॥ এক ॥
রাত প্রায় এগারোটা। দূর পাল্লার ট্রেনটি তখন রীতিমত জোরে ছুটছে। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে আর কোন স্টেশনে থামবে না। ফার্স্ট ক্লাসে-সেকেন্ড ক্লাস কামরাগুলোতে বেশির ভাগ আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে যাত্রীরা। থার্ড ক্লাস কামরায় আলো নেভে না, সেখানেও যাত্রীরা ঘুমে ঢুলছে। অনেকেই শোয়ার জায়গা পায় নি, এ ওর ঘাড়ে মাথা রেখেছে।
একটি কামরায় চার পাঁচ জন যুবক এক কোণে বসে তাস খেলছিল। সাধারণত তাস খেলার সময় খবু চেঁচামেচি হয়। যুবা বয়সের ছেলেরা অন্যদের সুবিধে অসুবিধে গ্রাহ্য করে না। কিন্তু এরা তাস খেলছে প্রায় নিঃশব্দে। ব্রীজ খেলা। ডাকার সময় এরা কথা বলছে মৃদু গলায়, তারপর আবার চুপচাপ। মাঝে মাঝেই এরা খেলা থামিয়ে তাকাচ্ছে। পরস্পরের চোখের দিকে, কিংবা ঘড়ি দেখেছে।
ট্রেনটির শেষ গার্ডের কামরার গার্ডবাবু বসে বসে একটা গল্পের বই পড়ছেন। তিনি পাঁচ কড়িদে’র লেখা গোয়ান্দা কাহিনী পড়তে খুব ভালোবাসেন।
ব্রেক ভ্যানে রাইফেলধারী রক্ষী মেঝেতে বসে আছে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। মাঝে মাঝে তার চোখ বুজে আসছে, আবার গা ঝাড়া দিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসছে।
ইঞ্জিনে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ড্রাইভার তার দু’জন সহকারীর সঙ্গে গল্প-গুজবে ব্যস্ত। তার প্যান্টের পকেট থেকে উঁকি মারছে একটা মদের বোতল। বোতলটির ভিতরের জিনিস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আর দু’এক চুমুক বাকি। সবাই জানে ইঞ্জিনের ড্রাইভার ফার্গুসন দু’তিন বোতল খেয়েও একটু টলে না।
এক সময় ট্রেনের গতি হঠাৎ মন্থর হয়ে এলো। কাছাকাছি কোনো স্টেশন নেই, এখানে ট্রেন থামার কথা নয়। দু’বার শোনা গেল তীব্র হুইশল
যে যুবকেরা তাস খেলছিল, তারা এক সঙ্গে হাতের তাসগুলো ফেলে দিল। চোখের ইশারা করে তারা উঠে পড়ে এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে। কামরার অধিকাংশ যাত্রীরা এখনো ঘুম ভাঙে নি।
দু’একজন ঘুম-কাতর চোখে জানালা দিয়ে তাকালো বাইরে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কোথাও একটু আলো বা মানুষজনের চিহ্ন নেই। অন্ধকার চোখে একটু সয়ে গেলে মনে হয় দূরে একটা বিল বা জলাশয় রয়েছে। আর একপাশে জঙ্গল। এখানে ট্রেন থামার মানে কি?
সে সময় দেখা গেল, ফিরিওয়ালা-হকাররা যেমন চলন্ত ট্রেনের এক কামড়া থেকে অন্য কামরায় যাতায়াত করে, সেই রকম কয়েকজন খাঁকি প্যান্ট-সাদা শার্ট পরা যুবক অবলীলাক্রমে চলাচল করতে শুরু করেছে। তাদের পায়ে কেডস্ জুতো।
ইঞ্জিনের দু’দিকের দরজা দিয়ে দু’জন যুবক ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তাদের হাতে লম্বা ধরনের পিস্তল। সেই পিস্তল উঁকিয়ে তারা ইংরেজিতে বলল, ট্রেনের গতি ধীর করে দাও, একেবারে থামবার দরকার নেই। আমার কথার অবাধ্য হয়ে আমাদের গুলি করতে বাধ্য করো না।
ইঞ্জিন ড্রাইভার ফার্গুসন বিরক্তভাবে বললো, এটা কি ছেলেখেলা হচ্ছে?
একজন যুবক তার কানের কাছে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে বললো, আর একটাও কথা শুনতে চাই না। যা বলছি কারো!
ড্রাইভারের সহকারী একজন ষোলো- সতেরো বছরের ছেলে।
সে হঠাৎ দু’বার বিপদ- সংকেত ধ্বনি বাজিয়ে দিল। তখন যুবক প্রচন্ড এক ঘুষি কষালো তার মুখে। ফান্ডসন আর বাক্যব্যয় না করে গতি কমাতে লাগলো গাড়ির। এক সময় সে থামিয়ে দিল ট্রেন।
পিস্তলধারি যুবকটি বললো, গাড়ি একেবারে থামাতে বারণ করলুম না?
ফার্গুসন বললো, তোমার চালাতে ইচ্ছে হয়, তুমি চালাও। আমি আর পারছি না! অন্য যুবকটি বললো, ঠিক আছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। কোনো রকম চালাকি করার চেষ্টা করো না!
গাড়ি থেমে যেতেই আট দশটা ছেলে টপাটপ্ নেমে দাঁড়ালো। তারা সবাই সশস্ত্র। যুবকেরা তিন চারটে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো ট্রেনের সামনে ও পিছনের দিকে। একটু দূরত্ব রেখে তারা পাহারা দেবার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়লো। এখনো তারা নিঃশব্দ।
গার্ডবাবুর হাত থেকে বইখানা খসে পড়ে গেছে। তিনিও তখনও বুঝতে পারছেন না যে তিনি স্বপ্ন দেখছেন না এটা সত্যি! সত্যিই তাঁর সামনে তিনজন ডাকাত দাঁড়িয়ে আছে? তিনি যে বইটা পড়ছিলেন, তাতেও হুবহু এরকম একটা ট্রেন ডাকাতির ঘটনা আছে। তাঁরা চাকরি হয়ে গেল চব্বিশ বছর -কখনো এরকম ঘটনা ঘটে নি।
গার্ডবাবু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমাকে প্রাণে মারবেন না, আমার অনেকগুলো ছেলেমেয়ে —-
অস্ত্রধারী যুবকদের মধ্যে যার বয়সে সবচেয়ে বেশী, অর্থাৎ তিরিশ বত্রিশ, মুখে গোঁফ, সে গম্ভীর গলায় বললো, আপনাকে প্রাণে মারার আমাদের একটুও ইচ্ছে নেই। আমরা যা বলছি শুনুন।
গার্ডবাবু হাত জোড় করে বললেন বলুন!
-ব্রেক ভ্যানে চলুন। আমাদের বাক্সগুলো চিনিয়ে দেবেন।
– কিসের বাক্স?
– যাতে সরকারি টাকা আছে।
– সে রকম তো কোনো বাক্স নেই। ইয়ে, মানে সব তো চিঠিপত্র আর মালপত্র।
-আপনার বউকে বিধ্বা করতে চান?
– কি বললেন?
গোঁফওয়ালা যুবকটি এবার প্রচন্ড ধমক দিয়ে বললো, কানেও শুনতে পাচ্ছেন না! আপনি আপনার বউকে বিধ্বা করতে চান? আমরা খুব ভালোভাবেই জানি এই ট্রেনে টাকা আসছে।
– আপনারা কে?
– ডাকাত! সেটুকুও বোঝার মতো ক্ষমতা নেই?
আর একজন যুবক বললো, শুনুন, আমরা–
গোঁফওয়ালা যুবকটি তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বললো, আপনি ডাকাত-সর্দার অযোধ্যা -সিং এর নাম শোনেন কি? আমরা সেই দলের লোক। আমাদের সর্দার ইঞ্জিন ঘরে আছে। ভালো চান তো চলুন?
-ওরে বাবারে, আমার পা কাঁপছে। আমি হাঁটতে পারছি না!
-আমরা আপনাকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি!
গোঁফওয়ালা যুবকটি আর একজনকে ইঙ্গিত করলো। সে অসুস্থ লোকটিকে হাঁটবার মতন ভঙ্গিতে গার্ডকে নিয়ে চললো।
খানিকটা দূর গিয়ে গার্ডবাবু হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। তার পরেই তিনি ডাকাতের হাত বাড়িয়ে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন।
গোঁফওয়ালা যুবকটি দৌড়ে এসে গার্ডবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে একটা লাথি মারার জন্য পা তুললেন।
গার্ডবাবু হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, আমাকে মেরো না! আমাকে মেরো না। আমি ব্ৰাহ্মণ!
– ব্রাহ্মণ তো হঠাৎ এরকম চতুষ্পদ হলেন কেন?
– আমার চাকরি যাবে। আমি ধনে-প্রাণে মারা যাবো।
যুবকটি গার্ডবাবুর ঘাড় ধরে টেনে তুলে ধমক দিয়ে বললে, তা হলে কি এক্ষুণি মরতে চান?
ব্রেক ভ্যানে সশস্ত্র প্রহরীটির হাত মুখ বাঁধা। তার রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে দু’জন যুবক তাকে পাহারা দিচ্ছে। গার্ড নিয়ে সদলবলে গোঁফওয়ালা যুবকটি ঢুকলো। সেখানে অনেকগুলো বাক্স ও নানা রকম প্যাকেট।
গোঁফওয়ালা যুবকটি গার্ডকে বললো, কোনটা কোনটা দেখিয়ে দিন।
– আমি জানি না, সত্যি জানি না।
– যুবকটি পিস্তল তুলে বললো, এক— দুই——
– মারবেন না, আমাকে মারবেন না।
-অযোগ্য সিং-এর দল কখনো বাজে সময় নষ্ট করে না!
– আমার চাকরি যাবে! আমি ধনে-প্রাণে মারা যাবো!
– ল আপনার চাকরি যাবে না। আপনারও হাত-মুখ বেঁধে রেখে যাবো আমরা।
– ঐ যে, ঐ বাক্সটা।
– চাবি কোথায়?
– চাবি আমার কাছে থাকে না। বিশ্বাস করুন।
দু’জন যুবক এসে দু’দিকে থেকে গার্ডবাবুকে চেপে ধরে তার কোট আর শার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। এক গোছা চাবি বেরুলো। কিন্তু কোনো চাবিই বাক্সটাতে লাগে না। যুবকরা তাড়াহুড়ো করে ঠিক মতন লাগাতে পারছে না।
– কোন্ চাবিটা? শিগগির বলুন।
– এর মধ্যে নেই। সত্যি নেই।
– ধুত্তোরি ছাই!
একজন বিরক্তিতে চাবিগুলো ফেলে দিল মেঝেতে।
অনেক যাত্রী তখনও ঘুমাচ্ছে। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখছে। কেউ কেউ অবশ্য ঘুম ভেঙে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে জানতে চাইছে ব্যাপারটা কি?
হঠাৎ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা পিস্তলের গুলির শব্দ শোনা গেল। তারপরই অনেকের ছোটাছুটির আওয়াজ।
ফাষ্ট ক্লাস বগির একটা কুপেতে এক ইংরেজ দম্পতি জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছিল। সাহেবটিরই আগে ঘুম ভাঙলো। স্ত্রীর আলিঙ্গন ছাড়িয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে আলো জ্বালালো, তারপর মুখ বাড়ালো জানালা দিয়ে।
মেমটি চোখ মেলে বললো, ডালিং আলো জ্বালালো কেন?
সাহেবটি বললো, সামথিং ইজ হ্যাপেনিং আউট-সাইড!
- আলো নিভিয়ে দাও! কেউ যদি জানালা দিয়ে দেখে?
মেমসাহেবটি একটি পাতলা কাপড়ের সেমিজ পরে আছে শুধু। তার ভেতর দিয়ে তার সর্বাঙ্গ পরিস্কার দেখা যায়। ভারতবর্ষের অসহ্য গরমের রাত- এ ছাড়া আর কি পোশাক পরা যায়।
মেমসাহেবটি ঘ্যানঘেনে গলায় বললো, আলো নিভিয়ে দাও! প্লিজ!
সাহেবটি বাইরের গোলমাল কিছুটা অনুভব করেছে। সে মুখ না ফিরিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, গেট ড্রেসড!
– হোয়াই?
সাহেবটি জানালা থেকে ফিরে এসে বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা বের করলো। তারপর বললো, মনে হচ্ছে হোল্ড আপ। গাড়িতে ডাকাত পড়েছে।
মেমসাহেবটি এতে বেশ আমোদ পেয়ে বললো, রিয়েলি? আই মাস্ট সী দেম? আমি কখনো ডাকাতি দেখি নি!
দু’জনেই জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। কয়েকটা ছায়ামূর্তি এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছিল। কাছাকাছি একজনকে দেখে সাহবেটি রাজকীয় মেজাজে জিজ্ঞেস করলো, হেই, হোয়াট্ হ্যাপিং দেয়ার?
একটা চ্যাংড়া মতন ছেলের গলায় উত্তর এলো, শাট আপ!
সাহেবটির মুখখানা লাল হয়ে গেল। সে স্ত্রীকে বললো, আমাকে নেমে দেখতে হচ্ছে।
মেম বললো খানা, এখান থেকে দেখো! তুমি তো এয়ার ফোর্সের স্টাফ, তুমি তো পুলিস নও!
আরও দুটি ছায়ামূর্তিকে দেখে সাহেবটি চমকে উঠে বললো, দে আর ক্যারিং গান্স!
-নেটিভরা এত গান্স পায় কি করে? রটন্ গভর্ণমেন্ট।
সাহেবটি বাইরের দুটি ছায়ামূর্তিকে চ্যালেঞ্জ করে বললো, স্টপ দেয়ার, হু আর ইউ?
আবার উত্তর এলো, শাট্ অ্যান্ড দা উউন্ডো।
সাহেবটি এবার আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না। গুলি চালালো। সঙ্গে সঙ্গে একটি যুবক মাটিতে পড়ে গেল আছড়ে। বিপরীত দিক থেকে পর পর দুটি গুলি ছুটে এলো ওদের দিকে।
মেমসাহেব ঠিক সময় মুখ সরিয়ে নিয়েছিল। একটা গুলি এসে লাগলো সাহেবটির মুঠো করে ধরা হাতে। পিস্তলটা খসে পড়ে গেল, রক্তে ভরে গেল হাত।
মেমসাহেব এক হ্যাঁচকা টানে স্বামীকে টেনে নিয়ে এলো ভেতরে। তারপর হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। ডাকাত দেখার শখ তার ঘুচে গেছে। নেটিভরা যখন তার স্বামীর দিকে গুলি চালাবার চেষ্টা করেছে। তখন ব্যাপার নিশ্চয়ই সাংঘাতিক। প্রাণের ভয়ে তার গলায় আওয়াজ বিশ্রী হয়ে গেল। ততক্ষণে বগির মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে। সাহেবের এক বন্ধু ধাক্কা দিচ্ছে তাদের কুপের দরজায়।
যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে গেছে সাহেবের। তবু দাঁতে দাঁত চেপে মেমসাহেবের প্রায় নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো, ড্যাম ইট! ইউ গেট ড্রেস্ড ফাস্ট! দেন ওপন দা ডোর!
এই সময় বাইরে থেকে কেউ একজন জোড়ালো গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, কেউ বাইরে বেরুবেন না। কেউ জানালা খুলবেন না! তাহলে কারোর কোন ভয় নেই।
সেকেন্ড ক্লাস কামরায় একজন নেপালী ভদ্রলোক ঘুম ভেঙে বসেছিলেন। লোকটি অসম- সাহসী। এক সময় বিলেতে ঘুর্খা রাইফেলসে ছিলেন, সদ্য রিটারার করেছেন। তিনি কামরায় অন্য লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দো, চারঠো ডাকু! আপলোগ মেরা সাথ আইয়ে!
কেউ কোনো সাড়া শব্দ করলো না। সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।
তিনি অবজ্ঞার সঙ্গে বিরক্তি মিশিয়ে বললেন, কয়েকটা ডাকু ভয় দেখাবে আর আমরা চুপ করে বসে থাকবো?
তাতেও কেউ কিছু না বলায় তিনি একাই উঠে দাঁড়ালেন।
বেল্ট সমেত সার্ভিস রিভলভার মাথায় কাছ স্যুটকেসের মধ্যে রাখা ছিল। সেটা দ্রুত বের করে নিয়ে তিনি কামরা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লেন নিচে।
কামরায় ভেতর থেকে কয়েকজন ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে বললেন, ও মশাই কি করছেন! শিগগির উঠে আসুন! ওদের কাছে বন্ধুক আছে।
নেপালী ভদ্রলোক মুখে একটা। অসম-সাহসীর মতন তিনি উন্নত মস্তকে এগিয়ে গেলে কয়েক পা।
কাছাকাছি কেউ নেই। ইঞ্জিনের কাছে কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, ডাকু পাকড়না চাইয়ে। মরদ কই হ্যায় তো-
তার কথা শেষ হলো না, খুব কাছে অন্ধকারে একজন দাঁড়িয়ে ছিল। অন্ধকারের মধ্যে সে এমনভাবে মিশেছিল যে নেপালী ভদ্রলোক ওকে দেখতে পায় নি। ওর পাশ দিয়েই তিনি হেঁটে এসেছেন। সে তৎক্ষণাৎ গুলি চালিয়ে নেপালী ভদ্রলোকের দেহ ফুঁড়ে দিল। তিনি কষ্ট না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন।
যে গুলি চালালো সে একটা রোগা পাতলা প্রায় বাচ্চা ছেলে!
বড় জোড় আঠারো- উনিশ বছর বয়েস, এক মাথা এলোমেলো চুল, বড় বড় টানা চোখ, ফর্সা রং। গুলি চালবার পর সে একটু পাগল-পাগল ব্যবহার করতে লাগল। কয়েক মুহূর্ত সে ভ্যাবচ্যাক খেয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। তারপরই নিজের হাতের পিস্তলটা ফেলে দিয়ে দৌড়ালো! কয়েক পা মাত্র গিয়েই ফিরে এলো আবার! নিচে হয়ে নেপালী ভদ্রলোকটিকে দেখলো সত্যি সত্যি মরে গেছে কিনা। এ আকস্মিক মৃত্যু সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। নেপালী ভদ্রলোকের মুখখানি খুব শান্ত, কোনো বিকৃতির চিহ্নমাত্র নেই। ঐ বাচ্চা ছেলেটি প্রথম গুলি চালিয়েই একজন লোককে মেরে ফেলেছে। হঠাৎ সে ভয় আর কান্না মেশানো একটা শব্দ করে উঠলো, তারপরই মুখ চেপে ধররো নিজের। এবার সে নিজের ও নেপালী নিজেরও নেপালী ভদ্রলোকটিকে রিভলভার দুটো কুড়িয়ে নিল মাটি থেকে। ততক্ষণে দূর থেকে তার কয়েকজন সঙ্গী ছুটে আসছে। দূর থেকে একজন জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে রে, সুকুমার?
এই রোগা-পাতলা ছেলেটি, যার নাম সুকুমার, সে কিন্তু দাড়ালো না। আবার দুটো রিভলভার ফেলে দিয়ে তীর বেগে ছুটে গেল সামনের অন্ধকার মাঠের দিকে।
বিরাট লম্বা চওড়া চেহারার ইঞ্জিন ড্রাইভার ফান্ডর্সন রীতিমতন ঘামছে। বাইরে থেকে যে গুলির শব্দ আসছে অতেও এখানকার পিস্তলধারী যুবক দুটির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা জায়গা ছেড়ে এক পাও নড়েনি।
ফার্গুসন আর তার দু’জন সহকারীকে মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কতক্ষণ এভাবে হাত তুলে রাখা যায়?
সে একটু নড়াচড়া করলেই যুবকরা তাকে ধমক দিচ্ছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তার। ওদের হাতে পিস্তল না থাকলে ওদের মাথা দুটো গুড়ো করে দিতে তার এক মিনিটও লাগতো না। চঞ্চল চোখে সে এদিক ও দিক তাকাতে লাগল। ট্রেনের ইওরোপীয়ান প্যাসেঞ্জাররা কি করছে, তারাও কি সব ভয় পেয়ে গেল?
ফার্গুসন তার পকেটের মদের বোতলটার দিকে ইঙ্গিত করে বললো, এক চুমুক খেতে পারি? এটা ছাড়া আমি থাকতে পারি না।
তার কানের কাছে যে যুবকটি পিস্তল ধরে ছিল, সে একটু হাসলো। তারপর বললো, আচ্ছা খাও!
ফার্গুসন পকেট থেকে বোতলটা বের করে ধরলো মুখের সামনে। একবারেই সে সবটুকু গলায় ঢেলে দিল।
তারপর সে একটা কান্ড করলো। খালি বোতলটা যেন বাইরে ফেলে দিতে যাচ্ছে এই ভঙ্গি করে সেটা দিয়ে জোরে আঘাত করতে গেল তার পাশের যুবকটির মাথায়।
ফার্গুসনের এক চুমুকে বোতল শেষ করার দৃশ্য দেখতে দেখতে যুবক দু’জনই একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিল। তাই আকস্মিক আঘাতের আগে তারা সাবধান হতে পারে নি।
ঠিক মতন লাগলে ঐ এক ঘাতেই কাজ হয়ে যেত। কিন্তু যুবকটি শেষ মুহূর্তে মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিল বলে আঘাতটা লাগলো গলা ঘেষে তার ঘাড়ে। সেখানে ভাঙা কাঁচ বসে গেল। সেই অবস্থাতেও সে পিস্তলটা হাতছাড়া করে নি- ফার্গুসন তার হাত থেকে সেটা কাড়তে যেতেই যে নিচু হয়ে বসে পড়ে গুলি করলো ওর পায়ে। গুলি লাগলো না। ফার্গুসন ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর ওপর।
অন্য যুবকটি তার সঙ্গীর গায়ে গুলি লাগতে পারে এই ভয়ে পিস্তল চালায় নি, এবার সে ঠিক মতন জায়গা নিয়ে বললো, সাবধান!
আহত যুবকটি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো, তার ঘাড়ের দু’দিক দিয়ে রক্ত পড়ছে আধখানা বোতল গেথে আছে সেখানে। সে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে দোস্ত ইংরেজিতে ফার্গুশনকে বললো, আই ফিল লাইক কিলিং ইউ রাইট অ্যাওয়ে। তোমাকে মারবার জন্য আমার হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু মারতে পারছি না। কারণ, এই ট্রেন তোমাকেই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
অন্য যুবকটি বললো, তবু ওর পা খোড়া করে দিতে আপত্তি কি? খোঁড়া লোকও তো ট্রেন চালাতে পারে।
আহত যুবকটি বললো, থাক তার দরকার নেই!
এই সময় বাইরে ঘন ঘন হুইশল বেজে উঠলো। সেই শব্দ শুনে যুবক দুটি চঞ্চল হয়ে উঠলো। কাজ শেষ হয়ে গেছে, এবার ওদের যেতে হবে।
পিস্তল বাগিয়ে ধরে ওরা চলে এলো দরজার দিকে। আহত যুবকটি লাফিয়ে পড়লো আগে। অন্য যুবকটি নামবার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফার্গুসনের মাথায় এক ঘা মারলো তার মাউজার পিস্তলের বাঁট দিয়ে। চেঁচিয়ে বললো, তোমার বেয়াদপির সামান্য শাস্তি। তারপর নেমে পড়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
জায়গা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা ছিল। পনর ষোল জন যুবক ছড়িয়ে ছড়িয়ে থেকে অন্ধকারের মধ্যে ছুটলো একই দিকে। কয়েকজন মিলে তিনটে বাক্স ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। একটু বাদে ট্রেনের কামরা থেকে কয়েকটা বন্ধুকের গুলি এলো এদিকে। কোনটাই ওদের গায়ে লাগলো না। ট্রেন থেকে নেমে এসেও ওদের তাড়া করার সাহস পেল না। তাছাড়া ওরা যাত্রীদের কারোর কাছ থেকেই কিছু লুট করে নি বলে অনেকেই কখনো বুঝতে পারে নি ডাকাতরা ঠিক কি জন্য এসেছিল।
মাঠ পেরিয়ে খানিকটা জলা জায়গা। তার ওপর দিয়ে ছপছপ করে দৌড়াচ্ছে। সেটা পেরিয়ে আসার পর শুরু হলো জঙ্গল।
ট্রেন থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে বলে ওরা কয়েজজন এবার চর্ট জ্বালালো বনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে মাইল দুয়েক দূরে একটা ফাঁকা মতন পরিষ্কার জায়গায় ওরা এসে থামলো।
এতক্ষণ একটানা দৌড়ে এসে ওরা সকলেই দারুণ হাঁপাচ্ছে। কয়েকজন ধপাস করে শুয়ে পড়লো মাটিতে।
মেঘলা মেঘলা আকাশ। নইলে আজ জ্যোৎস্না ওঠার কথা ছিল। তবু বনের গাছগুলোর মাথায় ক্ষীণ চাপা আলো ছড়িয়ে আছে। মাটিতে পড়েছে জাফরির মতন ছায়া।
গোঁফওয়ালা যুববটি সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, সবাই এসেছে?
তার পাশ থেকে একজন বললো, হ্যাঁ সব্বাই! আমাদের প্ল্যান দারুণ সাকসেসফুল! গোঁফওয়ালা যুবকটি বললো, তবু গুনে দেখা যাক। অরিন্দম গুণে দেখো তো!
অরিন্দম গোণা শেষ করার আগেই পেছনে থেকে একজন বললো, সুকুমারকে দেখছি না তো!
গুণেও দেখা গেল, একজনই মাত্র কম পড়ছে। এদের দলের মধ্যে সবচেয়ে যার বয়স কম, সেই সেখানে শুধু অনুপস্থিত।
যে যুবকটির কাঁধে কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল, সে তখন মাটিতে বসে। তার সঙ্গী কাঁচের টুকরো টেনে বার করার চেষ্টা করছে। সে বলে উঠলো, সুকুমার আসে নি? কোথায় গেল? ওর গায়ে গুলিটুলি লেগেছে?
আর একজন বললো, না সুকুমারকে আমি আগেই চলে আসতে দেখেছি।
– হলে সে কোথায় গেল?
-রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে নাকি?
আহত যুবকটি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে বললো, তাহলে সুকুমারকে এক্ষুণি একবার খুঁজে আসা দরকার।
যারা টাকা গুণছিল তারা শেষ করে বললো, রতনদা ভালোই পাওয়া গেছে। তিন লাখ তিরিশ হাজার!
অন্যরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।
রতনলাল ব্যস্ত হয়ে বললো,- এই এ কি ছেলেমানুষী করছো, চুপ করো।
চার পাঁচজন অস্ত্রধারী যুবকের হাতে টর্চ দিয়ে সে দাঁড় করিয়ে দিল একটু দূরে। ফিসফিস কর বললো, খুব সাবধানে লক্ষ্য রাখবি। খুব সামান্য একটু আওয়াজ হলেই চেঁচিয়ে উঠবি। কোনো রকম ভুল যেন না হয়।
তারপর সে অন্যদের নির্দেশ দিল, টাকাগুলো তিন ভাগ করে ফেল। এক ভাগ থাকবে আমার কাছে, রফিক আর সব্যসাচীর কাছে এক এক ভাগ। তার মানে প্রত্যেকের কাছে এক লাখ দশ হাজার টাকা। তোমরা সবাই সাক্ষী রইলে। এর প্রতিটি পাই হিসেব থাকবে। আজ থেকে এক মাস বাদে আমাদের সেই নির্দিষ্ট জায়গায় সবাই এসে জড়ো হবে। এর মধ্যে কেউ কারোর সঙ্গে দেখা করবে না। তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। এক্ষুণি যেতে হবে।
-বাক্স তিনটে কি হবে?
– এখানেই ফেলে রেখে যাও। এগুলো আর বয়ে নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ নেই। এই সময় বনের মধ্যে মানুষের পায়ের চরার খচখচ আওয়াজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে আলো নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়লো মাটিতে। তখন ফিসফিস করে বললে, আমিনা বললে, কেউ গুলি করবে না!
অন্ধকার চোখে সয়ে যাবার পর দেখা গেল, একজন মাত্র মানুষ মাতালের মতন টলতে টলতে এদিকে আসছে। পথভ্রষ্ট কোনো গ্রাম্য লোক হলে চুপচাপ থাকাই ভালো।
লোকটা যেন ঠিক মতন হাঁটতে পারছে না। মাঝে মাঝে পড়ে যাচ্ছে। বিড় বিড় করে কি
যেন বলছে আপন মনে। একবার সে চেঁচিয়ে উঠলো, রতনদা-
তৎক্ষণাৎ রতনলাল চর্ট জ্বেলে বললো, ঐ তো সুকুমার-
অরিন্দম দৌড়ে গিয়ে সুকুমারকে জড়িয়ে ধরে বললো কি হয়েছে? কোথায় লেগেছে? সুকুমারের চোখের দৃষ্টি ঘোর-লাগা। সে জড়ানো গলায় বললো, আমার কিচ্ছু হয় নি। আমি একজন লোককে মেরে ফেলেছি।
রতন এগিয়ে এসে বললো, তোর কোথাও লাগেনি তো?
সুকুমার বললো, না। আমি একটা গুলি ছুঁড় লাম, অমনি লোকটা মরে গেল। একজন
নেপালী ভদ্রলোক। মানুষের মরা কি এত সহজ! একটু ছটফট পর্যন্ত করলো না।
– সুকুমার ঠিক হয়ে নে।
-আমি একজন মানুষ মেরেছি। আপনারা তো কেউ মারেন নি।
রতনলাল বললো, না তুই মারিস নি। আমরা সবাই মিলে মেরেছি। তোমরা সবাই শুনে রাখো। আজকের অ্যাকশনে একজন মানুষ মারা গেছে। তাকে মারার জন্য বিশেষ একজন দায়ী নই, আমরা সবাই এক সঙ্গে দায়ী।
তারপর সে টাকার থলিটা কাঁধে ঝুলিয়ে বললো, আর এক মিনিট দেরি নয়। রফিক সুকুমারকে নিয়ে যাক। সব্যসাচীও এখন একা যেতে পারবে না, অরিন্দম তুমি যাও ওর সঙ্গে। আর সবাই আলাদা আলাদা।
অন্ধকারের মধ্যে আর খানিকটা হেঁটে যাবার পর একটা গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা। সেখানের আট দশখানা সাইকেল রাখা হয়েছে; একজন পাহারা দিচ্ছে সাইকেলগুলো। এরা চটপট ভাগাভাগি করে উঠে পড়লো সাইকেলগুলোতে।
রতনলালের সাইকেলের পেছনে উঠলো নিরঞ্জন। সে বললো, রতনদা, আপনি খানিকটা চালাবেন, বাকিটা আমি চালাবো।
-এখানে? ওখানে এখন ফিরে যাওয়া সম্ভব?
– আমি যাচ্ছি।
গোঁফওয়ালা যুবকটি বললো, সব্যসাচী, কি বলছো কি? তোমার কাঁধ দিয়ে অত রক্ত পড়ছে। তুমি এখন কোথায় যাবে?
-আমার কিছু হবে না। সুকুমারকে ফেলে রেখে আসতে পারি না আমরা। রতন, তুমি আমার সঙ্গে আর দু’জনকে দাও। আমরা চট করে একবারে ঘুরে আসবে।
গোঁফওয়ালা যুবকটির নাম রতনলাল। সে বললো, সব্যসাচী, একটু দাঁড়াও। সুকুমারকে খুঁজতে গিয়ে যদি সবাইকে ধরা পড়তে হয়- তাহলে আমাদের সব কষ্ট ব্যর্থ হবে। আগে চটচট কাজগুলো সেরে নেয়া যাক। আগে বাক্সগুলো ভাঙা হোক! আমরা চাবি পাই নি।
কয়েকজনের কাছে ভোজালি এবং ছোরা ছিল। সেইগুলো দিয়ে বাক্সের তালায় মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতে লাগলো। অবিলম্বে ভেঙে গেল সেগুলো। তখন দেখা গেল, তাদের ভুল হয় নি। বাক্সগুলোর মধ্যে থরে থরে টাকা সাজানো।
রতনলার বললো, টাকাগুলো এক্ষুণি ফেল!
অরিন্দম বললো, এখন গোনার দরকার কি? এখন সময় নষ্ট করে লাভ নেই। রতনলাল দৃঢ়ভাবে বললো, না এক্ষুনি শুনতে হবে। তিনজনে মিলে বসে যাও, চটপট।
কয়েকজন টাকা গুনতে বসেছে। রতনলাল তখন সব্যসাচীর কাছে এসে তার ক্ষতস্থানটা পরীক্ষা করে দেখলো। কাঁচের বড় টুকরোটা তুলে ফেলা হলেও ভেতরে আরও দু’টো ছোট টুকরো রয়ে গেছে। কিছুতেই রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছে না। সব্যসাচীর বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য। বোঝা যায় তার দারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে, কিন্তু মুখে সে একটু ও শব্দ করছে না।
রতনলালকে দেখে সে একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, এমন কিছু না।
রতনলাল বললো, হুঁ। আর কারোর কোথাও লেগেছে?
অরিন্দম বললো, কিছু না। এমন নিখুঁতভাবে সব হবে, আমি আশাই করি নি রফিকের একটা আঙ্গুল বোধ হয় গেছে।
অরিন্দমের পাশেই যে দাঁড়িয়ে ছিল, তার নাম রফিক আলম। প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা, টকটকে ফর্সা এবং মাথার চুলের রং লালচে, চোখের মণি নীলবর্ণ। সে তার বাঁ হাত টা চেপে ধরেছিল। এবার হাতটা তুলে বললো, না যায় নি শেষ পর্যন্ত। তবে, ব্যাটার ইচ্ছে ছিল আমার আঙুলটা খেয়ে ফেলার।
রতনলাল জিজ্ঞেস করলো,কি হয়েছিল?
রফিক বললো, আর্মড গার্ডটার হাত পা বাঁধার পরও চেঁচামেচি করতে যাচ্ছিল, তখন ভাবলাম ব্যাটার মুখটাও বেঁধে ফেলি। যেই বাঁধতে গেছি, ব্যাটা অমনি খ্যাক করে আমার একটা আঙ্গুল কামড়ে ধরলেন। ওরে বাপরে বাপ, ঠিক যেন কচ্ছপের কামড়। তখন ওর নাকটা চেপে ধরলাম খুব জোরে- তারপর ছাড়লো।
দেখা গেল রফিকের বা হাতের তর্জনী লাল হয়ে ফুটে উঠেছে। বড় বড় দাঁতের দাগ। রতনলাল বললো, মানুষের দাঁতের বিষ থাকে।
রফিক হাসতে হাসতে বললো, আমার শরীরেও বিষ আছে। বিষে বিষক্ষয় হয়ে যাবে। অরিন্দম বললো, একজন সাহেব জানলা দিয়ে গুলি ছুড়েছিল সেই গুলি সুকুমারের গায়ে লাগে নি তো?
আর একজন উত্তর দিল,না। গুলিটা আমার আর নিরঞ্জনের দিকে ছুঁড়েছিল, আমরা মাটিতে শুয়ে পড়েছিলাম। আমাদের গায়ে লাগে নি। নিরঞ্জন গুলি করে সাহেবটার হাত ভেঙ্গে দিয়েছে।
-আর কারুকে মারতে হয় নি তো?
– আর একজন লোককে নিচে মরে থাকতে দেখেছি। আমাদের দলের কেউ নয়। বোধ হয় সুকুমারই তাকে-
রতনলাল বললো, চল তো দেখা যাক। বোধ হয় তার দরকার হবে না। দেখাই যাক না। আমি টানা কুড়ি পঁচিশ মাইল চালাতে পারবো। তুই রাস্তার দিকে নজর রাখবি। কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ করলে কোন উত্তর না দিয়ে সোজা গুলি চালাবি!
-সুকুমার খুব শক পেয়েছে।
-বড্ড ছেলে মানুষ তো। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
-আমরা কোথায় যাবো? বাংলাদেশের বাইরে?
-না। এখন কোনো গ্রামে থাকতে হবে। তারপর কলকাতা। এটা জেনে রাখিস, কলকাতার মতন লুকোবার এত ভাল জায়গা আর কোথাও নেই।
-আমার কিন্তু মনে হয় বেনারস।
-তুই বেনারস যেতে পারিস। তবে আপাততঃ আসানসোলে গিয়ে তোকে আমি ছেড়ে দেবো। এখন দু’জনের এক সঙ্গেও থাকা উচিত নয়।
এতক্ষণ রাস্তা একেবারে ফাঁকা ছিল। এখন পাশে পাশে দু’একটা ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে! মাঝে মাঝে দু’একটা কুকুর ডেকে উঠছে ঘেউ ঘেউ করে।
নিরঞ্জন বললো, রতনদা, আপনি অযোধ্যা সিং-এর দলের নামটা করে খুব ভালো করেছেন। গার্ডবাবু নিশ্চয়ই পুলিশকে ঐ নামটা জানাবে। পুলিশ প্রথমে অযোধ্য সিংকেই খুঁজবে।
রতনলাল গম্ভীরভাবে বললো, পুলিশ অত বোকা নয়।
তারপর সে আরও জোরে সাইকেল চালাতে লাগলো।