৭
ইতিমধ্যে ইউক্লিড তার বর্ণনার সমর্থনে এতো সব প্রমাণ উপস্থিত করলো যে বিষয়টা তখন আর প্রবাল পাহাড়ে আটকে থাকা দু’একটা কানের দুল আর আংটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না, ব্যাবিলোনীয় ঐশ্বর্যের সম্ভার নিয়ে নিমজ্জিত পঞ্চাশটি জাহাজ থেকে সে সব উদ্ধারের জন্য এবার বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে, তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে এখন। এর পর, এক সময় না এক সময়ে যা ঘটবার ছিল তাই ঘটলো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার অভিযানকে সফল সমাপ্তিতে নিয়ে যাবার জন্য মায়ের কাছে সাহায্যের আবেদন জানালো। মা অলঙ্কারের পাথর বসানো জায়গা দাঁত দিয়ে কাটলেন, রত্নগুলি আলোর উল্টো দিকে ধরে দেখলেন, সবই ঝুটো, কাচের, মেকি, বুঝলেন যে তাঁর সরল বিশ্বাসপ্রবণ ছেলেকে কেউ একজন বেদম ঠকাচ্ছে। ইউক্লিড নতজানু হয়ে, শপথ করে, বারবার বললো যে সে কোনো কারচুপি করে নি, কিন্তু পরের রবিবার তাকে জেলে বন্দরে দেখা গেল না, এর পর তাকে আর কোথাও দেখা গেল না।
এই বিপর্যয় থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার একটাই লাভ হয়। সে বাতিঘরের প্রীতিময় আশ্রয়টি খুঁজে পায়। এক রাতে সে যখন ইউক্লিডের সঙ্গে তার নৌকায় সমুদ্রের বুকে, তখন হঠাৎ ঝড় উঠলে, সে ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর থেকে সে বিকালের দিকে মাঝে মাঝে ওখানে গিয়েছে, বাতিঘরের রক্ষকের সঙ্গে কতো গল্প করেছে, সমুদ্রে এবং ডাঙায় সে যে কতো আশ্চর্য জিনিস দেখেছে তার কাহিনী শুনেছে। এই সময় তাদের দুজনের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পৃথিবীর নানা পরিবর্তন সত্ত্বেও তাদের ওই বন্ধুত্বে কখনো চিড় ধরে নি। কী করে আগুনকে প্রজ্বলিত রাখতে হয়, গাদা গাদা কাঠ গুঁজে দিতে হয়, তারপর বিশাল মাটির পাত্র ভর্তি তেল ঢেলে দিতে হয় কি ভাবে, সে সবই শিখে ফেলে। এসব এখানে বিদ্যুৎ শক্তি আসার আগের কথা। ফ্লোরেন্টিনো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলের গতিপথ নিয়ন্ত্রিত করার এবং দর্পণের সাহায্যে আলোর উজ্জ্বলতা বাড়াবার কৌশলও আয়ত্ত করে ফেললো। বেশ কয়েকবার বাতিঘরের রক্ষক যখন ওসব করতে পারছিলেন না তখন সে তার ওখানে থেকে গেছে, রাতে টাওয়ার থেকে সাগরের বুকের জাহাজগুলির ওপর চোখ রেখেছে। সে জাহাজগুলির কণ্ঠস্বর শুনে, দিগন্তের গায়ে তাদের আলোর ধরন ও আয়তন দেখে, জাহাজগুলিকে চিনতে শিখলো, জাহাজের আলো আর বাতিঘরের আলোকসঙ্কেতের মধ্যে যে একটা যোগসূত্র গড়ে ওঠে সে বোধ তার মধ্যে জাগ্রত হল।
দিনের বেলায়, বেশির ভাগ সময় রবিবারে, তার জন্য ছিল আরেক ধরনের আনন্দ। ভাইসরয়দের জেলায় বাস করতো শহরের পুরনো উচ্চবিত্ত মানুষরা। সেখানে মেয়েদের সমুদ্র সৈকত থেকে পুরুষদের সৈকতকে একটা পলেস্তরা করা দেয়াল দিয়ে পৃথক করে রাখা হয়েছিল। একটা সৈকত ছিল বাতিঘরের ডান দিকে, অপরটি বাঁ দিকে। বাতিঘরের রক্ষক তার বাতিঘরে একটা ছোট টেলিস্কোপ বসালেন, এক সেন্টাভোর বিনিময়ে তিনি যে কোনো দর্শনার্থীকে ওই টেলিস্কোপের সাহায্য মেয়েদের সৈমুদ্র সৈকত দেখতে দিতেন। উচ্চবিত্ত সমাজের তরুণীরা, তাদের যে কেউ দেখছে সে সম্পর্কে অনবহিত থেকে, কুঁচি দেয়া স্নানের পোশাক, চটি, হ্যাট ইত্যাদি পরে তাদের সাধ্য মতো নিজেদের প্রকাশ করতো।
রাস্তায় বেরুবার সময় তাদের ধরাচূড়া তাদের শরীরকে যে ভাবে ধরে রাখতো, এই সমুদ্র সৈকতেও প্রায় সে রকমই রাখতো, ওদের বরং এখানে আরো খারাপ দেখাতো। মেয়েদের মায়েরা বেতের দোলচেয়ারে রোদে বসে থাকতেন, গির্জায় উপাসনায় যোগদানের সময় যে পোশাক পরতেন, মাথায় যে রকম পালক দেয়া টুপি চাপাতেন, হাতে যে রকম অর্গান্ডির ছাতা ধরে রাখতেন ঠিক সে ভাবেই সমুদ্র তীরে বসে মেয়েদের ওপর নজর রাখতেন যেন পার্শ্ববর্তী সৈকত থেকে কোনো পুরুষ এসে ওদেরকে জলের নিচে কোনো কুকর্মে প্রলোভিত করতে না পারে। সত্যি কথা বলতে গেলে, টেলিস্কোপের মাধ্যমে দর্শক যে দৃশ্য দেখতে পেতো তা তারা রাস্তাতেও দেখতে পেতো, তার চাইতে বেশি উত্তেজনাপূর্ণ কিছুই তাদের চোখে পড়তো না, তবু দেয়াল ঘেরা এলাকার নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ গ্রহণের নির্জলা আনন্দই বহু খদ্দেরকে এই বাতিঘরে প্রতি রবিবার টেনে আনতো, কে আগে টেলিস্কোপে চোখ লাগাবে সে জন্য তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেতো।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও ছিলো ওই দর্শকদের একজন, তবে সে ওখানে আনন্দের জন্য ততটা যেতো না যতোটা যেতো একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাবার জন্য। তবে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখার বাড়তি আকর্ষণের তাগিদে সে বাতিঘরের একজন ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে নি। আসল কারণ ছিল অন্যত্র নিহিত। ফারমিনা ডাজা কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবার পর সে ওর জায়গায় বসাবার জন্য নানা ভিন্নধর্মী প্রেমকে প্রশ্রয় দেয় কিন্তু কোথাও শান্তি ও সান্ত্বনা পায় নি, একমাত্র বাতিঘরেই সে সুখ ও আনন্দের স্বাদ পায়, তার দুর্ভাগ্য কিছু সান্ত্বনা লাভ করে এখানেই। সে এ জায়গাটিই সব চাইতে বেশি ভালবাসতো, এতোটাই বেশি যে ওটা কিনতে তাকে সাহায্য করার জন্য সে বহু বছর তার মায়ের কাছে, পরে তার কাকা দ্বাদশ লিও-র কাছে, অনেক দেন দরবার করেছিল। সে যুগে ক্যারিবীয় অঞ্চলে বাতিঘরগুলি ছিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন এবং বাতিঘরের মালিকরা বন্দরে প্রবেশ করার অধিকার বাবদ জাহাজের আয়তন অনুযায়ী প্রতি জাহাজ থেকে ফি আদায় করতেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মনে করতো যে কবিতার মাধ্যমে ছাড়া মুনাফা অর্জনের ওটাই ছিল একমাত্র সম্মানজনক পন্থা, কিন্তু তার মা কিংবা তার কাকা কেউই তার সঙ্গে একমত হলেন না, আর সে যতো দিনে নিজেই ওটা কেনার মতো সম্পদশালী হয়ে ওঠে ততদিনে বাতিঘরগুলি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে যায়।
তবে তার ওই স্বপ্নগুলির একটাও বৃথা যায় নি। জাহাজের উপাখ্যান আর বাতিঘরের অভিনবত্ব তাকে ফারমিনা ডাজার অনুপস্থিতির যন্ত্রণা উপশমে সাহায্য করে আর তারপর, যখন সে একটুও আশা করে নি তখনই, ফারমিনার প্রত্যাবর্তনের খবর এসে পৌঁছল তার কাছে। আসলে, রিওহাচায় দীর্ঘকাল অবস্থানের পর লোরেঞ্জো ডাজা বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। সময়টা সমুদ্র ভ্রমণের অনুকূল ছিল না, ডিসেম্বরের বাণিজ্য বাতাস তখন বইতে শুরু করেছ। তাদের জাহাজই ছিল একমাত্র ঐতিহাসিক জাহাজ যা ওই সময় সমুদ্র পাড়ি দেবার ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল, কারণ বিপরীত বাতাসের ধাক্কায় যে বন্দর থেকে জাহাজ যাত্রা শুরু করতো তাকে আবার সেই বন্দরে ফিরে আসার আশঙ্কা থাকতো এবং এ ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটে। ফারমিনা ডাজা একটা পীড়াদায়ক পুরো রাত কাটালো একটুও না ঘুমিয়ে, বারবার বমি করলো, পিত্তি উঠলো বমির সঙ্গে, ক্যাবিনে তার বাঙ্কে নিজেকে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বেঁধে রাখলো, আর ক্যাবিনটাকে তার মনে হল কোনো সরাইখানার শৌচাগারের মতো, ঘুপচির মতো তার সঙ্কীর্ণ আয়তনের জন্যই শুধু নয়, গরম আর তার ন্যক্কারজনক দুর্গন্ধের জন্যও বটে : জাহাজটা এতো প্রবল বেগে দুলছিলো যে তার মনে হয় শয্যায় তাকে বেঁধে রাখা দড়ির বাঁধনগুলি বোধ হয় যে কোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে যাবে। তার বিনিদ্র রাতের বিভীষিকা আরো বেড়ে যায় তার বাবার কারণে। তিনি পাশেই তাঁর বাঙ্কে শুয়ে শার্দুলের মতো নাসিকা গর্জন দ্বারা কুঠুরিটাকে পূর্ণ করে তুলেছিলেন। বিগত প্রায় তিন বছরের মধ্যে এই একটি রাত ফারমিনা ডাজা না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়, এক মুহূর্তের জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা না ভেবে। আর, অন্য দিকে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, তাদের বাড়ির পেছনের দিকের ঘরে তার দোলনা-শয্যায় শুয়ে ফারমিনা ডাজার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় মুহূর্তগুলি একটি একটি করে গুনতে গুনতে গোটা রাত কাটিয়ে দেয়।
সেদিন সমুদ্রের বুকে সকালের দিকে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া থেমে যায়, আর সমুদ্র শান্ত হয়ে ওঠে, ফারমিনা ডাজা জাহাজের নোঙ্গর ফেলার শব্দে জেগে ওঠায় বুঝলো যে সমুদ্র পীড়ায় আক্রান্ত হলেও সে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন সে খাটের বাঁধনগুলি খুলে জাহাজের ঘুলঘুলিতে চোখ দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো, বন্দরের হইচই-এর ভেতরে সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে দেখতে পাবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু তার চোখে পড়লো শুধু রিওহাচার জাহাজ ঘাটের জীর্ণ তক্তা, শুল্ক বিভাগের গুদামঘর, আর চারপাশের তাল গাছের সারি, সূর্যের প্রথম রশ্মির আভায় আলোকিত। জাহাজটি গত রাতে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল আবার সেখানেই ফিরে এসেছে।
ওই দিনের বাকি সবটুকু সময় কেটে যায় একটা মায়া ও বিভ্রমের মধ্য দিয়ে। গতকাল সে যে বাড়িতে ছিল আজও সে বাড়িতে আছে, যে দর্শনার্থীরা কাল তাকে বিদায় জানিয়েছিল আজ সে তাদের অভ্যর্থনা করছে, সেই একই জিনিস নিয়ে আলাপ করছে, একটা ঘোরের মধ্যে তার মনে হল সে যেন তার যাপিত জীবনেরই একটা অংশ আবার নতুন করে যাপন করছে। পুনরাবৃত্তিটা এতোই এক রকম হল যে পাছে তার পুনর্বার জাহাজ ভ্রমণও ওই একই রকম হবে ভেবে ফারমিনা ডাজা শিউরে উঠলো, সে ভ্রমণের স্মৃতি তাকে ভীষণ আতঙ্কিত করে তুললো। কিন্তু ঘরে ফেরার আর একটি মাত্র সম্ভাব্য পথ আছে, আবার দু’সপ্তাহ ধরে খচ্চরের পিঠে চড়ে পাহাড়ি পথচলা, তার উপর এখন পরিস্থিতি আগের চাইতেও বিপদজনক, অ্যান্ডির রাজ্য ককাতে নতুন এক গৃহযুদ্ধ বেধেছে এবং সেটা সমগ্র ক্যারিবীয় প্রদেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ছে।
তাই রাত আটটায় আবার তারা বন্দর অভিমুখে যাত্রা করলো, সঙ্গে চললো হইচই করা আত্মীয়স্বজনের দল, আবার সেই অশ্রুসিক্ত বিদায় সম্ভাষণের পালা, নানা উপহার সামগ্রী, যার মধ্যে বৃহদাকার বাক্সগুলি ক্যাবিনে আঁটানো গেল না। জাহাজটি যাত্রা করার পূর্বক্ষণে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা আকাশের দিকে একযোগ অনেকগুলি বন্দুকের গুলি ছুড়ে জাহাজটিকে অভিবাদন জানালো, আর লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর পিস্তলের পাঁচটি গুলি ছুড়ে ওদের প্রতুত্তর দিলেন। যাত্রার পর ফারমিনা ডাজার সব আশঙ্কা দূরীভূত হল, রাতভর বাতাস ছিল অনুকূল, আর সাগরের বুকে সে সুন্দর ফুলের গন্ধ পেল, দড়ি দিয়ে তার নিজেকে আর খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হল না। স্বপ্ন দেখল, আবার সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে দেখছে, ফারমিনা সব সময় ফ্লোরেন্টিনোর যে মুখ দেখতো, সে মুখ ও সরিয়ে ফেলেছে, কারণ তার ওই মুখ ছিল আসলে একটা মুখোশ, কিন্তু তার আসল মুখ আর নকল মুখ যে হুবহু এক রকম! সে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়লো, স্বপ্নের রহস্যটা নিয়ে একটু গোলমালে পড়ে গেল, আর তারপর সে তার বাবাকে আবিষ্কার করলো ক্যাপ্টেনের সঙ্গে, তিনি ব্র্যান্ডি মিশিয়ে পাহাড়ি কফি খাচ্ছিলেন, সুরার কারণে চোখ বেঁকে গেছে, কিন্তু তারা যে ফিরে চলেছেন সে বিষয়ে তাঁর মধ্যে কোনো অনিশ্চয়তা দেখা গেল না।
এখন তারা বন্দরে ঢুকছে। সরকারি বাজারের পাশের খাড়িতে অনেকগুলি জাহাজ নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্য দিয়ে ফারমিনাদের জাহাজ কোনো রকমে পথ করে এগিয়ে চললো। বাজার থেকে বিশ্রী গন্ধ ভেসে আসছিলো। সমুদ্রের ভেতর অনেক দূর পর্যন্ত ওই গন্ধ পাওয়া যেতো। ঝিরঝির করে সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি পড়ছিল, এখন তা তুমুল বর্ষণে পরিণত হল। টেলিগ্রাফ আপিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জাহাজটা দেখলো, বৃষ্টিতে তার পালগুলি নেতিয়ে পড়েছে, লাস অ্যানিমাস উপসাগর পেরিয়ে বাজারের অবতরণ সেতুর পাশে জাহাজটা নোঙর করলো। গতকাল সে সকাল থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল, তারপর হঠাৎ একটা অপরিকল্পিত তারবার্তার মাধ্যমে সে ঝোড়ো হাওয়ার কারণে জাহাজটি এখানে পৌঁছতে দেরি হবার খবর পায়। তাই সে আজ সকাল চারটা থেকে এখানে এসে পাহারা দিচ্ছিল। এখন সে লঞ্চের দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো, ওই লঞ্চে করে কয়েকজন যাত্রী ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কিছু দূর অগ্রসর হবার পর সেটা চড়ায় আটকে যায়, তখন কয়েকজন যাত্রীকে জল কাদা ভেঙে অবতরণ সেতুতে উঠে আসতে হল। বৃষ্টি থামার জন্য সবাই অপেক্ষা করলো কিন্তু আটটা বেজে গেলেও যখন বৃষ্টি থামলো না তখন একজন কৃষ্ণাঙ্গ কুলি কোমর জল ভেঙে জাহাজের রেলিং-এর কাছে গিয়ে সেখান থেকে ফারমিনা ডাজাকে পাঁজাকোলা করে তীরে নামিয়ে আনলো, কিন্তু সে ভিজে এমন চুপচুপ হয়ে গিয়েছিল যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে চিনতেই পারলো না।
তার সদ্য সমাপ্ত সফর তাকে কতটা পরিণত করেছে তা ফারমিনা ডাজা নিজেদের বন্ধ করে রাখা বাড়িতে প্রবেশ করে সেটাকে আবার বাসযোগ্য করার সুকঠিন কাছে ব্ৰতী হবার আগে পর্যন্ত উপলব্ধি করে নি। তাকে এ কাজে সাহায্য করার জন্য, তার ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে, নিজেদের পুরনো ক্রীতদাস বস্তি থেকে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারিকা গালা প্লাসিডিয়া ফারমিনা ডাজার কাছে চলে আসে। ফারমিনা এখন আর বাবার প্রশ্রয় আর কড়া শাসনে স্বভাব নষ্ট করে দেয়া একটি সন্তান মাত্র নয়, সে এখন ধূলাবালি আর মাকড়সার জালে আকীর্ণ বিরাট একটি সাম্রাজ্যের কর্ত্রী, একমাত্র ভালবাসার অপ্রতিরোধ্য শক্তি দ্বারাই এ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা সম্ভব, অন্য কিছু দ্বারা নয়। কাজটার দুরূহতা দ্বারা সে ভীত হল না, একটা অন্তর্নিহিত উজ্জীবিত সাহস তাকে অনুপ্রাণিত করলো, সে করতে পারবে না এমন কিছুই নেই। তাদের ফিরে আসার রাতেই ওরা যখন রান্না ঘরের বড় টেবিলে বসে গরম চকোলেট ও বিস্কুট খাচ্ছিল তখনই তার বাবা সংসার পরিচালনার সমস্ত ভার তার ওপর অর্পণ করেন এবং এ কাজটি তিনি এতোটা আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে করলেন যেন এটা ছিল একটা পবিত্র ধর্মীয় কৃত্য। তিনি বললেন, এই নাও, আমি তোমার হাতে সমর্পণ করছি তোমার জীবনের চাবি।
তার সতেরো বছরের সমস্ত শক্তি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে সে অকম্পিত হাতে চাবির ছড়াটি গ্রহণ করলো, সে যে শুধু তার ভালবাসার জন্য তার স্বাধীনতার প্রতিটি অণুপরিমাণ অর্জন করেছে সে সম্পর্কে সে পুরোপুরি সচেতন ছিল। রাতে সে একটা বাজে স্বপ্ন দেখলো। পরদিন, বিষণ্ন বৃষ্টিধারার মধ্যে দিয়ে, তার বারান্দার জানালা পথে ছোট পার্কটির দিকে তাকালো সে, আর তখন তার ঘরে ফেরার পর প্রথম নিরানন্দ অনুভূতি হল। পার্কে মুণ্ডুহীন বীরের ভাস্কর্য আছে, যে মার্বেলের বেঞ্চে বসে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার কবিতার বই পড়তো সেটা আছে, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে না দেখে সে বিস্মিত হল। সে তাকে এখন আর তার অসম্ভব প্রেমিক হিসেবে দেখে না, এখন সে তার হৃদয়-মন সমর্পণ করা অবধারিত স্বামী। তার অনুপস্থিতিতে যে সময় নষ্ট হয়েছে তার গুরুভার সে অনুভব করলো, বেঁচে থাকা যে কী সুকঠিন তা উপলব্ধি করলো সে, ঈশ্বরের দাবি অনুযায়ী তার মানুষটাকে যথাযথ ভালবাসার জন্য তার যে কী বিপুল পরিমাণ ভালবাসার প্রয়োজন হবে সেটা বুঝলো সে। কিন্তু ও পার্কে নেই কেন, বহুবার বৃষ্টি সত্ত্বেও ও ঠিক ওখানে এসে বসেছে, ওর কাছ থেকে কোনো খবর সে এখন পর্যন্ত পায় নি, কোনো রকম আসন্ন বিপদের সঙ্কেতও তার মনে জাগে নি, কিন্তু হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়ায় সে কেঁপে উঠলো। ও মারা যায় নি তো? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফারমিনা ওই অশুভ চিন্তা মন থেকে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল, কারণ তার আশু ফেরার খবর নিয়ে যেভাবে পাগলের মতো টেলিগ্রাফ চালাচালি হয় তার মধ্যে ফারমিনা বাড়ি ফেরার পর ওরা কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে সে ব্যাপারটা স্থির করতে ওরা ভুলে গিয়েছিল।
আসলে ফারমিনা ফিরে এসেছে কিনা সে সম্পর্কে ফ্লোরেন্টিনো নিশ্চিত ছিল না। শেষে রিওহাচার টেলিগ্রাফ অপারেটর তাকে জানালো যে নির্ধারিত জাহাজ শুক্রবার ছেড়ে যায় এবং সে জাহাজে ফারমিনা ও তার বাবা ছিল, কিন্তু প্রতিকূল হাওয়ার জন্য জাহাজটি নির্ধারিত দিনে পৌঁছতে পারে নি। শনিবার ও রবিবার ফ্লোরেন্টিনো ওদের বাড়িতে কোনো প্রাণের চিহ্ন দেখা যায় কিনা সেদিকে লক্ষ রেখেছিল, তারপর সোমবার সন্ধ্যার পর সে জানালার মধ্য দিয়ে একটা বাতিকে ঘরের ভেতর ঢুকতে দেখলো, তারপর রাত নটার একটু পরে সে বারান্দাওয়ালা শোবার ঘরে বাতিটাকে নির্বাপিত হতে দেখলো। সারা রাত তার ঘুম হল না। ভালবাসার প্রথম রাতগুলিতে তার যেরকম বমির প্রকোপ হয়েছিল এখনও প্রায় সে রকম হল। ট্রান্সিটো আরিজা ভোরে মোরগ ডাকার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েছিলেন, তার ভয় হল ছেলে বুঝি মাঝরাতে উঠোনে গিয়ে বসে আছে আর এখনো ভেতরে আসে নি, কিন্তু তিনি তাকে কোথাও দেখতে পেলেন না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা রাতেই জেটিতে চলে গিয়ে সেখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করে, প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করে, দিনের আলো না ফোটা পর্যন্ত আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। তারপর সকাল আটটায় সে প্যারিস ক্যাফের খিলানের নিচে এসে বসে, ক্লান্তিতে বিকলচিত্ত, কেমন করে সে ফারমিনা ডাজার কাছে তার সুস্বাগতম পৌঁছে দেবে সে চিন্তায় ব্যাকুল। আর এই সময়ে সে একটা প্রচণ্ড ভূমিকম্পের দোলা অনুভব করলো, তার মনে হল তার বুক বুঝি ভেঙে খান খান হয়ে যাবে।
ওই যে সে, ক্যাথিড্রালের খোলা চত্বর পার হয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে আছে ঝুড়ি বহন করা গালা প্লাসিডিয়া। তার স্কুলের ইউনিফর্ম ছাড়া ফারমিনা ডাজাকে ফ্লোরেন্টিনো এই প্রথম দেখলো। আগের চাইতে লম্বা হয়ে গেছে, আরো মার্জিত, আরো তীব্র, পরিণতির সংযমের ফলে তার সৌন্দর্য এখন আরো পরিশোধিত। তার চুলের বেণী আরো বড় ও ভরাট হয়েছে, তবে এখন সে আর ওটা পেছনে পিঠের ওপর না ফেলে সামনে নিয়ে এসেছে, আর এই সামান্য পরিবর্তনটুকুই যেন তার মধ্যে থেকে সমস্ত বালিকাসুলভ চিহ্ন মুছে নিয়েছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজের আসনে বসে তার স্বপ্নকে ক্যাথিড্রাল-চত্বর পেরিয়ে চলে যেতে দেখলো, ডাইনে-বাঁয়ে কোনো দিকে একটুও না তাকিয়ে। কিন্তু তারপরই যে অদম্য শক্তি তাকে চলৎশক্তিহীন করে দিয়েছিল তাই তাকে ওর পেছনে ছুটিয়ে নিয়ে গেল। ও ততক্ষণে ক্যাথিড্রালের মোড় ঘুরে বাজারের রুক্ষ খোয়া বাঁধানো রাস্তায় কানে তালা লাগানো হইচইয়ের মধ্যে মিশে গেছে।
সে ওকে অনুসরণ করলো, এমন ভাবে যেন ও তাকে দেখতে না পায়। সে লক্ষ করলো পৃথিবীর মধ্যে তার সব চাইতে প্রিয় মানুষটির সব মামুলি অঙ্গ-ভঙ্গি, ওর দেহ সৌষ্ঠব, সময়ের আগেই অর্জিত ওর পরিপক্বতা, এই প্রথম সে ওকে দেখলো ওর স্বাভাবিক অবস্থায়। যে স্বচ্ছন্দ সাবলীলতার সঙ্গে সে ভিড়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল তা দেখে সে অবাক হল। আর গালা প্লাসিডিয়া কেবলই লোকজনের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছিল, তার হাতের থলি-ঝুড়ি এখানে ওখানে আটকে যাচ্ছিল, ফারমিনাকে ধরবার জন্য মাঝে মাঝেই তাকে ছুটতে হচ্ছিল। কিন্তু ফারমিনা বাজারের রাস্তার তাবৎ বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সাবলীল ভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল, অন্ধকারের মধ্যে বাদুড়ের মতো, কারো সঙ্গে ওর ধাক্কা লাগছিলো না। ও এর আগে এসকোলাস্টিকা পিসির সঙ্গে প্রায়ই বাজারে এসেছে, কিন্তু ছোটখাটো দু’একটা জিনিস কেনার জন্য শুধু, কারণ ওর বাবাই সংসারের যাবতীয় জিনিস কিনতেন, শুধু আসবাবপত্র নয়, সব খাবার-দাবারের জিনিসও, এমনকি মেয়েদের কাপড়-জামাও। তাই তার এ সফল প্রথম অভিযান তাকে মুগ্ধ করলো, বালিকা বয়সের তার এই স্বপ্নকে কতো আদর্শায়িত করে রেখেছিল ও!
সাপুড়েরা ওকে একটা মিষ্টি রস কিনতে পিড়াপিড়ি করলো, ওই রস পান করলে প্রেম চিরস্থায়ী হবে। দোকানের দোরগোড়ায় খোলা ঘা প্রদর্শন করা ভিখিরির দল পয়সার জন্য কাকুতি মিনতি করলো ওর কাছে। এক নকল ইন্ডিয়ান ওর কাছে একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুমির বিক্রি করার চেষ্টা করলো। কিন্তু ও তাদের কারো প্রতিই কোনো দৃষ্টিপাত করলো না। ও বাজারের বিভিন্ন অংশে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরলো, কোনো পূর্বপরিকল্পিত গমনপথ অনুসরণ করে নি ও। সব জিনিসের আনন্দের অংশ নেবার জন্যই যেন ও তার খুশি মতো এক এক জায়গায় থামছিল। যেখানেই কিছু বিক্রি হচ্ছিল সেখানেই ও ঢুকলো, আর প্রতিটি জায়গাতেই সে কিছু না কিছু দেখলো যা তার মধ্যে বাঁচার আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে তুললো। বড় বড় সিন্দুকের মধ্যে রাখা কাপড়ের ভেতর সুগন্ধি পাতার ঘ্রাণ ওর ভারি ভালো লাগলো, ও তার গায়ে বুটিদার সিল্কের পোশাক জড়ালো, ও পূর্ণদৈর্ঘ্য আয়নায় নিজেকে দেখলো, মাদ্রিদের মেয়েদের পোশাকে সুসজ্জিত, চুলে চিরুনি গোঁজা, হাতে ফুল আঁকা একটা পাখা, আয়নাতে নিজের হাসি দেখে সে নিজেই মহা আমোদ পেল। বিদেশী খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা একটা দোকানে ঢুকে ও লবণ দেয়া হেরিং মাছের পিপার ঢাকনা খুললো, আর সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পড়লো উত্তর পূর্বাঞ্চলে সান হুয়া ডি লা সিনেগায় ওর শিশুকালের কথা। ও আলিকান্ত সামুদ্রিক বন্দরের সসিজ চেখে দেখলো, লিকরিস পাতার স্বাদ পেল ও তার মধ্যে, শনিবারের প্রাতরাশের জন্য ও দু’প্যাকেট কিনলো, তা ছাড়া কড় মাছের কয়েকটা ফালি আর রসে ভেজানো এক শিশি লাল জামও কিনলো ও। মশলার দোকানে ও সুগন্ধি পাতা নিজের হাতের তালুতে ঘষলো, শুধু তার ঘ্রাণ নেবার আনন্দের জন্য, এক মুঠ লবঙ্গ কিনলো, এক মুঠ মৌরি কিনলো, একটা আদা ও একটা জুনিপার গুল্মের শিকড়ও কিনলো। তারপর ও চোখে জলভরা হাসি নিয়ে মশলার দোকান থেকে বেরিয়ে এলো, ওখানে লাল ঝাল মরিচের গন্ধতরুর জল কিনলো, ওরা পারী থেকে সদ্য আমদানি করা একটা সুগন্ধী তার কানের পেছনে লাগিয়ে দিল, ধূমপানের পর নিঃশ্বাস সুরভিত করার জন্য একটা ট্যাবলেটও দিল ওকে।
এটা ঠিক যে ও জিনিসপাতি কেনার একটা খেলা খেলছিল, কিন্তু তার সত্যিকার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি ও কোনো রকম দ্বিধা না করে এবং এমন কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভাবে কিনছিলো যে কেউ ভাবতেও পারতো না যে ও প্রথমবারের মতো এই রকম বাজার সওদা করছে। তার কারণ, ও শুধু ওর নিজের জন্য বাজার করছিলো না, ও বাজার করছিলো তার জন্যও : টেবিলের জন্য বারো গজ লিনেন, বিয়ের শয্যার জন্য সুন্দর চাদর, যা সকাল নাগাদ উভয়ের গায়ের ঘামে আর্দ্র হয়ে উঠবে, ভালবাসার ভবনে উপভোগ করার জন্য ও তাদের উভয়ের জন্য ও প্রতিটি ক্ষেত্রে সবচাইতে ভালো জিনিসগুলি কিনলো, আর সে তাদের দাম চুকিয়ে দিল স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে, আর দোকানিরা তাদের মার্বেলের কাউন্টারের ওপর তা বাজিয়ে দেখলো শুধু তাদের মধুর শব্দ সানন্দচিত্তে উপভোগ করার জন্য।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা লুকিয়ে লুকিয়ে অবাক হয়ে ওকে দেখতে লাগলো। সে ওকে অনুসরণ করলো শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায়, অন্য বাড়ির কাজের মেয়েদের ঝুড়িতে ধাক্কা লেগে তার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার অবস্থা হয় কয়েকবার, মেয়েরা তার ক্ষমা প্রার্থনা করে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে, একবার ও তার এতো কাছ ঘেঁষে যায় যে সে ওর গায়ের গন্ধ পায় তার নাকে, আর ও যে তাকে লক্ষ করে নি আর একমাত্র কারণ ছিল ওর উদ্ধত অহংকারী পথচলা। তার কাছে ওকে মনে হল এতো সুন্দর, এতো চিত্তহরণকারী, সাধারণ মানুষের চাইতে এতো ভিন্ন রকম যে ইট বাঁধানো রাস্তায় ওর জুতার পেছন দিকের খটখট শব্দে আর সবাই কেন তার মতো বিচলিত হচ্ছে না, মৃদু হাওয়ায় ওর ওড়না একটু দুলে উঠলে আর সবার হৃদয় কেন তার মতো উন্মাতাল হয়ে উঠছে না, ওর বেণী এবং ওর হাতের ওঠানামায় এবং ওর সোনা ঝরা হাসি আর সবাইকে কেন তার মতো পাগল করে দিচ্ছে না তা সে বুঝতে পারলো না। ওর একটি ভাবভঙ্গিও তার নজর এড়ালো না, কিন্তু পাছে এই জাদুকরি প্রভাব ভেঙে যায় সেই ভয়ে সে ওর কাছে যেতে সাহস করলো না। কিন্তু ও যখন কলমপেশীদের চত্বরের প্রচণ্ড গোলমালের মধ্যে গিয়ে ঢুকলো তখন সে উপলব্ধি করলো আর দেরি করলে যে মুহূর্তটির জন্য সে এতো বছর অপেক্ষা করেছে ওই মুহূর্তটি চিরতরে হারিয়ে যাবে।
ফারমিনা ডাজা তার স্কুলের বান্ধবীদের মতোই মনে করতো যে কলমপেশীদের চতুর একটা সমূহ সর্বনাশের নিষিদ্ধ স্থান, সেখানে ভদ্রঘরের তরুণীরা কখনো যায় না। ছোট একটা খোলা চত্বরের উল্টো দিকে ছিল এই খিলান দেয়া জায়গাটা। সামনের খোলা চত্বরটায় দাঁড়িয়ে থাকতো ভাড়ায় যাবার জন্য ঘোড়ার গাড়ি ও গাধাটানা মালপত্র বহনকারী কিছু গাড়ি। ওইখানেই বাজার জমে উঠতো, হইচই বেড়ে যেতো। নামটার উৎপত্তি ঔপনিবেশিক যুগে, যখন কোট এবং শার্টের হাতে নকল কাফ লাগানো জামাকাপড় পরে কলমপেশীরা নানা ধরনের কাগজ লিখে দিয়ে দু’পয়সা রোজগারের জন্য ওখানে বসতো : কোনো অভিযোগ অথবা দরখাস্ত, আইন আদালতের সাক্ষ্য বা বিবৃতি, অভিনন্দন কিংবা সমবেদনা জানানো কার্ড, প্রেমের যে কোনো পর্বের জন্য উপযুক্ত প্রেমপত্র ইত্যাদি। এই জমজমাট বাজারের কুখ্যাতির জন্য অবশ্য তারা দায়ী ছিল না, তার মূলে ছিল অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালের কিছু খুচরো ফেরিওয়ালা। ওই ফেরিওয়ালারা ইউরোপীয় জাহাজগুলিতে করে চোরাই পথে আসা নানা রকম সন্দেহভাজন জিনিস বেআইনিভাবে বিক্রি করতো, যেমন অশ্লীল পোস্টকার্ড, যৌন ক্ষমতাবর্ধক মলম, বিখ্যাত ক্যাটালোনীয় কনডম যার মাথায় গোসাপের মূর্তি কিংবা ফুল, ব্যবহারকারীর ইচ্ছানুযায়ী যা হয় পতপত করতো, নয় ফুলের পাপড়ির মতো খুলে যেতো। ফারমিনা ডাজা বাজারের এই রাস্তার গতি প্রকৃতি ও স্বভাব চরিত্র সম্পর্ক তেমন অবহিত ছিলো না, ও কোনো কিছু না লক্ষ করে এগিয়ে গেল, বেলা এগারোটার সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ও একটুখানি ছায়াঘেরা আশ্রয় খুঁজছিল।
ও জুতা পালিশ করা ছেলে, পাখিওয়ালা, সস্তা বই পুঁথির ফেরিওয়ালা এবং ডাকিনী বিদ্যায় পারদর্শী উপজাতীয় চিকিৎসকদের হট্টগোলের মধ্যে ডুবে গেল। জনতার গোলমাল ছাপিয়ে শোনা গেল মিঠাইওয়ালাদের হাঁকাহাঁকি : আসুন, আনারসের মিষ্টি নিয়ে যান, নারকেলের মিঠাই যার তুলনা নাই, তুলনা নাই, আপনার চিনির জন্য চিনির রুটি নিয়ে যান, বাড়ি গিয়ে দুজনে হুটোপুটি করে খান। কিন্তু সে এই সব চেঁচামেচিতে কোনো কান দিলো না, এক কাগজ বিক্রেতার কেরামতি দেখে ও মুগ্ধ হয়ে গেল। সে জাদু কালির নানা রকম কায়দা দেখাচ্ছিল, রক্তের আবহমাখা লাল কালি, সমবেদনা জানিয়ে বাণী পাঠাবার জন্য বিষণ্নতার আবহমাখা কালি, অন্ধকারে পড়বার জন্য দ্যুতিমান কালি, অদৃশ্য কালি যার লেখা আলোর বিপরীতে ধরলে স্পষ্ট পড়া যায়। এই সবগুলি কালিই কিনবার কথা ভাবলো ও, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা খুব মজা পাবে, ওর চতুরালি দেখে অবাক হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও এক শিশি সোনালি কালিই কিনলো। এর পর ও গেল মিঠাই বিক্রেতার দিকে। বিশাল আকারের গোল কাচের পাত্র সামনে নিয়ে তারা বসে আছে। হইহল্লার জন্য কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছিল না, তাই ও আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ও কি কিনতে চায়। ও প্রতিটি মিঠাই কিনলো ছটা করে, ছটা দেবদূতের চুল, ছকৌটা টিনের দুধ, ছটা তিলের খাজা, ছটা কাসাভা পেস্ট্রি, ছটা চকলেট বার, ছটা রানীর টুকরা, ছটা এটা আর ছটা ওটা, সব কিছু ছটা করে, আর ও জিনিসগুলি একটা অসম্ভব সুন্দর ভঙ্গিতে গালা প্লাসিডিয়ার ঝুড়িতে ছুড়ে দিচ্ছিলো, মিঠাই আর চিনির সিরার উপর মাছি ভনভন করে উড়ছে, চারপাশে প্রচণ্ড হইহল্লা, অসহ্য গরমে মানুষের গায়ের ঘাম থেকে যেন ভাঁপ উঠছে, আর এরই মধ্যে ও ঘুরছিলো, কেনাকাটা করছিলো, ওকে যেন কিছুই স্পর্শ করছে না। ওর আচ্ছন্নভাব ভাঙ্গিয়ে দিলেন এক মিষ্টি স্বভাবের কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা, গোলগাল, সুশ্রী দেখতে, মাথায় রঙিন রুমাল বাঁধা, তিনি ওকে একটা কসাইর ছুরির মাথায় বেঁধানো ত্রিভুজাকৃতি একটুকরা আনারস খেতে দিলেন। ও গোটা টুকরাটা একবারে মুখে পুরে দিল, চাখলো, তারপর চিবুতে চিবুতে চোখ ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো। এমন সময় অসম্ভব চমকে উঠে ও যেখানে ছিল সেখানেই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লো। ঠিক তার পেছনে, এতো কাছে যে চারপাশের প্রচণ্ড কোলাহল সত্ত্বেও ও তার গলা পরিষ্কার শুনতে পেল : একজন মুকুটশোভিত দেবীর জন্য এটা কোনো উপযুক্ত স্থান নয়।
ও মাথা ঘুরিয়ে ওর চোখের কাছ থেকে এক হাতেরও কম দূরত্বে দেখলো সেই বরফশীতল দুটি চোখ, সেই নীল ধূসর মুখ, ভয়ে পাথরের মতো জমে যাওয়া ঠোঁট, ওর খুব কাছে গির্জায় মধ্যরজনীর উপাসনার সময় ভিড়ের মধ্যে প্রথমবার তাকে যেমন দেখেছিল ঠিক সেই রকম, কিন্তু এবার ভালবাসার উদ্বেলতার পরিবর্তে ও অনুভব করলো মোহভঙ্গের অতল গভীরতা। এক মুহূর্তের মধ্যে তার ভুলের বিশালতা তার চোখে ধরা পড়লো, আর আতঙ্কিত হয়ে ও নিজেকে জিজ্ঞাসা করলো, কেমন করে ও এতো দীর্ঘকাল ধরে এবং এতো প্রচণ্ড আবেগের সঙ্গে একটা অলীক কল্পনা নিজের বুকের মধ্যে লালন করেছিল। সে কোনো রকমে শুধু ভাবলো, হা ভগবান, বেচারা! আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, কিছু বলতে চাইলো, ওকে অনুসরণ করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ফারমিনা ওর হাতের একটা দোলায় তাকে ওর জীবন থেকে মুছে ফেলে দিল। ও বললো, না, প্লিজ! ভুলে যাও সব কিছু।
সেদিন অপরাহ্ণে, ওর বাবা যখন দিবানিদ্রায় মগ্ন, তখন ও গালা প্লাসিডিয়ার হাত দিয়ে দু’লাইনের একটা চিঠি পাঠালো: আজ তোমাকে যখন আমি দেখলাম তখন আমি বুঝলাম যে আমাদের মধ্যে যা বিরাজ করছে তা একটা মোহ ও বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। গালা গ্লাসিডিয়া তাকে ফেরত দিল তার টেলিগ্রামগুলি, তার কবিতা, তার শুকনো ক্যামেলিয়া এবং তাকে অনুরোধ জানালো সে যেন ফারমিনা ডাজার চিঠিপত্র এবং তাকে দেয়া উপহারগুলি ফেরত পাঠিয়ে দেয়, এসকোলাস্টিকা পিসির প্রার্থনা পুস্তক, ওর বিশেষ বাগানের পত্রপল্লব, সন্ত পিটার ক্লাভিয়েরের পোশাকের একবর্গ সেন্টিমিটার কাপড়ের টুকরো, ওর স্কুলের ইউনিফর্মের সিল্কের ফিতা দিয়ে বাঁধা ওর পনেরো বছর বয়সের বেণী। এর পরের কয়েকদিন ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাটলো অর্ধোন্মাদ অবস্থায়। মরিয়া হওয়া অসংখ্য চিঠি লিখলো সে ওকে, গালা প্রাসিডিয়াকে চিঠিগুলি ওকে পৌঁছে দেবার জন্য মিনতি করলো বারবার, কিন্তু পরিচারিকা বললো যে সে শুধু ফারমিনার দেয়া উপহারগুলি ফেরত দিয়ে যাবে, তার ওপর স্পষ্ট নির্দেশ আছে, আর কোনো কিছু সে নিতে পারবে না। এতো প্রবলভাবে সে একথা বললো যে শেষ পর্যন্ত ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সব কিছু ফেরত পাঠালো, শুধু বেণীটা দিল না, সেটা সে ফারমিনা ডাজার নিজের হাতে তুলে দেবে, তখন এক মুহূর্তের জন্য হলেও সে ওর সঙ্গে কথা বলতে পারবে। কিন্তু ফারমিনা ডাজা রাজি হল না। ট্রান্সিটো আরিজার ভয় হল পাছে তাঁর ছেলে কোনো মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, তাই তিনি তাঁর আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ফারমিনা ডাজার সঙ্গে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য একটি সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলেন। ফারমিনা ডাজা নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় তাঁর সঙ্গে দেখা করলো, তাঁকে ভেতরে বসবার আমন্ত্রণ জানালো না, তার দুর্বলতার কোনো চিহ্ন মাত্র দেখালো না। দু’দিন পরে, মায়ের সঙ্গে বেশ কিছুটা তর্কাতর্কির শেষে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার ঘরের দেয়াল থেকে রঙিন কাচের আধারে রক্ষিত বেণীটা নামিয়ে দিল। সে ওটা ওখানে সাজিয়ে রেখেছিল কোনো সন্তের পবিত্র চিহ্নের মতো। ট্রান্সিটো আরিজা সোনালি সুতার কাজ করা মখমলের বাক্সে ওটা তাঁর নিজের হাতে ফারমিনাকে ফেরত দিয়ে এলো। এর পর উভয়ের দীর্ঘ জীবনকালে ওদের বেশ কয়েকবারই আকস্মিক ও ক্ষণিক দেখা হয়েছে, কিন্তু একা নির্জনে ফারমিনা ডাজাকে দেখার বা ওর সঙ্গে কথা বলার আর একটি সুযোগও ফ্লোরেন্টিনো পায় নি। ওই সুযোগ সে পেল একান্ন বছর নয় মাস চার দিন পর, যখন ফারমিনার বৈধব্য জীবনের প্রথম রাতেই সে তার চিরন্তন বিশ্বস্ততা ও চিরস্থায়ী ভালবাসার প্রতিশ্রুতি পুনর্বার ব্যক্ত করলো।
আঠাশ বছরের ডক্টর জুভেনাল উরবিনো ছিলেন সে অঞ্চলের সব চাইতে আকাঙ্ক্ষিত অকৃতদার পুরুষ। তিনি দীর্ঘদিন বাড়িতে কাটিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, সেখানে ভেষজ ও শৈল্য চিকিৎসা বিদ্যায় উচ্চতর পর্যায়ে পড়াশোনা সমাপ্ত করেছেন এবং দেশের মাটিতে পা দেবার পর থেকেই তিনি যে বিদেশে এক মুহূর্তও সময়ের অপচয় করেন নি তার প্রবল নিদর্শন রাখতে শুরু করেন। তিনি বিদেশে যাবার প্রাক্কালে যেমন ছিলেন ফিরে এলেন তার চাইতে বেশি খুঁতখুঁতে হয়ে, তবে নিজের স্বভাবের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আগের চাইতে বেড়েছে। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে তাঁর মতো এত কঠোর এবং তাঁর অধীত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এত বিদ্বান আর কেউ ছিল না। তাছাড়া সমকালীন সঙ্গীতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর মতো এত ভালো নাচতেও কেউ পারতো না, পিয়ানোতে তাঁর মতো এত নতুন নতুন সুরও আর কেউ বাজাতে পারতো না। তাঁর ব্যক্তিগত মোহিনী শক্তি ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পত্তির নিশ্চিতি দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে মেয়েরা কে তাঁর সঙ্গে সময় কাটাবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে গোপন লটারি করতো, তিনিও তাদের সঙ্গকামনায় বাজি ধরতেন, তবে নিজেকে তিনি সর্বদা অক্ষত ও লোভনীয় করে রেখেছেন এবং কখনোই নিজেকে শোভনতা- শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যেতে দেননি। কিন্তু যখন কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই ফারমিনা ডাজার সাধারণ অনিভাজাত মোহিনী শক্তির সামনে তিনি ধরাশায়ী হলেন তখন উপরোক্ত পর্বের সমাপ্তি ঘটলো।
তিনি বলতে ভালোবাসতেন যে ওটা ছিল একটা চিকিৎসা সংক্রান্ত ভুল। ব্যাপারটা যে ঘটতে পারে তাই তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না, বিশেষ করে সেই সময়ে যখন তাঁর সকল শক্তি ও আবেগ কেন্দ্রীভূত ছিল তাঁর এই প্রিয়তম শহরের নিয়তি নিয়ে, যে শহর সম্পর্কে তিনি প্রায়ই এবং দ্বিতীয় চিন্তা ছাড়াই বলতেন যে সারা দুনিয়ায় এটা ছিল অদ্বিতীয়। পারীতে সাময়িক কোনো প্রিয়াকে বাহু পাশে আবদ্ধ করে শরতের বিকালে পায়চারি করতে করতে তাঁর মনে হত ওই রকম স্বর্ণালী অপরাহ্নের চাইতে নির্ভেজাল মধুময় আনন্দক্ষণ আর কোথাও পাওয়া অসম্ভব। কোনো বাড়ির আগুনের চুল্লি থেকে বাদাম কাঠের গন্ধ ভেসে আসছে, শোনা যাচ্ছে অ্যাকর্ডিয়নের বিষণ্ণ মন্থর বাজনার শব্দ, খোলা চত্বরে বসে পরম লোভী প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরকে চুমু খেয়ে চলেছে, কিন্তু তখনো তিনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারতেন যে তাঁর কাছে তাঁর ক্যারিবীয় এপ্রিলের একটি মুহূর্তের মূল্য ছিল ওই সব আনন্দ উপকরণের চাইতে বেশি। তখনো তাঁর বয়স ছিল কম, হৃদয়ের স্মৃতি যে সর্বদা মন্দকে বাদ দিয়ে ভালোকে বড় করে তোলে সেটা তাঁর জানা হয় নি। কিন্তু ওই কৌশলকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তার কারণেই অতীতের গুরুভার বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়। কিন্তু এখন, জাহাজের রেলিং-এর গায়ে দাঁড়িয়ে, ঔপনিবেশিক জেলার সাদা অন্তরীপ আবার দেখতে দেখতে, বাড়িগুলির ছাদের উপর নিশ্চল শকুনিদের লক্ষ করতে করতে, গরিব মানুষগুলিকে বারান্দায় ধোয়া কাপড় শুকাতে দিতে দেখতে দেখতে, তিনি বুঝতে পারলেন স্মৃতিকাতরতার প্রবঞ্চনার কতো সহজ এবং কতো প্রবল শিকারে তিনি পরিণত হয়েছেন।
জাহাজ উপসাগরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললো। চারিদিকে অসংখ্য পশুর মৃতদেহ ভাসছে। দুর্গন্ধ এড়াবার জন্য বেশির ভাগ যাত্রী নিজেদের ক্যাবিনে ঢুকে পড়েছে। যুবক ডাক্তার পশমের নিখুঁত স্যুট পরে তক্তার ওপর দিয়ে হেঁটে নিচে নেমে গেলেন, তাঁর চিবুকে তরুণ পাস্তুরের মতো একটুখানি দাড়ি, মাথার চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, মাঝখানে সিঁথি কাটা, তাঁর গলায় একটা ডেলা উঠে আসছিলো, ভয়ে নয়, বেদনায়, তিনি তাকে সসংযমে সামলে নিলেন। জাহাজঘাট ছিল প্রায় জনশূন্য, খালি পায়ে ইউনিফর্মবিহীন সৈন্যরা জায়গাটা পাহারা দিচ্ছে, তার বোনেরা আর মা আর খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু তার জন্য অপেক্ষা করছে। কেতাদুরস্ত ভাবভঙ্গি সত্ত্বেও বন্ধুদের মনে হল নিষ্প্রভ এবং প্রত্যাশাহীন। তারা এমন ভাবে চলমান গৃহযুদ্ধের সঙ্কটের উল্লেখ করলো যেন সেটা বহু দূরের এবং বিদেশের কোনো ব্যাপার। কিন্তু তাদের সবার গলায় বিষয়টা এড়িয়ে যাবার কম্পনের সুর শোনা গেল, চোখে ফুটে উঠলো অনিশ্চিতির ভাব, তাদের মুখের কথার সঙ্গে যার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তার সব চাইতে বিচলিত হলেন মাকে দেখে। এখনও অল্প বয়েসী, এই মহিলা তাঁর সুরুচি ও সামাজিক কর্মোদ্যোগ দ্বারা তার জীবনকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছেন, কিন্তু এখন তাঁর বিধবার কালো পোশাক থেকে ভেসে আসা কপূরের গন্ধের মধ্যে মনে হল তিনি যেন ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছেন, ঝরে পড়ছেন। পুত্রের দুর্ভাবনার মধ্যে তিনি নিশ্চয়ই নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন, তাই তাৎক্ষণিক আত্মরক্ষার তাগিদে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ওর চামড়া মোমের মতো এত মলিন দেখাচ্ছে কেন।
জবাবে ডাক্তার বললেন, ‘মা, ওখানকার জীবনই ওই রকম। পারী সবাইকে সবুজ বানিয়ে ফেলে।’
একটু পরে মায়ের পাশে বন্ধ গাড়িতে বসে গরমে তাঁর প্রায় দম আটকে আসছিল। জানালা পথে ঢুকে পড়া নিষ্ঠুর বাস্তবতা তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। সমুদ্রকে দেখাচ্ছিল ছাই-এর মতো, উচ্চবংশীয় অভিজাত ব্যক্তিদের পুরনো প্রাসাদগুলি ভিখিরিদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ভেঙে পড়ার পথে, আর খোলা নর্দমাগুলি থেকে ভেসে আসা মৃত্যুর বাষ্প থেকে ব্যগ্র মল্লিকার গন্ধকে আলাদা করে চেনা অসম্ভব হয়ে উঠছিলো। তাঁর মনে হল সবকিছু যেন আগের চাইতে ছোট, দরিদ্র এবং দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে গেছে। রাস্তার পাশের আবর্জনার স্তূপে এত বেশি সংখ্যক বুভুক্ষু ইঁদুর ছোটাছুটি করছিল যে তাদের গাড়ির ঘোড়া প্রায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। ওঁদের বাড়ি ছিল ভাইসরয়দের জেলার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। বন্দর থেকে বাড়িতে যাবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার সময় ডাক্তারের মনে হল যে তাঁর স্মৃতিকাতরতার যোগ্য কোথাও কিছু নেই। পরাজয় মেনে তিনি তাঁর মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, যেন তাঁর নীরব অশ্রু বিসর্জন মায়ের চোখে না ধরা পড়ে।
মার্কুইস ডি কাসালডুয়েরার ভূতপূর্ব প্রাসাদ, উরবিনো ডি লা কল পরিবারের ঐতিহাসিক বাসভবন, পরিপার্শ্বের ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা পায় নি। নিরানন্দ প্রাঙ্গণ অতিক্রম করে বাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো ভগ্ন হৃদয়ে সে সত্যটি উপলব্ধি করলেন! তিনি ভেতরের বাগানের ফোয়ারাটিকে দেখলেন ধূলিধূসরিত, ফুলের বেডগুলি আগাছা ও কাঁটালতায় আকীর্ণ, সেখানে গোসাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কয়েকটা মার্বেলের পাত উধাও হয়ে গেছে, তামার রেলিং দেয়া প্রশস্ত সিঁড়ির কয়েকটি মার্বেলের পাত এখানে ওখানে ভাঙ্গা। এই সিঁড়ি দিয়েই যেতে হয় বাড়ির প্রধান কক্ষগুলিতে। জুভেনাল উরবিনোর বাবাও ছিলেন একজন চিকিৎসক, তবে তিনি যতখানি উল্লেখযোগ্য চিকিৎসক ছিলেন তার তুলনায় তাঁর মধ্যে আত্মত্যাগের প্রবণতা ছিল বেশি। ছ’বছর আগে এখানে মারাত্মক এশীয় কলেরা মহামারী আকারে দেখা দেয় আর ওই দুর্যোগের সময় জুভেনালের বাবা মৃত্যুবরণ করেন, আর তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে এ বাড়ির প্রাণেরও মৃত্যু ঘটে। আগে জুভেনালের বাবার সময় এ বাড়িতে প্রায়ই কবিতার আসর ও গানের জলসা বসতো, এখন তাঁর মা প্রবর্তন করেছেন নয়দিনব্যাপী ধর্মীয় উপাসনার অনুষ্ঠান। তাঁর দুই বোন, তাদের উচ্ছল আনন্দ উৎসব উপভোগের প্রবণতা সত্ত্বেও, প্রবেশ করেছে মঠের জীবনে।
গৃহে প্রত্যাবর্তনের প্রথম রাতে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো একটুও ঘুমাতে পারেন নি। অন্ধকার আর নৈঃশব্দ তাঁকে আতঙ্কিত করে তোলে। তিনি হোলি স্পিরিটকে স্মরণ করে তিন বার মালা জপলেন, যতগুলি প্রার্থনা তিনি স্মরণ করতে পারলেন মনে মনে সবগুলি আবৃত্তি করলেন যেন রাত্রির তাবৎ বিপর্যয়-বিভীষিকার হাত থেকে তিনি রক্ষা পান। ইতিমধ্যে অর্ধেক বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে তাঁর ঘরে একটা বাঁকানো চষ্ণু লম্বা পায়ের কারলিউ ঢুকে পড়েছিল, পাখিটা ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডেকে উঠতে থাকলো। পাশের বাড়িটি ছিল মেয়েদের উন্মাদ নিবাস, সেখান থেকে পাগলিনীদের দুঃস্বপ্ন তাড়িত চিৎকার তাঁকে অস্থির করে তুললো। একটা জলের পাত্র থেকে মুখ-হাত ধোয়ার গামলায় টিপ টিপ করে জল পড়ছিল, সেই শব্দ সারা বাড়িতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল। লম্বা পায়ের কারলিউটা তাঁর ঘরের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। অন্ধকার সম্পর্কে তাঁর ছিল জন্মগত ভয়, আর এই বিশাল নিদ্রিত পুরীতে তিনি এখন অনুভব করলেন তাঁর মৃত পিতার অদৃশ্য উপস্থিতি। কারলিউটা যখন রাতা মোরগগুলির সঙ্গে সকাল পাঁচটার ডাক ডেকে উঠলো তখন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো নিজেকে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করে স্থির করলেন যে তাঁর জঞ্জাল আকীর্ণ এই স্বদেশে তিনি আর একটি দিনও থাকবেন না। কিন্তু কালের অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মায়া-মমতা ও তাঁর সব শ্রেণীর অবিবাহিতা তরুণীদের সাগ্রহ মনোযোগ যুক্ত হয়ে তাঁর প্রথম অনুভূতির তিক্ততা অনেকখানি কমিয়ে দিল। একটু একটু করে তিনি অক্টোবরের গুমোট গরম, নানা রকম গন্ধের তীব্রতা, বন্ধুদের দ্রুত সিদ্ধান্তসমূহ, আগামীকাল দেখা যাবে, ডাক্তার, কিছু ভেবো না, এসবের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন এবং অবশেষে অভ্যাসের মায়াজালে আটকে পড়লেন। আত্মসমর্পণের সপক্ষে একটা সহজ যুক্তি দাঁড় করাতে তাঁর বেশি সময় লাগলো না। তিনি আপন মনে বললেন, এটা তাঁর ভুবন, এই দুঃখী, পীড়াদায়ক ভুবন, ঈশ্বর যেটা তাঁকে দিয়েছেন, এর প্রতি তাঁর একটা দায়-দায়িত্ব আছে।
তিনি সব কিছুর আগে বাবার অফিসটার দখল নিলেন। তিনি কাঠের তৈরি বিলেতের শক্ত অনুজ্জ্বল আসবাবপত্র স্থানান্তরিত করলেন না, সকালের তুষার শীতল আবহাওয়ায় সেগুলি যেন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, কিন্তু ভাইসরয়দের সময়ের বিজ্ঞান চর্চা ও রোমান্টিক ভেষজ চিকিৎসা সম্পর্কিত সব কাগজপত্র তিনি বাড়ির চিলে কোঠায় নির্বাসন দিলেন, আর কাচের দরজার পিছনে বই-এর তাকগুলি পূর্ণ করে ফেললেন নতুন ফরাসি স্কুলের লেখালেখি দিয়ে। অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া ছবিগুলি তিনি দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেললেন, স্বস্থানে শুধু দুটি জিনিস রাখলেন, জনৈক চিকিৎসক এক রোগিনীর নগ্ন দেহের জন্য মৃত্যুর সঙ্গে যে ছবিতে তর্ক করছেন সেই ছবিটি, আর গথিক অক্ষরে মুদ্রিত হিপোক্র্যাটিসের শপথ। তারপর নামিয়ে দেয়া শূন্য স্থানে তাঁর বাবার পাওয়া একমাত্র ডিপ্লোমাটির পাশে টানিয়ে রাখলেন ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতম অনার্সসহ পাওয়া তাঁর নিজের নানা ডিগ্রি ও সম্মাননার কাগজ।
তিনি মিসারিকোর্ডিয়া হাসপাতালে সর্বশেষ ধারণাগুলি চালু করতে চেষ্টা করলেন কিন্তু তাঁর তারুণ্যদীপ্ত উদ্দীপনায় কাজটা যত সহজ ভেবেছিলেন তত সহজ হল না। পুরুষ পরাম্পরাগত কুসংস্কারগুলির সঙ্গে ওই প্রাচীনপন্থী স্বাস্থ্য ভবনটির বন্ধন ছিল অতিশয় দৃঢ়, যেমন খাটের পায়াগুলি জলভর্তি পাত্রে বসাতে হবে যেন রোগব্যাধি তার গা বেয়ে উপরে উঠে আসতে না পারে, অথবা ডাক্তারকে সন্ধ্যাকালীন সম্পূর্ণ পোশাক পরিচ্ছদ পরে, হাতে শ্যাময় চামড়ার দস্তানা এঁটে অস্ত্রোপচারের ঘরে ঢুকতে হবে কারণ ওই রকম শোভনতা ও সৌন্দর্যই রোগীকে সেপ্টিকের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার অব্যর্থ প্রতিষেধক রূপে বিবেচিত হত। এই নবাগত তরুণ ডাক্তার রোগীর দেহে চিনির উপস্থিতি নির্ধারণের জন্য তার প্রস্রাবের স্বাদ পরীক্ষার কথা বলল, সে শারকট এবং ট্রশো থেকে এমন ভাবে উদ্ধৃতি দিল যেন ওরা তার রুমমেট ছিল, প্রবীণ ডাক্তারদের কাছে এসব অসহ্য মনে হল। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো তাঁর ক্লাসে ছাত্রদের টিকা দানের মারাত্মক ঝুঁকি সম্পর্কে সাবধান করে দিলেন, আবার সাপসিটারি দেয়ার নতুন প্রথা সম্পর্কে তাঁর সন্দিগ্ধ আস্থার কথা ব্যক্ত করলেন। সব কিছুর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ দেখা গেল। তাঁর পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা, নাগরিক কর্তব্য সম্পর্কে তাঁর পাগলের মতো উগ্র বোধ, যে দেশে সবাই সারাক্ষণ উদ্ভট কৌতুকে মেতে থাকে সেখানে তাঁর শ্লথ রস জ্ঞান, প্রকৃতপক্ষে তাঁর সব কিছুই ছিল অন্যদের সব কিছুর বিরোধী আর এগুলি তাঁর সব চাইতে বেশি বয়সের প্রবীণ সহকর্মীদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তুললো, আর অল্প বয়সী সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করলো তাঁর বিরুদ্ধে লুকিয়ে চুরিয়ে চতুর ঠাট্টা-বিদ্রূপের বান নিক্ষেপ করতে।
শহরের স্বাস্থ্য রক্ষা ব্যবস্থার অভাব তাঁর সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তার কারণ হল। স্পেনীয় নর্দমাগুলি ভর্তি করে দেবার জন্য তিনি সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন করলেন, ওই নর্দমাগুলি ছিল ইঁদুরের এক সুবিশাল প্রজনন ক্ষেত্র, তিনি তার জায়গায় ভালোভাবে আবৃত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরামর্শ দিলেন, যার ফলে চিরকাল যেমন হয়েছে সেই রকম সমস্ত ময়লা গিয়ে বাজারের কাছের খাড়িতে আর পড়বে না, তার পরিবর্তে সেটা গিয়ে পড়বে দূরের কোনো একটা জল নির্গমন প্ৰণালীতে। ঔপনিবেশিক ভবনগুলিতে সেপ্টিক ট্যাঙ্কসহ শৌচাগারের সুব্যবস্থা ছিল, কিন্তু নগরীর দুই-তৃতীয়াংশ জনগণ বাস করতো জলাভূমি সংলগ্ন ঝুপড়িতে, তারা খোলা আকাশের নিচে যত্রতত্র মল ত্যাগ করতো। ওই মল রৌদ্রে শুকাতো, ধুলায় পরিণত হত, তারপর সবাই তা বড়দিনের আনন্দ-উৎসব উপভোগের সময় ডিসেম্বরের শীতল শান্ত বাতাসের সঙ্গে নাক ভরে টেনে নিতো। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো নগর পর্ষদ কর্তৃক একটা বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করার চেষ্টা করেন যেন গরিবরা নিজেরাই নিজেদের শৌচাগার নির্মাণ করতে শিখতে পারে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে তাদের যাবতীয় আবর্জনা কাঁটাবনের ঝাড়ের উপর ছুড়ে ফেলে এসেছে, এখন সে জায়গা একটা দুর্বিষহ গলিত পচা স্থানে পরিণত হয়েছে। ডাক্তার চেষ্টা করলেন ওরা যেন তার পরিবর্তে তাদের সমস্ত আবর্জনা একটা নির্দিষ্ট স্থানে জমা করে, তারপর সপ্তাহে অন্তত দু’দিন লোকজনের বসতির বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়ে তা পুড়িয়ে দেয়, কিন্তু তাঁর এ প্রয়াস সফল হল না।
পানীয় জলের মারাত্মক বিপদ সম্পর্কে ডাক্তার সচেতন ছিলেন। একটি কৃত্রিম জলাধার নির্মাণের ধারণাটাই অনেকের কাছে মনে হল অবাস্তব। যারা এই ধারণাকে সমর্থন করতে পারতো তাদের সবারই নিজ নিজ ভূগর্ভস্থ চৌবাচ্চা ছিল, সেখানে বছরের পর বছর ধরে সঞ্চিত বৃষ্টির জলের উপর পুরু ময়লার স্তর জমে থাকতো। সেই সময় সংসারের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান তৈজসপত্রের মধ্যে ছিল কাঠের জল সংগ্রহকারী পাত্র, যেখান থেকে পাথরের ফিল্টার দিয়ে দিনরাত ফোঁটা ফোঁটা করে বিশালাকার মাটির জালায় গিয়ে ওই জল পড়তো। পাছে কেউ যে অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র ডুবিয়ে জল তোলা হত সেটার সাহায্যে ওই জল পান করে ফেলে সেজন্য পেয়ালাটার চারপাশ ভেঙ্গে তীক্ষ্ণ সুচিমুখ করে রাখা হত। কালো মাটির জালায় রাখা ওই জল ছিল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ এবং ঠাণ্ডা, আর তার স্বাদ ছিল অরণ্যের মতো। কিন্তু ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর চিত্ত বাইরের এই সুন্দর পবিত্র রূপ দেখে ভুললো না, কারণ তিনি জানতেন যে সকল রকম সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও মাটির প্রতিটি জালার নিচের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ে বাস করতো অসংখ্য জলের কীট। তাঁর শৈশবে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক ধরনের মরমীয়া বিস্ময়ের সঙ্গে এই জলের পোকাগুলি লক্ষ করেছেন। অনেকেই মনে করতো এই সব পোকা এক আধিভৌতিক জগতের প্রাণী, নিস্তরঙ্গ জলের তলায় বাস করে এরা কুমারী তরুণীদের উদ্দেশে প্রেম নিবেদন করে এবং সে প্রেম প্রত্যাখ্যাত হলে নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেয়। বালক বয়সে তিনি দেখেছেন ওদের আহ্বানে সাড়া না দেয়ায় ওরা কি ভাবে লাজারা কন্ডি নাম্নী এক স্কুল শিক্ষিকার বাড়িঘর তছনছ করে দেয়, বড় বড় পাথর ছুঁড়ে তার জানালা ভেঙে ফেলে। ওই সব পাথর তিনি দেখেছেন, লাজারা কন্ডির বাড়ি পর্যন্ত জলে ভেজা কাচের পদচিহ্ন রেখাও তিনি দেখেছিলেন। তাই ওই জলের পোকাগুলি যে আসলে মশার লার্ভা, মশককীটের আদ্যাবস্থা, সেটা উপলব্ধি করতে তাঁর অনেক দিন লাগে। কিন্তু ব্যাপারটা একবার উপলব্ধি করার পর তিনি আর সেটা কখনো ভুললেন না। তিনি বুঝলেন যে শুধু মশার লার্ভা নয়, আমাদের ওই সাধারণ পাথরের ফিল্টারের মধ্য দিয়ে ওই জাতীয় আরো অনেক তথাকথিত আধিভৌতিক প্রাণী অক্ষত অবস্থায় আমাদের পানীয় জলের মধ্যে অতি সহজে ঢুকে যাচ্ছে।
অনেককাল ধরে চৌবাচ্চার ওই জলকে সবাইবিশেষ সম্মানের চোখে দেখতো। বহু লোক মনে করতো যে তাদের অণ্ডকোষের হার্নিয়ার কারণ হচ্ছে ওই জল। তারা তাদের অণ্ডকোষের স্ফীতির জন্য কিছুমাত্র ব্রিত বোধ করতো না, পক্ষান্তরে তার মধ্যে একটা দেশপ্রেমজাত ঔদ্ধত্য অনুভব করতো। জুভেনাল উরবিনোর তার প্রাথমিক স্কুল জীবনের কথা মনে আছে। তিনি ভয়ার্ত চোখে দেখেছেন কিছু কিছু মানুষ তাদের বিশাল অণ্ডকোষ একটা ঘুমন্ত শিশুর মতো তাদের দু’পায়ের মধ্যে আটকে রেখে নিজেদের বাড়ির দোরগোড়ায় বসে আছে, তপ্ত অপরাহ্নে পাখা নেড়ে অণ্ডকোষের গায়ে হাওয়া দিচ্ছে। এ সম্পর্কে একটা প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী ঝড়ের রাতে তাদের হার্নিয়া থেকে একটা শোকার্ত পাখির শিসের ধ্বনি উঠতো, আর নিকটবর্তী কোনো স্থানে কেউ শকুনের পাখা পোড়ালে তাদের অণ্ডকোষ অসহ্য যন্ত্রণা বাঁকাচোরা হয়ে যেতো। তবু এই সব কষ্টের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতো না, কারণ ভালোভাবে? বহন করা বড় আকারের একটি বিদীর্ণ অণ্ডকোষের মধ্যে অনেকেই দেখতো পুরুষোচিত মর্যাদার এক চমৎকার প্রকাশ। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো যখন ইউরোপ থেকে ফিরে আসেন তখনই তিনি বৈজ্ঞানিক দিক থেকে এসব বিশ্বাসের অসারতার বিষয়টি জানতেন কিন্তু লোকজনের মনে স্থানীয় কুসংস্কারগুলি ছিল অত্যন্ত গভীরভাবে প্রোথিত, তাই তিনি যখন চৌবাচ্চার জলকে ধাতব পদার্থের সাহায্যে সমৃদ্ধ করার প্রস্তাব দিলেন ওরা তখন তা প্রত্যাখ্যান করলো, পাছে অণ্ডকোষের মর্যাদাকর স্ফীতি ও বিদারণের যে শক্তি জলের মধ্যে আছে তা ধ্বংস হয়ে যায়।
দূষিত জল ছাড়া অন্যান্য কিছু জিনিসও ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে ভীত করে তোলে। সরকারি বাজারের স্বাস্থ্য রক্ষার ঘাটতির দিকটা তাঁকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করলো। লাস অ্যানিমাস উপসাগরের পাশে বিশাল একটা জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে ওই বাজার গড়ে তোলা হয়। উপসাগরে অ্যান্টিল থেকে আসা জাহাজগুলি ভিড়তো। সমকালীন একজন বিখ্যাত সফরকারী এ বাজারকে পৃথিবীর সব চাইতে বৈচিত্র্যময় বাজারগুলির একটি বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুতপক্ষে এটা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও কোলাহলমুখর, তবে, সম্ভবত, সব চাইতে ভয়ঙ্করও। এই বাজার গড়ে ওঠে নিজেদের আবর্জনার স্তূপের উপর, খামখেয়ালি জোয়ারের স্রোতধারার দয়ার উপর এটা ছিল নির্ভরশীল, পয়ঃপ্রণালীগুলি থেকে যে জঞ্জাল উপসাগরে এসে পড়তো উপসাগর আবার সেগুলি এখানেই উগরে দিতো। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী কশাইখানা থেকে জবাই করা পশুর অব্যবহার্য যাবতীয় জিনিস এখানেই ছুড়ে ফেলা হত- কর্তিত মস্তক, পচন ধরা নাড়িভুঁড়ি, মল ইত্যাদি, কাদামাটি মাখা রক্তের মধ্যে এগুলি ভাসতো, সূর্যের আলোয় আর তারার আলোয়। শকুনির দল ইঁদুর আর কুকুরের পালের সঙ্গে এগুলির জন্য লড়াই করতো সারাক্ষণ, আর অন্যদিকে বাজারের দোকান ঘরের সামনে ঝোলানো থাকতো সোটাভেন্টো থেকে আনা হরিণের মাংস আর রসালো খাসি মোরগের রান, আর মাটিতে শোলার মাদুরের উপর সাজিয়ে রাখা দেখা যেত আরজোনা থেকে আনা বসন্তকালীন শাক-সব্জীর সম্ভার। ডাক্তার উরবিনো জায়গাটাকে স্বাস্থ্যসম্মত করতে চাইলেন। তিনি চাইলেন যে কশাইখানা স্থানান্তরিত হয়ে অন্যত্র নির্মিত হোক, একটা আচ্ছাদিত বাজার হোক, রঙিন কাচের ছোট বুরুজ থাকুক তার বার্সিলোনায় তিনি যেমন দেখে এসেছেন, সেখানে খাদ্য দ্রব্যসামগ্রী এমন পরিচ্ছন্ন ও চমৎকার ভাবে সাজানো থাকে যে মনে হয় ওসব খেয়ে ফেলা একটা লজ্জাকর ব্যাপার। কিন্তু তার সব চাইতে সহানুভূতিশীল বন্ধুরাও এ রকম অলীক স্বপ্ন দেখার জন্য তাঁকে অনুকম্পা করলো। ওরা ছিল ওই রকমই : ওরা সারা জীবন কাটিয়ে দেবে নিজেদের প্রাচীন বংশ গৌরবের কথা বলে, এই শহরের ঐতিহাসিক মর্যাদার কথা বলে, এর মূল্যবান ধর্মীয় স্মৃতিচিহ্ন ও স্মারকগুলির কথা বলে, এর বীরত্ব ও সৌন্দর্যের কথা বলে, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এর যে অবক্ষয় হয়ে চলেছে সে সম্পর্কে থাকবে সম্পূর্ণ অন্ধ। পক্ষান্তরে, ডাক্তার উরবিনো শহরটাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে তিনি সত্যের চোখ দিয়ে সেটাকে দেখতে পেতেন।
তিনি বলতেন, ‘সত্যিই কী মহান এই নগরী। আমরা চারশো বছর ধরে এটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে চলেছি তবু সফলকাম হই নি।’
তবে প্রায় সফলকাম হয়েছিল। মহামারী আকারে কলেরা দেখা দেবার পর জলাবদ্ধ বাজারের মানুষগুলিই তার প্রথম শিকার হল। এগারো সপ্তাহ ধরে এতো বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা গেল যা এদেশের ইতিহাসে ইতিপূর্বে কখনো ঘটে নি। তখন পর্যন্ত বিত্তশালী বিখ্যাত মানুষদের মৃতদেহ গির্জার প্রাঙ্গণের পাথরের নিচে সমাধিস্থ করা হত, আর্চবিশপ ও গির্জার অন্যান্য প্রধানদের কবরের কাছাকাছি, আর কম বিত্তশালীদের সমাহিত করা হত মঠের উঠানে। গরিবদের পাঠানো হত একটা বাত্যাতাড়িত টিলার উপর অবস্থিত ঔপনিবেশিক সমাধিস্থলে, শুকিয়ে যাওয়া একটা খাল দ্বারা নগরী থেকে আলাদা করা, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন জনৈক মেয়রের নির্দেশে যার ইটের সেতুর গায়ে খোদিত ছিল এই কথাগুলি : “Lasciate ogni speranza voi chi cntrate.”