বুকের মধ্যে আগুন – ৫

॥ পাঁচ ॥

সব্যসাচীর কাঁধের ক্ষতস্থানে সেপ্‌টিক হয়ে গেছে, কয়েকদিন ধরেই তার খুব জ্বর। ওঠার শক্তি নেই।

পরিকল্পনা ছিল যে, অরিন্দম সব্যসাচীকে মাত্র একটা দিন তার দিদির আশ্রয়ে রাখবে। তারপর সব্যসাচীর ফরাসী চন্দননগরে আশ্রয় নেবে। দলের মধ্যে একমাত্র সব্যসাচীর পুলিশ রেকর্ড আছে। বরিশাল টাউনে সত্যগ্রহ করতে গিয়ে সে একবার সাত দিনের জন্য জেল খেটেছিল। তা ছাড়া, কাশীপুর বোমার মামলায় পুলিশ তার যোগাযোগ ধরে ফেলেছিল, অন্য আর সাত জনের জেল এবং দ্বীপান্তর হলেও সব্যসাচী সেবার ধরা পড়ে নি, তার নামে, এখনো হুলিয়া ঝুলছে। সুভাষবাবু তাকে আত্মগোপন করে থাকার অনুরোধ করেছিলেন, তবু সব্যসাচী এই ট্রেন ডাকাতির অ্যাকশনে নিজের থেকেই এসেছে। পুলিশ যদি এর সঙ্গে তার যোগসূত্র একবার অনুমান করতে পারে-তা হলেই তার ছবি ও বর্ণনা সমেত ইস্তাহার বেরিয়ে যাবে।

রতনলালও আগের কয়েকটিতে অংশ নিয়েছে বটে, কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি। সুতরাং পুলিশের কাছে সে এখন পর্যন্ত অচেনা।

অরিন্দম বেশ বিপদে পড়েছে সব্যসাচীকে নিয়ে। তার জামাইবাবু সরকারী অফিসার। তাঁর বাড়িতে এরকম বিপজ্জনক আসামীকে লুকিয়ে রাখতে কতদিন সম্ভব? যদিও তার মেজাদির পুরোপুরি সমর্থন আছে তাদের দিকে, কিন্তু জামাইবাবু সে কথা ঘুনাক্ষরেও জানেন না। সব্যসাচীকে তো এখন কোথাও নড়নোও অসম্ভব।

ডাক্তার ডাকতে পারা যায়নি। যদিও স্থানীয় ডাক্তারটি কুন্তলার বান্ধবীর বাবা, কিন্তু তিনি খুব গোঁজা রাজভক্ত বলে শোনা গেছে। এখন একটু ঝুঁকি নেওয়া যায় না। অরিন্দমের জামাইবাবু এসে পড়লে যে কি হবে সেও আর এক কথা।

একতলার ঘরে হঠাৎ বাইরের লোক এসে পড়ে দেখে ফেলতে পারে বলে সব্যসাচীকে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয়েছে তিন তলার ঘরে। তিন তলার এই একটি মাত্র ঘর, বাকিটা ছাদ। কুন্তলা সব্যমাচীকে ব্যাণ্ডেস বদলে দিতে এসেছে। সব্যসাচী আজও জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন। তার কপালে জলপট্টি লাগানো।

কুন্তলা প্রথমে জলপট্টিটা ভিজিয়ে দিল। তারপর ব্যাণ্ডেজটা খুলতে লাগলো। পুঁজ ও রক্তে ব্যাণ্ডেজটা নোংরা হয়ে গেছে।

গরম জল দিয়ে ঘষে ঘষে তুলোটা পরিষ্কার করার সময় সব্যসাচী যন্ত্রণায় চোখ মেলে তাকায়। চোখের সামনে সে দেখে একটি যুবতীর মুখ, তবু সে অস্ফুট গলায়, বলে, অরিন্দম অরিন্দম।

কে?

কুন্তলা বললো, অরিন্দম নিচে আছে। ডাকবো।

-হ্যাঁ ডাকো।

-আচ্ছা এই জায়গাটা আগে পরিষ্কার করে দিই।

-সব্যসাচী আবার ভালো করে চোখ মেলে মেয়েটিকে দেখে। তারপর জিজ্ঞেস করে, তুমি

-আমার নাম কুন্তলা। কালকে যে আমার সঙ্গে কথা বললেন?

-কালকে? কালকে আমি কোথায় ছিলাম?

– এখানেই তো।

-এখানে মানে? এটা কোন জায়গা?

-এটা আমাদের বাড়ি।

-আমাদের মানে কাদের?

কুন্তলা একটু হেসে বললো, এই সব কথাই কিন্তু কালকে বলেছি। আপনার একটুও মনে পড়ছে না?

-তুমি অরিন্দমকে ডাকো। লক্ষ্মী মেয়ে, কথা শোনো তো।

কুন্তলা উঠে গিয়ে অরিন্দমকে ডেকে নিয়ে এলো। অরিন্দমের মুখখানা দারুন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এখন সেই ভাবটা গোপন করে বললো, কি রে আজ কেমন আছিস?

সব্যসাচী বললো, অরিন্দম, আমরা এখানে কি করছি? আমাদের তো এখনো অনেক কাজ বাকী আছে।

অরিন্দম একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো, তা তো অনেক কিছুই বাকী আছ। তুই যে উঠতে পারছিস না!

-আমি ভালো হয়ে গেছি। আমি ঠিক যেতে পারবো।

-তোর গায়ে এখনো একশো চার ডিগ্রী জ্বর।

– ওতে কিছু হবে না। আমি খালি গায়ে কেন? আমার শাটটা কোথায়?

সব্যসাচী উঠতে যাচ্ছিল, কুন্তলা তাকে এক ধমক দিয়ে বললো, কি করছেন কি?

চুপ করে শুয়ে থাকুন তো!

সব্যসাচী অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে বললো, এই মেয়েটি কে রে? এ আমার সব সময় ব্যথা লাগিয়ে দেয়? আঃ।

অরিন্দম বললো, ব্যথা লাগিয়ে দেয় কি রে? ওই তো তোকে বাঁচিয়ে তুলছে।

কুন্তলা বললো, আমি আপনাকে ব্যথা লাগিয়ে দিই? ঠিক আছে, আরো বেশী করে ব্যথা লাগবো। এইবার?

কুন্তলা শক্ত করে ব্যাণ্ডেজের বাঁধন দিতে সব্যসাচী যন্ত্রণায় আ-আ করে উঠলো। তারপর বললো, আমাকে কি মেরে ফেলতে চাও।

-তাহলে যে বললেন, আপনি সব কিছু করতে পারবেন এখন?

সবসাচী তার সুস্থ হাতখানা উচুতে তুলে ধরলো। তারপর বললো, একটা হাত তো ঠিকই আছে। এক হাতে আমি অনেক কিছু করতে পারি। এই জ্বরটা এলো কোথা থেকে?

-তোর আঘাতটা বড্ড বেকায়দায় লেগেছিল।

-আমাকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যেতে হবে।

-সেই চেষ্টাই তো হচ্ছে।

-অরিন্দম তুই আমার ওপর রাগ করিস নি তো?

-না, না।

সব্যসাচী কুন্তলাকে বললো, আমাকে একটু ধরো তো ভাই!

-কে? আবার কি করতে চান?

-গদিওয়ালা খাটে শুয়ে থেকে মেয়েলি হাতের সেবা ভোগ করবো, এই ভাগ্য নিয়ে তা আমরা জন্মাই নি!

-আপনি বড্ড বড় বড় কথা বলেন।

সব্যসাচী একটু চুপ করে গেল। দুঃখিতভাবে তাকালো অরিন্দমের দিকে। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, অরিন্দম, আমি নিজেকে খুব অপরাধী বোধ করছি। তোর দিদি-জামাইবাবুর ঘাড়ে চেপে থাকার ইচ্ছে আমার একটুকুও নেই।

অরিন্দম শুকনোভাবে বললো, তা আর কি করা যাবে। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট।

-আর কারুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?

-না। এখানে বেরোই নি।

-রতনলালের কাছে যে করেই হোক একটা খবর পাঠাতেই হবে।

-দেখি।

তারপর দুই বন্ধু মুখোমুখি চেয়ে বসে রইলো। ওরা অনেক কথা ভাবলো। ট্রেন ডাকাতির জন্য একটু যেন অপরাধ বোধ জেগেছে মনে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, চুরি-ডাকাতিকে এখনো, কোনো শুভ উদ্দেশ্যের জন্য হলেও-মন থেকে সমর্থন করতে পারে না। বোমা-পিস্তল নিয়ে মানুষ খুন করার একটা যুক্তি পেয়ে গেছে অবশ্য গীতা থেকে অর্জুনাকে কৃষন যে সব বাছা-বাছা যুক্তি শুনিয়েছিলেন।

ডাকাতির টাকায় ওর ভেবেছিল কিছু ডিনামাইট কিনবে। সেগুলো পাঠাতে হবে পাঞ্জাবে। পাঞ্জাবের বিপ্লবীরা অনেক আশা করে আছে। পাঞ্জাবে পুলিশ এখন নৃশংস অত্যাচার চালাচ্ছে। এর একটা পাল্টা জবাব না দিতে পারলে সাধারণ মানুষের মনোবল একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতেই হবে কয়েকজনকে।

কিন্তু কিছুই করা যাবে না। টাকার বান্ডিল বালিশের তলায় রেখে শুয়ে আছে সব্যসাচী। অপরের টাকা ডাকাতির টাকা। ভাবলেই একটু গা ঘিনঘিন করে।

অরিন্দমের জামাইবাবু রমেশ মিত্র ট্যুর থেকে ফিরলেন পরের দিন। অরিন্দমকে দেখে তিনি একটু বিব্রত বোধ করে। তিনি শান্তি প্রিয় মানুষ। সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার গন্ডগোলের মধ্যে যেতে চান না। মাথা গরম ছেলে -ছোকরারা পুঁচকে পুঁচকে অস্ত্র নিয়ে মহাশক্তিশালী ইংরেজকে তাড়াবার স্বপ্ন দেখছে। কিস্যু হবে না। শুধু নিজেরা মরবে আর -মাকে জ্বালাবে।

শ্যালক হচ্ছে বড় টুকুম, সে বাড়িতে এলে যত্নটুত করতেই হয়। তাকে তো আসতে বারণ করা যায় না। কিন্তু হঠাৎ এই সময় এসে উপস্থিত হয়েছে কেন, কে জানে। ওর সঙ্গে রাজনীতির যোগ আছে তিনি জানেন।

অরিন্দমের জামাইবাবুকে সব্যসাচীর কথা জানানোই হলো না।

অরিন্দম তাকে বললো, জামাইবাবু আমি এসেছি চাকরির সন্ধানে। একটা চাকরিবাকরি না পেলে আর চলছে না। যতদিন না পাচ্ছি, ততদিন দিদির বাড়িতে থেকে অনু-ধ্বংসে করবো ঠিক করেছি।

রমেশ হেসে বললেন, কেন, তোমার দেশোদ্ধারের কাজ কি হলো?

-এখন একটু থেমে আছে। খেয়ে দেয়ে কিছু একটু গায়ের জোর করে নিই, তারপর আবার দেখা যাবে।

-ইংরেজদের সঙ্গে গায়ের জোরে পারবে?

-না পারি, যুযুৎসুর প্যাঁ মারবো। তাতে অনেক পালোয়ানও ধরাশায়ী হয়ে যায়।

-কিন্তু ব্রাদার, এসব মতলব থাকলে তো চাকর করা যায় না। কে তোমাকে চাকুরি দেবে বলো!

-আপনার তো অনেকগুলো ব্যবসা। একটা কোথাও ঢুকিয়ে দিন না।

রমেশ সরকারী চাকুরে হলেও সেই সূত্র ধরেই কয়েকরকম সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করেন অন্য নামে। দু’হাতে টাকার রোজগার করছেন, তাই নিয়েই মনের খুশীতে আছেন।

রমেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, নিজের আত্মীয়-টুকুম্বের মধ্যে কারুকে চাকরি দেওয়া পছন্দ করি না। সেটা ভালো দেখায় না। তার চেয়ে এখানে থাক না যতদিন ইচ্ছে।

রমেশের ঘর দোতলায়। সন্ধেবেলা তিনি একটু মদ্য পান করেন। লুকিয়ে করতেই ভালোবাসেন! নিজের স্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না।

এবং কাজটা তিনি

জানলার ধারে তিনি একটা গেলাস নিয়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ মাথার ওপরে, ছাদে কি একটা শব্দ পেলেন।

স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসের শব্দ হলো?

-কোথায় আবার শব্দ? আমি তো শুনি নি?

ছাদের ঘরে চেয়ারে টানার শব্দ হল না?

-তাই বলো, ও ঘরে তো অরু থাকে।

-অরিন্দম? তাকে যে দেখলাম, এইমাত্র রাস্তায় গেল।

-ফিরে এসেছে বোধ হয়।

-ফিরে এসেছে কি? এই তো গেল। চোরটোর নয় তো!

-এই সন্ধেবেলা চোর আসবে কোথায় থেকে?

রমেশ তাঁর ব্যবসার টাকা পয়সা বাড়িতে সিন্দুকেই রাখেন। অফিসে করুকে বিশ্বাস করেন না, ব্যাঙ্কে রাখারও অসুবিধে আছে। সব সময় সেই জন্যেই তার চোরের ভয়। তিনি বললেন, একবার দেখতে হচ্ছে।

-তুমি বসে আছো, বসো না। আমি দেখছি।

-না, চলো। আমি যাই।

রমেশ ঘর থেকে বেরুতেই তার স্ত্রী চেঁচিয়ে বললেন, ও কুন্তলা, কুন্তলা? ছাদের সিঁড়িতে আলো জ্বালা আছে?

এটা একটা ইশারার কথা! কুন্তলার ঘর সিঁড়ির পাশেই। সে বৌদির কথা শুনেই তরতর করে উঠে গেল ওপরে। কোনো সাড়া দিল না।

সব্যসাচী তখন বিছানা থেকে নামবার চেষ্টা করছিল। কুন্তলা ঘরে ঢুকে তাকে চেপে শুইয়া দিল খাটে। ঠোটে আঙুল দিয়ে বললো, চুপ? একটাও শব্দ করবেন না।

তারপর মরা মানুষকে যেমন ঢাকে, সেই রকম একটা কম্বল দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দিল তাকে।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে কুন্তলা দাঁড়িয়ে রইলো। উত্তেজনায় তার মুখখানা লালচে। রমেশ এসে দরজা ধাক্কাতেই কুন্তলা বলে উঠলো, কে?

রমেশ জিজ্ঞেস করলেন, কে রে, ভেতরে? কুন্তলা নাকি?

-হ্যাঁ, দাদা। আমি!

-তুই এখানে কি করছিস?

কুন্তলা দরজা খুললো, ভেতরটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে বললো, এখানে বসে একটু পড়াশুনা করছি

রমেশ ভুরু কুঁচকে বললেন, অরিন্দম এখানে শোয়। আর তুই এখানে পড়াশুনা করছিস মানে? বাড়িতে আর জায়গা নেই?

-অরিন্দমদা বেরিয়ে গেলেন, তাই আমি একটু এলাম। এখানে খুব হাওয়া।

– আজ আবার গরমটা কোথায়?

কুন্তলা বেরিয়ে হেসে বললো, দাদা, তুমি রেগে গেছো মনে হচ্ছে? আমি এখানে পড়তে বসেছি তো কি হয়েছে?

রমেশ একটু থতমত খেয়ে গেলেন। তাঁর এই বোনটি বড় আদরের। সকলের মুখের ওপর টকাস টকাস করে কথা বলে। রমেশের বাবা-মা তীর্থ করতে গেছেন, কুন্তলা সঙেগ যায় নি, পরীক্ষার পড়া পড়বে বলে।

রমেশ অবিবাহিত ছেলে মেয়েদের মেলামেলা বেশি পছন্দ করেন না। অরিন্দমের সঙ্গে কুন্তলা হাসিঠাট্টা করে- এটা খুব একটা ভালো নয়। মুখে কিছু বলতে পারেন না যদিও। কুন্তলা মেয়ে অবশ্য খুবই ভালো, তার চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ করা যায় না। তবু, বলা তো যায় না, (ঘি আগুন এত কাছাকাছি থাকা)-অরন্দিমের সঙ্গে কুন্তলার বিয়ে দিয়ে কেমন হয়? তাতে যদি ছেলেটার মতিগতি ফেরে-তাহলে না হয় একটা চাকরি-বাকরির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আর যদি ঘরজামাই হয়ে-থাকতে চায়, আপত্তি নেই।

এই সব ভাবতে ভাবতে রমেশ নিচে নেমে এলেন।

কুন্তলা সিঁড়িতে উঁকি দিয়ে দাদার নিচে যাওয়া দেখে নিশ্চিত হয়ে আবার ঘরে ঢুকলো। কম্বলটা সরিয়ে ফেলে জিজ্ঞেস করলো, খুব কষ্ট হচ্ছিল?

সব্যসাচী প্রথমে কিছুক্ষণ কোনো কথা বললো না। তারপর নিজের চেষ্টাতেই উঠে বসলো। বললো, দ্যাখো তো, অরিন্দম কোথায় সিগারেট রেখে গেছে। অনেকদিন সিগারেট খাই নি।

টেবিলের ড্রয়ার থেকে পাওয়া গেল সিগারেট আর দেশলাই। বাড়িয়ে দিল সব্যসাচীর দিকে।

সব্যসাচীর একটা হাত আশক্ত। দেশলাই জ্বালাবার ক্ষমতা নেই। সে কিছু বললো না, কুন্তলা বুঝতে পারলো। কুন্তলা ওর ঠোটে সিগারেট গুঁজে দিয়ে দেশলাই জ্বেলে বললো, এই নিন!

সব্যসাচী সিগারেট ভালো করে টান দিয়ে বললো, শোন কুন্তলা তুমি আমাদের জন্যে এত করছো কেন?

-কি করছি?

-এই যে আমার সেবাযত্ন করছো, এর ফল জানো? পুলিশ আমাকে ধরার পর তোমাকেও ধরবে।

– ধরুক!

-জেলে যেতে চাও তুমি? ভাবছো জেলটা খুব রোমান্টিক জায়গা? অনেক পাগল হয়ে যায়। যাই হোক তোমাদের ওপর নির্ভর করে আছি বলে আমার নিজের ওপর ঘেন্না আর লজ্জা হচ্ছে।

-লোকের কি অসুখ করে না?

-আমার করে না। সাত বছর বয়সের পর আমি অর কোনো অসুখে শুয়ে থাকি নি। তাছাড়া মেয়েদের হাতের সেবা নেওয়া আমার পছন্দ হয় না।

-আমি মেয়ে না হয়ে কোনো ছেলে হলে এমন কি তফাত হতো?

-অনেক তফাত হতো। মেয়েদের সংসর্গ আমাদের এড়িয়ে থাকা উচিত। এতে আমাদের ব্রত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

-আপনি মেয়েদের ভয় পান?

-নিজেকের ভয় পাই। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, আশা করি তুমি সব বুঝবে তাই তোমাকে খোলাখুলি বলছি। আমাদের রক্ত-মাংসের শরীর। এই শরীরে কি কামনা বাসনা নেই? সবই আছে। ব্রত পালনের জন্যে সেসব দমন করে থাকতে হয়। নির্জন ঘরে তোমার মতন সুন্দরী মেয়ে এত কাছাকাছি থাকলে আমাদের সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে।

কুন্তল ঠোঁট টিপে হেসে বললো, আমি সুন্দরী বুঝি?

-কেন, তুমি আয়না দেখো না? সুন্দরের প্রতি আমার একটা মোহ আছে। এক সময় আমি কবিতা-টবিতা লিখতাম এখন সেসব ঘুচিয়ে দিয়েছি। তবু মাঝে মাঝে মন দুর্বল হয়ে যায়। তাছাড়া অরিন্দমের বোধ হয় তোমার সম্বন্ধে –

কুন্তলা সব্যসাচীকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আপনি তো অনেক কথা বললেন, এবার আমি কিছু বলি? আপনি মেয়েদের সম্পর্কে কি ভাবেন জানি না। মেয়েদের সঙ্গে পুরুষদের বঝি শুরু কামন বাসনার সম্পর্ক? আপনারা দেশের জন্য চিন্তা করতে পারেন, কোনো মেয়ে বুঝি তা পারে না?

-তেমন তো দেখি না বিশেষ। আমাদেরই দলের অনেক ছেলে মেয়েদের জন্য নষ্ট হয়ে গেল। শুধু বিয়ে করার জন্যে পুলিশের ইন-ফর্মারও হয়েছে কেউ কেউ।

কুন্তলা বললো, আমার কথাটা এখনো শেষ হয়নি। আমি দেখছি, ছেলেদের মধ্যেও অনেকে দেশের কথা ভাবে না। খায়-দায়, ফুর্তি করে কিংবা শুধু নিজের জীবনের কথা ভাবে। সেই জন্যই যখন শুনি কেউ কেউ নিজের ঘর সুখসম্ভোগ ছেড়ে দেশের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়েছে- তখন তাদের ওপর আমার খুব শ্রদ্ধা হয়। তাদের যদি কখনো সামান্য সাহায্য করতে পারি, তাহলে নিজেদের ধন্য মনে করবো। সে রকম কারুকে তো আগে কাছ থেকে দেখিনি, আপনাদেরই প্রথম দেখলাম। কিন্তু আপনারও যদি সাধারণ প্রেম ভালোবাসার কথা বলেন কিংবা ন্যাকামি করতে আসেন, তাহলে আমি খুব দুঃখ পাবো। শুধু দুঃখ পাবো না, দরকার হলে আপনাদের মুখে থুতু ছিটিয়ে দেবো।

সব্যসাচী স্নান গলায় বললো, তাহলে তুমি আমার মুখে থুতু দাও। আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। শুধু যে আমার শরীরটাই এখন দুর্বল তা-ই নয়, আমার মনটাও দুর্বল এখন। তুমি যখন আমার ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দাও কিংবা আমার গায়ে তোমার হাতের ছোঁয়া লাগে আমি ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠি!

ছি!

কুন্তলা এত কঠোর হয়ো না। কঠোর হওয়া মেয়েদের মানায় না। আমি তো এই কথাটা স্বীকার না করলেও পারতাম। কিন্তু নিজের দুর্বলতা আমি গোপন রাখতে চাই না। তুমি কেন আমাকে এভাবে নষ্ট করে দিচ্ছো?

-প্লিজ এরকম করে বলবেন না। মেয়ে হওয়া কি আমার অপরাধ?

-অপরাধ কি না, ঠিক তা জানি না। তুমি আর এ ঘরে এদম এসো না। আমার বাণ্ডেজ- ফ্যাণ্ডেজ যা বদলবার তা অরিন্দমই করে দেবে। এভাবে বেশী দিন থাকারও কোনো মানে হয় না।

-আপনার ইয়েটার জন্য একজন ডাক্তার বিশেষ দরকার।

-মনে হচ্ছে, আমার হাতটা পচে যাচ্ছে। বোধ হয় হাতটা কেটে বাদ দিতে হবে।

কুন্তলা মুখ দিয়ে একটা ভয়ের শব্দ করলো।

সব্যসাচী বললো, মৃত্যুর সঙ্গে আমাদের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছে। আজ হোক কাল হোক, আমাকে মরতেই হবে। রাসবিহারী বোস ছাড়াও এ পর্যন্ত ভারতবর্ষের কোনো বিপ্লবই বৃটিশ পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পায় নি। দেশের কাজ বলতে তোমার মনে নিশ্চয়ই একটা আবছা ধারণা আছে। আমরা কি করেছি, তা কি তুমি জানো? আমরা একটা রেল-ডাকাতি করতে গিয়েছিলাম-সেখানে একজন বা দু’জন লোককে আমরা মেরে ফেলেছি। ফাঁসির দড়ি আমার মাথার ওপর ঝুলছে।

কুন্তলা এগিয়ে এসে ব্যাকুলভাবে বললো, মৃত্যুর কথা বলবেন না। আপনাকে বাঁচতে হবে। সব ছুড়ে সন্নাসী হয়ে গেলে হয়তো বাঁচা যায়। কিন্তু আমার ধর্মবিশ্বাস নেই। বিবেককে ফাঁকি দিয়ে আমি বাঁচতে চাই না। তবে, মরার আগে একটা প্রচন্ড লড়াই দিয়ে যেতে চাই। তাও যদি না পারি, তাহলে আমার দুঃখের শেষ থাকবে না।

– সেই জন্যও তো আপনার সেরে ওঠার দরকার। আমি কি এইটুকু সাহায করতেও পারি না?

সব্যসাচী বললো, তোমার হাতটা আমার কপালে একবার রাখো।

কুন্তলা বিনা দ্বিধায় তার ডান হাতটা ছোঁয়ালো সব্যসাচীর কপালে। সব্যসাচী তার ওপর নিজের সুস্থ হাতটা রাখলো। বললো, আঃ কি নরম আর ঠাণ্ডা তোমার হাতা। কপালটা জুড়িয়ে যায়। এই রকম সময় মনে হয় কি জানো, কি হবে যুদ্ধ বিগ্রহ করে। বাইরে ছোটাছুটি করাই বা কি দরকার। এই রকম একটা জায়গায় সারাজীবন শুয়ে থাকি, তোমার হাতটা আমাকে ছুঁয়ে থাকুক।

মাথাটা সরিয়ে সব্যসাচী হঠাৎ আবার রুক্ষভাবে বললো, এই জন্যই বলছিলাম, তোমার আর এ ঘরে আসবার দরকার নেই। কক্ষনো আর আমার সমানে আসবে না।

কুন্তলাও দীপ্তভাবে জবাব দিল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসবো। যতদিন না আপনি সেরে ওঠেন, আমি আপনার সেবা করবো। তারপর আপনি সুস্থ হয়ে উঠলে, জোর করে আপনাকে পাঠিয়ে দেবো যুদ্ধে। তখন আর আমার দেখা পাবেন না।

রমেশ নিচে নিজের ঘরে ফিরে মদের পাত্রটি নিয়ে বসে নানা কথা ভাবছিলেন। ভাবতে ভাবতে তার চৈতন্য উদয় হলো।তিনি এবার স্ত্রীকে কিছু না বলে সোজা উঠে এলেন ওপরে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।

কুন্তলা মেঝেতে বসে ছিল সব্যসাচীর খাটের পাশে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়লো। সব্যসাচী তার বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে চেপে ধরলো রিভলভারটা।

রমেশ জিজ্ঞেস করলেন, এ কে?

কুন্তলা সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করে বললো, দাদা, তুমি তো কখনো সন্ধেবেলায় ওপরে আসো না?  

– এ কে? জবাব দিচ্ছিস না কেন?

সব্যসাচী শান্তভাবে বললো, আপনি বসুন। আমিই সব বলছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *