নিয়তি, কাল ও স্বতন্ত্র ইচ্ছা
জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ দুটিরই উৎস হচ্ছে মৃত্যু, এবং মৃত্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা। প্রাগৈতিহাসিক সমাধিক্ষেত্রের উৎখননে প্রকাশ পেয়েছে মৃত্যু ও মৃতের সম্বন্ধে উদ্বেগ ও পরলোকগত আত্মাকে মরণোত্তর অবস্থায় কিছু আরাম দেওয়ার চেষ্টা। জীবন কখনওই মৃত্যুকে স্বীকার করতে পারে না, যে-মৃত্যু জীবনের অস্বীকৃতি। ‘মানুষ চিরদিনই মৃত্যুতে সাড়া দিয়েছে, (তার প্রতিক্রিয়া এসেছে মৃত্যু সম্বন্ধে), (কারণ) তার বিশ্বাস ছিল জীবনের নকশায় মৃত্যুর কোনও স্থান থাকতে পারে না। এই জন্যেই আমরা পৃথিবীতে মৃত্যুর উৎপত্তি সম্বন্ধে বহু অতিকথা পাই।’ (ব্ল্যাকার, ১৯৬৩, পৃ. ১৪৫) মৃত্যুকে মানুষ যত ভাবে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছে তার একটি হল, জাদু বিদ্যার দ্বারা জীবনকে দীর্ঘতর করার চেষ্টা, শবদেহকে দিয়ে জাদুর সাহায্যে ভবিষ্যদ্বাণী আদায় করার চেষ্টা, রসায়নের সাহায্যে বার্ধক্যে নবযৌবন লাভ করা। এ সবের গভীরে আছে একটি বিশ্বাস: জীবনের কল্পপটের বাইরে মৃত্যু। মানুষ মনে করেছিল যে, মৃত্যুতে জীবনের আত্যন্তিক অবসান অস্বীকার্য। তা ছাড়া, মৃত জীবিতের স্বপ্নে আনাগোনা করে, সে-ও যেন জীবিতের কাছে এক প্ৰমাণ যে, মৃত্যুর পরে দেহটা নষ্ট হয়ে গেলেও আসল মানুষটা বেঁচে থাকে। এ সব থেকেই মৃত্যুর পরের এক জীবন সম্বন্ধে মানুষের বিশ্বাস জন্মায়: স্বর্গে নন্দনকাননে, নরকের শোধনাগারে, খাস নরকে, জ্যোতিষ্কজীবনে কিংবা বিদেশী আত্মা হয়ে ওই আসল মানুষটা কোথাও বেঁচে থাকে। ‘মৃতের অন্ত্যেষ্টি সম্বন্ধে যে উদ্বিগ্ন ব্যবস্থাপনা তার থেকে একটি দৃঢ় বিশ্বাস প্রমাণিত হয় যে, ঠিক মতো প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠান হলে মৃত্যু শুধু একটি অবস্থা পরিবর্তন বলেই প্রমাণিত হবে… মিশরের নবম রাজবংশের (আনুমানিক ২১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের) দারুময় সমাধিভাণ্ডের ঢাকায় ক্ষোদিত প্রাচীনতম লিপিগুলিই আমাদের (এ সম্বন্ধে) প্রাচীনতম নিদর্শন। এগুলিকে বলে ‘কৌণিক (diagonal) নক্ষত্রঘটিকা’ কিংবা ‘কৌণিক পঞ্জিকা’; এতে রাশিচক্রের প্রতি দশমাংশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নক্ষত্রগুলির নাম দেওয়া আছে।’ (হুইটরো, ১৯৮৮, পৃ. ২৩, ২৮)
সারা পৃথিবীতে সর্বকালেই মানুষ মৃত্যুকে জানবার বোঝবার চেষ্টা করেছে, একে বিশ্লেষণ করে এর স্বরূপ বুঝে পরিচিত জীবনের ছকে এর স্থাননির্ণয় করবার চেষ্টা করেছে। মৃত্যুকে বোঝা যেহেতু জীবনের তাৎপর্য বোঝারই একটি অংশ, তাই এই চেষ্টা সার্বত্রিক। এ হল মানুষের পরম একটি আধ্যাত্মিক প্রয়োজন— জীবনের রহস্যভেদ, তার সঙ্গে মৃত্যুরও। যে সময়ে দার্শনিক অনুসন্ধান দেবকল্পের ভাষায় রচিত হত এবং দেবকল্প অনুষ্ঠিত হত ধর্মীয় ক্রিয়ায়, ‘যাঁরা সামাজিক রাজপ্রীতিকে ধর্মীয় মহিমায় মণ্ডিত করেন, সেই ব্রাহ্মণদের লোকোত্তর প্রতাপ আরও দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল মৃত্যুকে একটি সৃষ্টিযোগের ব্যাখ্যা দিয়ে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী যজ্ঞের পরিসরে নিহিত পুনর্জন্মের শক্তিকে (মানুষ) যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট করে এবং এ শক্তির নিয়ন্ত্রণ যজ্ঞকারীকে হাতে সঁপে দেয়।’ (ব্লক অ্যান্ড প্যারি সম্পাদিত, ১৯৮২, পৃ. ৪১) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে ও শবদেহে এ ভাবে পুনর্জননের শক্তি আরোপিত হয়। অন্ত্যেষ্টি একটি গৃহ্যকর্ম, একটি যাগ, যাতে শবদেহই হব্য, যাতে দহন করে ক্রব্যাৎ অগ্নি; এবং এর দ্বারা পুনর্জন্ম নিশ্চিত হয়। যেমন সমাধি হলে পর খ্রিস্টান নিশ্চিত জানে যে, সৃষ্টি-স্থিতির অবসানে দেবদূতের ভেরী বাজবে ও তা মৃতদের অনন্ত জীবনে নিয়ে যাবে। তথাপি মৃত্যু সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা হল, এই অবসানকে এড়ানো যায় না।
সকলকেই মরতে হবে, মহাকাব্য, পুরাণ ও সাহিত্যে এ কথা বারংবার উচ্চারণ করা হয়েছে। ‘মর্তলোকে কেউ অমর নয়, প্রত্যেকেরই একটা নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল আছে।’ (মহাভারত ৩:১৩৬:৫) কেউ আপন কর্মের দ্বারা অমর হয়, কেউ বা মৃত্যুর অস্তিত্বই অস্বীকার করে। ‘মহারাজ, আমার কথা শুনুন, এ-ই যখন ব্যাপার, তখন আতঙ্কিত হবেন না। ওরা দুজনেই ঠিক (কথা বলে); ক্ষত্রিয় যখন নিরুদ্যম হয় তখন মৃত্যু তার মোহ, কবিরাও এ কথা সমর্থন করেন। আমি মৃত্যুকে ভ্রান্তি বলি, সর্বদা সতর্ক থাকাই অমর হওয়া। সনৎসুজাত ধৃতরাষ্ট্রকে এই ভাবে বুঝিয়েছেন।’ (ঐ ৫:৪১:৩-১৪)
মৃত্যু ভয়ংকর, আকস্মিক বা ধীরগতি হতে পারে। সব রূপেই মানুষের মনে মৃত্যু বিভীষিকা সৃষ্টি করে; শুধু যে-মরে তার মনে নয়, যারা দেখে ও বেঁচে থাকে, তাদের মনেও। মৃত্যুর উৎপত্তি সম্বন্ধে মহাভারতে একটি কাহিনি আছে:
জনসংখ্যাবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে ব্রহ্মা একটি নারী সৃষ্টি করলেন, মৃত্যু, তাকে ধ্বংসের দ্বারা জনসংখ্যা কমাবার ভার দিলেন। নারীটি অসম্মত হল, সে সেখান থেকে গিয়ে তপস্যায় বসল। ব্রহ্মা জবাবদিহি চাইলে সে বলল যে, এ নিষ্ঠুর কাজ সে করবে না। ওই ভয়ংকর
আদেশের জন্যে এবং মানুষের মরণের কথা ভেবে তার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। ব্রহ্মা দু’হাতের অঞ্জলিতে অশ্রুবিন্দুগুলি গ্রহণ করে বললেন, ‘এগুলি হবে ব্যাধি, এরাই মানুষকে মারবে।’ (১২:২৭৪)
মৃত্যু সরাসরি হত্যার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেল, মারার দায়টা বর্তাল অন্যত্র, ব্যাধি হল নিমিত্ত। স্বয়ং মৃত্যুর মনে এই করুণার সঞ্চার বেশ একটা নতুন তত্ত্ব; অবশ্য মৃত্যু এখানে একটি নারী। অন্য সর্বত্র, মহাকাব্য, পুরাণ ও সাহিত্যে মৃত্যু ভয়ংকর এক পুরুষ। রাবণের অন্তঃপুরে রাক্ষসী ত্রিনেত্রা (রাবণের) আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে স্বপ্ন দেখে, সেখানে মৃত্যু করাল ও ভয়াবহ। হরিবংশ-এ ‘অধর্মে’র স্ত্রী ‘বিষ্টি’র তিন পুত্র ‘ভয়’, ‘মহাভয়’ ও ‘মৃত্যু’। মৎস্যপুরাণ-এ ‘বিষ্টি’ কালের নারীরূপ, এ কাল হল সময় ও মৃত্যু। (১১:১২) কোনও কোনও দেবকল্প শিবের সংহারমূর্তির সঙ্গে মিলিয়ে তাঁকে মৃত্যুর দেবতায় পরিণত করেছে। শিবের প্রকৃত তাৎপর্য ব্রহ্মার মনে উদিত হয়, তিনি ইন্দ্রকে তা জানান, ইন্দ্র আবার মৃত্যুকে জানান, যাঁর কাছ থেকে একাদশ রুদ্র এ জ্ঞান লাভ করেন এবং শেষ পর্যন্ত এঁরা মানুষ তণ্ডিকে এ জ্ঞান সমর্পণ করেন।’ (মহাভারত ১৩:১৭ )
ভারতীয় দেবকল্পনায় খাঁটি মৃত্যুর দেবতা হলেন যম, যিনি প্রথমে মর্ত্য ছিলেন এবং মৃত্যুর পরে অমরত্ব প্রাপ্ত হয়ে এক আনন্দলোকে উত্তীর্ণ হন। ঋগ্বেদে তিনি মর্ত্যমানুষকে মৃত্যুর পরে সেখানে আমন্ত্রণ করেন এবং তাদের আদর-যত্ন, আপ্যায়ন করেন, তাদের সঙ্গে খাদ্য পানীয় গ্রহণ করেন। লক্ষণীয়, এই সময়ে যমের কোনও ভয়াবহতা বা সন্ত্রাসের অনুষঙ্গ ছিল না। জন্মান্তর ও কর্মবাদের উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে যম আমূল পরিবর্তিত হলেন, ‘মৃতদের দেবতা’ থেকে তিনি এখন ‘মৃত্যুর দেবতা’ হয়ে গেলেন— করাল, ভয়াবহ ও ক্রুর। (যমের দেবকল্পনা সম্বন্ধে দ্রষ্টব্য বর্তমান গ্রন্থকারের দি ইন্ডিয়ান থিওগনি, দ্বিতীয়, তৃতীয় এ চতুর্থ অধ্যায়)
গ্রিসে মৃত্যুর দেবতা ছিলেন ‘কের’, আরও একটি রূপ ‘থানাটস’। থানাটসের প্রতি উদ্দিষ্ট ‘অর্ফিক’ স্তোত্রে আছে, ‘শুধু তোমারই জন্যে সকলের বিচার হয়; একমাত্র তোমাকেই প্রার্থনা ও মিনতিতে টলানো যায় না।’ (সংখ্যা ৮৭, পঙ্ক্তি ৮) মৃত্যুর কেল্টিক প্রতিরূপ হল ‘মরিগান’। আয়ারল্যান্ডে, ‘মৃত্যুর রথের চালক মুণ্ডহীন, কৃষ্ণ কিংবা কবন্ধ অশ্বগণ। ব্রিটানিতে ‘আনকু’র রথের চালক মৃত্যু, সে একটা দীর্ঘকায় কৃশ কঙ্কাল মাত্র।’ (এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, এথিক্স ‘ফেট’)
যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ-এ মৃত্যুকে কালের সঙ্গে অভিন্ন দেখানো হয়েছে:
সে মুষিকের মতো জীর্ণ দেহটিকে চিহ্নিত করে এবং মারাত্মক বিষাক্ত ব্যাধিগুলি দেহের সেই গর্তে আশ্রয় নেয়। বিষধর সাপেরা যেমন অরণ্যবায়ুকে শুষে নেয় তেমনি করেই এরা জীবনকে শুষে নেয়।… মৃত্যু সেই ভাবেই মানুষকে তাক করে এগোয় যেমন বিড়াল ইঁদুরকে।… সে ব্যক্তিই সুখী যে পৃথিবীকে উপভোগ করতে চায়, আকাশ থেকে চাঁদকে ধরতে চায়; কেমন করে সে সুখ লাভ করবে? তটভূমির গাছটিকে যেমন নদী উন্মূলিত করে তেমনই করে জরা দেহকে উন্মূলিত করে। (বৈরাগ্য ১৬:১৭, ১৯; ২২:২)
কাজেই জীবন মৃত্যুর দ্বারা গূঢ় ভাবে প্রতারিত হয়, যেমন শিকারী তার বধ্য জন্তুকে লুকিয়ে প্রতারণা করে। এই কল্পের অবসান ঘটাতে শেষ অবতার কল্কি যে মহাবিশ্বে প্রলয় আনবেন, সে বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘কোথা থেকে কাল, কোথা থেকে মৃত্যু, যম কে? দেবতাটি কোথায়? কল্কি-দেবই মায়ার দ্বারা বহুগণিত হয়ে (এই সব হয়েছেন)।’ (কল্কি পু. ৩:১:৩৬) অন্যান্য কিছু অতিকথাতেও এই প্রলয়ান্তিক দৃশ্য বিবৃত হয়েছে।
রাবণের শক্তিশেলে লক্ষ্মণ যখন অজ্ঞান, তখন রাম বিলাপ করছেন, ‘না জানি পূর্বজন্মে কী পাপ করেছি, যার জন্যে আমার ধার্মিক ভাই মরে পড়ে আছে।’ (রামায়ণ ৬:১০১:১-২) যখন লক্ষ করি দেবতারা রামকে বলেন, ‘সীতা লক্ষ্মী, তুমি বিষ্ণু এবং কৃষ্ণ হলেন প্রজাপতি’ (৬:১০৭:২৭) তখন ধাঁধা লাগে, কারণ বিষ্ণুরূপে রাম কেমন করে পাপ করবেন? কিন্তু রাম সীতা উভয়েই দীর্ঘকাল দুঃখভোগ করেছিলেন যখন তাঁরা রাবণ ও রাক্ষসদের বিনাশের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। স্বর্গে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীরূপে তাঁদের পাপ করার কথাই ওঠে না। মন্দোদরী রাবণের মৃত্যুর পর বিলাপ করছেন, ‘স্বামিন, কর্মকর্তাকে যথাকালে কৃতকর্মের ফলভোগ করতেই হয়, এতে কোনও সন্দেহ নেই। পুণ্যকৃৎ শুভফল পায়, পাপী অশুভ ফল।’(৬:১১১:২৫,২৬) দুরাত্মা রাবণ তার পাপের প্রতিফল পেল, সেটা বোঝা যায় কিন্তু দেবতারা পূর্বজন্মের পাপের ফলে এত দীর্ঘ ও গভীর দুঃখ পাচ্ছেন এ কথা মানা শক্ত। অথচ সমস্ত রামায়ণে কোথাও বলা হয়নি বালীকে ও শম্বুককে অন্যায় ভাবে বধ করার ফলে রামের এ দুঃখভোগ, অথবা নিরতিশয় নিষ্ঠুর ও গর্হিত ভাবে সীতাকে প্রত্যাখ্যান ও পরিত্যাগের ফলে তাঁর এ কষ্ট; এমনকী, এগুলি যে অন্যায় কাজ তা-ও কোথাও বলা হয়নি। তা হলে হয়তো রামের দুঃখভোগের ব্যাখ্যা পাওয়া যেত। কিন্তু সীতা? এই পবিত্র পতিগতপ্রাণা নারীর দুঃখভোগের কী হেতু থাকতে পারে? এক বার শুধু অন্যায় ভাবে লক্ষ্মণকে তিরস্কার করেছিলেন— যেটা তাঁর তৎকালীন মানসিক অবস্থায় খুব অস্বাভাবিক ছিল না। এ ছাড়া তিনি তো আর কখনওই কোনও অন্যায় করেননি, অথচ কী নিষ্করুণ তাঁর দুঃখভোগ, রামের দুঃখের বহুগুণ বেশি তাঁকে ভোগ করতে হয়েছিল। এ দুঃখ কোনও মতেই তাঁর পূর্বকর্মের ফল বলে মানা যায় না।
শম্বুকের বধে দেবতারা প্রীত হয়েছিলেন, সীতা অগ্নিপ্রবেশ করবার সময়েও তাঁরা এলেন সীতার নিরাপরাধত্ব প্রমাণ করতে, কিন্তু রামকে একটি বারও বললেন না যে, নিষ্পাপ বধুকে ত্যাগ করতে চাওয়াই মহাপাপ। মনে হতে পারে, রাম-অবতারে তিনি এই যে সব নীতিবিগর্হিত কাজ করলেন তার দণ্ড জন্মান্তরে পাবেন; কিন্তু মহাকাব্যের শেষে রাম সোজা স্বর্গে গিয়ে বিষ্ণু হয়ে বসলেন মহা ধূমধামে ও দেবতাদের স্বাগতধ্বনির মধ্যে। কাজেই রাম-জন্মে কৃত বেশ কিছু অন্যায়ের কোনও মূল্য দিতে হল না তাঁকে।
ধার্মিক উত্তানপাদের মৃত্যু যখন আসন্ন, ‘তখন তাঁর অন্ত-কে মনে হল যেন সে মৃত্যুর ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘর বেয়ে উঠছে… তিনি তপস্যা করতে লাগলেন, বেদপাঠ করলেন শতলক্ষ বছর ধরে, হৃষীকেশের উপাসনা করলেন এবং শেষে দুর্ধর্ষ, প্রায়-অজেয় মৃত্যুকে জয় করলেন।’ (ভাগবত পু. ৪:১২:৩০; ১২:৮:১১) এখন মৃত্যুকে এমন ভাবে দেখানো হয়েছে, যেন সৎকার্য ও কোনও পরিত্রাতা দেবতার প্রতি ভক্তি দিয়ে তবে তাকে জয় করা যায়। কিন্তু সাধারণ মর্ত্য মানুষের পক্ষে মৃত্যু অমোঘ, অজেয়। ‘ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মতো দেবতাদেরও মৃত্যু ভক্ষণ করেছে, কাজেই হীনতর জীব সম্বন্ধে আর কী বলা যায়?’ (দেবীভাগবত পু. ১০:১৩:৫১)
বৌদ্ধ ধর্মে মৃত্যুর প্রতিরূপ কাম ও মার-কে কখনও কখনও মৃত্যুর সঙ্গে অভিন্ন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মার সম্বন্ধে ফুসমান বলেন, ‘প্রাচীন ভারতীয় ধর্মের নতুন একটি সমস্যা হল, হিন্দুকুশের কাফিররা যারা মারের ওপরে দেবত্ব আরোপ করে। তাদের অবশ্য এর পরের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়: মার যদি গৌণ একটি দেবতা হন… বৌদ্ধ শাস্ত্র প্রবক্তারা কেমন করে মার-কে ইন্দ্রের ওপরে স্থান দেন? এর উত্তর, আমার মতে স্পষ্ট: এই সব উপকথা সে যুগে রচিত, যখন মার-কে দেবরাজ বলে ভাবা হত।’ (জুর্নাল আসিয়াতিক, ১৯৭৭, ১ ও ২, পৃ. ৫২) অতএব কিছু লোকের মধ্যে কোনও কোনও এক যুগে মৃত্যু বা মার’ই শ্রেষ্ঠ দেবতা ছিলেন। এ কথা আরও স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয় যখন দেখি মৃত্যুর কাছে জীবন মার খাচ্ছে। এ ছাড়াও মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে সর্বকালে সর্বদেশে মানুষ কেমন মরিয়া হয়ে মৃত্যুর ওপরে একহাত নিতে চেয়েছে, এবং ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য গিলগামেশ-এ প্রয়াসটি সুন্দর ভাবে চিত্রিত হয়েছে। ‘মানুষকে সৃষ্টি করার সময়ে দেবতারা তাদের ভাগ্যে নিরূপণ করলেন মৃত্যুকে, নিজেদের মুঠোয় শক্ত করে রাখলেন জীবনকে।’ (ব্লীকার, ১৯৬৩, পৃ. ১৩৮) গিলগামেশ আদি পূর্ব-পুরুষ উতনাপিশতিম-এর কাছে গেলেন অমৃতের সন্ধানে, সেই পূর্বপুরুষের কাছে পৌঁছবার পথে বিস্তর বাধা অতিক্রম করলেন কিন্তু তিনি গিলগামেশ কে এ সন্ধান থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন। গিলগামেশ কিন্তু নিজের লক্ষ্যে ও প্রার্থনায় দৃঢ় হয়ে রইলেন। অবশেষে প্রার্থিত বস্তুটি লাভ করে ফিরে এলেন। পথে নদীতীরে ঘাসের ওপরে অমৃত রেখে স্নান করবার জন্যে নদীতে নামতেই জল থেকে একটি সাপ উঠে এসে সেটি গ্রাস করল এবং তৎক্ষণাৎ খোলস ছাড়ল। মনে পড়ে, ভগবদ্গীতায় জীর্ণ বাস ত্যাগ করা জন্মান্তরের উপমান; এর পশ্চাতে সাপের খোলস ছেড়ে নতুন পরমায়ুলাভের তথ্যটিই হয়তো সক্রিয়। যাই হোক, অত্যন্ত চতুর ভাবে উতনাপিশতিম নিজের অভীষ্ট সিদ্ধ করলেন, মানুষকে আশার ছলনায় প্রলুব্ধ করে অবশেষে বঞ্চনা করলেন। এবং অমৃতত্ব নিজের জন্যেই সংরক্ষণ করলেন।
মানুষের ভাগে তা হলে মৃত্যু। বৃহদারণ্যক উপনিষৎ বলে, মর্ত্য প্রজাপতি অমর দেবতাদের সৃষ্টি করেন। ‘যেহেতু স্বয়ং মৃত্যু হয়েও তিনি অমর দেবতাদের সৃষ্টি করেন, তাই সৃষ্টিই তাঁর চরম কৃতিত্ব।’ (১:৪:৬) এটি একটি আশ্চর্য শাস্ত্রবাক্য, যেখানে প্রজাপতিকে মর্ত্য বলা হয়েছে; কারণ বৈদিক সাহিত্যে যম ছাড়া আর কোনও দেবতাকে মর্ত্য বলেননি। (যদিও ইন্দ্র, অশ্বিনরা এবং হয়তো ঋভুদেরও অমর হওয়ার আগে মর্ত্য ইতিহাস একটা ছিল।) মানুষ এবং দেবতার এই পার্থক্য— মরণশীলতা ও অমরত্ব— এর ফল এ দুটো দল সম্পূর্ণ পৃথক জাতে চলে গেল; পরস্পর নির্ভরশীল, তবুও এই দারুণ বঞ্চনার জন্যে মানুষের একটা গোপন প্রতিবাদ রয়ে গেছে দেবতাদের সম্বন্ধে।
এই প্রতিবাদের একটা কারণ হল মানুষের ভাগ্য বিশেষত অদৃষ্টরূপে অনেকটাই দেবতাদের হাতে। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বলেন, ‘ঈশ্বর হলেন জাদুকর, মানুষ তার জাদুর পুতুল। নিজের সুখদুঃখ সম্বন্ধে মানুষ কিছু জানে না, (সেগুলি নিয়ন্ত্রিত করবার) কোনও ক্ষমতাও নেই তার।… ঈশ্বরের ক্রিয়াকলাপকে দেখতে হবে সেই রকম স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য থেকে উত্থিত ক্রিয়া হিসাবে ঠিক যেমন মানুষের।… মানুষেরই মতো ঈশ্বরকে তাঁর কৃতকর্মের ফল তাড়া করে ফেরে, তাই তিনিও মানুষেরই মতো নৈতিক বিচারের অধীন।’ (মহাভারত ৩:৩১১:২১-৩৯; ভগবদ্গীতাতেও এই মর্মের কথা পাই; ২:১৮:৬১) এখানে দ্রৌপদীর মূল বক্তব্য যুক্তিনিষ্ঠ; মানুষ ও দেবতার মধ্যে খুব সামান্যই পার্থক্য; উদ্দেশ্য, কর্ম, কর্মফলের সুখদুঃখভোগ, প্রেরণা এ সবই উভয়ের ক্ষেত্রেই স্বার্থপ্রণোদিত। তবুও দেবতারা মানুষের ঊর্ধে, মানুষের ভাগ্যের নিয়ন্তা। ঈশ্বরবাদী ধর্মগুলিতে প্রাক-নিরূপণের নিষ্ঠুর তত্ত্বকে একটু কোমল করে আনা হল, অনিবার্য ঘটনাগুলি ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন বলে নির্দেশ করে। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব সোশাল সায়েন্সেস পৃ. ১৩৬) যদিও অধিকাংশ ধর্মেই ভাগ্য এবং ঈশ্বর বা দেবতাদের মধ্যে একটি আপাতবিরোধ আছে, তবু এ দুটি তত্ত্বই একত্রে সহাবস্থান করে থাকে। ফলে দৈবের সঙ্গে দেবতার সম্বন্ধ একটি গভীর রহস্যে আবৃত। মহাভারত বলে, ‘কর্মের— পাপ ও পুণ্য দুয়েরই— ফল, উত্থান ও পতন, দেবতাদের কাছেও রহস্যময়। (৩:৩২:৩৩) দ্বিতীয় পাশাখেলার আগে যুধিষ্ঠির দুর্নিবার ভাবে খেলায় আকৃষ্ট হয়ে বলছেন, ‘জীব ভাল মন্দ (ফল) ভোগ করে দৈবের নির্দেশনায়।’ (২:৬৭:৩) প্রায় এই ধরনের আর একটি উক্তি হল, ‘দেবতারা যাকে ধ্বংস করতে চান, তাকে বুদ্ধিভ্রষ্ট করেন, সে (সব কিছুই বিপ্রতীপ দেখে।’ (২:৭২:৮) ধৃতরাষ্ট্র নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করার জন্যে ব্যাসকে বললেন, ‘দেব, আমি এই খেলায় আনন্দ পাই না, আমার মনে হয় নিয়তি আমাকে জোর করে (খেলায়) প্রবৃত্ত করেছিল।’ (৩:১০:১) অন্যত্র ব্যাস কর্ম সম্বন্ধে বলেন, ‘হয় ঈশ্বর কর্তা, নয় মানুষ। মানুষ কর্ম করে, ফল কিন্তু ঈশ্বরের কাছে যায়। পৃথিবীতে আপতিক ঘটনা ঘটে, অথবা ফলটি যে কর্মেরই, সে স্মৃতি তার থাকে। (মানুষ) ভাল মন্দ কর্ম করে ঈশ্বর দ্বারাই প্রণোদিত হয়ে।’ (১২:৩২:১১,১২)
সাবিত্রী সত্যবানের কাহিনি শুরু হয় পূর্বনিরূপণ থেকে; সত্যবানের পরমায়ু ফুরোবে এক বছরের মধ্যে, এবং তা-ই হতে চলেছিল; যম তাঁর প্রাণ নিতেই এসেছিলেন। তার পর বিপ্রতীপ ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয়: সাবিত্রী তর্ক করে, মিনতি করে, অনুনয় ও স্তুতি করে, শাস্ত্রবাক্য উদ্ধৃত করে, শাস্ত্র অনুসন্ধিৎসুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং শেষ পর্যন্ত যমের কাছে এমন বর আদায় করে যা সত্যবানকে না বাঁচালে সফল হতে পারে না। যম, সত্যবানের নিয়তি, যখন সাবিত্রীর কথা রাখলেন তখন কিন্তু তার পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য বিফল হল। কিন্তু এর সমাজতাত্ত্বিক দিক বাদ দিলেও এটি একটি বিরল ব্যতিক্রম।
কাজেই ঈশ্বর, দেবতা ও দৈবের মধ্যে একঠি অন্তর্নিহিত বিরোধ আছে: যম তাঁর নিয়তি-ভূমিকা— যে-নিয়তি পূর্বনির্ধারণ হিসাবে যথার্থ বিচার— তার থেকে সরে এসে বরতাদা দেবতা হলেন। বিরোধটা রয়ে গেল, এ উপাখ্যানের উপজীব্যে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে। ঈশ্বরকে ভাগ্য নিয়ন্তার ভূমিকায় দেখে মানুষ ভাগ্য সম্বন্ধে আর এটা ভাবতে পারে না যে ভাগ্যের বিচারে (কোনও) নৈতিকতা আছে; যেমনটা সে যখন ভাগ্যকে দেখে এক নৈর্ব্যক্তিক যান্ত্রিক শক্তি হিসাবে।… যদি আমরা নিয়তিবাদের সেই ভূমিকায় বিশ্বাস করি যাতে মানুষের ভাগ্য নির্ব্যক্তিক নিয়তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, স্পষ্টতই অন্তত তত্ত্বগত ভাবে, নিয়তিবাদ ভাগ্যের নিয়ন্তা হিসাবে ঈশ্বর বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিরোধী হয়ে ওঠে।’ (রিংগার্ন, ১৯৫৫, পৃ. ১২৪) যথার্থ নিয়তিবাদে ঈশ্বরের কোনও স্থানই নেই, উভয়ের মধ্যে দার্শনিক বিরোধ আছে। সবই, সম্পূর্ণ ভাবে সব কিছুকেই— প্রকৃতি, সমাজ, কর্ম, মানুষের চিন্তা (এ সব কিছুকেই) কোনও ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের অধীনে এনে ফেলা হয়েছে।’ (দুহূের্জের, ১৯৮৭, পৃ. ১১৩)
কিন্তু যদি ঈশ্বরকে বিশ্বের ও মানুষের জীবনের তাবৎ অসঙ্গতির সমাধানের জন্যে উপস্থাপিত করতে হয়, তা হলে আমাদের সামনে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র আসে। এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন চতুর্থ এজরা (৩:২০), যার ভাষ্যে এডওয়ার্ড স্টোন লিখেছেন, ‘… প্রাথমিক ভাবে জগতের অবস্থা সম্পর্কে দায়িত্ব ঈশ্বরে আরোপ করবার চেষ্টা (হয়)… কারণ, ঈশ্বর শুধু পাপ করবার অনুকূল দুর্বলতা দিয়েই মানুষকে সৃষ্টি করেননি, (বরং) এ ভাবে সৃষ্টি করবার পর তিনি মনুষ্যজাতি ও ইজরায়েলকে পাপের জন্যে শাস্তি দিতে গেলেন… ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে এ একটা প্রত্যাহ্বান… ঈশ্বরের দয়ালু কাজকর্মের বিবৃতির দায় ঈশ্বরেই ফিরে যায়, তাঁর নিজের ন্যায়-বিচারের কাঠগড়ায় বিচারিত হওয়ার জন্যে তাঁকে হাজির হতে হয়। উৎপত্তিস্থলের এই পরিবর্তন… লেখকের ধর্ম সম্বন্ধে দুঃসাহসের পরিচায়ক… শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিধানে পূর্বনিয়ন্ত্রণের ভূমিকা স্বীকার করে নেন।’ (ব্লক, বার্দা ও ম্যাসফিল্ড ১৯৮৮, পৃ. ১৩৩, ৩৪) কারণ এ বিশ্বাস তখন সমাজে ওতপ্রোত ভাবে বিদ্যমান ছিল এবং সমাজ শাস্ত্রে তারই সমৰ্থন খুঁজত।
প্রাচীন গ্রিসে ভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের নানা দেবতা ছিল। আমরা দেখেছি, কী ভাবে ঈশ্বর বা দেবতার সঙ্গে মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তার ভূমিকা নিয়েই নিয়তির বিরোধ। কিন্তু যে কোনও যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত কার্যকারণের সঙ্গেই নিয়তিবাদের আত্যন্তিক বিরোধ। পূর্বগত কারণ থেকে অনিবার্য ভাবে পরের কার্য আসে, এ-তত্ত্ব এত স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন যে এর মধ্যে নিয়তির অনুপ্রবেশের কোনও অবকাশই নেই; অথচ কার্যকারণবাদে প্রতিষ্ঠিত কর্মবাদ ও নিয়তিবাদ যুগ যুগ ধরে প্রায় সব দেশেই সহাবস্থান করছে। গ্রিক ভাগ্যদেবী ‘তুখে’ সর্বদাই সক্রিয়, কিন্তু যে সব ঘটনার অন্য কোনও কারণ দেখা যায় না, সেখানেই তার স্পষ্ট প্ৰকাশ। আদ্রাস্টাইয়া বস্তুজগতের ঊর্ধে, এমনকী দেবতাদেরও ঊর্ধে নীতিগুলি স্থাপন করেন। ‘হাইমারমেনে’ সেই নীতিগুলির স্থাপয়িত্রী, যেগুলির ওপরে এই বস্তুজগৎ প্রতিষ্ঠিত। তিনটি ভাগ্যদেবী জেউসের সচিব, এঁদের কাজ (জেউসের) বিধানের দলিল ও হুকুমনামা সংরক্ষণ করা। (সৌভাগ্যদেবী) হঠাৎ হঠাৎ ভাগ্যদেবীর কাজের মধ্যে ধুমকেতুর মতো উদয় হন, আকস্মিক অদৃষ্টপূর্ব ব্যত্যয় ঘটান। পূর্বানুমেয় ঘটনাতে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি ভবিষ্যতের অনুমেয় কার্যকারণ সম্বন্ধে ওপরেও কিছু নিয়ন্ত্রণের দাবি রাখেন। এবং— এর দ্বারা যথাযথ শাস্তি পুরস্কারের নিয়ন্ত্রী ‘নেমেসিস’ এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এপিকিউরিয়ান মতবাদে ঘটনা কার্যকারণ সম্বন্ধে যুক্ত নয়, হয় দৈবের ফলে ঘটে, নয় অনির্দেশ্য স্বাধীন ইচ্ছার প্রভাবে।’ (ডিকশনারি অব আইডিয়াস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২২৮-২৯)
লক্ষণীয় যে, অধিকাংশ ভাগ্যবাচক দেবদেবী জেউসের অধীনেই কাজ করেন; কিন্তু জেউসকে কখনও ভাগ্যের চূড়ান্ত বিধায়ক বলে উপস্থাপিত করা হয়নি, ‘এমনকী মহাবিশ্বের বা মানবজীবনে ন্যায়ের প্রতিভূরূপেও দেখানো হয়নি। নিয়তি তাই সেই সব দেব-দেবীর অধিকারের আশ্রয়, যাঁরা বস্তুত প্রায় স্বাধীন ভাবেই কাজ করেন, তাঁদের নিজেদের ন্যায়বুদ্ধির ওপরে নির্ভর করে, যেহেতু তাঁদের বিচার এবং সে-বিচারের যুক্তিগত সামর্থ্য মর্ত্য মানুষের কাছে কদাচ ব্যাখ্যা করা হয় না, দেবদেবীর ভূমিকা তাই মানুষের কাছে গাঢ়, দুর্ভেদ্য তমসাচ্ছন্ন প্রতীয়মান হয়। এ লক্ষণটি সার্বত্রিক এবং সেই সব দেবকল্পেই বিদ্যমান যেখানে দেবদেবী ও নিয়তি সহাবস্থান করে।
যদি গ্রিক সভ্যতার পরবর্তী একটি যুগের দিকে তাকাই, তা হলে অর্ফিক স্তোত্রগুলিতে মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু দেবদেবীর নিদর্শন পাই। ধনরাজ, পাতালের অধিপতি প্লুটোর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দৃশ্য ও অদৃশ্য কর্মের পুরস্কারদাতা একমাত্র তুমিই।’ (স্তোত্র ১৮, পঙক্তি ১৬) হেরাক্লেসের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দুর্ভাগ্যকে বিষাক্ত তীর দিয়ে দূরে সরিয়ে দাও।’ (১২ পঙক্তি ১৬) ভাগ্যের প্রচলিত দেবী ময়রাদের বলেন মানুষকে সেখানে নিয়ে যেতে যেখানে পৃথিবীকে ধারণ করে যে রথ, তার অনুসরণ করে ন্যায়বিচার; আশা ও দুশ্চিন্তার ওপারে। (৫৯, পৃ. ৮,৯) অন্য এক ভাগ্যদেবী নেমেসিসের বিষয়ে শুনি, ‘মানুষের ন্যায়বিচার তোমার মধ্যেই।’ (৬১, পৃ. ৯) অপর ভাগ্যদেবী ডিকে’র উদ্দেশে বলা হচ্ছে, ‘দুর্নামের মাধ্যমে সব কিছু ঘটে, যার বিচার মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য, (কারণ) তারা অসাধু পরামর্শই চায়, তুমিই একমাত্র যে অসাধুদের জন্য ন্যায়বিচার করবার জন্যে এগিয়ে আসো। হে অবিচারের শত্রু, দয়া করে যেন সাধুদের পুরস্কার দিও।’ (৬২, পৃ. ৬-৯) এনোমোস নামের নিয়তিদেবীকে বলা হচ্ছে, ‘কারোর প্রতিই অমঙ্গলবাসনা নেই, হে ন্যায়নিষ্ঠ (দেবী), দুর্বৃত্তদের ওপরে হানো দারুণ অমঙ্গল।’ (৬৪, পৃ. ১০,১১) প্রতিশোধপরায়ণ ন্যায়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এনরয়েসদের বিষয়ে শুনি, ‘যাঁরা সর্বদাই মানুষের অসংখ্য জাতির প্রতি সুবিচারের দৃষ্টিতে তাকান: যাঁরা চিরন্তন বিচারকারিণী। ভাগ্যদেবীরা, নাগবেণী, বহুরূপিণী।’ (৬৯, পৃ. ১০-১৩) প্রায় সমান ভূমিকার দেবীরা হলেন এউমিনিডেস ‘যাঁরা দুষ্কৃতিকারীদের জীবন লক্ষ করেন, অসাধুদের দণ্ড দেন…’ (৭০, পৃ. ৪,৫) মেইলিনো-র বিষয়ে বলা আছে তিনি ‘বিভীষিকার কল্পনা দিয়ে মানুষকে উন্মুক্ত করে’ তোলেন, (বিভীষিকাময়) আকৃতির রূপ প্রকাশ করেন অদ্ভুত কল্পনায়। কখনও প্রকাশ্য, কখনও ছায়াচ্ছন্ন; মসীলিপ্ত রাত্রের নৈশ এই (দেবী)-র ক্রুর আক্রমণ।’ (৬১, পৃ. ৬-৯) সুপরিচিত নিয়তিদেবী ‘তুখে’র সম্বন্ধে শুনি, ‘কাউকে তুমি সমৃদ্ধিমান ঐশ্বর্য্যের ভাণ্ডার দাও, আবার অন্য কাউকে (দাও) দৈন্য, যাতে (তার) অন্তরাত্মায় জমে ওঠে ক্রোধ।’ (৭২, পৃ. ৭,৮)
কতকটা প্রাচীন হল হোমারের নামে প্রচলিত স্তোত্রগুলি, যাতে দেব কল্পনা-বিধৃত এই সব দেবদেবীদের চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে। কাল্লিডিকে ডিমিটারকে বলছেন, ‘জননি, দেবতারা মর্তে আমাদের যা (যে ভাগ্য) পাঠান তা-ই বাধ্য হয়ে সহ্য করতে হয়, যদিও তাতে বেদনা বোধ করি, কেননা তাঁরা আমাদের চেয়ে বহুগুণে শক্তিমান।’ (২ পৃ. ১৪৭-৪৮) পীথীয় এপোলোর উদ্দেশে নিবেদিত তৃতীয় স্তোত্রটিতে আছে, ‘এখন এই যে আমরা জাহাজে এখানে এসেছি, একেবারেই স্বেচ্ছায় নয়— অন্য পথে এবং অন্য দিক দিয়ে- খুশি হয়েই ফিরে যেতাম। কিন্তু এক অমর দেবতা (আমাদের) ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের এখানে এনেছেন। (৩ পৃ. ৪৭০-৭৪) চতুর্থ স্তোত্রে হের্মেসকে আহ্বান করা হচ্ছে, সেখানে এপোলো বলেছেন, মানুষের ব্যাপারে, আমি ক্ষতি করব, কারও-বা উপকার করব। যে-কেউ পাখির ডাক বা ওড়ার ধ্রুব চিহ্ন দেখে আসবে, সে আমার বাণীর দ্বারার উপকৃত হবে এবং আমি তাকে প্রতারণা করব না। কিন্তু যে যেমন-তেমন পাখির ডাকে বিশ্বাস করে আমার ভবিষ্যৎবাণীর ক্ষমতাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আহ্বান করে এবং অমর দেবতাদের চেয়ে বেশি বুঝতে চাইবে, আমি ঘোষণা করছি, তার যাত্রা নিষ্ফল হবে।’(৪ পৃ. ৫৪১-৪৫) অর্ধমানব-অর্ধছাগ দেবতা পানকে বলা হচ্ছে ‘সৌভাগ্যদাতা দেবতা’। (১৯ পৃ. ৪০) বিশ্বজনীন ধরিত্রীকে বলা হচ্ছে, ‘তোমারই সাধ্য আছে মর্ত্য মানুষকে জীবন দেওয়ার ও তা কেড়ে নেওয়ার।’ (৩০ পৃ. ৭-৯) এবং পরিশেষে দিয়সকুরয়কে (গ্রিসের অশ্বিনৌ) বলা হচ্ছে, ‘যাঁরা পৃথিবীতে মানুষের পরিত্রাতা আর দ্রুতগামী তরণীও, (তাঁরা) যখন নিষ্ঠুর সমুদ্রের ওপরে ঝোড়ো বাতাস তছনছ করতে থাকে। (তখনও)।’ (৩৩ পৃ. ৫-৭)
এই উদ্ধৃতিগুলিতে দেখি যে মানুষ সুবিচারের জন্যে এই সব দেবতাদের ওপরে নির্ভরশীল, আর প্রায়ই এঁদের দৈবের সঙ্গে একাত্ম করে ভাবে। অর্থাৎ ভাগ্য বা যে অদৃশ্য শক্তি মানুষের প্রতি বিচার করে তার নিয়ন্তা দেবতারা। এতে দেবতাদের দেবসুলভ মহিমা আছে, মানুষের প্রতি দয়া, অনুগ্রহ প্রায়ই নেই, বরং কতকটা ঔদাসীন্যই আছে। এ তত্ত্বের অসঙ্গতি মানুষকে বিচলিত করেনি। তথাপি কোনও আধুনিক লেখক যিনি গ্রিক মহাকাব্যে ও নাটকে দেবতাদের ভূমিকা সম্বন্ধে ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখেন তাঁর কাছে চিত্রটি অনেকটা অন্য রকম। কোনও সময়েই মানুষ দেবতাদের কাছে খেলনা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। ‘হেকাটে’ ও কাল্লিওপে’ মানুষ সম্বন্ধে আগ্রহী। ‘প্রথমজন সদ্যোজাত শিশুকে রক্ষা করেন, কিন্তু এ ছাড়া তাঁর প্রসাদ নেহাৎ খেয়ালখুশি মতো যোদ্ধা ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে বিতরণ করেন… দ্বিতীয়জন বুদ্ধিমান রাজন্যদের বাগ্মিতা দান করেন যাতে তাঁদের রাজনৈতিক সুবিধা হয়। কিছু লোক অবশ্যই দেবতাদের কাছ থেকে প্রসাদ পান যার দ্বারা বিত্ত ও বুদ্ধিমত্তার বৈষম্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সাধারণ ভাবে মানুষের ভাগ্য কিন্তু এই পক্ষপাতী হস্তক্ষেপের দ্বারা উন্নতিলাভ করে না।’ (গীস ১৯৭১, পৃ. ১৩৩) হেসিয়ডের থিয়গনিতেও এ কথা প্রতিপন্ন হয়: ‘(জেউস) তাঁর অন্তরে মর্ত্যমানুষের চিন্তা করেছিলেন যা একই ভাবে সফল হওয়ার কথা। (পৃ. ১১৯)
আমাদের খুব স্পষ্ট করে যা চোখে পড়ে তা হল মানুষ ও দেবতার মধ্যে শুধু ঔদাসীন্য এবং শত্রুতাই নয়, কেমন যেন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাও আছে। দেবতারা শুধু যে খেয়ালখুশি মতো আচরণ করেন তা-ই নয়, বরং মানুষের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ভাবেই করেন। এবং যে ব্যাপারটি বিভীষিকা ও আতঙ্ক উৎপাদন করে তা হল এই যে, এই শত্রুতার পিছনে মানুষের কোনও আপাত দুরাচারিতা বা ত্রুটি নাই। এ যেন সত্যিই নিষ্কারণ বিদ্বেষ, অতএব নিষ্প্রতীকার্য এবং সে কারণে আরও বেশি ভয়াবহ। এবং এ সমস্ত লক্ষণই সংলগ্ন হয়ে যায় নিয়তিতে— এই অকারণ বিদ্বেষ, এই যথেচ্ছচারিতা, মানুষের আচরণ দেবতাদের দেওয়া সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য। ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিত ভাবে একটি অনচ্ছ— এবং সেহেতু আরও বেশি ভীতিপ্রদ— মূর্তির আবির্ভাব ঘটছে, যার ইচ্ছাই আইন এবং যার ইচ্ছা নীতির ধার ধারে না। মানুষের স্বার্থ বা সুবিচারের প্রত্যাশা সম্বন্ধে দেবতারা সম্পূর্ণ উদাসীন। সারা পৃথিবীতেই দেবতাদের এই ঔদাসীন্য মানুষকে ধাঁধায় ফেলেছে। দুষ্কৃতিকারীর শাস্তি হয় না, জিক জিমন সদাচারী, কিন্তু পুরস্কৃত হন না; অতএব ভাগ্য আর যাই হোক সুবিচারক নয়। এই অসঙ্গতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র কর্মবাদের পরিপাটি ছকটি উদ্ভাবন করেছে। কর্ম ও কর্মফলের যে অসঙ্গতির ব্যাখ্যা এ জীবনে মেলে না তাকে সুকৌশলে অতীতে এবং ভবিষ্যতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। দুষ্কর্মকারীর বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে? –ও পূর্বজন্মে ধর্মাচরণ করত, কিংবা পরজন্মে ঠিকই শাস্তি পাবে। ধার্মিক নিগৃহীত হচ্ছে? —পূর্বজন্মের পাপকর্মের ফল পাচ্ছে, অথবা আগামী জন্মে ধর্মাচরণের ফল ঠিকই পাবে। যেহেতু এ দুটি জন্মের কোনওটাই মানুষের জ্ঞানগোচর নয়, তাই কর্মে নিয়তির চরিত্রের মৌলিক লক্ষণটি আরোপিত হচ্ছে: অজ্ঞেয়তা এই লক্ষণ। দু’ হাজার বছরেরও বেশি পুরাণকার ও ধর্মশাস্ত্রকাররা সযত্ন প্রয়াসে একটি বিপুল কলেবর শাস্ত্র নির্মাণ করেছেন যার ভিত্তি হল নিয়তি, বর্তমান জীবনের এ-পারে ও ও-পারের জীবনে যার অবস্থিতি; অতএব সে দুয়ে, দুরনুমেয়। দেবতাদের বিদ্বেষ গ্রিক পুরাণে প্রত্যক্ষ বিরোধিতা। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সরাসরি এই ব্যাপারটার সম্মুখীন হয়নি, কৌশলে তাকে এড়িয়ে গেছে বা ঘুরিয়ে নিয়ে ইষ্টসিদ্ধি করেছে। দেবতার মাৎসর্যের স্থান নিয়েছে পূর্বজন্মকৃত কর্ম; এতে সাপও মরল না লাঠিও ভাঙল না। দেবতায় বিশ্বাস অচল রইল এবং দুর্ভাগ্যের আপাত ব্যাখ্যাও মিলল।
ইসলামে সত্যি বলতে নিয়তিবাদ নেই। থাকা সম্ভবও নয়, শাস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতি থাকবে না বলে। বরং সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পূর্বনির্ধারণে বিশ্বাস আছে। ‘…প্রাক্-ইসলাম আরব ও প্রাচীন টিউটনদের একটা প্রবণতা ছিল ভাববাচ্য সম্বন্ধে, যাতে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য বোঝায়।’ (রিংগার্ন, ১৯৬৭, পৃ. ১০) মহম্মদ যে বহু দেববাদী, পরস্পর-যুযুৎসু, বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলিকে একত্র করবার একটা উপায় হিসাবেও একেশ্বরবাদের প্রবর্তন করেন, তা সুবিদিত। কিন্তু এই সব গোষ্ঠী তাদের প্রাক্-ইসলাম গোষ্ঠীগুলির বিশ্বাস সঙ্গে এনেছিল। যখনই কোনও দুর্ঘটনা ঘটত, করুণাময় পিতৃকল্প ঈশ্বরকে দোষ দেওয়ার চেয়ে তারা আপন ভাগ্যকেই দোষ দিত। ইসলামিক ফেটালিজম গ্রন্থে রিংগার্ন বলেন, ‘হয়তো এ কাব্যের একান্ত ইহনিষ্ঠার ফলেই, ঈশ্বরের চেয়ে নিয়তিই অনেক বেশি স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান… এর একটা চরিত্রধর্ম হল প্রায় সব ভাগ্যবাচক ক্রিয়াপদই কোরানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, সেখানে আল্লাই সুখদুঃখের নিয়ন্তা। ঈশ্বর মানুষের কর্মগুলি সৃষ্টি করেন কিন্তু মানুষ সেগুলি ‘অর্জন করে’ নিজস্ব করে নেয় ও সেগুলির জন্যে নিজ দায়ী হয়।’(১৯৬৭, পৃ. ৫৩, ৫৫) লক্ষণীয় যে, কর্মবাচ্যের ও ভাববাচ্যের ক্রিয়াপদগুলি যে প্রাক্-ইসলাম আরব সাহিত্যে সুপ্রচুর, স্ক্যান্ডিনেভীয় সাহিত্যেও সেগুলির প্রাধান্য দেখা যায়। উভয় সাহিত্যেই মানুষ যত না কর্মের কর্তা তার চেয়ে বেশি তাকে ঘিরে ঘটনা ঘটে, মানুষ যেন নিষ্ক্রিয় ঘটনাভোগী, সক্রিয় জীবনযোদ্ধা নয়। ধর্মীয় যে সূক্ষ্ম দর্শনে আল্লাহ যে কর্ম নির্দিষ্ট করে রেখেছেন মানুষ তা নিজে অর্জন করবে— এ তত্ত্ব কতকটা গোলমেলে, দর্শনে বা নীতিতেএক সমর্থন করা চলে না। এ যেন পরস্পরবিরোধী দুই তত্ত্ব— স্বাধীন ইচ্ছা ও পূর্বনিরূপণকে সংহতি দেওয়ার চেষ্টা, যা যুগে যুগে পৃথিবীর বহু দেশের বহু দার্শনিক করে এসেছেন। এ বদ্ধ গলি থেকে বেরোবার একটি উপায় হল রহস্যবাদ। রিংগার্নও এর উল্লেখ করেছেন। রহস্যবাদীর ক্ষেত্রে একান্ত নির্ভরশীল ঔদাসীন্য বা পক্ষাঘাতের নিঃসাড় মনোভাব সৃষ্ট হয় না। পূর্বনিরূপণ তাকে মুক্তি দেয়। নিয়তিবাদের এ এক ব্যাখ্যা, যার মূল কথা হল মানুষের সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা— কোনও নির্ব্যক্তিক শক্তি বা বিশ্বজাগতিক নিয়মের কাছে নয়, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে।’(১৯১৭, পৃ. ৬২) ব্যাখ্যা যেখানে স্বতোবিরোধী, সেখানে রহস্যবাদ মানুষকে বোঝায় যে, এক অদৃশ্য রহস্যজগতে এই স্বতোবিরোধ নেই, সে জগৎ দৈনন্দিন সহজবুদ্ধির অগম্য, তাকে জানে তৃতীয়-নেত্রবান মানুষ।
এড্ডা সাহিত্যে নিয়তিবাদ সম্বন্ধে নয়মান বলেন, এখানে নিয়তিবাদ প্রয়োজনীয় এক ব্যাপার, এতে (১) ‘যা ঘটবার তা-ই ঘটে, (২) সর্বাতিগ কোনও এক ইচ্ছা নেই যে এ ভাবেই হোক। প্রথমটি প্রাগৈতিহাসিক মানুষের, এবং ‘স্থানীর’ নামের দেবতাদের সঙ্গে তার যোগ আছে এবং দ্বিতীয়টি শিক্ষিততর ও রাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত মানুষের, এবং এর যোগ ‘ঈসীর’ নামে দেবতাদের সঙ্গে।’ (গীসেন, ১৯৫৫, পৃ. ১৭০) এই ঈসীররা ভারতের দেবকল্পনার কাছাকাছি, আর হ্বানীররা দুয়ে এবং নিয়তিবাচক দেবতাদের কাছাকাছি, সাধারণ ভাবে ঈসীরদের শত্রুপক্ষ। অতএব কিছু দেবকল্পে বিধাতা বা ঈশ্বরই মানুষকে শুভ অশুভ অভিজ্ঞতা দেন, অন্য কয়েকটিতে নিয়তির ভূমিকায় সুনির্দিষ্ট কিছু দেবতাই তা করেন। কিন্তু দু’ধরনের দেবকল্পেই একটি ভূমিকা পরস্পরের সঙ্গে মিশে গেছে; দৈব ও দেবতাকে পৃথক করা সেখানে দুঃসাধ্য। এর একটি কারণ হল, মানুষের অভিজ্ঞতা। যে-দেবতা সৌভাগ্য দেন, ভক্তিভরে তার উপাসনা করা সত্ত্বেও কত বার মানুষের সব আশা ভরসা ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। কাজেই মানুষ তখন বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, দেবতাদের ওপারে কোনও এক দুয়ে শক্তি আছে; তাকেই সে বলেছে নিয়তি।
প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করত যে, ‘মৃত্যুর পরে ভাগ্যের ও দৈবের দেবী’ (মাত), মানুষটির চরিত্র সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেয় এবং ‘থথ’ সাক্ষ্যের দলিল রাখে। সেই রায় দেবতারা গ্রহণ করেন এবং মানুষটি ও তার আত্মা পাতালে অসিরিস-লোকে পৌঁছয়।’ (ডেডি, ১৯৮২ পৃ. ১১১) এখানে বিচারক ও শান্তি পুরস্কারদাতার মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভেদ আছে, দুটির অধিষ্ঠাতা দুই ভিন্ন দেবতা।
প্রাচীন বাবিলনে নিয়তির বিষয়ে পড়ি, ‘প্রাচীনতম যুগে ভক্তের পক্ষে নগরদেবতাই অবিতর্কিত ভাগ্যবিধাতা ছিলেন, কিন্তু বহু নগরের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নগর-মণ্ডলের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই স্বভাবতই তাঁর স্থান নিলেন দেবরাজ।… হেলেনিস্টিক যুগের আগে, বাবিলনে দেবতাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য থেকে নিয়তিকে কখনওই পৃথক করা হয়নি। কিন্তু যখন করা হল, তখনও একান্ত, আত্যন্তিক পরিস্থিতিতে একে কিছু পরিবর্তন-সহ পৃথক করা হল।’ (এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন অ্যান্ড এথিক্স; ‘ফেট’)
চিনারা প্রাচীনতম যুগ থেকেই দৈবে এবং দেবে বিশ্বাস করত; এ দুটিকে তাদের কল্পনায় পরস্পর থেকে পৃথক করা যেত না। প্রাচীন চিনা ঐতিহ্য বিবরণে ও সাহিত্যে ‘ইচ্ছা’ রূপে ঈশ্বরে বা দেবগণে বিশ্বাস ছিল, তেমনই বিশ্বাস ছিল দৈবেও; এ দুইয়ের অন্তর্নিহিত বিরোধ নিয়ে তারা কখনওই মাথা ঘামাত না। কিছু কল্যাণপ্রসূত ঘটনা তারা মঙ্গলময় দেবতায় আরোপ করত আর মন্দ ঘটনা বা দুর্ভাগ্যের জন্য দোষারোপ করত মন্ত আত্মা ও দৈবকে। এই শেষ দুটি পরস্পর-পরিবর্তন-সহ বলে ধরা হত। ফলে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের নিয়ন্তা চিনাদের কল্পনায় পৃথক ছিল— দেবশক্তি ও দৈবশক্তি।
পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির অন্যতম সুমেরীয়, অন্য অনেক প্রাচীন জাতের মতোই এরাও বহু-দেববাদী ছিল, ‘অনেক দেবতা ছিলেন যাঁদের প্রধান কাজই ছিল নৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা… দুর্ভাগ্যক্রমে যদিও প্রধান দেবতাগুলি নীতিপরায়ণ এবং আচরণে ধর্মনিষ্ঠ মনে হত তবুও এ কথা সত্য যে, সুমেরীয়দের জীবন দর্শনের নিরিখে এঁরাই সভ্যতা প্রতিষ্ঠার কালে মন্দ ও মিথ্যাকে স্থান দিয়েছিলেন, নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারকেও— সংক্ষেপে… মানুষের আচরণে সমস্ত দুর্নীতির ও অনৈতিকতার। …দেবতারা ঠিক মানুষ রাজার মতো, এবং সন্দেহ নেই, এদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নজর দিতে হত।’ (ক্রামার, ১৯৯৬, পৃ. ১২৪-২৬) প্রাচীন দেবমণ্ডলীতে দেবতাদের বীরত্বের কাজ করতে হত, বিদেশিদের জয় করতে হত, ভক্তদের সাহায্য করতে হত। কাজেই তাঁদের পক্ষে নৈতিক বা সত্যাশ্রয়ী জীবনযাপন করা সম্ভব ছিল না। তাঁদের স্খলন ও বিচ্যুতি অনেক এবং বহু প্রকারের। এরই সঙ্গে মানিয়ে যায় ন্যায়বিধানের ব্যাপারে তাঁদের খামখেয়ালি স্বভাব। দেবকল্পগুলিতে যেহেতু তাঁদের নিজেদের ব্যবহারই ত্রুটিপূর্ণ এবং অননুমেয়, মানুষও তাদের কাছে যথার্থ ন্যায়বিচার আশা করত না। যদৃচ্ছাচারী শক্তিমান রাজার আচরণ যা জীবনে তাদের প্রত্যক্ষগোচর ছিল তাই তারা আরোপ করত দেবতায়। দেখতে পাচ্ছি, নিয়তিবাদ প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, এর বিকাশ ঘটে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্যে। কোথাও কোথাও এর আগেই নগরায়ণ ঘটে, সেখানে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ সহস্রাব্দেই নিয়তিবাদ দেখা দেয়। এ সভ্যতাগুলির মধ্যে একটি সাধারণ লক্ষণ হল, এগুলি নাগরিক সভ্যতা, যেখানে সমাজে শ্রেণিবিভাগ স্পষ্ট প্রতীয়মান। স্থল এবং জলপথের বাণিজ্য মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতেই ছিল; এরা কৃষি ও শিল্পের বহির্বাণিজ্যে ব্যাপৃত থাকত এবং দেশের মধ্যে কৃষিজাত এবং শিল্পজাত বস্তুর উৎপাদনের ব্যবস্থাপনা করত। তাদের অধীনে সরাসরি বা গৌণ ভাবে কাজ করত প্রাথমিক উৎপাদকরা, যারা শুধুমাত্র পেটভাতায় খাটত। এ সব সমাজে, বিশেষত যেখানে সম্পন্ন শ্রেণিই নগরবাসী ছিল, সেখানে শ্রেণিবিভাগ খুব তীক্ষ্ণ ছিল। শিল্পশ্রমিকরা কখনও নগরের মধ্যে, কখনও বা ঠিক তার বাইরেই বাস করত, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ থাকত আদিম ধরনের গ্রামে। গরিব চাষির গোষ্ঠীগত সংহতিতে, তাদের এক ধরনের নিরাপত্তা ছিল, কিন্তু তা আগেই ভেঙেছে, নয়তো ভাঙবার মুখে। নাগরিক মানুষকে নিরাপত্তা দিত নগরকেন্দ্রিক পত্তনের সৈন্যরা। এই জন্যে জীবনযাত্রার মানে, ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যে, উভয়ের মধ্যে বড় রকমের একটা ব্যবধান ছিল। এমন জায়গা, যেখানে ধনের ও জীবনের সুখোপকরণের বণ্টন অসম, সেখানে নিয়তিবাদ যে প্রতিষ্ঠা পাবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অন্য দিকে সমুদ্রে ঝড়, শস্যক্ষেত্রে কীট-পঙ্গপাল, অনাবৃষ্টি, বন্যা, সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপগুলিতে ধনিক শ্রেণিও কখনও কখনও বিপর্যস্ত হত, যদিও প্রায়ই গৌণ ভাবে ও অপেক্ষাকৃত নগণ্য পরিমাণে। এই জন্যে নিয়তিবাদের প্রথম প্রবক্তা ধনিক শ্রেণির পুরোহিত সম্প্রদায়, কিন্তু বিশ্বাসটা তারা বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে দিয়েছিল জনতার সর্বশ্রেণির মধ্যে। শেষ বিচারে মধ্যপ্রাচ্যে, মিশর ও চিনে নিয়তিবাদ প্রাথমিক নগরায়ণের সমকালীন।
একটি জাতক কাহিনিতে আছে ‘তেত্রিশ-লোক থেকে একটি নিষ্পাপ প্রাণী একটি পদ্মের মধ্যে পড়ে একটি শিশুকন্যার রূপ ধারণ করে বাড়তে থাকে।’ (৩৪, আসঙ্ক) আর একটি কাহিনিতে শুনি ‘সিরি (শ্রী, লক্ষ্মী) আসেন এবং তাঁর (দেহ) থেকে একটি স্বর্ণাভ দ্যুতি নির্গত হয়; তিনি বলেন নৈতিক ভাবে নির্দোষ ও ধার্মিক লোকদের প্রতি তাঁর পক্ষপাত আছে।’ (৩৮২ সিরি কালকন্নি) কিন্তু বাস্তবে দেবতারা সচ্চরিত্র মানুষের প্রতি প্রসাদ বিতরণ করেন না; বহুবার অত্যন্ত দুরাচার ব্যক্তিও দেবলোকে পৌঁছয় এবং বুদ্ধ বা কোনও বোধিসত্ত্ব বা পচ্চেকবুদ্ধের প্রতি যৎসামান্য কোনও ভক্তির চিহ্ন দেখিয়ে অত্যন্ত উন্নত লোকে স্থান পায়। সারা জাতকে বারবার আর একটি ব্যাপারে দেবতাদের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়: যখনই কোনও মানুষ কৃচ্ছ্র সাধনে, দানে, আত্মত্যাগে কিংবা কোনও অসামান্য পুণ্যে অত্যন্ত আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করে, স্বর্গে সক্ক’র (ইন্দ্রের) সিংহাসন তপ্ত হয় এবং তিনি নেমে এসে সেই পুণ্যবানকে পরীক্ষা করেন ও পরে সাহায্য করেন এবং পুরস্কার দেন। প্রায়ই অবশ্য অসাধারণ উন্নতমানের নৈতিকতা দেখলে সক্ক ঈর্ষান্বিত হন। অবশ্য অধিকাংশ সময়েই এমন ক্ষেত্রে তিনি পুণ্যবানকে পুরস্কৃত করেন।
অতএব প্রায় সব দেবকল্পেই দেবতারা নৈতিক ভাবে নিষ্কলুষ নন, তাঁদের চরিত্রও আদর্শ নয়। তাঁরা মানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ করেন এবং কখনও ন্যায়বিচার করেন, কখনও বা যথেচ্ছ ভাবে অবিচার করেন। বিশেষ দেবতারূপে এই তাঁদের ভূমিকা, কিন্তু কোনও কোনও কাহিনিতে তাঁরা নিয়তির বিভিন্ন নাম ও পরিচয় বহন করেন এবং নিয়তির স্বেচ্ছাচারী আজ্ঞাবহ রূপে পাপাচার হয়েও সুবিচারের প্রতীক রূপে প্রতীয়মান হন।
শুধু যে কর্মবাদ ও নিয়তির মধ্যেই বিরোধ আছে তা-ই নয়, দেবগণ ও নিয়তির মধ্যে, কার্যকারণ-পরম্পরা ও নিয়তির মধ্যেও বিরোধ আছে। কার্যকারণবাদকে যদি বিশ্বজগতের ও প্রকৃতির একটা তত্ত্ব হিসাবে দেখা হয়, তা হলে তা অমোঘ ও অপরবির্তনীয় হয়ে ওঠে ও নিয়তির জন্যে কোনও অবকাশ রাখে না। লঙ হেলেনিস্টিক দেবকল্পের বিষয়ে বলেছেন, যে সব লক্ষণ প্রকৃতির উপরে আরোপিত ছিল কাহিনিগুলি প্রাঙ্-নিরূপণ তত্ত্বের প্রতি অনুগত থাকে সেইগুলির দ্বারাই। সর্বব্যাপী প্রাণশক্তি বাক্ হিসেবেই প্রকৃতি ও বুদ্ধির সাহায্যে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। যদি কিছু ঘটনা নিষ্কারণ হয় অথবা প্রকৃতির শক্তির বাইরে পড়ে, তা হলে পৃথিবীটাকে প্রাকৃতিক আইন দিয়ে পুরো ব্যাখ্যা করা যাবে না… দৈব বিধান বা স্টোইকরা (কৃচ্ছ্রসাধকরা) প্রাণপণে যা মানতে চেয়েছেন, তার একটি প্রাক্-শর্ত হল ঈশ্বরের সেই ক্ষমতা, যার দ্বারা শুভ ঘটনা ঘটানো যায়।’ (১৯৮৬, পৃ. ১৬৪)
বৈদিক যাগযজ্ঞ থেকে জন্মান্তর ও কর্ম এবং তাদের আবশ্যিক সহচারী নিয়তিবাদের ধারণা আসার মধ্যে দিয়ে কর্ম ও কর্মফলের ওপরে বিশেষ এক ঝোঁক পড়ে। মাদাম বিয়ার্দো লেখেন, ‘এক কথায়, মূল্যবোধের বিভাজনটাই পালটে গেছে, মূল্যগুলি নয়; ফলের মধ্যে যদি না-ও হয় তবুও সামাজিক তত্ত্বে তাদের রূপ অপরিবর্তনীয় থেকে গেছে।’ (এগজিস্তে, ২ক সংখ্যা পৃ. ৯)
যখন প্রকৃতি ও কার্যকারণবাদকে এক সঙ্গে ক্রিয়াশীল দুটি পরস্পর-নির্ভর শক্তি হিসাবে একত্রে নেওয়া যায়, তখন ‘কারণ’ হল ‘কার্যের আবশ্যিক, প্রাগুপস্থিত পূর্ববর্তী বস্তু। কিন্তু বাস্তবে বারে বারে এ তত্ত্বেও ব্যতিক্রম ঘটেছে। ‘এটাও… লক্ষ করা বিশেষ প্রয়োজন যে, কার্যকারণবাদের প্রাভাব ও পশ্চাদভাবের মধ্যে কোনও আবশ্যিক সম্পর্ক সম্বন্ধে চার্বাক চিকিৎসাশাস্ত্রের তালিকাগুলি বিশেষ আপত্তি তোলে। তারা নির্দেশ করে যে, এ দুইয়ের মধ্যে বস্তুগত বা যুক্তিগত কোনও সম্পর্ক নেই। এ শুধু চিন্তা প্রণালীর একটা কল্পনিষ্ঠ অভ্যাসমাত্র।’ (বালাস্লেভ, ১৯৮৩, পৃ. ২০) প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যার ব্যাপারে কার্যকারণবাদ গ্রহণীয় কোনও তত্ত্ব নয়। কারণ, দেখা গেছে এ তত্ত্ব ভ্রান্তিপূর্ণ— অতএব নির্ভরযোগ্য নয়। কার্যকারণবাদ দিয়ে প্রকৃতির গতিবিধি সর্বদাই অব্যতিক্রমী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই নিয়তিবাদের জন্য খানিকটা জমি ছেড়ে দেওয়া হয়, যা স্বতই অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয় ব্যাপার বলে, প্রকৃতিতে বা কার্যকারণবাদে যার কোনও ব্যাখ্যা নেই তারও ব্যাখ্যা করে দেয়। মানুষের জগতেও কর্ম ও কর্মফলের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা যায়। রবার্ট অলটার তাঁর সেক্রেড হিস্ট্রি অব প্রোজ ফিকশন লেখায় বলছেন, ‘…দেবতার প্রতিশ্রুতি ও তার ব্যর্থতা, তাঁর দৈব নির্দেশনা ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, মানুষের নিয়ম-ব্যতিক্রমী স্বভাব পরিকল্পনা ও অব্যবস্থা— ঈশ্বর ও স্বাধীনতা এ দুইয়ের মধ্যে দ্বিগুণ দ্বন্দ্ববাদী (বিরোধ)…।’ (ফ্রিডম্যান সম্পাদিত ২২ খণ্ড, পৃ. ১৪) প্রত্যাশিত ও বাস্তবের মধ্যে ফারাকটা টের পেতে কয়েক শতাব্দী, এমনকী কয়েক সহস্রাব্দও লেগেছিল। প্রথম যুগের ব্রাহ্মণগুলি এবং যে মুণ্ডক উপনিষদে যজ্ঞীয় ধর্মকে ‘অদৃঢ় নৌকা’ বলা হয়েছে এ দুইয়ের মধ্যে তিন-চার শতাব্দীর ব্যবধান। যজ্ঞের দ্বারা লভ্য বস্তু যখন পাওয়া যেত না, তখনকার ব্যর্থতাবোধ ক্রমেই স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বোধ হয় আরও বড় আধ্যাত্মিক সংকট হল মানুষ যখন দেখে যে, প্রকৃতি খেয়াল খুশি মতো চলে, সেখানে কোনও অমোঘ নীতি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে না, মানুষের আচরণের শাস্তি ও পুরস্কার আসে কোনও খেয়ালি নীতিতে। এ আশাভঙ্গ অনেক গভীরতর, এবং অনেক স্থায়ী ভাবে মনকে প্রভাবিত করে।
এ অভিজ্ঞতা থেকে একটি স্বাভাবিক যুক্তিগত সিদ্ধান্ত হল, নিজের ভাগ্যরচনায় মানুষের নিজের দায়িত্ব কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মৎস্য পুরাণে একটি প্রাসঙ্গিক কথা আছে: ‘নিয়তির পরিমাপ করা যায় না, কাজেই সমস্ত কর্ম পৌরুষের ওপর নির্ভর করে। মানুষের নিজের ভাগ্যকে বলা হয় পূর্বজন্মে অর্জিত কর্মের ফল। তাই পণ্ডিতেরা বলেন পুরুষকারই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যারা ধর্মানুষ্ঠানে নিরত থাকে এবং আরও ঊর্ধে ওঠার চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে নিয়তি পুরুষকারের দ্বারা খণ্ডিত হতে পারে। যাদের পুরুষকার একেবারেই অনুপস্থিত, তারাই নিয়তিকে বিশ্বাস করে। নিয়তি, মানুষের নিজের কর্ম এবং কর্মের ফল, প্রাক্তন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ— এই তিনে মিলে মানুষের কর্মফল সৃষ্টি করে।’ (২২১:১১২) জোরোস্টার কিন্তু ‘বিশ্বাস করতেন… মানুষের নিজের কর্ম সম্বন্ধে একটি অলঙ্ঘনীয় দায়িত্ব আছে।’ (হুইটরো, ১৯৮৮, পৃ. ৩৪) পুরুষকার প্রাধান্য পায় বলে এ বিশ্বাসে নিয়তিবাদ তত্ত্বগত ভাবে অনেকটাই খণ্ডিত হয়।
মানুষের নৈতিক দায়িত্ব এবং তার স্বতন্ত্র ইচ্ছার পরিধি এ দুইয়ের সম্পর্কে একটি মৌলিক প্রশ্ন মানুষকে বহু সহস্রাব্দ ধরে ভাবিয়েছে। ‘…নৈতিক অপরাধ ও নিন্দাহতা এবং দায়িত্ব স্বভাবতই গোলমেলে, …তা হলে এ ভাবেই আমরা এগুলিকে দেখতে পাই, যদি পূর্বনির্ধারণের সত্যতা বা মিথ্যাত্ব সম্বন্ধে ভাবি, যথার্থ শাস্তি এবং নৈতিক দোষারোপ মানে নৈতিক অপরাধ, অপরাধের প্রাক্শর্ত স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার অর্থনৈতিক পূর্বনিরূপণের মিথ্যাত্ব।’(সঙ্গস্ট্রসন, ১৯৩৭, পৃ. ১,২) স্বাধীন ইচ্ছা ও পূর্বনিরূপণ বা নিয়তি এই দুইয়ের পরস্পর বিরোধ পণ্ডিতদের কাছে বহু যুগ ধরেই পরিষ্কার। সম্ভবত এ দুটির মাত্রার ওপরে নির্ভর করে এই সংমিশ্রতার অস্পষ্টতা। অনবরুদ্ধ স্বাধীন ইচ্ছা-কল্পনাকে আঘাত করে বাস্তবের অনাশঙ্কিত, আকস্মিক, আপতিক ঘটনা এবং প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও এমনকী পারিবারিক বিপর্যয়ও। তেমনই মানুষ যখন কোনও কিছু ইচ্ছা করে, তা সাধন করে এবং পরে এ কাজের শুভ বা অশুভ ফল ভোগ করে তখন সে অনবরুদ্ধ নিয়তিবাদকে খণ্ডন করে। এখানে উল্লেখ করা উচিত যে আজীবিক বা ক্যালহ্বিন এর মতো একান্ত নিয়তি বা পূর্বনিরূপণের সমর্থক প্রস্থানও আছে; কিন্তু এমন কোনও প্রস্থান নেই যা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করে। বহু রকমের আপতিক বা আকস্মিক দুর্ঘটনার দ্বারা এ বোধ প্রতিহত হয়।
যদি পরিপূর্ণ পূর্বনিরূপণই নিয়তিবাদ হয়, তা হলে সম্পূর্ণ নিয়তিবাদী চিন্তা ধর্মে বা দর্শনে কখনও ঐকান্তিক হয়ে ওঠেনি। সীমাবদ্ধ পূর্বনির্ধারণের পরিসরে নিয়তি ও স্বাধীন ইচ্ছার বিরোধ অনেক কম তীক্ষ্ণরূপে প্রতিভাত হয়। এ দুইয়ের আপেক্ষিকতার আলোচনা সর্বশেষ অধ্যায়ে।
‘পূবনিরূপণের সঙ্গে স্বাধীন ইচ্ছার সংহতিতে কোনও সমস্যাই নেই… হবস এই সমন্বয়বাদের আবিষ্কর্তা, কিন্তু তিনি… স্বাধীন ইচ্ছার সত্যকে অস্বীকার করেন।’ (রাফায়েল, ১৯৮১, পৃ. ৯৭) ক্রিয়া যদি বাধ্যতামূলক হয়, রুচি অনুসারে নির্বাচনের— অতএব নৈতিক দায়িত্বেরও কোনও অবকাশই না থাকে তবেই পূর্বনিরূপণের সঙ্গে স্বাধীন ইচ্ছার সংগতি করা যেতে পারে। কিন্তু যেহেতু এই ক্রিয়ার পিছনে কোনও নৈতিক নির্বাচন থাকে না তাই স্বাধীন ইচ্ছারও কোনও অবকাশ থাকে না।
জৈন ভগবতীসুক্ত’র দ্বিতীয় সুত্তের ব্যাপারে ‘চুর্ণী’ বলে, ‘মানুষ তার কর্মফলেই দুঃখ পায়, যে কর্ম বাসনাপ্রণোদিত। এই হল নিকৃষ্টতম অপরাধ, বাসনা।’ কিন্তু বাসনা থাকা সত্ত্বেও কর্মে যে বাসনা প্ররোচিত করে তাকে যে এড়িয়েও যাওয়া যায়, সেখানে বিকল্প বা নৈতিক নির্বাচনের অবকাশ আছে। কিন্তু এক বার যখন মানুষ বাসনার কাছে আত্মসমর্পণ করে মন্দ কাজ করে তখন সে নরকে পতিত হয়— এই ভাবেই ওই চূর্ণীর ব্যাখ্যা চলে। কাজেই ইচ্ছার স্বাতন্ত্র্য প্রতিহত হয় না।
কাজের ক্ষেত্রে নিয়তিকে যা বাধা দেয় তা হল স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা প্রবর্তিত পুরুষকার। আর এইখানে দীর্ঘকালের একটি অন্তর্নিহিত বিরোধ থেকে যায়। নিনিয়ান স্মার্ট বলেন, ‘এটা প্রণিধান করার বিষয় যে, যখন ভারতীয় দার্শনিকরা স্বাধীন ইচ্ছা সম্বন্ধে আলোচনা করেন (এবং সে আলোচনা নামে মাত্রই)— তখন যে প্রসঙ্গ উঠে আসে, তা হয় কর্মসংক্রান্ত অথবা মানুষের ওপরে ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে। মানুষের সমস্ত কর্মই পূর্বকারণের কার্য, এই মত প্রায় অনিবার্য ভাবেই স্বনিয়ন্ত্রিত কর্মের প্রসঙ্গে ব্যাখ্যাত হয়। এই স্বাধীন ইচ্ছার প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন জাগে: বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কর্মের দ্বারা কর্মের যে কার্যকারণ-সূত্র সৃষ্টি হয়েছে তার পরিবর্তন করা কি সম্ভব? এর মোটামুটি সাধারণ ভাবে স্বীকৃত উত্তর— হ্যাঁ, কারণ, আমরা ভাল কাজ করতে পারি যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ আরও অনুকূল হয়। এবং তার চেয়েও বড় কথা, নানা ভাবে সঞ্চিত কর্মকে ও তার ফলকে নির্মূল করতে পারে।’ (১৯৬৭, পৃ. ১৬৪) এখানে গ্রন্থকার যে সব প্রশ্নের সম্মুখীন হননি, তা হল (১) পুনর্জন্ম প্রমাণ করা যায় কিনা, (২) এক জন্মের ওপারেও ব্যক্তিসত্তা প্রসারিত হতে পারে কিনা, (৩) পাপ ও পুণ্য কর্ম জন্মান্তরে বস্তুসত্তার মতো উত্তীর্ণ হতে পারে কিনা, এবং পরিশেষে (৪) পাপ ও পুণ্যের চেতনা, যার থেকে কর্ম উৎপন্ন হয় এবং এর ফলে যা ওই সব কর্মের অবিচ্ছেদ্য লক্ষণে পরিণত হয় তা-ও জন্মান্তরে সংক্রামিত হতে পারে কিনা। বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ শাস্ত্রই এ বিষয়ে একমত যে পুর্ণ্যকর্মের ফল হল উচ্চবর্ণের ধনী পরিবারে সুস্থ পুরুষ হয়ে জন্মলাভ করা। অনেক ক্ষেত্রেই তেমন পুরুষ নীচমনা, স্বার্থপর, প্রবঞ্চক ও ভ্রষ্টচরিত্র হয়; তখন স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, যে-পুণ্যবান ব্যক্তি পূর্বজন্মের সৎকর্মের সুফল ভোগ করছেন, তিনি এ জন্মে পূর্বজন্মের বিপরীতধর্মী চরিত্র কেমন করে পেলেন? পুনর্জন্মের পথে কোথাও কি পূর্বের সৎ চরিত্রটি ফেলে এসেছেন? এ ছাড়া, পূর্বে যে চারটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে তার কোনও প্রমাণিত সদুত্তর নেই। আছে শুধু অনুমান, যাকে পদে পদে মারাত্মক দার্শনিক অসঙ্গতি তাড়া করে ফিরছে।
ডিকশনারি অব দ্য হিস্ট্রি অব আইডিয়াজ গ্রিক ও রোমান চিন্তাধারা সম্বন্ধে বলে, ‘লটারির মতো দান ফেলে ঠিক হয়, যে-আত্মারা তাদের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করে, তাদের সামনে উপস্থাপিত কয়েকটি জীবনের ছক থেকে পছন্দসই (জীবন) বেছে নেবে। আত্মার দিক থেকে ব্যক্তিনিষ্ঠ দৃষ্টিতে দেখলে এই অনির্দেশ্যতা ভাগ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেই স্বাধীন নির্বাচনও আবার ব্যক্তিগত ভাগ্যের দ্বারা সীমিত… ভাগ্য যখন কারণের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তা ‘চিত্ত’ হয়ে যায়। এই কারণ যতক্ষণ থাকে তা আপতিক ঘটনাও হতে পারে… দুটি প্রশ্ন থাকে (১) অযোগ্যকে সৌভাগ্য দান করা দেবতার পক্ষে কোন যুক্তিতে সম্ভব? এবং (২) যোগ্যকে কেন দুর্ভাগ্য প্রেরণ করা হয়?… স্টোইকরা মনে করেন কার্যকারণ-পরম্পরা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাবই নিয়তি। সে যাই হোক, নিয়তির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এই যে, তা মানুষের বোধবুদ্ধির কাছে অগম্য, কারণ, এর নিজস্ব বাস্তব সত্তা থাকতে পারে না।’
অগাস্টিনের বক্তব্যে (দে সিঙ্গিতাতে দেই ৫ম খণ্ড ১১শ অধ্যায়) ‘বিধাতা সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন, কারণ যে-ঈশ্বর সব কিছুরই জন্য ব্যবস্থা করেন, তিনি বিধানের পরিসর থেকে বা জ্যোতিষ্কদের নিরূপণ থেকে বেরিয়ে ঈশ্বর-ইচ্ছার বাইরে কোনও কিছু থাকার অনুজ্ঞা কখনওই দেবেন না।’ সেন্ট টমাস আকুইনাস বলেন, ‘নির্হেতুক ঘটনা যেহেতু মানুষের (নৈতিক) নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত, (সেই জন্যে) মানুষিক নির্বাচন কার্যকারণ-পরম্পরার মধ্যে যে ভাবে প্রবেশ করে সেটা তাৎপর্যপূর্ণ: (১) ইচ্ছা এবং নির্বাচন অব্যবহিত ভাবে ঈশ্বর প্রেরণ করেন, কারও মধ্যস্থতা ছাড়াই এবং (২) মানুষের জ্ঞান ঈশ্বর নিরূপণ করেন, দেবদূতদের সাহায্যে।’
ফ্রি উইল ফর প্রিডেস্টিনেশন গ্রন্থে বার্নার্ড বেরোফস্কি বলেন, ‘নির্বাচন তখনই স্বাধীন যখন, স্বাধীন বিচারবুদ্ধি-প্রণোদিত হয়ে উদ্ভুত হয়… কোনও কর্ম স্বাধীন বলে বিবেচিত হয় যখন সেটির পশ্চাতে সক্রিয় থাকে মানুষের যুক্তি অথবা বুদ্ধি। এই স্বাধীনতাই নৈতিকতার মর্মবস্তু।’ (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২২৭-২২৯, ২২৯, ৪০) এ মত দার্শনিক কান্টের। ডিকশনেয়ার দ্য তেওলজি কাতলিসিজম বলে, ‘পূর্বনিরূপণের তত্ত্ব পুরোপুরি সাবত্রক।’ কোনও কোনও দর্শনপ্রস্থান আপত্তি করে বলেছে, ‘যদি পূর্বনিরূপণের তত্ত্ব অভ্রান্ত হয়, তা হলে আমার সম্বন্ধে পূর্বনিরূপণ হয় আছে কিংবা নেই। যদি থাকে তা হলে যাই করি না কেন আমার নরকবাস অবধারিত।’(‘ফ্রি উইল’, পৃ. ৩০০) এখানে সমস্যাটি খুব স্পষ্ট ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে; যুক্তিতে এর সমাধান নেই। পূর্বনিরূপণের ক্ষেত্রে মানুষের সদাচরণের কোনও প্রাসঙ্গিকতাই নেই, আছে শুধু ঈশ্বরের বিশেষ করুণা। যা দিয়ে তিনি ক্ষমা করতে পারেন, এবং তা নির্ভর করে তাঁর খুশির ওপরে। কাজেই মানুষ নিষ্ক্রিয় কৃপাপাত্রে পরিণত হয়।
মিশরে নিয়তি সংশ্লিষ্ট ছিল জন্ম এবং/বা পুনর্জন্মের ওপরে। পুত্র জন্মালে দেবী হাথোর তার চারদিকে তার ভাগ্য বুনে দেন। এখানেও ভাগ্য তাঁদের বিশেষ ক্ষমতা দেখানোর জন্যে দেবতাদের একটা সুযোগ দেয়। ভাগ্য যে কোনও প্রকারেই হোক জন্মের সঙ্গে গ্রন্থিবদ্ধ— দেবতারা তাঁদের উপহার হিসাবে মানুষকে পুত্রসন্তান পাঠান এবং তার পরে হাথোর এসে তার ভাগ্য নিরূপণ করেন। ‘মিসরীয়রা জানত, মানুষের জীবনে অপ্রত্যাশিত সুখ বা দুঃখ এসে থাকে; এ জন্যে তারা জন্মক্ষণের (জ্যোতিষিক গণনার) ওপরে খুব গুরুত্ব দিত।’ (নূমেন দ্বিতীয় সংখ্যা গ্রন্থনা ১,২ পৃ. ১১৫, ১১৮, ১২৮; ‘মিশরীয় ধর্মে নিয়তি’) ভাল, মন্দ সব অভিজ্ঞতার জন্যে নিয়তিকে দায়ী করাটা প্রাচীন সভ্যতাগুলির চিন্তায় ওতপ্রোত ভাবে বিদ্যমান ছিল, অন্তত প্রাথমিক নগরায়ণের যুগ থেকে। এর দ্বারা যুগে যুগে ধর্মবিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন ভাবে রঞ্জিত হয়েছিল।
প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্য সম্বন্ধে পড়ি ‘আশির বিশেষজ্ঞদের মতে সাধারণত ‘শিমতু’র অনুবাদ ‘ভাগ্য’ বা নিয়তি; এ অনুবাদটি ত্রুটিযুক্ত ও ভ্রান্তি ঘটায়… খুব সাধারণ ভাবে বললে ‘শিমতু’ হল দেবতা, রাজা অথবা অন্য কেউ, যে বিশিষ্ট উদ্দেশ্য কাজ করে, যার শক্তি আছে কাজ করবার বা বিধান দেওয়ার, তেমন কারও থেকে উৎপন্ন স্বভাব বা মেজাজ।… প্রাচীন পারসিকে ‘মেলাম্বু’র অর্থ প্রায় ‘হ্বরেন’র কাছাকাছি, যার প্রচলতি আরবী প্রতিশব্দ হল ‘গদিয়া’– ভাগ্য।’ (ওপেনহাইম, ১৯৬৪, পৃ. ২০১, ২০৪, ২০৬) সুমেরীয় ভাষা ‘উসুতু’ হল নকশা বা ছক যা দেবতারা মানুষের জীবন সম্বন্ধে রচনা করেন। নিয়ন্তা হিসেবে ভাগ্য সম্বন্ধে ধারণা এসেছে পার্থিব কোনও শক্তিমান রাজা থেকেই, যাঁর ক্ষমতা আপাত ভাবে অপরিসীম, যিনি নিজের ইচ্ছাক্রমে পুরস্কার ও শাস্তি দিয়ে থাকেন। আইন তৈরি হওয়ার আগে রাজ্যগুলিতে রাজা এবং/বা রাজপুরোহিত কখনও কখনও ন্যায়বিচার করলেও, অনেক সময়েই নিজের অন্যায় খেয়ালখুশি চরিতার্থ করতেন প্রজাদের মধ্যে সন্ত্রাস ও সম্ভ্রম সৃষ্টি করবার জন্যে; প্রভুর মর্জি প্রকাশ পেত অদ্ভুত সময়ে, অদ্ভুত রকমে এবং কোনও রকম যুক্তিবুদ্ধির ধার না ধরেও। নিয়তির কল্পনার বীজ এই সব ক্ষমতায় আসীন যথেচ্ছচারী রাজাদের মধ্যেই নিহিত ছিল।
পাশ্চাত্য দার্শনিকদের আলোচনা থেকে কয়েকটি সাধারণ তথ্য দেখা দেয়: (১) ঈশ্বর সর্বজীবে দয়াবান, (২) তিনি মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের বিকল্প দিয়েছেন, (৩) একবার প্রাথমিক স্বাধীন সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরে বাকিটা আপনা থেকেই ঘটে, (৪) স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার নিজস্ব রীতিতে নির্বাচন এবং সেটা স্বতন্ত্র; কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্বের সঙ্গে এ স্বাধীন ইচ্ছার কোনও সঙ্গতি সৃষ্টি করা যায় না। তা ছাড়া মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিও সক্রিয় হয় স্বাধীন ইচ্ছার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু এমন কোনও বিধাতাকে যদি স্বীকার করা যায় যিনি স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করেন, তা হলে স্বাধীন মানবিক বুদ্ধিবৃত্তির ও ইচ্ছাশক্তির সামান্যই অবকাশ থাকে। এ ছাড়া নিয়তি এবং বিধাতাকে প্রায় সর্বত্রই খুব সুবিধাজনক ভাবে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। নিয়তি সম্ভবত দুর্ভাগ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বিধাতা সৌভাগ্যের সঙ্গে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচার করলে এটাও ধোপে টেকে না।
বড় জোর বলা যায়, এটা একটা সরল, কষ্টকর আকল্প রচনার প্রয়াস, যাতে পরস্পরবিরোধী তত্ত্বের স্থান হয়। আর তত্ত্বের দিকে একটা বিশুদ্ধ জগাখিচুড়ি, কারণ এতে এমন সব তত্ত্বের সংহতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে যেগুলোকে কোনও মতেই মেলানো যায় না। শুধু ঐতিহাসিক ভাবেই এ সমস্যাকে বোঝাবার চেষ্টা করা যেতে পারে। ধীরে ধীরে কিন্তু অপ্রতিহত ভাবেই মানুষের বুদ্ধি অভিজ্ঞাত কতকগুলি তথ্যের সম্মুখীন হতে বাধ্য হল: স্বাধীন ইচ্ছা, নিয়তি, ঈশ্বর, বিধাতা। সৌভাগ্যক্রমে সবচেয়ে জটিল তত্ত্ব— জন্মান্তরকে এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু তবু, নিয়তি অন্ধ বা খামখেয়ালি, তার কাছে এটা প্রত্যাশা করা যায় না যে সে যুক্তিসঙ্গত ভাবে কাজ করবে। যদি এমন কোনও বিধাতাকে এই ছকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় যাঁর বিচার অন্তত যুক্তিসহ ও মনুষ্যজাতির প্রতি সদয়— তা হলে জল আর আগুনের সহাবস্থান আশা করার মতোই হবে। যেহেতু এটা যুক্তিবহির্ভূত ব্যাপার তাই ছকটিতে বিস্তর ফাঁক ও ফাঁকি। আর একটা অসঙ্গতি তাহলে দেখা যায়, সদয় কোনও বিধাতা নিয়তির সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে না। স্বাধীন ইচ্ছা কি নিয়তির সঙ্গে একত্র থাকতে পারে? এইটিই মূল প্রশ্ন। মস্করী গোসাল মনে করতেন যে, স্বাধীন ইচ্ছার কল্পনাটাই একটা লোকায়তিক স্থূল ভ্রান্তি। ‘স্বাধীন ইচ্ছার দৃষ্টিভঙ্গি… ব্যক্তির ওপরেই দায়িত্ববোধের দায় এনে দেয়, কারণ, এতে মনে করা হয় যে তার ইচ্ছার মধ্যে ললাটলিপি প্রতিরোধ করার এবং এমন কাজ করার ক্ষমতা আছে যা অপ্রীতিকর ঘটনাকে প্রতিহত করতে পারে। যদি তার ললাট-লেখনের জন্যে আশঙ্কাতীত দুঃখ আসে, তবুও তাকে দায়ী করা হয় কারণ সে (দুঃখ)টা তার পূর্ব জন্মে স্বেচ্ছাকৃত কর্মের ফল।’ (কেস্ ও ড্যানিয়েল, ১৯৮৩, পৃ. ৪১) যে ছকটিতে নিয়তির প্রাধান্য সেই ছকে অন্য কোনও কিছুকে ভরে দেওয়ার এই পরিহসিত ফল।
খুব কম করে বললেও দার্শনিক ভাবে পরস্পরবিরোধী দুটি তত্ত্বকে একত্র সন্নিবেশিত করার অপচেষ্টায় সততা নেই। যদি নিয়তিই বলীয়সী হয় তবে এ জন্মের, পূর্ব জন্মের ও আগামী জন্মের কর্ম, ভাল, মন্দ সবই নিয়তির অধীনে। এই অবস্থানের সঙ্গে মস্করী গোসালের প্রথম প্রতিপাদ্যটিতে পুরো সংহতি ছিল: মানুষের প্রয়াসের কোনও মূল্য নেই; ঘটনা ঘটে নির্হেতুক ভাবে, কিছু লাভ করবার জন্যে বা পূর্বনির্দিষ্ট কোনও কিছুকে ঠেকাবার জন্যে মানুষ কিছুই করতে পারে না, কারণ নিয়তি সবই নিয়ন্ত্রণ করে। গোসালের দ্বিতীয় প্রতিপাদ্যটি অনির্দিষ্ট আশাবাদ থেকে উত্থিত: মানুষের চরম পরিণতি হল, চুরাশি লক্ষ জন্মের পরে মানুষ আপনাআপনিই মুক্তিলাভ করে। এই আশাটি দুরাশার মতো এত ঝাপসা, এত সুদূর কালের ওপারে স্থাপিত যে এ জন্মে মানুষকে নৈতিক কোনও সিদ্ধান্তে প্রেরণা দিতে পারে না। আজীবিকবাদে জীবনে ও মরণে মানুষ নিয়তির হাতের ক্রীড়নক মাত্রই রয়ে গেল। খ্রিষ্টধর্মে, আমরা জানি, স্বাধীন ইচ্ছা ও পূর্বনিরূপণের আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়ে সংঘাত দীর্ঘকাল ধরে ধর্মচিন্তকদের ব্যাপৃত রেখেছিল; এখনও ক্যালহ্বিনের পূর্বনির্ধারণবাদে বিশ্বাস ওই সমাজে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। কিন্তু মোটের ওপর কিছুকাল ধর্মচিন্তকদের ভাবিয়ে সাধারণ মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে ওর গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমে এসেছে। ‘প্রথম থেকেই দুটি ব্যাপারকে সম্পূর্ণ পৃথক করে বুঝতে হবে: (১) দিব্য পূর্বজ্ঞান যা জ্ঞানের জগতের বস্তু, ও (২) পূর্বনির্ধারণ যার অর্থ আরও অনেক বেশি। শেষেরটিতে ঈশ্বরকে স্রষ্টা ও সৃষ্টির পালনকর্তা হিসাবে দেখা হয়; তিনি (জগতের) প্রাথমিক চালিকাশক্তির নিয়ন্তা যাঁর অধীনে (মানুষের) স্বাধীন ইচ্ছা ও অন্যান্য দ্বিতীয় শক্তিগুলি চলে। ইচ্ছাকে তিনি এমন ভাবে চালনা করেন যে তার সমস্ত স্বাধীন সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের প্রাথমিক ইচ্ছারই অধীনে কার্য হয়ে ওঠে। যে কোনও মানুষের জীবনে সাধারণ ভাবে এবং প্রত্যেকে ব্যক্তিজীবনের প্রত্যেক স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত সম্বন্ধেই এটি সত্য।’ (স্যাক্রামেন্টস মুন্ডি: অন এনসাইক্লোপিডিয়া অব থিওলজি, ১৯৬৯, ৫ খণ্ড, পৃ. ৮৮)
‘আদিম পাপটির ফলরূপে মনুষ্যজাতিকে ধ্বংসের মুখে সঁপে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই সামগ্রিক প্রলয় (মাসসা ডামনাটা) থেকে ঈশ্বর তাদেরই বাঁচান, যাদের তিনি মুক্তির জন্যে পৃথক ভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং এরা নিশ্চিত ভাবেই পরিত্রাণ পায়। অনাদিকাল থেকে এই বিশেষ ভাবে চিহ্নিতদের সংখ্যা স্থির করা আছে। বাকিদের ঈশ্বর সরাসরি পরিত্যাগ করেন না, কিন্তু তাদের পাপের জন্য তাদের নিজেদেরকে বিনষ্ট হতে অনুমতি দেন। প্রাথমিক ভাবে যা এক বিমূর্ত তত্ত্ব বলে প্রতিভাত হয়, তা আসলে দিব্য করুণা ও স্বাধীনতার সূক্ষ্ম লীলাভূমি।’ (কার্ল পপার ১৮৬৯, পৃ. ৮৮-৯০) শাস্ত্রতত্ত্ব হিসাবে এই উক্তিটি একেবারেই যুক্তিযুক্ত নয়, কারণ এতে বহু পরস্পরবিরোধী মতের সমাবেশ। ঈশ্বর ঠিক করে রেখেছেন কাকে পরিত্রাণ করবেন; বাকিরা পরিত্রাণ পাবে না, অনন্ত নরকে যাবে। যুক্তির ভাষায় এই শেষোক্তরা স্বতই সৃষ্টির আদি থেকে, তাদের জন্মেরও আগে থেকে মহতী বিনষ্টির জন্যে চিহ্নিত। ঈশ্বর কী করে তাদের বিনষ্টি তাদেরকেই অর্জন করতে দেন? স্বাধীন ইচ্ছাকে এক ধরনে উপস্থাপিত করা হয়েছে: মানুষ নিজের পাপকর্ম দ্বারাই ত্রাণে বঞ্চিত হয়। ক্রান্তিক দৃষ্টিতে তাদের সত্যিকার কোনও বিকল্প ছিল না। যেটাকে বিকল্পের মতো বোধহয় আসলে তা ফাঁকি। কাজেই এই পূর্বনির্বাচন শুধু ভবিষ্যদৃষ্টি নয়, পূর্বনির্ধারণও এর গতি। আসলে বিনাশের জন্যে চিহ্নিত মানুষটির নৈতিকতার আপাতবিকল্প হল নিরুপায় ও অনিবার্য ভাবে তার পাপকর্মই বেছে নেওয়া এবং পরিণামে তার অনিবার্য নরক। যারা একটিও পাপকর্ম করবার পূর্ব থেকেই বিনষ্টির জন্যে নিরূপিত হয়ে আছে, তাদের ক্ষেত্রে সুবিচার বা করুণার কোনও অবকাশই নেই। স্বাধীন ইচ্ছা মনকে চোখঠারা একটা ধোঁকা মাত্র, কোনও যুক্তিশীল মনই এতে প্রতারিত হবে না। ‘মানুষের যুক্তির ক্ষমতাই তার স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তি, আর স্বাধীন ইচ্ছা তো উদ্ভিদ-জগতে বা পশুদের জগতে পাওয়া যায় না।’ (বোটন ১৯৪৬, পৃ. ১৩) যুক্তির ক্ষমতা তাই স্বাধীন ইচ্ছার একটি অপরিহার্য প্রাক্শর্ত এবং বুদ্ধিমান মানুষ যুক্তিনিরূপিত আচরণ করে, তবু নিয়তিবাদে এটাকেই অনুচ্চারিত ভাবে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। করুণাময় ভগবান বা দয়াবান দেবকূল কিংবা কোনও যান্ত্রিক শক্তি যা ন্যায়বিচার করে তা কখনওই অন্ধ নিয়তিকে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার সঙ্গে একত্র অবস্থানের বিধান দিত না, কারণ এই স্বাধীন ইচ্ছার পূর্বশর্ত হল মানুষের যুক্তিবৃত্তি।
ইসলামে দেখেছি, বিরুদ্ধ নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও প্রাক্-ইসলাম যুগ থেকেই নিয়তিবাদী চিন্তা ছিল এবং এখনও তা চলে আসছে। এই বিশ্বাসের ছকে স্বাধীন চিন্তার স্থান কোথায়? ইসলামী সমাজের প্রাচীন যুগ থেকেই স্বাধীন ইচ্ছার প্রসঙ্গটি মানুষকে ভাবিয়েছে। একটি ঐতিহ্য, যার সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে তা হল, মহম্মদ বলেছিলেন, ‘স্বাধীন ইচ্ছার প্রবক্তারা আমার ধর্মে (ইরানীয়) ‘মাগি’ (পুরোহিত)-দের মতো।’ বালিয়ুজি বলছেন, ‘নিয়তিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হল ঈশ্বরীয় পূর্বনির্ধারণ। যারা বিশ্বাস করত যে, বিশিষ্ট ভাবে তাদেরই জন্যে বিধাতার নির্মিত নিয়তির শৃঙ্খলে বাঁধা পড়া থেকে মানুষ স্বতন্ত্র ভাবে (নৈতিক) বিকল্প (গ্রহণ করতে) অক্ষম, তাদের ‘মিয়াব্বিরা’ বা ‘জাহৃয়্যা’ বলা হয়— (অর্থাৎ) প্রবল একান্ত নিয়তিতে বিশ্বাসী.. মানুষের ওপরে যখন আমরা ক্রিয়া আরোপ করি তখন তা রূপকমাত্র।’ (১৯৭৬, পৃ. ২২5)
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রুকহাউস পূর্বনির্ধারণ সম্পর্কে বলে ‘ইসলামে পূর্বনির্ধারণের চিন্তা খুব স্পষ্ট ভাবেই দেখা যায়। কোরানে পশ্চাদ্দৃষ্টি দিয়েও কোনও অব্যর্থ তত্ত্বের দেখা পাওয়া যায় না (তখন একে অস্বীকারও করা হয়), অষ্টম শতকেই এটি খ্রিস্টীয় ধর্মে এসে গেছে। … পরে নিয়তিবাদ (কিসমৎ)-এর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হলে পর সমস্ত চিরায়ত শাস্ত্রের অগ্রভাগে এর স্থান হয়।’ সাধারণ্যে প্রচলিত ধর্মতত্ত্ব একে গড়ে তুলল। দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন কালে নিয়তিবাদ সম্বন্ধে কোনও ঐক্যমত্য ছিল না। ধীরে ধীরে স্বাধীন ইচ্ছা ও নিয়তির দ্বন্দ্ব ক্ষীণ হয়ে এল এবং সব প্রতিষ্ঠিত ধর্মমত যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেই নিয়তিবাদকে স্বীকার করে নিল।
প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ব্রাহ্মণ্যধর্মে। স্বাধীন ইচ্ছা সম্বন্ধে এখানে কোনও প্রশ্ন তোলা হয়নি; এটিকে পুরুষকার নামে একটি স্বীকৃত তত্ত্ব বলেই দেখা হয়েছে। পরে নিয়তিবাদের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এ দুটি তত্ত্বের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষে পূর্বনির্ধারণের আধার বা কর্তা হচ্ছে নিয়তি, কিংবা নিয়তির কোনও একটি প্রকাশ। খ্রিস্টধর্ম বা ইসলামে, যেখানে ঈশ্বর বা আল্লাহ বা বিধাতা মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করেন, ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিধি/বিধাতা হল তার সবচেয়ে কাছাকাছি; তফাৎ হল ঈশ্বর বা আল্লাহ হলেন ব্যক্তি, কিন্তু নিয়তি হল বিমূর্ত তত্ত্ব। যাই হোক, নিয়তি যেরূপই পরিগ্রহ করুক না কেন, এর সংঘাত স্বাধীন ইচ্ছার সঙ্গে। শোপেনহাওয়ার এর সংক্ষেপসার বলেছেন, ‘মানুষ যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে, কিন্তু সে যা খুশি তাই ইচ্ছে করতে পারে না।’
‘নিয়তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণত ব্যক্তিকে দায়ী করে এই অর্থে যে, কর্মের কর্তা সে-ই; দোষ দেওয়ার বা পুরস্কার দেওয়ার অন্য কেউ নেই; কর্মের জন্যে ঘটনাগত দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যায়কারী বা দুঃখভোগীর জন্যে সহানুভূতি জন্মায়; আর যারা কৃতকর্মা তাদের সার্থকতাকে সামান্য ভাবে উড়িয়ে সমর্থন করে। ললাটলেখনই সর্বতো ভাবে দায়ী, কারণ ব্যক্তির ভাল বা মন্দ উদ্দেশ্য কেবলমাত্র ইতিহাসের প্রভাব থেকে আনুষঙ্গিক ভাবে উদ্ভুত।’ (কেস অ্যান্ড ড্যানিয়েল, সম্পাদিত, ১৯৮৩, পৃ. ৪০ )
এর থেকে সরাসরি যে সিদ্ধান্ত হয় তা হল, যেহেতু মানুষের জীবনে কর্মে ও কর্মধারার চরম দায়িত্ব পূর্বনির্ধারিত, তাই ব্যক্তি হিসাবে মানুষের ওপরে কর্মের যথার্থ কোনও দায়িত্ব বর্তায় না বা তার জীবনে যা ঘটে তারও কোনও দায় নেই। মানুষ তা হলে এই যুক্তিতে এক অনৈতিক জীবে পরিণত হয়। তার বিধিলিপি বা ললাটলিখনই তার জীবনে যা ঘটবে তা ছকে রাখে তার জন্মের ক্ষণে বা তারও আগে। এই ভাবে তা হলে মানুষের অপকর্মের দায় যেমন এড়িয়ে যাওয়া যায়, তেমনই সৎ, নিঃস্বার্থ এবং মহৎ কর্মের পুরস্কারও তার পাওনা হয় না। এখন এই ললাটলেখনের সঙ্গে যদি পূর্বজন্মে কৃতকর্মের যোগ থাকে, তা হলে একটা ক্ষীণ সূত্রে ব্যক্তির দায়িত্ব স্বীকার করা হয়। কিন্তু যেহেতু এ জন্মে সে পূর্বজন্মের কৃতকর্মকে নষ্ট করতে পারে না বা যা ঘটেছে তাকে ইচ্ছাক্রমে উড়িয়ে দিতে পারে না, তাই সঞ্চিত ও প্রারব্ধ ললাটলিপি হয়ে তার সব কর্মের এবং তার জীবনের সব ঘটনার নিয়ন্ত্রক হতে পারে। এই ছকের মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছার স্বীকৃতি নেহাৎই মৌখিক ব্যাপার, এত সীমাবদ্ধ যে না থাকারই মতো। এই ধরনের যুক্তিতে রাবণের ওই রকম দুষ্কৃতী না হয়ে উপায় ছিল না, কারণ, জীবনই তার নিয়তিনির্দিষ্ট, যে নিয়তির ওপরে রাবণ-জন্মে তার কোনও শক্তিই ছিল না; সে নিয়তি নির্দিষ্ট হয়েছিল তার পূর্বজন্মে কৃতকর্মের দ্বারা। ঠিক এই ধরনের যুক্তিতেই সীতার সচ্চরিত্রতা এবং দুঃখভোগ নিয়ে কোনও প্রশংসাই তাঁর পাওনা নয় কারণ দুই-ই নিরূপিত হয়েছিল পূর্বজন্মের কৃতকর্ম দিয়ে। কিন্তু মুশকিলটা ঠিক এইখানে, কারণ রামায়ণে বলে তিনি আসলে লক্ষ্মী, সীতারূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন; রামরূপ বিষ্ণুর স্ত্রী তিনি। লক্ষ্মীরূপে তিনি এমন কী জঘন্য পাপ করে থাকতে পারেন যার ফলে আজীবন দুঃখ ও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হল? এই সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে শাস্ত্র নীরবই থাকে, কারণ উত্তর দিতে গেলে শাস্ত্রকারদের অতি যত্নে রচিত জন্মান্তর ও কর্মবাদের ধর্মীয় তাসের বাড়িটি ভেঙে পড়ে
বহুপ্রচলিত গল্পগ্রন্থ পঞ্চতন্ত্র-তে একটি শ্লোক আছে: ‘মানুষ যখন ভ্রুণাবস্থায় থাকে, তখনই পাঁচটি ব্যাপার নিষ্পন্ন হয়ে যায়: পরমায়ু, কর্ম, ধন, বিদ্যা ও মৃত্যু। অন্য ভাষায় বললে, জীবনের নির্মাণ ও অন্তিমকালের সব কিছুই মানুষের নিজের আয়ত্তের বাইরে এবং তার জন্মের পূর্বেই স্থিরীকৃত। লক্ষণীয়, এই তালিকার বাইরে তার চরিত্র অর্থাৎ বাইরের ঘটনা আগে থেকেই নির্ধারিত, কিন্তু যা তার আভ্যন্তরীণ তার নিয়ন্তা সে নিজেই। কিন্তু এই চরিত্রও তার সম্পত্তির পরিমাণ, জীবনে তার ক্রিয়াকলাপ ও বিদ্যাশিক্ষা যেগুলি মানুষের জীবনকে গভীর ভাবে নাড়া দেয় তার কোনও কিছুকেই প্রভাবিত করতে পারে না। এই বহুল প্রচারিত শ্লোকটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল নিয়তির ক্ষমতা জনমানসে কত দূর প্রসার লাভ করেছিল তা দেখানো। এ বোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল ভয় আর আতঙ্ক। ‘সব কিছুরই নির্ভীক নিয়ন্তা (হল) নিয়তি, পূর্বনির্ধারিত।’ (অর্ফিক স্তোত্র সংখ্যা ১০, পৃঙক্তি ২৬) ওই যে ‘পূর্বনিরূপিত’ বিশেষণটি এটিই হল ভয়ের কারণ, কারণ নিয়তির রায়ের পরে কোনও আপিল নেই। মানুষের কর্মের প্রায়ই কোনও কারণ নির্দেশ করা যায়, কিন্তু এতে তার স্বাধীন ইচ্ছা ব্যাহত হয় না। বের্গমানের প্রশ্ন ‘…এটা কি স্বতঃসিদ্ধ যে, কোনও কর্ম স্বাধীন হতে পারে না তার পূর্বে তার কারণ আছে বলে?… কর্মটি কোনও কারণ প্রসূত হোক বা না হোক, যে কারণ তাকেই সৃষ্টি করে বা অন্য ভাবে নির্মাণ করে সে ব্যক্তিটি যদি আমি না হই তবে কর্মটিও স্বাধীন নয়।’ (১৯৭৭ পৃ. ২৩২, ২৩৭) অর্থাৎ কর্তা যদি স্বয়ং কোনও কর্মের ইচ্ছা না করে ও সাধন না করে, সে তার স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করে না। লঙ তাঁর হেলেনিস্টিক ফিলজফি গ্রন্থে বলেন, ‘স্টোয়িকরা নিয়তিবাদ সমর্থন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ, যার ধর্মগুলি তার প্রকৃতিতে আরোপ করে। সার্বত্রিক ‘প্লেউমা’ বা ‘লোগস’-রূপে প্রকৃতি সব কিছুর সচেতন নিয়ন্ত্রী। যদি কিছু ঘটনা স্বতই ঘটত অথবা প্রকৃতির ক্ষমতার বাইরে থাকত তা হলে শুধু প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়ে পৃথিবীর ব্যাখ্যা মিলত না। দিব্য বিধাতা, যাকে স্টোয়িকরা কষ্ট করে মানত, তার প্রাক্শর্ত হল, ঈশ্বরের বা প্রকৃতির তেমন ক্ষমতা যার দ্বারা এ (পৃথিবীর) অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও ভাল কাজ করানো যেত। প্রকৃতি প্রতি অংশকে এমন ভাবে বিন্যস্ত করেছে যাতে পৃথিবীতে সুসংগতি থাকে।… তথাকথিত স্বাধীন সমস্যা মূলত দুটি ধারণা থেকে আসে— ভগবানের সর্বশক্তিমত্তায় বিশ্বাস এবং প্রাকৃতিক কার্যকারণ সম্পর্কের অব্যবহিত ধারায় নিঃশর্ত বিশ্বাস। কার্নেয়াডেস বিশ্বাস করতেন, সজ্জনের দুঃখভোগ এবং দুর্জনের সুখী জীবন প্রমাণ করে যে, দেবতারা মানুষের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন… এখানে এবং অন্যত্র কার্নেয়াডেস এমন একটি স্টোয়িক তত্ত্ব খুঁজে বের করেছেন, মানুষের প্রতি দেবতাদের দায়িত্বশীল করুণাবৃত্তি প্রমাণে যুক্তি এনেছেন যা এ তত্ত্বের সঙ্গে একান্তই সম্পর্করহিত। (১৯৮৬, পৃ. ১৬৪, ৬০, ১০১)
কার্নেয়াডেস ছিলেন খ্রিস্টপূর্বকালের স্বাধীন ইচ্ছার সমর্থক একজন দার্শনিক। তিনি বলতেন, মানুষ কী করতে যাচ্ছে তা বলার সাধ্য স্বয়ং আপোলোরও নেই। এ উক্তি ইচ্ছা-স্বাধীনতা সম্বন্ধে মানবিক গর্বের একটি চূড়ান্ত উচ্চারণ। হবস বলেন ‘কর্ম সম্বন্ধে প্রকৃতিতে নিহিত এবং কর্মকর্তার নিজস্ব গুণধর্মগত সব রকম বাধার অভাবই স্বাধীনতা।’ (১৯০৬) দার্শনিক লক বলেন, ‘নিজের ইচ্ছার গতি অনুসারে মানুষ চিন্তা করবে কি না করবে, গতিমান হবে কি না হবে, এ ক্ষমতা যতটা পরিমাণে তার আছে ততটাই সে স্বাধীন।’ দার্শনিক হিউম বলেন, অবশ্যম্ভাবী কারণের একটি ধারা (আছে) যা পূর্বনিরূপিত ও পূর্বনিয়ন্ত্রিত, যা আদিতম কারণ থেকে প্রত্যেক পৃথক ইচ্ছা ও মানবিক কর্ম পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন। নিয়তিবাদী বিশ্বাস করে কিংবা অর্ধেক বিশ্বাস করে যে, শুধু যে যা ঘটতে চলেছে সেটিই তার সৃষ্টির কারণের অনিবার্য ফল তা নয়— এটিই যথার্থ আবশ্যিকতার তত্ত্ব, কিন্তু তা ছাড়াও এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিরর্থক; আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন এ ঘটবেই।’ এই সব দার্শনিকদের মতে স্পষ্টতই প্রমাণ হয়, নিয়তিবাদ স্বাধীন ইচ্ছার পরিপন্থী। ঈশ্বরবাদী দার্শনিকরা বিধাতার সেই দিব্য পূর্বনিরূপণ স্বীকার করেন, যা পৃথিবীর মর্ত্য মানুষের কাছে নিয়তিরূপেই প্রতিভাত হয়। কারণ দুটিই মানুষের কাছে সমান অজ্ঞেয় এবং দুটিই দেখা দেয় এমন অনর্জিত অভিজ্ঞতা রূপে যার সম্বন্ধে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার কোনও অবকাশ ছিল না। ক্যাম্পবেল-এর যুক্তি ‘কোনও সিদ্ধান্ত কি ব্যক্তির নিজের ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও বৈকল্পিক রূপে প্রকাশিত হতে পারে? তা যদি হয়, তা হলে আমরা এমন স্বাধীন ক্রিয়া পাচ্ছি, যার যথেষ্ট নৈতিক ভিত্তি আছে, যে স্বাধীন ইচ্ছা যা-কিছু ইচ্ছা করতে পারে তেমন স্বাধীন ইচ্ছার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’ (১৯৬৭, পৃ. ৪৪) ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়তিবাদের বিরুদ্ধে, স্বাধীন ইচ্ছারও বিরুদ্ধে। এ কথা ঠিক যে চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ মতবাদীরা ঈশ্বর মানতেন না, কিন্তু চার্বাক বাদে অন্যরা এবং আরও অনেক বেদবিরোধী প্রস্থানেও কর্মবাদ বা জন্মান্তরবাদের স্থান হয়েছিল এবং অমোঘ নিয়তিবাদেরও। ‘ধর্মানুষ্ঠানকারী (আর তার আস্তিক বংশধর) মানুষের মরণোত্তরণকে নিরাপদ করবার জন্যে আধ্যাত্মিক নির্দেশের কাছে মাথা নত করে। অপরপক্ষে নাস্তিক তার মরণোত্তরণকে সঁপে দেয় মানুষের স্বাধীনতার জন্যে।’ (হেস্টারমান, জ্বীনার সাইটশ্রিফট ফ্যুর ডী স্যুড উন্ড অস্টআসিয়েটনস’ সংখ্যা ১২-১৩-১৯৬৮-৬৯, পৃ. ১৮৪)
ভারতবর্ষে সংহিতাকালের পর থেকেই স্বাধীন ইচ্ছা ও নিয়তিবাদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। নিয়তি ও পুরুষকারের মধ্যে এই সংঘাত মহাকাব্য ও পুরাণে দৃঢ় ভাবে প্রকাশিত হয়। ভগবদগীতা বলে, মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা তাকে জোর করে কর্মের দিকে ঠেলে দেয়। (৩:৬) ‘সব মানুষই স্বপ্রকৃতির অধীন, এবং সে প্রকৃতিরই অনুগামী হবে, তাড়নায় কোনও ফল হয় না।’ (৩:৩৩) কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, ‘অহমিকার বশে তুমি সিদ্ধান্ত নিলে ‘আমি যুদ্ধ করব না’– এটা হল মিথ্যা দত্ত। প্রকৃতি তোমাকে বাধ্য করবে। তুমি নিজের কর্মেই আবদ্ধ, যে কর্মের উৎস প্রকৃতি। এখন যে কর্মবিমুখ হচ্ছ, যে কর্ম তুমি করতে চাইছ না— মোহবশে— (সেই কর্মই) তোমাকে যন্ত্রচালিতবৎ করতে হবে।’ (১৮:৫৯,৬০) দেবীভাগবতপুরাণ বলে, ‘সমস্ত জড় ও জঙ্গম জগৎ নিয়তির (অধীনে); কোনও জীবই স্বতন্ত্র নয়, সকলে নিজের কর্মফলের অধীন।’ (৩:২০:৩৫,৩৬) নিয়তির বশে থাকা বা নিজের অজ্ঞাত কৃতফলের বশে থাকা মানুষকে নিষ্কর্মা ও সুখদুঃখে উদাসীন করে তুলতে পারে। নিয়তিকেই আমি সর্বপ্রধান মনে করি, ধিক মানুষের কর্মকে। (না হলে) সব দেবতাদের চোখের ওপরে বিষ্ণুর মাথা কাটা যেত না।’ (ঐ ১:৫:৪২) ‘হে ইন্দ্ৰ, মানুষ নিয়তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তার সুখই বা কী, দুঃখই বা কী? কাল (তার ওপরে) যথেচ্ছ আচরণ করে।’ (ঐ ৪:১৪:৫)
কাল তা হলে নিয়তির আর এক চেহারা। আগেই দেখেছি মৃত্যু ও কালের কয়েকটি সাধারণ প্রতিশব্দ আছে— কাল, অন্তক, ইত্যাদি। মৎস্যপুরাণ বলে, ‘কাল, মৃত্যু, অন্তক (অন্তকারী) যম, বৈবস্বত এবং ধর্মরাজ এরা সকলেই এক।’ (২১৩:৩-৭) ওই পুরাণেই আছে, ‘সব দুর্ভাগ্য ও আপতিক ঘটনাই নিয়ন্ত্রণ করে কাল; কাল প্রতিকূল বা কুপিত হলে কেমন করে তা এড়াব?’ (২১০:৫-৭) ‘কাল, কর্ম ও প্রকৃতি— পরমাত্মা এদের যেমন পেরেছেন তেমনই ব্যবহার করেছেন, এবং নিজে যা হয়েছেন তা হওয়ার জন্যেই ব্যবহার করেছেন।’ (ভাগবত পু. ২:৫:২১) ‘ওই কাল, অনন্তকালের স্রষ্টা; স্বয়ং অনাদি কিন্তু আদির স্রষ্টা, ন্যায়চারী, মানুষকে সৃষ্টি করেন ও মৃত্যু দিয়ে অন্যায়কে বিনাশ করেন।’ (ঐ ৩:২৬:৪৫) ‘এই স্বতন্ত্র রূপ দস্যুদের নিধন করে স্বর্গকেও প্রজাদের অধিপতিরূপে (বিনষ্ট করে), কালরূপে; বিভিন্ন গুণের (অধিকারী হয়ে) তিনি এ কাজ করবেন, (অর্থাৎ) সব কিছুকেই সংহার করবেন।’ (ঐ ৮:১৪:৯) ‘নাগরাজ তক্ষক সূক্ষ্ম কীটরূপে শত্রুর কণ্ঠলগ্ন হয়ে তাকে বিনাশ করেন; মারবার পূর্বক্ষণে তক্ষক কালের ভয়ংকর মূর্তি পরিগ্রহ করেন।’ (দেবীভাগবত পু. ২:১০:৬২)
কালের তা হলে একটি দ্বিতীয় সত্তা আছে: মৃত্যু, বিনাশ ও অন্ত। মহাভারত বলে, ‘কাল প্রাণীদের ‘পাক’ করে, (সম্ভবত) তাদের মৃত্যুর উদ্দেশ্য পরিপক্ক করে।’ (১:১:১৮৮০-৯১, ১২:২০৬:১৩; ২২০:২) ‘কালঃ পচতি ভূতানি।’ এখানে ‘পচ’ ধাতুর একটি অর্থ পাক ধরানো, যেমন ফলের পরিণতি। কাল কত দিন ধরে পাকায়, পাক করে এবং কেন? জীবকে মৃত্যুর যোগ্য করে তুলতে, কারণ পাকা ফলটিই খসে পড়ে। কালের বিশ্বজাগতিক ভূমিকা তা হলে জীবকে পরিণত করে মৃত্যুর বশে এনে ফেলা? নারদের বলা এক কাহিনিতে আছে, কালের একটি কন্যা উপযুক্ত স্বামীর খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাউকেই পছন্দ হচ্ছে না, শেষ পর্যন্ত নারদের পরামর্শে সে ‘ভয়’ কে স্বামী বলে নির্বাচন করল। মৃত্যুর সঙ্গে ভয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সূচিত হচ্ছে এ কাহিনিতে। অন্যত্র কালের অপর একটি কন্যার নাম ‘জরা’, যাকে কারও পছন্দ হয় না। যবনরাজ ‘মৃত্যু’ ভগিনী জরাকে ক্ষয়ের জন্যে নিয়ে যায়। (‘ক্ষয়’ শব্দের আর একটি অর্থ ‘গৃহ’!) যবনের সঙ্গে কালের সম্বন্ধ এক বিজাতীর অনুষঙ্গ বহন করেছে এ কাহিনিতে। (মৃত্যুকে যবনরাজ বলে উল্লেখ করাটাও লক্ষণীয়, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকেই এর উদ্ভব) (ভাগবত পু. ৪:২৯:২২-২৩) নিয়তির প্রসঙ্গে কালের ভূমিকা তা হলে কী? কাল অনিবার্য মৃত্যুর অভিমুখে জীবকে নিশ্চিত পরিণতির দ্বারা এগিয়ে দেয়। মৃত্যু ধ্রুব; বিশ্বজাগতিক একটি নিয়ম, যা সব প্রাণীর পক্ষে সমান ভাবে অনিবার্য। সেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে এগিয়ে দেয় কাল? কেমন করে? পাক করে বা পরিণতি দিয়ে। তা হলে কাল মৃত্যুর রূপান্তরই শুধু নয়, মৃত্যুর অবিচ্ছেদ্য সহকারীও এই কালের একটা পিঠ মানুষের দিকে, তা পাক করে ‘পরিণত করে’ মানুষকে মরণের যোগ্য করে তোলে; আর এর উল্টোপিঠটা হল মানুষের ঊর্ধে মহাবিশ্বের দিকে, যেখানে সে অনাদি অনন্ত সময়, যার মধ্যে উৎপত্তি, স্থিতি ও বিলয় বিধৃত আছে।
মুশকিল, কাল জীবকে পরিণত করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেয় এ কথাটা সর্বাংশে তো সত্য নয়। রোগে মৃত্যু, আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, অকাল মৃত্যু, যুদ্ধে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মৃত্যু, শিশুমৃত্যু, ভ্রূণমৃত্যু এগুলির মধ্যে পরিপাক নেই, কালের ওই মহাজাগতিক ভূমিকা এর মধ্যে অনুপস্থিত। যথাসম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাপন করার পরে জরায় বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর মধ্যে ওই ‘পাক’ এর কথা ওঠে। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ লোকের অকাল মৃত্যু হচ্ছে রোজ, তাদের ক্ষেত্রে কালের কোনও ভূমিকাই নেই; কাল সেখানে অকাল মরণের ক্রূর স্বেচ্ছাচারী একটি রূপ। এখানে না আছে স্বাধীন ইচ্ছার অবকাশ, না আছে কর্মবাদের কোনও যথার্থ ক্ষেত্র। কালের কন্যা উপযুক্ত স্বামীর খোঁজে গিয়ে নারদের পরামর্শে ‘ভয়’কে নির্বাচন করল এইটিই খাঁটি কথা; কাল থেকে উদ্ভুত, অর্থাৎ বিনষ্টির অপর রূপ, সে তো মৃত্যুভয়েরই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সবচারিণী। যেমন যবনরাজ মৃত্যুর ভগিনী জরা; যদিও এটি সার্বত্রিক নয়; কারণ অকাল মৃত্যুতে জীব জরা পর্যন্ত পৌঁছতেই পারে না। এই ধরনের ক্ষেত্রে কাল নিয়তির বিকল্প হয়ে যায়। পদার্থবিদ্যা বলে, কালের আত্যন্তিক কোনও সত্তা নেই; ‘সময়’কে মানুষই বৎসর-মাস-দিন-প্রহরে ভাগ করেছে; কিন্তু যাকে ভাগ করেছে তা তো কাল্পনিক, অবাস্তব। মানুষ দিনরাত্রি ও ঋতুপরিবর্তন দেখে কাল সম্বন্ধে কল্পনা করেছে। এবং মানুষের জীবনে এই কল্পিত কালের যা ভূমিকা তার শেষ প্রান্তে মৃত্যু। মৃত্যু মানুষের চরম ভয়ের বস্তু, এই ভয়ই কালের ওপরে এক সার্বভৌম ক্ষমতা আরোপ করেছে। যার ফলে কাল পরাক্রান্ত, অপ্রতিহত রূপে প্রতিভাত হয়।
‘এই মহাবীর সর্বাভিভু কালের অন্তরাত্মা নির্মিত হয়েছে বিক্রম, শক্তি ও চরিত্রবল এবং ইন্দ্রিয়গুলি দিয়ে। ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতারা এর অধীন।’ (ভাগবত পুরাণ ৭:৮:৮৯) ‘কাল শক্তিমানের চেয়েও শক্তিমত্তর, প্রভু ঈশ্বর, অনন্ত। মেষপালক যেমন পালের পশু হনন করে, তেমনই ইনি নিজের প্রজাকে বধ করেন।’ (ঐ ১০:৫১:১৯) এখানে যেন প্রতিধ্বনি পাই শেক্সপীয়রের, ‘দুর্বৃত্ত বালকদের কাছে যেমন মাছি, তেমনই আমরা দেবতাদের কাছে/নিজেদের খেলার ফূর্তির জন্যে মারেন আমাদের।’ (কিং লিয়র, ৪র্থ অঙ্ক ১ম দৃশ্য, পঙক্তি ৩৬-৩৭)
‘কাল সর্বাতিগ আত্মা অগম্য লোক, প্রকৃতি ও ধর্ম— এই সব পরস্পর-সংমিশ্র বস্তুর মধ্যে মানুষ আমাকে (ঈশ্বরকে) নানা ভাবে রূপায়িত করে।’ (ভাগবত পু. ১১:১০:৩৪) ‘কালের সঙ্গেই সব ক্রিয়ার সম্পর্ক ফল ভোগ করার জন্যে। কর্ম ও তার ফলোদয়ের মধ্যবর্তী ব্যবধান (ভোগ্য) শুভ বস্তুগুলি হল সুখ, আনন্দ, দুঃখ, ভয়, বেদনা ও ক্ষতি। কালে গাছ বাড়ে, শাখা ছড়িয়ে দেয় কালে, কালে পুষ্পোদগম ও ফলোদয় হয়। আবার কালে ধ্বংস ও হয়ে যায়।’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. প্রকৃতি খণ্ড ১৭:৫৫-৫৭) ‘কাল রাজ্যদান করে, কাল (নিরুপণ) করে মৃত্যু ও পুনর্জন্ম। কাল বিশ্বকে সৃষ্টি করে, (আবার) কালই তাকে ধ্বংস করে। জনার্দন রূপে (সৃষ্টিকে) রক্ষা করে, কালের অন্ত শ্রীকৃষ্ণ, স্রষ্টারও স্রষ্টা, সংহারকেরও সংহতা, পালকেরও পালক, নিষেকের (যে কর্ম আসন্নফল) স্রষ্টা। নিয়তির সঙ্গে মিলে তপস্যার ফল নিষেককে (কাল)নিজেই দেন। কোন জীবন কার দ্বারা কবে নিহত হয়েছে, যার কর্মফল পরিপক্ক হয়নি?’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. ৩৩ গণেশজন্ম খণ্ড, ৩৪, ৬৬-৬৮) ‘কালে সব কিছু ধ্বংস হয়, কালকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কালেরও কাল শ্রীকৃষ্ণ।’ (ঐ ৪০:৪৬,৪৭) ‘কালই বন্ধুদের একত্র করে, আবার পৃথকও করে, শত্রুতা অথবা স্নেহের সৃষ্টি করে আনন্দ, দুঃখ, ভয়, ক্রোধ, জরা মৃত্যু, পুনর্জন্ম সবই কর্ম অনুসারে হয়, কাল তা নিয়ন্ত্রণ করে।’ (ঐ কৃষ্ণজন্ম খণ্ড ৯০:৭০-৭৩) ‘নাসাবিদ্ধ গাভীরা যেমন নিয়ন্ত্রিতভাবে চলে, সেই রকম সমস্ত দেবতারাই কালের পাশে আবদ্ধ হয়ে থাকে।’ (দেবীভাগবত পু. ৪:২০:১৭) ‘কালই পুণ্য ও পাপের স্রষ্টা।’ (ঐ ৬:১১:১৪) কাল-কে অতিক্রম করা যায় না।’ (ঐ ৩:৩০:১৯) ‘সমতা ও বিষমতার স্রষ্টা কাল, কালই আনে পরাজয়, সম্মান ও শ্রদ্ধা। কাল কোনও মানুষকে দাতা করে, অন্যকে করে প্রার্থী। কালের চরিত্র পর্যবেক্ষণ কর।’ (ঐ ৭:২২:১৯, ২০) ‘কালে বিশ্বগুলির উৎপত্তি কালেই তাদের বিলয়। স্রষ্টা কাল থেকে সৃষ্টি করেন, পালক কালে পালন করেন, সংহর্তা কালেই সংহার করেন; এঁরা তালে তালে পা ফেলে চলেন। স্রষ্টা, পালক ও সংহর্তাই আত্মা, কালের নর্তক।’ (ঐ ৯:১৬:৫৩, ৫৬-৫৮)
রামায়ণ-এ জটায়ু রাবণকে বলেন, তুমি কালের পাশে বদ্ধ, মুক্তির জন্য তুমি কোথায় পালাবে? (৩:৫১:২৭) রাম লক্ষ্মণকে বলেন, লক্ষ্মণ, সমস্ত জীবের মধ্যে কালের সর্বাতিক্রমী মহাপরিক্রম দেখ। (৩:৬৯:৪৮) কাল হরণ করে, ধ্বংস করে গঠন করে, দগ্ধ করে এবং বধ করে। কাল সংসারে নৃত্য করে নানা রূপে, যেন এটি নট। (যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ, বৈরাগ্য ২৩:১১) ‘দেব মহাকাল যেন লীলাপর পিকশিশু।’ (ঐ ২৪:৮) ‘এই কাল, গ্রাস করবার জন্যে সততই উন্মুখ এক বর্বর, সংসারকে সর্বদাই বিপদসমুদ্রে ঠেলে ফেলেছে।’ (ঐ ২৬:৩) বনগমনের আগে কৌশল্যা রামকে বলেন, ‘কালকে যথার্থই কখনও অতিক্রম করা যায় না।… এ পৃথিবীতে কৃতান্তের গতিবিধি, বৎস, সর্বদাই বোধের অতীত।’ (রামায়ণ ২:৩৩:৩৫) ‘জীবের সত্তা ও সত্তাহীনতার একমাত্র অধীশ্বর হল কাল।’ (ভাগবত পু. ৪:১২:৩) ‘বীর, পরাক্রমী, সশস্ত্র সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে বালুকাস্তুপের মতো পড়ে যায়।’ (রামায়ণ ৩:৬৯:৫) বালী শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে তারা বিলাপ করে বলেছেন, ‘কালই নিশ্চয় তোমার জীবনের অবসান ঘটাচ্ছে। (ঐ ৪:২০:১৪)
মহাভারত-এ একটি বারংবার উচ্চারিত শ্লোকে একটি চিরসত্য বিঘোষিত হয় ‘কাল উদ্যত অস্ত্র দিয়ে শত্রুর শিরশ্ছেদ করে না। কালের শক্তি এইখানেই যে, সে মানুষকে সব কিছু বিপ্রতীপ দেখায়।’(২:৭২:১১) কালকে দেখা হয়েছে সর্বাপেক্ষা প্রবল ধ্বংসশক্তিরূপে, নিয়তির শ্রেষ্ঠ অস্ত্ররূপে, যা মানুষের চিত্তে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, কারণ তা (নিয়তি) সম্পূর্ণই অননুমেয়। খরা, প্রবল ঝড়বৃষ্টি, অগ্নিকাণ্ড, বন্যা এ সবই কাল নিয়ে আসে। এক কল্পের শেষে এ সব ঘটে, কারণ তখন কাল কলিরূপে কল্পটির অবসান ঘটায়। ভগবদ্গীতা-য় বিশ্বরূপ-দর্শন করানোর সময় কৃষ্ণ নিজেকে লোকক্ষয়কৃৎ বলেছেন। (মহাভারত ৬:৩৩:৩২) প্রায়ই শুনি কালের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তনীয়, কাল অনতিক্রম্য, কালের রায় কেউ এড়াতে বা অবজ্ঞা করতে পারে না। কালের কলিরূপ সম্বন্ধে আরও শুনি মৎস্যপুরাণ-এ। (২৭০-২৭২; বামন পুরাণেও ৪৭:১২৫-৩৬) কলিকে কালের বিপর্য্যাস হিসাবে দেখানোর একটি ক্ষীণ চেষ্টা আছে; কলি হল অকাল, বিকাল, দুষ্কাল এবং কাল। স্পষ্টতই এখানে কালকে উচ্ছৃঙ্খলরূপে দেখাবার চেষ্টা, কিন্তু কোনও চিত্র স্পষ্ট হয় না, কারণ সমস্ত অংশটি বিমূর্ত, কষ্টকল্পিত অর্থাৎ মানুষের যুক্তিবুদ্ধি কালকে তার স্বরূপে জানতে বা ভাবতে পারে না। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ-এ (১:৮৬:১২০) কলি ও যুগক্ষয়ের প্রলয়ংকর মহাবিনাশের চিত্র আছে। খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, কলির সবচেয়ে স্পষ্ট বর্ণনা দার্শনিক ভাবে অসার্থক; সার্থক সেখানে যেখানে বর্ণনা সামাজিক বিপর্যয়ের, বিভ্রাটের, মূল্যবোধের বিপর্য্যাসের এবং কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের, যেখানে বিষ্ণুযশার পুত্র কল্কি সমাজে পরিব্যাপ্ত পাপকে ধ্বংস করে অক্ষম দৈত্যদের বিরুদ্ধে এক ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ, তার যুদ্ধ জয়ের ফলে সৃষ্ট হয় এক নতুন পৃথিবী, তার দ্বারা সূচনা হয় পরের কল্পের। কাল অপভ্রষ্ট হয় কলির মধ্যে এবং কল্কির মধ্যে সে এক প্রতিকারী কর্মকর্তাকে খুঁজে পায়, সারা পৃথিবীর পাপ-ত্রুটি বিচ্যুতিকে মুছে দেবে, যাতে কাল আবার নতুন করে চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকবে নির্বিঘ্নে। যুগসংহর্তা কলির কল্পনা নানা নামে পৃথিবীর সব পুরাণেই আছে।
১৩৩
মহাভারতের সেই বিখ্যাত এবং মৌলিক তত্ত্বপূর্ণ কাহিনিটিতে শুনি, ‘গৌতমীর পুত্রের সর্পাঘাতে মৃত্যু হয়েছে। গৌতমীর অনুযোগ যে, সর্পটি বলে সে মত্যুর হাতের যন্ত্র মাত্র। ‘কাল আমাকে প্ররোচনা দিয়েছিল, সর্পটি বলে। মৃত্যু বলে, ‘মৃত্যুর পশ্চাতে কাল’, আর কাল বলে ‘বালকটির পূর্বকর্মই এই অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী।’ সব কালকেন্দ্ৰিক, হে সৰ্প, এ সমস্ত সত্তাই কাল।’ (মহাভারত ১৩:১:৪৬) … সব কিছুই সৃষ্টি করে কাল, ধ্বংসও করে কাল।’ (ওই শ্লোক ৪৯) কৃষ্ণ সৃষ্টিতে সত্তার ব্যাখ্যা দেন অজুর্নের কাছে, ‘সবেরই মূল কালে, ধনঞ্জয়, কালই আবার নিজ ইচ্ছায় সব ফিরে নেয়।’ (ঐ ১৬:৭:৩৩)
মহাভারত-এর বহু পরে এক পরিশিষ্ট কাব্য হরিবংশ-তেও এই উপজীব্যটির উল্লেখ আছে, ‘কাল মানুষের শত্রু, কালই আবার পরিণাম। কাল সকলকেই নিয়ে চলে যায়, আমার মতো ব্যক্তি নিমিত্ত মাত্র।’ বিষ্ণু পুরাণ-এর ভবিষ্য পর্বে কলিতে উত্তরোত্তর ধর্মের অবক্ষয় ও হীনতার এক বিবরণ আছে, (৩য় অধ্যায়) কাল তার সংহারী মূর্তিতে বহু অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দৈত্যসেনার সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়লাভ করে। (৫৯ অধ্যায়, ৭৪-১০০) কালের অপর মূর্তি মৃত্যু, তার সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, কেউ অকালে মরে না— নাপ্রাপ্তকালো ম্রিয়তে। (মহাভারত ৪:৬২:১৩; ৮০:১০-১৩৩; ৮১:১-১৭৮; ৮১:১-১৪৩; ৮৪:১-১১৪; এই সর্ব দীর্ঘ অধ্যায় ও অধ্যায়াংশে কাল নিয়তির সঙ্গে অভিন্ন এবং দু’জনেই ন্যায়পরায়ণ ও অভ্রান্ত, এই কথাই বলবার চেষ্টা করা হয়েছে।) কিন্তু এ হল প্রশ্নটিকেই প্রশ্ন করা: কেউ অকালে মরে না মানে যখন মরে তখনই তার মৃত্যুকাল! খুব সদয় ব্যাখ্যাতেও এ একটি নিরর্থক সান্ত্বনা মাত্র, আর যথার্থ ব্যাখ্যায় এ হল অসাধু বিতর্ক। অর্জুন যখন অসংখ্য আত্মীয়ের আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায় শোকাভিভূত, কৃষ্ণ তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘পার্থ, শোকে আচ্ছন্ন হয়ো না, কাল দুরতিক্রম্য।’ (মহাভারত ৭:৫৭:৬) যদিও কোনও কর্ম সম্বন্ধে কোনও পরিকল্পনা হয়েও থাকে, তবু সেটা অন্য ভাবে ঘটে— এতেই বোঝা যায় নিয়তির ক্ষমতা কত। কাল দুৰ্জেয়।’ (মহাভারত ৮:৫:৪৫) এখানে কালকে নিয়তির সঙ্গে অভিন্নরূপ দেখা হয়েছে। কালের চিত্র সর্বদাই ন্যায়পর, কোনও ব্যক্তির সপক্ষে বা বিপক্ষে পক্ষপাতিত্ব নেই।… কাল (আবার) (স্বকর্মে) উদাসীনও নয়। সকলকেই সে সবলে আকর্ষণ করে। (৩:২:১৪) ‘সব কিছুই ঘটে কাল পরিণত হলে,’ আগেও নয় পরেও নয়। (১২:২৬:৫-১২) কালের ভীষণ সংহারী মূর্তি দেখানো হয়েছে: ‘কাল ঘুরে ঘুরে সব বাড়িতে হানা দেয়, টাক-মাথা, ভয়ংকর রক্তবর্ণ এক কৃষ্ণ পুরুষ রূপে।’ (ঐ ১৬:৩:১,২২)
এই ভয়ংকর দেবতার নারী সংস্করণ হল কালী। তন্ত্র এই দেবীকে অধিগ্রহণ করলে পর এঁর কালসূচক লক্ষণগুলি জটিল, সাংকেতিক রহস্যাবৃত হয়ে ওঠে; এই কৃষ্ণাবর্ণা নারী ‘রাত্রে হাসেন, সাদা দাঁতগুলি প্রকাশ করে।’ (ঐ ১৬:৪:১)
কালের সারসত্ত্ব কী? ‘যাকে কোনও দিক থেকেই কখনওই, প্রতিহত করা যায় না সেই দিব্য কাল আমাদের সামনে উপস্থিত।’ (ব্রহ্মাণ্ড পু. ১:১৩:১৯) এর মূলসত্ত্ব হল অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রতিহত। তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, ‘কালই যদি সুখদুঃখের হেতু হয়, তা হলে নিজেকে শুচি করার, নিষ্ক্রিয় বা সক্রিয় থাকার সার্থকতা কী?’ (ভাগবত পু. ১১:২৩:৫৫) এই গুরুত্বপূর্ণ মতের থেকে যেটি উত্থিত হয় তা হল, কালই যে আমাদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ ও সেগুলির ফলও নিয়ন্ত্রণ করে, তা স্বীকার করা। এতে কর্ম যে করে সে যেন নিষ্ক্রিয় দ্রষ্টা অথবা অসাড় যন্ত্রে পর্যবসিত হয়।
কালের সঙ্গে সম্পর্ক ত্রিকালের: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের। মানুষ তার বর্তমান সম্বন্ধে গভীর ভাবে ও অব্যবহিত ভাবে সচেতন, যে-বর্তমানে সে বেঁচে আছে, কাজ করছে; ভবিষ্যৎ আছে তার স্বপ্নে ও বাসনায়, কিন্তু অতীত সম্বন্ধে তার চেতনা ক্ষীণ। প্রত্নখননে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালে সুমেরীয় উপত্যকায় পণ্ডিতেরা যে সব সমাধিবস্তু পেয়েছেন তার থেকে অনুমতি হয় ওখানে একটি সর্বতোপ্লাবী বন্যা হয়েছিল। এ বন্যার পরে যারা বাঁচল, তাদের ও তাদের সন্ততিদের ওপরে এর একটি গভীর প্রভাব পড়েছিল মেসোপটেমিয়ার নগর-রাষ্ট্রগুলিতে। এটা খুবই সম্ভব যে, পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহৎ প্লাবনগুলির শেষতম এই প্লাবনের ফলে একটা অস্বাভাবিক অস্থিরতা এসেছিল মানুষের মনে। এই প্লাবন এবং মধ্যে মধ্যে (এ ছাড়া) যে সব ভূমিকম্প, সূর্য চন্দ্রগ্রহণ, খরা, বন্যা, দাবদাহ, অবিরল বর্ষণ, পঙ্গপাল, মহামারী, হিংস্র জন্তুর আক্রমণ, অত্যন্ত বিভীষিকাময় ঝড় বৃষ্টি হত, সে সব মিলে মানুষের নিরাপত্তাবোধ যেন চলে গিয়েছিল। প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুমেরের রাজাবলীর তালিকাযুক্ত মহাকাব্য গিলগামেশ— যার আস্য সংস্করণ পূর্বে লোকসমাজে প্রচলিত ছিল— তার মধ্যে এবং প্রাচীন চিনা শাস্ত্রগুলিতে পাই মেসোপটেমিয়ায় প্রচলিত ওই মহাপ্লাবনের এক সংস্করণ- যা শতপথ ব্রাহ্মণ-এর মনুমৎস্য উপাখ্যানে এবং বাইবেল-এও পাওয়া যায়— এ সবের মধ্যেই মানুষের এই অস্থিরচিত্ততার নিদর্শন মেলে। এ বিপৎসংকুলতার মনোভাব নিয়তিবাদের উৎপত্তির উপযুক্ত জমি তৈরি করে। অন্যান্য কারণও ছিল, পরে আলোচনা করব।
মানুষ যেহেতু প্রাণপণ কল্পনাতেও এই সব ‘অতিলৌকিক’ ঘটনার হেতুনির্ণয়ে সমর্থ হয়নি, তাই তারা জ্যোতিষ্কলোকের চর্চায় ব্যাপৃত হয়ে এমন একটি জ্যোতিষশাস্ত্র নির্মাণ করল যার সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের খানিকটা যোগ আছে। এর দ্বারা মানুষ নিয়তিঘটিত দুর্বিপাকের ব্যাখ্যাই যে শুধু করল তা নয় আগামী ঘটনা-দুর্ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণীও করতে লাগল। ‘জ্যোতির্মণ্ডলের প্রত্যেক ঘটনার সঙ্গে মানবজীবনের ঘটনাবলির ঘনিষ্ঠ যোগ আছে, এই বিশ্বাসের পরিণতি হল পুরোহিতরা জ্যোতিষ্কগুলি সম্বন্ধে সূক্ষ্মচর্চা শুরু করলেন।’ (হুইটরো, ১৯৮৮, পৃ. ৩১) জ্যোতিষচর্চা হল মানুষের জীবনের অজ্ঞাতকে জানবার বহুবিধ চেষ্টার অন্যতম, সেই অজ্ঞাত হল কর্ম আর নিয়তি। ভূতলে কোনও কারণে যার হেতু পাওয়া গেল না, পুরোহিতরা তার হেতুনির্ণয় করতে চেষ্টা করল, আকাশের জ্যোতিষ্কে। এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা ছিঁটেফোঁটাও নেই।
ইরানে কাল সম্বন্ধে দ্বৈত ধারণা ছিল। সমস্ত ইরানীয় ধর্মচিন্তায় একটা দ্বৈততার প্রবণতা আছে, কাজেই সময় সম্বন্ধেও যে দুটি পৃথক রূপ বা লক্ষণ দেখা যাবে, এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই: এ দুটি হল অবিভাজ্য কাল অর্থাৎ চিরন্তন ‘বর্তমান’, আর বিভাজ্য কাল যার ক্রমপর্যায় আছে। প্রথমটিতে কালের স্রষ্টার ভূমিকা এবং এটিই মৌলিক। এর নাম ‘জুবান অকরণ’ অথবা অনন্তকাল যা সৃষ্টির আদিপুরুষ, শুভ ও অশুভ শক্তিরও। বিশ্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত হল কালের অপর রূপটি, ‘জুবান দারেঘো ছবধত’ অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী কাল। এই কালই জরা ও মৃত্যু আনে।’ (হুইটরো, ১৯৮৮, পৃ. ৩৫)
প্লেটো মনে করতেন বিশ্বই কাল বা সময়কে সৃষ্টি করে। এরিস্টটল এ মত প্রত্যাখ্যান করেন, ‘কাল (বা) সময়কে আর একটি স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক তত্ত্ব হিসেবে দেখা হল না, এটি হয়ে গেল কর্মেরই একটি প্রক্রিয়া।’ (হাল্বফাস, ১৯৯১, পৃ. ২৯৪) কাজেই কাল ও কর্মের মধ্যে একটি আপাত-বিরোধী অবস্থা সৃষ্টি হল; কালের কৃতান্তরূপ মৃত্যুর একটি চেহারা হিসেবে একান্ত ভাবে নিয়তির সঙ্গে সংযুক্ত হল। কর্মকে পশ্চাতের দিকে অনন্তকালব্যাপী যুগপরম্পরার দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্যে কর্ম ও জন্মান্তরকেও অনন্ত অতীতে ঠেলে দিতে পারা গেল। ‘খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মধ্যেই পূর্ববর্তী কল্পগুলির নিজস্ব বুদ্ধ এসে গেল।’ (পানিক্কর: ঈস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ৩৮ সংখ্যা (১-৪) ডিসেম্বর, ১৯৮৮, পৃ. ২) ডাওয়ার বলছেন, ‘ম্যান্ডিয়ারনরা পৃথিবীর মানুষের ইতিহাসকে চারটি যুগে ভাগ করেন। প্রত্যেক যুগের শেষে মানবজাতি ধ্বংস হয়েছে, শুধু একটি করে দম্পতি বাদে।’ (পৃ. ৯) এর সঙ্গে খুব মিল আছে ভারতীয় চেতনায় চারটি যুগের— সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি— চারটি মিলে একটি কল্প, যার শেষে একটি বিশ্বজাগতিক মহাপ্রলয়ের ইতিহাস এবং যার পরে নতুন সৃষ্টি, ঠিক পূর্বের মতনই। ভারতীয় মতে শুধু একটি করে দম্পতির বদলে কল্পশেষে পরবর্তী সৃষ্টি বেদ থেকেই হয়। কাজেই কাল সম্বন্ধে ভারতীয় ধারণাকে চক্রাকার বলা যায়, কারণ কল্পগুলি একই ছকে পুনরাবৃত্তির ইতিহাস। কিন্তু কল্পের মধ্যে কালের গতি সরলরৈখিক এবং সম্মুখের গতি না হলে পশ্চাদমুখী— কিন্তু গতি সরলরেখায়। পশ্চাদমুখী, কারণ চারটি যুগে ক্রমে ক্রমে নৈতিক ও বাস্তবজীবনের অধোমুখী গতি ততক্ষণ অব্যাহত থাকে যতক্ষণ না পরবর্তী যুগে পৌঁছয়। ধীরে ধীরে যুগ এত পাপপূর্ণ এবং অবক্ষয়ী হয় যে, সামগ্রিক বিনাশ ও পরবর্তী সূচনা ছাড়া অন্য বিকল্প থাকে না।
পারসিক ধর্মগ্রন্থ দেনকাৎ-এ পড়ি, ‘কাল প্রথমে অনন্ত ছিল, পরে সীমার বশে আসে এবং শেষে আবার অনন্তে পৌঁছয়।’ (পৃ. ২৮২) প্রাচীন পারসিক দৃষ্টিভঙ্গিটি খুবই প্রণিধানযোগ্য, ‘কাল মানুষের বিরোধী, এ বিরোধ প্রকাশ পায় দুর্ভাগ্যে… মানুষের প্রতি নিয়তির ব্যবহার অমোঘ, নির্দয় এবং অর্থহীন… এ সব ধারণার মূল প্রাচীন ইরাণীয় ধারণায়। পহ্লবী ধর্মগ্রন্থে… আমরা প্রায়ই মানুষের জীবনের সঙ্গে কালের সম্পর্কের কথা পড়ি… জুর্বানের মধ্যে ভাগ্যদেবতার দ্বৈতসত্তা প্রকাশিত। অপরপক্ষে জামান এমন একটি সত্তা যা মঙ্গলের জন্যে সচেষ্ট এবং যাকে ‘অহ্রিমান’ নাশ করতে পারবে না।’ (রিংগার্ন, ১৯৫২, পৃ. ২১, ২২, ২৩, ৩০, ১০১) এই গ্রন্থকারই তাঁর স্টাডিজ ইন এরেবিয়ান ফেটালিজম গ্রন্থে একটি অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন, ‘নিয়তির সহকারী কর্তা কাল’; সেখানে তিনি বলেন, ‘এটা খুব লক্ষণীয় যে, কাব্যের নিয়তিবাদী অংশে আল্লাহ’র ভূমিকা অতি গৌণ… কাসকেট (অন্য এক গ্রন্থকার ) এমনকী এটাও মনে করেন যে, কাব্যের পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ আল্লাহ করেন না, করে কাল। আর ঈশ্বর যদি হস্তক্ষেপ করেন তো তিনি যথেচ্ছ ভাবেই করেন, কাজেই এ ক্ষেত্রে নিয়তি কালের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হন। (১৯৫৫, পৃ. ২৯, ৪৭) পারসিক ও আরবী নিয়তিবাদে আমরা দেখি, আপাত ভাবে বিস্ময়কর, কিন্তু দার্শনিক ভাবে অপ্রত্যাশিত নয়, এমন একটি ব্যাপার, যা ভারতীয় শাস্ত্রেও স্পষ্ট ভাবে বিশ্লেষণ হয়নি: কাল ও নিয়তির অন্তঃসলিলা, কিন্তু বাস্তব অস্তিত্ব, যেন ঈশ্বর বা দেবগণের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পেয়েই দেখা দিয়েছে। গৌতমীর পুত্রের অকালমৃত্যুর কাহিনিতে দেখি নিয়তি কাল ও মৃত্যু (বা মৃত্যুর দেবতা) যেন একযোগে কাজ করছেন— এবং সকলেই এসে মিলেছেন কর্মবাদে। যদিও বিশুদ্ধ ধর্মতত্ত্বে নিয়তি ও দেবগণ একত্র সহাবস্থান করতেই পারেন না (তথাপি প্রায় সব প্রাচীন ধর্মেই তাঁরা তা করে থাকেন) কিংবা কাল যদি সত্যিই ভালমন্দের নিয়ন্তা হয়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখানো হয়, তা হলে কাল নিয়তিকে বর্জন করে। তা হলে ঠিক ভাবে বলতে গেলে, বিধাতা বা ঈশ্বরের বা নিয়তির কোনও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা থাকে না। পরিশেষে স্বতন্ত্র ইচ্ছাকে যদি অবকাশ দেওয়া হয়, তা হলে ঈশ্বর, নিয়তি, সম্রাট কাল কারওরই যথার্থ কোনও করণীয় থাকে না।