প্রেমময় বিষাদের উৎস সন্ধানে – অলক চট্টোপাধ্যায়
রাতের রেলগাড়ির সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ৷ কিন্তু অজস্র চিন্তাভাবনা ভিড় করে থাকা মনেরও কি কোনও সখ্য নেই সেই রেলযাত্রায়? বিশেষ করে কোনও সুদূর যখন কাছাকাছির দূরত্বে এসে পড়ে! অনিবার্য অভ্যেসে প্রতিদিন ভোর হয় এবং সেই প্রহরে দ্রুতলয়ে ছুটে চলা ট্রেনের সশব্দ তালও যেন তখন বৃষ্টি-ধোওয়া আকাশের যোগ্য পরিবেশ-সঙ্গীত নির্মাণ করছিল৷ আর কিছুক্ষণ পরেই ‘ফৈজাবাদ’৷
কখনও-কখনও ইতিহাসও স্মৃতির হাত ধরে হাজির হয়৷ মনেরও কোনও বারণ থাকে না৷ সে তো সর্বদাই সকৌতুকে পরের দৃশ্যের দর্শক৷ কেউ কক্ষনো বুঝিয়ে বলতে পারবেন না কেন, ঠিক কী কী কারণে উমরাও জান এবং বেগম আখতার, দুজনেই উত্তরপ্রদেশের এই ফৈজাবাদ অঞ্চল থেকেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন৷ এবং কেন দুজনের জীবনই নাটকীয়ভাবে ভাগ্যতাড়িত ট্র্যাজেডি হিসেবে স্বীকৃত৷ ভারতীয় লঘু-উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রতিভাদীপ্ত অবদানের প্রশ্নে বেগম আখতার যে শর্তে অবিস্মরণীয়া, উমরাও জান-এর সঙ্গীত সম্পর্কে হয়ত ততটা নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাবে না৷ কারণ, তিনি কালের অবিমৃশ্যকারিতায় অনেকটাই স্মৃতি-বিস্মৃতির আবরণে ঢাকা পড়েছেন৷ কিংবদন্তি গায়িকা ও কবি উমরাও জান প্রথম পরিচিতি ও খ্যাতির আলোয় এসেছিলেন বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে লেখা একটি উর্দু উপন্যাসের মাধ্যমে৷ মির্জা মহম্মদ হাদি রৌসা-র সেই উপন্যাস ‘উমরাও জান আদা’-র প্রধান চরিত্র উমরাও সাম্প্রতিক-অতীতে মুজাফফর আলি পরিচালিত হিন্দি ছায়াছবি ‘উমরাও জান’ মুক্তি পাওয়ার পর জনপ্রিয় হয়েছেন৷ সচেতন দায়িত্বে ইতিহাস-এর ধারণ বা সংরক্ষণের কোনও ঐতিহ্য ভারতীয়দের নেই৷ সে জন্য সেই কিংবদন্তি নৃত্যপটিয়সী-গায়িকা উমরাও জান যেন বেশ কিছুটা লোককথা, রূপকথার সঙ্গে ইতিহাসের আলো-অন্ধকার আর কল্পনাদীপ্ত রঙিন আলোয় ভালবাসাধন্য হয়েই বেঁচে আছেন৷ অন্যদিকে, তুলনায় সাম্প্রতিক হওয়ার জন্য বেগম আখতার স্বাভাবিকভাবেই সারাদেশের অসংখ্য প্রবীণ ও বৃদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতামুগ্ধ স্মৃতিতে উজ্জ্বল৷ তাঁর এই জন্মশতবর্ষে তাঁকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করার অনেক প্রকার যান্ত্রিক সহায়তাও আছে৷ কিন্তু সমস্যা সেই সযত্ন সন্ধান ও সংরক্ষণ নিয়েই৷ সমকাল উদাসীন হলে ভুলতে, স্মৃতিতে হারাতে বিশেষ সুবিধে হয়৷
১
ঠিক কোথায় জন্মেছিলেন? এবং কোন অঞ্চলে তাঁর শিশুকাল ও বালিকাকাল কাটিয়ে ছিলেন বেগম আখতার? প্রকাশিত বই, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদির লেখক-গবেষকদের অনেকেই সহজ অন্বেষণে ফৈজাবাদ শহরে পৌঁছে থেমে গেছেন বা অন্বেষণের বাড়তি পরিশ্রম করেননি৷ কিন্তু প্রাসঙ্গিক তথ্যের বাস ছিল একদা অযোধ্যার রাজধানী ফৈজাবাদ থেকে বেশ খানিকটা দূরের গ্রামাঞ্চলে৷ সুতরাং সকালের রোদ হারিয়ে মুখভার করা আকাশকে সঙ্গী করেই আমাদের ভাদারসা গ্রামের দিকে রওনা হতে হল৷ সারথি হিসেবে চমৎকার-দক্ষ ইমতিয়াজ আলি বেশ হাসিখুশি যুবক৷ তাঁর অতিরিক্ত যোগ্যতা তিনি সেই ভাদারসা (Bhadarsa) অঞ্চলটা বেশ ভালভাবেই চেনেন৷ হোটেল ছেড়ে ফৈজাবাদ শহর পেরিয়ে গ্রামের পথ ধরতেই ইমতিয়াজ স্বাভাবিক প্রশ্নে জানতে চেয়েছিলেন আমরা দূর গ্রাম ভাদারসাতে কেন যাচ্ছি৷ ‘পত্রকার’দের তো বিনাকারণে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয় না৷ তখনই কথায় কথায় বুঝতে পারা গেল বছর পঁয়ত্রিশের ইমতিয়াজ শতবর্ষবয়সী বেগম আখতার সম্পর্কে কিছুই জানেন না৷ কিন্তু তিনি বিখ্যাত সুন্দরী অভিনেত্রী রেখার ছবি হিসেবে ‘উমরাও জান’ দেখেছেন৷
পথে যেতে যেতে আখের খেত, আমবাগান, বিভিন্ন ধরনের সবজির খেত পেরিয়ে মাঝে মাঝে ছোটবড় পুকুরও দেখা যাচ্ছিল৷ বেশ বড় একটা আখের খেতের আড়াল অতিক্রম করে বাঁক নিতেই তাঁর সঙ্গে দেখা৷ গলায় কোনও ডাক ছিল না বটে, কিন্তু মেঘ নেমে আসা সেই প্রান্তরে তাঁর পেখম মেলে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতেই কেমন একটা— এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার— গোছের ভঙ্গি ছিল৷ যাচ্ছি সুরের সম্রাজ্ঞীর জীবনকাহিনী খুঁজতে, কী করে ময়ূরকে অগ্রাহ্য করব! তাছাড়া ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের ইতিহাস বলে ‘ষড়জ’-এর প্রাণী-প্রতীক হচ্ছে ময়ূর, সেই মহামান্যর কণ্ঠস্বর থেকেই নাকি সপ্তসুরের প্রথম সুরের জন্ম হয়েছে৷ কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান না-হওয়া পর্যন্ত চিত্তে কোনও প্রকারের শান্তি নেই, সুতরাং তিনি সেই মেঘমেদুর সকালে শিহরিত পুলকে স্থির হয়ে রইলেন, আমরাও তাঁকে দেখতে দেখতে বিদায় নিলাম৷
ভাদারসা পৌঁছে মালুম হল ঠিক গ্রাম বলতে যা বোঝায়, অঞ্চলটা এখন আর ঠিক তেমন নয়৷ একশো বছর আগে হয়ত নিতান্তই গ্রাম ছিল, কিন্তু এখন সেটি রীতিমতো গঞ্জের চেহারা পেয়ে গেছে৷ পৌঁছে জিজ্ঞাসা শুরু করে বেশ হতাশ হতে হচ্ছিল৷ কেউ কিচ্ছু বলতে পারছেন না৷ অথচ আমরা প্রাণপণ চেষ্টায় খাঁটি রাষ্ট্রভাষার নিজস্ব সংস্করণে সবিনয় নিবেদন জানাচ্ছিলাম৷ কেউ কেউ তো প্রায় অর্থহীন প্রশ্ন শুনছেন— এমন ভঙ্গিতেও তাকাচ্ছিলেন৷ সেই মুহূর্তে কালের হিসেব খুবই বড় হয়ে উঠছিল৷ সত্যিই তো, একশো বছর কি খুবই কম সময়! সকলেই সকালের বাণিজ্যে ব্যস্ত৷ কয়েকটা ঝাঁ-চকচকে চেহারার দোকানে দিব্যি বাণিজ্য চলছে৷ কখনও কখনও বোধহয় দ্রুত হতাশ হতে না চাইলেও পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা উৎসাহকে আধমরা করে ফেলে৷ একটা দামি গাড়ি ও অতিআধুনিক ক্যামেরাও সঙ্গে রয়েছে৷ সুতরাং আমরা যে অকারণে ফৈজাবাদ থেকে সকালে হাজির হইনি, সেটাও সম্ভবত কেউ কেউ বুঝছিলেন৷ বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর একজন মধ্যবয়সী দোকানদার আন্তরিক ভঙ্গিতে জানালেন— একটু দূরে লালপুল অঞ্চলে ‘বন্নে মিয়াঁ’ নামের একজন প্রবীণ মানুষ আছেন, তিনি এই বর্ধিষ্ণু অঞ্চলের প্রায় সব খবরই রাখেন৷ কথাটা বললেন বটে, কিন্তু সেই মুসলিম ভদ্রলোককেও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী মনে হল না৷
সেই একটু দূরে গিয়েও সেই বন্নে মিয়াঁর কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না৷ অতএব প্রবীণ থেকে প্রবীণতর মানুষকে জিজ্ঞাসা-অভিযান জারি রইল৷ সরু সরু গলির অভাব নেই৷ সেইসব পথে গাড়ি ঢোকানো মানে রীতিমতো চালক-পরীক্ষা পরিস্থিতি তৈরি করা৷ কিন্তু দেখা গেল ইমতিয়াজ প্রায় সব পারেন৷ সুদূর কলকাতা থেকে আসা পত্রকারসাহেবরা যদি এমন প্রবল গরমে এতটা উৎসাহ নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারেন, তাহলে তিনি কেন গাড়ি নিয়ে গলির মধ্যে ঢুকতে পারবেন না! কিন্তু সেই গলির পর গলির অপ্রতিরোধ্য প্রেমময় সম্পর্কের টানেই সম্ভবত, কয়েকটা গলির জট পেরিয়ে একটা ছোট্ট মাঠে পৌঁছে ইমতিয়াজকে হাল ছেড়ে দিতেই হল৷ অবশ্য এর মধ্যে উৎসাহিত হওয়ার মতো একটা খবর পাওয়া গেছে৷ জনৈক পক্বকেশ ও কুঞ্চিত সফেদদাড়ির অবস্থানগতবৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এক বৃদ্ধ নিদান হাঁকার মতো ভঙ্গিতে জানালেন— হ্যাঁ, ওঁরা মর্শিয়া মহল্লায় থাকতেন৷ এই গলিটায় ঢুকে ডানদিকের কয়েকটা গলি পেরিয়ে পৌঁছতে হবে৷
সহজ পরামর্শও কখনও কখনও যে এমন জটিল সঙ্কেতধর্মী হয়ে পড়ে তা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল৷ শ্রীরাধিকা যখন বৃন্দাবনে সেইসব সুশোভন কুঞ্জগলিতে তাঁর প্রাণপ্রিয় শ্যামসুন্দরকে খোঁজার সময় সখীদের ক্রমাগত প্রশ্ন করতেন, তখনকার পরিস্থিতি ঠিক কেমন হত তা জানি না৷ এবং শ্যামসুন্দরও হয়ত তখন কৃত্রিম ছলনাতেই লুকিয়ে বেড়াতেন, কে জানে! তখনকার প্রাকৃতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল তা-ও জানি না৷ কিন্তু আমাদের অবস্থা ততক্ষণে বেশ কাহিল৷ কারণ, সকালবেলার সেই বাদল-আঁধার ঘুচে গিয়ে প্রবল রোদ্দুর প্রায় মাথার ওপর৷ বৃষ্টির কোনও চিহ্ন নেই৷ ইতোমধ্যে দুই পত্রকারের একজন (কুমার রায়) তাৎক্ষণিক গুরুত্বে জনপ্রিয়৷ দুটো দামি ক্যামেরা গলায় ঝুলছে, অতএব গলির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে৷ আরও কয়েকটা গলির নিজস্ব প্যাঁচে ঘুরে একটা তুলনায় প্রশস্ত অঞ্চলে গিয়ে জানা গেল যিনি বেগম আখতার ওরফে আখতারিবাঈ ও তাঁর মা মুস্তারিবাঈ সম্পর্কে কিছু খবর দিতে পারবেন তাঁর সংক্ষিপ্ত নাম— ‘পাপ্পু’৷ এবং তিনি মহল্লার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি৷
গলি এবং তস্য তস্য গলির মধ্যে বাড়ি হলে কী হবে, সেই পাপ্পু যে সত্যিই একজন বিশেষ ব্যক্তি তা বোঝা গেল তাঁর দোতলা বাড়ি এবং বসার ঘরের আসবাবপত্র দেখে৷ তিনি ধনী ব্যক্তি৷ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সৈয়দ শাহিল হুসেন৷ তাঁর পার্টির নাম ‘কাংগ্রেস’৷ তিনিই তাঁর চ্যালাদের কয়েকজনকে আখতারিদের বাড়িটা দেখিয়ে দিতে বললেন৷ অর্থাৎ আরও একটা-দুটো গলির বাঁক এবং গলি৷ স্বভাব-আলোকচিত্রী ততক্ষণে রীতিমতো ব্যস্ত৷ হাঁটতে হাঁটতে পাপ্পু ওরফে শাহিল হুসেনের অনুগতদের চিনিয়ে দেওয়া গলির মধ্যে পৌঁছে দেখা গেল সেখানে এক নিমগাছ দাঁড়িয়ে৷ কিন্তু সেই নিমগাছটির বয়স বোধহয় শতবর্ষের কাছাকাছি নয়৷ ঠিক কোন বাড়িটায় থাকতেন মুস্তারিবাঈ? কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারলেন না৷ গলির মধ্যে কয়েকটা বাড়ির বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁরাও বেশ খানিকটা সমস্যায় পড়ে যাচ্ছিলেন৷ বুঝতে পারছিলেন তাঁদের যথাসাধ্য সাহায্য করা উচিত, কিন্তু তাঁরা জানেন না৷ প্রবীণরাও এতকাল পরে আর কিছু মনে করতে পারেন না৷ সত্যিই তো এ-ক-শো-ব-ছ-র খুবই দীর্ঘ সময়! মধ্যবয়সী শাহিল হুসেন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিও বলতে পারেন৷ তিনিও যা জেনেছেন ও শুনেছেন সবই তাঁর বাবা-মা-কাকাদের কাছ থেকে৷ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানালেন, মুস্তারিদের বাড়িও গলিটার মধ্যস্থিত অন্য সাধারণ বাড়ির মতোই ছিল, কোনও দৃঢ়চরিত্রের বাড়ি ছিল না৷
স্মৃতি সর্বদা সময়ের ব্যবধান মানে না, বিশেষ করে যদি সেই কাহিনী কোনও বিস্ময়কর প্রতিভার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে৷ গলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছ থেকে ফিরে এলে শাহিল হুসেন আমাদের সঙ্গেই হাঁটছিলেন৷ কয়েক মিনিট হাঁটার পর তিনি একটা ছোট দোতলা বাড়ির সামনে এসে দেখিয়ে দিলেন— ‘এখানেই মা আর মেয়ে গান গাইতেন৷’ বাড়িটি আসলে একটা ছোট্ট চেহারার ইমামবাড়া৷ সেটি এখনও স্থানীয় প্রার্থনার স্থল৷ মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁরা সেখানে নমাজ পড়েন৷ —’কী ধরনের গান তাঁরা গাইতেন?’ অনভিজ্ঞদের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন আসা যেন স্বাভাবিকই ছিল, এমন ভঙ্গিতে শাহিল হুসেন বললেন— ‘ওই যে, আমাদের যে মর্শিয়া (marsia) গান৷ সেই জন্যই আমাদের এই মহল্লার নাম ‘মর্শিয়া মহল্লা’৷’ বেদনাবাহিত সেই প্রার্থনা-সঙ্গীতে মুস্তারিবাঈ ও বালিকা আখতারি নাকি এক অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন৷ বিশেষ করে মহরমের সময় তাঁদের গান শুধু ভাদারসা নয়, গোটা অঞ্চলের কাছেই এক বিশেষ আকর্ষণ ছিল৷ মর্শিয়ার গান (যাকে চরিত্রে mournful elegy বলা যায়) থেকে বিষাদাশ্রিত মূর্ছনা নির্মিত হয়, তা-ই কি পরবর্তী জীবনের গানেও সঞ্চারিত করেছিলেন বেগম আখতার? নিশ্চিত করে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়৷ কোনও লোককাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যে থেকে নির্মিত হয় না৷ জীবনের কোনও না কোনও অংশের সত্যই তার নির্ভুল আশ্রয়৷ মুস্তারির কাছ থেকেই গানের একেবারে শুরুর তালিম পেয়েছিল ছোট্ট মেয়ে, কিন্তু মুস্তারি কোথা থেকে পেয়েছিলেন তালিম? শাহিল হুসেন শান্ত স্বরে বললেন— ‘ছোটবেলা আমার মা-বাবার কাছে শুনেছি উনি তাঁর গাইবার ক্ষমতা পেয়েছিলেন নিজের ভিতর থেকে, একজন প্রকৃত স্বশিক্ষিত শিল্পী৷’ ইমামবাড়ার আধুনিক সময়ের নির্মাণের ধরন দেখে প্রশ্ন করলে শাহিল বললেন— ‘ভেঙে গিয়েছিল, তাই নতুন করে তৈরি করতে হয়েছে৷’ কথায় কথায় লোককাহিনীর প্রসঙ্গ ফিরে এলে উনি বললেন— ‘ছোটবেলায় শুনেছি মা-মেয়ের মর্শিয়ার সময় গাছের ডালের পাখিরাও কোনও শব্দ না করে চুপ করে বসে থাকত৷ গান শেষ হলে আবার উড়ে যেত৷’
২
ভাদারসাতেই ‘বিব্বি’র জন্ম ১৯১৪-র ৭ অক্টোবর৷ যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন মুস্তারিবাঈ, অন্য মেয়ে ‘জোহরা’৷ অন্য নামে এরাই আখতারি আর আনোয়ারি৷ এদের পিতা লক্ষ্ণৌয়ের সিভিল জজ সৈয়দ অসগর হুসেন জীবনকাহিনীর সহজ বিন্যাসে নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি হিসেবেই চিহ্নিত হবেন৷
ভাদারসা-র মর্শিয়া মহল্লার শাহিল এবং অন্যরা মুস্তারিবাঈ-এর ফৈজাবাদ শহরে বসবাসের বিষয়ে বিশেষ কিছু জানাতে পারেননি৷ শুধু বলেছিলেন, ফৈজাবাদ শহরে মুস্তারির অনেক সম্পত্তি, বাড়ি ইত্যাদি আছে৷ বিখ্যাত গায়িকা হওয়ার পরেও আখতারিবাঈ নাকি কখনও কখনও মায়ের সঙ্গে মহরমের সময়ে ভাদারসাতে যেতেন৷ খুব সাধারণভাবে ভাবলেই প্রশ্ন ওঠে— ফৈজাবাদে বাড়িঘর ও সম্পত্তি থাকলে তিনি প্রায় অসহায় অবস্থায় সন্তানদের জন্মের সময় দূরের গ্রাম ভাদারসা-তে যাবেন কেন? হয়ত গিয়েছিলেন সেই ব্যক্তিত্বহীন সিভিল জজ মশাইয়ের হৃদয়হীন সিদ্ধান্তের জন্য৷ প্রসঙ্গত আরও একটা সহজসত্য বলে রাখা প্রয়োজন, একদা অযোধ্যার রাজধানী ফৈজাবাদ শহরের সুন্দরী বাঈজি মুস্তারিবাঈ নৃত্য ও সঙ্গীতের রীতিমতো তালিম পাওয়া শিল্পী ছিলেন৷ সেই প্রকারের যোগ্যতা না থাকলে লক্ষ্ণৌয়ের জনৈক সিভিল জজ সাহেব তাঁর প্রেমে পড়বেন কেন?
আমাদের দেশের গবেষক-লেখকদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত মানুষদের জীবনকাহিনী লেখার সময় সতর্ক থাকেন না৷ তাঁদের সেই অসতর্কতার ফলে পাঠকরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান৷ ‘বিব্বি’-র ছোট বোন ‘জোহরা’ দু-বছর ছয় মাস বয়সে মারা যায়৷ লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশন থেকে প্রচারিত ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে সেই জোহরা-র মৃত্যু সম্পর্কে বিশেষ কোনও কারণ বলা হয়নি৷ কয়েকটি বইতে অবশ্য বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷
কোনও জীবনকাহিনীই ঠিক ইটের পর ইট সাজানোর মতো চরিত্রে সরলপন্থী নয়৷ যাঁরা বিরাট খ্যাতিদীপ্ত এবং যাঁদের জীবন-সম্পর্কিত গবেষণা, লেখালিখি ইত্যাদি তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরে শুরু হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে বিতর্ক, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থাকবেই৷ বিশেষ করে এদেশে তার প্রাচুর্যও কম নয়৷ তবে এটা সন্দেহাতীত সত্য, বেগম আখতার মানুষ হিসেবেও অনন্যসাধারণ ছিলেন৷ সামান্য পরিচয়ের পরেই তিনি তুলনাহীন হৃদয়ের সদর থেকে অন্দরমহলের সবগুলো দরজা-জানালা খুলে দিতেন৷ এবং এই কথা এতকাল পরেও আন্তরিক আবেগে উচ্চারণ করেছেন শান্তি হীরানন্দ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সেলিম কিদওয়াই, সঙ্গীতজ্ঞা শ্রুতি সন্ডিলিকার, লক্ষ্ণৌ বেতারকেন্দ্রের উচ্চতম স্তরের কর্মী কে কে শ্রীবাস্তব থেকে শুরু করে বেগম-এর শেষবয়সের ছাত্রী প্রভাতী মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত— সকলেই৷ নিজের দুঃখসাধন জীবনের কথা বেগম আখতার নিজেই অকপটে বলতেন৷
কথা গোপন করার কোনও চেষ্টা করতেন না৷ শান্তি হীরানন্দকে বেগম নিজের জীবনের যে-গল্প বলেছেন তাতে নিজের যমজ বোন আনোয়ারির মৃত্যুকাল বলেছেন দেড় বছর এবং কোনও বিষক্রিয়ার ঘটনাও সেখানে নেই৷ এস কালিদাস-এর বইয়ে (‘লাভস ওন ভয়েস’) আনোয়ারির মৃত্যুর ক্ষেত্রে কোনও বিষ খাওয়ানোর ঘটনা উল্লেখ করেননি৷ কিন্তু অতনু চক্রবর্তী তাঁর বইতে (‘মালিকা এ গজল বেগম আখতার’) আত্মীয়স্বজনদের কোনও একজন দ্বারা বিষ মেশানো লাড্ডু খাওয়ানোর কথার উল্লেখ আছে৷ যা-ই হোক, গোটা জীবনের বিশাল পরিপ্রেক্ষিতে এই তথ্যগুলো শেষ পর্যন্ত আর তেমন জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ থাকে না৷ ‘বিব্বি’-র বোন জোহরা-র মৃত্যুর পর মুস্তারি বিব্বিকে স্বাভাবিক কারণেই প্রাণপণ চেষ্টায় নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন৷
চারিত্রিক দৃঢ়তার ও দূরদর্শিতার প্রশ্নে মুস্তারিবাঈ যে খুব সাধারণ মহিলা ছিলেন না তা আমরা এই লেখার উত্তরপর্বেও জানতে পারব৷ কোনও বা কোনও কোনও কারণের জন্য মুস্তারির জীবন একেবারেই মসৃণ ছিল না৷ রূপ-যৌবন ও সঙ্গীতের আকর্ষণে মুস্তারিকে সেই অসগর হুসেন তাঁর দ্বিতীয় পত্নী (মতান্তরে তৃতীয়) হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও তাঁর অবিবেচনা ও নিষ্ঠুর আচরণের জন্য দুই কন্যার শিশু বয়সেই মুস্তারি ও অসগরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়৷ মুস্তারিকেও স্বাভাবিক কারণে জীবনসংগ্রামে নেমে পড়তে হয়৷ কিন্তু মুস্তারির জীবন নিয়ে তাঁর আত্মীয়স্বজনদের ঈর্ষার শেষ ছিল না বলে জানা যায়৷ তাঁর ফৈজাবাদের বাড়িতে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়৷ ছোটবেলার নানা দুষ্টুমির স্মৃতি-সহ বেগম আখতার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পরেও ছোটবেলার সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির কথা এক সাক্ষাৎকারে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন৷
‘বিব্বি’র বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ যে দুষ্টুমিতেই অধিকতর বিকশিত ছিল তারও নানা প্রকারের সরকারি বিবরণ জানা যায়৷ সেই দুষ্টুমিকে বিশুদ্ধ বাংলায় বললে দাঁড়ায়— বিচ্ছু টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি৷ কোনও কথা জিজ্ঞাসা করলে সে তার জবাব কক্ষনো সোজাভাবে না বলে সর্বদা ঘুরিয়ে দিত৷ লিখতে বললে দেওয়ালে লিখতে শুরু করত৷ জনৈকা শিক্ষিকা স্কুলের মিস বাহাদুর-এর খুব লম্বা চুল বিব্বির খুবই পছন্দ ছিল৷ যিনি কেশবতী কন্যে, সেই মিস বাহাদুরও প্রলম্বিত কেশরাশি যে অপছন্দ ছিল তা নয়, কারণ সেই মিস নাকি ক্ষণে ক্ষণে তাঁর কেশদীপ্ত অহঙ্কার প্রকাশও করে ফেলতেন৷ বিচ্ছু বালিকা বিব্বির হয়ত সেইখানেই খানিকটা আপত্তি ছিল৷ একদিন একটা চেয়ারে বসে আছেন মিস, মেয়েরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে৷ নিশ্চয়ই খুব আনন্দময় কথাবার্তা হচ্ছিল৷ কেশবতীর চুল ঝুলছে চেয়ারের পেছন দিকে৷ বিব্বি তার পূর্বপ্রস্তুতিতে ব্যাগের মধ্যে একটা কাঁচিও রেখেছিল৷ অন্যরা মিস-এর কথা শুনতেই ব্যস্ত, বিব্বি চুপিসারে চেয়ারের পেছনে গিয়ে সেই কেশরাশির অনেকটাই কেটে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল৷
এরপর থেকে আর স্কুলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷ অনেক বকাঝকা ও পিটাই হওয়ায় বাধ্য হয়ে কেশকাহিনী মা মুস্তারিকে বলতে বাধ্য হয়েছিল বিব্বি৷ কিন্তু কেন এই চুল কাটার বিবরণ এতটা গুরুত্বপূর্ণ? কারণ স্বয়ং বেগম আখতার প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে যাওয়ার পরেও এক বেতার সাক্ষাৎকারে বিস্তারিতভাবে তাঁর স্কুলশিক্ষার প্রসঙ্গে সহজ কৌতুকে এই কেশকর্তন পালা-র সহাস্য বিবরণ শুনিয়েছিলেন৷ মহিলাদের মস্তিষ্ক সম্পর্কিত গবেষণায় ভিতর-বাহির দুটোই যে গুরুত্বপূর্ণ, তা-ও যেন এই কেশকাহিনীতে নতুন করে প্রমাণিত৷
আকর্ষণীয়া নিশ্চয়, কিন্তু যৌবনেও আখতারিবাঈকে ঠিক প্রকৃত অর্থে সুন্দরী বলা যাবে না৷ কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি ঘটেনি৷ এ-জীবনে অনেকেই জীবনরহস্যের অনেকটা জেনে এবং বুঝে শুরুর দিকে অন্যরকম ভাবনাচিন্তায় চলতে-ফিরতে চেয়ে থাকেন৷ কিন্তু বিব্বির রক্তে এবং চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে অনিবার্য আকর্ষণে সেই দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, এবং সেদিকেই তিনি শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন৷ অর্থাৎ থিয়েটার, গান ও সিনেমার আকর্ষণীয় জগৎ, যেখানে পয়সার সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্য খ্যাতি-জনপ্রিয়তাও জড়িয়ে থাকে৷
এবং গৃহদাহ৷ আখতারি ও মুস্তারির জীবন গৃহদাহের ঘটনা থেকেই বদলে যায়৷ যাবতীয় বিপর্যয় যেন ঘটনাসমূহের দলবদ্ধ আক্রমণে মুস্তারির জীবনও ছারখার করে দিতে চেয়েছিল৷ স্বল্পসময়ের ব্যবধানে তাঁর চার ভাই ও বাবা মারা গিয়েছিলেন৷ স্বামী-পরিত্যক্তা মুস্তারি তাঁর ঝলমলে গায়িকা-বাইজির জীবন থেকেও আস্তে আস্তে সরতে বাধ্য হচ্ছিলেন৷ অপর শিশুকন্যাটির মৃত্যুও তাঁকে প্রবলভাবে ব্যথিত করেছিল৷ তথাকথিত আত্মীয়স্বজনরা তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল৷ ঠিক কারা এবং কেন সেই আত্মীয়রা আখতারিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সে সম্পর্কে প্রমাণিত সত্য কারও জানা নেই৷ নানাজন নানাভাবে তার বিবরণ পেশ করেছেন৷
কিন্তু সেইসব সন্দেহ, কাহিনী ইত্যাদি পেরিয়ে দুঃখময় সত্য হিসেবে আগুন তাঁদের যাবতীয় সম্পদ-সহ বাড়িটি জ্বালিয়ে দিলে ব্যক্তিত্বময়ী মুস্তারি, দুঃখসহন যুদ্ধে জয়ী হয়ে, অনিশ্চিত জীবনে পা-বাড়াতে তাঁর এক দূরসম্পর্কের ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন৷ সেই ইউসুফ হুসেন বিহারের গয়ায় থাকতেন৷ নিতান্ত বালিকা বিব্বি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে যে দৃশ্য দেখেছিল তা অনেক পরে, পরিণত বয়সে তা তিনি দীপ্যমান খ্যাতির বেগম আখতার হয়েও ভোলেননি৷ সেই বয়সের সাক্ষাৎকারে অনায়াস স্মৃতিকথা হিসেবে তিনি সেই গৃহদাহের কথা বিস্তারিতভাবে বলেছিলেন৷ দুঃখ মানুষকে উদাসীন করে, কিন্তু কিছুতেই সেই দুঃখকে ভুলতে দেয় না৷
সেই বিহারে বসবাসকালীন সময়েই প্রকৃত অর্থে বালিকা বিব্বির সঙ্গীতের প্রথম পাঠ শুরু হয়৷ পাটনায় থাকতেন সেই সময়ের প্রখ্যাত সারেঙ্গিবাদক উস্তাদ ইমদাদ খাঁ৷ সারেঙ্গিবাদকরা কণ্ঠসঙ্গীতের তালিমদাতা হওয়ার প্রশ্নে অনেক বিদগ্ধ পণ্ডিত ও প্রকৃত জ্ঞানী মানুষের কিছুটা আপত্তি আছে (তার মধ্যে চিরশ্রদ্ধেয় কুমারদা অর্থাৎ কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও আছেন)৷ তবে যাঁরা শিক্ষার্থী, তাঁদের কাছ থেকে কিন্তু কোনও আপত্তি শোনা যায়নি৷ বেগম আখতারও পরিণত বয়সের সাক্ষাৎকারে রীতিমতো শ্রদ্ধা-ভালবাসায় সেইসব তালিমের স্মৃতি শুনিয়েছেন৷
প্রবীণ ও বৃদ্ধরা তো জানেনই, উৎসাহী মধ্যবয়সীরাও মানবেন গোটা দেশের সর্বত্র গায়িকা হিসেবে আখতারিবাঈ বা বেগম আখতার যতদূর সম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন ঠিকই, কিন্তু কলকাতার সঙ্গে তাঁর প্রেম যেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মতো, চিরকালের এবং যথার্থই বর্ণময়৷ পাটনায় প্রাথমিক শিক্ষার পর কলকাতায় আখতারির শিক্ষক ছিলেন উস্তাদ আতা মহম্মদ খান৷ এবং তাঁর পরবর্তী শিক্ষাগুরু উস্তাদ ওয়াহিদ খান৷ রেকর্ড-এ প্রথম গাওয়া, থিয়েটারে অভিনয় করা এবং বোম্বাইয়ের সিনেমায় অভিনয় করতে যাওয়া—সবই কলকাতা থেকেই শুরু হয়েছিল৷ আবার জীবনের শেষ দশ-বারো বছরে কলকাতায় আসতেন মাঝে মাঝেই৷ সঙ্গীত সম্মেলনে গান গাওয়া এবং রেকর্ডে বাংলা গান গাওয়ায় কলকাতা তাঁর প্রাণের মানুষকে নতুন করে ফিরে পেয়েছিল যেন৷ গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ‘জোছনা করেছে আড়ি’— শুধু শহরের গলি নয়, গঞ্জ, গ্রাম, নদীতীর পেরিয়ে সব শ্রোতার হৃদয়ে সেই আড়ি করার জোছনাকেই খুঁজে বেড়াত৷
বাস্তবিক দূরত্ব যে কখনও-কখনও মনের দূরত্বও তৈরি করে দেয় সেটা কোনও নতুন কথা নয়৷ সেই সেকালে এই দূরত্ব যেন আরও বড় চেহারায় হাজির হত৷ প্রধান কারণ, যত্রতত্র টেলিফোন বস্তুটি ছিল না৷ লক্ষ্ণৌ থেকে ফৈজাবাদ দূরত্বে তত বেশি হলে মুস্তারিবাঈ-এর দায়িত্বহীন প্রেমিক ও অস্থায়ী পতিদেবতা, যিনি আবার সিভিল জজও বটেন, সেই তিনি একদা, প্রায় নিয়মিতভাবে সপ্তাহের শেষে কি ফৈজাবাদে পৌঁছতে পারতেন?
তো এদেশের প্রায় কেউই দায়িত্বশীল নয়, রেলগাড়িও না৷ যে-গাড়িটিতে আমাদের সন্ধের প্রথম প্রহরেই লক্ষ্ণৌ পৌঁছে দেওয়ার কথা, সে এলই দিনশেষের আলো গায়ে মেখে৷ বোঝা গেল সে-ও দিব্যি খেয়াল-এর অনুরক্ত৷ তার বোধহয় আটচল্লিশ মাত্রার অতি বিলম্বিত লয়েই চলার অভ্যেস৷ চলভাষ চালু হওয়ার পর থেকে মুহূর্তেই সদুপদেশ, পরামর্শ ইত্যাদি পাওয়া যায়৷ লক্ষ্ণৌয়ে পৌঁছে ঠিক কোথায় অস্থায়ী আস্তানা খোঁজা যায় এই সম্পর্কে পাওয়া নির্দেশপ্রাপ্তির পর প্রায় রাত্রি দ্বিপ্রহরে সেখানে পৌঁছনো গেল৷ কিন্তু সেখানে কোনও স্থান কেউ বিপ্র ও তাঁর সঙ্গীকে দিলেন না৷ বাধ্য হয়ে অটোরিকশা চালকের পছন্দ অনুযায়ী যেখানে পৌঁছনো গেল, সেটি একটি মন্দের ভাল হোটেল৷
অন্য একটি দিন, অন্য একটি সকাল৷ কলকাতা থেকেই সহকর্মী সব্যসাচী সরকার উত্তরপ্রদেশ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের একজন পদস্থ অফিসারের ফোন নম্বর ও অসম্পূর্ণ ঠিকানা দিয়েছিলেন৷ সেই তরুণ ‘সাব’ দীনেশ সেহগল একই সঙ্গে সুদর্শন ও সজ্জন৷ তিনি মহাসমাদরে আমাদের খাতির-যত্ন করলেন৷ কিন্তু তিনি দু-একটা সিনেমা ও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করলেও বেগম আখতার সম্পর্কিত সন্ধানে কিন্তু তেমন কিছুই বলতে পারলেন না৷ লক্ষ্ণৌ শহরের পুরনো ‘চায়না বাজার’ অঞ্চলেই একদা আখতারিবাঈ ও তাঁর মা মুস্তারিবাঈ থাকতেন— এই তথ্য জানালে তিনি অবিলম্বে সরকারি রথ ও সারথি-সহ আমাদের সেই অঞ্চলে পাঠিয়ে দিলেন৷ কিন্তু সেই অভিযান ব্যর্থ হল৷ সেই মঞ্জিল-স্থলে পৌঁছে কলকাতা থেকে আসা এক পত্রকার ও ফোটো-পত্রকার জনে জনে জিজ্ঞাসা করেও কিচ্ছু উদ্ধার করতে পারলেন না৷ আবহাওয়ায় প্রচণ্ড উত্তাপ, কিন্তু দিব্যচক্ষে তখন হতাশার মেঘ রাস্তাঘাট ঢেকে ফেলেছে৷ হোটেলে ফিরে পরবর্তী উদ্যোগের পরিকল্পনা ভাঁজতে হচ্ছিল৷
বেগম আখতারের শেষবয়সের ছাত্রী প্রভাতী মুখোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে লেখা তাঁর স্মৃতিকথায় (‘ইয়াদেঁ’, পৃষ্ঠা ১১৮) লিখেছিলেন— ‘বস্তুতপক্ষে লক্ষ্ণৌ শহরটাই যেন নূপুরের, সারেঙ্গির আর সুরের’৷ লক্ষ্ণৌতে পৌঁছে যে-কেউ তেমন করে খুঁজতে চাইলে সত্যিই সেই নূপুর আর সুরের সন্ধান পেয়ে যাবেন৷ ঠিক তেমন কিছু এই শহরটাতে না থাকলে স্বয়ং নবাব ওয়াজিদ আলি শা-সহ অতুলপ্রসাদ সেন, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, পাহাড়ী সান্যাল, বিনোদ চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেক বিখ্যাত সঙ্গীতপ্রাণ বাঙালিরা এখানে থাকবেন কেন! এখনও লক্ষ্ণৌয়ের অস্তিত্ব ও তার সৌন্দর্য নিয়েই কোনও রসিক ও অভিজ্ঞ অবশ্যই এক মহাগ্রন্থ লিখে ফেলতে পারেন৷
৩
মানুষের জীবনে বিচিত্র সব ষড়যন্ত্র থাকে৷ তার কিছু কিছু রীতিমতো রমণীয়৷ মনের মধ্যে হাজির থেকে ব্লটিং-পেপারে ফেলে রেখে যাওয়া খোলা ফাউন্টেন পেন-এর পরিস্থিতি তৈরি করে তারা৷ কিছুক্ষণ পরে ওই ব্লটিং-পেপারের মতোই গোটা হৃদয় তখন স্বপ্ননীল৷ লক্ষ্ণৌ শহর, তার গান, নর্তকীর ছন্দ এবং অসংখ্য প্রাসাদের আকর্ষণীয় উপস্থিতি নিয়ে পর্যটকদের ক্রমাগত কাছে টানতে থাকে৷ সসম্মানে স্বীকার করতেই হবে, লক্ষ্ণৌ সম্পর্কে একদা মনের মধ্যে প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছিলেন শ্রীপান্থ এবং অবশ্যই কিছুটা পরিমাণে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও৷ শ্রীপান্থ-র লেখাতেই প্রথম জানা গিয়েছিল বিদেশিনী এমা রবার্টস-এর সেই অবিস্মরণীয় উক্তি— ‘ওয়াজ কোয়াইট অ্যাজ অ্যারাবিয়ান নাইটস অ্যাজ আই মেন্ট ইট টু বি৷’ প্রসঙ্গত, ‘লন্ডন টাইমস’-এর প্রতিবেদক উইলিয়াম রাসেল-এর মন্তব্যটাও পেশ করতে হয়, তিনি যা বলেছিলেন তার বাংলা করলে এই দাঁড়ায়— রোম, অ্যাথেন্স, কনস্ট্যান্টিনোপল— কোনও শহরেরই তুলনা চলে না লক্ষ্ণৌর সঙ্গে৷ সৌন্দর্যে লক্ষ্ণৌ সব শহরকে ছাড়িয়ে যায়৷ নবাব আসফউদ্দৌল্লা ফৈজাবাদ থেকে রাজধানী সরিয়ে লক্ষ্ণৌতে আনেন ১৭৮০-তে৷
কিন্তু মনে মনেও বেশিক্ষণ লক্ষ্ণৌ-প্রেমিক থাকা যাচ্ছিল না৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেলেই ছেঁড়া জুতোর মধ্যস্থিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী পেরেকের মতোই তখনও পর্যন্ত অনুসন্ধানের ব্যর্থতা খোঁচা দিচ্ছিল৷ সুতরাং প্রাসাদ-মিনার-গম্বুজ ইত্যাদি শোভিত লক্ষ্ণৌ যতই ‘হিন্দুস্থানের বাবুল’ বা ‘আখতার নগর’ (সৌভাগ্যের শহর) হোক না কেন, বাস্তবিক কারণে সেখানেও বিষাদের প্রবেশাধিকার থাকে৷ সুতরাং অনুচ্চারিত সঙ্গীতে মন বলছিল— যাঁউ কাঁহা বাতা এ দিল…৷
লক্ষ্ণৌয়ে ভাতখণ্ডে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় তো আছেই৷ সুতরাং গানেরই টানে যদি সেখানে পৌঁছে কোনও এত্তেলা পাওয়া যায় বেগম সাহেবার— এই অনিয়ন্ত্রিত বুনো ভাবনায় সেখানেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল৷ সেটা আমাদের হোটেল থেকে খুব দূরেও নাকি নয়৷ তো চিরকাল পথই বলে দেয় অন্য পথ কোথায়, কোথা থেকে তার শুরু, কতদূর পৌঁছনো যায়৷ এবং অটোরিকশার উস্তাদ চালকদের কেউ কেউ দিব্যি জানেন ঠিক কোথায় ‘ভাতখণ্ডে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়’৷ সেখানকার অধ্যক্ষ বা অধ্যক্ষা নিশ্চয় কিছু জানবেন৷ কিন্তু চোখ তো আর বন্ধ রাখা যায় না৷ বিশেষ করে লক্ষ্ণৌতে তা একেবারেই সম্ভব নয়৷ সেই সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের বাড়িটাকেও কোনও স্মৃতিসৌধের মতো মনে হচ্ছিল৷ সামনেই একটা প্রশস্ত সযত্নসংরক্ষিত মাঠ৷ সেই মাঠে জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া প্রৌঢ়, প্রবীণ ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা হাঁটছিলেন৷ মনে হল সেটাই অটো থেকে নেমে পড়ার উপযুক্ত স্থান৷ মানুষের মন স্মৃতির ঐশ্বর্যে আবেগতাড়িত হতেও তো পারে!
হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন একদা বলেছিলেন— স্বয়ং জীবনের হাতে নির্মিত যে রূপকথা, তার কোনও তুলনা নেই৷
নির্ভেজাল সত্যি কথা৷ যাঁরা তার প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়েছেন, তাঁরা কথাটা জীবনে ভুলবেন না৷ প্রবীণ বা বৃদ্ধদের কেউ কেউ তখনও হাঁটছেন, কেউ আবার উদ্যানে-প্রান্তরে যুগলবন্দীর উদাহরণে এক প্রান্তস্থিত বেঞ্চ-এ বসে পড়ে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে কথা বলছেন৷ ততক্ষণে যদিও লক্ষ্ণৌ যে সৌজন্যসুন্দর তা-ও বোঝা হয়ে গেছে, তবুও এমন পরিস্থিতিতে নিজের পরিচয় দেওয়াটাই সহজ পদ্ধতি৷ সুতরাং কলকাতা থেকে গত রাতেই পৌঁছনো পত্রকারকে তাঁর যাবতীয় প্রয়োজনের কথা জানাতে হল৷
ততক্ষণে ক্রমাগত ছবি তুলতে ব্যস্ত আলোকচিত্রী-পত্রকার কুমার রায় সাহাব৷ তিনি সেই ভাদারসা-ফৈজাবাদ থেকেই নিজস্ব মেজাজে ছবি তুলেই যাচ্ছেন৷ খোঁজাখুঁজি করলে মাঝে মাঝে কয়েক মিনিট পরে এসে হাজির হচ্ছেন৷ প্রবীণ ও বৃদ্ধদের সকলেই যে আখতারিবাঈ বা বেগম আখতারে সাগ্রহী বা সেই গৌরবে আপ্লুত তা নন, কিন্তু প্রায় সকলেই সাগ্রহে সাহায্য করতে চান৷ সেই মুহূর্তেই প্রেমময় মনুষ্যত্বের ধ্বজা উড়ছিল যেন৷ শেষবিকেলের হাওয়াও সেখানে কিছু কম সহানুভূতিশীল ছিল না৷ তিনি ড. শুক্লা৷ তিনিই আগ্রহে সব কথা শুনে অনতিবিলম্বে চোস্ত হিন্দি-ইংরেজির সহজ অভিব্যক্তিতে জানালেন, মিস্টার কে কে শ্রীবাস্তবজি, যিনি লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশনের ডিরেক্টর ছিলেন, তিনি নিজেই একজন ‘মিউজিক্যাল পার্সোনালিটি’, তাঁর কাছে বিস্তর কথা জানা যাবে৷ তিনি বেগম আখতারের সঙ্গে একদা কাজও করেছেন৷ এই হচ্ছে তাঁর টেলিফোন নম্বর৷ আপনি দ্বিধাহীনভাবে আমার নাম তাঁর কাছে বলতে পারেন৷
সেই সদাহাস্যময় প্রবীণই যে ড. জ্ঞানেশ্বর শুক্লা এবং তিনি কে কে শ্রীবাস্তবজির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত— এই সব সত্য পরে জানা গিয়েছিল৷ একদা না কি বেগম আখতারের পুরনো ছাত্রীরা একদা কে কোথায় থাকতেন সেই খবরও ড. শুক্লা জানতেন৷ এখন আর তেমন মনে নেই৷ তার মধ্যে একজন বেঙ্গল-এর বহরমপুরে থাকতেন৷ পৃথিবীর সব কাহিনীরই বাসস্থান যেন কোনও সহজ-সুন্দর রূপময় অরণ্যে, যেখানে অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যে একের সঙ্গে অন্যের ডালপালা ও পাতার মতো সহজ সম্পর্ক যেন ঠুমরির সঙ্গে ‘লগ্গি’ বাজানোর মতোই অপরিহার্য শর্তেই স্বাভাবিক৷ একজন পক্বকেশ বৃদ্ধ (তাঁর রীতিমতো সুন্দরী সহধর্মিণীও লাঠি হাতে পাশে বসেছিলেন) ধীরে ধীরে বললেন, আপনারা ঠিক জায়গাতেই এসেছেন, একদা বেগম এই ভাতখণ্ডে মিউজিক কলেজেও কিছুদিন অধ্যাপনা করেছিলেন বোধহয়, আমি সেইরকমই শুনেছি৷
কোন চেহারার শরীর নিয়ে শেষবিকেলের প্রান্তরে কত জোরে হাঁটতে হবে তার কোনও ডাক্তারি নিয়ম থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সকলেই তা নিশ্চয় মানতে বাধ্য নন৷ অন্তত সেই বিশালবপুর (বেশ খানিকটা খর্বকায়) মুসলিম ভদ্রলোক দেখা গেল রীতিমতো বীরত্বব্যঞ্জক হন্টনে বিশ্বাসী৷ মাথায় ফৌজি টুপি৷ হাঁটার সময় হাত দুটো সবেগে সামনে-পিছনে ওঠানামা করছিল৷ সেই তিনিও, অদম্য কৌতূহলেই সম্ভবত, দেখলেন পরিচিত চার-পাঁচ বুড়ো একজন অপরিচিত শুঁটকো বুড়োকে ঘিরে ধরে কী সব আলোচনা করছেন৷ দূর থেকেই তাঁর হাঁটা চোখ টেনেছিল৷ তিনি কাছে এসে নিজেই সব শুনলেন, তারপর উর্দুমেশানো চোস্ত হিন্দিতে বললেন— এখানে আমিনাবাদ অঞ্চলে আক্রামভাইয়ের একটা স্পোর্টস গুডস-এর দোকান আছে, ওঁরা বেগম আখতার-এর আত্মীয়, ওখানে গেলে আপনি কিছু খোঁজ পেতে পারেন৷
সকলের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় ‘চক’ (chowk) শব্দটা বারবার শোনা গেল এবং তার সঙ্গে ‘চৌরাহ’ও৷ তা নানা লগ্নে চৌরাস্তায় তো পৌঁছতেই হবে, নইলে পথ হারানোর সম্ভাবনা থাকবে কী করে! মন্দ মন্থরে নয়, সন্ধেটা যেন হঠাৎ পর্দা পড়ার ভঙ্গিতে নেমে এল৷ ভাতখণ্ডে মিউজিক ইউনিভার্সিটির দ্বাররক্ষী জানালেন— ‘কুলপতি’ দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে সন্ধে সাতটা অবধি থাকেন এবং এখনও আছেন৷ কলকাতা থেকে পত্রকারদ্বয় এসেছেন জেনে কুলপতি সময় দিলেন৷ তার আগে স্বাভাবিক সৌজন্যে জল, চা ইত্যাদিরও বন্দোবস্ত হল৷ ঘরে ঢুকে প্রাথমিক পরিচয়ে জানা গেল ভদ্রমহিলা মহারাষ্ট্রের মানুষ, প্রফেসর শ্রুতি সান্ডলিকার কাটকার৷ তিনি একদা কলকাতার আই টি সি সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমিতে কয়েক বছর অধ্যাপনাও করে গেছেন৷ এবং সেই সুবাদে তিনি পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী ও পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়িকেও বিলক্ষণ চেনেন৷ বেগম আখতার সম্পর্কে স্বাভাবিক শ্রদ্ধায় জানালেন— ‘নিষ্ঠাভরে গান শিখলেই কেউ বেগম আখতার হতে পারেন না, সম্ভবই নয়৷ ওঁর প্রতিভা-দক্ষতা ব্যাখ্যার অতীত৷ এই প্রতিষ্ঠানেরও সৌভাগ্য যে একদা তিনি কিছুদিনের জন্য এখানেও অধ্যাপনা করেছিলেন৷ এবং সেই স্নেহময়ী মহিলা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন৷ ঠিক কবে থেকে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছিলেন তার সরকারি অনুমোদনপত্রের কপি আপনাকে কাল দেব, যদি অনুগ্রহ করে আসেন৷’ কী করে বলি, আমি নয় তিনিই অনুগ্রহ করতে পারেন, যদি মালিকা এ গজল বেগম আখতার-এর বিস্তারিত খবর আমাদের দিতে পারেন৷ তা তিনি দিলেনও৷ জানালেন— ‘এক্ষুনি লক্ষ্ণৌ শহরে জীবিত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সেলিম কিদওয়াইয়ের চেয়ে বেশি কেউই বেগম আখতার সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন না৷ আপনি তাঁর কাছে যান৷ তিনি অতি সজ্জন ব্যক্তি৷ নিশ্চিতভাবে আপনাকে সাহায্য করবেন৷’
স্মৃতিও কখনও কখনও রীতিমতো রহস্যময় আচরণ করে৷ সেলিম কিদওয়াইয়ের নামটা সেই মুহূর্তে একেবারে বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ল৷ এস কালিদাস তাঁর বেগম আখতার সম্পর্কিত বইটি যে-দুজনকে উৎসর্গ করেছিলেন তার একজন হচ্ছেন এই কিদওয়াই সাহেব৷ হোটেলে ফিরতে ফিরতেই ঠিকানা সংগ্রহের ফোন করা ছাড়া আরও একটা সমস্যা নিয়ে গবেষণা করতে হচ্ছিল৷ এই আধুনিক লক্ষ্ণৌ কোনও যুক্তিতেই ছোট শহর নয়৷ নানা প্রান্তে ঘোরাঘুরির জন্য রথ ভাড়া করা ছাড়া কোথায় আগে যেতে হবে সেটাও ঠিক করতে হবে৷
গোলাপবাগ এলাকা থেকে দুটো চৌরাহ পেরিয়ে বাঁদিকে গেলে আমিনাবাদ শুরু হচ্ছে৷ পরের দিন সকালে সেখানে পৌঁছে চক্ষুস্থির৷ অসংখ্য ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়, প্রয়োজনে এবং উৎসাহে দোকানই যেন উপচে রাস্তায় নেমে এসেছে৷ এখানে কোথায়, কীভাবে সেই আক্রামভাইয়ের স্পোর্টস গুডস-এর দোকান খুঁজব? কিন্তু কোনওভাবেই পিছিয়ে আসার প্রশ্ন নেই৷ অতএব সেই ‘আক্রামভাই’ আর ‘স্পোর্টস গুডস’— এই দুটো শব্দকে পোস্টারের মতো সামনে রেখে এবং কোনও দোকানে বিশেষ কোনও উৎসাহ পেলে সেখানে বেগম আখতার-এর নামটাও উচ্চারণ করছিলাম, দুজনেই৷ ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, কুসংস্কারেও না৷ কিন্তু নাটকীয়, বিরল ও আকস্মিক ঘটনায় অবিশ্বাসী নই৷ শেষ পর্যন্ত প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে সেই প্রশ্নতাড়িত হন্টনের পর একটা ছোট্ট হোসিয়ারি দোকানের প্রায় প্রৌঢ় মালিক সোল্লাসে বলে উঠলেন— ‘হাঁ হাঁ, উয়ো আখতারিবাঈ ফৈজাবাদীকী গজলেঁ আবিভি ইয়াদ হ্যায়— ‘অ্যায় মোহাব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া’৷ সঙ্গীতশিক্ষায় বা স্বাভাবিকভাবে পাওয়া সুরেলা কোনও কণ্ঠস্বর নয়, কিন্তু হৃদয়গত আবেগে কোনও খামতি নেই৷ সেই তিনিই বলেছিলেন আর কতদূরে এক চৌরাহ আছে, সেখানে পৌঁছেই বাঁদিকে ঘুরে দোতলায় আক্রামভাইয়ের দোকান, এখন তাঁর ছেলেরা দেখাশোনা করে৷ কিন্তু ঠিকানা জানলেই মঞ্জিল-এ পৌঁছনো যায় না৷ অসংখ্য খদ্দের, জুতো, পোশাক, আতর থেকে শুরু করে কী নেই সেখানে! যাবতীয় বাণিজিক ভিড় ঠেলতে ঠেলতে যাওয়ার সময় বেগম সাহেবারই একটা জনপ্রিয় গজল-এর প্রথম লাইন মনে পড়ছিল— ‘দূর হ্যায় মঞ্জিল রাহেঁ মুশকিল’৷ শেষ পর্যন্ত সেই দোকানে পৌঁছে জানা গেল আক্রামভাইয়ের জ্যেষ্ঠপুত্র মহম্মদ আরশাদ খান নামাজ পড়তে গেছেন, দোকানে ফিরতে— তা ঘণ্টাখানেক দেরি তো হবেই৷
প্রয়োজন তীব্র হলে কখনও কখনও প্রয়োজনীয় প্রশ্নরাও তীর সাজানোর মতো গোছানো থাকে৷ সেই গজল গেয়ে ওঠা দোকানের মালিককে প্রশ্ন করেছিলাম, চায়না বাজার-এ ‘আখতারি মঞ্জিল’টা ঠিক কোথায়, আর তিনি ও তাঁর মা মুস্তারিবাঈয়ের সমাধিটা শহরের ঠিক কোথায়? তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেও দিয়েছিলেন, কিন্তু পথনির্দেশের ধরনে খানিকটা হলেও জটিলতা ছিল৷ পরে প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি একজন অপরিচিত, বিশেষ করে লক্ষ্ণৌয়ে নবাগতকে ঠিক যেভাবে বলা উচিত, সেভাবে না বললেও বিশেষ ভুলও বলেননি৷
দোতলায় অবস্থিত দোকান থেকে প্রবল ব্যস্ত বাজার এলাকার দৃশ্য আরও অন্যরকম একটা চেহারা নিল৷ কারণ, সেই দ্বিপ্রহরে হঠাৎ বৃষ্টি নামল৷ এবং আরশাদভাই তখনও আসছেন না৷ তাঁর ছোট ভাই অবশ্য লক্ষ্ণৌয়ের স্বাভাবিক সৌজন্যে কিছুক্ষণ পরে পরেই তাঁর চলন্ত দূরভাষ মারফত খবর নিয়ে আশ্বস্ত করছিলেন, আরশাদভাই এই এসে পড়লেন বলে৷ শেষ পর্যন্ত সেই সুদর্শন ঝকঝকে চেহারার তরুণ এলেন এবং জানালেন তিনি নিজে বিশেষ কিছু বলতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর মা পারবেন৷ কারণ, তিনিই বেগম আখতারের আত্মীয়া৷ তবে তাঁদের পরিবার সেই কিংবদন্তি গায়িকার দূরসম্পর্কের আত্মীয়া হলেও লক্ষ্ণৌ শহরের কোথায় বেগম আখতার থাকতেন বা তাঁর সমাধিস্থলই বা কোথায় তিনি নির্ভুল জানেন৷ এবং তাঁদের নিজেদের সপরিবার বাসস্থান শহরের মডেল হাউস অঞ্চলে৷
সুতরাং পরের দিন সকালেই জয়ভারত চৌরাহ পেরিয়ে, নিশাদ হসপিটালের পাশ দিয়ে আমরা যেন অনেকদিনের মনের মানুষের বাড়িতেই পৌঁছে গেলাম— এমন মসৃণভঙ্গিতে যাওয়া যেন কতদিনের চেনা৷ সেই চায়না বাজার এলাকাতেই, একটু পাশে সরে যাওয়া অঞ্চলে দুটো রাস্তার সংযোস্থলে সেই ঐতিহাসিক বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েও খানিকটা হতাশ হতে হল৷ কারণ, বর্তমান মালিক জনৈক কর্নেল চ্যাটার্জি, তিনি নেই৷ তিনি বছরের অধিকাংশ সময়েই দিল্লিতে থাকেন৷ প্রবীণ কেয়ারটেকার ও তাঁর ছোকরা পুত্র সবিনয়ে জানালেন, দোতলা বাড়িটির অধিকাংশ ঘরে তাঁদের ঢোকার অধিকার নেই ইত্যাদি ইত্যাদি৷ নতুন সময়ের সঙ্গে সাথসঙ্গতে ‘আখতারি মঞ্জিল’-এর নতুন ঠিকানা হয়েছে— ১৩০/১৪ জে সি বোস রোড৷
৪
বেগম আখতার তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে লক্ষ্ণৌতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ এই ‘আখতারি মঞ্জিল’ নির্মিত হয়েছিল ১৯৩৮-এ, মাকে নিয়ে সেখানে বসবাসের শুরু ১৯৩৯ সালে৷ বাড়িটি একটি বিশেষ ধরনের স্থাপত্যের চিহ্ন ধরে রেখেছে এবং তার শরীর এখনও যথেষ্টই ভাল রয়েছে৷ বাড়িটি নির্মাণের আগে পুরনো লক্ষ্ণৌয়ের আরও কয়েকটি অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া করে ছিলেন বলে অনেকেই বলেছিলেন এবং সেইসব তথ্যের কোনওটাই সম্পূর্ণ ও নির্ভুল চেহারায় জোগাড় করা যায়নি৷ এমনকি গাড়ি নিয়ে সেইসব প্রায় উড়ো খবরের পেছনে ধাওয়া করেও কিছু উদ্ধার করা যায়নি৷ বেগম শেষজীবনে কোথায় এবং কেমন অবস্থায় ছিলেন তা অবশ্য আমরা এই লেখার অন্য অধ্যায়ে জানতেপারব৷
পরের দিন দ্বিপ্রহরে আবার ভাতখণ্ডে মিউজিক ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছতেই শ্রুতিজি সেই প্রতিষ্ঠানে বেগম-এর অধ্যাপনা করার সরকারি নির্দেশের কপি দিলেন, দিলেন বেগমের আর তাঁর মায়ের সমাধিস্থলে পৌঁছনোর পথনির্দেশও৷ সেখানে যিনি সমাধিস্থলটির দেখাশোনা করেন তাঁর নাম ‘গুড্ডু’৷ পাওয়া গেল তাঁর ফোন নম্বরও৷
বেগম আখতার ও তাঁর মা মুস্তারিবাঈয়ের পুরনো সমাধির ছবি প্রথম দেখেছিলাম প্রভাতী মুখার্জির বই ‘ইয়াদেঁ’-তে৷ কিন্তু এখন সেখানকার ছবি সম্পূর্ণ বদলে গেছে৷ এবং এই কাজটির জন্য প্রধান ভূমিকা নিয়েছেন বেগম-এর সবচেয়ে পুরনো ছাত্রী শান্তি হীরানন্দ ও সেলিম কিদওয়াই৷
যাঁরা পথের হদিশ দিয়েছিলেন, দোষটা তাঁদের নয়৷ বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে, বেগম আখতার-এর ‘মাজার’ থেকে পাঁচশো গজ দূরেও কেউ কেউ তাঁর ‘মাজার’-এর নামই জানেন না৷ এবং তাঁরা ব্যস্ত, খুবই ব্যস্ত৷ কিন্তু ভবিষ্যতে গোটা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হয়ত কিছুসংখ্যক নির্বোধ (যাঁদের হাতে অথবা মাথায় বিস্তর সময় আছে) সেখানে যাবেন বা যেতে চাইবেন, সেই তাঁদের জন্য জানাতে হচ্ছে— লক্ষ্ণৌ শহরের একেবারে এক প্রান্তে ঠাকুরগঞ্জ অঞ্চলে পৌঁছে পসন্দবাগ-এ কোনেশ্বর মন্দির পেরিয়েই বাঁদিকে ঢুকে খানিকটা গেলেই টিবি হসপিটাল৷ সেই হাসপাতাল পেরিয়ে যে রাস্তায় পড়বেন, সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে কিছুদূর এগিয়ে আবার ডানদিকে একটা গলিতে ঢুকতে হবে৷ তারপর খানিকটা এগিয়ে বাঁদিকে পড়বে এস এস ব্রাইট ইন্টার কলেজ৷ আরও একটু এগিয়ে পর পর দুবার বাঁদিকে ঘুরে এগিয়ে একটা খোলা মাঠ৷ ডানদিকে পথের পাশেই শুয়ে আছেন এক বিশাল চেহারার ট্রান্সফর্মার৷ একটু এগিয়ে ডানদিকের গলিতে ঢুকলেই দেখা যাবে বেগম ও তাঁর মায়ের মাজার৷ কয়েক বছর আগেও নাকি সেখানে চারদিকের বাড়ি থেকে নোংরা ছুঁড়ে ফেলা হত৷ দেশটার নাম যখন ভারতবর্ষ, তখন তা ঘটতেই পারে৷ কিন্তু এখন যদি কেউ শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছতে পারেন, তাহলে শান্তিজি ও কিদওয়াই সাহেবের উদ্যোগ ও তার পরিণতি দেখে ভালই লাগবে৷ তিন বছর আগে নির্মিত সুন্দর অথচ ছোট্ট স্থাপত্যের নিদর্শন ছাড়া এখন সেখানে প্রতিদিনই প্রদীপ জ্বলে, ধুপও গন্ধ ছড়ায়৷
সেখানেও নির্জন পরিবেশে বিষাদ-বেদনার আবহসঙ্গীত হয়ে হাওয়া আসে৷ দিনশেষে বা মধ্যরাতে কোনও অস্ফুট উচ্চারণে বেগমেরই কোনও গান ঘুরে বেড়ায় কিনা জানি না৷ যদি গুনগুন করে হাওয়াই গান করে, তাহলে সেটা কোন গান— এই প্রশ্নেরও কোনও উত্তর নেই৷ হতেই পারে সেই গানটি হয়ত— উয়ো যো হামমে তুমমে কারার থা ৷
কারণ, সারাজীবনই ভালবাসা, বিস্মৃতি আর বিচ্ছেদের গান শুনিয়েছেন বেগম আখতার৷ বুকের ভেতরের যন্ত্রণা নিংড়ে তা প্রেমবিহ্বল শ্রোতাদেরও কাঁদিয়ে ছেড়েছে৷ সাজসজ্জা আর পুষ্পপ্রেমে আলোড়িত প্রহর কাটানো বেগম আখতারের এই সমাধিস্থলে কোন কোন ফুল নিত্য ফোটে বা ফুটতে চায়? বিশ্বস্ত প্রহরী, গুড্ডুভাইকে যদি কেউ এই কথা জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়ে দেবেন— কিঁউ, রাত কি রানী, তুলসী, হরসিঙ্গার, দেশি গুলাব আউর কড়ি পাতা৷
মাকে বড্ড বেশি ভালবাসতেন তিনি, ছোট্ট বিব্বি থেকে পদ্মভূষণ বেগম আখতার হয়েও৷ জীবন তাঁকে প্রায় হাতে ধরে, একগাল হেসে এবং চোখের জলে বুঝিয়ে দিয়েছিল মুস্তারিবাঈয়ের মতো মা-বন্ধু আর হয় না৷ হওয়া সম্ভবও ছিল না৷ সুতরাং সারাজীবনে যাঁকে ছেড়ে থাকতে চাননি, মৃত্যুতেও তাঁকে ছাড়বেন কী করে!
৫
অনেকটা বেঙ্গালুরু শহরের মতোই, আধুনিক লক্ষ্ণৌয়ের সবচেয়ে আধুনিক, পরিষ্কার ও পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত অঞ্চলগুলোর একটির নাম— ‘ইন্দিরা নগর’৷ লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশনের একদা কর্তাব্যক্তি কে কে শ্রীবাস্তব সেখানেই থাকেন৷ গোমতী নদীর অধিকাংশ অঞ্চলের চলাফেরায় হারিয়ে যাওয়া, শুকিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত থাকলেও এখনও কোনও বাঁক, বয়ে যাওয়ায় হারানো স্বপ্ন ফিরে আসে যেন৷ সেই নদী পেরিয়ে যেতে হবে শ্রীবাস্তব সাহেবের নীলগিরি কমপ্লেক্স-এ৷ দূরভাষের নির্দেশে বলেছিলেন সি এম এস স্কুল পেরিয়ে ‘কাঞ্চন সুইটস’-এর কাছে পৌঁছে আবার ফোন করবেন৷ সন্ধে ৭টা৷ কখন কী মনে পড়বে তা কি কেউ জানেন! তালাত আজিজ-এর একটা গজলের প্রথম লাইনটার মতলব ছিল— ‘তোমরা তাকে বলে দিও, শহরের সব রাস্তারই আলো যেন জ্বালা থাকে, আমি আসছি৷’ সুতরাং আলো জ্বলছে পথে পথে৷ এবং সব রাস্তার মেকআপ একইরকম৷ আরও দু-তিনবার ফোন করার পর একটা পার্কের উল্টোদিকের একটা চমৎকারভাবে সাজানো একতলা বাড়িতে হাজির হওয়া গেল৷
চমৎকার রসিক মানুষ এবং সদাহাস্যময়৷ বেগম আখতারের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল জলন্ধর রেডিও স্টেশনে৷ বেগম আখতার বলতে তখন গোটা দেশ পাগল৷ সব গীতিকার, কবি প্রায় নিত্য প্রার্থনার মতো চাইতেন তাঁর লেখা অন্তত একটা গজল যেন বেগম আখতার-এর গলা থেকে উচ্চারিত হয়৷ জলন্ধর রেডিও স্টেশনের মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট থেকে অনেক কিছুই তখন দেখতেন কে কে শ্রীবাস্তব৷
কবে চলে গেছেন বেগম আখতার, কিন্তু তাঁর স্মৃতি আজ অমলিন হয়ে মুচকি মুচকি হাসছে যেন৷ অত বড়, অত বিখ্যাত শিল্পী, তাঁকে একেবারে সরাসরি কিছু বলা, কোনও অনুরোধ জানানোর কথা ভাবাই তখন অসম্ভব কথা৷ কিন্তু, কেন তা আজও জানেন না শ্রীবাস্তব সাব, তাঁকে বেশ পছন্দ করতে শুরু করলেন বেগম৷ এবং উচ্চাভিলাষীরা সর্বত্র বিরাজমান৷ সেই জলন্ধর রেডিও স্টেশনেই একজন তরুণ কর্মী ছিলেন, তিনিও গজল লিখতেন৷ তাঁরও হৃদয়গত বাসনা ছিল যদি তাঁর একটা গান স্বয়ং বেগম সুরারোপ করে পরিবেশন করেন৷ কিন্তু বাস্তবে কাজটা যে-কোনও ক্ষিপ্রপদ একটা বিড়ালকে ধরে তার গলায় ঘণ্টা বাঁধার চেয়েও অনেক কঠিন৷ সেই নওজোয়ান গজল লিখিয়ে, অর্থাৎ সুদর্শন ফকিরি, তিনি সহকর্মী হওয়ার দাবিতে শ্রীবাস্তব সাহাবকে ধরলেন৷ খানিকটা সঙ্কোচের সঙ্গে হলেও শ্রীবাস্তব বেগম আখতারকে সেই প্রস্তাবটি নিবেদন করলেন৷ বেগম কথাটা শুনে হেসেছিলেন৷
মানুষের সভ্যতায়, বিশেষ করে এদেশের খ্যাতিমানদের আচরণে বিচিত্রসব জটিলতা থাকে৷ বহুক্ষেত্রেই তাঁরা বৈচিত্র্যময় বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়ে থাকেন এবং সমকালীন সমাজও তা মেনে নিতে বাধ্য হয়৷ বেগম আখতার সেই পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগেই যে প্রকারের জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, তা এখনও বহু শিল্পীর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্বপ্নসম্ভব বলে মনে করেন কে কে এস৷ বেগম অনেকটা যেন খেলাচ্ছলে, খুব তাড়াতাড়ি সুর তৈরি করতে পারতেন (একই ধরনের মন্তব্য করেছেন শান্তি হীরানন্দজিও), পরের অনুষ্ঠানে এসেই জানিয়েছিলেন সুদর্শন তো একজন ভাল গজল লেখক এবং পরে সুদর্শনের লেখা সেই গজলটা উনি একটা লঙ প্লেয়িং রেকর্ড-এ রেখেও ছিলেন৷ মনে রাখতে হবে উনি তখন শাকিল বাদায়ুনি, ক্যায়ফি আজমিদের মতো বিখ্যাত উর্দু কবিদের গানই বেশি গাইতেন৷ সমগ্র ঘটনাটা অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে ঘটেছিল৷ তরুণ সুদর্শনের চোখে জল দেখতে পেয়েছিলেন রেডিও স্টেশনের অন্য সব সহকর্মীও৷
রেডিও স্টেশনও একটা ব্যস্ত সরকারি দপ্তর, সেখানে প্রতিদিন কত কী ঘটে যায়৷ সেই সময়েই, অর্থাৎ ১৯৭০ বা ১৯৭১-এ জলন্ধর রেডিও স্টেশনের অডিশন পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিলেন বিখ্যাত শিল্পী জগজিৎ সিং৷ তবে সুদর্শন-এর চোখের জল আর অনায়াস, সহজিয়া মেজাজে বাঁধা মানবিকতার উদাহরণ হিসেবে পদ্মশ্রী বেগম আখতার-এর সেই আচরণের কাহিনী কেউই ভোলেননি৷
১৯৭২-এ কে কে এস বেগমের শহর লক্ষ্ণৌতেই বদলি হয়ে আসেন৷ উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ আরও দৃঢ় হয়৷ তখন উনি হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশনে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন৷ ওই দাদরা, ঠুমরি, কাজরি ও গজলই গাইতেন৷ শ্রোতাদের প্রবল আগ্রহের জন্য ওঁর অনুষ্ঠান দিন-রাতের অনেকটা সময় জুড়ে করতে হত৷ সকালের ৭টা ৫ মিনিটে উনি আধঘণ্টায় (১৫ মিনিট + ১৫ মিনিট) দাদরা, ঠুমরি গাইতেন৷ দুপুরবেলায় একটা থেকে দেড়টা এবং রাতে বিশেষ অনুষ্ঠান হিসেবে দশটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত শুধু গজলই গাইতেন৷ কে কে এস তখন ট্রান্সমিশন ইনচার্জ৷ ইনস্ট্রুমেন্টের ব্যালান্সিংয়ের দায়িত্বও তাঁকে সামলাতে হত৷
অত্যন্ত দয়ালু প্রকৃতির মানুষ, একই সঙ্গে মৃদুভাষী এবং কোনওরকম ভড়ং নেই৷
ফলে বেগম গাইতে আসা মানেই একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হওয়া৷ তখন লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশনে একেবারে চাঁদের হাট বললেও কম বলা হয়৷ আছেন বিনোদ চট্টোপাধ্যায়, সি রামচন্দ্র ও মুমতাজ আলি৷ মুমতাজ আলি সারেঙ্গি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে গজল-এর সুরকারও ছিলেন৷ বেগম-এর সঙ্গে সারেঙ্গি বাজাতেন গুলাম সাবির কুয়াদ্রি, তবলায় মুন্নে খান এবং তানপুরায় থাকতেন ভগবান দাস৷ যাঁরা এখনও স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন তাঁরা তো জানেনই তবলিয়া মুন্নে খাঁ-র সঙ্গে ওঁর বোঝাপড়া, সেটা একই সঙ্গে দেখবার ও শোনবার৷ কখনও উচ্চকিত কিছু করতেন না, বেগম শুধু মুচকি মুচকি হাসতেন৷ অতবড় শিল্পী, কিন্তু অনুষ্ঠান থাকলে অন্তত একঘণ্টা আগে পৌঁছে যেতেন এবং রিহার্সাল রুমে রেওয়াজ করতেন৷ হাতে করে নিয়ে আসতেন ক্যাপস্টান সিগারেটের কৌটো৷ ধর্ম নিয়ে কখনও কোনও গোঁড়ামি দেখিনি৷ এসেই একেবারে আপনজনের মতো বলতেন— কে কে শ্রীবাস্তব সাব কো বোলাও৷
স্মৃতিভারে কেমন যেন উদাসীন হয়ে যাচ্ছিলেন কে কে এস৷ হঠাৎ মনে পড়ার মতো ভঙ্গিতে শোনালেন, মুম্বই চলচ্চিত্রের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক মদনমোহনের কথা৷ মদনমোহন ১৯৭৪-এ বেগমের মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ কালো রঙের পোশাক পরে লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশনে এসেছিলেন৷ (অভিজ্ঞরা জানেন, মদনমোহন একদা লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশনেই উস্তাদ আলি আকবর খাঁঁ ও বেগম আখতার-এর সংস্পর্শে এসে নিজের সঙ্গীতশিক্ষাকে ঋদ্ধ করেছিলেন৷) মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর মুসলিম সম্প্রদায়ের যে ধর্মাচরণ, যাকে ‘চালিশা’ বলে, সেই অনুষ্ঠানে মদনমোহন উপস্থিত ছিলেন৷ কালো পোশাক পরা মদনমোহনের চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছিল৷ অতিকষ্টে বলতে পেরেছিলেন— ‘আমাকে গজল গাইতে, বুঝতে শিখিয়েছিলেন কে তা পৃথিবীর কেউ জানুক না-জানুক আমি তো জানি৷’
বেগমের বিয়ের পর ব্যারিস্টার আব্বাসি সাহেবের শর্ত অনুযায়ী অনুষ্ঠানে গান গাওয়া বারণ ছিল— এমন কথা কে কে এস শুনেছিলেন, কিন্তু রেডিওর ক্ষেত্রে তাঁর সম্মতি ছিল— এটাও তিনি শুনেছেন৷
দেশের কেউ ভুলুক না-ভুলুক লক্ষ্ণৌ বেতার কেন্দ্রের পক্ষে বেগম আখতারকে বিস্মৃত হওয়া সম্ভব নয়৷ এবং স্বস্তির ও আনন্দের কথা, তাঁর জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে সারা দেশের একমাত্র বেতার কেন্দ্র হিসেবে লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশন ২০১২-২০১৩ সালে একটা শ্রদ্ধাঞ্জলিসূচক সঙ্গীতময় ধারাবাহিক শ্রোতাদের শুনিয়েছিল, যার নাম ‘কুছ নকশ তেরি ইয়াদ কি’৷ কে কে এস জানালেন— সেই সিরিয়ালটির সঙ্গীত-পরিচালক অমিতাভ শ্রীবাস্তব (সঙ্গীতশিল্পী কেবল কুমারের পুত্র) তাঁর ছাত্র, তিনি বলবেন সে যেন হোটেলে এসে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে৷ লক্ষ্ণৌয়ের প্রথাগত সৌজন্য অনুযায়ী সেই অমিতাভ সত্যিই তার পরের দিনই এসেছিলেন৷ গুণী ও বিনয়ী— একই সঙ্গে দুটি বিশেষণ কারও অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলে যা হয়! কিছুতেই নিজের সঙ্গীতময় কাজকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইছিলেন না কে কে এস৷ কিন্তু গানের প্রসঙ্গ তো, তাই শেষ পর্যন্ত প্রেমে জল হয়ে গলে জানালেন, একদা ‘দাদরা’র বিশেষ অনুরাগী হিসেবে তিনি ‘দাদরে কে রঙ’ নামে একটা মিউজিক্যাল ফিচার নির্মাণ করেছিলেন এবং তাতে খুব স্বাভাবিকভাবে বেগম-এর গাওয়া দাদরা নিয়েও উদাহরণ সহযোগে আলোচনা আছে৷
৬
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সেলিম কিদওয়াইয়ের নামটি অপরিচিত ছিল না৷ কারণ এই সঙ্গীতরসিক, উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোকই একদা ‘মালকা পুখরাজ’-এর বিখ্যাত আত্মজীবনী (Song Sung True, ২০০৩-এ প্রকাশিত) বইটি উর্দু থেকে অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছিলেন৷ এবং আগেই লিখেছি, ১৯৯৪-এ বেগম আখতারকে নিয়ে নির্মিত এস কালিদাস-এর ডকুমেন্টারি ‘হায় আখতারি’-তে তাঁকে সাক্ষাৎকার দিতেও দেখা গেছে৷ কিন্তু এসব তো দূরের মানুষের সঙ্গে দূরেই থেকে যাওয়া পরিচয়৷ কখনও সাক্ষাতের সম্ভাবনা থাকত না যদি না তাঁর শহরে পৌঁছনো সম্ভব হত৷
টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তার সুরেই সুভদ্র মানুষটির সৌজন্যবোধ সম্পর্কে একটা প্রত্যাশা জন্মেছিল৷ কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতার স্বরলিপি তো সাধারণত অন্য সুরে বাজে, তাই শুরুতে কিছুটা সতর্কও থাকতে হচ্ছিল৷ ঠিক কতদূরে আছে লক্ষ্ণৌয়ের ‘মহানগর’ অঞ্চল তা-ও জানা ছিল না৷ সকালে বেগমের মাজার-এ যাওয়ার জন্য আমাদের পৌঁছতে প্রায় কুড়ি মিনিট দেরি হয়েছিল৷ টেলিফোনে ক্ষমাও চেয়েছিলাম তার জন্য৷
শেষ পর্যন্ত সেই মহানগর-এর গোল্ড মার্কেট অঞ্চল পেরিয়ে, ঠিকানা খুঁজে তাঁর দোতলা বাড়িটির সামনে গিয়ে গাড়িটি দাঁড় করাতেই বুঝতে পারলাম একজন সম্পন্ন, রুচিশীল ব্যক্তির বাড়িতেই এসেছি৷ সামনে বাগান, তারপর তাঁর দোতলা বাড়ি৷ আমাদের ডাকাঘণ্টি বাজাতেই হল না, বুঝলাম কিশোর ছোকরাটি পাঁচিলের ভেতরে উদ্যানপ্রান্তে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল, গাড়ির আওয়াজেই বাইরে এসেছে৷
সিঁড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে উঠছি, উঠতে উঠতেই মনে হচ্ছিল একটা বোধহয় কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপকের বাড়ি নয়, কোনও চলচ্চিত্র-পরিচালক বা প্রযোজকের বাড়ি৷ চারদিকেই হিন্দি ছায়াছবির বিগত দিনের নায়ক-নায়িকাদের সুনির্বাচিত, উজ্জ্বল সব ছবি৷ ‘চৌধবী কি চাঁদ’-এর ওয়াহিদা রেহমানের ফোটোটির সামনে তো কয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়েই পড়তে হল, কারণ ফোটোগ্রাফিটি এতটাই ভাল এবং সযত্নে রক্ষিত৷ পরে, যখন আলাপ জমে উঠেছিল, তখন সহাস্যে সেই সিনেমা স্টারদের ছবিগুলোর কথা জিজ্ঞাসা করতেই অকৃতদার অধ্যাপক অকৃত্রিম হেসে বলেছিলেন— গান, বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি ওঁদেরও ভালবাসি, তা-ই ওঁরাও আছেন৷
সকালেই বেগম আখতার ও তাঁর মা মুস্তারিবাঈয়ের সমাধিস্থলে ‘সেলিম কিদওয়াই’ নামটা একাধিকবার সম্মানিত হতে দেখেছিলাম বলে প্রথম প্রশ্নটা সেই প্রসঙ্গেই হাজির করতে হল৷ সৌম্যদর্শন সেলিমভাই শান্তভাবে সেই প্রসঙ্গে যা বললেন—
‘অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে দিল্লি থেকে ফিরে আমি বেগমের মাজার-এর বাস্তবিক পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম৷ সেখানে একাধিক ছাগল চরে বেড়াচ্ছে, পাশে একটা নিমগাছও গজিয়েছিল৷ দিল্লিতে থাকার সময়ে শান্তি হীরানন্দজির সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, আমি ওঁকে পরিস্থিতির কথা বিশদভাবে জানাই৷ তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাদেরই কিছু একটা করতে হবে৷ আম্মিজির মাজার একটা নোংরা ফেলার জায়গায় পরিণত হবে, তা সহ্য করা সম্ভব নয়৷
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের স্ত্রী একদা শান্তিজির কাছে গান শিখতেন, শান্তিজি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন৷ সেই ২০০২-তেই কিছু আর্থিক অনুদান জোগাড় করার চেষ্টা শুরু করি৷ সেই সময়ে আমরা দিল্লিতে একাধিক সরকারি দপ্তরে হাজির হয়ে আমাদের প্রয়োজনের কথা জানিয়েছিলাম৷ শেষ পর্যন্ত ভারত সরকারের আর্কিওলজি দপ্তর থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করা হয়৷ কিন্তু আমাদের প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি৷ গোটা কাজটির জন্য মোট ১১ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে৷ তখন আমরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে কিছু টাকা একটা তহবিলে জমা করি৷ সেই কাজে শান্তি হীরানন্দ ছাড়া বেগম আখতারের আর একজন পুরনো ছাত্রী অঞ্জলি ব্যানার্জিও সাহায্য করেছিলেন৷ আমার বন্ধু পরাগ প্রধান মাজার-এর ডিজাইন করেছিল, আর্কিটেক্ট ছিলেন আশিস থাপার আর নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন এস কুকরেজা৷ আমাদের এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ‘সনৎ কাদা’ (Sanat kada) নামের এক সংস্থা, যারা লক্ষ্ণৌয়ের হেরিটেজ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য নানা ধরনের কাজ করে চলেছে৷ তারা এখনকার বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ছবি নিয়ে বাণিজ্যিক শিল্পকর্মে টাকা তোলার চেষ্টা করছে৷ তবে মোট খরচ হিসেবে যে ১১ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে, তার পুরোটা আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি, কিছু ধার এখনও রয়ে গেছে৷’
বন্যরা বনে চঞ্চল, প্রশ্নরা চিত্তপ্রদেশে৷ মানুষের আচরণগত বৈশিষ্ট্যে কখনও কখনও প্রায় অলৌকিক এবং বাস্তবের প্রশ্নে অবিশ্বাস্য এক সেতু নির্মিত হয়৷ এদেশে যা জনপ্রিয়, সেই সাংবাদিকসুলভ কৌতূহলে ‘স্টোরি’ চরিত্রের উত্তর পেরিয়ে এই সেলিম কিদওয়াই সাহেবের কাছেই সেইসব প্রশ্ন করতে সাহস পাওয়া গেল, যার উত্তর পাওয়ার জন্যই উত্তরপ্রদেশের কয়েকটা শহরে, বিশেষ করে লক্ষ্ণৌতে পৌঁছনো৷
মুস্তারিবাঈকে জীবনের একটা পর্বে প্রবল আর্থিক সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল৷ সুতরাং কন্যার গায়িকা হিসেবে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠাকে তিনিও কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন৷ সেটাই স্বাভাবিক ছিল৷ রামপুরের নবাব রাজা আলি খাঁ মেয়ে ও মা-কে রামপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ নিজের প্রাসাদে থাকার বন্দোবস্ত ছাড়া সেই আমলের হিসেবে বিশাল অঙ্কের টাকাও দিয়েছিলেন৷ শোনা যায়, নবাব নাকি আখতারিকে অস্থায়ী বিবাহের (‘মুতা’) প্রস্তাবও দিয়েছিলেন এবং ভালবেসে নাকি একটা সাতনরী হার (যার শেষ ধাপ নেমে যেত প্রায় হাঁটু অবধি এবং সেখানেই ছিল একটা বিশাল হীরকখণ্ড), হীরে বসানো আংটি ইত্যাদি ছাড়া বহু অলঙ্কার দিয়েছিলেন৷ সেই হার উপহার দেওয়া প্রসঙ্গে স্বয়ং নবাব নাকি একদা বলেছিলেন— দুনিয়ায় যদি এর চেয়েও দামি কিছু থাকে তাহলে সেটা আখতারির হাসি৷
কিন্তু কালের ঐতিহ্য অনুযায়ী রামপুরের সেই প্রাসাদে নবাবের বেগম ছিলেন একাধিক৷ তাছাড়া নবাবের আচরণে আখতারিদের বন্দী করে রাখার মতো ভাবভঙ্গিও প্রতিষ্ঠিত ছিল৷ সুতরাং ছলাকলায় অভ্যস্ত আখতারি রামপুরের সেই প্রাসাদ থেকে কৌশলে পালিয়ে এসেছিলেন, বহুমূল্যের সেই সব অলঙ্কার সমেতই৷ সেই সাতনরী হার-এর কাহিনী কিন্তু কেউ কেউ মানতে চান না৷ এই কথাও প্রচারিত যে, প্রধানত আইনের মাধ্যমে আত্মরক্ষার কারণেই আখতারিবাঈ ব্যারিস্টার ইস্তিয়াক আহমেদ আব্বাসিকে বিয়ে করেছিলেন৷ তবে কেউই আখতারি ও আব্বাসির প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে সন্দিহান ছিলেন না৷
ততক্ষণে একটা নিখুঁত আড্ডার পরিবেশ নির্মিত, সখ্যের অদৃশ্য সেতুও দুলছে৷ সামনে এসে হাজির পুরনো ছবি, এল পি রেকর্ডরাও৷ একই সঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের প্রসঙ্গ এসে পড়ায় হেসেই ফেললেন সেলিম কিদওয়াই৷ স্মৃতি হাতড়াতে হচ্ছিল তাঁকেও—
‘আমাদের বয়সের ব্যবধান ছিল অনেক, সুতরাং সব জানা সম্ভব নয়, আর প্রশ্ন করার সাহস ছিল না৷ তবে আমি স্বচক্ষে না দেখলেও সেই আমলে লক্ষ্ণৌয়ের কেউ কেউ সেই সাতনরী হার দেখেছিলেন৷ দামি অলঙ্কারের প্রতি একটা স্বাভাবিক টান আম্মিজির ছিল৷ তেমন অনুষ্ঠানে উনি রীতিমতো দামি অলঙ্কার পরেই যেতেন৷
আব্বাসি সাহেবকে বিয়ের প্রসঙ্গ একটা বাস্তবিক, জটিল অথচ স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনার ফসল৷ জীবনের নানা যন্ত্রণা, দুঃখ, বঞ্চনা বুদ্ধিমতী আখতারিবাঈকে অভিজ্ঞ করে তুলেছিল৷ রামপুরের নবাবকে আখতারি কিছুতেই বিয়ে করতে চাননি, কারণ তিনি জানতেন তাঁকেও বিয়ের কিছুদিন পরেই নবাব অনাগ্রহী হয়ে তাঁর অসংখ্য বন্দিনী বেগমের একজন করে রাখবেন৷ সেই কঠিন পরিস্থিতিতে আখতারি আব্বাসি সাহেবকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ লক্ষ্ণৌয়ের একাধিক অভিজাত পরিবারের যুবকই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে ব্যারিস্টার আব্বাসিকেই বেছে নিয়েছিলেন কারণ, তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ‘কোঠেওয়ালি’ ইমেজ থেকে মুক্ত হয়ে অভিজাত পরিবারের একজন— এই পরিচয় পেতে চাইছিলেন৷ আব্বাসি সাহেবকে বেছে নেওয়ার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণও ছিল৷ আব্বাসি অভিজাত, বুদ্ধিমান এবং সংস্কৃতিমান, আকর্ষণীয়ভাবে রূপবান৷ ব্যারিস্টার হিসেবেও সফল এবং উর্দু কবিতা সম্পর্কেও রীতিমতো অভিজ্ঞ৷ তাছাড়া ততদিনে আখতারি জেনে গেছেন তিনি দিব্যি রসিক মানুষ৷ তাঁর বাসস্থানও লক্ষ্ণৌ শহরের অভিজাত এলাকায় (হ্যাভলক প্লেস)৷
প্রেমময় সম্পর্কের আরও একটা-দুটো গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল৷ আব্বাসি ফারসিও জানতেন, ধ্রুপদী উর্দু কবিতা বিষয়ে বেগমকে পথ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে আখতারি জানতেন তিনিই প্রেমিক আব্বাসির একমাত্র পত্নীর সম্মান পাবেন, কারণ ব্যারিস্টারমশাইয়ের প্রথমা স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন৷ প্রাথমিকভাবে একজন কোঠেওয়ালির এমন সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়াতে কোনও ভুল ছিল না৷’
ততক্ষণে কফি ইত্যাদিরা সযত্নের পরিবেশনে সামনের নিচু টেবিলে হাজির৷ কিন্তু পৃথিবীর যে-কোনও উৎসুক শ্রোতারও মনে মনে হারিয়ে যাওয়ার অধিকার আছে৷ কিদওয়াই সাহেবের উত্তরের মধ্যে দুটো শব্দ কোথাও যেন মৃদু ধাক্কা দিয়ে গেল৷ আমিনাবাদ যাওয়ার পথে পুরনো লক্ষ্ণৌয়ের কোঠেওয়ালিদের পাড়া দিয়েই যেতে হয়৷ কিন্তু এই ২০১৫-তে শেষ জুন-এর সকাল-দুপুর-বিকেলে তাঁরা দৃশ্যমান ছিলেন না৷ কিন্তু এ কথা এখনও সত্য, তাঁদের অস্তিত্ব লক্ষ্ণৌয়ের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ একাধিক ঐতিহাসিক ও পর্যটকদের কথাকে সত্যের মতো সামনে তুলে ধরে একদা শ্রীপান্থ লিখেছিলেন:
‘মাথায় কারও কাপড় নেই৷ সবার মাথাভর্তি কালো চুল৷ বিনুনি নেমে গেছে পিঠ বেয়ে কোমরের দিকে৷ ফাঁকে ফাঁকে জড়োয়ার ঝিকিমিকি৷ প্রায় সকলেই নাকে নথ (বেগম আখতারের নাকের নথে হীরের ঝিলিক কে ভুলতে পারবেন!) মুখের এক কোণে তা ঝুলে আছে৷ কানের দুল প্রায় কাঁধ ছুঁইছুঁই৷ ওদের মধ্যে খুব কমই যথার্থ সুন্দরী আছে৷ কিন্তু প্রত্যেকেরই দৃষ্টি মর্মভেদী৷ কাজলের রেখা তাদের চোখগুলোকে আরও আয়ত, আর কালো এবং টলটলে করে তুলেছে৷… তাদের নূপুরনিক্বণে-লক্ষ্ণৌ ঝঙ্কৃত৷’
সম্ভবত সকলেই জানেন একই সঙ্গে ডাকসাইটে সুন্দরী, নৃত্যপটিয়সী ও গায়িকা; ‘আদা’ ছদ্মনামে যিনি ‘শায়েরি’ লিখতেন সেই উমরাও জান, তিনি নবাব ওয়াজিদ আলি শা-র সময়েই লক্ষ্ণৌতে থাকতেন৷ সুতরাং আসা-যাওয়ার পথের ধারের যেখানে সেই নবাব ওয়াজিদ আলি শা-র প্রাসাদটিতে গিয়ে আমাদেরও বেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয়েছিল৷
এবং যেহেতু লক্ষ্ণৌ কবিতা-পাগল শহর, সেজন্য স্বল্পশিক্ষিতা আখতারিবাঈ মর্মে মর্মে উর্দু কবিতার অন্তরতর অর্থ ও আলফাজ সম্পর্কে উপলব্ধির প্রশ্নে আন্তরিকভাবেই আগ্রহী ছিলেন৷ তাঁর নিজের ছাত্রীদেরও গজলের অর্থ বুঝে নিয়েই নিখুঁত উচ্চারণে গাইবার চেষ্টা করতে পরামর্শ দিতেন৷ সুতরাং এই আখতারিবাঈ আব্বাসির মতো একজন প্রকৃত সমঝদারের প্রতি বাড়তি আগ্রহ দেখাবেন তাতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না৷
সেলিম নিজে উর্দু ভাষা-সাহিত্যের একজন রসিক পণ্ডিত৷ দীর্ঘদিন বেগমের সঙ্গে ঘোরাফেরা করেছেন৷ উভয়ের মধ্যে আলোচনাও হয়েছে বিস্তর৷ সুতরাং বেগমের এই দিকটার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়াটাই স্বাভাবিক৷
সেলিম কিদওয়াই বলে চলেছেন—
‘সেই বিয়েটা অতি দ্রুত এবং গোপনে সেরে ফেলতে হয়েছিল৷ কারণ শুধু প্রেমিকের উপহার হিসেবে দেওয়া অলঙ্কারগুলোর জন্যই তাঁকে বিয়ে করার জন্য রামপুরের নবাব তাঁকে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন—এটাই একমাত্র কারণ বোধহয় নয়৷ সুতরাং এমন প্রবল মানসিক চাপ সামলানোর ক্ষেত্রে একজন ডাকসাইটে আইনজীবীর চেয়ে ভাল পাত্র আর কে হতে পারতেন?’
চমৎকার কফি, কিন্তু তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া যাচ্ছিল না, তার প্রত্যক্ষ কারণ পরের প্রশ্নগুলির অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি৷ লক্ষ্ণৌ শহরে নিজেদের পছন্দমতো বাড়ি নির্মাণ করেছেন, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার উচ্চস্তরেও পৌঁছে গেছেন, সেই তখনও কি মা-মেয়ের আর্থিক সঙ্কট ছিল?
সহজ ও আন্তরিকতার সঙ্গে সেলিম সাহেব বললেন— ‘একেবারেই ছিল না৷ দামি মোটরগাড়িও চড়তেন তখন৷ বেগমের মা মুস্তারিবাঈয়ের তীক্ষ্ণ ‘ম্যানেজারিয়াল ট্যালেন্ট’ ছিল৷ তিনিই উদ্যোগ নিয়ে লক্ষ্ণৌ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটা বাড়ি কিনেছিলেন এবং সেইসব বাড়ি থেকে নিয়মিত ভাড়াও পেতেন৷ পরে অবশ্য, বিশেষ করে ১৯৫০-এ মুস্তারিবাঈ মারা যাওয়ার পর সেইসব সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যায়৷ দেখাশোনা করার কেউ ছিল না৷ কারণ বেগম তো ততদিনে সত্যিকারের বেগম আখতার হয়ে সযত্নে সংসার করছিলেন আব্বাসি সাহেবের হ্যাভলক প্লেসস্থিত বাংলোয়৷’
শুধুই বাঙালিরা নয়, রেগে গেলে অবাঙালি ভদ্রলোকবৃন্দও দিব্যি উত্তেজিতকণ্ঠে ইংরেজি বলতে থাকেন৷ মাঝে মাঝে বলা হিন্দি তখন উধাও৷ যাই হোক, প্রশ্নের প্রসঙ্গে উচ্চারিত মনোহরণ গপ্পোর সঙ্গে বাস্তবিক যুক্তি-তক্কোর হৃদ্যতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ার কথাও নয়৷ সুতরাং সেলিমভাইকে জিজ্ঞাসা করতেই হল— সে ভদ্রলোক নিজে উচ্চতমমানের সঙ্গীতরসিক, আখতারির গানের টানে প্রায় নিয়মিত চায়না বাজারের ‘আখতারি মঞ্জিল’-এ পৌঁছে যেতেন (কিদওয়াই সাহেবের ভাষায়— ব্যারিস্টার আব্বাসিও ওয়ান অফ দি রয়্যাল শুটার্স) সেই তিনিই কী করে উভয়ের বিয়ের পর আখতারিকে প্রায় বন্দী রেখে গান গাইতে না দিয়ে দিনরাত কাটাতে পারেন, সত্যটা কী?’
সৌজন্যের প্রতিমূর্তি সেলিম সামান্য উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করলেন—
‘আই থিংক দিস ইজ আ স্টোরি দ্যাট ওয়াজ রোম্যান্টিক্যালি ইনভেন্টেড৷ অ্যান্ড বেগম আখতার ওয়েন্ট অ্যালং উইথ দ্য স্টোরি৷’
সত্যিই খুব অকর্ষণীয় গল্প এবং তা শ্রোতা বা পাঠকদের আকর্ষণ করার জন্যই নির্মিত হয়েছিল৷ সেলিম কিদওয়াই যা বললেন তার বিশুদ্ধ বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়—
শুরু থেকে শেষ অবধি গল্পটা নাটকীয় ঘটনার উদাহরণ হিসেবে দারুণ৷ একটা গান গাওয়া নাইটেঙ্গল পাখিকে একটা খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছে৷ এবং নিষ্ঠুর কাণ্ডের জন্য স্বয়ং আব্বাসি ও তাঁর অভিজাত পরিবারের সদস্যরাই দায়ী ইত্যাদি ইত্যাদি৷ কিন্তু গোটা কাহিনীটাই মিথ্যে এবং সযত্নে সাজানো৷ এবং এটা একটা যুক্তিহীন, হাস্যকর ভাবনা৷ কারণ, আব্বাসি সাহেব স্বয়ং তাঁর বেগমের গানের বিশেষ রকমের ভক্ত, সেই আকর্ষণেই তাঁদের প্রেম ও বিয়ে৷ আমরা জানি সত্যির আসল চেহারাটা ঠিক কী৷ একটা ধনী ও সত্যিকারের অভিজাত পরিবারের কর্ত্রী হিসেবে সংসার সামলেও মাঝে মাঝে তাঁদের বাড়িতে আয়োজিত গানবাজনার অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিতই গাইতেন৷ একদা আব্বাসি সাহেব উত্তরপ্রদেশের একটা গ্রামের জমিদারও ছিলেন বলে শুনেছি৷ সেই সময়ে লক্ষ্ণৌয়ে একজন ‘শরিফ উওম্যান’-এর জীবনযাপনের স্টাইল বেগম বেশ ভালই আয়ত্তে এনেছিলেন৷ নিজের বাড়িতে আব্বাসি সাহেবের বন্ধুবান্ধবদের সামনে কিন্তু তিনি প্রায় নিয়মিতই গাইতেন৷
তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী বেগম আখতার নিজেই বুঝেছিলেন অভিজাত পরিবারের কাউকে বিয়ে করার অর্থ তাঁর বাঈজি-জীবনের মহফিল-এ গাওয়ার সমাপ্তি ঘটানো৷ এবং আব্বাসি সাহেব নিজে কক্ষনো তাঁর বেগমকে গান গাইতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি৷ আরও একটা কারণ আছে, ততদিনে যথেষ্ট অভিজ্ঞ বেগম জানতেন লক্ষ্ণৌতে কোনও অনুষ্ঠান হলে তিনি আব্বাসি সাহেবের বেগম হিসেবে কোথাও কোনওরকম পয়সাকড়ি চাইতে পারবেন না৷ সুতরাং প্রচারিত গল্পটাকে তিনিই বেঁচে থাকতে দিয়েছিলেন৷
কিন্তু তাতে তাঁর জনপ্রিয়তা ও অসংখ্য আমন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ে কোনও সমস্যা তৈরি হয়নি?
‘হতে পারত৷ এবং বেগম জানতেন লক্ষ্ণৌতে কোনও অনুষ্ঠান বা মহফিল-এ গাইতে শুরু করলে কাউকেই ‘না’ বলতে পারবেন না৷ শুধু তা-ই নয়, পেশাদার শিল্পী হিসেবে তিনি সেখানে কোনওরকম আর্থিক শর্তও আরোপ করতে পারবেন না৷ মায়ের মৃত্যু এবং তাঁর নিজের শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদিতেও, তাঁর গায়িকা-জীবনে বাধা পড়েছিল৷ পরে তিনি শুধু লক্ষ্ণৌয়ের রেডিও স্টেশনে গাইতেন৷ এবং রেকর্ড কোম্পানিগুলো সেই সময়ে তাঁর অনেক আগে গাওয়া ৭৮ আর পি এম-এর গানগুলো নিয়েই নতুন রেকর্ড হিসেবে ই পি ও এল পি প্রকাশ করতে থাকে৷ কারণ, গোটা দেশ জুড়ে তাঁর গানের রেকর্ডের সর্বদাই বিরাট চাহিদা ছিল৷ আমি নিশ্চিতভাবে জানি, কোনও রেকর্ড কোম্পানি যদি সেই সময়ে তাঁকে নতুন গান গাওয়ার জন্য বাণিজ্যিক প্রস্তাব দিত, তাহলে তিনি তা সানন্দেই গ্রহণ করতেন৷ সমকালীন উর্দু কবিদের এবং সুরকারদের সঙ্গে তাঁর একেবারে ইয়ার-দোস্তের মতো সম্পর্ক ছিল৷ তিনি নিজেও একজন এক্কেবারে প্রথম শ্রেণীর সুরকার ছিলেন৷ গজলের জন্য উপযুক্ত উর্দু কবিতা নির্বাচনের প্রশ্নে আব্বাসি সাবকে চোখ বুজে দায়িত্ব দেওয়াতেও কোনও সমস্যা ছিল না৷’
— আপনি বললেন, আমিও জেনেছি ওঁর স্বামী লক্ষ্ণৌতে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার হওয়া ছাড়া উত্তরপ্রদেশের একটা অঞ্চলের নবাব (মতান্তরে জমিদার) ছিলেন৷ তাহলে তাঁর হঠাৎ এমন আর্থিক সঙ্কট হয়েছিল কেন?
— এই প্রশ্নের একেবারে নির্ভুল উত্তর আমিও জানি না৷ তবে এই অর্থনৈতিক সমস্যা শুরু হয়েছিল বেগমের বিবাহিত জীবনের পনেরো-ষোলো বছর পর৷ আব্বাসি সাহেব রিটায়ার করেছিলেন৷ ওঁদের দুজনকেই বহু আত্মীয়স্বজনকে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই বাঁচিয়ে রাখতে হত৷ সুতরাং পরিস্থিতিগত কারণে বাধ্য হয়ে বেগমের লক্ষ্ণৌতে নয়, দেশের অন্যত্র অর্থাৎ বোম্বে, হায়দরাবাদ, দিল্লি, কলকাতা— সর্বত্র অনুষ্ঠানে যাওয়া শুরু করতেই হয়েছিল৷’
সত্যেরও নির্ভুল স্বরলিপি থাকে, কোথাও তা আঘাতে বেজে উঠলেই চরমরসিক জীবনমশাই সামনে এসে দাঁড়ান৷ যে-পরিবেশ ও পরিস্থিতি থেকে আখতারিবাঈ থেকে তিনি খ্যাতি ও বাহ্যিক প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পেরেছিলেন, যাঁর গায়ে প্রায় সর্বদা বহুমূল্যের অলঙ্কার ঝলমল করে, তাঁর কি কখনও কোনও আর্থিক সঙ্কট থাকতে পারে? কেউ বিশ্বাস করবে না, করেওনি৷
লক্ষ্ণৌয়ের আমিনাবাদে খুব স্বাভাবিক কৌতূহলে আরশাদ খানের কাছে প্রশ্ন করে মডেল হাউস এলাকায় তাঁর মায়ের কাছে গিয়েছিলাম৷ সেই নাসিম আখতার এখন বৃদ্ধা, কিন্তু স্মৃতিশক্তি হারাননি৷ (একটু দূরে সোফায় বসে থাকা আক্রামভাই অবশ্য একটি কথাও বলেননি, শুধু শুনেছেন) নাসিম আখতার বলেছিলেন—
আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম, সেই ১৯৪৫-এ (অন্যত্র পাওয়া তথ্যে বলা হয়েছে আখতারি ও আব্বাসির বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৪-এ) ‘আমার বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর৷ আমি ‘মৌসি’ বলে ডাকতাম৷ আমার গানবাজনায় তেমন আগ্রহ ছিল না বলে ওঁর কাছে গান শিখতে যাইনি৷ কিন্তু উনি শুধু আমাকেই নয়, আমাদের যত আত্মীয়স্বজনের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছিল, উনি সব্বাইকে খুব ভালবাসতেন৷ কাছে গেলে মিঠাই খাওয়ার পয়সাভি দিতেন৷ ওঁর যে জুড়ুয়া বহিন ছিল, তাকে সাপে কামড়েছিল (এটাও বিতর্কিত তথ্য) বলে সে ছোট্ট বয়সেই মারা গিয়েছিল, ফৈজাবাদে৷ আমি বড় হলে ওঁর সঙ্গেই অনেক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম৷ যেমন— হায়দরাবাদ, আফগানিস্তান, দিল্লি, বম্বে— সব জায়গায় গিয়েছিলাম৷ সঙ্গে ওঁর একজন ছাত্রীও যেতেন, তাঁর নাম ছিল শান্তি, শান্তি হীরানন্দ৷ আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন মৌসির কাছ থেকে হর মাহিনা টাকাপয়সা সাহায্য পেত৷ বিশেষ করে যাঁরা খুব গরিব, সেই সব আত্মীয়ের ছেলেমেয়েদের বিয়েতে উনি টাকা-গয়না দিয়ে সাহায্য করতেন৷ সব সময়ে হাসিমুখের মহিলা ছিলেন৷ নিয়মিত নমাজ পড়তেন৷ আমি— আমরা কখনও ওঁকে কারও সঙ্গে ঝগড়া বা উঁচুগলায় কথা বলতে দেখিনি বা শুনিনি৷’
নাসিম আখতারিকে তার বক্তব্য নিয়ে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই৷ সেই মধ্যচল্লিশের দশক ও পঞ্চাশের দশকে বেগম সত্যিই কোনওরকম আর্থিক দৈন্যে ছিলেন না৷ আবার ষাটের শুরুতেই তাঁর খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার ফুলও যেন আকারে-সৌন্দর্যে আরও বিকশিত হয়েছিল৷ ১৯৬৩-তে তিনি ‘পদ্মশ্রী’ হয়েছিলেন৷ সুতরাং সেলিম কিদওয়াইয়ের বক্তব্য একেবারে বাস্তবিক যুক্তিতেই প্রতিষ্ঠিত৷ মানুষ স্বভাবগতভাবে অভ্যাসের দাস, সেটা কু-অভ্যাসের মতো সু-অভ্যাসের ক্ষেত্রেও সত্য৷ এবং প্রতিষ্ঠিতদের বাইরের ঠাট-বাটদেরও সেই পরিস্থিতিতে রক্ষা করে চলতেই হয়৷ ব্যক্তিজীবন থেকে বাইরের জীবন পর্যন্ত তা বজায় রাখার চেষ্টা করতে বাধ্য ছিলেন পদ্মশ্রী বেগম আখতার৷
অন্য কোনও ঘটনা ছিল কিনা জানতে সেলিম ভাইকে আবার প্রশ্ন করতে হল৷
—সেই তীব্র প্রয়োজনের সময়েও লক্ষ্ণৌতে পেশাদার শিল্পী হিসেবে না-গাওয়া বা না-গাইতে চাওয়ার কারণ তাহলে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা নয়?
‘একেবারেই না৷ উনি জানতেন লক্ষ্ণৌয়ের কোনও প্রাইভেট ম্যহফিল বা মিউজিক্যাল ফাংশন-এ তিনি কারও কাছ থেকেই তাঁর প্রাপ্য চাইতে পারবেন না৷ আব্বাসি সাহেবের বেগম পাবলিক মিউজিক্যাল সয়েরি-তে টাকার বিনিময়ে গাইছেন— সেটা তখন অকল্পনীয় ছিল৷ এবং একটি অনুষ্ঠান করলেই তাঁকে সব অনুষ্ঠানেই যেতে হবে৷ সেই পরিস্থিতিতে কাউকে ফেরানো যাবে না৷ যে-কথা আপনাকে আমি আগেই বললাম৷’
—অভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশনে তাঁর সেই বিখ্যাত ছ-মাত্রায় বাঁধা পূর্বী দাদরা—’কোয়েলিয়া মাত কর পুকার’, যেটা তিনি বাংলায় গাওয়া-সহ, নিজেই একাধিকবার রেকর্ড করেছিলেন, সেটা দিয়েই নাকি তাঁর নতুন করে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল— এই ঘটনা কতদূর সত্যি?
‘প্রায় পুরোটাই সত্যি৷ কারণ, তাঁর জীবনের নানা পর্বের নাটকীয় ঘটনার মধ্যেও লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশনের সম্পর্ক একেবারে অবিচ্ছেদ্য ছিল৷ রেডিওতে তাঁর বিখ্যাততম দাদরা হিসেবে ‘কোয়েলিয়া মাত কর পুকার’ গাওয়ার পর গোটা দেশই বিস্ময়করভাবে আলোড়িত হয়েছিল৷’
বেগম নিজেও তা জানতেন এবং গানটাকে বোধহয় উনি আলাদা করে ভালবাসতেন৷ নানা সময়ে গাওয়াটা তারই প্রত্যক্ষ ফল৷’
—১৯৫০-এ মুস্তারিবাঈয়ের মৃত্যু বেগম আখতারকে নাকি বিষাদ-সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিল৷ তিনি সব ভুলে থাকার জন্য মদ্যপান-সহ একাধিক আচ্ছন্ন করে রাখার ওষুধ খেতে শুরু করেছিলেন— এই সব কাহিনী কতদূর সত্যি, কীভাবে পরে এইসব নেশা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন?
‘মুস্তারিবাঈয়ের মৃত্যু বেগমকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ জীবনের একাধিক নাটকীয় বিপর্যয়ে মা-মেয়ে একই সঙ্গে লড়াই করতে করতে প্রায় ঘনিষ্ঠতম বন্ধুত্বে পৌঁছেছিলেন৷ মুস্তারির দুঃখময় জীবন একদা আখতারিকে যেমন সতর্ক করেছিল, তেমন সেই দুঃখ ভুলতেও দেয়নি কক্ষনো৷ মানসিক বিষাদই শুধু তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিল না, তাঁর ইউটেরেসে একটা বড় টিউমার তাঁকে অসহ্য যন্ত্রণা দিত৷ সেই তীব্র বেদনা থেকে মুক্তির জন্য তিনি পেথিডিন ইনজেকশন নিতেন এবং তার প্রতি যথারীতি আসক্তিও তৈরি হয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত বম্বেতে গিয়ে অস্ত্রোপচারের পর তিনি সুস্থ হয়েছিলেন৷ মদ্যপানের নেশা থেকে তিনি নিজেই মুক্ত হন৷ অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী ও দৃঢ় মানসিকতার মানুষ ছিলেন৷ তবে সেই অসুস্থতার সময়ে রেওয়াজ ও গান না করতে পারার দুঃখও ছিল৷’
—রেকর্ড করার প্রসঙ্গে ফিরতে চাইছি৷ কবে আবার তাঁর নতুন রেকর্ড প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল?
‘ওই মধ্য-ষাট বা ঠিক তার আগে রেকর্ড কোম্পানিগুলো বেগমের পুরনো বিখ্যাত গানগুলো যেমন— ঠুমরি-দাদরা-গজল মিলিয়ে ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায়’, ‘ছা রহি কালি ঘটা’, ‘কোয়েলিয়া মাত কর পুকার’— এইসব গান থাকা সেই লং প্লেয়িং রেকর্ডগুলো ভালই বিক্রি হচ্ছিল৷ কিন্তু তাঁর রেকর্ড বিক্রিতে একধাক্কায় বন্যা আসার মতো ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৮-তে৷ সেই বছর ছিল মির্জা গালিব-এর জন্মশতবর্ষ৷ গ্রামোফোন কোম্পানি বেগমকে সেই বছরে গালিবের গান রেকর্ড করার অনুরোধ করলে তিনি রাজি হন এবং সেই রেকর্ডটি গোটা দেশেই লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল৷ আমার মনে হয় ক্লাসিক্যাল ও লাইট ক্লাসিক্যাল শিল্পীদের মধ্যে তাঁরই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক এল পি রেকর্ড বেরিয়েছিল এবং বিক্রিও হয়েছিল৷ এই সাফল্য ও সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠান করে বেড়ানো তাঁকে আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্তি দিয়েছিল৷’
—এমন একটা কথাও শোনা যায়, তিনি নাকি তেমন শ্রোতাদের সমাগম ঘটলে, যাঁরা নাকি টাকার অহঙ্কার দেখাতেই গানের আসরে হাজির হতেন, তাঁদের সামনে গান গাইতে পছন্দ করতেন না?
‘আপনিই আমাকে বলুন, কোন শিল্পী বেরসিক, অনাগ্রহী শ্রোতার সামনে গান গাইতে চান? তবে হ্যাঁ, একথা নিশ্চয়ই সত্যি যে শিল্পী হিসেবে বেগম আখতার একজন বিরল শ্রেণীর প্রতিভাময়ী, ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতার অধিকারিণী, কিন্তু তাঁরও টাকার দরকার ছিল৷ বেগম আখতার প্রসঙ্গে এই কথাটা আপনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তিনি তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একজন ‘ওয়ার্কিং লেডি’৷ একটা বিশাল পরিবার ও অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবেই তাঁর ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের জন্য তিনি আর্থিক উপার্জনে বাধ্য ছিলেন৷
তাঁর জীবনকাহিনীর এই বেদনার্ত অন্য অধ্যায়টাও আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি৷ সেই ১৯৭৪ সালের জুন মাসেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ অথচ যে অক্টোবর (১৯৭৪) মাসের ৩০ তারিখে তিনি ওই হৃদরোগেই মারা গিয়েছিলেন, সেই অক্টোবরেই তিনি তিন-তিনটি অনুষ্ঠান করেছিলেন, বা আরও সরাসরি বললে, করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷
তবে আপনার প্রশ্নটা অর্থহীন বা এমন কোনও ঘটনা কখনও ঘটেনি— এমন নয়৷ তবে কোনও শিল্পীই তাঁর শ্রোতাদের পছন্দ করে কোনও সঙ্গীতের আসরে বসতে দিতে পারেন না৷ শিল্পীদের প্রতিভারও অনেকগুলো দিক থাকে৷ বেগম আখতারের আত্মবিশ্বাস, স্টেজে বসে অনায়াসে শ্রোতাদের মন জয় করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা, মিডিয়াকে নিজের ইচ্ছেমতো প্রভাবিত করার দক্ষতা এবং পরিস্থিতি জয় ও রঙ্গরসিকতা করার মতো তাৎক্ষণিক বুদ্ধি-বিবেচনার পরিচয় দেওয়া— এসবই তাঁর মধ্যে ছিল৷ বলা যায়, কণ্ঠ ও গায়কির দক্ষতার মতো এগুলোও তিনি অর্জন করেছিলেন৷
একবার এই লক্ষ্ণৌতেই একটা অনুষ্ঠানে একেবারে সামনের দিকের আসনে বসে এক ভদ্রমহিলা ঘুমোচ্ছিলেন এবং তাঁর পতিদেবতাই সেই অনুষ্ঠানের একজন বড় বিজ্ঞাপনদাতা৷ মঞ্চে গাইতে গাইতে বেগম সেটা লক্ষ্য করেছিলেন৷ কিছুদিন পরেই আবার একটা প্রায় ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এসেছেন, তাঁকে দেখেই বেগম বলে উঠেছিলেন (সেদিনও যথারীতি তিনি একেবারে সামনের আসনগুলোর একটায় বসেছিলেন)— ‘দেখুন মিসেস অমুকচন্দ্র অমুক, আপনি তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বেন, সুতরাং ওই পেছন দিককার একটা আসনে গিয়ে বসুন, আপনার ঘুমোতে সুবিধা হবে৷’ আমিও ব্যক্তিগতভাবে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম৷ সুতরাং ঘটনাটি আজও পরিষ্কারভাবে মনে আছে৷’
—জীবনের নানা সময়ে নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক যন্ত্রণা ছাড়া বেগম পরিস্থিতিগত দুর্ঘটনায় জর্জরিত ছিলেন৷ বাইরের আড়ম্বর পেরিয়ে মানুষ বেগম আখতার কীভাবে এইসব সহ্য করেছিলেন? যেহেতু আপনি তাঁর খুব কাছের মানুষ তাই…
‘অসম্ভব লড়াকু চরিত্রের ব্যক্তিত্ব ছিলেন৷ নাটকীয় জীবনের নানা অধ্যায়ে দুঃখ, যন্ত্রণা সহ্য করতেই যেন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন৷ প্রচারিত আছে তাঁর একবার টিবি-ও হয়েছিল, কিন্তু সেটা সবৈর্ব মিথ্যে৷ কিন্তু পঞ্চাশের শুরুতে তিনি যে গান করতে পারতেন না, তার প্রধান কারণ ছিল শারীরিক৷ অসহ্য যন্ত্রণায় দিন-রাত কাটাতেন৷ এ ঘটনা আপনাকে আগেই বলেছি, সারাজীবন তিনি শুধু গানই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি ও শারীরিক যন্ত্রণা তাঁকে নিরবচ্ছিন্নভাবে গান করতে দেয়নি৷’
লক্ষ্ণৌ থেকে চলে আসার সময় একাধিক সজ্জনের স্মৃতি মনের মধ্যে ঘুরে ম্ভ্রেবড়াচ্ছিল৷ অনেক কথা শোনা হল, তবু কত কথা বাকি থেকে গেল! কেউ যদি ভালবেসে এই কবিতার, স্মৃতিসৌধের, নূপুরের ছন্দের এবং প্রায় সর্বত্র বেজে ওঠা সারেঙ্গির বুক চিরে দেওয়া সুরের লক্ষ্ণৌকে ভালবেসে ফেলতে পারেন, তাহলে সেই তিনিও বুঝতে পারবেন স্বয়ং মির্জা আসাদুল্লা খান গালিব কেন লক্ষ্ণৌয়ের নাম দিয়েছিলেন— ‘পুবের বাগদাদ’৷ ‘আখতার’ ও ‘আখতারি’ শব্দ দুটোর সঙ্গেও যেন শহরটার যুগ-যুগান্তরের সম্পর্ক৷ নইলে নবাব ওয়াজিদ আলি শা-র এক বেগম ‘আখতার মহল’-এ অন্তরস্থিত ভালবাসাময় বন্দী নবাবকে প্রত্যহ খানা আর পাঁচটা করে পান পাঠাবেন কেন? নবাবও নিজের পরিচয় দিতেন কবি ‘আখতার’ হিসেবে৷
৭
সাধারণ, নিতান্তই সাধারণ মানুষের নিজস্ব কাণ্ডজ্ঞান ও ধ্যানধারণা নির্মিত হয় নানাভাবে৷ এবং তার অনেকটাই ওই শুনে শুনে৷ সেই অকাট্য যুক্তিতে ‘পড়া’-র সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্কে উচ্চারিত হয়— ‘শোনা’৷ এবং এদের অঘোষিত প্রভু হচ্ছেন শ্রীযুক্ত ‘স্মৃতি’৷ তা এখন এইসব ইয়ার্কি-ফাজলামি থাক, আমাদের ‘ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস’ এখন বেনারসে পৌঁছচ্ছে৷ ওই পড়াশোনা-র কোথাও কেউ জানিয়েছিলেন— ইউরোপের পূর্বপ্রান্ত থেকে একেবারে জাপানের প্রশান্ত সাগরের তীর পর্যন্ত সুদীর্ঘ দূরত্বের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো শহর হচ্ছে দুটি৷ প্রথম ইস্তাম্বুল এবং দ্বিতীয়টি বেনারস৷ তা হবেও-বা৷ কারণ শহরের একপ্রান্ত দিয়ে ঘুরে, দুর্ভেদ্য ট্রাফিক জ্যাম সহ্য করে গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলের কোনও হোটেলের খোঁজ করতে করতেই ধর্মপ্রাণ শহর বেনারসের প্রাচীনত্ব মালুম হচ্ছিল৷
কলকাতায় ফেরার পথে বেনারস কেন— এই সহজ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আবার লক্ষ্ণৌতে ফিরতে হবে৷ বেগম আখতারের বেনারস ঘরানা-স্টাইল প্রভাবিত ঠুমরি ও দাদরা সম্পর্কিত কৌতূহলের প্রশ্নরা যাতে অনাথ হয়ে না ঘুরে বেড়ায়, সেটাই কারণ৷ কিন্তু সমস্যারা আবার এসেছে ফিরিয়া৷ যাব কোথায়, কার কাছে? ফোন করতে হল লক্ষ্ণৌয়ের সেই কে কে শ্রীবাস্তব সাহেবকে৷ তিনিই তো অসহায়-পালন সমিতির অবৈতনিক সভাপতি৷ সহজাত কৌতুকে বললেন— ‘একশো বছর তো, অনেকটা লম্বা সময়৷ সিদ্ধেশ্বরী দেবী রসুলন বাঈ তো আর নেই…৷ আপনি একমাত্র ছান্নু মহারাজের কাছে যেতে পারেন৷ তাঁরও বয়স হয়েছে, তা আশির মাঝামাঝি তো হবেই, এখনকার বনারসে একমাত্র উনিই কিছু বলতে পারবেন৷’
তা নিশ্চয় পারবেন, কিন্তু ওঁর কাছে পৌঁছব কী করে! বিদেশ-বিভুঁই-এ খবরের কাগজের লোককে অন্য আখবরওয়ালারা না দেখলে কে দেখবে— এই চিত্তপ্রিয় বাণী মনে রেখে হিন্দি ‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এর দপ্তরে পৌঁছে গেলাম৷ এই যোগাযোগের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ফোটোসাহেব আকবরওয়ালা অর্থাৎ কুমার রায়ের৷ দশাশ্বমেধ ঘাটের সামান্য আগে একজন বস্ত্রব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা গেল কুমারসাব-এর পুরাতন প্রেম৷ সেই সম্পর্কের পরোক্ষ সাহায্যে আমরা হিন্দুস্তান টাইমস-এর নিউজ এডিটর রজনীশ ত্রিপাঠীর কাছে পৌঁছে গেলাম৷ সেই দপ্তর জগৎগঞ্জ-এ৷ সেখান থেকেই পাওয়া গেল স্থানীয় প্রবীণ সাংবাদিক অমিতাভ ভট্টাচার্যের ফোন নম্বর৷ তিনি নাকি প্রায় সব বিষয়েই বিস্তর খোঁজখবর জানেন৷ তা তিনি সাদর-সৌজন্যে ফোন ধরলেন এবং জানালেন ছান্নু মহারাজ এখন বোধহয় সোনিয়া এরিয়ায় থাকেন৷ এবং তাঁর পুত্র কুমারলাল মিশ্র তবলা বাজান৷ কিন্তু ওই ‘বোধহয়’-নির্ভর হয়ে একটা সুপ্রাচীন শহরের গলিতে গলিতে ঘোরা যায়? বিশেষ করে বেরসিক বৃষ্টি যখন কাজকম্মের লগ্ন না-বুঝে যখন-তখন ভিজিয়ে দিচ্ছে!
কিন্তু কর্তব্য কঠোর বড়৷ পথে নেমেই দেখলাম আকাশের মুখ গোমড়া৷ সামনে কোনও বড় মাঠ নেই, কতিপয় প্রৌঢ় বা বৃদ্ধরাও হেঁটে বেড়াচ্ছেন না৷ রাস্তাটা চরিত্রের গলির সেজদা৷ অতএব বাবুজিদের ধীরে না চলে কোনও উপায় ছিল না৷ কিন্তু ওই যে, ধর্মপ্রাণ মানুষদের চরণধূলিতে নিয়মিত পবিত্র হওয়া বেনারস তো! হঠাৎই একটি ক্ষিপ্রচক্র স্কুটার যেন ইচ্ছে করেই সামনে এসে দাঁড়াল৷ আরোহী যে-ই হোন না কেন, তাঁকে প্রশ্ন করতে কোনও বাধা নেই—
—আচ্ছা, ছান্নু মহারাজ ঠিক কোথায় থাকেন জানেন? সেটা কি সোনিয়া এরিয়ায়? কীভাবে সেখানে পৌঁছব?
বিশুদ্ধ হিন্দিতে সেই পরিত্রাতা মৃদু হেসে বললেন, তিনিও কিছু কিছু বাংলা বলতে পারেন এবং তিনি পেশায় একজন তবলিয়া৷ ছান্নু মহারাজের পুত্র তবলাবাদক কুমার মিশ্র তাঁর বিশেষ পরিচিত এবং তিনি দীপক মিশ্র৷
বাধ্য হয়ে তাঁকে সবিনয়ে থামিয়ে মনে করিয়ে দিতে হল— আমাদের শ্রদ্ধেয় ছান্নুলাল মিশ্র মহারাজ থাকেন ঠিক কোন অঞ্চলে—
—হাঁ হাঁ, আপনি কি কবীর চৌরাহ চেনেন?
বলতে হল আমি নবাগত, আমি যে পথ চিনি না৷
সহজ পরামর্শে উনি জানিয়ে দিলেন সেই হোটেলের সামনের রাস্তা থেকে সোজা এগিয়ে গিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের চৌরাহতে পৌঁছে বাঁদিকে ঘুরে একটু এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে ঘুরে, এগিয়ে গিয়ে কিসি কো পুছ লেনা…৷ আউর হাঁ, কার ইয়া অটো মত লেনা, রিকশা আচ্ছা রহেগা— কবীর চৌরাহকে পাস…৷
একেবারে ঘুমড়ি বা মামার বাড়ির জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল, রিকশাওয়ালার কাছে ওই ‘কবীর চৌরাহ’ বলে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে অকুস্থলে পৌঁছে অসংখ্য প্রশ্ন করতে হবে৷ দীপক মিশ্রজির সঙ্গে আমার আন্তরিকভাবে উচ্চারিত খাঁটি রাষ্ট্রভাষা-র ব্যবহার ও আমাদের গোটা কথোপকথনে ফোটোওয়ালা আখবরওয়ালা কুমার রায় মহোদয়ও হেসে ফেলেছিলেন৷
এবং জনাকীর্ণ রাস্তা ও বেনারসের গলির তুলনা কিছুতেই অজগরের ভূতের মতো হতে পারে না৷ বরং এইসব গলি পৃথিবীর দীর্ঘতম, চঞ্চলপ্রকৃতির হেলে সাপ হতে পারে৷ প্রশ্ন করে করে মুগ্ধ হতে হচ্ছিল, পথের পাশের চায়েঁ কা দুকান, জলেবির সদাব্যস্ত সরবরাহকারী উৎসস্থল, লোহা-লক্কড়, রঙ, সাইকেল— সর্বত্র প্রায় সব্বাই ছান্নু মহারাজকে জানেন৷ তাঁকে কে না-জানে ইত্যাদি ইত্যাদি৷ শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধকে বৃদ্ধেরা না দেখিলে…, একটা চায়েঁ কা দুকানে তিন বৃদ্ধ বসেছিলেন, তাঁদেরই একজন প্রায় নির্ভুল পথনির্দেশ দিলেন, কিন্তু এটাও বললেন, সেই গলির মুখে ঢুকে একটু জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে৷ আবার ছোট রাস্তা, বড় রাস্তা এবং গলির পর গলি৷ বেনারসের গলিতেও মাঝে মাঝে যাঁরা ধীরস্থির ভঙ্গিতে আয়েসে আধা-শোয়া ভঙ্গিতে বিশ্রাম নেন, নিতেই থাকেন সেইসব ষণ্ড মহারাজদের (মানুষ মহারাজবৃন্দ অপরাধ নেবেন না) সর্বদাই বিলম্বিত লয়ে মাথা নাড়ানো অভ্যেস৷ এবং মানানসই শরীরের সঙ্গে শিরোপা হিসেবে সেই বিশাল ও একফালি চাঁদের বক্রতায় সুন্দর শিংদ্বয়সহ সেই মাথা নাড়ানো অনভিজ্ঞ ও দুব্বল মনুষ্যদের সতত ভয়ের উদ্রেক করে৷ নির্দেশিত স্থলে গিয়ে দেখা গেল সকলেই বিস্মরণ ও অশ্রদ্ধার অসুখে ভোগেন না৷ যে-রাস্তায় আমাদের রিকশা-রয়েস ঢুকছিল তার নাম অবিস্মরণীয় কণ্ঠে মহারাজের স্মরণে ‘কণ্ঠে মার্গ’৷ কথায় বাড়তি উল্লাসের বনারসি-বাজ তৈরি হল যেন৷ একটু এগিয়ে দেখা গেল পণ্ডিত কিষেণ মহারাজের বাড়িও৷ তারই ডানদিকে নাকি ছান্নু মহারাজ থাকেন৷ দরজায় ডাকা-ঘণ্টি নেই, ঝুঁকে দেখে বোঝা গেল তার প্রয়োজনও নেই৷ মহারাজের ললাটলিপির স্টাইল অনুযায়ী কপালে মস্তবড় সিক্ত সিঁদুরের লম্বাটে টিপ, দীর্ঘদেহী সেই প্রবীণও হয়ত কোনও মহারাজ হবেন৷ তিনি সবিনয়ে জানালেন, একদা এখানে ছান্নু মহারাজ থাকতেন বটে, কিন্তু এখন এখানে নেই৷ শহরের এক্কেবারে অন্যদিকে যেতে হবে৷
—যদি দয়া করে ঠিকানাটা একটু লিখে দেন৷
বোঝা গেল লেখা ইত্যাদি তত সহজ কাজ নয়৷ কিন্তু তিনি অসহায়, কলকাতার পত্রকারদের হতাশ করতে চান না৷ জলদগম্ভীর হাঁকে যাকে ডাকলেন, সে একটি সদাচঞ্চলা, বেণী দোলানো কিশোরী এবং রীতিমতো আংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করা বেটি৷ আমাদেরই দেওয়া টুকরো কাগজে ঝটপট ভঙ্গিতে, আংরেজি হরফে লিখে দিল—
সিধগিরি বাগ কে বগল মে, রিতু খান্না গলিকে অন্দর…
আমাদের নির্বাচিত রিকশাচালক অভিজ্ঞ, ধৈর্যশীল, পরিস্থিতি-সচেতন এবং যথোচিত সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষ৷ তিনি ঠিকানাটির বেশ খানিকটা বুঝতে পেরে আমাদের নিয়ে সেই সিধগিরি বাগে পৌঁছে গেলেন৷ পথে অবশ্য ঝাঁপিয়ে বৃষ্টিও নেমেছিল৷ রিতু খান্না গলিতে পৌঁছে যথারীতি জিজ্ঞাসা করতে করতে সেই পদ্মভূষণ পণ্ডিত ছান্নুলাল মিশ্রজির বাড়ির দরজায় পৌঁছনো গেল৷ বাইরে বর্ষণক্লান্ত দুপুরের বৃষ্টি সামান্য হলেও তখনও পড়ছে৷ মহারাজের গৌরবর্ণে উজ্জ্বল সুদর্শন যুবক পুত্র দ্বারে এসে বললেন—
‘এটা পণ্ডিত ছান্নু মহারাজের বাড়ি ঠিকই৷ কিন্তু তিনি এখন একজন ছাত্রীকে ঠুমরির তালিম দিচ্ছেন৷ এখন তো দেখা হবে না৷’
তাঁকে সবিনয়ে বোঝাতে হল, আমরা ওঁকে না-জানিয়ে এসেছি ঠিকই, সুদূর কলকাতা থেকে লক্ষ্ণৌ হয়ে মহারাজের দরজায় ওঁর সাক্ষাতের কৃপাপ্রার্থী৷ সুতরাং যত বিলম্বই হোক না কেন, আমরা অপেক্ষা করছি৷
পুত্র আবার ভেতরে গেলেন, কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বললেন— ‘অপেক্ষা করুন’৷ যদিও ততক্ষণে আমাদের ‘নাইবা ডাকো’-মার্কা মানসিক প্রস্তুতি হয়ে গেছে৷ বোঝা গেল বেনারস সৌজন্যের লক্ষ্ণৌ নয়৷ সুতরাং সেই আধভেজা অবস্থায় বেনারসের অধিকাংশ গলিপ্রভাবিত সংক্ষিপ্ত, অন্ধকারময় কোঠির অপ্রশস্ত প্রবেশদ্বারেই অপেক্ষা করতে হল৷ তবে দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয়নি৷ মিনিট পনেরো পরেই সেই কন্যাসম ছাত্রীটির তালিম শেষ হতেই আমরা ডাক পেলাম৷
মূর্খের অশেষ দোষ৷ তবে মাঝে মাঝে না জানিলে যাহা পাওয়া যায়, তা এক্কেবারে হিরণ্ময় বিস্ময়৷ ছান্নু মহারাজের সেই অপ্রশস্ত ঘরে ঢুকেই যা দেখতে হল, তাকে সহজেই ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আলোকচিত্র প্রদর্শনী বলে প্রচার ও প্রমাণ করা যায়৷ কে নেই সেই ঘরে? একেবারে আক্ষরিক অর্থেই আকাশভরা সূর্য-তারা৷ সব্বার ওপরে আছেন পণ্ডিত আনোখেলাল মিশ্রজি৷ আবার অদৃশ্য চপেটাঘাত, ছান্নু মহারাজ যে তাঁরই সুযোগ্য জামাতা— এই তথ্যটিও সহজ-মূর্খদের জানার কথা নয়৷
আমরা ওঁকে খবর দিয়ে আসিনি, আমাদের জানার প্রসঙ্গ যে বেগম আখতার ও তাঁর গায়নে, বিশেষ করে দাদরায় বেনারসি ঘরানার, পূর্বী দাদরা শিল্পবৈভবের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল— এইসব প্রসঙ্গে প্রশ্নের জন্য ওঁকে কোনও সময় না-দেওয়াটা আমাদের একেবারেই উচিত কাজ হয়নি৷ ছান্নু মহারাজের এমন মন্তব্যের উত্তরে মৌন থাকতে হল৷ বিচ মে বহুৎ দিন বিত চুকে হ্যাঁয়… আগে থেকে জানলে বেগমের গানগুলো নতুন করে শুনতেন৷ আশি পেরিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়া সৌম্যকান্তি সুদর্শন মানুষটি সব অনুযোগ মৃদু হাসির সঙ্গে করলেও তাতে কোনও ভুল ছিল না৷ নিতান্ত দূরের শহর কলকাতা থেকে আসা পত্রকার, সেজন্য বাধ্য হয়ে সময় দিচ্ছেন৷ মাথা নিচু করে শোনা আর আড়চোখে ঘরের দুর্লভ ও কালজয়ী ফোটোদের দেখতে হচ্ছিল৷ তার মধ্যেও একটা ছবি যেন আলাদা করে স্মরণীয় হওয়ার যোগ্য৷ উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ সাহেবের বয়স পঞ্চাশ বছরে পৌঁছলে ভারতের অধিকাংশ সঙ্গীতমহানক্ষত্রবৃন্দ তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন৷ অভিজ্ঞ মানুষ এবং সহানুভূতিহীনও নন, সুতরাং আমাদের কথাবার্তা শুরু হল৷ একে বনারসের বৃদ্ধ, তার ওপরে আন্তরিকভাবেই সংস্কৃতি-সচেতন৷ সুতরাং তাঁর কথায়, অর্থাৎ সঙ্গীত-সংস্কৃতিতে মাঝে মাঝেই হিন্দির সঙ্গে বিশুদ্ধ সংস্কৃতও ঝঙ্কৃত হচ্ছিল—
‘বেগম আখতারজির সঙ্গে আমার যে বহুবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল তা নয়, কিন্তু ওঁর গান লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর মতো আমিও বহুৎ শুনেছি৷ ওঁর গান গাওয়ার আন্দাজ বহুৎ আচ্ছি থি, বিশেষ করে ওঁর গাওয়া দাদরা আর গজল-এ৷ কিঁউ কি সিধা সিধা গাতি থি, লেকিন উসমে বহুৎ রস থি৷ এমন গাইয়ের অভাব নেই যারা কারণে-অকারণে— লম্বে তান মারতা হ্যায়৷ উয়ো চিজ দিখাবট হ্যায়, উসমে গানে কা দিল রহতা নেহি৷ লেকিন বেগম সাহেবা কো মালুম থি সঙ্গীত কা রস কৌনসা চিজ হ্যায়৷ গানে কি যো বোল হ্যায়, উসকা মতলব সমঝ করকে, করাকে গাতি থি৷ সবকো মালুম হোনা চাহিয়ে গানে কা অন্দর ইয়ে আর্ট যো হ্যায়— ইয়ে বহুৎ বড়া চিজ হ্যায়৷ আজ ভি উনকি গজল শুনতে হেঁ তো বড়া আচ্ছা লাগতা হ্যায়৷ আসলি চিজ হ্যায় গানে কা আন্দাজ৷
দাদরা-কাজরির বৈচিত্র্য ও পাগল-করা গায়কির প্রশ্ন করতেই, কী আশ্চর্য, বাইরে আবার বৃষ্টি নামল৷ ঘরের মধ্যে মনে মনে বেগম আখতার-গাওয়া সেই অবিস্মরণীয় কাজরি স্বমহিমায় ফিরে এল যেন— ‘ছা রহি কালি ঘটা’৷ গানটি স্বয়ং বেগম আখতার বিশেষভাবে পছন্দ করতেন বলে জানা গিয়েছিল৷ বাস্তবিক ভালবাসায় তিনি এই গানটিই বিখ্যাত দাদরা— ‘কোয়েলিয়া’র মতো একাধিকবার রেকর্ড করেছিলেন৷
—’দাদরা গানা উনকো বহুৎ পসন্দ থি, উনোনে বনারসি স্টাইলসে গাতি থি৷ বনারসি আন্দাজ যো হ্যায়, কিঁউ কি বনারসি স্টাইল মে য্যায়সা বোল বানানা, উয়ো ঠ্যাহারাও আউর উসকি অন্দর যো রস উসকা অনুভব হোতি হ্যায়৷ সঙ্গীতকী আসলি বাত হ্যায় উয়ো ‘কর্ণপ্রিয়’ হোনা চাহিয়ে৷
এরপর মহারাজ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একটি বিশাল চেহারার ধ্বনিময় সঙ্গীতময় শ্লোক আউড়ে গেলেন৷ টেপরেকর্ডারে সেটা ঠিক স্পষ্ট চেহারায় নেই৷ কিন্তু সেখানেও ‘কর্ণপ্রিয়’ শব্দটা বারবার ধ্বনিত হয়েছে৷ এবং ওঁর সহজ বক্তব্য হচ্ছে রাগ-রাগিণীর সুর, তাদের বৈচিত্র্যময় চলনের শেষ কথা তাকে শেষ পর্যন্ত শ্রোতাদের কাছে কর্ণপ্রিয় হতেই হবে, নইলে সব আয়োজনই বৃথা৷ যো শুননেওয়ালোকে চিত্তকো আকর্ষণ করবে সেটাই রাগ-রাগিণীর বর্ণময় অস্তিত্বের প্রাণপ্রিয় পরিচয়৷
বেগম আখতারজির আরও একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত চিজ ছিল, সেটা ওঁর ‘খনকদার’ আওয়াজ৷ মতলব…
মতলব উনি একটু হেসে, কেশে যা বুঝিয়ে বললেন— একই গান, সুর-তাল-লয় সবই নির্ভুল, কিন্তু অন্যরা গাইলে তেমন কিছু মনে হয় না৷ যদি সেই গানটিই বেগম আখতার সাহেবার গলায় শোনা যায়, তাহলেই মেহফিল-এর সব আলো জ্বলে ওঠে যেন৷ আরও কিছু বিস্ময় ছিল বাকি৷ কথা বলতে বলতে আবেগতাড়িত বৃদ্ধ শিল্পী বেগমেরই একটা বিখ্যাত গজল গেয়ে উঠলেন— ‘কোই ইয়ে কহে দে গুলশন গুলশন’ এবং তারপরেই অপ্রতিরোধ্য আবেগেই গাইলেন— ‘কোয়েলিয়া মত কর পুকার’৷ নব্য তরুণী ছাত্রীটি, যে পণ্ডিতজির কাছে বনারসি ঠুমরির তালিম নিচ্ছিল, সে-ও অবাক বিস্ময়ে হঠাৎ পণ্ডিতজির আবেগ ও উচ্ছ্বাসে গাওয়া মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখছিল ও শুনছিল৷ প্রশ্নরা উচ্চারিত না-হলেও সুরের জীবন, ইচ্ছে আর নিত্য বেঁচে-থাকার সত্যনির্ভর কথা বলতে বারণ করেছে কে, বিশেষ করে সেই বক্তা যদি পদ্মভূষণ পণ্ডিত ছান্নুলাল মিশ্র হন—
এসব সেই কতদিন আগের কথা৷ সেই স্মৃতিতে ফিরে যাওয়ার কোনও মওকা মেলে না৷ এখন নিজেরই এত বিচিত্রসব গান আছে, তার মধ্যেই দিন-রাত কাটাচ্ছি৷ ছোট ছোট প্রদীপ ঘিরে আছে আমার চারদিকে, যদি তাদের আলোতেই কোনওদিন পুরনো দেওয়ালির দিন ফিরে আসে— সেই প্রতীক্ষায় বেঁচে আছি৷ সেই একটা শের আছে না, মেরা কহেনে কা মতলব ভি ওহি হ্যায়—
ইলাহি কোঈ তামান্না নেহি জমানে মেঁ
ম্যয়নে সারি ওমর উজারি হ্যায়
আপনে হি গানে মেঁ৷
অন্য কোনও কালের সুরেলা বিষাদ ফিরে এল যেন৷ এবং বাইরে তখনও ঝিরঝির বরষা৷
৮
এবং কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়৷ যে-সকল বাঙালি সংস্কৃতি-রসিক হিসেবে কখনও কুমারদার সঙ্গে মোলাকাত করেননি, তাঁহারা কোনওদিন জানিবেন না, ঠিক কী হারাইয়াছেন! প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি, জ্ঞান ও শিক্ষার অহঙ্কার তাঁকে কখনও স্পর্শ করেনি৷ অহঙ্কার যদি কোথাও থেকেও থাকে, অন্তত তাঁর প্রিয়জনেরা তখনও তা বুঝতে পারেননি৷ কুমারদা তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে যা বলতেন, প্রায় তা-ই লিখতেন৷ মার্গসঙ্গীতের অন্য সুবিখ্যাতরা তো বটেই, বেগম আখতার, সিদ্ধেশ্বরী দেবী, হীরাবাঈ বরদেকার— প্রমুখের প্রসঙ্গ তুললে উনি যা বলতেন তা কেবল অনেক আয়াসসাধ্য গবেষণার পরই জানা যায়৷
বেগম আখতারের গান সম্পর্কে ওঁরও স্বাভাবিক মুগ্ধতা ছিল৷ সকল অভিজ্ঞ ও সত্যান্বেষী সঙ্গীতশিল্পীর অনুভব সংক্ষেপে বর্ণনায় উনি বলতেন— গাইতে পারার দক্ষতা কখনও সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না এবং তা শেখানোও যায় না, যদি না উৎসাহী ছাত্রছাত্রীর ভেতরে কোথাও দক্ষতার স্ফুলিঙ্গ না থাকে৷
যদিও ওঁর লেখায় বেগম আখতার সম্পর্কিত বিচিত্র অভিজ্ঞতার অনেকটা বেগমেরই ছাত্রী ঋতা গাঙ্গুলির কাছেই শোনা, কিন্তু তাতেও কুমারদার নিজস্ব রঙ্গ-রসিকতার খুশবু কিছু কমেনি৷ মশলাদার রান্নার মতো সেখানে হাজির সমকালীন বনারসি ঘরানার শিল্পী সিদ্ধেশ্বরী দেবীর প্রসঙ্গ, অর্থাৎ উভয়ের মধ্যের টক-ঝাল-মিষ্টির সম্পর্ক৷ সিদ্ধেশ্বরীর কাছে গিয়েই নাকি বেগম আখতার ঋতাকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন— এমন ঘটনাই ঋতা কুমারদাকে সবিস্তারে বলেছিলেন৷ মানতেই হবে দিল্লিতে ঋতার কিছু বাড়তি সুবিধা ছিল৷ কারণ তাঁর স্বামী কেশব কোঠারি একদা দিল্লির সঙ্গীত-নাটক অকাদেমির সচিব ছিলেন৷
যে-যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন, আমাদের এই কাহিনীর সঙ্গে শুধু সিদ্ধেশ্বরী দেবী ও বেগম আখতারের অম্লমধুর সম্পর্কের ছবিটাই প্রয়োজনীয়৷ সিদ্ধেশ্বরী যেমন চেহারায়, তেমনি সঙ্গীতশিক্ষা ও মেজাজে রীতিমতো দাপুটে মহিলা ছিলেন৷ সেই দাপুটিয়া সিদ্ধেশ্বরী একদা উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ-র গান শুনে প্রায় পাগল হয়ে নাকি তাঁর পিছু নিয়ে সুদূর বরোদায় পৌঁছে গিয়েছিলেন৷ এবং সেখানে পৌঁছে তিনদিন ধরে ‘বাজুবনধ খুলু খুলু যায়’-এর তালিম নিলেন৷ কিন্তু একান্ত প্রয়োজনীয় ‘খনক’, টপপায় যা দেওয়া হয় বা ফৈয়াজ খাঁ সাহেব তাঁর ঠুমরিতে যা দিতেন, তার একটাও সিদ্ধেশ্বরীর গলা থেকে বেরুল না৷ তখনকার দিনে এই সব উচ্চকোটির সঙ্গীতমহলে সহজ অভ্যাসে গালাগালিও চলত৷ সিদ্ধেশ্বরীর ব্যর্থতায় রেগে কাঁই হয়ে ফৈয়াজ খাঁ সাহেব নাকি (সিদ্ধেশ্বরী যা বলেছেন) বলেছিলেন— ‘তিনদিন সে এক খনক গলেসে নহি নিকলা, শালী গানা সিখনে আয়ি’৷ কুমারদা লিখেছেন, পরে সেই সিদ্ধেশ্বরীই নাকি হেসে হেসে বলতেন— ‘তোমরা যে খুশগুলু অর্থাৎ মিষ্টি গলার এত মাহাত্ম্য দাও, ফৈয়াজ খাঁ-র গলা সেই দিক থেকে (সোজা বাংলায় যারে কয় বাজখাঁই গলা) তো ঠুমরি-দাদরার ছিল না, কিন্তু ওঁর ভৈরবী ঠুমরির যে ঔরৎ, যাঁর বাঁহো থেকে বাজুবনধ খুলে খুলে যেত, তার চেয়ে হসীন, তার চেয়ে সুন্দরী তো আমি জীবনে কারও গানে পাইনি৷’
এহেন সিদ্ধেশ্বরী যাকে তাকে পাত্তা দেবেনই বা কেন৷ কিন্তু যে নির্ভেজাল সত্যটা শোনাবার জন্য এই সিদ্ধেশ্বরীর প্রাসঙ্গিক ভূমিকা, সেটা হচ্ছে, ওই সত্যিকারের এক চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়ের প্রতি আরেক চ্যাম্পিয়নের যেমন অন্তরস্থিত শ্রদ্ধা থাকে, তা সিদ্ধেশ্বরীরও ছিল৷ একদা কানপুরের একটা অনুষ্ঠানে সারা সন্ধে ধরে তিনি ঠুমরি, দাদরা, কাজরির পর ভজন শুনিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেছেন৷ রীতিমতো ক্লান্ত৷ তখন একজন ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করলেন— ‘বাঈসাহেবা, এক গজল হো যায়’৷ বাকি শ্রোতারাও সমস্বরে সেই অনুরোধকারীকে সমর্থন করলেন৷ সেই অনুরোধে তানপুরার ওপর হাত রেখে সিদ্ধেশ্বরী বলেছিলেন— ‘আমাকে ক্ষমা করবেন, মুঝে গজল নহি আতি৷ আজ আজ্ঞা দিন, আমার যথেষ্ট মেহনত হয়েছে৷ আমার সামান্য যা টুটাফুটা গান আছে তা আপনাদের শুনিয়েছি৷ গজল আমি গাই না৷ গজল গাইবার হক আছে হিন্দুস্তানে একমাত্র আখতারির৷’ পরে কিছু তীব্র ভাষার খারাপ কথাও বলেছিলেন সেই শ্রোতাদের সম্পর্কে, সঙ্গের ছাত্রী ঋতাকেও, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়৷
প্রচারিত আছে বেগম আখতারও নাকি যথেষ্ট অহঙ্কারী মহিলা ছিলেন৷ এ-প্রসঙ্গে সেলিম কিদওয়াই বললেন— ‘মনের ভেতরের খবর জানি না, অহঙ্কার থাকলেও উনি কক্ষনো তা প্রকাশ করতেন না৷ বেগমের কোনও ছাত্রীও ওঁর আচরণের এই দেখানো অহঙ্কার সম্পর্কে কখনও কিছু বলেননি৷’
পাহাড়ী সান্যাল একবার নাকি বেগম আখতার সম্পর্কে বলেছিলেন— এমন ‘পিরিতখোর’ মহিলা তিনি জীবনে দ্যাখেননি৷ সর্বদা প্রেম সম্পর্কিত বিচিত্র তথ্য সবিস্তারে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই৷ তবে প্রায় সকলেই এই আশ্চর্য জীবনে প্রেমে পড়েই৷ এক-আধবার পড়লেও পড়ে৷ প্রেমের সঙ্গে চেহারার বা গাত্রবর্ণের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই৷ নব্যযৌবনা সিদ্ধশ্বরীও প্রেমে পড়েছিলেন এবং প্রেমিক প্রতিশ্রুতি না রাখায় পেটে সন্তান নিয়ে আত্মহত্যার ইচ্ছেয় বেনারসের গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন৷ কাছেই স্নানে ব্যস্ত এক সন্ন্যাসী তাঁকে বাঁচিয়ে ছিলেন৷ জীবনের সেই ঘটনায় পুরুষ জাতটার ওপরেই নাকি ঘেন্না ধরেছিল সিদ্ধশ্বরীর৷ কী মুশকিলের কথাবার্তা! বেগম আখতারের গান শুনে, ওঁর পাগল-করা কণ্ঠ শুনে যদি কেউ কেউ ওঁর প্রেমে পড়তে চায়, প্রেমে পড়ে সত্যিই দিওয়ানা হতে চায় তাতে ওঁর কী করার থাকতে পারে! যাঁরাই ওঁকে নিয়ে বইপত্তর লিখেছেন, তাঁরাই সমকালীন উর্দু কবি ও গীতিকারদের সঙ্গে ওঁর প্রেমময় সম্পর্কের কাহিনী একেবারে আলাপ থেকে বিস্তার পেরিয়ে দ্রুত তিন তাল-এ পৌঁছে যাওয়ার বিবরণ শুনিয়েছেন৷ তার মধ্যে কিছু তো একেবারে মর্মস্পর্শী৷ সেই ঘটনার সাক্ষী স্বয়ং সেলিম কিদওয়াই সাহেবের বাবা৷ তিনিও লক্ষ্ণৌয়ের একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল ও নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীতরসিক ছিলেন৷ প্রবীণ ও বিখ্যাত উর্দু গীতিকার জিগর মোরাদাবাদী বেগমের গজল বিশেষভাবে পছন্দ করতেন৷ তাঁর জন্য গান লিখে ধন্য হতেন বলা যায়৷ লক্ষ্ণৌয়ের একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বেগমের কণ্ঠে নিজের গান শুনতে শুনতেই তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয় এবং তিনি মারা যান৷ ক্যায়ফি আজমির সঙ্গেও বেগম আখতারের বিশেষ হৃদ্য সম্পর্ক ছিল৷ এক সাক্ষাৎকারে তিনি ক্যায়ফি-কে বলেছিলেন— ‘ঠিকমতো গাইতে পারলে দেশ থেকে গজল শেষ হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন না, যদি অবশ্য ঠিক আন্দাজ ও আলফাজ বজায় রেখে গাওয়া হয় তবেই৷’ ৩০ অক্টোবর ১৯৭৪-এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে বেগম ক্যায়ফি আজমির লেখা গজলই গেয়েছিলেন একটা এল পি রেকর্ডে৷
নানাপ্রকারের বাস্তবিক, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট পেলেও দুঃখতাড়িত জীবনে কেউই তাঁর কাছ থেকে কখনও অশোভন, অসুন্দর ব্যবহার পায়নি৷ এই প্রাপকদের দলে ছোটবড় সব্বাই আছেন৷ সেলিম কিদওয়াইকে তিনি সর্বদাই রঙ্গ-রসিকতায় চমকে দিতেন৷ লক্ষ্ণৌতে এলেই ডাকতেন— ‘অ্যাই চামচে, চলো মহফিল মে যানা হ্যায়৷’ এবং তাঁর সংলাপে সহজাত রসবোধ ছিল অসাধারণ৷ বাস্তবছোঁয়া রঙ্গ-রসিকতাতেও তাঁর জুড়ি ছিল না৷ সেলিমদের বয়সী, ওঁদেরই বন্ধু একটি যুবককে একদিন গান শেখাতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু দেখা গিয়েছিল সেই গজল-দিওয়ানা যুবকটির কান যতই সাফ হোক, কণ্ঠে সপ্তসুরের একটাও সশরীরে নেই৷ অবাক বেগম বলেছিলেন— ‘যার কান আর মাথা এত ভাল, তার কণ্ঠ এমন কী করে হয়!’
৯
সেদিন সেই ঘটনার অভিজ্ঞতায় প্রায় সারারাত ধরেই নাকি বারবার হেসে উঠেছিলেন বেগম৷ তাঁর সেই সহজ কৌতুকের স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল বেটা সেলিম-এর কাছে৷ জীবনের কিছু বিশেষ ধরনের অনুভব-উপলব্ধিও যেন ক্লান্ত পথিকের নিজস্ব গান৷ সিংহদুয়ারের বাইরে থেকে গেলে প্রাসাদের অভ্যন্তরের বিষাদ-বেদনার স্বরলিপি হয়ত অধরাই থেকে যায়৷ বেগম আখতারের জীবন এবং নিজস্ব জীবন নির্মাণ তাঁর হৃদয়-বেদনার সুরেই গাঁথা৷ যারা সাধারণ, নিতান্তই সাধারণ, তারা প্রাপ্তির আলোড়নে ভেসে যায়, সুর-তালও যায় কেটে৷ প্রাপ্তির প্রশ্নে বিব্বি থেকে আখতারিবাঈ ফৈজাবাদী-তে পৌঁছেই ভেসে যাওয়া শুরু হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি৷ শুধু হয়নি বললে যেন সত্যের দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়৷ এ-দেশের একটা বিরাটসংখ্যক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ দিশি সত্যকে সম্মান দিতে চান না৷ কিন্তু আমেরিকার কোনও সাহেব বললে হাঁ করে থাকেন৷ অর্থই যাবতীয় অনর্থের কারণ— এই আপ্তবাক্যের যেন কোনও গুরুত্বই নেই৷ অথচ W K Kellog যখন বলেন— ‘Dollars have never known to produce character, and character will never be produced by money.’ (I’ll invest My Money in People). ব্যক্তিজীবনে বেগম আখতার সততা, নিজস্ব বুদ্ধি, বিবেচনা ও উদার হৃদয় দিয়ে মনুষ্যত্ব এবং আভিজাত্য অর্জন করেছিলেন৷ নিজে দুঃখী হলে অন্যের দুঃখ কিছুটা হলেও বোঝার ক্ষমতা অর্জন করে মানুষ৷ প্রকৃত শিক্ষা ও উদারতা যেখানে নেই, সেখানে নিজের তুলনামূলক প্রতিষ্ঠায় অন্যদের ছোট করার অমানবিক প্রবণতা শুরু হয়ে যায়৷
দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য না করলে খ্যাতিদীপ্ত, অভিজাত ধনী পরিবারের সদস্য হয়ে যাওয়া বেগমের কী ক্ষতি হত? মৃত্যুর আগে পর্যন্তই যে তিনি ‘ওয়ার্কিং লেডি’ থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার অভ্যন্তরীণ পরিচয় অনেকটাই জানেন ইতিহাসের অধ্যাপক সেলিম কিদওয়াই— ‘নিজের অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ছাড়া আব্বাসি সাহেবের সুবিশাল পরিবারের বোঝাও তাঁর কাঁধে এসে পড়েছিল৷ এতটাই ওজনদার সেই বোঝা যে, হার্ট অ্যাটাকের পরেও তিনি ডাক্তারের বিধিনিষেধ না মেনে প্রায় সর্বত্র অনুষ্ঠান করে বেড়াতেন, জীবনের শেষপর্বে রেকর্ড কোম্পানির প্রস্তাবও ফেরাতেন না৷ জীবনের দুঃখদিনে রেকর্ডওয়ালারা পুরনো রেকর্ডগুলো নতুন করে প্রকাশ করে নিজেদের ব্যবসা চালাত, কিন্তু বেগমের দিকে তাকায়নি৷ ছবিটা বদলেছিল মির্জা গালিবের জন্মশতবর্ষ থেকেই৷ —সেলিম ভাইয়ের বলা এই সত্যের সাক্ষী গোটা দেশের সঙ্গীতরসিকবৃন্দ৷ যাঁরা সেই আমলে রেকর্ড কিনতেন তাঁদের কাছে মির্জা গালিবের গজল নিয়ে সেই রেকর্ডটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই ছিল৷ বেগম ও রেকর্ড কোম্পানিরা— উভয়ের প্রয়োজনে রেকর্ড-বাণিজ্যে প্রাণ ফিরেছিল জীবনের শেষ সাত বছরে৷
আভিজাত্যের বিলাসের ধ্বংসাবশেষ দেখতে সেই হ্যাভলক প্লেসে গিয়ে আধুনিক প্রবণতা অনুযায়ী পুরনো বাংলোর বদলে ফ্ল্যাটবাড়ি দেখতে হয়েছে৷ বেগমের ঘনিষ্ঠরা সঙ্কোচের সঙ্গে জানিয়েছেন সন্তানহীনা বেগমের অর্থ, অলঙ্কার ও বহুমূল্যের যাবতীয় সম্পদ রক্ষা তো দূরের কথা, দায়িত্বহীনতার লোভে সহজ সুযোগে নষ্ট হয়ে গেছে৷ ব্যারিস্টার আব্বাসি সাহেবের অবস্থা নাকি জীবনের শেষ দিকে ম্লান হয়ে যাওয়া ছবির মতো হয়েছিল৷ তিনি মারা যান ১৯৭৯-তে৷
অন্যের প্রতি, বিশেষ করে সম্ভাবনাময় সঙ্গীত-প্রতিভাদের প্রতি যেন মাত্রাতিরিক্ত স্নেহশীল হয়ে পড়তেন বেগম আখতার৷ হয়ত মাথার মধ্যে অন্যরকম আচরণ করার পরামর্শ দিতে মৌলিক দুষ্টুমি-প্রতিভার ‘বিব্বি’ও এসে দাঁড়াত পাশে৷ এমনও হতে পারে ততদিনে জীবনবোধে নির্মিত হৃদয় নির্ভুল নির্দেশ দিতে শুরু করেছিল৷
প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে বোম্বাইয়ে৷ বোম্বাই-অভিজ্ঞরা জানেন, সেখানেও কখনও কখনও বৃষ্টি শুরু হলে আর থামতেই চায় না৷ তেমনই বরষা ছিল সেদিন, যেদিন সম্ভাবনাময় সদ্য-কিশোরী শ্রুতি সান্ডলিকার-এর গান শুনতে যাবেন পদ্মশ্রী বেগম আখতার৷ বেরসিক বৃষ্টির সাধ্য কী যে সুররসিক বেগমকে আটকাবে? বৃষ্টি মাথায় নিয়েই, আধভেজা হয়ে বেগম শ্রুতিদের বাড়িতে গিয়েছিলেন৷ বেগমের মৃত্যুর একচল্লিশ বছর পরেও শ্রুতিজি তা ভোলেননি৷ ভোলা সম্ভবও নয় বোধহয়৷
সদ্য-তরুণী প্রভাতী মুখোপাধ্যায় বাবার হাত ধরে লক্ষ্ণৌতে তালিম নেওয়ার জন্য হাজির৷ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হিসেবে হোটেলেই থাকবেন প্রভাতী— এমন ভাবনার মাথায় এক কলসি ঠান্ডা জল ঢেলে শান্ত অথচ যাবতীয় কর্তৃত্বসম্ভব কণ্ঠে আম্মিজি প্রভাতীর পিতাকে জানিয়েছিলেন— ‘মেয়ে তো মায়ের সঙ্গেই থাকবে৷ সেই নির্দেশের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে অতিরিক্ত শিক্ষাও ছিল —’বাঙগালি লেড়কি’ যাতে উর্দুর ‘আলফাজ’ বস্তুটাও শুনে শুনে শেখে৷ দাদরা-গজল-ঠুমরি গাইতে গেলে সেগুলোও শিখতে হয় কিনা৷
অবিস্মরণীয় সঙ্গীতব্যক্তিত্ব অমিয়নাথ সান্যালের মেয়ে রেবা-র (রেবা মুহুরি) গান শুনে খুব খুশি হওয়া বেগম তাঁর জন্য ঈশ্বরের কাছে দোয়া মেঙেছিলেন৷ একগাল হেসে গজল শিখতে চাওয়া রেবার গুরুদক্ষিণা হিসেবে দেওয়া একশো টাকা ফেরত দিয়ে, একগাল হেসে ‘যদি তোমার মতো আমার একটা মেয়ে থাকত’ বলেই থেমে থাকেননি৷ অন্যের মঙ্গলের, সাহায্যের জন্য সর্বদাই সচেতন থাকতেন৷ স্বভাবে শুভবোধ না-জন্মালে মানুষের চরিত্র যে প্রকৃত অর্থে বিকশিত হয় না তা-ও মানতেন৷ রেবাকে উর্দু ডিকশনারি পাঠাবেন— এই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন৷ ‘তোমায় কিছু দেব বলে’-র চিন্তাও যেন তাঁর মনে মনে সর্বদা ঘুরে বেড়াত৷ পরে একবার রেবার বাড়িতে গিয়ে আপ্লুত স্নেহে তাকে বিরাট মাপের একটা পান্নার আংটিও দিয়ে এসেছিলেন৷
শিক্ষা ও সাহায্যের প্রশ্নে জীবনের সব পরিস্থিতিতেই বেগম আখতার অন্যদের সাহায্য করতে তৈরি থাকতেন৷ একদা কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং-এর সভার নৃত্যপটিয়সী ও সুশিক্ষিত গায়িকা মালকা পুখরাজ লাহোর থেকে এসেছেন বেগমের কাছে, উদ্দেশ্য বেগমের জনপ্রিয় একটা দাদরা (‘বহুত দিন বীতে সাইয়াঁ কো দেখে’) শেখার জন্য৷ সমস্ত কাজ ফেলে রেখে বেগম আখতার সঙ্গে সঙ্গে মালকা পুখরাজ-কে গানটা শেখাতে বসে গিয়েছিলেন৷ মালকা পুখরাজও বেগমের মৃত্যুর পর তাঁর সহজ-সুন্দর স্বভাব ও অন্যদের সাহায্য করার আন্তরিকতার কথা বলে বেড়াতেন৷
না-চাইলেও যাঁর দেওয়ার অভ্যাস, তিনি কেউ কিছু চাইলে কী করে ফেরাবেন?
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ফিরতে হয়৷ যতদূর মনে পড়ছে, সেই সত্তর-এর একেবারে শুরুর দিকের একটা অনুষ্ঠান, ওঁর শরীরটা একটু যেন কাহিল৷ গ্রিনরুমে তাঁর বাঁহাতের পাশেই রয়েছে পানের ডিব্বা হিসেবে রুপোর কৌটো, আর ক্যাপস্টানের গোল কৌটোটাও৷ মাঝে মাঝে অল্প কাশছেন৷ একজন প্রৌঢ় মানুষ, বেশভূষায় কেউকেটাত্ব প্রকট৷ তিনি সবিনয়ে বেগমকে বললেন— আপনার শরীর ভাল আছে তো, গলা? দেখছি তো মাঝে মাঝে কাশছেন… বেগম তাঁর অননুকরণীয় হাসির সঙ্গে বললেন— ‘গানা গলে সে বলতি হ্যায় থোড়ি৷’ পরে শুনেছি ও জেনেছি কেউ ওঁর অনবদ্য কণ্ঠসম্পদের দিকে ইঙ্গিত করলেই উনি কথাটা বলে মনে করিয়ে দিতেন গান বস্তুত আন্দাজ, বুদ্ধি আর হৃদয়েরই ফসল৷ হয়ত কথাটা শতকরা হাজার ভাগ সত্যি, কিন্তু তার সঙ্গে যে-সৃষ্টি তাঁর কণ্ঠবাহিত হয়ে শ্রোতার কাছে হাজির হচ্ছে তাকে অসম্মানিত করা যায় না তো কিছুতেই৷ পণ্ডিত ছান্নু মহারাজ বলেছেন, ‘খনকদার’ , যন্ত্রসঙ্গীতের সুর ও সমন্বয়ের পণ্ডিত কে কে শ্রীবাস্তব বলেছেন— ‘লিটল হাসকি, বাট ডিলাইটফুল টু হিয়ার৷’ কুমারদা বলতেন— ‘ওঁর কণ্ঠে উর্দু ভাষাটাই যেন শিকারায় চড়ে হাজির হয়৷’ তো এই কণ্ঠকে কোন শ্রোতা অস্বীকার করতে পারেন৷
সঙ্গে থেকে গৌরব বৃদ্ধি করা সঙ্গতিয়ারাও কি কখনও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েননি? হ্যাঁ, তা-ও ঘটেছে৷ এবং সেটাও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা৷ ওই— ‘গানা গলেসে বনতি হ্যায় থোড়ি’-র রাতেই তাঁর সঙ্গে তবলায় বসেছিলেন উস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ ও সারেঙ্গিতে মহম্মদ সাগিরুদ্দিন৷ শেষরাতে সেই আবির্ভাবের শুরুতেই বেগম প্রথমে শুনিয়েছিলেন— ‘অ্যায় মোহাব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া’৷ কিন্তু গোটা হলের সবাইকে অবাক করে স্বয়ং স্বভাবশান্ত উস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ সেই হলের দরজা খুলে দেওয়া ভোরবেলায় প্রায় বাঘের মতো বেগম-এর হারমোনিয়ামের ওপর ঝাঁপিয়ে বলেছিলেন— ফির হোগা ‘অ্যায় মোহাব্বত…’ এবং হয়েছিলও৷
একদা রামপুরের নবাব তাঁকে উপহার-উপঢৌকন দিয়ে ভুলিয়ে, অস্থায়ী বিবাহের ছলনায় বন্দী করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আখতারিবাঈয়ের স্বাধীন শিল্পীসত্তার পক্ষে তা মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না৷ সুকৌশলী আখতারি বাস্তবিক ব্যস্ততায় পালানোর সময় সম্ভবত ভুল করেই সাতনরী হার ও অন্যান্য অলঙ্কার নিয়ে চলে এসেছিলেন৷ এই ‘ভুল করে নিয়ে আসা’র কাহিনীও কিছু কম প্রচার পেয়েছিল তা নয়৷ প্রসঙ্গত বলতেই হয়, যে অলঙ্কারগুলো তিনি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন, তা নিয়ে আসা অপরাধ হবে কেন? বিশেষ করে সাতনরী হারটির শেষ স্তরে সুরম্য অবস্থানে স্থাপিত হীরকখণ্ডটির প্রতি বহু বিখ্যাত ব্যক্তির লোভ ছিল৷ উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ সাহেবের ভাগনে রঈস খাঁ, একবার এক অনুষ্ঠানে মামার অনুকরণে সরু গলায় একটা ফিল্মি গজল গাইতে গাইতে সেতার বাজিয়েছিলেন, আর সেই আসরেই কিনা বেগম গজল গাইবেন! অপমানিত বেগম তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তবলিয়া মহম্মদ আহম্মদ মারফত উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ-র কাছে গাণ্ডা বাঁধার প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷ খাঁ সাহেব রাজি, কিন্তু একটি শর্তে, সেই রামপুরের নবাবের উপহার দেওয়া হারটির প্রধান আকর্ষণ হিসেবে শোভিত হীরকখণ্ডটা দিয়ে একটা আংটি নির্মাণ করে উস্তাদকে নজরানা হিসেবে দিতে হবে! রেগে আগুন বেগম আখতার মন্তব্য করেছিলেন— ‘উনি কিছু না চেয়ে পাঠালে আমি হয়ত তার দশগুণ কিছু দিতাম৷’ পরিস্থিতির উপযুক্ত বন্দোবস্ত হিসেবে উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ সাহেবের শিষ্য অরবিন্দ পারেখের গাণ্ডা বেঁধে সর্বজন সমক্ষে তাঁকেই উস্তাদ বলে সম্মান দেখিয়ে অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে আবার শান্ত ও উদাসীন হয়েছিলেন৷
বিচিত্র, বর্ণময় ও নাটকীয় জীবনের নানা অধ্যায়ে লড়াই করেছেন, অপমানিত হয়েছেন, খ্যাতি-প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন৷ ধনীও হয়েছিলেন, কিন্তু প্রকৃত শান্তি বোধহয় কখনও পাননি৷ বিষাদের সুরই বারবার ফিরে এসেছে৷
ক্ষমাশীল পাঠকবৃন্দ, প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য হিসেবে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে সামনে হাজির হচ্ছে৷ আমার পিতৃদেব আমাদের ছোটবেলায় সহজ ভঙ্গিতে একটা গল্প শোনাতেন— একবার নাকি পিতামহ ব্রহ্মা স্বর্গে একটা সুদৃশ্য পাত্রে যতসব দুর্লভ আচরণগত গুণকে তরল পদার্থে রূপান্তরিত করে মানুষের ওপরে বর্ষণ করছিলেন৷ কী করে যেন খবরটা পেয়েই দেবর্ষি নারদ তাঁর সেই ব্যক্তিগত রকেটে (মানে ঢেঁকিতে চড়ে) চড়ে বিদ্যুৎগতিতে সেখানে হাজির হয়েই সেই পাত্রটি পিতামহর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন— ‘পিতেমো, আপনি করছেন কী! সব দেবসুলভ গুণ মানুষদের দান করলে তারা আর কক্ষনো দেবতাদের মানবে?’ পিতামহ সেই অকাট্য ও বাস্তবিক কথাটা মানলেন৷ তখন দেখা গেল সেই অলৌকিক চরিত্রের দেবতানির্মিত পাত্রটির তলদেশে যে তরল পদার্থটি পড়ে আছে সেটি ‘শান্তি’৷ অর্থাৎ স্বয়ং ঈশ্বর সুখ, দুঃখ, স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি দিয়েছেন, কিন্তু মানুষকে কখনও শান্তি দেননি৷ বেগম আখতারের ভাষ্য হিসেবেও এই সত্যটা বলা যায়—
ইয়ে না থি হামারি কিসমত
কে বিশালে ইয়ার হোতা
অগর ঔর জিতে রহতে
ইয়েহি ইন্তেজার হোতা…
১৯৭২-এ উস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের মৃত্যুতে প্রায় ভেঙে পড়েছিলেন বেগম৷ বেগম একদা উস্তাদ আবদুল বহীদ খাঁর ছাত্রী ছিলেন, আর উস্তাদ আমির খাঁ-র গায়কি ছিল গভীরভাবে সেই উস্তাদ দ্বারাই প্রভাবিত৷ দুজনের প্রতি দুজনের গভীর শ্রদ্ধা-ভালবাসার সম্পর্ক ছিল৷ সেই মৃত্যুসংবাদ শুনে বেগম সেলিমকে বলেছিলেন—
‘লাগতা হ্যায় অব হামারে ভি দিন আ গয়ে৷’ |
গ্রন্থপঞ্জি
শ্রীপান্থ : মেটিয়াবুরুজের নবাব
কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় : মজলিস
S. Kalidas : Love’s Own Voice
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ : তহজীব এ মৌসিকী
রেবা মুহুরী : ঠুমরী ও বাঈজী
অতনু চক্রবর্তী : মালিকা এ গজল
প্রভাতী মুখোপাধ্যায় : ইয়াদেঁ
Malka Pukhraj : Song Sung True
বেতারে প্রচারিত ধারাবাহিক
কুছ নকশ তেরি ইয়াদ কি/লক্ষ্ণৌ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত
ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা
সেলিম কিদওয়াই— লক্ষ্ণৌ
কে কে শ্রীবাস্তব— লক্ষ্ণৌ
শ্রুতি সান্ডলিকার কাটকার— লক্ষ্ণৌ
দীনেশ সেহগল— লক্ষ্ণৌ
এস কালিদাস— দিল্লি
প্রভাতী মুখোপাধ্যায়— কলকাতা
পদ্মভূষণ পণ্ডিত ছান্নুলাল মিশ্র— বেনারস
দীপক মিশ্র— বেনারস
নাসিম আখতার— লক্ষ্ণৌ
জ্ঞানেন্দ্র শুক্লা— লক্ষ্ণৌ