নিয়তি ও মুক্তি প্রচেষ্টা

নিয়তি ও মুক্তি প্রচেষ্টা

প্রয়োজনে মানুষ যেমন নিয়তির বিধান খণ্ডনের জন্যে ব্রত, দান, উপবাস, ধ্যান, জপ, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি করে, তেমনই তার হয়ে অন্যরাও ওই একই উদ্দেশ্যে কিছু কিছু ধর্মক্রিয়া করতে পারে। যজমান শব্দটির আদিমতম এবং ব্যাকরণ সম্মত অর্থ ছিল, ‘যে নিজে যজ্ঞফল ভোগ করবে তেমন যজ্ঞকারী।’ (ব্যাকরণ সূত্রটি হল, ‘স্বরিতঞিতঃ কর্তৃগামিনি ক্রিয়াফলে’।) সম্ভবত, বৈদিক আর্যরা পশুচারী যাযাবর যুগে গোষ্ঠীর প্রতিভূকে দিয়ে যজ্ঞ করতেন, তখন যজ্ঞফল গোষ্ঠীতেই বর্তাত, তাই যজমানের যজ্ঞফল যজ্ঞকর্তৃগামী। পরে যজ্ঞ যখন জটিল, ব্যয়সাধ্য, বহু পুরোহিত সাপেক্ষ হয়ে উঠল, যখন সাধারণ বিত্তহীন মানুষ আর যজ্ঞ করে না, দূর থেকেই শুধু দেখে, তখন বৃত্তিধারী পুরোহিত যজ্ঞ করত। যজ্ঞের ব্যয় নির্বাহ করত যে ধনী রাজন্য ও বৈশ্য, তার জন্যে, এবং যজ্ঞফল বর্তাত সেই ধনীতেই। তখন যজমান শব্দটা রয়ে গেল, অর্থটা পরিবর্তিত হয়ে গেল। পরস্মৈপদী পুণ্যকর্মের সূচনা এইখানেই। বৈদিক যুগের যজ্ঞেও যজমানের হয়ে ঋত্বিক তার পুত্রোষ্টি যজ্ঞ বা অশ্বমেধ বা রাজসূয় যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারত বা তার শত্রু ধ্বংসের জন্যে নানা অভিচার ক্রিয়া করতে পারত। ধর্মাচরণে এই পদ্ধতির পরিবর্তে ক্রমে ক্রমে সমাজে পূজার আবির্ভাব। ধর্মের যে গৌণ ধারাটি এত কাল সমাজের ঐহিক কল্যাণে নিয়োজিত ছিল— তা এবারে অনুকারী অভিচার ক্রিয়ার দ্বারা প্রতিকূল দৈবকে অনুকূল করার চেষ্টা করল। এ ধরনের ক্রিয়াকলাপ সমাজের আদিম স্তর থেকেই লোকমানসে অন্তঃসলিলা হয়েছিল, এত দিনে তা প্রকাশ্যে দেখা দিল, সম্ভবত অথর্ব বেদের সময় থেকেই।

এই সব দৈবনিয়ন্ত্রণের উপায়গুলির মধ্যে প্রধান গুরুত্ব ছিল শাপ ও বরের। বর, (১) দেবতা দেবতাকে দিতে পারতেন, (২) দেবতা মানুষকে দিতে পারতেন, (৩) মানুষ মানুষকে দিতে পারত, এবং (৪) খুব অল্প ক’টি নিদর্শনে, মানুষও দেবতাকে দিতে পারত। বর যোগ্যতা দিয়েও পাওয়া যায় আবার দেবতার অনুগ্রহেও পাওয়া যায়। রামায়ণ-এ দেখি বৈশ্রবণা ব্রহ্মার কাছ থেকে সার্বভৌমত্বের বর পেয়েছিলেন। (৭:৩:৯-১৮) দশগ্রীব রাবণ তাঁর দশটি মাথা একে একে কেটে দেবতাকে নৈবেদ্য দিয়েছিলেন, এবং এ জন্যে বর লাভ করেছিলেন, যক্ষ, দৈত্য, অসুর ও রাক্ষস কেউ তাঁকে বধ করতে পারবে না অর্থাৎ প্রায়-অবধ্যতারই বর। (৭:১০:১৯)

প্রজাপতি দক্ষ যখন জামাতা চন্দ্রের সাতাশটি স্ত্রীর মধ্যে শুধুমাত্র রোহিণীর প্রতি তার পক্ষপাতিত্বের জন্যে তাকে যক্ষ্মারোগের অভিশাপ দেন, যার ফলে দক্ষের সাতাশটি কন্যারই বৈধব্য সম্ভাবনা দেখা দিল, তখন দক্ষই আবার আর একটি বর দিয়ে শাপটিকে প্ৰায় খণ্ডন করেন। (ব্রহ্মবৈর্ত পু. প্রকৃতিখণ্ড ৯:৫৭,৫৮) অপুত্রক গন্ধর্ব পঞ্চশিব তপস্যায় শিবকে প্রীত করেন; শিবের বরে তিনি নারদকে পুত্ররূপে লাভ করেন। (গণপতিখণ্ড ১২:৪২) বিষ্ণু শিবকে বর দেন। (গণপতি ৬ষ্ঠ অধ্যায়)

পরবর্তী উপপুরাণগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল ব্রহ্মবৈবর্ত, দেবীভাগবতও বৃহন্নারদীয় এগুলিতে দেবতারা পরস্পরকে বর দিচ্ছেন এমন বহু কাহিনি আছে। তাঁরা একে অন্যের কোনও আচরণে প্রীত হয়ে বর দিচ্ছেন, অথবা দুর্দমনীয় কোনও অসুরকে পরাস্ত করবার পুরস্কার রূপে বর দিচ্ছেন, যাতে স্বর্গ ও দেবতাদের নিরাপত্তা-বিধান ও পৃথিবীর শান্তি হয়, এমন অনেক কাহিনি আছে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ শাপ ও বরের যুক্তিমত্তার মূলোচ্ছেদ করে বলে ‘শাপ ও বর’ সম্পূর্ণতই ভাগ্যের ওপরে নির্ভর করে।

আশীর্বাদ করবার জন্যে সংস্কৃত ব্যাকরণে বিশেষ একটি ল-কার (ক্রিয়ার উদ্দেশ্যবাচক চিহ্ন) ব্যবহৃত হয়— আশীর্লিঙ। আশীর্বাদ করার অধিকারী বয়োজ্যেষ্ঠ, মহত্তর অথবা শক্তিমত্তর ব্যক্তি বর দেন নিজের চেয়ে হীন কোনও ব্যক্তিকে। ভারতীয় সাহিত্যে বরদানের অসংখ্য নিদর্শন আছে; তার মধ্যে কোনও কোনওটি জটিলতার সৃষ্টি করেছে, যেমন শিব অন্ধকাসুরকে বর দিয়ে শক্তিমান করার পরে সে স্বর্গবাসীদের উৎপীড়ন করতে আরম্ভ করে। শেষ পর্যন্ত শিব অন্ধককে অসুরত্ব থেকে মুক্তি দেন। (বামন পুরাণ ৭০:৫৮) ব্রহ্ম মাঝে মাঝেই দেবতা বা মানুষের দীর্ঘ কঠোর তপস্যায় ব্যতিব্যস্ত বোধ করে সম্পূর্ণ অযোগ্য ব্যক্তিকে অমরত্ব বা অজেয়ত্বের বর দেন; পরে ওই বরপ্রাপ্ত ব্যক্তি অত্যাচারী হয়ে ওঠে, তখন দেবতারা শিব বা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে তাঁরা একটা সমাধান করে দেন।

প্রাচীন গ্রিক অতিকথাতেও দেব-দেবীরা পরস্পরকে বর দিচ্ছেন এমন কথা আছে। সেখানেও কিছু কিছু বর ঈর্ষা ও অনিষ্টের সৃষ্টি করত, এতে এমন জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হত যে, দেবতারা নানা বঙ্কিম পথে ওই জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেন। বাইবেল-এর ‘পুরাতন নিয়মে’ বহুবার মানুষকে বর বরক (-বরখ-বর) য়াত্বেহ (ঈশ্বর) বা দেবদূতরা সফল করেছেন। বহু প্রাচীন ধর্মেই দেবতাদের পক্ষে বর দেওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল, কখনও বিনম্র প্রার্থনার দ্বারা তা লাভ করা যেত, কখনও বা কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন বা তপস্যার দ্বারা, কিংবা শাস্ত্র-নির্দিষ্ট কোনও পন্থা অবলম্বনে, আবার কখনও-বা দেবতারা নিজেরাই সদয় হয়ে বর দান করতেন। প্রাচীন ফিনিশিয়াতে গৃহকর্তা একাই দেবতাকে অনুনয় করে পরিবারের পক্ষে আশীর্বাদ নামিয়ে আনতে পারতেন। কঠোপনিষদ-এ নচিকেতা যমের বাড়িতে গিয়ে তিন দিন উপবাসী ছিলেন, যম বাড়িতে ছিলেন না বলে। ব্রাহ্মণ সন্তানের ত্রিরাত্রি উপবাসে গৃহস্বামী হিসেবে যম অপরাধী বোধ করেন ও অমঙ্গল আশঙ্কায় তাঁকে তিনটি বর দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন; এরই ফলে পুরো কঠোপনিষদ জুড়েই যম নচিকেতার কাছে পরলোক ও আত্মাতত্ত্ব প্রকাশ করেন। (১:১:৯) ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে অনেক উপাখ্যানে দেবতারা মানুষকে বর দেন, কারণ প্রার্থী মানুষ কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন করেছে, নানা ভাবে আত্মত্যাগ করেছে ও ধ্যান-তপস্যা করেছে। বহুবার দেখা গেছে, বরদানটি অপাত্রে বা অনুপযুক্ত ভাবে হয়েছে বলে তার থেকে অন্য বিপদ দেখা দিয়েছে।

রামায়ণ-এ অসুর সুকেতু কঠিন তপস্যা করে পুত্রলাভের জন্যে; ব্রহ্মা তাকে পুত্ৰ না দিয়ে কন্যা দান করেন; সে তাড়কা, যে শক্তি ও বিক্রমে পুরুষের মতোই ছিল, কারণ তার পিতা পুত্র-আকাঙ্ক্ষায় কঠিন তপস্যা করেছিলেন। (১:২৫:৫-৬) দ্রুপদ পুত্রের জন্যে শিবের কাছে প্রার্থী হয়ে একটি পুত্র লাভ করেন, যে পরে কন্যাত্ব প্রাপ্ত হয়। (মহাভারত ৫:১৮৮ পুরো অধ্যায়টিই) দ্রৌপদীর বহুপতিকতার বিষয়ে ব্যাস বলেন, এক নারী মনোমত স্বামী না পেয়ে কঠোর তপস্যা করেন। প্রীত হয়ে শিব বর দিতে চান; বারবার পাঁচবারই সে নারী, উপযুক্ত স্বামী প্রার্থনা করে; এ-ই দ্রৌপদী, ওই কারণেই সে পঞ্চপতিকা। (১:১৮১:৪১-৪৬) স্পষ্টতই, এখানে ব্যাস বহুপতিত্বের ব্যাখ্যা করেছেন যা তখন প্রায় লুপ্ত হয়ে এসেছে, সমাজে আর আচরিত হয় না। (যদিও মহাভারতেই সপ্তপতিকা জটিলার ও অন্য দু-একটি এ ধরনের ব্যতিক্রমী নিদর্শন আছে।) এই পঞ্চপতিকার বরটি নেহাৎই একটি প্রায়-অপ্রচলিত সামাজিক রীতির ব্যাখ্যা।

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এ সাবিত্রীকে যমের বরদানের কথা পড়ি। (প্রকৃতিখণ্ড ৩৪ অধ্যায়) বৃকাসুর খুব পরাক্রান্ত ও অত্যাচারী হয়ে উঠেছিল। ক্রমাগত উচ্চাশা বাড়তে বাড়তে সে শিবের কাছে বর পায়। শিবের একটি নাম আশুতোষ, কারণ তিনি যাকে তাকে, যখন তখন যা-তা বর দিয়ে বসেন। শিব অসুরকে বর দিলেন, ‘যার মাথায় সে হাত দেবে সে-ই ভষ্ম হয়ে যাবে।’ বর পেয়ে বৃকাসুরের এত আহ্লাদ হল যে, অন্যমনস্ক ভাবে নিজেরই মাথায় হাত দিয়ে ভষ্মীভূত হয়ে গেল। (ওই কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৩৬:৩১-৩৯) রাধা বর দিতে চান স্বয়ং ব্রহ্মাকে, ব্রহ্মা বর প্রার্থনা করেন যে, রাধাকৃষ্ণে যেন তাঁর অচলা ভক্তি থাকে; রাধা সম্মত হন। (ওই কৃষ্ণজন্মখণ্ড ১৫:১২০-২১)

বৃকাসুরের কাহিনিটি তাৎপর্যপূর্ণ; এতে দেখি, বরদানের মুহূর্তে বরটি থাকে অনৈতিক। অযোগ্য, দুরাত্মা ও মন্দমতি ব্যক্তিও সৎ এবং ধর্মাচরীর মতোই বর লাভ করে; কিন্তু সব বরের মধ্যেই নিহিত থাকে তার ব্যর্থতার বীজ। তাই শেষ পর্যন্ত, যদিও রাবণ, বৃক, অন্ধক বা তারকাসুরদের বর দান করা হয়, তবু দেবতারা খেয়াল রাখেন যাতে মন্দ ব্যক্তি বর পেয়েও আয়ত্তের বাইরে না যায় বা স্থায়ী কোনও ক্ষতি করতে না পারে। তাঁরা এমন ব্যবস্থা করেন যাতে ওই দুষ্টাত্মারা বর পেয়েও শেষ পর্যন্ত নিজের দোষেই ধ্বংস হয়ে যায়, যাতে বিশ্বজগতের ভারসাম্য বজায় থাকে। ব্রহ্মার প্রতি রাধার বর গ্রন্থকারের একটি স্বচ্ছ কৌশল যাতে রাধাকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিকে গৌরাবান্বিত করা যায়। দেবীভাগবতপুরাণ-এ একটি অদ্ভুত কাহিনি আছে: স্বর্গে তুলসীর সঙ্গে কৃষ্ণের একটি সংক্ষিপ্ত প্রেমসম্পর্ক ঘটে। জানতে পেরে কৃষ্ণের প্রিয় পত্নী রাধা তুলসীকে মর্ত্যনারী হয়ে জন্মাবার অভিশাপ দেন। তুলসীর সুদীর্ঘ তপস্যায় নারায়ণ নেমে এলে তুলসী তাঁকে স্বামীরূপে কামনা করেন, কিন্তু নারায়ণ তাঁকে বলেন যে, প্রথমে তুলসীকে সুদামা-র স্ত্রী হতে হবে, পরে তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হবেন এবং এর প্রাক্শর্ত হল তুলসীকে একবার অসতী হয়ে স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসিনী হতে হবে। (লক্ষণীয় অবৈধ প্রণয়ে কৃষ্ণেরও দায়িত্ব ছিল, কিন্তু মূল্য দিতে হল একা নারীটিকেই, যেমনটি সমাজে ঘটে।) সুদামার ওপরে অভিশাপ এল, তিনি অসুর শঙ্খচূড় (তুলসীর স্বামী) হয়ে জন্মাবেন এবং দেবতাদের বিরক্তিভাজন হবেন। তাই স্বর্গেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, শিব অসুরটির সঙ্গে যুক্ত তাকে করবেন, নারায়ণ শঙ্খচূড়ের বেশে তুলসীকে সম্ভোগ করবেন। এটা ঘটাবার সময় তুলসীর সংশয় জাগে, কৃষ্ণের শঙ্খচূড় ছদ্মবেশ সত্ত্বেও। তখন নারায়ণ তুলীর কাছে সমস্ত কৃৎকৌশল ব্যক্ত করেন, এবং তুলসীকে মৃত্যুবরণ করে স্বর্গে তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে বলেন। (৯:১৭ থেকে) এ কাহিনিতেও গ্রন্থির মধ্যে গ্রন্থি আছে: সমাজে স্বীকৃত নীতিবোধের দৃষ্টিতে তুলসী স্বামী শঙ্খচূড়ের প্রতি অবিশ্বাসিনী হন, যে শঙ্খচূড়কে তিনি দাম্পত্যজীবনে ভালবাসতেন; কিন্তু আরও গভীরতর, সত্যতর এক স্তরে তাঁর কোনও অপরাধ ঘটেনি, কারণ তাঁর তপস্যা এবং সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা ও চিত্তের গভীরে প্রোথিত প্রেম ছিল কৃষ্ণের প্রতিই, যাঁর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তার মিলন ঘটল। এ ঘটনার সমস্ত সামাজিক ও নৈতিক জটিলতা বিধৃত আছে শাপ ও বরের কাঠামোতেই। অতএব দেবতারা বর দিলেও প্রচলিত অর্থে সে বরের কোনও নৈতিকতা থাকে না, যদিও প্রাথমিক ভাবে দেবতারা পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যই বর দেন, যাতে গভীর বা স্থায়ী কোনও ক্ষতি না হয়।

সবচেয়ে সাধারণ বর হল মানুষ মানুষকে যা দেয়। দেবতার দেওয়া বর সহজেই বোঝা যায়: দেবতারা অতিলৌকিক শক্তির অধিকারী এবং তা ব্যবহারও করেন। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই ভাবে বর দেওয়ার অধিকার আসে কোথা থেকে? ‘যে মধ্যস্থতা করে, সে অনুষ্ঠান এবং প্রতীক দুই-ই ব্যবহার করে, সে রাজা, পুরোহিত, সাধু ভবিষ্যদ্বক্তা অথবা গৃহকর্তা হতে পারে। অনুষ্ঠানের অর্থ হল, যে শক্তিগুলির দ্বারা অতিলৌকিক শক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায় সেগুলিকে সঞ্জীবিত করে তার দ্বারা দিব্যশক্তির সঙ্গে একটি বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করা… (উচ্চারিত) বাক্যও সেই দিব্যশক্তির উপাদান, যাকে পরিশীলিত বাক্যের দ্বারা ভবিষ্যদ্বাণী বা দিব্যনামের অনুষঙ্গের দ্বারা আহ্বান করা যায়। লিপিহীন সমাজে বরের সঙ্গে অতিকথার ঘনিষ্ঠ সংযোগ। বস্তুত এই সমাজের (মানুষের) জীবনে অতিকথাই দিব্য ইতিহাস, যা মানুষকে অতিলৌকিক জগতের সঙ্গে, বর্তমান কাল ও আদিমতম কালের, বর্তমান ক্রিয়ার সঙ্গে আদিমতম ক্রিয়ার যোগসাধন করে।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন, ২য় খণ্ড ‘ব্লেসিং’ পৃ. ২৪৮) পুরোহিতের অধিকার আসে দেবলোকের সঙ্গে তার সরাসরি পেশাগত যোগাযোগ থেকে; সাধুর অধিকার, তার পবিত্রতা তাকে ওই রকম যোগাযোগে অধিকার দেয় বলে, ভবিষ্যদ্বক্তার অধিকার হল স্বয়ং ভগবানই তার দিব্যশক্তির উৎস, রাজার অধিকার, তিনি দেবাংশে নির্মিত বলে। (স্মরণীয়, অষ্টানাং লোকপালানাং মাত্রাভিনির্মিতো নৃপঃ’, অর্থাৎ রাজা আটটি লোকপালের অংশ দিয়ে নির্মিত।) বৈদিক সাহিত্যে অতিপ্রাকৃত শক্তিযুক্ত উচ্চারিত বাক্য হল ‘ব্রহ্ম’, বাক্য, ‘বাক্’ যার দিব্যত্ব আসে— অতিকথা যা তাকে পবিত্রতায় মণ্ডিত করে— তার থেকে। উপনিষদের বহু উপখ্যানে ব্রহ্ম কিছু কামনা করেন, সে কামনা উচ্চারণ করেন এবং তৎক্ষণাৎ তা বাস্তবায়িত হয়। এ যেমন বাইবেল-এর ঈশ্বর বললেন, ‘আলো (সৃষ্টি) হোক’ এবং তৎক্ষণাৎ আলো হল; বাক্ এর বাস্তবায়ন। এই যাঁদের কথা আলোচনা করা হল, পুরোহিত, ইত্যাদি, এঁরা ভগবানের ভূমিকায় কাজ করেন বলেই যা বলেন, তা-ই ঘটে। এইখানেই এঁরা বাস্তবের অতীত এবং নিয়তির প্রতীক হয়ে যান।

বরদানের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যোগ্যতা, গুণ ও প্রার্থিত বস্তুলাভের নৈতিকতা হিসেবের মধ্যে ধরা হয় না, বরং বাইবেল-এর য়াহে যেমন একটি ব্যক্তিকে নির্বাচন করে তাকে বংশধর পুত্রের বর দিয়ে একটি মনোনীত বংশধারার সূত্রপাত করেন; এখানেও তেমন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেবতা বরদানের প্রাপককে খেয়ালখুশি মতন নির্বাচন করেন, সম্ভবত তাঁদের অনুগ্রহ ও ক্ষমতার প্রচারের জন্য। মাঝেমাঝেই তাঁরা পুরো দেবমণ্ডলীকে মুশকিলে ফেলেন অযোগ্যকে বর দিয়ে। কখনও বা শুধুমাত্র দীর্ঘ তপস্যাই হয় বরদানের মানদণ্ড এবং এর ফলেও বহু অযোগ্য ব্যক্তি বর লাভ করেন। এ সব বরের কোনও নৈতিক সমর্থন থাকে না। দেবতারা নিজেদের কৃপা ও ক্ষমতা ঘোষণা করেন অযোগ্যকে বর দিয়ে। অর্বাচীন পুরাণগুলিতে বর অতি সুলভে লাভ করা যায়, মাঝেমাঝেই অনৈতিক এবং ক্ষতিকর ভাবেও। কিন্তু কোনও দেবতার সাধ্য নেই প্রার্থীকে ‘না’ বলার। ফলে বরদানে বারবার প্রত্যাশিত ঘটনাস্রোত ব্যাহত হয়, এবং অর্বাচীন পুরাণের রচয়িতারা, যাঁদের কল্পনাশক্তি নিরতিশয় সীমিত, তাঁদের হাতে কাহিনিটিকে এঁকেবেঁকে এগোতে থাকে, শুধু শেষে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে দেওয়ার জন্যে। বর তাই আখ্যানের একটি অবজ্ঞেয় কৌশল, যেন কাহিনিটিকে যেনতেন প্রকারেণ সমাপ্তিতে পৌঁছে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। এ ধরনের কাহিনি থেকে যা প্রতীয়মান হয়, তা হল প্রার্থী— সে দেবতা, মানুষ, অসুর, রাক্ষস, গন্ধর্ব, নাগ, যে-ই হোক না কোনও কিছু তপস্যা বা কৃচ্ছ্রসাধন করেই এবং অনেক ক্ষেত্রে না করেও দেবতার কাছ থেকে বর আদায় করে নিতে পারে। নিয়তির গতিকে প্রার্থীর অনুকূলে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যে ধর্মতত্ত্বের এটি একটি কৌশল। দেবতা ও ঋষিরা নিয়তির কর্মচারী হিসাবে কাজ করেন প্রার্থীর স্বার্থের প্রয়োজনে বা কালের জন্য। যেহেতু নিয়তির অধিষ্ঠাতা এমন কোনও প্রধান দেবতা নেই যার কাছে জবাবদিহি করতে হবে, তাই বর প্রায়ই নীতিবর্জিত দায়িত্বজ্ঞানহীন এমনকী খামখেয়ালি বলেও প্রতীত হয়। বর যেন দেবতা বা ঋষিদের শক্তি প্রকাশ করবার একটা অবকাশ, তাঁদের বা তাঁদের প্রার্থীদের ইচ্ছা চরিতার্থ করবার জন্যে। যোগ্যতা, চরিত্রবল, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ, নির্দোষ স্বভাব, ধর্মসম্মত বা জনহিতকর কোনও উদ্দেশ্য— যা কিছু বরকে নৈতিক সমর্থন দিতে পারত তার কিছুই প্রায় কখনওই এ সব কাহিনিতে দেখা যায় না। দাতা ও প্রতিগ্রহীতা সম্পর্কই এই সব কাহিনির প্রাণবস্তু, বরটির নীতিগত সমর্থন প্রায় অনুপস্থিত থাকে। কখনও বর সামাজিক কোনও ঘটনার ব্যাখ্যা করে (যেমন দ্রৌপদীর পঞ্চপতিকতা), কখনও বা কাহিনিটি আত্মধ্বংসী, কখনও বা পরহসনীয়, যেমন বৃকাসুরের বর, কখনও বর পূরণ করতে গেলে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয় যেমন তুলসীর উপাখ্যানে, যদিও শেষ পর্যন্ত নৈতিকতার একটা পালিশ লাগানোর চেষ্টাও করা হয়। যে বস্তুটি প্রায় সব কটি বরের ক্ষেত্রে একান্ত অনুপস্থিত তা হল, কোনও রকম ধর্মীয় গম্ভীরতা বা নৈতিক কার্যকারণ সম্বন্ধ। বর নিয়তির হাতের ক্রীড়নক, ফলে নিয়তির মতোই দুর্বোধ্য।

‘বর’-এর বিপরীত মেরুতে থাকে অভিশাপ, কিন্তু তার ক্রিয়া ওই একই রকমের। যারা অতিলৌকিক শক্তির অধিকারী, কিংবা যে সব ব্যক্তিবিশেষ কোনও অবস্থায় ‘দিব্যত্ব কে স্পর্শ করেছে তাদের অভিশাপ সত্য হয়। দেবদেবীরা পরস্পরকে যেমন বর দিয়ে থাকেন, ঠিক তেমনই তাঁরা পরস্পরকে অভিশাপও দিয়ে থাকেন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যাস্ক বলেছেন যে, দেবতারা মানুষের প্রতিমূর্তিতেই নির্মিত। (নিরুক্ত ৭:২:৮) বোধহয় সেই কারণেই তাঁরা ঠিক মানুষেরই মতো আচরণ করেন। এতেই তাঁদের মানবিক মেজাজের ব্যাখ্যা মেলে।

এক রাজা দুরাচার ও অত্যাচারী ছিলেন বলে প্রজারা উৎপীড়িত ও ক্ষুব্ধ ছিল। পুরোহিত দেখলেন প্রজাদের ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ আছে, তখন রাজার বিরুদ্ধে যে অভিসম্পাত উচ্চারণ করলেন তা সফল হল। (জাতক, সংখ্যা ৫২০, গণ্ডতিন্দু)

রামায়ণ-এ শুনি, দেবতারা পার্বতীকে শিবের ঔরসে সন্তান গর্ভে ধারণ করতে বাধা দিয়েছিলেন বলে তিনি তাঁদের অভিশাপ দিয়েছিলেন— তাঁদের কারওরই নিজের স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান থাকবে না, তাঁরা অন্যের স্ত্রীতে সন্তান উৎপাদন করবেন। (এই শাপটিও গোলমেলে, কারণ পুরাণে এর কোনও সমর্থন পাই না; সব দেবতার সন্তানই বৈধ ধর্মপত্নীর গর্ভে তাঁদের ঔরসেই জাত। তবে কি পার্বতীর শাপটি আসলে সফলই হয়েছিলেন, পরে দেব-কাহিনিগুলিতে বৈধতা আরোপ করা হয়েছিল? বৃহস্পতির স্ত্রী চন্দ্রের ঔরসে বুধকে গর্ভে ধারণ করেন এবং পরে বৃহস্পতি সপুত্রা তারাকে গ্রহণ করেন।) পার্বতী পৃথিবীকে শাপ দেন সে বহুপতিকা হবে। (অতিকথা অনুযায়ী সব রাজাই পৃথিবীর প্রতি কাজেই পার্বতীর শাপ সফল হয়েছে।) এখানে এক দেবী সব দেবকে ও অন্য দেবীকেও অভিশাপ দিচ্ছেন। (রামায়ণ ১:৩৬:২১-২৪) রামায়ণ-এই আছে অপ্সরা পুঞ্জিকস্থলা (= অঞ্জনা) কে শাপ দিয়ে বানরীতে পরিণত করা হয় এবং বানর কেশরীকে তিনি বিবাহ করেন। বায়ু তাঁকে প্ৰণয় সম্ভাষণ করাতে তিনি তাকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাই এই শাপ। কিন্তু বায়ু তাকে তেজস্বী পুত্র লাভের বর দেন, সেই পুত্রই হনুমান। (৪:৬৬:৮-২০) রাবণও মানুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলেন, কিন্তু তিনি পুঞ্জিকাস্থলাকে ধর্ষণ করেন বলে ব্রহ্মা তাকে শাপ দেন: এর পর কাউকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলেই তার মৃত্যু হবে। (৬:১৩:১০-১৪) এ কাহিনি রামায়ণ-এ অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে, রাবণ কেন সাধ্য থাকলেও সীতাকে ধর্ষণ করেননি, তার ব্যাখ্যা রূপে এবং এর দ্বারা সীতার শুচিতাও প্রতিপন্ন হয়েছে। মহাভারত-এ বেশ কয়েকটি উপাখ্যান আছে যেখানে দেবতারা দেবতাদের শাপ দিচ্ছেন। পুরাণে এ ধরনের কাহিনি বিস্তর; বিশেষত উপপুরাণগুলিতে।

সরস্বতী লক্ষ্মীকে শাপ দিচ্ছেন উদ্ভিজ্জ (তুলসী) হয়ে মর্তে অবতীর্ণ হতে, এবং লক্ষ্মী সরস্বতীকে অনুরূপ শাপ দিচ্ছেন মর্তে নদী হতে। (দেবীভাগবৎ ৯:৬:৩২) গঙ্গাও সরস্বতীকে অভিশাপ দিচ্ছেন নদীরূপে মর্তে অবতীর্ণ হতে (৯:৬:৩৯); এই নদীই সরস্বতী। সরস্বতী অভিশাপ দেন, গঙ্গা মর্তে নেমে নদীরূপে প্রবাহিত হয়ে পাপীদের পাপ বহন করবেন। (৯:৬:৪১) ইন্দ্র ত্বষ্টার পুত্রকে হত্যা করলে ত্বষ্টা ইন্দ্রকে শাপ দেন। (৬:৭:১৪) বিষ্ণু যখন দেখেন লক্ষ্মী একদৃষ্টে অশ্ব রেবন্তকে দেখছেন, তখন তাঁর ঈর্ষা ও সংশয় জন্মায়, লক্ষ্মীকে অশ্বী হওয়ার অভিশাপ দেন। (৬:১৭:৫৩-৬১)

এ সব কাহিনি পড়তে পড়তে মনে হয় পুরাণে দেবতারা শুধু দেবত্বহীনই নন, চরিত্রভ্রষ্টও বটে।

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এর কয়েকটি কাহিনি :

জামাতা চন্দ্র সাতাশটি ভার্যার মধ্যে রোহিণীর প্রতি পক্ষপাতী জেনে শ্বশুর দক্ষ চন্দ্ৰকে যক্ষ্মার অভিশাপ দেন। (৯:৫৫-৫৬) বিশ্বকর্মা ঘৃতাচীকে কামনা করেন, কিন্তু ঘৃতাচী তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন, তখন তাঁরা পরস্পরকে শাপ দেন: ঘৃতাচী গোপালক মদনের কন্যা হয়ে জন্মে তপস্যা করে স্বর্গে ফিরে যান; আর বিশ্বকর্মা মর্ত্য শিল্পী হয়ে জন্মান। (ব্রহ্মখণ্ড ১০/৪২ থেকে) সহস্র বৎসর গর্ভধারণ করবার পরে যখন প্রকৃতি একটি অণ্ড প্রসব করেন তখন ক্রোধে ও ঘৃণায় তিনি সেটিকে জলে ফেলে দেন; তাতে কৃষ্ণ তাঁকে বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ দেন। (প্রকৃতিখণ্ড, ২:৫২) পার্বতী শিবের সঙ্গে মিলিত থাকার সময় দেবতারা বিঘ্ন উৎপাদন করেন বলে রুষ্টা পার্বতী দেবতাদের নিঃসন্তানতার অভিশাপ দেন। (গণেশখণ্ড, ২:৪; কিন্তু পুরাণে এর বিস্তর ব্যতিক্রম আছে, প্রায় সব দেবতাই সন্তানবান।) ব্রহ্মা অপ্সরা মোহিনীর প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেন, তাতে তিনি ব্রাহ্মাকে শাপ দেন মর্তে ব্রহ্মার আরাধনা হবে না। (কৃষ্ণজন্ম, ৩৩:৩৭) একবার ক্রুদ্ধা পার্বতী শিবকে অভিশাপ দেন, ‘এখন থেকে যারা তোমার পূজা করে তারা একবার বিড়াল হয়ে জন্মাবে।’(৩৭:৩২) এ শাপের সত্যতা প্রমাণ করা যায় না। চন্দ্র তারাকে কামনা করলে তারা তাঁকে অভিশাপ দেন, ‘রাহু তোমাকে গ্রাস করবে, মেঘ তোমাকে আচ্ছন্ন করবে, বিশেষ বিশেষ তিথিতে তুমি অশুভনিমিত্ত বলে পরিগণিত হবে, তোমার কলঙ্ক থাকবে এবং তুমি যক্ষ্মাগ্রস্ত হবে। এ শাপে চন্দ্রের প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ গুলির ব্যাখ্যা মেলে। (কৃষ্ণজন্ম ৮০:১৭:৮৮) পরে তিনি মদনকে শাপ দেন, ‘কোনও বিশিষ্ট দেবতার প্রভাবে তুমি ভস্মীভূত হবে।’ কৃষ্ণ রাধাকে শাপ দেন বন্ধ্যাত্বের (কৃষ্ণজন্ম ৮৪:৯০) গন্ধর্ব উপবর্তা রম্ভাকে কামনা করে, রম্ভা অসম্মানিত বোধ করাতে ব্রহ্মা গন্ধর্বকে শূদ্র হয়ে জন্মাবার অভিশাপ দেন। (ব্রহ্মখণ্ড ১৩:১০)

মানুষের পাপ বা ত্রুটি দেখলেই দেবতারা অভিশাপ দেন। অথর্ববেদ-এ নানা রকম শাপের নাম আছে, গ্রাহি (ভর), অবধ্য (শাপ), অভিশস্তি (কলঙ্ক বা নিন্দা) শাপ, দুরিত (সর্বনাশ)। (২:১০:৬, ঋগ্বেদ ১০:৩০:৯-তে এবং ১০:১০৪:৯-তেও আছে।) লক্ষণীয়, এগুলি সবই ঋগ্বেদ-এর শেষ অংশই আছে। এবং দশম মণ্ডলটি বাকি ঋগ্বেদ থেকে প্রায় দুশো বছর পরের রচনা:

রামায়ণ-এ কুবের গন্ধর্ব তুম্বুরুকে রাক্ষস হওয়ার অভিশাপ দেন। (৩:৩:১৬-১৮) স্বর্গে শ্বেতকেতু ক্ষুধার্ত বোধ করলে ব্রহ্মা ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দেন সে তার নিজের মৃতদেহ ভক্ষণ করবে। অগস্ত্যের দয়া হয়; তিনি তুম্বুরুকে এ শাপ থেকে মুক্তি দেন। (৭:৭-৭৮) গঙ্গা অম্বাকে বলেন যে তিনি যদি শিশু ভীষ্মকে বধ করেন তবে গঙ্গার শাপে তাঁকে হিংস্র জন্তুতে পূর্ণ নদী হতে হবে। হরিশচন্দ্র প্রথম পুত্রটি বরুণকে সমর্পণ করার প্রতিজ্ঞা করেন; কিন্তু যখন বরুণ এসে পুত্রটিকে দাবি করেন তখন রাজা বলেন, ‘ছেলেটি কোথায় গেছে আমি জানি না।’ এই মিথ্যা শুনে বরুণ হরিশচন্দ্রকে শোথ হওয়ার শাপ দেন। (দেবীভাগবত ৬:১২:৬৭) পার্বতী শুককে অভিশাপ দেন যে, তিনি ঘৃণিত রাক্ষসকুলে জন্মাবেন, ‘যাতে শুক এখানে আর কোনও ক্ষতি করতে না পারেন।’ (ভাগবত পুরাণ ৬:১৭:১৫) পার্বতীর শাপেই রাজা চিত্রলেখ বৃত্র হয়ে জন্মান। (ঐ ৬:৭) ব্রহ্মা নারদকে শাপ দেন: ‘দাসীপুত্র হয়ে জন্মাও’, পরে অবশ্য কৃষ্ণের কৃপায় নারদ ব্রহ্মারই পুত্র হয়ে জন্মান। (ব্ৰহ্মবৈবর্ত, ব্রহ্মখণ্ড ৮:৪৩ থেকে) রাধা যখন সুদামাকে অভিশাপ দেন, তখন ব্রহ্মা কথা দেন, শাপটি যাতে সফল না হয় ও সুদামাকে স্পর্শ না করে, তার ব্যবস্থা করবেন। (ঐ ১৭:১৩) রম্ভা দুর্বাসাকে দুর্ভাগ্যের শাপ দেন; ‘অত্যন্ত বিকৃত দেহে জন্মে ত্রিলোকের ঘৃণাভাজন হও, তোমার সমস্ত পুণ্য এখনই নষ্ট হোক।’ (কৃষ্ণজন্ম ৩০:১০০-১০২)

‘নারীর বন্ধ্যাত্ব ও পুরুষের প্রজনন-ক্ষমতার অভাব হতে পারে রোগে, অভিচারক্রিয়ায় অথবা অতিলৌকিক ক্ষমতাযুক্ত মানুষের অভিশাপে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও দম্পতি সন্তান, বা বিশেষ ভাবে অভিলষিত পুত্রসন্তানের আশীর্বাদ লাভ করবে কিনা তা নির্ভর করে ভাগ্য বা কর্মলেখের প্রারন্ধের ওপরে (লিখিত/বা প্রানিরূপিত পূর্বজন্মে অর্জিত কর্মফল)। সাধারণ ভাবে কর্মফল থেকে কারওরই পরিত্রাণ নেই। কেবল দৈব অনুগ্রহই মানুষকে বাঁচাতে পারে, কিন্তু সেটি লাভ করাও কঠিন।’ (মদন, ১৯৮৭, পৃ. ২৫) কিন্তু দেবীদের ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব অচল। রাধার পূর্বজন্মের কথা তো শোনা যায় না, কাজেই পূর্ব জন্মের দুষ্কৃতির ফলে তাঁর বন্ধ্যাত্ব, এ তো অকল্পনীয়। কিন্তু তেমনই মনে রাখতে হবে যে, উমা রূপে জন্ম নেওয়ার পরে পার্বতী রূপে দেবী দুর্গার পুর্বজন্ম ঘটেছিল; আগের জন্মে তিনি দক্ষের কন্যা সতী হয়ে জন্মেছিলেন। ঠিক তেমনই রামায়ণ-এর প্রক্ষিপ্ত অংশে সীতা লক্ষ্মীর অবতার, বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুর স্ত্রী; সে জন্মে নিশ্চয়ই কোনও পাপই করেননি যার ফলে সীতাজন্মে তার মূল্য শোধ করতে হবে দীর্ঘ কঠিন দুঃখে। বৈকুণ্ঠের নারায়ণও এমন কোনও পাপ করেননি যার জন্যে রামজন্মে তাঁকে এত দুঃখযন্ত্রণা সইতে হবে। আগের জন্মে দ্রৌপদী ছিলেন পদ্মা, লক্ষ্মী, যে কথা যুধিষ্ঠির স্বর্গে গেলে দেবদূত তাঁকে বলে। কাজেই নিষ্পাপ লক্ষ্মীর দ্রৌপদী জন্মে দুঃশাসনের হাতে প্রকাশ্যে লাঞ্ছনা, অপমান ও জীবনভর নানা কষ্ট, যুদ্ধে সব ক’টি সন্তানের মৃত্যু— এ সবের কোনও প্রস্তুতিই থাকে না, কারণ এর কোনওটিই কর্মফলের জন্য হতে পারে না। এ রকম বেশ কয়েকটি নিদর্শনই শাস্ত্রে মেলে, যাঁরা আগে স্বর্গের দেবদেবী ছিলেন তাঁরা অকারণ অভিশাপে মর্তে এসে নানা লাঞ্ছনা ও দুঃখভোগ করে চলেন; এর ব্যাখ্যা কর্মবাদে মেলে না।

রাধা কৃষ্ণের লীলা সঙ্গিনী ও প্রেমিকা, তাঁকে সন্তানবতী কল্পনা করাই কঠিন। কৃষ্ণের ঔরসেই যদি তাঁর গর্ভে সন্তান জন্মাত তা হলেও তাঁর প্রাথমিক ভূমিকা— প্রেমিকা— কতকটা ম্লান হয়ে যেত। তা ছাড়া মর্তে কৃষ্ণ তাঁর স্বামী ছিলেন না, কাজেই সন্তান হলে অবৈধ বা জারজ হত; এবং এ তিনটির কোনওটাই সমাজ মেনে নিত না। তথাপি প্রজনিকা শক্তি শুভ, নারীর মাঙ্গলিকতা সূচিত করে, তাই রাধার ক্ষেত্রে অভিশাপের উদ্ভাবন করা হয়েছে, তাঁর বন্ধ্যাত্বের ব্যাখ্যা হিসেবে। প্রকৃত কারণ সম্ভবত, তাঁর কাব্যিক অনুষঙ্গ নাশের সম্ভাবনা, তাই অভিশাপের দ্বারা তাঁর নান্দনিক আকর্ষণ অক্ষুণ্ণ রাখা হল।

শাপের একটি ভিন্নতর প্রকাশ ভারতের লেখসংকলন, এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা-তে ভুরিভুরি পাওয়া যায়। ‘যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত সম্পত্তি বা ব্রাহ্মণের প্রদত্ত সম্পত্তি চুরি করে সে ছয় সহস্র বৎসর মলকীট হয়ে থাকে।’ এরই বিকল্প পাঠ পাই অন্যত্র, সেখানে দেখি, ওই সম্পত্তি-অপহারক যষ্টি সহস্র বৎসর শকুনি, শতজন্ম শুক, শতজন্ম শ্বাপদ, সাতজন্ম গণ্ডার, সাতজন্ম ঘোড়া, পাঁচজন্ম কৃমিকীট, শতজন্ম গোধিকার যোনিকীট, সাতজন্ম গণিকার ব্রণকীট, গোসাপ, গর্দভ, বিড়াল, তিনজন্ম নকুল, ক্রুর সর্প, ব্যাঘ্র, শতজন্ম উচ্চৈঃশ্রবাঃ, শতজন্ম অশ্বতর, সাতজন্ম ছাগ, শতজন্ম ভাল্লুক, লক্ষজন্ম শৃগাল, শতজন্ম জোঁক— এবং এই দীর্ঘ ভয়াবহ পরিক্রমার অবসানে ব্রহ্মার শতজন্মকালব্যাপী কুম্ভীপাক নরকে থাকতে হবে। ব্রহ্মার একদিনই এত সুদীর্ঘ বর্ষব্যাপী যে, তাঁর শতজন্মব্যাপী কাল প্রায় জ্যোতিষ গণনার মতো কাল্পনিক অঙ্ক। (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৭৫:৩১-৩৭)

এই ধরনের কথা বিস্তর শিলালেখেও পাই। ধ্রুবসেনের বলভী দানপত্রে ভূমি ও মন্দির দানের প্রশংসাসূচক কয়েকটি উক্তির পরেই পড়ি, ‘যে ভূমি দান করে সে ষাট হাজার বছর স্বর্গে বাস করে, যে সেই দত্ত সম্পত্তির নাশ বা ক্ষতি বা সে চেষ্টার সমর্থন করে সে তত বছরই নরকে বাস করে।’ (৪৭-৪৯ পঙ্ক্তি) চালুক্য রাজা প্রথম কর্ণ তাঁর সনক শিলালেখে (১০৯১ খ্রিস্টাব্দ) এই অভিশাপই বলেন। (পঙ্ক্তি ২০-২১) কৃষ্ণ দেবরায় তাঁর হাম্পি শিলালেখের সংস্কৃত অংশে তাদের আশীর্বাদ জানান ‘যাঁরা ব্রাহ্মণকে রক্ষা করে ও সুলতানকে ধ্বংস করে।’ (শ্লোক ২৯) খ্রিস্টীয় ৫৯৫-৯৬ সালে সংখেদের শিলালেখে বহু পুরাতন অভিশাপ, ‘ব্রহ্মদত্ত সম্পত্তির অপরাহক বিন্ধ্য অঞ্চলের জলহীন অরণ্যের বৃক্ষকোটরে কৃষ্ণসর্প হয়ে বাস করে।’ ২৪৯-৬৪০ খ্রিস্টাব্দে দদ্দর ‘সংখেদ’ শিলালেখে এই অভিশাপ বারবার উচ্চারিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় নবম বা দশম শতকের বাদল স্তম্ভলেখে আশীর্বাদ আছে ‘সেই ধার্মিক ব্যক্তিকে যিনি বেদ ব্যাখ্যা করেন, কলিযুগে বাল্মীকিজন্মের নীতি ও ইতিহাসের আশ্চর্য অংশগুলির পরিপ্রেক্ষিতে।’ (পঙ্ক্তি ২৫) মহারাজা লক্ষ্মণের ও পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের তাম্রশাসনেও সেই ‘স্বদত্তাং পরদত্তাং’ ভূমি বা সম্পত্তির চোরকে ষাট হাজার বছর নরকবাসে দণ্ডিত করা হচ্ছে। নবম ও দশম পঙ্ক্তিতে বলা হয়েছে সেই চোর মলকীট হয়ে পূর্বপুরুষদের সঙ্গে নরকবাস করে। রাজা মাধববর্মার বগুণ্ডা লেখে বলে ‘রাজা যদি নিজে ভূমিদান করে তা হলে তাঁর অক্ষয় স্বর্গবাস হয়, আর অন্যের দান করা সম্পত্তির সুরক্ষা করলে ষাট হাজার বছর স্বর্গবাস হয়।’ (পংক্তি ৮) ধারারাজ্যের রাজা জয়সিংহ ‘মান্ধাতা’ লেখটি রচনা করান, তাতে আছে, ‘অন্যের কৃত তাৎপর্যপূর্ণ কর্মকে কখনও নষ্ট করা উচিত নয়।’ (পংক্তি ২৮) বলাকার রাজা জনুকেশ্বর তাঁর কময় লেখে বলেন, ‘এই দান (ভূমি) কে যদি কেউ কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা হলে তার গঙ্গাতীরে গোহত্যা করার পাপ হয়।’ (পৃ. ৮) রাজা প্রথম ধ্রুবসেন তাঁর গণেশগড় লেখে আবার ওই ‘স্বদত্তা পরদত্তা’র অভিশাপটির পুনরুক্তি করে বলেন সেই অপহারকের লক্ষ গাভীহত্যার পাপ হয়। বাকি কতকটা অংশ অস্পষ্ট থাকলেও মূল অংশটি পরিষ্কার, ‘রাজারা মন্দির নির্মাণ করিয়েছেন, দান দিয়েছেন, বিগ্রহ নির্মাণ করিয়েছেন, ব্রাহ্মণকে দেওয়া এসব দানকে কোনও সৎলোক কেড়ে নেয় না। দত্ত বস্তুর রক্ষা ও পালন এবং দান হল পুণ্যকর্ম।’ (পৃ. ২৪ থেকে) রাজা পৃথ্বীশ্বরের পীঠাপুরা শিলালেখে আছে, ‘এই সদয় ভূমিদানে যদি কেউ বাধা সৃষ্টি করে, তা হলে তার গঙ্গাতটে সহস্র গাভীহত্যা ও সহস্র ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়।’ (পৃ. ১৫৯) রাজা বেঙ্কট তাঁর বিলপক দানপত্রে লেখেন, দান ও দত্তরক্ষার মধ্যে দ্বিতীয়টিই শ্রেয়ান। দানে মানুষ স্বর্গে যায় কি দত্তরক্ষার দ্বারা বিষ্ণুলোকে যায়। অন্যের দত্ত দানকে রক্ষা করা দানের চেয়ে দ্বিগুণ পুণ্যের অন্যের দত্ত দান অপহরণ করলে নিজের দান নিষ্ফল হয়ে যায়।’ তার পরে ‘স্বদত্তা পরদত্তা’র পুনরাবৃত্তি। (পু. ১৪৯) এর অনুবৃত্তি ব্রাহ্মণের দ্বারা বা ব্রাহ্মণের উদ্দেশ্যে দান কারওরই ভোগ করা উচিত নয়, সে জমির ওপর রাজস্ব গ্রহণ করাও অবিধেয়; পুণ্যের এই সাধারণ সেতুটি যুগে যুগে তোমাদের সকলের পক্ষেই রক্ষণীয়।’ (পৃ. ১৫৫) বহু পুরাণে ‘স্বদত্তা পরদত্তা’ আবৃত্তি করা হয়েছে। (গরুড়, উ. ৪০:১, ব্রহ্মবৈবর্ত প্রকৃতি ৯:৮)

এ সব অভিসম্পাতের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিটি হল— ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের করে যদি কেউ তা দাতা বা গ্রহীতার মৃত্যুর পরে কেড়ে নেয়, তা হলে কী হবে? এ উদ্বেগটি খাঁটি, এর পশ্চাতে নিশ্চয়ই বহু অপহরণের অভিজ্ঞতা আছে; কাজেই অভিশাপটিকে মহাপাতকের সমতূল্য করে তুলতে হয়েছে।

এই শিলালেখের অভিসম্পাতগুলির একট বিশেষ চরিত্র আছে। কে অভিশাপ দিচ্ছে? কাকে দিচ্ছে? স্পষ্টতই অভিশাপদাতা অভিশপ্ত থেকে কালের দিক দিয়ে বহু দূরে অবস্থান করত, কাজেই তার অভিশাপ অজ্ঞাত অদৃষ্ট অপরাধীর উদ্দেশ্যে। তার উদ্দেশ্যে ছিল, স্বদত্ত বা পরদত্ত ভূমি কোনও লুব্ধ ব্যক্তির দ্বারা অপহৃত যেন না হয়। যে একটি মাত্র অস্ত্র সে প্রয়োগ করতে পারে তা হল অপহারকের মনে ভগবানের ক্রোধের আতঙ্ক গভীর ভাবে ঢোকানো। এই ভয়টা সঞ্চার করার উপায় হল নিয়তির অনুচরদের আহ্বান করে বলা যে, অপহারক ব্রহ্মঘ্ন গোঘ্নর সমান পাপী— এ দুটি পাপই সমাজে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও কলঙ্কের বলে ধরা হত সেই আদি মধ্যযুগের সমাজে। সেই কারণে দানের চেয়ে দত্ত সম্পত্তির সুরক্ষা বেশি পুণ্যের বলা হয়েছে, কারণ কোনও দানই ততক্ষণ নিরাপদ নয় যতক্ষণ না কোনও শক্তিমান ব্যক্তি তার রক্ষার সুব্যবস্থা করেন। প্রদত্ত ভূমি যদি কেউ কেড়ে না নেয় তা হলে দাতা দানের ফল পাবেন— ব্রাহ্মণকে ভূমিদান দানের তালিকার একেবারে ওপরের দিকে আছে। দাতা কেমন করে নিশ্চিত হবেন যে, কোনও অতিলৌকিক শক্তি তাঁর ঘোষণার সম্মান রাখবেন? দান পুণ্যার্জনের একটি স্বীকৃত পন্থা; এই পুণ্য দাতাকে সেই সমস্ত অতিলৌকিক শক্তির কাছাকাছি নিয়ে আসে, যেগুলি নিয়তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শক্তি যদি প্রদত্ত ভূমির অপহারকের বিরুদ্ধে উচ্চারিত অভিশাপগুলি সফল না করে তবে ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী ব্রাহ্মণকে ভূমিদান তো নিষ্ফল হয়ে যায়; ব্রাহ্মণ আর ভূমিদানের ফল ভোগ করতে পারবেন না, দাতাও পুণ্য অর্জন করতে পারবেন না। সে ভূমিতে নির্মিত মন্দির, তড়াগ, পুষ্করিণী, কূপ ইত্যাদি সবই নিরর্থক, অশুচি ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। দিব্যশক্তিগুলি নিশ্চয়ই এ সব পাপ অনুমোদন করবেন না, অতএব শিলালেখের অভিশাপবাণীগুলিকে তাঁরা সার্থক করবেন নিজেদের স্বার্থেই এবং ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর জন্মজন্মান্তর স্থায়ী দুর্ভাগ্য ও যন্ত্রণার দুনিয়তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মানুষ ভয়ে অপহরণ থেকে নিবৃত্ত হবে।

এই অভিশাপ সুদূরপ্রসারী, যেন অদৃষ্ট, অপরিচিত ও বহুদূরস্থিত শত্রুর উদ্দেশ্যে অস্ত্রনিক্ষেপ, কিন্তু অস্ত্রটি যেহেতু দিব্যশক্তিযুক্ত তাই অব্যর্থ ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছবেই। মনে করা যেতে পারে, ওই সব অভিসম্পাতবাণী কিছু লোককে কয়েক পুরুষ ধরে ভূমি অপহরণ বা ধ্বংস থেকে নিবৃত্ত করেছিল; হয়তো আরও কিছুকাল ধরে দাতা ও গ্রহীতার খ্যাতি তাদের নিবৃত্তি করেছিল; কিন্তু আরও কিছুকাল সেই স্মৃতি ম্লান হয়ে গেলে পর ওই সব ভূসম্পত্তি, মন্দির, কূপ, পুষ্করিণী অবশ্যই হস্তান্তরিত হয়ে অন্যদের ভোগে লেগেছিল। জমি তখন আর ব্রহ্ম থাকেনি, নিষ্কর ও থাকেনি, প্রাচীন মন্দির ইত্যাদি ক্রমে অযত্নে ধূলিসাৎ হয়েছে, যার কিছু কিছু নিদর্শন ইতস্তত মেলে। অভিসম্পাতের আতঙ্কটি ততক্ষণই বাস্তব ছিল যতক্ষণ দাতার পতিগ্রহীতা বা তাদের কয়েকটি উত্তরপুরুষ জীবিত ছিল। ততক্ষণই অভিসম্পাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধ হয়েছিল, কারণ দাতা নিয়তির শক্তিকে আহ্বান করে ওই নিদারুণ অভিসম্পাত সফল করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, চৌর্যে উদ্যত ব্যক্তি ওই আতঙ্কেই কিছুকাল নিবৃত্ত থাকত, সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনও অভিসম্পাতই লোভকে অনির্দিষ্টকাল স্থগিত রাখতে পারে না, কাজেই নিয়তি ধীরে ধীরে নিজেকে দায়মুক্ত করে নিল, সম্পত্তি ক্রমে ক্রমে হস্তান্তরিত হয়ে গেল এবং লোভী পরস্বাপহরণ করল, কোনও বিপদের ঝুঁকি রইল না আর।

অর্বাচীন পুরাণগুলিতে শিলাখণ্ডের অভিসম্পাতগুলির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। অবশ্য কে কার কাছে ঋণী জোর করে বলা যায় না। নতুন যে সুরটি পুরাণে লেগেছে তা হল, (১) অপরাধীর ঊর্ধতর বহু পুরুষকে দণ্ডভাগী করা হয়েছে, এবং (২) দণ্ডকে নিষ্ঠুরতর, বিচিত্রতর ও বহু জন্মব্যাপী করা হয়েছে, সহস্র সহস্র বৎসরে পরিব্যপ্ত এ সব দণ্ড। এটি কিন্তু কর্মবাদের পরিপন্থী। পূর্বপুরুষ যদি সদাচারী হয়ে থাকেন তা হলে কর্মবাদের তত্ত্ব অনুসারে উত্তরপুরুষের অপরাধ তাঁদের স্পর্শ করবে না এবং তার জন্য কোনও দণ্ডও তাঁদের প্রাপ্য নয়। ঠিক তেমনই পাপীর অজাত উত্তরপুরুষ ধার্মিক হতে পারে, পূর্বপুরুষের পাপের দণ্ড তাঁদের ভোগ্য নয়। সে ক্ষেত্রে ওই দণ্ডের নিষ্ঠুরতা অপরিমেয়, অন্ধ, যুক্তিহীন, দণ্ডযোগ্যতার বিচারহীন। এ যেন নিয়তিকে অযথা খোঁচা দিয়ে অকারণ দণ্ডবিধান করানো। এতে অভিসম্পাতকারীর পাপিষ্ঠ নিষ্ঠুর বাসনাই প্রকট হয় এবং এক সর্বশক্তিশালী কিন্তু সম্পূর্ণ অনৈতিক, নিষ্ঠুর, উদাসীন নিয়তিকে চিত্রিত করে। অভিসম্পাত নিয়তিরই আজ্ঞাবহ। অভিসম্পাত যদি বর্তমানে পাপীকে অতিক্রম করে, বিধাতার দয়া ও ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করে তবেই নিয়তির চরিত্রে এই সব মাত্রা যুক্ত হয়। তবু শিলালেখে শুধু নয়, পুরাণে এ জাতীয় বহু শত শত অভিসম্পাত উচ্চারিত হয়েছে। এতে দিব্য শক্তিগুলির সঙ্গে ন্যায়বিচারের যে কল্পনা যুক্ত ছিল তা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ, তিক্ত অভিসম্পাতের বিলাসে লিপ্ত এক নিয়তির চিত্র সৃষ্ট হয়।

শিলালেখের অভিসম্পাতগুলি সম্পত্তি-সম্বন্ধে তৎকালীন সমাজের মূল্যবোধ ও মনোভাবের প্রতিবিম্ব মাত্র এবং এগুলিতে দাতা ও প্রতিগ্রহীতার অবর্তমানে প্রদত্ত সম্পত্তিটির সুরক্ষা উপায় নির্দেশিত হয়েছে। লক্ষ করা যায় যে, দণ্ডের কঠোরতা বেড়েই চলেছে। উচ্চৈঃশ্রবা যেন কতকটা অবৈধ ভাবে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এর জন্তুর তালিকায় অনুপ্রবেশ করেছে, বাকি জন্তুরা ঘৃণ্য জীব। মনে হয় ব্রহ্মবৈবর্ত ও অন্য কয়েকটি পুরাণের এই ধরনের উক্তিগুলি স্পষ্টতই শিলালেখের অভিসম্পাতের কঠোরতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির একটি কারণ। কৃষ্ণদেবরায়ের অভিশাপের লক্ষ্য সুলতান (সুরতান), তার একটা কারণ সম্ভবত বিজয়নগরের পার্শ্ববর্তী বাহমনি রাজ্য।

ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপেডিয়া অব রিলিজিয়ন-এ দেখছি, ‘ধর্মীয় শাপ বরের খুব কাছাকাছি; একই ধরনের মানুষ শাপ ও বর দেওয়ার অধিকারী; এবং শাপ ও বরের প্রায় একটা আকৃতিগত মিল আছে। দেবতা, সাধু এবং অন্যেরা যাঁরা গভীর দুঃখঋদ্ধ অভিজ্ঞতা বা প্রাবীণ্যের দ্বারা সাময়িক একটা মহিমা অর্জন করেছেন এবং এ সবের দ্বারা যাঁরা বর দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন, তাঁরাই বৈধ ভাবে দুর্ভাগ্য, এমনকী মৃত্যু ও ধ্বংস, জনগোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষের ওপরে ডেকে আনতে পারেন। প্রাচীন বৈদিক ঐতিহ্যের ঋষিরা বাক্শক্তির ভাণ্ডার ছিলেন, শত্রুদের পক্ষে বিশেষ করে ভয় পাওয়ার মতো, এমনকী যারা তাঁদের প্রার্থনায় বাধা দিত, তাদের পক্ষেও। কোনও কোনও মুনিঋষি কোনও রাজনৈতিক বা যুদ্ধের ব্যাপারে রাজার অপরিহার্য অনুচর ছিলেন।’ (৪র্থ খণ্ড, ‘কাসিং’ পৃ. ১৮২)

মাঝে মাঝে শাপকে পাপের সঙ্গে সমানুপাতিক করার যথার্থ প্রচেষ্টা দেখা যায়, কিন্তু স্পষ্টতই এগুলি ব্যতিক্রম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাপের সঙ্গে অপরাধের অনুপাত ততটা  থাকে না, যতটা থাকে অভিসম্পাতকারীর মনে উদ্রিক্ত ক্রোধের সঙ্গে; অপরাধীর প্রকৃত অপরাধের সঙ্গে ততটা নয়, যতটা প্রসঙ্গ, ঘটনাচক্র, মেজাজ এবং ঠিক সেই মুহূর্তের ক্রোধাবেগের সঙ্গে। প্রায়ই দেখি, মুনিঋষিরা সামান্য ব্যাপারেই অপমানিত, অবহেলিত বোধ করেন, একান্ত নিরাপরাধ ব্যক্তির আচরণে বা তাদের অতি স্বাভাবিক কোনও অন্যমনস্কতায়, বা রুষ্ট ঋষির তুষ্টি বিধানে অসমর্থতায়। সেই সব সময়ে ‘গভীর ভাবে অনাদৃত’ মুনিঋষিরা প্রতিশোধমূলক শাপ উচ্চারণ করেন, দোষীর দোষের শাস্তি হিসেবে ততটা নয়, যতটা অশোভন ও অদমিত ক্রোধের প্রকাশ হিসেবে।

শাপ ও বর কী ভাবে কার্যকর হয় সে সম্বন্ধে শুনি, শাপ বা বর আপনা থেকেই সফল হয়, কিংবা এগুলিকে সফল করবার জন্যে কোনও দেবতাকে আহ্বান করা হয়। ‘আইরিশ লোকসাহিত্যে বলে, এক বার উচ্চারিত শাপ কোথাও না কোথাও গিয়ে অবস্থান করবেই, সাত বছর ধরে বাতাসে উড়বে এবং যে কোনও মুহূর্তে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির ওপরে এসে পড়বে।’ (হেস্টিংস এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিক্স, ৪র্থ খণ্ড, ‘কার্সিং অ্যান্ড ব্লেসিং’, পু. ৩৬৭) ভারতবর্ষে এমন কোনও সময়সীমা নেই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখানে অভিশাপের পরমায়ু দীর্ঘতর, কারণ এক শাপে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন বহু পুরুষ দণ্ডিত হয়। যে-সব উত্তরপুরুষ এখনও জন্মায়নি, ভ্রুণ অবস্থাতেও নেই, যারা বহু শতাব্দী পরে জন্মাবে তাদের ভাগ্যও আগে থেকেই শাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে; তারাও বহু পূর্বের কোনও পুরুষের ওপর শাপের ফলে দণ্ডিতের দুর্ভাগ্য, যাতনা, ঘৃণ্য জন্ম এবং ওই রকম হীন, জুগুপ্সাজনক বহু জন্ম পরিক্রমার পরে সংঘাতিক যন্ত্রণাময় নরকে অনন্তকাল বাস করতে পারে। এই সব শাপে দেখা যায় উত্তরপুরুষ সম্পূর্ণ নির্দোষ, তবুও তাদের ভাগ্যে লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা ও নরক নিরূপিত হয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি বলাও হয় যে, ওই উত্তরপুরুষ এমন পাপ করবে যাতে দণ্ড ন্যায়সঙ্গতই হবে, তা হলে প্রথম আপত্তি হল, সে ক্ষেত্রে শাপ তো বাহুল্যমাত্রে পর্যবসিত হল। দ্বিতীয় আপত্তি হল, কারণ-বাহুল্য, অর্থাৎ সেই দুর্ভাগ্যের একটা কারণ তার স্বকৃত কর্ম আর একটা কারণ ওই শাপ— তর্কশাস্ত্রে এই দ্বিতীয়টি একটি দোষ। তবুও শিলালেখের অভিসম্পাতের মতোই বহু শাস্ত্রবর্ণিত শাপও অজাত উত্তরপুরুষের ভাগ্য নিরূপণ করে; এ সব শাপ শুধু যে ন্যায়শাস্ত্রগত দোষে দুষ্ট তা নয় এর দ্বারা মানুষের আচরণের মানুষের স্বাধীনতাও খণ্ডিত হয়; নিজের সুকৃতিতে শাপ প্রতিহত করবার সুযোগও থাকে না। এ ক্ষেত্রে সবটাই পূর্বনির্ধারিত। সমাজে প্রতিষ্ঠিত উচ্চবর্ণের সুবিধাভোগী মানুষের কাছে দুঃস্থ সাধারণ মানুষ ক্রমেই মানুষিক মর্যাদা হারিয়ে ‘জনসমূহ’ রূপে নির্ব্যক্তিক হয়ে উঠছিল, তাই সম্ভব হয়েছিল ঊর্ধতন ও অধস্তন, অজাত বহু সংখ্যক নিরপরাধ পূর্ব ও উত্তরপুরুষকেও একটি অভিসম্পাতে অকল্পনীয় এবং সম্পূর্ণ নিষ্কারণ যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেওয়া। শাপদাতার কাছে সাধারণ মানুষ ও তাদের অধঃস্তন বংশধরের আর মানুষ পরিচয় ছিল না। বরের ক্ষেত্রেও বরদাতা চোখ বুজে অনেক পূর্ব ও উত্তরপুরুষকে প্রসাদ বিতরণ করেছেন নিজের কোনও স্বার্থরক্ষার পুরস্কার হিসেবে। অপরাধী বা পুণ্যবাণ, শাপদাতা ও বরদাতার কাছে আর ব্যক্তি নয়, তাই এই ঢালাও ব্যবস্থা তাদের মহিমা বিস্তারের। এ সব শাপে বরে নৈতিকতা সম্পূর্ণ ভাবে পরাস্ত হয়েছে। স্বার্থসিদ্ধির আশায় ও স্বার্থহানির আশঙ্কায় সম্পূর্ণ অনৈতিক বর বা শাপ স্পর্শ করবে একেবারে অযোগ্য ও একেবারে নিরপরাধকে। এ সব ক্ষেত্রে শাপ ও বর নিয়তির কর্মকর উপায় হয়ে নিয়তির স্বেচ্ছাচারিতারই প্রতীক হয়ে উঠেছে।

হেস্টিংস এনসাইক্লোপেডিয়া অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিক্স অনুসারে, ‘অতিলৌকিক শক্তির মাধ্যমে রূপে মুনিঋষিরা, অন্তত যখন শাপ বা বর দেন তখন ভয়াবহ আতঙ্ক উদ্রেক করেন। তালমুদ বলে যখন পুরোহিত আশীর্বাণী উচ্চারণ করছেন তখন তাঁর দিকে তাকাতে নেই, কারণ তখন তাঁর ওপরে ঈশ্বরের মহিমা (এসেছে)। আবেগের শক্তি, অহিতাকাঙ্ক্ষার ভয় ও শত্রুতার মধ্য দিয়ে প্রস্তাবিত ধারণা কার্যকর হওয়ার একটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। শব্দের তত্ত্ব এবং অভিসম্পাতকারী বা বরদাতার স্বয়ংক্রিয় আধ্যাত্মিক শক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধারণার দ্বারা এর শক্তি বৃদ্ধি পায়।… গ্রিক ও রোমান যুগের শাপের যে সুবৃহৎ সংকলন পাওয়া গেছে, তা বেশির ভাগই সীসার ফলকে অথবা প্রতীকি নখে খোদাই করা, যাতে অভিসম্পাত শত্রুকে নারকীয় শক্তির কাছে সঁপে দিচ্ছে। এতে শাপ সম্বন্ধে আদিম তত্ত্বই প্রমাণিত হচ্ছে।’ (পৃ. ৩৬৭, ৩৬৯-৩৭৩) সমাজে যারা নৈতিক অত্যাচারে ভুগেছে, সেই উৎপীড়িতরা প্রায়ই অত্যাচারীকে শাপ দেয়। যেহেতু সমাজ বা সমাজের এক অংশ সাধারণ মানুষকে ন্যায়বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে এবং এই কারণে সমাজ বিশ্ববিধানের ন্যায়বিচার বিতরণের ব্যাপারে তাদের কাছে ঋণী— সেই জন্যে উৎপীড়িতরা ওই অসাধু সমাজকর্তাদের বিরুদ্ধে অলৌকিক শক্তিকে আহ্বান করে। সমাজের সেই অপরাধীকে শাপ দিয়ে এই অত্যাচারিতরা, সাময়িক ভাবে হলেও আধ্যাত্মিক প্রতিশোধ নেয়। অর্থাৎ অভিসম্পাতবাণী শুধু ব্যক্তিগত প্রতিশোধের জন্য উচ্চারিত হয় না। বরং মহাবিশ্বে অন্তর্নিহিত ন্যায়বিচারের ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যেও হয়। ধর্ষিতা বেদবতী রাবণকে অভিশাপ দিলেন বা গান্ধারী কৃষ্ণকে অভিশাপ দিলেন; ন্যায়বোধে উদ্দীপ্ত ক্রোধ থেকে নিঃসৃত এই সব এমন এক অভিশাপ নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যা গভীরতায় ও তাৎপর্যে ভাস্কর। এঁদের স্বরে আমরা যেন নৈতিক আদর্শের প্রেরণা থেকে উৎসারিত বাণীই শুনি, নিরপরাধ দণ্ডিতদের ওপরে অনুষ্ঠিত অন্যায়ের প্রতিবিধানের জন্যে কোনও অজ্ঞাত ন্যায়াধীশের দরবারে উদাত্ত আহ্বান। নিপীড়িতদের ওপরে অনুষ্ঠিত অন্যায় যেন তাদের শাপ দেওয়ার নৈতিক অধিকার দেয়, যে শাপ সেই কারণেই ফলে যায়। ‘পাপের বোঝা যখন ভারী হয়ে ওঠে একমাত্র তখনই অন্যের উচ্চারিত শাপ সফল হতে পারে; ততই বেশি প্রতিবিধানের জন্যে দুঃখভোগের দেখা দেয়।’ (মদন, ১৯৮৭, পৃ. ৩৬)

কপিলমুনি সগররাজার ষাট হাজার সন্তানের ওপর এত ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর শাপে সব ক’টি পুত্রই ভষ্মীভূত হয়ে যায়। (রামায়ণ ১:৩৪:৩০) ঋষি গৌতম স্ত্রী অহল্যার ‘অসতী’ত্বে এত রুষ্ট হন যে তাঁকে অভিশাপ দেন যাতে তিনি সহস্র সহস্র বৎসর ভষ্ম শয্যায় শুয়ে অদৃশ্য ও বায়ুভুক হয়ে তপস্যা করেন। (১:৪৮:২৯,৩০) বহু বৎসর কঠোর তপস্যা করে বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন; যখন তিনি ত্রিশঙ্কুর যজ্ঞে পৌরোহিত্য করতে গেলেন ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করলেন তখন আমন্ত্রিতরা বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণত্ব অস্বীকার করে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। প্রচণ্ড ক্ষোভে বিশ্বামিত্র শাপ দিয়ে তাদের ধ্বংস করেন। (১:৬৯:১৭,১৮) যে অন্ধমুনির পুত্রকে দশরথ না জেনে হত্যা করেন তিনি দশরথকে পুত্রশোকজনিত মৃত্যুর শাপ দেন। (২:৫৪:৫৪) যদিও অধিকাংশ শাপের ফলই তৎক্ষণাৎ কার্যকরী হয়, কিছু শাপের ফল বিলম্বিতও হয়ে থাকে। যেমন অন্ধমুনির পুত্রহত্যার সময়ে দশরথ অপুত্রক ছিলেন, কাজেই শাপ শুনে তিনি হৃষ্ট হন, পুত্রলাভের সম্ভাবনার কথা ভেবে। এখানে শাপটি দীর্ঘকাল পরে ফলপ্রসূ হয়। দশরথের আনন্দ সাময়িক এবং পরে মৃত্যুকালে শাপের অন্তর্নিহিত মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে তিনি অবহিত হন। কবন্ধ তার জন্মকালে সুদর্শনই ছিল, কিন্তু নানা ভীষণ রূপ ধরে মুনিঋষিদের ভয় দেখানো তার একটা বিলাস ছিল। এমনই ভয় পেয়ে ঋষি স্থূলশিরাঃ তাকে চিরদিনের মতো কুৎসিত হওয়ার অভিশাপ দেন। অন্যান্য বহু অভিশপ্তের মতো কবন্ধও ঋষিকে অনুনয় করাতে তিনি সদয় হয়ে বলেন, রামচন্দ্র যখন তোমার বাহুচ্ছেদ করবেন, তখনই তোমার শাপমুক্তি হবে।’ (৩:৭১:১-৭) তরুণী বেদবতী বিষ্ণুকে পতিরূপে মনোনীত করার পরে রাবণ তাকে ধর্ষণ করাতে তিনি রাবণকে শাপ দেন, ‘এর পর কাউকে ধর্ষণে প্রবৃত্ত হলেই তোমার মৃত্যু হবে।’ (৭:১৭:৮-৪২) রম্ভা যখন তাঁর প্রেমিক নলকুবেরের সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছিলেন, তখন রাবণ রম্ভাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্ভোগ করলে রম্ভা তাকে শাপ দেন, ‘অন্য কাউকে ধর্ষণ করতে গেলেই রাবণের মৃত্যু ঘটবে।’ (৭:২৫-২৬) রম্ভা বিশ্বামিত্রকে প্রলুব্ধ করতে গেলে মুনি তাঁকে শাপ দেন, সে শিলামূর্তিতে পরিণত হবে। (১:৬৪:১২)

মহাভারত-এ মুনি মৈত্রেয়কে দুর্যোধন যথোচিত সম্মান করেননি; অপমানিত বোধ করে মুনি দুর্যোধনকে যুদ্ধে পরাভবের অভিশাপ দেন।(৩:১১:২৮-৩৪) স্পষ্টতই, এখানে অপরাধ ও শাপের গুরুত্বের মধ্যে বিস্তর তারতম্য আছে; কোনও মুনিকে যথেষ্ট খাতির না করার মধ্যে দুর্যোধনের অশিষ্ট, দাম্ভিক এবং সাধারণ ভাবে সম্মান করার দায়িত্ব না বোঝার দোষ আছে; কিন্তু যে পরাভবে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু ও একটি বংশের নিধন নিহিত, শুধু এক ব্রাহ্মণের গৌরব ঘোষণার জন্যে তেমন শাপ প্রত্যক্ষতই অন্যায়। রৈভ্যর পুত্রবধুকে যবক্ৰী ধর্ষণ করলে রৈভ্য ক্ষিপ্ত হয়ে মাথা থেকে দুটি চুল ছিঁড়ে দুটি কৃত্যা (অসুরী-জীব) নির্মাণ করেন, এরা যবক্রীকে হত্যা করে। পরে রৈভ্যের পশ্চাত্তাপ হয় এবং যবক্রীকে সঞ্জীবিত করেন। (৩:১৩৭ পুরো অধ্যায়টি) যদি দিব্য অনুপ্রেরণায় কোনও শাপ দেওয়া হয় তবে প্রায়ই তার খানিকটা প্রতিবিধান হয়: শাপটির কালসীমা নিরুপিত হয় এবং মাঝে মাঝে অভিসম্পাতকারী দয়ার্দ্র হয়ে শাপ প্রত্যাখ্যান করেন। রৈভ্যর ক্ষেত্রে তিনি স্ত্রী-পুরুষ দুটি কৃত্যাকে একত্র বাসের অনুমতি দেন। অতএব যে কৃত্যারা অশুভশক্তির প্রতীক এবং প্রায়ই অশরীরী হয় তারা এখানে দেহধারী হয়ে স্বতন্ত্র সত্তা লাভ করল। ধর্মব্যাধের উপাখ্যানে ধর্মব্যাধ পূর্বে বিপ্র ছিল, অনবধানে এক ক্ষত্রিয় বন্ধুকে হত্যা করায় অভিশপ্ত হয়ে ব্যাধ হয়। (৩:২০৫-২০৬:৫) পাণ্ডু মৈথুনে মিলিত মৃগদম্পতির মধ্যে মৃগটিকে হত্যা করেন, মৃত্যুকালে মৃগ অভিশাপ দেয়, ‘মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেই পাণ্ডুর মৃত্যু ঘটবে।’ (১:১০৯:২৯) এই শেষ দৃষ্টান্তে পাপ ও দণ্ডের মধ্যে কিছু সামঞ্জস্য থাকলেও আগেরটিতে কিছুই নেই: একটি অসতর্ক হত্যার জন্য হত্যাকারীকে যাবজ্জীবন জিঘাংসুবৃত্তির অভিশাপ দেওয়ার মধ্যে কোনও ন্যায়বিচার নেই। কল্মাষপাদ বশিষ্ঠের পুত্র শক্তিকে অভিশাপ দিয়ে রাক্ষসে পরিণত করেন কারণ শক্তি রাজা কল্মাষপাদকে পদাঘাত করে পথ করে দেন। (১:১৬৬:৯) এক ব্রাহ্মণ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছিলেন, তখন কল্মাষপাদ তাকে ভক্ষণ করেন, মৃত্যুকালে ব্রাহ্মণ রাক্ষসকে শাপ দেন যে, তারও স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের সময় মৃত্যু হবে। (১:১৯২:১২) কৰ্ণ নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে মিথ্যা পরিচয় দেওয়ার অপরাধে পরশুরাম কর্ণকে অভিশাপ দেন; প্রয়োজনের সময় তাঁর অধীত অস্ত্রবিদ্যা কোনও কাজে লাগবে না। (৮:২৯:৬) শুক্রাচার্য যযাতিকে অকালবাধ্যকের অভিশাপ দেন (৭:৫৮); ‘দণ্ড’ রাজা ভার্গবের কন্যাকে ধর্ষণ করার অপরাধে ভার্গব সাত দিনের মধ্যে তাঁর মৃত্যু ঘটার অভিশাপ দেন। (৭:৮১) দেখা যাচ্ছে, একই অপরাধ, ধর্ষণের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বের অভিশাপ দেওয়া হচ্ছে। আবার আমরা একটা অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছি যেখানে ন্যায়বিচারের কোনও অধিকর্তা নেই, বিচারের কোনও স্থির মানদণ্ড নেই— এই কারণেই অপরাধ ও দণ্ডের কোনও সামঞ্জস্য নেই।

ধার্মিক প্রহ্লাদের পৌত্র বলি যখন দুরাচার হয়ে উঠে প্রজাপীড়ন করতে শুরু করল, তখন প্রহ্লাদ তাকে ও তার সহচরদের ধ্বংসের অভিশাপ দিলেন। (বান পু. ২৯:৩৩) বশিষ্ঠ সৌদাসকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হয়েও বিরত হলেন; কিন্তু শাপ দেওয়ার জন্য যে জল হাতে নিয়েছিলেন তার কতকটা সৌদাসের পায়ে পড়ে যায় এবং পায়ের সেই জায়গাটা কালো হয়ে যায়। এই কারণেই তাঁর নাম হয় কল্মাষপাদ। (নারদ পু. ১:৯:১-৪২) এই কাহিনিরই দ্বিতীয় একটি সংস্করণ হল: রাক্ষস কল্মাষপাদ এক ব্রাহ্মণকে ভোজন করতে উদ্যত হলে তাঁর ব্রাহ্মণী স্বামীর প্রাণভিক্ষা করেন। কিন্তু কল্মাষপাদ সে অনুনয়ে কর্ণপাত করেননি; ব্রাহ্মণী তাকে শাপ দিলেন স্ত্রীর সঙ্গে মিলনে তার মৃত্যু হবে। ক্রুদ্ধ কৰ্ম্মাষপাদ ব্রাহ্মণকে শাপ দিলেন, তিনি রাক্ষস হবেন। (৯:৫০-৭০) রাজা সুযজ্ঞ এক ব্রাহ্মণকে নির্বাসন দেন, ব্রাহ্মণের শাপে রাজা রাজ্য ও প্রতাপ হারান। (ব্রহ্মবৈবর্ত, প্রকৃতি ৫১:২৯) রাজা কার্তবীর্যকেও পরশুরাম ঠিক ওই রকম অভিশাপ দেন, সঙ্গে বাড়তি শাপ দেন রাজা কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হবেন; কুষ্ঠ গলিত হবে, তাঁর বুদ্ধিভ্রংশ হবে এবং তিনি উৎপীড়িত হবেন। (ঐ ৫০:২৮-২৯) দুর্বাসা অপ্সরা তিলোত্তমা ও সাহসিককে মিলিত অবস্থায় দেখতে পেয়ে তিলোত্তমাকে শাপ দেন, সে গর্দভ হবে, কারণ গর্দভরাই যৌন ব্যাপারে এমন নির্লজ্জ হয়। (কৃষ্ণজন্ম ২৩:১৩৬) কলিঙ্গের এক রাজা কোনও ব্রাহ্মণকে যথোচিত অভিবাদন করেননি বলে ব্রাহ্মণের অভিশাপে জন্তু হন। (১২২:১৮) এটি সেই সব বহুতর দৃষ্টান্তের একটি, যেখানে অপরাধ ও দণ্ড একেবারেই সমানুপাতিক নয়। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর বশিষ্ট বিশ্বামিত্রকে শাপ দিলেন যাতে তিনি বক হয়ে যান এবং বিশ্বামিত্রও শাপ দিলেন যাতে বশিষ্ঠ অন্য একটি পাখি হন। (দেবীভাগবত পু. ৬:১৩:৩৫,৩৬)

একটি দীর্ঘ কাহিনি আছে, ঋষি পর্বত ও নারদ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পরস্পরের কাছে কোনও কিছুই গোপন করবেন না। দু’জনে যখন রাজা সঞ্জয়ের অতিথি, তখন দু’জনেই রাজকন্যা দময়ন্তীর প্রেমে পড়েন। রাজকন্যা দুই ঋষিরই পরিচর্যা করতেন, তিনি নিজে নারদের প্রেমে পড়েন। এই তথ্যটি বন্ধুর কাছে গোপন করার অপরাধে পর্বত নারদকে বানর হওয়ার শাপ দিলেন; নারদ পর্বতের স্বর্গে যাওয়া আটকালেন। রাজকন্যা অন্য কাউকে বিয়ে করতে অসম্মত হলেন। দেবতারা দুই বন্ধুকেই পরস্পরের শাপ থেকে মুক্তি দিলেন। পর্বত স্বর্গে গেলেন; নারদ রাজকন্যাকে বিয়ে করে মর্তেই থেকে গেলেন। (৬:২৬,২৭ দুটি পুরো অধ্যায়) ত্রিশঙ্কু বশিষ্ঠের গাভী চুরি করেছিলেন। বশিষ্ঠ তাঁকে শাপ দিলেন পিশাচ হতে। মাথায় তিনটি শঙ্কু (কাঁটা) থাকার জন্য তাঁর নাম হয় ত্রিশঙ্কু। সত্যব্রতের পিতা মান্ধাতা পুরোহিত বশিষ্ঠকে পদচ্যুত করেন; বশিষ্ঠ তাঁকে শাপ দেন, চণ্ডাল হতে। (৭:১০:৫৪-১২:২৯)

অভিশাপ দিতে হলে একটা আধ্যাত্মিক অধিকার প্রয়োজন, এ অধিকার নানা রকমের হতে পারে: (১) তপস্যায় অর্জিত পবিত্রতা, (২) অকারণে দণ্ডিত হয়ে বা শাপগ্রস্ত হয়ে দুঃখভোগ করার ফলে সজ্ঞাত নৈতিক উৎকর্ষ (ওপরের নিদর্শনগুলিতে এ-দু’ধরনের অধিকারের পরিচয় মেলে, (৩) তৃতীয় আর একটি অধিকার জন্মায় প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধের জন্য প্রত্যাভিশাপ দেওয়ার। পুরাণে এক জায়গায় রয়েছে, যে অন্তর্দাহে পীড়িত সে যখন শাপ দেয়, সে শাপকে দেবতা বা নিয়তি কেউই প্রতিহত করতে পারে না। (ব্রহ্মবৈবর্ত পু কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৩০:৯৯) অকারণে নির্যাতিত ব্যক্তির শাপ দেওয়ার একটি নৈতিক অধিকার জন্মায়; সেজন্যে এদের সব শাপই সফল হয়। দুটিমাত্র ব্যতিক্রম আছে: (১) প্রত্যাভিশাপ কখনও কখনও অভিশাপ-দাতাকে দয়ার্দ্র করে, ভয় পাওয়ায়, যাতে সে শাপ প্রত্যাহার করে যেমন পর্বতনারদ উপাখ্যানে), এবং (২) প্রায়ই অভিশপ্ত ব্যক্তি— দেবতা বা মানুষ— অভিশপ্তকে মিনতি করে শাপ মুক্তির জন্যে; তখন সেই দেবতা বা ঋষি হয় শাপ পুরোপুরি প্রত্যাহার করেন কিংবা শাপের প্রকৃতি পরিবর্তন করে কম দুঃসহ করেন অথবা তার দীর্ঘকালের মেয়াদকে সংক্ষিপ্ত করে দেন।

শাপের শেষতম অংশটিতে মানুষ দেবতাকে শাপ দেয়। এ আলোচনার পূর্বে মানুষ দেবতাকে বর দিয়েছে এমন কথাও কিছু আছে। এক ব্রাহ্মণ পার্বতীকে বর দেন। (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. গণপতিখণ্ড ৮ম অধ্যায়) বিশ্বকর্মার শাপে এক ঋষি বানর হয়ে যায় এবং দৈবের লীলায় পর্বতশিখর থেকে মাটিতে পড়ে যায়। (বামন পু. ৬৪:২) বিশ্বামিত্র মানুষ হয়েও দেবী সরস্বতীকে অভিশাপ দেন। (৪০:২০-২১) এক অপ্সরাকে দেখে ঋষি মস্কগণের বীর্য স্খলিত হয়, অপ্সরা তাঁকে অভিশাপ দেন। (১২:৭৩) নারদের অভিশাপে পৃথিবীতে ব্রহ্মার আরাধক সম্প্রদায় গড়ে উঠতে পারল না। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মাকে ঘিরে কোনও সম্প্রদায় গড়ে ওঠেনি— এ তারই অতিকথাগত কারণ-নির্ণয়। (ব্রহ্মবৈবর্ত ব্রহ্মখণ্ড, ৮:৬৩) রাজা জনমেজয় ইন্দ্রকে শাপ দিলে ইন্দ্র মর্তে উপাসনা হারালেন। (হরিবংশ, ভবিষ্য ৫:১৬-১৮) স্পষ্টতই এ কাহিনি এবং ব্রহ্মার মর্তে সম্প্রদায়বিলোপ পরবর্তী কালের বাস্তব ঘটনার অতিকথাগত সমর্থন। অতীতের দুই দেবতা মর্তে পূজা-বিরহিত বা তাদের সম্প্রদায় নিতান্ত গৌণ। দুটি কাহিনিতেই যুগপৎ ব্রাহ্মণকে ভয়াবহ এবং শ্রদ্ধেয় করে তোলার চেষ্টা লক্ষ করি— ব্রাহ্মণ শুধু যে মানুষকেই অভিশাপ দেয় তাই নয়, দেবতাকেও দেয়। সমাজের সম্ভ্রম এবং আতঙ্কের আসনে ব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠা ঘটল। হরিবংশ থেকে আরও কিছু নমুনা: ঋষি সুতপাও অশ্বিনদের অভিশাপ দেন যেন তাঁরা যজ্ঞভাগ কখনওই না পান। (১১:৮) সূর্যদেব অসুস্থ হয়ে এক ঋষির শরণাপন্ন হলে তাঁকে ঋষির বর সুস্থ করে তোলে। (প্রকৃতি খণ্ড ৩৬ অধ্যায়) দুর্বাসা ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন যেন তিনি রাজ্য, শক্তি ও মহিমা হারান। (৩৬:২৭-৩০) ঋষি জমদগ্নি দিনের বেলাতেও স্ত্রী রেণুকার সঙ্গে মিলিত হতেন; সর্বদর্শী সূর্যের এতে জগুপ্সা উৎপন্ন হয়; ক্রুদ্ধ জমদগ্নি মাঝে মাঝে সূর্যকে গ্রহণে আক্রান্ত হওয়ার অভিশাপ দেন। বলা বাহুল্য, এটিও সূর্যগ্রহণের অতিকথাগত ব্যাখ্যা। (কৃষ্ণজন্ম ৭৯:৩০) সূর্যও জন্মদগ্নিকে অভিশাপ দেন ক্ষত্রিয়ের কাছে তিনি পরাস্ত হবেন। (৭৯:৪০ )

আবার দেবী ভাগবত পুরাণে দেখি, বশিষ্ঠ তাঁর গাভী চুরির জন্য দিব্য বসুদের অভিশাপ দেন: তারা মর্তে মানুষ হয়ে জন্মাবে। (১:৩:৩৫) হরি ভৃগুর স্ত্রীকে কেটে ফেলেছিলেন বলে ভৃগু তাঁকে বানর হয়ে জন্মাবার অভিশাপ দেন। এতে বানরকে হরির অংশ বলা হয়। (৬:৭:৩৪) তুলসী কৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন শিলারূপে (শালগ্রাম) মর্তে অবতীর্ণ হওয়ার (৯:২৪:১৪) ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের কাহিনি, মালাবতীর প্রিয় স্বামীর মৃত্যু হলে তিনি নারায়ণকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হন, তখন নারায়ণ তাঁর স্বামীকে সঞ্জীবিত করেন। (১৩:৬০) কখনও কখনও তৎক্ষণাৎ শাপের অবসান ঘটে, অভিশপ্তের মিনতিতে; কখনও অভিশপ্তের ইচ্ছাপূরণ হিসেবে আগে থেকেই নিবারিত হয়, কিংবা শাপের সময়সীমা হ্রস্ব করা হয় অথবা শাপের কঠোরতার উপশম করা হয়, কখনও বা শর্তসাপেক্ষ ভাবে তা হ্রাস হয়।

শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধদের একটা রীতি আছে যার নাম ‘বিষাক্ত গান’, সেগুলি ব্যবহার করা হয় অভিশাপকে নিষ্ক্রিয় বা অকেজো করে তোলার প্রক্রিয়ার সঙ্গে। বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্বে অভিশাপের কোনও অবকাশ নেই, কর্মবাদে ও প্রতীত্যসমুৎপাদতত্ত্বে অবিচল নিষ্ঠাই অভিশাপ বা প্রত্যাভিশাপকে প্রতিরোধ করে, যাতে নিয়তিকে পরিবর্তিত করে তার গতি অন্য খাতে বইয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু লক্ষ করি, লোকায়ত ধর্ম তত্ত্বগত ধর্মের প্রায়ই পরিপন্থী হয়। ‘বিষাক্ত গান’গুলি আদিম শামান যুগের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বেদের অভিশাপগুলির একটা বাঁধা ভাষাগত ও ভাগবত ছক হল, ‘যে আমার প্রতি বিদ্বিষ্ট এবং যার প্রতি আমাদের দ্বেষ। (‘যো’স্মান দ্বেষ্টি যজ্ঞ বয়ং দিষ্মঃ’) শত্রুর বৈরিতা ও বিদ্বেষকে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যাপার বলে মনে করা হত এবং সব প্রাচীন ধর্মতত্ত্বই একে খুব গুরুত্ব দিত।

নাইজেরিয়ায় কোনও সংঘর্ষ শেষ হলে লোকেরা অভিশাপকে (ফুঁ দিয়ে) নিভিয়ে দেয়, অর্থাৎ সকলে একমত হয়ে যে ভাবে অভিশাপটি থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছিল তাকে প্রতীকী ভাবে নিষ্ক্রিয় বা নিষ্ফল করে দেয়। প্রতিকারহীন অভিশাপ অভিশপ্তের এবং হয়তো বা সমগ্র জনগোষ্ঠীর মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করে, শুধু এই কারণেই যে, অভিশাপ নিয়তির সঙ্গে সংযুক্ত।

শাপ দেওয়া স্বতঃস্ফূর্ত ক্রোধের বিষ্ফোরণ থেকে সুচিন্তিত বিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত পর্যন্ত (সবই হতে পারে।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ‘কাসিং’)

দেবতাকে মানুষের শাপ দেওয়ার দুটি দৃষ্টান্ত প্রণিধানযোগ্য। প্রথমটি হল, মহাভারত-এর স্ত্রীপর্বের গান্ধারী কৃষ্ণকে শাপ দিচ্ছেন। যুদ্ধ শেষে শত শত শবদেহের মধ্যে পরিক্রমা করতে গিয়ে, নিজের পুত্রদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শবগুলি এবং তাঁর সঙ্গিনী একশত সদ্যবিধবা তরুণী পুত্রবধূদের দেখে গান্ধারীর মনে এমন এক তীব্র, অসহ্য ক্ষুব্ধ ক্রোধের উদ্রেক হল যে, তিনি কৃষ্ণের দিকে ফিরে চাইলেন। বুঝলেন, একা কৃষ্ণেরই এ যুদ্ধের সঙ্গে কোনও ব্যক্তিগত লাভক্ষতি জড়িত ছিল না, ফলে একা তিনিই এই অকারণ রক্তপাত ও সহস্র মৃত্যু নিবারণ করতে পারতেন, অর্থাৎ শুধু তিনিই ওই ভয়াবহ লোকক্ষয় রোধ করতে পারতেন। সেই নিবার্য সর্বনাশ নিবারণ না করার অপরাধে বৃদ্ধা মহিষীর ধর্মসম্ভব ক্রোধ উদ্ৰিক্ত হল; তিনি অভিসম্পাত দিলেন: ‘কুৎসিত উপায়ে তোমার মৃত্যু হবে, সমগ্র যদুবংশ ধ্বংস হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যাদব রাজশক্তির কিছুমাত্র অবশেষ থাকবে না।’ গান্ধারী সাধারণ মর্ত্য নারী হয়েও সমস্ত সৎসাহস সংযত করে সেই কৃষ্ণকে শাপ দিলেন, যে কৃষ্ণকে মহাভারত ধর্মের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছে (‘যতঃ কৃষ্ণস্ততো জয়ঃ, যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ’)। প্রচণ্ড অন্তর্দাহে এই শতপুত্রহীনা গান্ধারী নিষ্ঠুর সর্বনাশের কর্তা হিসেবে কৃষ্ণকে দেখে তাঁর হৃদয়হীন ঔদাসীন্যের জন্যে শাপ দিলেন। এই মর্মযন্ত্রণা, জ্বলন্ত ক্রোধ তাঁকে যেন গ্রিক ভবিষ্যদ্বক্তা রমণী কাসান্ড্রার পর্যায়ে নিয়ে এল, যেখানে নিয়তির শক্তি ঘনীভূত হয়ে তাঁর শাপ বাক্যকে দৈববাণীতে পরিণত করল; ফলে তাঁর উচ্চারিত প্রত্যেকটি কথাই আক্ষরিক ভাবে সফল হল। এ যেন নিগূঢ় অন্তর-প্রেরণায় উদ্দীপ্ত ঋষির বাণী, এ বাণীর ভয়ংকর গম্ভীর তাৎপর্য বুঝতে গেলে মনে রাখতে হবে সমগ্র মহাভারত কৃষ্ণকে কী দৃষ্টিতে দেখেছে। শাপটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু সাংঘাতিক এবং সার্থক।

মানুষ কর্তৃক দেবতাকে শাপ দেওয়ার দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন পাই মহাভারত-এর আদিপর্বে। ঋষি অণীমাণ্ডব্য (বা মাণ্ডব্য) মৌনব্রত গ্রহণ করে নিজের কুটীরে নীরবে ধ্যান করছিলেন। একদল ডাকাত এসে লুটের মাল তাঁর কুটীরে রেখে পালিয়ে গেল। প্রহরীরা এসে বামাল পেয়ে মুনিকে জিজ্ঞাসা করল, ডাকাতরা কোন দিকে গেছে; কিন্তু মৌনব্ৰতী ঋষি উত্তর দিতে পারলেন না। তখন প্রহরীরা মুনিকেও ডাকাতদের সহচর ভেবে রাজার কাছে নিয়ে যেতে রাজা তাঁকে শুলে দেওয়ার বিধান দিলেন। ঋষি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানতে পেরে ধর্মকে প্রশ্ন করলেন, তাঁর এ শাস্তি কেন। ধর্ম বললেন, ‘শিশুকালে তুমি একটি কীটের দেহে তীক্ষ্ণ তৃণাগ্র গ্রথিত করেছিলে, তাই।’ তখন ক্রোধে অভিভূত হয়ে অণীমাণ্ডব্য অতি লঘুপাপে অতি গুরু এবং সম্পূর্ণ অন্যায় দণ্ড বিধান দেওয়ার অপরাধে স্বয়ং ধর্মরাজকে শাপ দিলেন, শূদ্রযোনিতে জন্ম নেওয়ার। সেই শাপের ফল বিদুর। (মহাভারত ১:৫৭:৭৭-৮২) দেবতা যে শক্তির বলে মানুষের শাপের লক্ষ্যীভূত হন তা ধর্ম বা নিয়তির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

এখানে মর্ত্য মানুষ শুধু যে-যে কোনও দেবতাকে শাপ দিচ্ছে তা নয়, দিচ্ছে বিশ্বজাগতিক ন্যায়বিচারের অধিষ্ঠাতা স্বয়ং ধর্মকে, তাঁর সম্পূর্ণ অধার্মিক আচরণের জন্যে। এ চিন্তাটাই বৈপ্লবিক। প্রথমত, ধর্ম এখানে একজন সম্পূর্ণ নির্দোষ ধার্মিক ব্যক্তির সম্বন্ধে সত্যিই নিরতিশয় ধর্মবিরুদ্ধ কাজ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, এ কাহিনিতে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের ভিতটাই নড়ে যায়: ধর্ম মানে তা হলে ন্যায়বিচারের নয়, ধর্ম ভয়াবহ ভাবে অধার্মিক আচরণও করতে পারে। অতএব, তৃতীয়ত, কর্ম এবং কর্মফলের তত্ত্বে একটি মারাত্মক ফাঁকি আছে। নিয়তি তা হলে, ন্যায়নিষ্ঠ নয়, ধ্রুব নয়, সমদর্শী নয়, অতএব নির্ভরযোগ্যও নয়, তারও ভ্রমপ্রমাদ ঘটে, সে-ও যদৃচ্ছ আচরণ করে থাকে। মনে রাখতে হবে, ধর্মের আর এক নাম যম, এবং যমও ভ্রমপ্রমাদের ঊর্ধে নয়। মহাভারতেই একটি উপাখ্যানে দেখি শর্মী নামের এক ব্রাহ্মণকে যমদূতরা যমলোকে নিয়ে গেলে যম বিনীত ভাবে মার্জনা প্রার্থনা করলেন, তাঁর দূতরা নামসাদৃশ্যে বিভ্রান্ত হয়ে ভুলে এই শর্মীকে এনেছে। (১৩:৬৯০) যম (মৃত্যু, কাল, অন্তক) বা ধর্ম, কোনও ভাবেই নিয়তি, ভাগ্য অথবা বিধাতা অভ্রান্ত নয়। তাই অণীমাণ্ডব্যের অভিশাপ মানুষের গাঢ় সংশয়ের একটি জ্বলন্ত প্রমাণ; বিশ্বসংসার যে ভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বা কোনও ভাবেই সত্যি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কিনা, সে সম্বন্ধেই এই সংশয়। এ বিধানে আর যাই থাক, এখানে কোনও অন্তর্নিহিত ন্যায়বিচার নেই।

উইলসন লিখছেন, ‘সাধুসন্তদের অপরাধীকে দণ্ড দেওয়ার শক্তিকে বিশ্বাস হল, বিশ্বসংসারের অন্তরস্থিত ন্যায়বিচারের বিশ্বাস। এই ন্যায়বিচার বর্তমান সত্যক্রিয়া বিচারের সঙ্গেও সম্পৃক্ত; এবং এ সবই সংযুক্ত সামাজিক ও রাষ্ট্রিক উপাদানগুলির সঙ্গে, খুবই স্পষ্টত, অন্যবিধ বিচারের বিদ্যমানতার সঙ্গে জড়িত। ধর্মসংস্থার সামাজিক প্রসঙ্গে সাধু দণ্ডদাতার ওপরেও বিশ্বাস যে ভঙ্গির আশ্রয় নেয় এটা তার আর একটি প্রমাণ।… সাধুরা অধিকাংশই পুরুষ।’(১৯৮৩, পৃ. ২৭,৩০) সাধুরা ভবিষ্যদ্বাণী ও অভিসম্পাতের দ্বারা সামাজিক বিচারকের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু অধিকাংশ অভিশাপই নিয়তির ভ্রান্ত নির্দেশে লব্ধ শাপ বা বরের সংশোধন। এই জন্যেই এই সব অভিশপ্ত ঋষিদের সমাজে এত প্রতিষ্ঠা, তাঁরা নিয়তির সহায়ক; ভাগ্য যেখানে দুর্বল সেখানে এঁরা প্রতিবিধায়কের ভূমিকায় আসীন।

শাপ যখন ব্যক্তির প্রতি প্রযোজ্য, তখন তার উদ্দেশ্য হল শত্রুকে উৎপীড়ন করা, যখন গোষ্ঠী বা সমাজের প্রতি প্রযোজ্য, তখন তা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে যথাযথ দণ্ড ও পুরস্কার বিধানের প্রয়াস। বিশ্বে নিয়তির যে অন্তর্নিহিত শক্তিসমবায় সক্রিয়, মানুষের কল্পনা যাকে ন্যায়বিচারের সঙ্গে যুক্ত করে দেখে— তারই সহকারী হল অভিশাপ বা বর

নিয়তিকে প্রসন্ন করবার অন্য উপায় হল যজ্ঞ বা পূজা, যার উদ্দেশ্য বিরুদ্ধ নিয়তির রোধ প্রশমন, ও বিরূপ সিদ্ধান্তের কিছু অনুকূল পরিবর্তন। বৈদিক যুগের গৃহ্যযাগের উদ্দেশ্য ছিল নিয়তি বিমুখ হলেও প্রার্থী যাগযজ্ঞ দ্বারা তাকে নিজের অনুকূলে আনতে চেষ্টা করবে। পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করে পুত্রহীন পুত্রলাভ করবে, শক্তিমান রাজা রাজসূয় যজ্ঞ করে রাজচক্রবর্তী হবে, অশ্বমেধ যজ্ঞ করে প্রতিবেশী রাজাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করবে। পূজার সময় পুরোহিত যজমানের ও তার প্রিয়জনের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে সংকল্প করে। এ সবই বৈকল্পিক অনুষ্ঠান, প্রতিনিধিমূলক। ব্রহ্মঘ্ন স্বামীর উদ্ধারের জন্যে সদ্যবিধবা যখন স্বামীর চিতায় প্রবেশ করে, সতী হয়, তখন সে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বামীর মহাপাতকের প্রায়শ্চিত্ত করে। (গরুড় পু. পূব ৬:২৩) ‘আমি ওকে ওর শাস্তি বহন করাব, যাতে তুমি শান্তিতে থাকতে পারো।’ (এনুমা এলিশ ৬:২৬; ‘ব্যাবিলনীয়ান জেনেসিস’ হাইডেল অনুদিত, পৃ. ৩৫) অন্যের জন্যে করা সব প্রার্থনা, প্রায়শ্চিত্ত, মিনতি এই শ্রেণিভুক্ত; এগুলিতে নিয়তির রায় পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা থাকে, এ চেষ্টা একজন করে, অন্যের জন্যে।

অন্যের ভাগ্যবিধান পরিবর্তন করার একটি পরিচিত প্রয়াস হল শ্রাদ্ধ। মৃত আত্মার সদগতির জন্যে সমাধিদ্রব্য নৈবেদ্যের মতো দেওয়া হত সমস্ত প্রাগৈতিহাসিক শেষকৃত্যে। জীবিতরা মৃত আত্মীয়ের পারত্রিক কল্যাণের জন্য উদ্বিগ্ন বোধ করত এবং পরলোকে তার যা অমঙ্গল হতে পারে তা নিরাকরণের জন্যে কিছু কিছু আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া করত: সমাধি দ্রব্য, খাদ্য বস্ত্ৰ, ভৃত্য, প্রয়োজনীয় পশু— গাভী, অশ্ব, কুকুর— এবং নারী এগুলি কোথাও কোথাও সমাধিতে দেওয়া হত, কোথাও এর কয়েকটি দ্রব্য দান করা হত। মনে হয়, বিশেষ বিশেষ ঋতু বা তিথিতে তারা সমাধির কাছে এসে প্রার্থনা করে জেনে নিতে চাইত পরলোকে তাদের প্রিয়জনের স্বস্তিতে বা আরামে থাকবার কী কী বস্তুর প্রয়োজন এবং সেই মতো সেগুলি জোগাত। ভারতবর্ষে যা ‘শ্রাদ্ধ’ তা নানা নামে ও রূপে পৃথিবীর অন্যত্রও ছিল। নিজের পাপকার্যের জন্যে পরলোকে প্রয়াত আত্মার যে যাতনা প্রাপ্য, তারই উপশমের প্রচেষ্টা শ্রাদ্ধের মধ্যে রয়েছে। রামায়ণ অন্ত্যেষ্টি সম্বন্ধে সামান্য কিছু কথা বলে, কিন্তু মহাভারত-এ বিশেষত, শেষ ভার্গব প্রক্ষেপে, অন্ত্যেষ্টি ও শ্রাদ্ধের সুদীর্ঘ বিবরণ ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এর থেকে বোঝা যায় যে কালের গতিতে শ্রাদ্ধের সামাজিক প্রতিষ্ঠা বাড়ছিল, সেই সঙ্গে শ্রাদ্ধকারীর গৌরবও। বেদাঙ্গ রচনার কাল থেকে গুপ্ত সাম্রজ্যের কালে রচিত পুরাণগুলিতে শ্রাদ্ধের বৈচিত্র, আয়োজন সম্ভার, দানদক্ষিণা ক্রমাগত বেড়েই চলেছিল। একটা কারণ সম্ভবত আঞ্চলিক পার্থক্য, অন্যটি প্রাগার্য রীতিনীতির অনুপ্রবেশ। মহাভারত-এ নানা ধরনের শ্রাদ্ধের সঙ্গে সেগুলির আনুপাতিক পুণ্য বিবৃত হয়েছে। (১৩:৯০, ৯ তর্পণ সম্বন্ধে ৯২ অধ্যায়।

মৎস্যপুরাণ-এ শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে পুরো একটি অধ্যায় আছে (১৩); এর মুখ্য বিষয় হল পিতৃপুরুষদের শ্রাদ্ধ। আর একটি অধ্যায় শ্রাদ্ধের শুভাশুভ লক্ষণ ও মৃতের এবং জীবিত শ্রাদ্ধকারীর ওপরে তার প্রতিক্রিয়া, নিমন্ত্রিত ও ভোজের উপকরণ, ইত্যাদি নিয়ে। (১৭,১৮) এত দীর্ঘ বিবরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য অবশ্যই শুধুমাত্র প্রয়াতের মঙ্গল নয়, যারা জীবিত রইল, তারা প্রয়োজনের সময়ে কী জাতীয় অনুষ্ঠান করলে ও রকম পুণ্যের অধিকারী হবে, মৃত্যুর পরে তাদের উত্তরপুরুষের কাছে কী সমারোহ প্রত্যাশা করতে পারে সে সম্বন্ধেও একটা ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। হয়তো ব্রাহ্মণদেরও প্রকারান্তরে বলা হয়েছে কী রকম চরিত্র হলে শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিত হতে পারে। পরিশেষে দান দক্ষিণার সানুপুঙ্খ তালিকাতেও ব্রাহ্মণের প্রাপ্তিযোগের প্রত্যাশা উদ্রিক্ত হয়। এ কথা ঠিক যে, জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহে সকল ধর্মেই আড়ম্বর হয়ে থাকে এবং এগুলির মধ্যে শ্রাদ্ধই শেষতম। মৃত্যু একটা সীমানির্দেশ করে; মৃতরা আপন পাপ সম্পূর্ণ নষ্ট করার সুযোগ পায় না এবং সে পাপে কে কেমন শাস্তিভোগ করতে পারে, তার রোমাঞ্চকর বর্ণনা পাই গরুড়পুরাণ-এ। সেখানে নরকযন্ত্রণার বহু প্রকারভেদ সাড়ম্বরে ঘোষিত হয়েছে। কাজেই মৃতের জীবিত আত্মীয়রা শ্রাদ্ধে প্রভূত আয়োজন ও ব্রাহ্মণকে প্রচুর দানদক্ষিণা দিতে নিজেদের বাধ্য মনে করে, না হলে প্রয়াত আত্মার অকল্যাণ এবং তাঁদের নিজেদেরও। দানদক্ষিণার তালিকায় আছে, দৈনন্দিনন জীবনযাত্রার সব উপকরণ, তা ছাড়া ভূমি, স্বর্ণ, ইত্যাদি; কাজেই ব্রাহ্মণদের প্রতি এই বদান্যতা তো পুণ্যকর্ম, নিয়তি এতে প্রসন্ন হয়ে হয়তো পরলোকগতের বিচারে একটু সদয় হবে, এ আশাও থাকে।

কূর্মপুরাণেও মৃতের ও জীবিতদের পক্ষে শ্রাদ্ধের নানা অনুপুঙ্খ, পদ্ধতি ও তজ্জনিত পুণ্য ইত্যাদি সম্বন্ধে দীর্ঘ বিবরণ আছে। (উপরিভাগ ২০-২৩ অধ্যায়) মার্কণ্ডেয়পুরাণ-এর নৈমিত্তিক কর্মের অংশে শ্রাদ্ধ, পার্বণশ্রাদ্ধ, তিথিকল্প ও কাম্যশ্রাদ্ধের প্রণালী বর্ণিত আছে (৩০-৩৩ অধ্যায়) মৎস্যপুরাণ-এ শ্রাদ্ধে দানদক্ষিণায় পরলোকগতের কী সুবিধা হয় তা বর্ণিত হয়েছে। (১৯:৮,৯) বৃহন্নারদীয়পুরাণ-এ যে সব খাদ্য দিতে হবে তার তালিকা আছে। (২৮:১০-১২) পদ্মপুরাণ-এর দুটি সম্পূর্ণ অধ্যায় শ্রাদ্ধ সম্পর্কে। (১৯,১১) অন্যান্য পুরাণে ও স্মৃতিতে দানদক্ষিণার তালিকা দীর্ঘায়ত হয়েই চলেছে। তারই সঙ্গে শ্রাদ্ধে করণীয় এবং অকরণীয়গুলির তালিকাও; এগুলির সঙ্গে ভূস্বামীদের উদ্ভাবিত সমাজে, অপরাধী, ঘাতক ও বিদ্রোহীদের প্রতি প্রযোজ্য নিত্য নতুন পীড়ন নির্যাতনের যোগ বেশ বোঝা যায়। এই আতঙ্কে মানুষ ত্রাস ও হতাশার মধ্যে ক্রমেই নিমজ্জিত হচ্ছিল। লোকে বুঝত, যেমন করে হোক পিতৃপুরুষের পাপের প্রতিকার করতেই হবে। তাই শ্রাদ্ধ পল্লবিত হতে লাগল, ব্যয়ে ও আড়ম্বরে। জীবিত উত্তরপুরুষের সন্তানরা শিখল মৃতের জন্য কী, কতটা এবং কেমন ভাবে করণীয়। ক্রমেই শ্রাদ্ধ একটি জীবনমৃত্যুর সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। অনেক শাস্ত্রেই মৃতের পাপ নাশ করার জন্য শ্রাদ্ধ কতটা কেমন ভাবে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত করতে হবে তার নির্দেশ দেওয়া হল। এতে পাপীর পূর্বপুরুষ নরকযন্ত্রণা এড়াতে পারত— এই বিশ্বাস ছিল। এর বেশির ভাগটাই দানদক্ষিণানির্ভর আড়ম্বর, যার দ্বারা ব্রাহ্মণকে দান, সম্মান করা, ইত্যাদি খুবই জরুরি হয়ে উঠল। অর্থাৎ ভাল ভাবে অনুষ্ঠিত শ্রাদ্ধ নিয়তির গতিরোধ ও পরিবর্তন করে, মৃতের অনুকূলে।

শ্রাদ্ধ একটি পরস্মৈ-কৃত অনুষ্ঠান; জীবিত উত্তমপুরুষ মৃত পূর্ব-পুরুষদের প্রাপ্য শাস্তি ও যাতনার প্রতিবিধান করে, মৃতের অবর্তমানে এবং তার হয়ে। কিন্তু পাপপুণ্য অন্যত্র সঞ্চারের আরও সরাসরি কাহিনিও আছে। ‘মানুষ পুণ্য হস্তান্তর করে একে (কর্মকে) প্রতিহত করতে প্রয়াসী হতে পারে। কিন্তু এটি একটি পরবর্তী কালের ধারণা। যতটা মহাযান বৌদ্ধমত, ততটা হিন্দু নয়।’ (ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, ৩৮ খণ্ড, ১-৪ সংখ্যা, ডিসেম্বর, ১৯৮৮, স্মিথ, পৃ. ১০২) মহাযান ও হীনযানের একটি পার্থক্যের দিক হল, মহাযানে বোধিসত্তত্বরা স্বেচ্ছায় নিজেদের ‘নিব্বান’বিলম্বিত করতেন, আশেপাশের মানুষকে মোহমুক্ত করে ধর্মমার্গে অবতীর্ণ করার উদ্দেশ্যে এবং স্বেচ্ছায় জন্মান্তর বরণ করতেন, যাতে তাঁরা সব মানবদের আধ্যাত্মিক উন্নতিবিধান করতে পারেন। এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা-তে কয়েকটি নিদর্শন পাই। ‘পাজা’ শিলালিপি বলে, ‘সর্বজীবের আধ্যাত্মিক উন্নতিকল্পে’ অধিকর্তা পুণ্যবিভাজন করে নিতে প্রস্তুত। (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৬৫) অথবা ‘সর্বজীবের সুখ ও পুণ্যের জন্যে’ (জামালগঢ়ি শিলালেখ, ওই, ১১৪) এবং ‘সকলের পুণ্যের জন্য’ (কুররম শিলালেখ, ওই, পৃ. ১১৫)

সম্পদের মতোই পুণ্যও উপার্জন করা যায়; সযত্নে, কঠিন কৃচ্ছ্রসাধনে একে সংরক্ষণ করা যায়; প্রার্থীকে দান করা যায়, নির্বোধের মতো অপচয় করা যায় এবং অন্যের সঙ্গে ভাগ করেও নেওয়া যায়। পুণ্য আধ্যাত্মিক সম্পদ এবং শাস্ত্রকাররা সেই ভাবেই দেখিয়েছেন। ‘মহাযানে পুণ্য হস্তান্তার করার তত্ত্ব বলে সংযত আচরণের চেয়েও বিশ্বাসেই ভক্ত স্বৰ্গ অর্জন করতে পারে এবং ওই ভাবে নির্বাণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।’ (স্মার্ট, ১৯৬৭, পৃ. ১৬৪) ‘এই বিশ্বাসের অন্তর্গত ছিল একটি করুণার মনোভাব, যাতে বোধিসত্ত্ব প্রণোদিত হতেন; যখন কর্মক্ষয়ে ও বাসনাবিনাশে তাঁরা নির্বাণ অভিমুখী হয়েছেন তখন দুর্বলতরদের সঙ্গে নিজের পুণ্য ভাগ করে আসন্ন নির্বাণকে বিলম্বিত করতেন। পুণ্যের অংশ দেওয়া যেত প্রিয়জনদেরও এবং পরিবারভুক্ত ব্যক্তি বা বন্ধুস্থানীয়দের। পরিবারস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে পুণ্য সংক্রমণ করা যায় (যাতে পুণ্যবাণের পুণ্যের অংশ কমে না যায়, প্রকৃতপক্ষে এতে তার পুণ্য বৃদ্ধিই পায়) অথবা বৃহত্তর সামাজিক গোষ্ঠীর জন্যেও তা করা যায়।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডয়া অব রিলিজিয়ন, ১৯শ খণ্ড, পৃ. ৩৮২)

সমাজে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যজাত দ্রব্য উদ্বৃত্ত হলে অন্তর্বাণিজ্যে ও বহির্বাণিজ্যের দ্বারা যে সম্পদ সঞ্জাত হত, যা ভোগে লাগত উপরতলার মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকে এবং তার কিছু পরে, মুদ্রা প্রচলনের পরে, সাধারণ মানুষের কাছে সম্পদ একটি নতুন চেহারায় দেখা দিল। এ সম্পত্তি প্রয়োজনের বহির্ভূত, একে অর্জন, সংরক্ষণ, পরিভোগ, দান, ঋণদান, গচ্ছিত রাখা এবং নষ্ট করে ফেলা যায়। মহাকাব্যের ও প্রথম বৌদ্ধগ্রন্থগুলির মধ্যে যখন পাপপুণ্যের বোধ এবং ক্রমে তার সংজ্ঞাও নিরূপিত হতে লাগল, তখন সাধারণ মানুষ দেখল যে উদ্বৃত্ত সঞ্চিত ধনের সব রকম ব্যবহারই পুণ্য সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। পাপ হিসেবের খাতায় খরচের দিকে; এ হল ঋণ, এ ঋণ মানুষের কাছে নয়, দৃশ্যজগতের ওপারে ন্যায়নীতিবোধের নিয়ন্তা ধর্ম, দেবমণ্ডলী এবং নিয়তির কাছে। সংসারের নিপীড়িত মানুষ জানত রাজা, ভূস্বামী বা মহাজনের কাছে অপরিশোধিত ঋনের দায় কত— বহুতর যন্ত্রণা ও পীড়ন ঋণীর ভাগ্যে অপেক্ষা করে থাকত। কাজেই সে প্রাণপণ চেষ্টা করবে যেমন করে পারে ঋণ শোধ করতে। কিন্তু এখনও যেমন নিরক্ষর খাতকের ঋণ মহাজনের খাতায় চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়েই চলে, কখনও পরিশোধ হয় না, তখনও তেমনই দুঃখী সাধারণ মানুষকে বলা হয়েছিল, ‘এ দুঃখ কি তোমার শুধু এ জন্মে অর্জিত? কত জন্ম ধরে পাপ করে এ পরিণতি হয়েছে, এবং আরও কত জন্মে পুণ্যাচরণের ফলে, নরকে নানা নিগ্রহ ভোগ করে তবে ঋণমুক্তি অর্থাৎ পাপক্ষয়।’ আগে এবং পরে ঋণ তথা পাপকে পিছিয়ে দীর্ঘায়ত করেছিল শাস্ত্রকাররা। এবং সঙ্গে সঙ্গে বিধান দিয়েছিল সমাজে ওপরতলার মানুষের যথাবিধি সেবা করে যেতে পারলে ভবিষ্যতে কিছু আশার আলো থাকতে পারে। পৃথিবীতে যেমন একের ঋণ অপরে শোধ করতে পারে, ধর্মের ক্ষেত্রেও তেমনই একের পাপ অন্যের পুণ্যকর্মে ক্ষমা পায়। তবে সব কিছুর হিসেবের মধ্যে একটি অনির্দেশ্য ও অনির্ণেয় উপাদান থেকে যায়— ওই জমাখরচের খাতাটা কোনও দিন কোনও পাপী বা পুণ্যবানের যেমন দৃষ্টিগোচর হয় না, তেমনই পাপপুণ্যের খাতাটাও অদৃশ্য এবং এইটিই অদৃষ্ট নিয়তির আওতায়, যার হিসেব কোনও দিনই ঠিকমতো পাওয়া যাবে না।

স্বামীর চিতায় পুড়ে মরে স্ত্রী স্বামীর বহু মহাপাপ খণ্ডন করে, তার অক্ষয় স্বর্গবাসের ব্যবস্থা করতে পারত, কিন্তু স্ত্রীর জন্যে স্বামীর কিছুই করণীয় ছিল না। পুণ্য, ঋণ বা দান দেওয়াতেও দেখি, একমাত্র রুরুর পরমায়ুর অর্ধেক দান ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দানটা করতে হয় নারীকে, দুর্বলকে। শিলালেখগুলিতে মহাপ্রাণ দাতাদের পুণ্যভাগ দেওয়া কিছু কথা আছে। সাধারণ ভাবে পুণ্য মানুষ নিজের বা পিতৃপুরুষের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে অর্থাৎ নিয়তি নিয়ন্ত্রণের জন্যে ব্যবহার করে। পাপ যেন বস্তু এবং দেহ থেকে স্নানজলের সঙ্গে নির্গত হয়ে ঝড়ে পড়ে; সমস্ত কল্পনাটিই হাস্যকর এবং শিশুসুলভ। শুধু পরার্থপর ব্রাহ্মণদের মাহাত্ম্য দেখানোই এ কাহিনির উদ্দেশ্য।

বৌদ্ধসাহিত্যে এ ধরনের পুণ্য ভাগ করে নেওয়ার বেশ কয়েকটি নিদর্শন আছে। যদিও এটি মহাযানের স্পষ্টতর লক্ষণ, তবু সম্প্রদায়ভেদের পূর্ব থেকেই, যখন থেকে সর্বাস্তিবাদীদের একটি অংশ স্থির ভাবে মহাযান অভিমুখে এগোচ্ছিল, তখন থেকেই চিন্তার জগতে এ ধারণার উদ্ভব হয়েছিল এ কথা অনুমান করা সঙ্গত। জাতকগুলিতে করুণা একটি প্রধান প্রেরণা।

নৌকাডুবির পরে একটি উদ্ধারের নৌকা যাচ্ছিল, শুধু যাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ পুণ্য আছে তাদের নিয়ে। এক বণিকের পুণ্যে ঘাটতি ছিল, তাকে ফেলে যাওয়াতে সে বিষম মনঃক্ষুণ্ণ হয়। তখন এক গৃহী বুদ্ধশিষ্য নিজের পুণ্য, ধর্মাচরণ ও আধ্যাত্মিক শক্তি তাকে দান করল; শুধু তখনই বণিকটি উদ্ধার-তরণীতে স্থান পেল। (১৯০ সংখ্যক, শীলানিশংস) একবার রাজার স্নানের সময়ে দশটি ব্রাহ্মণ ঘাটের জলে নিমজ্জিত হয়ে শুয়ে ছিল, যেন রাজার স্নানের সময়ে তাঁর পাপস্নান-জলের সঙ্গে পড়লে ওই ব্রাহ্মণরা তাঁদের পুণ্য দিয়ে তা ধুইয়ে দিতে পারেন। (৪৯৫ সংখ্যক, দসব্রাহ্মণ) ঋষি কিসবচ্ছকে দেখে এক গণিকা স্বার্থপর ভাবে কামনা করল যেন তার পাপ স্নানের সময় ওই সাধুর ওপরে পড়ে ও সে শুচি হয়; তিনি স্বেচ্ছায় সম্মত হলেন। এক পদচ্যুত পারিবারিক পুরোহিতও নিজের পাপ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে পূর্বপদে নিযুক্ত হন। (৫২২ সংখ্যক, সরভঙ্গ) মহাবগ্গে এই ধরনের সর্বভূতে অনুকম্পা ও করুণার কথা পড়ি। (৮:২৬) মনে পড়ে যিশুও বলেছিলেন, ‘সত্য সত্যই, এ ভাইদের মধ্যে তুচ্ছতম ব্যক্তির জন্যে তোমরা যা কর, তা আমার জন্যেই করা হয়।’ (ম্যাথিউ ২৫:৪০)

এখানে পুণ্যসংক্রমণের একটি উচ্চমার্গের নিদর্শন চোখে পড়ে, মানুষের সেবা করে লোকে প্রকৃতপক্ষে ভগবৎসেবাই করে এবং এই বৈকল্পিক সেবার দ্বারাও পুণ্য অর্জন করা যায়।

এই সব উপাখ্যানে, এবং সুবৃহৎ বৌদ্ধসাহিত্যে এমন আরও অনেক উপাখ্যান আছে, যেখানে পুণ্যবান স্বল্প পুণ্যবানের সঙ্গে পুণ্য ভাগ করে নিতে অনুপ্রাণিত হন; এখানে ওই দান যে গ্রহীতার আধ্যাত্মিক উন্নতিকল্পে তা খুবই স্পষ্ট। ব্রাহ্মণ্যধর্মে সব সময়ে এ জাতীয় প্রেরণা এতটা পরহিতার্থে নয়। রুরু ও প্রমদ্বরার উপাখ্যানে উদ্দেশ্য তো অনেকটা স্বার্থপরই; প্রমদ্বরার মৃত্যুতে রুরু’র জীবন অর্থহীন হয়ে পড়েছিল, তাই নিজের পুণ্য ও পরমায়ুর অংশ নিয়ে প্রমদ্বরাকে সঞ্জীবিত করা পুরোপুরি নিঃস্বার্থ নয়। রাজা সোমক তাঁর পুরোহিতকে নরকে দেখে নিজের পুণ্য দিয়ে তাকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু এখানেও পরার্থপরতা ততটা নয় যতটা অনুশোচনা; সোমকের স্বার্থেই পুরোহিত জঘন্য অমানবিক উপায়ে যজ্ঞ করেছিলেন। অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে তিনি ধর্মের কাছে প্রার্থনা করেন যেন তাঁর পুণ্যে পুরোহিত স্বর্গে যেতে পারেন; ধর্ম দুজনকেই স্বর্গে পাঠিয়ে দিলেন। মোটের ওপরে, করুণা-মৈত্রী-ভূতানুকম্পা বৌদ্ধ সাহিত্যে বেশি স্পষ্ট। খ্রিস্টধর্মেও করুণার ভূমিকা আছে, কিন্তু স্বর্গ ও নরক সেখানে চরম বা চূড়ান্ত। ধনী লাজারাসের দ্বারপ্রান্তে যে কুষ্ঠী ভিক্ষা করত, দুজনের মৃত্যুর পরে সে স্বর্গে আব্রাহামের কোলে স্থান পেল। লাজারাস নরকে গেল। ধনী নরক থেকে আব্রাহামকে করুণ মিনতি জানালেন যেন কুষ্ঠী পায়ের আঙুলের ডগা ভিজিয়ে তার মুখে ছোঁওয়ায়, যাতে তার নরকের তৃষ্ণা দাহের উপশম হয়। কিন্তু আব্রাহাম রূঢ় ভাবে তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন: স্বর্গে ও নরকে কোনও যোগাযোগই নেই। (লুক ১৬-১৯-৩১)

অপরকে পুণ্যের অংশ দিলেও নিজের পুণ্য কমে না, বরং বাড়ে, এই ধারণার পশ্চাতে একটা কারণ সম্ভবত এই যে, পুণ্যদানের প্রেরণাটি মহৎ। আর একটা কারণ হয়তো এই যে, ‘এই (পুণ্যদান) কর্মটি শুধু তার অতীত কর্ম নয়। কিন্তু রক্ত, খাদ্য ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যদের কাছে সে যা পেয়েছে এর মধ্যে তা-ও আছে। কাজেই কোনও ব্যক্তির ললাটলেখনে যে সব শাস্তি ও পুরস্কার থাকে তার ওপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না।’ (কি’স অ্যান্ড ড্যানিয়েল ১৯৮৩, পৃ. ৩৫) এ কথার ব্যঞ্জনা হল, মানুষ আপন পরিবারের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যা কিছু পেয়েছে, খাদ্যবস্ত্র-আশ্রয় ভাগ করে নেওয়ার ফলে তার জন্যে তার একটা দায়ও থাকে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এ দস্যু বাল্মীকি পরিবারের সকলকে তার পাপ ভাগ করে নিতে বলেছিল, যেহেতু তার পাপকর্মের ফল লুণ্ঠিত ধন ও অন্নবস্ত্র সকলে ভোগ করেছিল; কিন্তু কেউই পাপের ভাগ নিতে রাজি হয়নি। এর দ্বারা প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, ব্যক্তিগত পাপের ফল ব্যক্তিকে একলাই ভোগ করতে হয়। অর্থাৎ, পুণ্য যেমন ভাগ করে নেওয়া যায়, পাপ সে ভাবে ভাগ হয় না। সমাজেও পুরস্কার ভাগ করে দেওয়া যায়, শাস্তি নয়। পাপের নৈতিক গর্হিতা মানুষকে আত্মিক ভাবে নিঃসঙ্গ করে তোলে।

অবশ্য কদাচিৎ পাপও ভাগ করা যায়। ফ্লরেন্টাইন কোডেকস বলে, নির্যাতিত ক্রীতদাস নিজের পাপের বোঝা অত্যাচারী প্রভুর ওপরে তুলে দেয়।’ (৬ষ্ঠ অধ্যায়, ৩৬) এতে অত্যাচারী প্রভুর ক্রুরতা ও অবিচারই প্রতিপন্ন হয়। ভারতবর্ষে পাপের ভাগ নেওয়ার কথা নেই, পুণ্যের আছে। সম্পূর্ণ হৃদয়হীন স্বার্থপর পিতা যযাতির জন্যে কষ্টে অর্জিত পুণ্যের ভাগ দিল সর্বতো ভাবে লাঞ্ছিতা কন্যা মাধবী। (মহাভারত ৫:১১৯:২৩-২৭) ‘যে পাপ করে কালের মোহে, সেই নরাধম নিজের কর্মে সমস্ত বংশকে ধ্বংস করে।’ (ওই ৬:৩:৮:৭) প্রমদ্বরার মৃত্যুতে প্রবল শোকে রুরু দেবতাদের অনুনয় করে নিজের পরমায়ুর অর্ধেক দিয়ে প্রমদ্বরারকে সঞ্জীবিত করার অনুমতি পেল— এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। একটি অর্বাচীন পুরাণে এই ব্যতিক্রমী কাহিনির অন্য এক সংস্করণ পাই। রুরু যখন প্রমদ্বারার জন্যে উন্মাদের মতো শোক করছে, তখন তার কাছে দু’জন ঋষি এলেন, যজ্ঞমালী আর সুমালী। রুরুকে বললেন, ‘হে ব্রাহ্মণ, এর প্রতিকারের যে বিধান দেবতারা পূর্বকাল থেকেই দিয়েছেন তা শোনো: তোমার পরমায়ুর অর্ধেক দিয়ে প্রমদ্বরারকে বাঁচাও।’ (দেবীভাগবত পুরাণ ২:৯:৩২) এখানে বিস্ময়ের কথা এইটুকুই যে, দেবতারা নাকি পুরাকাল থেকেই পরমায়ু ভাগ করে নেওয়ার ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। মনে পড়ে, গ্রিক অতিকথায় দুই ভাই কাস্টর ও পলিডেউকেস-এর একজনের মৃত্যু হলে অন্যের পরমায়ুর অংশ নিয়ে তারা পালা করে জীবিত থাকে; প্ৰায় একই ধরনের কল্পনা।

এ-ই কি তবে দেবতাদের পুরাকলের বিধান, ইন্দো-ইউরোপীয় অতিকথায় যার রেশ থেকে গেছে? যেমন আছে অন্য একটি গ্রিক অতিকথায়, যেখানে মৃতা স্ত্রী ইউরিডিকেকে বাঁচাবার জন্যে স্বামী অর্ফেউস পরমায়ুর অর্ধেক দিতে প্রস্তুত হয়েছিল? (১:৯:১৫) অথব বেদে একটি আশ্চর্য কথা আছে: দেবতারা পাপ করে খোঁজ করছিলেন কার ওপরে পাপ চাপানো যায়। খুঁজে পেলেন ত্রিতকে। কিন্তু বুদ্ধিমান ত্রিত ওই বোঝা বইতে রাজি ছিলেন না, তিনি তৎক্ষণাৎ মানুষের ওপরে সেটা চাপিয়ে দিলেন। (৬:১১৩:১-৩; ঋগ্বেদ ২:২৮; ৬:৫১:৭; ৮:৫২:২; বাজসনেয়ী সংহিতা ৩:৪৮, শতপথ ব্রাহ্মণ ৪:৪:৫:২২) এ কাহিনি ঋগ্বেদ থেকে শুরু করে শতপথ ব্রাহ্মণ পর্যন্ত চলে এসেছে, কাজেই এর তাৎপর্যের গুরুত্ব আছে। এই অতিকথাটি প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকাহিনি: দেবতাদের পাপ এবং সেটা এড়ানোর পাপ এবং শেষ পর্যন্ত দেখা গেল মানুষের পাপ এসেছে দেবতাদের কাছ থেকেই। এখানে পাপের পরম্পরাগত সংক্রমণ দেখানো হয়েছে— আদিপাপ দেবতাদেরই, সেই কথা দিয়ে।

ব্রহ্মপুরাণে পার্বতী তপস্যায় অর্জিত তাঁর পুণ্য স্বামী শিবকে দান করলেন, শিব বিনা প্রতিবাদে তা গ্রহণও করলেন। (৩৫:৩১-৬০) রুরু বাদে হিন্দুশাস্ত্রে অন্য সব জায়গাতেই পুণ্যদান করে নারী এবং পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষ তা গ্রহণ করে প্রাপ্য হিসেবেই। নিঃসন্তান সোমক সুদীর্ঘকাল পরে যে পুত্র লাভ করে, পুরোহিতের পরামর্শে সেই পুত্র ‘জন্তু’কে খণ্ডখণ্ড করে যজ্ঞে আহুতি দেন। সোমক খুবই বিচলিত হয়েছিলেন, বহু কষ্টে লব্ধ একমাত্র সন্তানকে হারানোর সম্ভাবনায়, এবং সম্পূর্ণ অমানবিক নিষ্ঠুর প্রক্রিয়াটিতে। কিন্তু শতপুত্রের লোভ এমনই দুর্বার যে, রাজা পুরোহিতের পরামর্শ শুনেছিলেন, এবং সত্যিই শতপুত্র লাভ করেছিলেন। পুত্রের জননী সম্পূর্ণ উপেক্ষিত, তাঁর মত নেওয়াটাও দরকার হয়নি। মৃত্যুর পরে রাজা ও পুরোহিত দু’জনেই নরকে গেলেন; রাজা ধর্মকে অনুরোধ করলেন পুরোহিতের নরকবাসের মেয়াদ তিনি বহন করবেন— এ অনুমতি যেন দেওয়া হয়। ধর্ম বললেন, ‘কেউ অপরের কৃতকর্মের ফলভোগ করতে পারে না।’ কিন্তু রাজা সমস্ত পাপের দায়িত্ব নিয়ে পুরোহিতের মুক্তি ভিক্ষা করলেন। শেষ পর্যন্ত ধর্ম দয়া করে বললেন, ‘তোমার পুণ্যের অংশ সমান ভাবে ভাগ করে নাও, তাহলে দু’জনেই অল্পকালের জন্যে স্বর্গে যেতে পারবে।’ সোমক খুশি হয়ে রাজি হলেন। (মহাভারত ৩:১২৭:১-১০) এখানেও পুণ্য ভাগ করে নেওয়া হল।

মানুষ পুণ্য নিয়ে জন্মায় না, শুধু পূর্বজন্মে অর্জিত পুণ্য ছাড়া। এ পুণ্য আসে ধর্মকর্ম, ব্রত, তীর্থ, যজ্ঞ, দক্ষিণা ও দান থেকে, বিশেষত ব্রাহ্মণকে দান ও ইষ্টাপূর্ত থেকে এবং ধ্যান, ভক্তি ও পূজা থেকে। এ সব দিয়ে মানুষ নিজের পুণ্য সঞ্চয়কে বৃদ্ধি করতে পারে। এ পুণ্য সে সঞ্চয় করতে পারে, এ দিয়ে স্বর্গে যেতে পারে, এর সুবাদে পরজন্মে সদ্বংশে ধনী, স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ও বিদ্বান হয়ে জন্মাতে পারে। সঞ্চয় যথেষ্ট হলে মোক্ষ বা নির্বাণও পেতে পারে। কিন্তু যেহেতু পুণ্য তার নিজস্ব সম্পত্তি, সে ইচ্ছা মতো বা কারও অনুরোধে অন্য যোগ্য ব্যক্তির সঙ্গে সে সেটা ভাগ করেও ভোগ করতে পারে। এই ভাবে সে অন্য ব্যক্তিটির নিয়তিকে প্রভাবিত করতে পারে, এবং একই যুক্তিতে তার নিজের নিয়তিও সেই পরিমাণে হ্রাসবৃদ্ধির দ্বারা প্রভাবিত হয়। যযাতি নিজের পুণ্যে স্বর্গে যেতে পারত না, যখন মাধবী তার পুণ্যের অংশ পিতাকে দিল, তখন অপরের পুণ্য নিয়ে যযাতি স্বর্গে গেল; এখানে পুণ্য আদান-প্রদানের দ্বারা নিয়তি প্রভাবিত হল। মাধবী যযাতিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারত, সে ক্ষেত্রে নিয়তি নির্দিষ্ট পরিণতি হত যযাতির স্বর্গে না যাওয়া; কিন্তু মাধবীর উদারতার ফলে যযাতির নিয়তি পরিবর্তিত হল। এটা সম্ভব হল, কারণ চিন্তার ক্ষেত্রে পুণ্য ‘বস্তু’তে পরিণত হয়েছিল, যা দেওয়া নেওয়া চলে, অতএব যার দান ও প্রতিগ্রহণের মধ্যে নিয়তি রূপান্তরিত হয়।

এই পরস্মৈপদী ভাগ্যপরিবর্তনের উপায়গুলি সবই কর্মের বিভিন্ন প্রকাশ। এমনকী ভক্তিও বিভিন্ন ভক্তি-প্রণোদিত কর্মের প্রেরণা দেয়। শ্রাদ্ধে কর্ম আছে; ব্রত, তীর্থ, যজ্ঞ, পূজা, দান, দক্ষিণা, ধ্যান, তপস্যা সবই কর্মের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। এ সবেরই লক্ষ্য এক: নিয়তির সিদ্ধান্তকে পরিবর্তিত বা প্রভাবিত করা। শুধু শাপ ও বরই অতিপ্রাকৃত-শক্তিগর্ভ বাণী, কিন্তু সেগুলিরও লক্ষ্য একই; ভাগ্যকে প্রভাবিত, প্রতিহত বা ভিন্নপথে চালিত করা। অতএব নিয়তি মানবিক বা দিব্যশক্তির দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। একটি ক্ষেত্রে তা হলে নিয়তি অমোঘ বা অপরিবর্তনীয় নয়। যেমন সচরাচর বলা হয়ে থাকে। এই সব ফাঁক উদ্ভাবন করে মানুষ নিয়তির প্রতিকূল রায় থেকে আত্মরক্ষার উপায় বের করেছে এবং পুরোহিত ও সাধুসন্তদের মানুষের বিপদ উদ্ধার করার ভূমিকায় আবির্ভূত হতে সুযোগ দিয়েছে এবং এর দ্বারা পুরোহিতরাও নিজেদের আর্থিক সুবিধা করে নিতে চেয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এদের সাহায্য প্রমাণের বাইরে, কারণ নিয়তির আদি সংকল্প কী ছিল তা কেউই জানতে পারে না, তেমনই জানতে পারে না সে সংকল্প এড়ানোর এই কৌশলগুলি আদৌ কার্যকর হল কিনা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরলোকে— যদি পরলোক থাকতই— মৃত ব্যক্তির কী অবস্থা হল সেটা জানা যায় না, কাজেই যথাযথ অনুষ্ঠিত শ্রাদ্ধে তার অবস্থার সত্যিই উন্নতি হল কিনা তাও কেউ বলতে পারে না। মৃত্যুর পরে আত্মা বলে কিছু থাকে কিনা তারও কোনও প্রমাণ নেই। কাজেই বহু দানদক্ষিণা দিয়ে শ্রাদ্ধ করলে, ব্রাহ্মণকে তুষ্ট করলে, আত্মার সদগতি হল কিনা তাও প্রমাণ করা অসম্ভব। তেমনই ব্রত, তীর্থ, দান, দক্ষিণা মৃতের পারলৌকিক সাহায্য লাগে কিনা তা-ও একান্তই অনুমাননির্ভর, তা দিয়ে পূর্বজন্মকৃত পাপের মোচন হয় কিনা এবং পরবর্তী জন্মে সুখ হয় কিনা তার কোনও প্রমাণ নেই; আসলে আত্মা, পরলোক, পূর্বজন্ম সবই তো কল্পনানির্ভর। কাজেই নিয়তির সিদ্ধান্ত এড়াবার এই সব উপায়ও অলীক, অনুমানকল্প।

কিন্তু সর্বত্র সর্বকালেই তো অতিকথা ও তন্নির্ভর অনুষ্ঠান ও ধর্মতত্ত্ব, প্রভৃতি কল্পনা দিয়েই নির্মিত; এদের উপযোগ্যতা অনেকটা সেই রকম যে ভাবে মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক তাঁর রোগীকে আশ্বস্ত করেন। তিনি মানসিক স্থৈর্য ও এক ধরনের শান্তি দেন। যুগে যুগে দেশে দেশে মানুষ এই শান্তির জন্যেই তৃষিত থেকেছে। পুরোহিতরা প্রথমে নানা স্তরের পাপের একটি বিস্তৃত ছক তৈরি করেন, যে সব পাপের কিছু বাস্তব কিছু বা কাল্পনিক, কিছু নৈতিক বিচ্যুতি, কিছু মানবতাবিরোধী, কিছুবা ব্রাহ্মণ বা দেবতা বিরোধী, কিছু আনুষ্ঠানিক ত্রুটি, কিছু দেশে কালে পরিবর্তনশীল উদ্ভাবিত অপরাধ; তার পরে সেই পুরোহিতরাই নিয়তিবাদের একটি সৌধ নির্মাণ করেন, নিয়তির দুর্জ্ঞেয়তা, কর্মবাদ ও জন্মান্তরের তত্ত্ব এবং তারই সঙ্গে নিয়তিকে পূর্বাহ্নে জানবার চেষ্টা এবং তার অভীষ্ট অশুভকে প্রতিহত করবার উপায়ও উদ্ভাবন করেন। যেহেতু ব্যাধি ও ভেষজ কোনওটিই প্রমাণসাপেক্ষ নয়, মানুষকে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, নির্ধারিত উপায় অবলম্বন করলে নিয়তির প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করা যাবে এবং দীর্ঘ পরমায়ু, সিদ্ধি ও স্বর্গলাভ করা যাবে। অপরাধবোধ যখন একবার দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেমন অধিকাংশ ধর্মেই হয়েছে, মানুষ স্বভাবত তা ক্ষালনের জন্যে নিরতিশয় উৎসুক হয়। তাই সব ধর্মের মূল কথাটি হল পরিত্রাণ। শাস্ত্রকার ও পুরোহিতরা মানুষের বিশ্বাসপ্রবণতা ও অবিশ্বাস ঠেকিয়ে রাখার উৎসাহকে পুরোপুরি ব্যবহার করে, কারণ অপরাধবোধে আচ্ছন্ন অসহায় মানুষের সামনে পরিত্রাণের লোভটি রাখা থাকে। একবার অপরাধ ও পরিত্রাণের ছকটি যখন মানুষের চিত্তে দৃঢ়মূল হয়, তখন বিরুদ্ধ দৈবের প্রতিকারের জন্যে এই বিপুলকায় শাস্ত্র ও তার অগণ্য নির্দেশ সবই অসহায় মানুষ অনায়াসে গলাধঃ করণ করে। স্বর্গ, নরক, বায়ুভূত নিরালম্ব অবস্থা, দেবতা, উপদেবতা, মানুষ বা পশু রূপে পুনর্জন্ম— সবই ওই বিরাট সৌধের মধ্যে নিজের নিজের স্থান খুঁজে পায়। ক্রমে ক্রমে স্বেচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত অপরাধের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে, তারই সঙ্গে বহুগুণিত হতে থাকে নিয়তি সম্বন্ধে পূর্বজ্ঞানসঞ্চারী, নিয়তি নিরোধকারী, প্রায়শ্চিত্তকারী ও নিয়তির গতিপরিবর্তনকারী নানা উপায়।

এর প্রত্যেকটির আদি ভিত্তিপ্রস্তর হল নিয়তিবাদ। ভারতবর্ষে নিয়তির সঙ্গে জুড়েছে কর্ম ও জন্মান্তর, তার জটিলতা গ্রন্থিলতর হয়েছে। এমন একটি সূক্ষ্ম রহস্যময় নকশা বোনা হয়েছে যার মর্মোদ্ধার করতে পারে শুধু পুরোহিত ও শাস্ত্রকাররা; অন্তত তারা এ দাবি ঘোষণা করে থাকে, অসহায় মানুষ তা বিশ্বাসও করে। পুরোহিতরা যখন এ জন্মের বা কল্পিত পূর্বজন্মের পাপের দ্বারা উদ্রিক্ত নিয়তির কল্পিত রোষের বিরুদ্ধে বিধান দেয় তখন তাঁদের শ্রোতা প্রার্থীরা শুধু নিঃশেষ আত্মনিবেদন ও কৃতজ্ঞতাই অনুভব করেন। ফলে বুদ্ধিমত্তা, যুক্তিমত্তা, স্বাধীন চিন্তা— সবই সমর্পিত হয় ওই পরিত্রাতাদের চরণে। ইচ্ছার স্বাধীনতাকে শেষ পর্যন্ত কাল্পনিক বলে প্রতিপন্ন করা হয়, কারণ নিযুক্তিক নিয়তিই মনুষ্যজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। শুধু শাস্ত্রে উল্লিখিত বিধান অনুসারে নিজেদের ভাগ্যের উন্নতিসাধনের চেষ্টা ছাড়া তখন মানুষের কী বাকি থাকে।

তা সত্ত্বেও, পরের অধ্যায়ে দেখব মানুষের যুক্তিমত্তা সত্যিই দুর্মর। ভেতরে ভেতরে মানুষ ঠিকই জানে, জীবনের বেশ অনেকটা অংশ সে ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নিজের চেষ্টায়। এখানেই নিয়তির ওপরে সে বিজয়ী। প্রতিকূল দৈবের সঙ্গে শাস্ত্রনিৰ্দিষ্ট পন্থায় যুদ্ধ করার বদলে যুগে যুগে মানুষ বেছে নিয়েছে সেই দৈবের বিরুদ্ধে নিজের বুদ্ধিতে ও চেষ্টায় যুদ্ধ করা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *