॥ ছয় ॥
অরিন্দম ফিরে এসেছে। তার দিদিও উঠে এসেছেন ওপরে। রমেশ নিজের স্ত্রীকে আর শ্যালককে অভিযুক্ত করে বললেন, তোমরা আমাকে পথে বসাতে চাও?
অরিন্দম বললো, দিদির কোনো দোষ নাই। সব দায়িত্ব আমার। আমরাই জোর করে এখানে উঠেছি-আপনি তখন ছিলেন না। আমার আর কোন উপায় ছিল না।
– কিন্তু এসবের মধ্যে আমাকে জড়ানোর মানে কি?
-আমরা কয়েকদিন পরেই চলে যাবো।
কয়েকদিন? তোমরা আজই চলে যাও।
আজ যাওয়া অসম্ভব। আমি একটু ঘুরে দেখে আসতে গিয়েছিলাম। এখানকার রাস্তায় পুলিশ গিজগিজ করছে। কিন্তু একটা ব্যাপার সন্দেহ করে বাইরের পুলিশ এখানে এসেছে।
-তোমার বন্ধু তো অসুস্থ। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এসো গে!
-তার উপায় নেই। পুলিশ ওকে চিনে ফেলবে। পুলিশের কাছে ওর ছবি আছে।
-সর্বনাশ। তাহলে পুলিশ তো এ বাড়িতে আসতে পারে।
-জামাইবাবু আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। আমরা যদি আর বাড়ি থেকে না বেরোই -আমাদের কেউ খোঁজ পাবে না। আজকের কাগজে আসানসোলের একটা ঘটনা দেখলাম। আমাদের দলের কেউ কিনা ঠিক বুঝতে পারছি। যাই হোক পুলিশ এখানো ওদিকেই জোরদার করবে তল্লাশি।
সব্যসাচী বললো, আমার জামাটা গায়ে গলিয়ে দে। আমি চলে যাচ্ছি।
অরিন্দম তাকে চোখের ইশরায় চুপ করতে বললো।
সব্যসাচী তবু বললো, কারুক ওপর জোর করে জুলুম করে আমি আর থাকতে চাই না। আমি আমার রাস্তা খুঁজে নেবো।
অরিন্দম দিদির দিকে তাকালো। দিদি তাঁরা স্বামীকে বললেন, হ্যাঁ গো, তুমি এই অসুস্থ ছেলেটিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে?
রমেশ বললেন, যারা এই সব কাজের ঝুঁকি নেয়, তাদের কি উচিত আমাদের মত নিরীহ লোককে বিপদে জড়ানো?
সব্যসাচী বললো, আমরা যে কাজ করছি, সেটা আমার আপনার এবং সকলের জন্য। স্বাধীনতা এলে আপনিও তার ফল ভোগ করবেন, কিন্তু তার জন্য একটুও স্বার্থত্যাগ করতে পারবেন না।
-অত সব বড় বড় কথা আমি বুঝি না। ইংরেজ রাজত্বে আমরা কি খারাপটা আছি? তবু দেশে একটা নিয়মকানুন আছে। ইংরেজ চলে গেলে কে চালাবে দেশটা? আপনারা আপনাদের তো বারো রাজপুতের তেরো হাড়ির হাল। নিজেদের মধ্যে এখন থেকেই মারামারি খাওয়া- খাওয়ি করছেন।
সব্যসাচী কিছু একটা কঠিন কথা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু দিদির কথা চিন্তা করে চুপ করে গেল। মুখ নীচু করে শুধু আস্তে আস্তে জানালো, আপনাকে বিপদে ফেলার জন্য মাফ চাইছি। এখন যদি আমরা চলে যাই, তাহলে আমাদের কথা কেউ জানতে পারবে না। যদি ধরা পড়ি, আমাদের মেরে ফেললেও কোনো কথা বলবো না। দিদি, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
সব্যসাচী উঠে দাঁড়িয়েছে। অরিন্দম কি করবে বুঝতে পারচ্ছে না। সব্যসাচী তাকে খানিকটা ধমক দিয়ে বললো, দেরি করছিস কেন?
– সত্যি যাবি?
– তা ছাড়া কি, এমনি এমনি বলছি নাকি?
কুন্তলা পাথরের মূর্তির চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। দিদির মুখ মাটির দিকে। তিনি নরম স্বভাবে মহিলা, স্বামীর ওপরেও জোর দিয়ে কথা বলতে পারে না।
রমেশের সামনেই সব্যসাচী পিস্তলটা। গুজলো কোমরে। টাকাগুলোএকটা খবরের কাগজ দিয়ে বন্ডিল করা সেটা ও গুজ পেটের সঙ্গে। জামাটা তুলে নিয়ে একটা হাত গটো গুজে নিল একটা হাত ঝুলতে লাগলো বাইরে। তার গায়ে তখনও অনেক জ্বর। চোখ দুটো লাল। তবু গলায় জোর আছে। অরিন্দদমের কাধে! অরিন্দমের কাঘে হাত রেখে বললো চল।
সব্যসাচীকে দেখলেই বোঝা যায়, এরকমভাবে বেশীক্ষণ চলতে পারবে না। অত বড় চেহারার মানুষটা একেবারে অসহায় হয়ে গেছে। বারে বারে অরিন্দমের গায়ের ওপর ঝুকে পড়ছে। নেমে গেল সিড়ি দিয়ে।
বাইরে রাস্তায় লোক চলাচল কম। রীতিমত অন্ধকার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব্যসাচী বললো, স্টেশন কত দূরে?
অরিন্দম বললো, মাইল দেড়েক দূরে।
ঠিক আছে, যদি একটা সাইকেল রিকসা টিকশা পাওয়া যায় তাহলে কোনো অসুবিধা হবে না। আমাকে ষ্টেশনে পৌছে দিয়ে তুই ফিরে আসবি। তোর তো এখানে থাকার কোনো অসুবিধে নেই!
রমেশ সঙ্গে সঙ্গে দরজার পর্যন্ত এসেছিলেন! তিনি বললেন, একটু দাঁড়িয়ে যান তাহলে। এখান থাকে রিক্সা ধরে—
-না এগিয়ে যাই ততক্ষণ। এরপর কটার সময় ট্রেন আছে।
-কোন দিকের
-যে কোনো দিকের।
-আটটা কুড়িতে একটা-
-ঠিক আছে। ধন্যবাদ-
পেছন থেকে চটি ফটফটের আওয়াজ পাওয়া গেল। কুন্তলা বেরিয়ে এসে বললো, চলুন আমিও যাচ্ছি!
রমেশ বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোথায় যাবি, কুন্তলা?
কুন্তলা বললো, ওদের ষ্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি। নতুন লোক, রাস্তাঘাট চিনতে পারবেন না-
অরিন্দম মৃদু গলায় জানালো, না কুন্তলা, তোমার যাবার দরকার নেই
-চলুন দেরি হয়ে যাচ্ছে শুধু।
রমেশ এসে কুন্তলার হাত চেপে ধরে বললেন, কি পাগলামি করছিস! আয়, বাড়িতে আয়- কুন্তলা অত্যন্ত শান্ত এবং দৃঢ় গলায় বললো, দাদা আমি যাবো!
– তুই বাড়িসুদ্ধ সবাইকে বিপদে ফেলতে চাস?
-আমি আর কারুকে বিপদে ফেলবো না।
রমেশ অসহায় বোধ করলেন। ছোট মফঃস্বল শহর। এখানকার রাস্তা দিয়ে ছেলে- মেয়েরা এখনো পাশাপাশি হাঁটে না। বিশেষত সন্ধ্যের পর কোনো কুমারী মেয়েকে পথে দেখতে পাবার কথা ভাবাই যায় না। আর কুন্তলা এখন যাবে, কোমরে পিস্তল গোঁজা ছোকরাদের সঙ্গে। যে কোনো মুহূর্তে যাদের পুলিশে ধরতে পারে?
তিনি এ কথাও জানেন, কুন্তলাকে জোর করে ফেরাতে গেলে এখন অনেক কাণ্ড হবে। যা জেদী মেয়ে, কিছুতেই কথা শুনবে না। চেঁচামেচি শুনে অন্য লোকজন না এসে পড়ে।
তিনি পেছন ফিরে তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন। দিদির মুখ ভাবলেশহীন। বোঝা যায়, কুন্তলাকে ফেরাবার জন্য দিদি একটি কথাও বলবেন না। দূরে হেড লাইট জ্বালিয়ে একটি গাড়ি আসছে। রমেশ ভয় পেয়ে গিয়ে বললো, ভেতরে চলে এসো, সবাই ভেতরে চলে এসো-
সব্যসাচী বা অরিন্দম সে কথায় ভ্রুক্ষেপ করলো না। তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে রইলো গাড়িটার দিকে। রমেশ ওদের কাছে এসে হাত জোড় করে বললেন, আপনারা ভেতরে চলে আসুন — যদি পুলিশের গাড়ি হয়—এইখানেই যদি ধরে ফেলে–হা ভগবান!
গাড়িটা পুলিশেরই। সব্যসাচী আর অরিন্দম দ্বিধা না করে ফিরে এলো বাড়ি মধ্যে। দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হলো। রমেশ জানালার খড়খড়ি দিয়ে দেখতে লাগলেন বাইরে।
পুলিশের গাড়িটা থামলো না, বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেল।
রমেশ জানালার কাছ থেকে সরে এসে বললেন, আপনাদের কারুকেই যেতে হবে না। আপনারা থাকুন।
সব্যসাচী বললো না, দরকার নেই। এবার আমরা যেতে পারবো। পুলিশের গাড়ি ঘন ঘন আসে না।
রমেশ হাত জোড় করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমার ঘাট হয়েছে। আমি ক্ষমা চাইছি! আপনারা চলে গেলে আমার বউ আর আমার বোন আমাকে বাড়িতে টিকতে দেবে না। নিরীহ লোক তাই ভয় পেয়ে অমন কথা বলছিলাম!
হঠাৎ স্ত্রী ও বোনের দিকে ফিরে রমেশ গলা চড়িয়ে বললেন, ভদ্রলোকের এমন অসুখ, আর তোমরা একটা ডাক্তার ডাকতে পারো নি? আমি বাড়িতে ছিলাম না বলে কি এটুকুও তোমার করতে পারো না?
সবাই চুপ করে রইলো। রমেশ নিজেই অবিলম্বে ডাক্তার ডাকতে চলে গেলেন। এল. এম. এফ পাশ অতি সাধারণ ডাক্তার-রমেশের অনেক কালের বন্ধু-এ বাড়িতে প্রায়ই আসেন।
তিনি অপরিচিত যুবক দুটিকে দেখে কোনো রকম কৌতূহল প্রকাশ করলেন না। ব্যান্ডেজ খুলে সব্যসাচীর বীভৎস ক্ষতটা পরীক্ষা করে মন্তব্য করলেন-এটা তো চার পাঁচ দিনের পুরোনো এর মধ্যে কিছুই চিকিৎসা করান নি?
সবাই চুপ।
ডাক্তার আবার বললেন, কেউ যদি নিজেই নিজের জীবনটা নষ্ট করতে চায়, তাহলে ডাক্তার কি করবে? ভেতরে এক খন্ড কাচ ঢুকে আছে। এই নিয়ে কেউ চুপচাপ থাকতে পারে?
হঠাৎ তিনি সব্যসাচীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি করেন?
সে একটু ইতস্তত করে উত্তর দিল, একটা ইস্কুলে পড়াই।
ডাক্তার উচ্চকণ্ঠে কাষ্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন.আপনি পরশুরাম আর কর্ণের গল্প জানেন না? কর্ণ নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে পরশুরামের কাছে গিয়েছিল অস্ত্রবিদ্যা শিখতে। তারপর একদিন পরশুরাম কর্ণের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি- এমন সময় একটা বজ্রকীট কর্ণের উরু কামড়ে ধরে মাংস খুলে নিল।
গুরুর ঘুম ভেঙ্গে যাবে এই ভয়ে কর্ণ পা সরিয়েও নিল না, মুখ দিয়ে একটা শব্দও করল না। ঘুম ভেঙ্গে উঠে পরশুরাম এই কান্ড দেখে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তুমি তো ব্রাহ্মণ নও, তুমি ক্ষত্রিয়। ব্রাহ্মণ কখনো এত কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সেই রকমই বলছি, কোনো সাধারন স্কুল মাস্টার শরীরে একখানি যন্ত্রণা নিয়ে চুপ করে থাকে না। আপনারা কে, তো বুঝতে আমার বাকী নেই। কিন্তু এখন আমার একটা বিপদের কথা শুনুন। এখন যদি আমি বলি, এর চিকিৎসা করবার সাধ্য আমার নেই- তা হলে আপনারা ভাববেন, আমি ভয় পাচ্ছি। কিন্তু সত্যিই হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন না করলে কিছুই হবে না।
-হাসপাতালে যাওয়া এখন সম্ভব নয়।
-তা হলে আমি কি করবো বলুন?
-কাঁচটা আপনি বার করে দিতে পারবেন না?
-আমার কাছে কি যন্ত্রপাতি আছে না, অজ্ঞান করার ব্যবস্থা আছে? কিছুই নেই, তবে গ্রামের নাপিতরা যেমন খোঁচাখোঁচি করে অনেক অপারেশন করে, সেই চেষ্টা করতে পারি।
ভাতে সব্যসাচী বললো, সে যা হয় হোক। আপনি এমন একটা ব্যবস্থা করুন যাতে আমার জুরটা কমে যায়-দু’তিন দিনের মধ্যে বাইরে বেরতে পারি।
সব্যসাচীকে কড়া ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে রাখা।
তিনতলা সেই ঘরের খাটের ওপর তাকে শোয়ানো হয়েছে আবার! অরিন্দম শুয়েছে মাটিতে বিছানা পেতে।
অরিন্দমের ঘুম আসছে না। শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছে। ভবিষ্যতে কোনো পরিকল্পনা ঠিক করতে পারছে না। তারা আগে থেকে সব কিছু ছকে রেখেছিল। ট্রেন আক্রমণের সময় দলের কেউ যদি মারা যায় কিংবা ধরা পড়ে-তবুও অন্য কেউ তার জন্য অপেক্ষা করবে না। দয়ামায়া প্রশ্ন এখন বাস্তব। কার্য-উদ্ধারের জন্য ঘনিষ্টতম বন্ধুকেও বিসর্জন দিতে হবে দরকার হলে।
কিন্তু সব কিছু তো হিসেবের মধ্যে থাকে না। হঠাৎ যদি একজন কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং আরেক জনের আত্মীয় বাড়িতে তাকে আশ্রয় দিতে হয়-তখন কি করা উচিত। এখন অরিন্দম সব্যসাচীকে একা ফেলে কিছুতেই চলে যেতে পারে না। তাছাড়া সব্যসাচী তাদের দলের একজন প্রধান নেতা, শুধু বন্ধু তো না, এই সময় তারই তো নির্দেশ দেবার কথা।
কাগজে কাগজে এই ট্রেন লুঠের ঘটনা নিয়ে রোজ লেখালেখি চলছে। একজন কেউও এ পর্যন্ত ধরা পড়েনি। তারা এ ব্যাপারে দারুণ স্বার্থক হয়েছে। কিন্তু এর পরের ব্যাপারে কি হবে? আর কয়েকদিন পরই সেই নির্দিষ্ট গোপন জায়গায় সবার দেখা কথার কথা। সে আর সব্যসাচী যদি না যেতে পারে-রতনলাল কি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এখনো কত কাজ বাকি আছে।
বিছানায় ছটফট করে অরিন্দম। এক সময় বাইরে কারোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলো। উঠে এসে দেখলো, ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার দিদি।
অরিন্দম জিজ্ঞেস করলো, মেজদি, তুমি ঘুমোও নি?
দিদি বললেন, তুইও তো ঘুমোস নি? তুই বুঝি জেগে জেগে পাহারা দিচ্ছিস?
-না! পাহারা দেবার কিছুই নেই। ও তো একবারে অজ্ঞান। এমনিই আমার ঘুম আসছে না। জামাইবাবু খুব রাগ করছেন না?
-ও এমনিই। মানুষটা দুর্বল। কি যে করবে, নিজেই বুঝতে পারে না।
–তোমাদের তো বিপদে ফেলা হলো ঠিকই। আমি ভেবেছিলাম, এক রাত্তির থেকেই চলে যাবে।
নিয়তিতে যদি থাকে, তাহলে কি বিপদ ঠেকানো যাবে? কিন্তু তোরা এসব কি করছিস? তোরা বুঝি ডাকাতি করিস?
-কে বললে তোমাকে?
-খবরের কাগজে সব দেখেই বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ রে, পাপের পথে গিয়ে কি কখনো ভালো কাজ হতে পারে?
-কোনটা পাপ? বিদেশী সরকার আমাদের দেশ থেকে টাকা শুষে নিচ্ছে- সেই টাকাই যদি আমরা জোর করে কেড়ে নিই, সেটা কি পাপ?
-অরু, তোদের কথা ভাবলেই আমার বুক কাঁপে। একি সর্বনাশা পথ! এর থেকে বিলীত জিনিস বয়কট করা ভালো নয়?
-দিদি, ওসব ব্যাপারে আজকাল আর কেউ ভোলে না। কয়েকজন বিপ্লবীকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতেই হবে। নইলে দেশের লোক মনে জোর পাবে না!
-কয়েকজনকে জেল থেকে ছাড়াবার জন্য আর কয়েকজন প্রাণ দেবে? এ আবার কেমনধারা কথা! এই যে ছেলেটা মরতে বসেছে- এ কার জন্য?
-সব্যসাচী! ও মরবে কেন? একটা হাত নষ্ট হয়ে গেলেও বাকি একটা হাত দিয়েই যা ও করতে পারে- একশো জন তা পারে।
-তোরা এই পথ ছেড়ে দে। এমনি দেশের লোককে বোঝা, লেখাপড়া শেখা- তারপর সবাই মিলে এক সঙ্গে ক্ষেপে উঠলেই কাজ হবে। বাবা তো এই কথাই বলতেন।
-মহাত্মাজী তো দেশের লোককে কতদিন ধরে বোঝাতে চেষ্টা করছেন। কি লাভ হলো তাতে।
-বাবা কেমন আছেন রে?
-এমনিতে ভালোই। হাঁপানিটার জন্য বাইরের কাজ বিশেষ কিছু করতে পারে না বলে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছেন।
-বাবা তো এক সময় অনেক কিছু করেছেন।
-এ একটা নেশা। একবার ধরলে ছাড়া পায় না!
অরু, তুই কথা দে, সব সময় সাবধানে থাকবি, তুই মায়ের সবচেয়ে ছোটো ছেলে। -সব্যসাচী ওর মায়ের একমাত্র ছেলে।
– ও তো আমার কথা শুনবে না। তুই কথা দে-আর যাই হোক, জীবনের ঝুঁকি কখনো নিবি না।
-আচ্ছা! তুমি এবার শুতে যাও!
বেলা এগারোটা। সব্যসাচী তখনও ঘুমিয়ে। অসুস্থতার জন্য মুখখানা একটু বির্বণ। ঠোটে খানিকটা বিষন্ন রেখা। কপালের ওপর চুল এসে পড়েছে।
অরিন্দম নিচে গেছে স্নান সেরে নিতে। কুন্তলা এককাপ দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। এর আগে কয়েক বার ডেকে ডেকে সব্যসাচীকে খাওয়ানো যায় নি কিছু।
মাথার কাছটায় একটু ঝাঁকনি দিতেও সব্যসাচীর ঘুম ভাঙলো না। কুন্তলা খুব অস্বস্তিতে পড়লো। ছোটো ছেলে তো নয় যে ঘুমের মধ্যেই ঠোঁট ফাঁক করে মুখে দুধ ঢেলে দেবে। অথচ কাল সন্ধ্যে থেকেই সব্যসাচী কিছু খায়নি। না খেলে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
কুন্তলা সব্যসাচীর গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলো, এই, এই।
ঘুমের ঘোরেই সব্যসাচী এক হাত ছুঁড়ে বিরক্তভাবে বললো, আঃ!
কুন্তলা তখন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো, পুলিশ-
সঙ্গে সঙ্গে সব্যসাচী চোখ খুললো। এই শব্দটার সঙ্গে যেন তার স্নায়ুর যোগ আছে। সঙ্গে সঙ্গে শরীর সতর্ক হয়ে উঠে।
দু’চোখ বিস্ফরিত করে সে বললো কি?
কুন্তলা হেসে বললো, কিছু না।
তারপর বললো, দুধটা খেয়ে নিন।
সব্যসাচী আপত্তি করলো না। ঢক ঢক করে দুধটা শেষ করে মুখ দিয়ে একটা শব্দ করলো আঃ!
সেই শব্দটা যন্ত্রণার না আরামের তা ঠিক বোঝায় যায় না।
এখন একটু ভালো লাগছে?
-খুব। হঠাৎ কি কথা মনে পড়লো জানো? রেলের ইঞ্জিন ড্রাইভারটা যেভাবে আমাকে বোতলটা দিয়ে মারতে গিয়েছিল, যদি সেটা ঠিক মতন লাগতো কিংবা চোখে মুখে লাগতো-তা হলে হয়তো আমি অনেক আগেই মরে যেতাম। তা যে মরিনি, এখনো যে বেঁচে আছি, সেটাই খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার।
-মুখ চোখ ধোবেন? জল নিয়ে আসবো?
-তুমি ধুইয়ে দেবে?
কুন্তলা হাসলো। বললো, কাল যে বলেছিলেন, আমার হাতের সেবা নেবেন না? আমি মেয়ে, সুতরাং আমি অপবিত্ৰ।
-সে কথা মোটেই বলিনি। অরিন্দম কোথায়?
-নিচে গেছেন।
-অরিন্দম আসুক। ততক্ষণ তুমি একটু বসো।
কুন্তলা টেবিলের পাশটায় চেয়ারের বসতে যাচ্ছিল, সব্যসাচী বললো, এখানে এসো এই বিছানায় বসো! আমার তো ছোঁয়াচে অসুখ নয়!
কুন্তলা এসে বসলো খাটের ধার ঘেঁষে। মুখে হাসি মাখানো থাকলেও ভঙ্গিটা একটু আড়ষ্ট। সব্যসাচী বললো, একটা হাত নষ্ট হলেও আমি বেঁচে উঠবো ঠিকই, কি বলো?
কুন্তলা বললো, হাতটাই বা নষ্ট হবে কেন? দুটো কাচের টুকরো কাল বেরিয়েছে। আর কিছু নেই।
আমার এই কাঁধের কাছটা পেকে থসথসে হয়ে গেছে। ভাবলেও ঘেন্না করে।
-এবার সব সেরে যাবে।
-আমি যেন একটা বাচ্চা ছেলে, তুমি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ। শুনতে ভালোই লাগে অবশ্য। তুমি গ্রাংগ্রিন কথাটা শুনেছো! হয়ে যেতে পারে-তাতে কেউ বাঁচে না, সাধারণত। সে রকমভাবে মানুষকে আমি মরতেও দেখেছি। অবশ্য আমি যে সে রকমভাবে মরবো, তেমন কথা নেই। আমি বাঁচতে চাই!
কুন্তলা চুপ করে রইলো। সব্যসাচী তার সুস্থ হাতটা কুন্তলার বাহুতে রাখলো।
তারপর বললো, কি সুন্দর এই পৃথিবী-আর আমি এখানে থাকবো না, তা কি হতে পারে?
কুন্তলা এতেও কোনো কথা বললো না। সব্যসাচী জিজ্ঞেস করলো, আমি যে তোমার গায়ে হাত ছোঁয়ালাম তাতে তুমি সরে বসলে না?
– কেন?
মেয়েরা তাই তো করে! পর পুরুষদের হাত, এক্ষুণি কেউ এসে দেখে ফেলতে পারে।
-আপনি এসব কথা বলেছেন কেন?
-কি জানি! আমার বোধ হয় মাথার গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! গ্যাংগ্রিন হলে কি মাথা খারাপ হয়ে যায়?
-আজ আপনাকে অনেক সুস্থ দেখাচ্ছে।
-তুমি আসবার ঠিক আগেই একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। তুমি এসে ডাকাডাকি করে সেই স্বপ্নটা ভেঙে দিলে।
-কি স্বপ্ন?
– স্বপ্নের কথা অন্য কারুকে বলতে নেই।
-আপনার স্বপ্নটা ভেঙে দেবার জন্য আমি দুঃখিত।
-কিন্তু আমি দুঃখিত নই। তুমি এই যে আমার পাশে বসে আছো, এটাও যেন মনে হচ্ছে স্বপ্ন। কয়েকদিন আগেও তোমাকে চিনতাম না, অথচ তোমাকে এমন কাছের আর আপন মনে হচ্ছে……।
-আমি আপনার মুখ ধোবার জল নিয়ে আসি?
-আরও একটু বসো! তোমাকে আর একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। তুমি জানো স্বদেশীরা বীরের মতন প্রান দেয়। আমি লোভী আর কাপুরুষের মত এখন বাঁচতে চাই। তা যতক্ষণ মৃত্যু কাছাকাছি আসেনি, ততক্ষণ খুব সাহস দেখাতাম। এখন যে- কোন মূল্য দিয়ে বেঁচে থাকতে চাইছি। ইচ্ছে করছে, তোমার আঁচলের তলায় মুখ লুকোই। তোমাকে আদর করি।
কুন্তলার বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। মুখ অরুনবর্ণ। তবু সে উঠে যেতে পারছে না। সব্যসাচী বললো, তুমি আমার মুখে থুতু দিলে না? কাল যে বলেছিলে, এসব কথা বললে তুমি থুতু দেবে?
-আপনি অন্য কথা বলুন।
-না, আমি এসবই বলবো। আমার যা বলতে ইচ্ছে, করছে তা বলবো। আমার ইচ্ছে করছে, তোমার বুকে মুখ ঘষি। তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুই। কুন্তলা, আমি যদি বলি, তুমি এক্ষণি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো। আমি তোমার কোলে মাথা দিয়ে শোব। তুমি রাজী হবে?
সব্যসাচীকে অবাক করে দিয়ে কুন্তলা উত্তর দিল, হ্যাঁ, রাজী হবো।
– কেন?
এমনিই। এতে কি আসে যায়।
-তাহলে যাও। বন্ধ করো দরজা। যে যা ভাবে ভাবুক!
কুন্তলা সত্যি সত্যি দাঁড়ালো। দরজার কাছে গিয়ে ফিরে এদিকে দাঁড়ালো একটুক্ষণ। তাকে দেখাচ্ছে ঠিক একটা ছবির মতন। সব্যসাচী ভেবেছিল এই সুযোগে কুন্তলা ঘর থেকে বেরিযে যাবে। গেল ন। দরজার ওপরে তার হাত। সব্যসাচী তৃষ্ণার্তভাবে চেয়ে রইলো তার দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আচ্ছা, এখন নয়। এখন অরিন্দম আসবে।
একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো, তুমি অরিন্দমকে ভালোবাসো?
কুন্তলা মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে বললো, না। ভালোবাসার কথা আজ সকালের আগে পর্যন্ত কখনো ভাবিইনি।
-আজ সকালে প্রথম ভাবলে? না,না এটা ভালোবাসা নয়। এর নাম দয়া। ঠিক আছে। তুমি আমাকে দয়াই করো। কারুর কাছে কখনো দয়া চাইনি। তোমার কাছে চাই। তুমি আমাকে একটু শান্তি দাও!
-আমি কি করে আপনাকে শাস্তি দিতে পারি বলুন? আমার কি সে ক্ষমতা আছে?
-হ্যাঁ আছে। মেয়েরা জানে না তাদের কতখানি ক্ষমতা। তোমার চোখের দৃষ্টি একটুখানি ছোঁওয়া এতেই যেন আমার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে। আমি তোমার বুকে আমার মুখটা ঘষতে চাই। ভীষণ ভাবে চাই।
-আপনি আজ বেশী দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
-শরীর দুর্বল থাকলেই মন দুর্বল হয়।
অরিন্দম চুল মুছতে মুছতে ফিরে এলো এ ঘরে। কুন্তলার আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে সে একটু অবাক হলো। তারপর সেটাকে মন থেকে মুছে ফেলে সব্যসাচীকে বললো, তুই উঠেছিস? শোন, তোর সঙ্গে একটা কাজের কথা আছে। কুন্তলা, তুমি একটু বাইরে যাবে?
সব্যসাচী বললো, ও থাক। ওর কাছে আমাদের গোপন করার আর কিছুই নেই। কুন্তলা নিজেই বললো, আমি আপনার জন্য মুখ ধোবার জল নিয়ে আসছি।
কুন্তলা বেরিয়ে যাবার পর অরিন্দম বললো, আমি অনেক ভেবে ঠিক করলাম; রতনলালকে একটা খবর পাঠানো বিশেষ দরকার। এভাবে পড়ে থেকে আমরা দলের কোনো কাজেই লাগছি না।
-কি করে খবর পাঠাবি?
-আর তো কোনো উপায় দেখছি না। আমাকেই যেতে হবে।
-তুই একা যাবি?
-হাঁ। এখন তোর এখানে থাকার কোনো অসুবিধে নেই। তুই দু’চার দিনে আর একটু সুস্থ হয়ে নে। আমাদের দুজনেরই এখানে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না।
-কিসে যাবি? সাইকেলে?
-পাগলা নাকি? সাইকেলটা আমার কাছেও রাখি নি। পরশুদিন আমি ওটাকে বাজারের কাছে ফেলে রেখে এসেছিলাম, কাল গিয়ে দেখে এসেছি, কেউ ওটা চুরি করে নিয়ে গেছে। ওটার সম্বন্ধে আর আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই। আমি ট্রেনেই যাবে।
-ঠিক আছে। তুই টাকাগুলো নিয়ে যা।
-টাকাগুলো? আমি নিয়ে গিয়ে কি করবো?
-রতনলালকে লুকিয়ে দিবি। আমার কাছে তো টাকাগুলো থেকে কোনো লাভ নেই।
অরিন্দমের মনে একটু সুক্ষ্ণ অভিমান ছিল যে, সব্যসাচী আহত থাকা সত্ত্বেও রতনলাল টাকাগুলো তার কাছেই দিয়েছিল, অরিন্দমকে দেয়নি। তবে, অভিমানটা এতই সূক্ষ্ণ যে মনের উপরতলে আসে না। টাকাগুলো ঐ তিনজনের মধ্যে ভাগ করার কথাই আগে ঠিক ছিল, তাই আর বদলানো হয় নি।
অরন্দিম বললো, টাকাগুলো তোর কাছেই থাকা ভালো। কারণ আমি রাস্তাঘাটের অবস্থা জানি না। রতনলালের দেখা পাবো কিনা ঠিক নেই। আমি একবার ঘুরে দেখে আসি।
অরিন্দম যখন প্রস্তুত হয়ে বেরুবে তখন সব্যসাচী তাকে ডেকে বললো, অরিন্দম, শোন, কাছে আয় একটু।
অরিন্দম, কাছে আসতেই সব্যসাচী তার হাত ধরে বললো, সাবধানে থাকবি। পিস্তলটা তোর লাগবে!
-না।
-তুই ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি ঘুমোতে পারবো না।
-আমার জন্য চিন্তা করিস না।
-আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি রে। ভয় হচ্ছে, তোর সঙ্গে বোধ হয় আর দেখা হবে না।
-যাঃ, এসব কি বলছিস?
-অরু, আমার হাত ছুঁয়ে বল আবার দেখা হবে?
-আমি কাল, বড়জোর পরশুর মধ্যেই ফিরে আসবো।
অরিন্দম রাস্তায় বেরিয়ে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেল না। ধীরে সুস্থে কিছুটা পথ হেঁটে একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে স্টেশনে পৌছালো। বাইরের দোকান থেকে একটা পান খেয়ে সিগারেট ধরালো। তারপর টিকিট কিনে ঢুকে পড়লো স্টেশনে।
স্টেশনে ঢুকেই সে চমকে গেল। সেখানে গিজাগিজ করছে পুলিশ। হঠাৎ এক সঙ্গে অত পুলিশ দেখে মাথা ঘুরে গেল অরিন্দমের। সে আর যুক্তি ঠিক রাখতে পারলো না। মানুষও তো আসলে যুক্তহীন প্রাণীই।
পুলিশ কোনো গন্ধ পেয়েই সেখান এসেছে ঠিক। তা বলে অরিন্দমকে যে কোনো সন্দেহ করেছে, তার কোনো মানে নেই। অরিন্দমের মতন আরও অনেক লোক রয়েছে স্টেশনে। এমন হতে পারে, সেই ট্রেনে কোনো বড় দরের রাজপুরুষ যাবে বলে প্রত্যেক স্টেশনে পুলিশের কড়া পাহারা।
অরিন্দমের সে সব কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা আর নেই। সে দারুণ ঘামতে লাগলো। একবার ভাবলো ফিরে যাবে। একদল পুলিশ সেই মুহূর্তে স্টেশনের বাইরে যাওয়া সে আর বেরুতে সাহস করলো না।
সে আস্তে আস্তে একটা বেঞ্চিতে ঠেস দিয়ে বসলো। কোনোক্রমে একবার ট্রেনে উঠে পড়তে পারলেই হয়। তার হাতের সিগারেটটা কাঁপছে।
অরিন্দম যদিও আরও কিছুক্ষণ সময় পেত তা হলে মাথা ঠানডা করে সব দিক চিন্তা করতে পারতো। কিন্তু সে সময় পেল না। সে দেখলো, পুলিশের লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। সোজা তার দিকে।
ট্রাজিডি এই, অরিন্দম যেখানে দেয়ালের কাছে বেঞ্চিতে বসে ছিল সেখানেই তার মাথার ওপরে পুলিশ বিভাগের একটা নোটিশ লাগানো। পুলিশ দু’জন সেই নোটিশ পড়তেই আসছিল। তারা অরিন্দমকে কোনো রকম সন্দেহই করেনি। অরিন্দম তা বুঝতে পারলো না। পুলিশ দু’জন তার সামনে এসে পড়তেই সে উঠে দাঁড়িয়ে অন্ধের মতন ছুটতে লাগলো।
কোথায় যেন একটা মাইক্রোফোন বাজছে; অরিন্দমের মনে হলো, সেই স্পাউড লাকারে ক্রমাগত বলা হচ্ছে, অরিন্দম পালাও। অরিন্দম পালাও!
তারপর তার মনে হলো, তার চারিদিকেই শত শত লাউড স্পীকার। তারপরে ঘোষণা করছে, অরিন্দম পালা অরিন্দম পালাও। কান ঝালপালা হয়ে যাচ্ছে।
সেই সময় অরিন্দমের ব্যবহার আলোর সামনে মৃত্যুমুখী পোকার মতন। সে যেন অন্ধ হয়ে গেছে। সে ভুলে গেছে স্টেশন থেকে বেরুবার পথ। এক এক সময় পুলিশের দিকেই ছুটে যাচ্ছে, যেন একটা ভয়ার্ত শিশু। খুব সামনা-সামনি এসে আবার উল্টো দিকে ফিরে দৌড়। অরিন্দমের মতন একজন পোড় খাওয়া বিপ্লবীও এখন কি অসহায়। মৃত্যু-চিন্তা গ্রাস করে ফেলেছে তাকে। সে শুনতে পাচ্ছে, চতুর্দিক থেকে হাজার হাজার লোক মাইক্রোফোনে তার নাম ধরে ডাকছে-তাকে পালাতে বলছে।
অরিন্দম এই মুহূর্তে আর কিছু চায় না, শুধু বেঁচে থাকতে চায়।
কোন দিকে পালাবে? অরিন্দম দেখছে, চতুর্দিকে পুলিশ। সে উদভ্রান্তের মতন ছুটছে এদিকে সেদিকে। একজন সার্জেন্ট তার হাত চেপে ধরতেই সে লাফিয়ে নেমে পড়লো, ট্রেন লাইনে পাগলের মতন ছুতে লাগলো।
ততক্ষণে সত্যি সত্যি অনেক পুলিশ তাকে তাড়া করেছে। একজন পা লক্ষ্য করে গুলি চালালো। অরিন্দম মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। সেই অবস্থাতেও সে মাটি ছেড়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলো খানিকটা। জন তিনেক পুলিশ তাকে চেপে ধরতেই সে কাটা পাঠার মতন ছটফট করতে করতে বললো, আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও! আমি কিছু করি না।
একজন দারোগা সেই অবস্থাতেই অরিন্দমের গালে বিরাট এক চড় কষিয়ে বললো, কে তুই শীগগির বল।
আরেকজন তার টুটি চেপে ধরে দাঁড় করালো। সে বললো, সেই রেল-ডাকাতি? না? -আমি কিছু করি না। ‘আমি কিছু করি নি। আমাকে ছেড়ে দাও।
আর একখানা ঘঁষি পড়লো তার মুখে। একজন তার জুলপি ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেললো সব কটা লোম।
মিনিট চল্লিশের বীভৎস অত্যাচার করার পর অরিন্দম একেবারেই ভেঙে পড়লো। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললো, আর মারবেন না। আমি সব বলছি।
সব্যসাচীকে পুলিশ ধরতে এলো বিকেলের দিকে। কোনোরকম গোপনীয়তা আবরণ নেই। দু’গাড়ি পুলিশ এসে বাড়ির সামনের রাস্তায় থামলো। তারপর তারা ধীরে সুস্থে ঘিরতে লাগলো বাড়িটা। তারা জেনেই এসেছে যে, আসামীর পালাবার ক্ষমতা নেই।
সব্যসচাী তখন শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছিল একটু আগে সে কুন্তলার কোলে মাথা দিয়ে শোওয়ার আশা মিটিয়ে নিয়েছে। কুন্তলা নিজের থেকেই তার কোলে তুলে নিয়েছিল সব্যসাচীর মাথা। সব্যসাচী কুন্তলার গোছাগোছা কালো চুল তার নাকের কাছে এনে গন্ধ শুকেছে, আর বলেছে, আঃ “জীবনে আর আমার কিছুই চাইবার নেই।
এক সময় কুন্তলার দু’ফোটা চোখের জল কোনোক্রমে পড়ে গিয়েছিল সব্যসাচীর। মুখে। সে চমকে উঠে বলেছিল, একি? কুন্তলা, তোমার মনে কি কষ্ট দিয়েছি আমি? তুমি আমাকে ঘেন্না করছো?
-না।
-তবে তুমি কাঁদছো কেন?
-আমি ভাবছি, আমি একটা সামান্য মেয়ে! আমার জন্য আপনি এই রকম করছেন?
-কুন্তলা, আমিও তো সামান মানুষ। আমার লোভ আছে, কামনা আছে। দেশের কথা চিন্তা করেও আমি সব কিছু বিসর্জন দিতে পারি নি। আমি কি তোমার চোখে অনেক ছোট্ট হয়ে গেলাম?
-না। আমি সে কথা বলি নি!
-এরকম অসুস্থ হয়ে না পড়লে বোধ হয় আমি কখনো এতটা দুর্বল হয়ে পড়তাম না। কিন্তু তুমি আমাকে যা শাস্তি দিলে, তার তুলনাই নেই। আমি তো বেশি কিছু চাই নি! কুন্তলা মুখ নিচু করে বললো, আগে আমার ধারণা ছিল, এটা পাপ।
সব্যসাচী তেজের সঙ্গে বললো, পাপ আবার কি? পৃথিবীতে পাপ-পূণ্য কোনোটারই স্থির সংজ্ঞা নেই। মানুষ খুন করা কিংবা ডাকাতিও তো পাপ। কিন্তু আরও বড় পাপের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমরা সেগুলোই আশ্রয় নিয়েছি। আমরা কোনো পাপ করছি না।
-আপনি বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।
-কুন্তলা, আমাকে আপনি না বলে তুমি বলতে পারো না।
-আচ্ছা, কাল থেকে বলবো।
একটু আগে কুম্ভলা চা তৈরি করে আনার জন্য নিচে নেমে গিয়েছে। যাবার আগে সে তার গালটা ঠেকিয়ে গিয়েছিল সব্যসাচীর কপালে। সব্যসাচী এখনও অনুভব করছে সেই মাদকতা। এখনো তার নাকে লেগে আছে কুন্তলার শরীর ও চুলের ঘ্রাণ।
পুলিশ বাড়ির দরজায় ধাক্কা দেবার পর কুন্তলা দৌড়তে দৌড়তে ওপরে উঠে এসে কোনোক্রমে বললো, পুলিশ!
সব্যসাচী এক গাল হেসে বললো, আবার আমাকে ভয় দেখাচ্ছো শুধু শুধু?
কুন্তলার মুখখানা ভিজে কাগজের মতো নিষ্প্রাণ। সে বিস্ফরিত চোখ মেলে শুধু বললো, অনেক পুলিশ।
সব্যসাচী স্প্রিং এর মতন লাফিয়ে উঠলো। হঠাৎ তার গায়ে অসুরের শক্তি এসে গেছে। সে বললো, যাক অরিন্দমটা তবু বেঁচে গেল!
তারপর সে কোমর থেকে পিস্তল টেনে বার করলো।
কুন্তলা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, আপনি এখন কি করবেন?
সব্যসাচী তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো, কি আবার করবো? মরবো! তার আগে লড়াই করে মরবো!
– রা অনেক। অনেক পুলিশ।
-হোক। তোমার জামাইবাবু কোথায়?
– বাথরুমে!
-ব্লাডি ফুল! যাও শীগগির তাকে বেরোতো বলো। পুলিশকে যেন দরজা খুলে না দেয়। দরজা ভাঙুক। তুমি একটা মোটা দড়ি দিয়ে তোমার জামাইবাবুকে বেঁধে ফেল। পুলিশকে বলো, আমি তোমার জামাইবাবুকে বেঁধে রেখেছি। তারপর তোমাদের ভয় দেখিয়ে জোর করে এ বাড়িতে থেকেছি।
কুন্তলা তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে – সাব্যসাচী প্রচন্ড চিৎকার করে বললো, যাও!
খোলা পিস্তল হাতে সব্যসাচী দৌড়ে গেল ছাদের পাঁচিলের দিকে। উকি মেরে একবার দেখলো। পালবার কথা তার একবারও মনে এলো না। তার একমাত্র চিন্তা, লড়াই করে মরতে হবে। সুবিধা মতন একটা জায়গা বেছে নিল। তারপর রাস্তায় দাঁড়ানো অফিসটারটিকে টিপ করে গুলি চালালো।
গুলি চালিয়ে সে বসে পড়ে গেছে। তার গুলি কারুর গায়ে লাগেনি। ইস কেন যে বা হাতেও পিস্তল চালানো অভ্যেস করেনি সে।
ততক্ষণে ওদিক থেকে এক ঝাঁক গুলি ছুটে এসেছে। সব্যসাচী বসে আছে পাঁচিলের আড়ালে। পাচিলের মাঝে মাঝে ফুটো। একটা ফুটোয় চোখ রেখে আবার গুলি চালালো। কে জানে আর কারুর গায়ে লাগলো কিনা।
সব্যসাচী একটা একটা গুলির বিনিময়ে এদিকে ওদিকে থেকে পাঁচ ছটা গুলি ছুটে আসছে। সে যেন বেশ মজা পেয়েছে এতে।
দরজা ভাঙার চেষ্টা চলছে, শব্দ পাওয়া যাচ্ছে দম্ দম্! সব্যসাচী দরজার দিকে টিপ করে গুলি ছুড়লো। এবার কারুর না কারুর লেগেছে বোধ হয়। আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেছে। কুন্তলা কি তার ইচ্ছে মতন জামাইবাবুকে বাঁধতে পেরেছে দড়ি দিয়ে। অরিন্দমটা যখন পালাতে পেরেছে তখন সব্যসাচীকে এ বাড়ির সঙ্গে যুক্ত করা চলবে না। তার মৃত্যুদেহ দেখে কুন্তলা বলবে, আমরা একে চিনি না।
সব্যসাচী শেষ গুলিটা নিজের জন্য রেখে দেবে ভেবেছিল, হঠাৎ দেখলো গুলি শেষ। ইস এটা একটা বিশ্রী ব্যাপার। তার কোমরে আরও গুলি জড়ানো আছে। কিন্তু এক হাতে গুলি ভর অসম্ভব। চেষ্টা করেও সে পারলো না।
তখন সে উঠে দাঁড়িয়ে পাঁচিলের এদিক ওদিক উঁকি মারতে লাগলো। তার মাথা একটু দেখা গেলেই গুলি ছুটে আসছে, কিন্তু তখন ওতে কিছু আসে যায় না।
বাড়ির পেছন দিকে একটা জায়গায় নোংরা, জল কাদা মতন। সেখানেও একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে লাফাবার শেষ চেষ্টা করা যায় বটে। কিন্তু তার একটা হাত একেবারে অচল। সে বুঝতে পারলাম এখান থেকে লাফিয়ে পড়লে সে সেই ধাক্কাতেই মরবে।
তখন হঠাৎ সব্যসাচীর মনে হলো, এভাবে মরে লাভ কি? ধরা পড়লে যদি ফাঁসিও হয়, তাহলেও তো কম পক্ষে আরও দু’এক মাস বেঁচে থাকা যাবে। তাই বা কম কি? একটা দিন বেঁচে থাকাও তো একটা দিন বেশি বেঁচে থাকা।
সব্যসাচী নিজের শরীরটার দিকে একবার তাকালো। খুব মায়া হলো তার। কত যত্নের এই জীবন সামান্য একটু সূচ ফুটে গেলেও ব্যথা লাগে, যত কামনা-বাসনা, ঈর্ষা-লোভ সবাই তো এই শরীরকে জড়িয়ে। এরই মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে? পরজন্ম বলে কিছু আছে কি নেই কে জানে।
বারবার সব্যসাচীর ছেলেবেলার কথা মনে পড়তে লাগলো। সে একটা পুকুরের ধারে বসে খেলা করতো। পুকুরের জলের কাছে মুখ ঝুঁকিয়ে নিজের ছায়াটা দেখতে খুব ভালোবাসতো সে। ঘন্টা পর ঘন্টা সেই ভাবেই বসে থাকতো আর নিজের সঙ্গে কথা বলতো। হঠাৎ সে কথাটাই এমন মনে পড়ছে কেন, কে জানে।
সব্যসাচী আবার চলে এলো সামনের দিকে। রিভলবারটা বাইরে রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে বললো আই সারেন্ডার।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। সব্যসাচী আস্তে আস্তে পাঁচিলের ওপর মাথাটা তুললো। অনেকগুলো বন্দুকের নল তার দিকে তাক করা।
সে একটা হাত মাথার ওপরের তুলে বললো, খুব দুঃখিত। আমার আর একটা হাত ভাঙা- সে হাতটা তুলতে পারছি না।
পাঁচিলের কাছে ঝুঁকে সে ব্যান্ডেজটা দেখালো।
রাস্তা থেকে একজন ইন্সপেক্টার জিজ্ঞেস করলো, নেম? শাউট দা নেম!
খুব জোরে চেঁচিয়ে সব্যসাচী বললো, ক্ষুদিরাম! আমার নাম ক্ষুদিরাম।
-স্টে দেয়ার! রেমেইন ভিজিবল!
ইংরেজ অফিসারটি তার পিস্তলের মুখ সোজা তাগ করে রেখেছে সব্যসাচীর কপালের দিকে। যে কোন মুহূর্তে গুলি ছুড়তে পারে। সব্যসাচীর এটা ভালো লাগছে না। সে আবার বসে পড়লো পাঁচিলের আড়ালে।
নিচের দরজা খুলে গেছে কিংবা এতক্ষণে ভেঙে ফেলেছে। আর বড় জোর এক মিনিট।
টাকাগুলো কি হবে?
পুলিশ তাকে ধরার পর কেড়ে নেবে। গভর্ণমেন্টের টাকা আবার গভর্ণমেন্টের ঘরে যাবে। তাহলে এত কষ্ট সব বৃথাইস অরিন্দম যদি টাকাগুলো নিয়ে যেত। কুন্তলার কাছে টাকাগুলো জমা রেখে কোনো লাভ হতো না। নিশ্চয়ই সারা বাড়ি সার্চ করবে।
তাহলে উড়ো খৈ গোবিন্দায় নমো হয়ে যাক। সব্যসাচী মন ঠিক করে ফেলেছে।
দ্রুত সে কোমার থেকে টাকাগুলো বার করে ফেললো। তারপরে গোছা গোছা করে টাকাগুলো ওড়াতে লাগলো।
হওয়ায় বেশ জোর ছিল! নোটগুলো পাখির মতন উড়তে লাগলো হওয়ায়। পুলিশরা প্রথমে ইস্তাহার ভেবেছিল। তারপর তাদের সামনেই একশো টাকার নোট, উড়তে দেখে একটা চাঞ্চল্য পড়ে গেল।
কিছুদূরে ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছিল। অনেক টাকা উড়ে গেল সেদিকেও একশো টাকার নোট দেখেও স্থির হয়ে থাকতে পারে ক’জন মানুষ। প্রাণভয় তুচ্ছ করেও অনেক হুটোপুটি করে কুড়োতে লাগলো সেই টাকা।
সব্যসাচী গোছা গোছা নোট জোরে জোরে ছুঁড়ে দিয়ে বলতে লাগলো, এই নাও! এই নাও!
চারজন পুলিশ ছাদের ওপরে এসে দৌড়ে গিয়ে যখন তাকে চেপে ধরলো, সে এক গাল হেসে বললো, সব শেষ!