কর্ম, কর্মফল ও নিয়তি

কর্ম, কর্মফল ও নিয়তি

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি জন্মান্তরবাদের সঙ্গে যুক্ত হয় কর্মবাদ; এ বিশ্বাস অনুসারে মানুষ পৃথিবীতে তার কৃতকর্মের ফল অনুসারে জন্মান্তর প্রাপ্ত হয়। এই সংযোগের অনেকগুলি দিক আছে। প্রথম স্তরে জন্মান্তরের মুখ ভবিষ্যৎকালের দিকেই ফেরানো ছিল; কিন্তু কর্মবাদ যুক্ত হলে এটি উভয়মুখী হয়: মানুষের অতীত কর্ম তার বর্তমান অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে, এবং তার বর্তমান কর্ম অনুসারে তার ভবিষ্যৎ জন্ম ও অবস্থা নিরূপিত হয়। ‘এ জন্মের পাপ ও পুণ্য অনুসারে (পরজন্মে) ঘৃণ্য বা সম্মানিত অবস্থা লাভ করা যায়।’ (মৎস্যপুরাণ ৩৯:১৯) ‘জাতক’ অনুসারে মানুষ দেবতা, মানুষ, পশু, যক্ষ, পিশাচ, গন্ধর্ব, কিন্নর, রাক্ষস, নাগ ও অন্যান্য উপদেবতা হয়েও জন্মাতে পারে, আবার জন্তু, পাখি, সাপ, কীট, জলজ, বায়বীয় জীব হয়েও জন্মাতে পারে। বৃক্ষদেবতা, নদীদেবতা হিসেবে তারা কতকটা যেন প্রকৃতির অংশভূত হয়ে যেতে পারে।

এই ভাবে, প্রথমত, জন্মান্তরের পরিসর ও সম্ভাব্যতা যেন অসীম হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, এখন একটি আপাত কার্যকারণ পরম্পরা দেখা যায়: কর্ম নিশ্চিত ফল দেয়। তৃতীয়ত, মানুষের জীবনের ওপরে কর্মের শক্তির আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ স্বীকৃত হল। চতুর্থত, নিয়তি এখন বহু নামে দেখা দিল। কর্মবাদ জন্মান্তরবাদের সঙ্গে জুড়ে এমন এক শক্তির পরিসর সৃষ্টি করল যা শুধু একক জন্মান্তরবাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন-এ মাহোমি কর্মসম্বন্ধে বলেন, ‘আদিতে কর্ম সুচারুরূপে সম্পাদিত যজ্ঞক্রিয়াকে বোঝাত। এই ধারণাটি নৈতিকতায় উন্নীত হয়ে যে কোনও অভ্রান্ত ক্রিয়াকে বোঝাল। এই মত মেনে নিয়ে ভারতের ধর্মীয়, সামাজিক এবং আয়ুর্বেদিক দার্শনিকরা, (বিশেষত যাঁরা জন্মান্তর এবং দুঃখের উদ্ভব নিয়ে এবং তৎসংশিষ্ট ব্যক্তিত্বের উদ্ভব ও সামাজিক অবস্থানের সমর্থন নিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট ছিলেন) এই (কর্ম) শব্দটির অর্থকে ব্যাপকতর করেন।’ (৮ম খণ্ড, পৃ. ২৬৭) যে সব আর্থসামাজিক উপাদান জন্মান্তরবাদের সৃষ্টি করে, সেগুলি ক্রমশ ঘনীভূত হয়; এ ছাড়াও কিছু কিছু ধর্মীয় দার্শনিক উপাদানও এই ধারণাটির সৃষ্টি ও পুষ্টিসাধন করে : এ দুটি মিলে এক শক্তিশালী ধারণার উদ্ভব হয়। বুদ্ধ যখন সাধনমার্গে অবতীর্ণ হন, তখন বিভিন্ন দর্শনতত্ত্বের প্রবর্তক কিছু সন্ন্যাসীর দেখা পান। ধর্ম-দর্শন চিন্তায় ঘন-আবিষ্ট এক পরিমণ্ডলে কর্মবাদের জন্ম, এবং ব্রাহ্মণ্যধর্ম এই কর্ম-সংজ্ঞায় অভিহিত মতটিকে আত্মস্থ করে। কর্মবাদের একটি আপাত-বৈজ্ঞানিক রূপ আছে; যদিও সমাজে ও দর্শনে এর থেকেই উদ্ভুত হল সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক নিয়তিবাদ।

কর্ম ও কর্মফলের সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রাচীনতম একটি উল্লেখ মেলে বৃহদারণ্যক উপনিষদে: ‘মানুষ যে ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় সে ভাবে কর্ম করে, এবং যে ভাবে কর্ম করে সেই রকম ফল পায়।’ (৪:৪:৫) মনুসংহিতাতেও কর্ম ও কর্মফল সম্বন্ধে সুদীর্ঘ একটি অংশ আছে; (১২:১-৮২) কিন্তু এটি বহু পরবর্তী কালের, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের রচনা; এখানে কর্মের ত্রিবিধ উৎস বলা আছে, মন, বাক্য ও ক্রিয়া; তিনটিরই কর্মফল হয়।

কর্ম কী? সহজ ভাবে বলতে গেলে, যে কোনও ক্রিয়া যার পশ্চাতে নৈতিক সিদ্ধান্ত ও ইচ্ছার ভূমিকা আছে তা-ই কর্ম। কখনও কখনও অনিচ্ছাকৃত ক্রিয়ার ফলও দেখি। প্রত্যেক ক্রিয়ারই ফল অবশ্যম্ভাবী, ভাল বা মন্দ। এ জন্মে বা কোনও এক পরজন্মে কর্ম থেকে কর্মফল পর্যন্ত যে কালগত ব্যবধান আছে তার একটা ব্যাখ্যা শংকরাচার্য জৈমিনির পূর্বমীমাংসা সূত্রের ভাষ্যে বলেছেন। সেখানে শংকরাচার্য এই কালগত ব্যবধানের হেতুনির্দেশে ‘অপূর্ব’ নামে একটি ব্যাপার স্বীকার করেছেন। ‘অপূর্ব’ একটি তত্ত্বগত কৃৎকরণ, যজ্ঞের ফলদানের ক্ষমতা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাপ্রসূত সমালোচনাকে ঠেকাবার একটি তাত্ত্বিক কৌশল। ‘এমন একটি কার্যকারণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, যা প্রত্যক্ষগত ওই পরম্পরার অধীন নয়…ঈশ্বরবাদী বৈশেষিক বা নিরীশ্বরবাদী সাংখ্যের প্রসঙ্গে কর্ম কখনওই সমস্ত বিশ্বপ্রক্রিয়ার চালিকাশক্তি হতে পারে না। বৈশেষিক মতে ‘অদৃষ্ট’ পূর্বকর্মের ফলনির্ধারক, গুণ হিসেবে তা আত্মায় সঞ্চিত থাকে, একে পরবর্তী শাস্ত্রকাররা ‘অপূর্ব’র ব্যাখ্যার আদিরূপ হিসেবে মেনেছেন।’ (ও’ফ্লাহার্টি, সম্পাদিত, ১৯৮১, পৃ. ২৭৯, ২৮১)

কর্ম যেহেতু বহুবিধ তাই বহু ‘অপূর্ব’র সৃষ্টি হয়, কাজেই কর্মের ফলও প্রত্যেক কর্ম-সৃষ্ট অপূর্ব অনুসারে বহু ও বহুবিধ হয়। (জৈমিনীয় ব্রা ১:১১৮; ছান্দোগ্য উপ ৫:১০:৬; কৌষীতকি উপ ১:১: থেকে ২৬:৩; বৃহদারণ্যক উপ ১:৫:১৭; ৩:২:১৩; ৪:৩:৩৩; তৈত্তীরিয় উপ ২:৮) কর্মের অব্যবহিত পরেই ফল দেখা যায় না বলেই ‘অপূর্ব’ নামে কর্মের থেকে উদ্ভুত এক শক্তির কল্পনা করা হল। এ শক্তি তৎক্ষণাৎ ক্রিয়া শুরু করলেও সে ক্রিয়ার ফল আসে কালগত ব্যবধানে। এ ব্যবধান সর্বত্র সমান নয় বলে ‘যথাকালে’ ফল দেখা দেয়; অবশ্য এই ‘যথাকাল’ গভীর রহস্যাবৃত। প্রথম ধর্মক্রিয়া হল যজ্ঞ, যার থেকে পরবর্তী কর্মকাণ্ডে এই কর্মের অর্থই থেকে গেছে। পরবর্তী কালে ‘অপূর্ব’ দেখা দিয়েছে ‘অদৃষ্ট’ রূপে অর্থাৎ যা দেখা যায় না। কী দেখা যায় না? অতীতের সেই কর্ম যা আজ ফল দিচ্ছে, অথবা আজকের সেই কর্মের ফল ভবিষ্যতে যা দেখা দেবে।

জৈনধর্মে জন্মান্তরিত আত্মার আধার একটি দীপ্ত দেহ। জৈনমতে কর্মের যে অবশিষ্টাংশ পরিণতি লাভ করে তা ‘লেশ’ ও ‘বাসনা’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিরূপণ করে কোন দিকে কর্মের সম্ভাবনা সক্রিয় হবে। ‘এখানে কর্ম ও কর্মফলের মধ্যে যে কালগত ব্যবধান, তার একটা আংশিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বাস্তব ও বিশ্বজাগতিক অর্থে ‘অদৃষ্ট’র ভূমিকা হল অদ্ভুত ও অসাধারণ যে সব ঘটনার ব্যাখ্যা অন্যত্র পাওয়া যায় না তার ব্যাখ্যা দেওয়া… আর সেই সব ঘটনারও যেগুলি শাস্তি ও পুরস্কারের অংশ বা চিহ্ন বহন করে। …অন্যদিকে বাস্তব কার্যকারণ ফাঁক পূরণ করে ব্যাখ্যার একটা সূত্র নির্দেশ করে, যেখানে অন্য প্রত্যক্ষ, অতএব আরও গ্রহণীয়, কারণ তা পাওয়া যায় না।’ (ওফ্লাহার্টি’, সম্পাদিত, ১৯৮৩, পৃ. ২৮৫, ২৮৮)

মীমাংসা যদিও ‘অপূর্ব’র উল্লেখ করে ‘অদৃষ্ট’ বা ‘নিয়তি’র উল্লেখ পাই ন্যায়কুসুমাঞ্জলি-তে, এতে ‘অপূর্ব-অধিকরণ’ নামে একটি পরিচ্ছেদ আছে। এখানে কর্ম ও কর্মফলের মধ্যে কালগত ব্যবধানের ব্যাখ্যায় বপন ও ফসল-কাটার মধ্যে ব্যবধানের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে; এ হল কর্মের ‘বিপাক’ বা পরিণতিতে যে সময় লাগে, তা-ই। এখানে অদৃষ্ট হল ‘পরিপাক’।

রামানুজ, কুমারিল বা এ দুইয়ের অন্তর্বর্তী মীমাংসার যত ভাষ্যকার আছেন তাঁরা ব্যবহার করেছেন চিকিৎসাশাস্ত্রের উপমান: ঔষধ-সেবন ও আরোগ্যলাভের মধ্যে যে কালগত ব্যবধান আছে তা-র। মনে রাখতে হবে, উপনিষদের যুগেই যজ্ঞকে বলা হয়েছে ‘অদৃঢ় নৌকা’ (মুণ্ডক ১:২:৭) পরে যাস্কের নিরুক্ত-তে এবং তারও পরে মীমাংসায় যজ্ঞের ফল উৎপাদনের ক্ষমতা সম্বন্ধে সংশয় পোষণ করা হয়েছে। এর একটা কারণ, যজ্ঞ ও তার ফলের ব্যবধান যখন খুব বেশি হয়েছে তখন সাধারণ মানুষ যজ্ঞটিকে নিষ্ফল মনে করেছে। তাছাড়া অভিজ্ঞতায় লোকে দেখেছে যে যথানির্দিষ্ট ভাবে নিষ্পন্ন হলেও বহু যজ্ঞ ফল দেয়নি, তাই যজ্ঞকে আর খুব নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি।

ভারতবর্ষে কর্মবাদের উদ্ভব কেমন করে হল? স্মরণীয় যে, মানুষ নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করে, এমন একটা বিশ্বাস সারা পৃথিবীতে সব যুগেই ছিল। ‘কিন্তু ভারতবর্ষে প্রাগার্য অধিবাসীদের কৃষিকর্ম থেকে উদ্ভুত কার্যকারণ সম্পর্ক সম্বন্ধে একটা নৈর্ব্যক্তিক ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল (যা প্রায়ই কৃষি-নিরপেক্ষ); বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের ধারণা, যোগ, বেদান্ত, আয়ুর্বেদীয় ভেষজ এবং সাম্প্রদায়িক ঈশ্বরবিশ্বাস (থেকে উদ্ভূত এই ধারণা), এবং (বৌদ্ধ ও জৈনধর্মে) এটি একটি মৌলিক তত্ত্ব। দক্ষিণ-এশিয়াতে কোনও একটিমাত্র কর্মবাদ নেই।’ (ম্যাকমিলান এনাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ২৮শ খণ্ড, পৃ. ২৬৭)

মূল জৈন ধর্মগ্রন্থগুলির অনেক ক’টিতেই অন্তর্নিহিত একটি নিয়তিবাদ লক্ষ্য করা যায়। উবাসগদসাও-র ভাষ্যে (৬:১৬৫) অভয়দেব বলছেন, ‘যা হওয়ার নয় তা কখনও ঘটে না; যা হওয়ার, কোনও প্রয়াস ছাড়াই তা ঘটে। যা হওয়া নিয়তিনির্দিষ্ট নয় তা হাতের মুঠোয় এসেও হারিয়ে যায়।’ স্যাদ্বাদমঞ্জরী থেকে মল্লিসেন একটি শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘ধ্বংস হওয়ার পরও (দেহ) আবার ফিরে আসে, যদি বিশ্বাস আহত হয়ে থাকে।’ আজীবিকমতের আবিষ্কর্তা বুদ্ধের সমকালীন মস্করী গোসাল বলেন, ‘প্রাণীর দুঃখভোগের কোনও হেতু বা প্রমাণ নেই।’ (দীঘনিকায় ১:৫০৩) প্রশ্নব্যাকরণসূত্র-এর টীকায় জ্ঞানবিমল বলেন, ‘বিশ্বজগৎ নিয়তির দ্বারা সৃষ্ট এমন কথা বাতুলের প্রলাপ, নিয়তি সর্বত্রই বলবত্তর, যেমন, মানুষের অভীষ্ট বস্তু লাভের কারণ (অবশ্যই নিয়তি)। তাই যা আমাদের ভাগ্য তা অন্যদের নয়, এ নিয়ে আমি শোক বা বিলাপ করি না। ভাগ্য হঠাৎ নিয়ে আসে দীপান্তর থেকে, সমুদ্রমধ্য থেকে। পৃথিবীর প্রান্তদেশের যে কোনও দিক থেকে, নিয়ে আসে মুখের সামনে। পরমায়ু মানুষের নিয়তি, (নিয়তি দ্বারাই) বুদ্ধির সাফল্য (ঘটে), (তেমনই) সংকল্পের, (নিজের) সঙ্গীদেরও।’ এ সব শাস্ত্রে নিয়তির দিকে এমনই ঝোঁক যে কর্ম যেন নিষ্ফল প্রতিপন্ন হয়। যা ঘটবার তা মানুষের প্রয়াস ছাড়া বা প্রয়াস সত্ত্বেও অনিবার্য ভাবেই ঘটে।

শংকরাচার্যের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য(৩:২:৩৮-৪১) বলে প্রারব্ধকর্মের ফল জীবৎকালের মধ্যেই ফলে। জৈমিনির মত এই যে কৃতকর্ম একটা শক্তি সৃষ্টি করে (যাকে ভাষ্যে ‘অপূর্ব’ বলেছে), যা কর্মটিকে ফলের অভিমুখে নিয়ে যায়। এ ফল হল পূর্ব জন্মে কৃতকর্মের অবশেষে (সঞ্চিত কর্ম) যা একটা জীবৎকালে ফল উৎপাদন করে। ব্রহ্মসূত্রকার বাদরায়ণ বলেন, কৃতকর্ম পরজন্মে ফল উৎপাদন করতে পারে না, কারণ জন্ম থেকে জন্মান্তরে সংক্রমিত হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তিনি আরও বলেন ‘অপূর্ব’ ও ফল উৎপাদন করতে পারে না কারণ এটি বুদ্ধিবিরহিত শক্তিমাত্র; তাই ফল উৎপাদন করবার উপযুক্ত স্থান, কাল ও পাত্র নির্বাচন করবার ক্ষমতা আর থাকতে পারে না। কাজেই ব্রহ্মসূত্রের রচয়িতা ও ভাষ্যকার উভয়কেই স্বীকার করতে হয়েছে ঈশ্বরকে, যিনি ফলের নিয়ন্তা। এই ঈশ্বর মানুষকে নৈতিক দায়িত্ব দিয়েছেন; তাঁর কাজ শুধু দেখা, ফল যেন কর্মের অনুরূপ হয়। তবু প্রশ্ন থেকে যায় যে, ঈশ্বর কর্ম ফলের সম্বন্ধের পরিদর্শক হলেও, কর্মের সঙ্গে ফলের সত্যিকার অনুপাত রক্ষিত হয় কিনা। এ এল হার্মান বলেন, ‘যদি কর্মবাদ ন্যায়সঙ্গত হয়… তবে লোকে ঠিক যা তার প্রাপ্য তা-ই পেত, বেশিও নয়, কমও নয়। তা হলে প্রাপ্যের ন্যূনধিকতা কি হতে পারত? …কর্মবাদ সম্বন্ধে কেন কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয় এবং ও ভাবে দেখাও আমাদের পক্ষে সঙ্গত নয়। …যদি সত্যিই কর্ম বলে বিশ্বজাগতিক কোনও একটা বিধান থাকত, এবং এর বিশ্বজাগতিক ফল, (সত্যিই) সংসার, বা ঈশ্বরের ইচ্ছা থেকে নিরপেক্ষ ভাবে থাকত, তা হলে ঈশ্বরের শক্তি খর্ব হয়ে যেত। …ঈশ্বর যদি কর্মবাদের নিয়ন্তা হন, তা হলে এই বিধানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দুঃখযন্ত্রণার সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েন। আর ঈশ্বর যদি কর্মের নিয়ন্তা না হন, আর কর্ম যদি ঈশ্বরনিরপেক্ষ, স্বাধীন একটি বিধান হয়, তা হলে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নন অথবা আমরা সংক্রমণশীল ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি, অথবা দুটোই (একসঙ্গে) হয়। …কিন্তু পরিণামে যদি ঈশ্বর জড়িত হন অতএব অপরাধের দায়িকও), অথবা অনিয়ন্ত্রণীয় বিশ্বজাগতিক এক প্রক্রিয়ার হাতের পুতুল মাত্র হন (সর্বশক্তিমান নন); তাহলে মনে হতে পারে, সৃষ্টির শুরু থেকেই তিনি এই দু’ভাবেই জড়িত। …পুনর্জন্ম দিয়ে সমাধান হয় না এবং কর্মবাদে এমন কোনও (নৈতিক) বিশুদ্ধ দৈব নেই, মানুষের ভাগ্যে যার সংঘটনে কিছু পাপকর্মের শাস্তি হয় না বা কিছু পুণ্যকর্মের পুরস্কার মেলে না। (ও’ফ্লাহার্টি, সম্পাদিত, ১৯৮৩, পৃ. ২৭৫, ২৭৮, ২৯০)

কর্ম ও কর্মফল সমানুপাতিক কিনা এ বিষয়ে ওপরের উদ্ধৃতিতে আলোচনা আছে, বিশেষত মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার কোনও সংগতি আছে কিনা সে নিয়ে। ঈশ্বরকে নিয়ন্তা মেনে বা না মেনেও এমন সব জটিলতা আছে যার থেকে বেরোনোর পথ পাওয়া যায় না। জি কে কবীশ্বর বলেন, ‘বৈষয়িকরা স্বর্গে পুনর্জন্ম কামনা করেন, মোক্ষ চান না; তা (স্বর্গ) পাওয়া যায় মন, বাক্য এবং দেহের সদাচরণ দিয়ে; এবং দেবতা, রাজা, সন্ন্যাসী, আত্মীয়, গুরুজন, কনিষ্ঠদের ও পিতামাতার উদ্দেশে দানের দ্বারা।’ (১৯৭৪, পৃ. ৩১) এই লেখক অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, কিন্তু তাঁর সমাধানগুলি দুর্বল। ঈশ্বরের অনুগ্রহ কি কর্মের বিধান খণ্ডন করে, তাঁরই ইচ্ছায় তাঁকে নস্যাৎ করে? যদি তা হয়, তা হলে এই বিধানে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়ে না? এবং অনুতাপ ও আত্মসমর্পণের প্রলোভন দেখায় না? …(মানুষ) ন্যায়বিচার দাবি করতে পারে, কিন্তু অনুগ্রহের ক্ষেত্রে তা হয় না… (অনুগ্রহ) একটা বিশেষ সুবিধা যা গ্রহীতা নিজের জোরে পেতে পারে না, বা জোর করে বা দাবি করে পেতে পারে না, অথচ পাওয়ার যোগ্যতা প্রাপকের আছে এবং দাতা যখন ইচ্ছা করেন তখন দেন।’ (ঐ পৃ. ৩২-৩৩) কর্ম ও কর্মফলের বিধায়ক ঈশ্বর হলে, অনুগ্রহের প্রশ্ন ওঠেই; কিন্তু এ ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ও দয়ালু নন; ইনি যেন বিশিষ্ট এক সরকারি ক্ষমতায় থেকে কর্মের অনুপাতে ফল দেন। যখন তিনি অনুগ্রহ করেন তখন আর বিচারক নন।

এর পর প্রশ্ন ওঠে, কর্মকর্তার, ফলপ্রসূ কর্মের কারকের। বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ্য উভয়মতেই বাসনাই সত্তা এবং দুঃখভোগের মূলে। বাসনা আত্মায় নিহিত থেকে দেহ থেকে দেহান্তরে সঞ্চায়িত হয়। ‘এ কোনও বিশেষ বাসনারূপে প্রতিভাত নয়, বরং তার আপন পরিসরের মূলে যে সব প্রাথমিক বাসনাগুলি থাকে— সব বাস্তবজ্ঞানের মূলেই সেগুলিকে প্রথমে দেখা যায়। স্বতঃস্ফূর্ত সজীব অস্তিত্বের মূলীভূত বাসনার রূপে এগুলিকে দেখা যায়, কর্মফলে মানুষ যে শরীর পায় তারই অনুগামী হয়ে এগুলি উপস্থিত থাকে।’ (বিয়ার্দো, সম্পাদিত, ১৯৭৩, পৃ. ৭৬)

কর্মকর্তার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত যখন এক জন্মের কর্মের ফল সে ভোগ করে জন্মান্তরে, তার ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনের পরেও— ভিন্ন দেশে, কালে ও পরিবেশে। যদি বলা হয়, কর্মকর্তাই ফল ভোগ করে, মানুষ, জন্তু, উপদেবতা, অপদেবতা যে কোনও রূপে— তা হলে কর্ম ও তার ফলভোগের মধ্যে এমন গভীর ব্যবধান থাকে যে তা স্বীকার করা যায় না। … আলানদণ্ডত্যাগ আশ্রয়পরাবৃত্তি; আশ্রয় ত্যাগ করার পর ব্যক্তিত্বের পুনঃ সংহতি। (অর্থাৎ আশ্রয়ভূত শরীরের বিনাশের পর আত্মার নরদেহের সঞ্চারিত হওয়া) আশ্রয়দণ্ড হল ব্যক্তির মানস-শরীরে সমাহার… (একথা) কোনও কোনও প্রস্থান সাদামাটা ভাবে কর্ম দ্বারা ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হিসেবে বোঝে, যেমন কোনও নারীর পুরুষরূপে পুনর্জন্ম বা মানুষের পশুজন্ম।’ (তুচ্চি: ঈষ্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, ৩৪ খণ্ড, সংখ্যা ১-৪, ডিসেম্বর ১৯৮৮, পৃ. ১৬, ১৭) কর্ম ও কর্মফল আপাতদৃষ্টিতে যান্ত্রিক ভাবে চলে, অনুগ্রহ বা অন্যবিধ পরিবর্তনের কোনও অবকাশই সেখানে থাকে না। ‘যে কর্মের প্রকৃতি যান্ত্রিক তা ক্ষমা করতে পারে না এবং নিজে থেকে থেমে যেতেও পারে না।’ (পানিক্কর: ঈস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০ )

কর্মবাদ সম্বন্ধে মৌলিক সমস্যা কার্যকারণ সম্বন্ধের একটা আপাত যৌক্তিক রূপ থাকলেও, ফলে যেটা দাঁড়ায় তা হল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নিয়তিবাদ। আরও গভীরে অনুসন্ধান করে বলা যায় কর্ম-কর্মফলের অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া সম্বন্ধে ‘অপূর্ব’র মাধ্যমেই হোক, অথবা অপূর্ব নিরপেক্ষ ভাবেই হোক, কোনও স্পষ্ট ধারণার অভাবই এর কারণ। নিনিয়ান স্মার্ট একটি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত কথা বলেন, ‘জন্মান্তরবাদ এবং তারই সহজাত (তত্ত্ব) কর্মবাদ কতকগুলি অসুবিধার সৃষ্টি করে, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কাছে (এই প্রশ্ন তুলে ধরে): কোন প্রক্রিয়ায় জন্মান্তর, ইত্যাদি ঘটে। তাই… যুক্তিবাদী পরমাণুবাদীরা, জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী বলেই স্থানগত দূরত্ব সত্ত্বেও কার্যকারণ পরম্পরাকে স্বীকার করতে বাধ্য হন। আর, জীবমাত্রেরই নিয়তি নির্ধারণ করে দেয় যে অদৃশ্য শক্তি তা বস্তুত কর্মে কার্যপ্রণালীকে এড়িয়ে যায়। অন্য দিকে ভারতবর্ষের প্রচলিত যে ধারণার আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা সর্বব্যাপী, সে অনুসারে স্থানিক দূরত্বেও কার্যকারণে ক্রিয়া গ্রহণযোগ্য হয়, কারণ এক জন্মের অবশিষ্ট নৈতিকশক্তি সর্বব্যাপী আত্মার দ্বারা সঞ্চারিত হয়। যাই হোক, প্রাচীন (নিঃসংশয়ে অ-ভারতীয় প্রভাবজাত) ভারতীয় কর্মবাদ বলে যে, এক ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারাই এটি কার্যকর হয়; এক বার যখন কেউ এ কথা বলে যে পৃথিবীটা এ রকমই, তখন তো সত্যিই আর কোনও সমস্যা থাকে না। পরবর্তী দার্শনিকরা প্রশ্ন তুললেন কর্মবাদের কার্যপ্রণালী কেমন। ঈশ্বর বিশ্বাসীরা যুক্তি দিলেন যে, কর্মের প্রক্রিয়া ‘ঈশ্বর সম্বন্ধে একটি প্রমাণ’, কিন্তু ভারতীয় কল্পনায় স্বনিয়ন্ত্রিত একটি নৈতিক বিধির ধারণা এত দৃঢ়মূল ছিল যে ওই প্রমাণে অবিশ্বাসীর বিশ্বাস জন্মাত না।’ (১৯৬৪, পৃ. ১৬৩)

কর্ম ও তার পরিণতির মধ্যে যে কালিক ব্যবধান তার সঙ্গে এই ধারণা সংশ্লিষ্ট হল যে, কর্মফল একই জন্মে কোনও সময়ে বা ভবিষ্যৎ কোনও জন্মে অনুভূত হয়। যজ্ঞে উচ্চারিত মন্ত্র ‘অপূর্ব’ সঞ্চারিত করে এবং ‘অপূর্বই অভীষ্ট ফল সৃষ্টি করে, কিন্তু তাতেও মন্ত্র-উচ্চারণ ও ফলোমের মধ্যে কালগত ব্যবধান থাকে। হাজিমে নাকামুরা বলেন, ‘কিছু কর্ম যে জন্মে অনুষ্ঠিত হয় সেই জন্মেই ফল দেয়, আর কিছু ঠিক তার পরের জন্মে এবং আরও কিছু, পরবর্তী কোনও কোনও জন্মে। ব্যক্তিসত্তা হল বহু কারণের কার্য, যে সব কারণ অতীত জন্মগুলি থেকে বাহিত হয়ে এসেছে, পৃথিবীর আর সব কারণের সঙ্গে তা ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। এ ব্যাখ্যা সব সময়েই বিপরীতক্রমে বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়। ঘটনার সঙ্গে মেলে, কারণ ঘটনা থেকেই এ তথ্যের উদ্ভব। (যদিও অভিজ্ঞতা দিয়ে এর সত্যতা প্রমাণ করা যায় তবুও) উল্টো বলে প্রমাণ করা যায় না, কারণ মানুষের সন্ধানের ওপারে এর অবস্থান। বৌদ্ধধর্মে একে রক্ষা করা হয়েছে, কারণ এর থেকে (কর্মফলের) একটি নৈতিক কারণ পাওয়া যায়।’ (১৯৮৬, পৃ. ২৬৪) ‘নৈতিক কর্মকর্তা যে-ব্যক্তি সে তারই অতীত ক্রিয়াকলাপের ফল পায়— যা কিছু কিছু পরিণত হয়ে এ জন্মে কার্যকর হয়। সে যদি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আসক্তিমুক্ত করতে না পারে তো আরও কিছু কর্ম ও বাসনা তার সত্তায় সংলগ্ন হয়, যার ফলে বারবার তাকে জন্মগ্রহণ করতে হয় যতক্ষণ না জমা-খরচের দু’দিকই শূন্য হয়, অর্থাৎ এমন অফলিত কোনও কর্ম বা অতৃপ্ত কোনও বাসনা আর না থাকে, যার জের জন্মান্তরেও টানতে হয়। পরজন্মে ব্যক্তির কর্মফলের দায় থেকে যায়।’ (সংযুক্তনিকা ৩:২:১০:৯-১০; ১:৪:৬; অঙ্গুত্তরনিকায় ১:২:১৩; ৩:৩৫:১ যেখানে যম বলে, মানুষকে তার কাজ, কথা ও কর্মের সব পাপের শোধ করতে হয়।) মজ্ঝিমনিকায় বলে, ‘এ (আত্মা) যা করে তাই নির্ধারণ করে এ কী হবে এবং তার কোন সব ধারণা জন্মাবে।’ ধম্মপদে পড়ি ‘মন্দ মানুষ করে; (তার ফলের) বেদনা অনুভব করে, মানুষই মন্দের প্রতিকার করে এবং মানুষই মন্দকে শাস্তি দেয়।’ (১৬৫) বুদ্ধ বলেন, ‘মানুষ সজ্ঞানে কৃত কোনও কর্ম এবং যার ফল ভোগ করা হয়নি এমন সঞ্চিত কর্ম মুছে ফেলতে পারে না; এগুলি এ জন্মে, নয় পরের কোনও জন্মে ফল দেবেই।’ (অঙ্গুত্তরনিকায় ১-২:১৩) নতুন জোর দেওয়াটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ ‘সজ্ঞানে কৃত’, এতে মানুষের নৈতিক দায়িত্ব আসে, এবং মনে করা যেতে পারে ফল কর্মের ওপর ততটা নির্ভর করে না, যতটা ইচ্ছার ওপরে করে। ধর্মশাস্ত্রে এ একটা নতুন মাত্রা প্রথমবার দেখা দিল, নীতি হয়ে দাঁড়াল মানদণ্ড। এর থেকে একটা কথা আসে: যেহেতু কর্মের কর্তা হল ব্যক্তি, তাই ফলভোগও শুধু তাকেই করতে হয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যেমন সংক্রামক রোগের আক্রমণ, দুর্ভিক্ষ, ট্রেন বা প্লেনের বা মোটরগাড়ির দুর্ঘটনা, যার সঙ্গে অনেক লোকের ভাগ্য জড়িত থাকে তা জনসমষ্টির কোনও ক্রিয়ার ফলে নয়, ব্যক্তিগত কর্মের ফলেই ঘটে।— আপতিক ভাবে? এক সঙ্গেই? ‘কাজেই নিঃসন্দিগ্ধ প্রমাণ আছে, গোষ্ঠীগত কর্মের ধারণা ভারতীয় ধর্মে বিজাতীয় এবং কর্ম সম্বন্ধে ধ্রুপদী ধারণার পরিপন্থী।’ (ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, ৩৯ খণ্ড, ১-৪ সংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৮৯ পৃ. ১৯৩)

‘বস্তুসত্তা আরোপ করার দ্বারা চিন্তাকল্পিত জগৎ প্রাকৃতিক জগতে বিলীন হয়ে যায়। (তখন) সেটা আবশ্যিক আর (বস্তুত) নিয়তিই হয়ে ওঠে, এবং মানুষ জীবনেও তাকে তেমন ভাবেই উপলব্ধি করে… (জীবনের) ভূমিকাতেও এমন ভাবেই বস্তু-সত্তা আরোপ করা যায় যেমন চিন্তাকল্পিত (জগৎ)। আত্মসচেতনতার যে পরিসরটি (ব্যক্তিজীবনের ভূমিকাতে বাস্তবায়িত হয়েছে তাকে তখন অনিবার্য নিয়তি বলেই মনে হয়, ফলে ব্যক্তি তার সম্বন্ধে দায়িত্ব অস্বীকার করে। (বার্গার, ১৯৭০, পৃ. ১০৮)

বৈদিক যজ্ঞনিষ্ঠ ধর্ম প্রধানত গোষ্ঠীগত ছিল, গৃহকর্মেও পরিবারের সকলে উপস্থিত থাকতেন; আর পরিবার মানে ‘কুল’ অর্থাৎ বৃহৎ যৌথ পরিবার। সামূহিক শ্রৌতযাগের (দু-একটি ব্যতিরেকে) ফল সমস্ত গোষ্ঠী ভোগ করত। সংহিতা ব্রাহ্মণের যজ্ঞনির্ভর যুগ থেকে উপনিষদের যুগের মধ্যে বহু পরিবর্তন এসে পড়ে। জন্মান্তরের একটি আনুষঙ্গিক অঙ্গ যা ব্রাহ্মণ্যসাহিত্যে দেখি, তাতে জন্মান্তর হল বহুবার-ভোগ্য একটি অশুভ দুর্ভাগ্য, যার থেকে নিষ্ক্রমণ ব্যক্তিরই শুধু হতে পারে, তাই এ বারে ধর্মের লক্ষ্য গোষ্ঠী থেকে ব্যক্তিতে পৌঁছল। ব্যক্তিরই পুনর্জন্ম হয়, তাই জন্মান্তরের অবসান ঘটলে ব্যক্তিরই লাভ। উপনিষৎ স্পষ্ট ভাবে বলেছে, ব্যক্তির ভূমিকা, কর্তব্য ও লক্ষ কী। বৃহৎ শ্রৌতযাগ তখনও অনুষ্ঠিত হত, এক সহস্রাব্দের বেশি চলেও ছিল। কিন্তু ধর্মাচরণের প্রণালীটা এক দিকে ক্রমশ যজ্ঞ থেকে তপস্যার দিকে, বোধির দিকে সরে যাচ্ছিল, অপর দিকে প্রাথমিক পর্যায়ে পূজা দেখা যাচ্ছিল উপনিষদের যুগের কিছু পর থেকেই। নতুন লক্ষ্য হল মোক্ষ। মোক্ষ কার? বৃহৎ জনসমাজ অসহ্য দারিদ্র্যে ক্লিষ্ট এবং সামান্য আর্থিক স্বাচ্ছল্যের জন্যে উন্মুখ— তাদের জন্যে নয়; কিন্তু যে মুষ্টিমেয় শিক্ষিত লোকেরা মোক্ষের কথা চিন্তা-আলোচনা করছিলেন তাঁরাই এর দাবিদার। হেস্টারমান বলেন, ‘কর্মবাদের উদ্ভব ও বিস্তারের মধ্যে বহু উপাদানই কার্যকর ছিল। কিন্তু আমার মনে হয়, কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ব্যক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ। জীবনমৃত্যুর যে কঠিন টানাপোড়েন অন্যদের সঙ্গে সহযোগিতা প্রয়োজন, এখন একক ব্যক্তিকে জন্মে জন্মান্তরে তা-ই সাধন করে চলতে হবে। অশুচিতার নিষ্কাশন উত্তরাধিকারের একটি বৈশিষ্ট্য। অন্য ভাবে বললে, এইখানে আমরা জাতিভেদের নীতিগত তত্ত্বকে স্পর্শ করছি।’ (হেস্টারমান, ডব্লু-ইউ, জেড, কে এস, ১৯৬৩, পৃ. ১৬)

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের কাছাকাছি ভূমধ্যসাগরের চারপাশে, গ্রিস, চিন এবং ভারতবর্ষে ধীরে ধীরে কিন্তু অপ্রতিহত ভাবে বৃহৎ কিছু পরিবর্তন দেখা দিচ্ছিল। এর মধ্যে একটা হল, জন্মান্তরবাদের অভ্যুত্থান। এটি যখন দু’এক শতকের মধ্যে কর্মবাদের সঙ্গে যুক্ত হল, তখন ওই পরিবর্তনের ধারার সবচেয়ে বড় পর্যায় সমাপ্ত হল। অন্য ভাষায় বললে, একটি যুক্তিসিদ্ধ দার্শনিক মত সংজ্ঞা লাভ করল, যাতে এ পর্যন্ত অব্যাখ্যাত অনেক আপাত-অসঙ্গতির ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। জীবনে সামাজিক অবস্থান, সুখদুঃখ, লাভক্ষতি, এ সবের কারণ পাওয়া গেল কর্মভোক্তার পূর্বকৃত কর্মে। এর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না, কিন্তু সাধারণ বিশ্বাসপ্রবণ মানুষ যাঁরা অসীম দুর্গতির মধ্যে জীবনের কোনও অসঙ্গতির অর্থই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু নিজেদের দুর্ভাগ্যের অনুপাতে কোনও দুষ্কর্ম যাঁরা করেননি, তাঁরা এত দিনে আপাত-অসঙ্গতির ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন: তাঁদের দুর্গতির জন্য দায়ী তাঁদের পূর্বজন্মে কৃত কর্ম, যার ফল ফলছে এ জন্মের দুঃখভোগে। বোঝা সহজ, কর্মবাদে অনেক ফাঁক, অনেক ফাঁকি আছে, যা সাধারণ মানুষের বোধের অগম্য ছিল বলেই তাঁরা কর্মবাদকে সবশুদ্ধ মেনে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে আপাত ভাবে সব কিছুর ঢালাও ব্যাখ্যা বলে যা উপস্থাপিত করা গেল তা যেন একটি নিখুঁত ছক যার মধ্যে সব অভিজ্ঞতা ধরে যায়। ল হ্বাল্লে পুস্যা একটি উল্লেখ করেছেন, ‘দুঃখের ও মানুষের অবস্থা-বৈষম্যের সূচনা-বিষয়ক প্রহেলিকার যে সমাধান ভারতবর্ষ দিয়েছে তা পাওয়া যায় ‘কর্ম’ নামক শব্দে। ওই প্রহেলিকার এ সমাধান সর্বতো ভাবে সন্তোষজনক নয়, যেহেতু একেবারে সূচনাপর্বের ধাঁধাটির কোনও সদুত্তর এতে নেই। এটি (কর্মবাদ) বৈদিক প্রকৃতিবাদ, রহস্যবাদ ও ধার্মিকতাবোধ থেকে ধীরে ধীরে সরে এসেছিল।’ (এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিক্স, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৬৭৩-৭৬) জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদে ওতপ্রোত ভাবে নানা ধরনের ভ্রান্তসিদ্ধান্ত অনুপ্রবিষ্ট; দু-চারটি উদাহরণ দিই:

মহাভারতে ইন্দ্র গৌতমের ছদ্মবেশে অহল্যাকে সম্ভোগ করবার পরে গৌতম দুজনের কাউকেই দোষ দিলেন না (সম্ভবত অপরাধী স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র বলেই); বললেন: ‘অপরাধ কর্মের’। (১২:২৫৮:৪২) কার কর্মের? সে সম্বন্ধে ঋষি নীরব। এখানে কর্মের দোহাই পেড়ে একটি অন্যায়কে মেনে নেওয়া হল। মৎস্যপুরাণ বলে, ‘দেবতাদের কর্মে ভাল বা মন্দ কোনও ফল থাকে না, যেমন থাকে মানুষের ক্ষেত্রে।’ (৪:৬) দুটি কাহিনির অসঙ্গতি চোখে পড়ে। বাংলায় যেমন বলে, ‘দেবতার বেলায় লীলা খেলা, পাপ লিখেছে মানুষের বেলা।’ দেবতাদের কর্মে ফল নেই, মানুষের আছে। দেবতার লীলার নৈতিক বিচার হয় না, মানুষের কর্মই পাপ বা পুণ্য বলে অভিহিত। রামের ছলনায় বালিবধ, অন্যায় ভাবে সীতা পরিত্যাগ ও শম্বুকবধ এ সবের কোনও ফল ভোগ করতে হয় না। কারণ তিনি বিষ্ণুর অবতার। সীতাও তো লক্ষ্মীর অবতার, তবে তাঁকে সারাজীবন কষ্ট পেতে হল কেন? স্বর্গে তিনি কোনও পাপ করেছিলেন এমন কথা তো শাস্ত্রে লেখে না। সীতা নিজেও অবাক হয়েছিলেন অনর্জিত দুঃখভোগে, বলেছিলেন, ‘কী পাপ না জানি আগের জন্মে করেছি, তাই মর্মান্তিক দুঃখভোগেই এ জীবনটা কাটল!’ (রামায়ণ ৫.২৫:১৮) এখানে সাধারণ মর্ত মানুষের মতোই কথা বলেছেন সীতা, ভুলে গেছেন তাঁর আগের জন্মে তিনি লক্ষ্মী ছিলেন, কাজেই পাপ করার কথাই ওঠে না। পরের সাহিত্যে আর এই অবাক ভাব থাকে না। মার্কণ্ডেয় পুরাণে এক ব্রাহ্মণী স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্বজন্মের পাপেই এমনটা হল’। (৭১:১৭)

লক্ষণীয়, কর্মবাদ যতই সমাজে শেকড় গাড়ছে, ততই লোকে এর থেকে সান্ত্বনা পাচ্ছে। কৌশল্যা রামের বনবাসে ও দশরথের মৃত্যুতে মর্মাহত, সীতার অভিজ্ঞতাও তিক্ত, কিন্তু সময়ে এ তিক্ততা খানিকটা কমে যায়। এটা ঘটে শুধু সেখানেই, যেখানে নিয়তিবাদী বিশ্বাসে নৈতিক সুবিচারের প্রত্যাশাই কমে যায়, একটা কড়া পড়ে যায় মানুষের মনে, তাতে ভাগ্যকে অনিবার্য বলে স্বীকার করা যায়।

যে-মতে কয়েক জন্মের ব্যবধানেও কর্মের ফল ফলে, তাতে কর্ম দুয়ে এবং তার ফল দুয়েতর, প্রায় অবিদ্যমান হয়ে ওঠে— অর্থাৎ কর্মের ফল ব্যবহিত। সমস্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে কর্মফলকে নিয়ে গিয়ে কর্ম ও কর্মফলের কার্যকারণ সম্বন্ধে প্রায় অবিশ্বাস্য পর্যায়ে চলে গেছে। মন্দকর্মের ফলভোগ বহু জন্মের ব্যবধানে কার্যকারণ সম্বন্ধকে এড়িয়ে যায়, বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। এই মতে এই জন্মে প্রচুর অপকর্ম করেও যদি দিব্যি সুখে থাকা যায়, (কারণ ফলভোগ ঘটবে কয়েক জন্ম পরে) তা হলে উপলব্ধির ক্ষেত্রে পাপপুণ্যের সীমারেখা এত অস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তা না-থাকার সমানই হয়। নৈতিক বোধবিশ্বাস যেন এতে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে থাকে।

দেবতা ও নিয়তিবাদের অন্তর্নিহিত গরমিল সম্বন্ধে দেবীভারত পুরাণ বলে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা, অসুর, যক্ষ গন্ধর্ব সকলেই কর্মের অধীন, না হলে তাদের দেহ থাকত কেমন করে? এবং সুখদুঃখের অনুভূতি হত কী করে? যেমন শরীরী জীবের হয়। কৃষ্ণ তাঁর সমস্ত পৌরুষকর্ম করেছিলেন পূর্বনিরূপণের দ্বারা। (৪:১০:১৭-১৯) পুরাণে দেবতাদের আচরণ মানুষেরই মতো। স্কন্দপুরাণ বলে, ইন্দ্র পাপ করলে বৃহস্পতি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, দুঃখ কোরো না, নিখিল বিশ্বই কর্মের অধীন।’ (২:৭:২৩:১০) লিঙ্গপুরাণ-এ এক ব্যক্তির পিতাকে অসুর মেরে ফেললে পর শুনি, ‘অসুরেরা তোমার বাবাকে মারেনি, এটা ভাগ্য নিরূপিত ছিল। কে কার দ্বারা নিহত হয়? মানুষ তার আপন কর্মেরই ফল পায়।‘ (১:৬৪:১০৯-১১১) মজা হচ্ছে, এখানে কর্মফলকেই নিয়তি বলা হয়েছে। এবং হত্যার মতো পাপকেও নিহতের কর্মফল বলে বিচারের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হল।

সাধারণ ভাবে অবশ্য যে-দর্শনপ্রস্থানই মানুষের জীবনে কর্মের প্রভাবও মোক্ষ নিয়ে আলোচনা করেছে সে-ই বলেছে যে, মানুষের জীবনে কর্মের ভূমিকা সম্বন্ধে কেউ কিছুই জানে না। জৈন ধর্ম সম্ভবত একটি সত্যকার চূড়ান্ত মত প্রকাশ করেছে; ‘ছোটখাট এক দেবত্বে উপনীত হয়েও সে জানে না কোন কর্ম তাকে এই ফল দিয়েছে।’ (দসবেয়ালি সুত্ত ৫:৪৭) এই গ্রন্থ যা জানার এতটা মূল্য স্বীকার করেছে, তাতেই পড়ি, মানুষ নিজের কৃত পাপকর্ম জানলে পর সেই জানা-ই তাকে মুক্তি দেয়। (চুলিয় ১:১৮) প্রাক্তন জন্মের কর্ম ও তার ফল সম্বন্ধে অজ্ঞতা থেকেই বন্ধন ও পুনর্জন্ম হয়। যতক্ষণ মানুষ তার অতীত পাপকর্ম ও তার প্রতিফলন সম্বন্ধে না জানে ততক্ষণ পুনর্জন্মের আবর্তন থেকে তার মুক্তি নেই। অতএব মুক্তি অর্থাৎ পুনর্জন্মনিবারণ আসে জ্ঞান থেকেই।

কর্ম যে তার ফল থেকে সুদুর ব্যবধানে থাকতে পারে এ থেকে একটা সমস্যা জন্মায়, কারণ কোন কর্ম থেকে কোন ফল আসে তার কোনও নিশ্চয়তা থাকে না; যুক্তিসিদ্ধ কার্যকারণ পরম্পরার ক্ষেত্রে এটা একটা মস্ত বাধা। মস্করী গোসাল অবশ্য স্বীকার করেন না যে, প্রত্যেক কর্মেরই একটা আনুপাতিক সুদৃশ ফল আছে। তাঁর মতে মানুষের অভিজ্ঞতা সর্বৈব অহেতুক, কোনও কর্মের সঙ্গেই সেগুলি কার্যকারণ-সূত্রে গাঁথা নয়। ‘কাজে, কথায় ও চিন্তায় মন্দ হওয়া দুশ্চরিত্রতার ফল নয়, ভালও ভাল থেকে উদ্ভুত হয় না।’ (উবাসগদসাও, পরিশিষ্ট ২) কর্ম ও ফলের মধ্যে এই সমতার তত্ত্ব এসেছে মীমাংসাভাষ্য থেকে। জৈন মত এই যে, ভাল ও মন্দ কাজ পরস্পরকে নাকচ করে দেয় না, তাদের পৃথক পৃথক ফল অনিবার্য। কিন্তু কর্মের ফল দেখা দেওয়ার আগে তার বিপাক প্রয়োজন। নূমেন দেখাচ্ছেন, জৈন কর্মবিপাকতত্ত্বেও সেই গোলমেলে অস্পষ্টতা। কর্মবিপাক হচ্ছে কর্মের পরিণাম, পরিপক্ক হওয়া। কোনও কোনও ভারতীয় শাস্ত্রে, বিশেষত ধর্মসূত্র সাহিত্যে এবং কোনও কোনও পুরাণে আমরা দেখি, কর্ম ও তার ফলের বিরাট আনুপাতিক তালিকা, বিশেষ ভাবে নিষিদ্ধ কর্মের শাস্তির প্রকারভেদ: এ পৃথিবীতে অথবা অধোলোকে হীন অবস্থা। বর্তমান বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এ কোনও ব্যাখ্যাই নয়, বরং ঐশ্বরিক নিয়ন্ত্রণের কাছাকাছি এক তত্ত্ব। মনে রাখতে হবে, ভুল ব্যাখ্যাও মানুষের ব্যাখ্যাকামিতাই সূচনা করে; তার গূঢ় বিশ্বাস ও বাসনা হল চিনতে পারা যায় এমন কোনও একটি ছক আছে, যদিও আসলে কিছুই নেই। তিব্বতের ধর্ম বিশ্বাসেও কর্ম ও কর্মফলের একটা কার্যকারণ সম্পর্ক স্বীকার করা হয়েছিল, তিব্বতী ‘মৃতদের গ্রন্থ’-তে কর্মের সঙ্গে জন্মান্তরের সম্পর্ক স্পষ্ট। মহাভারতের আশ্বমেধিকপর্বে কশ্যপমুনির সঙ্গে এক ব্রাহ্মণের দীর্ঘ সংলাপের বিষয়বস্তু হল ব্রাহ্মণের একরাশি প্রশ্নের উত্তরে কশ্যপ বলে যাচ্ছেন কর্মের সঙ্গে জন্মান্তরের আনুপাতিক সম্বন্ধ। (১৬শ অধ্যায় থেকে)

কর্ম এবং নিয়তির প্রসঙ্গে স্বভাবতই প্রকৃতির কথা আসে। নিয়তি কি কর্মের দ্বারা প্রতিহত হয় বা তার সহায়তা পায়? প্রকৃতি বলে স্বতন্ত্র কিছু আছে কি? থাকলে কী তার দ্বারা মানুষের কর্ম প্রভাবিত হয়? হলে কী ভাবে হয়? প্রকৃতি বা স্বভাবের মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে, প্রথমত প্রাকৃতিক নিয়তিতে বিশ্বাস, এবং দ্বিতীয়ত অতিপ্রাকৃত নিয়তিতে বিশ্বাস। পাণ্ডে বলেন, প্রাকৃতিক নিয়তিতে বিশ্বাস প্রাকৃতিক ঘটনাপুঞ্জের নিয়মানুবর্তিতা থেকে উদ্ভুত, আর অতিপ্রাকৃত নিয়তিতে বিশ্বাস, মানুষের জীবনে আকস্মিক ঘটনা সম্বন্ধে চিন্তা থেকে প্রসূত। ‘আকস্মিক হল তা-ই যার কারণ জানা যায় না, সে জন্য প্রাচীনকালে কৌতূহল যখন জ্ঞানকে অনেকখানি ছাপিয়ে ওঠে, তখনই অতিপ্রাকৃতের কল্পনা আবির্ভূত হয়। ঘটনার অবশ্যম্ভাবিতা মানুষের মনকে দৃঢ় ভাবে প্রভাবিত করে থাকবে। সম্ভাব্যতার সূত্রে নিয়তিবাদকেও এই ধরনের অবশ্যম্ভাবিতার প্রসঙ্গে ভাবতে হবে।’ (১৯৭৪, পৃ. ৩৩৯)

স্বাধীন ইচ্ছার দৃঢ় অস্বীকৃতি এবং নিয়তিবাদকে কোনও দিব্য কর্তার অনুল্লেখ—একেই চূড়ান্ত তত্ত্ব বলে মনে করা হয়েছিল। মানুষের ‘সংকিলেস’ বা বিশুদ্ধির পিছনে কোনও কারণ বা হেতুকে অস্বীকার করাতে প্রকাশ পায় যে, নিয়তিকে অন্ধ মনে করা হত, অর্থাৎ নির্হেতুক আবশ্যিকতার মতো… এক বার অর্জিত হলে পর কর্মের উত্তরাধিকার আর ইচ্ছার ওপরে নির্ভরশীল নয় বলে ভাবা হত, তখন তা নিজস্ব নিয়মে কাজ করে যায়… ইচ্ছাটাকেই অস্বীকার করা হয়েছে… এই চূড়ান্ত পূর্বনির্ধারণবাদ কর্মে বিশ্বাস থাকাকে বাধা দেয় না। কিন্তু মস্করী গোসালের পক্ষে এ তত্ত্ব তার নৈতিকতার জোর হারিয়েছে। ধর্মাচরণ, ব্রত, তপস্যা, যৌন শুচিতা এ সব কোনও কিছু দ্বারাই কর্ম প্রভাবিত নয়, কিন্তু একে অস্বীকারও করা হয়নি। সমস্ত জীব নিয়তি, সংগতি এবং ভাব (প্রকৃতি) দ্বারা পুষ্ট। অগ্রগতি ও পরিবর্তন সর্বতো ভাবে নিয়ন্ত্রিত। নিয়তি মৌলিক বর্গ, তার ঠিক নিচেই ভাব, প্রত্যেক সত্তাতেই (কতকগুলি) শর্ত এবং লক্ষণ যা উপাদান হিসাবে কাজ করে তা বৃহৎ নিয়ামক নীতির অধীন, (এরা) বুদ্ধি, পুষ্টি এবং পুনর্জন্ম নির্ধারণ করে। (তবে) প্রয়াসের প্রয়োজন কী? মনে হবে যে স্বভাববাদীরা নিয়তিবাদীদের থেকে এইখানেই স্বতন্ত্র যে, নিয়তিবাদীরা মনে করেন ব্যক্তির বাইরের প্রভাব তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর স্বভাববাদীরা মনে করেন ব্যক্তি তার আধিভৌতিক ও মানসিক স্বভাবের দ্বারা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত। আর এই দুই মতের মধ্যে অনেক সাধারণ লক্ষণ আছে বলে এমনটা মনে করা হয় যে, স্বভাববাদীরা আজীবিকদের একটি ছোট উপসম্প্রদায় মাত্র। বেদবহির্ভূত প্রস্থানগুলির মধ্যে বহিঃপ্রকৃতির বাইরের ঘটনাপ্রবাহ ও মানবজীবনের ধারাকে প্রভাবিত করতে স্বভাব (প্রকৃতি)-এর অনুপ্রবেশ এবং অচিরেই তা নিয়তি বা ভাগ্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল। মায়াবাদ যখন মঞ্চে আবির্ভূত হল তখন নিয়তিবাদকেও তা গ্রাস করল।… এই অগ্রগতি, সত্তামাত্রেরই কঠোর নিয়মের ধারায় ধীরে ধীরে বিবর্তন— এ কথা পালি ও অর্ধমাগধীতে আছে। শুধু যে সব কিছুই পরিবর্তন ও বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এ কথা নিছক একটি বিশ্বজাগতিক মায়া— তা নয়…. নিয়তিবাদের গুরুত্ব কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানবিক ক্রিয়ার নিরর্থকতাও হয়তো পশ্চাৎপটে সরে গেল… বাস্তবিকপক্ষে এ-ও হতে পারে যে আজীবিক তত্ত্বের কঠোর নিয়ন্ত্রণ কখনওই আজীবিক আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করেনি। তা ছাড়া দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব নগণ্যই ছিল। গোসাল এক অপরিবর্তন তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন যার দ্বারা সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সচ্চরিত, ব্রত, তপস্যা বা চারিত্রশুদ্ধি দিয়ে কর্মের কোনও হেরফের হয় না।… কাজেই আজীবিকদের কাছে নিয়তিই মহাবিশ্বের একমাত্র কারণ, প্রথম কারণ; সঙ্গতি আর ভাব হল নিয়তির ভ্রান্ত রূপভেদ। (পাণ্ডে, ১৯৭৪, পৃ. ৩৩৯, ২২৫-২২৭, ২৩৫, ৪৭১)

গোসাল তাঁর তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে প্রায় ওই ধরনেরই উক্তি পাই, ‘কালঃ স্বভাবো নিয়তির্যদৃচ্ছা’। (১:২) ‘যদৃচ্ছা’ এখানে নিয়তির বিষয়বস্তুকেই সূচিত ও বিশেষিত করছে: অর্থাৎ নিয়তি খামখেয়ালি ও অভাবনীয়। এর দ্বারা নিয়তির মধ্যে কোনও সুসংহত ছক খোঁজার প্রয়াস দুশ্চেষ্টায় পরিণত হয়। কেউ কেউ একেই বলেন নিয়তির চূড়ান্ত সার্বভৌমতা বা আকস্মিকতাবাদ। এঁদের মত সম্বন্ধে বালাস্লেভ বলেন, আকস্মিকতাবাদ নামে বেশ কিছু মত (যার অর্থ) হঠাৎ ঘটা ঘটনা যদৃচ্ছাবাদ, (অর্থাৎ) যেমন-তেমন ঘটনা, স্বভাববাদ, (অর্থাৎ) প্রকৃতিবাদ বা বস্তুবাদীদের ওপরে আরোপিত, এ সব নিশ্চয়ই বহু প্রাচীন কালেই প্রচলিত ছিল। এ সব মতের পরস্পরের মধ্যে যত সূক্ষ্ম ভেদই থাক না কেন, সব ক’টিরই সাধারণ প্রতিপাদ্য হল এই যে, কোনও ঘটনারই কোনও নিয়তিকারণ নেই, অন্য কোনও কিছুরই ওপরে কোনও ঘটনার কোনও আবশ্যিক নির্ভরতা নেই। স্বতঃপ্রণোদিত, অনির্দেশ্য উৎপত্তির এই সব তত্ত্ব নিশ্চয়ই মহাবিশ্ব সম্বন্ধে কোনও কার্যকারণগত ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে সংশয়বাদীদের প্রত্যাহ্বান জানানো।’ (১৯৮৩, পৃ. ১৯)

আজীবিকরা নিয়তি ও কর্মের মধ্যে কার্যকারণ সূত্রটিকে ছিন্ন করলেন। কিন্তু মূল ব্রাহ্মণ্যধর্ম ঠিক উল্টোটাই, কর্ম ও নিয়তির যোগসূত্রকে দৃঢ়তর করল। তাই অল্পকালের মধ্যেই কর্ম জীবনের সেই অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হল, যা মানুষের জ্ঞানের পরিধির ওপারে; নাম পরিগ্রহ করল ‘অদৃষ্ট’, যার অর্থ ‘যা দেখা যায় না’। দীর্ঘনিকায়-এর সমাঞফলসুত্তের ব্যাখ্যাকালে বুদ্ধঘোষ তাঁর সুমঙ্গলবিলাসিনী টীকায় বলেন, ‘জীবের পাপের কোনও কারণ বা ভিত্তি নেই; তারা বিনা হেতু ও ভিত্তিতেই পাপী হয়। জীবের পুণ্যেরও কোনও কারণ বা ভিত্তি নেই, তারা হেতু বা ভিত্তি ছাড়াই পুণ্যবান হয়। নিজের বা অন্যের কৃত এমন কোনও কর্ম (নেই), (যা এ জন্মে তার নিয়তিকে প্রভাবিত করতে পারে), মানুষের কোনও কর্ম, কোনও শক্তি, কোনও সাহস, কোনও মানবিক সহিষ্ণুতা বা মানবিক শৌর্য নেই (যা এ জন্মে তার নিয়তিকে প্রভাবিত করতে পারে)। সব জীব যার নিঃশ্বাস পড়ে, যার জন্ম হয়, প্রাণ আছে (তারা সবাই) শক্তিহীন, ক্ষমতাহীন, গুণহীন; তারা নিয়তি, ভাগ্য, স্বভাব ও অভিজ্ঞতা দ্বারা পুষ্ট এবং সত্তার ছ’টি শ্রেণিতেই সুখ ও দুঃখ অনুভব করে।’ (পালি টেক্সট সোসাইটি, লন্ডন, ১৯৭৫, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৫৩-৫৫, পরিচ্ছেদ ২১)

চোদ্দ লক্ষ প্রধান যোনিজ জন্ম আছে; ছ’ হাজার ছ’শো কর্ম, পাঁচশো কর্ম, তিন কৰ্ম, দেড়টি কর্ম; গৌণ কল্প, ছ’শ্রেণির মনুষ্যজীব, মানুষের জীবনে আটটি পর্যায় ভাগ, চার হাজার ন’শো সন্ন্যাসী, চার হাজার ন’শো নাগপ্রাসাদ, দু’ হাজার ক্ষমতা, তিন হাজার শুদ্ধি-নরক, ছত্রিশটি ধূলিলিপ্ত স্থান, একশোটি সচেতন জন্ম, একশোটি অচেতন জন্ম, গ্রন্থি থেকে একশোটি জন্ম, শত দেবতা, শতজন মানুষ, সাতটি পিশাচ, সাতশো সাতটি স্বপ্ন। চুরাশি লক্ষ মহাকল্প যার মধ্যে দিয়ে জ্ঞানী ও মূর্খ সমান ভাবেই পেরোবে, এবং দুঃখের অবসান ঘটাবে। অপরিপক্ক কর্মকে ফলপ্রসূ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, তেমনই সদাচরণ, ব্রত, তপস্যা ও শুচিতা দ্বারা পরিণত কর্মের বিনাশেরও (প্রশ্ন ওঠে না)। ওটা হতে পারে না। সংসারকে মাপা হয় যেন ধানমাপা ভাণ্ড দিয়ে, তার সুখদুঃখ এবং নির্ধারিত অবসানকেও কমানো যায় না, বাড়ানোও যায় না, বাড়তি কিছু থাকে না, ঘাটতিও না। সুতোর গোলা ছুঁড়ে দিলে যেমন পুরোটাই আপনা-আপনি খুলে যায়, তেমনই পণ্ডিত ও মূর্খ দু’জনেই ওই পথে চলে দুঃখের অবসান ঘটাবে।

এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি কার্যকারণ পরম্পরার সব যুক্তিযুক্ত অনুমানকে সঁপে দিল ভবিতব্যের কাছে। কিছুরই স্থায়ী মূল্য নেই, ভাল বা মন্দ, পণ্ডিত বা মুর্খ সকলেই অন্ধ এক নিয়তির হাতে ক্রীড়নক মাত্র। বৌদ্ধসাহিত্যে সংখ্যার দিকে এক কিশোরসুলভ প্রবণতা আছে এবং অচিরেই তা জ্যেতির্বিজ্ঞানের গণনাতীত রাশির মতো হয়ে ওঠে (যখন মানুষের বোধের মধ্যেই থাকে তখনও); এমন ভাবে সাজানো থাকে যা ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু যে কারণে ওই অংশটি ভয়াবহ হয়ে ওঠে তা হল কার্যকারণ সম্পর্ক সম্বন্ধে বা কোনও যুক্তিসাপেক্ষ ছক সম্বন্ধে এর সম্পূর্ণ ঔদাসীন্য। এই ছকটিই স্থায়ী হয় এবং দুয়ে সব অনুপঙ্খ নিয়ে বহুগণিত হতে থাকে। মানুষকে যেন নির্বিকার কর্মকারী হিসাবে দেখা যায়, তার ওপরে ঘটনা ঘটে, যার কোনও নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নেই।

এই অবস্থাচক্রকে কার্ল পটার সুন্দর ভাবে বলেছেন:

…একদিকে সংশয়বাদ (দেখায় যে) ঘটনাসমূহ শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে পরস্পরসংযুক্ত, অতএব উঠে দাঁড়াবার মতো (স্থান বা) অবস্থা আছে, সরে যাওয়ার মত নয়। অন্য দিকে নিয়তিবাদ: অর্থাৎ এই সংশয় যে, নৈর্ব্যক্তিক শক্তির দ্বারা মানুষের ভাগ্য পূর্ব-অবধারিত যা তার আয়ত্তের বাইরে। এরই সমান্তরাল শঙ্কাগুলি এক দিকে এই যে, মানুষ যা-ই করুক না কেন, প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না; অন্য দিকে, সে যা-ই করুক না কেন যা ঘটবার তা ঘটবেই।… সম্পূর্ণ স্বাধীনতা হচ্ছে কর্ম থেকে মুক্তি। কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, নিষ্কাম কর্ম ও নৈরাজ্যবাদে আংশিক মুক্তি মেলে, সেই দুইয়ের মধ্যে সত্যিকার কোনও পার্থক্য নেই…. (এ হল) মানুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক এক অযৌক্তিকতা-জনিত শঙ্কা যা তার স্বভাবেই নিহিত আছে; এর দ্বারা কোনও বিশেষ কিংবা সাধারণ অবস্থার পরিমাপ সে নিজে বা অন্য কেউই করতে পারে না।’ (১৯৬৩, পৃ. ২৩)

আবার হালবফাস বলছেন, ‘ক্রমে ক্রমে এমন একটি পরিমণ্ডল রচিত হল যাতে যে-অদৃশ্য অজ্ঞেয় শক্তিকে প্রথমে অস্থায়ী ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছিল, ভাবজগতে তার এত গুরুত্ব পড়ল যে, তা প্রায় ভয়াবহ আকার ধারণ করল। ফলে মানবিক ক্রিয়ামাত্রই তার যুক্তিসঙ্গত আনুপাতিক ফল সহ সেই শক্তির অধীন হয়ে পড়ল। ধর্ম ও অধর্মের ধারণাও অদৃষ্টের হয়ে গুণের তালিকায় দেখা দিল এবং প্রশস্তপাদের, অর্থাৎ ধ্রুপদী বৈশেষিকের দ্বিতীয় বর্গভুক্ত পদার্থের অন্তর্গত হল।… জাতিভেদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় জন্মান্তর ও কর্মবাদে এবং উত্তরকালে (তার দ্বারা) উচ্চতর মার্গে আরোহণের অবকাশ থাকে।’ (১৯৯১, পৃ. ২৯, ৭০)

অদৃষ্ট নানা চেহারা, নাম ও অনুষঙ্গে চিহ্নিত হয়, কিন্তু তার ভূমিকা সেই অপ্রতিহত নিয়তিরই। এ সব নামের মধ্যে একটি হল ললাটলিপি, গ্রিসে এর কিছু ভিন্ন পরিচয় ছিল। দেবী কোরসে যে-শিশুটির ধাত্রী হয়েছিলেন, তাকে তিনি অগ্নিদগ্ধ করে অমর করতে উদ্যত হয়েছিলেন। অন্যত্র দেবীর প্রসাদে অ্যাকিলিসকে জলে ডুবিয়ে অমর করা হচ্ছিল। দেবী আইলেইথিয়া সদ্যোজাত শিশুদের ভাগ্য নিরূপণ করতেন। প্রাচীন ইরানে প্রধান দেবতা ইন্মানাও ‘এক বিশিষ্ট ভাগ্যদেবতা, একই সঙ্গে ভাল এবং মন্দ এবং সম্পূর্ণ অনির্দেশ্য।’ (হিডেনগ্রেন ১৯৩৮, পৃ. ৪) কাজেই, নবজাতকের ভবিষ্যৎ-নিরূপণের জন্যে দেবীদের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়ার দ্বারা এই বিশ্বাস স্পষ্ট হচ্ছে যে, নানা নামে নিয়তিই সেখানে সক্রিয়। মানুষের জীবনে ভাল মন্দ যা-ই ঘটুক সবই ওপরের এক ঈশ্বর আগে থেকে ঠিক করে রাখেন— এ বিশ্বাস প্রায় সারা পৃথিবীতেই চিরকাল পরিব্যাপ্ত ছিল। ভারতবর্ষে গ্রামীণ ধর্মবিশ্বাস বলে, শিশুজন্মের ষষ্ঠ দিনে ভগবান বিধিরূপে (বা ষষ্ঠী দেবীরূপে) রাত্রে এসে অদৃশ্য অক্ষরে শিশুটির কপালে তার ভাগ্য লিখে দিয়ে যান। সত্যবান এক বছরের মধ্যে মারা যাবে, এমন বিধিলিপি জানা ছিল বলেই সাবিত্রীর নির্বন্ধাতিশয্যে যম শেষ পর্যন্ত সত্যবানকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এই রকম আরও দু-একটা ঘটনার উল্লেখ আছে যেখানে বিধিলিপি পরিবর্তিত হয়েছে। কংস বলেছিল, ‘আমাদের মতো মানুষ সদাচরণ, মন্ত্র, ওষধি এবং নিরন্তর প্রচেষ্টার দ্বারা ভাগ্যকে প্রতিহত করে নিজের স্বার্থের অনুকূলে আনতে পারে।’ (হরিবংশ ৪৮:৩৯) কংস কিন্তু বিধিলিপি অন্যথা করতে পারেনি, সম্ভবত সদাচরণে ঘাটতি ছিল বলে। অন্য দু-একজন পেরেছিলেন, এটা আমরা পরে দেখব।

‘মানুষের ওপরে বাইরের চাপের সঙ্গে যুক্ত হল প্রথম নির্হেতুক ভাবে নির্দেশিত ললাটলেখন, যা সত্তামাত্রেরই সদর্থক বা নঞর্থক নিয়তিকে প্রকাশ করে। প্রথমত পূর্বজন্মের কর্মে ললাটলিপির কোনও ভিত্তি নেই, তাই নিরূপিত ঘটনাগুলি এক অর্থে ‘অনর্জিত’… নিয়তির প্রবল শক্তির সামনে আমাদের প্রশ্ন করতে হয়, কোনও মানুষের কখনওই কী কোনও ললাটলেখন পরিবর্তন করার সাধ্য আছে? ললাটলিপিতে নির্দেশিত নঞর্থক ঘটনাধারাকে প্রত্যাখ্যান করার বা অন্যের কাজ থেকে অর্জিত দুষ্কর্ম প্রতিহত করার, কিংবা ললাটলিপির প্রভাবকে পরাস্ত করে এমন কোনও ভাগ্য নির্ধারণ করার সাধ্য কী আছে যা সে চায় অথবা নিয়ন্ত্রণ করে…? (প্রাঙনিরূপণবাদ অনুসারে) প্রত্যেক কর্ম পৃথক ভাবে নথিভুক্ত হয় এবং প্রত্যেকটিরই কর্মের অনুরূপ একটা ফল থাকে কোনও প্রতিক্রিয়ায় (পুরস্কার বা শান্তি)। সৎকর্ম অপকর্মকে মুছে দিতে পারে না, যদিও সৎকর্ম যত বেশি হবে ললাটলিপি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত শুভফলও তার বেশি হবে। এখানে ললাটলিপির ভূমিকা হল কোন কর্ম ফলবান হবে, অর্থাৎ একটি জীবনকালে (তার) ফল ফলবে তা নিরুপণ করা এক জন্মে করা সব কর্মই পরজন্মে ফল ধারণ করে না। কোনও কোনওটা বহু জন্মের ব্যবধানেও করে।’ (কীস অ্যান্ড ড্যানিয়েল, ১৯৮৩, পৃ. ৩৫-৩৯) ‘আপাত ভাবে মনে হয় কর্ম এমনই বস্তু যা… কোনও কালেই নষ্ট হয় না।’ (ও’ফ্লাহাটি, ১৯৭৪, পৃ. ১৪) কিন্তু সহস্রাব্দব্যাপী বিরাট সাহিত্যে বিস্তর বিধান দেওয়া আছে যাতে কর্মফল সম্পূর্ণ নষ্ট করা, মুছে দেওয়া বা বহুলাংশে পরিবর্তিত করা যায়। তার চেয়ে নিশ্চিত ভাবে যা বলা যায় তা হল, কর্ম ও কর্মফলকে এমন দুয়ে ও অমোঘ রূপে দেখানো হয়েছে শুধু একটি জটিল ও বিস্তৃত ছক তৈরি করার জন্যে, যাতে কর্ম ও কর্মফল নষ্ট করা সম্ভব হয়। কাপালিক ও লিঙ্গায়েত্রা কর্ম ও পুনর্জন্ম অস্বীকার করে। বৃহৎ পৌরাণিক সাহিত্যে অতীত কর্মকে অ-দৃষ্ট রূপে দেখানো হয়েছে; মুষ্টিমেয় কিছু গূঢ়জ্ঞানের অধিকারী ত্রিকালদর্শী ব্যক্তি ভান করেন যে, কর্মফল থেকে হিসেব করে তাঁরা কারণস্বরূপ কৃতকর্মে পৌঁছতে পারেন। বহু পূর্বে বৌদ্ধ মিলিন্দপঞহ গ্রন্থে আছে যে, কর্মের বিপাক ও ফলধারণ অজ্ঞেয়। (৪:৪:১) তেমনই জৈন সন্ন্যাসী হরিভদ্র সূরি নিয়তিকে অদৃষ্ট বলেন। (শাস্ত্রবার্তাসমুচ্চয় ৯১:১০৭) ব্যাপক ধারণা হল, কর্ম নিয়তির অধীন।

রামের বনবাসের পর কৌশল্যা বিলাপ করে বলেন, বৃথাই তিনি এত কাল ধরে পুত্রের জন্মের জন্যে ব্রতপালন করেছেন, দান, কৃচ্ছ্রাসাধন ও তপস্যা করেছেন, যেহেতু নিয়তি সেই পুত্রকেই ছিনিয়ে নিয়ে গেল। (রামায়ণ ২:২০:৫২) সীতাকে হরণ করবার সময়ে রাবণ যে স্পর্শ করেছিল তার জন্যে দায়ী সীতার দুনিয়তি। (ঐ ৬:৮৬:৮) যেখানে প্রত্যক্ষত নৈতিক ভাবে দায়ী ও অপরাধী ব্যক্তি আছে, সেখানেও ঘটনার ব্যাখ্যার জন্যে নিয়তিকে টেনে আনা হচ্ছে, নিয়তির আধ্যাত্মিক মূল্যবান বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য।

মহাভারত-এ এক জায়গায় পড়ি লোকেরা নিজের দোষে বা গুণে দুঃখ বা সুখ ভোগ করে। (১:৭৪:২৯); এই যুক্তি অনুসারে সীতার অপমান ও লাঞ্ছনা তাঁরই দোষের ফল। আবার এই ব্যক্তিগত দায়িত্ব খণ্ডিত হয় অন্য এক জায়গায়: ‘সুখদুঃখ মেপে দেয় নিয়তি, ব্যক্তির অধিকারের বাইরে এ সব।’ (ঐ ১:৮৪:৭) পাণ্ডবরাও তাদের নিজেদের (কর্মার্জিত ও নিয়তিনির্দিষ্ট) ভাগ্যই ভোগ করেছে। (ঐ ২:৪৪:১); অজ্ঞান কর্ম ও বাসনার তাড়নায় মানুষ জন্ম থেকে জন্মান্তরে ঘুরে বেড়ায়। (ঐ ৩:২:৬৭) এই ধরনের পরস্পরবিরুদ্ধ মত যখন প্রবল তখন একটি আপোসের সংজ্ঞা পাওয়া গেল: ‘কিছু নিয়তির বশে, কিছু আপতিক, আর কিছু বা নিজের কর্মের দোষে মানুষ ফল ভোগ করে।’ (ঐ ৩:৩৩:৩২) এতে যেন আঁধি আরও বেড়ে গেল, অথচ এই হল সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি তথ্য, মানুষের ভাগ্যে যে দুয়ে শক্তির খেলা, সেটা এখানে সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেটা হঠাৎ চোখে পড়ছে না তা হল কর্ম ও নিয়তির মধ্যে একটা বিরোধ আছে; সে প্রসঙ্গ পরে। ‘হয় মানুষ হয়ে (মর্তে) কিংবা স্বর্গে, কিংবা পশু হয়ে মর্তে জন্মানো যায়, চতুর্থ কোনও ভাগ্য হতে পারে না।’ (ঐ ৩:১৭৮:৯) এই ধারণাটি ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এ পুনরায় দেখা দেয়: ‘কেউ কেউ বলে (এ পৃথিবীর) অভিজ্ঞতা মানুষের নিজের কর্মের জন্যে হয়, কেউ বলে নিয়তির জন্যে, অন্যেরা বলে প্রকৃতির জন্যে হয়। বেদে এই তিনটি মতই পাওয়া যায়… (মানুষ) নিজেই যখন কর্মের কর্তা, তখন (তা) নিয়তির জন্যে হয় এবং মানুষের প্রকৃতি পূর্বতন কর্মের ফলে সৃষ্ট হয়।’ (প্রকৃতি খণ্ড, ৬০:২৫-২৮) ভাগবতপুরাণ-এ এর পুনরুল্লেখ পাই: ‘কেউ বলে কর্ম, কেউ বলে মানুষের নিজের স্বভাব, কেউ বলে কাল এবং অন্যেরা বলে বাসনা… মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর কারণ দৈব।’ (ভাষ্যকার শ্রীধর স্বামী ঈশ্বরবাদী, ‘দৈবের ব্যাখ্যায় বলেন ঈশ্বর’) এই সংমিশ্র ধারণার পুনরুক্তি বহু শাস্ত্রবচনেই আছে। ‘কেউ বলে আত্মাই হল সত্তার পরম বিকল্প, কেউ একে নিয়তি বলে মনে করে, কেউ বা ভাবে কর্ম, আবার অন্যেরা ভাবে প্রকৃতি (বা স্বভাব)। কারও-বা সিদ্ধান্ত এই যে ধারণা তর্কের অতীত, সম্পূর্ণ অজ্ঞেয়। তাই রাজর্ষি, আপনি আপনার বুদ্ধি দিয়ে একে বুঝে নিন।’ (ভাগ. পু. ১:১৭,১৯:২০) ‘শেষপর্যন্ত কর্ম দিয়ে কর্মের খণ্ডন হয় না, দুই-ই অজ্ঞান প্রসূত, যেন স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন।’ (ঐ ৪:২৯:৩৪) ‘ভাগ্যের ওপরে কোনো শক্তি নেই।’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ৪৪:৭৩) শাপ ও বর উভয়ই ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।’ (ঐ ২৩:১৪৬) আবার ‘যা হবার তা হবেই, যা ঘটবার তা ঘটবেই।’ (ঐ ২৭:৫৭)

এই ভাবে শাস্ত্রের পর শাস্ত্রে নিয়তিকে মানব-অভিজ্ঞতার চূড়ান্ত নিয়ন্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে। সহজেই বোঝা যায় যে, এটি একটি অসম্ভব অবস্থান; ব্যক্তির নৈতিক দায়িত্বের সঙ্গে নিয়তিকে এতে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। তা ছাড়া বেদে এ সব কথা আছে, এ উক্তিটি হাস্যকর। জন্মান্তর, কর্ম ও নিয়তি বেদে, সংহিতায় নেই, পরবর্তী উপনিষৎ সাহিত্যে এর আভাসমাত্র আছে। কিন্তু আমরা তো বহু নজির পাচ্ছি, রাক্ষস, অসুর, যক্ষ, অপ্সরা, গন্ধর্ব, কিন্নর, নাগ, উপদেবতা ও পূর্ণ দেবতা হয়ে জন্মানোর। মহাভারত বলছে, ‘যখন কোনো শাস্ত্র বলে যে, নিয়তি বলবতী এবং সঞ্চিত কর্ম এড়ানো কঠিন, তখন তা হল পূর্বজন্মের পাপের ফল।’ (৩:১৯৮:৮৬) পূর্বকৃত কর্ম এবং নিয়তির সম্পর্ক কী, তা একেবারেই স্পষ্ট নয়। একই নিঃশ্বাসের বলা হচ্ছে, ‘মানুষই পাপপুণ্যের কর্তা ও ফলভোক্তা, ঈশ্বর কেন কর্তা হতে যাবেন?’ (ঐ ৩:১৮১:৭, ৭:৪১১) আর এক জায়গায় শুনি, ‘নিয়তি পূর্ব হতে যা পাপ বলে ঠিক করে রেখেছে তা নিমিত্ত-মাত্র, একটা ছুতো শুধু, আমরা যন্ত্রের মতো সে সব কর্মের কারকমাত্র।’ (ঐ ৩:১৯৯:২-৩) ‘পূর্বকৃত কর্ম আত্মায় সংলগ্ন থাকে। বিধাতা বহুকর্মের মধ্যে ভেদাভেদ বোঝাবার জন্য এই বিধানটি দিয়েছেন।’ (ঐ ৩:১৯৯:১৬) এ ধরনের অসংখ্য কথার ছড়াছড়ি সমস্ত মহাকাব্যটি জুড়ে এবং এগুলির মোট যোগফল হল মানুষের কর্মের দায়িত্ব সম্বন্ধে তাকে অন্ধ করে রাখা। যেমন ‘আপতিক ঘটনা, নিয়তি, প্ৰকৃতি (বা স্বভাব) থেকে মানুষ যা পায় তা তার পূর্বকর্মের ফল।’ (ঐ ৩:৩৩:১৮) আবার, ‘অন্য কেউ কৃতকর্মের (ফলের) অভিজ্ঞতা ভোগ করে না, সে একাই কর্তা, সুখদুঃখের ভোক্তা, কৃতকর্ম কখনও নষ্ট হয় না।’ (ঐ ৩:২০০:২৭) ‘মৃত্যুর পরে কেউই তোমার সঙ্গী হবে না, শুধু পাপ ও পুণ্য-কর্মই তোমার অনুগামী হবে’ (ঐ ১২:৩১৬:৩৫) বপন ও ফসল কাটার উপমান ব্যবহার করা হয়েছে: ‘চাষী যেমন বীজ বোনে তেমনই ফসল তোলে— ভাল বা মন্দ।’ (ঐ ১৩:৬:৬) ‘মানুষ কৃতকর্মের ফল ঠিক সেই সেই দেহেই ভোগ করে (আবার)… কৃত কৰ্ম নষ্ট হয় না।’ (ঐ ১৩:৭:৩:৫)

যে ভগবদ্গীতা-কে মহাভারত-এর শ্রেষ্ঠ নির্যাস বলে মনে করা হয় তারও ভিত্তি জন্মান্তর ও কর্মবাদে। অরবিন্দ শর্মা বলেন, ‘পূর্বে যে সব সিদ্ধান্ত বলা হয়েছে, অর্থাৎ গীতা প্রাঙনির্ধারণবাদ বেছে নিয়েছে অথবা এ বিষয়টি সম্বন্ধে কখনও মনস্থির করতে পারেনি— এ সব মত হল কর্ম ক্রিয়মাণ বা আগামী কর্ম, সঞ্চিত কর্ম এবং প্রারব্ধ কর্ম নিয়ে যে বৃহত্তর ছকটি তৈরি হয়েছে তা-ই। এই ত্রিভাগ অনুসারে কৌরবদের মৃত্যু প্রারব্ধ কর্ম হয়ে যায়, কিন্তু যুদ্ধে অর্জুনের অংশগ্রহণ তখনও সঞ্চিত কর্ম, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আগামী ও ক্রিয়মাণ কর্মের শাণিত ধার; কৃষ্ণ প্রোৎসাহন বাক্য বলে একে পুরোপুরি ক্রিয়মাণ বা প্রারব্ধ করে তুলছেন, যা কৃষ্ণের মতের অর্জুনের করা সম্ভব, উচিত এবং তিনি তা করবেন।’ (১৯৭৯, পৃ. ৫৩৭) ভগবদগীতা তথা মহাভারতের মূল কাহিনিকে কর্ম ও কর্মফলের একটি প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত বলে নেওয়া চলে। অধিকাংশ পুরাণ সম্বন্ধেও এ কথা প্রযোজ্য।

অর্বাচীনতার শাস্ত্র যোগাবাশিষ্ঠ রামায়ণ-ও প্রতিপন্ন করে এ তত্ত্ব: কর্ম→পুনর্জন্ম কর্মফলভোগ, ও একে দৃঢ়তর করে তোলার জন্যে নিয়তি পরিকল্পিত। ‘পূর্বতন বাসনা আমাকে (এ জীবনে) প্রণোদিত করে’। (মুমুক্ষু, ৫:১০) মানুষের উচিত এমন সব উদ্যোগ নেওয়া যা আপনিই অশুভকে খণ্ডন করে।’ (ঐ ৫:১১) ‘একটি ভাণ্ড বা বস্ত্রের যেমন নির্দিষ্ট আয়তন আছে, তেমনই মানুষের বাসনারও নির্দিষ্ট সীমা আছে।’ (ঐ ৫:২৪ )

নিয়তিবাদ এমনই এক সর্বদেশে, সর্বকালে পরিব্যাপ্ত ধারণা যে, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের আয়ুর্বেদগ্রন্থ চরকসংহিতা-কেও এর মুখোমুখি হতে হয়েছিল এবং নিজের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে ব্যবহার করতে হয়েছিল। চরক স্পষ্ট বলেন, ‘ভাগ্যকে নিজেরই পূর্বজন্ম থেকে মেনে আনা বলে মনে করতে হবে, যদিও মানুষ এ জন্মেও কর্ম করে।’ (চরকসংহিতা ৩:৩:৩০) কিছু পরে গ্রন্থকার প্রবল এবং দুর্বল নিয়তির মধ্যে ভেদরেখা টেনেছেন, দুর্বল নিয়তি মানুষের কর্মের দ্বারা প্রতিহত হয় কিন্তু একই সময়ে কর্মও নিয়তির দ্বারা পূর্ব-নিরূপিত হয়।’ (ঐ ৩:৩:৩৩-৩৪)

মিচেল জি হ্বাইস চরকের বিষয়ে বলেছেন, ‘নিয়তিকে স্বতঃপ্রবর্তিত বলে দেখতে হবে, তা পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফল, তা ছাড়াও মানুষ এ জন্মে যে কাজ করে তা-ও আছে। দুর্বল নিয়তি ব্যক্তির কর্ম দ্বারা প্রতিহত হয়; অপরপক্ষে মানুষের কর্মও নিয়তির দ্বারা প্রতিহত হয়। পূর্বজন্মে কর্মের উৎপত্তি থেকে গুরুত্ব সরিয়ে এ জন্মে এনে ফেলে চরক সার্থক ভাবে অমোঘ কর্মবাদকে পরিবর্তনশীল করে তুললেন।’ চরকসংহিতা(৪:২) সম্বন্ধে হ্লাইস বলছেন, ‘শুক্রের ত্রুটির জন্যে, নিজের অবশিষ্ট কর্মের জন্যে, ঋতু বিশেষের জন্যে, মায়ের খাদ্য ও কাজকর্মের জন্যে বহুবিধ অশুচিতার দোষ থেকে (শিশু) বিকৃত গঠনের হয়…।’ লক্ষণীয়, ভৌতিক হেতুর সঙ্গে চরক কৌশলে কর্মকে এনে এনে সমাজে আত্মরক্ষা করছেন। একই গ্রন্থের (২:৭) সম্বন্ধে বলছেন, ‘দেব, গন্ধর্ব, পিশাচ, রাক্ষস কেউ সেই মানুষকে ক্লেশ দিতে পারে না যে স্বতঃক্লিষ্ট নয়।’ এই অংশ থেকে মনে হয় বিকৃতগঠন শিশুর ব্যাপারে চরক পূর্বজন্মের পাপের চেয়ে প্রাকৃতিক হেতুগুলিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, চিকিৎসা সম্বন্ধে চরক বলেন, ‘অতএব যে কোনও রোগই সারে যখন দোষ ও কর্ম দুই-ই নিরস্ত হয়।’ (ও’ফ্লাহার্টি সম্পাদিত, ১৯৮৩, পৃ. ১১৭) এই আপাতবৈষম্য ধাঁধা লাগায়: শিশুর গঠন বিকৃতির ব্যাপারে যাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বৈজ্ঞানিক, তিনিই আবার প্রাক্তন পাপকর্মের দোহাই দিয়ে কর্মবাদের প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। যিনি বলেন আত্মক্লেশই ক্লেশ, দেবতা, উপদেবতারা মানুষকে স্পর্শই করতে পারে না তিনিই হঠাৎ নিজের চিকিৎসার ব্যাপারে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করলেন? এটা কিন্তু কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়, সমগ্র চরকসংহিতা ঠিক এ জাতীয় পরস্পরবিরোধী উক্তিতে ভরা। সমগ্র গ্রন্থটির মূল অবস্থান বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক, কিন্তু এ ধরনের কিছু রহস্যবাদী দুজ্ঞেয়বাদী উক্তি গ্রন্থটির সাহসী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আপাতদৃষ্টিতে বিকৃত করে। একমাত্র যে ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য তা হল, এ সব উক্তি সমাজপতি, ধর্মশাস্ত্রকারদের তোয়াজ করবার জন্যে। তাঁরা তো কর্মবাদী, নিয়তিবাদী, তাই পুরো বৈজ্ঞানিক, কর্ম-নিয়তি-নিরপেক্ষ অবস্থান তাঁরা সইবেন কেন? তাঁদের তাঁবে যে-সমাজ, তার মধ্যে এ ধরনের বিশুদ্ধ স্বনির্ভর বিজ্ঞানী ভাবধারা অনুপ্রবিষ্ট হলে তাঁদের সব প্রচার ভেস্তে যাবে। তাই মাঝে মাঝে দু-চারটে ধার্মিকসুলভ কথা ঢুকিয়ে মূল গ্রন্থটিকে চরক অপমৃত্যু থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। বিজ্ঞানের অন্য প্রবক্তা এবং বেদ-নিরপেক্ষ দর্শনপ্রস্থানগুলিকেও এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং তাঁরাও ঠিক একই উপায়ে গা বাঁচিয়েছেন।

কর্ম ও কর্মফলকে চূড়ান্ত রহস্যে আবৃত রাখার ফল হল এই যে, যদিও পণ্ডিতেরা ঘটনাপ্রবাহকে বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ— মেঘ থেকে বৃষ্টি বা বীজ থেকে শস্য— দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন তবু সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি; কারণ কর্ম ও কর্মফল প্রকৃতির অন্তর্গত নয় এবং প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কাজ করে না। ওই মত হল কর্মবিপাকের। পুরাণ এবং অন্যান্য গ্রন্থে কর্ম ও আনুপাতিক কর্মফল সম্বন্ধে সুদীর্ঘ তালিকা আছে (বায়ু পু. ১০১:১১৫-৪৫; ১৭৫-১৯২; ব্রহ্মাণ্ড পু. তৃতীয় খণ্ড, ৪:২:১৪৫-১৯১, বিষ্ণু পু. ২:৬:১-১০, ৩২; অগ্নি পু. ৩৫২ অধ্যায়; মার্কণ্ডেয় পু. ১১:২২-২৫, পুরো দ্বাদশ অধ্যায় ১৪:১৬-১৮, ২৩-৩১, ৩৯-৯৫, পুরো পঞ্চদশ অধ্যায়; গরুড় পু. ২:৩২; ৭২-৮০; ১২৫-২৬, ভাগবত ৩:৩০; ৪:৫; ২০-২৭, ৩২, ব্রহ্মবৈবর্ত ২৬:১১:৩১; ৩৯:১-১৬, বামন পু. দ্বাদশ অধ্যায় ও আরও অনেক)

এ সব তালিকা সত্ত্বেও কার্যকারণ সম্বন্ধের আবির্ভাবের জন্যে— বিশেষত আধিভৌতিক স্তরের বাইরে— প্রয়োজন এক বুদ্ধিমান ও সমর্থ বিচারকের, যার বোধবুদ্ধি সন্দেহাতীত এবং যাঁর বিচার নির্ভরযোগ্য। খ্রিস্টানের ঈশ্বর, মুসলমানের আল্লাহ, ইহুদির যাহহ্বেহ’র মতো কোনও বিধাতার অবর্তমানে এমন এক খাঁটি ভারতীয় বিশ্বনিয়ন্তার অভাব স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়। যদিও এই সব ঈশ্বরের অস্তিত্বও যে সব ধর্মীয় সমস্যার সমাধান করেছে একেবারেই তা নয়। ব্রাহ্মণ্যধর্মের মতো বহু দেবদেবী সম্পন্ন কোনও ধর্মে এমন এক জন দেবতা নেই যিনি কর্মফল বিতরণ করেন, যাঁর বিচার তর্কাতীত, অতএব সকলের গ্রহণযোগ্য। ‘সুমেরীয়দের পক্ষে এক সৌরদেবতা ‘উতু’ আর চন্দ্রদেবতা ‘নান্নাহ’ মৃতের বিচার করে ‘ভাগ্যে’ নিরূপণ করতেন।’ (ক্রামার, ১৯৬৩, পৃ. ১৩২) এ বিচার দেবতার পক্ষেও প্রযোজ্য। ‘এনলিল অপরাধ করলেন এবং দেবতাদের বিচার অনুসারে সুমেরীয় নরকের অভিমুখে তাঁকে যেতে হল।’ (ঐ পৃ. ১৪৭) এই ধরনের সর্বব্যাপী দিব্য বিচারের একটি অলঙ্ঘনীয় বিচার ছিল। ভারতে ব্রাহ্মণ্য বৌদ্ধ জৈন ধর্মবিশ্বাসের ঠিক এমন কোনও বিধাতা নেই। শাস্ত্রগুলিতে কর্ম ও ফলের মধ্যে পরস্পর-বিরোধিতা, অসামঞ্জস্য, বৈসাদৃশ্য এবং ভারসাম্যের অভাব স্পষ্ট চোখে পড়ে। অর্থাৎ কার্য ও কারণের মধ্যে কোনও সামঞ্জস্য বা ধ্রুব অনুপাত নেই, তাই এই বৈসাদৃশ্য থেকে কর্মবাদের বিশ্বসনীয়তা সম্বন্ধে সন্দেহ আসে। ভারতে দেবতাদের এক করণিক আছে, চিত্রগুপ্ত, কিন্তু কোনও বিচারক নেই। তাই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মের যথোপযুক্ত ফল পাওয়ার জনে যে অন্তর্নিহিত প্রত্যাশা মানুষের থাকে, তার সামনে আছে বিভিন্ন প্রভুত্ব ও মানদণ্ডের প্রতীকের এক এলোমেলো ব্যবস্থা। এই ফাঁকটাতেই বিকশিত হয়েছে নিয়তিবাদ ও কর্মবাদের তত্ত্ব।

ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম সকলেই মানে যে এ জন্মের পাপের একটা ফল পরজন্মে নিম্নমানের কোনও স্তরে, অর্থাৎ মনুষ্যেতর যোনিতে বা দরিদ্র, ব্যাধিগ্রস্ত বা ঘৃণিত কোনও জন্ম; শুধু একজন্মে নয়, তার পরের কয়েকটি জন্মেই। মানুষ হয়ে জন্মানো হল পূর্বজন্মের পুণ্যের ফল। জৈনশাস্ত্রে পড়ি, ‘কোনও পশুরও নরকের অভিজ্ঞতা থাকতে পারে… ঘটনাচক্রে কোনও দেবতাও সর্প, মণি বা বৃক্ষরূপে প্রকাশিত হতে পারেন…. উদ্ভিদ-আত্মা আসে পশু বা মানব স্তর থেকে; যদিও মনে রাখতে হবে, যে এখানে ঝোঁকটা পড়ছে যুগপৎ একাধিক রূপ পরিগ্রহের ওপরে। অংশত এ (ধারণা)-র ভিত্তি হল (এই বিশ্বাস যে) কিছু উদ্ভিদের একাধিক বা বহু আত্মা আছে।’ (শূব্রিং, ১৯৬২, পৃ. ১৯১) এত স্পষ্ট করে কর্মের ফল হিসাবে ব্রাহ্মণ্যধর্ম কখনওই আত্মার মনুষ্যেতর বা জড়পদার্থের রূপপরিগ্রহ করার কথা বলে না। এ দিক থেকে জৈনধর্মের বিশ্বজগতের ব্যাখ্যা অনেক বেশি ব্যাপক। অবশ্য, ব্রাহ্মণ্যসাহিত্যেও দেবতাদের নাগ, মণি বা বৃক্ষরূপে জন্মাবার কথা আছে (বলরামের বাসুকিরূপ, বিষ্ণুপ্রিয়ার তুলসী, নারায়ণের শালগ্রামশিলা ও শিবের বাণলিঙ্গরূপ)। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যসাহিত্যে যেখানে এ সব দেবকল্পকাহিনি তত্ত্বের দৃষ্টান্তরূপে আছে, জৈনধর্ম এখানে ধর্ম-বিশ্বাসের সূত্র হিসেবে এগুলিকে উপস্থাপিত করে। এক দিক থেকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে খুব মিল: দুটি ধর্মেই দেবতারা পাপের ফলে স্বর্গচ্যুত হন; ব্রাহ্মণ্যসাহিত্যেও এ কথা আছে, তবে অনেক কম। পাপকারী সত্যভ্রষ্ট দেবতা ব্রাহ্মণ্যসাহিত্যে বিরল হলেও জৈনধর্মে তা খুবই সাধারণ: দেবতারা কর্মফলে জড়পদার্থ হয়ে জন্মান, এ যেন কর্মবাদের চূড়ান্ত নিদর্শনরূপেই ঘটে। ব্রাহ্মণ্যসাহিত্যে দেবতাদের যখন দেবেতর বা মনুষ্যেতর জন্ম ঘটে তখন তা কোনও অভিশাপের ফলেই, বৌদ্ধ বা জৈনসাহিত্যের মতো কর্মফলে নয়।

টি এন মদন নিয়তিবাদকে রূঢ়ভাবেই দোষ দিয়েছেন: ‘পিতামাতা ও সন্ততির সম্পর্ককে নিয়তি পদে পদে প্রভাবিত করে। প্রথম কন্যাদান থেকে শুরু করে… অসংখ্য ধাপের মধ্য দিয়ে, গর্ভধান থেকে পিণ্ডদান পর্যন্ত।’(১৯৮৭, পৃ. ২৯) পুরাণগুলির বহু উপাখ্যানের সমষ্টি থেকে এই ধারণাই হয়। ‘নিয়তির পরিমাপ করা যায় না, তাই সমস্ত ক্রিয়াই মানুষের কর্ম দিয়েই পরিমিত।’ (দেবীভাগবত পু. ৪:২১:৫-৭) যুক্তির দিক থেকে এটি ধোপে টেকে না, কিন্তু মোট কথাটা হল— নিয়তির পরিমাপ হয় না; যদি মানুষের প্রয়াস কর্ম হয়, তা হলেও নিয়তি বিলুপ্ত হয়। মহাভারতেও পাশাখেলার আমন্ত্রণ গ্রহণ করা থেকে যুধিষ্ঠিরকে কোনও মতে নিবৃত্ত করা গেল না; তাঁর দুর্বল যুক্তি হল, ‘নিয়তির দুর্বার শক্তির জন্যেই আমি তাঁর (ধৃতরাষ্ট্রের) বাক্য অমান্য করতে পারি না।’(২:৬৭:৩,৪) যদিও ছ’টি মহাপাপের তালিকায় পাশাখেলা আছে, তবু তা দিয়েও ধর্মপুত্রকে নিবৃত্ত করা গেল না। এ যেন সচেতন ভাবে নিয়তির কাছে তাঁর আত্মসমর্পণ, নৈতিক দায়িত্ব অস্বীকার করা। নিয়তির সার্বভৌমত্ব মহাভারতে বারবার উল্লিখিত। (১:১০৯:১০,১১; ৪৩:৩২; ৪৫:৫৫ থেকে ৬৭:৩,৪, ৭১:৩৫; ১৭৬:২৬ থেকে ৫:১৫৯-৬৪ অধ্যায়; ৬:৭৬:১৯; ১৩৫:১; ৮:৯:৩, ১২:৬:১ ইত্যাদি)

কখনও কখনও বিশেষ বিশেষ পাপ ও তাদের ফল উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন চণ্ডাল বা অন্য ইতর বর্ণের কাছে দক্ষিণা নিলে যজমান ঋত্বিক দুজনেই শিলাকীটরূপে জন্মায়। (বামন পু. ১২:৩৬) ‘যদি তোমার ভাগ্য শক্তিশালী হয় তা হলে তুমি আবার ধনলাভ করবে; (কারণ) যখন ভাগ্য ক্ষীণ হয় তখন ধনও হ্রাস পায় আর ভাগ্য উন্নতিশীল হলে ধনবৃদ্ধি ঘটে।’ (ঐ ৭৯:২৭-২৮) জিন অর্থাৎ বুদ্ধের কাছে কল্কি আত্মপরিচয় দিচ্ছেন, ‘আমাকে পাপপুণ্যের ফলের সংহার কর্তা বলে জেনো।’ (কল্কি পু. ২:৭:১৫) নিয়তি সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি বার উচ্চারিত কথা হল, ‘মানুষকে কর্মফল অবশ্যই ভোগ করতে হয়। শতকোটি কল্পেও অভুক্ত কর্মফল নষ্ট করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর অধিপতি দেবতারা মানুষের অন্তরে বাস করে সমস্ত কর্মের ফল ভোগ করেন।’ (নারদ পু. ২:৩:৬৯,৭০) নিয়তির অমোঘতা সম্বন্ধে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিয়তি যা নির্ধারণ করে তা কে কবে এড়াতে পেরেছে?’ (ব্রহ্ম পু. ২:১:৬৯) ‘মনুষ্য আকৃতি ধারণ করে কে নিয়তিকে জানতে পেরেছে?’ (ঐ ২:৩:১০) এ দুটি শাস্ত্রাংশে যদিও নিয়তির সার্বভৌমত্বই প্রতিষ্ঠিত করেছে তবুও কর্ম ও কর্মফলকে এখানে প্রভূত প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে; ‘সব মানুষই সর্বত্র সর্বদা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়, কেউ অপরের প্রতি ভাল বা মন্দ কিছু করতে পারে না।’ (ঐ ২:১২:৪৯) এখানে সহজেই লক্ষ করা যায় যে, উক্তিটির মধ্যে একটা বিভ্রান্তি আছে, অস্পষ্ট কারণগুলির অন্তর্নিহিত এক দুজ্ঞেয়তার কথাই শুধু প্রকারান্তরে ঘোষণা করা হচ্ছে। ‘মানুষ পূর্বে যেমন কর্ম করেছে তেমনই ফল সে ভোগ করে।’ (ঐ ২:২৩:২৪) তিনটি কারণের মধ্যে কর্ম প্রথম, তার পরে কর্তা, তার পরে অন্য কিছু।’ (ঐ ২:২৭:২২)

পুরাণগুলি এক বার কর্মের, এক বার নিয়তির ভূমিকাকে গুরুত্ব দেয়। ‘এই সমগ্ৰ বিশ্বের স্থাবর ও জঙ্গম সব কিছুই নিয়তির প্রভাবের অধীন।’ (নারদ পু. ২:১৩:১০৭) ওই পুরাণের পুরো অষ্টম অধ্যায়টিতে হরিশচন্দ্রের উপাখ্যানে অনার্জিত দুঃখের একটি সুদীর্ঘ বিবরণ; যেমন বাইবেলে জোবের উপাখ্যান, বা বেসসন্তর জাতকে। যদিও তিনটি কাহিনিতেই মানুষের প্রত্যাশিত প্রতিকার আসে শেষ কালে। নিয়তির চেয়ে শক্তিশালী কিছুই নেই, এই কথাটা অসংখ্যবার পুরাণে ও অন্যান্য শাস্ত্রে উল্লিখিত হয়েছে। মহাকাব্য ও পুরাণে নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করার মনোভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। ‘(মানুষের) চেষ্টা করার পর যা ঘটবার তো ঘটবেই।’ (দেবীভাগবত পু. ৫:৫:৬১) পূর্বনিরূপিত নিয়তিকে মেনে নেওয়া হয়েছে প্রথম সূত্র হিসেবে, ভাগ্যলিপিই জীবনের সব অভিজ্ঞতার নির্ণায়ক। ‘কালের প্রভাবে যখন আত্মা একটি দেহ ধারণ করে, তখনও সব কিছুই আগে থেকে লেখা হয়ে আছে— (তার) সুখ, দুঃখ ও মৃত্যু। মানুষের যা নিয়তি সেই ভাবেই সে মরে, তার কোনও পরিবর্তন হয় না। মানুষের জীবন ও মৃত্যু সম্পূর্ণ ভাবেই নিয়তির অধীন, ত্রিভুবনে কেউ তার অন্যথা করতে পারে না।’ (ঐ ৫:১০,৩৮,৩৯; ১১:৪৪; ৯:১৭:৩১ ) ‘সাধু ব্যক্তি দীর্ঘকাল ধরে তপস্যা করে; ফলদাতা হলেন দেবতারা; এ কথার সত্যতা সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই।’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. ব্রহ্মখণ্ড ১৪:৩০) নিয়তি সর্বভৌম, নিয়তির চেয়ে বেশি শক্তিশালী কেউ নেই।’ (দেবীভাগবত পু. ৯:১৬:৩১) কখনও কখনও নিয়তি ও কর্মের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন ‘ভাগ্য (মানুষদের) মিলিত করে, কিন্তু কর্ম বিযুক্ত করে’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. ১৩:৪:৬) কর্মের সঙ্গে নিয়তিকে যুক্ত করা হয়েছে একটি অপরিবর্তনীয় সম্পর্কে; ওই শৃঙ্খলসূত্রের প্রত্যেকটি শৃঙ্খল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে ক্রমেই, যদিও সে শৃঙ্খলের যুক্তি কোথাও স্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হয়নি।

নিয়তিকে চূড়ান্ত শক্তি বলে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। ‘জ্ঞানে’ পূর্ণনিষ্ণাত ব্যক্তি যাঁরা এই মর্ত্যদেহকে তার স্বরূপে জানেন, তাঁরা এটি নিশ্চল বা ঊর্ধগতিশীল কিনা তা নিয়ে ভাবেন না। তাঁরা (মনে করেন এটি) ভাগ্যের পথ বেয়ে এসেছে কিংবা সর্বাভিভু নিয়তির দ্বারা এসে পৌঁছেছে; সুরামত্ত মানুষ যে ভাবে তার মলিনবসনকে দেখে সেই ভাবে (এঁরাও দেহকে দেখেন)’ (ভাগবত পু. ১১:৩:৩৬) এই হল ভ্রান্তির চরম নিদর্শন যে, মানুষ যখন খাওয়া বা কাজ করার কথা বলে, তখন তারা আসলে ভাগ্য ও কালের কথাই বলে।’ (যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ, বৈরাগ্য, ২৫:১) ‘এই দৃশ্যমান জগৎ, যাকে তার ব্যাপ্তিতে দেখছি তা আসলে হল আত্মার নৃত্যশালা, তাই সে এখানে নেচে যায়। তৃতীয় শক্তিটি হল কৃত্যন্ত, ঘোর এক শক্তি। ভাগ্য পৃথিবীতে (আসে) নৃত্যপর কাপালিকের বেশে।’ (ঐ ২৫:১০) ‘ভাগ্যের এই রূপের সামনে চিরনারী নিয়তি অঙ্গভঙ্গি একটুও না থামিয়ে (ঘুরে ঘুরে চারিদিকে নেচে চলেছে। নিয়তি নারী বলে সর্বদাই চঞ্চল এবং কতকটা ব্যাপিকা।’ (ঐ ২৫:১০; ২৬:৫) ‘কর্মের মূল নিয়তিতে, সমস্ত পৃথিবীই নিয়তির অধীন। নিয়তি সজ্জনকে পুরস্কার ও দুর্জনকে শাস্তি দেয়।’ (বৃহন্নারদীয় পু. ৮:৫৮) জীবনে যদি এটা সত্য হত! তা যখন নয়, তখন আমাদের দৃষ্টি এ ফাঁকি ভেদ করে দেখে ফেলে, যে এর উল্টোটাই বহু ক্ষেত্রে সত্য; যারা দুঃখভোগ করে তারা দুর্জন বলে মনে করে না, ঠিক তেমনই সুখী মানুষ মাত্রেই পুণ্যাচারী নয়। এই ধরনের কথা অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বাস্তবিক পক্ষে মিথ্যা।

দেবীভাগবৎপুরাণ-এ আছে, ‘জয়পরাজয় নিয়ন্ত্রণ করে ভাগ্য।’ (৫:২৭:১১) ‘কাল ক’টি উপাদান মাত্র, দুটির মধ্যে ভাগ্যই সমধিক শক্তিশালী। সব কিছুই নির্মাণ করে ভাগ্য, তাই কিছুরই পরিবর্তন হয় না! (ভাগ্য) সমস্ত দেবতাদের ওপরে বিজয়ী।’ (৫:৩১:৭,৮) ভাগ্য প্রতিকূল হলে, মানুষের আর কোনও সহায়ক থাকে না।’ (৬:৭:২২,২৩) ‘সমর্থ বা দুর্বল মানুষ যা করে, ভাল বা মন্দ, কম বা বেশি, তার ফল ভোগ করা অনিবার্য; সত্যই সর্বতো ভাবে (ওই ফল) দেবতা, দানব, মানুষ সকলকেই ভোগ করতে হয়।’ (৬:৭:১৯,১৯) ‘কেউই নিজের অধীনে নয়, ভাগ্যের অধীনে।’ (৬:১০:২৯) ‘মানুষের মিলনবিরহ সর্বদাই ভাগ্যের অধীন।’(৬:৩০:১৬) ‘হরিশ্চন্দ্রের ধীর দুঃখভোগের পরে দেবতারা তাঁকে পুরস্কার দিলেন : স্ত্রীপুত্রসহ তিনি স্বর্গারোহণ করতে পারবেন।’ (৭:২৭:১৬) ক্রমে ক্রমে শাস্ত্র ও সাহিত্যের প্রত্যেক উপাখ্যানকেই কখনও কর্মফল কখনও বা নিয়তির খেলা হিসেবে দেখানো হয়েছে। অসংখ্য গ্রন্থে ভাগ্যের সর্বাত্মক প্রাধান্য ঘোষিত হলেও, পৌরাণিক যুগের প্রারম্ভেই উপস্থাপিত হল নতুন একটি তত্ত্ব— ‘কর্ম’ এবং প্রবল প্রতাপে তা প্রতিষ্ঠিত হল:

কর্মই নির্ধারণ করে জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ, ভয় এবং বিচ্ছেদ। হরির দাসজন্ম ইত্যাদি থেকে মুক্ত। মানুষ নিজের কর্ম দ্বারাই সমস্ত সার্থকতা পেতে পারে এবং অমর হতে পারে। কর্মের দ্বারা মানুষ বিষ্ণুর সঙ্গে সালোক্য (একই লোকে থাকা), সাযুজ্য (নিবিড় ঘনিষ্ঠতা), সমীপ্য ও সাষ্টি (সমমান) লাভ করতে পারে। কর্ম দ্বারাই মানুষ ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করতে পারে; মোক্ষ, দেবত্ব, মনুষ্যত্ব, সার্বভৌমত্ব, সর্বাত্ম, ঋষিত্ব বা সন্ন্যাসিত্ব, ক্ষত্রিয়ত্ব, বৈশ্যত্ব, শূদ্রত্ব, অস্পৃশ্যত্ব, সবই পেতে পারে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। স্থাবর ও জঙ্গম বস্তু, শৈল, বৃক্ষ, পশু, পক্ষী, কীট, কৃমি, সর্প, গন্ধর্ব, রাক্ষস, কিন্নর, যক্ষ, কুষ্মাণ্ড, আত্মা, বেতাল, প্রেতাত্মা, অসুর, ডাকিনী, দৈত্য, দানব, পুণ্যাত্মা, মহাপাপী, সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান, ঘোরতর অসুস্থ, কানা, কুদর্শন (সবই হতে পারে)। স্বর্গে বা নরকে, ইন্দ্র-সূর্য-চন্দ্রলোকে, অগ্নি, বায়ু, বরুণ, কুবের, ধ্রুব, শিব, নক্ষত্র, সত্য-জন-মহালোকে, পাতালে অথবা ব্রহ্মলোকে, সর্বজনকাঙ্ক্ষিত ভারতবর্ষে, বৈকুণ্ঠে, গোলোকে, রোগমুক্ত অবস্থায়, দীর্ঘায়ু, স্বল্পায়ু ভ্রূণের মতো যে ক্ষণায়ু ও এতক্ষণ পরেই যার মৃত্যু, (এ সবই তার হতে পারে)।’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. প্রকৃতি খণ্ড ২৪:১৭-৩৭)

বহু স্থানে বহু ভাবে জন্মানোর এই যে দীর্ঘ তালিকা, এর আসল উদ্দেশ্য হল জীবনের সর্বপ্রকার প্রকাশকে কর্মের অধীনে এনে ফেলা, এ সবেরই কারণ হল কর্ম। এ তত্ত্বের সঙ্গে অন্যান্য বিরুদ্ধে তত্ত্বের যে কোনও সামঞ্জস্য আছে তা কিন্তু নয়। শুধু তাই-ই নয়, এ তালিকাটির মধ্যে বহু পরস্পরবিরোধী কথা আছে। বৈষ্ণবধর্মের কথাই যদি ধরি, তাহলে ঊর্ধ্বলোকের বহু স্থান আছে যেগুলি কখনওই কর্মের দ্বারা পাওয়া যায় না, শুধু ভক্তির দ্বারাই পাওয়া যায়। তার ওপরে আবার উপনিষৎ ও বেদান্ত কখনও কখনও এমন কথা বলে যে পুণ্যকর্ম বা যাগযজ্ঞ দ্বারা ব্রহ্মলাভ ঘটে না; গভীর ও ব্যাপ্ত জ্ঞানের দ্বারাও না; যথোচিত মনোভাবের সাধককে ভগবানের করুণাই উপযুক্ত পাত্রজ্ঞানে মোক্ষলাভের সন্ধান দিয়ে থাকে:

সাধু ব্যক্তিরা কখনও দম্ভ প্রকাশ করেন না, কারণ জীব তার আপন কর্মের ফলেই নির্মিত হয়। কেউ রথে চড়ে, কেউ সে রথ বয়, রাজা কর্মের বলেই রাজস্ব পান, অন্যে তা দেয়। কেউ সিংহাসনে বসে, কেউ বা হয় সভাসদ, অন্যেরা নানা স্তরের দাস হয় কর্মেরই ফলে। কেউ অশ্বারোহী, কেউ গজারোহী, কর্মেরই ফলে।… কেউ শূকরীর গর্ভে প্রবেশ করে, কেউ বা শচীর। কেউ হয় আপনার দাস (অর্থাৎ ব্রহ্মার, তাঁরই সঙ্গে মোহিনী কথা বলেন), কেউ হরিভক্তির গুণে তাঁর সভাসদ হয়। দৈবদোষে কেউ বিষ্ঠাকীট হয়, কর্মের গুণে কোনও রাজা স্বর্গে যান, অন্যেরা নরকে গিয়ে বিষ্ঠা ও মুত্রে গড়াগড়ি খায়। কর্মগুণে কেউ দেবতাদের অধিপতি হন, এমনকী ইন্দ্রও হন; কেউ বা দেবতা, কেউ মানুষ, কেউ বা ক্ষুদ্র জীব। কর্মগুণে কেউ শ্রেষ্ঠ বর্ণে জন্মান, ভূলোকে ব্রাহ্মণ হয়ে, অন্য কেউ রাজা, বৈশ্য, শূদ্র ও অস্পৃশ্য হন। কর্মগুণে কেউ বুদ্ধিমান, জ্ঞানদৃষ্টিতে সর্বদর্শী, অন্য কেউ আবার মূর্খ, অন্ধ বা বিকলাঙ্গ হন। কর্মগুণে কেউ শিষ্যদের কাছে শাস্ত্র ব্যাখ্যা করেন, অন্যরা গুরুর কাছে পাঠ নিয়ে সব কিছু শেখেন। কর্মফলে কেউ স্থাবর বা জঙ্গম দেহে সন্ন্যাসী, কেউ বা আততায়ী কিংবা আপনি, ব্রহ্মা হন। কোনও নারী কর্মগুণে সচ্চরিত্রা, অন্য কোনও নারী গণিকা হন (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড ৩২:৪২-৫৪)

পুরাণ ধীরে ধীরে কর্মবাদের এক বৃহৎ সৌধ নির্মাণ করে; এর ভিৎ অবশ্য খুব টলমলে জমিতে স্থাপিত, এবং পরস্পর-বিরোধিতায় ভরা, তা সত্ত্বেও কলেবরে এবং জটিলতায় কর্মবাদ ক্রমশই স্ফীতকায় হয়ে উঠছিল। মহা-পুরাণগুলির একটি, পদ্মপুরাণ-এ, একটা খুব অদ্ভুত কথা আছে: ‘(আত্মা) একাই পৃথিবীতে আসে ও বারে বারে একাই ফিরে যায়, কারণ কর্মের ফল ভোগ করতে করতে (তার এই আনাগোনা)। জীব তার কর্মের ফলে জন্মায়, কর্মের ফলেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সুখ, দুঃখ, ভয়, বিষাদ— এ সব শুধু কর্মজনিত অভিজ্ঞতা। কর্মের অবশিষ্ট দিয়ে, লোকে (পৃথিবীতে) জন্মায় এবং বারেবারে যাওয়া-আসা করে। কৃতকর্মের ফল ভাল ও মন্দ, দুই-ই অনিবার্য ভাবে ভোগ করতে হবে। …দেবত্ব, মনুষ্যত্ব, পশুপক্ষীরূপে বা তুচ্ছ প্রাণী কিংবা জড় পদার্থরূপে জন্ম— এ সবই নিজের কর্ম অনুসারইে হয়। জ্ঞান বা শক্তি দিয়ে কেউই পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফলভোগ খণ্ডন করতে পারে না।’ (ঐ ২:৮১:৪৩; ৯৪:১৩,১৫)

উদ্ধৃতিটির প্রথমাংশে, যেটা লক্ষণীয়, সেটা হল এই যে, যদিও কর্মকে এখানে জীবনের সব অবস্থার সব অভিজ্ঞতার মূল কারণ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, তথাপি এ সব অবস্থার মধ্যে এক জায়গায় যেখানে বিষ্ঠাকৃমির কথা আছে সেখানে কারণ কিন্তু কর্ম নয়, ‘দৈব দোষ’, অথচ বাক্যটির মূল ধারায় কর্ম ও কর্মফলের কথাই আছে। হঠাৎ ‘দৈবদোষকে’ এক জায়গায় টেনে আনার কোনও কারণ নেই। আসল কথাটা হচ্ছে, এ সবটার পেছনে যেন একটা অনুচ্চারিত সমীকরণ আছে— দৈবের সঙ্গে কর্মের। এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করব।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এ অবস্থানটি ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, ‘কর্তা (ফল) ভোগ করে, আত্মা ব্যক্তিগত সত্তাকে সর্বদাই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। (প্রকৃতিখণ্ড ২৫:১৬, দ্রষ্টব্য ২৬:৩০; ২৮:১০; ৩৭:১৪; ১৭; ৬০:৬৪; গণেশখণ্ড ১২:১৯; ২৭:৬২, ৬৬; ৩৮:৪৫; শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড ৬:৩০,৩১, ৩২:৪২-৫৪) এই শাস্ত্রংশগুলিতে দুটি কথা বলা হয়েছে: (১) কর্মফল এড়ানো যায় না, (২) কর্তাকেই অনিবার্যরূপে তা ভোগ করতে হয়। ‘সংসার, জন্মান্তর ও কর্মফলরূপে কার্যকারণপরম্পরা, এগুলি কিছু কিছু উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (যেমন অধিকার অদৃষ্ট, অপূর্ব, ইত্যাদি) যেগুলি জাগতিক ব্যাখ্যা ও নিরূপণে নিজে থেকে ধরা দেয় না। (হালবফাস ১৯৯ট, পৃ. ১৫২)

দেবীভাগবতপুরাণ-এ যখন সাবিত্রী যমকে প্রশ্ন করেন কোন কর্মের ফলে কোন রোগ, বিকৃতি, মানসিক অবস্থা, সাফল্য, পরজন্মের অবস্থা নির্ভর করে, তখন যম যে দীর্ঘ উত্তরটি দেন, তাতে আপাত ভাবে কর্ম ও কর্মফলের মধ্যে একটা কার্যকারণ সম্পর্ক আছে, কিন্তু প্রণিধান করে দেখলে সেটা টেকে না। (৯:২৯:১৫-৩৩) এর কিছু পরেই তো শুনি, চণ্ডাল যদি তুলসি পাতা ছোঁয়, সে সাত জন্ম ধরে শুচি থাকে, ম্লেচ্ছ গঙ্গাজল ছুঁলে পাঁচ জন্ম, বিষ্ঠাকীট শালগ্রাম শিলা ছুঁলে শত জন্ম ধরে শুচি থাকে। (৯.৩৫:৪১,৪২) এই গ্রন্থে পাপ পুণ্যের ফল দেখানো হয়েছে: বহু পুত্র, অপুত্রকতা, মৃতশিশুর জন্ম, দীর্ঘায়ু পুত্র, গুণবান, বিকৃত বা বিকলাঙ্গ পুত্র, বহু ভার্যা, বিপত্নীকতা, দৈহিক সৌন্দর্য, ধর্মপ্রাণতা, ব্যাধি, রুগ্নতা, আরোগ্য ইত্যাদি— এর শেষ হচ্ছে এই বলে, অতএব কর্ম হল সব বেদের সার বেদ। (৯:৪৬:২৯-৩১) কিছু আগে ওই গ্রন্থেই আছে, ‘কর্ম দ্বারা মানুষ পায় জন্ম, মৃত্যু, দুঃখ, ভয়, পরম দুঃখ (এ সবই কর্মের সঙ্গে সঙ্গেই আবির্ভূত ও অন্তর্হিত হয়)। দেবতারা আরও সম্মানের উচ্চলোকে আরোহণ করেন; ম্লেচ্ছ কর্মদোষে ম্লেচ্ছ হয়েই জন্মায়। মানুষ বৃক্ষ, শিলা, রাক্ষস, জন্তু, কীট ও কৃমি হয়ে জন্মায় কর্ম অনুসারে।’ (৯:২৭:১৭-২৪) আবার গরুড়পুরাণ-এ আছে, অন্যের সঙ্গে ভাগ না করে খেলে নিঃসন্তান হয়, পরশ্রীকাতর (পরজন্মে) জন্মান্ধ হয়, গ্রন্থচোরও জন্মান্ধ হয়, ফলচুরি করলে নিঃসন্তান হয়।’ (উত্তরখণ্ড ৪৪:১৪,১৫)

পূর্ব থেকে যে কর্ম জগতে থাকতে পারে, তা হল ‘সঞ্চিত’; এখন যে কর্ম করা হচ্ছে তা হল ‘ক্রিয়মাণ’, অতীতের যে কর্মের ফল এ জন্মে পাওয়া যায় তা হল ‘প্রারব্ধ’ কর্ম। প্রারব্ধ কর্ম যখন ঠিক ফলতে যাচ্ছে তখন তার পারিভাষিক নাম ‘নিষেক’; যা কিছু করা হয় তা ‘নিষেক’ দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়। ‘নিষেক দৈবনির্ধারণের চেয়ে বলবান… নিষেককে কে বাধা দিতে পারে?’ (ব্রহ্মবৈবর্ত পু. কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৪৬:৫৮, এ কথা ৯১:১ এও আছে) পূর্ব-জন্মার্জিত, ক্রিয়মাণ, ফলোন্মুখ, ইত্যাদি নানা বিভাজন করে, কর্মকে প্রায় বৈজ্ঞানিক একটা আকৃতি দিয়ে বুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার এই প্রয়াসটি কিন্তু ইষ্টসিদ্ধি করতে পারেনি, বহু পরস্পরবিরোধী তত্ত্বের সংঘাতে এর টিকে থাকা দায় হয়ে উঠেছিল বলে। নিয়তিবাদ ভারতবর্ষের উদ্ভাবন নয়, পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাগুলিতেই কোনও না কোনও রূপে এটি বর্তমান ছিল। হেলমার রিংগার্ন একটি পারসী দোহা অনুবাদ করেছেন, যার অর্থ হল ‘যে পথে ভাগ্য ঠেলে টেনে নিয়ে যায়, সেই পথ ধরে হাঁটি/নিয়তি যে পথ লিখে রেখেছে, সে পথেই সুখে হাঁটি।’ (আল লাইলা ওয়া লা ইলাহ থেকে ম্যাকনটন সম্পাদিত এবং বার্টন কর্তৃক অনুদিত, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৭৭) রিংগার্ন তাঁর স্টাডিজ ইন এরেবিয়ান ফেটালিজম-এ লিখেছেন, ‘ভাগ্যবাচক একটি সাধারণ শব্দ হল ‘হম্ম’ ও এর থেকে নিষ্পন্ন শব্দগুলি। এটি সাধারণত কর্মবাচ্যে ব্যবহৃত হয়, তাতে এইটে বোঝায় যে, সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত, নিরূপিত অথবা জুয়া খেলায় যেমন দান পড়ে তেমনই, যথেচ্ছ ভাবে কোনও মানুষের ভাগ্যে পড়েছে (প্রধানত মৃত্যু, তার দিনটি পূর্বনিরূপিত)। যা ভাগ্যে আছে বা পূর্বনির্ধারিত তা দৃঢ়, অপরিবর্তনীয়, যেন আগে থেকেই এগিয়ে ছিল… কে যে নির্ধারণ বা নিরূপণ করে তা কখনও বলা হয় না … ভাগ্যের পেয়ালা, যেন কোনও বইয়ে বা ফলকে আঁকা।’ (১৯৯৫, পৃ. ৬,৭,১৮,৪৮) আদি মধ্যযুগে পারসী মহাকাব্য ও আরবি সাহিত্যে, একেশ্বরবাদ থাকা সত্ত্বেও নিয়তিবাদের একটি স্পষ্ট ছবি পাওয়া যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে নিয়তিবাদ ছিল একটি পুরাতন বিশ্বাস; এখন আমরা জানি যে, প্রচুর প্রতিকূলতার মধ্যেও এটি টিকে ছিল। সেমিটিক একেশ্বরবাদে নিয়তির অবকাশ নেই, তবু সেখানকার সাহিত্যে নিয়তি স্পষ্ট ভাবেই কীৰ্তিত।

চিনে নিয়তিবাদপন্থী ‘মিয়েন’ যার অর্থ মিং বা ভাগ্যের সঙ্গে মিলে যায়, তা দিয়ে জীবনের সেই সব ঘটনা বোঝাত, যার ওপরে মানুষের নিজের কোনও কর্তৃত্ব থাকে না।’ (ফুং য়ু লান, ১৯৫২, পৃ. ৩) মেনশিয়াস সম্বন্ধে গ্রন্থকার বলেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, যতই শ্রীবৃদ্ধি হোক না কেন, সব নিজেদের মূলে ফিরে যায়। এই মূলে ফেরাকে বলে প্রশান্তি (চিং), যার অর্থ নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ, এবং একে বলা হয় অপরিবর্তনীয়। এই অপরিবর্তনীয়কে জানাই-ই হল জ্ঞানের উদ্ভাস।’ (ঐ পৃ. ১৮১) মোৎসু সম্বন্ধে পড়ি, ‘এখন যারা বিশ্বাস করে, নিয়তি বলে কিছু আছে, তারা বলে, যে পুরস্কার পায় ভাগ্যের হাতে তার সেই পুরস্কার পাওনা ছিল, নিজের গুণে যে সে পুরস্কার পেল তা নয়… এই স্বর্গ এবং ভাগ্য দুটোই বোঝায় মানুষের ক্ষমতার বাইরে কোনও একটা শক্তিকে।’ মেনশিয়াসের মতে, ‘মানুষ যা করেনি এমন কিছু ঘটে তখন তা স্বর্গ থেকেই হয়। এমন কিছু যখন ঘটে যা ঘটাতে মানুষ নিমিত্ত নয়, তা ভাগ্যই ঘটায়।’ (ঐ পৃ. ১২৭) চিনা সভ্যতা অতি প্রাচীন এবং যতটুকু নজির আমাদের হাতে আছে তাতে দেখি চিনে নিয়তিবাদ নগরায়ণের প্রথম পর্ব থেকেই আছে, এবং বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের প্রভাব সত্ত্বেও অব্যাহত আছে, যদিও সত্যকার শিক্ষিতদের সামাজিক স্তর তার প্রসার সংকুচিত করেছে।

প্রথম অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, প্রাচীন গ্রিস ও প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যকালীন গ্রিস নিয়তিবাদের সঙ্গে পরিচিত ছিল ও নিয়তির বিভিন্ন দিককে প্রকাশ করবার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবী উদ্ভাবন করেছিল। এই সঙ্গে বলা উচিত যে, এই বিস্তীর্ণ দেবমণ্ডলীর কয়েকজনের ওপর আঞ্চলিকতার প্রভাব চোখে পড়ে। পরে কিন্তু দেখেছি, গ্রিক দার্শনিকরা শুধু যে নিয়তিবাদী ছিলেন তাই নয়, যে দার্শনিক তত্ত্ব তাঁরা প্রচার করতেন তার দ্বারা নিয়তিবাদকে যুক্তিসিদ্ধ করে তোলবার প্রয়াস পেতেন। তাই টিমাএউসও রিপাব্লিক দুটি গ্রন্থেই ঈশ্বরেচ্ছার সঙ্গে সংগতি রেখে, নক্ষত্রদের অমোঘ শক্তিই নির্ধারণ করে জন্মান্তর-পরম্পরা। (ভিঞ্চেঞ্জো চিওফারি, ১৯৩৫, পৃ. ৩৬)

ইয়াকব নয়েসনার লেখেন, ‘একথা মনে করা কঠিন যে, মানুষ যা করে তার ফল ওই কর্মদ্বারাই নিরূপিত হয়। কিন্তু এ অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। কোনও কর্মের শক্তি ও ফল নির্ভর করে, প্রথমত, যে কাজটি করতে চায় সেই কর্তার ইচ্ছার ওপরে, যা কর্মটির (অন্তর্নিহিত) অপরাধকেও নিয়ন্ত্রণ করে। কর্মটির নিজস্ব কোনও ওজন নেই।’ (ব্রোএক, বার্ড এবং ম্যাক্সফিল্ড সম্পাদিত, ১৯৮৮, পৃ. ২৭৭)

আর মর্টন স্মিথ তাঁর জিসাস দ ম্যাজিশিয়ন গ্রন্থে লেখেন, ‘খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের যাজক শাস্ত্রজ্ঞরা গ্লস্টিকদের উল্লেখ করেন, যারা বিশ্বাস করত যে, পরিত্রাণ আসে স্রষ্টারও ওপারে ঈশ্বর সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এক জ্ঞান থেকে, আর মোজেসের বিধানে প্রকাশিত ওই মৌলিক বিধানের জ্ঞান।’ (১৯৭৬ পৃ. ৩৭) গ্রস্টিক ধর্মবিশ্বাস খ্রিস্টান ধর্মের মূল ধারার বিশ্বাস থেকে পৃথক ছিল। তারা সেই স্রষ্টা ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিল যে-স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকর্মে ব্যর্থ। তাই সৃষ্টি এত অসম্পূর্ণ। মুক্তি তাই কর্ম দিয়ে আসবে না, আসবে স্রষ্টার এই ত্রুটিপূর্ণ সৃষ্টির উপলব্ধি থেকে, মোজেসের আইনের ঊর্ধ্বে অন্য এক ঈশ্বরের উপলব্ধি থেকে। এঁদের কর্মবাদকে বর্জন করার দিকটার সঙ্গে আজীবিকদের মিল আছে এবং উপনিষদের ঋষিদের মতো এঁরাও মুক্তির ব্যাপারে জ্ঞান, ‘গ্লসিস’ বা বোধির ভূমিকায় আস্থা রাখতেন।

প্রাচীন জগতের বহু সম্প্রদায় কর্ম দিয়ে মুক্তি পাওয়া সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন। এটি নিয়তিবাদেরই ফল। মানবিক বিষয়ের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে অবিশ্বাস মানুষকে নিয়ে যায় ভাগ্যের কাছে। এটি ঈশ্বরের কাছেও নিয়ে যেতে পারত, যেমন বহুক্ষেত্রে পেরেছেও, কিন্তু অধিকাংশ প্রাচীন দেবকল্পই ‘টুখে’-ফরটুনাকে তাদের দেবমণ্ডলীতে স্থান দিয়েছে। তাই নিয়তি দেবতাদের পাশাপাশি বিরাজ করত; কখনও কখনও বিশিষ্ট নাম, রূপ ও ভূমিকায় দেবতাদের সঙ্গে বা তাঁদের অধীনে কিংবা তাঁদের ঊর্ধে কাজ করত। নিয়তি ও কর্মের ভূমিকা প্রায়ই পরস্পরের ক্ষেত্রে অতিব্যাপ্ত হয়ে পড়ত, তাদের ভেদ-রেখা অস্পষ্ট হতে হতে বিলীন হয়ে যেত। কোনও কোনও শাস্ত্রে নিয়তিকে দেবতাদের ঊর্ধে স্থান দেওয়া হয়েেেছ। অন্যান্য শাস্ত্রে বলে, যেহেতু মানুষের অভিজ্ঞতা তার কর্মপ্রসূত, তাই কর্মের প্রাধান্য সম্বন্ধে দ্বিমত থাকতে পারে না। কর্মবাদ ও নিয়তিবাদ যে শুধু পরস্পর-নিরপেক্ষ তা-ই নয়, পরস্পরবিরোধীও। তবু শাস্ত্রকাররা মাঝেমাঝেই চতুষ্কোণকে গোলকের মধ্যে ভরে দিতে চেষ্টা করে থাকেন। এবং ব্যর্থ হন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *