জন্মান্তরবাদ থেকে নিয়তিভাবনা

জন্মান্তরবাদ থেকে নিয়তিভাবনা

ভারতীয় নিয়তিবাদ দুটি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে আছে— জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ। প্রথমে উদ্ভূত হয় জন্মান্তরবাদ, এবং লক্ষণীয় যে, প্রথম উল্লেখে এটি পুনর্জন্ম নয়, পুনমৃত্যু। এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ধারণাটি প্রথমে মানুষকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত হয়নি, দেবতাদের সম্পর্কেই এর আদিমতম উল্লেখ। শতপথ ব্রাহ্মণে পড়ি, ‘বস্তুত, দেবতারা প্রথমে মরণশীল ছিলেন, পরে যখন সম্বৎসরকে তাঁরা অধিকার করেন তখনই তাঁরা অমর হন।’ (১১:১:২:১২) যজ্ঞ করে দেবতারা অমর হলেন, মৃত্যু আতঙ্কিত হল, ‘আমার ভাগে তা হলে রইল কী?’ দেবতারা তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘এখন থেকে সশরীরে কেউই অমর হবে না। যারা এটা জানে অথবা পুণ্যকর্ম করে তারা মৃত্যুর পরে পুনর্বার জীবিত হয় এবং পুনর্জীবিত হয়ে তারা অমরত্ব পায়। কিন্তু যারা এ কাজ করে না তারা মৃত্যুর পরে আবার জীবিত হয় এবং বারে বারে তার (মৃত্যুর) খাদ্য হয়।’ (শতপথ ব্রা. ১০:৪:৩; ৯,১০) ‘যদি কেউ (যজ্ঞে) এ নৈবেদ্য না দেয়, তবে সে বিভিন্ন লোকে মৃত্যুপ্রাপ্ত হয়।’ (তৈত্তিরীয় ব্রা. ৩:৯:১৫:৫৩-৫৬) এই যুগ বিশেষ একটি রূপে মৃত্যুকে চিনত: ক্ষুধা। ‘ক্ষুধা হল জীয়ন্ত মরণ, মৃত্যুর দ্বারা ক্ষুধার দ্বারা সব কিছুই পরিব্যাপ্ত ছিল, ক্ষুধাই মৃত্যু।’ (ঐ ১০:৬:৫:১)

পুনর্জন্ম সম্বন্ধে কয়েকটি মৌল তাত্ত্বিক উপাদান পাচ্ছি:

(ক) মৃত্যু প্রথমে আক্রমণ করতে যায় দেবতাদের, এবং মৃত্যু যখন তার খাদ্য হারাবার ভয়ে আতঙ্কিত হয়; তখন

(খ) দেবতারা দুটি বিধি স্থাপন করেন; (১) সম্ববৎসরকে অধিকার করা, ও (২) কিছু নির্দিষ্ট যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা, যার দ্বারা

(গ) তাঁরা অমরত্ব লাভ করেন। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুকে আশ্বাস দেওয়া হয়, অতঃপর সশরীরে কেউ অমর হবে না। এ বিধান এ বার শুধু মানুষেররই জন্যে, কারণ দেবতারা তো ইতোমধ্যেই অমর হয়ে গেছেন। কাজেই মানুষ নির্দিষ্ট যজ্ঞ করে অমরত্ব লাভ করতে পারে, অন্তত এক বার মৃত্যুর পরে। মনে পড়ে, স্বয়ং যমেরও মৃত্যু হয়েছিল (যো মমার প্রথমো মর্ত্যানাম)। (অথর্ব সংহিতা ১৮:৩:১৩) এবং শেষত,

(ঘ) মৃত্যুর অন্যতম রূপ হল ক্ষুধা; উপনিষৎ কাব্য করে বারংবার ‘অশনায়াপিপাস’ (ক্ষুধা-তৃষ্ণা) বিষয়ে বলে যে, এ দুটিই মানুষের প্রবল শত্রু। উৎপাদন ব্যবস্থা অনুন্নত ছিল; ফলে জনসাধারণের অধিকাংশের পক্ষে খাবারে টান পড়ত; কাজেই ক্ষুধা ছিল একটি তীব্র বাস্তব এবং অনেকেই ক্ষুধাপীড়িত হয়ে মৃত্যুমুখে পড়ত। খাদ্যশস্যের অপ্রাচুর্য প্রতিফলিত হয়েছে ‘শৈব উপনিষদে’ যেখানে একপাল ক্ষুধিত কুকুর যজ্ঞ করে খাদ্যলাভ করার তথা ক্ষুধানিবারণের কল্পনাকে বিদ্রুপ(?) করছে। (ছান্দোগ্য উপনিষৎ ১:১২)

এক বার মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে বারংবার মরণ যন্ত্রণার অভিজ্ঞতার আতঙ্ক জয় করা যায় না। ‘মৃত্যুর পর মানুষ পুনমৃত্যুর অধীন হয়ে থাকে, তার কৃতকর্মসকলই তাকে গ্রাস করে।’ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১:৮:৬) ‘মানুষ এ পৃথিবী ত্যাগ করবার পর আবার জন্মলাভ করে; সেটি তার তৃতীয় মৃত্যু; প্রথমটা শারীরিক, দ্বিতীয়টি উপনয়নে (পুনর্জন্ম), এবং তৃতীয়টি মরণোত্তর পুনর্জন্ম;’ (ঐ ২:৫:১) ‘হে প্রাজ্ঞ, তাঁকে চিত্ত ও হৃদয় দিয়ে জানো, যাতে তোমাকে পুনর্বার মৃত্যুর অধীন না হতে হয়।’ (ঐ ১:৬৩) শতপথ ব্রাহ্মণ বারংবার জন্মের কথা বলে (৩:১:২:২১), কঠ উপনিষৎ বলে পুনঃপুনঃ মৃত্যুর কথা (১:২:৬, ২:৩৪; ২:২:৭)। যারা ‘মৃত্যুর পর কিছুই নেই’ বলে, এ পৌনঃপুনিক মৃত্যু তাদেরই জন্যে। পুনর্জন্ম মনুষ্যাকৃতিতে হতে পারে, আবার মনুষ্যেতর আকৃতিতেও হতে পারে। কঠ বলে, ‘মানুষ শস্যের মতো মরে, আবার শস্যেরই মতা পুনর্জাত হয়।’ (১:১:৬) ‘ব্রহ্মকে না জেনে যারা মরে, তাদের পুনর্জন্ম অনিবার্য।’ (কঠ ২:৩:৪) ‘পরজন্মে মানুষের প্রতিষ্ঠা কী রকম হবে তা নির্ধারিত হয় এ জন্মের কৃতকার্য দিয়ে’। (ঐ ৩:৩:২) একটি দীর্ঘায়ত উপমা আছে ডুমুর, পিপুল আর আমগাছ দিয়ে, ‘এরা বৃদ্ধ, শীর্ণ হলেও কেমন পরে আবার পুনর্জীবিত হয়।’ (ঐ ১:২:৯); উদ্দেশ্য, এ কথা বলা যে, মানুষের ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটে। আর একটি উপমা: ‘জোঁক যেমন একটা পাতার প্রান্ত থেকে লাফিয়ে অন্য পাতায় যায়’– মানুষও তেমনি এক জীবন থেকে অন্য জীবনে উত্তীর্ণ হয়।

শেষের দিকের ব্রাহ্মণ ও উপনিষদগুলি ভারতবর্ষের চিন্তায় ও ইতিহাসে প্রথমবার জন্মান্তরবাদ উপস্থাপিত করার পর এল পালি জাতকসাহিত্য, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শেষার্ধে এগুলি রচিত হয়। এগুলিতে জন্মান্তরকে ধর্মপ্রত্যয়ের একটি স্থির স্তম্ভ হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এবং ইতর প্রাণীদের দেহে জন্মান্তরের সঞ্চরণের কাহিনির সঙ্গে আছে এই ধারণা যে, বুদ্ধ বিভিন্ন আকৃতি ও প্রতিষ্ঠায় জন্মান্তরিত হচ্ছেন; এবং অন্যান্য প্রাণীও তাই। জাতকে জন্মান্তর সম্বন্ধে কিছু তাত্ত্বিক চিন্তাও আছে:

প্রথম জাতক, ‘তাপন্নক’-তে আছে ধার্মিক ব্যক্তি কখনওই নরকে জন্মগ্রহণ করেন না, বরং যাতনাপূর্ণ লোকে জন্ম হওয়া থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন। ‘আদিত্ত’ জাতকে আছে, নিচু স্তরের কর্মের পরিণাম মর্তে জন্ম, মধ্যম স্তরের ফলে স্বর্গে ও উত্তম কর্মের ফলে পবিত্ৰ লোকে জন্ম হয়। (জাতক সংখ্যা ৪২৪) কঠ উপনিষৎ বলে, মানুষের বাসনা অনুসারেই তার জন্ম হয়। (৩:২:২) এমন কথা ‘সঙ্খপাল’ জাতকেও আছে, (সংখ্যা ৫২৪) সেখানে মিথিলার রাজপুত্র পিতার নাগবন্ধুকে দেখে অভিলাষ করে সে যেন নাগলোকে জন্মাতে পারে; পরের জন্মে সঙ্গপাল নাগরূপেই জন্মাল। কাশীর নিঃসন্তান ধার্মিক রানি ‘চন্দ্ৰাদেবী’ ধার্মিক পুত্র কামনা করলেন, এ দিকে স্বর্গে সক্কও একটা ভাল মতো জায়গা খুঁজছিলেন— আশি হাজার বছর তপস্যা করেছেন এমন এক বোধিসত্ত্বের জন্মের জন্যে; ইনি কাশীমহিষীর সন্তান তেমিয়কুমার নামে জন্মালেন। (৫৩৮) বারাণসীর এক ধার্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন নিঃসন্তান, তাঁর স্ত্রীর একাগ্র প্রার্থনায় স্বয়ং বুদ্ধ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ‘সোমনন্দ’ হয়ে জন্মালেন। (৫৩২) এক জন্মে বুদ্ধ দাস হয়ে জন্মেছিলেন, তিনি তাঁর সামান্য আহার পরম ভক্তি ভরে এক পচ্চেকবুদ্ধকে দান করেন ও প্রার্থনা করেন, আর যেন দাস হয়ে পরজন্মে না জন্মাতে হয়; তিনি পরজন্মে রাজা হয়েছিলেন। (৪১৫) আরও একটি জাতকে বুদ্ধ দাস হয়ে জন্মে অনেক কৃচ্ছ্রসাধন করে এই বাসনা নিয়ে মারা গেলেন যেন পরজন্মে রাজা হন; তা-ই ঘটল। (৪২১) এক পিশাচকে বুদ্ধ বলেছিলেন, তোমার অতীত পাপে এই পিশাচজন্ম। সে নিহত হলে পর বুদ্ধ তাকে পাঁচটি ধর্মমার্গ এবং পাঁচটি পাপমার্গ দেখান, সে ধর্মের পথই বেছে নিল। (৫৫) বারানসীরাজ এত মাংস খেতে পছন্দ করতেন যে, মাংস ছাড়া তাঁর খাওয়াই হত না। পাচক এক দিন মাংস জোগাড় করতে না পেরে একটি শবদেহ থেকে মাংস এনে রান্না করেন। নরমাংসের স্বাদ রাজার শরীরে এক শিহরণ জাগাল, কারণ তিনি পূর্বজন্মে যক্ষ ছিলেন। (৫৩৬) পূর্বজন্মের স্বভাব ও কৃতকর্মের ফল পরজন্মে সংক্রমিত হয়। কাশীর এক মহিষী নিজের রূপ সম্বন্ধে এত দম্ভ পোষণ করতেন যে, পরজন্মে মলকীট হয়ে জন্মান। (২০৭) সম্পূর্ণ প্রত্যয়যোগ্য নয় এমন একটি জাতকে বুদ্ধ চোর হয়ে জন্মান। তিনি চুরি করে ধরা পড়েও দণ্ড থেকে মুক্ত হন, কারণ গণিকাশ্রেষ্ঠা শ্যামা তাঁর প্রেমে পড়ে ও অত্যন্ত নিষ্ঠুর অমানবিক উপায়ে তাঁকে মুক্ত করে। (৩১৮)

জাতকের এই সব পুনর্জন্মের উপাখ্যানগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখি ব্রাহ্মণ্য ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে বৌদ্ধ বিশ্বাসে জন্মান্তর সম্বন্ধে কোনও মতপার্থক্য নেই। শুধু জাতকে বিশেষ জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, পূর্বজন্মের চরিত্র, অভ্যাস, সংস্কার ও বাসনা পরজন্মে সংক্রমিত হয়। সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ব্যক্তি ছাড়া সকলেরই পুনর্জন্ম নিশ্চিত, মানুষ অংশত তার পরবর্তী জন্মের অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার বাসনা ও যোগ্যতা দিয়ে। এ সবের দ্বারাই নিরূপিত হয় মানুষ, দেবতা বা জন্তু— তার কোন জন্ম হবে।

জাতকগুলি দুটি মহাকাব্যের রচনার সমকালীন, তাই এগুলির মধ্যে নিয়তিবাদের অঙ্কুর দেখা যায়; সে অঙ্কুর হল জন্মান্তরবাদ। মহাভারতের একটি অংশে জন্মান্তরের সূচনা আছে, তাতে মানুষের কৃতকর্ম ও জন্মান্তর সম্পর্কে কিছু সাংকেতিক আভাস নিহিত আছে। ‘মানুষ মরে, আবার জন্মলাভ করে, পরিণতি ও বার্ধক্যে পৌঁছয়, প্রার্থনা করে, প্রার্থিত হয়, শোক করে ও শোচিত হয়। সুখ, দুঃখ, সত্তা, সত্তাহীনতা, লাভ ও ক্ষতি, মৃত্যু এবং জীবন— এ সব কিছুকেই মানুষ পর্যায়ক্রমে স্পর্শ করে; তাই বীরচিত্ত আনন্দে উচ্ছ্বসিত বা শোকে অভিভূত হয় না।’ (মহাভারত ৫:৩৬:৪৪-৪৫) এই ধরনের যুক্তিকেই জাতিভেদের সমর্থন করা হয়েছে; শূদ্র যখন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যকে যথোপযুক্ত ভাবে সেবা করে এবং এঁরা (ত্রিবর্ণ) প্রসন্ন হন, তখন দেহান্তে শূদ্রের যন্ত্রণার অবসান ঘটে ও সে স্বর্গসুখ ভোগ করে।’ (ঐ ৫:৪০২৬) ‘আত্মা বিভিন্ন দেহে জন্মান্তরিত হতে হতে এক দিন ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মায়’। (ঐ ১৩:২৮:৫)

বৌদ্ধগ্রন্থ মধ্যমকসূত্রে একটি উপাখ্যান আছে। এক খাজনা আদায়কারী অসাধু জীবনযাপন করত, মৃত্যুর মুখোমুখি এসে সে বুদ্ধশিষ্য সারিপুত্তকে ডেকে পাঠাল এবং মিনতি করে জানতে চাইল পরজন্মে ব্রাহ্মণ হতে গেলে তাকে কী করতে হবে। সারিপুত্ত বললেন উপযুক্ত মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, সেই ভাবে সে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাল। (৮-১) এ ধরনের গল্পে পরজন্মে জীবনের স্থান ও মান নির্ণয় কর্মের ভূমিকা হাস্যকর হয়ে ওঠে; শেষ দিকে পুরাণগুলি অবশ্য অনেক জায়গায় এই কাহিনিকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে এ সব গল্পে একটা ব্যাপার প্রতিপন্ন হয়: পরজন্ম নিরূপিত হয় কর্মের দ্বারা, তা সে সারা জীবনের কর্মই হোক বা আকস্মিক চিত্তপরিবর্তনই হোক কিংবা বিশেষ কোনও একটি পুণ্যকর্মই হোক।

মৃত্যুর ঠিক পূর্বক্ষণে মনের কী অবস্থা থাকে তার ওপরে অনেক কিছুই নির্ভর করে। বৈষ্ণবরাও মনে করেন মৃত্যুক্ষণে স্বর্গ কামনা করলে মানুষ স্বর্গে যায় ও পরজন্মে ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মায়। (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতি খণ্ড ২৬:৩০) আপাত ভাবে মনে হয়, জন্মান্তরের ব্যাপারে মানুষই স্বয়ং তার ভাগ্যবিধাতা। ওবেয়সেকরে কিন্তু বলেন, আদর্শ জন্মান্তরবাদের পারত্রিকতায় নৈতিকতার কোনও স্থান নেই। নৈতিক ভাবে মন্দ আচরণ ধর্মীয় ভাবে মন্দ আচরণ নয়, নৈতিক ভাবে ভাল আচরণও ধর্মীয় ভাবে সদাচরণ নয়… নৈতিকায়ন মানে নৈতিক ক্রিয়াকলাপের ধর্মীয় মূল্যায়ন, নৈতিক ভাল ও মন্দ আচরণ তা হলে ধর্মীয় ভাবেও ভাল বা মন্দ আচরণ হয়ে যায়, অর্থাৎ পাপ ও পুণ্যের বোধ জন্মানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে। …(পিথাগোরস ও অর্কিকরা) উভয়েই জন্মান্তরপরম্পরার মধ্যে দিয়ে চিত্তশুদ্ধিতে বিশ্বাসী ছিলেন।’ (ও ফ্লাহার্টি সম্পাদিত, ১৯৮৩, পৃ. ১৪৬, ১৪৭, ১৫১) পিথাগোরীয়রা ছাড়া অর্ফিক উপাসনাধারায় বিশ্বাসীরাও পুনর্জন্মকে খুব গুরুত্ব দিতেন। ‘অর্ফিক মতের লক্ষ্য জন্ম থেকে আত্যন্তিক নিষ্ক্রমণ ও ইলিসিয়াম বা স্বর্গীয় জ্যোতিতে উত্তরণ।’ (ক্যামবেল, ১৯৬৮, পৃ. ২৬৬) এ কিন্তু মানবাকারে বা ঊনমানবাকারে পৃথিবীতে জন্মপরিগ্রহ করা নয়। তবু অর্ফিক মতবাদ জন্মান্তরকে স্বীকার করত। এমনই এক বার মাত্র পুনর্জন্মের একটা ধারণা ছিল ‘আত্তিস’-এর দেবকাহিনিতে: ক্রুদ্ধা জননী কুবেলের তাগাদায় পুত্র আত্তিস নিজেই নিজের ক্লৈব্য সম্পাদন করেন; পরে মা’র তীব্র শোক ও বিলাপে মৃত্যু থেকে আবার জীবনে ফিরে আসেন। (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ষষ্ঠ খণ্ড, ‘রিবার্থ’) অর্ফিক ধর্মমত জন্মান্তরে বিশ্বাস করত, যদিও কেবলমাত্র ধর্মের সূত্র হিসেবেই; কিন্তু পণ্ডিতেরা মনে করেন যে পিথাগোরস যে জন্মান্তরবাদ প্রবর্তন করেন তা অফিকদের থেকেই সংগৃহীত। অফিকরা কর্মানুযায়ী পুনর্জন্মে বিশ্বাস করত; অর্ফিক পুরোহিতরা ব্যাখ্যা করে বলেন যে, ‘এ জন্মের শাস্তি পূর্বজন্মের পাপের ফল।’ (পোলার্ড ১৯৬৫, পৃ. ১০০)

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে প্লেটো লেখেন, ‘যেহেতু আত্মা অমর এবং বহুবার জন্ম পরিগ্রহ করেছে, পৃথিবী ও নরকের সব কিছুই সে দেখেছে, সব কিছুই সে জেনে গেছে।’ (মেনো, ৮১সিডি; ৫০এ, বি) অন্যত্র তিনি বলেন, ‘নিয়তির বিধান হল দিব্য বিধান’, যার দ্বারা মানুষ জন্মান্তরপরম্পরার মধ্যে দিয়ে জীব-বিশ্বকে সৃষ্টি করে; মানুষ কিন্তু নিজের ইচ্ছা ও কর্ম দ্বারা প্রতি পরবর্তী জন্মকে নিয়ন্ত্রিত করে।’ (টিমাএউস ৪১ই) জন্মান্তরের গ্রিক প্রতিশব্দ হল মেটেনসোমাটোসিস (আক্ষরিক অর্থ, এক দেহ থেকে দেহান্তরে যাওয়া; ইংরেজি মেটেনসাইকোসিস ও প্যালিনজেনেসিস, ‘আক্ষরিক অর্থ, পুনর্বার শুরু করা’)। পিথাগোরস শুধু যে জন্মান্তরে বিশ্বাস করতেন তাই নয়, জাতিস্মরত্বেও বিশ্বাস করতেন। হেরাক্লেইডেস পন্টিকুস বলেন যে, পিথাগোরস বলেছেন, তিনি এক বার হার্মিসের ছেলে আএথালিডেস নামে জন্ম নেন এবং হার্মিসের কাছে জাতিস্মরত্বের বর পান। মেনেলাওস তাঁকে আহত করেছিলেন তা তাঁর মনে ছিল, এবং পিথাগোরস-জন্মেও তাঁর মনে ছিল, ব্রাঙখিডনে এপোলোর মন্দিরের কোনখানে মেনেলাওস তাঁর বর্ম রেখেছিলেন। পরে এক জন্মে তিনি ছিলেন হেমোটিমুস এবং তার পরে ডেলসে জেলে পিরুস হয়েও জন্মান

বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে আমরা বহু চরিত্রের দেখা পাই যাঁরা দাবি করেন যে পূর্ব পূর্ব-জন্মের কথা তাঁদের মনে আছে। এঁদের শীর্ষস্থানে বুদ্ধ, জাতকের প্রায় পাঁচশোটি গল্প তাঁর পূণর্জন্মকে ঘিরে রচিত; এতেই তাঁর জাতিস্মরত্ব নিশ্চিত ভাবেই প্রমাণিত হয়। আসলে জনমানসে ভেসে বেড়ানো বহুতর উপাখ্যানকে গেঁথে রাখবার একটি সূত্র পাওয়া গেল, বুদ্ধ সেই সূত্র। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, জন্মান্তরবাদকে দৃঢ় ভাবে লোকচিত্তে প্রতিষ্ঠিত করা। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে, বিশেষত পুরাণে, বহু বিক্ষিপ্ত উপাখ্যানেরও প্রতিপাদ্য জন্মান্তরবাদকে অভ্রান্ত প্রমাণ করা; এদের মধ্যে বুদ্ধ, দেবতাদের অবতার ও অন্য মানুষেরও জন্মান্তরের কাহিনি আছে।

জন্মান্তরের প্রসঙ্গে ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন বলে, ‘এই বিশ্বাস সারা পৃথিবীতেই কোনও না কোনও আকারে, গোষ্ঠীগুলোতে ও নিরক্ষর জনসমাজে চলিত ছিল। …হয়তো মানুষের সংস্কৃতির স্বরূপের থেকেই এই বিশ্বাস উদ্ভুত হয়েছিল। আফ্রিকার জুলুরা বিশ্বাস করেন, মানুষের আত্মা নানা জন্তুর দেহে বারেবারে আবির্ভূত হয়… শেষ পর্যন্ত একটা সময়ে সে মানবদেহে প্রবেশ করে; সেখান থেকেও তার আরও এক বার পুনর্জন্ম হয়। শেষ পর্যন্ত মানবিক অভিজ্ঞতার তুঙ্গে পৌঁছে আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়, যার থেকে সে উদ্ভুত হয়েছিল.. অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ধর্মবিশ্বাস অনুসারে, মৃত পূর্বপুরুষ অনির্দিষ্টকাল মৃত্যুলোকে পরিভ্রমণের পর মাতৃগর্ভে মানবশিশুর ভ্রুণ হয়ে আবির্ভূত হয়।’ (দ্বাদশ খণ্ড)

জন্মান্তরে আত্মা যে রূপ পরিগ্রহ করে তার সম্বন্ধে ব্রুস লঙ বলেন, ‘(জীবমাত্রই) সচরাচর প্রকৃতিতে মনুষ্যাকৃতি, উদ্ভিজ্জ বা জ্যোতিষ্কও হয়’। (ম্যাকমিলান, ‘রিবার্থ’ পৃ. ২৬৫) বিশেল উল্যা বলেন, ‘(সংসার) বা জন্মান্তর নামক বৃহৎ অস্পষ্ট অতিকায় আত্মা যে-কলেবরে পুনর্ভূত হয় তা পশুরূপী; তা দিব্যাকৃতি অথবা মনুষ্যাকৃতি হয় তাদের কর্ম অনুসারে। ব্রাহ্মণ ধারণার বা প্রক্রিয়ার ক্রান্তিবিন্দুতে আছে যজ্ঞক্রিয়া (যার ফল অনিবার্য, যা যজ্ঞক্রিয়া যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হওয়ার ওপরে নির্ভর করে) ও একটি নির্দিষ্ট নিয়মানুবর্তিতা, যার উৎস পুনর্জন্ম ও জীবনের উৎসে। এরও মূল নিহিত আছে জাতিভেদবাদে।’ (১৯৭৮, পৃ. ৩৮) কারণ, পুণ্য বা পাপ কর্ম দিয়েই নিরূপিত হয় পরজন্মে উচ্চ বা নীচ বর্ণে জন্ম। পরবর্তী কালের ভারতীয় ধর্মচিন্তা সম্বন্ধেও এ কথা প্রযোজ্য; এর সঙ্গে কর্মের অবিচ্ছেদ্য যোগ। কিন্তু প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগের পূর্বে এমন একটা সময় ছিল যখন জন্মান্তর স্বতন্ত্র ভাবে অর্থাৎ কর্মনিরপেক্ষ ভাবে বিদ্যমান ছিল। আত্মা কতকাল ধরে দেহ থেকে দেহান্তরে বিচরণ করে সে সম্বন্ধে এম্পিডক্লেস (৫৮২-৫০৭ খ্রিস্ট পূর্ব) মনে করতেন যে, পাপীরা ত্রিশ হাজার বছর নানা রূপে জন্ম নেয় এবং চারটি প্রাকৃতিক উপাদানের (ক্ষিত্যপতেজোমরূৎ) দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রভাবিত হয়। দীর্ঘ এক শুদ্ধীকরণের কাল যাপন করে অবশেষে এই দুঃখময় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পায়।

নারদপুরাণ বলে, আত্মা এক কোটি বৎসর পরিক্রমার পরে মনুষ্যজন্ম লাভ করে। (২:৬:৩৬) মৃত্যুযন্ত্রণার বিশদ বর্ণনাও এতে আছে; আবার গর্ভবাসযন্ত্রণা, পুনর্জন্মের যন্ত্রণা এবং মরণোত্তর যন্ত্রণারও বিবরণ আছে। জৈন ভগবতীসূত্র বলে, ‘চুরাশি হাজার মহাকল্প লাগে পুরো সাতটি জন্ম, সাতটি দল, সাত সচেতন জন্ম, সাতবার জন্মান্তরনিবৃত্তি, পাঁচ লক্ষ কম্ম, ষাট হাজার ছশো তিন ভাগ কম্মের জন্যে। তার পর মুক্তিলাভ করে, পরিত্রাণ পেয়ে, নির্বাণে পৌঁছে মানুষেরা দুঃখের অবসান ঘটিয়েছে, ঘটাচ্ছে বা ঘটাবে।’ লক্ষ করা যায়, মোক্ষকে এমন সুদীর্ঘকালের ব্যবধানে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে সেটা প্রায় দুরধিগম্য হয়ে ওঠে; আসল উদ্দেশ্য অবশ্য এ চেষ্টার দুরূহতা বোঝানো।

আচারাঙ্গ চয়নিকা (কমলচাঁদ সোমানি সম্পাদিত) হল কয়েকটি আচারাঙ্গসূত্রের সমাহার। তার মধ্যে কয়েকটি বলে, যখন কর্মটি (যার ফলোদগম হয়েছে) ধরা যাচ্ছে না, তখন মানুষ এ-দিক ও-দিক বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরে, এবং বহু আকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যন্ত্রণা পায়… বাসনাযুক্ত মানুষ, ভোগে লিপ্ত মানুষ (মাতৃ) গর্ভে আবার প্রবেশ করে (অর্থাৎ পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হয়)… মানুষকে তার কৃতকর্মের ফল পেতেই হয়।’ (সূত্রসংখ্যা ৬, ১০৮, ১৭০)

বৌদ্ধ অঙ্গুত্তরনিকায় গ্রন্থে যখন নানা রকম ভয় দেখিয়ে অহিংসা সম্পর্কে উপদেশ দেওয়া হয়েছে সেখানে একটা নৈতিক যৌক্তিকতাও দেওয়া হয়েছে: ‘প্রাণ যে নেয় সে এমন বস্তু নেয় যা (তাকে) দেওয়া হয়নি।’ (৮১) যজ্ঞে পশুবধ ধিকৃত হল। কিন্তু যুক্তি ও নীতি ছাড়াও হিংসার কুফল পরজন্মে মানুষ পায়। ‘গৃহপিতা, এ সেই অপরাধবোধের আতঙ্ক যা হত্যকারী এই দৃশ্যমান অবস্থাতেই নিজের হিংসার প্রতিফলরূপে পায়।’ (২:৯২) এই অহিংসাবাদের উত্থান ও বিকাশের আর্থসামাজিক যে হেতুগুলি বিদ্যমান ছিল, বিশেষত খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতক থেকে, তা পরবর্তী যুগে অহিংসার অনুকূলে যুক্তি ও ভীতিপ্রদর্শনের অবতারণা করে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয় পরবর্তী কোনও জন্মে নিজেদেরই হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা। এই সময়ে জন্মান্তরবাদ ক্রমশ বৃদ্ধি ও প্রসার লাভ করেছিল বলে কর্মকে জন্মান্তরের হেতু হিসাবে নির্দেশ করা সহজ হল।

জন্মান্তরবাদ প্রবর্তিত হল কেন? একটা সহজ কারণ হল, মানুষের জীবনপ্রীতি; মৃত্যুর ওপারে জীবনকে বিস্তারিত করে দেখার বাসনা এবং সে কারণেই যুক্তিগত ভাবে জন্মের পূর্বেও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, জন্মান্তরে বিশ্বাস করলে এক জীবনে যত অভিজ্ঞতা হওয়া সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞতালাভের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তৃতীয়ত, এ বিশ্বাস অনুসারে মানুষের এ জীবনের ভুলত্রুটি জন্মান্তরে সংশোধনের একটা অবকাশ পাওয়া যেতে পারে। চতুর্থত, এ বিশ্বাসে চূড়ান্ত অন্তিমতা বা আত্যন্তিকতার আতঙ্ক মন থেকে অন্তর্হিত হয়, যে-আতঙ্ক মানুষকে সর্বদেশে সর্বকালে তাড়া করে ফিরছে। কিন্তু এ-ও সত্য যে কেবলমাত্র জন্মান্তরবাদ মানুষের আধ্যাত্মিক বা ব্যবহারিক উন্নতির আশ্বাস বহন করে না। একমাত্র উন্নতির আকাঙ্ক্ষাই উন্নতির নিশ্চয়তা আনে, এবং তার পথেও নানা বাধা— আধিদৈবিক এবং জন্মান্তরীণ— যা মানুষের আয়ত্তের বাইরে। সর্বোপরি জন্মান্তরবাদ এক গভীর অর্থে মৃত্যুকে নিরাকৃত করে। হাজিমে নাকামুরা বলেন, জন্মান্তরবাদে ‘আত্মা মরে না, কিন্তু দেহ থেকে দেহান্তরে সংক্রমিত হয়— এতে ধর্মাচরণের একটা মস্ত প্রেরণা পাওয়া যায়, কারণ মৃত্যুভয় এখানে পরাস্ত।’ (১৯৪৬, পৃ. ৯০) ব্রাহ্মণসাহিত্য বলেছে, মরণোত্তর আত্মার অবস্থিতি দু’ ধরনের হতে পারে: একটি চন্দ্রের মধ্যে দিয়ে পুনর্জন্মে, পিতৃযান; অন্যটি সূর্যের মধ্য দিয়ে মোক্ষ, দেবযান (সিজারের ডি বেল্লো গাল্লিকো ৬:১৪-তে এই ধরনের কথা পাওয়া যায়)। বহু প্রকার জীবনধারার মধ্যে দিয়ে আত্মা পরিক্রমা করে, তার বিস্তৃত যে সব বিবরণ পাওয়া যায় সেগুলির একটিই উদ্দেশ্য: অন্তিমে মুক্তি। যে সব ধর্মতত্ত্ব, যেমন ‘এড্ডা’র জার্মানিক বা গলিক, যেগুলিতে পুনর্জন্মবাদ একটি ধর্মীয় তত্ত্ব হিসেবে উপস্থাপিত নয়, সেগুলি এই মুক্তিকে স্বর্গে নিয়ে যায়। প্রাচীন ভারতীয় ঋগ্বেদের ধর্মতত্ত্বও ঠিক তেমনই।… এই অবস্থার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় এলিউসিসে। এ সব গূঢ় ধর্মাচরণের ধার্মিকতা সম্বন্ধে অত্যুক্তি করতে না চাইলেও ছোট হোক বড় হোক, দৈব অভিপ্রায় অনুসারে পুনর্জন্মের যে তত্ত্ব তার শক্তি ভক্তদের ওপরে এই প্রভাব সৃষ্টি করে: তারা বিশ্বাস করে যে সমাধির ওপারে দিব্য এক অবস্থায় তারা উত্তীর্ণ (হবে)। খাঁটি ভক্ত মুক্তির স্বাদ পায়; সে ভাবে যে, পুণ্যাত্মা ও সাধুদের নিয়েই জীবন।’ (ডিকশন্নোয়ার দ্য স্পিরিট্যুয়ালিটে ১৯৬৭, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৩৭২) পরলোকে স্বর্গ, এলেউসিস, বিহিশ‍ যা-ই হোক, মানুষের প্রত্যাশা থাকে যে, সেখানে অবিমিশ্র ও নিরবধি সুখ পাওয়া যাবে। মোক্ষ বা নির্বাণে এ-অর্থে ‘সুখ’ নেই, পরমাত্মায় বিলীন হওয়া বা নিঃশেষ হওয়া আছে। কিন্তু এ দুয়েরই প্রাক-শর্ত হল জন্মান্তরপরম্পরা।

পরিশেষে প্রশ্ন থাকে, জন্মান্তর হয় কার, আত্মার? এক জীবন থেকে অন্য জীবনে সে কি নিয়ে যায়? হার্মান বলেন, ‘যার জন্মান্তর হয়, তা হল ব্যক্তিলগ্ন কিছু কিছু রুচি ও স্বভাব, যেগুলি নিরাত্ম, কিন্তু কোনও কোনও অর্থে ব্যক্তিনিষ্ঠ… এমন কোনও কৃৎকৌশল, যান্ত্রিকতা বা মাধ্যম প্রয়োজন, যার দ্বারা ব্যক্তিসত্তা, স্বাতন্ত্র্য বা আত্মসত্তা এক জীবন থেকে অন্য জীবনে উত্তীর্ণ হয়। অন্যথায় কর্মবাদের ক্রিয়ার পশ্চাতে কোনও যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না, যার দ্বারা কর্মবাদ ক্রিয়াশীল থাকতে পারে।’ (ও’ফ্লাহার্টি সম্পাদিত, ১৯৮৩, পৃ. ১৭১, ১৯০)

জন্মান্তর নামক ধর্মবিশ্বাসটি কর্মবাদের পূর্ববর্তী এবং কিছুকাল স্বতন্ত্র ভাবেই ছিল। কোনও কোনও ধর্মবিশ্বাস কর্মবাদ-নিরপেক্ষ ভাবেই বর্তমান থাকে। ভারতবর্ষেও আজীবিকরা জন্মান্তরে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু কর্মবাদ মানতেন না; আরও কয়েকটি ছোট ছোট প্রস্থান জন্মান্তরের ওপরে কর্মের কোনও প্রভাব স্বীকার করতেন না। তাই কর্মবাদ জন্মান্তরবাদের অপরিহার্য পরিণাম নয়, যদিও জন্মান্তরবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দু-শতাব্দীর মধ্যেই কর্মবাদের সঙ্গে কার্যকারণ সূত্রে জড়িয়ে গেল এবং গত দুই সহস্রাব্দ ধরে এ ভাবেই থেকে গেছে। ব্রুস লঙ বলেন, ‘একবার যখন মহাবিশ্বের জীবনসত্তা বহু বিচিত্র রূপের প্রাণীদের নিয়ে গতিশীল হয়ে উঠল, তখন থেকে চক্রাকারে ঘূর্ণমান হয়ে জন্ম থেকে জন্মান্তরে চলতে লাগল, তা সে স্রষ্টার বা নিয়তির প্রভাবেই হোক, কিংবা মানুষের কর্মের ফলেই হোক।’ (ও’ফ্লাহার্টি সম্পাদিত, পৃ. ৮০)

জন্মান্তরের ছকটিতে দেবতাদেরও অন্তর্ভুক্ত করার ফলে জন্মান্তরের অমোঘতা প্রতিপন্ন হল। মনে হতে পারত, দেবতারা এ নিয়মের বাইরে থাকবেন, যেমন অধিকাংশ দেবকল্পেই তাঁরা থাকেন; সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদে তাঁরা যে ভাবে ছিলেন। দেবতাদেরও জন্মান্তরের বিধানের বশীভূত করা শুরু হল জাতক থেকে, যেখানে বুদ্ধ বারেবারে বিভিন্ন জন্ম পরিগ্রহণ করেন। পরে দুটি মহাকাব্যের প্রক্ষিপ্ত অংশে দেবতারাও জন্মান্তরের অধীন হলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে তখন হল ‘অবতারবাদ’; তাঁরা ভিন্ন রূপে মর্তে অবতীর্ণ হন। ‘এই যে দেবতারা যাঁরা অবতার রূপে জন্মান্তরিত হন, যদি না জন্মান্তরবাদের নিয়ম তাঁদের ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য হয়, তবে মানুষের ক্ষেত্রে যেমন, তাঁদের ক্ষেত্রে তেমনই সব কিছু ঘটবে: তাই তাঁদের আত্মা থাকবে, কোনও অর্থে বাসনাপ্রসূত কর্মেও তাঁরা পূর্ণ থাকবেন যেমন ক্লিশ্যমান মানবাত্মার মুক্তিসাধনের বাসনা। …এতে অবশ্যই প্রতীয়মান হয় যে, যে দেবতা অবতীর্ণ হচ্ছেন তিনি নিখুঁত নন, কারণ তাঁর বাসনার লেশ তখনও আছে, যে-বাসনা মনুষ্যরূপে পৃথিবীর কোথাও পূরণ করা যায়। …বহু ঐতিহাসিক যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখিয়েছেন…. কর্মবিধানকে ভারতীয়রা অব্যতিক্রমী, অদৃশ্য এক বিধি বলে মনে করেন, যার আধিপত্য বস্তুগত পরমাণুর ওপরেও সক্রিয় এবং বস্তু ও ঘটনাকে যা ঘটায় তেমনই নৈতিক কোনও বিধিতে।’ (ও’ফ্লাহাটি সম্পাদিত পৃ. ২১০, ২৩৭) অর্বাচীন পুরাণ ও উপপুরাণগুলিতে দেবতাদের মর্তে অবতরণ ক্রমেই খুব সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখানো হয়েছে, এতে জন্মান্তরবাদ যেন এমনই এক দৃঢ় জমিতে প্রতিষ্ঠা পেল যাতে মানুষের জন্মান্তর স্বতঃসিদ্ধ ও অবধারিত বলে প্রমাণিত হল, এ যেন এক অতি স্বাভাবিক অমোঘ মহাবিশ্বগত বিধান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *