বেগম আখতার: এক বিস্ময় – জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়

বেগম আখতার: এক বিস্ময় – জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়

অনেক দুষ্প্রাপ্য গুণ একসঙ্গে পাওয়ার নাম বেগম আখতার৷ তাঁর গানের পরতে পরতে মেলে বৈশিষ্ট্য, মেলে তুলনাহীনতা৷ গানের কথাগুলো যেন শিল্পীর বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে৷ যাঁরা গান করেন, তাঁদের পক্ষে এ এক নিরন্তর শিক্ষার বিষয়৷ উদাহরণ খুঁজে বেড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই৷ রসিক শোতৃমণ্ডলী তাঁর গান শুনতে বসলেই এই পরম সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন৷ যদি বাধ্য হয়েই বলতে হয়, তাহলে একটা উদাহরণ পেশ করি৷ ওঁর গাওয়া একটা বিখ্যাত গজল-এর প্রথম লাইন—’অ্যায় মোহাব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া’৷ এই ‘রোনা’ কথাটি বেগম আখতার এমনভাবে বলেন, যে অনেক কান্না ঝরে পড়ে৷ ওঁর গানের কথা বলার মধ্যেই একটা অন্তহীন cry লুকিয়ে রয়েছে৷

দরাজ গলা, যাকে Full throat বলা হয়, তার উজ্জ্বল ও অবাক উদাহরণ বেগম আখতার৷ Range খুব বেশি নয়— এ ধরনের ভরাট কণ্ঠস্বরে তা সাধারণত হয় না বলেই মনে হয়৷ কিন্তু ওই যে স্বর সমান ওজনে বলে, তার মধ্যেও উচ্চারণের গুণে এবং বক্তব্যকে সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়ার মুনশিয়ানায় অপূর্ব এক সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়৷ শুধু গজল নয়, ওঁর গাওয়া যে-কোনও গানেই এই অলৌকিক পরিবেশ তৈরি হয়৷ সেই বিখ্যত দাদরা— ‘কোয়েলিয়া মত কর পুকার৷ করেজোয়া লাগে কটার’— ‘কোকিল তুই আর ডাকিস না, তোর ডাক শুনে আমার কলিজায় যেন কাটারির ঘা পড়ে৷’ যেভাবে উনি ‘করেজোয়া লাগে কটার’ বলেন তাতে মনে হয় কলিজা সত্যিই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে৷

দুই

কণ্ঠস্বরের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, উনি আশ্চর্যজনকভাবে একক৷ কারও কণ্ঠস্বরের সঙ্গে ওঁর কণ্ঠের বিন্দুমাত্র মিল নেই৷ কোনও Modulation-এর ওপর নির্ভরশীল নয়৷ এবং এটা তখনই সম্ভব, যখন কণ্ঠের আওয়াজের মধ্যেই বুকের ভেতরের অনুভবদীপ্ত সুর এসে জায়গা করে নেয়৷

সুরের বিস্তারের প্রসঙ্গে বলা যায়, যেটা expected সেটাকে সরিয়েই উনি যেন বিস্তারের খেলা খেলছেন৷ সূক্ষ্ম কাজগুলোর পরিচ্ছন্নতা সেই বিস্তারকে আরও বর্ণময় করে তোলে৷ গজল-এ বিস্তার করতে করতে যখন অন্তরার শেষ লাইনে, অর্থাৎ—— লাইনে মুখড়ার সঙ্গে মিলের কথাটি বলার মধ্যে যে মজাটুকু আছে, তা অনবদ্য ভঙ্গিতে বলার গুণে শ্রোতারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরব তারিফ করে ওঠেন, সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী নিজেও যেন ওই মজাটুকুতে মজে যান৷

বিস্তার প্রসঙ্গে আরও কিছু বলার প্রয়োজন আছে৷ বিস্তারে গানের কাজগুলো এতটাই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও দ্যুতিময় যে শুনলেই মোটামুটি বোঝা যায় কী পরিমাণ অধ্যবসায় ও সুরবোধ থাকলে তবেই তা করা সম্ভব৷ বিস্তারে কোনটির পর কোনটি তা সাজানোতেই সমগ্রভাবে বিস্তারের রূপ নির্ভর করে৷ এই যে বিস্তারের অঙ্গগুলো সাজানো, তা বিশেষ শ্রেণীর সঙ্গীতবোধ এবং রূপকল্পজ্ঞান না থাকলে কখনও করা সম্ভব নয়৷

এখানে আবার একটা বিশেষ কথাও বলে নিতে হয়৷ যথেষ্ট সুরবোধ আর অধ্যবসায় থাকলে নিশ্চয়ই একজন ভাল মানের শিল্পী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে৷ সেইসব যোগ্যতা নিয়েও কিন্তু বেগম আখতার হওয়া যায় না৷ তিনি সম্পূর্ণভাবে একক এবং অবশ্যই নিরন্তর গবেষণার বিষয়৷

তার সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্যে কেমন যেন একটা casual approach আছে৷ গান গাওয়ার সময় মুখড়ায় ফিরতে লাইনের শেষ পর্যন্ত না বলে থেমে যান৷ কিন্তু তাতে গানটি মর্যাদাহীন হয় না মোটেই৷ কেন না সেই লাইনটা শ্রোতা তো আগেই শুনে নিয়েছেন৷ কিন্তু ওই যে শেষ না করার মধ্যেই casual ভাবটা রয়েছে৷ যেন সামনে বসা কোনও শ্রোতাকে আগেই বলা কথাটা শিল্পী আবার বলছেন৷ কোনও অনুষ্ঠান বা Recording নয়৷ আবার এরপর যখন গানে আসছেন তখনই মনে হয় কেমন একটা নতুন কিছুর তোড়জোড় হচ্ছে৷ যে কথাটা বলতে চাইছি, তা হল আগে থেকেই prepared হয়ে কিছু করছেন এমন মনেই হয় না৷ যখন যা খুশি করছেন৷ এ জিনিস মুখস্থ বলার নয়, আপন খেয়াল-খুশি মতো বলা৷ পরিবেশনার স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর গানকে আরও বেশি সজীব করে তোলে৷

বিস্ময়েরও যেন কোনও শেষ নেই৷ গানে তালও যেন ওঁর খেলার বস্তু৷ উনি তালের সঙ্গে সঙ্গে যেতে বাধ্য নন, তালই যেন ওঁকে অনুসরণ করছে৷ আরও সহজ করে বললে আসল কথাটাই বলে ফেলতে হয়৷ তালকে গুলে খেয়ে না নিলে এই হৃদয়হরণ খেলা খেলাই সম্ভব নয়৷ এই লেখার গোড়াতে গানের ‘কথা’ বলার কথা বলেছিলাম, সেই প্রসঙ্গ আবার এসে পড়ছে৷ হৃদয় নিংড়ে যে কথাগুলো উনি শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, সেখানে তাল যে কোনও বাধাই হতে পারে না, বরং ওই মজাটুকু ধরে রাখতেই তাল সাহায্য করছে তা রসিক শ্রোতারা ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন৷ আরও একবার একই সত্য উচ্চারণ করতে হয়— অসাধারণ সাঙ্গীতিক বোধ না থাকলে এই শিল্প নির্মিত হয় না৷

সত্যি বলতে কি উনি ঠুমরি, দাদরা ও গজলের ক্ষেত্রে যেভাবে গানের কথাগুলো উচ্চারণ করেন, তাতে মনে হয় উনি যেন আন্তরিক ভঙ্গিতে বোঝাতে চাইছেন— সুর ও তালের কথায় পরে আসছি, আগে গানের কথাটা তো শোনো৷ সেই অসাধারণ উচ্চারণ সরাসরি শ্রোতার বুকের ভেতরে পৌঁছে যায়৷ সঙ্গে থাকে ওই বিস্ময়কর সুরেলা আওয়াজ এবং অপূর্ব গায়নভঙ্গি৷ সব মিলে গানটিকেই অকল্পনীয় উচ্চতায় পৌঁছে দেয়৷

লেখা শেষ করব ওঁর সম্পর্কে একটা শোনা কাহিনী শুনিয়ে৷ এলাহাবাদ সঙ্গীত সম্মেলন৷ অনেক বিখ্যাত, গুণী শিল্পীর মধ্যে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান, উস্তাদ আমির খানের মতো শিল্পীরাও আছেন৷ তখনকার দিনের Musical conferance-এ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাঝে Break-এ Semi-Classical গানও পরিবেশিত হত৷ শচীন দেববর্মণও এই ধরনের Break-এ গান গেয়েছেন৷ সেবারের সেই কনফারেন্সে বেগম আখতারকেও গাইবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে ওই স্তরের বড় বড় শিল্পীর সমাবেশ দেখে বেগম খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছেন৷ এইরকমও নাকি ভেবেছিলেন— কী কুক্ষণে এখানে এলাম৷ এখন কী হবে? এখানে আমার গান কে শুনবে? এইরকম ভাবনায় বেগমের দু’চোখ জলে ভরে গেল৷ ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে একবার ওর কাছে, একবার তার পায়ে পড়ে অব্যাহতি চাইছিলেন৷ রীতিমতো কান্নাকাটি করছেন৷ উস্তাদরা ওঁকে অভয় দিচ্ছেন, সাহসও জোগাচ্ছেন৷ কিন্তু বেগমের কান্না যেন আর থামে না৷

এদিকে, যথাসময়ে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়ে গেছে৷ প্রায় কাঁদতে কাঁদতেই স্টেজে উঠে, বসে প্রায় মরিয়া ভঙ্গিতেই গাইতে শুরু করলেন— ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো দিওয়ানা বানা দে’৷ ব্যস! সেই পাগল করা আওয়াজ, সেই বিস্ময়কর গায়নভঙ্গি৷ শ্রোতারা যেন মন্ত্রমুগ্ধ৷ গানটা শেষ হতে হাততালি আর থামে না৷ কিছুক্ষণের বিরতিতে নয়, সেদিন নাকি সেই আসরেই তাঁকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা গাইতে হয়েছিল, আর সেখান থেকেই এই অসাধারণ শিল্পীর পথ চলার শুরু৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *