বুকের মধ্যে আগুন – ৩

॥ তিন ॥

রফিক আর সুকুমার বর্ধমান স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিল। সুকুমার তখনও ছটফট করছে। সারা রাত সে ঘুমলো না। চোখের পাতা বুজলেই সিনেমার মতন ভেসে উঠেছে সেই দৃশ্য-গুলি খেয়ে নেপালী ভদ্রলোকটি চুপ করে পড়ে গেলেন, মাটিতে মুখখানা কি দারুণ কুঁকড়ে গেচে সুকুমার পালাতে চাইছে তবু পালাতে পারছে না!

রফিকও জেগে রইলো সারা রাত। থার্ডক্লাস ওয়েটিং রুমের গাদা গাদা মানুষের পাশে ওরা দু’জনেও ঘাপটি মেরে আছে। রফিকের চোখ বাইরের দিকে। খবর রটে গেছে এতক্ষণে- সারা রাত ধরেই পুলিশের আনাগোনা চলছে। শোনা যাচ্ছে ভারী বুট জুতো পরা পায়ের দাপাদাপি।

এবার কয়েকজন পুলিশ এই ওয়েটিং রুমের মধ্যেও ঘুরে গেল। সেই সময় ওরা দম বন্ধ করে গাঢ় ঘুমের ভান করে রইলো। পুলিশ অবশ্য করুকেই ঘাঁটলো না।

সুকুমার মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে আর ভয়ে জড়িয়ে ধরছে রফিকের হাত। রফিক ফিসফিস করে বললো, আরে আমার এ হাতে ব্যথা। অন্য হাতটা ধর।

আহত আঙ্গুলটা রফিক একবার চোখের সামনে এনে দেখলো স্পষ্ট তিনটে দাঁতের দাগ। মানুষের দাঁত। মানুষের দাঁতের নাকি বিষ থাকে? তবে ব্যথাটা আর বেশি বাড়ে নি।

ভোর হতে না হতেই মানুষজন জাগতে শুরু করেছে। রফিক আর সুকুমার তখনও উঠলো না। লোকজনের ভিড়ে যখন প্লাটফর্ম একেবারে গম্ গম্ করতে লাগলো, তখন ওরা জাগলো। চা-ওয়ালার কাছ থেকে দু:ভাড় চা কিনে নিয়ে রফিক সুকুমারকে বললো, যা, গোসলখানা থেকে ঘুরে আয়।

সুকুমার ফিরে আসার পর তাকে বসিয়ে রেখে রফিক গেল বাথরুমে সেরে আসতে। ফিরে এসে দেখলো সুকুমার নেই। তার বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। টাকার থলে ও রিভরভারটা সে সুকুমারের কাছে জমা দিয়ে গিয়েছিল।

রফিক তীব্র চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। প্লাটফর্মের বাইরে এসে খুঁজতে লাগলো সুকুমারকে। এইটুকু সময়ের মধ্যে সে কোথায় যাবে? সাইকেল স্ট্যাণ্ডে তার সাইকেলটা এখনো রয়েছে।

একটু বাদে দেখলো, দূরে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে সুকুমারতাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রফিক প্রায় দৌড়ে তার কাছে এসে বললো, চলে এলি কেন? সুকুমার ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে বললো, চুপ! পুলিশ।

রফিক পেছনে তাকিয়ে দেখলে, স্টেশনে গেটের কাছে দু’জন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ নিজেদের মধ্যে কি সব কথা বলছে।

রাগে রফিকের গা জ্বলে গেল। ইচ্ছা হলো সুকুমারকে এক চড় কষাতে। চাপা গলায় বললো, আরে বেকুব, ঠোঁট থেকে হাত নামা!

– রফিকদা, পুলিশ দুটো আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল।

বেশ করেছে। পুলিশ দেখে ওরকম ভয় পেলে এক্ষণি ধরা পড়বি।

রফিক বুঝতে পারলো, সুকুমারের মুখ চোখের চেহারা অস্বাভাবিক। গত রাত্রের ঘটনায় সে এমন একটা ধাক্কা খেয়েছে যে অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। বড্ড ছেলেমানুষ!

রফিক ওর হাত থেকে নিজের পুটলিটা কেড়ে নিয়ে বললো, তুই এবার কোন দিকে যাবি? আমি তো ট্রেনে উঠবো।

সুকুমার রফিকের হাত জড়িয়ে ধরে বললো, রফিকদা আমাকে ছেড়ে যেও না! আমি তোমার সঙ্গে যাবো।

-না, না, এখন এক সঙ্গে থাকা ঠিক নয়। এখন সবাইকে আলাদা থাকতে হবে।

সুকুমার তবু ছেলেমানুষের মতন বললো, রফিকদা আমাকে ছেড়ে যেও না।

সুকুমারের সম্পর্কে রফিকের মনে খানিকটা মায়া আছে। বিপ্লবীদের মনে এরকম দয়া- মায়ার প্রশয় ঠিক নয়। তাতে কাজে ভুল হয়ে যায়। তবু রফিক সুকুমারকে এই অবস্থায় ছাড়তে পারলো না।

খানিকটা নরমভাবে বললো, চল আমার সঙ্গে। কিন্তু একদম চুপ-চাপ থাকবি। ঐ পুলিশ দু’জনের সামনে দিয়েই আমাদের স্টেশনে ঢুকতে হবে আবার, পারবি তো?

-পারবো।

বাইরের কাউন্টার থেকে রফিক দু’খানা’ টিকিট কিনে নিল কলকাতার। তারপর গুণগুণ করে। একটা গান গাইতে গাইতে এগোলো ষ্টেশনের দিকে।

পুলিশ দু’জন তখনও গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রফিক তাদের কাছাকাছি এসে একজন পুলিশকেই জিজ্ঞেস করলো, সাব, আপকা ঘড়ি মে কিনা বাজা হ্যায়?

একজন সার্জেন্ট বিরক্তভাবে ঘড়ি দেখে বললো, সাড়ে আট। তারপরেই সে অন্য জনের সঙ্গে কথা বলায় আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

ভেতরে এসে হাসি মুখে রফিক তাকালো সুকুমারের দিকে। সুকুমারের মুখখানা পুরোনো কাগজের মতন বিবর্ণ। সে যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

রফিক বললো, আচ্ছা ডরপুক দেখছি তুই। চল, নাস্তা করে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সুকুমার বুঝতে না পেরে বললো কি, করবো?

-জলখাবার! খিদে পায় নি? একটু কিছু খাবার-টাবার খেলেই জোর আসবে।

খাবার দোকানের সামনে এসে অর্ডার দেবার আগে রফিক সুকুমারকে জিজ্ঞেস করলো, তোর কাছে কিছু টাকা পয়সা আছে তো? আমি রেলের টিকিট কাটলাম, আমার কাছে বেশী পয়সা নেই।

রফিকের কাছে এক লক্ষ দশ হাজার টাকা রয়েছে, কিন্তু সে টাকা খরচ করার অধিকার নেই তার।

সুকুমার পকেট থেকে সাতটা টাকা বার করে বললো, এই আছে।

-যথেষ্ট।

ওরা দু’জনে ডিম সেদ্ধ, টোস্ট, জিলিপি, চা খেল পেট পুরে। খাওয়া তখনো শেষ হয়নি। এই সময় ঝম ঝম করে, একটা কলকাতাগামী ট্রেন এসে দাঁড়ালো।

রফিক বললো, তাড়াতাড়ি চা-টা শেষ কর, আমার এই ট্রেনে উঠবো।

-সাইকেলটা কি হবে?

জাহান্নামে যাক্ সাইকেল।

ছুটির দিন, ট্রেনের বিশেষ ভিড় নেই। তবে প্রত্যেক স্টেশনেই পুলিশ এসে উকি মেরে যাচ্ছে। কি তারা দেখছে কে জানে। রফিক নিশ্চিন্ত মনে জানলার ধারে বসে গান গাইছে। সুকুমার এখন একটু একটু ঘুমে ঢুলছে।

কিছুক্ষণবাদে দু’জন সহযাত্রী গায়ে পড়ে আলাপ করতে এলো রফিকের সঙ্গে। রফিক এখন পৃথিবীতে কারুকে বিশ্বাস করতে পারে না। এই লোক দুটি অনায়াসে ইনফরমার হতে পারে। রফিকের চেহারাটা এমনই যে তাকে চট করে বাঙালী কি অবাঙালী ঠিক বোঝা যায় না। সে অনর্গল উর্দু মেশানো হিন্দী বলা শুরু করতেই লোক দু’টি দমে গেল একটু।

হাওড়া স্টেশনে আসবার আগেই ওরা নেমে পড়লো বেলুড়ে। সেখান থেকে বাস ধরলো। গঙ্গার ঘাট থেকে ফেরি নৌকায় চলে এলো এপারে। তারপর একটা রিক্শা চেপে চললো খিদিরপুরের দিকে।

রফিক জিজ্ঞেস করলো, কলকাতায় তোর মেসে তো ফেরা যাবে না। আর কোনো থাকবার জায়গায় নেই?

– সুকুমার বললো, না।

– সে রকম কোনো বন্ধু নেই?

– রফিকদা, আমি তোমার সঙ্গে যাবো।

কি মুশকিল, তুই কি আমার সঙ্গে আঠার মতন লেগে থাকবি নাকি? রতনলাল কি বলেছে শুনিস নি? এখন সবাইকে আলাদা থাকতে হবে।

-আমি তা হলে কোথায় যাবো?

সুকুমার কথাটা এমন অসহায়ভাবে বললো যে রফিকের বুকটা মুচড়ে উঠলো। এই ছেলেটার মন এখন অবশ হয়ে আছে। ওকে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না। ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, চল!

-কোথায়?

– মুসলমান পাড়ায় থাকতে পারবি?

– কেন পারবো না?

– মুসলমান পাড়ায় পুলিশ বিশেষ সন্দেহ করবে না। কিন্তু পাড়ার লোক যদি চিনে ফেলে? আমি লুকিয়ে থাকবো।

– চল্‌ তো, দেখা যাক্।

বস্তির ধার ঘেষে একটা দোতলা বাড়ি। এক তলায় দু’ঘর ভাড়াটে। ওরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো দোতলায়। সিঁড়ির মুখেই দরজা, সেটা বন্ধ। কয়েক বার ধাক্কা দিতেই একজন বৃদ্ধ বাবুর্চি ধরনের লোক সেটা খুলে দিল। সে রফিককে দেখে দু’হাত ছড়িয়ে একটা হতাশার ভঙ্গি করে বললো, আ— কোনোদিন কি একটু খবর দিয়ে আসতে নেই? আগে থেকে খবর দিলে-

রফিক হাসতে হাসতে বললো, ব্যবসার কাজের কি সময় ঠিক থাকে? করিম ভাই, আমার এক দোস্তকে নিয়ে এসেছি। বহুৎ আচ্ছা সে দেখভাল কর্ না, হ্যাঁ?

করিম বললো, তোমার দোস্ত্ এত দুবলা কেন? এখানে এক মাহিনা দো থাকো – আমি ভালো করে খাইয়ে জোওয়ান করে দেবো!

– দেখি, আজ দুপুরে ভালো করে খাওয়াও তো!

ওরা এসে ঢুকলো চমৎকার সাজানো গোছানো ঘরে। করিম চলে আসার পর রফিক বললো, এটা আমার চাচার বাড়ি। চাচা থাকেন মুর্শিদাবাদে, ব্যবসার কাজে এখানে মাঝে মাঝে আসেন। একটা আলমারি ভর্তি জামা কাপড়। সেটা খুলে রফিক বললো, যেটা খুশি পরতে পারিস তবে, দিনের বেলা বেশির ভাগ সময় লুঙ্গি পরে থাকবি, বুঝলি?

– আচ্ছা।

-আর একটা কথা। এখানে অনেক খুবসুরত জানান আছে। তাদের দিকে তাকাবি না। মুসলমান মেয়ের প্রেম তুই সহ্য করতে পারবি না।

সুকুমার লাজুকভাবে হাসলো।

স্নানটান সেরে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ওরা দু’জনেই দারুণ ঘুম দিল। জেগে উঠলো একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবার পর।

করিম পট ভর্তি চা বানিয়ে কোথায় যেন বেরিয়েছে। ঠান্ডা হয়ে গেছে চা।

রফিক বিরক্তির শব্দ করে বললো, এখন কে আবার চা বানায়। এই, তুই চা করতে পারিস?

সুকুমার বললো, চেষ্টা করে দেখতে পারি।

তার কথা শুনলেই বোঝা যায়, সে কোনোদিন রান্নাঘরে ঢোকে নি। সবাই জানে সুকুমার একটু কবি প্রকৃতির ছেলে। লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতাও লেখে, কিন্তু কারুকে দেখায় না। রান্নাবান্নার মতন ব্যাপারে তার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।

রফিক হেসে বললো, তুই কি ভেবেছিস, এখানে শুধু বসে বসে খাবি? কাজকর্ম করতে হবে!

এই সময় দরজার কাছে কার যেন ছায়া পড়লো। রফিক চমকে উঠে বললো, কে? কুণ্ঠিত মেয়েলী গলায় ডাক শোনা গেল, রফিক ভাই!

রফিক হুট করে দরজাটা খুলে ফেললো। একটা উনিশ কুড়ি বছরের মেয়ে, শ্যালেয়ার কামিজ পরা, হাতে একটা বড় গোল বাটি। মেয়েটির গায়ের রং ফুটফুটে, মাথার চুল ঘন কালো।

রফিক রুক্ষ গলায় বললো, তোমার এখানে কি চাই?

মেয়েটি লাজুকভাবে বললো, আপনি আজ এসেছেন তো, তাই দেখতে এলাম।

-তুমি যখন তখন ওপরে উঠে আসো বুঝি? দরজা বন্ধ থাকে না।

-আমরা তো ছাদে কাপড় মেলতে আর উঠাতে যাই, তাই করিম ভাই সকালে আর বিকালে দরজা খুলে রাখেন।

-কেন, নিচে কাপড় শুকাতে দেবার জায়গা নেই?

-রফিক ভাই, আপনি আমাকে বকছেন?

-না, বকছি না। এখন নিচে যাও!

-রফিক ভাই, আমি আপনার জন্য একটু কাবাব নিয়ে এসেছি। আমি নিজের হাতে বানিয়েছে।

-এর মধ্যেই এসব শুরু হয়ে গেছে! এসো, ভেতরে এসো!

রফিক রীতিমতন ধমক দিয়ে কথা বলছিল মেয়েটির সঙ্গে। মেয়েটি তবু হাসি মুখে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। খাটের ওপর সুকুমার জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।

রফিক মেয়েটিকে বললো, এর নাম সুকু মিয়া। আমার ফুফাতে ভাই। তুমি একে আগে দেখো নি।

তারপর সুকুমারের দিকে তাকিয়ে বললো,এই মেয়েটির নাম তিশনা। তৃষ্ণা নয়, তিশনা। ভারী ফাজিল মেয়ে।

তিশনা বললো, রফিকভাই, আপনি আমাকে দেখলেই বড় বকেন।

– বকবো না! তোমার নানী বারণ করেছেন না যখন তখন আমাদের এখানে আসতে?

-নানীর এখন খুব অসুখ, বিছানা থেকে ওঠে না।

-বা বা বা নানীর এখন অসুখ, আর সেই সুযোগ নিয়ে ও এসেছে পালিয়ে! আবার কাবার বানানো হয়েছে! ঠিক আছে, এনেছো যখন, দাও দুটো প্লেটে।

তিশনা রান্নাঘরে থেকে দুটো প্লেট এনে যত্ন করে কাবাব সাজিয়ে দিল। দুটো গেলাসে নিয়ে এলা ঠান্ডা পানি।

রফিক বললো, গেলাস-বর্তন সব ধুয়ে রেখো আবার। নইলে করীম ভাই আবার রাগারাগি করবে।

-করীম ভাই আমাকে কিছু বলে না।

-আগে থেকেই ভাব জমিয়ে রাখা হয়েছে! যাও তাহলে চা বানিয়ে নিয়ে এসো!

তিশনা চা বানাতে চলে গেল রান্নাঘরে। রফিক কাবাব আস্বাদ করতে করতে বললো, তিশনা এ বাড়ির নিচের তলায় ভাড়াটেদের মেয়ে। ভাবী ছটফটে।

সুকুমার বললো, খুব সরল মেয়েটি।

-বড় বেশী সরল। এই বয়সে মেয়েদের এত সরল থাকা ভালো না।

-আপনি ওকে বড্ড বেশি বকছিলেন।

মেয়েছেলেদের সব সময় বকে বকে ঠান্ডা রাখতে হয়। নইলে ওরা বড় বেশি লাই পেয়ে যায়। তুই ছেলে মানুষ, তুই কি বুঝবি?

-আপনি আমার থেকে ক’বছরের বড়? সাত আট বছর?

-তবু আমি অনেক পোড়া খাওয়া মানুষ। এই জীবনেই অনেক কিছু দেখেছি। যাই হোক, মেয়েটা যে হঠাৎ এসে পড়েছে, এটা আমার একটু ও ভালো লাগছে না।

– কেন?

-মেয়েদের তো চিনিস না। ওরা পেটে কোন কথা রাখতে পারে না। তুই যে একটা নতুন লোক এখানে এসে রয়েছিস, এ কথা পাঁচজনকে বলে বেড়াবে। লোকের কৌতূহল হবে। বুড়োরা দেখতে আসবে।

-আমার লুকিয়ে পড়া উচিত ছিল।

-একটা জলজ্যান্ত মানুষ সব সময় লুকিয়ে থাকতে পারে না। দরজা বন্ধ করে রাখতে হবে সব সময়করীমকে সাবধান করে দিতে হবে।

তিশনা দু’কাপ চা দু’হাতে ধরে ব্যালেন্স করতে করতে ঢুকলো ঘরে। বললো খেয়ে দেখুন তো, কি রকম বানিয়েছি?

রফিক চায়ে এক চুমুক দিয়েই মুখ বিকৃত করে বললো এঃ হে। একেবারে বাজে! মুখটাই খারাপ হয়ে গেল।

সুকুমার হেসে বললো, আমার কিন্তু বেশ ভালো লাগছে।

তিশনা অভিমান করে বললো, রফিক ভাই তো আমার কোনোকিছুই ভালো বলেন না!

রফিক হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে চ-টা শেষ করলো। তারপর কাপটা নামিয়ে রেখে তীব্র চোখে তিশনার দিকে তাকিয়ে বললো, শোনো, তোমাকে একটা দরকারী কথা বলছি। আমাদের এখানে আর একদম আসবে না। আর আমার এই যে ভাইটি এখানে রয়েছে, এর কথা কারুকে বলবে না।

তিশনা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, আমি কারুকে কিছু বলবো না। তাহলে আমাকে আসতে দেবেন না কেন?

– তুমি বেশি এলে তোমার পেছনের অন্য লোক আসবে।

-আমি লুকিয়ে লুকিয়ে আসবো!

-আরে, একে নিয়ে তো খুব মুশকিয়ে পড়া গেল দেখছি! আমাকে যা বলছি তাই শুনবে। বেশি বেয়াদপি করলে কান মলে দেবো!

তিশনার ঝলমলে মুখখানা স্নান হয়ে গেল। দেখে মনে হলো এক্ষণি বুঝি কেঁদে ফেলবে। সুকুমার ভাবলো, তার কিছু একটা সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। কিন্তু মুখে তার কোনো ভাষা এলো না। তারপর ভাবলো, চুপ করে থাকাই তার উচিত। সে এখানে নতুন লোক, রফিকদা যা ভালো বুঝবে তাই করবে।

তিশনা আবার মুখ তুলে দারুণ কৌতুহলের সঙ্গে দেখছে সুকুমারকে। তারপর এক সময় থাকতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়ার কি হয়েছে? ভাইয়া লুকিয়ে থাকবে কেন?

রফিক ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললো, ভাইয়াকে ওর বাবা -মা জোর করে শাদী দিয়ে দিয়েছে। ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে ওকে ধরে নিয়ে যেতে চায় তাই পালিয়ে এসেছে।

তিশনা সুকুমারের দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসতে লাগলো। বললো, ভাইয়া শ্বশুরবাড়িকে এত ভয় পায়?

– হুঁ। সবাই ভয় পায়।

-ঠিক আছে আমি কারুক বলবো না।

চায়ের কাপগুলো ওদের কাছ থেকে নেবার সময় তিশনার নজর পড়লো রফিকের আহত আঙুলটার দিকে।

শিউরে উঠে বললো ইস, একি হয়েছে?

রফিক বললো, ও কিছু না।দরজায় ছেঁচে গিয়েছে।

-দাওয়াই লাগনার নি? দেখি, দেখি।

– না, কিচ্ছু দরকান নেই, এমনি সেরে যাবে।

-আমাদের ঘরে দাওয়াই আছে নিয়ে আসবো?

রফিক এবার তাড়া দিয়ে বললো, বলছি না, কিচ্ছু দরকার নেই তুমি এবার যাও, আমাদের এখন কাজের কথা আছে।

তিশনা কাপ প্লেটগুলো নিয়ে চলে গেল। রফিক একটা সিগারেট ধরালো, সুকুমার পড়তে লাগলো সেদিনকার খবরের কাগজ। ট্রেন ডাকাতির ব্যাপারটা প্রথম পৃষ্ঠাতেই বড় বড় অক্ষরে বেরিয়েছে। পুলিশ থেকে ইঙ্গি করা হয়েছে, এটা সাধারণ ডাকাতি নয়, এর পেছনে স্বদেশীয়দের হাত থাকা খুবই সম্ভব।

একটু বাদেও বাইরে মেয়েলী হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ শুনে রফিক বেরিয়ে আলো। দেখলো, দরজার কাছে দেয়ালের দিকে মুখ করে তিশনা দাঁড়িয়ে আছে অভিমানী মুখে। চোখে জলের ধারা।

রফিক কাছে এগিয়ে এসে বললো, এই, আবার কি হয়েছে?

তিশনা কোনো উত্তর দিল না। মুখও ফেরালো না।

– এই কি হয়েছে বলো না?

-আপনি আমাকে আজ সব সময় বকছিলেন।

-আরে এই জন্য কান্নাকাটি? তুমি কি এতই ছেলেমানুষ?

তিশনা হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লো রফিকের বুকে। সেখানে মুখ ঘষতে ঘষতে বললো, আমাকে কেন আসতে বারণ করছেন? কেন? আমি কি এতই খারাপ?

রফিক খুব সাবধানে তিশনাকে ছাড়িয়ে নিল নিজের বুক থেকে। তাকে একটু দুরে দাঁড় করিয়ে বললো, তুমি দেখছি সত্যি বড্ড ছেলেমানুষ আছো। এ রকম, আর কখনো করো না।

রফিকের গলার আওয়াজে এক রকমের দৃঢ়তা ছিল, তিশনা চট করে সামলে নিল নিজকে। চোখ মুছে বললো, আমি আর কিছু চাই না। আমাকে শুধু এখানে আসতে বারণ করবেন না বলুন? আমি শুধু দেখতে আসবো।

আচ্ছা, দিনে মাত্র একবার। কিন্তু আমি যা বলবো, তাই শুনতে হবে।

-শুনবো ঠিক শুনবো।

– এখন তাহলে ভালো করে চোখ মুছে ফেলে নিচে যাও।

তিশনা চলে যাবার পর রফিক দরজা বন্ধ করে এলো ঘরে। তার মুখখানায় ঈষৎ উত্তেজনার চিহ্ন, চট করে কোনো কথা বলতে পারছে না।

সুকুমার বললো, রফিকদা একটা কথা বলবো?

-কি?

-ঐ মেয়েটা আপনাকে খুব ভালোবাসে।

রফিক হেসে বললো, তাই নাকি? তুই কি করে বুঝলি?

-মুখ দেখেই বোঝা যায়।

-বেশী কিছু দেখে ফেলিস না যেন।

-আপনি ঠাট্টা করে কথা ঘোরাচ্ছেন।

-ওর বাড়ির লোকেরা ওর সঙ্গে আমার শাদী দিতে চেয়েছিল। আমার চাচাকে ধরেছিল খুব। আমি রাজি হইনি।

– কেন? মেয়েটা কিন্তু খুব ভালো। এত সরল।

মেয়েটা ভালো ঠিকই। কিন্তু এখন কি আমাদের বিয়ে করার সময়? এখন কারুকে বিয়ে করা মানে তো সর্বনাশ করা। ঐ মেয়েটা কিছুতেই বোঝে না। কি যেন রবীন্দ্রাথের সেই কবিতাটি-

আমি পরানের সাথে খেলিবি আজিকে মরণ খেলা।
নিশীথ বেলা।
সঘন বরষা, গগণ আঁধার।
হেরো বারিধারা কাঁধে চারিধারা
ভীষণ রঙ্গে ভব তরঙ্গে ভাসাই ভেলা;
বাহির হয়েছি স্বপ্নশয়ন করিয়া হেলা
রাত্রিবেলা?

রফিক একটু থেমে বললো, এর পরে কি যেন?

সুকুমার এই কবিতার পরের লাইনগুলো আবৃত্তি করতে লাগলো গলা ছেড়ে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *