কিছু কথা – অলক চট্টোপাধ্যায়

কিছু কথা – অলক চট্টোপাধ্যায়

জীবনের গল্প নিজস্ব যুক্তিতেই নানা কিসিমের হয়। যদি তা না হবে, তাহলে কারও জীবনে কান্না ফিরে ফিরে আসবে কেন‍‌!‌আর বৈচিত্র্য ?‌‌ তার সঙ্গেও জীবনের চিরকালের প্রেমময় সম্পর্ক। আমরা এখনও কথায় কথায় কোনও কথার গ্রাহ্যযুক্তি প্রসঙ্গে বলে থাকি— কথাটা জজেও মানবে। সাহেবরা ঠিক কী ভাবেন জীবনের এই রহস্যময়তা নিয়ে?‌ খুব সংক্ষিপ্ত সংস্করণ হিসেবে Robin Norwood‌–‌এর উক্তি পেশ করা যায়— ‌‌‘‌‘‌We don’‌t always remember that truth can be charming and whimsical and profound all at on‌ce…’‌’। একদা নাকি রোজ রাতে ঘুমোনোর আগে ছোট্টদের মত বেগম আখতারকে মিলনাত্মক গল্প শোনাতেই হতো। সেখানে দুঃসহ বিরহ বা কোনও দুঃখ–‌কাহিনী থাকলে চলবে না। থাকলে নিবেদিতপ্রাণ শ্রোতা হিসেবে বেগম নিজেই রীতিমত কান্নাকাটি শুরু করে দিতেন। সেই সব কাহিনীকে নির্ভেজাল সত্যি বলে মেনে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ তাঁর ‌জীবনে কান্নার পরিস্থিতি বার বার ফিরে ফিরে এসেছে। কারও জীবনের সম্পূর্ণ কাহিনী অন্য একজনের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সুতরাং বেগম আখতার ওরফে আম্মিজির প্রথম ছাত্রী, কন্যাসম শান্তি হীরানন্দও ঠিক বুঝতে পারতেন না কেন, কোন দুঃসহ স্মৃতিচ্ছবি তাঁকে কখনও কখনও গানের আসরেই হাউহাউ করে কাঁদিয়ে ছাড়ত।

কাছে বা দূরেই হোক, প্রকৃত অন্বেষণে উদ্বেগ ও আশঙ্কার সঙ্গে কিঞ্চিৎ প্রত্যাশাও জড়িয়ে থাকে। উত্তপ্ত অপরাহ্নে খুঁজে বেড়িয়েছি ঠিক কে আমাদের বলে দেবেন বেগমের দূর সম্পর্কের সেই আত্মীয় ‘‌‌আক্রামভাই’‌‌–‌এর দোকান কোথায়। এবং লক্ষ্ণৌয়ের আমিনাবাদ কোনও ছোট অঞ্চল নয়। বাণিজ্য–‌ব্যাকুলতায় ছোট ও মাঝারি দোকানগুলো যেন সহজ আত্মীয়তায় ওপর থেকে নেমে রাস্তায় এসে পড়েছে। বস্তুত ফুটপাথ বলে কোনও কিছু আর সেখানে নেই। পদচারণা পথিকেরই সমস্যা, বাণিজ্যের নয়।

আশঙ্কার প্রথম দৃশ্য রচিত হয়েছিল ভাদারসা ও ফৈজাবাদে। বার বারই মনে মনে হিসেব করতে হচ্ছিল—সত্যিই তো, একশো বছর কি কিছু কম সময় ! কিন্তু কখনও কখনও প্রশ্নের উত্তরে কারও চোখের আলোই উৎসাহকে বাঁচিয়ে রাখে। যেমন রেখেছিলেন ফুটপাথস্থিত সেই ছোট হোশিয়ারি দোকানের প্রৌঢ় মালিক। উচ্ছ্বাসে গেয়ে ওঠা গজলের কলিতে সেই মুহূর্তে আধুনিক লক্ষ্ণৌ–‌এর সঙ্গে ‘খু্যিশতা লখনউ’ (‌পুরনো ‌লখনউ)‌–‌এর প্রেমময় সম্পর্কের স্থায়ী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এবং উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বেগমের মাজার–‌এর যে পথনির্দেশ দিয়েছিলেন তা–‌ও নিশ্চিতভাবে আমাদের পসন্দবাগ–‌এ পৌঁছে দিত।

সময়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অনেকটা সন্দেহেসিদ্ধ রূপসী, পরম প্রেমিকার মত। সারাজীবন ধরে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্ধ হতে হবে, কিন্তু তাকে ত্যাগ করা যাবে না। সকল প্রহর সময়ের হিসেবে বাঁধা। অর্থাৎ প্রতিটি সকাল–‌সন্ধ্যেই মনে করে দিয়েছে কবে লক্ষ্ণৌনগরী ছেড়ে চলে যেতে হবে। একে উদ্দেশ্যতাড়িত ভ্রমণ, তার ওপর সারাক্ষণ মাথায় অজানা অনিশ্চয়তার পাগড়ি। ফলে তেমনভাবে ভাঙা প্রহরের জন্যও ইতিহাসের সামনে দাঁড়ানো হয়নি। পথে পথেই কেটে গেছে দিন–‌রাত্রির দুর্লভ সময়।

জীবনের চিত্রনাট্য ততটা সুলভ নয়, ফলে কোনও পরিচালকের কাছ থেকেই তার কোনও অগ্রিম কপি পাওয়া যায় না। গোমতি নদী পেরিয়ে আসা–‌যাওয়ার ব্যস্ততা ছিল এমনই যে দু–‌দণ্ড তার তীরে বসারও সময় হয়নি। নাটকীয় জীবনের প্রথমার্ধ কেটে যাওয়ার পর বেগম আখতারের লক্ষ্ণৌতেই স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্তের মধ্যে যথেষ্ট বিচক্ষণতা ছিল। তীক্ষ্ণধী বেগম নিজের সঙ্গীতচর্চা ও জীবন যাপনের মেজাজের সঙ্গে শহরটার প্রেমময় সম্পর্ক চিনতে ও বুঝতে ভুল করেননি। তিরিশের দশকের শেষে ‘‌আখতারি মঞ্জিল’ নির্মাণের আগে মেয়ে ও মা (‌মুস্তারি বাঈ)‌ লক্ষ্মৌ–‌এর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন। কিন্তু রথ ও অভিজ্ঞ সারথিদের সাহায্য পাওয়ার পরেও সেইসব বাসস্থানের নির্ভুল হদিশ পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ সাগ্রহে কোনও কোনও মহল্লার উল্লেখ করেছেন ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই সময়ের টানে তাঁদের বিস্মৃতিই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পুরনো বাসিন্দারা স্বাভাবিক শর্তেই অনুপস্থিত। সুতরাং আব্বাসি সাহেবের হ্যাভলক প্লেসের বাংলোটির সন্ধান পেতেও সমস্যা হয়েছে। লক্ষ্ণৌ–‌এর রেডিও স্টেশন থেকে অনতিদূরে অভিজাত অঞ্চলের সেই বাংলোটি এখন শুধুই ইতিহাস। সেই বাংলো এবং তাঁর কিচেন গার্ডেন (‌আখতারি কী বাগ)‌‌ এখন কয়েকটা সুদৃশ্য ফ্ল্যাটবাড়ির ঠিকানা।

সময়াভাবে তেমন করে, সময় নিয়ে ঘুরে–‌ফিরে দেখা হয়নি নবাব ওয়াজিদ (‌লক্ষ্ণৌতে কেউই তাঁকে কলকাতার মত ‘‌ওয়াজেদ’‌ বলেন না।)‌ আলি শা–‌র প্রাসাদটিও। সফরসঙ্গী আলোকচিত্রী সহকর্মী ও ভাতৃপ্রতিম বন্ধু কুমার রায় গোটা সফরে ঠিক কত হাজার ছবি তুলেছেন তা জানা ও গোনা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি সর্বদা তুমুল ব্যস্ত ছিলেন। কখনও কখনও গল্পরা ভালবেসে গলা জড়িয়ে ধরার মতো করে চলাফেরার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। সঙ্গীতরসিক, সঙ্গীতজ্ঞ নবাব ওয়াজিদ আলি শা–‌কে নিয়ে গল্প শোনা শুরু হয়েছিল ফৈজাবাদে এবং লক্ষ্ণৌতে পা দিয়েই। নবাবের সঙ্গীতপ্রিয় স্বভাবের কথা নানা গ্রন্থে যেমন পাওয়া যায়, তেমনই তা ছড়িয়ে আছে লক্ষ্ণৌয়ের সঙ্গীতবিদ ও গবেষকদের নানা রচনা ও মন্তব্যে। বলা হয়, ক্যায়সরবাগ–এ যে রাস (‌‌‘‌রহস‌’‌‌)‌‌ উৎসব হতো তাতে স্বয়ং ওয়াজিদ আলি শা কৃষ্ণ সাজতেন। নবাব গান শিখেছিলেন উস্তাদ বসিত খাঁর কাছে এবং নিজেও একজন প্রথম শ্রেণীর সঙ্গীতবোদ্ধা ছিলেন। তাঁর লয়বোধ ছিল প্রকৃতিদত্ত। প্রখর সঙ্গীতবোধ ও বুদ্ধির অধিকারী হিসেবে তাঁর নিজস্ব ঢঙে নতুন নতুন রাগিনী সৃষ্টি করেছিলেন। নিজের পছন্দ অনুযায়ী তাদের নামকরণও করেছিলেন, যেমন–‌ ‘‌কন্নড়’‌ (‌শ্যাম)‌, ‘‌জুহী’‌, ‘‌যোগী’‌, ‘‌শাহপসন্দ’‌ ইত্যাদি।

তবে সকলেই সর্বদা সঙ্গীতের গল্পে আপ্লুত হয় না। সেখানে ভিন্ন প্রকৃতির কৌতুক ও ইতিহাসের ভাঙা টুকরোও এসে উপস্থিত হয়। লক্ষ্ণৌ–‌এর সর্বত্র নবাব ওয়াজিদ আলিকে যে–গল্পটি নিয়ে বাতাসে ঘুরে বেড়ায় তার মধ্যে নবাবের রসবোধের সঙ্গে সঙ্গে প্রখর আত্মমর্যাদাবোধও জড়িয়ে আছে। ইংরেজ সৈন্যরা প্রাসাদের দখল নিতে আসছে জানতে পেরে নবাব প্রাসাদের সবাইকে নিরাপদস্থানে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি একা, সিংহাসনে বসে। জনশূন্য প্রাসাদে প্রবেশ করে ইংরেজ সেনাপতি সবিস্ময়ে দেখলেন নবাব স্থির ভঙ্গিতে বসে আছেন। তিনি কোনওরকমে প্রশ্ন করলেন— ‘‌একী!‌ সব্বাই চলে গেছে, আপনি যাননি কেন?‌’‌ শান্ত ভঙ্গিতে নবাব বললেন— ‘‌যাব কী করে!‌ আমার জুতো পরিয়ে দেবে কে?‌’‌ তারপর ইংরেজ সেনাপতি নিজের হাতে নবাবকে জুতো পরিয়ে দিলে নবাব নাকি বলেছিলেন— ‘‌এবার চলো, তোমাদের সঙ্গে কোথায় যেতে হবে।’‌

নবাব ওয়াজিদ আলি শা–‌র সেই প্রাসাদে এখন আর সারেঙ্গি ও ঘুঙুরের শব্দ শোনা যায় না। ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাসের মত উদাসী বাতাস আজও এসে প্রাসাদের শরীর স্পর্শ করে চলে যায়। সেখানে নাকি এখন ওষুধ সম্পর্কিত একটা সরকারি গবেষণাগারের কাজ হয়।

সঙ্গীতরসিক ও উৎসাহী পাঠকদের প্রতি নিবেদন, এটা প্রকৃত অর্থে কোনও গবেষণাগ্রন্থ নয়। গজল–‌সম্রাজ্ঞী বেগম আখতার–এর সাংগীতিক মূল্যায়নের প্রশ্নেও এই সংকলন অমূল্য কোনও বিশ্লেষণ উপস্থিত করেনি। তাঁর জন্মশতবর্ষ এক অবিস্মরণীয় সময়লগ্ন। কলকাতা ও বাঙালি শ্রোতাদের সঙ্গে বেগম আখতারের সম্পর্ক জীবনের কান্না–‌হাসির মতই সহজ ও স্বাভাবিক। তাঁর জীবনকাহিনী যেন প্রায় আধুনিক এক রূপকথা। ভারতীয় লঘু–‌উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একাধিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ‘‌গজল’‌–‌এর ক্ষেত্রে বেগম আখতারের অনন্য নিজস্বতা প্রমাণিত। তিনি যে অবিস্মরণীয় স্টাইল নির্মাণ করেছিলেন শুধু তা কথানির্ভর আনন্দ–‌বেদনার গানই নয়, গান গাইবারও শিক্ষণীয় পথনির্দেশ সেখানে জীবন্ত হয়ে আছে। যথার্থ সৎ শিল্পীর মতো তাঁর জীবনই যেন সুরসিক্ত হয়ে উচ্চারিত হয়েছে তাঁর গানে। স্বাভাবিক প্রতিভায় সুরসংযোজনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তুলনাহীন গায়কীতেও মুগ্ধ করেছিলেন গোটা সুরের জগৎকে। দুঃখের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেকটা বাধ্যতামূলক প্রেমের মত, কেউ কাউকে ছাড়েনি কখনও। সুতরাং নিজস্ব উচ্চারণে তিনিই প্রশ্ন করতে পারেন—

রোয়েঙ্গা হাম হাজারবার

কোই হামে রুলায় গা কিঁউ!‌

সারাজীবনে একাধিক অপবাদ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল তাঁকে । বালিকা বয়সে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের বাড়ি পুড়ে যেতে দেখেছিলেন। জীবনে প্রকৃত বন্ধু বলতে শুধু নিজের মাকেই পেয়েছিলেন। তাই নির্ভুল বিবেচনায়, স্থায়ী দুঃখের সিদ্ধান্তে সমাধিস্থলে মায়ের পাশেই শুয়ে থাকতে চেয়েছিলেন বিব্বি থেকে বেগম আখতার হয়ে ওঠা একজন দুঃখী মানুষ। তাঁর নিজের দুঃখ, প্রেম এবং জীবনকাহিনী গানের চেহারায় বেঁচে থাকবে চিরকাল। সেখানেই তিনি অপরাজিতা।

মনুষ্যত্বের মহৎ উপলব্ধি, আলোড়িত স্মৃতির নিঃসঙ্গ একক ভ্রমণ কখনও কখনও মর্মস্পর্শী প্রশ্নোত্তরের চেহারায় উপস্থিত হয়েছে প্রবীণ কবি অলোকরঞ্জনের দীর্ঘ কবিতায়। চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে তিনি যে–‌সত্য জানিয়েছেন, তারই সাক্ষী হয়েছেন প্রবীন কবি সিদ্ধার্থ দাশগুপ্তও। তাঁর কবিতাতেও কেউ যখন রোদনসিক্ত, তখন সেখানে অভিমানে নাকের খিলানে দীপ্ত হীরকখণ্ড কেঁপে ওঠে। কারও জীবনের সঙ্গে অসংখ্য দিন–‌রাত্রি না কাটলে কীভাবে জানা সম্ভব সুখ–‌দুঃখের স্বরলিপি!‌

সুতরাং আম্মিজির প্রথম ছাত্রী প্রবীণা শান্তি হীরানন্দ ছাড়া আর কে–‌ই বা জানাতে পারতেন অন্তরঙ্গ জীবনের ছবি?‌ বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকের স্পর্শে জীবন্ত এক শিল্পীর সৃষ্টিশীলতার ছবিও তাঁর লেখায় উপস্থিত। কৃতী মানুষের জীবনও নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হয়। সঙ্গীতজ্ঞ–সমালোচক এস কালিদাস বেগম আখতারের সমকাল ও অন্য গুণী মহিলা শিল্পীদের প্রসঙ্গ এনে হাত ধরেছেন ইতিহাসেরও। এবং নিজের পছন্দের কিছু সুনির্বাচিত গানের আলোচনা ও সার্থক উল্লেখে অন্য ধরনের এক মজলিস–‌এ পাঠকদের পাশেই বসে গেছেন যেন।

সার্থক একজন শিল্পীই পারেন অন্যের প্রতিভায় মুগ্ধ হতে। কারণ সেই মুগ্ধ হওয়ার ধরনটাও হয় একটু অন্যরকম। বাংলা গানের যশস্বী শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় তাই বিস্ময়ে অভিভূত হতে হতে বলে ফেলেন, ‘‌উনি তালের সঙ্গে যেতে বাধ্য নন, তালই যেন ওঁকে অনুসরণ করছে।’‌ ভারতীয় সঙ্গীতে ‘‌গজল’‌ ও তার বিকাশে বেগম আখতারের ভূমিকাকে ইতিহাসের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বিশিষ্ট সরোদিয়া অনিন্দ্য ব্যানার্জি। ইতিহাসের নিজস্ব ধারায় কখনও কখনও সামান্য উল্লেখই যথেষ্ট। বাস্তবিক কারণেই একই রচনার মধ্যে অন্য প্রসঙ্গে সরে যাওয়ার অসুবিধে থাকে। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে জনপ্রিয় গজল গায়িকা ও গায়কদের নাম উল্লেখ করেছেন অনিন্দ্য। জোহরাবাঈ, কমলা ঝরিয়ার সঙ্গে আছে ‘‌মাস্টার মদন’‌-‌এর নামও। শিশুপ্রতিভা হিসেবে এই ‘‌মাস্টার মদন’-‌এর গান যখন রেকর্ডে প্রকাশিত, তখন সেই শিল্পীমশাইয়ের বয়স ছিল মাত্র সাত। গোটা দেশের সর্বত্র সেই রেকর্ড আলোড়ন ফেলেছিল। অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন খুলনার সেনহাটি গ্রামের সুপ্রভা সরকারও। তখন তাঁর বয়সও ছিল সাত-‌এর কাছাকাছি। কণ্ঠের সুর এবং সঙ্গীতময় সম্ভাবনা বোধহয় চিরকাল ইতিহাসের দরজায় অপেক্ষা করে। একমাত্র সন্তান ‘‌বিব্বি’‌র হাত ধরে ষড়যন্ত্র আর চরম শত্রুতার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে নিজের বাসস্থানকে পুড়ে যেতে দেখেছেন, কিন্তু কন্যার শিল্পীজীবন সম্পর্কে আশা ছাড়েননি মুস্তারি বাঈ। তখনকার বিব্বির বয়সও ওই সাত বছর থেকে খুব দূরে ছিল না। আম্মিজির শেষ বয়সের ছাত্রী প্রভাতী মুখোপাধ্যায় স্মৃতিবেদনার মালা গাঁথার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সতত স্নেহশীলা শিক্ষিকা হিসেবেও কতদূর যত্ন নিতেন। নাটকীয় জীবনের গল্প ও বেগমের সঙ্গীত–কৃতিত্বকে যুক্তি–‌নির্ভর বিশ্লেষণে উপস্থিত করেছেন অভিজ্ঞ সঙ্গীত-সমালোচক অতনু চক্রবর্তী। তার সুদীর্ঘ রচনা নির্ভুলভাবে প্রমাণ করেছে ঠিক কীভাবে ‘‌ছোটা চিজ’‌–‌এর শিল্পী হয়েও বেগম আখতার একদা গোটা দেশের হৃদয় হরণ করেছিলেন। গবেষণা কর্মের মত তথ্য ভারাক্রান্ত না করেও কী করে শিল্পীর জীবনের নানা অধ্যায় ও মহিমাণ্বিত সাফল্যের ইতিহাস একেবারে সারেঙ্গীর সুরের সঙ্গে হাজির হয়েছে অতনুর লেখায়। সব কথার পরেও বলতে হয়, গানের প্রকৃত পরিচয় গানেই বেজে ওঠে। রসিক শ্রোতৃমণ্ডলী চিরকাল গানের খোঁজখবরে উল্লসিত ও আলোড়িত হতে চান। বিপুল পরিশ্রমে রেকর্ড তালিকা উপহার দিয়েছেন সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সঞ্জয় সেনগুপ্ত। এই তালিকার মধ্যস্থিত উল্লেখও একাধিক অর্থে ইতিহাসের অঙ্গ।

ছোট–‌বড় যে কোনও উদ্যোগেই একাধিক সহৃদয় মানুষের আগ্রহ, সাহায্য ও উৎসাহের প্রয়োজন হয়। ‘‌আজকাল’‌–‌এর সঙ্গীতপ্রেমিক সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত পরিকল্পনা অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে প্রবলভাবে উৎসাহও দিয়েছিলেন। আন্তরিক উদ্যোগে লেখা ও দুর্লভ ছবি সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছেন দিল্লিতে থাকা সহকর্মী রাজীব চক্রবর্তী। এছাড়া কলকাতা, বেনারস ও লক্ষ্ণৌ–‌এর সহৃদয় প্রিয়জনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য পাওয়া গেছে। সেইসব সহায়তা বাস্তবিক চেহারায় না পাওয়া গেলে এই প্রয়াস ছাপার অক্ষরে উপস্থিত করা যেত না।

শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে নিবেদিত এই সঙ্কলন গ্রন্থ ভবিষ্যতে যদি কোনও উৎসাহী সঙ্গীত–‌গবেষককে বেগম আখতার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয়, আরও বিস্তারিত চেহারার গ্রন্থ রচনায় কোনওভাবে উৎসাহিত করে তাহলেই আমাদের যাবতীয় পরিশ্রম সার্থক হবে। সাধারণদের অকিঞ্চিৎকর একটি জীবন বোধহয় কোনও বিস্ময়কর, কালজয়ী শিল্পী ও তাঁর সৃষ্টির সকল মাধুর্য ধারণের পক্ষে যথেষ্ট নয়। এবং এই অর্থেই সঙ্গীত চিরকালের। অত্যাচারিত, ছলনায় বঞ্চিত, দুঃখদীর্ণ জীবন নিয়ে দুজন শিল্পী মা ও মেয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। নিজেরা ভালবাসার কাঙাল হয়েও আমৃত্যু ভালবাসার সঙ্গীতময় স্বরূপ শুনিয়ে গেছেন। অল্পদূরের গোমতী নদীর হৃদয়স্থিত বাতাস আজও লক্ষ্ণৌ–‌এর পসন্দবাগে দুজনের সমাধির ওপরে দিওয়ানা হয়ে ঘুরে হয়ত গুণ গুণ করছে—

অ্যায় মোহাব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া.‌.‌.‌

অলক চট্টোপাধ্যায়‌‌
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬
কলকাতা‌

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *