সজ্ঞানে সক্রিয়, দায়িত্বহীন ভাবে খেয়ালখুশি মতো খেলা করছেন মানুষের ভাগ্য ভবিষ্যৎ নিয়ে, তাঁর নিজের সৃষ্ট মানুষের সুখদুঃখ নিয়ে উদাসীন আমোদ করছেন।
মহাভারত-এ একটি অনন্য উক্তি আছে:
‘ঈশ্বর নিজে কর্তা, বা পৃথিবীতে বিদ্যমান দৈব, অথবা কর্মফল— ভাল ও মন্দ সব কিছুই ঈশ্বরনির্মিত। মানুষ তার কর্ম করে, ফল কিন্তু ঈশ্বরে আরোপিত। কৌন্তেয়, এ তো ঠিক নয় যে, একজনের কর্মের ফল অন্যের ওপরে আরোপিত হবে, তাই ঈশ্বরেই আরোপ কর। মানুষ পাপকর্মের অথবা পুণ্যেরই কর্তা হোক, তার বাইরে আর কিছু তো নেই, অতএব পুণ্য কাজই কর। রাজা, কোথাও কোনও মানুষকে নিয়তি থেকে সরিয়ে নেওয়া যাবে না। প্রায়শ্চিত্তের জন্যে কর্ম কিংবা শাস্ত্রসম্মত (কর্ম) সাধিত হলে মানুষে তা সংযুক্ত হয় না।’ (১২:৩২:১১,১২,১৪,১৬)
যেহেতু ঈশ্বর মানুষকে এই ভাবে কর্ম না করার জন্যে প্রেরণা দিচ্ছেন, সেহেতু কর্মকর্তা যে-ই হোক না কেন, দায়িত্ব ঈশ্বরেরই, মানুষের নয়। এতে মানুষের আপন কর্ম সম্বন্ধে নৈতিক দায়িত্ব চলে গেল, কিন্তু তার ফলে সে যন্ত্রমাত্রে পরিণত হল, তার স্বাধীন মনুষ্যত্বের গৌরব ক্ষুণ্ণ হল, কারণ মানুষ স্বতন্ত্র নৈতিক নির্বাচন করে তার মধ্যেই এই গৌরবটির মূল গ্রোথিত আছে।
ঋষি ব্রহ্মদত্ত এবং তাঁর স্ত্রী পূজনী নামে পাখিটির সংলাপে কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় আছে:
ব্রহ্মদত্ত: কাল স্বয়ং মানুষকে দিয়ে নানাবিধ কর্ম করায়; (মানুষ) কে প্ররোচিত করে কাল; কার কাছে জবাব দেবে কে? অগ্নি ইন্ধন পেলে যেমন তা জ্বালায় তেমনই কাল জীবকে দগ্ধ করে… কাল জীবের সুখদুঃখ নিরূপণ করে দেয়। (১২:৫০:৪৫,৪৬,৪৭) পূজনী: কালই যদি আপনার কাছে চূড়ান্ত রূপে প্রামাণ্য হয়ে, তাহলে রোগী ওষুধের জন্যে বৈদ্যকে ডাকে কেন? বিপাক যদি কালেই ঘটে তা হলে ভেষজ কী করে? কালকে নিয়ে যদি শপথ হয় তবে শাস্ত্রকারদের বিচার কেমন করে হবে? (১২:৫০-৫৩) পূজনী এখানে স্পষ্টতই বৃহস্পতি ও চার্বাকের মতের পুনরুক্তি করছে; কালের, ঈশ্বরের বা নিয়তির সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করছে। অর্থাৎ সে স্বামীকে মন ঠিক করতে বলছে, কর্মের দায়িত্ব কার— কালের মানুষ কর্মকর্তার। কাল যদি এমন সর্বশক্তিমান হয় তা হলে মানুষ পাপ বা পুণ্য কি করে তাতে কিছু এসে যায় না, কারণ শেষ দায়িত্ব তো কালেরই। তবু মানুষ চিকিৎসার জন্যে বৈদ্যের শরণাপন্ন হয় শুধু কালের ওপর ভরসা করে বসে থাকে না। সে তো বিশ্বাস করে: (১) কাল রোগনিরাময় করতে চায় না, পারে না ও করে না, (২) বৈদ্যের ভেষজে রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা বেশি, এবং (৩) নির্ণীত রোগের ভেষজশাস্ত্রসম্মত যুক্তিসংগত চিকিৎসা আছে। পূজনী দৃঢ় বস্তুবাদের ও সাধারণ বুদ্ধির প্রতিভূ, নিয়তির কাছে তার স্বামীর নিষ্ক্রিয় আত্মসমর্পণের ঠিক বিপরীত মেরুতে তার অবস্থান
নিয়তিকে সম্পূর্ণ দুজ্ঞেয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যা কিছু বুদ্ধিসংগত ব্যাখ্যার অতীত তাকে ব্যাখ্যা করার জন্যেই নিয়তির উদ্ভাবন। নিয়তির এই দুয়েতা সচেতন ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় রাখবার জন্যে, যাতে অনুসন্ধান স্থগিত থাকে এবং উদ্যত প্রতিবাদ নীরব ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সমাজে অন্যায় ভাবে অত্যাচারিতারা যাতে নিষ্প্রতিবাদে নিজেদের ভাগ্য মেনে নেয়।
‘নিয়তি সম্বন্ধে সাধারণের মধ্যে প্রচলিত ধারণা দৃঢ়মূল, কারণ এতে উদ্বেগ ও অনুশোচনা প্রশমিত হয়, আলস্য ও বুদ্ধিহীন আচরণ প্রশ্রয় পায়। ভবিষ্যদ্বাণী, ভাগ্য গণনা, বিশেষত জ্যোতিষ, নিয়তিবাদের পরিপোষক। কিন্তু যখন শোষণ, কিংবা এগুলির দ্বারা যে ভাগ্য নির্ণীত হয় তার সুযোগ নিয়ে ঘোষিত ভাগ্যের বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনও উদ্যোগ হয়, তখন সে উদ্যত প্রতিবাদকে (নিয়তিবাদকে) নিরস্ত করে, মানুষের সিদ্ধান্ত যাতে কার্যকর না হয় যাতে মানুষের সিদ্ধান্ত নিয়তিবাদের সঙ্গে কার্যকারণ-সম্পৃক্ত পূর্বনিরূপণবাদকে গুলিয়ে ফেলাটা দুর্ভাগ্যজনক। যা হোক, বিরলতর অন্তর্নিহিত পূবনিরূপণবাদ (যার অর্থ, প্রত্যেক ঘটনা যুক্তিগত ও ঘটনানিরপেক্ষ ভাবে প্রয়োজনীয়) থেকে যুক্তিসংগত নিয়তিবাদের ধারণা আসে।’(এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা, ‘ফেটালিজম’, পৃ. ৪৬) এই যুক্তিসংগত নিয়তিবাদই আজীবিক অর্থে খাঁটি নিয়তিবাদ: এই ধরনের নিয়তিবাদ মানবিক প্রয়াসকে নিষ্প্রয়োজন করে তোলে। সকল ধর্ম ও দর্শন প্রস্থানকেই কখনও না কখনও এক সম্মুখীন হতে হয়েছে। অতএব মানুষ বুঝতে পারল, নিয়তিবাদকে নিষ্প্রতিবাদে স্বীকার করলে তার মনুষ্যত্বের গৌরব খর্ব হয়ে যায়। শর্তসাপেক্ষ ভাবে নিয়তিকে স্বীকার করলে— জীবনের শুধু একটি মাত্র ক্ষেত্রে শুধু সেইখানেই স্বীকার করলে— মানুষ আরও বেশি মনুষ্যত্বের গর্ব ও সাহস নিয়ে সেই সব প্রতিকূল ঘটনার সঙ্গে সংগ্রাম করতে পারে, এর ফলে শুধু যদি মনুষ্যত্বের গর্বই রক্ষা করতে পারে— তাহলেও।
ক্লিফর্ড গীস বলেন, ‘মানুষ পাপাচরণ করলে আগে হোক পরে হোক জেউস তাকে শাস্তি দেন। সে কারণেই তিনি ন্যায়বিচারের দেবতা… এতে অবশ্য তাঁর আদিম এবং স্থায়ী মন্দতা বা অশুভেচ্ছার কোনও ব্যত্যয় ঘটে না। জেউস এর সর্বশক্তিমত্তাই হল আসল কথা এতে সর্বগ্রাসী এক আতঙ্কের উদ্রেক হয় এবং এর একমাত্র মূল হল যে, এই ভয়ই মনুষ্যসমাজে একমাত্র (নিয়ন্ত্রক ও) বাধা। দেবতাদের রোষ থেকে বাঁচো, তাঁদের থেকে নিজেদের রক্ষা কর যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান ও জাদুক্রিয়ার দ্বারা এবং আশার বিকল্প রূপে নিজেকে অহোরাত্র ধর্মানুষ্ঠানে নিরত রাখো। এই হল আমাদের প্রতি হেসিয়ডের পরামর্শ… পুরনো অর্থে নিয়তিবাদের অবকাশ এতে সামান্যই। নতুন নির্দেশনাগুলি— এবং এগুলি বহু সংখ্যক— প্রকৃতি এবং সমস্ত কাঠামোটিই একটি অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যক উপাদানরূপে মানুষের অন্তর্নিহিত বুদ্ধিকে স্থান দেয়।’ (১৯৭১, পৃ. ১৩৫)
হেসিয়ডের মতে প্রাগ্-ধ্রুপদী গ্রিসের প্রধান ভাগ্যদেবতা জেউস মানুষের প্রতি অসদুদ্দেশ্য পোষণ করেন। তাঁকে প্রসন্ন করার জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজন, মানুষের একাগ্র প্রয়াস। কালে অন্য দেবতারা মানুষকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ক্ষতিকর ইচ্ছাটিকে মানুষের ওপরেই অর্পণ করেন। ততদিনে পুরস্কার ও সৌভাগ্যের সূচকরূপে নিয়তির একটি প্রতিরূপ গড়ে উঠেছে, যা মানুষকে তার সৎকর্মের ফল দেয়। কিন্তু মূলত গ্রিক অতিকথা দেবতা ও মানুষের মধ্যে একটি সম্পর্ক দেখতে পায়— মন্দতম অভিপ্রায় হল শত্রুতা এবং শুভতম হল ঔদাসীন্য। কাজেই নিয়তি এমন এক শক্তি যার বিরুদ্ধে মানুষ নিজে একান্ত অসহায় বোধ করেছিল, কিন্তু তৎসত্ত্বেও অবিরত সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিল, মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্যে। গ্রিক ধ্রুপদী সাহিত্যেও এটি প্রতিবিম্বিত। প্রখ্যাত গ্রিক নাটকগুলির প্রারম্ভেই আমরা জানতে পারি, নায়কের বিরুদ্ধে যে শক্তিসমূহের সমাবেশ, নায়কের চেয়ে সেগুলি অনেক বেশি শক্তিমান কাজেই পরিণাম সম্বন্ধে সূচনা থেকেই কোনও সংশয় থাকে না: নায়কের পরাজয় অবধারিত। তবু গ্রিক নাটক সাহিত্য মূল্যে জীবনবোধের পুনর্মূল্যায়নের নিরিখে অনন্য, কারণ পরাজয় ধ্রুব জেনেও নায়ক আপন পুরুষকারের গৌরব রক্ষার জন্য আমরণ সংগ্রাম করে চলে।
কখনও কখনও সমাজ বিশ্বজাগতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার পুঞ্জীভূত তপ্তবাষ্পমোচন করে এবং তখনই দেখা দেয় প্রশমক ধর্ম। সামাজিক জীবন যখন গভীর ভাবে খণ্ডিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় তখন ধর্মীয় প্রশমক অনুষ্ঠান আচরিত হয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিতে নিহিত একটি বোধ থাকে যে, কোনও একটি পরিমাণে মৌলিক সংহতি থাকা প্রয়োজন এবং বিরোধগুলিকে নিরস্ত হতেই হবে, যদি সমাজজীবনকে প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই অগ্রসর হতে হয়।’ (হুর্সলে, ১৯৬৮, পৃ. ২৪৬, ২৫৭) এই ধরনের প্রশমক ধর্মগুলিও আসন্ন প্রতিকার ও সুখের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই বিশ্বাসে (কার্গো কাল্টস) মৌলিক ব্যর্থতাবোধের প্রকাশ এবং সমাজ যে সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিকার করতে অক্ষম এবং/বা অসম্মত, সেগুলির সংশোধনের জন্যে একটা যেন মরিয়া চেষ্টা এ ধরনের বিশ্বাসপ্রস্থানে দেখা যায়। এই কার্গো কাল্ট বা অন্য ধরনের প্রশমক ধর্মে অন্তর্নিহিত থাকে একটি চেতনা, যে মানুষের চারপাশে যা ঘটছে তা গুরুতর ভাবে অন্যায় এবং সমবেত প্রচেষ্টায় এর এটি সৌষম্যবিধান আশু প্রয়োজন। প্রশমক ধর্মে এই প্রতিকার আসে কোনও অতিলৌকিক শক্তিস্থান থেকে। অপরপক্ষে এ উদ্দেশ্যে মানবিক প্রয়াসের নামই পুরুষকার। নিয়তির দুর্জয় শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ অবিচারের ওপরে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সুবিচার আদায় করবার চেষ্টায় ব্যাপৃত হয়।
ধর্ম, বিশেষত বহু দেববাদী ধর্মগুলি, সর্বত্রই নিয়তিকে স্থান করে দিয়েছে বিশেষ কোনও দেবতার অধিকারভুক্ত এলাকা হিসেবে, অথবা এমন দেবদেবী উদ্ভাবন করেছে, যাঁরা নিয়তির প্রতিনিধি হয়ে তারই কাজ করেন। পুরোহিত, ভবিষ্যদ্বক্তা, শাস্ত্রকার, নীতিগ্রন্থকার চেষ্টা করেছে মানুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে, যার শাস্তি একেশ্বরবাদীর ঈশ্বর এ জন্মে ও পরলোকে নরকে দেন, আর অধিকাংশ প্রাচীন বহু দেবদেবী ধর্মের নিয়তির বিভিন্ন দিব্য কল্পমূর্তিকে দেবতারা পৃথক দেবরূপে গ্রহণ করে, অযাচিত শাস্তি বা পুরস্কার তাঁরাই দেন, এ জন্মে অথবা অন্য কোনও পরবর্তী জন্মে। ব্রাহ্মণ্যধর্মে সঞ্চিতকর্ম, যার গুণগত মান বা পরিমাণ কর্মকর্তার অজ্ঞাত, তা-ই দুজ্ঞেয় রহস্যে আবৃত হয়ে নিয়তির ভূমিকা গ্রহণ করে। স্বাভাবিক ভাবেই পুরোাহিত ও শাস্ত্রকারদের শিক্ষা মানুষের মনের মধ্যে এই বোধটি দৃঢ় ভাবে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করে যে, নিয়তির অজ্ঞেয় রহস্যের জাল বিদীর্ণ করা মানুষের সাধ্য নয়, এবং আরও সাংঘাতিক হল এই যে, নিয়তির সিদ্ধান্ত খণ্ডন করার কোনও সাধ্য মানুষের নেই।
মানুষের প্রয়াসের শাস্ত্রীয় প্রতিশব্দ হল পুরুষকার: অর্থাৎ পুরুষ যা করে। দৈব ও পুরুষকারের আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্বন্ধে দীর্ঘ বিস্তৃত জটিল একটি তত্ত্বগত বিরোধ আছে। জাতকের সেই গল্পটি মনে পড়ে। একটি মৃত মুষিক মাত্র মূলধন করে একজন সাধারণ মানুষ কী ভাবে অত্যন্ত ধনী হয়। (৪ সংখ্যক, চুল্লসেঠি) যতই অবিশ্বাস্য ও রূপকথাধর্মী মনে হোক না কেন, এ কাহিনির প্রতিপাদ্য হল পুরুষকারের আপাত ভাবে অকল্পনীয় শক্তি। রামায়ণ-এ বিশ্বামিত্র তাঁর ব্রাহ্মণ গুরুপুত্রের দ্বারা অপমানিত হয়েছিলেন, প্রচণ্ড ক্ষোভে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, দৈবই সর্বশক্তিমান, পুরুষকার নিরর্থক। দৈব সব কিছুর ওপরে।’ (১:৫৮:২২,২৩) কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, ওই ক্ষত্রিয় বিশ্বামিত্রই ব্রাহ্মণ ও অন্যদের দ্বারা প্রতিহত ও সংরুদ্ধ হয়েও হাল ছেড়ে দেননি। সুদীর্ঘকাল তপস্যা করে শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন, যার অভাবে তাঁর মনুষ্যমর্যাদা পূর্বে চূর্ণিত হয়েছিল। এ নয় যে, ব্রাহ্মণত্ব লাভ করাটাই পরম পুরুষার্থ বা বিশেষ কোনও গৌরবের ব্যঞ্জক, কিন্তু অব্রাহ্মণ হওয়াতে যদি হীনতা ও অপমান আসে তবে স্বাভাবিক ভাবেই আহত মানুষটি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে ব্রাহ্মণ জগৎকে বলবে যে পুরুষকারেরও ক্ষমতা কম নয়। যখনই কোনও মানুষ তার প্রাপ্য মর্যাদায় বঞ্চিত হয় সে দৈবকে দোষ দেয়।
রামায়ণ-এ লক্ষ্মণ রামকে ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘কেন আপনি দুর্বল, হীন দৈবের প্রশংসা করেন?’ (২:২৩:৭) ওই ভাবেই তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি অসমর্থ অথবা যার শৌর্যের অভাব আছে, সে দৈবের অনুগামী হয়। যারা বীর ও আত্মমর্যাদাবাদ তারা কখনওই দৈবকে পূজা করেন না।’ নিজ পুরুষকারের দ্বারা দৈবকে প্রতিহত করতে যে সমর্থ, সে কখনও নিরুদ্যম হয় না। আজ (লোকে) দেখবে দৈবের ও মানুষের ক্ষমতা, দৈব ও পুরুষকারের আপেক্ষিক মর্যাদা আজ প্রকাশিত হবে। আজ সর্বলোকে দেখবে আমার শৌর্যে দৈব চূর্ণিত, তারা দৈব-নিরুদ্ধ এই অভিষেক (আজ) দেখতে পারে। আজ আমি, মদমত্ত যে হস্তি আপন শৌর্যে কণ্টক, অঙ্কুশ ও শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলেছে তার মতো দৈবকে প্রতিহত করব।’ (২:৩৬:১৬-২০) পরে রাম যখন সীতার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদে হতোদ্যম ও নিরাশ, তখন লক্ষ্মণ রামকে উপদেশ দেন, দৈব ও পুরুষকারের সম্বন্ধে; দুর্বল ক্লীবের মত ধর্ম শক্তির পশ্চাতে চলে। আমার বিশ্বাস যে দুর্বল প্রাণ, যে সম্মান হারিয়েছে, এমন কারওর সেবা করা উচিত নয়। ধর্ম যদি শৌষের কাছে পরাস্ত হয়, তা হলে মানুষের উচিত ধর্মকে পরিহার করে শক্তিরই সেবা করা।… যে ধর্ম অন্যায়ের শরণাগত, তা বিনষ্ট হয়। সব ব্যাপারেই মানুষ যেমন ইচ্ছা করে তেমনই আচরণ করে।’ (৬:৮৩:২৬-২৮,৩০)
রামায়ণ-এর অন্যান্য চরিত্রের তুলনায় লক্ষ্মণ সমধিক ভাবে মানবিক মর্যাদার প্রতীক, যে মর্যাদাকে তিনি ‘পুরুষকার’ বলেন। তিনি বুঝতে পারেন না, অথবা জানতে চান না, কেন কোনও সুস্থ পুরুষ নিষ্প্রতিবাদে দৈবের নির্দেশ মেনে নেবে। এ যুক্তির একটা সূক্ষ্ম দিক আছে: দৈব শক্তিমানের অনুগামী হয়। অর্থাৎ, বীরত্বপূর্ণ কর্মের দ্বারা যখন সিদ্ধিলাভ করা যায়, লোকে মনে করে ভাগ্যের দ্বারাই সেটা ঘটল, এতে মানুষ তার পুরুষকারের ন্যায্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়। লক্ষ্মণের মতে দৈবের কাছে আত্মসমর্পণ করা কাপুরুষতা যেটা প্রায়শ সে করতে পারে তা না করে নিষ্প্রতিবাদে হাল ছেড়ে দিয়ে দুঃখকষ্টের জন্য দৈবের দোষ দেওয়াও কাপুরুষতা। রামের সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার মনোবৃত্তির পাশে লক্ষ্মণ একটি সুস্থ প্রতিবাদ। প্রকৃতপক্ষে দুটি মহাকাব্য ও পুরাণগুলিতে এবং সাহিত্যের অন্যত্রও দৈব ও পুরুষকারের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এখানে লক্ষ্মণ পুরুষকারের প্রতীক, রাম দৈবাধীনতার। সীতাহরণের পরে, লক্ষ্মণের ওপরে শক্তিশেল নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরে, রাবণ রামকে মায়াসীতা দেখানোর পরে সর্বদাই রাম অতি দ্রুত হতোদ্যম হয়ে সামান্যতম বিরুদ্ধতায় সব দুঃখের জন্য দৈবকেই দায়ী করতে উদ্যত হন।
মহাভারত যে শুধু আকৃতিতেই রামায়ণের চতুর্গুণ তা নয়, আত্মিক বিষয়গুরুত্বেও এটি বহুগুণ মর্যাদার দাবি রাখে। যে পরিবেশে নিয়তিবাদ সমাজের বাতাসকে ব্যাপ্ত করে ছিল, সেখানে জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কিত যে কোনও অনুসন্ধানেরই অন্তর্ভুক্ত হবে নিয়তি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা। সেই কারণে মহাভারত-এ দৈব ও পুরুষকার সম্বন্ধে অনেক বেশি উল্লেখ আছে। দুর্যোধন বলেন, ‘আমার মনে হয়, দৈবই সর্বাভিভু, পুরুষকার নিষ্ফল।’ (১:১৯২:১২) ‘কেউ কেউ বলে এ সবই ভাগ্য বা দৈবের দ্বারা সিদ্ধ, কেউ বা বলে পুরুষকারের দ্বারা, আবার অন্যরা তিনটিকেই দায়ী করেন।’ (৩:৩৩:৩৪) যুক্তির দিক থেকে এ অবস্থান সিদ্ধ নয়, কারণ দৈব যদি দায়ী হয়, কর্ম তা হলে বাহুল্যমাত্রে পর্যবসিত হয়। অতীত ও বর্তমান কর্ম যদি মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে তা হলেও দৈববাদ নিষ্ফল হয়। এবং শেষত, ঈশ্বর যদি মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করেন তা হলে দৈববাদ, কর্মবাদ দুই-ই নিষ্প্রয়োজন হয়ে যায়। কাজেই এ যুক্তি অন্তর্বিরোধে জর্জরিত। কিন্তু অধিকাংশ ঈশ্বরবিরোধী ধর্মতত্ত্বই নিয়তি, ঈশ্বর এবং/বা কর্মকে একত্রে সংহতি দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু এ-তো যুক্তিভ্ৰষ্ট দুশ্চেষ্টামাত্র। এর সঙ্গে যখন পুরুষকার যুক্ত হয় তখন ছকটি আরও জটিল হয়ে ওঠে। তখন পুরুষকার যুক্তিসঙ্গত আত্মনির্ভরশীল প্রয়াস হয়ে ওঠে, যা পূর্বজন্মের কর্মের থেকে বিশ্লিষ্ট এবং পরজন্মের জন্যে কোনও সঞ্চয় রাখে না, যা নিজের জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় দৈব বা ঈশ্বর-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র প্রয়াস। এ তিনটিকেই একটি কাঠামোতে ভরে দেওয়ার চেষ্টা সম্পূর্ণ নিষ্ফল। ‘যা কিছু মানুষ একটি উদ্দেশ্য নিয়ে করে তা সবই ফলবান হয়, যদি না অতীতে (তার বিরোধী) কিছু থেকে থাকে।’ (৩:৩৩:৩৪) বারেবারেই উচ্চারিত হয়েছে, ‘দৈবের বিরুদ্ধে কে কী করতে পারে, দৈবই সর্বশক্তিমান, পুরুষকার সম্পূর্ণ নিষ্ফল।’(৩:১৮/৭৬:২৭) ‘পাপ বা পুণ্যকর্মের কর্তা মানুষই, যখন কর্মের ফলোদগম হয়, তখন সে-ই তা ভোগ করে, ঈশ্বরকে কেন কর্তা বলে মনে করা হবে?’ (৩:১৮০:৫)
কখনও কখনও সাধারণকৃত বাক্য অনাবশ্যক ভাবে সরল হয়ে যায়: ‘যখনই কোনও লোক ভাল কিছু করতে চায়, তখন প্রত্যেকবারই তার সব প্রয়াসই সার্থক হয়।’ (৫:৩৫:৩৪) কিন্তু তেমনই কখনও কখনও চিন্তাসিদ্ধ পরিণত অভিজ্ঞতার কথাও খুব সরল ভাবেই প্রকাশিত হয়েছে, যেমন, ‘এ জগতের মূল দৈবে ও মানুষে প্রোথিত। কিন্তু আমি যা করব তা পুরুষকার দিয়েই করব, আমি দৈব দিয়ে কিছু করতে অসমর্থ।’ (৫:৭৭:৪,৫) বক্তা এখানে কৃষ্ণ কিন্তু এই বিশেষ প্রসঙ্গে তিনি দেবতা হিসেবে কথা বলছেন না।
‘সব মানুষই সীমাবদ্ধ (বা নিরুদ্ধ), এই দু (ধরনের) কর্ম নির্ভর করে দৈব ও পুরুষকারের ওপরে, তার ওপরে কিছুই নেই। কর্ম কেবল দৈব দ্বারা সিদ্ধ হয় না… শুধু প্রয়াসেও নয়। সিদ্ধি নির্ভর করে এ দুটি সংযোগের ওপরে।’ (১০:২:২,৩) ‘এ দুটির মধ্যে দৈবকে সে (দৈব বলে) চিনে নিলে তা স্বনির্ভর; বুদ্ধিমানরা দক্ষতার বলে পুরুষকার প্রয়োগ করে। সংসিদ্ধ পুরুষকারও একমাত্র দৈবের দ্বারাই সার্থক হয়, তখন কর্মফল কর্মকর্তার অনুসরণ করে। ভাগ্যের সাহায্য ছাড়াই কুশলী ব্যক্তিদের অভ্যুত্থান যদি (তাদের কর্মে) সিদ্ধ হয়, তবুও তাঁদের কর্মফলের উদয় হয় না।… পৃথিবীতে অধিকাংশ কর্মই নিষ্ফল, অকৃত কর্ম দুঃখ আনে; কর্মের সুফল হওয়া উচিত। যখন উপযুক্ত প্রয়াস বিনাই কর্তার ইচ্ছা মতো কিছু সিদ্ধ হয় এবং যে কর্ম করেও ফল পায় না— এ দুজনেই দুর্ভাগ্য। মানুষিক সাহায্য এবং দৈবের সহায়তা, এই দুটি কারণ ব্যতিরেকে জীবনে উন্নতি (করার প্রয়াস) নিষ্ফল হয়।’ (১০:২:৮, ১০,১১,১৩,১৪,১৯) ‘প্রয়াসের একটা বিশেষ গুণ হল যে বয়োবৃদ্ধরা তার সমর্থন করবেন।’ (১০:২:২২,২৩) ‘কোনও মানবিক চেষ্টাই দৈবের ঊর্ধ্বে নয়।’ (১০:৬:২৫) অতএব, মানুষের প্রযত্ন করা উচিত, (কারণ) অলসের সিদ্ধি নেই।’(১২:১৩৭:৭৫) নিয়তি ও পুরুষকার পরস্পরকে আশ্রয় করে থাকে।’(১২:১৩৭:৭৮) ‘ক্ষেত্রে উপ্ত না হলে বীজ যেমন নিষ্ফল হয় তেমনই পুরুষকার বিনা দৈব নিষ্ফল।’ (১৩:৬:৭) এমনই আর একটি উক্তি হল ‘পুরুষকার ছাড়া নিয়তি বন্ধ্যা।’ (১৩:৬:২৫)
কর্ম, দৈব, ভগবৎকৃপা ও পুরুষকার— এগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্বন্ধে এত যে মতবৈচিত্র্য তার কারণ, এগুলি হল প্রাচীন যুগের শেষে ও মধ্যযুগের আদিতে মানুষের বহুতর বিশ্বাসের নোঙরের প্রতীক। ঐকমত্যের অভাব খুবই প্রতীকি: মানুষ জীবনের তাৎপর্যের সন্ধান করেছে, অনুকূল ও প্রতিকূল ঘটনাবলির অর্থ খুঁজছে, বিভিন্ন যুগে এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে। অনুসন্ধিৎসুদের মানস-গঠন ভিন্ন, তাই তাঁদের সিদ্ধান্তও ভিন্ন। খুবই স্পষ্ট করে যা প্রতিভাত হয়, তা হল ওই বৈচিত্র্য— যে সমান সত্যকার সমস্যায় স্পন্দিত হচ্ছে, যে সমস্যার সমাধান তারা শুধু উৎসুক ভাবে নয় জীবনমরণ-সমস্যার মতো করেই খুঁজছে— সে সমাজের আন্তর স্বাস্থ্যের লক্ষণ এটি। আবার সম্পূর্ণ নতুন সুরের কথাও শুনি, ‘ধার্মিক লোকের প্রতি নিয়তি কী করবে?’ (১৩:৬:২৯) অর্থাৎ সম্পূর্ণ দৈববাদীর মত সম্পূর্ণ পুরুষকারবাদী প্রস্থানও হয়তো ছিল।
ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বলছেন, ‘সঞ্জয়, আমি দৈবকেই পরম বলে মানি, কারণ আমার পুত্রদের সেনা পাণ্ডব সেনার দ্বারা পরাস্ত হল।’ (৬:৫৮:১) ধৃতরাষ্ট্রপক্ষের পরাজয়ের কারণ তো শুদু দৈব নয়, নৈতিক অপরাধেও; কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে সে কথা স্বীকার করতে হলে নিজের এবং পুত্রদের অপরাধ স্বীকার করতে হয়। তার মধ্যে অনেক গ্লানি, অনেক আত্মধিক্কারের প্রসঙ্গ আসবে; তার চেয়ে দৈবকে দায়ী করলে অতি সহজেই সব চুকে যায়। ঠিক যেমন জুয়াখেলা প্রসঙ্গে যুধিষ্ঠির দৈবকে দায়ী করেন নিজের দায়িত্ব এড়ানোর জন্য। অতএব দেখছি, সমাজে ধর্ম ও নীতিচিন্তার অধিসংগঠনে যখন থেকে দৈব স্থান পেল তখন থেকে দুষ্কৃতকারী একটি ছুতো পেল আত্মদোষ দৈবের ওপরে চাপানোর। নিয়তিবাদ এ-দিক থেকে নৈতিক কাপুরুষতা ও মিথ্যাচারের সহায় হয়ে উঠল। অপরপক্ষে পুরুষকারের প্রয়োগে যখন মানুষ কোনও কাজে সিদ্ধি লাভ করে, তখন কিন্তু কখনও বলে না, এটা দৈবের দ্বারা ঘটল। পুরুষকারের কৃতিত্ব ও তার থেকে যে সাফল্য আসে তার কর্তৃত্ব মানুষ সর্বদাই স্বীকার করে। যখন ব্যর্থতা আসে, তখনই দৈবের দোহাই দেয়। অনেক সময়ে চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যর্থতা আসে, অদৃষ্টপূর্ব, অজ্ঞাতপূর্ব কোনও নিমিত্তকরণ থাকতে পারে সে ব্যর্থতার। কিন্তু যখন অন্যায় নৈতিক সিদ্ধান্তের মূল্য দিতে হয় ব্যর্থতায়, তখন আত্মদোষকে গোপন করার একটি সুলভ উপায় হল নিয়তিবাদী হয়ে ওঠা।
‘দৈবাহত ব্যক্তি বারেবারে যে কর্মই করতে যাক না কেন, দৈব তা নিষ্ফল করে দেয়। উদ্যমী ব্যক্তি যখন যা করে, তা নির্ভীক ভাবেই করা উচিত; সিদ্ধি অবশ্য দৈবের অধীন।’ (৭:১২৭:১৬, ১৭) ‘দৈবের সম্মুখীন হয়ে চিত্ত ক্লিষ্ট হয় না।’ (৮:১:৪৭) ‘পুরুষকারকে কখনওই দৈবের ওপরে স্থান দেওয়া যায় না।’ (১০:৭:২৫) কর্ণকে কৃষ্ণ বলে, ‘নীচাশয় ব্যক্তি, যারা রিপুতে আসক্ত, তারা দৈবকে দোষ দেয়, নিজেদের দুষ্কৃতীকে নয়।’(৮:৬৭:১) ‘তেল কমে গেলে প্রদীপ যেমন ক্ষীণলোক হয় তেমনই দৈব্যও দুর্বল হয়ে পড়ে যখন কর্ম (ফল) শেষ হয়ে আসে।’ (১৩:৬:৪৪ )
এই অংশটি এবং এ রকম আরও কিছু শাস্ত্রাংশ বুদ্ধির স্তরে দৈব ও কর্মের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করতে প্রয়াসী। যতক্ষণ কর্মফলে সুখদুঃখ ভোগ হচ্ছে শুধু ততক্ষণই দৈব সক্রিয়। অতএব অতীত ও বর্তমান কর্মের অবশিষ্টাংশেরই নাম দেওয়া হয় দৈব, কারণ তা অ-দৃষ্ট, যা দৈবেরই অন্য একটি প্রতিশব্দ। যে পুরুষোচিত উদ্যম পরিহার করে, দৈবের ওপরে নির্ভর করে, তার প্রযত্ন নিষ্ফল, যেমন ক্লীব স্বামীর স্ত্রী। (১২:৬:২০) এখানে স্পষ্টতই ঝোঁকটা পড়েছে পুরুষকারের ওপরে যা বাদ দিয়ে দৈবও কিছু সাধন করতে পারে না। দৈবের শরণাগত হওয়াকে সরাসরি নিন্দা করা হচ্ছে না, কিন্তু পুরুষকার বর্জন করে দৈবকে আশ্রয় করার নিন্দা করা হচ্ছে। কিন্তু যুক্তি দিয়ে এ দুটির যে-কোনও একটি প্রান্তে পৌঁছলে অন্যটি বাদ পড়ে। শাস্ত্র কোনও জায়গায় এ অসংগতির কথা বলে না, বরং ভাল করে বোঝাবার চেষ্টা করে যে, চতুষ্কোণের মধ্যে মণ্ডলাকৃতিতে ভাল ভাবেই বসানো যায়! শুধু পূজনীর যুক্তিতেই স্পষ্ট হয়, এ দুটি পরস্পর-বিরুদ্ধ।
অসংখ্যবার শুনি, ‘দৈবই চরম, ধিক পুরুষকারকে’, এবং ‘দৈবের চেয়ে ক্ষমতাশালী কিছুই নেই।’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. ব্রহ্মখণ্ড ১১:১৭) হতোদ্যম কংস পরাজয় ও সর্বনাশের পরে বলে, ‘আমি পুরুষকার দিয়ে ভাগ্যকে জয় করতে পারলাম না।’ (হরিবংশ বিষ্ণুপর্ব ৪:৫১ ) নিজের অন্যায় ও নীতিহীনতার কথা কংস একেবারে চেপে যায়। ‘কোনও কোনও জ্ঞানী ব্যক্তি ভাগ্যকে সর্বশক্তিমান বলেন, অন্য যাঁরা পুরুষকারের বিশ্বাসী তাঁরা ভাগ্যকে নিরর্থক বলেন।’ (দেবীভাগবত পু. ৫:২২:১২) কিন্তু, আবার ‘বিজ্ঞেরা যাকে ভাগ্য বলেন, তা হল সেই আশা, দুর্বলরা যাকে আশ্রয় করে। শক্তিমানরা কখনও কোনও ভাগ্যকে লক্ষ্যই করে না। বীর এবং দুর্বল যথাক্রমে পুরুষকার ও ভাগ্যকে আশ্রয় করে।’ (ঐ ৫:১২:২৮-৩০) ‘দৈব এবং পুরুষকার দুই-ই মানুষ পছন্দ করে। কারওরই উচিত নয় দৈবকেই একান্ত ভাবে আশ্রয় করা, মানুষের উচিত বুদ্ধিপূর্বক পুরুষকারের একটা পথ খুঁজে বার করা।’ (ঐ ৫:১৩, ১৪) কিছু পরেই কিন্তু উল্টো কথা: ‘এই বিশ্বসংসারই দৈব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জয়-পরাজয়ও। সব কিছুই যে দৈবনিয়ন্ত্রিত, এটা জেনে মানুষের দৈবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা উচিত নয়।’ (ঐ ৬:৬:১০) বেশি ভারসাম্য আছে, অন্য একটি উক্তিতে, ‘মানুষের উচিত দৈব ও পুরুষকার উভয়কেই সম্মান করা। পুরুষকার বিনা সাফল্য আসবে কেমন করে? বিজ্ঞের উচিত যথোচিত উপায়ে প্রযত্ন করা, প্রযত্ন থাকলে সাফল্য আসবে, অন্যথা নয়।’(ওই ৭:১৮:৩৬-৩৭) ‘হে বেদ-বেদাঙ্গ পণ্ডিত (সুধী), এ সংসারে কেউ বলে, নিজের কর্ম দ্বারাই সিদ্ধি হয়, কেউ বলে, দৈব দ্বারাই, অন্যেরা বলে প্রকৃতি দ্বারাই— এ তিনটিই বেদে স্বীকৃত। মানুষ নিজের কর্মের কর্তা (কিন্তু) সে কর্ম দৈব দ্বারা (নির্দিষ্ট); মানুষের পূর্বকর্ম নিজেদেরই কৃত, প্রকৃতির করা।’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. প্রকৃতি ৬০:২৫-২৪) স্পষ্টতই যদিও এ বাক্যটিতে তিনটি অংশকে ভাগ করা আছে— প্রকৃতি, পুরুষকার ও দৈব— তবু এ বিভাগটি দাঁড়ায়নি এবং বেদে এ সব কোনও কথাই নেই। অন্য দিকে কোনও স্পষ্ট সংজ্ঞা বিনা প্রকৃতিকে এনে জটিলতাকে জটিলতর করে তোলা হয়েছে। দার্শনিক ভাবে এটি একটি জগাখিচুড়ি। এই স্বভাব বা প্রকৃতি মানুষের স্বভাবেও প্রযুক্ত হতে পারে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্বভাব অথবা কোনও এক ধরনের ভাগ্যের বিষয়ে অর্থাৎ ভাগ্যের স্বভাব অর্থে। কিন্তু স্বতন্ত্র ভাবে স্বভাব বা প্রকৃতিতে আনা হয়েছে তার যথার্থ কোনও সংজ্ঞানিরূপণ না করেই। এতে অনর্থ কেবল বেড়েই গেছে।
স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সমাজে তিন ধরনের মূল্যবোধ ছিল: (১) পুরুষকারের ওপর নিঃশর্ত ভরসা, (২) নিয়তির ওপরে নিঃশর্ত ভরসা, (৩) এ উভয়ের সীমা সম্বন্ধে সচেতনতা অর্থাৎ একটি কোথায় শেষ হয়ে অন্যটির শুরু হয় সে সম্বন্ধে বোধ বা উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে অনির্দেশ্য সংশয়।
মৎস্যপুরাণ-এ ‘স্বভাব’-এর স্থানে ‘কাল’কে উপস্থাপিত করা হয়েছে। ‘তোমার পূর্বজন্মকৃত কর্মকেই নিয়তি বলে জেনো। এই কারণে প্রাজ্ঞেরা শৌর্যকেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করেন। বিরুদ্ধ নিয়তিকেও সর্বদা সক্রিয় সদাচারী ব্যক্তিরা শৌর্য দিয়ে জয় করতে পারেন না। হে নরশ্রেষ্ঠ, যাদের অতীত কর্ম ধর্মসম্মত, (এ জন্মের) সৎকর্ম না থাকলেও (শুভ) কর্মফল তারা পায়। উদ্যোগী লোক কর্মের ফল লাভ করে; ‘তামস’ কর্ম, যা অন্ধকারময় ও নীচ, সে কর্মের ফলে লোকে বহু কষ্ট পায়। হে নরশ্রেষ্ঠ, কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় পুরুষকারের দ্বারা। শৌর্যহীন মানুষ শুধু ভাগ্যকেই জানে। মানুষের প্রয়াস, দৈবের আশীর্বাদে ফলধারণ করে ‘কাল’ এ। অতএব দৈব, পুরুষকার ও কাল এ তিনের সমন্বয়ে ফলোদ্গম হয়… সে কারণে, সে কারণে, প্রত্যেকের নিজের সমাজ নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে সর্বদা সচেষ্ট থাকা উচিত।’ এই যে ‘সমাজ নির্দিষ্ট’ অবস্থিতি এ হল বর্ণাশ্রমধর্ম। অর্থাৎ কোনও অবস্থাতেই বর্ণাশ্রমধর্মের সীমা লঙ্ঘন করা চলবে না। শাস্ত্রকারদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল মানুষের যে শৌর্য, আত্মপ্রত্যয় সর্বদা প্রকাশ খোঁজে তা যেন কোনও মতেই ওই সমাজ নির্দিষ্ট সীমা লঙ্ঘন না করে; শম্বুক, একলব্য এঁরা নিষ্ঠুর মূল্যে এ সত্যটি জানিয়ে গেছেন। এ ভাবে চললে, শাস্ত্র বলে, এ জন্মে মানুষ ফল না পেলেও পরজন্মে পাবেই। পরজন্মটা দৃষ্টির অগোচরে, আপাতত এ জন্মে সমাজ তার পুরো আনুগত্য পাওয়ার ব্যবস্থাটা পাকা করে নিল। ‘অলস কখনও ঈপ্সিত বস্তু লাভ করে না, শুধু দৈবের ওপর নির্ভর করলেও করে না। যে অলস শুধু লক্ষ্মীকে আশ্রয় করে থাকে, তাকে ত্যাগ করে লক্ষ্মী উদ্যোগীর কাছে যায়। বিবেচনা করে পথের সন্ধান করা উচিত… অতএব সব সময়েই সক্রিয় ও উচ্চাশী হওয়া উচিত।’ (মৎস্যপুরাণ ২২০:২-১২)
ভগবদ্গীতা-য় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, ‘আমি জলের মধ্যে মিষ্টরস, আমি সূর্যচন্দ্রের জ্যোতি, সর্ববেদের ‘ওম’, পুরুষের পৌরুষ।’ (৩:৮) কৃষ্ণ স্বয়ং এখানে স্বীকার করেছেন যে, পুরুষের শ্রেষ্ঠ সত্তা তার পুরুষকার। এ সত্তা যদি প্রতি পদেই দৈবের দ্বারা প্রতিহত হয় তা হলে পুরুষের মর্যাদাহানি হয়, তার শ্রেষ্ঠ সত্তা অবমানিত হয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে, যখন অর্জুন আসন্ন লোকক্ষয়ের সম্ভাবনায় নিরুদ্যম, তখন কৃষ্ণ বলেন, ‘ক্লীবত্ব পরিহার কর, অর্জুন তোমাকে ওটা মানায় না, ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য ত্যাগ করে ওঠ, অর্জুন।’ (২:৩) কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করে অর্জুনকে বলেন, ‘ভগবান স্বয়ং সর্বজীবের অন্তরে অধিষ্ঠান করে যন্ত্রারোপিতবৎ তাদের চালনা করেন।’ (১৮:৬১) অর্জুনকে কৃষ্ণ বলেন, ‘ওঠ, যশোলাভ কর, শত্রু নিপাত করে সমৃদ্ধ রাজ্য ভোগ কর। এ সব সৈন্যকেই আমি পূর্বাহ্নেই নিহত করেছি; অর্জুন তুমি নিমিত্ত মাত্র হও।’ (১১:৩৩) এ শ্লোকের দ্বিতীয়ার্ধে কৃষ্ণের উৎসাহবাক্য নিরর্থক হয়ে পড়ে, কারণ কৃষ্ণ যদি আগেই সৈন্য নিধন করে থাকেন তো অর্জুন নিজ শৌর্যে কেমন করে যুদ্ধে যশোলাভ করবেন? গীতা-র মধ্যে এমন স্ববিরোধ বহুতর উক্তির কেন্দ্রে; এখানে স্পষ্ট বিরোধ, নিয়তি ও পুরুষকারের মধ্যে। কৃষ্ণ এখানে নিজেকে নিয়তির পূর্বনিরূপণের প্রতীক করে তুলেছেন।
কুন্তী যখন দেখেন তাঁর পুত্রেরা হতোদ্যম, হতাশ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন তখন তিনি তাঁদের বিদুলার পুত্র রাজা সঞ্জয়ের উপাখ্যান বলেন, যিনি পাণ্ডবদেরই মতো রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে অবসন্ন অবস্থায় বিলাপ করেছিলেন। মাতা বিদুলা সঞ্জয়কে ভর্ৎসনা করে ক্ষত্রিয়োচিত আচরণে প্রেরণা দেন, যুক্তিহীন অবসান ও আত্মগ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বলেন। সঞ্জয় নিজের অসহায় অবস্থা, সৈন্য ও অস্ত্রের অভাব জানিয়ে প্রশ্ন করেন কেমন করে তিনি যুদ্ধ করবেন; বিদুলা সঞ্জয়কে লজ্জা দিয়ে বলেন, ‘তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি করে না জ্বলে, বৃহৎ কাঠের মশালের মতো একবার অন্তত জ্বলে ওঠ, এক মুহূর্তের জন্যও হলেও। তুমি তো প্রকৃতপক্ষে ক্ষত্রিয়ই, এ আচরণ কি ক্ষত্রিয়কে শোভা পায়? যা কিছু তোমার নেই, উঠে গিয়ে তা সংগ্রহ কর।’ শেষ পর্যন্ত সঞ্জয় লজ্জা পেয়ে অবসাদ ঝেড়ে ফেলে যা প্রয়োজন তা সংগ্রহ করে যুদ্ধ করেন এবং জয়ী হন। (৫:১৩১) এ কাহিনিতে দৈব ও পুরুষকারের দ্বন্দ্বেরই বিবরণ আছে; দৈবনির্ভর সঞ্জয়কে বিদুলা ভৎসনা ও উপদেশে আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলেন, ফলে সে বিজয়ী হয়; দৈবের ওপরে পুরুষকারের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
জন্মস্বত্ত্বে ক্ষত্রিয় হলেও কর্ণ তাঁর জন্মবৃত্তান্ত জানতেন না। সারথি অধিরথের গৃহে লালিত হয়ে তিনি নিজেকে সূতপুত্র বলেই জানতেন। অন্যেরা যখন তাঁর হীন বংশ জন্ম নিয়ে বিদ্রূপ করে, তখন তিনি সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন— ‘সুতো বা সুতপুত্রো বা যো বা কো বা ভবাম্যহম। দৈবায়ত্তং কূলে জন্ম মদায়ত্তং তু পৌরুষম’— ‘সারথি বা সারথিপুত্র যে কেউই আমি হই না কেন, যে বংশে জন্মেছি সেটা ছিল দেবের হাতে, আমার হাতে আছে পৌরুষ’— এবং এখানে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা। পুরুষকারের যে গর্ব দুরূহ কার্য হাতে নেয় এবং সফলকাম হয়, তাই এখানে দেখছি। মহাভারতের যুদ্ধ এক অর্থে দৈব ও পুরুষকারের সংগ্রাম। যখনই পাণ্ডবরা অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্যের পরিবর্তে কৃষ্ণকে গ্রহণ করল, তখন যুদ্ধের ফলাফল তো স্থির হয়েই গেছে। গ্রিক ট্রাজেডির বীরদের মতো কৌরবরা তখন থেকেই দেবতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে রত। আবার অন্য দিকে সংখ্যালঘু পাণ্ডবরা অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী-সংবলিত রাজশক্তির বিরুদ্ধে; যুদ্ধে কৌরবরা অন্যায়কারী, অতএব শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের বাঁচাবে কি করে? তারা এক নিরাপরাধ রজস্বলা একবস্ত্রা নারীকে প্রকাশ্য রাজসভায় টেনে এনে বিবস্ত্রা করতে উদ্যত হয়েছিল বহু পুরুষের চোখের সামনে। তা ছাড়া কৃষ্ণ পাণ্ডবদের সখা এবং মহাভারত-এর প্রক্ষিপ্ত অংশে ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং’, এই কারণে কৌরবদের সত্যিই সাধ্য ছিল না যুদ্ধ জয় করার।
অতএব নিয়তি ও পুরুষকারের যে সংঘর্ষটি যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ-এ দীর্ঘায়ত ভাবে বিবৃত হয়েছে, এ গ্রন্থে সেটিই মুখ্য প্রতিপাদ্য মনে হয়। এই আর একটি চূড়ান্ত মিথ্যা কথা খেলা, যেমন লোকে বলে ‘কাল’ বা ‘দৈব’ ‘করে’ বা ‘খায়’ইত্যদি। (বৈরাজ্য ২৫:১) তৃতীয়টির বিভীষিকাপূর্ণ নাম ‘কৃতান্ত’, মদমত্ত কাপালিকের আকৃতিতে দৈব নেচে বলে এই পৃথিবীতে।’ (ঐ ২৫:৫) ‘এই আকৃতি-বিশিষ্ট কালের সামনে চিরন্তনী নারী নিয়তি নাচতে শুরু করে এবং তার হাবভাব ছলাকলার আর অন্ত নেই।’ (ঐ ২৫:১০) এ কথায় মধ্যে স্পষ্টতই স্বীকার করা হচ্ছে যে নিয়তির আচরণ দুর্নিরীক্ষ্য ও দুর্বোধ্য, কারণ চপলা লীলাময়ী নারীর মতো সে ক্ষণে ক্ষণে অভাবিত রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কাজেই নিয়তির ব্যাপার যে-মানুষের বোধের অতীত, তার কাছে কোনও যুক্তিসঙ্গত প্রত্যাশা থাকলে তা যে ব্যর্থ হতে বাধ্য- এই কথাটাই বিশেষ জোরের সঙ্গে বলা হচ্ছে। ‘নিয়তি ও পুরুষকারের লড়াই হয় দুটি ভেড়ার মতো, সমান ও অসমান, নিজের বা অপরের, দুটির মধ্যে যেটি শক্তিমত্তর সেটিই জেতে।’ (মুমুক্ষু, ৫:১০)
যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ নিয়তিকে নৃত্যপরা রমণীর মতো দেখে, উপমানটি তাৎপর্যপূর্ণ : নৃত্যের অঙ্গভঙ্গি নির্ভর করে নৃত্যকল্পনার বৈশিষ্ট্যের উপরে। একটু দূর থেকে নর্তকীর অঙ্গভঙ্গি কী হতে চলেছে তা বোঝবার উপায় নেই। কিন্তু নিয়তিকে যখন আদিম নৃত্যবিলাসিনী রমণীরূপে দেখানো হয় তখনই তাকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। অন্য একটি শ্লোকে দৈব জুগুপ্সা উৎপাদন করে— মদমত্ত কাপালিকরূপে দেখা দেয়; সেও নাচে, সুরার প্রভাবে। দুজনেই মানুষের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন, মানুষ মূক, নিষ্ক্রিয় দর্শক; তারই ভাগ্য নিয়ে এ দুজন লীলানৃত্য করছে। দুজনেই নিজের নিজের নাচে মগ্ন এবং দর্শকদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন, যে দর্শকদের ভাগ্যই তাদের নৃত্যবস্তু। যোগবাশিষ্ঠের মতে মানুষ ও দৈবের এ-ই হল সম্পর্ক। অর্বাচীন এই গ্রন্থে বহু শতাব্দীর নিয়তিবাদের প্রতিবিম্ব; নর্তকীর লীলানাট্যকে নিষ্ক্রিয় মেনে নেওয়া এমনকী তাতে মুগ্ধ হওয়া, এই হল নিয়তিবাদের এক পরম জয়ের সাক্ষ্য। এটি কিন্তু মেনে নেওয়ার পক্ষে একটি অতি গুরুতর অবস্থান: মানুষের নিজের ক্রিয়াকাণ্ডও তার ইচ্ছাধীন নয়। কোনও পূর্বতন জন্মে সে কী করেছে, যার সাক্ষ্য নেই, প্রমাণ নেই— তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তার জীবন। যুক্তির দিক থেকে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা এতে পুরোপুরি অস্বীকৃত, অতএব স্বাধীন পুরুষকারেরও নিয়তির কাছে এটি একটি নিঃশর্ত চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ। মানুষ পুরুষোচিত ভাবে কর্ম করবে এমন উদ্যোগগুলিতে, যাতে তার প্রাক্তন পুরুষকার সমস্ত অমঙ্গলকে (কর্মফলকে) মুছে দিতে পারে। (ঐ ৫:১১) ‘ভাগ্যহতরা বলে, দৈব তাদের প্রেরণা দেয়, যারা দৈবকে চূড়ান্ত মনে করে লক্ষ্মী তাদের কাছ থেকে সরে আসেন।’ (ওই ৫:২০) ‘শ্রেষ্ঠ মানুষরা, দারিদ্রাহত, অভাব ও দুঃখে জর্জরিত হলেও ইন্দ্রের আসনও দখল করে পুরুষকার ও উদ্যম দিয়ে।’ (৫:২৭) ‘কাজেই যারা দেখে যা প্রত্যক্ষতই দৃশ্য, উপলব্ধ, শ্রুত ও কৃত, তবু ভাবে ‘এই সবই ভাগ্যের কীর্তি’, সেই হতভাগ্যরা সম্পূর্ণ বুদ্ধিহীন।’ (ঐ ৫:২৯)
লিয়হ ৎছু’র (খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক) রচিত একটি সংলাপ আছে— নিয়তি ও পুরুষকারের মধ্যে। যে মুহূর্তে দৈবকে সর্বশক্তিমান মনে হচ্ছে, তখন, সব ঘটনা তারই কর্তৃত্বাধীনে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে দৈব বলে, ‘যেহেতু আমার নামেই দৈব, আমি কেমন করে কিছু নিয়ন্ত্রণ করব… (সব কিছুই) স্বভাবতই আসে প্রকৃতি থেকে। সে সম্বন্ধে আমি জানব কী করে।’ (এ ব্লাউন্ট ও সঁশে, ১৯৭৭, পৃ. ২৯৪) দৈবের শক্তির সীমা এই যে সংশয়বাদ, এতে মানুষের মনে একটা স্বাস্থ্যকর আত্মপ্রত্যয় জন্মায়। এই চিনা গ্রন্থে ভারতীয় পুরাণগুলির মতো দৈব দাবি করে না যে, সে সর্বশক্তিমান, বরং বলে সব কিছু স্বভাবতই আসে প্রকৃতি থেকে। অর্থাৎ যে প্রকৃতি নিজেও বহু ক্ষেত্রে দুয়ে আচরণ করে, সে-ই মানুষের জীবনের ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্বয়ং দৈব সে সম্বন্ধে কিছু জানে না। এই দৈব নিজেই সমস্ত দায়িত্ব প্রকৃতির ওপরে সমর্পণ করে, যে প্রকৃতির আর একটি ভারতীয় নাম ‘স্বভাব’। প্রকৃতির গতিবিধি’র অধিকাংশই মানুষের কাছে অজ্ঞাত, কিন্তু ‘লিয়েহ ছু’র দৈব প্রকৃতির সেই অজ্ঞাত অঞ্চলের কোনও কিছু নিয়ন্ত্রণ করারও দাবি করে না। এখানে ভারতবর্ষের তুলনায় পুরুষকারের স্বাধীন আচরণের অবকাশ অনেক বেশি। দৈবের ভূমিকা খর্ব করে তাকে প্রকৃতির অধীন করে প্রসারিত দেখিয়ে ইনি পুরুষকারের ক্ষেত্র অনেক বেশি অবাধ করে দিয়েছেন
প্রাচীন গ্রিক অতিকথায় দেবী তুখের নির্দিষ্ট স্থান আছে; দেবতা এবং মানুষের, পুরুষকারের ও দক্ষতার স্বতন্ত্র স্থান আছে। ‘তুখের সঙ্গে প্রতি তুলনা সচেতন উদ্দেশ্যনিষ্ঠপুরুষকারের সঙ্গে, যার ওপরে তুখের বিস্তৃত অধিকার আছে, কারণ তিনি ঈশ্বরের এক শক্তিমতী সচিব। তৃতীয় স্থানে, ঈশ্বর ও নিয়তির পরে আসে মানুষের নিজের কর্মকুশলতা।’ (চিত্তফফারি, ১৯৩৫, পৃ. ৪২) কাজেই আমরা সার্বভৌম শক্তিত্রয়ের সেই পরিপাটি ছকটি পাচ্ছি: স্বাধীন ইচ্ছা/ঈশ্বর (বা দেবতারা)/প্রকৃতি; তুখে (দৈব বা নিয়তি); পুরুষকার (=স্বাধীন ইচ্ছা)। কোনও কোনও ধর্মীয় বা দার্শনিক প্রস্থানে প্রথম দুটি— প্রকৃতি ও দৈব, অপৃথকীকৃত থাকে, কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছা ও দৈব সকল প্রস্থানেই স্বীকৃত।
উইলসন দেখাচ্ছেন, ‘(যে যুক্তির) বলে যুক্তিগত অসংগতি মিলিয়ে দেওয়া হয়, তা হল অ্যারিস্টটলের দৈব সম্বন্ধে সংজ্ঞাটি, (সেটি) এমন একটি হেতু যা মনুষ্য বুদ্ধির কাছে স্পষ্ট নয়…. সেনেকা তাঁর নৈতিক বিধানে ভাগ্যকে একটি সুনির্দিষ্ট স্থান দিয়েছেন। মানুষকে শক্তি ও সাহস দেওয়ার ব্যাপারে এর প্রয়োজন ছিল। তিনি আমাদের বলেন যে, মানুষের মনকে আঘাত করবার কোনও শক্তি ঈশ্বর ভাগ্যকে দেননি। অতএব আমাদের উচিত নিজেদেরকে তার দাসে পরিণত করার চেয়ে সেই শক্তিকে তাচ্ছিল্য করা। ভাগ্য এমন একটি শক্তি যার বিরুদ্ধে যাওয়া আমাদের উচিত, যাতে তার দ্বারা আমরা দৃঢ়তর হতে পারি।’ (১৯৮৩, পৃ. ৫০)
অজেয় শত্রুই হোক, অথবা এমন শত্রুই হোক, যাকে সংগ্রামে চূর্ণ করতে হবে, অধিকাংশ ধর্মীয় বা দার্শনিক চিন্তাপ্রস্থানই, দৈবের অস্তিত্ব মেনেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম কট্টর একেশ্বরবাদী কিছু ধর্ম যা দৈবের কোনও স্থান স্বীকার করেনি। খ্রিস্টধর্মে একটি নিরন্তর সংগ্রাম আছে শয়তান ও ঈশ্বরের মধ্যে। প্রান্তরে শয়তান কর্তৃক যিশুর পরীক্ষা মানুষের জীবনে নিত্য ঘটমান এই সংগ্রামের প্রতীক; মানুষ বিলাসে মগ্ন হওয়ার সম্ভাবনা ও আত্মপ্রচারের সম্ভাবনার সম্মুখীন হয়, তারই সঙ্গে আত্মনিগ্রহ ও সৎপথে চলার সম্ভাবনারও সম্মুখীন হয়। বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধকে মার ও তার কন্যারা পরীক্ষা করে; বুদ্ধ নিজ অবস্থানে স্থির থেকে জয়লাভ করেন; এ সংগ্রাম ও জয় প্রতীকী, প্রত্যেক মানুষের জীবনে এই পরীক্ষা সতত বিদ্যমান। বুদ্ধ পথ দেখিয়েছেন কী করে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়। জোরাষ্ট্রীয় ধর্মে আহুর মাজদা পুণ্যশক্তির প্রতীক, অংগ্ৰ মৈন্যু পাপশক্তির। মানুষের নৈতিক কর্তব্য হল, পুণ্যের পক্ষবর্তী হয়ে পাপশক্তিকে জয় করা। শুচি করে জিনের আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করা।
সবচেয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য হল, নৈতিক নির্বাচনের স্বাধীনতা। প্রাচীন গ্রিসে দৈবের নানা নাম ও গুণ ছিল; এদের অপরদিকে ছিল দেবমণ্ডলীর অন্য দেবতারা। যদিও ধর্মতত্ত্ব স্পষ্ট করে কখনও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বা পুরুষকারের কথা বলেনি তবু গ্রিক ট্রাজেডিগুলিতে পুরুষকারকে খুবই স্পষ্ট করেই চিত্রিত করা হয়েছে। এ সব নাটকে মানুষের স্বাধীন সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে দেবতাদের রায়ও পূর্বনিরূপিত (লক্ষণীয় ঐদিপুস রেক্স, ঐদিপুস এট কলোনস, আলকেস্টিস, আন্তিগোনে, আগামেমনন নাটকত্রয়, ইত্যাদি)। তবুও অধিকাংশ নাটকেই নায়ক বা নায়িকার সামনে একটি চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক নির্বাচনের সময় আসে, যার ওপরে নির্ভর করে তার ভবিষ্যৎ সুখ-দুঃখ। ভারতবর্ষে এই নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটি মহাকাব্যের সময় থেকে বোঝা যায়। মৃত্যু, কাল, অন্তক, নিয়তি ও দৈব, এই সব দেবতা বা দিব্যশক্তির সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের দুটি মাত্র বিকল্প ছিল, নির্লিপ্ত ভাবে হাল ছেড়ে দেওয়া অথবা পুরুষকারের জোরে নিয়তির সম্মুখীন হয়ে সংগ্রাম করা। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, সে নিষ্ক্রিয় থেকে ঘটনাকে তার ওপর দিয়ে ঘটতে দিতে পারত, অথবা সক্রিয় ভাবে সংগ্রাম করে মনুষ্যত্বের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতে পারত, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও।
ইরাণীয় এপিস্ল অব টনসার-এ (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের) যারা একান্ত ভাবে নিয়তিতে বিশ্বাসী তাদের এবং যারা পুরুষকারে একান্ত ভাবে বিশ্বাসী তাদেরও ধিক্কার দেওয়া আছে। এ ভাবে তারা পুরুষকারকে সমর্থন করেও তার ওপরে নিয়তির প্রভাব স্বীকার করেছে। ভারতবর্ষে আমরা দেখেছি, দুটি সমান শক্তিশালী ধারা আছে: (১) নিয়তিবাদী, যা নিয়তির চূড়ান্ত আধিপত্য স্বীকার করে, এবং (২) পুরুষকারে বিশ্বাসী, যারা পুরুষকারের প্রাধান্য স্বীকার করে। কিন্তু শাস্ত্রের অনুজ্ঞা, উপদেশ ও আখ্যানমূলক সমর্থন সংখ্যায় ও পরিমাণে অনেক বেশি হলেও পুরুষকার-সমর্থকরা সরাসরি নিয়তিবাদের বিরোধিতা করে না। সম্ভবত, আড়াই হাজার বছরের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে নিয়তিবাদ এত ওতপ্রোত ভাবে অনুপ্রবিষ্ট যে, সেজাসুজি তার বিরুদ্ধে কিছু বলা সমাজে নিরাপদ ছিল না। জন্মান্তরবাদের অসংখ্য কাহিনিতে প্রতিপাদন করা হয়েছে, নিয়তি কী ভাবে মানুষের জন্ম ও জন্মান্তর নিয়ন্ত্রণ করে, এবং মানুষ যাই করুক না কেন নিয়তির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে না। অনেক কাহিনিই তত্ত্বগত ভাবে অপরিণত, কোনও নৈতিক গুরুত্ব তাতে আরোপ করা যায় না। (ইন্দ্র গৌতমের বেশে অহল্যাকে ভোগ করলেন, বা নারায়ণ শঙ্খচূড়ের বেশে তুলসীকে; উভয়ত্রই স্বামীর বেশ ধরে প্রতারণা, ফলে পাঠকের নৈতিক বোধ কোনও ভাবে প্রভাবিত হয় না। কিন্তু রাবণ, কর্ণ, বিশ্বামিত্র যখন সামাজিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা জানায়, ধর্মীয় ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে, নিজেদের শৌর্য ও মনুষ্যত্বের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে, তখন তারা সমাজে একটা প্রতীক হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ রকম অধিকাংশ চরিত্রই প্রতিনায়ক এবং এরা নৈতিক ভাবে উচ্চমার্গে আরোহণ করতে পারে না, কিন্তু এদের নৈতিক সংগ্রাম ও সামাজিক প্রতিবাদ দুই-ই তাৎপর্য বহন করে।
কখনও কোনও নায়ক নিয়তির বিরুদ্ধে গিয়ে যে জয়যুক্ত হয় না, তার কারণ, মহাকাব্য ও পুরাণের রচয়িতারা নিয়তিবাদকে প্রতিষ্ঠাই করতে চেয়েছেন এবং প্রতিবাদকে চাপা দেওয়ারই চেষ্টা করেছেন। শাস্ত্রকার ও পুরোহিতরা ক্রমান্বয়ে এমন বহু ধর্মীয়, ক্রিয়াকলাপ উদ্ভাবন করছিল, যা আপাত ভাবে মানুষের নিয়তি নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎকে তার অনুকূলে এনে দিতে পারে। (পূর্ববর্তী দুটি অধ্যায় দ্রষ্টব্য) ফলে নিয়তিবাদকে শাস্ত্র ও সাহিত্য দৃঢ়তর ভাবে প্রতিষ্ঠা করছিল। স্বভাবতই সমর্থন করেও ধীরে ধীরে অসংখ্য গ্রন্থাংশে পুরুষকারের ব্যর্থতা সম্বন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে: ‘দৈবই চরম, পুরুষকার ব্যর্থ।’ কখনও কখনও মহাকাব্যের নায়ককে দুটি নৈতিক বিকল্পের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়েছে; রাম দশরথের আজ্ঞা লঙ্ঘন করতে পারতেন, এমনকী ভরতের নির্বন্ধ্যাতিশয্যে অযোধ্যায় ফিরে সিংহাসন গ্রহণ করতে পারতেন। যে কোনও একটি করলে নৈতিক আদর্শ থেকে ভ্রষ্ট হতেন। তবে সেই রামই আড়াল থেকে বালীবধ করবার মতো কাপুরুষোচিত কাজ করেছেন, শুধুমাত্র সীতাকে ফিরে পাওয়ার জন্যে, সুগ্রীবের সখ্য তাঁর প্রয়োজন ছিল বলে, অর্থাৎ স্বার্থপ্রাণোদিত হয়ে। তার পর সম্পূর্ণ নির্দোষ সীতাকে নিরপরাধ জেনেও বারবার প্রত্যাখ্যান করা, নির্বাসন দেওয়া— এগুলিও বিরোচিত কাজ নয়। যুদ্ধটাও সীতার জন্যে নয়, তিনি বলেন, ইক্ষাকু কুলের মর্যাদা রক্ষার জন্যে। শম্বুক বধও এক দিকে যেমন শাস্ত্রনির্দিষ্ট অন্য দিকে তেমনই অন্য শাস্ত্রের মানদণ্ডে গর্হিত; কাজেই এটি না করার বিকল্পও তাঁর ছিল। লঙ্কায় ভিত্তিহীন সন্দেহের বশে এবং অযোধ্যায় প্রজাদের মিথ্যা সন্দেহে সীতা পরিত্যাগের দুষ্কর্মটি রাম অনায়াসে পরিত্যাগ করতে পারতেন শাস্ত্র নির্দেশেই: শাস্ত্র বলে অবহৃতা ও ধর্ষিতা স্ত্রী, যে গৃহত্যাগ করেছে এমনকী তাকেও এক মাস পরে পুনরায় গ্রহণ করা বিধেয়। (বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ২১:৮-১০) স্ত্রীপরিত্যাগী দত্তযোগী, এ কথাও শাস্ত্রে আছে। এ কথা সত্য যে, নারীবিদ্বেষী শাস্ত্রকাররা অন্য রকম নির্দেশও প্রচুর দিয়েছেন এবং সেগুলি সংখ্যায় অধিক। কিন্তু রাম ইচ্ছা করলে শাস্ত্রের বলে সীতাকে পরিত্যাগ নাও করতে পারতেন। চন্দ্রের জন্য গৃহত্যাগিনী তারা; চন্দ্রের ঔরসে বুধের জন্ম হওয়ার পরেও তো বৃহস্পতি তাঁর স্ত্রীরূপে তারাকে গ্রহণ করেছিলেন। নৈতিক দ্বন্দ্বে মানুষ সচরাচর যে শাস্ত্রের সঙ্গে নিজের অভিপ্রায় মেলে সেটিই গ্রহণ করে। শাস্ত্রকার ও ব্রাহ্মণদের সুদৃষ্টিতে থাকবার জন্য, প্রজাদের কাছে আদর্শ রাজা বলে স্বীকৃত হওয়ার জন্যে, বর্ণবিভক্ত সমাজে বর্ণধর্মরক্ষাকারী আখ্যা পাওয়ার জন্য রাম স্ত্রীত্যাগ ও শূদ্র তপস্বীর প্রাণ হরণ করেন। নৈতিক বিকল্পগুলি স্পষ্টই ছিল; অন্য রকম আচরণও করতে পারতেন কিন্তু মহাকাব্য তাঁর এই নিন্দনীয় আচরণেই প্ৰশংসা করেছে, জাতিবিভক্ত পুরুষশাসিত সমাজে এই রকম মূল্যবোধই অপেক্ষিত।
নৈতিক নির্বাচনের স্বাতন্ত্র্য সর্বদাই ছিল; নায়ক কখনওই ওই আচরণ করতে বাধ্য ছিলেন না। যুধিষ্ঠিরও পাশা না খেলতে পারতেন, স্ত্রীকে ভাইদের ও সম্পত্তি পণ না রাখতে পারতেন। অন্যায় বিকল্পগুলি নির্বাচন করবার পরও রক্তক্ষয়ী, লোকক্ষয়ী যুদ্ধ না করতে পারতেন, যেহেতু প্রাথমিক জুয়া খেলার অপরাধ তাঁর ছিল। কৃষ্ণের পরামর্শে দ্রোণের কাছে মিথ্যা কথা না বলতে পারতেন, তাতে দ্রোণের মৃত্যু হত না, পরোক্ষে এ মৃত্যুর দায় তো তাঁরই। যুদ্ধের পরে গান্ধারীর কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছিলেন তিনি। এই নায়কটির বিবেক দ্বিধাখণ্ডিত, ইনি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থতিতে ভিন্ন ধরনের নৈতিক বিকল্প নির্বাচন করতেন। এতে মহাকাব্যটি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে, মানুষ হিসেবে যুধিষ্ঠির অনেক বেশি বিশ্বাসনীয় হয়েছেন; কিন্তু এ সব থেকে দ্বিধাহীন ভাবে বুঝতে পারি যে, গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে নৈতিক বিকল্প ছিল, দৈব হাত ধরে কাউকে কখনও অন্যায় করতে বাধ্য করেনি।
মহাকাব্যের চরিত্রগুলি, বিশেষত নায়ক এবং প্রতিনায়ক অন্ধ যুক্তিহীন নিয়তির হাতে ক্রীড়নকমাত্রই ছিলেন না। এঁদের মধ্যে অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রও আছেন, যাঁর নৈতিক অন্ধতারই প্রতীক দৈহিক অন্ধতা। পদেপদে গান্ধারী, বিদুর ও সঞ্জয় তাঁর বিবেকের ভূমিকায় থেকে তাঁর নীতিবোধকে জাগরিত করে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবার নৈতিক দায়িত্বের সামনে এসে তিনি অন্যায় পথই বেছে নিয়েছেন; এবং এতে নিয়তির কোনও ভূমিকাই ছিল না। মহাকাব্যোত্তর পৌরাণিক সাহিত্যে বহু উপাখ্যান উদ্ভাবিত হয়েছে, উপদেশ অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে, নিয়তির সার্বভৌমত্ব দেখবার জন্যে। এ যেন কাঁচা বিদ্যুতের তারের পরিসরে চলাফেরা করা, সামান্যতম অনবধানতাতেই মৃত্যু অবধারিত। তবু কিছু লোক প্রতিবাদ করে এবং চড়া দাম দেয়। জন্মান্তর ও কর্মবাদের সমন্বয়ে যে ছকটি নির্মিত হয়েছিল, তাতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছারও ব্যাখ্যা হয় যে সেটা নিয়তি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তই, অথবা সত্যকার কোনও প্রতিবাদ দেখা দিলে তার মূল্য জন্মে জন্মান্তরে শোধ করতে হয়।
বেদের ব্রাহ্মণ্যসাহিত্য থেকেও দেখা গেছে বহুবার অসুররা ন্যায় পথে থাকলেও দেবতারা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেন, শুধু তারা অসুর বলেই। এখানে দেবতাদের সঙ্গে নৈতিকতার কিছুমাত্র যোগ নেই। এমন বহু কাহিনি বৈদিক সাহিত্য থেকে পরবর্তী মহাকাব্য পুরাণে ও আছে যেখানে দেবতারা ইষ্টসিদ্ধির জন্য অম্লানবদনে মিথ্যাচরণ ও প্রবঞ্চনা করেছেন; দেবতাদের হাতে অসুরার বারবার অহেতুক নির্যাতন ভোগ করেছেন। এখন এই পরাজয়ে প্রবঞ্চনার জন্যে নিয়তিকে দায়ী করলে পুরুষকারের মূল্য থাকে না, শুধু দেবতাদের নৈতিক দায়িত্ব থেকে অন্যায় ভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই ভাবে উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে পুরুষকার এবং মানুষের প্রযত্ন নিয়তির অধস্তন স্থান পায়। এমন অসংখ্য কাহিনি থাকলে সেগুলি কল্পিত উপাখ্যান হলেও, ক্রমে শুধুমাত্র সংখ্যাধিক্যের জন্যে তাদের একটা ওজন গড়ে ওঠে এবং তার দ্বারা ধীরে ধীরে কল্পিত প্রামাণ্যতা আরোপ করা হয় নিয়তিবাদে; মানুষ পুরুষকারে বিশ্বাস হারায়।
যুক্তিপরম্পরাক্রমে পুরুষকারে বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার থেকে অনিবার্য ভাবেই আসে নিয়তির কাছে নিশ্চেষ্ট আত্মসমর্পণ। এ থেকে আসে জীবনবিমুখতা। মস্করী গোশালের নেতৃত্বে আজীবিকরা এ তত্ত্বের চরমপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন। তাঁরা প্রচার করতেন, পুরুষকারের একান্ত নিষ্ফলতা এবং নিয়তিবাদের সার্বভৌমতা। গোশালের ভক্তরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে ছিলেন এক সহস্রাব্দেরও বেশি; কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়ের কথা এই যে, এ-মত একদা লুপ্ত হয়ে গেল। তিনটি কারণে:
(১) এর মতাদর্শগত বহু উপাদান ব্রাহ্মণ্যধর্ম আত্মসাৎ করে নিল;
(২) এদের মত ৬৪০০০ জন্মের পর মানুষ আপনা থেকেই মোক্ষলাভ করবে, এই বিপুলসংখ্যা মুক্তিকে বোধের অতীত কালে ঠেলে সরিয়ে দেয়; সেটা কতকটা গ্রহণ করে জৈনধর্ম, যাতে কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ একটু ভিন্নরূপে আছে, কিন্তু নিয়তির কাছে নিঃশর্ত আত্মসর্পণ নেই; বরং নিয়তির ভূমিকা সেখানে একান্তই গৌণ;
(৩) নিয়তির কাছে বুদ্ধি যুক্তি সব সমর্পণ করার মধ্যে মনুষ্যত্বের একটা অপমান আছে। মানবিক মর্যাদাবোধই প্রতিবাদ করেছিল মানুষের নিশ্চেষ্ট সত্তার বিরুদ্ধে; নিয়তি ঘটনা ঘটাবে, আর মানুষের কাজের ওপরে মানুষের কোনও ভূমিকা থাকবে না— এটা মানবিক গর্বকে আঘাত করে। স্বাধীন ইচ্ছা বিসর্জন দেওয়ার চেয়ে একটা কর্মপন্থা বেছে নিয়ে সে অনুসারে কাজ করার মধ্যে মানবিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে। যদি কর্মের অন্তে বিফলতা আসে বা নিশ্চিত পরাজয় বা মৃত্যু আসে, তা হলেও পরিশেষে শতাব্দীর পর শতাব্দীর যে ইতিহাস মানুষ দেখেছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, ব্যর্থতাই পুরুষকারের নিশ্চিত পরিণাম নয়, মানুষের বহু প্রচেষ্টা জয়যুক্তও হয়েছে।
মানুষের জ্ঞানের জগৎ যত প্রসারিত হয়েছে, প্রকৃতির ওপরে তার অধিকার যত বেড়েছে, ততই নিয়তি, যদৃচ্ছা বা ভাগ্যের স্বেচ্ছাচারিতা, অন্তত কতক অঞ্চলে ও কতকাংশে কমেছে। কাজেই ইতিহাসই পুরুষকারকে সক্রিয় হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে। তা ছাড়া মানুষ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেছে যে, নিয়তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করা হল শাস্ত্রকার ও সমাজপতিদের একটি কায়েমি স্বার্থ; একে মানলে মনুষ্যত্বের অমর্যাদা হয়।
ধীরে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই মানুষ বুঝতে শিখেছে যে, কিছু ঘটনা আকস্মিক, যেমন ভূমিকম্প, খরা, বন্যা, মহামারী, পথে বা জলে দুর্ঘটনা, ব্যাধি, জন্মাগত শারীরিক বিকার, অকালমৃত্যু। এ সবের ওপরে মানুষের সত্যিই বিশেষ কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। বিজ্ঞানের এই প্রভূত উন্নতির যুগে মানুষকে যত সামাজিক অন্যায়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার কারণ বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ। স্বার্থসন্ধানী রাষ্ট্রনেতারা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করছে তাদের ইষ্টসিদ্ধির জন্য, রোগের চিকিৎসা যতটা প্রয়োজন ততটা উদ্ভাবিত হচ্ছে না, লাভের লোভে, দারিদ্র দূর করা যাচ্ছে না, এবং এটা ঘটছে নেতাদের স্বার্থবুদ্ধির জন্য, যার ওপরে এখন সাধারণ মানুষের কোনও হাত নেই। এমন কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনও কার্যকরী হল না, যার লক্ষ্য সাধারণ মানুষের সুখসমৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাশ ও আরাম। তবু মানুষের সমবেত চেষ্টা থাকবেই রাষ্ট্র নেতাদের স্বার্থবুদ্ধির স্বরূপ উদ্ঘাটন করে সেই বিপ্লব আনার, যার ফল স্থায়ী ভাবে বহুজনের সুখে ও হিতে নিয়োজিত হবে।
এই বিজ্ঞানের দ্বারাই তো কত রোগ নির্মূল হয়েছে, কত মঙ্গলকর আবিষ্কার হয়েছে, মানুষের পরমায়ু বেড়েছে। এ সবে মানুষের আত্মপ্রত্যয় বেড়েছে। সে আজ তাই অন্ধ ভাবে নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত নয়। যদিও সে জানে, আকস্মিক ঘটনা ও দুর্ঘটনাকে বিজ্ঞান রোধ করতে পারবে না; কিন্তু এগুলিকে সে আকস্মিক দুর্ঘটনাই বলবে, নিয়তি বলবে না।
ঋতুপঞ্জির আবিষ্কার ও মৌসুমি বায়ুর গতিপথ আবিষ্কার বহু নৌকাডুবি বাঁচিয়েছে। তেমনই প্রকৃতি ও তার আচরণ সম্বন্ধে জ্ঞান মানুষকে অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্বন্ধে পূর্বাহ্নে অবহিত করে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ক্রমে মানুষ যখন আইন উদ্ভাবন করেছে তখন সমাজের লোকেরা নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার, দাবি ও দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে। এতে রাষ্ট্রপতিদের অহেতুক অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু পরিমাণে নিরাপত্তা বেড়েছে। ক্রীতদাস, নারী, নিম্নবর্গের মানুষের অধিকার আইনে স্বীকৃত হয়েছে, যদিও সমাজ বহুলাংশে এ সব অধিকারকে কার্যকরী করা সম্বন্ধে উদাসীন।
সামন্ত্রতন্ত্র যখন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মনুসংহিতা ও কুড়িটি ধর্মশাস্ত্র এবং পরবর্তী কালে অগণ্য স্মৃতি ও নিবন্ধসাহিত্যের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে একটি আইনের ছক নির্মাণ করল— রাজনীতি, অর্থনীতি ও দণ্ডনীতির কাঠামোয় তখন এ ছক মানুষের জীবনের সমস্তটার ওপরে এমন এক সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন করল যার থেকে কোনও পরিত্রাণ নেই। সাধারণ মানুষের জীবনে আইন আজ দুর্জয় অমোঘ নিয়তির চেহারাতেই দেখা দিয়েছে। যারা নিম্নবর্গে জন্মেছে অস্বাস্থ্য, দারিদ্র, অশিক্ষার গ্লানিময় পরিবেশে যাদের জীবননির্বাহ করতে হয়— এবং এরাই এ দেশে অধিকাংশ, এদের আত্মন্নোতির আশ্বাস আইনের শাসনে এখনও পর্যন্ত নেই। আইন নিরপরাধকে পুরস্কৃত করে না, অপরাধীকে শাস্তি দেয় পদে পদে। নিম্নবর্গের মানুষ ধর্মশাস্ত্র স্মৃতিশাস্ত্রে অবজ্ঞাত; পরবর্তী কালের আইনে আক্ষরিক অর্থে সকলের সমতা থাকলেও প্রয়োগের যন্ত্রটি যেহেতু উচ্চশ্রেণির হাতে তাই সাধারণ মানুষের পক্ষে সুবিচার পাওয়ার আশা পদে পদে প্রতিহত হয়। জন্মান্তরবাদ তাকে ভবিষ্যৎ উন্নতির যে স্বপ্ন— ভ্রান্ত স্বপ্নই— দেখার অধিকার দিয়েছিল, নির্ব্যক্তিক কঠোর অমোঘ আইন তার সে স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে যা দিল তা বাস্তবে তাকে ঠেলে দিল অপ্রতিকার্য এক দুঃস্বপ্নের জীবনে। এ হল আধুনিক যুগে নিয়তির অন্য এক রূপ। জন্মান্তরবাদ আপাত-নমনীয়, আইন স্বরাট, কঠিন, একনায়ক।
রাষ্ট্রশক্তি যতক্ষণ শ্রেণিশাসনের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে ততক্ষণ সাধারণ মানুষের সামনে তা আইন, সম্পূর্ণ নির্ব্যক্তিক এক শাসনশক্তি, যার থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনও আশা নেই। এতে অপরাধী শাস্তি পেলেও অপরাধ প্রবণতার পরিবেশে সে অসংখ্য মানুষ বাস করে তাদের পক্ষে এটা নিয়তির মতোই অমোঘ এক সন্ত্রাস।
বর্তমান ভারতবর্ষে নিয়তির নবতম প্রকাশ ঘটেছে বহুজাতিক সংস্থাগুলির গণমাধ্যমের সাহায্যে মানুষের জীবনকে ভোগ্যপণ্যকেন্দ্রিক করে তোলবার বিপুল আয়োজন। সাধারণ মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ, সংখ্যায় যারা দেশের ধনীদের তুলনায় বহুগুণ বেশি, তাদের এটা এমন এক অবাস্তব স্বপ্নলোকের সন্ধান দিচ্ছে যেখানে মানুষ নিমেষে সব কামনা পূরণ করতে পারে, জরা, অক্ষমতাকে তাকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রতি মুহূর্তে দূরদর্শন, সংবাদমাধ্যম ও বিজ্ঞাপন তাকে নতুন নতুন বস্তু, ভোগ, সুখ, বিলাস কামনা করতে শেখাচ্ছে, শুধু নিজের এবং নিকটতম বৃত্তে। যারা তাদের ভোগলোলুপতার ইন্ধন জোগাচ্ছে, তারা পরার্থপরতাকে মূর্খতায় পরিণত করে তুলেছে। মুশকিল হল, তিলে তিলে কামনাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু আয়ত্তের সম্পূর্ণ বাইরেই থেকে যাচ্ছে শতকরা পঁচানব্বইটি মানুষের গণমাধ্যম এও শেখাচ্ছে যে, এ সবই স্বল্পকালে আয়ত্ত করা সম্ভব, সশস্ত্র দুর্বৃত্তের যথেচ্ছ সন্ত্রাসের প্রয়োগে। ফলে সাধারণ মানুষকে অচরিতার্থ কামনার নরকে ঠেলে দিয়ে এই দুষ্টচক্র অমোঘ এক নিয়তির রূপেই দেখা দিচ্ছে।
নবতম নিয়তির এ সব দুর্জয় শক্তিশালী প্রকাশগুলিকে রোধ করা আপাত ভাবে অসাধ্য হলেও যেহেতু ওই জয়েই মানুষের অন্তরাত্মার শক্তির শেষ পরিচয়ের স্পর্ধিত আহ্বান আছে, তাই সকলে সর্বশক্তি সংহত করে এর প্রতিরোধে এক দিন এ নিয়তির সঙ্গে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হবেই। তবু লোকে জানে, নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করার একটা বিকল্প আছে: পুরুষকার। সমবেত উদ্যোগে স্বীকৃত অধিকারকে বাস্তবে পরিণত করার প্রয়াস সার্থক প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, বিপ্লব মানুষকে উৎসাহ জুগিয়েছে— এই পথে নিয়তিকে অগ্রাহ্য করে পুরুষকারের সাহায্যে নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে। এখন মানুষ জানে, যা কিছু নিয়তি-নিরূপিত বলে সে জানত, তার অনেকটাই ক্ষমতাসীন সম্প্রদায়ের হাতে তৈরি মানুষের দুর্গতি। এবং তার প্রতিকার আছে। এই জানাটার দামই মানুষের ইতিহাসে বহুমূল্য। একক ব্যক্তি, কিছু জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, শক্তি ও বিত্তহীন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাহীন মানুষ এখনও মানুষের তৈরি দুঃখ ভোগ করে এবং যতদূর দৃষ্টি যায় আরও দীর্ঘকাল এ সব অবিচার থাকবে। কিন্তু সংগ্রামটা চলছে, সামগ্রিক ভাবে নিয়তির প্রতিস্পর্ধায় মানুষ সক্রিয়, নিয়তির নামে আচরিত, ক্ষমতায় আসীন সম্প্রদায়ের অত্যাচার মানুষ আর মেনে নেবে না। এই সংগ্রামে প্রত্যেকটি জয় নিয়তিবাদের ভিত্তি থেকে একটি করে পাথর সরিয়ে দিচ্ছে। আকস্মিক দুর্ঘটনাকে মেনে নিয়েই মানুষকে বাঁচতে হবে, এর ওপরে তার কোনও শক্তি নেই। এটা এই কারণে নেই যে এর হেতু জানা যাবে না, তাই অগ্রিম প্রতিবিধানও সম্ভব হবে না। কিন্তু মানুষ নিয়তিকে স্বীকার করে তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হবে না, আকস্মিক দুর্ঘটনাকে নিয়তি বলে দুর্জ্ঞেয় করে তুলবে না। বাকি যে সব দুর্ঘটনা-প্রতিকার্য ও নিবার্যতাকে নিয়তি বলবে না, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী হওয়ার সাধনা করবে।
সর্বোপরি ধীরে ধীরে মানুষ জন্মান্তর ও কর্মবাদের মোহ থেকে মুক্ত হবে। পূর্বজন্মে সঞ্চিত কর্মের বহুজন্মব্যাপী ফলভোগের যে পরিপাটি রচনা ও রটনা এত যুগ ধরে চলে এসেছে তা থেকে তার স্বচ্ছতর দৃষ্টি তাকে মুক্তি দেবে। মানুষের এই সমাজব্যবস্থা যে ‘সমাজপতি’দের কায়েমি স্বার্থ ও তার সম্বন্ধে ধর্মমোহাচ্ছন্ন এই ‘বোধ’টি অক্ষুণ্ণ রাখা- তার সঙ্গে স্বর্গ ও নরক সম্বন্ধে লোভ ও আতঙ্ক দিয়ে তাকে নিয়তির পায়ে মাথা খোঁড়ার লক্ষ পদ্ধতির বিধান দেওয়া— এইগুলির স্বরূপ খোলা চোখে দেখে সমূলে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি তার জন্মাবে। এই আত্মশক্তি তার প্রত্যয় জাগাবে ভবিষ্যৎ জয় সম্বন্ধে। বিগত পাঁচ সহস্রাব্দের জ্ঞাত মানব-ইতিহাস তাকে জানাবে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, তথ্যে ও তত্ত্বে মানুষের কতখানি অগ্রগতি হয়েছে এবং এই জানা-ই তার জ্ঞানের অনুপাতে প্রকৃতি, সমাজ ও মহাবিশ্ব সম্বন্ধে শক্তি অর্জন করার সাহস জোগাবে। নিয়তিকে পদদলিত করে ক্রমেই জয়যুক্ত হতে থাকবে আত্মশক্তি।