আর কেউই বেগম আখতার হতে পারবেন না – শান্তি হীরানন্দ
১২ বছর বয়সে লাহোর রেডিও-তে ভজন গাইতাম৷ কিন্তু ভাল প্রশিক্ষণ ছিল না৷ সেই সময়ে দাঙ্গার কারণে সেখানে রেডিওতে সংখ্যায় খুব বেশি অনুষ্ঠানও হত না৷ রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য বাধ্য হয়ে আমাদের পরিবার লক্ষ্ণৌতে ফিরে আসে৷ সেখানে ১৯৪৭-এর পর আকাশবাণীতে গান গাইতে শুরু করি৷ ওই সময়েই বেগম আখতার নিয়মিত লক্ষ্ণৌ-এর রেডিও স্টেশনে আসতেন৷ আমার সঙ্গে অবশ্য তখনও দেখা হয়নি৷ উনি আসতেন, গান গেয়ে চলে যেতেন৷ এদিকে, আমাদের মতোই জি সি অবস্তি নামে লাহোর রেডিওর এক আধিকারিক লক্ষ্ণৌ বদলি হয়ে এসেছিলেন৷ তখন আমি আহজাজ হুসেন খাঁ-র কাছে বাড়িতে নিয়মিত ভজন শিখছি৷ একদিন জি সি অবস্তি আমার বাবা-মায়ের সামনে আমাকে ডেকে বললেন— ‘যদি তুমি ভাল করে গান গাইতে চাও তবে সবার আগে ভাল করে গান শিখে নাও৷ বেগম আখতারের কাছে শিখতে পারো৷’ ১৯৫২ সালের গোড়ার দিকে একদিন আমি বেগম আখতারের বাড়িতে গেলাম৷ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে হাইহিল জুতো পায়ে এক বেঁটেখাটো মহিলা এসে দাঁড়ালেন৷ এলোমেলো শাড়ি পরিহিতা সেই মহিলাকে আমি তখনও চিনি না৷ তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘তোমাকে অবস্তিজি পাঠিয়েছে?’ আমি বললাম— ‘হ্যাঁ৷’ তিনি বললেন— ‘তুমি কী গাও?’ বললাম— ‘ভজন গাই৷’ উনি বললেন— ‘গেয়ে শোনাও৷’ শোনালাম৷ উনি বললেন— ‘তুমি তো দেখছি ভালই গাও৷’ আমি বললাম— ‘আমি আপনার কাছে গান শিখতে চাই৷’ উনি বললেন— ‘কাল এসো৷’ ওঁর কথামতো পরদিনই গেলাম৷ উনি আমাকে নিজের শিষ্যা করে নিলেন৷ সেই আমার শিক্ষার শুরু৷
আমি তখনও কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতাম না৷ শুধুমাত্র তানপুরা বাজাতে পারতাম৷ উনি আমাকে ধীরে ধীরে রাগ ‘তিলং’-এর পাল্টা শেখালেন৷ কখনও কখনও পর পর দু-তিনদিন শেখাতেন৷ আবার কখনও একটানা ৪-৫ দিন শেখানোর নামই নিতেন না৷ গজল, ঠুমরি শিখতে গিয়ে ভীষণ ঘাবড়ে যেতাম৷ তিনি বলতেন— ‘শুধু অনুসরণ করো৷’ এইভাবেই চলল৷ তার আগে আমার নিজের সঞ্চয়ের খাতা একেবারে সাদা ছিল৷ উনি যেমন শিখিয়েছিলেন, তেমনি গেয়েছি৷ আজও তাই-ই গাই৷ আমি ওঁর গান ছাড়া আর কিছুই শিখিনি৷ বুঝিনি৷ জানিওনি কোনওদিন৷
‘আম্মি’ নিজে আমাকে তাঁর জীবনের গল্প যা যা বলেছিলেন, সেগুলিকেই আমি আজও ধ্রুব সত্য বলে মানি৷ কখনওই আমার কাছে কিছু গোপন করেননি৷ জেনেছি, আম্মির মা একদা ফৈজাবাদে থাকতেন৷ তাঁরা দুই বোন ছিলেন৷ আনোয়ারি ও আখতারি৷ মাত্র দেড় বছর বয়সে আনোয়ারি মারা যান৷ সেই সময়ে তাঁদের চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে হয়েছিল৷ নিয়মিত খাবারও জুটত না৷ বিয়েবাড়ি-সহ মহল্লার যে-কোনও অনুষ্ঠানে গিয়ে বসে পড়তেন৷ তবে, তাঁর মা জানতেন আখতারির গানের গলা খুব ভাল৷ সেই সময়ে লক্ষ্ণৌতে ইলিয়াস খাঁ নামে একজন সেতার বাজাতেন, বেগমের বাবার সঙ্গে তাঁর জানাশোনা ছিল৷ তিনি মেয়েকে তাঁর কাছে নিয়ে যান৷ তাঁরই পরামর্শে উস্তাদ ইমদাদ হুসেন খাঁয়ের কাছে গান শেখানোর জন্য তাঁকে ভর্তি করা হয়৷ উস্তাদ ইমদাদ হুসেন খেয়াল শেখাতেন৷ আখতারি কিছুদিন শিখলেন বটে৷ কিন্তু, সেই তালিম বেশিদূর এগোয়নি৷ এরপর ইমদাদ হুসেন বলেন— ‘পাটিয়ালার উস্তাদ আতা মহম্মদ খাঁ খুব ভাল গান শেখান৷ আমি নিজে তাঁর সঙ্গে কথা বলব৷ আখতারিকে গান শেখানোর জন্য অনুরোধ করব৷’ তারপর থেকে খাঁ সাহেব ফৈজাবাদে এসে তাঁদের বাড়িতে থেকে গান শেখানো শুরু করেন৷ আখতারির তখন মাত্র ৮-৯ বছর বয়স হবে৷ ভোর ৪টে থেকে উঠে আলাপ করতেন৷ পাল্টা করতেন৷ আবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তালিম চলত৷ এইভাবে উস্তাদ আতা মহম্মদ খাঁ সাহেবই তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন৷ এবং খাঁ সাহেব ওঁদের সঙ্গেই রয়ে গিয়েছিলেন৷ আখতারির বিয়ের পর তিনি মুলতানে ফিরে গিয়েছিলেন৷
আমি যখন তালিম নিচ্ছি তখন লক্ষ্ণৌতে বেগমকে সবাই চিনতেন৷ সেই সময়ে কলকাতাতেও খুবই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি৷ একটি গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ড দিয়ে শুরু করেছিলেন৷ বোধ হয় তার নাম ছিল ‘ঘোষ মেগাফোন কোম্পানি’৷ মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়সেই মঞ্চে প্রচুর গান গেয়েছিলেন আম্মি৷ বহু থিয়েটারেও কাজ করেছেন৷ তখনই শ্রীযুক্ত ঘোষ তাঁর গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য গান রেকর্ডের অনুরোধ করেন৷ তবে, লক্ষ্ণৌতে তিনি কখনও মঞ্চে প্রকাশ্যে গান গাইতেন না৷ কারণ তিনি তাঁর স্বামীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন৷
বেগমের গানের মধ্যে পাটিয়ালা ঘরানার ছাপ ছিল৷ পাশাপাশি পূর্বী ঘরানাও ছিল৷ যেমন ঠেহরাও ও পুকার৷ ঠুমরিতে এক নতুন ঘরানার জন্ম দিয়েছিলেন আম্মি৷ না তা পূর্বের, না পাটিয়ালার ঘরানা৷ এক মিশ্র গায়কী ঘরানা তৈরি করেছিলেন৷ কণ্ঠস্বর এত মধুর ছিল যে শ্রোতারা সবকিছু ভুলে যেতেন৷ তিনি নিজেও সব ভুলে মনপ্রাণ দিয়ে গাইতেন৷
বেগম আখতারের আরও দুই শিষ্যা আছেন অঞ্জলি ব্যানার্জি ও রীতা গাঙ্গুলি৷ পরে শুনেছি কলকাতার প্রভাতীও শিখেছেন৷ তবে, প্রভাতী মুখার্জিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না৷ অঞ্জলিকে আমি ভাল করে চিনি৷ আমার যখন গান্ডা বাঁধা হয়, প্রায় তখনই ওঁর গান্ডা বাঁধা হয়েছিল৷ রেডিওতেও গাইতেন৷ খুব ভাল গান করেন৷ এখন তিনি নয়ডায় থাকেন৷ খুব একটা প্রকাশ্যে আসেন না৷ রীতা এখনও সক্রিয় আছেন৷ গান গাইছেন৷ তবে, রীতা কবে এবং ঠিক কীভাবে বেগম আখতারের কাছে গান শিখেছেন সেটা কিন্তু আমি জানি না৷ কারণ আমার সামনে ওঁর গান্ডা বাঁধা হয়নি৷ আমি শুনেছি, উনি নাকি শিখেছেন৷ তবে, উনি বেগমের সঙ্গে বহু মঞ্চে একসঙ্গে গান গেয়েছেন৷ গান্ডা বাঁধা শিক্ষা শুরুর এমন একটা অনুষ্ঠান, যেখানে গুরু তাঁর শিষ্য বা শিষ্যার হাতে তাগা বাঁধেন৷ গুরু তাঁর শিষ্যদের গুড়-ছোলা খেতে দেন৷ সেদিন থেকেই আনুষ্ঠানিক গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক স্থাপিত হয়৷ এই দিন থেকে একটানা ৪০ দিন তালিম চলে৷ এই ৪০ দিন শিষ্য বা শিষ্যার বাইরে বেরনো চলে না৷
আমার কাছে সঙ্গীতের সবকিছুই ছিলেন আমার আম্মি৷ যখন আমি প্রথম তাঁকে দেখি৷ আর যেদিন তিনি মারা যান, এর মধ্যে কখনও আমি একবারের জন্যেও তাঁর অবাধ্য হইনি৷ তিনি যা বলেছেন অন্ধের মতো তা-ই করে গেছি৷ আমার পরিবারে কেউ কখনও গান গাইতেন না৷ সবাই লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন৷ আমিই একমাত্র গান শিখতাম, গান গাইতাম৷ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান নিয়ে এম এ পাস করেছিলাম, পড়াশোনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছিলাম৷ কিন্তু, আমার মা আমাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে আমাকে গানই গাইতে হবে৷ আম্মি ও আমার মায়ের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল৷ আমার মা আমাকে নিজে বলেছিলেন, ‘তোমার শিক্ষাগুরুই তোমার মা৷ কখনও অবাধ্য হবে না৷ উনি যা বলবেন শুনবে৷’ আমি তা-ই সারা জীবন ধরে মেনে চলেছি৷ আম্মিও আমাকে মেয়ে বলেই মনে করতেন৷ আমার ব্যাপারে কখনও খারাপ কিছু ভাবতেই পারতেন না৷ কেউ যদি বলতেন, এই মেয়েটিকে আমার কাছে রেখে যান আমি গান শিখিয়ে দেব৷ আম্মি বলতেন, না৷ এ আমার বেটি৷ এর কিছু হলে আল্লাহর কাছে মুখ দেখাতে পারব না৷ আমাকে নিজের সম্পদ ভাবতেন৷ অনেক সময় মাসের পর মাস অনুষ্ঠানের জন্য আমি আম্মির সঙ্গে লক্ষ্ণৌ-এর বাইরে থেকেছি৷ তা নিয়ে আমার পরিবারের কেউ কখনও কোনও প্রশ্ন করেনি৷ আজ আমি যতটুকু গাইতে পারি, সবই তাঁর আশীর্বাদের জন্য৷ এখন আমরা যেভাবে গান গাইতে শেখাই, তখন কিন্তু তেমনটা ছিল না৷ শিক্ষাগুরুর গাওয়া দেখে দেখে শিখতে হত৷ আমিও তাই করেছি৷ ওই গান গাইতে গাইতেই কখন যে ওঁর সঙ্গে আত্মার বন্ধনে জড়িয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি৷
লক্ষ্ণৌতে বেগম আখতার-এর রামপুরের নবাবের প্রাসাদে যাওয়া এবং সেখানকার বহু অলঙ্কার নিয়ে চলে আসা নিয়ে বহু চর্চা আছে৷ এসবের বেশিরভাগটাই মিথ্যে৷ জনপ্রিয় গুজব৷ আসলে সে-সময় নবাব, রাজা ও জমিদাররা সঙ্গীতশিল্পীদের মাসোহারা দিয়েই রাখতেন৷ তা না হলে সেই সময়ের শিল্পীরা জীবনযাপন করতেন কীভাবে? রামপুরের নবাব আহমেদ রজা যখন আখতারির গান শুনলেন, তখন মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ডেকে পাঠালেন৷ এবং নিজের মহলে ঘর দিলেন৷ আখতারি ও তাঁর মায়ের থাকা-খাওয়া-সহ সমস্ত কিছুর বন্দোবস্তও করলেন৷ নবাব মাঝেমাঝে তাঁর গান শুনতেন৷ নবাবদের যেমন হয়, প্রায়শই নানা উপহার দিতেন৷ তার ওপর রজা সাহেব নিজেও খুব ভাল কম্পোজিটর ছিলেন৷ নিজে গান গাইতেনও৷ আম্মির একটা বিখ্যাত গান ‘তুম যাও যাও মু সে না বোলো সওতনকে’, এই গানটির কম্পোজিশন করেছিলেন রজা সাহেব৷ অন্যদিকে, আম্মিজিরা ছিলেন পেশাদার শিল্পী৷ ফলে যে যা উপহার দিতেন এঁরা সেগুলো নিতেন৷ তাই বলে কখনও লুটপাট করে কিছু নিয়ে নেওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না৷ নবাব রজা আলি খুশি হয়ে রুপোর পানদান, দামি আয়না ইত্যাদি উপহার দিয়েছিলেন৷ সেগুলি আমিও দেখেছিলাম৷ কিন্তু, সেই আমলের ন’লাখি হার নিয়ে আসার যে-কথা লোকমুখে শোনা যায়, তা মোটেই সত্যি নয়৷ চলচ্চিত্র-পরিচালক মেহবুবের ‘রোটি’ সিনেমায় গান করার জন্য আম্মি রামপুর থেকে বম্বে গেলেন, তারপর আর কখনও রামপুরে ফেরেননি৷
আম্মির বিয়েও হয়েছিল লক্ষ্ণৌতে৷ এক সময় বম্বেতেও অনেক বছর ছিলেন৷ মালাবার হিলস-এর বাড়িতে৷ কিন্তু, তিনি আবার গানেই ফিরতে চাইছিলেন৷ সিনেমার সবকিছু ছেড়ে উস্তাদ ওহিদ খাঁয়ের কাছে খেয়াল শিখতে শুরু করেন৷ এইসময় লক্ষ্ণৌয়ের একটি থিয়েটারে আব্বাসি সাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়৷ তিনি কাকুরির তালুকদার ছিলেন৷ আব্বাসি সাহেব লন্ডন থেকে পড়াশোনা করে আসা একজন ব্যারিস্টারও ছিলেন৷ তিনি আম্মির গানের খুবই ভক্ত ছিলেন৷ বিয়ের শর্ত রাখেন, বিয়ে করতে হলে গান গাওয়া চলবে না৷ বিশেষ করে লক্ষ্ণৌতে তো নয়ই৷ শুনেছি এই শর্তে এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন আখতারি৷ ৭ বছর আর গান করেননি৷ কারণ, তিনি তখন বাইরের ব্যস্ত-জীবনে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন৷ সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করতে চাইছিলেন৷ বেগম সঈদা রাজা নামে এক মহিলার সেই বিয়ের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল৷ তিনি একজন সুবক্তা সরকারি আধিকারিক ছিলেন৷ লক্ষ্ণৌ রেডিওতে উর্দু বিভাগে জনপ্রিয় সংবাদ পাঠিকা ছিলেন সঈদা৷ আম্মির সঙ্গে তাঁরও খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল৷ সঈদা আপা এক আই এ এস অফিসার মিঃ রাজার স্ত্রী ছিলেন৷ স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি মিঃ আহমেদকে বিয়ে করেন৷ তিনিই আব্বাসি সাহেবের সঙ্গে আম্মির বিয়ে দিয়েছিলেন৷ এই ব্যাপারটা বিস্তারিত বলতে চাই না৷ এটা ওঁর একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়৷ তবে, বিয়ের পর লক্ষ্ণৌয়ে হ্যাভলক রোডের একটি বাড়ি কিনে দিব্যি সুখে সংসার করছিলেন তাঁরা৷ ওঁর মা থাকতেন চিনা বাজারে, নিজেদের বাড়িতে৷ ১৯৫০ সালে ওঁর মা মারা যাওয়ার পর ভীষণ ভেঙে পড়েন আম্মি৷ তখন ওঁর স্নায়বিক সমস্যাও দেখা দিয়েছিল৷ আব্বাসি সাহেবকে চিকিৎসকরা বললেন, ওঁকে গান গাইতে দিন৷ না হলে উনি পাগল হয়ে যাবেন৷ ১৯৫০ সালের পর আবার গান শুরু করলেন আম্মি, রেডিও লক্ষ্ণৌতে৷ লক্ষ্ণৌ রেডিওতে সুনীল বোস ছিলেন৷ তিনিও সাহায্য করেছিলেন৷ ‘৫২-তে আম্মির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল৷ তখনও দেখেছিলাম, আব্বাসি সাহেবের সামনে তিনি গান গাননি৷ আব্বাসি সাহেব কোর্টে বেরিয়ে যাওয়ার পর আম্মি গান গাইতে বসতেন৷ তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন৷
প্রথমে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে মেনে না নিতে পারলেও জীবনের নানা সমস্যার মধ্যে থেকেও তাঁদের সবারই মন জয় করেছিলেন তিনি৷ নিজের মমতা, ব্যক্তিত্বের মাধুর্য ও সহানুভূতির মাধ্যমে ‘আখতারি বাঈ’ থেকে ধীরে ধীরে ‘বেগম আখতার, এবং সেখান থেকে ‘আম্মি’ এবং ‘আচ্ছি আম্মি’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি৷
উঁচুমানের দক্ষ তবলিয়া মুন্নে খাঁকে নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায়৷ আজও মনে আছে, একদিন, শামিম নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে আম্মি বলেছিলেন, তিনি তাঁর দূরসম্পর্কের বোন৷ পরে আম্মির তবলিয়া মুন্নে খাঁয়ের সঙ্গেই তাঁর বিয়ে হয়৷ এই মুন্নে খাঁ আম্মির গান খুব সমঝদারির সঙ্গে বুঝতেন৷ আম্মির সঙ্গে ওঁর খুব ভাল তালমিল ছিল৷ আম্মিই নিজের উদ্যোগে শামিমের বিয়ে দিয়েছিলেন মুন্নে খাঁয়ের সঙ্গে৷ মুন্নে খাঁ আম্মির সঙ্গে সব সময় থাকতেন৷ বম্বেতে থাকাকালীন সেখানেও তিনি আম্মির সঙ্গে ছিলেন৷ পরে শামিমের সঙ্গে তাঁর যখন বনিবনা হল না তখন তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়৷ কিন্তু, তার পরেও মুন্নে খাঁ প্রায়শই আম্মির কাছে আসতেন৷
আম্মির জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে বেগমের মা মুস্তারি বাঈয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ আম্মির তো সেই অর্থে মামা, চাচা, দাদা, বাবা কেউই ছিলেন না৷ মা-ই ওঁর জীবন ছিল৷ সেই কারণেই আম্মি তাঁর মাকে হারিয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন৷
৭ বছর তিনি অনুষ্ঠানের গান থেকে দূরে ছিলেন৷ এই সময় তিনি কেবল লক্ষ্ণৌ-এর রেডিওতেই গাইতেন৷ কিন্তু, তখন তাঁদের সংসারের বিপুল খরচ জোগানোর কোনও উপায় ছিল না৷ শম্মোর (শামিম) ১২টি সন্তান ছিল৷ আব্বাসি সাহেবও অবসর নেওয়ার পর আরও টানাটানি চলছিল৷ তখনও তিনি সব মুখ বুজে কত কিছু সহ্য করেছেন! কিন্তু অনবরত গান গেয়েছেন৷ সবার সব খরচ জুগিয়েছেন৷ সকালে গাড়ি এসে ওঁকে স্টুডিওতে নিয়ে যেত আবার ছেড়ে দিয়ে যেত৷ এইভাবেই চলত৷
অনেক পরে দিল্লিতে কনস্টিটিউশন ক্লাবে শঙ্করলাল ফেস্টিভ্যালে প্রথম আমাকে নিজের সঙ্গে গান গাইয়েছিলেন৷ আজও ওঁর গান ছাড়া আর কারও গানই আমার ভাল লাগে না৷ আমি যেন ওঁর পাপোশ হয়েও কত শান্তিতে ছিলাম৷ আজ সঙ্গীতের অনেক কিছুই ভাল লাগে না৷ আম্মিকে ছাড়া আমি আজও কিছুই ভাবতেই পারি না৷
অনেক গানের স্মৃতি আজও মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়৷ দাদরা, ঠুমরি, কাজরি ইত্যাদির মধ্যে ঠুমরিতে ‘আবকে শাওন ঘর আয়া’ গানটা আমার চিরকালই বড্ড ভাল লাগে৷ গানটা শুনলেই আজও আমার সব পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়৷ সব্বাই জানেন, কাজরি বর্ষার গান৷ ‘বরষণ লাগি শাওয়ন বুন্দিয়া’ শুনলে বুক কেঁপে ওঠে৷ দাদরায় ‘শাম বিনা লাগে না আঁখিয়া হামার’৷ গজলে ‘দিলকি বাত কহি নেহি যাতি’৷ প্রত্যেকটি গানের মধ্যেই জীবনদর্শনের প্রতিফলন আছে৷ প্রত্যেকটি গান মন ছুঁয়ে যায়৷ আমি কখনও বুঝতে পারতাম না উনি কখন কী গাইবেন! উনি নিজেও বোধহয় মঞ্চে উঠেও জানতেন না কী গাইবেন৷ হঠাৎ যা খুশি শুরু করে দিতেন৷ ফলে ওঁর সঙ্গে গান গাওয়া সর্বদা খুবই ভয়ের বিষয় ছিল৷
অনেক স্মৃতি আজও অক্ষয় হয়ে আছে৷ যে ঘটনাগুলো মনে পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম হল অনেক সময় উনি কখনও কখনও গান গাইতে শুরু করেই হাউহাউ করে কাঁদতেন৷ আমি অবাক হয়ে যেতাম৷ অনেক প্রশ্নও করতাম৷ কী হয়েছে জানতে চাইতাম৷ উনি কিন্তু কিছুই বলতেন না৷ কিছুক্ষণ পরে আবার গাইতেন৷ এখন বুঝি, ওঁর জীবনে বহু দুঃখ ছিল৷ গান গাইতে শুরু করলেই সেই দুঃখ জীবন্ত হয়ে জেগে উঠত৷ তিনি তথাকথিত শিক্ষিত ছিলেন না৷ কিন্তু, শিল্পী হিসেবে শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যেতে ওঁর কোনও জুড়ি ছিল না৷ অনেক সময় অকারণে রেগে যেতেন৷ খেপে উঠতেন৷ কেঁদে ফেলতেন৷ প্রকৃত শিল্পীর মতোই আবেগপ্রবণ ছিলেন৷
অনেক মজার কথাও মনে পড়ে৷ উনি সাধারণত অন্যের কম্পোজ করা গান গাইতেন না৷ নিজেই কম্পোজ করে নিতেন৷ আশ্চর্যজনকভাবে, তাৎক্ষণিক দক্ষতায় কম্পোজ করতে পারতেন৷ বিস্ময়কর গায়নদক্ষতার জন্য মনে হত, সেই গজলটি যেন ওঁর জন্যেই লেখা হয়েছে৷ একবার আমরা বম্বে থেকে লক্ষ্ণৌতে ফিরে আসছি৷ উনি ট্রেনেই যাতায়াত করতেন৷ স্টেশনে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর দৌড়ে এসে প্রখ্যাত গজল লিখিয়ে শাকিল বদায়ুনি একটা চিরকুট দিয়ে গেলেন৷ বললেন, এই গজলটা আমি আপনার জন্যই লিখেছি৷ আম্মি সেই চিরকুটটা আমার হাতে দিয়ে বললেন হাতব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে৷ ওঁর হাতব্যাগটা ছিল যেন প্যান্ডোরার বাক্স৷ দুনিয়ার সবকিছুই থাকত সেটার মধ্যে৷ ট্রেনে সবসময় প্রথম শ্রেণীতে যাতায়াত করতেন৷ একসঙ্গে সেই কামরার ৪টি আসনই বুক করতেন৷ নিজস্ব গোপনীয়তার দিকটা সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতেন৷ অসম্ভব ধূমপায়ী ছিলেন৷ উনি চাইতেন উনি শুয়ে থাকবেন, আর আমি ওঁর পা টিপে দেব৷ খুব সকালে উঠে চা খাওয়ার অভ্যেস ছিল৷ শাকিলজির গজলটার কথা বলছিলাম, ভোপালে পৌঁছে চা খেয়ে আমাকে বললেন চিরকুটটা বের করে দিতে৷ সঙ্গে একটা ছোট্ট বাদ্যযন্ত্র ছিল৷ সেটিকে বের করে চিরকুটটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই গেয়ে উঠলেন, ‘এ মহব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া’৷ সেই বিখ্যাত গজলের সৃষ্টি হল৷ আমি অবাক বিস্ময়ে সেদিন তাঁর সেই ঐশ্বরিক ক্ষমতার সাক্ষী হয়েছিলাম৷
সেবার মাঝরাতে তাঁর সিগারেট ফুরিয়ে গেছে৷ তিনি সিগারেট ছাড়া থাকতেই পারতেন না৷ রাতে কোনও এক অজানা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়েছে৷ উনি বললেন, দেখ কোথায় সিগারেট পাওয়া যায়৷ আমি বললাম, এত রাতে সিগারেট, কোথায় যাব? আশপাশে তো কোনও দোকানও দেখছি না৷ ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে করছে৷ দূরে গার্ড লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে সিগনাল দিচ্ছেন৷ উনি আমাকে বললেন— ‘এদিকে আয়, বুদ্ধু কোথাকার!’ ট্রেনের দরজা থেকে মুখ বের করে গার্ডকে হাঁক দিলেন, ‘ওরে আমার ভাই, এদিকে আয়৷’ বেচারা গার্ড মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা ছিলেন৷ গার্ড এসে সবিনয়ে জানতে চাইলেন, কোনও সমস্যা হয়েছে? উনি বললেন, সিগারেট শেষ হয়ে গেছে৷ এখানে কোথাও সিগারেট পাওয়া যাবে? গার্ড সাহেব জানিয়ে দিলেন— ‘এখানে কোথাও সিগারেট পাওয়া যাবে না৷ অনেক দূর যেতে হবে৷ ট্রেন ছেড়ে দেবে৷’ গার্ডের দু-হাতে থাকা লাল-সবুজ পাতাকা এবং লণ্ঠন কেড়ে নিলেন আম্মি৷ আশীর্বাদক ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন— ‘তোমার ছেলেমেয়ের ভাল হোক৷ তোমার ভাল হোক বাবা৷’ তাঁর হাতে ২০০ টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘সিগারেট এনে দে বাবা৷’ হঠাৎ দেখলাম, ম্যাজিকের মতো ঘটনাটা ঘটে গেল৷ সেই টিপিক্যাল পাথরমুখো গার্ড ভদ্রলোকই দৌড়ে গিয়ে কোথা থেকে সিগারেট এনে দিলেন৷ তারপর ট্রেন চলল৷
খাবার বানাতে খুব ভালবাসতেন৷ তবে, উনি খাবার বানালে বিকেল ৪টের আগে খাবার মিলত না৷ বড্ড খুঁতখুঁতে ছিলেন৷ নতুন কড়াই, নতুন বাসনপত্র এনে তারপর রান্না বসাতেন৷ আমাদের পেটে ছুঁচো দৌড়লেও কারও কিচ্ছু বলার উপায় ছিল না৷ তবে হ্যাঁ, সত্যি বললে, সেই বিলম্বিত লয়ে পাকানো খানাও ছিল ওঁর গানের মতো অতুলনীয়৷
মাত্র ৬০ বছর বয়সে মারা গেছেন৷ আরও বেশি বয়সে ওঁর মৃত্যু হলে জীবনকাহিনী কী হত জানি না৷ আম্মি যাঁদের জন্য নিজের সবকিছুই বিলিয়ে দিয়ে গেছেন তাঁরাও তাঁকে দেখতেন কিনা আমার সন্দেহ ছিল৷ শেষের দিকে আমি দিল্লিতে, উনি লক্ষ্ণৌতে থাকতেন৷ আমার পক্ষেও ওঁর সঙ্গে দেখা করা মুশকিল হত৷ তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়েই উনি চলে গেছেন৷ এটাই ভাল হয়েছে৷
পদ্মশ্রী উপাধি পাওয়ার পর আমি আম্মির সমাধিস্থল সংরক্ষণে জোর দিই৷ সেজন্য জমির প্রয়োজন ছিল৷ একটি গম খেতের পাশে ওঁর সমাধিস্থল করেছিলেন ওঁরা৷ সেখানে সংরক্ষণ করতে যেতে ওঁর স্বামীই আপত্তি করলেন৷ বললেন, বেগম শাম্মোর ছেলেমেয়েদের জন্য নাকি ওই গম খেত রেখে গেছেন৷ শাম্মোর ৩ স্বামীর ১২-১৩ জন ছেলেমেয়ে আম্মির সমাধিস্থলের আশপাশের সব জমি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বিক্রি করে দিয়েছেন৷ সেখানে পৌঁছনোর কোনও রাস্তা ছিল না৷ অন্যের বাড়ির ছাদে উঠে আম্মির সমাধিস্থল দেখতে হত৷ এই কাজে আমি লক্ষ্ণৌ-এর সেলিম কিদোয়াই ও মাধবী কুকরেজার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সম্পূর্ণ সাহায্য পেয়েছি৷ ২০০৮-০৯ সাল থেকে তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের কাছে বহু দরবার করে শেষমেশ আমার আম্মি বেগম আখতারের সমাধিস্থল সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ আদায় করেছি৷ সংরক্ষণ করতেও সক্ষম হয়েছি৷ এই কাজে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের দুই সচিব মিঃ ব্যানার্জি ও মিঃ সরকার সবরকমভাবে আমাদের খুবই সাহায্য করেছিলেন৷
এ বছর বেগম আখতারের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে৷ অসামান্য শিল্পীদের কখনও কোনও তুলনা পাওয়া যায় না৷ তেমনই বেগম আখতার আর কেউ হতে পারবেন না৷ যতই আমার কণ্ঠস্বর ওঁর সঙ্গে মিলুক না কেন, উনি উনিই৷ আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান৷ উনি ছিলেন আমার মা, আমার পথপ্রদর্শক, আমার গুরুমা৷ শিক্ষাগুরুর সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে যাওয়ার মতো সৌভাগ্য জীবনে কতজনের হয়! এখন একটাই প্রার্থনা, যে ক’দিন বেঁচে আছি আম্মির নামের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকতে চাই৷ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত৷
অনুলিখন: রাজীব চক্রবর্তী