বেগম আখতার এবং তাঁর সমকালীন শিল্পী ও উর্দু কবিদের প্রসঙ্গে – এস কালিদাস

বেগম আখতার এবং তাঁর সমকালীন শিল্পী ও উর্দু কবিদের প্রসঙ্গে – এস কালিদাস

কী করে, ঠিক কোন ভাষায় বেগম আখতারকে তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের সঙ্গে তুলনা করা যায়? বিশেষ করে সিদ্ধেশ্বরী দেবী বা রসুলন বাঈয়ের কথা যদি মনে পড়ে? একথা ঠিক তাঁদের সঙ্গে বেগম আখতারের গায়নভঙ্গিরও কিছু মিল আছে৷ এটাও সত্যি যে তাঁরা প্রায় একই ধরনের সামাজিক-সংস্কৃতি থেকে গানবাজনার জগতে এসেছিলেন৷ গানও গাইতেন প্রায় একই ধরনের লঘু-উচ্চাঙ্গসঙ্গীত৷ অর্থাৎ ঠুমরি, কাজরি, চৈতি, দাদরা এবং গজল৷ তবে এটাও মনে রাখতে হবে সিদ্ধেশ্বরী ও রসুলন গজল বিশেষ গাইতেন না৷ সেই দিক থেকে গজলই ছিল বেগমের নিজস্ব দক্ষতার আসল ক্ষেত্র৷ বেগমের স্বামী আব্বাসি সাহেব তাঁর প্রতিভাময়ী স্ত্রীর গানের ভুবনে, বিশেষ করে গজলের জন্য উপযুক্ত গানের কথা নির্বাচনের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ তিনি তাঁর শিক্ষাদীপ্ত যোগ্যতায় উচ্চমানের উর্দু কবিতার নির্বাচনে বেগমকে সাহায্য করতেন৷ বেগম তাঁর সহজ-সুন্দর শিল্পীর আচরণে উর্দু ভাষার কবি ও লেখকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন৷ শীলা ধর একদা এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন— ‘বেগম আখতারকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছিল তাঁর নিজস্ব সাঙ্গীতিক মেজাজ৷ এবং এই কথাটা বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ি নয়৷’ নিজের বক্তব্যের সমর্থনে শীলা আরও বলেছিলেন— ‘সঙ্গীতশিল্পীরা নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন এবং স্বয়ং সিদ্ধেশ্বরীজি এই সত্য নিজেও জানতেন যে, বেগম আখতার ছোট্ট সময়ের পরিসরেও এক অসাধারণ সাঙ্গীতিক জাদু দেখাতে পারতেন৷ বেগমের গান সরল সৌন্দর্যের এক তুলনাহীন উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করত৷ শ্রোতাদের সামনে বেগম এই অসাধারণ প্রাণবন্ত সঙ্গীত অনায়াসে পরিবেশন করতেন৷’

সিদ্ধেশ্বরী দেবী ও রসুলন বাঈ—এই দুজনের মধ্যে আখতারির সঙ্গে রসুলনের সখ্য ছিল গভীরতর৷ রসুলন আখতারির সঙ্গে কয়েকবার লক্ষ্ণৌতে বসবাসও করেছিলেন৷ অন্যদিকে সিদ্ধেশ্বরী দেবী, যাঁকে সহজ স্বীকৃতিতে ‘কুইন অফ বেনারস’ বলা যায়, তিনি প্রকৃত অর্থেই অনেক বেশি তালিম পেয়েছিলেন৷ শুধু তা-ই নয়, তাঁর গানের নিবেদনভঙ্গিও ছিল অনেক বেশি সিরিয়াস৷ তাঁর গান শুনলেই বোঝা যেত তিনি উত্তর ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের ব্যাকরণগত দিকটা সম্পর্কেও অধিকতর পারদর্শী৷ বেগম ও সিদ্ধেশ্বরীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাও সেই সময়ের এক স্বীকৃত লড়াই ছিল৷ বস্তুত, একথাও বলা যায়, বেগম আখতার ও সিদ্ধেশ্বরী দেবী—দুজনে যেন লঘু উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের মধ্যে পুরব অঙ্গের গায়কির দুই পৃথক মেরু৷ এ প্রসঙ্গেও শীলা ধরের মন্তব্য মেনে নিতেই হয়— ‘রসুলন হচ্ছে একেবারে প্রাচীন মদ্যর মতো, একই সঙ্গে মসৃণ ও গভীর সৌন্দর্যের আধার৷ অন্যদিকে সিদ্ধেশ্বরী যেন স্বর্গের পাখি, যে প্রবল আবেগ ও অফুরন্ত উদ্যমে স্বর্গের দিকেই উড়ে চলেছে৷ তুলনায় বেগম আখতারের সাঙ্গীতিক নিবেদনের কৌশল অনেক সূক্ষ্ম৷ তাঁর গানের নিয়ন্ত্রণ সর্বদাই এক আভিজাত্যের প্রকাশ৷’

সেলিম কিদওয়াই একদা আমাদের বেগম আখতারের সঙ্গে তাঁর সময়ের বিখ্যাত উর্দু কবি জিগর মোরাদাবাদী বা শাকিল বাদায়ুনি (যাঁদের কবিতা তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের হৃদয়স্থিত আনন্দ-বেদনার গজল হিসেবে পরিবেশন করতেন) সম্পর্কে উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়েছিলেন৷ আমরা সকলেই জানি, গীতিকার বেহজাদ তো প্রায় বেগমের সভাকবির মতো স্বীকৃতি পেয়েছিলেন৷ জনপ্রিয়তার প্রশ্নে বেগম আখতারের সবচেয়ে বিখ্যাত গজল— ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে’ শুনে মনে হয় গানটা বিশেষ ভাবনায় তাঁর জন্যই লেখা৷ সেলিম জানিয়েছিলেন, একদিন আমি তাঁর সঙ্গে ফিরাক গোরখপুরীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম৷ তিনি দিল্লির পাহাড়গঞ্জ এলাকায় একটা ছোট্ট হোটেলে থাকতেন৷ বেগম তার আগের রাতে তাঁর লেখা গজল একটা মেহফিল-এ পরিবেশন করেছিলেন এবং তারই রেকর্ডিং গোরখপুরীর জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন৷ একই সঙ্গে বেগম আখতার কাইফি আজমিরও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন৷ দুজনের মধ্যে যথেষ্টই কৌতুক-পরিহাসের সম্পর্ক ছিল৷ এঁরা ছাড়া আরও অনেক উর্দু কবি ছিলেন যাঁরা সেই আমলে কেবল বেগম আখতারের জন্য কবিতা লিখেই পরিচিতি পেয়েছিলেন৷’

কথায় কথায় সেলিম কিদওয়াই বেগমের মানসিকতা নিয়ে আরও বলেছিলেন— ‘একজন কবির খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার প্রত্যক্ষ নির্মাতা হিসেবে তিনি কি কখনও দম্ভ করতেন? কখনও না৷ তাঁর চরিত্রে কোনওরকম দাম্ভিকতার ছোঁয়া মাত্র ছিল না৷ যদি তাঁর মনে গর্ব বা অহঙ্কার থেকেও থাকে, তিনি কক্ষনো তা প্রকাশ করেননি৷ কিন্তু এটাও সত্যি কথা, যদি স্বয়ং বেগম আখতার কোনও কবির কবিতা গজল হিসেবে পরিবেশন করেন তাহলে সেই কবির আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?’

একজন অপরিচিত প্রেমিকের শোকের কবিতা

ভালবাসা সত্যিই বাঁচায় এবং মারে৷ অসহায় হাসমত ভালবেসে মরার এটা আরও একটা উদাহরণ৷ শোনা যায় অবিন্যস্ত আলুথালু চুলের এই ভবঘুরে ভালবাসাপাগল নাকি একদা অযোধ্যার এক প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তান ছিল৷ ঠিক কোথা থেকে, কবে এই হাসমত লক্ষ্ণৌ এসেছিল তা কেউই ঠিকঠাক জানেন না৷ যখন হাসমত এই দুনিয়ার বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বাভাবিক জ্ঞানের অধিকারী ছিল, তখন সেই পুরনো লক্ষ্ণৌয়ের রাস্তায় লেবু, রসুন, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা ইত্যাদি বিক্রি করত৷ এবং সেগুলো কোনও সাধারণ লঙ্কা, লেবু, পেঁয়াজ নয়, কারণ সেই হাসমত নাকি পুরনো লক্ষ্ণৌয়ের রাস্তায় গানের গলায় চেঁচিয়ে ফেরি করত— ‘আখতারি কী বাগকে নিম্বু লে লো, আখতারি কী বাগকে রসুন লে লো৷’ খুব স্বাভাবিকভাবে এই প্রায়-পাগলের খবর বেগম আখতারের কানেও পৌঁছেছিল৷ তিনি একই সঙ্গে মজাও পেতেন আবার বিভ্রান্তও হতেন৷ কারণ এটা তাঁর প্রত্যাশার বাইরে ছিল৷ কিন্তু বেগম আখতারের ব্যারিস্টার স্বামী তখন লক্ষ্ণৌয়ের একজন প্রতিষ্ঠিত, অভিজাত ব্যক্তিত্ব৷ তিনি হাসমত-এর এই আচরণে স্বাভাবিকভাবে হতচকিত ও অপদস্থ হয়েছিলেন৷ তাঁর নির্দেশে বাজারের গুন্ডারা নাকি হাসমত-কে কয়েকবার মারধরও করেছিল৷ কিন্তু যে-পৃথিবী মনের, ভালবাসার, সেখানে সম্পূর্ণ নিবেদিতপ্রাণ হাসমতকে কে থামাবে! সে তার নিজের মতোই একই মেজাজে তার কাজ করত৷ নিজের মেজাজে নিষ্কাম প্রেমিক হিসেবে সে বেগম আখতারের মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্বের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিল৷

১৯৭৪-এর ৩০ অক্টোবরের রাতে বেগম আখতারের দূর আমেদাবাদে ঘটে যাওয়া আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ হাসমত জেনেছিল অল ইন্ডিয়া রেডিওর খবরে৷ এবং সেই মুহূর্তেই তার চারপাশের নিজস্ব বাস্তবিক জগতে এক প্রবল আলোড়ন শুরু হয় এবং সে তৎক্ষণাৎ স্নায়বিক অসুস্থতায় ভুগতে আরম্ভ করে৷ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েক টুকরো কাঠকয়লা জোগাড় করে রাস্তায় বড় বড় অক্ষরে লিখতে শুরু করে ‘হায়! আখতারি!’ সে পুরনো লক্ষ্ণৌ-এর রাস্তার পথচারীবৃন্দ সেই লেখা অবাক হয়ে দেখতে থাকেন৷ হাসমত যখন চৌক (একদা যেখানে লক্ষ্ণৌ-এর গণিকারা থাকতেন) এলাকায় নেশাগ্রস্ত মাতালের পদচারণায় ঘুরছিল, তখন তার উচ্চকণ্ঠের আওয়াজে কবি বেহজাদ-এর সেই বিখ্যাত রচনা শোনা যাচ্ছিল—

দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে,
বরনা কাঁহি কিসমৎ তুমহে মুঝ সা না বানা দে
অ্যায় দেখনা ওয়ালো মুঝসে হাঁস হাঁসকে না দেখো,
তুমকো ভি মুহাব্বত কাঁহি মুঝ সা বনা দে,
হামারি আতারিয়া পে আও সাঁবিরিয়া,
দেখা-দেখি বালম হুই যায়ে৷

পথচারীদের হয়ত মনে হচ্ছিল গানের এই পঙক্তিগুলো স্বয়ং আখতারি এসে হাসমতের মনের কানে বলে যাচ্ছেন৷ হাসমত সেই এলোমেলো পদক্ষেপে যখন দোদুল্যমান জুঁই আর গোলাপের ‘গজরা’ পেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন সেই রাতের আঁধারে আখতারির গজলের অন্য এক পঙক্তি হাসমতের গলায় বেজে উঠল—

‘রাজাজি সোওতান কে লম্বে লম্বে বাল,
উলঝ মাৎ জানা হো রাজাজি’

অনেক পরে, গভীর রাতের স্তব্ধ প্রহরে হাসমতকে পথের ধারের একটা পরিত্যক্ত হাভেলির নড়বড়ে সিঁড়িতে উঠতে দেখা গিয়েছিল৷ সেখানেই নাকি এক ধরনের প্রহরীর কাজও করত৷ তার সঙ্গেই সেখানে শুয়ে থাকত একটা ছাগল৷ পরবর্তী ইদের জন্য সে ক্রমাগত মোটা হচ্ছিল৷ হাসমত তার কানেও একটা দাদরা শুনিয়ে দিল— ‘বহুৎ দিন বিতে সাইয়াঁ কো দেখে’৷ এবং পরের দিন থেকে লক্ষ্ণৌতে আর কেউ কখনও হাসমত-এর গলা শুনতে পায়নি৷

কিছু নিজস্ব পছন্দ

ঠুমরি

ননদিয়া কাহে মারে বোল

রাগ খামাজ-এর ওপর নির্মিত এটা এক পুরনো, প্রচলিত ঠুমরি৷ বেগম আখতার পুরব অঙ্গের গায়কিতে গাইতেন৷ প্রতিটি শব্দের উচ্চারণে বিস্তারিত ধীরগতির মেজাজে রাগের চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হত৷ বেগমের নিজস্ব, নিখুঁত সুন্দর ও সূক্ষ্ম সাঙ্গীতিক কল্পনাশক্তির ছবিও সেই গানে ফুটে উঠত৷

কাজরি

ছা রহি কালি ঘটা

বর্ষার গান হিসেবে এই কাজরিটি বেগম আখতারের নিজেরও খুব পছন্দ ছিল৷ গানটাকে এতটাই পছন্দ করতেন যে কয়েক দশক ধরে উনি এর নানা চেহারায় গেয়ে রেকর্ড করেছিলেন৷ এটি এক অতুলনীয় গান৷ মেঘমায়ায় আলোড়িত বর্ষায় গীত এই গানে বিরহপীড়িত ভালবাসার ছবি সুরে ও গায়নভঙ্গিতে স্মরণীয় করে রাখা বোধহয় শুধু বেগম আখতারের পক্ষেই সম্ভব ছিল৷

দাদরা

জারা ধীরে সে বোলো কোই শুন লেগা

রাগ ‘গারা’-র ওপর সুরারোপিত এই দাদরা যেন তীব্র সুগন্ধের ঝাঁঝালো ফুলের মতো একটা গান৷ নির্লজ্জ প্রেমিকার প্রেমের বহিঃপ্রকাশে নাটকীয় এই গানটি শুধুমাত্র বেগমের জন্যই লিখে দিয়েছিলেন কবি শামিন জয়পুরী৷ বেগমের মাদকতাময় কণ্ঠে মোহগ্রস্ত হয়ে মুগ্ধ হওয়ার মতো গান৷

কোয়েলিয়া মাৎ কর পুকার

বেগম আখতারের শিল্পীজীবনের প্রথমদিকের রেকর্ড করা গান৷ গানটি গোটা দেশেই অসাধারণ জনপ্রিয়৷ তিনি নিজেই এই গানটি একাধিকবার রেকর্ড করেছিলেন৷ বাংলা কথাতেও গানটি রেকর্ড করা হয়েছে৷ ‘পূর্বী দাদরা’ হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত এই গানটিতে গায়িকা কোয়েল পাখিকে বসন্তের আগমনের উল্লাসধ্বনি প্রকাশ করতে বারণ করছেন, কারণ তিনি আগে থেকেই বিরহের গভীর বেদনায় কাতর৷

গজল

দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো

এই গজলটাকে বেগম আখতারের বেদনার্ত জীবনকাহিনীর ‘টাইটেল সঙ’ বলা যেতে পারে৷ গানটি তিরিশের দশকে লিখেছিলেন বেহজাদ লক্ষ্ণৌয়ী৷ ‘আখতারিবাঈ’ হিসেবে গানটি সেই সময়ে রেকর্ড করা হয়েছিল৷ গানের কথা হিসেবে খানিকটা কল্পনাশক্তির অভাব দেখা গেলেও সাঙ্গীতিক আবেদনের প্রশ্নে এই গজলটির আবেদন অবিস্মরণীয়৷ মল্লিকা পুখরাজ একদা আমাকে বলেছিলেন, ‘শ্রোতারা বেগমের গলায় গানটা শুনে মোহাবিষ্ট হয়ে পাগলের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন৷’

কোই ইয়ে কহেদে গুলশন গুলশন

এই সুপরিচিত গজলটি লিখেছিলেন উর্দু ভাষার শেষ সুখ্যাত রোম্যান্টিক বোহেমিয়ান কবিদের অন্যতম, প্রবল জনপ্রিয় সংস্কারবর্জিত কবি জিগর মোরাদাবাদী৷ বেগম আখতারের গাওয়া জনপ্রিয় গজলগুলোর মধ্যে সেরা গানগুলোর এই গানটা সহজেই অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত হবে৷ এই গানটির অননুকরণীয় গায়নভঙ্গিতে বেগমের নিজস্ব প্রতিভা গানের কথার সঙ্গে সুরের এক অনবদ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছে৷

ইয়ে না থি হামারি কিসমৎ

এই ধ্রুপদী গজলটি লিখেছিলেন উর্দু কবিদের মধ্যে গুণগতমানের প্রশ্নে সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী স্বয়ং মির্জা আসাদুল্লা খান গালিব৷ এখনও পর্যন্ত বহু গজল গাইয়ে এই গানটা গেয়েছেন এবং গানটির জনপ্রিয়তা অবিশ্বাস্য৷ খ্যাতিময়ী ও অসামান্য সুন্দরী অভিনেত্রী-গায়িকা সুরাইয়া স্বয়ং ১৯৫৪ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘মির্জা গালিব’-এ গানটি গেয়েছিলেন৷ সেই ছবিটির পরিচালক ছিলেন সোহরাব মোদি, সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন গুলাম মহম্মদ৷ সুতরাং এক দশক আগে গাওয়া প্রবল জনপ্রিয় গানটি নতুন করে রেকর্ডে গাওয়ার কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না৷ কিন্তু বেগম আখতার নিজস্ব ঢঙে গানটা গেয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন কেন তাঁকেই ‘গজল কুইন’ বলা হয়৷

অ্যায় মোহাব্বৎ তেরে আনজাম পে রোনা আয়া

আক্ষরিক অর্থে এই গানই বেগম আখতারের বেদনাময় জীবনের সমাপ্তি-সঙ্গীত৷ তাঁর জীবনের শেষপর্বে কবি শাকিল বাদায়ুনি মর্মস্পর্শী শব্দের গজলটি যেন বেগমের জীবননাট্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই লিখেছিলেন৷ সঙ্গীত সম্মেলনের শেষ প্রহরে যেমন অধিকাংশ শিল্পীদের নির্বাচিত রাগ ‘ভৈরবী’-ই হয়, তেমন মোহাব্বৎ-এর চরিত্র বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এই গানটিও রাগ ‘ভৈরবী’-তে নির্মিত৷ এই কবিতায় চোখের জলে ভেসে যাওয়া শিল্পী যখন প্রেমের সমাপ্তি ঘোষণা করছেন, জীবনেরও তখন যেন সন্ধ্যা ছোঁয়া দিনের শেষপ্রহর৷

মূল ইংরেজি থেকে লেখাটির অনুবাদ করেছেন অলক চট্টোপাধ্যায়

লেখক-পরিচিতি

এস কালিদাস প্রায় তিন দশক ধরে ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে একাধিক ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করছেন৷ তিনি সুখ্যাত ইংরেজি পত্রিকা ‘ইন্ডিয়া টুডে’-র ‘আর্ট এডিটর’ ছিলেন৷ এবং সংবাদপত্র ‘দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ ও ‘পাইওনিয়ার’ সিনিয়র এডিটর পদাধিকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন৷ তিনি একজন উপযুক্ত শিক্ষাদীপ্ত মিউজিকোলজিস্ট৷ তিনি স্বদেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কনজারভেটরিতে বক্তৃতা দিয়েছেন৷ গত শতাব্দীর নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে একাধিক ডকুমেন্টারি ছবিও নির্মাণ করেছেন এবং সেগুলি উচ্চপ্রশংসিতও হয়েছে৷ ‘হায় আখতারি’ নামে তিনি বেগম আখতারের জীবন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারিও নির্মাণ করেছেন৷ ‘রসযাত্রা’ নামে তিনি তাঁর সঙ্গীতগুরু মল্লিকার্জুন মনসুর-এর জীবননির্ভর ডকুমেন্টারির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন৷ সেই ছবিটি ১৯৯৪-এ ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড’ স্বর্ণকমল জয় করেছিল৷ তিনি বিখ্যাত মডার্নিস্ট পেইন্টার ও শিল্প-সমালোচক ও জে স্বামীনাথন-এর সুযোগ্য পুত্র৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *