বুকের মধ্যে আগুন – ৮

॥ আট ॥

রতনলাল বাংলাদেশ ছেড়ে বিহার চলে এসেছে। কিন্তু বেশী দূরে যেতে পারছে না। টাকাগুলোর চিন্তা তার মনের মধ্যে সব সময় আলপিন ফোটাচ্ছে। প্রায় একজন স্রষ্টা স্ত্রীলোকের হাতে টাকাগুলো রেখে আসতে হলো। সে যদি ফেরত না দেয়?

রতনলাল এসে উঠলো ধানবাদে। দু’দিন বাদেই সে একবার আসানসোলে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছিল। কুমারডুবির কাছাকাছি পর্যন্ত গিয়ে বুঝেছিল পুলিশ এত কড়া নজর রেখেছে যে সে চোখ এড়াতে পারবে না।

রতনলালের নিজের কাছেই এখন খরচ চালাবার মতন টাকা পয়সা নেই। অন্য কারুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। খড়গপুরের একটা বাড়ির আর দু’দিন পরে সকলে এসে মিলিত হবার কথা। কিন্তু রতনলাল যে ধানবাদ থেকে কড়গপুরে যাবে, সেই ট্রেন ভাড়াই নেই। আসানসোল ষ্টেশনেই যদি গোলমালটা না হতো, তাহলে সে শ্রীরামপুরে আগে থেকে ঠিক করা আস্তানায় বেশ আরামেই থাকতে পারতো।

একজন সহৃদয় বিহারী ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হবার পর রতনলাল লজ্জা-টজ্জা ত্যাগ করে কিছু সাহায্য চাইলো। সে বললো,যে চাকরি খোঁজার জন্য সে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পরেড়ছিল তারপর চোরে তার সর্বস্ব চুরি করে নিয়ে গেছে।

ভদ্রলোক ওর কথা বিশ্বাস করলেন, বাড়িতে নিয়ে এসে পেট বলে খাওয়ালেন, আর দশটা টাকা দিলেন। তার পক্ষে কল্পনা করাও শক্ত, এই নিরীহ চেহারার বিনীত ছেলেটির কোমরে একটা পিস্তল গোঁজা আছে।

খড়গপুরে ট্রেনে আসতে হলে আসানসোলের ওপর দিয়ে গিয়ে বর্ধমানে আবার বদলাতে হবে। কিন্তু রতনলাল আসানসোল পার হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইলো না। ষ্টেশনে যেটুকু সময় ট্রেন দাঁড়াবে, সেই সময় কোনোক্রমে যদি কেউ তাকে চিনে ফেলে? এর সম্ভাবনা খুব কম হলেও বলা তো যায় না। পুলিশের হাতে সে কিছুতেই ধরা দেবে না। খড়গপুরে মিটিংটা সেরে নিয়েই সে যুক্ত প্রদেশের দিকে পাড়ি দেবে। তার আগে টাকাটা উদ্ধারের ব্যবস্থা একটা করতেই হবে অবশ্য।

অনেক ঘোরাপথে সে খড়গপুরের দিকে রওনা হলো দু’দিন আগেই। বার বার বদল করে এবং অনেক জায়গা পায়ে হেঁটে সে শেষ পর্যন্ত পৌছে গেল ঠিক।

ওদের দলের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন লোকের নাম অশ্বিনী ঘোষ, তার একটা বাড়ি আছে এখানে। সেই বাড়িতে এসে মেলার কথা। এই বাড়িতে আগেও তিনবার এরকম মিটিং হয়েছে। অশ্বিনী ঘোষ সে সব সময় কলকাতায় থাকে-দৈবাৎ পুলিশ এ বাড়ি সন্ধান পেয়ে গেলেও সে যাতে বলতে পারে যে এসব তার অজ্ঞাতসারে হয়েছে।

রতনলাল সতর্কভাবে বাড়িটার দিকে এগোলো। সন্ধে হয়ে এসেছে। বাড়িটা শহর ছাড়িয়ে একটু বাইরে। রতনলাল দেখলো, তার আগে আগে লম্বা মতন একজন হেঁটে যাচ্ছে।

আর একটু এসে তাকে চিনতে পেরে সে চেঁচিয়ে ডাকলো, রফিক?

রফিক ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, রতনদা? উঃ মনে হচ্ছে যেন কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম! গোঁফটা কোথায় গেল?

-উড়িয়ে দিলাম।

-খবর সব ঠিক আছে তো?

-না, রে, ঠিক নেই।

দু’জনে অল্পক্ষণে মধ্যেই পরস্পরের কাহিনী শুনে নিল। রফিক অনেক কিছু করেছে। টাকাটার সৎ ব্যবহার করতে পেরেছে। রতনলাল কুণ্ঠিতভাবে বললো, আমার সব গোলমাল হয়ে গেল। টাকাটা এমন জায়গার রেখে আসতে বাধ্য হলাম

– রতনদা, তোমার চেহারা একি হয়েছে? এই কদিনেই?

– আরে, রাখ চেহারা! টাকাটার জন্য।

-অত ভেবো না। ঠিক উদ্ধার করা যাবে। সব্যসাচীর কোনে খবর পেয়েছো?

-না। তবে সব্যসাচী আসবে নিশ্চয়ই আজ। ও যেখানেই থাক ঠিক আসবে। আমি যে আসতে পেরেছি–

-আমাদের কেউ ধরা পড়েনি তো?

-কিছুই তো খবর পাইনি। আমরা অবশ্য অনেকটা আগে এসে গেছি, নটার সময় সবার আসার কথা।

-চলো, ভেতরে গিয়ে বসি। যদি দরজা খোলা থাকে –

বাড়িটা একবারে অন্ধকার। সদর দরজা বন্ধ তাকার কথা। অরিন্দম এসে চাবি খুলবে। কিন্তু দরজাটা একটু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।

ভেতরটা আরো অন্ধকার। তবু ওরা ঢুকে পড়লো ভেতরে। রফিক পকেট থেকে দেশলাই বার করে জালালো। বাড়িটার অনেকগুলো সুবিধে আছে। দোতলায় মেথরদের ওঠবার জন্য আর একটা সিঁড়ি আছে, হঠাৎ কোনো বিপদ দেখা দিলে পেছন দিক দিয়েও পালানো যায়।

বারান্দা পেরিয়ে একটা ছোট উঠোন। সেখানে সামান্য একটা চাঁদের আলো এসে পড়েছে। সেই আলোতে দেখা গেল, অরিন্দম দাঁড়িয়ে আছে।

রতনলাল খুশী হয়ে বললো, এই তো অরিন্দম এসে গেছে। আলো জ্বালো নি কেন?

অরিন্দম কোনো উত্তর দিল না। কয়েকদিনে সে দারুণ রোগা হয়ে গেছে। মুখখানা অসম্ভব বিবর্ণ। যেন সে দাঁড়িয়ে থাকতেই পারছে না।

রতনলাল আবার জিজ্ঞেস করলো, সব্যসাচী কোথায়? সে আসবে না?

অরিন্দম এবার ঠোঁট নাড়লো, কিন্তু কি বললো, বোঝায় গেল না।

রফিক বললো, আপনার কি হয়েছে? আপনি এরকম করছেন কেন?

ফ্যাকাসে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে অরিন্দম, রফিক আর রতনলাল এগোচ্ছে তার দিকে। ওদের দু’জনের জুতোর শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। অরিন্দমকে দেখে খুশী হয়েছে রতনলাল, সে ওকে আলিঙ্গন করার জন্য হাত বাড়ালো।

এক পা পিচিয়ে গেল অরিন্দম। রতনলাল একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার? কিছু খারাপ খবর আছে? সব্যসাচী কোথায়?

হঠাৎ অরিন্দম চেঁচিয়ে উঠলো, পালাও! শিগগির এখনো পালাও!

রতনলাল ঘুরে দাঁড়াবার সময় পেল না। তিনজন পুলিশ অফিসার বাঘের মতন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। প্রচণ্ড শক্তিতে সে ঝটকা দিয়ে তাদের হাত ছাড়াবার চেষ্টা করলো, যদি অন্তত কোমর থেকে পিস্তলটা টেনে বার করতে পারে। পারলো না তাও, শিক্ষিত পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পিস্তলটা সরিয়ে ফেলল প্রথমেই। হাতে হাতকড়া পরালো।

রফিককেও দু’জন জড়িয়ে ধরেছিল, কিন্তু সে কোনেক্রমে পিছলে বেরিয়ে গেল। পিস্তলটা বার করেই সে গুলি চালালো অন্ধকারের মধ্যে। কার যেন লাগলো। সে দৌড়ালো দরজার দিকে। একজন পুলিশ সেখানেও ছিল, রফিক আবার গুলি চালাতেই সে সরে গেল। তারপর রফিক বাইরে বেরিয়ে যেন একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। অনেকগুলো পুলিশ তাকে খোঁজাখুজি করলো অনেকক্ষণ ধরে। আর পাওয়া গেল না।

হাত দুটো বাঁধা পড়ার পরেও রতনলাল ছটফট করছে, পুলিশরা তার ঘাড়ে রদ্দা মেরে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করলো। তাকে ঠাণ্ডা করা সহজ কথা নয়।

সে অরিন্দমের দিকে চোখ রাখতে পারলো না। মুখ ফিরিয়ে বললো, তুই–তুই– অরিন্দম সেদিকে চোখ রাখতে পারলো না। মুখ ফিরিয়ে নিল।

হাতকড়া বাঁধা হাত নিয়েই রতনলাল ঝাঁপিয়ে পড়লো অরিন্দমের ওপর। বোধ হয় সেও টুটি ছিড়ে দিত, তার আগেই একজন পুলিশ পিস্তলের বাঁট দিয়ে তার মাথায় মেরে তাকে অজ্ঞান করে, ফেললো।

ঐখানে আর একটু পরে ধরা পড়লো নিরঞ্জন, বাবুল আর নিমাই। ওরা নিজেরাই এসে যেন ফাঁদে পা দিল।

একদিন খড়গপুরে রেখে ওদের নিয়ে আসা হলো কলকাতায়। রতনলালকে রাখা হলো সাত নম্বর সেলে।

সেখানে এসেই রতনলাল শুনলো, সব্যসাচীকে জেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করতে লাগলো সে। কিন্তু তার হাতপাতালে যাবার অনুমতি নেই।

পরদিন অপ্রত্যাশিতভাবে সেখানে এসে পৌঁছালো রফিক। তাকে ও ঠেলে দিল রতনলালের সেলে। অদ্ভূত চেহারা হয়েছে রফিকের। মাথার চুলগুলো শক্ত হয়ে আছে। মুখে আর হাতে ও কালো কালো ছাপ।

রতনলাল বললো, এ কি করে হলো?

রফিক বললো, দৌড়াবর সময় ধাক্কা লেগে একটা আলকাতর ড্রাম উল্টে গিয়েছিল, তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম।

-কখন?

-কাল।

-তারপর ব্যাটারা ধরার পর ধোওয়ার ব্যবস্থা করে নিঃ

-আলকাতরা ওঠাতে অনেক তেল লাগে। অতখানি তেল কি আর খরচ করবে। তবে, আমাকে এই চেহারায় একবার কোর্টে নিয়ে যা না! জজ সাহেবকে বলবো-

-তুই জানিস তো, অরিন্দম সব বলে দিয়েছে।

-শেষে পর্যন্ত অরিন্দম? নিজের চোখে দেখলেও যেন বিশ্বাস হয় না। সব মামলাতেই দেখেছি, একজন না একজন রাজসাক্ষী হবেই। পুলিশরা কি কায়দা জানে বলো তো?

-মার সহ্য করতে পারে না সকলে। রেডি থাকিস, আমাদের মার খাওয়ার পালা আসেনি এখানো।

-আমাদের মারবে কেন? ধরেই তো ফেললো।

-অরিন্দম কতটা বলছে তার ঠিক কি? আমাদের অ্যাকশানের কথা- পুলিশ টাকাগুলো বার করার চেষ্টা করবে-আরও কে কে দলে আছে-পুলিশ তো কিছুতেই খুশী হয় না!

পরদিনই রফিককে রতনলালের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে রাখা হলো জেলের একেবারে অন্য প্রান্তে। রফিকের সঙ্গে দেখা করতে এলো ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কয়েকজন মুসলমান অফিসার। তারা রফিককে এই রকম মিথ্যে আশ্বাস দিল যে, রফিক যদি অন্যদের সব কথা বলে দেয়, তা হলেই তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হবে। শুদু শুধু সে কেন নিজেকে ওদের সঙ্গে জড়াচ্ছে।

রফিক সবচেয়ে মিষ্টভাষী পুলিশ অফিসার টিকে বললো, আপনি তো আমার খুব শুভাকাঙ্খী, আপনি আমার উপকার করবেন?

পুলিশ অফিসারটি সাগ্রহে বললো, কি বলুন?

-আমার প্রথম ডিক্লারেশানে কয়েকটা কথা বাদ পড়ে গেছে সেগুলো যোগ করে দেবেন? -হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

-তখন একটা কথা বলতে আমি ভুলে গেছি। ট্রেন ডাকাতির সময় সেই নেপালী ভদ্রলোককে আমি খুন করেছি।

ইন্সপেক্টর বললেন, তাই নাকি? হাই ইন্টারেস্টিং আপনার বন্ধুও যে সেই কথাই বললেন।

-আমার কোন বন্ধু?

-রতনবাবু। উনি বললেন, নেপালীটিকে উনিই খুন করেছেন আপনি তখন সেখানে ছিলেনই না।

-রতন ঠিক বলে নি। আর রতন আমার বন্ধুও নয়। ও অযোগ্য, সব সময় ভয় পেত, কোনো কাজ নিজে অংশ গ্রহণ করতে চায় নি-এই ট্রেনের অ্যাকশানেওর কোনো দায়িত্বই ছিল না।

-হুঁ! আর উনি বলছেন, উনিই নাকি সব কিছু পরিকল্পনা করেছিলেন। ঐলোকটিকে আপনারা যে রকম মনে করেন, সে রকম কিন্তু নয় একটুও। অসম্ভব ধূর্ত। আপনাদের সবাইকে জড়াতে চাইছে। আপনাদের নামে এমন সব কথা বলেছে-

রফিক তাকে বাঁধা দিয়ে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো, আপনাদের ঐ কায়দা খুব জানা আছে আমাদের। আমাকে এসে বলবেন রতনলালকে বিশ্বাসঘাতক, সে সব ফাঁস করে দিয়েছে। আর রতনলালকে গিয়ে বললেন, আমি বিশ্বাসঘাতক, আমি সব ফাঁস করে দিয়েছি। আপনি মুসলমান বলে আমার কাছে এসেছেন, আর ওর কাছ পাঠানো হবে হিন্দু অফিসারদের। তাই না? এরকমভাবে আগে অনেককে ধোঁকা দিতে পেরেছেন, আমাদের পারবেন না।

রতনলালের ওপরেও প্রথম দিকে তেমন কোনো অত্যাচার করা হলো না। তবে দিনের পর দিন সাত আট জন লোক তাকে ঘিরে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে হাজার রকম প্রশ্ন করে যায়। তারা প্রথমত জানতে চায়, টাকাগুলো কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে আর, সারা দেশের আর কোন বড়বড় নামকরা লোক এর সঙ্গে জড়িত আছে। নিশ্চয়ই সে রকম কেউ কেউ আছে। একমাত্র সব্যসাচী ছাড়া পুলিশের চোখে আর সবাই নতুন আসামী।

রতনলাল একটা কথারও উত্তর দেয় না। সে শুধু বলে সে পুলিশের কাছে কোনো ষ্টেটমেন্ট দেবেনা। যা বলার আদালতে বলবে। তবু একই প্রশ্ন বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে পুলিশ ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিতে চায়। কিন্তু রতনলাল চুপ করে বসে থাকে। সে রফিকের মতন হাস্য পরিহাসও করে না।

এরপর হঠাৎ শুরু হয় তার ওপর নানা ধরনের অতাচার। পর পর দুদিন তাকে খাবার দিতে ভুলে গেল জেল কর্তৃপক্ষ। তৃতীয় দিনে কয়েকজন পুলিশ এক গাদা ভালো ভালো খাবার নিয়ে এসে খুব ক্ষমা-টমা চাইলো। তারা বার বার বললো, এটা অন্যায় হয়ে গেছে। যাই হোক, পুলিশের সঙ্গে একটু সহযোগিতা করলেই তো তাকেও এ ক্লাসে প্রিনার করে রাখা হবে। তখন যা খুশি তাই খেতে পারবে। শুধু একবার বলে দিন, অমুক অমুক নেতা আপনাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন কিনা!

রতনলাল বললো, কেন মিছিমিছি আমাকে বিরক্ত করছেন। আমি ট্রেন ডাকাতি করেছি, একটা লোককে মেরেছি, টাকাগুলো নষ্ট করেছি-এ সবই তো আপনারা জানেন। এখন আমাকে আন্দামানে পাঠান বা ফাঁসি দিন, যা খুঁশি করুন। আমি আর অন্য কিছু জানি না!

এরপর পুরো দু’ঘন্টা রতনলালকে হাতে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হলো। মাঝে মাঝে তার হাঁটুতে রুলের গুঁতো মেরে এক একজন প্রশ্ন করে, কি কিছু বলবি, হারমীর বাচ্চা?

রতনলাল যেন একটা পাথর। এত মারধোর, অত্যাচারেও তার মুখ দিয়ে একটা কথা বার করা যায় না। পুলিশ অফিসারদের দিকে সে অবজ্ঞার চোখে তাকায়। যেন তার চোখে ওরা মানুষ বলে গণ্য করার মতনও কিছু নয়।

রাত্তিরবেলা যখন সে একা থাকে, তখনই তার মুখটা খুব বিষণ্ন হয়ে যায়। সে আপন মনে বিড়বিড় করে একা কথা বলে। রতনের মনের মধ্যে শুধু এই গ্লানি যে, তারা সার্থক হতে পারলো না। ট্রেন ডাকাতির এতগুলো টাকা, এতগুলো ছেলের প্রাণ-কিছুই তো কাজে লাগানো গেল না। দলপতি হিসাবে এই ব্যর্থতার বিরাট বোঝা শুধু যেন একা একা তাঁ কাঁধেই চেপে বসেছে।

এদিকে বিভিন্ন সংবাদপত্র রতনলালদের নিয়ে খুব হৈ-চৈ করা হচ্ছে। ছাপা হয়েছে তাদের ছবি। জেলখানায় তাদের ওপর অত্যাচারে বিবরণ কি করে বেরিয়ে এলো বাইরে, দেশি সংবাদপত্রগুলো তাই নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলো সরকারকে। আর সাহেবী কাগজগুলো প্রশ্ন করলো, গত পাঁচ ছ’বছর তো সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বন্ধ ছিল, আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো কি করে? এর পেছনে কি কংগ্রেসীদের হাত আছে? মিঃ গান্ধী কোনো কথা বলছেন না কেন?

মহাত্মা গান্ধী অবিলম্বেই বিবৃতি দিলেন, দেশের জন্য যারা কাজ করতে এসেছে, তিনি তাদের সকলকেই ভালোবাসেন। তবে হিংসামূলক কার্যকলাপ তিনি কোনোদিনই সমর্থন করবেন না।

কলকাতার নাগরিকদের নিয়ে একটা কমিটি গঠন করা হলো এদের মামলা চালাবার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য। কয়েকজন উকিল ব্যারিষ্টার আসতে লাগলেন জেলে। তার ফলে, জেলখানায় এদের থাকার ব্যবস্থার উন্নতি হলো, শারীরিক অত্যাচার কমলো। সেই সঙ্গে সঙ্গে সরকার ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হতে লাগলো এদের কঠোর শাস্তি দেবার। যাতে সন্ত্রাসবাদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠবার আগেই সমূলে বিনষ্ট হয়।

রতনলালকে একদিন জানানো হলো ভিজিটিং আওয়ার্সে একজন স্ত্রীলোক তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। নাম, সুশীলাবালা দাসী।

রতনলাল রীতিমতো অবাক হয়ে গেল। এ নামের কারুকে সে চেনে না। আলাদাভাবে দেখা করতে আসবে, এরকম কোনো মহিলার সঙ্গে ও তার আলাপ নেই। পাটনা থেকে তার বাবা ও বড়দি এসে গত সপ্তাহে একবার দেখা করে গেছেন।

রতনলাল সেখানে গিয়ে দেখলো মাথায় ঘোমটা দেওয়ার একজন মহিলা। মুখ তুলে তাকাতেই চমকে উঠলো।

আসানসোলের সেই বস্তির ভানুমতী। সিঁতিতে সিঁদুর, কপালে টিপ আর লাল পড়ে শাড়ী পরে অন্যরকম সেজে এসেছে-যাতে তাকে কেউ বারবনিতা বলে চিনতে না পাবে।

ভানমতী কোনো কথা বলার আগেই রতনলাল তাকে চোখে ইশারা করলো সাবধান হতে। একজন শাস্ত্রী পাশেই দাঁড়িয়ে। পাঠান শাস্ত্রী হয়তো বাংলা বোঝে না, তবু বিশ্বাস করা যায় না। তাছাড়া ভানুমতীর ওপর পুলিশের নজর পড়বে এবারে ওকে অনুসরণ করবে। বাড়িঘর সার্চও করতে পারে। এটা বেফাঁস কথা বললেই বিপদ।

ভানুমতী বললো, তোমাকে আমরা চিনতে পারিনি, কত রকম আজে বাজে কথা বলেছি। তাই পায়ের ধুলো নিতে এলাম।

রতনলাল বললো, তুমি যে এসেছো, আমি খুব খুশী হয়েছি। হয়তো আর কোনোদিন দেখা হতো না।

-আমাকে তুমি কি বিপদেই যে ফেলে গেছ। আমার একটুও ঘুম হয় না, সব সময় কাঁটা হয়ে থাকি।

রতনলাল ঠোঁটের ইশারায় বললো, চুপ করো।

ভানুমতী তবু থামলো না। বললো, তোমার ছেলেকে আমি কি করে মানুষ করবো? আমার সহায় সম্বল নেই, থাকবার জায়গা নেই-আমি তাকে নিয়ে কি করি!

রতনলাল বড় রকমের একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভানুমতীকে দেখে যাই মনে হোক, তার বৃদ্ধি আছে। টাকার কথাটা সে বলে ফেলে নি

অদ্ভূত ধরনের কৃতজ্ঞতা বোধ করলো রতনলাল।

অতগুলো টাকা নিয়ে ভানুমতী যদি আসানসোলের সেই বস্তি থেকে একবার সরে পড়তো- কোনোদিন আর তার খোঁজ পাওয়া যেত না। ওর যে রকম দুঃখের জীবন, তাকে টাকাগুলোর লোভ সংবরণ করতে যদি নাও পারতো, তবু খুব একটা দোষ দেওয়া যেত না। কত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সে এসেছে।

রতনলাল বললো, ছেলে তোমার কাছেই থাক। পরে একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। ভানুমতী বললো, না, না সেও কি হয়। তোমার ছেলে, আমার কাছে থাকলে তার কত অযত্ম হবে আমি সারাক্ষণ তাকে চোখে রাখতে পারবো?

রতনলাল একবার শাস্ত্রীর দিকে তাকালো। মুখ দেখলে মনে হয় নিরেট মূর্খ। কি জানি, সে কি ভাবছে।

রতনলাল বললো, তুমিই পারবে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আমার ছেলে তোমার কাছেই থাক!

ভানুমতি ব্যাকুলভাবে বললো, আমি যে নিজেই বিশ্বাস রাখতে পারি না কখন কি হয়ে যায়। তোমার কোনে আত্মীয়-বন্ধু নেই, তার কাছেই ওকে পাঠিয়ে দিতাম। যেমন করে হোক, আমি ঠিক পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবো।

রতনলাল দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো। টাকাটা সে কার কাছে পাঠাতে বলবে? তার দলের প্রায় সকলেই ধরা পড়েছে। যারা ধরা পড়েনি, তাদের ঠিকানাই বা জানবে কি করে? কয়েকজন যে শুভানুধ্যায়ী আছে, তাদের ওপরেও পুলিশের নজর পড়তে পারে। অন্য কোনো বিপ্লবী দলেরও এই টাকা পেলে অনেক কাজে লাগতো। কিন্তু সবাইকে কি বিশ্বাস করায় যায়? ঠিকানাই বা জানবার উপায় কি? কাগজে কিছু লিখে দেবার উপায় নেই।

দেখা করার সময় এক্ষুণি শেষ হয়ে যাবে এর মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে। টাকাটা যেন গভর্ণমেন্টের হাতে কিছুতেই না পড়ে।

রতনলাল বললো, নিজের কাছে না রাখতে পারো, তাহলে ছেলেকে গান্ধীজীর আশ্রমে পাঠিয়ে দিতে পারবে? সবরমতীতে ওনার আশ্রম।

ভানুমতী বললো, পারবো।

তারপর ভানুমতী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমাকে যে কি পরীক্ষায় ফেলেছিলে! আমি দিনরাত ঠাকুরকে ডাকতাম, ঠাকুর আমাকে রক্ষা করো। ছেলেটা যদি হঠাৎ চুরি হয়ে যায়, তাহলেও তো কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না। তখন ঐ দেবতুল্য লোকটাকে আমি কি কৈফিয়ৎ দেবো?

রতনলালের ইচ্ছে হলো, ভানুমতীর পায়ের ধুলো নিতে কিন্তু তা সম্ভব নয়। সে মনে মনে বললো, আমার জীবনের যদি কিছু পুণ্যফল থাকে তা হলে তার সবটুকুই আমি এই দুঃখিনী স্ত্রীলোকটিকে দিলাম।

বিদায় নেবার সময় সে ভানুমতীকে মুখে শুধু বললো, যদি বেঁচে থাকি, আবার দেখা হবে। আদালতে মামলা ওঠার সময় রতনলালের সঙ্গে রফিক, সব্যসাচী, নিরঞ্জন প্রভৃতির দেখা হলো। অরিন্দমকে সেখানে না দেখে ওরা একটু অবাক হয়েছিল। সরকারী পক্ষের সাক্ষী হিসাবেও অরিন্দমকে আনা হচ্ছে না। কয়েকদিন পরেই জানাজানি হয়ে গেল, অরিন্দম আত্মহত্যা করেছে। শেষের দিকে অরিন্দমের মাথার গোলমাল দেখা দেয়- লালবাজারের তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছে।

সব্যসাচীর হাতে এবং কাঁধে এখনও বিরাট ব্যাণ্ডেজ। কিন্তু তার মুখখানা বেশ উৎফুল্ল। আদালতে সে চেঁচামেচি করে আর মুহূমুহূ মাতরম ধ্বনি দেয়।

রতনলালকে সে জিজ্ঞেস করে, কি রে মুখ শুকনো করে আছিস কেন? এখনই তো আনন্দ করার সময়। আর তো চিন্তা-ভাবনা করার কিছু নেই।

রতনলাল বললো, সেজন্য নয়। আমাদের সব কিছু ব্যর্থ হয়ে গেল।

সব্যসাচী বললো কেন, ব্যর্থ হবে কেন, আমাদের যেটুকু সাধ্য আমরা করেছি।

-কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আমরা ট্রেনের অ্যাকশানটা করলাম-তার কিছুই হলো না। টাকাটা পর্যন্ত কাজে লাগানো গেল না।

কিন্তু আমাদের জীবনটা তো কাজে লাগিয়েছি। আমাদের যদি ফাঁসিও হয়, তাতে ও দুঃখ নেই, এক ক্ষুদিরাম ফাঁসি চড়ে কতগুলো বিপ্লবীর জন্ম দিয়ে গেছে।

রফিক কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো, রতনদা। তুমি দুঃখ করো না। সুকুমারকে আমরা পাঠাতে পেরেছি। আমাদের কিছুটা উদ্দেশ্য ওখানেই সিদ্ধি হয়েছে, সুকুমার ধরা পড়ে নি, সে খাঁটি ছেলে-সে আমাদের বিপ্লবের কাজ বয়ে নিয়ে যাবে!

রতনালালের মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠেলো। সে বললো, ঠিক। সুকুমার এখনো আছে। সে আমাদের সকলের প্রতিনিধি হয়ে রইলো।

সব্যসাচী বললো, আমার আর কি মনে হয় জানিস? আদালতে আমাদের সবার সব ঘটনা খুলে বলা উচিত। আমাদের বিবৃতির যেটুকু কাগজে ছাপা হবে তাতেই অন্যরা বুঝতে পারবে আমরা কি করতে চেয়েছিলাম। এরা আমাদের সারারণ ডাকাত সাজতে চাইছে।

রফিক বললো, আমারও তাই মত।

রতনলাল বললো, আমিও এতে রাজী।

তারপর আদালত তারা বেপরোযা হৈ-হল্লায় মাতিয়ে রাখে। জজের কোনো নির্দেশ মানে না। পুলিশের ব্যাটনের ঘা খেয়েও গানস জুড়ে দেয়।

জেলখানাতে ও এরা এখন আর নিঃশব্দ থাকে না। সকলকে বিভিন্ন সেলে রাখা হয়েছে। কিন্তু পরস্পরকে জান দেবার জন্য একজন বন্দে মাতরম চেঁচিয়ে উঠলেই অন্যরা সাড়া দেয়। সব্যসাচী গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে, রতন, রফিক, নিরঞ্জন, বাবুল-বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, তোরা শব্দ শুনতে পাচ্ছিস? মাইরি,আজ মুড়ি আর তেলেভাজা পেলে যা জমতো ন! গভীর রত্রে হঠাৎ সব্যসাচী সেল থেকে গান ভেসে আসে।

একবার তোরা মা বলিয়া ডাক
জগৎ-জনের শ্রবণে জুড়াক
হিমাদ্রি পাষাণ কেঁদে গলে যাক
মুখ তুলে আজি চাই রে। —
আপনার মায়ে মা বলে ডাকিলে
—আপনার ভায়ে হৃদয়ে রাখিলে
সব পাপ তাপ দূরে যাবে চলে
পূণ্য প্রেমের বাতাসে—-

রতনলালের গলায় সুর নেই, তবু উঠে সেও গুণগুণ করে গলা মেলায়। রফিক লোহার গরাদ ধরে শূন্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে।

অন্যরা একজন আলাদা সেলে থাকলেও রফিকের ঘর আর একজনকে রাখা হয়েছে। লোকটা সাধারণ অপরাধী কিংবা বা পুলিশের স্পাই। এখনো বোধ হয় পুলিশের আশা আছে, রফিক সরকারের দয়া চেয়ে আরও অনেক কথা ফাঁস করে দেবে।

রফিকের বহু আত্মীয়-স্বজন এসে এর মধ্যে তাকে বোজবার অনেক চেষ্টা করছে। রফিকের চাচাজীকে ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের এক বড় কর্তা রায় বাহাদুর আশ্বাস দিয়েছে যে রফিক রাজসক্ষী হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করলেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। রফিক কর্ণপাত করেনি।

শেষ পর্যন্ত রতনলাল, রফিক আর সব্যসাচী তিনজনের ফাঁসির দণ্ড হয়ে গেল। এত কঠোর দণ্ডদেশের কোনো লোকই আশা করেনি। সারা দেশে দারুণ একটা উত্তেজনা দেখা ছিল। মহাত্মা গান্ধী ভাইসরয়কে অনুরোধ করলেন, দণ্ড পুনর্বিবেচনা করার জন্য। এই বিপ্লবীদের সমর্থনে কলকাতায় একটি মিছিল পরিচালনা করতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র কারাবরণ করলেন।

বিপ্লবীর কেউই আপীল করলো না।

রফিকের চাচাজী আজ এসে বিষম পেড়াপীড়ি করতে লাগলেন। তিনি পাকা খবর নিয়ে এসেছেন, আপীল করলেই মৃত্যদণ্ড হ্রাস হয়ে কয়েক বছরের মাত্র জেল হবে।

রফিক বললো, না।

চাচাজী বললেন, কেন বাছা, তুই এরকম জেদ করছিস কেন?

রফিক উত্তর দিল, চাচাজী আপনার বড় ভাইয়ের যখন ক্যান্সার হয়েছিল, তখন সবাই জানতো তিনি কয়েক মাস পরেই মারা যাবেন। তখন কার কাছে আপীল করেছিলাম? বৃটিশ সরকারের কাছে?

রফিকের ভয় ছিল তিশনা নিশ্চয়ই দেখা করতে এসে খুব কান্নাকাটি করবে। তাহলে রফিকের মন দুর্বল হয়ে যেত বোধ হয় একটু। কিন্তু তিশনা একদিনও আসেনি নিশ্চয়ই তার বাড়ির লোকসব জানতে পেরে খুব ভয় পেয়ে গেছে। হয়তো তিশনাকে সরিয়ে দিয়েছে কলকাতার বাইরে।

কুন্তলা একদিন দেখা করতে এলো সব্যসাচীর সঙ্গে। পুলিশ রমেশবাবু, কুন্তলা মেজদি তিনজনকে গ্রেফতার করেছিল। রমেশবাবুকে এখানে আটক রেখেছে-বাকী দু’জন জামিনে ছাড়া পেয়েছে।

কুন্তলা এসে জিজ্ঞেস করলো, আপনার হাতের ব্যথা কি রকম? একটু কমে নি?

সব্যসাচী হেসে বললো, এ ব্যথাটা আর এ জীবনে কমবে না।

কুন্তলা পরের দু’এক মিনিট কোনো কথা বলতে পারলো না। এই দু’দিনে অনেক রোগা হয়ে গেছে সে। অনেকটা তপস্বিনীর মতন দেখায় তাকে।

সব্যসাচী বললো, তোমাদের বিশেষ কিছু শাস্তি দেবে না বোধ। হয় এবার তোমাদের ছেড়ে দেবে।

কুন্তলা সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললো, আপনাদের এখানে পড়বার বই-টই দেয়। কিছু লাগবে আপনার?

-না, বই-টই পাওয়া যায়।

-কিছু পেতে ইচ্ছে করে আপনার।

হ্যাঁ তোমাকে পেতে চাই।

কুন্তলা মুখ নীচু করলো। সব্যসাচী বললো, বিপ্লবী হিসাবে হয়তো ছোট হয়ে গেছি, শুধু দেশমাতৃকার চিন্তা নিয়ে মরতে পারলাম না। আমর দুটো দুঃখ বয়ে গেল। আমি দেশের জন্য আরও কিছু করতে পারলাম না। আর তোমাকে, পেলাম না। শুধু তোমার জন্য আমি দেশকে ছাড়তে পারতাম না। আবার দেশের জন্যও তোমার কথা মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। আমি অর্ধেক বিপ্লবী -এই সত্যি কথাটা তোমাকে শুনিয়ে যাচ্ছি।

-না, একথা ঠিক নয়। আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীদের একজন।

সব্যসাচী একটু হেসে বললো, দু’দিন বাদে মরতে যাচ্ছি। এখন তো মিথ্যে বলে লাভ নেই। দেশকে যতখানি ভালোবাসি, তোমাকে তার চেয়ে একটু কম ভালোবাসি নি। পরাধীনতার জন্য আমার বুকের মধ্যে আগুন জ্বলেছিল। এখন বুঝতে পারি, তুমিও আমার মধ্যে এক সাংঘাতিক আগুন জ্বালিয়েছিলে। এট বোধ হয় খাঁটি বিপ্লবীর ধর্ম নয়। তবু একথাটা স্বীকার করে যাই।

কুন্তলা মৃদু গলায় বললো, আমি পরজন্মে বিশ্বাস করি। আমি জানি, পর জন্মে ঠিক আবার আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে।

সব্যসাচী বললো, ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করে থাকবো।

দেশের লোকের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কিছুই গ্রাহ্য করলে না সরকার। ওদের ফাঁসির তারিখ নির্দিষ্ট হয়ে খেল।

সাধারণত ভোরবেলাই ফাঁসি দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু ওদের সেই চরম মুহূর্তে এলো রাত বারোটায়। রাতারাতিই মৃতদেহগুলি দূরে সরিয়ে ফেলার ইচ্ছে।

সব্যসাচী বই পড়ছিল। দরজা খোলর শব্দ হতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বললে, পথ দেখিয়ে নিয়ে চলুন, আমি নিজেই যাচ্ছি।

রফিককে জেল থেকে বার করার পর সে জেল অফিসারকে বললো, আপনার কাছে চিরনি আছে? পকেটে চিরুনি নেই?

-না তো চিরুনি মানে-

-হ্যাঁ, একটা চিরুনি এনে দিন না! শাদী করতে যাচ্ছি, একটু সেজে গুজে যেতে হবে না? এক বছর পর আমার শাদী করার কথা ছিল, একটু আগে আগেই হয়ে যাচ্ছি।

জেল অফিসার অন্য দিকে মুখ লুকোলো।

একমাত্র রতনলালই অত শান্তভাবে মরতে গেল না। শাস্ত্রীদের পায়ের আওয়াজ চেয়েই সে চেঁচিয়ে উঠলো, বন্দে মাতরম।

সে চিৎকার এমনই প্রচণ্ড যে, গরম কেঁপে উঠলো সার জেলখানা। প্রত্যেকটা বন্দী জেগে উঠলো সেই শব্দে

রতনলাল আর একবার সেই ধ্বনি দিতে অন্য কুঠুরি থেকে প্রতিধ্বনি ভেসে এসো।

ইউরোপীয় জেল সুপারিটেণ্ডন্ট ধমক দিল, কিপ ই মাউথ শাট।

রতনলাল তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললো, আরও কিছু শাস্তির ভয় দেখাবে নাকি? বেশ করবো, বললো।

রতনলাল আবার চিৎকার করলো, বন্ধে মাতরম।

সারা জেল থেকে তার উত্তর পাওয়া গেল। সাধারণ কয়েদীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতন এই ধ্বনিতে গলা মেলাচ্ছে।

রতনলালকে কচুপ করার জন্য ব্যাটন দিয়ে প্রচণ্ড এক ঘা মারা হলো তার মাথায়। সে মাটিতে পড়ে গেল, সেইখান থেকেই আবার সে চেঁচিয়ে উঠলো।

মিটিন দশেক ধরে রতনলালকে মারধোর করা চললো। টেনে হিঁচড়েও তাকে আনা যায় না। সে যেন এক মিছিল পরিচালনা করছে। শ্লোগানে সে জেল ভরিয়ে দিচ্ছে। তার মুখ দিয়ে তখন ভলকে রক্ত বেরচ্ছে এক সঙ্গে তিন চারজনে মিলে রতনলালকে এক সময় চুপ করিয়ে দিল। মাটি থেকে আবার টেনে হিচড়ে যখন তাকে তোলা হলো, তখন সে অজান হয়ে গেছে না একেবারেই মরে গেছে, তা বোঝার উপায় নেই। সে সজ্ঞানে ফাঁসির দড়ি গলায় পরলো না অন্তত। সেই অবস্থায় হঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে আসা হলো তাকে।

ফাঁসির মঞ্চের কাছে সব্যসাচীই আগে পৌঁছে গেছে। তর বন্ধুরাও তখন আসে নি বলে সময় কাটাবার জন্য সেস তার কাঁধের বাজেটা খুলে ফেলতে লাগলো একহাত দিয়ে। তার তো ব্যাজেটা রাখার দরকার নেই।

ব্যাণ্ডেজটা সব খুলে ফেলে সে সস্নেহে তার ক্ষত-স্থানটার দিকে তাকালো। ইঞ্জিন ড্রাইভারটা একটা মোক্ষম ঘা দিয়েছিল বটে। সেই লোকটা এখনো বোধ হয় কোনো রাতের ট্রেন চালাচ্ছে, এই খবরটা জানতে পারলে লোকটা বোধ হয় খুশীই হবে।

কুন্তলা বলেছিল, পরজন্যে দেখা হবে। পরজ বলে কি সত্যি কিছু আছে। মাথার ওপরে ঐ যে বিরাট আকাশ, ওটা কি শুধুই শূন্যতা না এক রহস্যের যবনিকা।

যাক, সুকুমার ধরা পড়েনি। আমাদের সকলের বাসনর প্রতীক হয়ে রইলো সুকুমার। সুকুমার, এই দেশটার দুর্দশা দুর করিস। একদিন যেন এই দেশ জগৎ সভায় আবার শ্রেষ্ঠ আসন নেয়। এখানে যেন কোনো মানুষের দুঃক থাকে না। আমরা পারলাম না। তুই পারিবি, ঠিক পারবি।

এই সময় কুন্তলার মুখটা মনে পড়ে গেল তার। কুন্তলা ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সব্যসাচী একটু অবাক হলো। দেশের জন্য সে প্রাণ দিতে যাচ্ছে, এখন শুধু দেশের কথাই তো চিন্তা করা উচিত ছিল তার। তবু একটি নারীর মুখ এসে দেশকেও আড়াল করে দিচ্ছে কেন। অন্যান বিপ্লবীদের কি এরকম হয়।

পুকুরের ধারে বসে জলের আয়নার নিজের মুখ দেখা-যে জীবন, তা আজ কত দূরে। তবু চিরকার ঐ ছবিটা থেকে যাবে।

রতনলালকে আনতে দেখে সব্যসাচী বললো, রতন, একবার কোলাকুরি করি।

রতনলাল কোনো সাড়া দিল না। সব্যসাচী তাকে ভালো করে দেখে একবার শিউরে উঠলো। তারপর ব্যাঙ্গ সুরে জেল অফিসারকে বললো, একে আগেই মেরে নিয়ে এসেছেন? কাজ এগিয়ে রাখছেন বুঝি?

এবার রফিক এসে পৌঁছালো। সে দৌড়ে এস জড়িয়ে ধরলো সব্যসাচীকে। সব্যসাচী যন্ত্রনায় চেঁচিয়ে বললো- উ উ উঃ! তুই আমার ব্যথার জায়গায়-

অপ্রস্তুত হয়ে রফিক ছেড়ে দিল তাড়াতাড়ি যন্ত্রণায় সব্যসাচীর চোখে জল এসে গেছে। তবু সেই অবস্থায় সে হেসে বললো, এখনো হাতের ব্যথার জন্য কি রকম চেঁচিয়ে উঠলুম! জীবনটা এই রকমই, না রে?

তারপর সে রফিকের কাধে সুস্থ হাতটা রেখে বললো, চল।

দুই বন্ধু নির্ভীকভাবে উঠে গেল ফাঁসির মঞ্চে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *