॥ দুই ॥
সব্যসাচীকে পিছনে বসিয়ে অরিন্দম সাইকেল চালাচ্ছে। সব্যসাচী একহাতে জড়িয়ে ধরে আছে তার কোমর। কাঁধে এখনও কাঁচ ঢুকে আছে, অসহ্য যন্ত্রণায় তার শরীরটা ক্রমেই অবশ হয়ে আসছে! অরিন্দম কথা বলে বলে তাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল, সব্যসাচীর শরীরটা এলিয়ে পড়েছে তার পিটের ওপর। আর পারছে না। এই অবস্থায় যদি থাকতে পারে, তাতেও ক্ষতি নেই। পড়ে না যায়।
অরিন্দম জিজ্ঞেস করলো, কি রে, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে?
সব্যসাচী বললো, উঃ না বেশি না-
-যেতে পারবি, না কোথাও থামবো?
-না, থামাতে হবে না। চালা, আরও জোরে চালা।
-এত সহজে যে আমাদের কাজ হয়ে যাবে, ভাবতেই পারি নি। শুধু যদি তোর কাঁধে না লাগতো।
-আমার কিছু হয় নি। কিছু হয় নি!
খানিকটা বাদে পেছনে ফরফর করে কাগজের শব্দ হতে অরিন্দম চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। কান্ড দেখে তার দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। সব্যসাচীর গলায় ঝোলানো একটা কাপড়ের ব্যাগ ভর্তি টাকা। এক লাখ দশ হাজার টাকা। সব্যসাচী অচৈতন্য হয়ে আছে, আর হাওয়ায় সেই টাকাগুলো উড়ে যাচ্ছে ফরফর করে। কতক্ষণ থেকে এ রকম শুরু হয়েছে কে জানে।
অরিন্দম তাড়াতাড়ি সাইকেল থামালো। ঝাঁকুনিতে চোখ মেলে সব্যসাচী জিজ্ঞেস করলো, কি হলো?
অরিন্দম বললো, সর্বনাশ হয়েছে। টাকাগুলো উড়ে যাচ্ছে!
– যাঃ, টাকা কি করে উড়ে যাবে। কিছু খরচ করি নি তো!
-তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলি। তোর ব্যাগ থেকে উড়ে পড়ে যাচ্ছে।
বিকারের ঘোরে সব্যসাচী বললো, যাক! যাচ্ছে যাক।
কিন্তু যাক বললেই তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। হিসেবের টাকা। রতনলাল সবাইকে সাক্ষী রেখে বলে দিয়েছে, পাই, পয়সা পর্যন্ত হিসেব করে দিতে হবে। হাওয়ায় টাকা উড়ে গেছে, এটা কি কোনো হিসেব হতে পারে? এত কষ্টের টাকা। কতক্ষণ থেকে পড়ছে কে জানে।
তাছাড়া,রাস্তায় টাকা ছড়িয়ে আছে। কাল সকালেই লোকের চোখে পড়ে যাবে। চেঁচামেচি শুরু হবে। পুলিশ আসবে। পুলিশ ওদের পালাবার পথের একটা পরিষ্কার চিহ্ন পেয়ে যাবে।
অরিন্দম সাইকেল থেকে নেমে পড়লো। সব্যসাচীর হাত ধরে বললো, নেমে একটু বোস। আমি দেখছি।
সব্যসাচীর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। শরীর থেকে নিশ্চয়ই অনেক রক্ত ঝরেছে সে জন্য তার মতন শক্তিশালী লোকও এত দুর্বল হয়ে পড়েছে। অরিন্দমের হাত ধরে টলতে টলতে এসে সে একটা গাছতলায় শুয়ে পড়লো।
অরিন্দম তাকে এক ঝুকুনি দিয়ে বললো, একটু চেষ্টা করে জেগে থাক। সঙ্গে এতগুলো টাকা, তাছাড়া সাইকেলটা যদি চুরি যায়- তাহলে আমরা গেছি।
সব্যসাচী নড়ে চড়ে কোনোক্রমে উঠে বসলো গাছটাতে হেলান দিয়ে। সুস্থ হাতটা দিয়ে রিভরবারটা ধরে রাখলো সামনের দিকে
অরিন্দম টাকাগুলো খুঁজতে গেল। সব টাকা তো রাস্তার মাঝখানেই পড়ে নি, হাওয়ায় এদিক ওদিক উড়ে গেছে। টর্চ জ্বেলে দেখতে দেখতে কয়েকটা পাওয়া গেল। আরও কয়েকটা চোখের আড়ারে রয়ে যাচ্ছে কি না কে জানে।
বেশ কিছুটা রাস্তা ধরে ফিরে এসে অরিন্দম অনেকগুলো নোট জড়ো করলো। আরও কত আগে থেকে টাকা পড়তে শুরু করেছে তার ঠিক নেই। রতনলাল টাকাটা অরিন্দমের কাছে দেয় নি, দিয়েছে সব্যসাচীকে। কারণ, সেই রকমের ঠিক করা ছিল আগে থেকে। সব্যসাচী যে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়বে, আজ কেউ বুঝতে পারে নি।
কিন্তু এইভাবে সময় নষ্ট করাও তো খুব বিপজ্জনক। কিছু টাকা যদি কম পড়ে, সবাইকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে বিশ্বাস করবে না? কি জানি!
অরিন্দমের মুখে একটা তেতো স্বাদ এলো, খুবই ক্লান্ত বোধ করতে লাগলো সে। এরকমভাবে রাত্রির অন্ধকারে টাকা খোজাখুজির কোনো মানেই হয় না। একবার তার একথাও মনে হলো, টাকাটা ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব তো তার নয়, সব্যসাচীর। সে কেন এত খেটে মরছে। সঙ্গে সঙ্গে সে চিন্তাটা মন থেকে তাড়িয়ে দিল। সব্যসাচীকে নিরপদে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তার। সেটা সে কি করে অস্বীকার করে।
দূরে কিছু লোকের গলায় আওয়াজ পেয়ে অসম্ভব ভয় পেয়ে গেল অরিন্দম। টাকার গোছা হাতে নিয়ে প্রাণপণে ছুটতে লাগলো।
গাছতলায় এসে দেখলো সব্যসাচী আবার ঘুমে ঢলে পড়েছে।
এই অবস্থায় একটা বাচ্চা ছেলেও এসে ওর কাছ থেকে রিভলবার এবং টাকাগুলো চুরি করে নিয়েযেতে পারতো। অরিন্দম তাকে ধাক্কা দিয়ে বললো, এই, ওঠ।
সব্যসাচী অতি কষ্টে চোখ মেরে বললো, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। রাত্রিটা এখানেই ঘুমিয়ে থাকি না।
-লোকজনের গলা শুনতে পাচ্ছি। আর এক মিনিট দেরী করা যাবে না।
– আমায় তুলে ধর।
টাকার থলির মুখটা ভালো করে বেধে অরিন্দম প্রথমে সেটা নিজের গলায় ঝোলালো। তারপর কি ভেবে আবার সেটা খুলে পরিয়ে দিল সব্যসাচীর গলায়। তার পর তাকে টেনে তুললো সাইকেলের পেছনে। নিজে সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে বললো, আমাকে শক্ত করে ধরে থাকিস।
সব্যসাচী বললো, তোর চিন্তা নেই। আমি ঠিক পারবো।
অরিন্দম মরিয়া হয়ে সাইকেল চালাতে লাগলো। শনশন্ করে হাওয়া বইছে, মাঝে মাঝে কয়েকটা কুকুর তাড়া করে আসছে,তবু কোনো দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার পিঠের ওপর সব্যসাচীকে সম্পূর্ণ দেহের বোঝা।
প্রায় দু’ঘন্টা সাইকেল চালিয়ে অরিন্দম একটা ছোট মফঃস্বল শহরে এসে পৌছালো। সারা শহরটা ঘুমন্ত। একটা দোতলা বাড়ির পেছনে দিকের বাগানে এসে থামলো অরিন্দম। সাইকেলটাকে দেয়ারে হেলান দিয়ে রেখে সবসচাীকে টানতে টানতে নিয়ে এলো বাগানের গেটের কাছে।
গেট খোলাই ছিল। বাগান বলতে কয়েকটা গোলাপ ফুলের গাছ, আর এক ঝাড় গাঁড়া আর জবা। বেশ একটা হালকা সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে আছে সেখানে।
বাগান পেরিযে এসে বাড়িটার পেছনের দরজায় টোকা মারলো অরিন্দম। তিনবার টোকা মারতেই দরজা খুলে গেল। সেখানে দুটি নারী দাঁড়িয়ে, একজন মধ্যবয়স্ক, আর এক জনের বয়স আঠারো উনিশ।
অরিন্দম সব্যসাচীকে নিয়ে টপ করে ভেতরে ঢুকে দরজায় পিঠ দিয়ে দাড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। এতক্ষণ তার দারুণ পরিশ্রম হয়েছে, এখন সে যেন আর দাঁড়াতে পারছে না। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, মেজদি, জামাইবাবু বাড়িতে নেই তো!
পৌঢ়া মহিলা বললেন, না ট্যুরে গেছেন। এর কি হয়েছে?
সব্যসাচী নিজে বললো, আমি শোবো। আমার বিছানা লাগবে না, মাটিতে একটু জায়গা হলেই –
অরিন্দম বললো, চল ভেতরের ঘরে চল-
সব্যসাচী তবু জড়িত গলায় বললো, না, আমি ভেতরে যাবো না। আমি কাল সকালেই চলে যাবো। এখন এখানে একটু শুয়ে থাকতে পারি।
অরিন্দম তাকে জোর করে টেনে বললো, কি হচ্ছে কি? চল ভেতরে শোবার জায়গা আছে। অরিন্দম একা তাকে নিয়ে যেতে পারছেনা, পৌঢ়া মহিলাটিও ধরলেন সব্যসাচীকে। যুবতী মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে এদের দু’জকে দেখছে।
বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি। সিঁড়ির এক পাশে একটি ছোট ঘর। অরিন্দমের মেজদি বললেন, ওপরে উঠতে পারবে তো?
অরিন্দম বললো . তার দরকার নেই। এই ঘরটা খালি আছে তো?
সিড়ির পাশের ঘরটা ছোট। তাতে শুধু একটা খাট ও মাদুর পাতা। ওরা সেই ঘরে ঢুকলো। সব্যসাচী টলতে টলতে গিয়ে হুড়মুড় করে শুয়ে পড়লো। খাটে। আচ্ছন্ন গলায় বললো আমি কালকেই ঠিক হয়ে যাবো!
সব্যসাচী কাঁধের বিরাট ক্ষতটা দেখে শিউরে উঠে মেজদি বললেন, ইস! এ কি হয়েছে? অরিন্দমও বসে পড়েছে মাটিতে। ক্লান্ত ভাবে বললো, জল, আমাকে এক গ্লাস জল খাওয়াবে?
মেজদি বললেন, খাবার তৈরি আছে। একটু দাঁড়া শুধু জল খেতে হবে না।
তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। খাবার খাবো না শুধু জল দাও।
এই কুন্তলা, জল নিয়ে আঁয় তো।
যুবতী মেয়েটি চকিত পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। একটু পরেই এক থালা সন্দেশ আর বড় ঘটিতে জল নিয়ে ফিরে এলো।
একটা সন্দেশ মুখে পুরে অরিন্দম ঢক ঢক করে প্রায় সব জলটুকু শেষ করে ফেললো। খানিকটা সুস্থ হয়ে নিশ্বাস ছেড়ে বললো, আ! প্রায় দশ আটকে আসছিল আমার!
মেজদি সব্যসাচীর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ও কিছু খাবে না?
– ওর কিছু খাবার ক্ষমতা নেই।
-অতখানি কাটলো কি করে? ইস এখনো রক্ত পড়ছে।
-পরে সব বলছি। খানিকটা গরম জল আর তুলো আনতে পারবে? ওর ঐ জায়গাটা এখনই ড্রেস করে দেওয়া দরকার।
কুন্তলা নিজে থেকেই বললো, আমি জলগরম করে আনছি।
সে চলে যাবার পর মেজদি জিজ্ঞেস করলেন। কোনো গণ্ডগোল হয় নি তো?
অরিন্দম বললো, সব একেবারে ঠিকঠাক হয়েছে। শুধু রফিকুলদার একটা আঙ্গুল জখম হয়েছে, আর সব্যসাচীর এই চোট লেগেছে। ওরটাই বেশি।
তোরা কারুকে মারিস-টারিস নি তো?
একটু ইতস্তত করে অরিন্দম বললো না! আমি অন্তত জানি না টাকা অনেক পাওয়া গেছে। এবারে বড় রকম কাজ শুরু করতে হবে।
-এখন কয়েক মাস চুপচাপ থাকিস। তোদের যেন কেউ সন্দেহ না করে।
– মেজদি, তোমার এখানে ক’দিন থাকা যাবে?
-তোর জামাই বাবু ফিরবে আর দু’দিন বাদে।
– ওঃ. তার মধ্যে সব্যসাচী ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ওর স্বাস্থ্য খুব ভালো। তারপর আমরা কলকাতয় চলে যাবো। সেখানে আমাদের ভালো জায়গা আছে।
মেজদি অরিন্দমের পিঠে হাত দিয়ে কম্পিত গলায় বললেন, অরু শেষ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক হবে তো?
অরিন্দম বললো, আমরা কতটা পারবো জানি না। কিন্তু আমাদের যার যেটুকু সাধ্য তা করে যেতে হবে। সব কিছুরই দাম আছে। আমরা যদি বৃটিশ রাজত্বের একটা ভিতও আলগা করে দিতে পারি-
সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোরা যে নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিচ্ছিস।
-তুমি ভয় পেয়ো না। আমাদে কিছু হবে না।
– হ্যা রে, এই রকম মারামারি খুনোখুনি ছাড়া অন্য কোন পথে যাওয়া যায় না?
-এত বড় শত্রু আমাদের সামনে, যে তাকে আমাদে র শক্তি না দেখালে সে কিছুই মেনে নেবে না। আঘাতের উত্তরে পাল্টা আঘাত করতে হবে।
হঠাৎ কথা খামিয়ে অরিন্দম জিজ্ঞেস করলো, তোমার ননদ সব দেখছে। ও কি রকম? শক্ত মেয়ে তো?
ওর জন্য চিন্তা করিস না। ওর খুব মনের জোর। ওকে তোরা তোদের দলে নিতে পারিস! -এখন আমাদের দলে মেয়েদের নেবার দরকার নেই। মেয়েদের নিলেই অনেক গণ্ডগোল দেখা দেয়।
-তোরা এটা ভুল করছিস। মেয়েরা অনেক কাজ পারে যা ছেলেরা পারে না। শুধু শুধু তোরা মেয়েদের দূরে ঠেলে রাখছিস।
– তোমরা এই যে আমাদের নানাভাবে সাহায্য করছো এটাও তো একটা মস্ত বড় কাজ।
এই সময় কুন্তলা এক বাটি গরম জল আর তুলো নিয়ে ফিরে এলো। অরিন্দম উঠতে যেতেই মেজদি বললেন, তুই বোস। আমরা দেখছি!
কুন্তলা গরম জলে তুলো ভিজিয়ে সব্যসাচীর কাঁধের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত মুছে দিতে গেল। সেখানে তখন কয়েকটা কাঁচের টুকরো গেঁথে রয়েছে দেখে শিউরে উঠলো সে।
মেজদি বললেন, এই কাঁচগুলো এক্ষুনি তুলে না ফেললে সেপটিক হয়ে যাবে যে! কুন্তলা বললো, আমার বন্ধু বিজয়ার বাবা ডাক্তার, তাকে ডেকে আনবো?
অরিন্দম বললো না। এখন কারুকে ডাকার দরকার নেই।
– উনি খুব ভালো লোক।
এখন কারুকেই বিশ্বাস করা যায় না।
কুন্তলা নিজের চেষ্টায় একটা কাচের টুকরো তুলতে যেতেই যন্ত্রণায় জেগে উঠলো সব্যসাচী। বিরক্তভাবে বললো, আঃ কি হচ্ছে কি?
অরিন্দম উঠে এসে ঝুকে পড়ে বললো, একটু ধৈর্য ধরে থাক্ – কাঁচগুলো তুলে ফেলতে হবে।
-কিছু তুলতে হবে না।
কুন্তলা বললো, আস্তে, খুব আস্তে তুলবো, আপনার বেশী লাগবে না।
– বলছি না, কিছু তুলতে হবে না।
কুন্তলা বললো, অরিন্দমকে বললো, আপনি ওকে চেপে ধরে থাকুন। বৌদি, তুমি কাঁধটা ধরো-
ওরা সেই রকমভাবে ধরলো। কুম্বলা আবার নিচু হয়ে কাঁচ তুলতে যেতেই সব্যসাচী জোরে একটা ঝটকা মারলো, একটা হাত তার এত জোরে উঠেছিল যে দড়াম করে লাগলো কুন্তলার মুখে। সে বেচারী এক পলকের জন্য অন্ধকার দেখলো চোখে।
সব্যসাচী এবার উঠে বসলো। তারপর বললো, কি হচ্ছে এসব? কেন আমাকে জ্বালাতন করা হচ্ছে?
অরিন্দম ভৎসনার সুরে বললো, কেন এরকম ছট্ফট্ করছিস? কাঁচগুলো না তুললে কি হবে জানিস?
-যা হয় হোক। আমি এখন চুপ করে ঘুমাতো চাই আমাকে বিরক্ত করিস না।
-অরিন্দম এবার কণ্ঠস্বর নরম করে বললো, সব্যসাচী কেন ছেলেমানুষী করছিস? তোর ভালোর জন্যই তো-
সব্যসাচী বললো, ভীষণ যন্ত্রণা। পারছি না। আচ্ছা, আমি চুপ করে আসছি, এবার তোল। কুন্তলা কাছে এসে বললো, আবার আমার মুখে মারবেন না তো?
-খুব লেগেছে?
– না, খুব না।
– এবার তুলুন।
ধারালো কাঁচের টুকরোগুলো খালি হাতে তোলা বিপজ্জনক। কুন্তলা হাতে একটা রুমাল জড়িয়ে নিয়েছে। সেইজন্য ভালো করে ধরতে পারছে না।
সব্যসাচী নিজেই বললো, ও ভাবে হবে না। একটা কাঁচি গরম করে নিন্ -তারপর দেখুন। সেই ভাবেই চেষ্টা হলো কিছুক্ষণ। স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে একটা কাঁচিকে গরম করে ক্ষতস্থানটা আরও খুচিয়ে খুচিয়ে কাঁচ তোলা হতে লাগলো। কয়েকটা বেরিয়ে এলো। দুটো ছোট টুকরো বার করা যাচ্ছে না। সব্যসাচী দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো, একবারও টু শব্দ করলো না। কুন্তলা পাকা নার্সের ভঙ্গিতে খোঁচাখুঁচি করে যাচ্ছে। এক সময় সব্যাসাচী বললো, আজ থাক।
-দুটো টুকরো অনেক ভেতরে ঢুকে গেছে। কিছুতেই বেরুচ্ছে না। আর একটু চেষ্টা করি?
সব্যসাচী করুণ মুখ তুলে বললো, আমি আর পারছি না। ভীষণ লাগছে যে।
মেজদি বললেন, কি হবে তা হলে?
-দুটো কাঁচের টুকরো শরীরের মধ্যে থাকলে কিছু হবে না।
-তা কি হয়?
কুন্তলা বললো, আমিও সাহস পাচ্ছি না। যদি বেশি লেগে টেগে যায়?
অরিন্দম বললো, এখন থাক তাহলে। জায়গায় বরং যেঞ্জিন দিয়ে ভিজিয়ে দাও। বেঞ্জিন আছে বাড়িতে?
-আছে।
কে না জানে, বেঞ্জিন লাগালে দারুণ জ্বালা করে। সব্যসাচী অরিন্দমকে বললো, তুই আমার মুখটা চেপে ধর। যদি আমি চেঁচিয়ে ফেলি।
অরিন্দম সব্যসাচীর মুখে হাত চাপা দিল। কিন্তু তার দরকার ছিল না। নিজেই দম বন্ধ করে রেখেছে সব্যসাচী, তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে
বেঞ্জিন লাগাবার পর তুলো চাপিয়ে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হলো। তারপর সব্যসাচী ধপ করে শুয়ে পড়লো আবার। মাথায় নিচে বালিশ নেই।
কুন্তলা দৌড়ে বালিশ এনে দিল দুটো। অরিন্দম সেই বলিশের নিচে টাকার থরে আর রিভলবারটাা রেখে দিল। তাপর বললো, এবারও ঘুমোক্। রাত্রিরটা তো কাটুক।
ঘরের আলো নিভিয়ে ওরা বেরিয়ে গেল।