বুকের মধ্যে আগুন – ৭

॥ সাত ॥

কান্নার শব্দে রফিকের ঘুম ভেঙে গেল। পাশ ফিরে দেখলো, সুকুমার শিশুর মতন ফোঁপাচ্ছে।

রফিক উঠে তার গায় ধাক্কা দিয়ে বললো, এই সুকুমার! এই!

সুকুমার সাড়া দিল না।

রফিক তাকে আরও দু’চার বার ধাক্কা দিয়ে বললো, তুই স্বপ্ন দেখছিস নাকি?

সুকুমার নিঃশব্দে উঠে কুঁজো থেকে এক গেলাস জল গড়িয়ে খেল। চোখ-টোখ মুছে অনুতপ্তভাবে বললো, শুধু তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম রফিকদা।

-দিলিই তো! দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছিলাম। দে, আমাকে এক গেলাস পানি দে। একটা সিগারেট খেলে কেমন হয়?

সুকুমার এসে আবার খাটে বসলো। রফিক তার কাঁধে হাত চেপে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলো, কি স্বপ্ন দেখলি? খারাপ স্বপ্ন? আমি তো স্বপ্নই দেখি না রে। কত সাধ্য সাধনা করি! স্বপ্ন দেখলে বেশ ভালো স্বপ্ন দেখতে হয়। সেই যে গান আছে না, খেয়াব দেখেছি আমি বাদশা বনেছি।’

সুকুমার চুপ।

রফিক তার মন ভোলবার চেষ্টা করছে হালকা কথা বলে। কিছুতেই সুকুমার মুখ খুলছে না দেখে আবার বললো, তোর কি মায়ের কথা মনে পড়েছিল বুঝি? তুইতো তোর মায়ের এক ছেলে তাই না? দ্যাখ, আমরা পাঁচ ভাই, চার বোন- আমার মায়ের একটা ছেলে গেলে এমন কিছু আঘাত লাগবে না, কিন্তু তোর মায়ের একটাই ছেলে।

সুকুমার বললো,আমার মায়ের তেত্রিশ কোটি ছেলে।

-ওসব কথা শুনতে ভালো, তা বলে নিজের মনকে কি ভোলানো যায়? মাকে স্বপ্ন দেখছিলি?

-না।

-তবে?

-একজন নেপালী ভদ্রলোককে। মনে হচ্ছিল, তিনি ঠিক আমার খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

– সে আবার কে?

সেদিন অ্যাকশানে যাকে তুমি আমি মেরেছি।

এবার রফিক একটু চুপ করে গেল। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিল কয়েকবার। তারপর বললো, তুই তো একা কারুকে মারিস নি? সব কাজে আমাদের সমান দায়িত্ব।

-তবু বুলেটটা আমার হাত থেকেই বেরিয়েছিল।

-সেই কথা ভেবে তুই কান্নাকাটি করছিস? এত দুর্বল হলে চলে না।

না, সে জন্য না। আমি দেখলাম ভদ্দরলোক এই খাটের পাশে এসে দাড়িয়েছেন, কপাল থেকে রক্ত ঝরছে-আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন আমাকে খুন করলে? আমি কি দোষ করছি?

– উনি আমাদের বাধা দিতে এসেছিলাম আমরা তো নিজেদের পরিচয় দিই নি। উনি আমাদের ভেবেছিলেন সাধারণ চোর-ডাকাত। কাপুষের মতন বসে না থেকে বাধা দিতে এসেছিলেন সাহস করে-

-সুকুমার, আমরা যা করতে চাইছি, সেটা মস্ত বড় কাজ। সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এরকম দু’একটা ঘটনা ঘটবেই।

-তবু একটা কথা ভেবেই আমার কান্না আসছিল। ভদ্রলোক হয়তো দেশে ফিরছিলেন। নেপালে হয়তো ওর স্ত্রী ছেলেমেয়ে আছে। ছেলেমেয়েরা আশা করে আছে বাবা কবে ফিরবেন, বাবা কি কি উপহার আনবেন, এই সব কিছু নষ্ট হয়ে গেল আমার জন্য-ওরা কেউ জানতেও পারলো না-

সুকুমারের চোখে আবার জল এসে যাচ্ছিল, রফিক তাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, এই কি হচ্ছে কি? এরকম কত লোক তো অ্যাকসিডেন্টে মরে। হঠ্যাৎ একটা ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে ও দুশো লোক মারা যায়- তাদেরও বাড়িতে বৌ-ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করে থাকে। এরকমভাবে চিন্তা করে লাভ নেই। একটা কথা শুধু মনে রাখবি, আমরা যা করছি তা নিজেদের কোনো স্বার্থের জন্য বা লাভের জন্য করছি না। ঐ নেপালী ভদ্রলোকটির বিরুদ্ধে তোর, বা আমার কোনো ব্যক্তিগত রাগ নেই, সুতরাং এ ব্যাপারে আমরা নির্লিপ্ত।

রফিকদা, তুমি গীতা পড়েছো নাকি?

-না রে, আমি গীতা বা কোরান কিছুই ঠিক মতন পড়িনি। সাধারণ বুদ্ধিতে যা মনে হয় তা বললাম।

আমি বোধ হয় তোমাদের সঙ্গে কাজ করার উপযুক্ত নই। আমার বাবা ডাক্তারি পড়তে গিয়েও ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রথম দিন মরা মানুষের গায়ে ছুরি চালাতে গিয়েই পড়ে গিয়েছিলেন অজ্ঞাত হয়ে। আমাদের বাড়ি সবাই দুর্বল। আমি মানুষের রক্ত দেখতে পারি না। রক্ত দেখলেই আমার মাথা ঝিমঝিম করে।

-আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

-কি জানি! আমার তো আর ফেরার ও উপায় নেই।

-তুই ফিরতে চাস?

-না তা ঠিক নয়।

ফিরতে চাইলে উপায় থাকবে না কেন? অনেকেই তো এক আধবার জেল খেটে এ লাইন ছেড়ে দেয়। পুরোনো কথা সবই ভুলে যায়। ঐ নেপালী ভদ্রলোককে মারার ব্যাপারে তোর নাম কোনদিন কেউ জানতে পারবে না।

– যদি না আমাদের মধ্যে কেউ রাজসাক্ষী হয়।

আমাদের দলে সেরকরম কেউ নেই। তুই আমার কথা শুনবি? আমার মতন লোকের পক্ষে এই সব ব্যাপারে জড়িয়ে পড়াটাই একটু অদ্ভূত মনে হয় না তোর?

– কেন?

-প্রথমতঃ আমি মুসলমানের ছেলে। কংগ্রেস থেকেই মুসলমানরা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। বিপ্লবী দলে তো তারা গোড়া থেকেই চায় নি। বিটিশ সরকারও এখন তোয়াজ করছে মুসলমানদের। আস্তে আস্তে দানা বাধঁছে মুসলীম লীগ। ব্রিটিশ সরকার চাইছে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দিতে, আমরাও সেই টোপ গিলে নিচ্ছি! স্বদেশী ছোকরা বলতো তো সাধারণ লোক হিন্দুর ছেলেদের বোঝে, তাই না? আমার ব্যাপারটা অবশ্য অন্য ছিল। আমি রাজনীতি-ফিরি নিয়ে মাথাই ঘামাতাম না। বাড়িতে টাকা পয়সার অভাব নেই, ফুর্তি-টুর্তি করে জীবন কাটাতাম- একটা হালকা অর্থহীন জীবন ছিল। তারপর সব্যসাচীর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর যখন সব কথা শুনলাম, এই দেশ ও দেশের মানুষকে চিনতে শিখলাম, আস্তে আস্তে কাজ শুরু করলাম, তখন বুঝলাম, এই জীবনে একটা অন্য রকম মানে আছে। এখন আমি সত্যিকারের আনন্দের মধ্যে আছি। মানুষের জন্য, পৃথিবীর জন্য কোনো কাজ করছি- এর ফলে বেঁচে থাকাটা ধন্য হয়ে গেল।

-কিন্তু রফিকদা, এইভাবে সত্যি কি কাজ করতে পারবো?

-সুকুমার,,মনের মধ্যে সন্দেহ রাখতে নেই। আমাদের যার যতখানি সাধ্য কাজ করে যাবো। কিছু না কিছু ফল তাতে হবেই। যেন আর বক্ করে লাভ নেই। ঘুমোতে হবে না?

রফিক সিগারেট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। সুকুমারকে বললো, ফের যদি বাচ্চা ছেলের মতন কাঁদিতে দেখি, তা হলে গাঁট্টা খাবি কিন্তু আমার কাছে!

পরদিন সকালে রফিকেরই আগে ঘুম ভাঙলো। সুকুমারকে না জাগিয়ে সে উঠে বাইরে চলে এলো।

মুখ ধুতে ধুতে সে গেল রান্নাঘরে করিম যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। এত ভোরে আবার কে এলো? করিম কি নিজের মনে মনেই বক্ করে নাকি?

রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখলো করিম টোস্ট সেঁকেছে আর তিশনা একটু টুলে বসে পা দোলাতে দোলাতে চাকুস চাকুস করে কি যেন খাচ্ছে।

-এই তুমি এত ভোরেই এখানে চলে এসেছো?

তিশনা চমকে উঠলো। হাতের বিস্কুটগুলো সব মুখে ভরে দিয়ে এক সঙ্গে চিবোতে গিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তারপর ঢোক গিলে বললো, ভোর কোথায়? এখন তো সাড়ে সাতটা।

-হলোই বা সাড়ে সাতটা। ঘরের কাজকর্ম কি নেই?

-আমি করিম চাচার কাছ থেকে চা খেতে এসেছি। আমাদের ঘরে তো চা হয় না।

-করিম ভাইয়ের সঙ্গে খুব ভাব দেখছি। প্রত্যেক দিন আমার ঘরের চা বিস্কুট খেয়ে যাওয়া হয়।

করিম এক গাল হেসে বললো, তার বদলে এই বেটি আমাকে ঘি মাখন এনে দেয়। তিশনার বাবার ঘি-মাখনের ব্যবসা। ইদানিং অবস্থা বেশ ভালো হচ্ছে।

রফিক বললো, বাঃ চমৎকার ব্যবস্থা দেখছি। একজন মালিকের চা-বিস্কুট অন্যকে দান- খায়রাত করেছে, আর একজন নিজের ঘর থেকে ঘি-মাখন চুরি করছে! দাঁড়াও তোমার দাদিকে বলে দেবো!

-দাদি এখন কানেই শুনতে পায় না।

করিম চা ভিজিয়েছে। ছাকবার আগে সে জিজ্ঞেস করলো, তোমার দোস্তকে ডাকবে না?

-না ও পরে নাস্তা করবে। এখন একটু ঘুমোক।

-তুমি বসো, আমি তোমারটা দিয়ে দিই।

রফিক খাবার টেবিলে গিয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসলো। নানান খবরের পুলিশের ধরপাকড়ের বিবরণ কিন্তু তাদের দলের একজনেরও নাম কোথাও নেই। আসানসোল আর বর্ধমানের দুটো ঘটনা দিয়ে ক’দিন ধরে খুব লেখালেখি হচ্ছে।

টেবিলের চায়ের কাপ রাখার শব্দ হতেই রফিক সে দিকে না তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে কাপটা নিয়ে এসে অন্যমনস্কভাবে চুমুক দিল। তারপর আবার একটা শব্দ হতে সে চোখ তুলে তাকালো। দেখলো আন্ডার পোচ সমেত প্লেট হাতে নিয়ে তিশনা দাঁড়িয়ে আছে। তিশনা জিজ্ঞেস করলো,আগেই চা খেতে শুরু করলেন? আন্ডা খাবেন না?

-তুমি এসব আনলে কেন? করীম কোথায়?

– কেন, আমার হাতের খাবার আপনি খাবেন না?

-ঠিক আছে, রাখো।

-রফিকভাই, আপনার মনটা সব সময় কোথায় থাকে?

রকিফ এবার কাগজটা সরিয়ে রেখে হাসলো। তারপর বললো, তোমাকে আমাদের এখানে বেশি আসতে বারণ করেছি না?

-আপনি দিনে একবার আসতে বলেছেন, এই তো একবারই এসেছি।

-তা বলে এই সকালবেলা! তুমি লেখাপড়া করো না?

-করেছি তো! উঠেছি সেই কখন। তারপর এক ঘন্টা বই পড়লাম, তারপর তো চা খেতে এলাম!

-আমি যখন এখানে থাকি না, তখনও কি তুমি চা খেতে আসো।

-শোনো কথা! আপনি না থাকলে করীম চাচা চা বানাবে কার জন্যে? তখন তো চা হয়ই না।

-আমার চাচাজী যখন থাকেন?

-আপনার চাচাজীকে দেখলেই আমার ভয় হয়। ভীষণ গম্ভীর। আপনি বড্ড কম আসেন। আপনি ঘন ঘন আসেন না কেন?

-যাতে তুমি বেশি করে চা খেতে পাও?

-না, যাতে আপনাকে বেশী করে দেখতে পাই।

-এই মেয়েটা আচ্ছা পাগলী! আমাকে দেখে কি হবে?

-আপনাকে দেখলে যদি আমার ভালো লাগে, তাতে ও আপনি রাগ করবেন।

-ওরকম ভালো লাগতে নেই। তোমার বাবা-জানকে আমি বলে দেবো, যাতে শিগগিরই তোমার শাদী দিয়ে দেয়।

বিয়ের কথায় তিশনার মুখখানা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। সে মাথা নীচু করে আঙুল বুলোতে লাগলো টেবিলে। তারপর ফিসফস করে বললো, আমি শাদী করবো না।

-ইস্! দেখা যাবে! যাই হোক আমাদের কথা কারুকে বলো নি তো?

-না কারুকে না! সবাইকে আপনার কথা বলতেই ইচ্ছে করে, খুব ইচ্ছে করে, তবু বলিনি। কিন্তু আপনি যে এসেছেন, তা তো অনেকেই জানে!

-তা জানুক। আমার ছোট ভাইটির কথা কেউ জানে না তো?

-না।

-ঠিক আছে।

-রফিক ভাই, আমি এখানে একটু বসি?

রফিক বসতে বলেনি বলে তিশনা দাঁড়িয়ে আছে। রফিক বললো, হ্যাঁ বসো। একটা আন্ডা আর টোস্ট খাও।

-আমি আর কিছু খাবো না। অনেক খেয়েছি।

-খেতেই হবে তোমাকে। না খেলে জোর করে খাওয়াবো। তারপর খাওয়া হলেই নিচে চলে যাবে। আমাদের এখন অনেক কাজ আছে।

সেদিন বেলার দিকে পাড়ার ক’জন প্রবীণ লোক দেখা করতে এলো রফিকের সঙ্গে। রফিক সুকুমারকে লুকিয়ে রাখলো ঘরে, পড়শীদের সঙ্গে কথা বললো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।

যারা এসেছে, তাদের বলার কথা বিশেষ কিছু নেই। চাচা কেমন আছে, বাড়ির খবর কি, গভর্ণমেন্ট থেকে নতুন আইন হচ্ছে, সব কলেজে পড়া ছেলেদেরই থানায় নাম লিখিয়ে আসতে হবে? এইসব অবান্তর প্রসঙ্গ। আসল ওরা কৌতূহলী! রফিক কেন দিনের পর দিন চুপচাপ ঘরে বসে আছে, তাই জানতে চায়।

রফিক বুঝতে পারলো, এই একম করলে বেশিদিন লোকের সন্দেহ এড়ানো যাবে না। সেদিন সে দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। চারদিকে একটু ঘুরে-টুরে দেখে বুঝলো বিপদের গন্ধ নেই। এ পাড়ার দিকে পুলিশও তেমন নজর রাখেনি।

পরদিন আর একটু সাহস করে সে গেল খিদিরপুরের ডক এলাকায়। পুরোনো লোকদের খুঁজতে লাগলো। আগ থেকেই সে সন্ধান রেখেছিল যে এখানে কিছু চোরাই অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। তার কিছু ডিনামাইটের স্টিক দরকার। সম্প্রতি ভুটানের রাজা আমেরিকা থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র আনিয়েছে। সেই জাহাজ এখনো ভিড়ে আছে ডকে। মাল খালাস শেষ হয়নি। এর থেকে দু’একটা পেটি সরাতে হবে।

আস্তে আস্তে রফিক যোগাযোগ গড়ে তুললো। তিন চারজন স্মাগলার, যারা সাবান সেন্ট আর স্কচ হুহস্কির চোরাই ব্যবস্থা করে, তারা এই ঝুঁকি নিতে রাজি আছে। কিন্তু আগে থেকে অনেক টাকা ঢালতে হবে।

এই টাকার ব্যাপারটা নিয়েই রফিক একটু মুশকিলে পড়লো। তার কাছে এক লাখ দশ হাজার টাকা আছে-আপাতত এই কাজের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এই টাকা সে তো নিজের ইচ্ছে মতন খচর করতে পারে না। পার্টির কাছে তাকে পাই-পয়সা পর্যন্ত হিসেবে দিতে হবে। টাকা- পয়সা জিনিসটা বড় নোংরা। সামান্য করণেই লোক বদনাম দেয়।

তাছাড়া, একবার টাকা ছড়াতে শুরু করলেই স্মাগলারগুলো গন্ধ পেয়ে যাবে, তাকে আরও চাপ দিতে শুরু করবে। তাই ইচ্ছে, কাজ শেষ হবার পর মাল পেলে হাতে হাতে টাকা দেবে। ওরা তাতে রাজী নয়। ওরাও রফিককে বিশ্বাস করতে পারছে না, রফিকও ওদের বিশ্বাস করতে পারছে না।

ওদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য রফিক অনবরত ওদের সঙ্গে মিশতে লাগলো। বেশিদিন সময়ও হাতে নেই। কলকাতার নানা জায়গায় সে ওদের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

স্মাগলারদের ক্ষমতা দেখে রফিক আশ্চর্য হতে লাগলো অনবরত। যে লোকটাকে সে রাত্তিরে দেখলো নোংরা বস্তির মধ্যে খেলাঘরে বসে দেখি মদ খাচ্ছে আর সস্তা মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করছে-সেই লোকটাই পরদিন সকালে স্যুট টাই পরে গ্রাণ্ড হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে গিয়ে একটা ঘরে ঢোকে গুরুত্বপূর্ণ একজন লোকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয় রফিকের। ডক এলাকার পুলিশের সঙ্গে ওরা ইয়ার-দোস্তের মতন কথা বলে।

শেষ পর্যন্ত কিছু টাকা আগে দিতে সে রাজী হলো। ওদের বিশ্বাস না করলে জিনিসগুলো হাতহাড়া হয়ে যাবে। রফিকের ইচ্ছে ছিল, টাকা পয়সা সে অন্যদের দেবার সময় সুকুমারকে স্বাক্ষী রাখে। সে একজনকে দশ হাজার টাকা দেবে-কিন্তু পরে যদি পার্টির কেউ এ ব্যাপারে তাকে অবিশ্বাস করে? পাঁচ হাজার দিয়ে সে দশ হাজার বলছে না, তা প্রমাণ কি? স্মাগলাররা তো আর রসিদ দেয় না!

কিন্তু সুকুমারের বাড়ি থেকে বার করায় বিপদের ঝুঁকি আছে। এ পাড়ায় সুকুমারকে কেউ চেনে না। তাকে কয়েকবার আনাগোনা করতে দেখলেই লোকে নানারকম সন্দেহ করবে। সুকুমারকে নিরাপদ রাখতে হবে। আর একটা উপায় হলো, স্মাগলারদের মধ্যে দু’একজনকে তার বাড়িতে নিয়ে আসা। তাহলে ওরা বাড়ি চিনে যাবে।

স্মাগলারদের সঙ্গে মিশে রফিক আর একটা জিনিস জানতে পারলো। ওদের আর একটা বড় ব্যবসা মেয়ে-চালান দেওয়া। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মেয়ে সংগ্রহ করে ওরা উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, এবং আরবের দেশগুলোতে চালান দেয়। বিশেষ করে আরব দেশগুলো থেকে যে চোরাই সোনার বাটগুলো আসে তা শোধ দেয় ওরা মেয়ে পাঠিয়ে।

ব্যাপারটা জানতে পেরে রাগ ও ঘেন্নায় রফিকের শরীর জ্বলতে লাগলো। এদের বিবেক বলে কিছু নেই। এদের সঙ্গে তাকে হেসে কথা বলতে হবে? এদের শাস্তি দেবার জন্য তার হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু তার কিছু সাধ্য নেই। সে পুলিশের কাছে যেতে পারবে না কারণ নিজেই পুলিশের কাছ থেকে পলাতক। তা ছাড়া এদের সাহায্য ছাড়া অস্ত্র পাবার আর কোনো উপায় নেই। পরাধীন দেশে চোরা চালান ছাড়া অস্ত্র পাবার আর কি পথ? জার্মানি জাহাজ ভর্তি অস্ত্র পাঠাবে বলে কি ধোঁকাই দিল। নরেন ভট্টাচার্যের সব চেষ্টা বিফলে গেল। বাঘা যতীন শুধু শুধু প্রাণ দিলেন। রফিককে এদের ওপরেই নির্ভর করতে হবে। দেশ স্বাধীন হোক, তারপর নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে এইসব সমাজ বিরোধীদের।

ব্যবস্থা অনেক পাকা হয়ে গেছে। তিন দফায় ওদের দু’জনকে বাড়িতে নিয়ে এসে সুকুমারের সামনে টাকা দেওয়া হয়েছে। সাফল্য সম্পর্কে ওরা নিশ্চিত।

একদিন রাত দশটরা সময় রফিক বাড়ি ফিরে দেখলো প্রধান দরজাটা খোলা, বারান্দাটা অন্ধকার, তার ঘরে দরজার বাইরে তিশনা দাঁড়িয়ে আছে খাবার ঘর থেকে নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে করীমের -সে খাবার বেড়ে রেখে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রফিক কোনো শব্দ করলো না। দেখতে চায় তিশনা কি করে।

দরজাটা ভেজানো ছিল, তিশনা আস্তে আস্তে সেটা ঠেলে খুললো। সুকুমার চমকে জিজ্ঞেস করলো, কে?

তারপর তিশনাকে দেখে বললো, ও আপনি

তিশনা জিজ্ঞেস করলো, রফিকভাই ফেরেন নি?

-না।

তবু তিশনা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সুকুমার মুখ নীচু করে আছে।

আড়াল থেকে লক্ষ্য করে কৌতুক বোধ করলো রফিক। সুকুমারটা নিতান্তই বাচ্চা। এখানো মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেই শেখে নি। তিশনার সঙ্গে কথা বলার মতন একটাও কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

দরজার কাছে তিশনাকে ঐ রকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রফিকের একবার সন্দেহ হয়েছিল, এই ক’দিন তিশনা বুঝি সুকুমারের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছে।

তিশনা বললো, আচ্ছা আমি যাই। তারপর সবে এলো দরজার কাছে থেকে। হঠাৎ রফিককে দেখতে পেয়ে দারুণ চমকে উঠলো। সে বললো, আপনি?

-তুমি এত রাত্রে কি করছো?

-আমি মানে, দেখতে এলাম আপনি ফিরেছেন কিনা?

–ছিঃ তিশনা, তুমি তো খুব ছোটটি নাও, এত রাত্রে আসতে নেই, তা জানো না?

-কেউ দেখে ফেললে কি মনে করবে?

-কেউ দেখে নি। আমাদের বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে আছে। আপনি বলেছিলেন, দিনে একবার আসতে। আজ সারাদিনে আপনাকে একবারও দেখি নি। সেই ভোরবেলা বেরিয়ে গেছেন – আপনাকে একবার অন্ততঃ না দেখলে আমার ভালো লাগে না।

রফিক একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো তিশনার দিকে। রাত্রে ফোটা ফুলের মতন ফুটফুটে মুখখানি, মাথা-ভর্তি ঘন চুল। একটা শালোয়ার কামিজ পরে আছে, তার শরীরটি যেন কোন শিল্পীর সৃষ্টি। তার শরীর থেকে মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসছে।

রফিক বললো, আজ এত সাজগোজ করে এসেছো যে?

তিশনা লজ্জা পেয়ে বললো, আপনি আমার এই নতুন পোশাকটা দেখেন নি তো, সেইজন্য–

-আতর কিংবা সেন্ট মেখে এসেছো?

তিশনা চুপ।

রফিক তিশনার কাঁধে একটা হাত রেখে বললো, এইসব দেখলে পুরুষ মানুষের মাথা ঘুরে যায়। তিশনা তুমি আমাদের মাথা ঘোরাতে এসো না। আমাদের এখন অনেক কাজ।

-সারাদিন কি এত কাজ করেন?

-সে তুমি বুঝবে না।

রফিকের হাতের স্পর্শ পেয়ে তিশনার শরীরটা কাঁপছে। সে কোনো কথাই বলতে পারছে না।

রফিক বললো, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তোমার এবার শাদী হওয়া দরকার। আমি তোমার জন্য খুব ভালো দুলহান খুঁজে এনে দেবো।

হঠাৎ তিশনা কাঁদতে আরম্ভ করলো। শব্দ করছে না। শুধু তার শরীরটা দুলে দুলে উঠছে। রফিক অবাক হয়ে বললো, কাঁদছো কেন? একি, আচ্ছা পাগলী মেয়ে তো, এতে কান্নার কি আছে?

-আপনি আরেকদিনও আমাকে এই কথা বলেছেন। আপনি শুধু আমার মনে কষ্ট দিতে চান।

-কিসে কষ্ট দিলাম?

-আপনি খালি-খালি আমার শাদীর কথা বলেন। আপনি ভালো করেই জানেন, আমি অন্য কারুকেই শাদী করবো না।

-অন্য কারুকে-তার মানে কাকে শাদী করবে?

-আপনি বোঝেন না? সত্যি কথা বলুন!

– আমাকে? ধুৎ! এসব চিন্তা মাথা থেকে একেবারে মুছে ফ্যালো। আমার পক্ষে শাদী-টাদী করা একেবারে সম্ভব নয়। আমি যদি জেলে যাই, তুমি সহ্য করতে পারবে?

– আমি সব সহ্য করবো!

-আমি যদি অনেকদিন আর না আসি?

-আমি অপেক্ষা করে থাকবো।

রফিক একটা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এই সরল প্রাণ মেয়েটিকে সে আঘাত দিতে চাইছে না।

সে তিশনার থুতনিতে আঙুল দিয়ে উচু করে বললো, তিশনা, এখন আমরা একটা খুব বড় কাজ নিয়ে আছি। এখন এসব নিয়ে চিন্তা করারও আমার সময় নেই। আজ থেকে ঠিক এক বছর বাদে আমি এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলবো। এই এক বছরের মধ্যে তুমি এই নিয়ে একদম ভাববে না, রাত্তিরবলা গায়ে সুবাস মেখে এসে আমাকে ভোলাতেও চাইবে না। কথা দাও।

-এক বছর পরে আপনি ঠিক আসবেন!

-যেখানেই থাকি, এক বছর পরে ঠিক আসবে?

-মনে থাকবে?

-হ্যাঁ, মনে থাকবে।

সেইদিনই শেষ রাত্তিরে সুকুমারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রফিক। এক পেটি অস্ত্র পাওয়া গেছে। সাতাশটা পিস্তল, তের হাজার কার্তুজ, সাতটা গ্রেনেড আর এক ডজন ডিনামাইট স্টিক। এগুলো পেলে পাঞ্জাবের বিপ্লবীরা আবার আগুন জ্বালাতে পারবে! ইউ পি-তে শচীন সান্যালের ভাঙা দলটাকে আবার জোড়া লাগানো দরকার। চট্টগ্রামে সূর্যবাবুও তৈরি হচ্ছে।

রফিক বললো, সুকুমার সকালের ট্রেনেই একটা দিল্লীর টিকিট কাটা আছে। আমাদের মধ্যে একজন যাবে। কে যাবে, তুই না আমি?

-দু’জন এক সঙ্গে যাওয়া যাবে না?

-না। দু’জনে আলাদা আলাদা গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। একজন ধরা পড়েলও অন্ততঃ আর একজন বাইরে থাকবে।

-তা হল কে যাবে. আপনি ঠিক করে দিন। আমি রাজী আছি।

-জিনিসটা নিয়ে তুই আগে চলে যা। আমি কয়েকদিন পরে যাবো। এর মধ্যে রতনলালকে একটা খবর দিতে হবে। তা ছাড়া, জিনিসগুলো, যোগাড় করার সময় আমি স্মাগলারদের সঙ্গে ঘুরেছি, পুলিশের চোখ পড়তে পারে আমার ওপর। আর ঐ স্মাগলাদের কোনো বিশ্বাস নেই। ওদের কেউ ধরা পড়লে, সেই হয়তো আমার নাম বলে দেবে। সেই জন্য মালটা আমার সঙ্গে না থাকাই ভালো। টিনের একটা ট্রাঙ্ক কিনে রেখেছি, তাতে ভরে নিয়ে যাবি-তোকে কেউ সন্দেহ করবে না।

-পাঞ্জাবে গিয়ে কার সঙ্গে দেখা করবো? ভগৎ সিং তো জেলে। আজাদজীর দেখা কি পাবো?

-তোকে সোজা পাঞ্জাবে যেতে হবে না। আগ্রায় নেমে পড়বি। সেখানে গিয়ে উঠবি সুকুমের হোটেলে। সেখানে থেকে ওরা তোকে নিয়ে যাবে। তবে, তুই চন্দ্রশেখর আজাদ ছাড়া আর কারুর হাতে জিনিসগুলো দিবি না। আজাদজীর সঙ্গে আমার সেই রকম কথা আছে।

-ঠিক আছে।

খিদিরপুরে এসে ওরা একটা নৌকোয় চেপে বসলো। তখনো ভোরের আলো ফোটে নি! ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। সমস্ত শহরটা ঘুমন্ত।

যাতে পোর্ট কমিশনের লঞ্চের নজরে না পড়ে যায়, সেইসঙ্গে তাদের নৌকাতে আলো জ্বালাও হয় নি। হাওড়া ব্রিজ এখন খোলা।

নৌকা এসে থামলো শিবপুরের বোটানিক্যাল বাগানের পেছনে দিকে। সেখানে আর একটা নৌকোয় অন্যরা অপেক্ষা করছিল।

রফিককে সেখানে এক লক্ষ্য টাকা তুলে দিতে হলো ওদের হাতে। টাকাগুলো গুণে গুণে নিল ও পক্ষের চারজন। রফিকও তেমনি ট্রাঙ্ক খুলে অস্ত্রগুলো গুণে গেঁথে মিলিয়ে নিল। সুকুমার দেখে নিল, জিনিসগুলো খাঁটি কিনা?

তারপর যে যার ছড়িয়ে পড়লো। জাহাজ থেকে অস্ত্রগুলো উধাও হবার খবর জানাজানি হয়ে গেলেই পুলিশ দারুন তৎপর হয়ে উঠবে। তার আগেই পালাতে হবে।

সুকুমার আর রফিক একটা রিকশা নিয়ে গেল কিছুটা পথ। তারপর একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল সৌভাগ্যক্রমে। হাওড়া ষ্টেশনে যখন পৌছালা, থখন সবে ভোর হয়েছে।

হাওড়া ষ্টেশনের থার্ড ক্লাস ওয়েটিং রুমে সাধারণত ভিখির আর ভবঘুরেরা রাত কাটাতে আসে। তারা অনেকেই ঘুমোচ্ছে। ওরা দু’জনেও তাদের পাশে শুয়ে পড়লো। রফিকের চেহারা এতই সুন্দর সে ওখানে তাতে কিছুতেই মানায় না। যে-কেউ তাকে দেখলেই সন্দেহ করবে।

শেষ পর্যন্ত ট্রেনের সময় হলো, কোনো কিছুই এর মধ্যে ঘটলো না। সুকুমারকে একটা থাউ ক্লাস কামরায় তুলে দিল রফিক। গোলাপ ফুল আঁকা টিনের ট্রাঙ্কটা ঢুকিয়ে রাখলো বেঞ্চের নিচে। তারপর বললো, ঠিক আছে?

সুকুমার বললো, ঠিক আছে। তুমি কিছু চিন্তা করো না।

– সাবধানে থাকিস।

-তুমি ও সাবধানে থেকো রফিক ভাই।

সুকুমারে ট্রেন ছাড়বার পর রফিক প্ল্যাটফর্ম বদলালো। সে একটা লোকাল ট্রেনে চেপে বসলো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *