তোমার সঙ্গে জোছনা করেনি আড়ি – অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
কে যেন আমায় বলল যেখানে তুমি জন্মেছিলে তার প্রত্যন্ত ছুঁয়ে জেগেছিল মরুভূমি যার উপর দিয়ে ভারবাহী উটেদের যাওয়া-আসা ছিল অব্যাহত; তাদের কুঁজে যখন ব্যথা হত চলনভঙ্গিমা যেত বদলিয়ে৷ যন্ত্রণার ওই স্পন্দ থেকেই তো এক সময় জন্ম নিয়েছিল আরবকবিতার দু’রকম ছন্দ: সজ আর রজজ৷ ধর্মগুরু মহম্মদ এই দুই ছন্দেই গান বাঁধতেন বলে সবাই তাঁকে মূলত কবি বলেই জানত৷ কেউ বুঝতেই পারত না কান্না ছাড়া সংগীতের কোনো সত্তাই থাকে না৷
প্রথম থেকেই তোমার তানপুরায় সেই রণন বেঁধে নিয়েছিলে
বলে আমরা তোমার কাছে সহজেই পৌঁছুতে পারিনি কখনো৷
সেদিক থেকে দেখলে কতো অনায়াসেই পৌঁছে গেছি তোমার দুয়েকজন সহমন্যু শিল্পীর সকাশে৷ আন্তর্জাতিক ভারতউৎসবের বোধনবেলায় ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরে গঙ্গুবাঈ হাঙ্গলকে আনতে যেতেই তিনি আমাদের দিকে উদগ্রীব হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ স্টেজে উঠবার প্রাকমুহূর্তে তাঁর গলাটা ধরে গিয়েছিল বলে তুলসীপাতার রস মিশিয়ে তাঁকে যখন চা খেতে দিলাম তিনি সানন্দে সেই পানীয় গ্রহণ করেছিলেন৷ ভাবাসঙ্গে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল, মজলিশে নামবার আগে এক সন্ধ্যায় ঈষৎ ধূসরকণ্ঠী ছিলে বলে গ্রিন রুমে তোমায় সেই মর্মে সতর্ক করে দিতেই তুমি আমাদের সুস্নব আঙ্গিকে কেমন বকে দিয়েছিলে: ‘আরে বাপু, শুধুমাত্তর গলা দিয়েই তো গান হয় না!’
আরেকজনের কথাও এখানে বলতেই হয়: মল্লিকার্জুন মনসুর৷ একবার এলাহাবাদের সমতলে উপত্যকার গাঢ় কুয়াশা নামতেই তাঁকে গিয়ে আমরা ধরলাম, কুহেলি বিদারণের গান ধরুন৷ আর তখুনি
মল্লিকার্জুন মনসুর
যেই-না জুড়লেন তরানা
নামল শরতের রোদ্দুর
যদিও উঠবার কথা না৷
মল্লিকার্জুন মনসুর
শুধুই আশাবাদে না থেকে
গুঁজে দিলেন কিছু কুয়াশা—
সেটাও শিল্পীর ঘরানা৷
হঠাৎ মাঝপথে আমাদের
ধমকানির সুরে বললেন:
কী-আশ্চর্য যে তোমরা
বেগম আখতার শোনোনি!
২
কাছে থেকেও দূরত্বের মায়া কীর্ণ ক’রে দিয়েছ বলে কতোবার দূরে গিয়ে তোমাকে খুঁজেছি আমরা৷ তোমার এক প্রবাসী ভক্ত একবার পারস্যে সুফি কবিদের কবি মৌলানা জালালুদ্দীন রুমী-র গজলের পুঁথির অলঙ্কৃত পাণ্ডুলিপির কাছে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন: ‘এর ভিতরে বেগম সাহেবার অভিমান লুকিয়ে আছে’:
দি শেখ বা চেরাগ হামি গশত গের্দ-এ শহর
কাজ দিভ-এ দাদ মৌলাম-ও এনসান-আরেজ উস্ত ||
কাল রাত্তিরে আমাদের শেখ লণ্ঠন হাতে সারাটা শহর
মানুষের মুখ খুঁজে হয়রান, শুধুই পুরুষ-জন্তুর ভিড় ||
সেই ছবি আর কবিতা ঘিরে আমরা পুরুষেরা দরবেশের দল নির্লজ্জের মতো পুরুষানুক্রমে গোল হয়ে জুড়ে দিলাম নাচ, মনের মধ্যে একবারও খটকা জাগেনি, সেই মণ্ডলে মেয়েদের অন্তর্গত করিনি কেন৷ আজ কিছুটা বুঝে উঠতে পারি, পুরুষপ্রশাসিত প্রাচ্যের নানা বিধান তোমায় বারেবারেই ক্ষুব্ধ করে থাকবে৷ তাহলে তোমার গান কি তারই বিরুদ্ধে নান্দনিক প্রতিবাদ?
৩
এক-সিগারেট-সময় তোমার হাতে,
তারই মধ্যে গাইতে হবে গান,
সবাই জানে স্টুডিওর ভিতরে
এক্কেবারে নিষিদ্ধ ধূমপান৷
তবুও সেই নিষেধ অনায়াসে
— হে ধূমাবতী — তুমি চমৎকার
চূর্ণ করে গেয়ে উঠলে কেমন
‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার৷’
যখন আমি কবিতা সিংহকে
বলেছিলাম ওই ঘরে একখানি
কবিতা পড়ে শোনাব, তৎক্ষণাৎ
চমকে উঠেছিল আকাশবাণী!
৪
বয়ঃসন্ধির এক হেমন্তেই নাকি তোমার ওস্তাদ জনসমক্ষে তোমায় প্রথম গান গাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন৷ যদ্দূর জানি, প্রাচীন ভারতবর্ষে অগ্রহায়ণ ছিল নববর্ষের অন্য আরেক নাম: নতুন ধান উঠত গোলায়, ঘরে ঘরে খড়মাটির পুনর্ণব প্রলেপ পড়ত৷ তুমি গেয়ে উঠলে মালকোষ, সাপুড়েদের ঝাঁপির গহ্বর থেকে ঝামরে-পড়া রহস্যরাগিণী৷ মনে রাখতে হবে, হেমন্তকালে পথঘাট যখন ভ্রমণের উপযোগী হয়ে আসত, সাপুড়েরা ওই সুরের ফেরিঅলা হয়েই গেরস্তদের কাছ থেকে রাতারাতি দু-পয়সা কামিয়ে নিত৷ তোমার গাওয়া মালবকৌশিক কিন্তু আশাভরসার পরপারে নিয়ে গিয়ে সঙ্গহীন মহারহস্যের মুখোমুখি উৎসর্গ ক’রে দেয় বিরহী প্রেমিককে৷ তাই তো তোমার গান পণ্য হয়ে উঠল না আজও৷
ষাটের দশকের শেষদিকে ম্যাক্সমুলার ভবনে অধ্যক্ষ গেয়র্গ লেশনার আয়োজিত বিশ্বসংগীত সংক্রান্ত একটি সেমিনারে তোমার প্রক্সি দিয়ে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ — তুমি সেদিন কোনো অতীন্দ্রিয় অছিলায় আসতে পারোনি — তাঁরই লেখা আর সুর-দেওয়া গান শুনিয়ে আমাদের অভিভূত ক’রে দিয়েছিলেন: ‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার/… প্রিয় বুঝি তোর ওরে পাখি/ মোর মতো তোরে দিল ফাঁকি/ তাই ফিরে তুই ডাকি ডাকি/ প্রাণ কাঁদাস দুখিনী রাধার৷’
পরিশেষে জ্ঞানপ্রকাশ বললেন, আমাদের মার্গসংগীতে শ্রীরাধার বিপ্রলম্ভ বেগম আখতারের কণ্ঠেই একালের নারীর স্বাধিকারের উপযোগী হয়ে উঠতে পেরেছে৷ তখন আমার চোখের উপর ভাসতে থাকল একটি দৃশ্য: কৃষ্ণপট নিয়ে তুমি ভ্রাম্যমাণ, নিজের অনর্পিত আত্মার আভিজাত্য অক্ষুণ্ণ রেখেই…
আছিল ঘন নীল ছায়াবীথিকাতল,
কদম্বের হাতছানি,
লুপ্ত হলো যেই কৃষ্ণ করলেন
মথুরাকেই রাজধানী৷
রাধিকা তবু নয় ছেড়ে দেবার
পাত্রী এতটুকু, তাই
রূপের ডালি হয়ে ঘুরে বেড়ায়
চড়াই আর উৎরাই—
বলা বাহুল্য তাকে কিনে নেওয়ার
খরিদ্দার নেই কম,
লখনো থেকে আসে সরগরম
সমঝদার হরদম৷
আজ যেখানে কিনা সাউথ সিটি মল
বেধেছে ভারি যানজট,
রাধিকা সেইখানে এসে বিলোয়
স্ব-আঁকা কৃষ্ণের পট;
ভীষণ কাছে গিয়ে দেখেছি অকপট
রাধার ভালোবাসাকেই,
নারীর হাতে আছে দ্বৈত প্রেম,
পুরুষ গেলে ক্ষতি নেই৷
৫
নমো নমো তোমার আবহমান বিষাদযোগ যা কিনা আরোগ্যেরই আরেক নাম৷ রবীন্দ্রসংগীতও কি সব সময় আমাদের সকল সংকটের গ্লানি ধুয়ে মুছে দিতে পারে? এই তো সেদিন আমাদের আদরের নবনীতা— আজন্ম রবীন্দ্রসংগীতেই পরিস্নাত — যখন দুরূহ অসুখে পড়ল, ডেকে পাঠাল আমার আরেক নিবিড় প্রিয়জন বিদিশাকে, যে কিনা স্বয়ং আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের আশ্রমিক ঘরানায় দীক্ষিত৷ বিদিশা সরাসরি নবনীতার ভিতরঘরে ঢুকে গিয়েই গণগুঞ্জনের তারাসপ্তকে গেয়ে উঠল তোমার:
জোছনা করেছে আড়ি,
আসেনা আমার বাড়ি,
গলি দিয়ে চলে যায়,
লুটিয়ে রুপোলি শাড়ি৷
নবনীতা সেরে উঠল৷ না, জ্যোৎস্নার সঙ্গে তোমার কোনো মনান্তর হয়নি, হতেই পারে না৷