পরলোক, মোক্ষ ও নিয়তি

পরলোক, মোক্ষ ও নিয়তি

ব্রাহ্মণ্যধর্মে মরণোত্তর অবস্থার বহু বিকল্প আছে: আত্মা সাময়িক ভাবে স্বর্গ বা নরকে যেতে পারে এবং পরে নিজের পাপপুণ্যের পরিমাণ অনুসারে, অর্থাৎ কর্ম দিয়ে সে যত কালের জন্যে স্বর্গ বা নরকবাস অর্জন করেছে সেই অনুসারে, স্থান পরিবর্তন করতে পারে। তার মোক্ষ বা নির্বাণ হতে পারে; সে মনুষ্যেতর জাতিতে বা জড় পদার্থ হয়েও জন্মাতে পারে। বিদেহী আত্মা হয়ে সে ঊর্ধ্ব বা অধঃস্থানে ঘুরে বেরিয়ে প্রবণতা অনুযায়ী মানুষের ভাল বা মন্দ করতে পারে। জ্যোতিষ্কদেহী হয়েও ইতস্তত ভ্রমণ করতে পারে। এ তত্ত্বটি অর্বাচীন খ্রিস্টীয় বা অন্য ধর্মমতেও স্বীকৃত। স্পষ্টই বোঝা যায়, এতগুলি মরণোত্তর অবস্থা পরস্পর নিরপেক্ষ, কিন্তু পরম্পরাক্রমে কিংবা উত্তরোত্তর জন্মে হওয়া সম্ভব।

ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈনশাস্ত্রে মরণোত্তর যে অবস্থাটি সবচেয়ে সাধারণ ও সচরাচর ঘটে থাকে তা হল পুনর্জন্ম। প্রাচীন মানুষের মরণোত্তর অবস্থা সম্বন্ধে কী ধারণা ছিল তা প্রথম জানা গেল প্রত্নখননে সমাধির মধ্যে পাওয়া মৃতের ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখে, বিশেষত ধনীর— দাস, স্ত্রী, বিলাসদ্রব্য, শয্যা, রথ, শকট, শকটবাহী পশু ও খাদ্যবস্ত্র, এই সব। এ থেকে সন্দেহাতীত যে ধারণা ক’টি জন্মাল তা হল: (১) মৃত্যুর পরে আত্মার কোনও না কোনও রূপে অস্তিত্ব, (২) তার ভোগ্যবস্তুর ভোগ করবার ক্ষমতা এবং এ সবের অভাবে ক্লেশের সম্ভাবনা, (৩) তার জীবিত আত্মীয়দের মনে একটা ভয় ও কর্তব্যবোধ থাকায় এগুলি সংগ্রহ করে তারা মৃতের সঙ্গে সমাহিত করে। স্পষ্টতই দীর্ঘকাল ধরে স্বর্গে বা নরকে থাকা বা মোক্ষলাভের সম্ভাবনা এদের মনে স্থান পায়নি, তাই বহুকাল ধরে সমাধিতে ওই ভোগ্যবস্তুর সমারোহ চলে এসেছিল।

জৈনরা শ্রাদ্ধ করেন না, কারণ তাঁদের মতে মৃত ব্যক্তির তৎক্ষণাৎ পুনর্জন্ম হয়। মহাভারত-এও শুনি, ‘মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মধ্যে কোনও কালগত ব্যবধান নেই।’(৩:১৮১:২৩, ২৪) ধর্মসূত্রকার আপস্তম্ব ও গৌতম বলেন মৃত্যুর কিছুকাল পরেই পুনর্জন্ম ঘটে। (আপস্তম্ব ২:১:২:২; গৌতম ২:২৯,৩০) শংকরাচার্যের সমকালীন দার্শনিক মণ্ডনমিশ্র তাঁর ব্রহ্মসিদ্ধান্ত-এ বলেন, ‘যাঁরা ব্রহ্মলোকে যান তাঁরা পুনর্জন্ম হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। জোরাষ্ট্রীয়বাদ সম্বন্ধে হুইটরো বলেন, ‘ধর্মতত্ত্বের ইতিহাসে এই অন্তিম বিষয়গুলিই প্রথমে পরলোকতত্ত্বে সুশৃঙ্খল ভাবে বিন্যস্ত হয় এবং জুডিয়, খ্রিস্টীয় এবং ইসলাম ধর্ম এর দ্বারা প্রবল ভাবে প্রভাবিত হয়।’ (১৯৮৮, পৃ. ৩৪) গ্রন্থকার সেমিটিক ধর্মগুলিও জোরাষ্ট্রেয়ার মতের কথাই বলছেন, তবু প্রাচীন সুমের, মিশর ও চিনেও পরলোকতত্ত্ব বেশ আগেই পরিলক্ষিত হয়। ভারতবর্ষে প্রথম নগরায়ণের সময়কার অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার কালের পরলোকতত্ত্বগত বিশ্বাস সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারা যায় না। কিন্তু দ্বিতীয় নগরায়ণের যুগে এই ধরনের চিন্তা বেশ একটা বুদ্ধিগ্রাহ্য রূপ পরিগ্রহ করেছে, যদিও মাঝে মাঝে পরস্পরবিরোধী মতের সমাহারে ও সহাবস্থানে তাদের চেহারা ঝাপসা হয়ে এসেছে।

মিশেল উল্যা বস্তু সম্বন্ধে নির্দিষ্ট দুটি দৃষ্টির কথা বলেন, ‘যে দুটি চিরকালই এক অন্তরালের দু’পাশে বিচ্ছিন্ন থাকে, যেখানে চেতন আত্মা ও পূর্বতন সত্তাটিকে গ্রাস করে এবং পরবর্তীটিতে তখনও প্রবেশ করেনি, কেবল তার বিশুদ্ধ অবিভক্ত সত্তায় বিরাজ করে।’ (১৯৭৯, পৃ. ৩০৮) ম্যান্ডিয়ানদের সম্পর্কে শুনি ‘সাধুদের আত্মা পৃথিবীতেই বাস করে, যেন প্রবাসে। ততক্ষণ এখানে মন্দ আত্মার রাজত্ব, বন্দি অবস্থায় অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে যাদের সম্পর্ক- অন্য মানুষের দেবতা, অন্য বিশ্বাসের লোকদের সঙ্গে। …মৃত্যুর মুহূর্তে এক দিব্য পুরুষ দেহ থেকে আত্মাকে অপরের দিকে স্বর্গরাজ্যে নিয়ে যান, জ্যোতি ও মহাজীবনের রাজ্যে।’ (এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিক্স, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৮৭) প্রাচীন মেক্সিকোবাসীর বিশ্বাস ছিল, প্রত্যেকেই শুধু যুদ্ধে মৃত সৈনিক ও সন্তানজন্মে মৃতা নারী এরা ছাড়া সকলেই (নরকে যায়)। মানুষের ভাগ্য সমর্পিত আছে সর্বশক্তিমান ‘টোনালপোহুয়াল্লি’র (রাশিচক্রের গোলকের) কাছে, লোকান্তরে তার জন্ম কোনও নৈতিক বিচার অনুসারে হয় না। তার কর্তব্য দেবতাদের জন্যে যুদ্ধ করে প্রাণ দেওয়া এবং এই ভাবে বিশ্ববিধানকে অক্ষুণ্ণ রাখা।’ (ব্রিটানিকা ম্যাক্রোপিডিয়া ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৫১) এখানে পরলোকতত্ত্ব অনেকটাই নিয়তিনির্ভর। ‘রাশিচক্র হল কালের দ্যোতক যা মানুষের ভাগ্য নির্ণয় করে, যুদ্ধে সে দেবতাদের জন্য প্রাণ দিয়েছে কিনা সেই বিচারে। পরজন্মে কুশলে থাকার একটিই হল মানদণ্ড। কিন্তু যেহেতু কালের দেবতা কী ভাবে লোকটি জীবন অতিবাহিত করেছে তা দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন না, কিন্তু কী ভাবে সে মরেছে শুধু তাই দিয়েই নেন, তার ফলে (সিদ্ধান্তটি) অল্পবিস্তর নৈতিকতা-নিরপেক্ষ ও নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়ে। সেন্ট অগাস্টিনের লেখায় পরলোকে মানুষের কুশলে থাকার প্রসঙ্গ আছে। ঈশ্বরের প্রেমে সব মানুষের মিলিত হওয়া সত্ত্বেও অগাস্টিনের স্বর্গ সাম্যবিধির স্বর্গ নয়; গুণানুসারে উচ্চ-নীচ ভেদ সেখানে আছে; যদিও সেখানে গৌরব ও মহিমা কী ভাবে বিভিন্ন মাত্রায় প্রদত্ত হবে অগাস্টিন স্পষ্ট ভাবে তা দেখতে পাননি।… আলোকজান্দ্রিয়ার প্লেটো ইডেনের ঈশ্বরকে প্লেটোর ঈশ্বরের মতো আধ্যাত্মিকরূপে চিত্রিত করতেই বেশি পছন্দ করতেন।… প্রথম শতকের গ্লস্টিকরা… (এ ব্যাপারে) অবাধ কল্পনার আশ্রয় নিতেন।’ (গীস, ১৯৭১, পৃ. ১০৫) যেখানে জ্ঞানের ফাঁক আছে মানুষ সেখানেই স্বপ্ন বোনে। মরণোত্তর জীবন তেমনই এক ফাঁক, কাজেই যত রকমের কল্পনাশ্রয়ী চিত্র দিয়ে বিভিন্ন রচয়িতা সেই ফাঁকটি ভরাবার চেষ্টা করেছেন।

চিনে ‘প্রচলিত মূল্যবোধ সমর্থন পেত দেবতাদের কাছ থেকে প্রকাশিত তথ্যে, আর মরণোত্তর শোধনশালার কল্পনায়, সেখানে আত্মার একটি অংশ যায় কর্মফলের শুভাশুভ পরিণতির নিয়ম অনুসারে পাপ অনুসারে শাস্তি পেতে। ওই শোধনাগারে দশটি মহল আছে, প্রত্যেকটিতেই একজন বিচারক আছেন। অপরাধ অনুযায়ী শাস্তির বিধান দেওয়ার জন্যে। এই শোধনালয়ে থাকাটার কাল সংক্ষেপিত হতে পারে (অন্য) কারও পুণ্যের অনুদানে, বৌদ্ধ বা তাও’বাদী ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, অর্থব্যয়ে। পাপ ক্ষয় হতে হতে আত্মা দশম মহলে পৌঁছয়, যেখানে সে কী রূপ পরিগ্রহ করে থাকবে তা নির্ণীত হয়।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮২) চিনে ‘দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে বিশ্বাস করা হত যে, ‘তা’ই পাহাড়ের মধ্যে ভূগর্ভস্থ একটি রাজ্য আছে, যেখানে বিচারকরা মৃতদের বিচার করে ভাগ্য নির্ণয় করেন।’ (ঐ ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৬৭) ‘১৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটি শিলালেখে লাওৎসু-কে স্রষ্টা দেবতা বলে বর্ণনা করা হয়েছে, গৌরবে যিনি সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রদের সমান। সমকালীন একটি গ্রন্থ তাঁর ভক্তদের আশ্বাস দেয়, ‘মানবজাতির পরিত্রাণের জন্যে তিনি বারবার অবতীর্ণ হয়েছেন।’ (ঐ পৃ. ২৬৮) এখানে পুনর্জন্ম তত্ত্বটি তত্ত্বগত ভাবে অবতারবাদে পৌঁছে পূর্ণতা লাভ করেছে, এ শুধু দেবতাদের ওপরে পুনর্জন্মবাদ আরোপ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। দেবতাদের ক্ষেত্রে এটি মানবহিতৈষার একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, ‘মানুষ পরিত্রাণ পাক’ এই বোধে পরহিতে শুভেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে দেবতারা অবতীর্ণ হন। যেমন চিনে তেমনই ভারতবর্ষে। মহাযান বৌদ্ধধর্মের এই তত্ত্বটি ভারতবর্ষ থেকে চিনে যায়। কর্মের দিকে থেকে সঞ্চিত কর্মক্ষয় করার প্রয়োজনে অথবা অন্য কর্ম অর্জন করার জন্য নির্বাণযোগ্য আত্মা নবজন্ম পরিগ্রহ করে থাকে। অন্য ভাষায় বললে, কর্ম অনুসারে মানুষের যত বার জন্মানো প্রয়োজন, তত বারই পুনর্জন্ম হয়। ‘যদিও পুনর্জন্মকে… দেখতে হবে অনেক বড় প্রেক্ষাপটে, (তবু) এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, ধর্মশাস্ত্রকারদের কাছে এটি ছিল কর্মের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল।’ (ও’ফ্লাহাটি (সম্পাদিত) ১৯৮৩; পৃ. ৭৮)

মেক্সিকোবাসী বিশ্বাস করত যে, যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত সৈন্য ও প্রসবকালে মৃত নারী ছাড়া সকলেই কঙ্কাল-মুখোশ পরা মৃত্যুদেবতা ‘মিকটলান’-এর কাছে যায়। সেখানে চার বছর ঘুরে বেড়ায় যতক্ষণ না নবম নরকে পৌঁছয়, সেখানে গিয়ে তারা একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়। (মৃতদের জন্যে উপহার) মৃত্যুর আশি দিন পর পর্যন্ত (দেওয়া) চলে, তার পর বৎসরান্তে; দুই তিন (বা) চার বছর পরে জীবিত ও মৃতদের মধ্যে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু যে বিজয়ীরা সূর্যের পরিচারকদের নিয়ে স্বর্গে পৌঁছেছে তারা চার বছর পরে কূজনশীল পাখি হয়ে মর্তে আসে… রাত্রে চতুষ্পথের মোড়ে দিব্য রমণীরা এসে পথিকদের পক্ষাঘাতগ্রস্থ করে তোলে। এখানে ধর্মতত্ত্বের দিকে থেকে ভারতীয় বোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে প্রচুর পার্থক্য। ভারতীয় শাস্ত্র বলে, সূর্যের মধ্যে দিয়ে আত্মার যে যাত্রা তা দেবযান, মোক্ষেই সে পৌঁছয়; চন্দ্রের মধ্যে দিয়ে যে গতি তা পিতৃযান, এর অন্তে পুনর্জন্ম। তা ছাড়া কূজনশীল বিহঙ্গরূপে জন্মানোর মতো কবিত্ব আমাদের পরলোকতত্ত্বে কোথাও নেই, কারণ আমাদের মনোভাব এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুগম্ভীর; এবং নেহাৎ সাদামাটা তার গঠন।’পূর্ব এশিয়া জুড়ে এক প্রলয়োত্তর আনন্দলোকের কল্পনা গড়ে উঠেছিল যার কাঠামোতে এত বিরোধ ছিল না, বিশ্বজনীন পরিপূর্ণ সত্তার পরিপন্থী কোনও ব্যক্তিত্বের সন্ধান সেখানে পাই না।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া, পৃ. ৫২২) বাবিলনে ‘যদি কেউ পুত্রহীন হয়, শ্রাদ্ধ ও মরণোত্তর দানসামগ্রী দেওয়ার মতো কেউ (পুত্র) না থাকে তা হলে সে ভিক্ষুকের মতো থাকে; কিন্তু অনেক পুত্র থাকলে সে কতকটা স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকতে পারে। আর যে তরুণরা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে তারা এবং ছোট শিশুরা মোটের ওপর ভালই থাকে।’ (ঐ পৃ. ৪৬২) এখানে পুত্র সন্তানের ওপরে ঝোঁকটা খুব নজরে পড়ে, পুত্রবত্তার ওপরে পারলৌকিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করে। এমন একটা ঝোঁক ভারতবর্ষে সর্বব্যাপী। কন্যা থেকে পিতার কোনও পারলৌকিক বা আধ্যাত্মিক লাভ হয় না, পুত্ৰই সর্বেসর্বা। ‘পুৎ’ নামক নরক থেকে ত্রাণ করে বলেই নাকি সে পুত্ৰ।

‘বিপুল অজ্ঞাতে’র জগতে, মরণোত্তর লোকে আত্মার ভবিষ্যৎ নিয়ে যত জল্পনা রচিত হয়েছে, তার রূপ এসেছে সমাজে চলিত দর্শন, সমাজতত্ত্ব এবং সামাজিক নীতিবোধ থেকে। এগুলি সরাসরি বা গৌণ ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে পারলৌকিক জীবনের ছকে। পুত্রের দ্বারা সম্পত্তি পরম্পরাগত ভাবে বংশে সুরক্ষিত হত, কাজেই মৃত পিতার সুখ বিধানের ব্যাপারে তারই প্রাধান্য। যে সমাজ গোষ্ঠীযুদ্ধে সর্বদা লিপ্ত, যেখানে গোষ্ঠীর মঙ্গলই সর্বোচ্চ প্রাধান্য পেত, সেখানে যুদ্ধে মৃত অর্থাৎ গোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য মৃত সৈনিকের এবং প্রসবকালে মৃত মাতা— অর্থাৎ সন্ততি বিস্তারের মাধ্যম যে নারী, তার প্রাধান্য বেশ বোঝা যায়। সন্ততি যে সযত্নে লালিত একটি সম্পত্তি, সে কথা মনে রাখলে এ বোধ আরও সহজগম্য হয়। প্রসবকালে মৃত মাতাও গোষ্ঠীর উর্বরতার প্রতীক, যে উর্বরা গোষ্ঠীর সন্ততির পরম্পরা রক্ষা করে। মেক্সিকোর ধর্মবিশ্বাসে চার বছর পরে জীবিতের সঙ্গে মৃতের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়, এই বিশ্বাসটির অর্থ হল, মৃতের উত্তরাধিকারীরা শ্রাদ্ধ ও মৃতের উদ্দেশ্যে দানের দায়িত্ব থেকে তখন মুক্তি পায়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটা সময়ের পরে মৃতের সম্বন্ধে আর কোনও দায় থাকে না, গোষ্ঠীজীবন পূর্বখাতে আবার প্রবাহিত হতে থাকে।

ভারতবর্ষে একটি মত আছে যে, মৃত্যুর সময়ে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রাকৃতিক উপাদানে বিলীন হয়: বাক্‌শক্তি যায় অগ্নিতে, চোখ দুটি সূর্যে, মন আকাশে, কর্ণ, শ্রুতি দিকগুলিতে এবং পরিশেষে নিঃশ্বাস বায়ু বাতাসে মিশে যায়।’ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১০:৩:৩:৮) ‘বরুণের পুত্র ভৃগু মৃতদের দেশে গিয়েছিলেন।’ (ঐ ১১:৬:১:১) তা হলে মৃতদের দেশ বলে কিছু ছিল। উপনিষদ পর্যন্ত সাহিত্যে স্বর্গ-নরক স্পষ্ট বিভাজন ছিল না, এবং বাস করার মেয়াদও পরিষ্কার করে কোথাও বলা হয়নি, যাতে মনে হতে পারে যে, পরলোকে আত্মার অনির্দিষ্ট কাল ধরে থাকে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে প্রথম মৃত্যুর পরে স্বর্গলোকে উত্তরণের কথা শুনি। (৪:৪:৩:৪, আরও স্পষ্ট করে আছে ১:৫:১৭ এবং কৌষীতকি উপনিষদে ২:১৫) এই সব শাস্ত্রাংশের মধ্যে যেখানে মানুষের শক্তি এবং ইন্দ্রিয়গুলি প্রকৃতির নানা অংশে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা আছে তাতে যেন মরণোত্তর কোনও ‘লোক’-কে অস্বীকারই করা হচ্ছে; বিশেষ ওইখানে মনেরও বিলীন হওয়ার কথা আছে এবং মনহীন আত্মা কল্পনা করা কঠিন। পরবর্তী কালের কিছু সাহিত্যও এ মতের সমর্থন আছে। ভৃগুর মৃতলোকে অবতরণের মতো কথা হোমার ও ভার্জিলেও আছে। রামায়ণে কিন্তু লঙ্কাকাণ্ডে মৃতদের আত্মারাই জীবিতদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। এই যে স্থির অথচ অনির্দিষ্ট একটি মরণোত্তর লোক, এ হল ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে যমসম্পর্কিত সূত্রগুচ্ছের উত্তরাধিকার, যেখানে মৃতদের সঁপে দেওয়া হচ্ছে মৃতদের অধিপতি যমের হাতে এবং মিনতি করা হচ্ছে, তিনি যেন এদের খাদ্য, আশ্রয় ও সঙ্গ দিয়ে সুখে রাখেন। পরলোক যেন ইহলোকের একটি প্রলম্বিত রূপ। দশম মণ্ডলের ওই সূত্রগুচ্ছেও গণমানসে প্রোথিত কিছু বিশ্বাস ও আচারের প্রতিফলনই পাওয়া যায়।

‘যে নিয়তির সঙ্গে মানুষের ‘পরলোক’-এ দেখা হবে, তার সম্বন্ধে ধারণা খুব স্পষ্ট নয়।’ (রোঢ় ১৯৪৬, পৃ. ১১৩) বস্তুত, উপনিষদের শেষাংশের আগে পরলোক সম্বন্ধে ধারণা খুবই অস্পষ্ট ছিল। এবং পুরাণগুলির একাগ্র ও বহুমুখী প্রয়াস সত্ত্বেও— যেখানে ধারণাগুলি নানা ভাবে রূপায়িত হয়েছে— এ সব ভাবনা পরস্পরবিরোধী এবং ক্রমে ক্রমে বিরক্তিকর ভাবে ভাসা-ভাসা হয়ে উঠছিল। বেশ অর্বাচীন বৃহন্নারদীয়পুরাণ-এ স্পষ্ট বলা আছে, ‘যমই পাপ-পুণ্যের চূড়ান্ত বিচার কর্তা এবং পরলোকে আত্মার যথোচিত স্থান তিনিই নিরূপণ করে দেন।’ পুরো গরুড়পুরাণ-এর বিষয়বস্তু হল মৃত্যু, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধ। এ ছাড়াও কিছু কিছু অন্য অনুষ্ঠানের কথা আছে (বার্ষিক শ্রাদ্ধ ইত্যাদি) যাতে পরলোকগত আত্মা সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। মৃত্যুর মুহূর্ত থেকে পদে পদে আত্মাটির কী গতি হবে তারও আনুপুঙ্খিক বিবরণ আছে, আত্মার অগ্রগতির পথে অসংখ্য বাধাবিপত্তি, এ সব পেরিয়ে সে যমের সম্মুখীন হবে এবং শেষ পর্যন্ত নরকে যাবে। নরকে নবাগতের আগমন এবং যমদূতের নামে নানা তাড়না ও যন্ত্রণার বর্ণনা আছে। জীবনে সে যে যে পাপ কাজ করেছে তারই ফল সে ভোগ করে। নরকযন্ত্রণার সুদীর্ঘ বর্ণনা আছে। জীবনে পালনীয় বিধিনিষেধের একটি তালিকা, যথার্থ পুত্র এবং শ্রাদ্ধাধিকারীই যে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, সে কথাও বলা আছে। তার পর আছে সহমরণের গুণকীর্তন এবং ‘সতী’র মহিমা বর্ণনা। এর পরে একটি অংশে অন্ত্যেষ্টি ও শ্রাদ্ধ সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরের একটি অংশ আছে। এ সবের একটি বৃহৎ অংশ শ্রাদ্ধ ও প্রায়শ্চিত্তে ব্রাহ্মণকে ‘দেয়’ দানসামগ্রীর মূল্য ও পরিমাণ। এই দানে শুধু যে দাতার পুণ্য বাড়ে তা-ই নয়— মৃতের আত্মার সদগতি হয়। পুরোহিতকুলের অর্থগৃধুতা ক্রমে বাড়ছিল, এখানে তার প্রমাণ মেলে।

শাস্ত্রে এটা স্পষ্ট যে, পরলোকে আত্মার গতি এবং অবস্থা অনেকটাই নির্ভর করে তার জীবিত আত্মীয়রা মৃত্যুর পরে তার পারলৌকিক সদগতির জন্য কী কী করে; তার নিজের পুণ্যকর্ম এবং তার আত্মীয়দের দেওয়া দান— এর দ্বারাই তার পারলৌকিক অবস্থান নিরূপিত হয়। এর পরে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বৃদ্ধি, ধীরে ধীরে মানবশিশুরূপে তার পরিণতি, পরে আবার নরকের বর্ণনা এবং নরকে যাওয়ার পথগুলির বিবরণ। তার পরে আবার আত্মার সদগতির উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণকে দানের মাহাত্ম্য, যথাযথ ভাবে অনুষ্ঠিত শ্রাদ্ধের গুণকীর্তন এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পাঁচটি সম্ভাব্য ত্রুটির স্বীকৃতি। এর পরে বিক্ষিপ্ত ভাবে নানা ছোটখাটো অনুষ্ঠান এবং খুচরো নানা দানের পুণ্য ঘোষণা, এরই সঙ্গে শ্রাদ্ধে বৃষোৎসর্গের মাহাত্ম্যও বলা আছে।

ব্রহ্মপুরাণ-এর সুদীর্ঘ একটি অংশে মৃত্যুর পরের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। (২:৪০:১০-৫০) আত্মা বিভিন্ন লোকে কল্পকাল পর্যন্ত বাস করে— আকাশ, গন্ধর্বলোক, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র এবং দেবলোক, ইন্দ্রলোক ও প্রজাপতিলোক। উল্টোদিকে আত্মার গতি হল পিতৃলোক থেকে পৃথিবীতে; তার পরে হরি, বরাহ, নরসিংহ, বিষ্ণু, নারায়ণলোক, অনিরুদ্ধের নগরীগুলিতে এবং শেষ প্রদ্যুম্নলোকে। স্পষ্টতই এ বিবরণ নারায়ণীয় সাত্বত সম্প্রদায়ের ব্যূহবাদের সঙ্গে জড়িত। কৃষ্ণ-র দুই বংশধর এখানে স্বতন্ত্র লোকের অধিষ্ঠাতা হিসেবে দেখা দিচ্ছেন। নারদপুরাণ-এ মৃত্যুর পর থেকে আত্মার গতি, নানা বিঘ্নসংকুল পথে এবং অবশেষে তার পরিণতি ভ্রূণত্বে, মাতৃজঠরে যাপিত মাসগুলির যন্ত্রণা, যার অবসান ঘটে জন্মে অর্থাৎ পুনর্জন্মে। (২:৪:২-৭)

কেউ শাস্ত্র নির্ধারিত কর্তব্যগুলি সম্পাদন করতে পারলে মৃত্যুর পরে একশতবার পুনর্জাত হয়ে প্রথমে বিরিঞ্চি হয়, পরে রুদ্রলোকে যায়। বিষ্ণুর ভাগবতলোক বর্ণনার অতীত। (ভাগবত পৃ. ৪:২৪:২৯) মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পরে পূর্বদেহ ত্যাগ করে নিজের কর্ম অনুসারে দ্বিতীয় দেহে প্রবেশ করে। বহু বিঘোষিত চরণটি হল, ‘ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি’ (দেবীভাগবত পৃ. ৩:১২:৬২), অর্থাৎ আত্মার পুণ্যার্জিত স্বর্গবাস শেষ হয় তার অর্জিত পুণ্য ক্ষয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এবং তখনই সে মর্তে পুনর্জাত হয়। সাধু ভাবে জীবনযাপন করলে মানুষ পরজন্মে উচ্চতর বর্ণে জন্মায়। ‘সচ্চরিত্র শূদ্র বৈশ্যত্ব পায়, সাধু বৈশ্য ক্ষত্রিয়ত্ব এবং সাধু ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণত্ব পায়। যে ব্রাহ্মণ শান্ত এবং বাসনামুক্ত সে কৈবল্য লাভ করে।’ (ওই ৪:১:১৮,১৯) এক ধাপ পেরিয়ে যেমন উন্নতির সম্ভাবনা নেই, তেমনই পরবর্তী উচ্চতর বর্ণে জন্মাবার প্রলোভনটি মানুষের সামনে সতত উপস্থিত। ধৈর্য, সাধুতা ও উচ্চবর্ণের নিরলস সেবায় তা মেলে।

আর একটি জায়গায় পড়ি, সত্য যুগে মানুষ পুণ্যকর্ম করে স্বর্গে যায়; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র পুণ্যকর্মের দ্বারা অব্যবহিত উচ্চতর বংশে জন্মায়। সত্য, করুণা, দান, নিজের স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততা, সর্বজীবে অহিংসা, সর্বজীবে সমদৃষ্টি— এই সব নীতি অনুসরণ করলে ধোপার মতো নীচ জাতীয়রাও স্বর্গে যায়। ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিতে দুষ্কর্মকারী নরকে যায় এবং এক কল্পকাল নরকেই থাকে। তার পর তাদের পুনর্জন্ম হয়, পৃথিবীতে মনুষ্যরূপে। কলির শেষে যখন নতুন কৃতযুগ আসে, তখন পুণ্যবানরা স্বর্গ থেকে নেমে পৃথিবীতে মনুষ্য জন্ম পরিগ্রহ করে। দ্বাপরের শেষে কলির সূচনায় নরকের পাপীরা পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্মায়। (ঐ ৬:১১:১৯-২৬)

একটি অদ্ভুত পুনর্জন্মের উপাখ্যানে আছে: বশিষ্ঠ রেগে গিয়ে নিজের ছেলে নিমিকে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার অভিশাপ দেন। নিমির অনুরোধে পুরোহিতরা কৃত্রিম ভাবে নিমিকে জীবিত রেখে এক যজ্ঞ করেন। যুজ্ঞে খুশি হয়ে দেবতারা নিমিকে বর দেন। নিমি বলে, ‘আমি সর্বজীবের নেত্রে জীবিত থাকতে চাই।’ দেবতারা নিমিকে পরামর্শ দেন পার্বতীর আরাধনা করতে। পার্বতীর বরে নিমি ‘নিমিষ’ হয়ে সর্বজীবের (নেত্রে) জীবিত আছে। (৬:৫:২০)

মানুষের মরণোত্তর অবস্থা কোথাও স্পষ্ট, দ্বিধাহীন ও অপ্রতিহত ভাবে উচ্চারিত হয়নি। বিস্ময় ও কৌতুকের ব্যাপার হল, বহু পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব একত্রে গেঁথে বৃহৎ ধর্ম-সাহিত্যে ইতস্তত ছড়িয়ে রাখা হয়েছে, এদের প্রত্যেকটিই উচ্চারিত হয়েছে শেষ কথা হিসেবে এবং অপ্রতিরোধ্যরূপে। ‘সারাজীবনের পুণ্যের ফলে স্বর্গলাভ হয়’, আবার অন্যত্র, ‘কেউ কোনও দেবতার মন্দির নির্মাণ করলেই স্বর্গে যায় এবং মন্দিরে যত সংখ্যক ধূলিকণা আছে তত বছর স্বর্গে বাস করে।’ (দেবীভাগবত পৃ. ৯:২৯:৫২) ‘অতিথি বা ক্ষুধার্তকে লোকে যা দান করে পরলোকে তা-ই সে ভোগ করে, যা দান করেনি এমন কোনও কিছুই সে ভোগ করতে পায় না। স্বর্গবাসের আশীর্বাদ ভোগ করবার পরে মানুষ ভারতবর্ষে জন্মায় এবং ক্রমে ক্রমে উচ্চতর বিপ্রবর্ণে জন্মায়।’ (ঐ ৯:২৯:৬৫,৬৬) একটি বারংবার উচ্চারিত তত্ত্ব হল মানুষকে তার সমস্ত কর্মেরই ফল ভোগ করতে হয়, ফলভোগ না করা পর্যন্ত কর্মের ক্ষয় হয় না অথচ, পরে দেখব যে, অসংখ্য কর্মের কথা বলা হয়েছে যা সর্ব পাপের ফল ক্ষয় করে, শুধু নিজের নয়, ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন বহু পুরুষের

এই বহুবিধ অনুত্তরিত প্রশ্নে সমাকীর্ণ বিষয়টিই ঠিক ভাবে প্রতিফলিত করে যে, শাস্ত্রকারদের অভিপ্রায় হল, মানুষ যাতে কোনও দিনই স্পষ্ট বুঝতে না পারে কোন কর্মের কী ফল, বা তার থেকে প্রাপ্য কী অভিজ্ঞতা; ফলে সমস্ত জীবনটাই সে কাটায় নিরন্তর ভয় এবং আতঙ্কে। পৃথিবীর সর্বত্রই পুরোহিতশাসিত ধর্ম সরল ব্যাখ্যাকে ভয় পায়। যে কোনও সময়ে যে কোনও কর্মকে নিয়তির ওপরে আরোপ করা যায়, এমন একটা ব্যবস্থা ধর্মের আবশ্যিক অঙ্গ। নিয়তি অমোঘ ও দুয়ে। কাজেই কর্ম ও কর্মফলের মধ্যে সমানুপাতিক সম্বন্ধ খোঁজা নিরর্থক, এমন একটা সম্বন্ধ কখনওই ওই ধর্মের অভিপ্রেত ছিল না। তাই তার বদলে আমরা পাই জটিল গঠনের একটি গোলকধাঁধা, যার থেকে নিষ্ক্রমণের পথ নেই।

মানুষের মরণোত্তর অবস্থা গভীর রহস্যে আবৃত, জন্মান্তরে কৃত পাপ ও পুণ্য কর্মেরই এই রহস্য, যার দ্বারা তার মরণোত্তর অবস্থা নির্ণীত হয় যার প্রত্যেকটি প্রকারভেদ নিয়তিকে প্রত্যাহ্বান জানায়: যদি কর্মফল অনুসারেই তার মরণোত্তর অবস্থা নির্ণীত হয় তবে নিয়তির তো কোনও অবকাশই নেই। পুণ্যের কোনও সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই; বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত বিভিন্ন যুগে পুণ্যের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়।

কিন্তু পুণ্যকর্ম যে মরণোত্তর সুখের হেতু এ কথা প্রায় সকলেই স্বীকার করে; তথাপি দুয়ে নিয়তি এই পরিচ্ছন্ন ছকটির মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে সব হিসেব গোলমাল করে দেয়। পুণ্যময় জীবনের পরে যদি কেউ নীচ অবস্থানে জন্ম নেয়, তা হলে তার ব্যাখ্যায় নিয়তিকে টেনে আনা হয়। শাস্ত্রকারদের পক্ষে সৌভাগ্যের কথা হল, কোনও লোক পূর্বজন্মে কেমন কাজ করেছিল তা কোনও মতেই জানা বা প্রমাণ করা যায় না। কাজেই হিসেব শুরু করা যায় যা প্রত্যক্ষ, বর্তমান, সুজ্ঞেয় তাই দিয়ে। তবু এই জীবনেও অজ্ঞেয়তার একটা মাত্ৰা এসে পড়ে, একে আমরা নিয়তি বলি, ভুলে যাই মরণোত্তর অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে হয় নিয়তি, নয় তারই কৃতকর্ম, যুগপৎ দুটো কোনও ব্যাখ্যা নয়।

মরণোত্তর অবস্থার নানা বিকল্পগুলি পরস্পরবিরোধী এবং তা দিয়ে কোনও পরিচ্ছন্ন গ্রহণযোগ্য ছক তৈরি হতে পারে না: আত্মা পুনর্জাত হতে পারে, স্বর্গে অথবা নরকে যেতে পারে, শোধনলোকে যেতে পারে, জ্যোতিষ্ক শরীরে বা বায়ুভূত অশরীরী প্রেত শরীরে আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াতে পারে, অথবা মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করতে পারে। প্রত্যেকটিই যুক্তিসংগত ও সম্ভাব্য, প্রত্যেকটিই কৃতকর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, অথচ এমন কোনও আনুপাতিক তালিকা নেই যাতে নির্দিষ্ট করা আছে কোন কর্মের কোন ফল। ব্যক্তির মরাণোত্তর দশা সম্বন্ধে তাই একটি অন্তনির্হিত বিরোধ শাস্ত্রে রয়ে গেছে।

যখন কোনও গোষ্ঠী বা দলের ভাগ্যের কথা ভাবি বা মনুষ্যজাতির অন্তিম ভবিষ্যতের কথা ভাবি তখন এটা আরও স্পষ্ট হয়। অগ্নিপুরাণ-এর ভবিষদ্বাণী হল, বিশ্বজাগতিক প্রলয়, যা এ সৃষ্টির অবসান ঘটাবে। (অধ্যায় ৩৬৯-৬৯, মৎস্যপুরাণেও তাই, অধ্যায় ১৬৫) যুগান্তে যে পরিবর্তন আসবে তার বিস্তৃত বিবরণ পাই কূর্মপুরাণ-এ (অধ্যায় ৪৩, ৪৪-৫০); এখানে ধাপে ধাপে প্রলয়ের বর্ণনা; প্রাণীদের মৃত্যু অবিরল এবং স্থায়ী একটি ঘটনা, একে বলা হয় ‘নিত্য বিনাশ’; সর্ব মানবের ক্ষেত্রে নৈমিত্তিক বিনাশ অথবা ‘ব্রহ্ম প্রলয়’; চতুর্যুগের অবসানে যে উদ্দাম প্রলয় লীলা তার নাম ‘প্রাকৃতিক প্রলয়’। যে মানুষের ব্রহ্ম ও আত্মার অভেদ জ্ঞান হয়েছে সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটি ‘আত্যন্তিক বিনাশ’ অর্থাৎ মোক্ষ। ‘প্রাকৃতিক প্রলয় শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টি রূপে আসে, সমুদ্রগুলি শুকিয়ে যায়, সাতটি সূর্যের উদয় হয়, পৃথিবী, স্বর্গ ও মর্ত্য হয়ে ওঠে ‘অম্বরীষ’ অর্থাৎ তর্পণ ক্রিয়ার কমণ্ডলু। ভূ’লোক ‘মহ’লোক বিলীন হয়, ‘মহ’লোক আবার ‘স্ব’লোকে মিলিয়ে যায় এবং অবশেষে সব কিছুই ‘জন’লোকে বিলীন হয়। তার পর আসে বিশ্বজাগতিক অগ্নিকাণ্ড, যার থেকে সৃষ্টি হয় দিগব্যাপী মেঘমঙ্গল; বিষ্ণু যোগনিদ্রায় যান ও পরে সন্ন্যাসী হয়ে জাগেন ও পুনরায় সৃষ্টি করেন।’ (মার্কণ্ডেয় পুরাণ অধ্যায় ৫৩, ৬৭, ৭২, ৭৪-৭৬, ৭৮, ৮০ ও ৯৪) অন্যত্র একে বর্ণনা করা হয়েছে বিভিন্ন মন্বন্তরে— স্বারোচিষ, উত্তম, তাপস, রৈবত, চাক্ষুষ, বৈবস্বত, সাবর্ণিক ও সর্বসাবর্ণ। মনু’দের লোকের ঊর্ধ্বে ‘বৈকুণ্ঠ’-লোক মহাপ্রলয়ের সময়ে ‘শিবলোকে’ মিশে গিয়ে হয় ‘গোলোক’— গাভীর ক্ষেত্র।’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. ব্রহ্মাণ্ড খণ্ড ২:২-১৪) গাভীর প্রতি এই উচ্ছ্বসিত ভক্তিপূর্ণ মনোভাব এই জন্য যে, গাভী বিষ্ণু বা শিবের চেয়ে অনেক বেশি প্রত্যক্ষ উপকারী; তা কল্পনাজগতে যত দূর সম্ভব একটি অস্পষ্ট ক্ষেত্র তৈরি করেছে; এর মহিমা কীর্তিত হয়েছে, কারণ দেবমণ্ডলীর শ্রেষ্ঠ দুই দেবতা শিব ও বিষ্ণু’র লোকের ঊর্ধে নির্ণীত হয়েছে ‘গো’লোকের স্থান, গাভী এই দুই শ্রেষ্ঠ দেবতারও ঊর্ধ্বে স্থান পেল। এ যদি মর্তের বৃন্দাবনের প্রতিকল্প না হয়ে থাকে, তা হলে এখানে ভবিষ্যতে স্থান পাওয়া মানুষের চিত্তকে আকর্ষণ করতে পারে না, ফলে গোলোক নেহাৎ অস্পষ্ট, বিমূর্ত একটি কল্পলোক।

প্রলয়ের পর অবশিষ্ট ওই দল বা গোষ্ঠীর মরণোত্তর অবস্থান বিকল্প হিসেবে অসার, কারণ মহাপ্রলয়ের পরে অবশিষ্ট জনগণের ভবিষ্যৎ নিয়েই এই কল্পনা। যুক্তির দিকে অসুবিধে হল, ঠিক এই ক’টি লোকের কর্ম পূর্বজন্মে এমনই এক রকম ছিল, যে সেই কর্মফলের জন্যে মহাপ্রলয়ে তাদের মৃত্যু অবধারিত ছিল। এটি সম্ভাবনার দিক দিয়ে একেবারে অসম্ভব না হলেও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে ওঠে। কাজেই পরলোকতত্ত্ব যুক্তির দিক দিয়ে একেবারে গ্রহণীয় বা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে না; কর্মবাদকে এ তত্ত্ব লঙ্ঘন করে, এবং নিয়তির জন্যে এটি বিরাট, প্রশস্ত অবকাশ রাখে।

দুঃখ অথবা অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা যে পাপকর্মের ফল এ কথা সর্বত্রই বলা হয়েছে। পাপের দু’রকম সংজ্ঞা: (১) যা নৈতিক ভাবে গর্হিত, এবং (২) যা ধর্মানুষ্ঠানের দৃষ্টিতে ত্রুটিযুক্ত। এই শেষেরটি আবার দু’রকম হতে পারে: (ক) করণীয় অনুষ্ঠানে ত্রুটি, ও (খ) অনুষ্ঠান না করা। (ঋগ্বেদ ১:২১, ২৩, ৮৫ অংশে নৈতিক পাপবোধের কথা আছে। বরুণ মানুষের আচরণের ওপর লক্ষ রাখেন, অপরাধীকে নিজের পাশে আবদ্ধ করেন এমন কথাতেও নৈতিক পাপবোধের প্রমাণ আছে।) সাধারণ ভাবে সব ধর্মমতই অন্য ধর্মমতকে ভ্রান্ত ও বিপথগামী মনে করে। জোরাষ্ট্রীয়মত অন্য ধর্মমতকে মন্দ বলে মনে করত, বৌদ্ধ, ইহুদি ইসলামীয় ও খ্রিস্টান মতে অন্য ধর্মমত ভ্রান্ত। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মমতেই মন্দের সংজ্ঞা হল, যা কিছু সেই ধর্মমতের বিরুদ্ধ। জোরাষ্ট্রীয় মতে মন্দশক্তি ব্যক্তিরূপায়িত একটি বিশ্বজাগতিক শক্তি, ‘অঙ্গ মৈন্যু’, পরবর্তী কালের ‘অহ্রিমান’। ‘যদিও মন্দকে ‘অহুর মাজদা’র ওপরে কোনও মতেই আরোপ করা যায় না, তবু সে এর সত্তাকে ব্যাখ্যা করতে হবে, এবং জোরাষ্টার-এর ব্যাখ্যা করলেন, স্বাধীন ইচ্ছা বলে।’ (হুইটরো, ১৯৮৮, পৃ. ৩৩) স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্বের ফলেই মানুষ মন্দকে বেছে নিতে পারে, জোরাষ্ট্রীয় মতে এ মন্দের পৃথক ও স্বতন্ত্র সত্তা আছে। কাজেই চিন্তার জগতে স্বাধীন ইচ্ছার প্রধান ক’টি ভূমিকা আছে, যা নিয়তির নেই। কিন্তু ‘অঙ্গ মৈনু’ অতিমানবিক এবং এর ভূমিকা হল মানুষকে মন্দ পথে যেতে প্রলুব্ধ করা। ‘মানিকীয়’রাও মনে করতেন পাপ স্বতন্ত্র একটি সত্তা এবং তা ঈশ্বরের সমশক্তিমান। বাইবেলের ‘পুরাতন’ ও নতুন দুই বিধানেই শয়তান একটি বাস্তব, শক্তিমান সত্তা, যদিও শেষ পর্যন্ত সে ঈশ্বরের অধীন। বৌদ্ধধর্ম ‘মার’কে এনেছে, সে-ও শক্তিমান কিন্তু সচ্চরিত্রদের প্রলুব্ধ করতেই তার সব শক্তি ব্যয় হয় এবং বুদ্ধের কাছে তার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছে; তার পরে সে চিহ্নিত হয়ে থাকে পরাজিত প্রত্যাহ্বায়করূপে।

শয়তান, অঙ্গ মৈন্যু আর মার ছাড়া পাপ বা মন্দের সত্তা বিমূর্তই। ‘পাপকে (নীতির) সীমা-লঙ্ঘন বলে ধরলে তাকে সাধারণত রূপায়িত করা হয় না।’ (রোঢ়, ১৯৪৬, পৃ. ১৪৭ ) বিমূর্ত পাপের বা মন্দের বহু নাম— পাপ, পাষ্পন, এনস, আগস, দুরিত (এর অপর অর্থ বিঘ্ন বা বিপদ, হেডন— দেবতাদের অসন্তুষ্ট করা), দুষ্কৃত, কিল্বিষ, অনৃত, ঋণ, দ্রুগ্ধ, সমল (মালিন্য), অভিশস্তি এবং ঋগ্বেদে ব্রহ্মপড়ীশ। পাপের এই যে বহু প্রতিশব্দ এর থেকে বোঝা যায়, (১) এ বোধটি পরিচিত ও প্রচলিত ছিল, এবং (২) প্রতিশব্দগুলির পরস্পরের মধ্যে সূক্ষ্ম ভেদ ছিল, অর্থাৎ এগুলির মধ্যে প্রায়োগিক ও প্রাসঙ্গিক পার্থক্য ছিল। কারও কারও মতে মন্দ একটি নঞর্থক বস্তু, ভাল’র বিপরীত। জন ফার্গুসন তাঁর ‘দি এচিভমেন্ট অব ক্লেমেন্ট অব এলেক্‌সান্ড্রিয়া’ প্রবন্ধে বলেন, মন্দ আসলে ভালর উল্টো, আরও যথাযথ ভাবে বললে, ঈশ্বরের অভাব। এর উৎপত্তি হল মানুষের স্বাধীনতায়। (রিলিজ্যস স্টাডিজ, ১২শ খণ্ড, ১ম সংখ্যা, পৃ. ৭৩) এ কথা সত্য যে, স্বাধীন ইচ্ছা না থাকলে মানুষের মন্দ কর্মের বিকল্প থাকত না; কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছা না থাকলে তার ভাল বিকল্পও থাকত না। ঈশ্বর জোর করে তাকে সোজা এবং সংকীর্ণ পথে রাখতে পারতেন, কিন্তু তার অর্থ হত জুলুম, তাতে মানুষ অন্য-চালিত যন্ত্রে পরিণত হত। ‘মন্দ যদি একেবারেই অসম্ভব হত তা হলে মোক্ষ বা মুক্তির জন্যে আগ্রহ তো আসলে সময় নষ্ট করা হয়ে যেত, একটা অর্থে মন্দ বাস্তব এবং একটা অর্থে কর্ম ও পুনর্জন্মও সত্য। অবাস্তবতায় বিশ্বাস ধরা পড়ে যায় বিশ্বাসীদের কর্ম ও উৎসাহে।’ (হার্মান, ১৯৭৬, পৃ. ২৪৭)

প্রাচীন ভারতে, ঋগ্বেদ-এ, পাপকে মনে করা হত দেবতাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। (৭:৮৬:৬; ৮৮:৬) খ্রিস্টধর্মে যেমন অমার্জনীয় বিধ্বংসী পাপের কল্পনা আছে, তেমনই ভারতবর্ষেও কতকগুলি পাপকে চূড়ান্ত অপ্রতিকার্য বলে গণ্য করা হত। শাস্ত্র থেকে শাস্ত্রে এ সব পাপের তালিকার পার্থক্য দেখা যায়। বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ প্রচলিত সাধারণ সংজ্ঞাটি পাওয়া যায়: ব্রহ্মহত্যা, সুরাপান, চৌর্য, গুরুপত্নীগমন— এগুলি মহাপাতক, এবং এগুলিতে লিপ্ত ব্যক্তির সাহচর্য হচ্ছে পঞ্চম মহাপাতক। (উত্তরভাগ ২০:২) দেবীভাগবতপুরাণ-এর সংজ্ঞায় সামান্য কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে; ব্রহ্মহত্যা, স্বর্ণচৌর্য, সুরাপান, গুরুপত্নীগমন— এগুলি মহাপাতক, পঞ্চমটি এ সব পাপীর সাহচর্য। (১১১:১৫)

হাদিথ-এর ছ’টি প্রামাণ্য অংশে প্রচলিত ইসলামীয় নীতি ও আচরণ আছে, এগুলির মধ্যে তিনটির প্রত্যেকটিতে একটি করে অধ্যায় আছে পূর্বনির্ধারণ সম্বন্ধে, যদিও কোরাণ-এ এর কোনও স্থান নেই। সম্ভবত প্রাক্-ইসলামীয় গোষ্ঠীগত বিশ্বাস ও আচরণেই উত্তরাধিকার এটি। শাস্ত্রের নির্দেশের সঙ্গে বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানে কখনওই মিল থাকে না, প্রথমটি নির্দেশ, দ্বিতীয়টি বিবরণ। একবার পূর্বনিরূপণ মেনে নিলে বহু অসংগতির আপাত ব্যাখ্যা মেলে, যেমন কর্ম ও পুনর্জন্মবাদে ঘটেছে।

মৃত আত্মার দুটি প্রধান গন্তব্যস্থল হল স্বর্গ ও নরক। সাধারণ ভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মে এ দুটির কোনওটিই চিরকালীন আবাসস্থল নয়; আত্মার মন্দ কর্ম বেশি হলে স্বল্পকাল স্বর্গবাসের পরে সে নরকে যায় এবং পুণ্য বেশি হলে এর বিপরীতটা ঘটে। কিন্তু স্বল্পকালের জন্যই হোক বা দীর্ঘকালের জন্যই হোক স্বর্গ ভক্তি বা পুণ্যকর্মের পুরস্কার, কিংবা তপস্যায় বা বরে লভ্য। কৌষীতকি ব্রাহ্মণে পড়ি এক যজ্ঞের শেষে পিতা পুত্রকে বর দিচ্ছেন, ‘তুমি স্বর্গ লাভ কর’। (২:১৫) অর্থাৎ বরের বলেও স্বর্গলাভ করা যায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এ যে সব পুণ্যকর্মে স্বর্গলাভ হয়, তার একটি তালিকা আছে। (প্রকৃতি খণ্ড ৩২ অধ্যায়; গোলকখণ্ড ৫৪ অধ্যায়) অন্যান্য পুরাণেও এ ধরনের তালিকা আছে। এই সব পুণ্যকর্মের অধিকাংশই মূলত তিনটি ভাগে বিভাজ্য: (১) দান, (২) ভক্তি, এবং (৩) দেবতা, ব্রাহ্মণ ও ঋষিদের সেবায় কৃত কর্ম; বিপরীত দিকে শোনা যায়, ‘যে কৃপণ একাকী আহার করে (অর্থাৎ অন্যের সঙ্গে ভাগ করে খায় না) সে স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হয়।’ (মহাভারত ৫:১২:২০) ‘যে বীর যুদ্ধে পিছু হটে না সে স্বর্গে যায়।’(ঐ ৭:৪৮:৩৪) মহাভারত-এ যে পুণ্যবান লোকেরা স্বর্গলাভ করেছিলেন তাঁদের একটি তালিকা আছে। (১৩:১০৫:১৭-৩০, ১৩৩) আবার এ কথাও শুনি যে, যে-মানুষ সৎ জীবনযাপন করে সে স্বর্গে যায় (ঐ ১৩:১১২, ১৩২, ১৩৩) দ্রৌপদীকে বলা হয়েছে, ‘ধর্মাচরণের নৌকাটিই মানুষকে স্বর্গে পৌঁছে দেয়, অন্য কিছুই পাবে না… মৃত আত্মার মাত্র তিনটি গতি: মানুষরূপে পুনর্জন্ম, স্বর্গবাস অথবা মনুষ্যেতর জন্ম।’ (ঐ ৩:১৭৮:৮:৯) এটি কিন্তু একেবারেই নিঃশেষ তালিকা নয়; কারণ মানুষ স্বর্গে যেমন যেতে পারে, তেমনই নরকেও যেতে পারে, মোক্ষলাভ করতে পারে, জ্যোতিষ্করূপ পরিগ্রহ করতে পারে, প্রেতযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে পারে, যক্ষ, পিশাচ, রাক্ষস, গন্ধর্বও হতে পারে আবার পুনর্জাত হতে পারে। দীর্ঘ একটি বর্ণনা আছে ভূলোক, ভূবলোক ও স্বর্গলোকের। (ব্রহ্ম পু. ১৫শ অধ্যায়)

সুখের স্থান এই স্বর্গ কিন্তু পুত্রহীনের জন্য নয়; কন্যাসন্তান থাকলে কোনও লাভই নেই, কারণ কেবলমাত্র পুত্রবানই স্বর্গলাভ করে। ‘বস্তুত স্বর্গলাভের অন্য কোনও উপায়ই নেই। (দেবীভাগবত পু. ১:৪:১৫); ‘পুত্রবানের সব পাপ ক্ষমা পায়’। এর মধ্যে অন্তর্নিহিত নিয়তিবাদের একটি তত্ত্ব, কারণ পুত্রবান হওয়া মানুষের হাতে নেই। (ঐ ১:৪:১৭) অন্যান্য কিছু কিছু অতিকথায় যে সব বীরেরা মৃত্যুর সম্ভাবনার সামনে পরাঙ্মুখ হন না, তাঁরা স্বর্গে যান। (দ্রষ্টব্য এড্ডা, ‘সগা’ওলি, ঈলিয়াড, অডিসি, কালেহ্বলা, মহাভারত, রামায়ণ ও পোপুল হুহ। ফ্লরেন্টাইন কোডেক্সও বলে যে স্বর্গ সূর্যের ধাম, এবং তা হল যুদ্ধে মৃত সৈনিকের ধাম; ৩য় ও ১৪শ খণ্ড)

জাতক জুড়ে রয়েছে পুণ্যবানদের স্বর্গলাভের কাহিনি। ‘নির্দোষ মতঙ্গ রাজার আজ্ঞায় নিহত হন, এবং তৎক্ষণাৎ ব্রহ্মার স্বর্গে জন্মান।’ (৪৭৯) ঋষি কোসিয় সক্কর কন্যাদের মধ্যে খ্যাতিকে নির্বাচন করেন এবং তার সঙ্গে ভাগ করে অমৃত পান করেন বলে স্বর্গে পুনর্জন্ম লাভ করেন। (৫৫৩) এ ধরনের নিদর্শন অসংখ্য পাওয়া যায়, কিন্তু মূল বক্তব্যটি তো সুপরিচিত, পুণ্যকাজের ফল শুভ, পাপের ফল অশুভ। প্রাচীন মিশরীয়রাও এ মতে বিশ্বাসী ছিল: ‘সাধারণ কোনও মানুষ যদি পাপ না করে ও অসিরিসের ভক্ত হয় তা হলে ব্যক্তিগত অমরতার আশা সে রাখতে পারে। অসিরিসের রাজ্যে যাওয়ার বাসনা দীনতম ব্যক্তিও পোষণ করতে পারত, কারণ প্রবেশাধিকার সাড়ম্বর সমাধিসজ্জার ওপরে নির্ভর করত না, (একে) দেখা হত পৃথিবীর অধোলোকে একটি দ্বীপমালা হিসেবে, যার অন্য নাম শরভূমি’। এই নন্দনে চিরবসন্ত অনুভূত হত, অবাধ প্রচুর ফসলের ফলন, এখনও মৃতেরা জীবলোকের সব আনন্দই পেত; দুঃখ বলে কিছু ছিল না। অসিরিসের জগৎ গঠন মূলত গণতন্ত্রী; ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সকলেই চাষের একখণ্ড জমি পেত, যেটা চাষ করছিল তাদের কর্তব্য… এলিউসিনীয় ধরনের দীক্ষা দীক্ষিতকে মৃত্যুর পরে সুখী জীবনের ভরসা দিত, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অধোলোকের দেবতাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের দ্বারা।’ (ডেডি, ১৯৮২, পৃ. ১৯৭)

গিলগামেশ-এর ভূমিকায় পাচ্ছি, ‘দিলমুন সম্বন্ধে খুব প্রাচীন একটি বিবরণ পাওয়া যায়, নিপ্পুরে শিলায় ক্ষোদিত… এতে বর্ণনা আছে পৃথিবী যখন তরুণ ছিল, সৃষ্টির কাজ যখন সবে শুরু হয়েছে, তখন দিলমুন ছিল এমন একটি স্থান যেখানে, দাঁড়কাকের কর্কশ ডাক শোনা যেত না, মৃত্যুর বিহঙ্গটি মৃত্যুডাক ডাকত না, সিংহ জীবকে গ্রাস করত না, নেকড়েবাঘ মেষ শিশুকে খণ্ড খণ্ড করত না, ঘুঘু বিলাপ করত না, সেখানে কোনও বিধবা ছিল না, রোগ, জরা ও শোক ছিল না।’ (পৃ. ৩৯) লক্ষ করি যে, দিলমুনের বর্ণনা সবটাই নঞর্থক, পৃথিবীর সব দুঃখের অনুপস্থিতি। এ যেন কীটস-এর সেই ‘শাখাপল্লবের অন্তরাল থেকে তুমি (নাইটিঙ্গেল) যা কোনও দিনই জানলে না।’ বাইবেলের পুরাতন নিয়মে স্বর্গের কোনও সদর্থক বর্ণনা নেই। বস্তুত যদিও নতুন নিয়মে সন্ত জনের কল্পান্তিক দৃষ্টিতে (প্রকাশিত বাক্য বা রেজ্বেলেশন-এ) তেমন বর্ণনা আছে, তবু এ বর্ণনা মূলত রহস্যাবৃত, মানুষের কল্পনাকে উদ্রিক্ত করবার ক্ষমতা অনুবৃত্তি ঘটছে মাত্র। ভারতীয় কল্পনায় স্বর্গ কিন্তু অত্যন্ত বেশি রকমে ভেদাশ্রয়ী; প্রত্যেক দেবতার নিজস্ব ‘লোক’ আছে কিন্তু তা-ও মানুষের আবেগ বা কল্পনাকে উদ্দীপিত করে তোলার মতো কিছু নেই; মানুষ এখানে কেবলমাত্র দেবতাদের সাযুজ্যে স্বর্গসুখ ভোগ করে। এবং সে সুখ পার্থিব ভোগেরই অবিরল অনুবৃত্তি।

গ্রিসের ‘এলিসিয়াম, যার প্রথম দেখা মেলে অডিসি’তে, তাকে বলা হয় মিনোয়ান কল্পনার উত্তরাধিকার। বীরদের মৃত্যুহীন আরামের একটি রম্যস্থান যা ওলিম্পাস নয়, হাডেসও নয়। … খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আথেন্সের সাধারণ মানুষ ইন্দ্রিয় সুখের একটি বাসনারঞ্জিত কল্পনন্দন সৃষ্টি করে যা প্লেটোর দার্শনিক স্বর্গের চেয়ে অর্ফিক কবিদের কল্পিত আত্মার স্বর্গের অনেক কাছাকাছি ছিল।… ইহুদিরা ‘নন্দন’ শব্দটি তাদের ধর্মশাস্ত্রে ব্যবহার করেননি। পারসিক ‘পারাইদ্দিজা’, হিব্রু ‘পার্দেস’ (কানন, এও পারসিক থেকে আগত), প্রথম গ্রিক প্রয়োগ ‘পারদেইসেস’। (মানুয়েল, এফ ই আর, এফ পি ১৯৭১ পৃ. ৮৭-৯২) ইহুদি নন্দন তেমন চিত্তাকর্ষক নয়, পুণ্যাত্মারা সেখানে অবিরল ‘তোরাহ’-পাঠে কালযাপন করেন, যেমন খ্রিস্টান স্বর্গবাসী নিরন্তর ঈশ্বরের স্তব করে।

চিনে মৃতদের প্রাচীন আবাসস্থল নিরূপণের কথা আছে ‘ৎসো ছুয়ান’ নামক উপাখ্যানে। (৭২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি এটি রচিত)। সেখানে মৃতদের নিলয় হল ‘পীত প্রস্রবণ, ছায়াচ্ছন্ন একটি অধোলোকের নিবাস, যা পৃথিবী থেকে বেশি নিচে নয়… (পরে) মৃতদের নিবাসলোক নির্দিষ্ট হল একটি গৃহে এবং নিজস্ব কৌমে অর্থাৎ যে পারিবারিক সমাধিতে তাঁরা সমাহিত হয়েছেন সেখানেই।’ (সাইডেল, নুমেন ২৯, ১৯৮১, পৃ. ১০৮-৯)

যদিও বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে স্বর্গ সম্বন্ধে বর্ণনায় বিস্তর পার্থক্য আছে, তবুও দুটি ব্যাপারে এগুলির মধ্যে মিল দেখা যায়, স্বর্গ সুখকর অভিজ্ঞতার স্থল এবং পুণ্যকর্ম দিয়ে তা লাভ করা যায়। যদিও প্রত্যেকটি আত্মার স্বর্গে প্রবেশাধিকার নেই (কোনও কোনও অতিকথায়, ওই জগৎ একটি আবছা বৈশিষ্ট্যবর্জিত স্থান মাত্র), তবু প্রায় সকলেই বলে, স্বর্গকে অর্জন করতে হয় পুণ্য দিয়ে। যেহেতু স্বর্গলাভযোগ্য পুণ্যকর্মের কোথাও নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি, তাই এ সম্বন্ধে নিয়তির ভূমিকার কিছু অবকাশ থেকে গেছে।

‘কপটিক শাস্ত্র ও বহু ইরাণীয় দলিলে দুঃখভোগের ধর্মতত্ত্বের একটি বিশিষ্ট ছাপ রয়ে গেছে, তুর্কী শাস্ত্রে প্রায়ই বিজয়-আনন্দের প্রকাশ দেখা যায়… এক মানিকীয় রাজার প্রয়াসে লেখকগোষ্ঠী ও মনোনীত লোকেরা পরিপূর্ণতা লাভ করে জগতের এমন একটি স্থান হিসেবে মূল্যায়ন করত যেখানে দেবতাদের বর ইতিমধ্যেই অনুভূত হয়েছে। অবশ্যই আত্যন্তিক মুক্তি কেবল পরলোকেই পাওয়া যায়, কিন্তু সে পরলোকের দীপ্তি এখনই ইহলোকে দীপ্যমান।’ (ক্লিমকাইট, নুমেন ২৯, ১৯৮২, পৃ. ২৮) মিথুবাদে ‘সল ইনভিক্টাস’ (অপরাজেয় সূর্য)-এর উপাসনাতে একটি লক্ষণ দেখা যায় যাতে তা ‘কাল এর দেবায়নে পরিণত হতে উদ্যত।’ (হালবসবের্গে, ১৯৭২, পৃ. ৪১) ‘এক অর্থে এতে পরলোকতত্ত্ব নস্যাৎ হয়ে যায়, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি; স্বর্গ ও নরক প্রাপ্তি ঘটত মানুষের মৃত্যুর পরে, তাদের কর্ম অনুসারে, মিথের প্রতি তাদের আনুগত্য অনুসারে এবং তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির মাত্রা অনুসারে… অর্ফিক মতে, অন্তিম মুক্তি স্বর্গীয় জ্যোতির্লোক ইলিসিয়ামে অপেক্ষিত ছিল’ (ঐ পৃ. ২৬১) অন্য কিছু অতিকথায়, যেমন ঋগ্বেদে ও হোমারে, আত্মাকে আনন্দলোকে অবস্থান করতে দেখা যাচ্ছে। (এরও পূর্বস্তরে ধারণা ছিল যে মৃতেরা জীবনবঞ্চিত হয়ে হাহুতাশ করছে ও অধোলোকের ছায়াবৃত তমিস্রায় বাস করছে) নরকের কল্পনা আসে পরে, সম্ভবত সমাজের এক শ্রেণি দ্বারা অন্য শ্রেণির অত্যাচারের নিদর্শন থেকে।

ভারতবর্ষে স্বর্গযোগ্য কর্মের প্রথম উল্লেখ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ‘এই যাগটি’র দ্বারা দেবতারা স্বর্গলোকে যান।’ (পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ ২:৬:২; ৩:২; ১২:২; ১৫:২,৩) ‘এই দুই শ্রেণির দেবতারাই (অর্থাৎ দেবতারা ও ব্রাহ্মণেরা) প্রীত হলে (উপাসককে) সুখস্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে প্রীত করেন।’ (শতপথ ব্রাহ্মণ ২:২:২:৬) এই সুখস্বাচ্ছন্দ্যকে স্বর্গগমন দিয়েও ব্যাখ্যা করা চলে, আবার পার্থিব সুখস্বাচ্ছন্দ্য দিয়েও এর ব্যাখ্যা হয়। ‘সে ব্যক্তি মানুষের জগৎ থেকে দেবতাদের জগতে উত্তীর্ণ হয়।’ (ঐ ১:১:১৪) ঋগ্বেদ-এর শেষ অর্থাৎ দশম মণ্ডলে হয়তো স্বর্গের মতো কিছু একটা অস্পষ্ট ভাবে আভাষিত হয়েছে, যেখানে পরলোকগতরা আনন্দে থাকে। (১০:১১৪:১০-১২ ছান্দোগ্য উপনিষৎ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে বা কিছু পরের রচনা; তাতে স্বর্গে সুরভি, মাল্য, পানভোজন, গান ও সংগীতের উল্লেখ আছে। (৭:২) স্বর্গের একটি মানচিত্র পাই, যেখানে উচ্চনীচ-ক্রমে অধিবাসীদের অবস্থান সুচিত হয়েছে। (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ৪:৩:৩৩; তৈত্তিরীয় উপনিষৎ ২:৮) ‘(পরলোকে) দাঁড়িপাল্লায় তার শুভকর্ম ওপরে ওঠে, পাপকর্ম ওঠে না।’ (শতপথ ব্রা, ১১:২:৭:৩৩) ‘মানুষ জীবনে যা কিছু ভাল করে তা তার নিঃশ্বাসে মিশে যায়, মন্দ মেশে তার শরীরে। যখন এ কথা জেনে কেউ চলে যায় এ পৃথিবী থেকে, তখন তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে তার পুণ্য যায়, তার পাপ পড়ে থাকে তার দেহের সঙ্গে।’ (জৈমিনীয় ব্রা. ১:১৫) ‘নিঃশ্বাস উঠে যায় দেবলোকে এবং দেবতাদের কাছে ঘোষণা করে— এ এতটা ভাল, এতটা মন্দ করেছে।’(ঐ ১:১৮) ‘যজমানের অনুষ্ঠিত যজ্ঞই পরলোকে দেহ হয়; এবং সত্যই যে-যজমান (এ কথা) জেনে যে-(যজ্ঞ) করে সে (পরলোকে) সম্পূর্ণ দেহ পায়।’ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১১:১:৮:৬) যজমান ‘যা দিয়ে যজ্ঞ করেছে তা তার সঙ্গে পরলোকে মিলিত হয়।’(তৈত্তিরীয় সংহিতা ৩:৩:৮:৫) মৃত্যুর পর আত্মাকে বলা হয়, ঊর্ধ্বতম লোকে পিতৃগণের সঙ্গে মিলিত হও, যমের সঙ্গে, তোমার ইষ্টাপূর্তের ভাণ্ডারের সঙ্গে। দোষত্রুটি ফেলে রেখে বাড়ি যাও; শোভন একটি দেহের সঙ্গে মিলিত হও।’(ঋগ্বেদ ১০:১৪:৮) এখানে স্বর্গ বা আত্মার গন্তব্যস্থলকে ‘বাড়ি’ বলা হয়েছে। মনে পড়ে, পরবর্তী উপনিষদে বলা আছে জীব আনন্দ থেকে জন্মায়, আনন্দে বাঁচে এবং আনন্দ পেয়ে ফিরে যায়।’’বস্তুত কেউ পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার পরে আত্মাকে জেনে বলে, ‘এই আমি’। অপর কেউ বা তার নিজের জগৎকে চিনতে পারে না। অগ্নিতে বিপর্যস্ত হয়ে, ধূমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সে তার নিজের জগৎকে চিনতে পারে না। কিন্তু যে আত্মা ‘এ-ই আমি’ বলে চেনে সে তার নিজের জগৎকে চিনতে পারে। তখন পবিত্র অগ্নি তাকে বহন করে স্বর্গে নিয়ে যায়।’ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩:১০:১১:১, ২) যে হব্য সে এখানে যজ্ঞে অর্পণ করে তাই পরলোকে তার দেহ হয়, তার দেওয়া দান তাকে ডেকে বলে, ‘এখানে এস। এই আমি তোমার দিব্য দেহ।’ (শতপথ ব্রা ১১:২:৫) ‘দেবলোকে জন্মলাভের জন্য যে যজ্ঞ, তা দেবলোকের অভিমুখে এগিয়ে যায়। তার পিছু পিছু যায় যজ্ঞে দেওয়া দক্ষিণা।’ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১০:১:৫:৪) এখানে লক্ষণীয় যে, ব্রাহ্মণ সাহিত্য থেকে যজমানই যজ্ঞের ব্যয়ভার বহন করে এবং ঋত্বিক নিযুক্ত করে বহুবিধ হব্যের দ্বারা যজ্ঞ সম্পাদন করে। শুনেই বোঝা যায়, সমাজের এক সহস্রাংশেরও কম মানুষ যজমান হতে পারত, কারণ যজ্ঞ ক্রমেই জটিল, বহু ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে উঠেছিল এবং বহু ঋত্বিকের দক্ষিণা দিয়ে নিষ্পন্ন হত। কাজেই রাজা ও সম্পন্ন রাজন্য (হয়তো পরবর্তী কালে ধনী বৈশ্য) ছাড়া অন্য কেউ এ দায়িত্ব নিতে পারত না। এবং শাস্ত্র বলছে, যজ্ঞের ফল যজ্ঞকর্তাতে বর্তায় এবং যজমানের হব্যই পরজন্মে তার দেহ হয়। তা হলে এ বিধানে শতকরা নশো নিরানব্বই জনের ভাগ্যে স্বর্গ জুটত না। স্পষ্টতই এ শাস্ত্র এবং বিধান ধনীদের প্রসন্ন করে সুখী ভবিষ্যতের অঙ্গীকার দেওয়ার জন্যই রচিত, দরিদ্র এখানে অপাঙক্তেয় ছিল। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উচ্চতর শ্রেণির বিত্তমান মানুষের জন্যই স্বর্গ; দরিদ্রের সেখানে প্রবেশ নিষেধ

এই সব শাস্ত্রেই যে সব পুণ্যকর্মে স্বর্গ বা উত্তম-লোক অর্জন করা যায় তা হল যজ্ঞ। কর্ম তখন পুরোহিতদের জন্যে প্রচুর দক্ষিণাসহ যজ্ঞানুষ্ঠান। পুণ্যকর্মের বোধ তখন আনুষ্ঠানিক ধর্মের ঊর্ধে নৈতিক বা আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের স্তরে পৌঁছয়নি। ঋত্বিক পুরোহিতদের জন্যে দক্ষিণা ব্রাহ্মণগুলিতে ক্রমবর্ধমান এবং ক্রমে ক্রমে এর গুরুত্ব বেড়েই চলেছিল।

স্বর্গে যেমন মর্তে বিত্তমানদের জীবনযাত্রার প্রাচুর্য, ভোজ, মাল্য, গন্ধ, দাসদাসী, ইত্যাদি— নরকেও তেমন নির্ধন এবং বা অপরাধীদের প্রতি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দণ্ডাদেশের প্রতিরূপ। প্রভুর দণ্ড ভৃত্যের প্রতি, মহাজনের দণ্ড ঋণীর প্রতি, শক্তিমানের অত্যাচার শক্তিহীনের প্রতি। নরক ও কর্ম সম্বন্ধে বৌদ্ধদের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে জাতকের কাহিনিগুলিতে :

‘একটি মাছ অসুস্থ ও অধার্মিক মন নিয়ে মৃত্যুর কাছে পৌঁছলে বুদ্ধ এসে তার (মন পরিবর্তনের জন্য) দেখা দেন, পাছে সে নরকে জন্মায়।’ (সংখ্যা ৩৪, ‘মচ্চ’) ‘বারাণসীরাজ চার দিক থেকে নরকের জীবের রব শুনলেন এবং প্রায়শ্চিত্ত যোগ করতে চাইলেন। বুদ্ধ রাজার কাছে ওই রবগুলি ব্যাখ্যা করে বললেন, নরকে অত্যাচারিতরা যখন তৃপ্ত কটাহ থেকে মাথা তোলে তখন ওই রকম রব শোনা যায়।’(১৪, ‘লোহকুম্ভী’) ‘এক মিথ্যুক রাজা ক্রমাগত মিথ্যা বলছিল এবং প্রত্যেক মিথ্যার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহ নরকের গভীর থেকে গভীরতর স্তরে নেমে যাচ্ছিল। (৪২২ ‘চেতিয়’) ‘কোকালিয়া তুদু ব্রহ্মার নির্দেশ লঙ্ঘন করেছিল এবং তার জন্যে তার কোনও অনুতাপ ছিল না; মৃত্যুর পরে সে নরকে গেল।’ (৪৮১, ‘তক্কারিয়া’) ‘সংকিচ্চ’র পুত্র বিপথগামী হয়ে যাওয়াতে (পরলোকগত) সংকিচ্চ তাকে দেখা দিয়ে নরকযন্ত্রণা বর্ণনা করলেন। ছেলেটি আতঙ্কে আত্মসংশোধন করেন। (৫৩০, ‘সংকিচ্চ’) ‘এক বোধিসত্ত্ব আশি বছর রাজত্ব করার পরে আট হাজার বছর নরকবাস করে। তার পরজন্মে তার বাবা যখন একটি চোরকে কঠিন দণ্ড দেওয়ার বিধান দেন তখন সে শিউরে ওঠে (এই ভয়ে, যে তার মতো তার বাবাকেও নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে)।’ (৫৩৮, ‘মুগপকখ’) ‘মিথিলার রাজা অতি দুর্বৃত্ত ছিলেন; বুদ্ধ মুনির বেশে তাকে দেখা দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নরকের বর্ণনা করেন। এতে কাজ হল, রাজার চিত্তপরিবর্তন হল এবং তিনি মন্দ পথ থেকে সরে এলেন।’ (৫৪৪, ‘মহানারদকসসপ’)

এ সব কাহিনিতে শ্রোতাদের মধ্যে নরকবর্ণনার একটা শুভফল দেখা গেছে: নরক এগুলিতে চিত্রিত হয়েছে নৈতিক বা ধর্মীয় অপরাধের দণ্ডভোগের স্থল হিসেবে। আনুষ্ঠানিক বা সামাজিক অপরাধ গুরুত্ব পায়নি, তাই মন্দকর্মের সঙ্গে নরকের একটা সরাসরি যোগ আছে। এ সব কাহিনিতে নিয়তির ভূমিকা নেই, কর্ম তার যথোপযুক্ত ফল পায় এইটেই দেখানো হয়েছে।

সংহিতাগুলির মধ্যে কনিষ্ঠতম সংকলনটি হল অথর্ব সংহিতা। এতে কোন কোন দোষে নরকে যেতে হয় তার একটি তালিকা আছে:

‘বশা গাভী (দান করলে) যমলোকে সমস্ত কামনা পূরণ হয়। প্রার্থীকে (বশা গাভী) দানে অসম্মত হলে সে (মালিককে) নরকে (নিয়ে যাবে।’ (১২:৪:৩৬) ‘যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণকে গালাগালি করে, মারে বা (ব্রাহ্মণের) রক্তপাত করে, সে যে ক’টি ধূলিকণার উপরে রক্ত পড়েছে তত বছর পিতৃলোকে যেতে পারবে না।’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ২:৬:১০:২) যারা ব্রাহ্মণের গায়ে থুথু দেয় কিংবা তার গায়ে নাসামল নিক্ষেপ করে তারা পরলোকে রক্ত নদীতে বসে চুল খাবে।’(অথর্ব সংহিতা ৫:১৯:৩) ইহলোকে মানুষ যা কিছু খায়, (পরলোকে) সেই খাদ্যই তাকে খায়।’ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১২:৯:১:১) কৌষীতকি ব্রাহ্মণে ভৃগুর বিভিন্ন নরকে সুদীর্ঘ ভ্রমণপঞ্জী বিবৃত হয়েছে। (১১:৩; এরই পুনরাবৃত্তি আছে জৈমিনীয় ব্রাহ্মণে ১:৪২-৪৪ এবং শতপথ ব্রাহ্মণে, ১১:৬:১:১৩)

এ কথা ঠিক যে সংহিতা ও ব্রাহ্মণগুলিতে সাধারণত নরক ও পরলোকতত্ত্ব সম্বন্ধে বক্তব্য খুবই অস্পষ্ট। কেমন যেন মনে হয়, এগুলিতে যে সব অভিশাপ ও শাস্তির উল্লেখ আছে তাতে সমাজে ব্রাহ্মণদের একটি শ্রেণির মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় তখনই শুরু হয়েছিল, তাই যে সামাজিক বর্গভেদ ভেঙে পড়ছিল তাকেই টিকিয়ে রাখার জন্যে এই ধরনের চেষ্টা। সে জন্যে নরকে যাওয়ার মতো অপরাধের তালিকা করা হচ্ছিল এবং ব্রাহ্মণদের প্রতি তাচ্ছিল্য সে তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরে, মহাকাব্যগুলিতে গুরু ও শাস্ত্রনির্দেশকে অগ্রাহ্য করার অপরাধেও নরকগামী হওয়ার মতো ঘৃণ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়। ক্রমে ক্রমে নরকগুলি আরও স্পষ্টরূপে চিত্রিত হতে থাকে এবং নরকযোগ্য অপরাধের মধ্যে এসে যায় বর্গ ও জাতির সীমা লঙ্ঘন এবং গুরু, রাজা ও অন্যান্য ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধাচরণ। তা হলে সামাজিক বর্গগুলির যে ক্রম ছিল তাকে লঙ্ঘন করা পাপ বলে পরিগণিত হল, তাদের ক্ষমতা ও সামাজিক উচ্চনীচ-ভেদকে অস্বীকার করা নৈতিক ও ধর্মীয় পাপ বলে ধরা হল। যারাই শাস্ত্রের বিধান স্বীকার করবে না, আনুষ্ঠানিক বিশ্বাসে যাদের স্বতন্ত্র মত প্রকাশ পাবে, তাদেরই জন্যে নির্দিষ্ট হল নরক (লক্ষণীয় নাস্তিক, বৌদ্ধ, পাষণ্ড এদেরও পরলোকে শাস্তির বিধান)। তাই ক্ষমতাপন্নদের মধ্যে ক্ষমতাবিভাজনে শাস্ত্রনির্দেশগুলির শৃঙ্খলাবদ্ধতার সঙ্গে এবং বর্ণ ও জাতির সীমা ও সংজ্ঞা অনমনীয় ভাবে সুনির্দিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধগুলি এবং আনুপাতিক দণ্ডগুলি আরও সুস্পষ্ট ভাবে, আরও দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দেশ করা সহজ হল। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন সাহিত্য, মহাকাব্য ও পুরাণগুলির যুগে; নিয়মকানুন ক্রমশই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠল। শাস্ত্রনির্দেশে স্বর্গ ও নরকে যাওয়ার মতো কর্মগুলি লক্ষ করলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সমাজে ক্ষমতায় আসীন ধনী ও উচ্চবর্গের মানুষের কায়েমি স্বার্থরক্ষা করাই পুণ্য, লঙ্ঘন করাই পাপ।

যেহেতু পাপকর্মের ফলে নরক ভোগ করতে হয় এবং পাপকর্মের সংজ্ঞা যেহেতু প্রথমে কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক থেকে বিশ্বাসগত ও ক্রমে সমাজের পদমর্যাদার সম্পর্কে মনোভাব ও আচরণ অনুসারে নির্ণীত হল, সেই কারণেই যেন অপরাধের নৈতিক গুরুত্বের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হয়ে নবতর অপরাধগুলির সঙ্গে যুক্ত হল নরকযন্ত্রণার অনুপাত, যা আসলে নেহাৎই যদৃচ্ছ বলে প্রতিপন্ন হতে লাগল। এই বারে অপরাধের সঙ্গে দণ্ডের পার্থক্য যত বাড়তে লাগল, ততই শাস্তির নীতিটা কাল্পনিক ও অবাস্তব হয়ে উঠল এবং দণ্ডবিধি কঠিনতর, জটিলতর ও অসঙ্গততর হয়ে প্রতিভাত হল।

রামায়ণ-এ নরকে যাওয়ার পথ হল, রাজহত্যা, ব্রহ্মহত্যা, গোহত্যা, চৌর্য এবং পশুহত্যা; এ ছাড়া নাস্তিক, জ্যেষ্ঠের পূর্বে যে বিবাহ করে, যে চরবৃত্তি বা বিশ্বাসঘাতকতা করে, কার্পণ্য বা মিত্রদোহিতা ও গুরুপত্নী-গমন করে সেও নরকে যায়। (৪:১৭:৩৬-৩৭) রাবণ নাকি নরকের শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করে কিন্তু ব্রহ্মার নির্দেশে তাকে স্বর্গ ছেড়ে যেতে হয়। মহাভারতে বর্ণসংকরকে খুব বড় অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। এ অপরাধে অপরাধীর পিতার শ্রদ্ধাবলি ও কার্য সব নষ্ট হয়ে যায়। (৬:২৩:৪২) যারা নির্দিষ্ট ধর্মকর্ম করে না, নাস্তিকরা, শ্রদ্ধাহীনরা, ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যক্তিরা, এদের সকলের ওপরে নেমে আসে যমযাতনা। (১৩:১০৫:১৫, ১৮:২:১৬-২৬) হরিবংশে আত্মঘাতীরা নরকে যায়। (ভবিষ্য পর্ব ১২৯:১৩) এ বিষয়ে মহাভারত-এর দৃষ্টি কিন্তু সুস্থতর। অপযশকর কাজ করলে মানুষ নরকে যায়। (৩:১৯১:২২)

পণ্ডিতেরা বলেন, মেসোপটেমিয়াই প্রথম স্বর্গের বর্ণনা করে; নরকের কল্পনার উদ্ভব ব্যাবিলনে, পরে ম্যাণ্ডীয়রা এটিকে অধিগ্রহণ করে এবং মানিকীয়রা তাদের কাছ থেকে এটি আত্মস্থ করে। উৎস যা-ই হোক, সব অতিকথায় কয়েকটি বিষয়ে মতৈক্য আছে: (১) মন্দকর্ম কর্তাকে নরকে নিয়ে যায়, এবং (২) নরক যন্ত্রণাভূমি। সেমিটিক ধর্মের সঙ্গে ভারতীয় অতিকথার পার্থক্য এই যে, এখানে স্বর্গ বা নরক কোনওটিই চিরদিনের আবাস নয়। পুণ্যবান তার সামান্য পাপ নরক বাসের দ্বারা ক্ষয় করে স্বর্গে যায়, পাপী তার সামান্য সৎকর্মের ফল স্বর্গে ভোগ করে নরকে যায়; এবং উভয়েরই পরে পুনর্জন্ম হয়। এখানকার নরক অনেকটা ক্যাথলিক শোধনলোকের মতো, এখানে পাপক্ষয় করে স্বর্গে যাওয়া যায় বা শুভ পরিবেশে পুনর্জন্ম হয়। নরক সাময়িক, এখানে যমদূতের অত্যাচার ও পীড়ন ভোগ করে পূর্বপাপ ক্ষালন করে মৃতের আত্মা ধর্মের ঋণশোধ করে ধর্মরাজ যমের কাছে।

বামন পুরাণে একটি পুরো অধ্যায় আছে, কোন কোন পাপকর্ম শোধ করতে নরকে কী কী যমযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। অনুপাতটা যদৃচ্ছা-প্রসূত, যুক্তির সঙ্গে কোনও সম্বন্ধ নেই, কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধের এটি একটি নির্ভরযোগ্য দর্পণ। পরলোকতত্ত্বের প্রামাণ্য গ্রন্থ গরুড়পুরাণ-এ নরকগুলির নাম দেওয়া আছে: তামিস্র, লোহশঙ্কু মহাভৈরব, শাম্মলী, রৌরব, কুণ্ডলী, প্রেতি, মৃত্যু, কালসূত্র, সংঘাত, লোহতাড়, সবিষ, সম্প্রযাতন, মহানরক, করাল, সংজীবন, অবীচি, অন্ধতামিস্র, কুম্ভীপাক, অসিপত্রবন ও তাপন। (১৪:২১-২৩) সাধারণ ভাবে বলা আছে, নরকের সংখ্যা মোট চুরাশি লক্ষ। (ঐ শ্লোক ২০) বামন পুরাণের তালিকায় নামগুলিতে কিছু পার্থক্য আছে: রৌরব, মহারৌরব, অন্ধতামিস্রক, কুটশাল্মলী, করপত্র, শ্বানভোজন ও সংশোধন। (১১:৫১-৫৮) অধিকাংশ পুরাণে নরকের নিজস্ব একটি তালিকা থাকে। বৃহন্নারদীয়পুরাণ-এর তালিকাটি হল: তপন, বালুকাকুম্ভ, রৌরব, মহারৌরব, কুম্ভীপাক, নিরুচ্ছ্বাস, কালসূত্র, প্রমর্দন, অসিপত্রবন, লালাভক্ষ, হিমোকট, মৃষাবস্থা, বসাকূপ— সব মিলে তেরোটি। (১৪:৩,৪) ভাগবতপুরাণ-এ এই তালিকা হল: তামিস্র, অন্ধতামিস্র, রৌরব, মহারৌরব, কুম্ভীপাক, কালসূত্র, অসিপত্রবন, সুকরমুখ, অন্ধকূপ, কৃমিভোজন, সন্দংশ, তপ্তসুমি, বজ্রকণ্টক, শাল্মলী, বৈতরণী, পূষোদ, প্রাণরোধ, বিশসন, লালাভক্ষ, সারমেয়াদান, অবীচি, অয়ঃপান। (৫:২৬:৪-৪০) ভাগবত একটি অর্বাচীন পুরাণ, এখানে তাই নানা নতুন নামের নরক উদ্ভাবিত হয়েছে। এগুলির থেকে ভারতবর্ষে আদি-মধ্যযুগে প্রচলিত দীন-দুর্বল বা অপরাধীর প্রতি প্রবলের অত্যাচারের প্রকারভেদ জানা যায়। সঙ্গে সঙ্গে অত্যাচারীর একটা আত্মপ্রসাদজনিত বর্বর হর্ষের সুরও এ সব বর্ণনায় লেগেছে। অন্যত্র বামনপুরাণের অন্য এক তালিকায় ষোলোটি নরকের নাম পাওয়া যায়, প্রত্যেকটির সঙ্গে তার কারণরূপ পাপেরও উল্লেখ আছে। (৬১:১-১৬) বামনপুরাণে নরকের যন্ত্রণা ও কষ্টের পুঙ্খানুপুঙ্খ সুদীর্ঘ রোমহর্ষক বর্ণনা আছে। (১:১৪:৩-১২৭) নরকের মৌলিক কল্পনাই হল যন্ত্রণাভোগ এবং এ যন্ত্রণা নাকি অপরাধের সমানুপাতিক, অন্তত শাস্ত্রগুলি তাই বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রথমত পাপ ও শাস্তির অনুপাতে কোনও সামঞ্জস্য নেই, দ্বিতীয়ত এই নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন শাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন মত। তা ছাড়া অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়ার যে বর্বর মনোবৃত্তি সব দেশের নরক কল্পনার পশ্চাতে সক্রিয়, তা-ও এখানে খুবই লক্ষণীয়। মার্কণ্ডেয়পুরাণ-এ পুরো দুটি অধ্যায় জুড়ে নরকের নানা বিচিত্র পীড়নের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও এ কথাই প্রমাণ করে (অধ্যায় ১২,১৫) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এও নানা নরকের বর্ণনা (অধ্যায় ২৯) এবং পাপীদের পীড়নের বর্ণনা। (অধ্যায় ৩০) ভাগবতপুরাণ পরবর্তী যুগের, যেখানে নরক যন্ত্রণার বীভৎস বর্ণনা: জ্বলন্ত মশাল দেহের চারপাশে, নিজে অথবা অন্য কেউ পাপীর দেহ থেকে মাংস কেটে দিচ্ছে এবং পাপী তা খাচ্ছে, কুকুর ও শকুনি সচেতন পাপীর অস্ত্র ও পাকস্থলী ছিঁড়ে বের করে খাচ্ছে, এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একে একে কেটে নেওয়া হচ্ছে, হাতির পায়ের নীচে তাকে পিষে ফেলা হচ্ছে। পাহাড়ের চুড়ো থেকে তাকে ঠেলে নীচে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, তার পানীয় জল শুকিয়ে যাচ্ছে, ইত্যাদি। (৩:৩০:২৫-২৮) অকস্মাৎ একটি বিস্ময়কর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন উক্তি শুনি: ‘স্বর্গ ও নরক দুই-ই এই পৃথিবীতেই, ওই সব নরক যন্ত্রণা সব এখানেই ভোগ করতে হয়।’ (ঐ ৩:৩০:২৯) এতে যেন গৌণ ভাবে বলা হচ্ছে, যে-সব বিলাস জনসাধারণকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় ক’জন সৌভাগ্যবান তারই প্রতিবিম্বন ভোগ করে স্বর্গকল্পনায়; ওই স্বর্গের লোভ দেখালে মর্তের দুঃখী মানুষ শাস্ত্র নির্দিষ্ট ভাবে ক্ষমতাবান ও বর্ণশ্রেষ্ঠের সেবা করে চিরজীবন যা শুধু লুব্ধ দৃষ্টিতে দেখেই এসেছে, তা-ই স্বর্গে ভোগ করার আশায় থাকবে। ক্ষমতাবান যে সব নব নব পীড়ন উদ্ভাবন করে দুর্বলের ওপর প্রয়োগ করত, তারই আর্তনাদ ও কাতরোক্তি যেন ভগবতের নরকের বর্ণনায় স্পষ্ট শোনা যায়। পরবর্তী যুগে রচিত বলে অনেক বেশি নিষ্ঠুর শাস্তিব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয়েছে, তারই এত সোল্লাস বর্ণনা।

বৌদ্ধ অঙ্গুত্তরনিকায় বলে ‘হে সন্ন্যাসীরা, ছ’টি বিষয়ের অনুসরণ করলে নরকে যেতে হয়; অন্যের প্রাণ নেওয়া, যা দেওয়া হয়নি তা নেওয়া, ইন্দ্রিয় ভোগে কালযাপন করা, মিথ্যা বলা, আসক্তি এবং ভ্রান্ত দৃষ্টি।’ (পালি টেক্সট সোসাইটি সংস্করণ ৭ম খণ্ড, পৃ. ৮১) ‘যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে অথবা অন্যকে করতে উৎসাহ দেয় সে নরকে যায়।’ (ঐ ১ম খণ্ড, পৃ. ১১২, ৩০৬-৭)

বৃহন্নারদীয়পুরাণ-এ নরকে যাওয়া খুব সহজ হয়ে যায়। ‘যে পাপী সদালাপের মধ্যে বাধা সৃষ্টি করে সে নরকে যায় এবং চন্দ্র-সূর্য যত দিন থাকবে তত দিন সেখানে থাকে।’ (২:৭৫) অর্বাচীন পুরাণগুলির একটি বৈশিষ্ট্য হল, স্বর্গ বা নরকবাস চিরস্থায়ী বা প্রায়-চিরস্থায়ী হয়। যদি সাধারণ অজ্ঞ বিশ্বাসপ্রবণ মানুষের মনে স্বর্গে যাওয়ার লোভ সঞ্চার করা এবং নরকের বীভৎস বর্ণনা দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এ সব শাস্ত্রের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে তা অতিমাত্রায় সার্থক হয়েছে বলতেই হবে। লোভ এবং ভয় জেগেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে নৈতিকতার বৃদ্ধি হয়েছে এ কথা বলা যায় না।

ভাগবতপুরাণে বিশিষ্ট নরকগুলির নিজস্ব বিশেষ যন্ত্রণা অত্যাচারের বর্ণনা আছে। যে অন্যের সম্পত্তি, সন্তান ও স্ত্রী চুরি করে তার গতি তামিস্র নরকে। যে অন্যের স্ত্রী হরণ করে, ভোগ করে সে যায় অন্ধতামিস্র নরকে। যে কেবল নিজের পরিবারের লোকেদেরই অন্নসংস্থান করে অন্যদের অন্নদান করে না, তার স্থান রৌরব নরকে। বামন পুরাণ বলে ‘যারা যথাযথ অনুষ্ঠান না করে সুখাদ্য ভোজন করে তারা নরকে যায়।’ (১২:২০) যে মানুষ জীবজন্তুর ওপরে অত্যাচার করে সে ‘মহারৌরব’ নরকে যায়। পশুপক্ষীকে যে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে তার স্থান ‘কুম্ভীপাক’-এ; পিতা, ভ্রাতা ও ব্রাহ্মণের প্রতি যার বিদ্বেষ সে ‘কালসূত্র’ নরকে গিয়ে তপ্ত কটাহে ভর্জিত হয়। নাস্তিকের, বৌদ্ধের ও পাখণ্ডের জন্য বিশেষ ভাবে সংরক্ষিত নরক হল অসিপত্রবন, সেখানে তাদের কশাঘাত করা হয় ও দু’পাশে অসিধারের মধ্যে তারা ছুটোছুটি করতে থাকে। তাদের দেহ ভীষণ ভাবে চিরে চিরে যেতে থাকে কিন্তু ক্ষতগুলি আবার সেরে যায়, যাতে তরবারির ফলায় নতুন ক্ষত হতে পারে। যাদের শাস্তি দেওয়া উচিত নয়, যে অধার্মিক রাজা তাদের শাস্তি দেয় এবং ব্রাহ্মণকে শারীর দণ্ড দেয় সে ‘সূকরমুখ’নরকে যায়, সেখানে প্রচণ্ড বলশালী দানবরা তাকে চূর্ণ করে। যারা অন্যের কষ্ট বুঝতে পারে না, নরকে জন্তুরা তার শরীরে দাঁত বসায়, কামড়ে নেয়, তীক্ষ্ণ কর্কশ কীট তাদের দংশন করে। প্রাত্যহিক পঞ্চযজ্ঞ করায় অবহেলা করলে এবং স্বার্থপরের মতো একা খেলে, সে লোককে ‘কৃমিভোজন’ নামক নরকে কৃমিকীটরা খেয়ে ফেলে। যে লোক জোর করে, কিংবা গোপনে ব্রাহ্মণের ধন হরণ করে, ‘সন্দংশ’ নামক নরকে জ্বলন্ত আগুনের চিমটে দিয়ে তাকে ছেঁকা দিয়ে তার মাংস উপড়ে নেওয়া হয়। শাস্ত্রে নিষিদ্ধ (সম্পর্কের) রমণীর সঙ্গে যে সহবাস করে তাকে ‘সূর্য্য’নরকে তপ্ত লোহার নারীদেহ আলিঙ্গন করতে হয়। যারা শাস্ত্রনির্দিষ্ট ধর্মকর্ম করে না তারা বৈতরণীতে যায় ও সেখানে বিষ্ঠা, মূত্র, পুঁজ, রক্ত, চুল, নখ ও অস্থি ভোজন করে। শারীরিক শুচিতা যে রক্ষা করে না, এমন চণ্ডালীর উপপতিও সেখানে যায়। যে সব দাম্ভিক লোক দম্ভ দেখানোর জন্য যজ্ঞে পশুবধ করে তারা ‘বিশসন’নরকে যায়। যারা (অন্যের গৃহে) অগ্নিসংযোগ করে বা অন্যকে বিষ দেয় তারা ‘অবীচি’ নরকে যায় ও তাদের দেহ কুকুরের কামড়ে খায়। যে সব ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সোমপান করে ও পরস্ত্রী সম্ভোগ করে, ‘কাষ্ণায়স’ নরকে তাদের দেহে গলানো লোহা ছিটিয়ে দেওয়া হয়। যারা গুরুজনকে শ্রদ্ধাপ্রদর্শনে অবহেলা করে তাদের জন্যে নির্দিষ্ট আছে, ‘ক্ষারকদম’নরক, যেখানে কাদা ক্ষারযুক্ত। নরঘাতক এবং যে সব নারী পুরুষকে ‘শোষণ’ করে, যমদূতরা তাদের নির্যাতন করে। যে সব লোক অপরকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায় তাদের ঠিক সেই ভাবে নির্যাতন করা হয় ‘দন্দশূক’ নরকে।

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এ পুরো কয়েকটি অধ্যায়ে বিভিন্ন নরকে বিভিন্ন যন্ত্রণার কথা বলা আছে (প্রকৃতি খণ্ড ২৯-৩১, ৩৩, ৩৪) যে স্বামী কামনাকে অগ্রাহ্য করে সে ‘কুম্ভীপাক’ নরকে বাস করে, তার শরীরে যত লোম আছে তত বছর থাকে। (ওই ৩০:৩৭) দেবীভাগবত পুরাণ বলে যারা অন্যকে কষ্ট দেয় তারা পাপের গুরুত্বের তারতম্য অনুসারে রুরু মৃগ হয়ে ‘রৌরব’ নরক বা ‘মহারৌরব’ নরকে যায়। যারা অন্যকে কারারুদ্ধ করে তারা ‘যাম্য’ নরকে যায়। যারা পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে (নিবেদিত) তর্পণদ্রব্য অশুচি করে, তারা ‘ক্রব্যাদ’ নরকে যায় এবং যারা অন্যকে নির্যাতন করে তারা জন্তুদের শরীরে যত সংখ্যায় লোম আছে তত দিন ‘কুম্ভীপাকে’ বাস করে। পিতামাতা, ব্রাহ্মণ এবং পশুদের প্রতি যারা বিদ্বেষ পোষণ করে তাদের গতি ‘কালসূত্র’ নরকে। যারা বৈদিক পন্থা ত্যাগ করে পাখণ্ড (নাস্তিক ও বৌদ্ধ) পন্থা গ্রহণ করে তারা ‘অসিপত্রবন’ নরকে গিয়ে কশাহত হয়। যে রাজা বা রাজকর্মচারী ব্রাহ্মণকে শারীর দণ্ড দেয় তারা ‘সূকরমুখ’ নরকে যায়। যারা সোনা এবং মণিমাণিক্য চুরি করে তাদের স্থান ‘সন্দংশ’ নরকে। যারা পশুগামী তারা ‘শাল্মলী’ নরকে গিয়ে অবিশ্রান্ত যন্ত্রণা পেতে থাকে। (৮:২২-৫০; ২৩, ৩২ এবং ৩৭ অধ্যায়ও) যে ব্রাহ্মণরা শূদ্রদের হয়ে যজ্ঞ করে, শূদ্রের শ্রাদ্ধে ভোজন করে কিংবা শূদ্রের শবদাহে সাহায্য করে তারা অবশ্য নরকে পুঁজের হ্রদে বাস করবে। চোর, চণ্ডাল, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়ের অন্ন গ্রহণ করা অত্যন্ত গর্হিত আচরণ। যারা শূদ্রের অন্ন গ্রহণ করে, তার সাহচর্যে থাকে ও একাসনে বসে, তারা ভয়ঙ্কর সব নরকে যায় এবং যত দিন চন্দ্রসূর্য থাকবে তত দিন তারা সেখানে বাস করবে। (ঐ ১১:২১,২২) পদ্মপুরাণ-এর পাতালখণ্ডে নানা নরকের নাম আছে এবং যে সব পাপে সেখানে যেতে হয় তার একটি বিস্তৃত বিবরণ আছে (১৮:৯৭-২২৬) এখানে নরকগুলির কয়েকটির নাম নতুন এবং কতকটা অদ্ভুত। প্রচলিত নামের নরকগুলি ছাড়াও এখানে শুনি: ‘নিকৃন্তন’, ‘তপ্তকুম্ভ’, ‘রোধ’, ‘তাল’, ‘তপ্তখল্ব’, ‘মহাজ্বাল’, ‘শালা’, ‘বিমোহন’, ‘কিমাঞ্জন’, ‘অধঃশির’, ‘রুধিরান্ধ’, ‘বিডভুজ’, ‘মূত্রকুণ্ড’, ‘লোহতাপী’ ও ‘ভেদন’। এ ধরনের তালিকা নানা পুরাণে ছড়ানো আছে। ছোটখাটো অনুপুঙ্খে পুরাণ থেকে পুরাণে নানা পার্থক্য দেখা যায়, কিন্তু মূল সূত্রটি হল ‘চোখের বদলে চোখ’, শুধু চোখটা উপড়ে নেওয়ার পদ্ধতিতে সাংঘাতিক নিষ্ঠুর জিঘাংসা। এতে জনসাধারণের নৈতিক স্বাস্থ্যের জন্যে শাস্ত্রকারদের উদ্বেগটা বড়, না অন্যকে পীড়ন করে ক্রুর পৈশাচিক একটা উল্লাসই বড়, তা বলা কঠিন। আরও একটা জিনিস চোখে পড়ে, পাপ ও দণ্ডের অনুপাতে কোনও একটা নির্দিষ্ট সঙ্গতি নেই। পুরাণকাররা আঞ্চলিক দণ্ডবিধিগুলিকে যেন তীক্ষ্ণতর করে আঞ্চলিক নীতিবোধ অনুসারে পাপ ও দণ্ডের অনুপাত নির্ণয় করেছেন। এটা পরলোকতত্ত্বে একটা বড় ত্রুটি। উচ্চবর্গের পক্ষে গুরুপাপে লঘুদণ্ডের বিধান আছে, নিম্নবর্ণে লঘুপাপে গুরুদণ্ড।

বহু কাহিনিতে এবং শাস্ত্রনির্দেশে পাপকর্মের একটি নিশ্চিত ফল হল; পরজন্মে অবাঞ্ছিত জীবন পাওয়া। …মানুষের পূর্বজন্মকৃত কর্মের ধর্ম অনুসারে পরজন্মে শাস্তিসূচক জন্ম। শোধনলোকে পুনর্জন্ম— কিছু কালের জন্য— এটা হয় প্রাণহানি ঘটানোর জন্যে। জৈনরাও বিশ্বাস করে— কর্মের পরিপাকের সময়, এবং যে সময়টা কর্ম প্রসুপ্ত থাকে তা বিভিন্ন কর্মের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিমাণের…।’ (নুমেন ৩০, ফাস ২, ডিসেম্বর ১৯৮৩, পৃ. ১৯৯, ২০২) পরলোকের দু’ প্রান্তে আছে স্বর্গ ও নরক, তৃতীয় বিকল্পটি পুনর্জন্ম। এই বিষয়ে সুমেরীয় বিশ্বাস সম্বন্ধে পড়ি, ‘মৃত্যুর পরে তার কৃশ আত্মাটি অন্ধকার, বিবর্ণ অন্ধকারে পাতালে নেমে গেল, যেখানে জীবন হল পার্থিব জীবনেরই একটি হতাশ, হতশ্রী প্রতিচ্ছায়া।’ (ক্লামার, ১৯৬৩, পৃ. ১২৩) তেমনই পোপোল হুহ গ্রন্থে পরলোক একটি বিষণ্ণ অবস্থার আবাস। তমসার নিকেতন, বহু শাস্তি, অন্ধকার, ঠাণ্ডা, জাগুয়ার, বাদুড় এবং ছুরি।’ (দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় অধ্যায়) এই দুটি অতিকথাতেই মরণোত্তর অবস্থানের সঙ্গে কর্মবাদের কোনও যোগই নেই; দুটিতেই পরলোক অন্ধকারময় ও বিষাদের স্থান— সকলের জন্যেই; জীবৎকালে কে কী কর্ম করেছে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ অসম্পৃক্ত এ বোধ। প্রাচীন বৈদিক কল্পনাতেও পরলোক তমসাচ্ছন্ন ও বিষাদময়। সে যুগের মানুষের জীবন সম্বন্ধে উষ্ণ আবেগ এত স্পষ্ট ছিল যে পরলোক আপনিই জীবনের অভাবে অন্ধকার ও দুঃখময় বলে প্রতিভাত হত। সুমেরীয়, প্রাচীন বৈদিক ও মেক্সিকোর কল্পনায় পরলোকের দুর্দশার সঙ্গে কর্মের কোনও যোগ ছিল না।

কর্মবাদ যখন গুরুত্ব পেল তখন কর্মের সঙ্গে পরলোকের একটা আনুপাতিক সম্পর্ক তৈরি করতেই হল। জীবনের অন্তর্নিহিত একটি নৈতিক বিচার সৃষ্টি হল: এর অনিবার্য পরিণতি হল, শুভকর্মকারী পরলোক সম্বন্ধে ধারণা আরও স্পষ্ট হলে ওই দুঃখময় স্থানটি ইহজন্মে কৃত পাপক্ষয় করবার স্থান হয়ে উঠল, যেখানে যন্ত্রণাভোগের মধ্যে পাপের ফল নষ্ট হয়। কাজেই নরকযন্ত্রণা শেষ পর্যন্ত আত্মার উন্নতি বিধানের সহায়ক হয়, যাতে আত্মা কলুষ ও গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে ঊর্ধ্বতর লোকে যাত্রা করতে পারে। নরকের সংখ্যা এবং নরকযন্ত্রণার বৈচিত্র্যের জন্যে বাধ্য হয়েই একটা আবরণ সৃষ্টি করতে হয়, যার দ্বারা কাল্পনিক ভাবে কৃত পাপের সংখ্যা, মাত্রা ও গুরুত্বের অনুপাতে নরকযন্ত্রণার দুঃসহতার তারতম্যের একটা সামঞ্জস্য থাকে। বাস্তবিক সে রকম কোনও অনুপাত কোনও দিনই খুঁজে পাওয়া যায়নি, কিন্তু মনকে চোখ ঠারার মতো একটা ছক তৈরি হয়ে গেল; পাপের বহু অনুপুঙ্খ, নরকের সংখ্যা, নাম ও যন্ত্রণার বৈচিত্র্য রীতিমত বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠল। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন পাপের একই দণ্ড এবং একই পাপের বিভিন্ন দণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। মানুষকে কোনও সময়ই এমন একটি পরিচ্ছন্ন ছক দেওয়া হয়নি, যাতে একটি তত্ত্বের মধ্যে অন্য একটি ঢুকে পড়েনি বা বহু বিচ্ছিন্ন অসম্পৃক্ত সূত্র ইতস্তত ছড়িয়ে থাকেনি। সাধারণ মানুষ এমনিই মোহাচ্ছন্ন ছিল যে ব্যতিক্রমী কয়েকটি নিদর্শন ছাড়া এই জন্মান্তর-কর্মবাদের সঙ্গে পরলোকতত্ত্বের মৌলিক সংগতি সম্বন্ধে কখনওই প্রশ্ন করেনি। খুব অস্পষ্ট ভাবে হলেও মানুষ বুঝতে পারত যে, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন মানুষের বিরোধিতা করা নিরাপদ নয়, করলে ইহলোকে কারাবাস ও পরলোকে নরকবাস হওয়া সম্ভব। কাজেই এই যে জটিল একটি মতবাদের উপস্থাপনা তা মোটের ওপর সার্থকই হয়েছিল।

স্বর্গ ও নরক পুরস্কার ও শাস্তিরই রূপভেদমাত্র; কিন্তু পুরস্কার ও শাস্তিরও কতকগুলি প্রাক্‌শর্ত আছে। প্রথমত, সর্বজনস্বীকৃত, স্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত কিছু নৈতিক বিধান থাকা চাই, যার থেকে বিচ্যুতিতে শাস্তি; নির্দেশ মানলে পুরস্কার। দ্বিতীয়ত, একজন অন্তিম নির্ধারক দরকার, যিনি শেষ পর্যন্ত ফতোয়া দেন কোন কাজগুলি মন্দ, অতএব নরকযোগ্য, এবং কোনগুলি ভাল অর্থাৎ স্বর্গাভিমুখী। তৃতীয়ত, এই রায়টি সুবিচার-প্রসূত, সকলের ওপরে সমান ভাবে প্রযোজ্য, অতএব নির্ভরযোগ্য হওয়া চাই।

মুশকিল সবচেয়ে বেশি এইখানে যে, কোনও শাস্ত্রই তেমন কোনও বিচারকের সন্ধান দেয় না। ‘বিধাতা’ খুব অস্পষ্ট এবং নির্বিকার, নির্লিপ্ত। দেবতারা সংখ্যায় বহু এবং তাঁদের অতীত কর্মজীবন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সৎ নয়; নিন্দার ঊর্ধ্বে নয়। তাঁরা পক্ষপাতীও বটে এবং তাঁরা ভক্তদের ভাগ্য নির্ণয়ের ব্যাপারে পরস্পরের সঙ্গে বিরোধ বিদ্বেষে লিপ্তও বটে। তৃতীয়ত, কর্ম যদি স্বতই ফল উৎপাদন করতে পারত, তা হলে তার একটা সর্বজনীন বিধান থাকত, ব্যক্তি ও অবস্থাভেদে তা পৃথক হত না। এবং পরিশেষ কর্ম মানলেও তার ফলোদ্‌গম ও পরিণতি মানুষের কাছে রহস্যই থেকে যায়, কাজেই তা বস্তুত নিয়তিতে পরিণত হয়।

স্বর্গ নরকের ধারণা যে দুটি মৌলিক ধারণার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে তা হল পুরস্কার ও শাস্তি। এ দুটিতেও অপেক্ষিত এক নিরপেক্ষ বিচারকর্তা, যাঁর ইচ্ছায় পুরস্কার ও শাস্তি নির্ণীত হয়। শাস্ত্রে সে রকম কোনও একজন ন্যায়পরায়ণ বিধায়কের সন্ধান মেলে না; বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন দেবতা বিচারকের ভূমিকায় দেখা দেন। কখনও বা ঋষিরা বা অবিচারভোগী মানুষও বিচারকের ভূমিকা তুলে নেন, তাঁরা কোনও কোনও ব্যক্তির সপক্ষে বা বিপক্ষে রায় দেন। খ্রিস্টধর্মে ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত সহজ ও সরলরৈখিক: ‘ঈশ্বর যথাক্রমে বাধ্যতা ও অবাধ্যতার জন্যে পুরস্কার ও শাস্তির বিধান দেন। যখন ইহজগতের হিসেবে এর যথার্থতা মিলল না, তখন তাকে ঠেলে দেওয়া হল পরলোকে।’ (স্যান্ডার্স ১৯৮৮, পৃ. ১২৬) কবি ব্রাউনিঙের কথা মনে পড়ে— ‘পৃথিবীতে ভগ্ন ব্যাসার্ধগুলি, স্বর্গে পুর্ণায়ত চক্রটি।’ (অ্যাবট ফোগলার, নবম ছত্র) কাজেই পরজন্মে নয়, মানুষের যা কিছু ফলযোগ্য অথচ পৃথিবীতে ফল পায়নি, তাকে ঈশ্বর পরলোকেই ফলবত্তা দান করেন। ইসলামেও শুধু স্বর্গ বা নরকই ভোগ করতে পারা যায় মৃত্যুর পরে, ইহজন্মে কৃত পাপ বা পুণ্য অনুসারে। জোরাষ্ট্রীয় ধর্ম কিন্তু ইহজন্মের কর্মের ফলভোগের জন্য পরজন্ম মানে না; মৃত্যুর পর মৃতের কর্মের পরিমাপ হয় ও সে অনুসারে তার পরলোকে গতি হয়। বৌদ্ধ ও জৈন উভয় ধর্মেই নরক হল ইহজন্মে কৃত পাপের ফলভোগের ক্ষেত্র এবং স্বর্গ ইহজন্মের পুণ্যের ভোগক্ষেত্র। এ দুটির কোনওটিতেই স্বর্গ বা নরক চিরস্থায়ী নয়, যেমন নয় ব্রাহ্মণ্যধর্মেও।

প্রত্যেক অতিকথাতেই নরক নানা মন্দ আত্মায় পূর্ণ; তারা হয় পাপীদের নরকযন্ত্রণা দেওয়ার জন্যে যমের নিযুক্ত অনুচর, অথবা তারা নিজেরাই পাপী, নরকবাসে পাপক্ষয় করে স্বর্গে যাওয়ার বা অন্য গতি পাওয়ার প্রতীক্ষায় আছে, কিংবা তারা শুধু নাম-পরিচয়হীন মন্দ আত্মাই। এই শেষোক্তরা নানা রকমের হতে পারে: ভূত, প্রেত, পিশাচ, পরী, জিন, অসুর, যক্ষ, গন্ধর্ব, রাক্ষস, ইত্যাদি। এদের শ্রেণিবিভাজন, বর্ণনা বা সংজ্ঞা নিরুপণ করা অতি কঠিন কাজ। ‘প্রেত বিষয়টি… শুধু যে অযৌক্তিক তা নয়, যুক্তি বিরোধী।’ (মেনশিং, ১৯৭৬, পৃ. ১৩২) কিন্তু ধর্মতত্ত্বে এ অবস্থানটিতে স্বীকার করা কঠিন; সব ধর্মতত্ত্বই প্রেতদের ও মন্দ আত্মাদের উদ্ভাবন করে, স্বীকার করে এবং গ্রহণ করে। এরা মানুষের মনে ভয়, জুগুপ্সা এমনকী কখনও কখনও কতকটা সম্ভ্রমেরও উদ্রেক করে। প্রেতাত্মার কল্পনা সার্বত্রিক এবং অতি প্রাচীন। অথর্ববেদে, জাতকে, নিকায় ও পুরাণগুলিতে এরা বহু সংখ্যায় ও নামে উপস্থিত। বাইবেল, তালমুদ, তোরাহ, অবেস্তা ও সম্পূর্ণ মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ও ভারতীয় ধর্মতত্ত্বে অগনিত প্রেতের আনাগোনা। ভাষ্যকাররা বহু বিনিদ্র রজনীতে এদের স্বভাব ও জীবনচরিত বিশ্লেষণ করেছেন; নিবন্ধকাররা এদের শ্রেণিবিভাজন ও সংজ্ঞা নিরূপণ করে বিশিষ্ট ভূমিকা নির্দেশ করতে চেষ্টা করেছেন। দেহবিমুক্ত আত্মার বহুবিধ গতির মধ্যে প্রেতত্ব একটি এবং সেই কারণে এরা লোকের মনে ভয় সৃষ্টি করতে পারে। ‘ঠিক নির্দিষ্ট কোনও বিভীষিকার ভয় নয়, কিন্তু প্রেতত্বের অনির্দেশ্য আতঙ্ক, যা অবোধ্য তারই বহিঃপ্রকাশ প্রেত-বিশ্বাসে প্রতিফলিত। সে (প্রেত) পৃথিবীর ভয়াবহতার প্রতীক, যে অপরিমেয় শক্তি আমাদের চারিদিকে নিজেকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে, যা আমাদের আক্রমণ করবার হুমকি দেয়। (তারই প্রতীক প্ৰেত)…’ (মেনশিং, পৃ. ১৪১ থেকে) ডাইনি বা জাদুকরকে শনাক্ত করা এবং শামানবাদ এ সবই প্রেতাত্মার সঙ্গে জড়িত।

মহাভারত-এ বলে, অসুররা একটি অশুভ ‘কৃত্যা’ (জাদুকর্ম)-র অনুষ্ঠান করে দুর্যোধনের শরীরের নিম্নার্ধ নির্মাণ করে, এই অর্ধাংশই প্রহারযোগ্য ও বিনাশশীল। (৩:২৪০:১-৮) অসুরেরা নানা রকম অনুষ্ঠান করে থাকে, যার অধিকাংশই মানুষের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর। কিন্তু অসুরের দ্বারা ক্ষতি সাধিত হওয়ার পূর্বশর্ত হল মানুষের মন্দ আচরণ, যা সেই ক্ষতিকে ডেকে আনে। ‘স্পষ্টতই, খ্রিস্টান, অখ্রিস্টান নির্বিচারেই দুর্ভাগ্য নির্মিত হয় মানুষের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী অসুরদের দ্বারা’ (ডগলাস, ১৯৭০, পৃ. ২৮)

অগ্নি পুরাণে প্রেতাত্মা ও তার দ্বারা আবিষ্ট হওয়ার কথা এবং মোট আটত্রিশটি প্রেতাত্মার নাম পাই। (২৯৯:৩৮) বৈদিক, মহাকাব্যিক এবং পৌরাণিক কল্পনায়, অন্তরিক্ষ ও পাতাল প্রেতাত্মায় ভরা। কিন্তু ‘সম্ভবত কোনও ধর্মেই প্রেতত্ত্ব মাজদার মতো এত বেশি মাত্রায় প্রাধান্য পায়নি, বিচিত্র বৈশিষ্ট্যও অর্জন করেনি। অসুরদের ভাবা হত আত্মা হিসাবে, (মইন্যু, দএব এবং তাদের সংখ্যা অগণ্য।’ (উইনস্টন, হিস্ট্রি অব রিলিজ্যন্স ১৯৬৬, ৫ম খণ্ড, দ্বিতীয় ংক্যা, পৃ. ১৯২) অসুরদের প্রভাব আরও গুরুত্ব পায় এই ভয় থেকে যে, মন্দকর্মের দ্বারা মানুষ মৃত্যুর পরে অসুর হয়ে যেতে পারে, সে এবং তার মৃত আত্মীয়রাও: এই ভয়াবহ সম্ভাবনার সদাজাগ্রত ভয়টির ব্যাখ্যা মেলে। তা ছাড়াও প্রেতলোকের অনির্দেশ্যতাও এই ভয়ের একটা কারণ, বিশেষত মানুষের জগতের আইন প্রেতজগতে অচল বলে। কেউই তা জানে না কোন কর্মের ফলে মানুষকে মৃত্যুর পর কোন জাতীয় প্রেতে পরিণত হতে হবে।

ছান্দোগ্য উপনিষৎ বলে, ‘এ (জন্মে) যারা সচ্চরিত্র তাদের সম্ভাবনা থাকে পরজন্মে ব্রাহ্মণ… ক্ষত্রিয়… বা বৈশ্যকুলে জন্মগ্রহণ করবার। কিন্তু এখানে যাদের দুর্গন্ধ চরিত্র তাদের সম্ভাবনা কোনও দুর্গন্ধময় যোনিতে, কুকুর বা শুয়োরের বা কোনও অস্পৃশ্যের যোনিতে জন্মগ্রহণ করা।’ (৫:১০:৭-৮) জাতকের কাহিনিগুলিতে জন্মান্তরে শাস্তি ও পুরস্কারের কথা বারেবারেই পাই :

এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ একটি ছাগহত্যা করে, এই অপরাধে চারশো নিরানব্বই জন্মে তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। (সংখ্যা ১৮, মতকভত্ত) এক ধনী নদীতটে ধন প্রোথিত করার অপরাধে পরজন্মে সাপ হয়ে জন্মায়; অন্য একজন ত্রিশ কোটি মুদ্রা পুঁতে রাখার পাপে ইঁদুর হয়ে জন্মায়। (৭৩, সচ্চংকির) এক বোধিসত্ত্বের মৃত্যু আসন্ন হলে লোকেরা তাঁকে প্রশ্ন করে ‘কী কী পারমিতা আপনি অর্জন করেছেন?’ ‘কিছুই না’, এ কথা বলার পরই তাঁর মৃত্যু হল এবং তিনি আভাস্বর দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেন। (৯৯, পরসহসস) সিবিকে সক্ক নানা ভাবে পরীক্ষা, প্রলোভন এবং কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য করেন; কিন্তু পরম সহিষ্ণুতা ও যথার্থ পরিহিতৈষায় তিনি সে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; তখন সক্ক তাকে বর দিতে চাইলে সিবি তাঁর চোখ দুটি ফিরে চাইলেন, বর হিসেবে নয়, সদাচারী জীবনের পুরস্কার রূপে। (৪৯৯, সিবি) এক রাজার এক অসাধু পুরোহিত ছিল, সে ঘুষ নিত, অন্যায় ভাবে প্রজার অর্থ শোষণ করত এবং লোকের আড়ালে তাদের নিন্দে করত। মৃত্যুর পর সে জন্মাল এমন এক রাক্ষস রূপে যার দু’হাতে দুটি লম্বা ধারালো নখ, যা দিয়ে সে নিজ দেহের মাংস খুঁড়ে খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করত। কিন্তু জীবৎকালে একবার সে এক দরিদ্র উপবাসিনীকে একটি আম খেতে দিয়েছিল এবং এই পুণ্যে সে প্রতিরাত্রে অপ্সরা হয়ে যেত। (৫১১, কিংছন্দ) একটি মাত্র পুণ্যকর্মের ফলে পরজন্মে প্রতি রাত্রে সে মানুষের উপরের স্তরের জীব হয়ে যেতে পারত, এতে জীবৎকালে কৃত সামান্যতম পুণ্যেরও গুণগান করা হচ্ছে, মানুষের পুণ্যপ্রবৃত্তি জাগাবার জন্য। একটি বানর এক ক্লান্ত ক্ষুধার্ত ব্যাধের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য তাকে একটি তিন্দুক ফল দিয়ে অনুরোধ করল যে, সে যতক্ষণ ঘুমোবে ততক্ষণ যেন ব্যাধটি গাছের নিচে বসে তাকে পাহারা দেয়। ব্যাধটির সহসা বানরমাংস খাবার লোভ জাগে, সে বানরটির মাথায় আঘাত করে। জেগে উঠে বানরটি সবই বুঝতে পারে এবং লোকটিকে জঙ্গল পার করে দিয়ে আসে। লোকটির কুষ্ঠ হয়ে যায় এবং পরে ভূমি তাকে গ্রাস করে। (৬১৬ মহাকপি) নাগরাজ পণ্ডর তার বন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এমন এক গুপ্ত তথ্য প্রকাশ করে দেয় যাতে বন্ধুর সমূহ ক্ষতি হয়। দু’জনে এক ঋষির কাছে যায়, যিনি বলেন শত্রুকে বিশ্বাস করা উচিত নয়। পণ্ডর বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন; তাঁর মস্তক সপ্তধা বিদীর্ণ হয় ও ভূমি তাকে গ্রাস করে। (৫১৮ পণ্ডর) একটি গরিব মেয়ের একটি লাল কাপড়ের লোভ হয়। তার পিতামাতার সাধ্য ছিল না সে কাপড় কিনে দেওয়ার, তাই সে অন্যের বাড়িতে দাসীবৃত্তি করে কিছু সঞ্চয় করে কাপড়টি কেনে। স্নান করে পরবে বলে স্নানে যায়; উঠে দেখে জরাজীর্ণ কাপড়ে এক পচ্চেকবুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে সে নিজের কাপড়ের অর্ধেকটা দেয়, পরে তাঁর দেহে ওই কাপড়ের উজ্জ্বল শোভা দেখে সবটাই দিয়ে দেয়। এই পুণ্যকর্মের ফলে পরজন্মে সে অসামান্য সুন্দরী হয়। (৫২৭, উন্মাদন্তী)

শাস্তি ও পুরস্কারের বিষয়টি পালি বৌদ্ধধর্মের একটি মূল উপজীব্য এবং অসংখ্য কাহিনিতে প্রতিবিম্বিত।

শান্তি ও পুরস্কারের আর একটি সংস্করণের কাহিনি পুরাণগুলিতে বহুসংখ্যায় পাওয়া যায়। যদিও বহু উপাখ্যানে পুণ্যের ফলে সুখ ও পাপের ফলে দুঃখ, এমন একটা আপাত সমতা দেখা যায় কিন্তু এর মধ্যে জাতিভেদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং সমাজের ক্ষমতাশালী ব্যক্তির ক্ষমতার প্রকাশেও সমতা রক্ষা পায়নি। তাই ব্রাহ্মণের সেবা করলে বা তাকে দানদক্ষিণা দিলে, তার জন্যে স্বার্থত্যাগ করলে অথবা রাজা বা ধনকুবেরের জন্যে এ সব করলে পুণ্য হয়; এর অন্যথায় সর্বনাশ। অন্য এক অধ্যায়ে আমরা দেখব যে অন্যান্য ধর্মানুষ্ঠানের ক্রিয়াতেও পুণ্য সঞ্চয় করা যায়, পাপ ক্ষয় হয় এবং পরজন্মে সমাজের উচ্চকোটিতে জন্মলাভ করা যায়। নৈতিক আচরণ ততটা পুণ্যের নির্ণায়ক নয় যতটা আনুষ্ঠানিক, সামাজিক ও পারিবারিক, শ্রেষ্ঠ ও জ্যেষ্ঠের অথবা উচ্চবর্ণের সেবানির্ভর। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এ পুণ্যকর্মের অনুরূপ সুফলের একটি তালিকা পাওয়া যায়। (ব্রহ্মখণ্ড ২৭ অধ্যায়) অন্য এক অধ্যায়ে যে সব কাজে স্বর্গলাভ হয় তার তালিকা আছে। ভাগবত পুরাণ স্পষ্ট বলছে: আত্মা তার পুণ্য ক্ষয় করে ভোগের দ্বারা, পাপ ক্ষয় করে ভোগের অভাবের দ্বারা। (১:১২:১৩) স্পষ্টই দেখা যায়, ভোগই উদ্দিষ্ট লক্ষ্য এবং লোকে পুণ্যের দ্বারা তা অর্জন করে এবং কেউ যখন তা থেকে বঞ্চিত হয় তখন তার ভোগের অভাবই পাপের শাস্তিরূপে গণ্য হয়।

পুণ্যকর্মই হোক বা পাপকর্মই হোক কর্মের এই ফাঁস থেকে এবং স্বর্গ, নরক, পুরস্কার ও শাস্তি যেগুলিতে মানুষ ওতপ্রোত ভাবে বিজড়িত, তাদের থেকে মুক্তির উপায় হল মোক্ষ মোক্ষ কী থেকে? সর্বজনীন উত্তর হল, জন্মান্তর, সংসার, অস্তিত্বের এই জটিল জালে বারংবার ফিরে আসা থেকে পরিত্রাণই হল আত্মিক পুনর্জন্ম, যাতে প্রথমে মৃত্যুর পরে স্বর্গে যাওয়ার নিশ্চিয়তা এবং পরে সত্তার আত্যন্তিক বিলোপ। যেমন নির্বাণ, তা-ও মোক্ষের এক রূপ; ব্রহ্মে নিঃশেষে বিলীন হওয়াও অন্য একটি প্রকারভেদ। অন্য ভাবে বলতে গেলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে ব্যক্তি সত্তার বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মসত্তার মধ্যে সানন্দ ও সচেতন সত্তাই মোক্ষ। ‘কিন্তু শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে সংসার ও মোক্ষ মিলিত হয়েছে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের ইতিহাস ব্যাপ্ত করে দুটি পরস্পর সম্পৃক্তই আছে।’ (রোঢ় ১৯৪৬, পৃ. ১৩৩)

শুধু অর্বাচীন শৈব শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-এই নয়, বেদান্তের বিশিষ্টাদ্বৈত ও দ্বৈতাদ্বৈত প্রস্থানেও এবং প্রচ্ছন্ন ভাবে মহাযানের কিছু পরবর্তী বিবর্তনে— সহজযান ও মন্ত্রযাণে— এ দুইয়েরই একটি সূক্ষ্ম পরস্পরে অন্তর্ভুক্তি বোঝা যায়। ‘মহাযান বৌদ্ধধর্ম… এবং শৈবমতে একটি মোক্ষবাদ নির্মিত হয়েছে যার লক্ষ্য মুক্তি, অর্থাৎ জ্যোতির্ময় চৈতন্যরূপে বোধিসত্ত্বে উপস্থিত হওয়া, তারই নবতর রূপান্তর ‘বাক্’-রূপে, শিব-রূপে; যে উপলব্ধিতে এই মুক্তি লভ্য হয় তাতে সমগ্র আধ্যাত্মিক সত্তা নিহিত থাকে, অতএব সম্পূর্ণ একটি প্রত্যাখ্যান বা পুনর্নবীকরণের সৃষ্টি হয়।’ (তুচ্চি, ১৯৬১, পৃ. ১৫-১৬) মান্ডোয়ানদের সম্বন্ধে হেস্টিংস এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিক্স বলে, ‘এরা (মন্দ আত্মা, বা অন্য জাতের মানুষের ও বিশ্বাসের দেবতারা) এবং এদের ভৃত্যরা মান্ডোয়ানদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। তাই বিশ্বাসী একাগ্রচিত্তে পরিত্রাণ কামনা করে ও জাগতিক অস্তিত্ব থেকে মুক্ত হতে চায়।’ (৮ম খণ্ড, পৃ. ৩৮৭)

মোক্ষের কথা আমরা প্রথম শুনি উপনিষদে। সংহিতা ব্রাহ্মণের কর্মকাণ্ডের দ্বারা অনুসরণ করে (আনুষ্ঠানিক যজ্ঞীয় ধর্মাচরণের যুগে) আরণ্যক ও উপনিষৎ আমূল পৃথক একটি জ্ঞানকাণ্ডের প্রবর্তন করে (জ্ঞানের যুগ)। এখনে জীবনের মূল লক্ষ্যই বদলে গেছে; পূর্বযুগের সুখী, দীর্ঘজীবী, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সমৃদ্ধ জীবনের কামনা থেকে এখন লক্ষ্য হল জন্মান্তরের ধারার ছেদ। জনসাধারণের জীবনের অর্থ তত দিনে হয়ে দাঁড়িয়েছে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, অপরিশোধ্য ঋণভার, অপ্রতিকার্য দারিদ্র্যের পীড়ন, অনাহার বা অর্ধাহার, ব্যাধি এবং নিরন্তর উচ্চবর্ণের এবং ধনী প্রভুর দ্বারা শোষণ। যদি জনতার কাছে পুনর্জন্ম এই দুঃখক্লিষ্ট জীবনের অনন্ত পুনরাবর্তন হয়ে দাঁড়ায়, যদি তাদের কর্ম ও তার প্রত্যক্ষ ফলের মধ্যে অনির্দেশ্য ব্যবধানই কায়েম হয়ে যায় এবং তথাকথিত কর্মফল দেখা দিলে কর্তা সে সম্বন্ধে একেবারেই অবহিত না হয়, যদি সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে দেখা দেয় অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয় ভাগ্যের রূপে, তাহলে মানুষ এ সম্ভাবনার বহুতর পুনরাবর্তনের বদলে যদি একেবারে মূলোচ্ছেদের চেষ্টা করতে প্রলুব্ধ হয়, তবে সেটা বেশ বোঝা যায়।

আরও একটি প্রাসঙ্গিক সমস্যা হল, জন্ম থেকে জন্মান্তরের চেতনার সঞ্চারণ। এ কথা সত্যি যে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই ‘প্রমাণ’ বের করা হয় তথাকথিত জাতিস্মরত্ব থেকে। কিন্তু প্রথমত, এ সব জাতিস্মরত্বের ক্ষেত্রে তথ্য খুব কমই পাওয়া যায়; দ্বিতীয়ত, অন্যান্য তথ্য থেকেও এর উদ্ভব ব্যাখ্যা করা যায়; তৃতীয়ত, বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর তুলনায় এই তথাকথিত জাতিস্মররা সংখ্যায় নেহাৎই নগণ্য— এ দিয়ে, কোনও কিছুই প্রমাণ করা যায় না। কাজেই মানব সমাজের বৃহত্তর অংশই যখন বর্তমান জীবনের আগেকার কিছুই স্মরণ করতে পারে না, তখন পূর্বজন্মকৃত পাপপুণ্যের শাস্তি বা পুরস্কার নিতান্তই অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন হয়ে যায়, তাতে কোনও রকম ন্যায়বিচারের অবকাশই থাকে না। এ যেন অচেতন কোনও শিশুকে শাস্তি বা পুরস্কার এমন কোনও কাজের জন্য দেওয়া, যা সম্বন্ধে সে মোটেই অবহিত নয়; এ ধরনের দণ্ড বা পুরস্কারকর্ম-কর্তার ওপরে কোনও প্রভাবই রাখে না, সে কিছুই শেখে না, কিছুই শোধরায় না এবং অন্তরের গভীরে সে জানে এ দণ্ড বা পুরস্কার সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, এর সম্বন্ধে তার কোনও দায়িত্বই নেই। ভাগ্যের এ সব ঘটনা কর্মের কর্তার কাছে হয় নেহাৎ অকারণে দণ্ডের পীড়ন হয়ে ওঠে, অথবা আকস্মিক অহেতুক সৌভাগ্য বলে প্রতিভাত হয়, সে যেন অনধিকারে কিছু ভোগ করছে। জনসাধারণ যখন বোধের অতীত দুর্বিপাক ভোগ করে তখন কোনও সুবিচারকের ওপরে তার আস্থা কেমন করে থাকবে? দরিদ্র, দুর্বল ও অসহায়রা বুঝত যে, ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকর্তাদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ নিষ্ফল হতে বাধ্য, তাই তারা মেনে নিত সব কিছুই। ঠিক এইটেই তাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। তাদের বোঝানো হয়েছে যে, দুঃখ আসে অতীতের কোনও জন্মের পাপ থেকে, আর পরজন্মে ‘ভাগ্য ফেরাবার’ একটি মাত্র রাস্তা হল বিনা প্রশ্নে ও নিষ্প্রতিবাদে উচ্চ ত্রিবর্ণের সেবা করে যাওয়া। জনসাধারণকে তাদের দুঃখের প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে অন্ধকারে রেখে প্রচার করা হয়েছে, অতীতে কোথাও তাদের দুঃখের কারণ রয়েছে— এ হল ধর্ম সম্বন্ধে শুকনো কচকচির চূড়ান্ত নিদর্শন। জাঁতার পাথর দুটোর মধ্যে পড়া এই সাধারণ মানুষগুলি সম্পূর্ণ পিষ্ট হওয়ার আতঙ্কে ন্যূনতম প্রতিরোধের পথ বেছে নিয়ে সমাজের উচ্চবর্গের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। স্বভাবতই তাদের মনে হয়েছিল, এই দুঃখময় অস্তিত্ব থেকে পরিত্রাণের একটি মাত্র উপায় হল, অস্তিত্বের সূত্রটিকেই ছিন্ন করে জীবন থেকে বিদায় নেওয়া। এই সম্ভাবনা দিয়েই তাদের প্রলুব্ধ করা হল, এর জন্য নানা পথও বাতলানো হল এবং ভক্তিকে একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প বলে উপস্থাপিত করা হল। কাজেই গত দু’হাজার বছর ধরে ভক্তিমার্গের নানা বিবর্তন ও বহুধা বিকাশ যে ঘটেছে তাতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। ভক্তির পাত্র হিসাবে এখনও বর্ষাকালে ব্যাঙের ছাতার মতো বহুসংখ্যক ‘মা’ ও ‘বাবা’-র জন্ম হচ্ছে। অন্য দেশেও স্বয়মারোপিত ‘পরিত্রাতা’র ভূমিকায় নিত্য নতুন ব্যক্তির দ্রুত উদ্ভব ঘটেছে; এরা মানুষের দুঃখ এবং তার মুক্তির স্বপ্ন ভাঙিয়ে খাচ্ছে।

পরবর্তী কালের ব্রাহ্মণ সাহিত্য ও উপনিষৎগুলিতে জন্মান্তরবাদের আবির্ভাব ও বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ দুঃখমুক্তির একটি বিকল্প পন্থার সন্ধান পেল। উপনিষৎ পুনর্জন্মের অবসান ঘটাবার একটি উপায় নির্দেশ করল। ‘যে মানুষ ইন্দ্রিয়লভ্য অভিজ্ঞতা ছেড়ে সেগুলির অন্তরালে অভিজ্ঞতার কর্তাকে উপলব্ধি করে সে মৃত্যুর পরে অমর হয়।’ (কেন উপ. ১:২) ‘জ্ঞান দিয়ে অমৃতত্ব পাওয়া যায়।’ (কঠ উপ. ২:৪:৫) ‘জ্ঞান থেকেই আসে চরম শান্তি।’ (কঠ ১:১:১৭) ইন্দ্রিয়জ্ঞানের বহির্ভুত যে আত্মা, যা অনাদি, অনন্ত, সেই চরম তত্ত্বকে জানলেই মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হওয়া যায়।’ (কঠ ১:৩:১৩,১৫) এ নিষ্কৃতির পিছনে বারংবার মৃত্যু সম্বন্ধে একটি ত্রাস বর্তমান, তাই একে বলে মোক্ষ। ‘পুরুষ (= আত্মা) কে জেনে মানুষ মুক্ত হয়ে অমৃতত্ব লাভ করে।’ (কঠ ২:৩:৮-১০) ‘প্রাণের ভূমিকা, অবস্থা, শক্তি ও স্থান সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞানই অমৃতত্বে পৌঁছে দেয়।’ (প্রশ্ন উপ. ৩:১২) ‘বিদ্বান পুরুষ যখন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে, তখন তার পাপ ও পুণ্য দুই-ই খসে যায়।’ (মুণ্ডক উপ. ৩:১:৩) অর্থাৎ জ্ঞানের এই সুউচ্চ শিখরে উঠে মানুষ ভাল ও মন্দ উভয় কর্মেরই ওপরে চলে যায়, তাই সে দণ্ড ও পুরস্কারের বাইরে গিয়ে মোক্ষ লাভ করে। ‘মোক্ষে নাম ও রূপ পরমাত্মায় নিমজ্জিত হয়, ঠিক যেমন নদীরা সমুদ্রে বিলীন হয়।’ (মুণ্ডক৩:২:৮) ‘যা (ব্রহ্মাণ্ডের) ওপারে, তা আকৃতিহীন, দুঃখহীন— এ কথা যারা জানে তারা অমর হয়।’ (শ্বেতাশ্বতর উপ. ৩:১০) ‘যে জানে, আমিই ব্ৰহ্ম, সে সব কিছুই হতে পারে, দেবতারাও তার এই হওয়ায় বাধা দিতে পারেন না।’ (বৃহদারণ্যক উপ. ১:৪:১০) ‘অশ্বমেধযাজীদের মধ্যে যারা এটা জানে তারা পুনঃ পুনঃ মৃত্যুকে জয় করতে পারে।’ (ঐ ৩:৩:২) পুনর্জন্মের বদলে পুনমৃত্যুর উল্লেখ চোখে পড়ে; স্বভাবতই মৃত্যুযন্ত্রণা একটি আতঙ্ক সৃষ্টি করে যা মানুষকে মৃত্যুর পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা সম্বন্ধে সন্ত্রস্ত করে তোলে। পরে জীবন সম্বন্ধে অনীহা পুনর্জন্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই আতঙ্ককে দৃঢ়তর করে তোলে; নিঃস্পৃহ পুরুষ, যে নিষ্কাম, অথবা যার কামনা চরিতার্থ হয়েছে সে (সাধারণ মানুষের মতো) চলে যায় না; ব্রহ্ম হয়ে সে ব্রহ্ম লাভ করে।’ (ওই ৪:৪:৬)

এই যে নানা ভাবে মুক্তিলাভ করবার উপায়, এগুলির মধ্যে কয়েকটি ‘সামান্য’ তত্ত্ব আছে: (ক) নিজেকে সত্তাগত ভাবে ব্রহ্মার সঙ্গে অভিন্ন বলে জানা, (খ) কামনাশূন্য হওয়া, (গ) নিজস্ব নাম ও রূপ পরমপুরুষে বিলীন হয়ে যাওয়া। মূলত, এই প্রাক্‌শর্তগুলি বুদ্ধিগত ও নৈতিক, কর্মনিষ্ঠ নয়। পরবর্তী শাস্ত্র মুক্তি লাভের জন্যে নানা নির্দেশ দেয়: (ক) আবেগনিষ্ঠ : ভক্তি, (খ) কর্মনিষ্ঠ: তীর্থভ্রমণ, মূর্তিপূজা, ব্রত, পবিত্র নদীতে স্নান, (গ) দান, দক্ষিণা, ইত্যাদি। পূর্ব অবস্থান থেকে এই পরবর্তী অবস্থানের মধ্যে যে আমূল পরিবর্তন তার মূলে, (ক) বৌদ্ধ, জৈন ও অন্যান্য অবৈদিক প্রস্থানগুলির বিকাশ, ও (খ) মহাকাব্যোত্তর উপাসনাবিধির বিবর্তন অর্থাৎ ‘পূজা’র বহুল অনুষ্ঠান ও বিস্তার, যেমন ভিন্ন রীতিতে পৃথক ধরনের পুরোহিতের মাধ্যমে বহুতর বিগ্রহের উপাসনা, মন্দিরনিষ্ঠ, ভিন্নতর নৈবেদ্যসাধ্য। এই পরিবর্তিত পটভূমিকায় পুণ্যের সংজ্ঞাই বদলে গেল। কর্ম ও ভক্তির কথা পরে আলোচিত হবে, এখন মোক্ষের সংজ্ঞার উদাহরণ দিই।

‘কোনও লোকের যদি নিজের অজ্ঞাতেও পুরীতে মৃত্যু ঘটে তা হলে সে দুঃখ থেকে মুক্তি পায় ও কাম্য লোক লাভ করে।’ (ব্রহ্ম পু. ২:৩১:১৬) ‘লক্ষ লক্ষ জন্মে সঞ্চিত পাপ, তার ও তার দশ লক্ষ আত্মীয়ের পাপ যমুনায় স্নান করলে নষ্ট হয়ে যায়।’ (নারদ পু. ১:১:৪৩) ভক্তিকে মুক্তির একটি নির্ভরযোগ্য পন্থা বলে স্বীকার করার পরে ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিত ভাবে মোক্ষ ক্রমে সহজলভ্য হয়ে উঠল। তাই শুনি, ‘যে সদ্যোবিকশিত তুলসীপত্র দিয়ে হরির পাদপদ্ম আরাধনা করে তার আর পুনর্জন্ম হয় না।’ (নারদ ১:১৩:৩৩) ‘যে তার প্রিয়তম বস্তুগুলি ব্রাহ্মণকে দান করে, সে বিষ্ণুলোকে যায়, আর কখনও পুনর্জাত হয় না।’ (ঐ ১:১৩১:৬৯) ‘যে বিষ্ণু শিবের পূজা দেখে প্রণাম করে সে বিষ্ণুলোকে গিয়ে লক্ষ লক্ষ কল্প বাস করে।’ (ঐ ১:১৩:১৩৫) এ ভাবে কালের গতিতে মোক্ষ হীনমূল্য হয়ে যেতে লাগল। ‘বারাণসী নগরীতে পৌঁছেই সে মুক্তিলাভ করল।’ (২:৬:৭২) ‘যে প্রত্যহ বিষ্ণুমন্দির ঝাঁট দিয়ে সেখানে প্রদীপ জ্বালে সে-ও মোক্ষ লাভ করে।’ (ঐ ২:১১:১১) ‘যে গঙ্গাতীরে বাস করে গঙ্গা জল পান করে তার সব সঞ্চিত পাপ বিনষ্ট হয় …যে অগ্নির পূর্ণ উপাসনা করে, পাপ পুণ্যে সে লিপ্ত হয় না।’ (অগ্নি পু. ২১১:২৩-২৪) ভাগবত পুরাণ কিন্তু এত সহজে মোক্ষ লাভের কথা বলে না, বলে, ‘এক হাজার লোক যদি মোক্ষার্থী হয় তবে এক জনের ভাগ্যে তা মেলে।’ (৮:৭:২২) কিন্তু ভগবদ্গীতা-তে আবার কৃষ্ণ মোক্ষলাভকে সহজ করে দিয়ে বলেন, ‘কৃষ্ণ-আশ্রিত জনের সর্ব পাপ-ক্ষমা হয়ে যায়।’ (মহাভারত ৬:৪০:৬৮) ভাগবত পুরাণ বাস্তবিক পক্ষে একটি বৈষ্ণব গ্রন্থ। তবু শিবের বিষয়ে বলে যে, ‘একমাত্র শিবই বন্ধন মোচন করে সারা পৃথিবীকে মুক্তি দেওয়ার অধিকর্তা।’ (৮:৭:২২) কৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের সব ধর্মপন্থা ত্যাগ করে তাঁকে আশ্রয় করতে আহ্বান করেন, তিনি সর্বপাপ থেকে মুক্ত করবেন। শুনলে বাইবেলে যিশুর উক্তি মনে পড়ে: ‘আমিই পথ, সত্য ও জীবন, কোনও মানুষই আমার মধ্যে দিয়ে না এলে পিতার কাছে যেতে পারে না।’ (যোহন সুসমাচার ৪:১৪) এই ধরনের মুক্তির আশ্বাস যা সম্পূর্ণ ভাবে কর্মনিরপেক্ষ, এর সূচনা ভক্তিমার্গের উদ্ভব থেকেই; ভক্তি তখন কর্মের বিকল্প হয়ে ওঠে। কারণ হয়তো এই যে, শাস্ত্র নির্দিষ্ট উপাসনা পদ্ধতি তত দিনে অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছে, ব্যয়সাপেক্ষ তো বটেই, আর বেশ কতকটা গোলমেলেও; বিশেষত, যে মানুষ পরিচ্ছন্ন একটি ছক খোঁজে তার পক্ষে। সে কর্ম, ভক্ত ও জ্ঞানমার্গের মধ্যে সংহতি খোঁজে, আর খোঁজে নিয়তিবাদের সঙ্গে এগুলির সংহতি, কারণ, এগুলির কোনওটিই নিয়তিবাদকে বর্জন করে না। বলা বাহুল্য, এ সংহতির সন্ধান সে পায় না।

ভক্তি ও দেবমণ্ডলীর মধ্যে নিয়তি দৈবানুগ্রহের রূপ পরিগ্রহ করে। সহস্র মোক্ষার্থীর মধ্যে একজন তা পায়, কারণ সে-ই দৈবানুগ্রহ লাভ করে। (মানিকীয় ঈশ্বর) ‘নিজের করুণায় আত্মাকে পুনর্জন্মপরম্পরা থেকে ত্রাণ করেন।’ (ব্লিকার, ১৯৬৩, পৃ. ২৬১) রবিনসন বলেন, ‘পরিত্রাতারা সর্বদাই লোকান্তরের, কখনওই ইহলোক থেকে আসেন না।,’ যেহেতু পরিত্রাতা দিব্য ও লোকাত্তর, তাই অনুগ্রহ সহজেই তাঁদের অনুষঙ্গে পরিণত হয়ে যায়; এবং অসংখ্য মোক্ষকামীর মধ্যে দৈবানুগ্রহই মোক্ষলাভের নির্ধারক হয়। কিন্তু মানুষের কাছে এ দৈবানুগ্রহ নিয়তিরই আর একটি সংজ্ঞায় পরিণত হয়। দৈবানুগ্রহ যোগ্যতালভ্য নয় বলেই একে পূর্ব হতে প্রত্যাশা করা, এর সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা বা এর বিষয়ে কোনও গণনা করা যায় না। গ্লস্টিকদের মতে ‘আলোর জগতের কোনও দূতের আহ্বানে যে দিব্য উদ্ভাস ঘটে, সে দূত বহু লোকান্তরের গণ্ডি পেরিয়ে এসে, তাদের অধিপতিদের বিমূঢ় করে দিয়ে আত্মাকে উদ্বোধিত করে দিব্য জ্ঞান দেয়।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, গ্লস্টিসিজম) এই পরিত্রাণের সঙ্গে খ্রিস্টানের পরিত্রাণের গভীর মিল আছে, উভয়ত্রই পরিত্রাতা স্বর্গ থেকে অবতীর্ণ হন, নরলোককে মুক্তি দেওয়ার জন্যে। অবশ্য বৈষ্ণবশাস্ত্রে বিষ্ণুর অবতার-পরম্পরার সঙ্গেও এর ক্ষীণ সাদৃশ্য দেখা যায়, উদ্দেশ্য একই: মানুষের মুক্তি। উভয়েই কর্মের ভূমিকা নগণ্য, দৈবানুগ্রহই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় তত্ত্ব। আবার দৈবানুগ্রহ বিশ্বজনীন নয়, নির্বাচক, তাই কর্ম ও মুক্তির নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে একটা পূর্বনিরূপণের ক্ষেত্র থেকেই যায়।

বৌদ্ধধর্মে সঞ্চিত পুণ্য বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, যদিও মহাযানে দৈবানুগ্রহেরও প্রাধান্য আছে — মুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে। অনির্দেশ্যতার, অপরিগণ্যতার ক্ষেত্র অনন্ত, তাত্ত্বিক দিক থেকে বৌদ্ধধর্মে ও সেমিটিক ধর্মে অনেক কম তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু শাস্ত্রে নির্দেশিত ধর্ম জনসাধারণ্যে আচরিত ধর্ম থেকে অনেকটাই পৃথক; এবং জনসাধারণের ধর্মে চূড়ান্ত মুক্তি পরিত্রাতার ত্রাণদায়ী দিব্য অনুগ্রহ থেকেই আসুক বা জ্ঞান থেকেই আসুক অথবা কর্মকর্তার পুণ্যকর্ম অথবা আত্মনিবেদনী ভক্তি থেকেই আসুক, একটা পূর্বনিরূপণের অবকাশ থেকে যায়। পূর্বনিরূপণের সব কিছুই যেহেতু রহস্যাবৃত তাই এই পূর্বনিরূপণই হল নিয়তি।

কর্ম ও জন্মান্তরবাদের পক্ষে নিয়তি যা, ভক্তির ক্ষেত্রে দৈবানুগ্রহও তাই। গ্রহীতা যে-মানুষ, তার দিক থেকে দেখলে দৈবানুগ্রহও পুরোপুরি অনির্দেশ্য ও অনিবার্য। এই অংশটি পূর্বগণনাকে অগ্রাহ্য করে, কর্ম ও প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ কর্মের কার্যকারণের সমতাকে অগ্রাহ্য করে এবং মানুষের চিত্তকে বিভ্রান্ত করে তোলে। কিছু পরিমাণে বা পরিসরে একটি অযৌক্তিকতার ক্ষেত্র থাকা ভক্তিবাদ ও মুক্তিদায়ী দৈবকরুণাবাদের পক্ষে অপরিহার্য ছিল, যেমন না বুঝেও সকলে এর জন্যে চেষ্টা করে এবং পায় খুব অল্প জনই। পৌরাণিক ও পুরাণোত্তর যুগে যখন ভক্তি ও পূজার সম্যক বিকাশ ঘটে তখন অন্য এক ধরনের পুরোহিত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হল, যাঁরা মন্দিরে উপাসনার তদারকি করবেন, ব্রত, তীর্থ, মানত, ভবিষ্যদ্বাণী, স্বপ্নব্যাখ্যা ও জ্যোতিষিক গণনার দ্বারা আগামীর পূর্বাভাস নিরূপণ করবেন। নিজেদের স্বার্থেই তাঁরা কতটা অলৌকিক গুহ্য জ্ঞান সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আড়াল করবেন, বিশেষত কে দৈবানুগ্রহ পাবে সে বিষয়ে। সমস্ত শাস্ত্র নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান করতে, পুরোহিতরা দৈনন্দিন জীবন সম্বন্ধে যা নির্দেশ দেন সবই পালন করতে, বিশেষ অনুষ্ঠানগুলিও যথাযথ ভাবে পালন করতে জনতা ভিড় করে সচেষ্ট হবে, কিন্তু এদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যকই দৈবকরুণা লাভের পাত্র হিসেবে ‘নির্বাচিত’ হবে। অন্যেরা সাগ্রহে অনুষ্ঠান করবে, সাড়ম্বরে অর্থব্যয় করবে এ কথা জেনেই যে, দৈব দয়া যাদের ওপরে বর্ষিত হবে তারা পূর্বনির্বাচিত। কাজেই যখন ভক্তি-প্রণোদিত পূজাকর্ম, অন্য নৈতিক ও আনুষ্ঠানিক কর্মের বিকল্পরূপে পরিগণিত হল তখনও কোনও অনির্দেশ্য নিয়তিই সেই স্বল্পসংখ্যক ভাগ্যবানকে বেছে দিত।

যদিও দেখছি, কোরানে নিয়তির কোনও স্থান নেই, তথাপি আরবী ও পারসী দুটি সাহিত্যেই ভাগ্যের ভূমিকা আছে। খ্রিস্টধর্মে নিয়তি তত্ত্বগত ভাবে বহিষ্কৃত; ঈশ্বরই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও সর্বত্রব্যাপী বিধাতা, কিন্তু শাস্ত্র ও সাহিত্য ক্রমে ক্রমে ক্যালম্বিনের পূর্বনিরূপণবাদের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল এবং যদিও এটি বহুতর প্রস্থানের মধ্যে একটা, তবুও এটি একটি প্রধান চিন্তাগত উপাদান, যার সঙ্গে তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘকাল অব্যাহত ছিল। ক্যালহ্বিনের পূর্বনির্বাচন কিন্তু ভারতীয় নিয়তিবাদ নয়; এটা প্রধানত এই কারণে যে এটি ঈশ্বরেই ভবিষ্যজ্ঞান আরোপ করেছিল। ভারতীয় নিয়তির কিন্তু কোনও একটি মাত্র দেবায়িত রূপ নেই। দ্বিতীয়ত, মানুষের অনন্ত আপাতদৃষ্টিতে কতকটা স্বাধীন ইচ্ছার অবকাশ ছিল, এমনকী ক্যালহ্বিন মতেও। তাই যদিও বহু ক্ষেত্রে মানুষের এই স্বাধীন ইচ্ছা তাকে অনিবার্য ও অপরিবর্তনীয়রূপে নিজের ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে দিত, যদি না সে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে পূর্বনিরূপিত হয়ে থাকে, তবু মারাত্মক বিলম্বের পূর্বে তার চূড়ান্ত পরিণতি জানার কোনও উপায়ই থাকে না। ভারতীয় নিয়তিবাদে কিন্তু বস্তুত এমন কোনও চূড়ান্ত অপরিবর্তনীয় নরক বা বিনষ্টির কল্পনা নেই। কারণ এখানে পূর্বজন্মের কল্পনা আছে। কিন্তু সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশে অর্থাৎ অজ্ঞেয়তা, রহস্যময়তা এবং অমোঘতায় ক্যালহ্বিনের পূর্বনিরূপণবাদের সঙ্গে নিয়তিবাদের মিল আছে। বিশেষত, যেখানে ভক্তিবাদের দৈবানুগ্রহতত্ত্বটি উপস্থিত, সেখানে এ দুটি মতের গভীর মিল। এ দুই ধর্মতত্ত্বের কেন্দ্রবস্তু হল, মানুষকে জীবৎকালে তার জীবনের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অন্ধকারে রাখতে হবে। এবং মৃত্যুর পরেও।

এই পূর্বনিরূপণতত্ত্বের মূল হল গ্রিক অতিকথার বহুনামিক ভাগ্যদেবতাগুলির কল্পনা, যা ইউরোপীয় চেতনায় দৃঢ়মূল। মধ্য এশিয়া, সুমের, আসিরিয়া, ব্যাবিলন, মিশর, চিন ও মেক্সিকো সর্বত্রই নানা আকারে ও নামে ভাগ্যনির্ণায়ক দেবতারা নিয়তির রূপান্তর হিসাবে বর্তমান ছিলেন। কোথাও নিয়তি স্বতন্ত্র দেবতা, কোথাও বা দেবমণ্ডলীর অন্তর্গত। পূর্বনিরূপণ নিয়তিবাদের একটি মূল স্তম্ভ, এবং এ তত্ত্বটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে সমস্ত অতিকথাতেই উপস্থিত। ভারতবর্ষেও মুক্তি, মোক্ষ বা নির্বাণতত্ত্বকে নিয়তিবাদের মুখোমুখি আসতে হয়েছে; শুধুমাত্র তার পরেই এগুলি দার্শনিক স্বীকৃতি পেয়েছে। যদিও স্বীকৃতি পাওয়ার পূর্বে, সমকালে এবং পরেও মুক্তিতত্ত্ব ও নিয়তিবাদের অন্তর্নিহিত বিরোধ থেকেই গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *