বেগম মহিমা – অতনু চক্রবর্তী
‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে’— কলের গানে ঘূর্ণায়মান গালার রেকর্ডে ফৈজাবাদি আখতরিবাঈয়ের এই আর্তি কাকে উদ্দেশ্য করে, কে জানে! কিন্তু তিনি যে গানে গানে অসংখ্য শ্রোতাকে দিওয়ানা করেছেন, এ ব্যাপারে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই৷ কেউ পাগল তাঁর কণ্ঠস্বরের মাদকতায়, কেউ তাঁর মাতলাহ-কলাম পেশকারীর মহিমায়, কেউ পাগল তাঁর রূপে-ছলাকলায়৷ তিনি ‘মা’ হয়ে জ্বলেছেন, অনেক ‘পরওয়ানা’কে পুড়িয়েছেন, নিজেও পুড়েছেন৷ কেউ জ্বলেছে কাছে গিয়ে, কেউ দূর থেকে৷ গজলের গূঢ় অর্থের মতো বেগম আখতারও এক রহস্য৷ একশো বছর আগে, ফৈজাবাদের গ্রামে জন্মগ্রহণ করা বিব্বি নামে মেয়েটির আখতারি হয়ে ওঠা, আখতারিবাঈজি থেকে বেগমে রূপান্তর, তাঁর রূপকথার মতো জীবনের ভাঁজে ভাঁজে রহস্য৷ যখন বহু সঙ্গীতগুণী জীবৎকালেই বিস্মৃতপ্রায়, সেখানে মৃত্যুর চার দশক পরেও তিনি সম্রাজ্ঞীর সমীহ পেয়ে চলেছেন, এটাও কম রহস্য নয়৷ শিল্পীকে তাঁর জীবনচরিতে না খোঁজবার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক বিজ্ঞজন, সেক্ষেত্রে বেগম আখতারের গান যত চর্চিত, জীবন অর্থাৎ তাঁর নির্মাণ প্রক্রিয়া সে তুলনায় অনালোচিত৷ তবে যেটুকু জানা যায়, তাঁর শৈল্পিক উত্তরণের পথটি সরলরৈখিক তো নয়ই, বরং রীতিমতো জটিল এবং দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতপূর্ণ এবং সেই যাপনের প্রভাব তাঁর গানে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত৷ শরবিদ্ধ হরিণীর আর্তনাদের মতো বেগম আখতারের গান থেকে উৎসারিত ‘হায়’, তাঁর জীবনধারার উপার্জন৷ তাঁর গানের উপভোগ্যতার পেছনে ব্যক্তিজীবনের অনুষঙ্গ জরুরি নয়, তবে জনপ্রিয়তার প্রশ্নে অপরিহার্য৷ বেগম আখতারের বিপুল চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা তাঁর জীবৎকালেরই অর্জন এবং এক্ষেত্রে তাঁর জীবনযাপন প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছে৷ পরবর্তীকালে তা পরম্পরায় তাঁর গানের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, তৈরি হয়েছে মিথ৷ জনপ্রিয়তা পাথর বা লোহা নয় যে, ফাটল বা মরচে নিয়েও থেকেই যাবে, কিন্তু ‘মিথ’ ক্ষয়ে-বিবর্ণ হয়েও অনেককাল ধরে বয়ে যায়৷ যেমন স্বদেশে রবিশঙ্কর জনপ্রিয় তাঁর সঙ্গীতের উৎকর্ষের সূত্রে, কিন্তু বিদেশে তাঁর জনপ্রিয়তার পেছনে কার্য-কারণ-ঘটনাচক্রের প্রভাব রয়েছে৷ রবিশঙ্কর যেমন রূপকথার নায়ক, রাগসঙ্গীতের সমঝদারী নেই, এমন অসংখ্য মানুষ রবিশঙ্করকে চেনেন, তাঁর সম্পর্কে অনেক খোঁজখবর রাখেন, হয়ত দেরাজে রেকর্ডও আছে দু-একখানা, তেমনই উর্দু ভাষার রসগ্রহণে অসমর্থ, চট করে বেগম আখতারের দু-একটি গজলের পঙক্তিও নির্ভুলভাবে স্মরণে আনতে পারবেন না, তেমন অনেকেই বেগম আখতার নামটির সঙ্গেও পরিচিত৷ কেউ হয়ত ‘কোয়েলিয়া’ বা ‘জোছনা করেছে আড়ি’ গানের সূত্রেই শিল্পীর অনুরাগী৷ শুধু এখন নয়, বেগম আখতার যখন বাঈজি-সম্রাজ্ঞী, লক্ষ্ণৌয়ে তাঁর কোঠা ‘আখতারি মঞ্জিলে’ যাঁরা যেতেন, তাঁদের মধ্যে কেউ গজলের রস নিতে, কেউ বাঈজি-সান্নিধ্যে বিনোদন কিনতে, কেউ সময় বা অবসাদ কাটাতে যেতেন, আর বাড়ির উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসাহী অনেকে চাতকের মতো প্রতীক্ষায় থাকতেন, উঁকিঝুঁকি দিতেন যদি একবার দেখা যায় সুন্দরী বাঈজিকে৷ জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এঁদেরও ভূমিকা রয়েছে৷
উস্তাদের পুত্রকন্যা গান গাইলে যেমন তাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়, আখতারির অবস্থান ছিল একেবারে বিপরীত পটভূমিতে৷ রইস ব্যক্তির রক্ষিতার কন্যা, যাকে জন্মদাতা সামাজিকভাবে অস্বীকার করে, তার জীবনধারণই যেখানে সমস্যা, সেখানে আখতারির গানপ্রেম ব্যতিক্রমী ছিল সন্দেহ নেই৷ আর আজ থেকে একশো বছর আগে মহিলাদের সঙ্গীতচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাও সহজেই অনুমেয়৷ আখতারি বাঈজি পরিচিতি বহন করতে রাজি হয়েছেন, তবু গান ছাড়তে রাজি হননি৷ শৈশবেই আখতারি এবং তাঁর যমজ বোনকে শত্রুতা করে কেউ বিষ খাইয়ে দিয়েছিল৷ বোন মারা গেলেও আখতারি বেঁচে উঠেছিলেন৷ প্রাণের ভয়ে মেয়েকে নিয়ে আখতারির মা মোস্তারি ভিটেমাটি ছেড়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন৷ কোনওরকমে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হলেও পরিস্থিতি সঙ্গীতশিক্ষার অনুকূল নয়, কিন্তু আখতারি গাইয়ে হওয়ার স্বপ্ন ছাড়েননি৷ সঙ্গীতের প্রতি এই প্যাশন, স্বপ্ন দেখার মন এবং উদ্দেশ্যের দৃঢ়তা নিয়ে যাবতীয় প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেছেন মা ও মেয়ে৷ জীবনভর এভাবে সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্যকে একসঙ্গে জড়িয়ে আখতারিকে এগোতে হয়েছে৷
১৭ বছর বয়সে আখতারির প্রথম আসর, শহর কলকাতায়, ২০ বছর বয়সে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড, ২৪-এ পা দেওয়ার আগেই ফৈজাবাদি আখতারিবাঈ ‘স্টার’৷ গানবাজনার তালিম যে তখনও যথেষ্ট হয়নি, জানতেন আখতারি৷ তাই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পরেও উস্তাদকে বাড়িতে রেখে শিখেছেন, নানা উস্তাদের সান্নিধ্যে পরিণত হতে চেয়েছেন৷ এখানেও রহস্য— যার একটাই উত্তর ‘প্রতিভা’৷ কী আশ্চর্য আইরনি৷ এরপর থেকে আখতারিবাঈয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী অথচ দুর্ভাগ্য এবং লাঞ্ছনা তাঁর পথ ছাড়েনি৷ রেকর্ডের গান পপুলার হওয়ার সূত্র ধরে যেমন নানা আসরে গাইতেন, তেমনই জমিদার, রইসবাড়িতে প্রচুর ডাক পেতেন আখতারিবাঈ৷ বিহারের এমনই এক দরবারে গান গাইতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন আখতারি৷ আসলে সেই রাজা শুধুই আখতারির সঙ্গীতরসে তুষ্ট হয়নি, মাঝরাতে অতিথিশালা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করে অচৈতন্য অবস্থায় ফেলে দিয়ে গেছে৷ এর ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া আখতারিকে বাধ্য হয়ে আত্মগোপনের পথ নিতে হয়েছে৷ অবৈধ সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি, তাকে নষ্ট করেননি, ফেলে পালাননি, নিজে আত্মহননের পথ খোঁজেননি, আখতারির মাকে ছলনার ঝুঁকি নিতে হয়েছে, বোনের মতো পালিত হয়েছে আখতারির কন্যা৷
এরপর রামপুরের নবাবের দরবারি শিল্পী হয়েছিলেন বেগম আখতার৷ নিন্দুকে বলত ‘হারেম’৷ নবাব বাঈয়ের গানে যেমন, রূপেও তেমনই ‘ফিদা’, বিয়ে করতে চাইলেন আখতারিকে৷ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন শিল্পী, অন্ধকার রাতে সেই রাজ্য ছেড়ে পালিয়েছিলেন৷ আখতারির বিরুদ্ধে রাজবাড়ির মূল্যবান গয়না চুরির অপবাদ দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন রামপুরের নবাব এবং তাঁর লোকজন আখতারিকে খুঁজে বের করে ধরে আনবার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিল৷
শৈশব থেকে বাবার স্নেহ পাননি, মা ছাড়া পরিবারে আর কারও ভালবাসা জোটেনি৷ ফলে আখতারি ছিলেন ভালবাসার কাঙাল, সুন্দরের প্রতি ছিল তাঁর আজন্ম মোহ৷ ভালবেসে রূপবান সঙ্গীত-অনুরাগী এক ধনীপুত্র বালির ঘর করতে গিয়েছিলেন আখতারি৷ ক’দিনেই মোহভঙ্গ হল৷ বালি বন্ধ করে দিলেন আখতারির গান গাওয়া৷ উপরন্তু নিজে খেয়ালখুশিমতো কখন কোথায় চলে যেতেন হদিশ মিলত না৷ আখতারি চলে এলেন বালির ঘর ছেড়ে৷ কিছুদিন বাদে আখতারি মঞ্জিলে বসেই খবর পেলেন সম্পত্তি নিয়ে বিবাদে বালি খুন হয়ে গেছে৷
এই ‘আখতারি মঞ্জিল’ শিল্পীর আরেক ভূষণ, তাঁর সাফল্যের বিজ্ঞপ্তি৷ সেখানে নিয়মিত মাইফেল বসাতেন আখতারিবাঈ৷ তাঁর কোঠায় গান শুনতে আসতেন নবাব-জমিদার-রইস সঙ্গীতরসিক৷ খানিকটা উদ্দেশ্যমূলক এই বাড়ির স্থান নির্বাচন, কারণ এর ঠিক উল্টোদিকেই আখতারিকে পরিত্যাগ করা জন্মদাতা সৈয়দ আসগর হুসেনের অট্টালিকা৷ অহঙ্কারী ঘোষণার মতো ‘আখতারি মঞ্জিল’ যেন বিদ্রুপ হয়ে উঠতে চেয়েছে সৈয়দের কাছে৷ সৈয়দের পুত্রও এসেছেন আখতারির কোঠায় গান শুনতে৷ এমনকি সৈয়দের সঙ্গেও দেখা হয়েছে আখতারির এক মুজরায়, কিন্তু তিনি পিতাকে পরিচয় দিতে চাননি৷
এই আখতারি মঞ্জিলেই গান শুনতে আসতেন কাঁকুলির নবাব ইসতিয়াক আহমদ আব্বাসি৷ স্ত্রীর মৃত্যুর শোক কাটাতে আখতারির মঞ্জিলে এসে আব্বাসি প্রেমে পড়েন গায়িকার৷ বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আখতারির বিয়ে সম্পর্কে মোহ কিঞ্চিৎ কেটে গেছে বলেই তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন৷ তবু আব্বাসি নিয়মিত আসতেন আখতারির গানের টানে৷ রামপুরের নবাবের পাঠানো সিপাইরা যখন আখতারির খোঁজ পেয়ে তাঁকে ধরে নিয়ে যেতে লক্ষ্ণৌয়ে তাঁর মঞ্জিলে এসে পৌঁছেছে, ঘটনাচক্রে সেদিনও এসেছিলেন আব্বাসি এবং তিনি সিপাইদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেন৷ এরপর থেকেই আখতারিও হয়ে ওঠেন আব্বাসির অনুরাগী, যার পরিণতি ৩১ বছর বয়সে আখতারিবাঈজি হয়ে গেলেন ‘বেগম’, নবাব আব্বাসির বিবি৷ বাঈজির এভাবে বেগমে রূপান্তর তাঁর বহু ভক্তকেই হতাশ করেছিল এবং শোনা যায় আখতারির প্রথম জনপ্রিয় গজল ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো’ গানের শায়র বজাহত লক্ষ্ণৌভি আখতারির বিয়ের খবরে এমনই আঘাত পেয়েছিলেন যে, উন্মাদের মতো লক্ষ্ণৌয়ের স্টেশন রোড থেকে লালবাগ বাড়ির দেওয়ালে ‘হায় আখতার’ কথা দুটি লিখে গেছেন৷ এমনই মোহিনী জাদু ছিল আখতারিবাঈয়ের গানে-আচরণে-রূপে-ঠাটবাটে, সর্বোপরি তাঁর অ্যাপ্রাোচে৷
বাঈজি থেকে বেগম হলেন, নবাববাড়ির গিন্নি মানে এলিট সমাজের সদস্য হলেন, কিন্তু এই আনন্দ ঢেকে গেল গভীর বিষাদে৷ সোনার দাঁড়ে বসে বনের পাখির মতো গান চলবে না৷ কোঠা থেকে তাকে তুলে আনা যেতে পারে, কিন্তু নবাবের বেগম বাঈজিদের মতো মুজরা করে বেড়াবে, তা হয় না৷ বন্ধ হয়ে গেল কোকিলের কুহুতান৷ ভেঙে পড়লেন বেগম৷ কারও ভাবপ্রকাশের ভাষা চলে গেলে সে কি আর বিলাসব্যসনে সুখী থাকে? তবু চেষ্টা করেছিলেন বেগম৷ নবাব মহলের ‘কোঠেওয়ালি’ বিদ্রুপ, অসহযোগিতা পেরিয়ে স্বামীর সান্নিধ্যে মা হওয়ার আগ্রহে মানিয়ে নিয়েছিলেন৷ কিন্তু পরপর আটবার গর্ভধারণ করে একটিও জীবিত শিশুর জন্ম দিতে ব্যর্থ বেগমের পৃথিবীতে আর কিছুই চাইবার রইল না৷ এরপর মারা গেলেন জীবনের পরম আশ্রয় মা৷ শোনা যায়, মায়ের কবরের জন্য খোঁড়া গর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বেগম৷ বেঁচে থাকবার আশাটুকুও তাঁর রইল না৷ শয্যায় আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকেন৷ এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তারের পরামর্শে যে-কোনও উপায়ে বেগমকে জীবনমুখী করে তুলতে নবাব মহলে ঢুকেছিল নিষিদ্ধ বস্তুটি— ‘হারমোনিয়াম’৷ ম্যাজিকের মতো কাজ হল৷ বেগম যেন হাইবারনেশন থেকে জেগে উঠলেন এবং কোকিলকণ্ঠ আবার সুর তুলল৷ এরপরেও নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে বেগম আখতার গাইতে শুরু করলেন রেডিও, গ্রামোফোন রেকর্ড, সঙ্গীত সম্মেলনে৷ অর্থাৎ স্বমহিমায় ফিরে এলেন কিংবা হয়ত আরও দ্যুতিময় মহিমা নিয়ে৷
বেগম আখতারের ৬০ বছরের ঘটনাবহুল জীবন থেকে এমন কয়েকটি টার্নিং পয়েন্ট তুলে আনা যায়, জনমানসে যার গভীর প্রভাব এবং এই সব ঘটনা বাতাসে ভেসে বেড়ানো শিমুল তুলোর মতো লেগে আছে শিল্পীর অস্তিত্ব জুড়ে৷ কিংবদন্তিদের নিয়ে চর্চায় এগুলো মাঝেমাঝেই উঁকি দেয়৷ জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী৷ লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে রূপকথা হয়ে আছে— ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো, জরা আঁখমে ভরলো পানি’৷ লতার অনন্য গায়কি গানটিকে মহিমা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এমন আবেগ জাগানো গানটির কথাকার প্রদীপ এবং তাঁকে এমন আকর্ষণীয় সুরে যিনি সাজিয়েছেন সি রামচন্দ্র, যাঁদের বিনিয়োগ ছাড়া গানটির জন্মই হত না, তাঁদের যাঁরা খোঁজ করেন না, তাঁরাও এই গানটির প্রসঙ্গে, এই গান শুনে নেহরু কেঁদে ফেলেছিলেন, সে কথাটির উল্লেখ করেন বা জানেন৷ জনপ্রিয়তার সঙ্গে এমন অনেক এলিমেন্ট জড়িয়ে থাকে৷ রবিশঙ্কর-বিলায়েত দ্বন্দ্বটি ভুলে গেলে দুজনেরই মহিমা যেন কম পড়ে, যেমন ঋত্বিক ঘটক থেকে হতাশা এবং সুরা কেড়ে নিলে৷ এসব অনুষঙ্গের কোনও যোগ নেই শিল্পরূপটির সঙ্গে, তবু এমন হয়, যেভাবে স্ক্যান্ডাল তারকাদের বাজারদর চড়িয়ে দেয়৷ আর এইসব কথামালার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রসারণ-সঙ্কোচন বা বিকৃতি হতে থাকে৷ যেমন বেগম আখতারের প্রথম দিকের কয়েকটি রেকর্ড তেমন জনপ্রিয় না হওয়ায় উদ্বিগ্ন তাঁর মা বেরিলিতে এক পিরের কাছে গিয়েছিলেন মেয়ের সৌভাগ্য কামনায়৷ সেই পির গানের খাতার যে পাতায় হাত রেখেছিলেন, সেই গানটিই ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো’, যা অবিশ্বাস্যরকম জনপ্রিয়তা পায় এবং এরপর আখতারিবাঈয়ের সমৃদ্ধি এবং খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ শ্রোতাদের কাছে বেগম আখতারের জীবনের নানা ঘটনা, তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ বাড়াতে পারে, কিন্তু শিল্পীর নির্মাণেও এইসব ঘটনাক্রমের অসীম গুরুত্ব রয়েছে৷ তাঁর জীবনের নানা পর্যায়ে প্রতিবন্ধকতা-লাঞ্ছনা বা সর্বোপরি সঙ্ঘর্ষের জীবন বেগম আখতারকে দিয়েছে ঋজুতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং প্রখর ব্যক্তিত্ব গঠনের শক্তি; উদ্দেশ্যে তিনি অবিচল থেকেছেন, আর অন্যদিকে তাঁর জীবনের লাঞ্ছনা-অবহেলা-নিগ্রহ-স্বপ্নভঙ্গের সূত্রে পাওয়া দুঃখ এবং যন্ত্রণা বা ‘দর্দ’ তিনি ঢেলে দিয়েছেন গানে৷
বেগম আখতারের ধারাবাহিক জীবন সংগ্রাম থেকে পাওয়া যায় সঙ্কল্পে অটুট, মুক্তিবাদী, বাধা তুচ্ছ করে শৈল্পিক উৎকর্ষে পৌঁছবার এক দুঃসাহসিক অভিযান, যা অনেক ক্ষেত্রেই সেদিনের প্রেক্ষিতে, বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে৷
বেগম আখতারের সঙ্গে বাঈজিকুলের একদা সম্রাজ্ঞী গহরজানের অনেক ব্যাপারেই মিল পাওয়া যায়৷ দুজনেই স্বাধীনচেতা, সাহসী; গানে যেমন, তেমনই পারফর্মার হিসেবেও নিজেদের সময় তাঁরা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী৷ দুজনেই নিজের শর্তে জীবনযাপনে প্রত্যয়ী, যা প্রবল পুরুষতন্ত্রের পটভূমিতে ব্যতিক্রমী৷ দুজনেই পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত, মাতৃকেন্দ্রিক জীবনে অভ্যস্ত৷ দুজনেই জীবনে বিচিত্র প্রতিকূলতা জয় করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন৷ দুজনেই পুরুষ শিল্পীদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে আসরের মনোযোগ কেড়ে নিতে অভ্যস্ত৷ দুজনেই কিংবদন্তি৷ দুই প্রজন্মের এই দুই দিকপালের একবারই মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল, তখন বেগম আখতারের বয়েস ৫ বছর, গহরজান কিংবদন্তি৷ ফৈজাবাদে যে স্কুলে পড়তেন আখতারি, তাদের অর্থসাহায্য দিতে গিয়েছিলেন গহরজান, তাঁকে দু’কলি গানও শুনিয়েছিলেন উত্তরকালের সম্রাজ্ঞী আখতারিবাঈ৷ আর দেখা হয়নি দুজনের, আখতারিবাঈয়ের কলকাতায় প্রথম আসরের বছর দুয়েক আগেই প্রয়াত হয়েছেন গহরজান৷
সে সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে বাঈজিদের গান গাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, তাদের অনুষ্ঠান হত আলাদা৷ বাঈজিদের সঙ্গে এক আসরে গাইতেন না ধ্রুপদ-ধামার গাইয়ে পুরুষশিল্পীরা৷ গহরজানের সূত্রেই এই প্রথা ভেঙেছিল, তিনি সে-কালের দিকপাল শিল্পীদের সঙ্গে এক মঞ্চে গাইবার সূত্রপাত করেন৷
বেগম আখতারের সময় শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের আসরে খেয়ালের পাশাপাশি ঠুমরি-দাদরা পরিবেশনে অনুমোদন ছিল, কিন্তু গজল ছিল অচ্ছুত৷ একটি সঙ্গীত সম্মেলনে গাইতে গিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা শুনে বেগম আখতার গান গাইতেই রাজি হননি বরং এই প্রথার তীব্র প্রতিবাদ করেন! আখতারির মতো জনপ্রিয় শিল্পী গাইবেন না শুনে শ্রোতাদের তীব্র ক্ষোভ দেখে উদ্যোক্তারা প্রচলিত নিয়ম ভাঙতে রাজি হলেন, বেগম আখতার গাইলেন ঠুমরি-দাদরা এবং গজল৷ শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের আসরে গজল গাইবার সূত্রপাত হয়েছিল আখতারিবাঈয়ের হাত ধরে৷ যেমন রোশন চৌকির বাদ্যযন্ত্র সানাইকে রাগসঙ্গীতের আসরে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন বিসমিল্লা খাঁ, সেভাবেই বেগম আখতার গজলকে মুশায়রা বা বাঈজির কোঠা থেকে তুলে এনেছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরে৷ এবং আশ্চর্য, উনিশশো একত্রিশে কলকাতার অ্যালফ্রেড থিয়েটারে যে সঙ্গীত সম্মেলনে, অর্থাৎ জীবনের প্রথম আসরে, বেগম আখতার গজল গেয়েছিলেন, সেই আসরেই মামা মিঞা বিলাতুর সঙ্গে সানাই হাতে উঠেছিলেন বিসমিল্লা খানও৷ সে হিসেবে অনুষ্ঠানটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে৷
আখতারিবাঈয়ের মতো গহরজানবাঈও অনুরাগের জালে জড়িয়েছেন বারংবার, কখনও বিখ্যাত উস্তাদের সঙ্গে, কখনও ধনী পৃষ্ঠপোষকের সঙ্গে নাম জড়িয়েছে তাঁর৷ বাঈসম্রাজ্ঞীর প্রেমে অনেকেই দিওয়ানা, তিনি নিজেও কখনও দুর্বলতার শিকার৷ ফল শুভ হয়নি, নিজেও পুড়েছেন, অন্যদেরও পুড়িয়েছেন৷ কিন্তু এজন্য লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি, গানের ঘরে টান পড়েনি, অন্য বাঈজিদের তো বটেই, দিকপাল পুরুষশিল্পীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এক-একটি গানের আসরে শ্রোতাদের সম্মোহিত করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছেন৷ দুজনেরই নিজেদের পেশ করার ক্ষেত্রে ‘এলিগ্যান্স’ ছিল একটি প্রধান আকর্ষণ৷ গহরজান শ্রোতাকে মুগ্ধতা দিতে ধ্রুপদ থেকে বাংলা গান এমনকি সাহেবসুবোদের বা তাদের সঙ্গিনীদের চমকিত করে ইংরেজি গানও গেয়েছেন৷ অন্যদিকে বেগম আখতারের গানের পরে আফতাব-এ-মৌসিকী কিংবদন্তি ফৈয়াজ খানও গাইতে চাইতেন না, বলতেন— ‘আখতারি আসরে বসলে তো আসরটা ওর দখলে চলে যাবে, তার আগেই আমি গেয়ে নিতে চাই৷’
গহরজানকে ‘হিম্মতয়ালি’ বলতেন সে যুগের আর এক বিখ্যাত বাঈজি মালকাজান (আগ্রাওয়ালি)৷ বাঈজিদের যেমন হীন চোখে দেখত সমাজ, সেক্ষেত্রে গহরজানের অহঙ্কারী আচরণ প্রতিবাদী মাথা উঁচু করে দাঁড়াত৷ ক্ষমতাশালী পুরুষদের আনুগত্য উপভোগ করতেন তিনি, বৌবাজারে বাড়ি কিনে নাম রেখেছিলেন ‘গহর ম্যানসন’, যেমন আখতারিবাঈয়ের লক্ষ্ণৌয়ে ছিল ‘আখতারি মঞ্জিল’৷ সেই পরাধীন দেশে কলকাতায় গোরাদের প্রবল প্রতাপের দিনে গহরজান বাঈজি, নিজে ফিটন চালিয়ে রাজপথে হাওয়া খেতেন, সচকিত হয়ে পথচারীরা দেখত সেই স্বাধীনচেতা মহিলাকে৷ গোরাদের গাড়ি এলে যেখানে জনতার পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবার কথা সেখানে গহরজানের এই বৈকালিক ভ্রমণ, অন্য ফিটনে চড়া সাহেবসুবোদেরও বিস্মিত করত সন্দেহ নেই!
বেগম আখতারও এমনই কাণ্ড করেছেন লক্ষ্ণৌয়ে৷ সময়টা পাল্টে গেছে, তাই ফিটনের বদলে এসেছে গাড়ি৷ আখতারি মঞ্জিল থেকে কোনও কোনও বিকেলে লাল রঙের স্পোর্টস কারে চেপে লক্ষ্ণৌয়ের রাজপথে হাওয়া খেতে বেরোতেন আখতারিবাঈ, দু’পাশের পথচারীরা অসীম আগ্রহে দেখত, এমনকি কাঁকুলির নবাবও এই দৃশ্য দেখে একইসঙ্গে আখতারি এবং তাঁর লাল গাড়িটির প্রেমে পড়েছিলেন৷ এই পছন্দের কথা বার্তাবাহককে দিয়ে জানিয়েছিলেন নবাব এবং সেই সঙ্গে বাঈকে বিয়ে করবার প্রস্তাব৷ আখতারি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও ড্রাইভারকে দিয়ে লাল গাড়িটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নবাবের দরজায়, এমন কাজের জন্য ‘হিম্মত’ জরুরি নিশ্চয়ই৷
একবার লক্ষ্ণৌ রেডিওতে আখতারির অনুষ্ঠান, পৌঁছতে দেরি হয়েছিল বলে সোজা স্টুডিওতে ঢুকে, তাঁর ভুবনমোহিনী হাসিটি দিয়ে সবাইকে বশ করে, ঘোষকের জন্য সময় নষ্ট না করে, ‘আমি আখতারিবাঈ ফৈজাবাদি, আপনাদের গজল শোনাচ্ছি’ বলে গান শুরু করে দিয়েছিলেন৷ এই ঘটনায় ইংরেজ ডিরেক্টর ওপরমহলে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, অপদার্থ ঘোষককে বরখাস্ত করা হোক এবং রেডিওর আইনবিরুদ্ধ কাজের জন্য বেতারে আখতারিবাঈয়ের গান নিষিদ্ধ করা হোক৷ এই ঘটনা জেনে আখতারি সোজা দিল্লি গিয়ে হাজির হলেন এবং সরাসরি ব্রডকাস্টিং ডিরেক্টরের ঘরে ঢুকে বলেছিলেন— ‘আপনারা নাকি আমার গান নিষিদ্ধ করতে চান, সে কাজটা আর কষ্ট করে করতে হবে না, আমাকেও আর বন্ধ ঘরে বসে গাইতে হবে না, এই রইল চিঠি, যাতে লেখা আছে আমাকে যেন আর রেডিওতে গান গাইতে ডাকা না হয়৷ আর একটা কথা শুনে রাখুন, রেকর্ডে আমরা নিজের নাম ঘোষণা করেই গাই, সেটাই করেছি, এ জন্য দয়া করে ঘোষকের চাকরিটা খাবেন না৷’ সাহেব এই ঝড়ের মতো কথাগুলো শুনে, হাতে চিঠি নিয়ে বিহ্বল চিত্তে দাঁড়িয়ে রইলেন, ফুরফুরে মেজাজে আখতারি বেরিয়ে গেলেন৷ এমন ব্যক্তিত্ব ছিল গজল-রানী বেগম আখতারের৷ ফলে মিলে-গরমিলে আখতারিবাঈয়ের মধ্যে, ব্যক্তিত্বময়ী আত্মমর্যাদাসম্পন্ন-স্বাধীনচেতা গহরজানের এক ধরনের অঘোষিত সমধর্মিতা গোচরে আসে! দুই যুগের দুই কিংবদন্তি এভাবেই জুড়ে থাকেন!
সঙ্গীতের রসগ্রহণে শিল্পীর নির্মাণপ্রক্রিয়া বা তাঁর জীবনের চড়াই-উৎরাই কিংবা তাঁর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য কোনও জরুরি বিষয় নয়৷ রেডিও-রেকর্ড বা প্লে-ব্যাক গাইয়েদের না চিনেই তাঁদের সঙ্গীতের রসাস্বাদন বা উজ্জীবন ঘটতে পারে৷ গানের মধ্যেই প্রকাশ পায় তাঁর ব্যক্তিত্ব, সামর্থ্য, উপলব্ধি, তা থেকেই শিল্পী বা তাঁর গান সম্পর্কে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ ঘটে! কিন্তু জনপ্রিয়তা বিষয়টির সঙ্গে প্রচার জড়িত৷ একটি অসাধারণ সিনেমার গান, দুর্বল পিকচারাইজেশনের জন্য শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হতে পারে, তুলনায় অনেক সাধারণ মানের গান পরিবেশনার মহিমায় পেয়ে যেতে পারে গুরুত্ব৷
আখতারিবাঈয়ের সমসাময়িক বহু গায়িকা অসাধারণ গান গেয়ে গেছেন, তাঁদের সঙ্গীত শ্রোতাকে উদ্বুদ্ধ করেছে, আনন্দ দিয়েছে, মুগ্ধ করেছে কিন্তু তাঁদের অনেকের কথাই পরবর্তী প্রজন্ম জানে না, বা মনে রাখেনি৷ অথচ বেগম আখতারের জনপ্রিয়তা বা মহিমা কাল পেরিয়ে স্থায়ী হয়ে গেল কীভাবে? এর উত্তর খুঁজতে গেলেই অনুষঙ্গগুলো এসে যায়৷ কারণ বেগম আখতারের জনপ্রিয়তা কোনও রিভাইভ্যালের ঘটনা নয়, বিস্মৃতপ্রায় কোনও শিল্পী পুনর্মূল্যায়নের সূত্র ধরে উঠে এসেছেন তেমনও নয়৷ তাঁর জনপ্রিয়তা জীবৎকালের অর্জন, জীবিতকালেই তিনি কিংবদন্তি, তার রেশ সময়ের ঘর্ষণে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে আজও ঈর্ষণীয় রকমের অবশিষ্ট রয়েছে৷ এই জনপ্রিয়তার রহস্য সন্ধানে অতএব অতীতচারী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই৷
বেগম আখতারের জনপ্রিয়তার সিংহভাগ এসেছে রেকর্ড এবং জলসা থেকে৷ জলসায় তাঁর এলিগ্যান্ট উপস্থিতির প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা৷ ইদানীং গানবাজনা শোনবার চেয়ে বেশি দেখবার বিষয় হয়ে উঠেছে— এমন কথা শোনা যায়৷ গান শোনবার সঙ্গে সঙ্গে দেখবার ব্যাপার চিরকালই ছিল যাত্রাগান-পাঁচালি-কবিগান-বাউল বা পাণ্ডবানিতে শোনবার সঙ্গে শিল্পীর অ্যাক্টও দেখবার বিষয় ছিল৷ কিন্তু গানটাও ছিল৷ ইদানীং অনেক গানকেই ভিস্যুয়াল গিলে নিতে চায়, উন্মাদনা-উত্তেজনা ছড়ানোর দায় নিতে হয় তাঁকে— সেখানেই পরিবর্তন ঘটেছে৷
বাঈজিদের গানেও দেখবার ব্যাপার ছিল, অনেক বাঈজিই গানের সঙ্গে নাচতেন, মুজরায় অঙ্গভঙ্গি-ঠাটঠমক-মূকাভিনয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ গহরজানও গানের সঙ্গে প্রয়োজনে নেচেছেন, বেগম আখতার অবিশ্যি সে পথে যাননি, তবে নিজেকে দ্রষ্টব্য করে তুলতে তাঁর আয়োজনের খামতি ছিল না৷
এ প্রসঙ্গে আখতারিবাঈয়ের সমসাময়িক একজন দিকপাল গায়িকার অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে— সিদ্ধেশ্বরী দেবী৷ তাঁর মতে আখতারির আদবকায়দায় নিজের প্রতি মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার বিশেষ দক্ষতা এবং ভঙ্গি ছিল৷ যৌবনে আখতারিবাঈয়ের সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন অনেকেই, ছবি দেখেও আঁচ পাওয়া যায় তাঁর গ্ল্যামারের৷ আখতারি আসরে ঢুকতেন অভিজাত আকর্ষণীয় পোশাকে, হাতে রুপোর পানদানি, গলায় ঝকমকে হার, নাকে হীরের ফুল— রাজরানীর স্টাইলে৷ ঢোকবার পথে মেহেদির নকশা করা হাত নেড়ে একে-তাকে আদাব জানাতেন, মোহিনী হাসিটি বিলোতেন, তাতেই শ্রোতাদের মাথা ঘুরে যেত৷ তাঁকে দেখেই শ্রোতাদের মধ্যে চাঞ্চল্য জাগত, তাঁকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত উদ্যোক্তারা, হোমরাচোমরারা নিজের সিট ছেড়ে আখতারিকে বসবার ব্যবস্থা করত, যার ফলে স্টেজে যিনি গান গাইছিলেন তাঁর মনঃসংযোগ নষ্ট এবং শ্রোতাদের মনোযোগ ঘুরে যাওয়ার ফলে, গানের যে প্রভাব পড়েছিল সেটি উবে যেত, শিল্পীকে আবার নতুন করে শুরু করতে হত৷ এবং এই কাজটি আখতারিবাঈ জেনেবুঝে অধিকাংশ আসরেই করতেন— বলেছিলেন সিদ্ধেশ্বরী দেবী৷ আখতারি গান শুরু করার আগেই তাঁর যুদ্ধজয় হয়ে যেত৷ স্টেজে উঠতেই দর্শকের তুমুল হর্ষধ্বনি আর হাততালি তাঁকে বরণ করে নিত, এর পরে গান তো রইলই৷ ‘গজলটা তো আখতারিবাঈয়ের মতো আর কেউ গাইতে পারেনি’— মত সিদ্ধেশ্বরী দেবীর৷
মহিলা কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে আখতারিবাঈয়ের এইসব কায়দাকানুনের জন্য অসন্তোষ ছিল, গানের ব্যাপারে কিছু নিন্দেমন্দ করা যেত না বলেই হয়ত তাঁর প্রেমতৃষ্ণা নিয়ে বিদ্রুপ করে বলা হত ‘পীরিতখোর’৷ কিন্তু দিকপাল পুরুষশিল্পীরা ছিলেন আখতারির প্রশংসায় অকৃপণ৷ কিংবদন্তি শিল্পী বড়ে গুলাম আলি খান সারেঙ্গি বাজিয়েছেন আখতারীবাঈয়ের সঙ্গে৷ বরকত আলি খান, যাঁর ঠুমরি বড়ে গুলাম আলির চেয়েও বেশি কদর করেন অনেকে, তিনি মাঝে মাঝে গজল-এর সুরও করতেন এবং গাইতেন৷ তাঁর মতে ‘আমার গজল আখতারির চেয়ে ভাল কেউ গাইতে পারে না’৷ ফৈয়াজ খান, আমির খান, রবিশঙ্করের মতো পথিকৃৎ শিল্পীরাও আখতারির প্রসঙ্গে উচ্ছ্বাসী৷ এর প্রভাব জনপ্রিয়তার ওপর পড়বে না এমন হওয়া কি সম্ভব?
আখতারিবাঈ তাঁর প্রথম রেকর্ড জনপ্রিয় হওয়ার আগে থেকেই পাবলিক ফিগার৷ অভিনেত্রী হিসেবে এই পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি৷ কলকাতায় করিন্থিয়ান থিয়েটারে ‘সীতা’ নাটকে আখতারিবাঈয়ের অভিনয় এবং গান যথেষ্ট কদর পেয়েছিল৷ সেকালে নাটকের চাহিদা ছিল যথেষ্ট, সেক্ষেত্রে আখতারি আরও কয়েকটি নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন, তবে স্টেজে বেশি চেঁচালে গলার ক্ষতি হবে ভয়ে থিয়েটার ছেড়ে দেন৷ এরপর আরও প্রভাবশালী মাধ্যম সিনেমায় আখতারিকে সক্রিয় হতে দেখা যায়৷ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যথার্থ স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই আখতারিবাঈ অন্তত সাতটি ছবিতে কাজ করে ফেলেছেন, আর তাঁর নবম ছবিটি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল৷ মেহবুব গানের ‘রোটি’ ছবিতে চন্দ্রমোহন-সিতারা দেবীর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন আখতারি৷ সে ছবিতে গ্ল্যামারাস ডার্লিং-এর চরিত্রে আখতারির প্রেজেন্স এবং অ্যাক্ট উচ্চপ্রশংসিত হয়েছিল৷ আমির খানকে সিনিয়র শিল্পী হিসেবে একটি আসরে বেগম আখতারের পরে শেষ শিল্পী হিসেবে গাইতে বলা হয়েছিল৷ আমির খান বলেছিলেন, ‘আখতারির ‘রোটি’ সিনেমার রোল আর ওঁর ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো’ রেকর্ড শুনে আমরা তরুণ বয়সে মাতামাতি করেছি৷ আমি নয়, আখতারিই সিনিয়র৷’
‘রোটি’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি অনিল বিশ্বাসের সুরে ছটি গান গেয়েছিলেন আখতারিবাঈ৷ তার মধ্যে তিনটি গান ছবিতে ছিল, বাকি গান রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছে৷ ‘ওহ হম রহে হ্যায় আহ কে লিয়ে’, ‘চার দিনো কা জওয়ানি মতওয়ালি’৷ রোটি ছবির গান খুবই পপুলার৷ তবে গাইয়ে হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠার ফলে গানের মনোযোগ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও আর সিনেমার সঙ্গে জড়াননি আখতারিবাঈ৷ ষোলো বছর পরে জীবনে আর একবারই ক্যামেরা-লাইট-অ্যাকশনের মুখোমুখি হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ ছবিতে৷ তাতে নিজের চরিত্রেই অ্যাক্ট করে, নিজের গাওয়া গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাতে হয়েছিল তাঁকে৷ ততদিনে কিংবদন্তি বেগম আখতারের জনপ্রিয়তা এবং বৈশিষ্ট্য, রইস বাড়ির মাইফেলের সিকোয়েন্সকে বিশ্বাসযোগ্য করার কাজে লাগাতে সত্যজিৎ নিয়েছিলেন আখতারিকে৷ ততদিনে বেগম হয়ে যাওয়া আখতারিবাঈ প্রথমে এই প্রস্তাবে রাজি হননি, পরে নবাবের, এক বন্ধুর সুপারিশে নবাব রাজি হন এবং বেগম গেয়েছিলেন বিলায়েৎ খানের কম্পোজিশন, পিলু দাদরা ‘ভর ভর আয়ী মোরি আঁখিয়া’৷ এই সিনেমা পর্বটি এবং সেই সূত্রে পাওয়া এক্সপোজার, বেগম আখতারের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে সাহায্য করেছে৷
ধরা যাক, এইসব বহুমাত্রিক প্রচার এবং গান মিলিয়ে তৈরি ইমেজ বা ব্র্যান্ডিং-য়ের ফলে মিথ হয়ে যাওয়া বেগম আখতারকে আমরা দেখিনি, তাঁর কথা শুনিনি-জানি না৷ আমাদের হাতে রয়েছে শুধু তাঁর গান৷ দেখা যাক সেই গানের প্রভাববিস্তারী সাধ্য কতটা এবং কোন কোন বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ, যা থেকে মোহাচ্ছন্ন হওয়ার অবকাশ জোটে৷
আকর্ষণ—এক৷ আখতারিবাঈয়ের কণ্ঠসম্পদ, সেটিই প্রথম সূত্র হতে পারে ভাল লাগবার৷ ফৈয়াজ খাঁ বলেছিলেন ‘আখতারির গলায় তো ফরিস্তা (ঈশ্বরের দূত) গান গায়’৷ অসম্ভব সুরেলা তাঁর আওয়াজ, কিন্তু পাশাপাশি গাইয়েদের থেকে অন্যরকম৷ কণ্ঠস্বরে মিশে থাকে কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ- মাধুর্য এবং স্মৃতিমেদুরতার হাতছানি৷ পূর্ণ জোয়ারিসমৃদ্ধ কণ্ঠটি ছাড়লেই সুরে ভরে ওঠে পরিবেশ৷ বলিষ্ঠ-প্রত্যয়ী স্বরপ্রয়োগ কিন্তু যেন সোচ্চার নয়, বরং একধরনের সফিস্টিকেশন ধরা পড়ে৷ সেকালে বাঈজিদের এবং মহিলা শিল্পীদের পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে, অনেকেরই যেমন মর্দানি ঢঙ প্রকাশ পেত, আখতারির কণ্ঠ সেক্ষেত্রে পরম রমণীয়৷ শুনতে শুনতে ঝিম ধরানো নেশার মতো আচ্ছন্ন করে শ্রোতাকে ক্রমশ জড়িয়ে ধরে৷ রবিশঙ্করের মতে আখতারির গলায় এক ধরনের ‘ইরোটিসিজম’ (আভিধানিক অর্থে যৌনকামনা উদ্দীপ্ত করার সামর্থ্য) আছে৷ শৃঙ্গার রসের গান ঠুমরি, প্রেমের গান গজল যাঁর ব্রত, তাঁর কণ্ঠস্বরে প্রেম এবং শৃঙ্গার রসের উপস্থিতি স্বাভাবিক৷ সব মিলিয়ে বেগম আখতারের কণ্ঠে এক ধরনের নেশা ধরে এবং শিল্পীকে স্বতন্ত্র আইডেনটিটি দেয়৷ দূর থেকে কোনও কণ্ঠ ভেসে এলে যেমন এর মতো বা তার মতো মনে হতে পারে, আখতারিবাঈয়ের কণ্ঠ একচিলতে কানে এলেই তৎক্ষণাৎ নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় এটি বেগম আখতারের কণ্ঠস্বর৷ অর্থাৎ ব্র্যান্ডেড ভয়েস৷ এছাড়া সরল মসৃণ চলনের মাঝখানে হঠাৎ গলাটা ভেঙে তিনি একটা অন্যরকম ‘এফেক্ট’ তৈরি করে ফেলতেন, যা সুন্দর মুখে একটি মানানসই তিলের মতো মাধুর্যময় হয়ে উঠত৷ সিদ্ধেশ্বরী দেবী বলেছিলেন, আমাদের আসর জমাতে কত মেহনত করতে হয়, সুর কায়েম করতে হয় যত্ন করে, অথচ আখতারির এমন গলার তাসীর (প্রসাদগুণ বা প্রভাব) যে, ও সুর লাগালেই গান জমে ওঠে৷’ এই বিষয়টা ভাষায় প্রকাশ করা শক্ত, আখতারিবাঈয়ের গান শুনলে বোঝা যায় এই বৈশিষ্ট্য৷
আকর্ষণ- দুই৷ বড়ে গুলাম আলি বলেছিলেন, ‘আখতারির গানে যে ‘দর্দ’, জীবনে আঘাত না পেলে তা আসে না৷’ অর্থাৎ জীবনের যাবতীয় দুঃখ-যন্ত্রণা-বঞ্চনা-প্রত্যাখ্যান-প্রতারণা, অবিচার-মোহভঙ্গ, সেই সব দুঃখ যা হৃদয়ের ঝিনুকে জমে ক্রমশ মুক্তো, কাঁদবার বদলে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম গানেই ঢেলে দিতেন সেইসব মুক্তো৷ এই ‘দর্দ’ আখতারিবাঈয়ের গায়কির প্রাণভোমরা৷ আমরা দুঃখ চাই না, দুঃখের গানে মগ্ন হই, দুঃখীকে সমবেদনা জানিয়ে গর্ববোধ করি৷ আখতারির গায়নভঙ্গিতে যন্ত্রণা-হতাশার নির্ভেজাল উচ্চারণ আমাদের সেই জায়গাটাতেই ঘাঁটি গেড়ে বসে৷ গজলের বাণীতে এমন উপলব্ধিরই প্রাধান্য এবং তাকে বিশ্বাসযোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা দিতে পারাটাই আখতারির গায়কির বৈশিষ্ট্য৷
গজলকে অনেকে বলে প্রেমিকের সঙ্গে আলাপ, আখতারির গায়কির মধ্যে শ্রোতাদের সঙ্গে আলাপের ভঙ্গিটাই ফুটে উঠত৷ তিনি শব্দগুলোকে ভেঙে ভেঙে সুরেলা কথনের ছাঁচে এনে ফেলতেন কখনও কখনও৷ গানটাকে একেবারে ‘পার্সোনাল লেভেলে’ নিয়ে আসতেন, যাতে শ্রোতার মনে হত যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই গানটি গাওয়া হচ্ছে৷ এই ‘আবেদন’ই বেগম আখতারের গায়কির ম্যাজিক৷ শেষ পর্যন্ত বিরহ-বিষাদ-যন্ত্রণা পেরিয়ে গানে আনন্দের উদ্ভাস ঘটত, উজ্জীবিত হতেন শ্রোতারা৷ একে রবিশঙ্কর বলেছেন ‘পজিটিভ ইনস্টিংক্ট’৷ জীবনে যতই দুর্বিপাক ঘটুক বেগম আখতারের ‘অ্যাটিচ্যুড’ ছিল জীবনমুখী৷ বিষণ্ণতার গানই মধুরতম সঙ্গীত, সেই বিষণ্ণতার মধ্যেই প্রশান্তি আনতে পারতেন আখতারিবাঈ৷ যখন ঠুমরি গাইতেন তখন বিরহীর আর্তি, আবার দাদরা গাইবার সময় চঞ্চল হরিণীর চলন এনে ফেলতেন৷
কিরানার ঘরানার ওয়াহিদ খান এবং পাতিয়ালা ঘরের আতা খানের কাছে তালিম পেয়েছেন কিন্তু এই দুই ঘরানার গায়কি প্রত্যক্ষভাবে ধরা পড়ে না আখতারিবাঈয়ের গানে৷ তিনি এর সঙ্গে বড়ে গুলাম এবং বরকত আলির গায়কি থেকে প্রভাবিত নিজস্ব একটি ঢঙ তৈরি করে নিয়েছিলেন৷ যখন ‘যব সে শ্যাম সিধার’ বা ‘আঁখিয়ন নিদ না আয়ে’ ধরনের ঠুমরি গাইতেন তখন যদিও অন্যের প্রভাব উঁকি দিত, গজলে তিনি নিজেই তৈরি করে নিয়েছিলেন অতুলনীয় এক স্টাইল এবং এক্ষেত্রে তিনি নিজেই তার তুলনা!
আকর্ষণ—কথা৷ ঠুমরি বাণীপ্রধান নয়, কিন্তু গজল প্রায় ‘কথাসর্বস্ব’৷ ফলে উর্দুভাষা অনুধাবন করতে অসমর্থ এমন কারও কাছে গজলের প্রভাব গৌণ৷ অতএব প্রাথমিকভাবে গজল পাঠ বা শায়েরির প্রতি আগ্রহী শ্রোতাই এই গীতরীতিতে আকৃষ্ট হবেন৷ তাঁদের কাছে আখতারিবাঈয়ের মোহিনীকণ্ঠে গজলের মতলাহ-শেরের আবৃত্তি নিশ্চিতভাবে অতিরিক্ত পাওনা৷ তাঁরা গালিব-মীর-মোমিন-দাগ রচিত ক্লাসিক গজলের মনোরম উপস্থাপনার অংশীদার হতে পারেন৷ কিন্তু যাঁরা শের শায়েরির সঠিক ব্যঞ্জনা, অন্তর্নিহিত ভাব বা তাৎপর্য যথার্থ উপলব্ধিতে অক্ষম তাঁরাও অনেকেই গজল শোনেন, যাঁরা বিশেষত বেগম আখতারের ভক্ত৷ তাঁরা ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে’ বা ‘অ্যায় মোহব্বত তেরে অঞ্জাম পে রোনা আয়া’, ‘ও আ-রহে হ্যায়’, ‘কভি বিমার কে দবা কে লিয়ে’, ‘দিল কি বাত কহি নাহি যাতি’, ‘দূর হ্যায় মঞ্জিল রাহেঁ মুশকিল’, ‘মেরে নসিব নে যব মুঝসে ইন্তকাম লিয়া’ কিংবা ‘মেরে হমনফস মেরে হমজওয়াঁ মুঝে দোস্ত বনকে দগা ন দে’— মাতলার এই বাক্যবন্ধের মোটামুটি অর্থ বুঝে গানের ভাবটি আঁচ করে নেন, আর যেহেতু গজলের প্রতিটি শেরই স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থ বহন করে, তার একটি-দুটি অর্থবহ হয়ে উঠলে বাকিটা সুর-ছন্দের মজা মিলিয়ে উপভোগ করেন৷ কিছু শ্রোতা বোঝাবুঝির ঊর্ধ্বে শ্রুতিমধুর গান হিসেবেই গজল শোনেন৷ তাঁদের কাছে বেগম আখতারের কণ্ঠমহিমা, স্ফূর্তিময় গায়কির আবেদনই উপভোগ্য হয়ে ওঠে৷
গজল নির্বাচন সাধারণত আখতারিবাঈ নিজেই করতেন, সেক্ষেত্রে গালিব থেকে সমকালের শায়ের যে কারও রচনা পছন্দ হলে নির্বাচন করতেন (এই কাব্যচর্চার পেছনে ইস্তিয়াক আব্বাসির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল৷ যথেষ্ট শিক্ষিত এবং পড়ুয়া নবাব বিবিকে দেশি-বিদেশি কবিতা ব্যাখ্যা করে শোনাতেন)৷ স্বভাবতই ব্যক্তিগত উপলব্ধির সমান্তরাল ভাবনা পেলে বেগম তা নির্বাচনে আগ্রহী হতেন৷ যার ফলে আখতারিবাঈয়ের অনেক গজলেই তাঁর নিজের জীবনের যন্ত্রণা-হাহাকার-অপ্রাপ্তি পাওয়া যায়৷ যেমন গালিবের একটি গজল আখতারির খুবই প্রিয় ছিল—
‘দিল হি তো হ্যায় না সঙ্গ ও খিস্ত
দর্দ সে ভরনা আঁখে কিঁউ৷
রোয়েঙ্গে হম হাজারবার
কোই হমে রুলায়গা কিঁউ ||’
(মর্মার্থ: আমার এ হৃদয় তো ইট-কাঠ বা পাথর নয়, দুঃখ পেলে ব্যথায় ভরে উঠবে কিন্তু কেউ আমাকে আঘাত দেবে কেন? হাজারবার আমি কাঁদতে পারি, কিন্তু কেউ আমাকে কাঁদাবে কেন?)
জীবনে যাদের কাছে পাওয়া আঘাত আখতারিবাঈয়ের হৃদয় রক্তাক্ত করেছে, তিনি তাদের বিশেষ কারও প্রতি অভিযোগের আঙুল তুলতে চাননি৷ সেই ভাবনাই প্রকাশ হয়েছে একটি গজলে—
”ওহ তেগ মিল গয়া, জিসসে কাতিল হুয়া থা মেরা
কিসি কে হাথ কা লেকিন নিশান নাহি মিলা”
(মর্মার্থ: যে ছুরি দিয়ে আমাকে খুন করা হয়েছে, সেই ছুরিটা পাওয়া গেছে কিন্তু তার ওপর কারও হাতের ছাপ মেলেনি৷)
জীবনের উত্তরকালে জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে এক ধরনের দার্শনিক ঔদাসীন্য এসেছিল আখতারিবাঈয়ের, সেই মানসিকতা ধরা পড়েছে তাঁর একটি গজলে—
”আপনি খুশি না আয়ে, না আপনি খুশি চলে
লায়ি হায়াৎ আয়ে কজা লে চলি চলে”
(মর্মার্থ: নিজের ইচ্ছেয় আমি আসিনি এ ধরায়, যাবারও কোনও তাগিদ নেই৷ জীবন হাত ধরে নিয়ে এসেছে— এসেছি; মৃত্যু হাত ধরে নিতে এলে চলে যাব৷)
আকর্ষণ—সুর! কোনও গানে শিল্পীর কণ্ঠস্বর এবং গায়কি, গানের লিরিক ছাড়া আর থাকে সুর৷ বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগও থাকে গানে, কিন্তু বেগম আখতারের গানে তাঁর নিজের হারমোনিয়াম এবং মুন্নে খাঁর তবলা ছাড়া অন্য বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের রেওয়াজ এবং প্রয়োজন ছিল না৷ পরের দিকে রেকর্ডে স্বরমণ্ডল, সন্তুরের আভাস মিলেছে৷ বাদ্যযন্ত্রের মতোই আখতারিবাঈয়ের গানের সুরেও বাহুল্য ছিল না৷ ছিল না চমকও৷ অতি সরল, ছিল সুরের কাঠামো, মূলত মধ্যসপ্তকেই ছিল ঘোরাফেরা, মন্দ্র বা তারসপ্তকে দু-তিনটি স্বর প্রয়োজনে জুড়ে যেত৷ সুরের এই সারল্যই তাঁর শক্তি৷ যেহেতু বাণীপ্রধান গজলে ভাষাই ভাবের মূল বাহন, ফলে সুরের আকর্ষণ-অলঙ্করণে লিরিককে ভারাক্রান্ত করে তুললে সুরের মাধুর্য হয়ত বাড়ে কিন্তু গজলের মাধুর্য এবং উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ সে কারণেই আখতারির গজলে ততদূরই সুরের বিস্তৃতি বা প্রসার, যতটা পর্যন্ত গেলে গজলের বাণী সরাসরি গিয়ে শ্রোতার হৃদয়ে ধাক্কা দিতে বাধাপ্রাপ্ত হয় না৷
প্রচলিত ছকের বাইরে নতুন কিছু করা বা গানে নতুন মাত্রা যোগ করবার আগ্রহ ছিল আখতারিবাঈয়ের ভাবনায়৷ যে জন্য উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের এলিমেন্ট নিয়েও তিনি দাদরাকে সমৃদ্ধ করেছেন৷ দাদরার ভেতরেই উর্দু বাক্যবন্ধ যোগ করে তাকে অন্য রঙ দিতে চেষ্টা করেছেন৷ ঠুমরির ক্ষেত্রে বিস্তার-অলঙ্করণে তাঁর সৃজনী-সামর্থে্যর পরিচয় রেখেছেন৷ ঠুমরির জন্য নির্দিষ্ট রাগিণীর বাইরে ভীমপলশ্রী, চন্দ্রকোষ, সারং-এর মতো রাগরাগিণীতে ঠুমরি গেয়েছেন৷ কিন্তু গজলের সুরে পরিমিতিবোধ তাঁর একটি অস্ত্র৷
আখতারিবাঈয়ের গাওয়া গজলের অধিকাংশ সুরই শিল্পীর নিজেরই সংযোজন, সেক্ষেত্রে কম্পোজারের সঙ্গে সমঝোতা কম করতে হয়েছে৷ গজল রাগরাগিণীর আধারেই বাঁধা হত এবং তাতে সুরের সৌন্দর্যের সঙ্গে বন্দিশের জোরটাও থাকত প্রথম দুটি পঙক্তি বা মাতলাহ কিংবা মুখড়ায়৷ এর পরের পাঁচটি বা সাতটি কলাম মোটামুটি একই সুরের চলন, যাতে একঘেয়েমির অবকাশ আছে কিন্তু প্রতিটি দোহা বা শেরের বক্তব্যই হয়ে উঠত মূল আকর্ষণ৷ সঠিক শব্দের ওপর ঝোঁক এবং যতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছেন আখতারিবাঈ৷ সুরের সারল্য এবং ঋজুতাই বেগম আখতারের গজলের বৈশিষ্ট্য, যাতে গজলের বক্তব্য সরাসরি শ্রোতার হৃদয়ে আঘাত করে৷ সুরে অকারণ জটিলতা এনে ওস্তাদি বা কালোয়াতি দেখানো বা রাগরাগিণীকে সোচ্চার করার কোনও প্রচেষ্টা ছিল না৷ ছোট ছোট অলঙ্কার বা হরকৎ এই কম্পোজিশনের আকর্ষণ বাড়াত৷ এভাবেই গজলের দর্দকে কাগজের অক্ষরমালা থেকে তুলে এনে সুরের ভেলা বাতাসে ভাসাতেন এবং শ্রোতারা হায় হায় করে উঠত৷ আখতারিবাঈয়ের যা তালিম ছিল তাতে একটু গিটকিরি সুর নিয়ে কিঞ্চিৎ খেলা দেখানো বা চাট্টি তান-সরগম মেরে দেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না৷ যেমন পরবর্তীকালের গজল গাইয়েদের কেউ কেউ করেছেন, তবে তাতে গজলের ওপর জাস্টিস হত না৷ শিল্পী পরিণত হলে তার টেকনিক দেখানোর বদলে গভীরতা আসে৷ যে ক’টি বাংলা গান বেগম আখতার গেয়েছেন তার অধিকাংশই তেমন কাব্যগুণসমৃদ্ধ বলা যাবে না— সুরেও তেমন বৈচিত্র্য বা জাদু আছে এমন নয়, যেমন— ‘জোছনা করেছে আড়ি, আসে না আমার বাড়ি৷’ কিন্তু শিল্পীর গায়কির মহিমায় গানগুলি অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ গানের আবেদনে সাড়া দিয়েছেন শ্রোতারা৷ নেশার মতো জড়িয়ে পড়েছে আবেশ৷
আখতারির একটি গান একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, অত্যন্ত ক্ষমতাশালী গায়ক নতুন করে গেয়েছিলেন, তাতে ভরপুর সুর ছিল, লয়ের খেলা ছিল— অসম্ভব রকমের সুরের জাল বোনা ছিল, শুনে মোহিত হতে হয় কিন্তু ‘প্রিয়াকে অভিমানে ভোলানো’র সেই আকুল আর্তিটা অত আড়ম্বরেও খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ এইখানেই বেগম আখতারের অনন্যতা৷
অবিশ্যি এইসব গুণাবলি থাকলেই একজন বেগম আখতার হয়ে ওঠা সম্ভব নয়৷ এর পরে শুরু হয় প্রতিভার নিজস্ব এলাকায় নানা সমীকরণ, যা যুক্তি বা বুদ্ধির ফিতে দিয়ে মেপে ফেলা অসম্ভব৷ সে-শক্তি খানিকটা জন্মগত, খানিকটা অর্জন— বাকিটা কার্যকারণ— সময় ও সংযোগসাপেক্ষ৷
অতিরিক্ত আকর্ষণ৷ এদেশে গজলকে গান হিসেবে সর্বসাধারণ্যে প্রচারের ব্যাপারে বেগম আখতার পাইওনিয়ার৷ এর আগে কবিতাপাঠের আসরে কবিরা গজল পাঠ করতেন আবৃত্তির ঢঙে৷ কেউ কেউ পরবর্তীকালে ছন্দের ওপর ঝোঁক দিয়ে পাঠে নাট্যগুণ সঞ্চার করতে চেয়েছেন, তাকে বলা হত ‘তহত’৷ এরপরে কেউ আবার একঘেয়ে সুরের টান দিয়ে গজল পড়তেন, তাকে বলা হত ‘তরন্নুম’৷ বাঈজিদের মুজরায় কখনওবা গজল সুরে পরিবেশিত হত৷ সেক্ষেত্রে গজলকে একটি বিশেষ গীতরীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আখতারিবাঈয়ের ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়৷ পাশাপাশি বরকত আলি খানের মতো কেউ কেউ গজল সুর করে গাইতেন৷
আখতারিবাঈয়ের রেকর্ড প্রকাশিত এবং জনপ্রিয় হওয়ার সূত্রে প্রথম জানা গেল, গজলকে গান হিসেবে বিক্রি করে লাভ করা যায় অর্থাৎ গজলের বাজার তৈরি হয়েছে আখতারির গানকে কেন্দ্র করে, ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক৷ আখতারিবাঈ এবং গজল একইসঙ্গে বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ নতুন এই নীতিরীতি, নতুন প্রজন্মের শ্রোতাকে আকর্ষণ করেছে বলেই আখতারিবাঈয়ের চাহিদা এবং বাজারদর ক্রমশ বেড়েছে, অন্যরা আগ্রহী হয়েছে এই গানে মনোযোগ এবং মেধা বিনিয়োগে৷
নাটক-গ্রামোফোন রেকর্ড এবং রেডিওর পর সেদিন সবচেয়ে প্রভাবশালী বিনোদন এবং জনসংযোগ মাধ্যম ছিল সিনেমা৷ সিনেমার গান এবং আখতারিবাঈয়ের সঙ্গীতযাত্রা প্রায় একই সময় শুরু, আর সিনেমায় প্লে-ব্যাক এবং আখতারিবাঈয়ের রেকর্ড প্রকাশও প্রায় সমসাময়িক ঘটনা৷ অনিবার্যভাবেই গজলের জনপ্রিয়তা দেখে সিনেমাও হাত বাড়িয়েছে গজলের দিকে৷ এই সূত্রে সায়গল, নুরজাহান, সুরাইয়া এবং পরবর্তীকালের জগন্ময় মিত্র, তালাত মাহমুদ, মহম্মদ রফি এবং অবশ্যই মঙ্গেশকর ভগিনীদ্বয়, সিনেমার জন্য শাকিল বদায়ুনি, মজরুহ সুলতানপুরী, শাহির লুধিয়ানভির মতো কবিদের লেখা গজল নৌশাদ থেকে মদনমোহনের সুরে গেয়েছেন৷ এক্ষেত্রেও সিনেমা আখতারিবাঈয়ের কাছে কৃতজ্ঞ৷ আখতারির বহু গানের ছায়া মেলে তৎকালীন সিনেমার গানে৷ মদনমোহন স্বীকার করেছেন, ‘আপকি নজরোমে সমঝা’ এবং এরকম আরও অনেক গান আখতারিবাঈয়ের গানের প্রেরণায় তৈরি৷ আখতারিবাঈ নিজেও একদা সিনেমায় গজল গেয়েছেন৷
অর্থাৎ আখতারিবাঈকে কেন্দ্র করে এদেশে গান হিসেবে গজলের প্রচার এবং পরোক্ষ পরম্পরা গড়ে উঠেছে৷ সায়গল, রফি, তালাত, জগমোহন সিনেমায় গজল গায়নে অগ্রপথিক, এঁদের মধ্যে অনেকেই রেকর্ডে জল গেয়েছেন, অন্যদিকে পাকিস্তানে গজলের একটি সমৃদ্ধ ধারা ধারাবাহিকভাবে এগিয়েছে মালিকা পোখরাজ, মেহদি হাসান, ফরিদা খানুম, ইকবাল বানোর এবং গোলাম আলির মতো শিল্পীদের কণ্ঠ ধরে৷ এ দুয়ের ইন্টারঅ্যাকশন ঘটার ফলে গজলে আগ্রহী হয়েছেন জগজিৎ সিং, তালাত আজিজ থেকে হরিহরণ পর্যন্ত বহু শিল্পী৷ গজল হয়ে উঠেছে একটি অন্যতম গীতিধারা৷ আখতারিবাঈয়ের প্রত্যক্ষ তালিমে শান্তি হীরানন্দ, রীতা গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী গেয়েছেন গজল৷ এই ধারায় শিপ্রা বসু বা প্রভাতী মুখোপাধ্যায়ও সক্রিয় হয়েছেন৷ এই পিরামিডের একেবারে ওপরের তলায় অবস্থান বেগম আখতারের৷ গজলের জনপ্রিয়তার যিনি উৎসমুখ, তাঁর জনপ্রিয়তার প্রশ্নটা অবান্তর৷ তিনি নিজেই গজলের শ্রোতা তৈরি করে নিয়েছেন, বাজারে নতুন গীতধারাটিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন৷
আর একটি বড় ব্যাপার, রাগরাগিণী জড়িয়ে থাকলেও গজলকে রাগসঙ্গীতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷ ফলে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসরে গজলের ছিল প্রবেশ নিষেধ৷ আখতারিবাঈ যখন দরবারি গায়িকা ছিলেন তখন অন্য উস্তাদরা তাঁর গানকে তাচ্ছিল্য করে বলতেন— ‘ছোটা চিজ’৷ আখতারির প্রভাব মেনে নিলেও তাঁকে কুলীন সমাজে গুরুত্ব দেননি৷ এই চ্যালেঞ্জটিও নিয়েছিলেন আখতারিবাঈ৷ শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের আসরে ঠুমরি-দাদরা গাওয়া গেলে গজল কেন নয়, এই দাবি নিয়ে লড়াই করে জিতেছিলেন তিনি৷ শাস্ত্রীয়সঙ্গীত সম্মেলনে ঠুমরি-দাদরার পাশাপাশি গজলও পরিবেশন করেছেন এবং সেক্ষেত্রেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন কাঙ্ক্ষিত শিল্পী৷ রাগসঙ্গীতের আসরে সব শ্রোতাই রক্ষণশীল বা সমঝদার এমন নন, ফলে শ্রোতৃমণ্ডলীর একটা বড় অংশ আখতারিবাঈয়ের গানে আকৃষ্ট হলেন, তিনি হয়ে উঠলেন শাস্ত্রীয়সঙ্গীত এবং দেশি সঙ্গীতের সংযোগকারী সেতু৷ উত্তরকালে রাগসঙ্গীতের আসরে ঠুমরি গাওয়া ক্রমশ কমিয়ে দিয়ে গজল এবং দাদরা বেশি করে গাইতেন আখতারিবাঈ৷ তাতেই আসরের মধ্যমণি হয়ে থাকতেন৷ দিকপাল শিল্পীদের স্নেহ-প্রশ্রয় এবং সমীহ আদায় করে নিতেন— এভাবেই তিনি রানী হয়েছেন— মালিকা-এ-গজল৷
এই প্রসঙ্গে একটি জলছবি— উনিশশো ছেষট্টির বালিগঞ্জ মিউজিক কনফারেন্সের মঞ্চে বেগম আখতার এলেন, শ্রোতাদের উচ্ছ্বাস-অভ্যর্থনার সুনামি উঠল৷ পরপর গান গেয়ে গেলেন, শ্রোতারা উদ্বেল৷ এরপর গানের অনুরোধ এল, শিল্পী বললেন, গানের কথা তো পুরো মনে নেই৷ শ্রোতাদের উৎসাহী আওয়াজ, ‘আমরা গানের কথা বলে দেব, আপনি গাইতে থাকুন৷’ এরপর সঙ্গীত সম্মেলনের বিরলতম ঘটনাটি ঘটল৷ শ্রোতাদের আসন থেকে একটি-দুটি লাইন উঠে আসছে, বেগম আখতার গাইছেন৷ জনপ্রিয়তা আর কাকে বলে!
আর একটি আশ্চর্য-বিস্ময়, বয়েস বেগম আখতারের কণ্ঠে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি৷ জীবনের নানা পর্যায়ের দুর্বিপাক পেরিয়ে অবাধে খানাপিনাকে প্রশ্রয় দিয়ে, গানের আগে গ্রিনরুমে ঠান্ডা পানীয়, একের পর এক ক্যাপস্টান সিগারেট জ্বালিয়েও গলার চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখেছেন কীভাবে, এই প্রশ্ন করলে বেগম আখতার, ‘গলা দিয়ে কি গান হয়, গান আসে এখান থেকে’ বলে নিজের হৃৎপিণ্ডে হাত রাখতেন৷
হৃদয়ের কারবারি বলেই হয়ত হৃদয়ে আঘাত পেয়েছেন বারবার, শরীরের ব্যাপারেও আঘাত এসেছে হৃদয়ের ওপর, দুবার হার্ট অ্যাটাকের পরে গানের টানেই চিকিৎসকের নির্দেশ না মেনে ছোটাছুটি করে গানবাজনা করে গেছেন৷ উনিশশো চুয়াত্তরের অক্টোবরে একটি আসরে প্রথাবিরুদ্ধভাবে একটি গজলের দুটি লাইনই বারবার গেয়ে চললেন—
‘মোহব্বত করনেওয়ালে কম না হোঙ্গে
তেরি মেহফিলমে লেকিন হম না হোঙ্গে৷’
সবাই অধীর পুরো গানটা শোনবার জন্য কিন্তু ওই দুটি পঙক্তি গাইতে গাইতে কেঁদে ফেললেন৷ শ্রোতাদেরও ভিজে উঠেছিল চোখ৷ এর ঠিক কুড়িদিন পরেই বেগম আখতারের জীবনের শেষ আসর৷ আমেদাবাদের সেই আসরে গান গাইতে গাইতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন গজলের বেগম, সেখান থেকে হাসপাতাল, তৃতীয় হার্ট অ্যাটাক এবং বেগম আখতারের কোকিলকণ্ঠ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল— উনিশশো চুয়াত্তরের ছাব্বিশে অক্টোবর৷ গান এবং প্রাণ প্রায় একই সঙ্গে চলে যাবার অনেক আগেই বেগম আখতার ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে নিজের নামটি পাথরে খোদাই করে দিয়েছেন, যা মলিন হলেও মুছে যাওয়া শক্ত৷ উত্তরকালের জন্য তিনি রেখে গেছেন মহার্ঘ সম্ভার৷ তাঁর জন্মের শতবর্ষ পেরোল, পেরোল মৃত্যুর চার দশক, এখনও তিনি রয়েছেন স্বমহিমায়— অনাগত দিনে উত্তরপ্রজন্ম রূপকথার গল্প শুনবে— ‘একদা হিন্দুস্থানে এক রানী ছিলেন, গজলের রানী৷ সৌন্দর্যপ্রেমিক সেই রানীর ধর্ম ছিল প্রেম, গান ছিল প্রাণ….৷