১৯
এর পরের চিঠিগুলি তাকে পরিপূর্ণ শান্তি এনে দিলো। সে চিঠিগুলি পড়লো ক্রমবর্ধমান কৌতূহল নিয়ে, তবু পড়ার পর সে ওগুলি পুড়িয়ে ফেললো, যদিও এ কাজের জন্য একটা অপরাধ বোধ সে তার মন থেকে দূর করতে পারলো না। তাই, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন চিঠিগুলিতে নম্বর দিতে শুরু করলো তখন সে ওগুলি নষ্ট না করার পক্ষে একটা নৈতিক যুক্তি লাভ করলো। আর, প্রথম থেকেই সে চিঠিগুলি নিজের জন্য রেখে দিতে চায় নি, তার পরিকল্পনা ছিল সুযোগ-সুবিধা মতো সে এগুলি ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে ফেরত দিবে, তার মনে হয় এগুলির একটা বড় মানবিক মূল্য আছে এবং এসব চিরতরে হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না। মুশকিল হল সময় পার হয়ে যেতে থাকে, চিঠিও আসতেই থাকে, সারা বছর ধরে, তিন-চার দিন অন্তর অন্তর একটা করে, আর চিঠিগুলি সে ফিরিয়েও দিতে পারছে না, তাতে করে একটা অবজ্ঞাপূর্ণ তাচ্ছিল্য দেখানো হবে, যা সে দেখাতে চায় না, একটা চিঠি লিখে সব ব্যাখ্যা করে বলতেও সে পারছে না, তার অহঙ্কার তাতে বাধা দিচ্ছে।
ওই প্রথম বছরটি তার বৈধব্যের সঙ্গে তাকে মানিয়ে নেবার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়েছিল। স্বামীর পরিশোধিত স্মৃতি এখন আর তার দৈনন্দিন কাজে, তার ব্যক্তিগত ভাবনায়, তার সরলতম উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, বরং তা বিরাজ করছে একটা জাগ্রত উপস্থিতি রূপে যা তাকে পথ দেখায় কিন্তু বাধা দেয় না। যখন সে সত্যিই তাঁর বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করতো তখন সে তাঁকে দেখতে পেতো, কোনো অশরীরী মূর্তির মতো নয়, রীতিমত রক্তমাংশের মানুষ রূপে। তিনি যে আছেন এবং এখনো জীবিত, কিন্তু এখন আর তাঁর মধ্যে কোনো পুরুষালি খামখেয়ালিপনা নাই, গোষ্ঠীপতির দাবিদাওয়া নাই, ফারমিনার ভালোবাসার জন্য সর্বগ্রাসী ব্যাকুলতা নাই, তিনি যেমন সময়ে অসময়ে চুম্বন ও ভালোবাসার কথা বলতেন এবং তার কাছেও তাই দাবি করতেন এখন আর সে রকম করেন না। ফারমিনা ডাজা এখন তাঁর জীবিত অবস্থার চাইতে বেশি ভালোভাবে তাঁকে বুঝতে পারছে। ভালোবাসার জন্য তাঁর ব্যাকুলতার কথা সে এখন বুঝতে পারে। তাঁর জনজীবনের প্রধান শক্তি ছিল যে নিরাপত্তা বোধ, বাস্তবে যা কখনো তাঁর আয়ত্তাধীন হয় নি, তিনি ফারমিনার ভালোবাসার মধ্যে সে নিরাপত্তা খুঁজতেন। একদিন এক মরীয়া মুহূর্তে ফারমিনা তাঁর উদ্দেশে চিৎকার করে বলেছিল, ‘আমি যে কী রকম অসুখী তুমি তার কিছু বোঝো না।’ যখন তিনি নির্বিকার ভাবে চোখ থেকে তাঁর চশমা খুলে, সেটা ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্যময় ভঙ্গি, তাঁর শিশুর মতো চোখের স্বচ্ছ জলধারা দিয়ে তাকে বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর একটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে তাঁর অসহনীয় প্রজ্ঞার বোঝা তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলেছিলেন : ‘সব সময় মনে রেখো, একটা ভালো বিয়ের ক্ষেত্রে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সুখ নয়, স্থিতিশীলতা’, ফারমিনা ডাজা তখন ভেবেছিলো তিনি বুঝি বেদনাদায়ক হুমকি হিসাবে কথাটা বলেছিলেন, কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে সেটা ছিল সেই চুম্বক যা তাদের উভয়ের জন্য বহু আনন্দময় মুহূর্ত এনে দিয়েছিলো।
সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াবার সময় ফারমিনা ডাজা কোনো নতুন জিনিস দেখলেই আকৃষ্ট হয়ে তা কিনে ফেলতো। একটা আদিম প্রণোদনা থেকে ওই সব জিনিস সংগ্রহ করতে চাইতো, আর তার স্বামী তার পেছনে একটা যুক্তি দাঁড় করাতেন। জিনিসগুলি ছিল সুন্দর, যতোক্ষণ তাদের আদি পরিবেশে থাকে ততক্ষণ কাজেরও, রোম, পারী, লন্ডন অথবা নিউইয়র্কের বিপণির প্রদর্শনী জানালায়, যেখানে চার্লসটনের তালে তালে তারা স্পন্দিত হত, যেখানে আকাশচুম্বী ভবনগুলি উঠতে শুরু করেছিল, কিন্তু এখানে ছায়ার মধ্যেও যখন তাপমাত্রা নব্বই ডিগ্রি ওঠে, স্ট্রাউসের সঙ্গীত বাজে ওয়ালটজ নাচের সঙ্গে, কবিতা উৎসবের সময় শোনা যায় শুয়োরের মাংস ভাজার পটপট আওয়াজ সেখানে ওইসব টিকতে পারলো না। ফারমিনা ডাজা তার ভ্রমণ শেষে ফিরে আসতো বিশাল ছয় ছয়টা ট্রাঙ্ক নিয়ে, মসৃণ ধাতুতে তৈরি, তামার তালা লাগানো, কোণাগুলি সুসজ্জিত শবাধারের মতো, সে ফিরে আসতো বিশ্বের সর্বশেষ বিস্ময়কর দ্রব্যসামগ্রীর কর্ত্রী ও মালিক হয়ে, যার মূল্য নির্ধারিত হত সোনা দিয়ে নয়, তার নিজস্ব স্থানীয় ভুবনের কেউ যখন ওই সব জিনিস মুহূর্তের জন্য চকিত দৃষ্টিতে দেখতো তার দ্বারা। আসলে সেই জন্যও সেসব কেনা হত, যেন অন্যরা তা দেখতে পায়। বুড়ো হতে শুরু করার আগে থেকেই জনসাধারণের মধ্যে তার যে হাল্কা চপল মূর্তি গড়ে উঠেছিল ফারমিনা ডাজা সে সম্পর্কে অবহিত ছিল। নিজের বাড়িতে তাকে প্রায়ই বলতে শোনা যেত, ‘এই সব তুচ্ছ মনোহারী জিনিস আমাদের ফেলে দিতে হবে, বাড়িতে একটু নড়াচড়ার জায়গা পর্যন্ত নাই।’ ডাক্তার উরবিনো তার ব্যর্থ প্রয়াস দেখে হাসতেন, তিনি জানতেন যে খালি করা জায়গাগুলি আবার ভর্তি হয়ে যাবে। কিন্তু সে লেগে থাকতো, কারণ সত্যিই অন্য কোনো জিনিসের জন্য আর জায়গা হত না, আর কোনো কিছুই কোনো কাজে লাগছিলো না, দরজার গোল হাতলে ঝোলানো শার্টগুলি কিংবা ইউরোপের শীতের উপযোগী ওভারকোট, সব ঠেসে ঠুসে ঢুকিয়ে দেওয়া হত রান্নাঘরের আলমারিতে। তারপর একদিন সকালে প্রচুর উৎসাহ নিয়ে ঘুম থেকে উঠে কাপড়ের আলমারিগুলি সে ঝেঁটিয়ে খালি করে ফেলতো, ট্রাঙ্কগুলি খালি করে ফেলতো, চিলেকোঠা তছনছ করে ফেলতো, আর স্তূপীকৃত কাপড়ের সঙ্গে একটা বিচ্ছিন্নতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হত, ওই সব কাপড়জামা যা বহু দিন ধরে সে দেখছে, ওই সব হ্যাট যা সে কোনো দিন পরে নি কারণ যখন তা কেতাদুরস্ত ছিল তখন সেসব পরার মতো কোনো অনুষ্ঠান তার সামনে পড়ে নি, সেই সব জুতো যা মহারানীদের অভিষেকের সময় পরা জুতা থেকে ইউরোপীয় শিল্পীরা নকল করেছিল, যাকে এখানকার উচ্চবংশীয় মহিলারা তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতো কারণ স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ রমণীরা তাদের বাড়িতে পরার জন্য বাজার থেকে হুবহু এই ধরনের জুতাই কিনতো। সারা সকাল ধরে বাড়ির ভেতরের চত্বরে বিরাজ করতো একটা সঙ্কটের অবস্থা আর বাড়ির ভেতরে নিঃশ্বাস নেয়া কষ্টকর হয়ে উঠতো ন্যাপথালিনের গন্ধের জন্য। কিন্তু তারপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হত কারণ মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে থাকা এতো সিল্ক আর ব্রোকেডের কাপড়, এতো অর্থহীন সৌখিন দ্রব্যসামগ্রী, পশুর লোমের এতো সব রুপালি শীতের পোশাক দেখে ওসবের জন্য তার মনে একটা অনুকম্পা জেগে উঠতো, এই সব আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হবে?
সে বলতো, ‘যখন এতো লোক দু’মুঠো খেতে পারছে না তখন এসব পুড়িয়ে ফেলা হবে একটা মহাপাপ।’
আর তাই দহনযজ্ঞ স্থগিত হত, সব সময় তা স্থগিত হত, আর জিনিসগুলি তাদের বিশেষ সম্মানের জায়গা থেকে স্থানান্তরিত হত আস্তাবলে, যা রূপান্তরিত হয়েছিল আজেবাজে জিনিসের গুদামঘরে, আর ওদিকে, তার স্বামীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুকরণ করে, খালি করা জায়গাগুলি আবার ভর্তি হতে শুরু করতো, আবার নানা জিনিসের ঠাসাঠাসি গাদাগাদি অবস্থান, যেগুলি কিছু কালের জন্য প্রাণ পাবার পর পুনর্বার মৃত্যুবরণের জন্য চালান হতো আলমারির গহ্বরে : যতক্ষণ না পরবর্তী পালা শুরু হতো। সে বলতো, ‘যে সব জিনিস কোনো কাজে লাগে না, আবার ফেলেও দেয়া যায় না, সেসব সম্পর্কে কি করা যায় সে ব্যাপারে একটা কিছু আবিষ্কার করা দরকার।’ কথাটি সত্য : যেভাবে জিনিসপত্র রাক্ষসের মতো থাকার জায়গার ওপর চড়াও হচ্ছে, মানুষকে হটিয়ে দিচ্ছে, বাধ্য করছে তাদের কোণা ঘুপচির মধ্যে আশ্রয় নিতে তাতে সে আতঙ্কিত বোধ করলো এবং শেষে সে ওই সব তার চোখের আড়ালে সরিয়ে দিল। আসলে লোকজন তাকে যে রকম সুশৃঙ্খল ভাবতো সে তেমন ছিল না, তবে মানুষের চোখে সে রকম দেখাবার জন্য তার একটা বেপরোয়া পদ্ধতি ছিল, সে তার বিশৃঙ্খলাগুলি লুকিয়ে রাখতো। যেদিন জুভেনাল উরবিনো মারা যান সেদিন তাঁর মৃতদেহ যথাযথ ভাবে স্থাপন করার জন্য ওদেরকে তাঁর পড়ার ঘরের অর্ধেক জিনিস খালি করে ফেলতে হয়, আর শোবার ঘরের জিনিসগুলি সব এক জায়গায় স্তূপ করে রাখতে হয়।
বাড়ির ভেতর দিয়ে মৃত্যুর যাত্রা সমস্যার সমাধান করে দেয়। স্বামীর কাপড়- জামা পোড়াবার পর ফারমিনা ডাজা লক্ষ করলো যে তার হাত কাঁপে নি। তখন ওই একই প্রণোদনায় সে নিয়মিত বিরতির পর আগুন জ্বালালো আর তার মধ্যে ছুড়ে ফেললো সব কিছু, পুরনো এবং নতুন, বিত্তশালীদের ঈর্ষা কিংবা অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে থাকা দরিদ্রের কথা ভাবলো না। সব শেষে সে আম গাছটা একেবারে শিকড় শুদ্ধ কেটে ফেললো, ওই দুর্ভাগ্যের কোনো চিহ্ন আর রইলো না, আর জীবিত তোতা পাখিটা সে দান করলো নগরীর নতুন জাদুঘরকে। আর কেবলমাত্র তখনই সে যেরকম বাড়ির স্বপ্ন চিরকাল দেখেছে, বড়, সহজ, পুরোপুরি তার, সেই রকম একটা বাড়িতে সে মুক্ত নিঃশ্বাস গ্রহণ করলো।
তার মেয়ে ওফেলিয়া তার সঙ্গে তিন মাস কাটিয়ে নিউ অর্লিয়ান্সে ফিরে গেল। ছেলে প্রতি রবিবার এবং সপ্তাহের অন্য দিনেও যখনি সম্ভব হত তার এখানে সপরিবারে এসে দুপুরের খাওয়া খেতো। ফারমিনা ডাজা তার শোকপালনের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পর তার বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আবার তার ওখানে বেড়াতে আসতে শুরু করে। তারা খালি উঠানের দিকে মুখ করে তাস খেলতো, নতুন নতুন রান্নার পদ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতো, তাকে ছাড়াই যে চির অতৃপ্ত পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকে আছে তার যাবতীয় গোপন বিষয়ের সর্বশেষ অবস্থা তারা তাকে অবহিত করতো। অন্যতম বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েল ডেল অবিস্পো। প্রাচীন সনাতনী ধারার এই অভিজাত মহিলা সব সময়ই ফারমিনার ভালো বন্ধু ছিল,
জুভেনাল উরবিনোর
মৃত্যুর পর আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। গেঁটেবাতের জন্য সে তার শরীর এখন সহজে বাঁকাতে পারে না, এক সময়ের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রার জন্য অনুতাপ করে, এই লুক্রেশিয়া যে তাকে সব চাইতে ভালো সঙ্গ দিতো তাই নয়, সে নিজেও শহরের বিভিন্ন নাগরিক ও জাগতিক প্রকল্পের ব্যাপারে তার সঙ্গে আলাপ করতো এবং এর ফলে তার নিজেকে একজন দরকারি মানুষ বলে মনে হত, তার নিজের মূল্যেই, স্বামীর নিরাপত্তামূলক ছায়ায় বাস করা কোনো প্রাণীর মতো নয়। অথচ এই সময়েই তাকে তার স্বামীর সঙ্গে যতো একাত্ম করে ফেলা হয় এমন আর কখনো হয় নি, কারণ তার কুমারী নামে এখন আর কেউ তাকে ডাকতো না, সবার কাছে এখন তার পরিচিতি বিধবা উরবিনো বলে।
এটা অবিশ্বাস্য মনে হল, কিন্তু তার স্বামীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী যতো এগিয়ে এলো ফারমিনা ডাজার ততোই মনে হল যে সে একটা ছায়াচ্ছন্ন, শীতল, শান্ত অপ্রতিকার্য কুঞ্জবনে প্রবেশ করছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার লিখিত দার্শনিক ভাবনাগুলি তাকে তার মনের শান্তি ফিরে পেতে কতোখানি সাহায্য করেছে সে- সম্পর্কে সে এখনও সচেতন হয় নি, আরো বেশ কয়েক মাস কাটার আগে সে হবে ও না। তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোক ওই ভাবনাগুলি তাকে তার নিজের জীবনকে বুঝতে সাহায্য করে, তাকে বার্ধক্যের চতুর অভিসন্ধিসমূহ প্রশান্তির সঙ্গে গ্রহণ করতে শেখায়। সেদিন স্মারক প্রার্থনা অনুষ্ঠান তাকে একটা দৈবপরিচালিত সুযোগ এনে দেয়, ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে সে জানাতে পারে যে তার উৎসাহব্যঞ্জক চিঠিগুলির জন্যই সেও এখন অতীতকে মুছে ফেলার জন্য প্রস্তুত।
দু’দিন পর সে তার কাছ থেকে ভিন্ন ধরনের একটা চিঠি পেলো : লিনেনের কাগজে হাতে লেখা, আর খামের পেছনে খুব স্পষ্ট করে তার পুরো নাম খোদিত। তার আগের দিনের চিঠিগুলির মতোই এখানেও সেই আলঙ্কারিক হস্তাক্ষর, সেই গীতিকাব্যিক সুর, কিন্তু এখানে তা প্রযুক্ত হয়েছে সেদিন ক্যাথিড্রালে ফারমিনা ডাজার সৌজন্যের জন্য একটি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক ছোট্ট সরল অনুচ্ছেদে। চিঠিটা পড়ার পর কয়েক দিন ধরে ফারমিনা ডাজা বিচলিত স্মৃতিতাড়িত হয়ে তার কথা ভাবে, কিন্তু তার বিবেক এতো পরিষ্কার ছিল যে পরের বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েল ডেল অবিস্পোকে জিজ্ঞাসা করলো ও নৌযান কোম্পানির মালিক ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে চেনে কিনা। লুক্রেশিয়া জানালো যে সে তাকে চেনে : মনে হয় ও সমকামী।’ প্রচলিত গুজবের পুনরুক্তি করলো সে, এতো চমৎকার অবস্থানে থেকেও ও কখনো কোনো রমণীকে উপভোগ করে নি, শোনা যায় ওর একটা গোপন অফিস আছে, রাতে জাহাজঘাটে ও যেসব ছোকরাদের অনুসরণ করতো তাদেরকে ওর ওই আপিসে নিয়ে আসে। ফারমিনা ডাজা বহুদিন ধরে এসব কথা শুনে এসেছে, সে এসব গুজব বিশ্বাস করে নি, একে কোনো গুরুত্বও দেয় নি। কিন্তু লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েল যখন কথাটা অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে আবার বললো, যার বিচিত্র রুচি সম্পর্কেও এক সময় বেশ গুজব ছিল, তখন ফারমিনা ডাজা বিষয়টা পরিষ্কার করার একটা তাগিদ দমন করতে পারলো না। সে বললো, ফ্লোরেন্টিনোকে সে তার বাল্যকাল থেকে চেনে। সে লুক্রেশিয়াকে মনে করিয়ে দিল যে জানালার সরণীতে ওর মায়ের একটা টুকিটাকির দোকান ছিল, তিনি পুরনো শার্ট ও চাদর কিনে সেগুলির ভাঁজ খুলে গৃহযুদ্ধের কালে ব্যান্ডেজ হিসাবে বিক্রি করতেন। তারপর ফারমিনা ডাজা দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বললো, ‘তিনি একজন মানী ব্যক্তি এবং অতিশয় বিচক্ষণ।’ সে এতো প্রবলভাবে তার কথাগুলি উচ্চারণ করলো যে লুক্রেশিয়া নিজের মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়ে বললো, ‘তো লোকে আমার সম্পর্কেও তো ওসব কথা বলে।’ যে মানুষটা তার জীবনে কখনো একটা ছায়ার চাইতে বেশি কিছু হয়ে ওঠে নি তার পক্ষ সমর্থনে সে কেন এতো আবেগদীপ্ত হয়ে উঠলো ফারমিনা ডাজা নিজেকে সে প্রশ্ন করলো না। সে ওর কথা ভাবতে থাকে, বিশেষ করে তখন যখন পরের ডাকে ওর কোনো চিঠি এলো না। দু’সপ্তাহের নীরবতার পর হঠাৎ একদিন বাসার কাজের একটি মেয়ে তাকে তার দিবানিদ্রা থেকে জাগিয়ে নিচু গলায় ফিসফিস করে বললো, ‘সিনোরা, ডন ফ্লোরেন্টিনো এসেছেন।’
এখানে এসেছে? ফারমিনা ডাজার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল আতঙ্কের। সে মনে মনে বললো, না, ও আরেক দিন আসুক, আরো সঙ্গত সময়ে, তার পক্ষে এখন কোনো দর্শনার্থীকে অভ্যর্থনা করা সম্ভব নয়, তা ছাড়া কি কথা বলবে তারা? কিন্তু সে প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে পরিচারিকাকে নির্দেশ দিল ওঁকে যেন ড্রয়িংরুমে বসানো হয় আর কফি দেয়া হয়। ইত্যবসরে তার সামনে যাবার আগে সে নিজেকে একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নেবে। বেলা তিনটার দুঃসহ রোদের তাপে জ্বলতে জ্বলতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বাড়ির সদর দরজার সামনে অপেক্ষা করছিল, কিন্তু পরিস্থিতি ছিল তার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। ফারমিনা তার সঙ্গে দেখা করবে না, তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল, ও হয়তো ভদ্র কোনো অজুহাত দেবে, আর ওই নিশ্চয়তাটুকু তাকে শান্ত রাখে। কিন্তু ফারমিনা ডাজার বার্তার দ্ব্যর্থহীন স্পষ্টতায় তার অস্থিমজ্জা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। যখন সে ড্রয়িংরুমের ঠাণ্ডা ছায়ার মধ্যে হেঁটে গেল তখন এই অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে ভাববার সময়ও সে পেলো না কারণ হঠাৎ তার পাকস্থলী থেকে নিম্নাংশ এক যন্ত্রণাদায়ক ফেনার বিস্ফোরণে পূর্ণ হয়ে যায়। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে কোনো রকমে বসে পড়লো, তার স্মৃতিতে ভেসে উঠলো তার প্রথম প্রেমপত্রের ওপর পাখির পূরীষ ঝরে পড়বার কথা, আর কাঁপুনির প্রথম আক্রমণটা প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত সে ছায়াঘেরা অন্ধকারের মধ্যে নিশ্চল হয়ে বসে রইলো, এই অন্যায্য দুর্ভাগ্য ব্যতীত অন্য যে কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে।
নিজের অবস্থা সম্পর্কে সে সম্যক অবহিত ছিল : তার জন্মগত কোষ্ঠকাঠিন্য সত্ত্বেও তার দীর্ঘ জীবনে তার পেট প্রকাশ্যে তার সঙ্গে তিন কিংবা চার বার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং তখন সে হার মানতে বাধ্য হয়। সে মাঝে মাঝে ঠাট্টাচ্ছলে একটা কথা বলতো, ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমি তাঁকে ভয় করি’, এই রকম এবং অনুরূপ জরুরি সময়ে সে ওই উক্তির যথার্থ সারবত্তা উপলব্ধি করতো। এই মুহূর্তে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। সে প্রাণপণ চেষ্টা করলো একটা প্রার্থনার বাণী উচ্চারণ করতে কিন্তু মাত্র একটা ছাড়া তার আর কিছুই মনে পড়লো না। ছেলেবেলায় গুলতি দিয়ে পাখি মারার জন্য একটি ছেলে তাকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিল : ‘যাক যাক, লাগুক গিয়ে তার গায়, না লাগলে আমার কিন্তু কোনো দোষ নাই।’ সে যখন তার নতুন গুলতি নিয়ে গ্রামাঞ্চলে যায় তখন সেই ওই মন্ত্র উচ্চারণ করেছিল, আর কী আশ্চর্য, পাখিটা মৃত্যুবরণ করে ঝুপ করে নিচে পড়ে যায়। তার মনে হয়েছিল দুটোর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে, সে বিভ্রান্ত বোধ করেছিল, এখন সে প্রার্থনার ঐকান্তিকতা নিয়ে ওই মন্ত্র আবার আওড়ালো কিন্তু এবার আকাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া গেল না। তার পেটের মোচড়ানি একটা স্প্রিংয়ের মতো তাকে তার আসন থেকে উৎক্ষিপ্ত করলো, তার পেটের ভেতরের ফেনা আরো ঘন ও পীড়াদায়ক হল, তার মুখ দিয়ে একটা আক্ষেপোক্তি নির্গত হল, তার সারা শরীর বরফ শীতল ঘামে ভিজে গেল। কফি নিয়ে আসা কাজের মেয়েটি তার মড়ার মতো মুখ দেখে ভয় পেল। সে নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘ভীষণ গরম।’ তাকে একটু আরাম দেয়ার জন্য মেয়েটি জানালা খুলে দিল, কিন্তু অপরাহ্ণের রোদ সরাসরি তার মুখের ওপর এসে পড়ায় সে আবার তা বন্ধ করে দিল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা টের পেল যে সে আর এক মুহূর্তও চেপে রাখতে পারবে না, আর তখনই ফারমিনা ডাজা ঘরে এসে ঢুকলো, অন্ধকারের মধ্যে প্রায় অদৃশ্য, তাকে ওই অবস্থায় দেখে আতঙ্কিত।
সে বললো, ‘আপনি কোটটা খুলে ফেলতে পারেন।’ তার পেট ভীষণ মোচড়াচ্ছিল কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো কাতর হল আরেকটা কথা ভেবে, ও কি তার পেটের ভেতরকার বুজবুজ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে? সে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, না, সে এখন বসবে না, সে শুধু জানতে এসেছিল তার সঙ্গে দেখা করতে সে আসতে পারে কিনা। ফারমিনা দাঁড়িয়ে থেকেই একটু বিভ্রান্ত হয়েই বললো : ‘তা, এখন তো এসেই পড়েছেন।’ সে তাকে চত্বরে গিয়ে বসার আমন্ত্রণ জানালো, ওখানে একটু ঠাণ্ডা হবে। সে ওই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলো, তার মনে হল একটা বেদনার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ফ্লোরেন্টিনো বললো, “শুনুন, আমি কাল আসবো, ঠিক আছে?’
ফারমিনা ডাজার মনে পড়লো যে আগামীকাল বৃহস্পতিবার, তার বাসায় লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েল ডেল অবিস্পোর নিয়মিত বেড়াতে আসার দিন, কিন্তু এ সমস্যার নিখুঁত সমাধান সে পেয়ে যায়। সে বললো, ‘পরশু আসুন, বিকাল পাঁচটায়।’ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে ধন্যবাদ দিলো, টুপি তুলে দ্রুত বিদায় জানালো, কফি স্পর্শ না করেই বিদায় নিলো। ফারমিনা ডাজা ড্রয়িংরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলো, বিভ্রান্ত, এই মাত্র কি ঘটলো তা এখনো বুঝতে পারছে না, তারপর রাস্তার শেষ মাথায় ওর গাড়ির ব্যাক-ফায়ারিং-এর শব্দে সম্বিত ফিরে পেলো। আর ওদিকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা গাড়ির পেছনের আসনে শরীরটা একটু কম কষ্টদায়ক অবস্থানে গুছিয়ে নিলো, তার চোখ দুটি বন্ধ করলো, মাংশপেশি শিথিল করলো, তারপর আত্মসমর্পণ করলো তার দেহের অভিলাষের কাছে। তর মনে হল তার যেন নতুন জন্ম হল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার বহু বছরের পুরনো ড্রাইভার এখন আর কোনো কিছুতেই অবাক হত না, তার মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না, বাড়ির সামনে পৌঁছে গাড়ির দরজা খুলে দেবার সময় সে শুধু বললো, ‘সাবধান থাকবেন, ডন ফ্লোরো, কলেরার মতো মনে হচ্ছে।’ কিন্তু ওটা ছিল তার স্বাভাবিক রোগ, সেজন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলো।
কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটার সময় ফারমিনা ডাজার পরিচারিকা ড্রয়িংরুমের অন্ধকারে মধ্য দিয়ে তাকে প্রাঙ্গণের চত্বরে নিয়ে গেল, সেখানে ও বসে ছিলো দুজনের জন্য একটা টেবিলের পাশে। সে তাকে চা কিংবা চকোলেট কিংবা কফির আমন্ত্রণ জানালো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কফি দিতে বললো, খুব গরম এবং খুব কড়া। ফারমিনা ডাজা পরিচারিকাকে বললো, ‘আমাকে সব সময় যা দাও তাই দিও।’ সেটা ছিল প্রাচ্যের বিভিন্ন পদের চায়ের একটা কড়া মিশ্রণ, দিবানিদ্রার পর সেটা খেলে সে চাঙ্গা বোধ করতো। যখন সে তার চায়ের পট ও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার কফির পট নিঃশেষ করে ফেলেছে তখন দেখা গেল যে তারা নানা বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করেছে এবং মাঝপথেই তা ছেড়ে দিয়েছে। কোনো বিশেষ উৎসাহের কারণে তারা ওইসব বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করে নি, বরং এই জন্য যে সাহসের অভাবে তারা কয়েকটি প্রসঙ্গ সচেতন ভাবে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। তারা উভয়েই ঈষৎ বাধাগ্রস্ত বোধ করছিল, তাদের যৌবন থেকে এতো দূরে একটা বাড়ির দাবার ছকের মতো টালি বসানো চত্বরে বসে, যে বাড়ির এখন কোনো মালিক নাই এবং এখনো যেখানে সমাধি ক্ষেত্রের ফুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, তারা কী করছে তা তারা বুঝতে পারলো না। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই প্রথম তারা এতো কাছাকাছি বসেছে, এই প্রথম একটু প্রশান্তির সঙ্গে তারা পরস্পরকে দেখার সময় পেয়েছে এবং তারা তাদের দেখছে নিজেদের যথার্থ রূপে, দুজন বৃদ্ধ, মৃত্যু যাদের জন্য ওঁৎ পেতে আছে, একটা ক্ষণস্থায়ী অতীতের স্মৃতি ছাড়া যাদের মধ্যে অভিন্ন আর কিছুই নাই, সে অতীতও এখন আর তাদের নয়, তার মালিক দুটি তরুণ প্রাণী যারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, যারা তাদের নাতি-নাতনীও হতে পারতো। ফারমিনা ডাজা ভাবলো অবশেষে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বোধ হয় তার স্বপ্নের অবাস্তবতা সম্পর্কে যথার্থ অবহিত হবে এবং তাই তাকে তার ঔদ্ধত্যের গ্লানি থেকে মুক্তি দেবে।
অপ্রীতিকর নীরবতা কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় এড়াবার জন্য ফারমিনা ডাজা নৌযান সম্পর্কে তাকে সোজা সরল কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলো। এটা অবিশ্বাস্য মনে হল যে সে, মালিক, মাত্র একবার নদীপথে ভ্রমণ করেছে, তাও বহু বছর আগে, যখন কোম্পানির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। এর কারণ ফারমিনা ডাজার জানা ছিল না, আর সেটা ওকে বলতে পারার জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার আত্মা পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে রাজি ছিল। ফারমিনা ডাজারও নদীর সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিল না। অ্যান্ডিসের বাতাস সম্পর্কে তার স্বামীর একটা বিরূপতা ছিল, নানা অজুহাত দিয়ে তিনি তা আড়াল করতেন : উচ্চতার জন্য হৃদযন্ত্রের ঝুঁকি, নিউমোনিয়ার সম্ভাবনা, লোকজনের কপটতা, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অবিচার প্রভৃতির কথা বলতেন তিনি। আর তাই তাঁরা অর্ধবিশ্বকে জানলেও নিজেদের দেশকে জানতেন না। আজকাল অ্যালুমিনিয়ামের গঙ্গাফড়িং-এর মতো দেখতে একটা জাঙ্কার্স সামুদ্রিক বিমান ম্যাগডালেনা অববাহিকার এক শহরে থেকে আরেক শহরে যাতায়াত করে, ওই বিমানে থাকে দুজন বিমানকর্মী, ছ’জন যাত্রী, আর অনেকগুলি চিঠিপত্রের বস্তা। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বললো, ‘একটা উড়ন্ত শবাধারের মতো মনে হয়।’ ফারমিনা ডাজা ছিল প্রথম বেলুন ভ্রমণের একজন যাত্রী কিন্তু সে যে ওই রকম একটা দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নিতে সাহস করেছিল এখন তা তার বিশ্বাস হতে চায় না। সে বললো, ‘সব কিছু বদলে গেছে।’ সে বোঝাতে চেয়েছিল, যাতায়াত ব্যবস্থা বদলায় নি, বদলে গেছে সে নিজে।
মাঝে মাঝে বিমানের শব্দে সে চমকে উঠতো। ত্রাণকর্তা’-র মৃত্যু শতবার্ষিকীতে সে বিমান বহরকে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেতে এবং নানা রকম ক্রীড়া কসরৎ প্রদর্শন করতে দেখেছে। বিশাল বাজ পাখির মতো একটা বিমান লা মাঙ্গার কয়েকটা বাড়ির ছাদ ঘেঁষে উড়ে যায়, নিকটবর্তী একটা গাছে বিমানের একটা পাখা আটকে যায়, তারপর সেটা জড়িয়ে যায় বৈদ্যুতিক তারের জালে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ফারমিনা ডাজা অ্যারোপ্লেনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো না। ইদানীং মানজানিলো উপসাগরের জলে সামুদ্রিক বিমান অবতরণ করতো। পুলিশের লঞ্চ আগে থেক জেলে ডিঙি আর ক্রমবর্ধমান বিনোদনপিয়াসীদের নৌকাগুলিকে সাবধান করে দিতো। এ সব খবর পেয়েও ফারমিনা ডাজার মনে কোনো কৌতূহল জাগে নি। চার্লস লিন্ডবার্গ যখন তাঁর শুভেচ্ছা উড্ডয়নে এখানে আসেন তখন গোলাপের তোড়া দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য ফারমিনা ডাজাকে নির্বাচন করা হয়, তার বয়সের জন্য, আর ফারমিনা ডাজা বুঝতে পারে নি কেমন করে লিন্ডবার্গের মতো এতো লম্বা, এতো ফর্সা, এতো সুদর্শন একজন মানুষ ওই রকম অদ্ভুত যন্ত্রে চড়ে আকাশে উড়তে পারেন, যে যন্ত্রকে মনে হয় ঢেউ টিন দিয়ে তৈরি আর যেটাকে মাটি থেকে তুলবার জন্য দুজন মিস্ত্রিকে তার পুচ্ছ ধরে ঠেলতে হয় কিছুক্ষণ। তার মাথায় কিছুতেই ঢুকতো না কেমন করে তার চাইতে তেমন কিছু বড় নয় একটা বিমান আটজন যাত্রীকে বহন করতে পারে। পক্ষান্তরে, সে শুনেছে যে নৌযানে ভ্রমণ খুব আনন্দদায়ক, বড় বড় সামুদ্রিক জাহাজের মতো সেগুলি দোলে না, যদিও চোরাবালি আর দস্যুদের অতর্কিত আক্রমণের মতো গুরুতর বিপদের সম্ভাবনা আছে তাদের ক্ষেত্রে।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে বিশদ ভাবে জানালো যে ওসব হচ্ছে অনেককাল আগের গল্পকাহিনী। এখন নৌপথে চলাচলকারী জাহাজে বড় বড় বলরুম থাকে, হোটেলের মতো লম্বা চওড়া বিলাসবহুল ক্যাবিন থাকে, নিজস্ব স্নানঘর ও বিজলি পাখা থাকে, আর গত গৃহযুদ্ধের পর থেকে নৌযানের উপর কোনো সশস্ত্র আক্রমণের ঘটনা ঘটে নি। সে আরো বললো, কিছুটা ব্যক্তিগত বিজয়ের আত্মসন্তুষ্টি নিয়ে, এই অগ্রগতির পেছনে অন্য সব কিছুর চাইতে বেশি কাজ করেছে নৌ চলাচলের স্বাধীনতার বিষয়টি। এর জন্য সে নিজে সংগ্রাম করেছে এবং এর ফলে প্রতিযোগিতা উৎসাহিত হয়েছে, আগে যেখানে মাত্র একটি কোম্পানি ছিল এখন সেখানে তিনটি কোম্পানি তাদের জাহাজে চালাচ্ছে, প্রত্যেকেই সক্রিয় এবং ভালো ব্যবসা করছে। তবে আকাশপথে চলাচলের দ্রুত অগ্রগতি তাদের সবার জন্য সত্যিকার হুমকি হয়ে উঠেছে। ফারমিনা ডাজা ওকে সান্ত্বনা দিলো, বললো যে জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা সব সময়েই থাকবে, বিমানের মতো একটা অদ্ভুত যন্ত্রে, যা প্রকৃতির বিরুদ্ধে বলে মনে হয়, তাতে চড়বার মতো পাগলের সংখ্যা কখনোই খুব বেশি হবে না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তখন ডাক ব্যবস্থার উন্নতির কথা বললো। তার চিঠির প্রসঙ্গে ওকে কথা বলাবার প্রয়াসে সে বললো যে আজকাল পত্র পরিবহন ও বিতরণ উভয় ক্ষেত্রে প্রচুর উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তার প্রয়াস সফল হল না।
কিন্তু একটু পরে প্রসঙ্গটা আপনা থেকেই ওঠে। ওরা যখন এ বিষয় থেকে অনেক দূরে বিচরণ করছিল তখন একটি কাজের মেয়ে ওদের কথায় বাধা দিয়ে ফারমিনা ডাজার হাতে একটা চিঠি দিল, চিঠিটা শহরের বিশেষ ডাকে এখানে নতুন চালু হয়েছে, এর আওতায় টেলিগ্রামের মতো জরুরি ভিত্তিতে চিঠিপত্র বিলি করা হয়। সব সময়ের মতো এখনও ফারমিনা ডাজা তার চশমা খুঁজে পেলো না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা দেখা গেল না। সে বললো, ‘তার কোনো দরকার হবে না, চিঠিটা আমার।’
হ্যাঁ, চিঠিটা ছিল তারই। গত পরশু দিন মনের অত্যন্ত বিষণ্ণ অবস্থায় সে চিঠিটা লিখেছিল, তার প্রথম দেখা-সাক্ষাতের ব্যর্থতা তার মধ্যে যে বিব্রত ভাবের জন্ম দিয়েছিল সে তা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। সে তার ওই চিঠিতে পূর্বানুমতি না নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে আসার ঔদ্ধত্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে এবং কথা দিয়েছে যে আর আসবে না। না ভেবেচিন্তেই সে চিঠিটা ডাকে দেয়, যখন দ্বিতীয় চিন্তা দেখা দেয় তখন বড় বেশি দেরি হয়ে যায়। কিন্তু এতো কৈফিয়তের প্রয়োজন আছে বলে তার মনে হল না, সে ফারমিনা ডাজাকে শুধু এই অনুরোধ জানালো ও যেন চিঠিটা না পড়ে। ‘অবশ্যই’, ফারমিনা বললো। ‘লেখকই তো চিঠির আসল মালিক, আপনি কি একমত নন?’
ফ্লোরেন্টিনো একটা সাহসী পদক্ষেপ নিলো, বললো, ‘অবশ্যই আমি একমত, সেজন্যই কোনো প্রেমপর্বের ইতি ঘটলে সব কিছুর আগে চিঠিপত্রগুলিই ফেরত দেয়া হয়।
ও তার গোপন ইঙ্গিত উপেক্ষা করে চিঠিটা তার কাছে ফেরত দিতে দিতে বললো, ‘চিঠিটা যে আমি পড়তে পারবো না সেজন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। অন্য চিঠিগুলি আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছে।’ ফ্লোরেন্টিনো বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলো। ও যে তার প্রত্যাশার অতিরিক্ত এতো কথা বলবে এবং এতো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাতে সে বিস্মিত হল। সে বললো, “আপনার একথা আমাকে যে কতো সুখী করেছে তা আপনি কল্পনা করতে পারবেন না। ফারমিনা ডাজা কিন্তু প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করে ফেললো এবং বিকালের বাকি সময়টুকুতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা চেষ্টা করেও ওই প্রসঙ্গ পুনরুত্থাপন করতে সক্ষম হল না।
সে সন্ধ্যা ছ’টা বাজার বেশ খানিকটা পরে ওর বাসা থেকে বেরুলো। ততক্ষণে বাসার ঘরে ঘরে আলো জ্বালানো শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার নিজেকে আগের চাইতে নিরাপদ অবস্থানে বলে মনে হল কিন্তু খুব বেশি স্বপ্নকে সে প্রশ্রয় দিলো না। বিশ বছর বয়সের ফারমিনা ডাজার চঞ্চল স্বভাবের কথা তার জানা ছিল, কখন তার কি প্রতিক্রিয়া হবে কেউ তা বলতে পারতো না, এসবের যে কোনো পরিবর্তন হয়েছে তা ভাবার কোনো কারণ সে দেখলো না। তাই সে একটু ঝুঁকি নিয়ে, আন্তরিক বিনয়ের সঙ্গে, জানতে চাইলো সে আবার আরেক দিন আসতে পারবে কিনা এবং আবারও ওর উত্তর তাকে অবাক করে দিলো। ফারমিনা ডাজা বললো, ‘যখন খুশি হবে তখনই আসবেন। আমি প্রায় সারাক্ষণই একা থাকি।’
চার দিন পরে এক মঙ্গল বারে খবর না দিয়ে সে ফারমিনা ডাজার ওখানে গিয়ে উপস্থিত হল। এবার চা পরিবেশিত হবার আগেই তার চিঠিগুলি তাকে কতো সাহায্য করেছে ফারমিনা ডাজা তাকে সে কথা বললো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বললো যে এগুলি আসলে ঠিক চিঠি নয়, তার ইচ্ছা এসব বিষয় নিয়ে সে একটা বই লিখবে, এগুলি ওই বইয়ের কয়েকটা পাতা। ফারমিনা ডাজা জানালো যে তারও ওই রকম মনে হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, সে ওগুলি ফিরিয়ে দেবার কথা ভেবেছিলো, যেন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সেগুলি আরো ভালো কাজে লাগাতে পারেন, তিনি যদি এটাকে অপমানকর বলে মনে না করেন। চিঠিগুলি ফারমিনা ডাজাকে তার এই কঠিন সময়ে কতোখানি সাহায্য করেছে সে কথা সে এতো প্রাণবন্ত ভাবে, এতো কৃতজ্ঞতার সঙ্গে, হয়তো এতো মমতার সঙ্গে, বললো যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এবার একটা সাহসী পদক্ষেপের চাইতে একটু বেশি ঝুঁকি নিলো : প্রায় একটা ডিগবাজি খেলো সে। সে বললো, “আমরা আগে একে অন্যকে তুমি বলতাম
ওটা ছিল নিষিদ্ধ শব্দ : ‘আগে।’ ফারমিনা ডাজার মনে হল অতীতের অলৌকিক দেবদূত যেন তার মাথার উপরে উড়ছে, সে তাকে এড়াতে চাইলো। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আরো একটু অগ্রসর হল : ‘আগে, মানে, আমাদের চিঠিপত্রে।’ ফারমিনা ডাজা বিরক্ত হল এবং তা গোপন করার জন্য তাকে রীতিমতো চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার বিরক্তি ধরতে পারলো, সে বুঝলো যে তাকে আরো বিচক্ষণতার সঙ্গে এগুতে হবে, তবে তার ভুলটা তার কাছে এই সত্যটাও তুলে ধরলো যে ও আগের মতোই চট করে রেগে যায়, যৌবনে যেমন ছিল ঠিক সেই রকম, যদিও এখন ও তাকে নমনীয় করতে শিখেছে।
ফ্লোরেন্টিনো বললো, “মানে, আমি বলছিলাম যে এই চিঠিগুলি একেবারে অন্য রকম।’
ও বললো, ‘পৃথিবীর সব কিছুই বদলে গেছে।’
‘আমি বদলাই নি’, ফ্লোরেন্টিনো বললো, ‘আপনি কি বদলেছেন?
ও তার চায়ের দ্বিতীয় পেয়ালা মুখে তুলছিলো, মাঝপথে সেটা ধরে রেখে চোখ দিয়ে তাকে ভর্ৎসনা করলো, সেই চোখ যা অনেক রুক্ষতা পেরিয়েও আগের মতোই ছিলো, মুখে বললো, ‘এখন আর তাতে কিছু এসে যায় না। ক’দিন আগে আমার বাহাত্তর বছর পূর্ণ হয়েছে।’
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার বুকের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে একটা আঘাত অনুভব করলো। দ্রুত এবং তীরের মতো লক্ষ্যভেদী একটা উত্তর দিতে চাইলো সে কিন্তু নিজের বয়সের কাছে তাকে হার মানতে হল। এতো অল্প সময়ের কথোপকথনে সে এর আগে কখনো এতো ক্লান্ত হয় নি, তার বুকে সে একটা বেদনা বোধ করলো, বুকের প্রতিটি স্পন্দন তার ধমনীতে একটা ধাতব অনুরণন তুললো। তার নিজেকে মনে হল বৃদ্ধ, নিঃসঙ্গ, অপ্রয়োজনীয়, আর তার এমন কান্না পেলো যে সে কথা বলতে পারলো না। তারা তাদের দ্বিতীয় পেয়ালা শেষ করলো নীরবে, ওই নীরবতার মধ্যে দাগ কেটে গেলো কিছু পূর্বানুভূতি, অবশেষে ফারমিনা তার একটি কাজের মেয়েকে ডেকে চিঠির ফোল্ডারটা নিয়ে আসতে বললো। ফ্লোরেন্টিনো বলতে যাচ্ছিলো যে ও চিঠিগুলি রেখে দিতে পারে, তার কাছে কার্বন কপি করা আছে, কিন্তু তারপরই ভাবলো ওটা খুব কদর্য মনে হবে। তাদের আর কিছু বলবার থাকলো না। বিদায় নেবার আগে ফ্লোরেন্টিনো জানালো যে সে সামনের মঙ্গলবার আসবে, একই সময়ে। ফারমিনা ডাজা মনে মনে ভাবলো, সে কী অতটা প্রশ্রয়প্রবণ হবে? সে বললো, ‘এত দেখা- সাক্ষাৎ করে কী হবে আমি বুঝতে পারছি না।’ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জবাব দিলো, ‘আমি তো ভাবি নি যে কিছু হবে।’
অতএব সে পরের মঙ্গলবার ফিরে এলো, বিকাল পাঁচটায় তারপর প্রতি মঙ্গলবার, আগে থেকে সংবাদ দেবার প্রথা সে উপেক্ষা করলো, কারণ দ্বিতীয় মাসের শেষ নাগাদ এই সাপ্তাহিক দেখা-সাক্ষাৎ উভয়ের রুটিনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা চায়ের জন্য বিলাসবহুল সামুদ্রিক জাহাজগুলি থেকে নিয়ে আসতো বিলেতি বিস্কুট, মিষ্টি মাখানো বাদাম, গ্রিসের জলপাই, আরো নানা টুকিটাকি সৌখিন খাদ্যসামগ্রী। এক মঙ্গলবার সে হাজির হল ফারমিনা ডাজা আর হিল্ডাব্রান্ডার পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে জনৈক বেলজীয় আলোকচিত্রশিল্পীর তোলা একটা ফটো নিয়ে। মসীজীবিদের চত্বর থেকে একটা বিশেষ পোস্টকার্ড বিক্রয় অনুষ্ঠানের সময় সে ওটা পনেরো সেন্টাভো দিয়ে কিনেছিলো। ওই ছবি ওখানে কেমন করে গেলো ফারমিনা ডাজা বুঝতে পারলো না, আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ব্যাপারটা বুঝতে পারলো একমাত্র প্রেমের এক অলৌকিক ঘটনা রূপে। একদিন সকালে তার বাগানে গোলাপ কাটতে কাটতে পরবর্তী সাক্ষাতের সময় ফারমিনা ডাজার জন্য একটা গোলাপ ফুল নিয়ে যাবার প্রলোভন সে সংবরণ করতে পারলো না। কিন্তু ফুলের ভাষায় এর মধ্যে একটা কঠিন সমস্যা ছিল, ও তো একজন সাম্প্রতিক বিধবা। লাল গোলাপ হল জ্বলন্ত কামনার প্রতীক, ওটা তার শোকপালনের অনুভূতিতে আঘাত করবে। হলুদ গোলাপ ভিন্ন এক ভাষায় সৌভাগ্যের ফুল, কিন্তু দৈনন্দিন শব্দতালিকা অনুসারে এর অর্থ ঈর্ষা। সে তুরস্কের কালো গোলাপের কথা শুনেছে, ওই গোলাপই সম্ভবত সব চাইতে উপযোগী হত, কিন্তু তার বাগানে সে জাতীয় গোলাপ ফোটাবার মতো প্রয়োজনীয় আবহাওয়া সে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় নি। শেষ পর্যন্ত বহু চিন্তাভাবনার পর সে একটা সাদা গোলাপ নিয়ে যাওয়াই ঠিক করলো, যদিও অন্য গোলাপের চাইতে এটা ছিল তার কম পছন্দ, সাদা গোলাপ যেন কেমন নিষ্প্রাণ ও বোবা : এ গোলাপ কিছুই বলে না। পাছে ফারমিনা ডাজা এর মধ্যে কোনো গোপন অর্থ আবিষ্কার করে তাই শেষ মুহূর্তে সে কাঁটাগুলি অপসারিত করলো।
ফুলটা কোনো গোপন অর্থ ছাড়াই উপহার হিসাবে ভালো ভাবে গৃহীত হয়। তখন থেকে মঙ্গলবারের আনুষ্ঠানিকতা আরেকটু সমৃদ্ধ হল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সাদা গোলাপটা নিয়ে উপস্থিত হলেই দেখতো যে চায়ের টেবিলের উপর ঠিক মাঝখানে জলভর্তি একটা ফুলদানি তৈরি হয়ে অপেক্ষমাণ। এক মঙ্গলবার সে ফুলদানিতে গোলাপটা রাখতে রাখতে বললো, ‘আমাদের সময়ে ছিল ক্যামেলিয়া, গোলাপ নয়।’
‘সে কথা ঠিক’, ফারমিনা বললো, “কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন এবং আপনি তা জানেন।’
সর্বদাই এটাই হত : সে একটু অগ্রসর হতে চেষ্টা করতো, আর ও সামনে একটা দেয়াল তুলে দিতো। কিন্তু এবার, ওর চটজলদি উত্তর সত্ত্বেও, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বুঝলো যে সে লক্ষ্যভেদ করেছে, কারণ ওকে ওর মুখ ঘুরিয়ে ফেলতে হয় যেন সে ওর লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠা গাল দেখতে না পায়। নিজস্ব প্রাণশক্তি ও ঔদ্ধত্যে উদ্দীপ্ত একটা গনগনে ছেলেমিভরা লালিমা, যার জন্য ফারমিনা নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত হল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সঙ্গে সঙ্গে, সযত্নে, কম আপত্তিকর প্রসঙ্গে চলে গেল, কিন্তু তার সৌজন্য এতোই স্পষ্ট ছিল যে ফারমিনা ডাজা বুঝলো যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা টের পেয়েছে, ফলে তার রাগ আরো বেড়ে গেল। মঙ্গলবারটা খুব বাজে কাটলো। ফারমিনা ডাজা তাকে আর এখানে আসতে বারণ করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তাদের এই বয়সে প্রেমিক-প্রেমিকার ঝগড়ার ধারণাটাই এতো হাস্যকর মনে হল যে সে সশব্দে হেসে উঠলো। পরের মঙ্গলবার ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন তার হাতের গোলপটি ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখছিল তখন ফারমিনা ডাজা নিজের বিবেককে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলো এবং আনন্দের সঙ্গে আবিষ্কার করলো যে সেখানে গত সপ্তাহের অসন্তুষ্টির এক কণাও অবশিষ্ট নাই।
অল্পকালের মধ্যেই ফ্লোরেন্টিনোর আসা-যাওয়াটা একটা বেঢপ পারিবারিক প্রাচুর্যে মণ্ডিত হল, কারণ মাঝে মাঝেই ডাক্তার উরবিনো ডাজা তার স্ত্রীসহ এসে উপস্থিত হত, যেন হঠাৎ এসে পড়েছে, তারপর তারা তাস খেলার জন্য থেকে যেতো। ফ্লোরেন্টিনো তাস খেলতে জানতো না, কিন্তু ফারমিনা তাকে এক বিকালেই শিখিয়ে দেয়, তখন তারা দুজন পরের মঙ্গলবারের জন্য একটা লিখিত চ্যালেঞ্জ পাঠিয়ে দেয় উরবিনো ডাজাদের। এই তাস খেলা সবার জন্য এতো আনন্দদায়ক হয় যে দেখতে দেখতে এটা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার বেড়াতে আসার মতো একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় এবং প্রত্যেকের আনা জিনিসগুলির মধ্য দিয়ে একটা রীতিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ডাক্তার উরবিনোর স্ত্রী চমৎকার কেক-পেস্ট্রি বানাতে পারতেন, ওরা সেসব নিয়ে আসতে, প্রত্যেক বারই নতুন কিছু। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ইউরোপীয় জাহাজগুলি থেকে মুখরোচক খাবার আনা অব্যাহত রাখলো, আর ফারমিনা ডাজা প্রতি বারই একটা না একটা নতুন চমক সৃষ্টি করতো। তারা প্রতি মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার খেলতো এবং কোনো অর্থ বাজি ধরা না হলেও যে হারতো তাকে পরের খেলার দিন একটা বিশেষ কিছু নিয়ে আসতে হত।
ডাক্তার উরবিনো ডাজা এবং বাইরে জনসাধারণের সামনে তার ছবির মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। তার প্রতিভা ছিল সীমিত, আচরণ আড়ষ্ট, হঠাৎ হঠাৎ তার চোখে-মুখে কুঞ্চন দেখা দিতো, গাল লজ্জার লাল হয়ে উঠতো, সুখে কিংবা বিরক্তিতে, যার ফলে তার আত্মসংযমের ক্ষমতা সম্পর্কে অনেকের একটা ভয় ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর পরই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিঃসন্দেহে বুঝলো যে সে হল, লোকে যাকে বলে, একজন ভালো মানুষ, আর ওই অভীধাটিকে সে নিজে সব চাইতে বেশি ভয় করতো। অন্য দিকে ডাক্তারের স্ত্রী ছিল প্রাণোচ্ছল, তার মধ্যে ছিল প্রাকৃত- জনের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও রসবোধ যা তার মার্জিত রুচিশীলতার মধ্যে একটা মানবিক মাত্রিকতা যোগ করেছিল। তাস খেলার জন্য এদের চাইতে ভালো কোনো দম্পতির কথা ভাবা যেতো না, আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মধ্যে ভালোবাসার জন্য যে চির অতৃপ্ত ক্ষুধা ছিল তা এখন একটা মোহময় অনুভূতির ফলে তার দু’কূল ভাসিয়ে দিলো, তার মনে হল সে একটা পরিবারের অংশ।
একদিন রাতে ওরা একসঙ্গে ফারমিনা ডাজার বাড়ি থেকে বেরুবার সময় ডাক্তার উরবিনো ডাজা তাকে তার সঙ্গে লাঞ্চ করতে আমন্ত্রণ জানালো : ‘আগামীকাল, সাড়ে বারোটায়, সোশ্যাল ক্লাবে।’ সেখানে চমৎকার সুরা, আর বহু কারণে সেখানে একজনের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা ছিল ক্লাবের, যার অন্যতম একটা ছিল অবৈধ জন্ম। এ ব্যাপারে কাকা দ্বাদশ লিও প্রচণ্ড বিরক্ত ছিলেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও একবার লজ্জা ও অপমানের শিকার হয়, ক্লাবের একজন প্রতিষ্ঠাতাসদস্যের অতিথি হয়ে সে একদিন ওখানে খেতে গিয়েছিল, খাবার পরিবেশিতও হয় টেবিলে, কিন্তু তারপর তাকে ক্লাব ত্যাগ করতে অনুরোধ করা হয়। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এক সময় নৌবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওই ভদ্রলোককে জটিল কয়েকটা অনুগ্রহ করেছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে তাকে অন্যত্র খেতে নিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর অন্য কিছু করার ছিল। সে বলেছিল, ‘আমরা যারা নিয়ম বানাই তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা তাদেরই সব চাইতে বেশি।
তবু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এবার ডাক্তার উরবিনোর সঙ্গে ওখানে যাবার ঝুঁকিটা নিলো। তাকে এবার বিশেষ সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা করা হয়, যদিও বিশেষ অতিথিদের জন্য সোনালি বইতে স্বাক্ষর দানের আমন্ত্রণ জানানো হল না। লাঞ্চ ছিল সংক্ষিপ্ত, তারা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। বিগত অপরাহ্ণ থেকে এই সাক্ষাৎ নিয়ে তার মধ্যে যে অস্বস্তির বোধ ছিল খাবার আগে পোর্ট সুরা পানের পর তা মিলিয়ে গেল। ডাক্তার উরবিনো ডাজা তার সঙ্গে তার মায়ের বিষয়ে কিছু আলাপ করতে চায়। তার কথাবার্তা শুনে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বুঝলো যে ফারমিনা ডাজা ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্কে আলোচনা করেছে। আরো বিস্ময়কর, সে তার পক্ষে মিথ্যা কথা বলেছে। সে ছেলেকে বলেছে যে তারা বাল্যবন্ধু, সান হুয়ান ডি লা সিনেগা থেকে এখানে আসার পর থেকেই তারা একসঙ্গে খেলাধুলা করেছে, সেই তাকে পড়তে উৎসাহিত করেছে, যে জন্য সে তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ফারমিনা ডাজা আরো বলেছে যে সে প্রায়ই ট্রান্সিটো আরিজার টুকিটাকির দোকানে অনেক সময় কাটিয়েছে, সেখানে প্রচুর এম্ব্রয়ডারির কাজ করেছে, ট্রান্সিটো আরিজা ছিলেন খুব ভালো শিক্ষক, তারপর ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে যে তার আর ঘন ঘন দেখা হয় নি তার কারণ তাদের দুজনের জীবন দুটি পথে বাঁক নেয়।
ডাক্তার উরবিনো ডাজা আসল কথায় আসার আগে বয়স বাড়ার বিষয়ে কিছু অপ্রাসঙ্গিক আলাপ করলো। তার মতে বৃদ্ধ ব্যক্তিদের বোঝা টানতে না হলে পৃথিবী আরো দ্রুত এগিয়ে যেতে পারতো। ডাক্তার বললো, ‘মানবতা, যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদলের মতো, সর্বনিম্ন গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়।’ সে আগামী দিনগুলিতে আরেকটু সহৃদয় আরেকটা সভ্য ব্যবস্থা হবে বলে আশা করছে, বৃদ্ধ ব্যক্তিরা যখন আর নিজেদের দেখাশোনা করতে অসমর্থ হবেন তখন তাদের প্রান্তীয় শহরগুলিতে সরিয়ে নেয়া হবে, সেখানে তারা বুড়ো বয়সের লজ্জা, অপমান, কষ্ট ও ভয়াবহ নৈঃসঙ্গের হাত থেকে বেঁচে যাবেন। চিকিৎসা বিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে এর জন্য যথার্থ বয়স হবে সত্তর, তবে যতদিন পর্যন্ত তারা ওই অনুকম্পার বয়সে উপনীত না হন ততদিন পর্যন্ত নার্সিং হোম বা সেবা সদনই হবে তাদের জন্য উপযুক্ত স্থান। বৃদ্ধরা সেখানে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক মতানৈক্য থেকে নিরাপদ দূরত্বে বাস করবেন, পরস্পরকে সান্ত্বনা দেবেন, পরস্পরের পছন্দ-অপছন্দ, অভ্যাস, দুঃখ-বেদনা প্রভৃতির ভাগ নেবেন। ডাক্তার বললো, বুড়োরা অন্য বুড়োদের সঙ্গে থাকলে আর তত বুড়ো থাকে না।’ তো, তার মায়ের বৈধব্যের নিঃসঙ্গতার সময়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাঁকে যে সুসঙ্গ দিচ্ছে সেজন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে চায় সে। সে অনুরোধ করলো ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যেন এটা অব্যাহত রাখেন, এতে উভয়েরই উপকার ও সকলেরই সুবিধা হচ্ছে, তিনি যেন তার মায়ের ভীমরতিধরা খেয়ালিপনাগুলি সহ্য করে যান। তাদের এই সাক্ষাতের ফলাফলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা স্বস্তি অনুভব করলো। সে বললো, ‘দুশ্চিন্তা কোরো না, আমি এখন ওঁর চাইতে বয়সে চার বছরের বড়ো, অনেক দিন ধরেই তাই আছি, তোমার জন্মের অনেক আগে থেকেই।’ তারপর তার চাপা অনুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একটা শ্লেষাত্মক উক্তি করার লোভ সামলাতে পারলো না। সে বললো, ‘ভবিষ্যতের সমাজে তুমি যখন সমাধিক্ষেত্রে যাবে তখন তোমার মা ও আমার লাঞ্চের জন্য তোমাকে পদ্মফুলের তোড়া নিয়ে যেতে হবে।’
এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত ডাক্তার উরবিনো ডাজা তার ভবিষ্যদ্বাণীর অসঙ্গত দিকের কথা খেয়াল করে নি, যখন করলো তখন কৈফিয়ত দিতে গিয়ে সে ব্যাখ্যার জটিল জালে জড়িয়ে পড়ে পরিস্থিতি আরো খারাপ করে ফেললো। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে ওই জাল থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করলো। এই মুহূর্তে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিল দীপ্তিমান, কারণ সে বুঝলো যে আগে কিংবা পরে ডাক্তারের সঙ্গে তার আরেকবার এই রকম সাক্ষাৎ হবে। অপরিহার্য সামাজিক প্রথা অনুযায়ী ফারমিনা ডাজার আনুষ্ঠানিক পাণিপ্রার্থী হবার আগে ডাক্তারের সঙ্গে তাকে আগে একবার আলাপ করতে হবে। আজকের লাঞ্চ ছিল খুবই উৎসাহব্যঞ্জক, শুধু খাবারের ব্যবস্থার জন্যই নয়, বরং এ জন্য যে সে বুঝলো যে তার অপ্রতিরোধ্য অনুরোধ করাটা হবে সহজ এবং তা গৃহীতও হবে ভালো ভাবে। সে যদি ফারমিনা ডাজার সম্মতি সম্পর্কে সুনিশ্চিত হত তাহলে অনুরোধটি জানাবার জন্য এটাই হত সর্বোত্তম সময়। তাদের ঐতিহাসিক লাঞ্চ-উত্তর আলাপের পর ওই রকম আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দান হত অতিশয় যথাযথ।
তার যুবা বয়স থেকেই ফ্লোরেন্টিনো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতো বিশেষ সাবধানতার সঙ্গে। তার বিশ্বাস, বার্ধক্য শুরু হয় ছোটখাটো একটা পতন দিয়ে, আর মরণ আসে দ্বিতীয় পতনের হাত ধরে। নিজের আপিসের সিঁড়িই তার কাছে মনে হত সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক, খাড়া, সরু, আর পা টেনে টেনে ওঠার জন্য বিশেষ চেষ্টা করার অনেক আগে থেকেই সে প্রতিটি সিঁড়ির ধাপের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, দু’হাতে রেলিং ধরে, সাবধানে উপরে উঠতো। ওই সিঁড়ির পরিবর্তে আরেকটা কম বিপজ্জনক সিঁড়ি বসাবার কথা কয়েকবারই হয়েছে, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো সর্বদাই সিদ্ধান্তটি আগামী মাসের জন্য স্থগিত রেখে দিয়েছে, তার মনে হয়েছে নতুন সিঁড়ির অর্থ হবে বার্ধক্যের কাছে নতি স্বীকার করা। বছর গড়িয়ে যায়, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে তার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সময় লাগে, সে তাড়াতাড়ি এর কারণ হিসাবে জানাতো যে সে একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করছে, আর কিছু নয়। কিন্তু, সেদিন ডাক্তার উরবিনো ডাজার সঙ্গে লাঞ্চের পর সে যখন ফিরে এলো, খাওয়ার আগে পোর্ট সুরা ও খাওয়ার সময় লাল মদ্য পানের পর, বিশেষ করে তাদের আলাপের বিজয়ঘটিত সমাপ্তির পর, তখন সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে পা রাখার সময় সে এমনই যৌবনোচ্ছল নাচের ভঙ্গি করলো যে তার বাঁ পায়ের গোড়ালি মচকে গেল, সে পেছন দিকে হেলে পড়ে গেল, মারা যে যায় নি তা ছিল নিতান্তই দৈবের অনুগ্রহ। পড়তে পড়তে তার স্বচ্ছ মাথায় মনে হল যে দুজন মানুষ একটি রমণীকে এতো বছর ধরে ভালোবেসেছে তারা যে একে অন্যের এক বছরের মধ্যে একই ভাবে মারা যাবে জীবনের লজিক নিশ্চয়ই তা অনুমোদন করবে না। তার চিন্তা ঠিকই ছিল। পায়ের ডিম পর্যন্ত তার গোটা পা প্ল্যাস্টার ছাঁচের মধ্যে আটকে দেয়া হল, নড়নচড়নহীন ভাবে সে বিছানায় শুয়ে থাকতে বাধ্য হল, কিন্তু তার মনের অবস্থা হল পতনের আগের চাইতে উদ্দীপিত। কিন্তু ডাক্তার যখন জানালো যে তাকে ষাট দিন বিশ্রাম নিতে হবে তখন সে তার দুর্ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সে কাতর কণ্ঠে বললো, ‘তোমার কাছে যা দশ বছর, ডাক্তার, আমার কাছে দু’মাসই তা।’
তার মূর্তির পায়ের মতো পা দু’হাতে ধরে সে কয়েকবারই উঠবার চেষ্টা করে কিন্তু বাস্তবতার কাছে তাকে হার স্বীকার করতে হয়। কিন্তু, অবশেষে, সে যখন আবার হাঁটতে পারলো, তখনো গোড়ালিতে ব্যথা আছে, পিঠেও, তখন তার মনে হল এই দৈবঘটিত পতনের ক্ষেত্রে তার অধ্যবসায়কে নিয়তি সত্যিই পুরস্কৃত করেছে।
প্রথম সোমবারই ছিল সব চাইতে কষ্টকর। ব্যথা কমে গিয়েছিল, অসুস্থতার সম্ভাব্য গতিধারা সম্পর্কে ডাক্তারের পূর্বাভাসও ছিল উৎসাহব্যঞ্জক, কিন্তু গত চার মাসের মধ্যে এই প্রথমবার আগামীকাল বিকালে সে ফারমিনা ডাজার ওখানে যেতে পারবে না নিয়তির এই বিধান সে মেনে নিতে অস্বীকার করলো। কিন্তু আত্মসমর্পিত দিবানিদ্রার পর সে তার নিয়তিকে মেনে নিল, চিঠি লিখে ফারমিনা ডাজাকে জানালো যে সে এ-মঙ্গলবারে তার ওখানে যেতে পারছে না। চিঠিটা সে সুরভিত কাগজে নিজের হাতে লিখলো, আলোকোজ্জ্বল কালিতে, যেন অন্ধকারের মধ্যেও সে পড়তে পারে এবং ওর সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টায় কোনো রকম লজ্জার বালাই না রেখে সে তার দুর্ভাগ্যের ঘটনার একটা নাটকীয় বর্ণনা দিলো। ফারমিনা ডাজা দুদিন পর উত্তর দিলো, খুবই সহানুভূতিপূর্ণ, খুবই সহৃদয় কিন্তু একটি বাড়তি কথাও নাই, তাদের প্রেমের সেই মহৎ দিনগুলির মতোই। দ্রুত অপসৃয়মান সুযোগকে আঁকড়ে ধরে সে আবার ওর কাছে চিঠি লিখলো। ও দ্বিতীয় বার উত্তর দেবার পর সে তাদের মঙ্গলবারের সাংকেতিক আলাপের চাইতে আরেকটু অগ্রসর হবার সিদ্ধান্ত নিলো, সে তার বিছানার পাশে একটা টেলিফোন বসালো, যুক্তি দিল যে কোম্পানির দৈনন্দিন কাজের ওপর তার চোখ রাখা দরকার। সে তিন সংখ্যার একটা নম্বরের সঙ্গে তাকে যুক্ত করে দেবার জন্য অপারেটরকে বললো, প্রথম বার ডায়াল করার পর থেকেই ওই নম্বর তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। শান্তপ্রিয় কণ্ঠস্বরটি দূরত্বের রহস্যময়তায় একটু টান টান হয়ে উত্তর দিলো, অন্য কণ্ঠস্বরটি চিনতে পারলো, তারপর প্রীতি সম্ভাষণের তিনটি গতানুগতিক বাক্য উচ্চারণের পর ছেড়ে দিলো ফোন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওর ঔদাসীন্যে মর্মাহত : ওরা আবার গোড়ার অবস্থানে ফিরে এসেছে।
দুদিন পর সে ফারমিনা ডাজার একটা চিঠি পেলো, ও অনুরোধ করেছে সে যেন তাকে আর ফোন না করে। তার যুক্তি ছিল যথার্থ। শহরে মাত্র গুটিকয়েক টেলিফোন ছিল, সব যোগাযোগ করতে হত অপারেটরের মাধ্যমে, আর অপারেটর সবাইকে চিনতো, তাদের জীবন, তাদের অলৌকিক ঘটনাবলী, সব ছিল তার জানা, লোকটি বাড়িতে না থাকলেও কোনো অসুবিধা হতো না, যেখানেই থাকুন অপারেটর তাকে খুঁজে বের করতো। এই কর্মদক্ষতার পুরস্কার হিসাবে সে নিজেকে তাবৎ কথোপকথন সম্পর্কে অবহিত রাখতো, তাবৎ গোপন ঘটনা তার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হত, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সযত্নে রক্ষিত যাবতীয় নাটকীয় ঘটনা সে জেনে ফেলতো। মাঝে মাঝে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি জানাবার জন্য কিংবা উত্তেজিত মেজাজ ঠাণ্ডা করার লক্ষ্যে সে চলমান ফোনালাপকেও বাধা দিতো। তার ওপর, ওই বছর ‘ন্যায় বিচার’ নামে একটি সান্ধ্য পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। পত্রিকাটির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নামের শেষে দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী পরিচিতি সংবলিত পরিবারগুলিকে আক্রমণ করা। প্রকাশকের পুত্ররা সোশ্যাল ক্লাবে প্রবেশাধিকার পায় নি, তারই প্রতিশোধ সে নিতো এই ভাবে। ফারমিনা ডাজা, তার অনিন্দ্য সুন্দরজীবন সত্ত্বেও এখন তার কথা ও আচরণে আগের চাইতেও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করে চলতো, তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের সঙ্গেও। তাই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে সে তার যোগাযোগ সেকেলে চিঠিপত্রের মাধ্যমেই রাখতো। এই চিঠিপত্রের আদান-প্রদান এতো ঘন ঘন ও আবেগদীপ্ত হয়ে ওঠে যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার পায়ের কথা, বিছানায় পড়ে থাকার শাস্তির কথা, বস্তুতপক্ষে অন্য সব কিছুর কথা ভুলে যায়। হাসপাতালে রোগীদের যে রকম সহজে বহনযোগ্য টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হয় সে ওই রকম টেবিলে কাগজ রেখে চিঠি লেখায় আত্মনিয়োগ করলো।
তারা এখন আবার পরস্পরকে তুমি সম্বোধন করছে, আগে এক সময় যেমন তাদের চিঠিতে নিজেদের জীবনের সব কথা বর্ণনা করতো এখন আবার তা করতে শুরু করলো, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আবারও বড় বেশি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। একটা তীক্ষ্ণ সূচিমুখ পিন দিয়ে সে ক্যামেলিয়া ফুলের পাতায় ফারমিনার নাম লিখে পাতাটা তার চিঠির মধ্যে স্থাপন করলো। দুদিন পর ওটা ফেরত এলো, সঙ্গে কোনো বার্তা ছাড়া। ফারমিনা ডাজা নিজেকে সংবরণ করতে পারে নি। এই সব কিছু তার মনে হল শিশুদের খেলাধুলার মতো, বিশেষ করে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন এভাঞ্জেলস পার্কের অপরাত্নকালীন বিষণ্ন কবিতাবলীর কথা, ওর স্কুলে যাবার পথে বিভিন্ন জায়গায় চিঠি লুকিয়ে রাখার কথা, বাদামগাছের নিচে ওর সেলাই শেখার কথা বারবার মনে করিয়ে দিতো। দুঃখভারাক্রান্ত চিত্তে ও তাকে তিরস্কার করলো, অন্যান্য তুচ্ছ মন্তব্যের পাশাপাশি একটা আকস্মিক প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, ‘যার কোনো অস্তিত্বই নাই কেন তুমি জেদ করে তার কথা বলছো?’ পরবর্তী সময়ে, সে যে স্বাভাবিক ভাবে নিজেকে বুড়ো হতে দিচ্ছে না বরং তা প্রতিহত করার জন্য নিরর্থক চেষ্টা করছে, সেজন্যও ও তাকে তিরস্কার করলো। তাড়াহুড়া করা এবং অতীতের স্মৃতি জাগিয়ে তোলার জন্য সে যে সব ভুল করছে তার কারণ ওটাই। যে-মানুষ তার বৈধব্যের কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তি যোগাবার চিন্তাভাবনার অধিকারী হতে পারে সে কেমন করে তার নিজের জীবনের ক্ষেত্রে সেগুলি প্রয়োগের সময় এই রকম বালোকোচিত ভ্রান্তির জালে জড়িয়ে পড়তে পারে তা ও বুঝতে পারলো না। তাদের ভূমিকা বদলে যায়। এখন ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবার জন্য ফারমিনাই ফ্লোরেন্টিনোকে নতুন সাহস দিলো, ও এমন একটি বাক্য ব্যবহার করলো যা ফ্লোরেন্টিনো তার বেপরোয়া তাড়াহুড়ায় বুঝতেই পারলো না : ‘সময় পার হতে দাও, তাহলেই আমরা বুঝতে পারবো সময় আমাদের জন্য কী নিয়ে আসছে।’ ফারমিনার মতো ভালো শিক্ষার্থী ফ্লোরেন্টিনো কখনোই ছিল না। তার বাধ্যতামূলক স্থানুত্ব, সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে তার এই বিশ্বাসের ক্রমবধর্মান স্বচ্ছতা, ওকে দেখার জন্য তার উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষা সব যেন তার কাছে একটা জিনিস প্রমাণ করলো, তার পড়ে যাবার ভয়টা সে যেমন ভেবেছিলো আসলে তার চাইতেও বেশি সঠিক ছিলো, তার চাইতেও ছিল বেশি ট্র্যাজিক। এই প্রথম সে মৃত্যুর বাস্তবতার কথা যুক্তিযুক্ত ভাবে ভাবতে শুরু করলো।
লিওনা কাসিয়ানি একদিন অন্তর অন্তর তাকে স্নান করতে সাহায্য করতো, তার পাজামা বদলে দিতো, এনিমা দিতো, তার জন্য মূত্রাধার ধরে রাখতো, তার পিঠের ঘায়ের ওপর আর্নিকার পুঁটলি দিয়ে সেঁক দিতো, তার স্থানুত্ব যেন অন্য কোনো কঠিন অসুখের জন্ম না দেয় সে জন্য ডাক্তারের পরামর্শ মতো তার গা মালিশ করতো। শনি ও রবিবার এসব কাজ করতো আমেরিকা ভিসুনা, এ বছরের ডিসেম্বরে সে তার শিক্ষকতার ডিগ্রি লাভ করবে। ফ্লোরেন্টিনো কথা দিয়েছে যে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য সে নৌকোম্পানির খরচে তাকে অ্যালাবামা পাঠাবে, কতকটা তার বিবেককে শান্তি দেয়ার জন্য, কতকটা ওর তিরস্কারের মুখোমুখি না হবার জন্য, যে তিরস্কার কি ভাবে করতে হবে তা যেমন আমেরিকা জানতো না, ওকে কি কৈফিয়ত দেবে তাও তেমনি ফ্লোরেন্টিনো জানতো না। ও যে তাকে কী গভীর ভাবে ভালোবেসেছিল তা ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কল্পনা করতে পারে নি, তাই সাপ্তাহিক ছুটির দুটি দিনে তাকে ছাড়া ও তার হোস্টেলে কী ভাবে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে, তাকে ছাড়া ওর জীবন কী ভাবে কাটবে, এ সব কথা সে ভাবতে পারে নি। স্কুল থেকে তাকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে জানানো হয় যে ও ক্লাসে সব সময় প্রথম হত, এখন তার অবস্থান এসে দাঁড়িয়েছে সর্বশেষে, আর ফাইনাল পরীক্ষায় সে প্রায় ফেল করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার অভিভাবকের দায়িত্ব উপেক্ষা করলো, একটা অপরাধ বোধ থেকে, যা সে এড়াতে চেষ্টা করে, ওর মা-বাবাকে সে কিছু জানালো না, আমেরিকার সঙ্গেও সে এ সম্পর্ক কোনো আলোচনা করলো না, এই আশঙ্কায় যে ও তার ব্যর্থতার জন্য তাকে দায়ী করবে। ওই আশঙ্কা মোটেই অমূলক ছিলো না। অতএব সে পরিস্থিতিকে যেমন ছিল তেমনি চলতে দিল, উপলব্ধি করলো না যে সে তার সমস্যাগুলি পেছনে ঠেলে দিচ্ছে এই আশায় যে মৃত্যু সব কিছুর সমাধান করে দেবে।
যে দুজন নারী তার যত্ন নিচ্ছিল তারা এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিজেও, তার পরিবর্তন লক্ষ করে বিস্মিত হল। দশ বছরও হয় নি, সে তার বাড়ির প্রধান সিঁড়ির পেছনে একটি কাজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিল, ওর কাপড় পরা এবং দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই, তারপর, একটা ফিলিপিনো মোরগের চাইতেও কম সময়ে সে মেয়েটিকে গর্ভবতী করে ফেলেছিলো। সে মেয়েটির কাছ থেকে কথা আদায় করে নেয় যে সে শপথ করে বলবে তার এই অসম্মানজনক অবস্থার জন্য দায়ী রবিবারের এক খণ্ডকালীন প্রেমিক, যে বাস্তবে তাকে একটা চুমো পর্যন্ত কখনো খায় নি, আর এর পুরস্কার হিসাবে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে আসবাবপত্রসহ একটি সুসজ্জিত বাড়ি দান করে। মেয়েটির বাবা ও কাকারা ছিল দক্ষ আখ-চাষী, তারা ওদের দুজনকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। বর্তমানের ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে সেই একই ব্যক্তি এটা সম্ভবপর বলে মনে হল না। এখন সম্মুখ ও পশ্চাৎ উভয় দিক থেকে যে-দুটি নারী তাকে নাড়াচাড়া করছে, কয়েক মাস আগেও তার মধ্যে যারা কামনার শিহরণ জাগাতো তারা এখন তাকে কোমরের উপরে ও নিচে সাবান ঘষে তার শরীর পরিষ্কার করে দিচ্ছে, মিশরিয় তুলার তৈরি তোয়ালে দিয়ে তার গা মুছিয়ে দিচ্ছে, আর তার মুখ দিয়ে কামনার একটা নিঃশ্বাসও নির্গত হচ্ছে না। তার কামনা-বাসনার অভাব সম্পর্কে ওদের দুজনের দু’রকম ব্যাখ্যা ছিল। লিওনা কাসিয়ানির ধারণা এটা হচ্ছে তার মৃত্যুর পূর্বাভাষ। আমেরিকা ভিসুনার মতে এর পেছনে রয়েছে একটা গোপন কারণ, যার জটিলতা সে ধরতে পারছে না। আসল ব্যাপারটা একমাত্র সেই জানতো, আর তার ছিল একটা নিজস্ব নাম। সে যাই হোক, এটা ছিল অন্যায়, সে যেরকম চমৎকার সেবা লাভ করতো তার তুলনায় সেবাদানকারীরা অনেক বেশি কষ্ট ভোগ করছিলো।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দেখা-সাক্ষাতের অভাব ফারমিনা ডাজা কতোখানি অনুভব করছে সেটা উপলব্ধি করার জন্য তার তিনটি মঙ্গলবারের বেশি সময় প্রয়োজন হয় নি। তার বন্ধুদের দেখা-সাক্ষাৎ সে উপভোগ করতো, সময় তার স্বামীর অভ্যাসগুলি থেকে তাকে যত দূরে ঠেলে দেয় সে তার বন্ধুদের সঙ্গ তত বেশি করে উপভোগ করতে শুরু করে। লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েল ডেল অবিস্পোর কানের বেদনা কিছুতেই না কমায় সে চিকিৎসার জন্য পানামা গিয়েছিল, এক মাস পর ফিরে এসেছে, আগের চাইতে অনেক ভালো বোধ করছে এখন, কিন্তু কানে শুনছে আগের চাইতেও কম, আর কানে লাগিয়েছে একটা তূর্যের মতো যন্ত্র। তার প্রশ্ন আর উত্তরের তালগোল পাকানো বিভ্রান্তির মধ্যে ফারমিনা ডাজাই ছিল তার সব চাইতে সহনশীল বন্ধু, আর এতে লুক্রেশিয়া এতোই উৎসাহিত হয় যে প্রায় প্রতিদিনই সময়ে অসময়ে সে ফারমিনা ডাজার বাসায় চলে আসতো। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে সে যে স্নিগ্ধ বিকালগুলি কাটাতো তার স্থান কেউ নিতে পারলো না।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বিশ্বাস করতো যে অতীতের স্মৃতি কখনো ভবিষ্যতের ত্রাণকর্তা হতে পারে না, সে জোর দিয়ে এটা বিশ্বাস করতে চাইতো। পক্ষান্তরে, ফারমিনা ডাজা সব সময়ই বিশ্বাস করে এসেছে যে বিশ বছর বয়সের ওই প্রবল আবেগমথিত উত্তেজনা ছিল মহৎ একটা কিছু, খুব সুন্দর একটা কিছু, কিন্তু সেটা প্রেম ছিল না। তার রুক্ষ সততা সত্ত্বেও ফারমিনা ডাজা কিন্তু এটা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাছে প্রকাশ করার কথা কখনো ভাবে নি, না চিঠিতে, না সামনা-সামনি। তাছাড়া তার লিখিত দার্শনিক ভাবনাচিন্তার সান্ত্বনা প্রদানের অলৌকিক শক্তির পর তার চিঠিগুলির ভাবালু কৃত্রিমতা, তার গীতিকাব্যিক মিথ্যাগুলি যে তাকে শস্তা করে তুলছে, অতীতকে পুনরুদ্ধার করার জন্য তার উন্মত্ত জেদ যে তার লক্ষ্যার্জনকেই বিঘ্নিত করছে এসব কথা ফারমিনা ডাজা ওকে বলার মতো নিষ্ঠুর হতে পারলো না। না : তাকে ছাড়া মঙ্গলবারের বিকালগুলি যে এতো পুনরাবৃত্তিমূলক হতে পারে সেটা তার বহু আগের চিঠিগুলির একটি লাইনও, তাচ্ছিল্যের শিকার ফারমিনার নিজের যৌবনের একটি মুহূর্তও, এতো স্পষ্ট করে তুলতে পারে নি।
ফারমিনা ডাজার স্বামী তার এক বার্ষিকী উপলক্ষে তাকে একটা রেডিওকনসোল উপহার দিয়েছিল। একবার জিনিসপত্র সাফ সুতরো করার প্রবল তাড়নায় সে ওই যন্ত্রটিকে আস্তাবলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারা ঠিক করেছিলো যে এই শহরে ওই জাতীয় যন্ত্রের প্রথম উপস্থিতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ওটাকে তারা জাদুঘরে দান করবে। ফারমিনা ডাজা তার শোক পালনের বিষণ্ণ দিনগুলিতে ওই গানের যন্ত্রটি আর কখনো ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার মতো ঐতিহ্যাবাহী পারিবারিক নামের কোনো বিধবা মৃতের স্মৃতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে কোনো রকম গানই শুনতে পারতো না, আপন ঘরের নিভৃতির মধ্যেও না। কিন্তু এখন তার নিঃসঙ্গ তৃতীয় মঙ্গলবারের পর সে রেডিও যন্ত্রটি আবার ড্রয়িংরুমে ফিরিয়ে আনলো, আগে রিয়োবান্ডা কেন্দ্রের যেসব ভাবালুতাময় গান সে উপভোগ করতো সে সব শুনবার জন্য নয়, এখন সে তার অলস মুহূর্তগুলি ভরে রাখবে সান্টিয়াগো ডি কিউবা থেকে প্রচারিত ধারাবাহিক সোপ অপেরাগুলি দিয়ে। পরিকল্পনাটা ছিল ভালো, কারণ তাদের মধুচন্দ্রিমার সময় থেকেই তার স্বামী তার মধ্যে, অধ্যবসায়ের সঙ্গে, বই পড়ার যে অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন প্রথম মেয়ের জন্মের পর থেকেই তার সে অভ্যাসে ভাটা পড়তে থাকে, তারপর তার চোখের ক্লান্তি বাড়তে থাকলে সে এক সময় বই পড়া প্রায় সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়, শেষে অবস্থা এমন হল যে মাসের পর মাস কেটে গেলেও সে যে কোথায় তার পড়ার চশমা রেখেছে তার খোঁজও সে রাখলো না।
সান্টিয়াগো ডি কিউবা থেকে সম্প্রচারিত ভাবালুতাময় ধারাবাহিক নাটকগুলি তার এতো ভালো লাগে যে সে প্রতিদিন অধৈর্য হয়ে নতুন কাহিনীর জন্য অপেক্ষা করে থাকতো। মাঝে মাঝে পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে জানার জন্য সে খবর শুনতো, আর অল্প দু’এক সময় যখন বাড়িতে কেউ থাকতো না তখন সে ভল্যুম খুব কমিয়ে দিয়ে সান্টো ডমিঙ্গো এবং পুয়ের্টো রিকো থেকে সম্প্রচারিত বল নৃত্যের সঙ্গীত শুনেছে। এক রাতে হঠাৎ একটা অচেনা স্টেশন তার যন্ত্রে ধরা পড়লো, ওই শব্দ এতো স্পষ্ট ও জোরে হল যেন পাশের ঘর থেকে আসছে, আর সে তখন একটা হৃদয়বিদারক খবর শুনলো। এক বয়স্ক দম্পতি, যারা অনেক দিন ধরে প্রতি বছর একই জায়গায় তাদের মধুচন্দ্রিমা উদযাপন করে আসছে, তারা খুন হয়েছে, যে নৌকায় তারা যাচ্ছিল তার কাপ্তান নৌকার বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে তাদের খুন করেছে, তারপর তাদের সঙ্গে যে টাকা ছিল তা চুরি করে নিয়েছে : চৌদ্দ ডলার। লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েল যখন তাকে পুরো কাহিনীটা শোনালো তখন ফারমিনা ডাজা একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। স্থানীয় এক খবরের কাগজে পুরো খবর প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ আবিষ্কার করেছে, যে বয়স্ক দম্পতিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তারা ছিল গোপন প্রেমিক-প্রেমিকা, চল্লিশ বছর ধরে তারা এই ভাবে ছুটি কাটিয়ে এসেছে, দুজনেরই অনেক সন্তানসন্ততি নিয়ে স্থিতিশীল সুখী বৈবাহিক জীবন ছিল। ফারমিনা ডাজা যে রেডিওতে সোপ অপেরা শুনে কখনো কাঁদতো না তাকে এখন অনেক কষ্টে তার উদ্গত অশ্রুরাশি চেপে রাখতে হল। তার পরের চিঠিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, কোনো রকম মন্তব্য ছাড়া, কাগজ থেকে কেটে রাখা খবরটা তাকে পাঠিয়ে দেয়।
ফারমিনা ডাজাকে ওই শেষ অশ্রুরাশি চেপে রাখতে হয় নি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ষাট দিনের নির্জনবাসের মেয়াদ তখনো পূর্ণ হয় নি, এমন সময় ‘ন্যায় বিচার’ পত্রিকার প্রথম পাতায় পাত্র-পাত্রীর ছবিসহ তাদের কথিত গোপন প্রণয়ের খবর ছাপা হয়, ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো ও লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েল ডেল অবিস্পোকে কেন্দ্র করে। তাদের সম্পর্কের প্রকৃতি নিয়ে বিশদভাবে নানা অনুমান তুলে ধরা হয়, কতো ঘন ঘন তারা মিলিত হতেন এবং কোথায়, এই দুষ্কর্মে ফারমিনা ডাজার স্বামীর সহযোগিতা, তিনি যে তার আখ চাষের খামারে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের সাথে সমকামিতায় আসক্ত ছিলেন এই জাতীয় নানা কথা পত্রিকায় সবিস্তারে মুদ্রিত হয়। রক্তের মতো লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে মুদ্রিত কাহিনীটা দুর্বল স্থানীয় অভিজাত সম্প্রদায়ের ওপর একটা ভয়ঙ্কর বজ্রাঘাতের মতো পড়লো। তার একটা লাইনও সত্য ছিল না। জুভেনাল উরবিনো আর লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েল ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এক সময়, তখন তারা উভয়েই ছিলেন অবিবাহিত, বিয়ের পরও তাদের বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকে, কিন্তু তারা কখনও প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন না। সে যাই হোক, এই কাহিনীর উদ্দেশ্য ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর চরিত্রে কালিমা লেপন বলে মনে হয় না, তাঁর স্মৃতিকে সবাই শ্রদ্ধা করতো, এর উদ্দেশ্য ছিল গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে সোশ্যাল ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েলের স্বামীকে আঘাত করা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবশ্য এই কুৎসার কাহিনী চাপা দেয়া হয়, কিন্তু লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েল এর পর আর ফারমিনা ডাজার বাসভবনে যান নি, আর ফারমিনা ডাজা এটাকে তার অপরাধের স্বীকৃতি হিসাবে ধরে নেয়।
অল্প পরেই বোঝা গেল যে ফারমিনা ডাজাও তার শ্রেণীর বিপদ থেকে মুক্ত নয়। ‘ন্যায় বিচার’ তার একটা দুর্বল দিককে আক্রমণ করল : তার বাবার ব্যবসায়িক কমকাণ্ড। তাঁকে যখন বাধ্যতামূলক ভাবে নির্বাসনে পাঠানো হয় তখন তাঁর অপরিচ্ছন্ন লেনদেনের একটা দৃষ্টান্তই ফারমিনা ডাজার জানা ছিল, গালা প্লাসিডিয়া তাকে সে কথা বলেছিল। গভর্নরের সঙ্গে দেখা করার পর ডাক্তার উরবিনো যখন বিষয়টিকে সমর্থন করেন তখন ফারমিনা ডাজার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে তার বাবা একটা অপবাদ ছড়ানো কুৎসার শিকার হয়েছেন। সরকারের দুজন প্রতিনিধি আদেশপত্র নিয়ে তাদের ইভাঞ্জেলেস পার্কের বাড়িতে এসেছিল, বাড়ির আগাপাশতলা সব তারা খুঁজে দেখে কিন্তু যে জিনিসের খোঁজ করছিল তা পেলো না। শেষে তারা ফারমিনা ডাজার পুরনো শোবার ঘরের কাচের দরজা দেয়া পোশাকের আলমারিটা খোলার নির্দেশ দিল। ওই সময় একমাত্র গালা প্লাসিডিয়া বাড়িতে ছিল, কাউকেই কোনো কিছু করা থেকে বাধা দানের শক্তি তার ছিল না, সে আলমারি খুলতে অস্বীকার করলো এই বলে যে ওটার চাবি তার কাছে নাই। তখন একজন প্রতিনিধি তার পিস্তলের কুঁদার আঘাতে দরজার আয়না ভেঙ্গে ফেলে, তখন কাচ আর কাঠের মধ্যবর্তী স্থানে ঠেসে গুঁজে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায় একশো ডলারের এক গাদা জাল নোট। একটা বিশাল আন্ত র্জাতিক চক্রের সঙ্গে লোরেঞ্জো ডাজার যোগাযোগের শেষ সূত্রটি এই ভাবে আবিষ্কৃত হয়। জালিয়াতিটা ছিল অভ্যন্ত দক্ষতাপূর্ণ, কারণ নোটগুলিতে মূল কাগজের জল-ছাপ ছিল, রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রায় জাদুমন্ত্রের মতো এক ডলারের লেখা মুছে ফেলে সেখানে একশো ডলারের অঙ্ক বসিয়ে তা পুনর্মুদ্রিত করা হয়। লোরেঞ্জো ডাজা দাবি করলেন যে ওই আলমারি তাঁর কন্যার বিয়ের অনেক পরে কেনা হয়, নোটগুলি ভেতরে থাকা অবস্থাতেই আলমারিটা এ বাড়িতে এসেছিল, কিন্তু পুলিশ প্রমাণ করে যে ফারমিনা ডাজা স্কুলের ছাত্রী থাকার সময় থেকেই এটা এখানে আছে। একমাত্র লোরেঞ্জো ডাজার পক্ষেই নোটগুলি আয়নার পেছনে লুকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল। ডাক্তার উরবিনো গভর্নরকে কথা দেন যে কেলেঙ্কারিটা চাপা দেবার জন্য তিনি তাঁর শ্বশুরকে তাঁর স্বদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন, আর তার পরেই তিনি স্ত্রীকে এই সব কথা জানান। কিন্তু খবরের কাগজ আরো অনেক কথা প্রকাশ করে।
সেখানে বলা হয় যে গত শতাব্দীতে যে অনেকগুলি গৃহযুদ্ধ হয় তার একটা চলার সময়ে লোরেঞ্জো ডাজা উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট আকিলিও পারার সরকার আর জনৈক জোসেফ টি. কে. করজেনিওভস্কির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছিলেন। শেষোক্ত জন ছিলেন পোলান্ডের অধিবাসী, ফরাসি পতাকা নিয়ে চলাচলকারী বাণিজ্য তরী সাঁৎ আতোয়ার একজন নাবিক। তিনি এখানে অস্ত্র বেচাকেনার একটা জটিল চুক্তি পাকাপাকি করার জন্য কয়েক মাস অবস্থান করেছিলেন। এই করজেনিওভস্কিই পরবর্তী সময়ে জোসেফ কনরাড নামে বিখ্যাত হন। কোনো এক ভাবে লোরেঞ্জো ডাজার সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। লোরেঞ্জো তার কাছ থেকে সরকারের পক্ষে জাহাজ ভর্তি অস্ত্র ক্রয় করে, তার পরিচয়পত্র ও তার টাকা-পয়সার রশিদ ঠিকঠাক ছিল, পণ্যের দাম দেয়া হয় স্বর্ণ মুদ্রায়। খবরের কাগজের প্রতিবেদন অনুযায়ী লোরেঞ্জো ডাজা দাবি করেছিল যে ওই অস্ত্র একটা অসম্ভব আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়ে লুট করে সংগৃহীত হয়, আর পরে সে ওই অস্ত্রসম্ভার দ্বিগুণ মূল্যে আবার বিক্রি করে সরকারের সঙ্গে তখন যুদ্ধরত রক্ষণশীলদের কাছে
‘ন্যায় বিচার’ পত্রিকা আরো জানায় যে জেনারেল রাফায়েল রেইস ওই সময়ে একটা নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। লোরেঞ্জো ডাজা ইংরেজ সেনাদলের কাছ থেকে এক জাহাজ বুট জুতা কেনেন, খুব কম দামে, আর ওই এক লেনদেন-এ তিনি ছ’মাসে তাঁর সম্পদ দ্বিগুণ করে ফেলেন। খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী মাল নিয়ে জাহাজে বন্দরে ভিড়লে লোরেঞ্জো ডাজা মাল খালাস করতে অস্বীকার করেন, কারণ জুতাগুলি সব ছিল ডান পায়ের। আইন মোতাবেক শুল্ক বিভাগ তখন ওই অকেজো মাল নিলাম করে দেয়, নিলাম-ডাকে অংশ নেয় একমাত্র লোরেঞ্জো ডাজা এবং তিনি একশো পেসোর নাম মাত্র মূল্যে ওই জুতো কিনে নেন। ওই একই সময়ে, অনুরূপ পরিস্থিতিতে, রিওহাচা বন্দরে এক জাহাজ ভর্তি বাঁ পায়ের জুতা এসে উপস্থিত হয়, আর লোরেঞ্জো ডাজার দুষ্কর্মের এক সহযোগী তা কিনে ফেলে। এবার সব জুতা সঠিক জোড়ায় পরিণত হলে লোরেঞ্জো ডাজা উরবিনো ডি লা কল পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে তার সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে সেগুলি বিক্রি করেন।
পত্রিকা তাদের কাহিনীর উপসংহারে উল্লেখ করে যে লোরেঞ্জো ডাজা যদিও বলতেন যে তিনি গত শতাব্দীর শেষ দিকে তাঁর কন্যার জন্য উন্নততর সুযোগ-সুবিধার খোঁজে সান হুয়ান ডি লা সিনেগা ছেড়ে চলে আসেন, কিন্তু আসলে তাঁকে স্বদেশ ত্যাগ করতে হয় অন্য এক কারণে। বিদেশ থেকে আমদানি করা তাঁর তামাকের লাভজনক কারবারে তিনি একটা অসাধু প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেন, তামাকের মধ্যে কুচি কুচি করে কাটা পাতলা কাগজ তিনি এমন নিপুণতার সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন যে খুব সৌখিন ও সমঝদার ধূমপায়ীরাও ফাঁকিটা ধরতে পারতো না। ওরা আরেকটা গুপ্ত আন্তর্জাতিক কারবারের সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা উদ্ঘাটন করে, গত শতাব্দীর শেষ দিকে সেটা খুব লাভজনক একটা ব্যবসা হয়ে ওঠে, সেটা ছিল পানামা থেকে চোরাই পথে চীনাদের এদেশে নিয়ে আসা। পক্ষান্তরে, তার খচ্চরের ব্যবসা নিয়ে সকলের যে সন্দেহ ছিল, যা তার খ্যাতির অনেক ক্ষতি করে, সেটাই ছিল তার এক মাত্র সৎ ব্যবসা।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন বিছানা ছেড়ে উঠলো তখন তার পৃষ্ঠদেশ জ্বলছিলো আগুনের মতো। জীবনে সে এই প্রথম বারের মতো তার ছাতার বদলে হাতে নিলো একটা বেড়াবার লাঠি, আর তার প্রথম গন্তব্য হল ফারমিনা ডাজার বাড়ি। তাকে দেখে মনে হল এক অচেনা মানুষ, বয়সের ভারে বিধ্বস্ত, ক্ষোভ আর অপমান বোধ যার বেঁচে থাকার ইচ্ছা ধ্বংস করে দিয়েছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা গৃহবন্দি হয়ে পড়ে থাকার সময় ডাক্তার উরবিনো ডাজা তাকে দু’বার দেখতে গিয়েছিল, ন্যায় বিচার’-এ প্রকাশিত কাহিনী দুটি পড়ে তার মা যে কী রকম বিচলিত হয়েছে সে কথা তাকে সে জানিয়েছিলো। প্রথম কাহিনী তার স্বামীর অবিশ্বস্ততা এবং তার বন্ধুর আনুগত্যহীনতার জন্য তার মনে এমন একটা প্রচণ্ড যুক্তিহীন ক্রোধের জন্ম দেয় যে সে প্রতি মাসের এক রবিবার করে পারিবারিক সমাধিস্থলে যাবার প্রথাটি ত্যাগ করে। স্বামীর উদ্দেশে উচ্চ কণ্ঠে তীব্র অপমানজনক বাক্য উচ্চারণ করতে তার ইচ্ছা করছিলো, কিন্তু কবরে শুয়ে থেকে তিনি তা শুনতে পাবেন না, এটাই তাকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। তার ঝগড়া ছিল এক মৃত ব্যক্তির সঙ্গে। তবে লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েলকে সে তার মনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল, ওকে যেন সবাই বলে দেয়, যে অসংখ্য লোক তার শয্যা সঙ্গী হয়েছে তাদের মধ্যে সে অন্তত একজন সত্যিকার মানুষ পেয়েছিল, একমাত্র ওটাই তাকে তৃপ্তি দেবে। আর লোরেঞ্জে ডাজার কাহিনীর ক্ষেত্রে, কোন জিনিসটা তাকে বেশি বিচলিত করেছিলো, কাহিনীটা নাকি তার বাবার প্রকৃত চরিত্র তার সামনে এতো দেরিতে উদ্ঘাটিত হওয়ার ব্যাপারটা, সে সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কিছু জানার উপায় ছিল না। কিন্তু যে কোনো একটা হোক, কিংবা দুটাই হোক, ওই কাহিনী তাকে শেষ করে দেয়। তার নিষ্কলঙ্ক ইস্পাতের রঙের চুল যা তার মুখমণ্ডলকে মাহাত্ম্যে মণ্ডিত করে তুলতো এখন দেখাচ্ছিল ছেঁড়া খোঁড়া হলুদ ভুট্টার রেশমী গুচ্ছের মতো, তার অপরূপ চিতা বাঘিনীর চোখ দুটি তার ক্রোধের প্রচণ্ড উত্তাপ সত্ত্বেও আগের সেই উজ্জ্বল দ্যুতি ফিরে পায় নি। তার প্রতিটি ভঙ্গির মধ্যে সে যে আর বেঁচে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ফুটে উঠছিলো। অনেক আগেই সে ধূমপান করা ছেড়ে দিয়েছিলো, দরজা বন্ধ করে বাথরুমে বা অন্য কোথাও সে আর ধূমপান করতো না, এখন সে আবার ধূমপান করতে শুরু করেছে, এই প্রথম সর্বজন সমক্ষে এবং নিয়ন্ত্রণহীন গোগ্রাসে, প্রথমে নিজেই হাতে মুড়ে সিগারেট বানিয়ে নিতো, সব সময়ে তাই করতে পছন্দ করতো সে, কিন্তু এখন দোকান থেকে সাধারণ সিগারেট কেনে, কারণ, হয় তার সময় নাই কিংবা নিজের হাতে বানাবার মতো ধৈর্য নাই।
সবার মনেই হয়তো একটা প্রশ্ন জাগতে পারতো, এক খোঁড়া বুড়ো যার পৃষ্ঠদেশ জ্বালা করছে আগুনের মতো আর এক নারী যে মরণ ছাড়া আর অন্য কোনো সুখের জন্য ব্যাকুল নয়, তাদের জন্য ভবিষ্যৎ তার গর্ভে কি ধারণ করতে পারে? কিন্তু না, ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে ওরকম কোনো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সে আবার আলোকরশ্মি দেখতে পায়, কারণ তার মনে হল ফারমিনা ডাজার দুর্ভাগ্য যেন তাকে গৌরবোজ্জ্বল করেছে, তার ক্রোধবহ্নি যেন তাকে আরো সুন্দর করেছে, পৃথিবীর বিরুদ্ধে তার তীব্র ঘৃণা যেন তাকে তার বিশ বছর বয়সের পোষনামানা চরিত্র ফিরিয়ে দিয়েছে।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করবার নতুন কারণ খুঁজে পেল ফারমিনা ডাজা। ‘ন্যায় বিচার’ পত্রিকার জঘন্য কাহিনীর উত্তরে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সংবাদপত্রের নৈতিক দায়িত্ব এবং অন্য লোকের সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি আদর্শপত্র পত্রিকাটিতে প্রেরণ করে। তারা ওটা ছাপায় নি কিন্তু পত্র লেখক একটা কপি ক্যারিবীয় উপকূল অঞ্চলের সব চাইতে প্রাচীন ও চিন্তাশীল কাগজ ‘কমার্শিয়াল ডেইলি’তে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারা চিঠিটা প্রথম পাতায় প্রকাশ করে। পত্র লেখক নাম সই করে ‘জুপিটার’ বলে চিঠিটা ছিল এত যুক্তিপূর্ণ, এতো তীক্ষ্ণধী ও এতো সুলিখিত যে সবাই ধরে নেয় ওটা প্রদেশের সব চাইতে বিখ্যাত কোনো লেখকের রচনা। মাঝ দরিয়ায় সেটা ছিল একক কণ্ঠস্বর, কিন্তু তা শোনা যায় গভীর তলদেশ ও বহু দূর পর্যন্ত। ফারমিনা ডাজা বুঝেছিল কে ওই চিঠির লেখক, তাকে বলবার দরকার হয় নি, কারণ সে চিনতে পারে যে এর কিছু কিছু ধারণা, এমনকি একটা বাক্য, সরাসরি নেয়া হয়েছে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার নৈতিক অনুচিন্তনসমূহ থেকে। আর তাই তার নৈঃসঙ্গের বিশৃঙ্খলার মধ্যে সে তাকে অভ্যর্থনা করলো নবায়িত স্নেহ-মমতার সঙ্গে। এই রকম সময়ে আমেরিকা ভিসুনা এক শনিবার বিকালে ‘জানালার সরণীর’ বাড়ির শোবার ঘরে যখন একা বসে ছিল তখন আকস্মিক ভাবে তালা না দেয়া পোশাকের আলমারিটার মধ্যে সে দেখতে পায় ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দার্শনিক অনুচিন্ত নগুলির টাইপ করা কপি আর ফারমিনা ডাজার হাতে লেখা চিঠির তাড়া।
তার মাকে উৎসাহিত করা ওই দেখা-সাক্ষাতের পালা নতুন করে শুরু হওয়ায় ডাক্তার উরবিনো ডাজা খুব খুশি হয়। কিন্তু তার বোন ওফেলিয়া যখন শুনলো যে ফারমিনা ডাজা একটি লোকের সঙ্গে একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে, আর ওই লোকের নৈতিক গুণাবলী মোটেই সর্বোচ্চ স্তরের নয়, তখন সে প্রথম যে ফলবাহী জাহাজটি পেলো তাতে চড়ে নিউ অর্লিয়ান্স থেকে এখানে এসে হাজির হল। তারপর যখন সে দেখলো কী রকম ঘনিষ্ঠ জনের মতো, কতোখানি আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এ বাড়িতে প্রবেশ করছে, অনেক রাত পর্যন্ত তাদের দুজনের মৃদু গুঞ্জন এবং প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষণিক কলহের শব্দ কী ভাবে তাদের সাক্ষাৎপর্বকে ভরে রাখছে, তখন ওই প্রথম সপ্তাহেই তার আশঙ্কা সঙ্কটজনক মাত্রা পরিগ্রহণ করে। যা ডাক্তার উরবিনো ডাজা দুজন নিঃসঙ্গ বুড়ো মানুষের স্বাস্থ্যকর প্রীতির সম্পর্ক বলে বিবেচনা করে তাই ওফেলিয়ার কাছে মনে হয় গোপন উপপত্নী সুলভ একটা ভয়ঙ্কর পাপ কর্ম। ওফেলিয়া উরবিনো সব সময়ই ছিল ওই রকম, তার দাদি ডোনা ব্লাঙ্কার মতো, ডোনা ব্লাঙ্কার মেয়ে হলে যেমন হত তার চাইতেও বেশি। সে ছিল তাঁর মতোই বিশিষ্ট, তাঁর মতোই উদ্ধত, তাঁর মতোই নিজের সংস্কারের জালে বন্দি। পাঁচ বছর বয়সের সময়ও সে একটি পুরুষ আর একটি মেয়ের মধ্যে নিষ্পাপ বন্ধুত্বের কথা কল্পনা করতে পারতো না, আশি বছর বয়স্কদের ক্ষেত্রে তো দূরের কথা। ভাই-এর সঙ্গে তিক্ত তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে সে বললো, এখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাদের মায়ের বিধবার শয্যায় উঠে পড়লেই তাঁকে সান্ত্বনাদান প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। বোনের সামনে দাঁড়াবার সাহস ডাক্তার উরবিনো ডাজার হল না, সে সাহস তার কখনোই হয় নি, কিন্তু তার স্ত্রী হস্তক্ষেপ করলো, বললো যে, যে কোনো বয়সেই ভালোবাসার একটা শান্তস্নিগ্ধ যৌক্তিকতা আছে। ওফেলিয়া তার মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো, চিৎকার করে বললো, ‘আমাদের বয়সে ভালোবাসা ব্যাপারটা হাস্যকর, ওদের বয়সে ন্যক্কারজনক।’
ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার সঙ্কল্প সে এতো প্রচণ্ড উগ্রতার সঙ্গে ঘোষণা করলো যে তা ফারমিনা ডাজার কানে গিয়ে পৌঁছায়। সে ওকে তার শোবার ঘরে ডেকে পাঠালো। যখনই কাজের লোকেরা যেন শুনতে না পায় এমন কোনো কথা ফারমিনা ডাজা কাউকে বলতে চাইতো তখনই সে তাকে এই ভাবে ডেকে পাঠাতো। সে ওফেলিয়াকে তার অভিযোগগুলি আবার বলতে বললো। ওফেলিয়া কিছুই হাল্কা করলো না। সে বললো, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, যার বিকৃত যৌনাচরণের কথা সর্বজনবিদিত, এই সন্দেহজনক সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তাদের পারিবারিক সুনাম এমনভাবে ক্ষুণ্ন করছে যা লোরেঞ্জো ডাজার দুষ্কর্ম কিংবা জুভেনাল উরবিনোর সরলচিত্ত অভিযান কখনো করে নি। ফারমিনা ডাজা একটি শব্দও উচ্চারণ না করে ওর কথা শুনে গেল, তার চোখের পলক পর্যন্ত পড়লো না, কিন্তু ওর কথা শেষ হওয়া মাত্র সে একটি ভিন্ন মানুষে রূপান্তরিত হল, সে যেন আবার নতুন জীবন নিয়ে জেগে উঠলো।
ফারমিনা ডাজা বললো, ‘একটা জিনিসই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, তুমি যে ঔদ্ধত্য ও কুৎসিত মনের পরিচয় দিলে তার জন্য তোমাকে যে রকম পেটানো উচিত সে রকম শক্তি আমার নাই, কিন্তু তুমি এই মুহূর্তে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে এবং আমি আমার মায়ের কবরের শপথ নিয়ে বলছি আমি যতদিন বেঁচে থাকবো তুমি ততদিন আর এ বাড়িতে পা দেবে না।’
তাকে টলাবার মতো কোনো শক্তি কোথাও ছিল না। ওফেলিয়া তার ভাই-এর বাড়িতে চলে গেল, সেখান থেকে সে বহু বিশিষ্ট দূতের মাধ্যমে নানা রকম আবেদন- নিবেদন করলো, কিন্তু সব ব্যর্থ হল। তার ছেলের অনুরোধ কিংবা তার বন্ধুদের মধ্যস্থতা কিছুই ফারমিনা ডাজাকে তার সঙ্কল্পচ্যুত করতে পারলো না। পুত্রবধূর সঙ্গে তার সর্বদাই একটা প্রাকৃতজনোচিত সৌহার্দ্য ছিল, অবশেষে সে একদিন তার কাছে স্বীকারোক্তিমূলক এই উক্তিটি করলো, ‘একশো বছর আগে জীবন ওই বেচারা আর আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল কারণ তখন আমাদের বয়স ছিল খুব কম, আর এখন জীবন সেই একই কাজ করতে চাইছে কারণ এখন আমাদের বয়স খুব বেশি।’ সে যে সিগারেটটা খাচ্ছিল তার মাথা থেকে আরেকটা সিগারেট ধরালো, তারপর যে বিষে তার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিলো তা সক্রোধে উগরে দিয়ে বললো, ‘জাহান্নামে যাক ওরা সব! আমাদের বিধবাদের একটা সুবিধা আছে, আমাদের ওপর হুকুম চালাবার জন্য এখন আর কেউ নাই। ‘
কিছু করার ছিল না। ওফেলিয়া যখন নিশ্চিত বুঝলো যে আর কোনো বিকল্প নাই তখন সে নিউ অর্লিয়ান্স ফিরে গেল। বহু মিনতি করার পর তার মা তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে রাজি হল কিন্তু বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি দিলো না। মায়ের কবরের নামে সে শপথ নিয়েছে, আর ওই অন্ধকার দিনগুলিতে পবিত্র বলতে ওই একটা জিনিসই অবশিষ্ট ছিল।
ফারমিনা ডাজার বাসায় প্রথম দিকের দেখা-সাক্ষাতের সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার জাহাজগুলির কথা প্রসঙ্গে এক পর্যায়ে তাকে তার জাহাজে একটা আনন্দ ভ্রমণ যাত্রার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। নৌযানের পর ট্রেনে সে আর একটা দিন ভ্রমণ করলেই দেশের রাজধানী শহরে গিয়ে পৌঁছতে পারবে। তাদের প্রজন্মের বেশির ভাগ ক্যারিবীয়দের মতো সে শহরটির উল্লেখ করলো সান্টা ফে বলে, গত শতাব্দী পর্যন্ত ওই নামই ছিল তাদের রাজধানীর। কিন্তু ফারমিনা ডাজার মধ্যে তার স্বামীর সংস্কারই কাজ করে। সে ওই ঠাণ্ডা বিষণ্ন নগরী দেখতে চায় না, যেখানে মেয়েরা একমাত্র পাঁচটার উপাসনায় যোগদানের জন্য ছাড়া ঘর ছেড়ে বেরোয় না, যেখানে, সে শুনেছে, তারা আইসক্রিমের দোকান কিংবা সরকারি দপ্তরে ঢুকতে পারে না, যেখানে দিন- রাত্রির যে কোনো সময়ে শোক শোভাযাত্রার জন্য যানজট বেঁধে যায়, আর যেখানে অনাদিকাল থেকে সারাক্ষণ ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ে, পারীর চাইতেও বিরামহীন ভাবে, না, সে ওটা দেখতে চায় না। তবে নদী তাকে ভীষণ আকর্ষণ করে। নদীর বালুকাময় তীরে কুমিরগুলি শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে এটা তার খুব দেখতে ইচ্ছা করে। সে খুব চায় যে রাত দুপুরে নদীর বুকে শুশুকজাতীয় অদ্ভুত প্রাণীদের নারীর কান্নার মতো শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু তার এই বয়সে, বিশেষ করে তার মতো একজন নিঃসঙ্গ বিধবার পক্ষে, অত কষ্টসাধ্য ভ্রমণ অবাস্তব বলে মনে হয়।
পরে, যখন স্বামীর অবর্তমানেও সে তার জীবন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আবার তাকে ওই আমন্ত্রণ জানায়, আর এবার তা আগের চাইতে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হল। মেয়ের সঙ্গে ঝগড়ার পর, বাবা সম্পর্কে মেয়ের অপমানজনক উক্তিতে চরম বিরক্ত হয়ে, মৃত স্বামীর প্রতি নিজের ক্ষোভের কারণে, যে লুক্রেশিয়া ডেল রিয়েলকে সে এতো বছর ধরে তার সব চাইতে ভালো বন্ধু বলে জেনে এসেছে তার কপট শঠতাপূর্ণ আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে তার নিজের বাড়িতেই মনে হল নিষ্প্রয়োজনীয়। একদিন বিকালে সারা দুনিয়ার চায়ের পাতার মিশ্রণে তৈরি তার বিশেষ চা পান করতে করতে সে তার প্রাঙ্গণের জলে ভেজা জমির দিকে তাকালো, ওখানে তার দুর্ভাগ্যের বৃক্ষটি আর কখনো ফলে ফুলে বিকশিত হবে না। সে বলে উঠলো, ‘আমার ইচ্ছা করছে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে, তারপর আমি চলতে থাকবো, চলতে থাকবো, চলতেই থাকবো, আর কখনো এখানে ফিরে আসবো না।’
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বললো, ‘একটা জাহাজে করে বেরিয়ে পড়ো।’ ফারমিনা ডাজা চিন্তাকুল চোখে তার দিকে তাকালো, তারপর বললো, ‘ঠিক সেটাই করতে পারি আমি।’ কথাটা বলবার এক মুহূর্ত আগেও এই চিন্তা তার মাথায় আসে নি, কিন্তু একবার এর সম্ভাবনা স্বীকৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টার বাস্তবতা বিবেচনার আওতায় এসে গেল। পুত্র আর পুত্রবধূ খবরটা শুনে আনন্দিত হল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাড়াতাড়ি ফারমিনা ডাজাকে জানালো যে তার জাহাজে সে বিবেচিত হবে বিশেষ সম্মানিত অতিথি রূপে, তাকে তার নিজস্ব ক্যাবিন দেয়া হবে, একেবারে বাড়ির মতো মনে হবে তার, আর কাপ্তান নিজে তার নিরাপত্তা ও সুখ শান্তি নিশ্চিত করবেন। তাকে উৎসাহ দেবার জন্য সে তার জন্য নদীপথের কয়েকটা ম্যাপ নিয়ে এলো, তাকে দেখালো উচ্চণ্ড সূর্যাস্তের ছবির পোস্টকার্ড, ম্যাগডালেনার আদিম স্বর্গ নিয়ে লেখা বিখ্যাত পর্যটকদের কবিতা, আর ওই সব কবিতা পড়ে যেসব লোক পর্যটক হয়েছেন এবং পরে কবিতা রচনা করেছেন তাও দেখালো। মন-মেজাজ অনুকূল থাকলে ফারমিনা ডাজা সেগুলি নেড়েচেড়ে দেখতো।
সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বললো, ‘আমি খুকি নই, আমাকে স্তোকবাক্য দেবার দরকার নাই। আমি যদি যাই, তাহলে আমি ঠিক করেছি বলেই যাবো, নিসর্গ দৃশ্যের চমৎকারিত্বের জন্য না।
যখন ছেলে বললো যে তার স্ত্রী তার সঙ্গী হতে পারে তখন ফারমিনা ডাজা সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘কেউ আমার দেখাশোনা করবে তার পক্ষে আমি বেশি বড়ো হয়ে গেছি।’ সে নিজেই তার ভ্রমণের যাবতীয় খুঁটিনাটি ঠিক করলো। আট দিন সে উজানে যেতে কাটাবে, ছয় দিন ফিরতে, এই চিন্তা তাকে বিপুল স্বস্তি দিলো। নিছক দরকারি কয়েকটা জিনিস ছাড়া সে আর কিছুই সঙ্গে নিলো না : গোটা ছয় সুতির পোশাক, তার প্রসাধনের জিনিস, জাহাজে ওঠা ও জাহাজ থেকে নামার জন্য এক জোড়া জুতা, ভ্রমণ পথের জন্য তার বাড়ির চটিজোড়া, আর কিছুই না : তার সারা জীবনের স্বপ্ন ি
১৮২৪ সালের জানুয়ারিতে নৌযান চলাচলের জনক কমোডোর বার্নার্ড এলবার্স ম্যাগডালেনা নদীপথে চলাচলের জন্য প্রথম বাষ্পচালিত জাহাজটি রেজিস্ট্রি করান, তিনি জাহাজটির নাম দিয়েছিলেন “বিশ্বস্ততা।’ সেটা ছিল আদিম পুরনো চল্লিশ অশ্বশক্তির ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা জাহাজ। এর একশো বছরেরও বেশি পরে এক জুলাই মাসের সাত তারিখে বিকাল ছ’টার সময় ফারমিনা ডাজা একটা জাহাজে উঠলো, নদীপথে তার প্রথম ভ্রমণের জন্য, তাকে তুলে দিতে তার সঙ্গে আসে তার ছেলে ও ছেলের বউ। এটা ছিল স্থানীয় জাহাজ নির্মাণ কারখানায় তৈরি প্রথম জাহাজ এবং তার গৌরবদীপ্ত পূর্বসূচির স্মৃতিতে জাহাজটার নামকরণ করা হয় ‘নব-বিশ্বস্ততা।’ ফারমিনা ডাজা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলো না যে এই রকম একটা বিশেষ অর্থপূর্ণ নাম নেহাৎই আকস্মিক যোগাযোগ, ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দীর্ঘস্থায়ী রোমান্টিকতাপ্রসূত আরেকটা কল্পনা নয়।
সে যাই হোক, নদী পথে চলাচলকারী প্রাচীন এবং আধুনিক কোনো জাহাজেই কাপ্তানের এলাকার ঠিক পাশে ‘নব-বিশ্বস্ততা’র মতো এতো প্রশস্ত ও আরামদায়ক পরস্পর সম্পৃক্ত কক্ষ সমষ্টি কোথাও ছিল না : বাঁশের আসবাবপত্র সংবলিত একটা বসবার ঘর, টেবিল চেয়ারগুলি উৎসবের রঙের কাপড়ে ঢাকা, একটা দ্বৈত শোবার ঘর, চীনা শিল্পকর্মে সজ্জিত, টব ও শাওয়ার সংবলিত একটা স্নানের ঘর, একটা বড় চারদিক ঘেরা পর্যবেক্ষণ ডেক, ফার্নগাছ ঝুলছে সেখানে, জাহাজের সামনের এবং দু’পাশের নদী দেখা যায় ওই ডেক থেকে, আর এই পুরো জায়গায় ঠাণ্ডা করার একটা নীরব ব্যবস্থা কাজ করছে, যার ফলে বাইরের কোলাহলের শব্দ এখানে প্রবেশ করছে না, আর বিরাজমান থাকছে অনন্ত বসন্তের আবহাওয়া।
এই বিলাসবহুল জায়গাটির নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘প্রেসিডেন্টের কক্ষসমষ্টি’, কারণ ইতিমধ্যে প্রজাতন্ত্রের তিনজন রাষ্ট্রপতি এইখানে অবস্থান করে তাদের ভ্রমণ সম্পাদন করেছিলেন। এর কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল না, এটা সংরক্ষিত রাখা হত খুব উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষ সম্মানিত অতিথিদের জন্য। আর.সি.সি.-র সভাপতি হিসাবে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার নাম ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রকাশ্যে উপরোক্ত লক্ষ্যে এই কক্ষসমষ্টি নির্মাণের আদেশ দেয় কিন্তু তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ছিল যে শীঘ্র হোক কিংবা বিলম্বে হোক ফারমিনা ডাজার সঙ্গে তার বিয়ের আনুষ্ঠানিক ভ্রমণ যাত্রার সময় এটাই হবে তাদের সানন্দ আশ্রয়স্থল।
দিনটি যখন সত্যি সত্যি উপস্থিত হল তখন ফারমিনা ডাজা সাবলীল ভাবে ‘প্রেসিডেন্টের কক্ষসমষ্টি’-র কর্ত্রীরূপে নিজেকে সেখানে অধিষ্ঠিত করে নিল। জাহাজের কাপ্তান ডাক্তার উরবিনো ডাজা, তার স্ত্রী ও ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে শ্যাম্পেন ও স্যামন মাছ দিয়ে আপ্যায়িত করলো। তার নাম ছিল দিয়েগো সামারিতানো, পরনে ছিল সাদা লিনেনের নিখুঁত ইউনিফর্ম, জুতা থেকে টুপি পর্যন্ত সব ধবধবে সাদা, টুপিতে সোনালি সুতায় আর. সি. সি.-র চিহ্ন এম্ব্রয়ডারি করা। নদী পথের অন্যান্য কাপ্তানদের মতো তার ছিল সিবা বৃক্ষের মতো মজবুত শরীর, চরম কতৃত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর এবং তার হাবভাব ও ব্যবহার ছিল ফ্লোরেন্সের কোনো কার্ডিনালের মতো।
সাতটার সময় জাহাজ ছাড়বার প্রথম সতর্ক-ভেঁপু বাজানো হল, শব্দটা ফারমিনা ডাজার বাঁ কানে একটা তীব্র বেদনার মতো আঘাত করলো। গত রাতে সে স্বপ্নের মধ্যে নানা অশুভ সঙ্কেত দেখেছিল, যার অর্থ উদ্ধারের সাহস তার হয় নি। আজ সকালে সে তার মোটরগাড়ি নিয়ে নিকটবর্তী যাজকদের সমাধি ক্ষেত্রে যায়, সে সময়ে ওটা পরিচিত ছিল লা মাঙ্গা সমাধি ক্ষেত্র নামে, সে ওখানে তার স্বামীর ভূগর্ভস্থ শবাধারের সামনে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে একা কথা বলে যায়, মৃত স্বামীর বিরুদ্ধে তার যে সব ন্যায্য পাল্টা অভিযোগ ছিল সব স্বচ্ছন্দে বর্ণনা করে এবং ওই ভাবে তাঁর সঙ্গে সে শান্তি স্থাপন করে নেয়। তারপর সে তাঁকে তার ভ্রমণ যাত্রার সব খুঁটিনাটি জানিয়ে এখনকার মতো তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়।
সে তার এই ভ্রমণ সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে অস্বীকার করে, শুধু জানায় যে সে ঘুরতে বেরুচ্ছে, এর আগে যখনই সে ইউরোপ ভ্রমণে যাত্রা করেছে তখনো শুধু ওই টুকুই বলেছে, যাতে করে ক্লান্তিদায়ক বিদায় পর্বের পালা এড়ানো যায়। বহুবার ভ্রমণ করা সত্ত্বেও তার মনে হল এটা যেন তার প্রথম ভ্রমণ যাত্রা এবং দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার উদ্বেগ বাড়তে থাকলো। জাহাজে আরোহণ করার পর তার নিজেকে মনে হল পরিত্যক্ত ও বিষাদগ্রস্ত। সে অবাধে কাঁদবার জন্য একা থাকতে চাইলো।