বুকের মধ্যে আগুন – ৪

॥ চার ॥

বেনারস এক্সপ্রেস ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এসে ঢুকলো আসানসোল স্টেশনের প্লাটফর্মে। রতনলাল নিরঞ্জনের হাতে টিকিটটা গুজে দিয়ে বললো, যাও, উঠে পড়ো। সাবধানে থেকো।

নিরঞ্জন বললো, রতনদা, আমি না হয় পরের ট্রেনে যাবো। আপনাকে আগে তুলে দিই। রতনলাল বললো, না না, শুধু দেরি করে কি হবে। আমারা ট্রেন একটু পরেই আসবে। – আপনি কলকাতাতেই যাচ্ছেন তাহলে?

– হ্যাঁ।

– আচ্ছা, উঠে পড়ি তাহলে?

– ঠিক আছে। সামনের সাত তারিখে তো দেখা হচ্ছোই।

ট্রেন ছেড়ে দেবার পরও রতনলাল প্লাটফর্মে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। জানলা দিয়ে নিরঞ্জন মুখ বাড়িয়ে আছে। ট্রেন দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবার পর সে পেছনে ফিরলো।

রতনলাল অত্যান্ত সাবধানী লোক। দলের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মীকেও সে নিজের গতিবিধি সব সময় জানতে চায় না। যতই বিশ্বাসী লোক হোক পুলিশের অত্যাচারে কার পেট থেকে কি কথা বেরিয়ে পড়বে কে জানে! নিরঞ্জনকে সে বললো বটে যে সে কলকাতায় যাচ্ছে, আসলে এখন সেখানে যাবে না।

সতর্ক চোখে চারদিকে তাকিয়ে সে স্টেশনের বাইরে এলো। কোথাও কোনো উত্তেজনার চিহ্ন নেই। রতনলাল প্রফুল্ল মনে শিস দিতে লাগলো।

সাইকেলটায় সবে মাত্র হাত দিয়েছে, এই সময় হঠাৎ পেছনে থেকে একজন লোক জিজ্ঞেস করলো, একশো তেতাল্লিশ নম্বর সাইকিল আপকা হ্যা?

রতনলাল চমকে ঘুরে দাঁড়ালো। ধুতি, সাদা শার্ট আর বুট জুতো পরা একজন লম্বা চওড়া চেহরার লোক। খুব সম্ভবত সাদা পোশাকের পুলিশ। রতনলালের উচিত ছিল আগেই লক্ষ্য করা। লোকটা তাকে হিন্দীতে প্রশ্ন করলো কেন? ওকি তাকে হিন্দুস্থানী ভেবেছে? রতনলালের মস্ত বড় পাকানো গোঁফ দেখলে অনেকেই তা ভাবে।

এখন আর অস্বীকার করা লাভ নেই বলে সে বিনীতভাবে বললো, জী হ্যাঁ।

-চলিয়ে আপ্‌কো থানা মে জানে হোগা!

– কাহে?

-ইয়ে সাইকিল থানা মে জমা দেনে পড়ে গা?

রতনলাল অবুঝের মতন নিরীহভাবে বললো, কেয়া হুয়া, কুছ নেই সমঝতা-

লোকটি বললো, একঠো বকরিকো মার দিয়া কোন্‌

রতনলাল যেন আকাশ থেকে পড়লো একেবারে। দু’টি ভুরু তুলে রাজ্যের বিস্ময়ের সঙ্গে বললো, বকরি মর গ্যা? ইস সাইকিল মে

রতনলাল তখন মনে মনে নিজের হাত কামচ্ছে! ভোরের দিকে একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। তখন নিরঞ্জন সাইকেল চালাচ্ছিল। চালাতে চালাতে ঘুম এসে গিয়েছিল বোধ হয়। হঠাৎ সামনে এক পাল ছাগল পড়লো। ব্রেক কষতে ভুলে গিয়েছিল, হুড়মুড় করে ঢুকে গেল ছাগলের পালের মধ্যে। তারপর ধাক্কা খেয়ে দু’জনেই পড়ে গেছে সাইকেল থেকে। পড়বি তো পড় একটা বাচ্ছা ছাগলের ঘাড়ের ওপর পড়েছে ওরা সাইকের সুদ্ধ। সেটা তখন মারা গেছে।

ছাগলটার দাম চুকিয়ে দিলেই চলতো। কিন্তু সঙ্গে যে দু’জন লোক ছিল, তারা এমন চেঁচিমেচি শুরু করলা যে রীতিমতন ভিড় জমে যাবার উপক্রম। টাকা নেবার বদলে অন্যসব পাঁচ রকম কথা! অত ভিড়ের মধ্যে ওরা দাঁড়াতে সাহস করে নি। একটা ছাগলের প্রাণের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান দায়িত্ব ওদের হাতে। রতনলাল তখন নিরঞ্জনকে পেছনে বাসার ইঙ্গিত করে নিজে বাই বাই করে সাইকেল চালিয়ে এসেছে। দু’একজনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতেও হয়েছিল।

কিন্তু সেই ঘটনা যে এত দূর গড়াবে তা কিছুতেই বোঝা যায়নি। সাইকেলে সাধারণত/ নম্বর থাকে না। কিন্তু সেই সাইকেলটার পেছনে যে ১৪৩ নম্বর লেখা একটা চাকতি রয়েছে, সে আগে লক্ষ্য করে নি। লোক দুটো সাইকেলের নম্বর নিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর দিয়েছে। থনার লোক এত তাড়াতাড়ি কাজে নেমে পড়েছে? আমাদের থানাগুলো এ রকম চটপটে হলো কবে থেকে? বৃটিশ পুলিশের হাতে এখন এত সব জরুরী কাজ, এখনও এর মধ্যে ছাগল চাপা দেওয়া কেস হাতে নেবার সময় আছে।

লোকটা রতনলালের সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে হাত দিয়ে বললো, চলিয়ে -।

রতনলাল ঠিক মনস্থির করতে পারলো না। সামান্য একটা ছাগল চাপা কেসের জন্য থানায় যেতে তার আপত্তি থাকার কথা নয়। কিছু টাকা ফাইন দিলেই চুকে যাবে।

কিন্তু যদি কোনো কারণে ওরা তাকে সার্চ করতে চায়? তার কাছে নগদ এক লক্ষ্য দশ হাজার টাকা, একটা মাউজার পিস্তল এবং একটা বারো ইঞ্চি ছোরা আছে। এগুলো লুকোবে কি করে?

সার্চ করার কথা নয়। ছাগল চাপা দিলে কারুর বড়ি সার্চ করে না। কিন্তু দারোগার মেজাজের কথা তো বলা যায় না। যদি জিজ্ঞেস করে অত ভোরবেলা সে সাইকেলে কোথা থেকে আসছিল? সাইকেলের মালিক কে? সাইকেলগুলো সব ভাড়া করা হয়েছে ফরাসী চন্দননগণ থেকে। যদি সেই ব্যাপারে খোঁজ পড়ে?

আর কিছু না, নিছক সন্দেহ বশেই যদি তাকে হাজতে আটকে রাখতে চায়, তাহলেও তো তার সঙ্গের জিনিস পত্তর বাইরে জমা দিতে হবে।

রতনলালের কপালে বিজবিজে ঘাম ফুটে উঠলো। যে কোনো কারণেই হোক, এখন তার থানায় যাওয়া চলতেই পারে না। কিন্তু এই লোকটাকে এড়াবে কি করে? আশে পাশে অনেক লোক।

রতনলাল শুনেছে, পুলিশকে ঘুষ দিলে অনেক সময় ঝামেলা এড়ানো যায়। এই রকম ছোটখাটো ব্যাপারে ঘুষ পাবার জন্য সেপাইরা তো মুখ বাড়িয়েই আছে। কিন্তু কি ভাবে ঘুস দিতে হয়, তা সে জানে না। এত লোকজনের মধ্যে এই লোকটির হাতে টাকা গুজে দিলে অন্যরা দেখতে পাবে না? এই লোকটাযদি চেঁচিয়ে ওঠে?

অগত্যা রতনলালকে যেতে হলো লোকটার সঙ্গে। সাইকেলের হ্যাণ্ডেলটার দু’দিকে দু’জন ধরে আছে। স্টেশনের এলাকা ছাড়িয়ে আসার পর রতনলাল পকেট থেকে পাসিং শো সিগারেটের প্যাকেট বার করে বললো সিগারেট পিয়েঙ্গা সিপাইজী?

লোকটি গম্ভীরভাবে বললো নেহি, পিতে নেহি!

ওরে বাবা, এ লোককে ঘুষ দেওয়া যাবে কি করে? আরও কিছুক্ষণ যাবার পর জিটি রোডে এসে পড়তেই অনেক লোকজনের ভিড়। থানা খুবই কাছে।

এখানে সামান্য একটা সিদ্ধানন্তের ওপরেই জীবন কিংবা মরণ। অনেক বৃহৎ পরিকল্পনা এই রকম ছোটখাটো কারণে ফেঁসে গেছে। রতনলালের হাতে আর সময় নেই।

রতনলাল মুহূর্তে মন ঠিক করে ফেললো।সে বললো, সিপাইজী সাইকেলটা ধরিয়ে তো। পিসাব করে গা।

লোকটাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে রতনলাল প্রচণ্ড জোরে সাইকেলটা ঠেলে দিল লোকটার গায়। আচমকা ধাক্কা খেয়ে লোকটা সাইকেল সমেত পড়ে গের সেই সুযোগে দৌড়ালো রতনলাল। রাস্তা পেরিয়ে ভিড়ের মধ্যে।

লোকটা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে খানিকটা সময় লাগলো। তারপর চেঁচাতে লাগলো, পাকাড়ো, পাকাড়ো! চোর, ডাকু-

রতনলাল প্রাণ পণে দৌড়াচ্ছে। রাস্তার লোক ব্যাপারটা চট করে বুঝতে পারে নি। তারপর কয়েকজন লোক ছুটতে লাগলো তার পেছনে। পলাতককে ধরার জন্য পথে ঘাটে সব সময়ই অনেক লোক তৈরি হয়ে থাকে।

রতনলাল এক হাতে টাকার থলে আর এক হাতে পকেটের মধ্যে পিস্তলটা চেপে ধরে আছে। দরকার হলে শেষ পর্যন্ত গুলি চালাতে হবে। উপায় কি!

পাশেই একটা বাজার দেখতে পেয়ে রতনলাল তার মধ্যে ঢুকে পড়ে বেঁচে গেল। বাজারের ভিড়ের মধ্যে তাকে আর দেখতে পাওয়া যায় না। সেখান থেকে বেরিয়েও এ গলি ও গলি দিয়ে ঘুরলো অনেকক্ষণ। শেষ পর্যন্ত পেছনে অনেকক্ষণ ধরে কেউ নেই দেখে নিশ্চিত হলো।

কাছেই দেখলো রাস্তার পাশে ইটের ওপর একজন নাপিত বসে আছে ছাতা মেলে। খদ্দের নেই। রতনলাল একটু আড়ারে সরে গিয়ে খুরে ফেললো নিজের গায়ের জামাটা, সেটার সঙ্গে অন্য জিনিসপত্তর দিয়ে পুটলি বাঁধলো একটা। খালি গায়ে এখন তাকে অনেকটা দেশোয়ালি লোকের মতন দেখাচ্ছে। এবার গিয়ে সে বসলো নাপিতটার ছাতার তলায়।

রতনলালের খুব শৌখিন বাবরি চুল। সেই চুল ছেটে ফেললো খুব ছোট করে। তারপর যখন নাপিতটিকে বললো, তার গোঁফ উড়িয়ে দিতে, তখন নাপিতটি পর্যন্ত অবাক। সে বললো, বাবু, এত শখের মোচ কেটে ফেলবেন? কত লোক এ রকম মোচ চেয়েও পায় না। কত লোকের গোঁফ হয় ঝাটার কাঠির মতন।

রতনলাল বললো, আরে ভাই, পকেটে পয়সা না থাকলে কি মোচ রাখা-মানায়? তাতে মোচেরই অপমান।

নাপিতটি হেসে বললো, তা বটে!

– মি চাকরির কথা কি করে জানাবো। আমি গরীব মানুষ।

-ভাই, তোমার সন্ধানে কোনো চাকরি আছে?

– আমি চাকরির কথা কি করে জানবো। আমি গরীব মানুষ।

-আমিও গরীব। তুমি তো অনেক বাবুদের বাড়ি-টাড়িতে যাও, যদি কোনো দারোয়ান বা চাকরের কাজ খালি থাকে-

রতনলাল অল্পক্ষণের মধ্যে বেশ গল্প জমিয়ে তুললো নাপিতটির সঙ্গে।

১৯২৮ সাল। আসানসোল তখন মূলতঃ অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের শহর। বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের সংখ্যা খুবই কম। রেলের অফিসার আর লাখনির সাহেবরা সেখানে ফুর্তি করতে আসে।

নাপিতটির কাছ থেকে রতনলাল একটি বস্তির সন্ধান জেনে নিল, যেখানে ঘর ভাড়া পাওয়া যায় সস্তায়। তারপর উঠে পড়লো। এখন রেল স্টেশনের দিকে যাওয়া তার পক্ষে কোনো মতেই উচিত নয়। ট্যাক্সি চেপে এখান থেকে সরে পড়া যেতে পারে। কিন্তু যদি চেকপোষ্টে পুলিশ থাকে? হোটেলে থাকলেও ধরা পড়ে যেতে পারে। একমাত্র উপায় এখানেই ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা।

বস্তির ঠিকাদারের নাম কুমার সিং বাপোট। বিরাট তাগড়া জোয়ান। রতনলাল খুঁজে বা করলো তাকে। যে কোনো একটা ঘর পেলেই তার চলবে।

কুমার সিং বাপোট প্রথমেই সন্দেহের চোখে দেখলো রতনলালকে। রতনলালের সঙ্গে কোনো জিনিষপত্র নেই। সেকি এক মাসের ভাড়া অ্যাডভান্স দিতে পারবে?

রতনলাল কাঁচুমাচুভাবে বললো, না বাপোটজী অত টাকা এক সঙ্গে তো দিতে পারবো না। আপনি সাতদিন করে নিন। এইটুকু মেহেরবাণী করুন।

কুমার সিং বাপোট জিজ্ঞেস করলো, কি কাজ করা হয়?

-কিছু না। কাজ খুঁজছি।

বাপোটজী তাকে তবু জেরা করতে লাগলো নানাভাবে। রতনলাল অবিলম্বে বুঝতে পারলো, কুমার সিং বাপোট তাকে পুলিশের লোক বলে সন্দেহ করছে।

এতে সে বেশ মজা পেল। তার মানে বাপোটজীর কোনো অবৈধ কারবার আছে। বাপোটকাজীর কথা শুনে সে এমন ভাব দেখাতে লাগলো যেন সে এক বর্ণিও হিন্দী বোঝে না।

ঘরভাড়া সাড়ে ষোল টাকা। রতনলাল পুটুলি থেকে চারটি টাকা আর একটা দু’আনি বার করে দিল বাপোটজীর হাতে। এক সপ্তাহের ভাড়া। বাপোটজী কোনো রসিদের ধার ধারেন না। সব কিছুই তার মুখে মুখে। রতনলালেরও কোনো গরজ নেই।

কথাবার্তা বলে সন্তুষ্ট হয়ে বাপোটজীর জিজ্ঞেস করলেন, রতনলাল কি রেলের পাথর ফেলা কুলীর কাজ করতে রাজী আছে?

রতনলাল যেন হাতে স্বর্গ পেল। এই কাজ পেলে সে এক্ষণি করবে। বাপোটজী বললো, তার জন্য পঞ্চাশ টাকা দস্তরি লাগবে। এর অর্ধেক নেবে রেল কোম্পানীর কন্ট্রাকটর, আর অর্ধেক বাপোটজীর প্রাপ্য।

রতনলাল নিরাশ হয়ে বললো, ওরে বাবা এত টাকা কোথা পাবো? আচ্ছা, দেখি যদি যোগাড় করতে পারি!

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। রতনলালের পদবী চক্রবর্তী। তার বাবা পাবনা শহরের একজন নামজাদা উকিল। রতনলাল ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংক ও সংস্কৃতে লেটার পেয়েছিল।

বস্তির ঘরখানায় কোনোরকম জিনিসপত্র নেই। আরও এক টাকা বাপোটজীর কাছ থেকে একটা খাটিয়া ভাড়া করতে হলো। তারপর মোড়ের দোকান থেকে চারখানা রুটির আর ঢেঁড়শের ঘ্যাট খেয়ে সে রতনলাল দরজা বন্ধ করে ঘুমালো। ভাল করে ঘুমোবার উপায় কি, খাটিয়াটা ভর্তি ছারপোকা। নেহাত অত্যন্ত পরিশ্রান্ত ছিল বলেই সে ঘুমোতে পারলো।

সন্ধো বেলা ঘুম ভাঙ্গার পর রতনলাল দেখলো তার ঘরের আশেপাশে কয়েকটা মুখে রঙ মাখা মেয়ে ঘোরাঘুরি করছে। রতনলাল বাইরে এসে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝলো। মেয়েগুলোর পরনে ঝালঝেলে পাটের শাড়ি, গালে ছোপ ছোপ পাউডার, আর ঠোটে লাল রঙ। তাকে দেখে তারা মুখ মচকে হাসতে লাগলো।

রতনলাল বুঝতে পারলো, সে ঠিক জায়গায় আসে নি। এসব জায়গায় প্রায়ই পুলিশে উপদ্রব হওয়ার কথা। অবশ্য বাপোটজী পাকা লোক, তিনি কি আর পুলিশের সঙ্গে পাকা ব্যবস্থা করে রাখেন নি।

রতনলাল কিছুক্ষণের জন্য বিমর্ষ বোধ করলো। কাল সারাটা দিন ও রাত অত্যন্ত বেশি পরিশ্রম গেছে। মানসিক উত্তেজনাই পরিশ্রান্ত করে বেশি। এখন তার প্রয়োজন ছিল কয়েকটি দিনের নিশ্চিন্ত বিশ্রাম। সে ব্যবস্থা করাও ছিল, হঠাৎ একটা ছাগল াপা দেবার জন্য ভন্ডুল হয়ে গেল সব কিছু। এখানে কি আর পরিশ্রম হবে! যে বস্তিতে বেশ্যা থাকে, সেখানে শাস্তি থাকে না। অনেক রাত পর্যন্ত লোকজনের আনাগোনা ও হৈ হল্লা চললো। ঘুঙুরের আওয়াজ, মেয়েদের গলায় তীক্ষ্ণ হাসি গেলাম ভাঙা। দিনের বেলা জায়গাটা ঠান্ডা থাকে রাত্রিরবেলা এখানে ঘুমোনো অসম্ভব।

প্রথম রাতটা কোনোক্রমে কেটে গেল। পরের দিনও দিনের বেলা রতনলার বাইরে বেরোলো না। পুলিশের তৎপরতা কতখানি সে জানে না। ছাগল চাপা দেওয়া ব্যাপারে ঝাম্পটা না পাকালে সে অনেক নিশ্চিন্তে থাকতে পারতো। তার খুব দরকার ছিল একটা খবরের কাগজ পড়ার- কিন্তু কোনো উপায় দেখছে না।

বিকেলে বাপোটজী এসে জিজ্ঞেস করলো, কি হে, সারাদিন বেরুলে না যে? নোকরি খুঁজতে হবে না? টাকার ধান্দা নেই বুঝি?

রতনলাল একটু বিরুক্ত বোধ করলো। এই লোকটা কি বার বার এসে বিরক্ত করবে নাকি?

সে বললো, বাপোটজী, আপনাকে তো সাতদিনের ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। আপনার এত চিন্তা কিসের?

বাপোটজা ভরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। যার কাছে পঞ্চাশটা টাকাও নেই, সে টাকার ধান্দায় না বেরিয়ে বসে বসে ঘুমোয় কি করে? এই জাতীয় মানুষদের সে বুঝতে পারে না।

নিজের মেজাজ সামলে রতনলাল বললো, আজ আমার শরীরটা ভালো নেই। -দিব্যি তো বহাল তবিয়ৎ দেখছি!

বাপোটজীর সন্দেহ ঘুচলো না। সে রতনলালের ঘরের আশে পাশেই ঘোরাফেরা করতে লাগলো।

দরজা ছাড়া ঘরে আর একটি মাত্র জানালা। সেই জানালাটার আবার বন্ধ করা যায় না। ছিটকনি নেই।

ধাক্কা দিয়ে সেই জানালাটা খুলে দুটি স্ত্রীলোক মুখ বাড়িয়ে বললো, দরজাটা একটু খুলো না বাপু! গোমড়া মুখে সে আছো কেন?

মেয়েদের সঙ্গে একেবারেই মেলামেশা করার অভ্যোস নেই রতনলালের। বিশেষ করে এ কেমন ধারা মেয়ে, অচেনা লোককে যারা প্রথম থেকেই তুমি বলে সম্বোধন করে! আর এক নতুন ঝামেলা।

উঠে গিয়ে রতনলালকে দরজা খুলতেই হলো। মেয়ে দু’টি তাকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তারপর একজন আরেকজনকে বললো, এই ঘরটারই দোষ আছে, না রে? এ ঘরে যে আসে সেই কি এমনি হয়ে যায়?

অন্য মেয়েটি বললো, আমার তো বাবা এখানে ঢুকলেই ভয় ভয় করে। একলা কোনোদিন আসতে পারবো না।

রতনলাল বোকার মতন দাঁড়িয়ে রইলো।

মেয়ে দুটি বোধ হয় রতনলালের সমবয়সী হবে। কিংবা বড়ও হতে পারে, কে জানে! তাদের চেহারা ও পোশাকে অদ্ভূত অসামঞ্জস্য আছে। শাড়ি ঝলমলে, কিন্তু ব্লাউজ কোঁচকানো ও ময়লা। মুখে পাউডার কিন্তু পায়ে ছেঁড়া চটি। কণ্ঠার হাড় জেগে আছে, কিন্তু স্তন অস্বাভাবিক

রকমের বড়।

মেয়ে দু’টি ওরে খাটিয়ার ওপর বসে পড়ে বেশ আপন আপন গলায় বললো তোশক নেই, বালিশ নেই, এখানে তুমি শোও কি করে? তোমার কষ্ট হয় না?

রতনলালের আর জায়গা নেই, সে দাঁড়িয়ে থেকেই বললো, বিদেশ বিভূঁয়ে ওসব কোথায় পাবো?

একজন বললো, বাড়ি থেকে কিছু আনো নি কেন? বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছো নাকি?

-বাড়িই নেই তো, তা পালাবো কোথা থেকে

এই সামান্য কথা, এতেই ওরা হেসে একজন আর একজনের গায়ে গড়িয়ে পড়লো। যে মেয়েটির গায়ের রং একটু মাজা মাজা, সে বললো, জানো ভাই, এই ঘরটায় আগেও তোমার মতন একজন পরদেশী মানুষ থাকতো। ঘর থেকে বেরুতো না, কারো সঙ্গে কথাও বলতো না। ওমা, তারপর একদিন সে আপনা আপনি মরে গেল। বিষ খেয়েছিল! সেই থেকে তো এ ঘর আর কেউ ভাড়া নেয় না।

কৃষ্ণাঙ্গী মেয়েটি বললো, তুমিও সে রকম করবো না কি? ধরণ-ধারণ তো সেই রকমই দেখছি।

একটু রসিকতা করার জন্য রতনলাল বললো, আমি যমেরও অরুচি।

এ কথায় কিন্তু ওরা হাসলো না। মুখের ভাব এমন করলো, যেন এ আবার কি রকম কথার ছিরি?

-তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়?

একটু না ভেবে রতনলাল বললো, আমার নাম যোগেন হালদার, দুনিয়ার কেউ নেই। পাটনায় চাকরি করতাম, হঠাৎ ছাড়িয়ে দিলে –

– বাবা -মা -ও নেই।

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রতনালাল বললো, না।

কৃষ্ণাঙ্গী মেয়েটি একটু ভুরু কুঁচকে তাকালো! তারপর বললো, আমার নাম রমলা আর এর নাম ভানুমতী।

রতনলাল বুঝলো, তৎকালীন সিনেমা-থিয়েটারের নায়িকাদের নাম থেকে এই নাম দু’টি ধার-করা। তখন এই সব নামই খুব শৌখিন হিসেবে গণ্য হতো। ওদের আসল নাম কুঁচি-পটলী ধরনের হওয়াই স্বাভাবিক।

এ কথা ও বোঝা গেল বাপোটজীই এদের পাঠিয়েছে রতনলাল সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ খবর নেবার জন্য।

রতনলাল আর একটা জিনিস বুঝতে পারলো। এই ঘরের ভাড়া তার কাছে থেকে অত্যন্ত বেশি নেওয়া হয়েছে। এরকম একটা ঘরের ভাড়া মাসে পাঁচ সাত টাকার বেশি হতে পারে না- বিশেষত যে ঘরে অপঘাত মৃত্যু ঘটেছে। এ কথায় সাড়ে ষোলো টাকা মাসিক ভাড়ায় রাজি হয়ে যাওয়া রতনলালের উচিত হয় নি। এরা যদি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে যে তার কাছে অনেক টাকা আছে, তাহলেই বিপদ।

রমলা পা দোলাতে দোলাতে বললো, তুমি নতুন এসেছো, আমাদের উচিত তোমাকে দেখাশুনা করা। তুমি খাও কোথায়?

-হোটেলে।

-ঘরে তো দেখছি একটা কুঁজোও নেই। জলটল খেতে হয় না?

-আপনারা দিদিরা রয়েছেন। দরকার হলে আপনাদের ঘর থেকে জল চেয়ে নিয়ে আসবো।

রমনা বললো, দিদি কি গো! এ মিনসে বলে কি? এর দেখছি মুখের কোনো আড় নেই।

ভানুমতী রতনলালকে বললো, দেখি, তোমার হাতখানা দেখি! ভানুমতী রতনলালের দিকে হাতখানা বাড়িয়ে দিল নিজের।

রতনলাল ঠিক বুঝতে পারলো না ব্যাপারটা। অপ্রস্তুত হয়ে বললো, কি? হাত দিয়ে কি করবেন?

ভানুমতীর আর তর সইলো না। খাটিয়া থেকে নেমে রতনলালের পাশে এসে তার হাতখানা ধরলো। তারপর তার হাত ও বুকের গন্ধ। শুকতে লাগলো।

রতনলাল কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার বাধা দেবার ক্ষমতা নেই যেন। এ সব তার কাছে একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।  

ভানুমতী বেশ কিছুক্ষণ গন্ধ শুকে বললো, হুঁমুখ দেখেই ঠিক ধরেছিলাম। তোমার গায়ে যে ভদ্দরলোক ভদ্রলোক গন্ধ গো-

রতনলাল তাকে বাধা দিয়ে একটা কিছু বলতে গেল—

ভানুমতী বললো, ওসব আমার কাছে লুকাতে পারবে না। অনেক পুরুষমানুষ ঘেঁটেছি তো। ভদ্দরলোকদের গায়ের গন্ধ আলাদা। সে ঘেমো গা হোক আর যাই হোক।

রমলা বললো, ভদ্দরলোকের ছেলে তো এই বস্তির মধ্যে ঘর ভাড়া করে আছো কেন’ রতনলাল একটা বড় রকমের নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, টাকা পয়সা যার না থাকে সে আবার ভদ্দরলোক কি?

-আহা, টাকা পয়সা এখন না থাকুক, পরে আবার হবে। তা বলে কি আনন্দ ফূর্তি করবে না? এরকম একলা ঘেঁড়ে হয়ে ঘরের মধ্যে সব সময় বসে থেকো না। আমাদের ঘরে চলো-

-সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, আমার কাছে পয়সা নেই। আমি আপনাদের কোনো কাজে লাগবো না।

– পয়সা পরে দিও। চেহারাখানা তো বাপু তোমার বেশ আছে।

– কিন্তু আমার অসুখ আছে।

– কি অসুখ?

-খুব খারাপ অসুখ।

ভানমতী ও রমলা আবার হেসে গড়াগড়ি যায়। রতনলালের কোনে কথাই তারা বিশ্বাস করেনি। একজন বললো, আহা ঢং করো না। পয়সা নেই বলে লজ্জা পাচ্ছো তো? ভদ্দরলোকদের পয়সা না থাকলেও অনেক অনেক কিছু থাকে। মরা হাতী লাখ টাকা।

ভানুমতী রতনলালের হাত ধরে টানলো।

রতনলাল দু’এক মুহূর্তে মনস্থির করে ফেললো। যম্মিন দেশে যদাচারঃ! এখানে যখন এসেই পড়েছে, এদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে হবে। বেশী কঠোর হলে টিকে থাকা মুশকিল হতে পারে।

সে বললো, আপনাদের ঘরে তো সন্ধেবেলা নাচ-গান হয়। আমি সেখানে তবলা বাজাতে পারি। ছোটবেলায় আমি তবলা শিখেছিলাম।

রমলা হাসতে হাসতে বললো, নাচ-গান! হায় হায়, নাচ-গান জানলে কি আর এ পোড়া ছাই বস্তিতে পড়ে থাকতাম। কলকাতা কিংবা লক্ষ্ণৌ চলে গিয়ে অনেক বেশি পয়সা কামাতে পারতাম।

-তুমি বুঝি নাচ-গান ভালোবাসো?

-না, না তবে ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পাই কি না?

-সে কি নাচ নাকি গো! সেতো খ্যামটা! এখানে নাচ গান বোঝার মতন মানুষ কি আসে?

ভানুমতী বললো, হোক না আজ একটু নাচ-গান। থিয়েটারের মেয়েদের মতন অত ভালো না পারলে ও একটু একটু তো পারি।

তাই ঠিক হলো। মেয়ে দুটি তখনকার মতন চলে গেল ঘর থেকে। যাবার আগে ভানুমতী পেছন ফিরে বিচিত্রভাবে তাকিয়ে এমন ভ্রুভঙ্গি করলো, যার মানে বুঝতে পারলো না রতনলাল।

রাত আটটার কিছু পরে একজন লোক এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল ভানুমতীর ঘরে। সেখানে আজ ভালো আসর বসেছে। যোগাড় হয়েছে ঘুঙুর হারমোনিয়াম আর তবলা। তবলাটা আবার বাঁধা নেই সুরে। সাত আট বছরের মধ্যে রতনলাল। একবার ও হাত দেয়নি তবলায়। তবে স্কুলে পড়ার সময় তার বাজানোর অভ্যেস ছিল। আর এক কাকা সেতার বাজাতেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গত করতে শিখেছিল রতনলাল।

হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে তবলটা ঠিক করে কয়েকটা চাঁটি দিতেই রমলা উঠে দাঁড়ালো। সাত-আট জন লোক এবং স্বয়ং বাপোটজী সেখানে আজ রঙ্গরস দেখতে উপস্থিত। মদের বোতল এবং গেলাস উপস্থিত।

রতনলালকেও মদ এগিয়ে দিয়েছিল একজন, রতনলাল প্রত্যাখ্যান করেনি, পাশে এনে রেখেছে।

রমলা ঘুঙুর বাজিয়ে নাচ শুরু করেছে। নাচ মানে একটা ধেই ধেই ব্যাপার আর কি। মেয়েটি কিছুই নাচ জানে – না রতনলাল অনেক চেষ্টা করেও লয় রাখতে পারছে না। কোনো মতে ঠেকা দিয়ে যেতে লাগলো। মেয়েটি নাচের নাম করে বিলোল লাস্যে অঙ্গ দোলাচ্ছে, হাবভাবে ফুটিয়ে তুলছে নির্লজ্জতা, মিনিটে মিনিটে আঁচল ওড়ানো আর শাড়ী উঁচু করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য।

রতনলাল মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বাজাতে লাগলো। এ দৃশ্য সে সহ্য করতে পারে না। তার গা গুলিয়ে উঠেছে। অন্যরা কিন্তু মদের ঝোঁকে এরই তারিফ করছে খুব।

এরপর নাচতে উঠলো ভানুমতী। আর তবু কিছুটা তাল লয় জ্ঞান আছে। কিন্তু শরীরটা বেশী ভারী। হাত পা দ্রুত চলে না। তাছাড়া শ্রোতাদের অনুরোধে ওকে ঘন ঘন কোমর দোলাতে হচ্ছে। ওরই মধ্যে একজন আবার উৎকট গলায় একটা গান শুরু করলো।

শ্রোতাদের সংখ্যা বাড়ছে। এই বস্তির সন্ধ্য অতিথিরা আজ একটা নতুন মজা পেয়েছে। অন্য ঘরের মেয়েরাও ক্রমে ক্রমে ভিড় করলো এখানে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেলেল্লা হৈ-হল্পা বাড়াতে লাগলো।

রতনলালের দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। তার খুব মন খারাপও হয়ে যাচ্ছে। এই তার দেশের মানুষ। এরা বোধ হয় জানেই না, এদেশ পরাধীন। মাতৃভূমির কলঙ্কমুক্ত করার জন্য এরা কোনো দায়িত্ব অনুভব করে না। এরা যেন অন্ধ ও বধির। কিংবা শিশুর মতন আত্মবিস্তৃত। এখনো কত কাজ বাকী আছে।

পুরোনো শ্রোতারা এক একজন এক একটি মেয়ের হাত ধরে বাইরে চলে যাচ্ছে, নতুন শ্রোতারা আসছে। যারা রতনলালকে চেনে না কিংবা তবলার কিছুই বোঝে না, তারাও রতনলালকে ধমকে বলছে, এই ছেকরা ঠিকসে বাজা!

যেন সে সাধারণ একজন ভাড়া করে তবলচি। ওরা শুধু জানে তবলচিদের মাঝে মাঝে এরকম করতে হয়।

রতনলাল সেখান থেকে ওঠে পড়ার সুযোগ খুঁজছিল। হঠাৎ শ্রোতাদের মধ্যে একজনকে দেখে সে দারুণ চমকে উঠলো। আসানসোল ষ্টেশনের সেই লম্বা চওড়া লোকটা, যে তাকে ছাগল চাপা দেওয়ার অভিযোগে থানায় নিয়ে যেতে এসেছিল।

রতনলাল মুখ নীচু করে ফেললো। লোকটা কি তাকে চিনতে পারবে? গোঁফ কামিয়ে ফেলেছে, মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা -এখন তাকে চেনা শক্ত। লোকটা তাকে কতটুকু সময়ই বা দেখেছে। কিন্তু পুলিশের লোককে টিক বিশ্বাস করা যায় না। পুলিশের লোকও কি এরকম বে-আইনী পাপের জায়গায় ফূর্তি করতে আসে? না কি ওর কোনো অন্য উদ্দেশ্য আছে?

লোকটা কি বিশেষভাবে নজর রেখেছে রতনলালের ওপর, তাও ঠিক মনে হয় না। খানিকটা ঢুল ঢুলু চোখে বসে দু’হাতে তাল দিচ্ছে। রতনলাল ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠলো। ছাগলটা চাপা দেবার পরই তার ভাগ্যটা খারাপ হতে শুরু করেছে।

রতনলাল একবার কোমরে হাত দিয়ে অনুভব করলো, পিস্তলটা ঠিক আছে কি না। সেই মুহূর্তে ভানুমতীর দিকে তার চোখ পড়ল। ভানুমতী কি যেন ইশারা করলো তাকে। এটাও বুঝতে পারলো না সে। টাকাগুলো ঘরে মধ্যে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। এখানে আর কিছুতেই থাকা চলে না।

সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পুলিশের লোকটির দিকে। মাঝে মাঝেই লোকটির সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। লোকটি আশা তাকে চিনতে পারার কোনো ভাব দেখাচ্ছে না- তবু রতনলালের মনে হচ্ছে, লোকটি যেন ঠিক মাতাল নয়, ভান করছে মাতাল হওয়ার। লোকটি কি অপেক্ষা করছে আরও লোকজন এসে পড়ার? যতই চেষ্টা করুক, রতনলালকে ওরা জীবন্ত ধরতে পারবে না। কিন্তু টাকাগুলোর কি হবে?

নাচ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন রমলা তার কপালের উপর মদ ভর্তি গেলাস রেখে ব্যালান্সের খেলা দেখাচ্ছে, এর সঙ্গে কিভাবে তবলা বাজাতে হয় তা রতনলাল জানে না। সে হাত গুটিয়ে বসেছিল। এক সময় বললো, আমি একটু বিড়ি খেয়ে আসছি বাইরে থেকে। এই বলে উঠে পড়লো।

বাইরে বেরিয়ে সে কাদা প্যাচপেচে গলিটা দিয়ে হন হন করে আসছিল নিজের ঘরের দিকে। সবে মাত্র দরজাটা খুলতে যাবে; এমন সময় পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। দেখলো, ভানুমতী।

ভানুমতী তীক্ষ্ম গলায় বললো, তুমি কে, সত্যি করে বলো তো?

রতনলাল বিস্ময় গোপন করে বললো, এখনো বুঝলে না। আমি একজন সাধারণ গরীব মানুষ। ফুর্তি করার পর্যন্ত মুরোদ নেই।

-আমার কাছে লুকিয়ে না।

– কিছু লুকোইনি তো।

– তুমি বিপদে পড়বে। বাপোটজীকে তুমি চেনে না।

রতনলাল দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। মোমবাতি জ্বালিয়ে বললো, ভেতরে আসুন। ভানুমতী ভেতরে ঢুকে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। তার কৌতূহল খুবই জাগ্ৰত। রতনলাল জিজ্ঞেস করলো, একরম কথা বলছেন কেন? আমি কি করেছি?

– বিকেলে যখন আমি এসেছিলাম তখন তোমার ঘরে আমি একটা জিনিস দেখেছি।

– জি জিনিস?

– যে পুঁটলিটা দিয়ে তুমি বালিশ করেছো, তার নিচে একটা পিস্তল ছিল। একটু আগেও তুমি কোমরে হাত দিয়ে দেখছিলে। তোমাকে ভালো লেগেছে বলেই একটা কথা জানতে এসেছি। এখানে বন্দুক পিস্তলের কারবার করতে যেও না। বাপোটজীর নিজের মস্ত বড় দল আছে। তুমি ওদের সঙ্গে পারবে না।

-আপনি এখানে একটু বসুন, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।

– না, আমি আর বসবো না। আমার বুঝি রোজগারপাতি নেই। তুমি আমাকে এত আপনি আজ্ঞে করছো কেন?

– আমার একটা দিদি ছিলেন, অনেকটা আপনার মতন দেখতে। তাই আপনাকে আমার দিদির মতন মনে হয়।

—ভদ্দরলোকের ছেলে হয়েও চুরি-ডাকাতির লাইনে এসেছো কেন? এ সব লাইন তোমাদের জন্য নয়।

-তার আগে আপনি একটা কথা বলুন, আপনি আমাকে সাবধান করতে এসেছেন কেন? আমির কোনো বিপদ হলেই বা আপনার কি এসে যায়?

– কি জানি বাপু, তোমাকে দেখলেই মনে হচ্ছিল, তোমার কপালে অনেক দুঃখ আছে। কেন সাধ করে এ লাইনে এসেছো?

-দিদি আপনাকে একটা কথা বিশ্বাস করে বলছি। আমি চোর বা ডাকাত নই। আমি একজন দেশের কর্মী। আমরা ইংরেজকে এ দেশ থেকে ডাড়াতে চাই। আপনি শোনেনি আমাদের কথা?

—গান্ধী বাবার চ্যালা?

—ঠিক গান্ধী বাবার শিষ্য না হলেও আমরা ঐ একই রকম কাজ করছি। বিশেষ কারণে আমাকে দু’একদিনের জন্য এখানে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।

ভানুমতি খানিকটা স্তম্ভিত হয়ে গেছে। ফ্যাকাশে ভাবে বললো, তোমাদের তো দেখলেই পুলিশে মারবে। এই কি লুকোবার জায়গায়?

– কেন, এখানে পুলিশ আসে?

-সে পুলিশ এলেও বাপোটজী হাত করে ফেলবে। কিন্তু এসব জায়গা কি তোমাদের মানায়? তোমরা হলে সব দেব রিত্র।

আমি কালকেই চলে যাবো। আপনার ঘরে কি আজ কোনো পুলিশের লোক এসেছেন।

-আমার ঘরে? কক্ষনো না?

-আপনি আমার কথা কারুকে বলবেন না। আপনাকে এইটুক বিশ্বাস করতে পারি তো? আমার কি দায় পড়েছে লোককে বলার? কিন্তু তোমার কথা সত্যি তো?

-দিদি আমি আপনার গা ছুঁয়ে এ কথা বলতে পারি।

-ওমা ছি ছি, এ কথা শুনলে যে পাপ হয়। তোমার মতন লোক আমার পায়ে হাত দেবে কি? হঠাৎ কেঁদে ফেললো ভানুমতী। কি জন্য সে কাঁদলো, সেই জানে। আবার চোখের জল মুছে বললো, আমি যাই, নইলে আমাকে ওরা খুঁজবে। তুমি সাবধানে থেকো।

ভানুমতী চলে যাবার পর রতনলাল ঠিক করলো, আর এখানে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। এই রাত্রির অন্ধকারে সরে পড়াই ভালো। একটু বিপদের ঝুঁকি থাকলেও তাকে সেই ঝুঁকি নিতেই হবে।

কিন্তু এর পর অসম্ভব তাড়াতাড়ি অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল। রতনলাল টাকাগুলো কোমরে বেঁধে নিয়ে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, এমন সময় বাপোটজী আর তিনজন গুণ্ডা মতন লোককে নিয়ে ঘরে ঢুকলো এবং কোনো কথা না বলে সেই তিনজন রতনলালকে জড়িয়ে ধরলো।

বাপোটজী বললো, তোমার কাছে কি কি মাল আছে সব বার করো! আমার চোখে ধুলো দেবে ভেবেছো?

রতনলাল খুব বড় করে দম নিলো। এতে সে ভয় পায়নি। তার গায়ের জোরের কথা এরা জানে না। এক ঝটকায় সে এই তিনটে লোককেই ছাড়িয়ে নিয়ে কোমর থেকে পিস্তলটা বার করে নিতে পারে। তারপর গুলি চালিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া শক্ত নয়। কিন্তু অনর্থক গোলমালের মধ্যে গিয়ে লাভ নেই। নিতান্ত বাধ্য না হলে এবং পুলিশের সঙ্গে লড়াই ছাড়া সে গুলি খরচ করতে চায় না। অনেক কষ্ট করে এসব জোগাড় করতে হয়।

রতনলাল ঠান্ডা গলায় বললো, আমাকে ছেড়ে দিতে বলুন। আমি সব বলছি।

বাপোটজী বললো মাৎ ছোড়ে দিতে বলুন। আমি সব বলছি।

বাপোটজী বললো, মাৎ ছোড়ে। ঠিকসে পাকড়ো।

রতনলাল এবার দাঁতে দাঁত ঘষে তীব্রভাবে বললো, শুয়োরের বাচ্চা, বেশি সাহস হয়েছে তোমার। আমার গায়ে হাত দিতে এসেছেঅ। বেশি চালাকি করলে আমার দলের লোক তোমার বস্তিকে সব জ্বারিয়ে দেবে। তুমি চেনো না আমাকে।

বাপোটজী নিজের হাতে পকেট থেকে একটা পিস্তল বার করে তাগ করে বললো, এই, ছাড়তো। কি বলে শুনি।

লোকগুলো রতনলালকে ছেড়ে দেবার পর সে বাপোটজীকে হুকুমের সুরে বললো, পিস্তল নামাও। ওসব আমাকে দেখাবার দরকার নেই। আমাকে ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। তোমার মতন কয়েক ডজন লোককে আমি চার্কি ঘোরাতে পারি। আমার হাতে বেশি সময় নেই, খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা কথা বলে নিচ্ছি। শোনো, তুমি আমি তোমার এই তিনজন লোক, এই বস্তির সবাই-আমরা একই দেশের মানুষ। ঠিক কি না?

বাপোটজী চুপ করে রইলো।

রতনলাল বললো, আমরা কেউ বাঙ্গালী, কেউ বিহারী বা কেউ ইউ পি থেকে এসেছি-কিন্তু এগুলো দেশ নয় আমাদের সকলের এক দেশ, তার নাম ভারত। আমাদের মধ্যে কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান, কেউ খৃষ্টান, তবু আমরা সেই এক দেশের মানুষ। এখন আমাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া মারামারি করার সময় নয়। এখন ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের লড়াই। আমাদের সকলকে এক কাঠঠা হয়ে সেই লড়াই চালাতে হবে।

বাপোটজী অস্ফুট গলায় বললো, স্বদেশীয়! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।

-হ্যাঁ আমি তাদেরই লোক।

-স্বদেশীয়াদের সঙ্গে আমাদের কোনো করবার নেই। ভাগে হিয়াসে!

-শোনো আমি তোমাদের সাহায্য চাই।

-ওসব বাতচিত ছাড়ো। তুমি যাও এখান থেকে।

-তোমরা গোপনে বন্দুক পিস্তল কেনাবেচা করো আমি জানি। সে রকম কিছু অস্ত্র আমাদের জোগাড় করে দাও। তার বদলে টাকা পাবে।

অন্য তিনজনের মধ্যে একজন বললো, সর্দার স্বদেশীয়াদের সঙ্গে আমাদের কারবারের দরকার নেই।

বাপোটজী বললো, সে আমি জানি। এরা সব ঝঞ্চাটিয়া লোক। এরা পিছনে পিছনে পুলিশের ফেউ আসে।

-শোনো বাপোটজী, পুলিশ তোমাদেরও সুযোগমত পেলে ছাড়বে না। আমরা পুলিশের ভয় পাই না, তোমরা পাবে কেন? তাছাড়া এটা দেশের কাজ। তোমার নিজের দেশের জন্য তুমি এইটুকু করবে না?

-ওসব বড়কা বড়কা বাত ময়দানমে যাকে বলো। আমাদের এখানে কেন ঝামেলা করতে এসেছো?

-ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। যদি পুলিশে খবর দিয়ে আমাকে ধরিয়ে দাও, তাহলে বিপদ আছে তোমার। একজন স্বদেশীকে ধরিয়ে দিলে অন্য স্বদেশীরা তার বদলা নেয়। তোমাকে সাবধান করে দিলাম।

– স্বদেশীদের সঙ্গে যেমন আমাদের কারবার নেই, তেমন পুলিশের সঙ্গেও আমার কারবার নেই।

-আমি ধরা পড়লে তুমিও খতম হয়ে যাবে।

-আরে বাবা, ভাগো না হিয়াসে। আভি ভাগ যাও।

এমন সময় বাইরে হুইশেল-এর শব্দ শোনা গেল। তৎক্ষণাৎ একটি ছেলে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে বললো, পুলিশ!

বাপোটজী আর তার সঙ্গীরা চক্ষের নিমেষে ঘর থেকে বেরিয়ে উধাও হয়ে গেল।

রতনলাল দু’এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বুঝে নিল অবস্থাটা। ঘন ঘন হুইশেল-এর শব্দ ভেসে আসছে চর্তুদিক থেকে-তাতে মনে হয় পুলিশের প্রস্তুতিটা বড় রকমের। নিতান্ত একটা ছাগল চাপা দেওয়া সাইকেল আরোহীকে ধরতে আসার ব্যাপার নয়। বস্তির চারদিক ঘিরে ধরে আস্তে আস্তে এগোবে।

রতনলাল দৌড়ে চলে এলো ভানুমতীর ঘরে। ঘর এখন ফাঁকা। তাকে দেখে ভানুমতী বললো, একি?

রতনলাল দরজটা বন্ধ করে দিয়ে বললো, আপনার সঙ্গে জরুরী কথা আছে। আপনার কাছে আমি কিছু টাকা রেখে যাবো আপনি লুকিয়ে রাখতে পারবেন?

-কত টাকা?

-এক লক্ষ দশ হাজার।

-অত টাকার অঙ্ক শুনে ভানুমতীর প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো অবস্থা। সে বললো, অত টাকা? আর তুমি বলছিলে, তোমার কাছে টাকা নেই।

-অত কথা এখন বলার সময় নেই। ঈশ্বরের দিব্যি করে বলছি, এই টাকা কোনো খারাপ কাজের জন্য আমার কাছে ছিল না। এটা আমাদের দেশের লোকের টাকা। এর প্রতিটি পাই- পয়সা পর্যন্ত দেশের কাজের খরচ হবে। এটা আপনার কাছে এখন রাখুন।

-এত টাকা আমি কোথায় লুকিয়ে রাখবো?

-আপনার কাছে এত টাকা আছে, কেউ সন্দেহ করবে না। সেই জন্যেই আপনার পক্ষে রাখা সুবিধে। আর যদি বেঁচে থাকি, আমি ফিরে এসে টাকাটা নিয়ে যাব। আমি যদি মরে যাই, তাহলে টাকাটা কলকাতার এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন। আপনি যদি টাকাটা না দিতে চান, সে আপনার ধর্ম। তবু দেশের কথা মনে রাখবেন। আমি যাচ্ছি।

-শোনো, শোনো তুমি ছাড়া এ টাকা অন্য কারুর হাতে কখনো দেবো না।

-আমি মরে গেলেও টাকাটা দেশের কাজে লাগাবার চেষ্টা করবেন। সেই জন্যেই কলকাতার ঐ ঠিকানার দিলাম। টাকাটা আমার সঙ্গে থাকলে পুলিশ আমাকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে টাকাটাও নিয়ে যাবে। তাই আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি।

-তুমি মরবে না, তুমি কিছুতেই মরবে না।

ভানুমতী ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কিন্তু সেদিকে তাকাবার আর সময় নেই রতনলালের। খোলা পিস্তল হাতে নিয়ে সে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।

বস্তির পেছন দিকে মস্ত পুকুর আছে, সেটা রতনলাল আগে দেখে রেখেছিল। এখন দ্রুত চলে এলো সেদিকে। পুকুরের ধারে একজন মাত্র লোক দাঁড়িয়ে ছিল। সে পুলিশ কিংবা অন্য লোক তা যাচাই করার আর সময় নেই। রতনলাল গুঁড়ি মেরে এসে বাঘের মতন ঝাঁজিয়ে পড়লো তার ওপরে। পিস্তলের হাতল দিয়ে উপর্যুপরি কয়েকবার ঘা মারলো তার মাথায়। এক হাতে লোকটার মুখ চেপে ধরেছিল।

লোকটা অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়তেই রতনলাল নিঃশব্দে নেমে পড়লো দিঘিটাতে। অন্ধকারে কালো জলের মধ্যে শুধু মুখ ও একটা হাত তুলে বুক-সাঁতার কেটে এগোতে লাগলো অন্যদিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *